একটি পারুল গাছ
লেখক: দীপেন ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বাইরে শেষ বিকেলের আলোটা একটা নাম-না জানা গাছকে বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দিচ্ছিল। গাছটা তো তার পরিচিত, নামটা সে মনে করতে পারছিল না।
এই ঘরটিতে দুটি মানুষ, একটি টেবিলের দু-পাশে, এমন যেন একে অপরের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। দু-জনের হাতই মুঠিবদ্ধ। একজনের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই করছে, আর একজন ত্রিশ হয়তো পার হয়নি। ষাট-ছোঁয়া মানুষটি তরুণটির দৃষ্টি অনুসরণ করে, জিজ্ঞেস করে, “গাছটিকে কি তোর মনে আছে?” সেই স্বরে ছিল স্নেহ ও ক্লান্তি।
ত্রিশ-না-পার হওয়া মানুষটির চোখে ছিল অসহায়তা। “কী গাছ যেন এটা?”
“তোর জানার কথা না, কিন্তু ওই গাছের চারাটা তুই নিয়ে এসেছিলি?”
অস্পষ্ট একটা স্মৃতি ভেসে ওঠে ত্রিশের মনে। দুষ্প্রাপ্য কিছু। “পারুল?” মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় ষাট।
একটা ছিমছাম দোতলা বাংলো বাড়ির সামনের ঘরে এই দুটি মানুষ। এই সময়ে এই দেশে এরকম বাড়ি থাকার কথা নয়, কিন্তু আছে। ত্রিশ তলা অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির বদলে নিজস্ব বাংলো বাড়ি এই সময়ে সবার থাকে না, এটা যে আছে সেটা ওই ত্রিশ-না-পার হওয়া মানুষটির জন্য। তাকে এখন পৃথিবীর সবাই চেনে।
বাড়িটির বাইরে দুটি গাড়ি। একটি গাড়ি সাধারণ, কালো রং, সেটির বাইরে দাঁড়িয়ে স্যুট পরা দু-জন, একজন নারী ও একজন পুরুষ। আর একটি গাড়িতে একটি সরকারি মন্ত্রণালয়ের তকমা লাগানো, গাড়িটিও সাধারণ নয়, সেটির ভেতরে আছে একটি ছোটোখাটো হাসপাতাল। বিদেশ থেকে এসেছে ত্রিশ, তার স্বাস্থ্যকে ক্রমাগতই পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে।
ষাট বলে, “তুই যাবার পরে ঠিক পাঁচ বছরের মধ্যে যুদ্ধটা শুরু হল, বাইরের পৃথিবী একে গৃহযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করল, কিন্তু অন্ধকার যদি আলোকে নিভিয়ে দিতে চায় তাকে কি গৃহযুদ্ধ বলা যায়? ওদের উত্থানকে বাধা দিতে ছোটো প্রথম দিনই চলে গেল স্বেচ্ছাসেবক হয়ে, আমাদের কোনো কথাই শুনল না। ওকে আমরা আর দেখিনি। যুদ্ধের এক বছরের মাথায় আমাদের শহর পুরোপুরি অপর পক্ষের দখলে চলে গেল। ছোটোর কথা ওরা জানত, আমাদের বাড়িতে এল। মেজোকে প্রথম দিকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু আমাকে যখন ধরে নিয়ে গেল, ওকে রক্ষা করতে পারলাম না।”
ত্রিশের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, মুঠিবদ্ধ হাত আরো শক্ত হয়, গলায় কী যেন জমে, ধরা গলায় বলে, “আমার কথা কি ওরা জানত?”
ষাটের হাসি বিষণ্ণ, “জানবে না? অবশ্যই জানত, কিন্তু সারা বিশ্ব যখন তোকে নিয়ে উৎসব করছে তখন এদের কাছে তোর অভিযান ছিল এক অমার্জনীয় অপরাধ। ওরা বিশ্বাস করত না পৃথিবীরে বাইরে যাওয়া সম্ভব, দূরের তারার কথা ছেড়েই দিলাম।”
“কী বলছিস? এও কী হতে পারে?” ত্রিশ তার মুঠিবদ্ধ হাত উন্মুক্ত করে অসহায়তায়।
“কেন, তোকে কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে অভিহিত করেনি?”
মাথা নাড়ে ত্রিশ, “না, ওরা তোর সঙ্গে আমার দেখা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলছিল আমায়।”
“অর্থাৎ আমার ওপর সব দুঃসংবাদ দেবার ভার দিল।”
পঁয়ত্রিশটি বছরের ভার এক ভাইয়ের কাঁধকে নুইয়ে দেয়। যমজ ভাই ছিল তারা, ষাটের জন্ম হয়েছিল ত্রিশের এক মিনিট পরে। এদের আছে এক বোন যাকে সবাই মেজো বলে ডাকে, আর ছিল এক ভাই – সবার ছোটো। যুদ্ধ থেকে ছোটো ফেরেনি, আর মেজো ফিরেছিল ক্ষত-বিক্ষত হয়ে।
“এত দিন ধরে লড়াইটা চলবে কেউ ভাবেনি। যুদ্ধ শেষে বাবা মা এক বছরের মধ্যে চলে গেলেন,” ষাট বলে। পারুল গাছটার নীচে তিনটে ছোটো স্মৃতিসৌধ।
“এই সময় আর ফেরত পাবার নয়,” বিড়বিড় করে ত্রিশ, সে পার করেছে মাত্র পাঁচটি বছর যখন পৃথিবীতে পঁয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষ আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল, শুধুমাত্র তার শারীরিক ক্ষমতাই মহাকাশযানের দ্রুত ত্বরণকে সহ্য করার জন্য বিবেচিত হয়েছিল, তাই যে সমস্ত দেশ মহাকাশযানটি প্রস্তুত করেছিল তাদের নাগরিক না হয়েও ত্রিশ নির্বাচিত হয়েছিল। আলোর গতির কাছাকাছি ভ্রমণ করেছিল সেই মহাকাশযান।
“মা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা করছিল তুই যাবি না, কিন্তু আমি ওদের রাজি করিয়েছিলাম, কিছু জিনিস আমাদের চাইতে বড়ো।”
“অপর্ণাও চায়নি আমি যাই।”
“অপর্ণা এখনো এই শহরে থাকে, ওর একটা ব্যাবসা আছে, দুটি সন্তান— তারাও পড়াশোনা শেষে কাজে ঢুকেছে।”
“আর তোর সংসার?”
“ওরা তোকে কিছু বলেনি?”
“বললাম না, তোর সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত কিছু বলবে না বলেছে।”
“সংসার নেই, মেজোকে দেখাশোনা করতেই অনেক সময় যায়।”
“মেজো কোথায় থাকে?”
“থাকে কাছেই, একটা মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে।”
“আমাকে নিয়ে যাবি?”
“তোকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা জানি না। মাঝে কত যুগ কেটে গেছে, আর তুই বলতে গেলে পালটাসনি।”
ঘরটা অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। আরো অনেকের কথা জানার বাকি ছিল। “আর অমল মামা?”
“অমল মামা গত বছরই চলে গেলেন, হার্ট অ্যাটাক, একাই তো থাকতেন, ব্যথা উঠলে আমাদের ফোন করেছিলেন, কিন্তু আমরা যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেননি।”
ত্রিশ কথাটা বিশ্বাস করতে পারে না, বলে, “কী বলছিস? অমল মামা মারা গেছেন।” বছর দশেকের বড়ো ছিলেন অমল মামা, কিন্তু এই ভাইদের কাছে তিনি ছিলেন চিরতরুণ। হার্ট অ্যাটাকে কি কেউ এই সময়ে মারা যেতে পারে?
“কোনো এক সময়ে তুই আর আমি এক বয়েসি ছিলাম, কিন্তু এখন তুই আমার থেকে অনেক অভিজ্ঞ,” ত্রিশ বলতে থাকে, “অনেক দিন বাঁচলে যে অভিজ্ঞতা হয় তা তোর হয়েছে, আমার হয়নি। অমল মামার মৃত্যুটাও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। উনি বলেছিলেন, “তুমি না আসা পর্যন্ত আমি ঠিক বেঁচে থাকব, মহাশূন্যে কী দেখলে তা না জেনে মরব না।”
অন্ধকার গাঢ় হয়, ষাট মৃদু স্বরে বলে, “আলো জ্বালাও!” ঘরের বাতিগুলি জ্বলে ওঠে। ত্রিশ চোখ কোঁচকায়, বলে, “অন্ধকারটাই ভালো।” ষাট বলে, “আলো নেভাও!” তারপর বলে, “মৃদু আলো দাও!” মেঝের কাছে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো প্যানেলের পেছনে হালকা আলো জ্বলে ওঠে।
“এবার তোর কথা বল। কী দেখলি তোর এই পাঁচ বছরে, কী অনুভব করলি, কেমন করে সহ্য করলি একাকীত্ব? তুই তো একমাত্র প্রায় আলোর গতিতে ভ্রমণ করা মানুষ।”
উত্তর দিতে সময় নেয় ত্রিশ। তার মহাকাশযানের বাইরে কী ঘটেছে সেটাকে ব্যাখ্যা করা সহজ নয়, তারারা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল আর মহাশূন্য ভরে ছিল মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির আবছা আলোয়। যে লাল বামন তারাটির চারদিকে ঘুরে সে ফিরে এল সেটিকেও সে ভালো করে দেখতে পারেনি, আর তারাটির চারদিকের কয়েকটি গ্রহকে তো চোখে দেখাই যায়নি, কিন্তু সব কিছুই মহাকাশযানের দূরবিনে রেকর্ড হয়েছে। সেই গ্রহগুলিতে প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে তাদের পরীক্ষা সফল হয়েছে, সে জীবিত ফিরে এসেছে। আলোর গতির কাছাকাছি ভ্রমণ করেছে বলে তার সময় শ্লথ হয়ে গিয়েছিল, পৃথিবীতে পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে, তার বয়স বেড়েছে মাত্র পাঁচ বছর।
এই সব বলে ত্রিশ। বাড়িটির বাইরে রাস্তার ধারে দাঁড়ানো গাড়ির পাশে স্যুট-পরা নারী ও পুরুষটি ঘড়ি দেখে, ফেরার সময় হয়ে গেছে। ত্রিশ বলে, “আমি ঠিক পৃথিবীর মানুষ নই। আমি হলাম জীববিদ্যার গবেষণাগারের প্রাণী, এক কালে যেমন বানরদের নিয়ে গবেষণা হত। পাঁচটি বছর মহাশূন্যের অন্ধকারে বাস করেছি, মানুষ থেকে দূরে, প্রকৃতি থেকে দূরে। সেই অন্ধকার আমার সমস্ত মন মেধা কেড়ে নিয়েছে। আমি গবেষণাগারের একটি নমুনা মাত্র।
বাড়ির বাইরে পারুল গাছটার নীচে একটা বাতি জ্বলে ওঠে, গাছটা একটা আলো-আঁধারি হয়ে রহস্যময় হয়ে ওঠে।
“তাহলে এখন ফিরে আয়,” বলে ষাট, “এখানে থাকবি, তোর সামনে জীবন পড়ে আছে।”
ত্রিশের বাঁ কব্জিতে হাতঘড়িটা শব্দ করে। ত্রিশ ডান হাতটা ঘড়ির ওপর দিয়ে সরায়, বাইরে গাড়ির পাশে দাঁড়ানো স্যুট-পরা নারীটির একটি ত্রিমাত্রিক মূর্তি ঘড়িটার ওপরে ভেসে ওঠে, সে বলে, “স্যার, সময় হয়ে গেছে।”
ষাট বলে, “এখনই চলে যাবি?”
“আমি আবার মহাশূন্যে ফিরে যাচ্ছি,” বলে ত্রিশ।
“কী বলছিস তুই? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
“না রে,” উত্তর দেয় ত্রিশ, “আমি এখন সময়ে ভ্রমণ করা মানুষ, অতীত থেকে ভবিষ্যতে এসে পড়েছি, এই সময়টা আমার নয়। আমি এক ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, পৃথিবী আর আমার জন্য নয়।”
ষাট নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, “তুই আবার ফিরে যাস না, আমার সঙ্গে থাক, কী পাবি আর সেই অন্ধকারে?”
আসলেই কিছু পাবার নেই, ভাবে ত্রিশ। পাহাড়ে হাঁটতে ভালোবাসত সে। বৃষ্টি ভালোবাসত, তার মহাকাশযানে বৃষ্টি নেই। কাছের সব মানুষগুলোকে পাঁচ বছরে ধীরে ধীরে সে ভুলে গেছে— মা, বাবা, তার যমজ ভাই, ছোটো, মেজো, অমল মামা, অপর্ণা, স্কুলের সহপাঠীদের। যারা বেঁচে আছে তারা তাকে ছাড়াই বাঁচছে। ত্রিশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
দু-জন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ত্রিশ পারুল গাছটার নীচে তিনটে নামফলকের কাছে দাঁড়ায়, মা, বাবা ও ছোটো। হাত জোড় করে তাদেরকে স্মরণ করে। আঙিনা থেকে বার হবার সময় ত্রিশকে ষাট বুকে জড়িয়ে ধরে, বলে, “এরপর ফিরে এলে আমাকে আর দেখবি না।”
ত্রিশ সেটা জানে, এই পৃথিবীর ভবিষ্যতে সে বারে বারে ফিরে আসবে, পুরোনো মানুষেরা চলে যাবে, নতুনরা আসবে। হয়তো আরো যুদ্ধ হবে, দাঙ্গা, অজানা ভাইরাস আসবে, কিন্তু মহাকাশের অসীমতায় সে ভাসবে। ভাসবে আর ভাববে এ সবের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী।
রাতের আকাশের দিকে তাকায় ত্রিশ। কোথাও জ্বলজ্বল করছে স্বাতী, তার পরবর্তী গন্তব্য। সে যখন ফিরে আসবে তখন পৃথিবী আরো সত্তর বছর পুরোনো হবে। গাড়ির দিকে হাঁটে ত্রিশ, ষাট পেছনে পড়ে থাকে। পেছন থেকে শরীরের ওপর এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে সে, শ্লথ হয়ে আসে পদক্ষেপ, পারুল গাছটি তাকে টানে। পারুল গাছটি একটি মৃদু বাতিতে আলোকিত হয় থাকে, এটুকু আলোও সে পাঁচ বছরের মহাশূন্য যাত্রায় পায়নি।
Tags: গল্প, দীপেন ভট্টাচার্য, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা