অবিনাশ হালদারের বাক্স
লেখক: দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“কই রে বিপিন? আমার ছাতাখান দে। পচ্চিমটা কালো করে এয়েছে, যখন তখন ঢালতে পারে,” মুখে একখিলি জর্দা পান ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন অনির্বাণবাবু। বছর পাঁচেক হয়ে গেল এই অভ্যেসটা হয়েছে। দ্বিপ্রাহরিক ভাতঘুমের পর বিকেলে একটু হাঁটতে না বেরোলেই নয়। আর তা নাহলে সন্ধের পরেই শুরু হবে পেট ভুটভাট, গা ম্যাজম্যাজ। কালো হাতলওলা ছাতাটা এগিয়ে দিল বিপিন। “শোবার ঘরের জানলাগুলো দেখিস” বলতে বলতে ধুতির কোঁচা ধরে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন অনির্বাণবাবু। এরপরের এক ঘণ্টা একদম বাঁধাধরা রুটিন। কালীতলার মাঠটা বেড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে যাবেন হাইস্কুলের দিকে, তারপর সাউ হার্ডওয়্যার্স, মাইতিদের রাইস মিল পেরিয়ে কিছুক্ষণ বিশুদ্ধ বাতাস সেবন করবেন নদীর ধারে। ফেরার পথে পল্টুর দোকানে এক কাপ লাল চা আর টুকটাক আড্ডা। ব্যাস্। এইসব সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে প্রায় ছ-টা বেজে যাবে।
কিন্তু আজ রুটিনটা খানিক ঘেঁটে গেল। সবে মাত্র হাইস্কুল পেরিয়েছেন, অমনি কোথা থেকে যেন খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছুটে এল মেঘের দল। সূর্যাস্তের সামান্য কয়েক ছিটে লালচে-গোলাপি আবির মেখে থাকা আকাশটা দেখতে দেখতে ঢেকে গেল কুচকুচে কালো রঙে, আর সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে প্রবল বেগে শুরু হল বৃষ্টি। সে কী জলের তোড়! তার কাছে পলকা ছাতাটা নেহাতই যেন নৌকোর ভাঙা মাস্তুল, বেশ কয়েকবার এদিক ওদিক শরীর মুচড়ে শেষ পর্যন্ত মড়াৎ করে রণে ভঙ্গ দিল। অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কোনো মতে একটা টিনের চালার নীচে ঠাঁই নিলেন অনির্বাণবাবু। জলের ছাঁটে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে ধুতি পাঞ্জাবি, তার ওপর ঠান্ডা জোলো বাতাসের ধাক্কা শরীরে বেশ ভালো রকম কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। বিরক্তিতে আপন মনেই দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন। আজ বেরোনোটাই কাল হয়েছে। এখন এই সন্ধেবেলা আপাদমস্তক ভিজে জ্বর না আসে!
তবে মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যেই বৃষ্টিটা ছেড়ে গেল। বিরাট গুমগুম আওয়াজ তুলে মেঘের দল রওনা দিল নদী পেরিয়ে। ঠান্ডায় হি হি করতে করতে ভাঙা ছাতা নিয়ে বাড়িমুখো হলেন অনির্বাণবাবু। সন্ধে নেমে গেছে এর মধ্যেই, রাস্তাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোডশেডিং হয়েছে বোধহয়, একটা দোকানেও আলো নেই। বেশির ভাগ দোকানই অবশ্য বন্ধ। বাতিবিহীন ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে কানা তালগাছের মতো। ছপাত ছপাত করে কোনোমতে এগিয়ে চললেন। ঘোষপাড়ার কাছে এসে গোড়ালি ডোবা জল ঠেলে এগোতে গিয়েই ঘটল বিপত্তিটা। ঝোপের একপাশে কী যেন এক শক্ত কেঠো বস্তুতে গুঁতো খেয়ে “বাবা গো!” বলে ককিয়ে উঠলেন অনির্বাণবাবু। অন্ধকারে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। ধুতি সামলে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছিলেন, এমন সময় কালো আকাশের বুক চিরে দপদপিয়ে উঠল বিদ্যুতের নীল-রূপালী ঝলক। সেই আলোতেই দেখতে পেলেন জিনিসটাকে।
একটা বাক্স।
ঘরে ফিরে তড়িঘড়ি গা-মাথা মুছে শুকনো কাপড় পরে জুত করে বসলেন অনির্বাণবাবু। রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে গেছে বিপিন, যাওয়ার আগে আদা দেওয়া এক কাপ লাল চা দিয়ে গেছে। চায়ে সশব্দে চুমুক দিয়ে বেশ জোরে জোরে দু-হাত ঘষলেন। না, ঠিক বৃষ্টি ভেজা শরীরকে গরম করার জন্য নয়, বরং একটা টগবগে উত্তেজনা এই মুহূর্তে বুড়বুড়ি কাটতে কাটতে বয়ে যাচ্ছে তাঁর শিরার ভেতর দিয়ে। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা হয়েই গেল তাহলে! কতবার কত সিনেমা-বায়োস্কোপে দেখেছেন, গল্প-উপন্যাসে পড়েছেন, এমনকী বেশ কয়েকবার এমন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে উঠেও বসেছেন, কিন্তু তাঁর এই সাদামাটা অবসর জীবনে গুপ্তধন জিনিসটা অধরাই থেকে গেছে। তবে এবার কপাল খুলল বলে! খাটের পাশে নীচু তেপায়াটায় রাখা আছে বাক্সটা, বাল্বের হলদে মরা আলোয় আরো রহস্যময় লাগছে। ঘরে ফিরে নিজের হাতে কাপড় দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করেছেন, এখন বেশ একটা বনেদি আভিজাত্য ঠিকরে বেরোচ্ছে বাক্সটার গা দিয়ে। বনেদি নয় তো কী! অমন সুন্দর মিনেকারি করা নকশা, বাঁকানো শঙ্খের মতো খাঁজকাটা ডালা… এ কি আর হেঁজিপেঁজি বাক্সের গায়ে থাকে? কত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে কে জানে! সাবধানে কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা তুলে আলতো করে একবার কপালে ঠেকিয়ে নিলেন অনির্বাণবাবু। জয় মা! বেশি না, খানকতক মোগলাই মোহরও কি পাওয়া যাবে না এর ভেতরে? কিন্তু জিনিসটা ভারী অদ্ভুত। খোলে কীভাবে? ভালো করে উলটে পালটে দেখলেন। নাহ্, কোনো তালা-টালা, নিদেনপক্ষে একখান চাবি ঢোকানোর গর্ত অব্দি নেই। যেন একটা গোটা কাঠের টুকরোর গায়ে খোদাই করে কারুকার্য করা হয়েছে। ভালো করে কানের কাছে ধরে ঝাঁকিয়ে দেখলেন। টুংটাং বা ঝনঝন কিছু হল কি? এক ঢোকে গরম চা গলাধঃকরণ করে মুখ মুছলেন অনির্বাণবাবু। এভাবে হাতে এসেও ফসকে যাবে জিনিসখানা! এক অদ্ভুত জেদ চেপে বসল তাঁর মাথায়। জ্বলজ্বলে চোখে জরিপ করতে করতে বুকে চেপে ধরলেন বাক্সটাকে, তারপর শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দিলেন এক হ্যাঁচকা টান!
ঝননন্! ধড়াম! আহ্!
মিসাইলের মতো উড়ে গিয়ে হাতখানেক দূরে মাটির ওপর দেহত্যাগ করল পোর্সেলিনের সাদা কাপ, সেই সঙ্গে তিনটে ডিগবাজী খেয়ে খাট, টেবিল, মোড়া পেরিয়ে তার পাশটিতেই আসন গ্রহণ করল বাক্সটা। শেষের করুণ কাতরানিটা অবশ্য বেরিয়েছে অনির্বাণবাবুর গলা দিয়ে। অমন জবরদস্তির ভালোই শোধ নিয়েছে খানদানী বাক্স, একটা তীক্ষ্ণ খোঁচায় আঙুলের ডগায় ফুটে উঠেছে লাল রক্তবিন্দু। আচ্ছা ঝামেলা তো! যন্ত্রণায় নাক কুঁচকে আঙুলটা মুখে পুরতে যাবেন, এমন সময় কোথা থেকে যেন ভারী অমায়িক গলায় কেউ বলে উঠল, “নমস্কার, অবিনাশ হালদার বলছি।”
“ক-কে?” কাঁপা গলায় প্রায় হেঁচকি তুললেন অনির্বাণ বাবু। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন বন্ধ দরজাটার দিকে। এই ঝড়-জলের রাতে কেউ এল নাকি? বাক্সের মালিক? কিছু বলে ওঠার আগেই কানে এল একটা গা জ্বালানো হাসি।
“খিক খিক! ভয় পেলেন নাকি? না না, ভয় পাবেন না মশাই! তা ছাড়া বাক্সটা যখন খুলেই ফেলেছেন তখন আর আপনার নিয়তিকে ঠেকায় কে! আসুন, বরং খেলাটার নিয়মকানুনগুলো বুঝে নিন। আপনারই সুবিধা হবে। বুঝলেন কিনা!”
চোখ কপালে উঠল অনির্বাণবাবুর। এ যে বাক্সটা থেকেই আসছে! মাটিতে আছাড় খেয়ে কীভাবে যেন খুলে গেছে ডালাটা, আর তার ভেতর ঘুরতে শুরু করেছে কিছুটা ক্যাসেটের মতো দেখতে খাঁজকাটা চাকা। নিজের অজান্তেই হাতটা মুখ থেকে মাথায় চলে গেল। শেষ পর্যন্ত কিনা একখানা ভাঙা টেপরেকর্ডার জুটল কপালে!
তাঁর এই মর্মাহত অবস্থায় কিছু অবশ্য এল গেল না বাক্সের ভেতর বাজতে থাকা গলাটার। ট্রেনের হকারদের মতো একটানা ঘ্যানঘেনে গলায় সে শোনাতে লাগল, “উফ্! এ যে কী আজব জিনিস বানিয়েছি, ভাবতে পারবেন না মশাই! অসাধারণ, অবর্ণনীয়, অভাবনীয়… ” অ দিয়ে আরো যা যা কঠিন শব্দ মাথায় আসছে আপনার, সব কিছুর উদাহরণ হল এই বাক্সখানা। হুঁহ্, সাধারণ লোকে কি আর বুঝবে এর মর্ম? বলবে ওই পাগলা অবিনাশের কথা ধরতে নেই। কিন্তু আপনি বুঝবেন। আপনাকে তো বুঝতেই হবে! কারণ এবার আপনিও ঢুকে পড়েছেন খেলাটায়। কাল সাগরে নামানোর পর থেকেই তো কোলা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যন্তরটা, এই যেমন এখন পৌঁছেছে আপনার কাছে। আর একবার পৌঁছে যখন গেছে, তখন খেলতে তো আপনাকে হবেই! তাই চটপট বুঝে নিন খেলাটা, কেমন?”
ব্যাজার মুখে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন অনির্বাণবাবু। বাইরে বৃষ্টিটা থেমেছে, তবে মাঝে মাঝে ভেজা বাতাসের ঝলক ছুটে এসে বেরিয়ে যাচ্ছে গা ছুঁয়ে। কারেন্ট এসেছে কিছুক্ষণ হল, রাস্তার ওপারে দোকানগুলো আলোয় ঝলমল করছে। ঝলমলে দোকানগুলোর পেছনে লালচে আকাশের গায়ে বড়ো বড়ো অশ্বত্থ গাছ, অকেজো হয়ে যাওয়া ল্যাম্পপোস্ট কেমন আবছা সিল্যুয়েটের মতো ফুটে উঠেছে। এদিকে এই বাদলা আবহাওয়ায় বেশ ভালোই জমে উঠেছে মাধবের তেলেভাজার দোকান। উলটোদিকের ফুটপাতে দাঁড় করানো তার চার চাকার ঠেলা থেকে অনবরত কড়াইয়ের ছ্যাঁকছোঁক আর বেগুনি-আলুর চপ-ফুলুরির মনকাড়া সুবাস ভেসে আসছে। ওই তো, একটা ন-নম্বর জুতোর সাইজের ইয়াব্বড় বেগুনি মুখে পুরলেন পাশের বাড়ির চাটুজ্জে মশাই। এমন সুগন্ধেও মুখ ভেটকে গেল অনির্বাণবাবুর। রাগে ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বলে যাচ্ছে। ওদিকে ওই মিহি গলাটা সমানে জ্ঞান ঝেড়েই চলেছে, “এ যেমন তেমন খেলা নয় মশাই, এ অনেক গভীর তত্ত্ব! এই যে আপনি গতকালটা কাটালেন, ধরে নিচ্ছি আজকের দিনটাও কাটিয়ে নিলেন কোনোমতে… কিন্তু কাল? আগামীকাল আপনি কোথায় থাকবেন, কীভাবে থাকবেন, আদৌ থাকবেন কিনা তা কি জানেন? আরে এসব আমার কথা নয়। আমার বাবা খুব বলত। আর আমিও ভাবতাম, তাই তো! তারপর অনেক ভাবনা চিন্তার পর শেষমেশ বুঝতে পারলাম এই কাল বা সময় হল গিয়ে একখানা বিশাল সমুদ্দুরের মতো। আর আমার আপনার জীবন হল গিয়ে সেই এক-একটা পুঁচকে নদী, বা খালও বলতে পারেন… যা বয়ে চলেছে ওই সমুদ্দুরের দিকে। যখন আপনি পটল তুলবেন, ইয়ে মানে মারা যাবেন, ঠিক তখনই আপনার জীবন নদী গিয়ে মিশবে ওই মহাকালের সাগরে। তাই আপনার সময় সবসময়ই এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। কিন্তু ধরুন, যদি এই এগিয়ে চলাটাকে নিজের মতো একটু থামিয়ে দেওয়া যেত? মানে ধরুন, আপনি রোববার দুপুরে বসে রগরগে খাসির ঝোল ভাত খাচ্ছেন, হঠাৎ কেউ টুক করে বোতাম টিপে থামিয়ে দিল কালের ঘড়িটাকে…”
“ধুত্তোর!” দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এবার প্রায় তেড়ে গেলেন অনির্বাণবাবু। এই বকবকানির চোটে যেন কানের পোকা বেরিয়ে আসবে এবার! তখনও সমানে ঘুরে চলেছে খাঁজকাটা চাকাটা। মিহি গলা বলে চলেছে, “সেই ছোট্টবেলা থেকেই লেগে পড়েছিলুম, বুঝলেন! বই পড়ার সময় যেমন পাতা উলটে উলটে আগে পড়া প্রিয় লাইনগুলো বা একদম শেষের টানটান ক্লাইম্যাক্সটা পড়ে নেওয়া যায়, তেমনি এই সময়ের কাঁটাগুলো পছন্দমতো জায়গায় আটকে দেওয়া যাবে না কেন? ব্যাস, সারা জীবন ধরে খেটেখুটে বানিয়ে ফেললুম বাক্সখানা! বাক্স খুলুন আর পছন্দমতো থামিয়ে নিন নিজের সময়কে। আজ অব্দি পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড়ো আবিষ্কার হয়নি মশাই!”
আর সহ্য হল না অনির্বাণ বাবুর। এক ঝটকায় ভারী কাঠের ঢাকনাটা বন্ধ করতে গিয়ে…
“উফ্! বাবা রে!”
টাল সামলাতে না পেরে মেঝের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। কোনোমতে ধুতি টুতি সামলে থেবড়ে বসতেই চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল!
অমন ঝাঁকুনি খেয়েও এক চুল নড়েনি বাক্সটা! বন্ধ হয়নি ঢাকনাটাও! মনে হচ্ছে কেউ যেন গঁদের আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে মেঝের সঙ্গে। বরং পাগলাটে গলাটা যেন একটু অপরাধী ভাব ফুটিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তবে মাপজোকে একটুখানি ভুল হয়ে গেছে বুঝলেন। সময়কে থামানোর পর আবার ইচ্ছেমতো চালু করার ব্যাপারটা ঠিক বাগে আনতে পারছি না। ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়, বলুন? তো হয়েছে কী, ব্যাটা এখন তার বাপকেই খেতে চাইছে। আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, সময়ের স্রোত বেয়ে এ ব্যাটা এখন আমাকে গিলতেই ফিরে আসতে চাইছে যাতে একে জন্মই না দিতে পারি! কীরকম অকৃতজ্ঞ বলুন তো! আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন বাক্স আবার একটা জলজ্যান্ত মানুষকে রসগোল্লার মতো টপ করে গিলে ফেলবে কী করে? কাল মশাই, কাল! সবই কালের খেলা! এই যে আপনারা ভূতের গপ্পো পড়ে-টড়ে ভয় পান আর ভাবেন শয়তান মানে বুঝি ভূত, পেত্নী, শাকচুন্নি, মামদো, বেম্মদত্যি এদেরকেই বোঝায়। হা হা! ওসব কিচ্ছু না। আসলে সবচেয়ে বড়ো শয়তান কী জানেন? সময়! সময়ের চেয়ে বড়ো শয়তান এই দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি পাবেন না। আর এ হল গিয়ে সেই শয়তানের বাক্স। যেই না বাক্সটাকে ভাসিয়েছি ওই কাল সমুদ্দুরে, ওমনি ব্যাটা তো থামিয়ে দিয়েছে আমার নিজের সময়টাকে, কিন্তু মুশকিল হল আবার চালু হওয়ার বোতামটা কিছুতেই কাজ করছে না। মানে বুঝলেন না তো? আরে আমার জীবনের এই মুহূর্তটুকুনি বাক্সবন্দি হয়ে পড়ছে মশাই! সব থেমে যাচ্ছে, চারদিকের সবকিছু আটকে যাচ্ছে! দূরের জিনিসগুলো মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে … ওই তো, টেবিলের ওপর আমার প্রিয় মানিপ্ল্যান্টের টবটা ছিল… আর দেখতে পাচ্ছি না… অন্ধকার… সব অন্ধকার…”
মাথায় খুন চেপে গেল অনির্বাণবাবুর। অপয়া জিনিস একটা! সেই সন্ধেবেলায় এটা পাওয়া থেকে একের পর এক যন্ত্রণা দিয়েই চলেছে হতচ্ছাড়া। হোঁচট খেয়ে পা ফুলেছে, তারপর কীসের যেন খোঁচা লাগল আঙুলে, আর এখন তো কনকনিয়ে চাগাড় দিচ্ছে মাজা-র ব্যথাটা। আর নয়, এই মুহূর্তেই বিদায় করতে হবে আপদটাকে! দরজার কোণে দাঁড় করানো ভারী কাঠের খিলটার দিকে লেংচে লেংচে এগোলেন অনির্বাণবাবু। বন্ধ করা না গেলে কী হয়েছে, ওই খিল দিয়ে পিটিয়ে দুরমুশ করেই ছাড়বেন ব্যাটাচ্ছেলে কে! জ্ঞান দেওয়া বেরিয়ে যাবে। প্রবল বিক্রমে দু-হাতে জাপটে ধরলেন খিলটা। সমস্ত শক্তি এক করে সবে মাথার ওপর তুলেছেন… এমন সময় হঠাৎ খিলখিল করে হেসে কেমন যেন ব্যঙ্গ করে উঠল গলাটা। “আপদটা কেমন বেইমান ভাবুন! আমাকেই কিনা জব্দ করতে চায়! তবে হুঁ হুঁ বাওয়া, আমিও ওর বাপ… বুঝলেন কিনা! ওকে কীভাবে ঢিট করতে হয় সে আমার জানা আছে। এই যে সামনেই মেঝেতে পড়ে আছে অমিতের লাশটা… ভলকে ভলকে রক্ত বের হচ্ছে… একটু পরেই সব রক্ত বেরিয়ে আসবে ওর শরীর থেকে… ব্যাস, তখনি আবার ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। আপাতত একবার চালু করে নিই সময়টা, তারপর ঠিক এর ব্যারামটা সারিয়ে ফেলব।”
থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন অনির্বাণবাবু। বলছে কী লোকটা! লাশ! অমিতটাই বা কে? ওদিকে একটু দম নিয়েছে অবিনাশ হালদার। আধ মিনিট চুপ থাকার পর নেশাড়ু মাতালের মতো জড়ানো গলায় বলে উঠল, “এই রক্ত কিন্তু বেশ মজার জিনিস, বুঝলেন। আপনার শরীরের হাঁড়ির খবর থাকে এর কাছে। সব খবরাখবর নিয়ে দৌড়ে চলে এ কোণ থেকে সে কোণ। মানে পাড়ার ওই সরলা মাসির মতো আর কী! খিক খিক! এ বাড়ির কথা ও বাড়িতে, ও বাড়ির কথা সে বাড়িতে… মানুষের রক্তও ঠিক তেমন। তাই যেমন ধরুন পাড়ার সবার খবর নিতে চাইলে যেমন সরলা মাসিকে ধরতে হবে, তেমনি এই শরীরটার হালহকিকত বুঝতে চেপে ধরুন ওই ব্যাটা ব্লাড সেলসগুলোকে। আপনার সেলের ভেতর ওই যে দড়ির মতো প্যাঁচানো যে ডিএনএ দুটো আছে না, তার মধ্যেকার জেনেটিক কোডগুলো খুঁজে নিয়ে এক্কেবারে… এহে, দেখুন তো কেমন বোর করছি! এসব বিদঘুটে জিনিসপত্র সবার মাথায় ঢুকবে না। মোদ্দা কথাটা হল গিয়ে এ বাক্সের সঙ্গে আসলে আপনার রক্তের সম্পর্ক। আপনি কে, কোথায় আছেন, সেখানকার সময় কত এই সব কিছু বাক্সটা পড়ে ফেলবে আপনার রক্তকে কালচার করেই। তাই চালু করতে গেলে প্রথমে একফোঁটা রক্ত নেবে আপনার শরীর থেকে, সে তো নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন? কিন্তু ফ্যাসাদটা হল বন্ধ করতে গিয়ে। যতক্ষণ আপনার শরীরে রক্ত আছে, ততক্ষণ আপনার অস্তিত্ব বুঝে ফেলবে এই বাক্স। আর তারপরেই ব্যাস্! সময়ের কানাগলিতে আটকা পড়লেন আপনি! ধীরে ধীরে আপনার চারপাশটা লেপেপুঁছে ফেলবে এই সময় নামের শয়তান। কী বিশ্বাস হচ্ছে না? অমিতেরও হচ্ছিল না, জানেন। আরে বাবা, তুই আমার অ্যাদ্দিনের সহকারী! বাইরের লোক বিশ্বাস নাও করতে পারে, তাই বলে তুই করবি না! তবে শেষ পর্যন্ত ওকে বিশ্বাস করতেই হয়েছে, প্রাণ দিয়ে। খিক খিক!”
ধপাস করে বেতের মোড়াটার ওপর বসে পড়লেন অনির্বাণবাবু। খিলটা ছিটকে পড়েছে হাত থেকে, দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর বেয়ে। এমনিতেই পুলিশ-টুলিশে তাঁর ভীষণ ভয়, আর এ তো স্বয়ং খুনি এসে ঢুকেছে ঘরে! বুকের ভেতরটায় কে যেন পাথর ঠুসে ধরেছে, গলাটা খটখটে শুকনো। কিন্তু তক্তপোশের পাশে রাখা জলের ঘটিটার দিকে কাঁপা হাতটা বাড়াতে গিয়েও আর বাড়ানো হল না তাঁর।
“আসলে কী জানেন তো, আমার মতো বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক খুব কমই আছে।” গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল লোকটা। “সন্দেহটা আমার আগেই হয়েছিল। তাই ফাইনাল এক্সপেরিমেন্ট এর সময় বাক্স খোলার ব্যাপারটা অমিতকে দিয়েই করালাম। বোকা ছেলে! কিছু ধরতেই পারল না। আমি অবশ্য রেডিই ছিলাম। বাক্স খোলার পর যখন দেখলাম কিছুতেই সময়কে ফের চালু করা যাচ্ছে না, ওমনি প্রথমে মাথার পেছনে বড়ো স্ক্রু-ডাইভার দিয়ে মারলাম এক বাড়ি। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই বাকি কাজটা সহজ হয়ে গেল। কিচেন থেকে মাংস কাটার চপারটা এনে ভালো করে কোপালাম বডিটা। টুকরো টুকরো করতে গিয়ে অবশ্য আধ ঘণ্টা সময় চলে গেল। কী আর করা যাবে! একবার ওর শরীর থেকে সব রক্ত বেরিয়ে গেলেই কেল্লাফতে! আর ওকে ট্রেস করতে পারবে না আমার যন্ত্র, আর সময়ও আটকে না থেকে আবার গড়গড়িয়ে চলতে থাকবে সামনের দিকে। এবার বুঝলেন তো খেলাটা? মানে সোজা বাংলায় দাঁড়ালো যে এখন এই সময়ের জাঁতাকল থেকে বেরোতে চাইলে চটপট শরীর থেকে রক্তগুলো বার করে দিন। একবার আটকা পড়লে কিন্তু আর নিস্তার নেই। তখন জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। দিনও নেই, রাতও নেই। আজও নেই, কালও নেই। আরে! আপনি এখনো বসে বসে আমার বকবকানি গিলছেন নাকি? ওহো, এ তো বড়ো মুশকিল হল! যান যান, ছুরি-টুরি কিছু একটা জোগাড় করুন। বাক্সটা খুলতে গিয়ে আঙুলে একটা ছোট্ট মতো ফুটো হয়েছে না? অল্প রক্ত বেরিয়েছে তো? ব্যাস, তাহলে তো হয়েই গেল! এবার আর ভয় করবে না আপনার। একটা ছুরি নিয়ে ওটাকে ভালো করে খুঁচিয়ে কিছুটা রক্ত বের করুন। তারপর একে একে কাটতে থাকুন আপনার হাত-পা। এমনিতেই ব্যাপারটা ধরতে অনেক দেরি ফেলেছেন বুঝতেই পারছি। এই বাক্স খোলা মাত্রই মহাকাল তার ন্যাতাটা বুলিয়ে ধীরে ধীরে মুছে দিতে শুরু করেছে সবকিছু। মনে রাখবেন, সময় কিন্তু আপনাকে গিলতে আসছে। টিক্ টক্! টিক্ টক্! টিক্ টক্! “
চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসছে। ঘোলাটে চোখে ডান হাতের অনামিকাটার দিকে তাকালেন অনির্বাণবাবু। ডগায় একবিন্দু রক্ত লাল মুক্তোর মতো টলটল করছে। শরীরের ভেতরের সমস্ত নাড়িভুঁড়ি ধীরে জমাট পাকিয়ে যাচ্ছে, বুকের বাঁ দিকটায় বসে যেন ধারালো নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে একটা বাঘ। এ কী কোনো পাগলের প্রলাপ? নাকি সত্যিই… হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ পড়তেই এক চাঙড় বরফ যেন অনির্বাণবাবুর শিরদাঁড়া বেয়ে পিছলে নামতে শুরু করল!
দূরের লাল আকাশটা নেই। কে যেন স্লেটের ওপর ভেজা ন্যাকড়া বুলিয়ে মুছে ফেলেছে আবছা গাছ, অকেজো ল্যাম্পপোস্টগুলো। জবাই করা মুরগির মতো এক দলা বীভৎস আর্তনাদ ছিটকে এল অনির্বাণবাবুর গলা দিয়ে! পাগলের মতো দৌড়ে এসে খামচে ধরলেন জানালার গরাদটা। থমকে গেছে সব কিছু। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে, রকে বসতে গিয়ে, হাত মিলিয়ে হাসতে গিয়ে দম দেওয়া পুতুলের মতো আটকে গেছে লোকজন। যেন জন্মের সময় বিধাতার ঘুরিয়ে দেওয়া চাবিটায় দম শেষ! ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ের ওপর ঝুলে আছে মাধবের বেসন মাখা হাত, মুখের সামনে বেগুনি ধরে হাঁ বন্ধ করতে ভুলে গেছেন চাটুজ্জে মশাই! খাঁচায় আটকে পড়া অসহায় জানোয়ারের মতো মর্মান্তিক হাহাকার করে উঠলেন অনির্বাণবাবু। চোখ দুটো ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে, আতঙ্কের করাল ছায়া ধীরে ধীরে জুড়ে বসছে সেই দু-চোখে। আর তারই সঙ্গে সঙ্গে কোনো এক অদৃশ্য শয়তান ধীরে ধীরে দোকানপাট, রাস্তাঘাট গিলতে গিলতে যেন এগিয়ে আসছে তাঁরই দিকে! কানের কাছে মশার গুনগুনানির মতো কে যেন বলতে থাকল, “সময় নেই… আর বেশি সময় নেই…” এক ঝটকায় পিছনে ফিরলেন অনির্বাণবাবু। ওই তো! টেবিলের ওপর ফলের ঝুড়ির পাশেই পড়ে আছে ধারালো ছুরিটা! রক্ত চাই, অনেক রক্ত। এখনি চিরে ফেলতে হবে হাত-পা, এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে হবে শরীরটা… তারপর সেই রক্ত দিয়ে…
“আহহহহ!!” একটা চাপা চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে বসল অনির্বাণ। ঘামে ভিজে গেছে গা-টা, বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ। ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল। চোখ কচলে ভালো করে চারদিকে তাকাল। উফ্! কী বীভৎস স্বপ্ন! সবকিছু এতটাই জীবন্ত ছিল, মনে হচ্ছিল যেন সত্যি সত্যিই ওইসব ঘটছে! সাইড টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে কিছুক্ষণ ভোম হয়ে বসে থাকল। এই এক বাজে অভ্যেস হয়েছে বটে। মহামারীর চোটে যবে থেকে অফিস যাওয়া বন্ধ হয়েছে, তবে থেকে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু চোখ লেগেই যায়। মিনিট খানেক মাথাটা টিপে বসে থাকার পর মেঝেতে পড়ে থাকা পেপারটার দিকে চোখ পড়ল অনির্বাণের। আর ওমনি একটা চাপবাঁধা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে। প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে হেডলাইন লেখা, “বাড়ি থেকে উদ্ধার হল এক ব্যক্তির কোপানো লাশ!” দুপুরের খিচুড়ি-ডিমভাজাটায় পেট গরম হয়েছিল বোধহয়। খাওয়ার পরে খাটে হেলান দিয়ে পেপারটায় চোখ বুলোচ্ছিল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল কে জানে! এইসব হাবিজাবি খবর পড়ে ভুলভাল স্বপ্ন দেখে আরেকটু হলেই আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড় হচ্ছিল! নিজের ধুতিপরা আশির দশকের প্রৌঢ় মার্কা ছবিটা মনে পড়তেই গুড়গুড়িয়ে হাসি উঠে এল অনির্বাণের। সারা দুপুর অঝোরে ঝরার পর এখন একটু ক্ষান্ত দিয়েছে বৃষ্টিটা, বাইরে মেঘের গর্জন অবশ্য এখনো থামেনি। রাতে আবার ঢালবে নির্ঘাত। তেলেভাজার দারুণ গন্ধ আসছে কিচেন থেকে। উফ্, কিছু বলতে হয় না রম্যানি কে। ঠিক টের পেয়ে যায় তার মনের খবর। পায়ে পায়ে ড্রয়িং লাগোয়া কিচেনে এসে দাঁড়ালো। চুলটা মাথায় চুড়ো করে বেঁধে পেঁয়াজি ভাজছে রম্যানি, পাশের ওভেনে টগবগ করে ফুটছে চা। আহ্, এই ওয়েদারে মুড়ি-পেঁয়াজি আর চা…
“উঠেছো?” চেটোর উলটো দিক দিয়ে চুল সরাতে সরাতে রম্যানি বলে উঠল, “বাবু কোথায় গেল দেখো তো!”
ফ্রিজ খুলে মুখে রসগোল্লা পুরতে পুরতে অনির্বাণ বলল, “কোথায় আর যাবে! ওপরের ঘরে বসে খুটুর খুটুর করছে হয় তো। সারাদিন তো হাবিজাবি ঘেঁটেই দিন কাটে তোমার ছেলের।”
“ওরকম বোলো না। কত্ত গুণী ছেলে আমাদের! আরে আরে! সবক-টা একেবারে খেয়ে ফেলবে নাকি! কালকের জন্য ক-টা রাখো?” চোখ পাকালো রম্যানি।
“ওফ্, কালকের ব্যাপার কাল দেখা যাবে। দেখি বাবু কী করছে” আরেক পিস রসগোল্লা চিবুতে চিবুতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল অনির্বাণ। মুখে যাই বলুক, ছেলেকে নিয়ে একটা চাপা গর্ব আছে রম্যানির। তারও। হবে নাই বা কেন! এই সবে বারোয় পড়ল ছেলে, এখনই গড়গড় করে দু ক্লাস ওপরের অঙ্ক করে যায়। ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে নাকি শিখেছে সেসব! সারাক্ষণ মুখ গুঁজে বসে আছে দেশ-বিদেশের বইতে। এখন থেকেই ছেলে একদম ফোকাসড, রিসার্চ এর লাইনে যাবে। ও আর রম্যানি তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, এই বছর থেকে নামকরা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দেবে ছেলেকে। এইরকম জিনিয়াস ছেলেকে কি আর ঠিকঠাক গাইড করতে পারে ওই সরকারি স্কুল? তা ছাড়া ইংরেজিটাও তো সড়গড় করতে হবে নাকি! বলা যায় না, কবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ এসে যায়! ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তেতো হয়ে উঠল অনির্বাণের মুখ। ঠাকুমা মারা যাওয়ার আগে কী সর্বনাশটাই করে দিয়ে গেলেন ছেলেটার! কোথায় ওর আর রম্যানির নাম মিলিয়ে “আরভ” রাখবে ভেবেছিল, তা না… এরকম একটা বস্তাপচা নাম দিয়ে দিলেন! মৃত্যু শয্যায় দেওয়া নাম, মা ফেলতে দিল না কিছুতেই। কত বুলিং যে সারাজীবন সইতে হবে ছেলেটাকে! এমন ব্রাইট ছেলের নাম নাকি অবিনাশ হালদার! দুপুরের স্বপ্নটার কথা ভেবে আরো একবার হেসে ফেলল অনির্বাণ।
দোতলার প্যাসেজের প্রথমটাই আপাতত ছেলের খেলার ঘর, বাড়তি জিনিসপত্র রাখা থাকে পরেরটায়। “বাবু? চল্, নীচে চল্”, ডাকতে ডাকতে প্যাসেজ দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ ধড়াম করে কী যেন পড়ে যাওয়ার শব্দ এল দ্বিতীয় ঘরটা থেকে। চোট-টোট লাগল নাকি ছেলেটার! দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল অনির্বাণ আর দরজায় পা রাখা মাত্র দমাস করে যেন এক বিশাল হাতুড়ি মেরে তাকে মেঝের মধ্যে গেঁথে ফেলল কেউ!
আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়েছে তার বারো বছরের ছেলে বাবু, ওরফে অবিনাশ। এক অদ্ভুত খ্যাপাটে দৃষ্টি সে চোখে। আর তার সামনে পড়ে থাকা সূক্ষ্ম কারুকার্য করা খোলা বাক্সের ভেতরে ঘুরন্ত চাকা থেকে বেরিয়ে আসছে একটা সরু চিকন গলা…
“নমস্কার, অবিনাশ হালদার বলছি।”
Tags: গল্প, দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা