আলোর গল্প
লেখক: দেবাঞ্জলি রায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আমরা ভাবি, রূপকথা মানেই বোধহয় সে অনেক অনেক বছর আগের কথা; বহু যুগের ওপারে হারিয়ে যাওয়া দেশ আর সেখানকার মানুষদের গল্প। কিন্তু সত্যি সত্যি কি সব দেশ, সব মানুষ হারিয়ে যায়? নাকি শুধুই চেহারা পালটে নেয়?
এই রূপকথাটার সময় বেশ কয়েকশো বছর আগের হতে পারে; আজকের, ঠিক এই মুহূর্তের হতে পারে; আবার কয়েক বছর পরেরও হতে পারে। রূপকথার দেশটা অবশ্য একই। চারদিকে ঘন নীলচে-সবুজ রঙের পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট উপত্যকা। তার ঠিক মাঝখান দিয়ে আধখানা চাঁদের আকার নিয়ে বয়ে গেছে পেরি নদী। পেরি নদীর দুধারে রয়েছে দুটো গ্রাম। পর্বতটার সবচেয়ে উঁচু গোম্বুজের মতো শৃঙ্গটার দিকে মুখ করে নদীর ওপর দাঁড়ালে বাঁ দিকের গ্রামটার নাম মঝুনি। সে গ্রামের লোকেরা ভারী আমুদে। পার্বত্য অঞ্চল হলে কী হবে, উপত্যকার মাটি মোটামুটি উর্বর; সেখানে যতটুকু শস্য, সবজি বা তরিতরকারি ফলে সেটুকু গ্রামের গুটিকয় মানুষের জন্য যথেষ্ট। তারা বড়ো বড়ো খরগোশ আর ভেড়া পোষে, তাদের লোম দিয়ে জামাকাপড় বানায়, আর ঘর বানায় পাহাড়ের পাথর দিয়ে। গান গায়, নাচে, ছবি আঁকে আর বুড়ো মোড়লের কাছে গল্প শোনে।
বুড়ো মোড়লের বয়স যে কত কেউ জানে না। বুড়ো হচ্ছে বলেই বোধহয় আজকাল মোড়ল কীরকম এতাল বেতাল বকে। একটু পাগলাটেও হয়ে গেছে। মঝুনি গ্রামে এক ওই মোড়ল ছাড়া কোনো বুড়ো মানুষ নেই। সক্কলে হয় টগবগে জোয়ান, নয়তো নেহাৎ কচিকাঁচা। বুড়ো মোড়ল এতদিন তাদের কত অদ্ভুত অদ্ভুত দেশের গল্প শোনাত। এখন আর শোনায় না। বাড়ির উঠোনে বসে বসে আকাশের দিকে চেয়ে কীসব ভাবে আর আপনমনে বিড়বিড় করে। কেউ কাছে গেলে রেগে উঠে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।
মঝুনি গ্রামের হাসিখুশি লোকগুলোর মন খারাপ হয়ে যায়। কিছুতেই তারা বুঝতে পারে না, বুড়ো মোড়লের হল কী! তবে তাদের মধ্যে একজন জানে, বুড়ো মোড়লের ঠিক কী হয়েছে। সে হল ছোট্ট ইপারু।
বয়স যত বাড়ে, মন নাকি তত পিছনপানে ছোটে। সেইজন্যই বোধহয় একদিন গল্প শুনতে আসা ইপারুর কাছে বুড়ো মোড়ল আকাশ পেরিয়ে আসা দেশের গল্পটা বলে ফেলেছিল। সেই গল্প শুনে অবধি ইপারু আজকাল প্রায়ই পেরি নদীর ধারে ঘুরঘুর করে কী যেন খুঁজে বেড়ায়।
বুড়ো বলেছে, এটা নাকি তাদের দেশ না। কতদিন আগে, সেটা বুড়ো মনে করতে পারে না; তারা নাকি একটা উড়ন্ত বাড়িতে চড়ে আকাশ পেরিয়ে এইখানটায় এসেছিল। ঠিক কেন যে তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল সেটাও বুড়ো জানে না। সেই বাড়িটাকে ওড়াতো বুড়োর বাবা। ইপারু আর অন্য সঙ্গীদের কীসব ওষুধ দিয়ে নাকি ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। তাই ওদের কিচ্ছু মনে নেই। শেষমেশ এই জায়গাটায় এসে নামে, জায়গাটা একদম তাদের দেশের মতো দেখতে। তারপর নদীটার একটা পাড়কে নাকি বুড়ো মোড়লের বাবা অঙ্ক দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। অঙ্ক জিনিসটা কী সেটা ইপারু জানে না। বুড়ো মোড়ল বা মঝুনি গ্রামের অন্য কেউ জানে না। সেই অঙ্কের চাদরের নীচে আছে বলেই মঝুনি গ্রাম টিকে আছে। মঝুনিতে কেউ বুড়ো হয় না, কারুর বয়স বাড়ে না। সে ব্যবস্থাও বুড়ো মোড়লের বাবার করা। কিন্তু কে জানে কেন, মোড়লের বাবা সে ব্যবস্থা মোড়লের ওপর প্রয়োগ করেননি। তাই বুড়ো মোড়ল খুব ধীরে ধীরে আরো বুড়ো হচ্ছে। একদিন নাকি সে ফুরিয়ে যাবে।
বুড়ো ফুরিয়ে যেতে চায় না। বুড়ো নাকি আলো হতে চায়!
ইপারু অবাক হওয়ার জায়গা পায়নি। আলো হবে, সে আবার কী?
বুড়ো ফিসফিসিয়ে বলে, হয় রে, আমি জানি। বাবাকে দেখেছি। এই অঙ্কের চাদরটার বাইরে বেরোলেই আমরা আলো হয়ে যাই। বাবা এই মঝুনি গ্রামের সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে একদিন পেরি নদী পেরিয়ে গেলেন। বুড়ো মোড়ল দেখেছিল ওপারে যেতে না যেতেই বাবার শরীরটা ফুঁড়ে ফুঁড়ে অনেকগুলো আলোর তির বেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে গিয়েছিল। আর বাবার মুখে নাকি ভারী সুন্দর একটা হাসি লেগে ছিল।
অঙ্কের চাদর সরায় কোথা দিয়ে? ইপারু সেটাই খুঁজে বেড়ায়।
সেদিন নিজের ঘরে গুটিসুটি মেরে বসে তারা দেখছিল ইপারু। হঠাৎ দেখে বুড়ো মোড়ল চুপিচুপি নদীর দিকে চলেছে।
ইপারু চমকে উঠল। বুড়ো কি তবে অঙ্কের চাদরের ফাঁকটা খুঁজে পেল?
নিঃশব্দে বুড়োর পিছু নিল ইপারু। বুড়ো নদীর কনকনে জলে নামল। আস্তে সুস্থে এগোল মাঝনদীতে। একবার পিছন ফিরে দেখল বোধহয়।
হঠাৎ তিরের মতো একটা আলোর রেখা বেরিয়ে এল বুড়োর শরীর থেকে। তারপর আরো একটা, আরো দুটো, তিনটে, অসংখ্য। একটা আলোর ঝরনা উঠে গেল আকাশের দিকে।
একেই আলো হয়ে যাওয়া বলে? ইপারু ভাবতে ভাবতে সরে এল নদীর ধার থেকে। কী যেন একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে তার ভিতরে। যেন টিকটিক করে কী একটা যন্ত্র চলছে তার অন্তঃস্থলে। একেই কি বয়স বাড়া বলে? বুড়ো মোড়লের মতো সেও একদিন আলো হয়ে যাবে?
২
গেমায়াকে সবাই একটু ভয় করেই চলে। গ্রামের ভিতরেও সে বড়ো একটা আসে না। তার বাস পেরি নদীর অন্য পাড়ে। অন্যদের মতো চাষবাস সে করে না। মাঝেমধ্যে গ্রামে এসে নানারকম আশ্চর্য ফলমূল বা ফুলগাছের বিনিময়ে দুধ, মাংস বা অন্যান্য শস্য নিয়ে যায়। বুড়ো মোড়ল যতদিন ছিল, ইপারু দেখেছে দু-জনকে ভারী গোপনে কীসব আলোচনা করতে। গেমায়ার কাছাকাছি থাকলে মোড়লের মুখটা কেমন অদ্ভুত এক খুশিতে মাখামাখি হয়ে থাকত। নরম মাটির ওপরকার আঁচড়ের মতো বলিরেখা ঢাকা মুখটায় হাসি লুটোপুটি খেত। ইপারু কতদিন দেখেছে! তাই হয়তো সে গেমায়াকে অন্যদের মতো অতটা এড়িয়ে চলে না।
আজও গেমায়াকে নদীর ধারে পাথরের ওপর বসে থাকতে দেখে ইপারু গুটিগুটি গিয়ে বসল তার পাশে। গেমায়া ওদের মতো ঢিলেঢালা আলগা জামাকাপড় পরে না, খালি পায়ে ঘাসের ওপর ঘোরে না। আঁটসাঁট পোশাক, পা ঢাকা, চুল টেনে বাঁধা। ইপারুর ওকে দেখলে কেমন সটান একটা গাছের মতো লাগে। কিন্তু আজ গেমায়ার খালি পা নদীর জলে ডোবানো। মাটি-মাটি রঙের চুলগুলো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। খুব খেয়াল করলে চুলের গোছার মধ্যে কয়েকটা রুপোলি সুতো চোখে পড়ে। ইপারুও তার পা-দুটো ডুবিয়ে দিল জলে। তারপর বলল, “আচ্ছা গেমায়া, আমাদের এই চাদরটা কী দিয়ে তৈরি?”
আনমনে দূরের পাহাড়টার দিকে তাকিয়েছিল। ইপারুর দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, “যদি বলি, আলো দিয়ে?”
“মজা করছ গেমায়া? আলো দিয়ে কী করে তৈরি হবে?”
“কেন? না হওয়ার কী আছে?”
“আলো দিয়ে তৈরি হলে তো চাদরটা সবাই দেখতেই পেত। আমরা তো কিছু দেখতে পাই না!”
“সব আলো মানুষ চোখে দেখতে পায়, সে কথা তোকে কে বলল ইপারু?”
ইপারু একটু থমকে গেল। বুড়ো মোড়লও মাঝে মাঝে এরকম কীসব বলত বটে। সব শব্দ মানুষের কানে যায় না, সব আলো মানুষ দেখতে পায় না। সে আবার বলল, “কিন্তু মোড়ল যে বলত, চাদরটা সংখ্যা, মন্ত্র আর অঙ্ক দিয়ে তৈরি?”
“শুধু অঙ্ক দিয়ে কি আর কিছু তৈরি করা যায় রে বোকা? হ্যাঁ, অঙ্ক দিয়ে খোঁজা যায়, পরিকল্পনা করা যায়। একটা মাথায় যদি বা অঙ্ক করা যায়, বানাতে গেলে অনেকগুলো হাত আর মাথা লাগে।”
“আমাকে শেখাবে, গেমায়া?”
“কী শিখবি? অঙ্ক?”
“সব।”
এতক্ষণের মধ্যে প্রথমবার গেমায়া সোজা চোখ ফেরালো ইপারুর দিকে। পেরি নদীর জলের মতো ঠান্ডা, ধূসর চোখ।
“শিখতে চাইলে যে যেতে হবে ইপারু।”
“কোথায় যেতে হবে গেমায়া? চাদরটার ওপারে?”
“না। তবে নদীটা পেরোতে হবে। যেতে হবে আমার ডেরায়।”
“মোড়ল যে বলত, নদীটার একটা পাড়ই ঢাকা?”
“না। নদীর ওপাড়েও আছে সেই আলোর চাদর। ওটাই তো রক্ষাকবচ। নাহলে আমি থাকতাম কী করে?”
“ওপাড়ে কী আছে গেমায়া?”
“বললাম যে, জানতে চাইলে যেতে হবে।”
“আর কি ফিরতে পারব না?”
“যখন ইচ্ছে হবে, ফিরে আসবি। কাউকে কোথাও আটকানোর অধিকার আমার নেই। তবে একটাই শর্ত। যদি শেখা শেষের আগে ফিরে আসিস, কাউকে কোনো কথা বলা চলবে না।”
“রাজি!”
“তবে আয়।”
*
ঘুমের মধ্যে কখন যেন গেমায়ার কাছে ঘেঁষে গিয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরেছিল ইপারু। অনেকখানি পথ হেঁটে আসার ক্লান্তিতে ওর চোখ খুলে রাখার ক্ষমতাই ছিল না। গেমায়াও ওকে নিবিড় করে জড়িয়ে নিয়েছিল। ঘুমের ঘোরে ইপারু টের পাচ্ছিল গেমায়ার শরীর থেকে উঠে আসছে একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ। একটা শীতল শান্তি আর নিরাপত্তা দিয়ে ওকে ঘিরে নিচ্ছিল গেমায়া। ঘুমন্ত ইপারুর মুখে ফুটে উঠছিল এক নিশ্চিন্ত আরামের অনুভূতি।
ঘুমটা পাতলা হয়ে আসতে নানারকম অচেনা আওয়াজের মিশেল ইপারুর কানে ঢুকল। তাতেই ঝটকা মেরে উঠে বসল সে। আর চোখ খুলতেই তার মুখটা একদম হাঁ হয়ে গেল।
অদ্ভুত আকৃতির একটা বিশাল ঘর। সেখানেই একটা উঁচুমতো নরম বিছানায় ইপারু এতক্ষণ শুয়েছিল। তার পাশেই গেমায়া তখনও ঘুমোচ্ছে। তাদের চারপাশে অসংখ্য চ্যাপ্টা চৌকোনা পাতের মতো জিনিসে অচেনা সব ছবি আর চিহ্নের ছড়াছড়ি। একদিকে ছোটো থেকে মাঝারি আয়তনের স্বচ্ছ বাক্সে অনেকরকম গাছ, যার একটাও ইপারু এখানকার জঙ্গলে দেখেনি।
বিছানার কাছেই দরজাটা চোখে পড়তে ইপারু চুপিচুপি বাইরে এল। এবার আরেকপ্রস্থ অবাক হওয়ার পালা। গোম্বুজাকৃতি পাহাড়চূড়াটা এত কাছে, যে মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। তিন দিক জঙ্গলে ঘেরা, মাঝখানে পরিষ্কার খানিকটা জমি। এই অংশটা মঝুনি থেকে কোনোদিক দিয়েই চোখে পড়া সম্ভব নয়। জমিটার একধারে দাঁড়িয়ে আছে বিদঘুটে চেহারার বাড়িটা। ছাদ থেকে কতগুলো ব্যাঁকাট্যারা চোঙার মতো জিনিস বেরিয়েছে। আর আছে দুটো বিশাল গোলাকার ঝকঝকে আয়নার মতো কী জিনিস। বাড়িটার ঠিক পিছনে উঠে গেছে দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়।
ইপারু বুঝতে পেরেছে এটা আসলে কী। এটা মোড়লের বাবার সেই আকাশবাড়ি।
৩
বছরের এই সময়টা ইপারুর বড়ো প্রিয়। কত বছর কেটে গেল এখানে, ইপারু আর ফিরে যায়নি। গ্রামের লোকজন অবশ্য জানে, সে গেমায়ার সঙ্গে জুটেছে। মঝুনিতে থাকার সময় ইপারু ওরই মতো ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকত। এক মোড়লের কাছেই “মা” বা “বাবা”র মতো শব্দগুলো শুনেছে ওরা। জোয়ান নারীপুরুষরা সেখানে নিজেদের ইচ্ছেমতো এক বা একাধিক সঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেয়। কিন্তু গেমায়া আর ইপারু একদম অন্যরকম এক মায়ায় বাঁধা পড়েছিল পরস্পরের সঙ্গে। গেমায়া একাধারে তার গুরু, বন্ধু, আবার কখনো এক অপার স্নেহময় ভরসার জায়গা।
বছরের এই সময়টায় ছাদে এসে বসলে গোম্বুজের মতো চূড়াটার মাথায় একটা ভারী উজ্জ্বল তারা দেখা যায়। এই তারাটা দেখতে দেখতেই ইপারুকে একদিন গল্পটা বলেছিল গেমায়া।
“অই যে তারাটা দেখছিস, আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম সূর্য। ওর সংসারেই ছিল আমাদের বাড়ি। আমাদের এসজিফাইভসির মতো একটা গ্রহ না, সূর্যের আশপাশে পাক খাচ্ছে অনেকগুলো গ্রহ, বামনগ্রহ, উপগ্রহ। এসজিফাইভসি নামটা কেমন খটমট না? তুই বরং একটা ভালো নাম দিস।
“আমাদের গ্রহটা ভারী সুন্দর ছিল জানিস? পাহাড়, বরফ, সমুদ্র, জঙ্গল। আমি অবশ্য সে সৌন্দর্য্য নিজের চোখে দেখিনি। আমি দেখেছি শুধু মানুষ। কত মানুষ ছিল তাতে আন্দাজ কর দেখি। থাক, পারবি না। দুইয়ের পর দশটা শূন্য বসালে যত হয়, তার চেয়েও বেশি মানুষ ছিল সেখানে। তাই বলে ভাবিস না, গ্রহটা অনেক বড়ো কিছু ছিল। মোটেই না। আমরা এখন যেখানে থাকি, সেই গ্রহটার চেয়ে খানিক ছোটোই হবে বরং।
“সেই গ্রহটায় মানুষকে জায়গা করে দিতে দিতে একসময় অন্যান্য সব জন্তু-জানোয়ার-গাছপালা সবাই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। বড়ো বোকা আর নিষ্ঠুর ছিল সেসব মানুষ। তারা পরস্পরের সঙ্গে লড়ত, মারত, দরকার না থাকলেও ছোটো-বড়ো জানোয়ার মেরে, গাছ কেটে একশা কাণ্ড করত। তারপর আবার সেইসব গাছ আর জানোয়ারদের জন্যই সাজিয়েগুছিয়ে জঙ্গল সংরক্ষণ করত।
“মানুষ যখন সেই গোটা গ্রহটার অধীশ্বর হয়ে বসল, ততদিনে তার সাম্রাজ্যের নীচে অগুন্তি প্রাণী, গাছ আর অন্যান্য মানুষের কঙ্কাল জমে গেছে। প্রকৃতির সমস্ত নিয়মকানুনের দাঁড়িপাল্লা বিগড়ে গেছে। বোকা মানুষ তাও পাত্তা দিল না কিছু। তাদের কয়েকজন বিপদ বুঝেছিল অনেক আগেই। কিন্তু তারা সংখ্যায় অন্যদের তুলনায় এতই কম, যে কেউ তাদের কথা শুনল না। যখন শুনল, তখন অনেকখানি দেরি হয়ে গেছে।
“ওরা যখন এই গ্রহটার সন্ধান পেয়েছিল, তখনও অবস্থা খানিক ভালো ছিল। বহুদিন ধরে নানারকম মাপজোক করে, মহাকাশযান থেকে ছবি তুলে যখন নিশ্চিত হল এখানে মানুষের উপযুক্ত বসবাসের আবহাওয়া আছে, তখন ঠিক হল এইখানে একটা উপনিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু ওদের যা বিজ্ঞান, তাতে দুই গ্রহের দূরত্ব পেরোতে সময় লাগবে প্রায় সত্তর বছর। একটা মানুষের গোটা জীবনের সমান। তাহলে?
“খুব গোপনে তৈরি করা হল একদল বিশেষ মানুষকে। তাদের বাইরেটা একদম মানুষের মতো হলেও ভিতরটা নয়। বিভিন্নরকম ওষুধপত্র আর রাসায়নিকের প্রয়োগে খুব ধীর করা হল তাদের বৃদ্ধি আর ক্ষয়ের গতি, আর শক্তিশালী করা হল তাদের মস্তিষ্ক। কিন্তু তাদের শরীর থেকে কেড়ে নেওয়া হল বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা। এরা কেবলই শ্রমিক। এদের পাঠানো হবে নতুন গ্রহে, সেখানে এরা বসতি গড়ার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজ করবে, আর যোগাযোগ রেখে চলবে পুরোনো গ্রহের বাসিন্দাদের সঙ্গে। সে কাজ ফুরোলে এদের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে।
“তোরা যাঁকে মোড়লের বাবা বলে জানিস, তিনি এই গোষ্ঠীর প্রথম মানুষ। তাঁর নাম ছিল আলফা। তারপর তৈরি হই আমি আর তোদের মোড়ল। ওরও নাম ছিল একটা। কিন্তু সবাই ওকে মোড়ল বলত। তারপর একে একে বাকি সবাই। আলফা, আমি আর মোড়ল— আমাদের শেখানো হল পৃথিবীর যাবতীয় বিজ্ঞান। আর তৈরি হল এই মহাকাশযান, যাকে মোড়ল বলত আকাশবাড়ি। তারপর একদিন আমাদের যাত্রা শুরু হল এক প্রায় অজানার উদ্দেশ্যে।
“যাত্রাপথের কিছুই আমরা জানি না। কারণ আমাদের নিষ্ক্রিয়, অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিল এক-একটা হাইবারনেশন ক্যাপসুলের মধ্যে। আকাশবাড়ির নীচের এক সুড়ঙ্গপথে সেই কেবিনটা খুঁজে পাবি।
“যাই হোক, এই গ্রহের কাছাকাছি এসে পড়ার পর মহাকাশযানের একটা অংশ আলাদা হয়ে এই গ্রহটার চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। আর বাকি অংশটা ল্যান্ড করল এখানে। কিন্তু এরপর দুটো ব্যাপার ঘটল। প্রথমত দেখা গেল, এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এমন কিছু জিনিস আছে যা পৃথিবীর জীবকোষের সংস্পর্শে আসামাত্র প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নষ্ট করে দেয়। দ্বিতীয়ত, আলফা আমাদের ছেড়ে আসা গ্রহের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন।”
এতদূর বলে একটু থেমেছিল গেমায়া। তারপর বলেছিল, “আলফা দেখেছিলেন, এ গ্রহ পৃথিবীর থেকেও সুন্দর। বিপুল এর জীবসম্পদ, এর মাটিতে এমন সব খনিজ সম্পদ আছে যা অন্তত কোটি বছরের জন্য মানুষের সমস্ত অভাব মিটিয়ে দিতে পারে। তার জন্য শুধু দরকার আমাদের কয়েকজনের মতো দীর্ঘজীবী মানুষের দল। ওদের কাছে মানুষের আয়ু বাড়াবার অনেক উপায় এমনিই রয়েছে। অপেক্ষা শুধু সেইসব প্রযুক্তিকে উন্নত করার। যে বিশাল সংখ্যক মানুষ সেখানে আছে, তাদের মস্তিষ্কের মিলিত চেষ্টায় সে কাজ করতে বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু তারপর? আরেকটা গ্রহ এই দু-পেয়ে প্রাণীটার চূড়ান্ত লোভের হাতে পড়ে তছনছ হয়ে যাবে?”
গেমায়ার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল ইপারু। গেমায়া আবার চুপ করে যেতে চোখ খুলে সে দেখল, গেমায়ার চোখে জল। তার শক্ত আঙুলগুলো খেলা করছে ইপারুর নরম চুলের গোছায়। গেমায়ার বলা পরের অংশটুকু খুবই সংক্ষিপ্ত। বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকর উপাদান এড়াতে আলফা, গেমায়া আর মোড়লের খুব একটা কষ্ট হয়নি। এই অঞ্চলটাকে ঘিরে বসানো রয়েছে কয়েকটা অ্যান্টেনা, যাদের জন্য তৈরি হয়েছে এক অদৃশ্য অথচ মহাশক্তিশালী তরঙ্গক্ষেত্র, অই উপাদান সে ক্ষেত্র ভেদ করতে পারে না। নতুন গ্রহে আসা কয়েকটা মানুষ তার আড়ালে বসিয়ে নিয়েছে তাদের ছোট্ট বাসস্থান। তাদের ক্ষয় যতই ধীর হোক, তা অনিবার্য। একদিন না একদিন, তারাও মুছে যাবে।
“কিন্তু গেমায়া, সে গ্রহ থেকে যদি আবার কেউ আসে?”
“অনেকদিন পর্যন্ত তাদের সংকেত পেয়েছিলাম আমরা। কোনো জবাব দিইনি। তারপর একদিন সংকেত আসা বন্ধ হয়ে গেল। ওরা হয়তো ধরে নিয়েছে ওদের এই অভিযান বিফলে গেছে। অথবা হয়তো…”
“অথবা কী?”
“অথবা হয়তো ওই গ্রহ থেকে মানুষের অস্তিত্বই মুছে গেছে। জানি না। কোনো বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে পারে… অনেক কিছুই হতে পারে। এতদিন যে টিকে গিয়েছিল, সেই তো আশ্চর্য!”
“আর যদি তা না হয়?”
গেমায়ার ধূসর চোখে একটা আগুন জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে সে বলল, “আসার সম্ভাবনা দেখা দিলেই জানতে পারবি। সেদিন শুধু অই অ্যান্টেনাগুলো আর আকাশবাড়ি নষ্ট করে দিতে হবে। সে ব্যবস্থা আছে। দেখিয়ে দেব।”
*
গেমায়াও সে তরঙ্গক্ষেত্র পেরিয়ে গেছে। আকাশবাড়ির খুঁটিনাটি আর গেমায়ার শেখানো সমস্ত কিছু মাথায় তুলে নিতে ইপারুর অল্পদিনই লেগেছিল। আর তারপরেই গেমায়া নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ওকে।
ঠিক মোড়লের মতোই গেমায়ার ক্লান্ত শরীর ফুঁড়ে দিয়েছিল আলোর তির। শেষ কয়েকটা দিন গেমায়া শুধু মোড়লের কথাই বলত। আলো হয়ে যাওয়ার পর কোথাও কি আবার দেখা হবে দু-জনের? আকাশের অন্য কোনো পাড়ে, অন্য কোনো তারার সংসারে, অন্য কোনো পেরি নদীতে পা ডুবিয়ে কি বসতে পারবে দু-জনে?
ইদানীং পাহাড়চূড়ার তারাটার দিক থেকে আরো কয়েকটা আলোর ফুটকি দেখতে পাচ্ছে ইপারু। দিনে দিনে বড়ো হচ্ছে সেগুলো। দেখেশুনে ইপারুও ঠিক গেমায়ার মতো বাঁকা হাসি হাসে। আর বেশিদিন নয়। এবার ওদের সব্বাইকে আলো হয়ে যেতে হবে।
Tags: গল্প, দেবাঞ্জলি রায়, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা