দ্য ফ্যান্টম অর্ব
লেখক: অবন্তী পাল
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
টেলিস্কোপের লেন্সে আরেকবার চোখ রাখল রিও। নিশ্চন্দ্র আকাশের অতলান্ত অন্ধকারে বসেছে অগণিত তারাদের সম্ভার। কিন্তু তাদের মধ্যে আজ একটা অদ্ভুত গোলক দেখা দিয়েছে। একটা অতিক্ষুদ্র কালো বস্তু, যার চারপাশে একটা ক্ষীণ আলোর বলিরেখা না থাকলে তার উপস্থিতি কোনোভাবেই টের পাওয়া যেত না। এত নিখুঁত পরিপূর্ণ অন্ধকার সেই গোলকের অভ্যন্তরটি, যে তার পরিধির ভেতরে কিচ্ছুটি দৃশ্যমান নয়। হুট করে চোখে পড়লে মনে হবে আকাশে পাতা থাকে তারাদের জাল, তবে এ সেই জালের মধ্যে একটা ছিদ্র।
ছায়াপথ অনুসরণকারী বিশেষ টেলিস্কোপটির ওপর অবিসংবাদিত ভরসা আছে রিওর। ভুলভাল কিছু দেখাবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত। নিজের গবেষণাগারের ছাদের একদম মাঝের জায়গাটায় অত্যাধুনিক টেলিস্কোপটি রিও স্থাপন করেছে মাসখানেক আগে। সেই যন্ত্রের সুবাদে শত সহস্র নক্ষত্রপুঞ্জ এসে ধরা পড়ছে তার অভিজ্ঞ চোখে। নভপদার্থবিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক আর গবেষক ডক্টর রাতুল রাহা ওরফে রিওর নেশা মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা, দূরদূরান্তের ছায়াপথের অতিথিদের নিপুণভাবে দেখা, ফিরে দেখা ইতিহাসের আলো। ইতিহাসই তো বটে, ওই দূরের তারাদের থেকে আসা আলো যে আসলে কত প্রাচীন! আজ যার অস্তিত্বই নেই, এক কালে উজ্জ্বল হয়ে থাকা সেই নশ্বর বস্তু এখনো সমহিমায় উপস্থিত মহাবিশ্বের নাগাল না পাওয়া অন্য কোনো প্রান্তে। বস্তু আর শক্তি এমনই আপাত-অলীক বাস্তব, সময় আর স্থানের নিরিখে!
কিন্তু আজ যন্ত্রটা কী যে দেখাচ্ছে? কালো গোলকের মতন বস্তুটির বায়ুমণ্ডল বলে কিছুই নেই। নাহ্, গোলকটি কোনো কৃষ্ণগহ্বর নয়, নয় কোনো মৃত তারাও। স্ক্রিনে ভেসে উঠল গোলকটির থেকে পাওয়া এক রহস্যময় বিকিরণ। এক মুহূর্তের জন্য অকারণেই এক বন্য ভাবনা রিওর মাথায় খেলে গেল— আকাশটা কি ফুটো হয়ে গেল? বিড়ম্বনায় পড়ে আবারও টেলিস্কোপটি ঠিক করতে লাগল অধ্যাপক।
২
পরবর্তী কয়েকদিন একই অভিজ্ঞতা হল রিওর। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গোলকটি নিরীক্ষণ করে অবশেষে তার প্রবীণ বন্ধু ডক্টর পাওলোকে এই ব্যাপারে অবগত করার সিদ্ধান্ত নিল। তিনি কয়েকদিন পর্যবেক্ষণের পর ইঙ্গিত দিলেন প্রায় আশি বছর আগের কিছু গোপনীয় স্তরের নথিপত্র ঘেঁটে দেখার। আলোকপাত করলেন ওই সময়ে চাপা পড়ে যাওয়া রহস্যময় এক ঘটনার, যা প্রকাশ্যে আসলে বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্য আর ত্রাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল।
রিওর জেদ চেপে গেল। বস্তুটির সম্পর্কে জানতে তাকে হবেই। অনেক পরিশ্রম করে রিও এই ঘটনা অবলম্বনে একজন নভোচারীর ডায়েরি হাতে পেল, তাতে প্রচুর জটিল গণনা আর সর্বশেষে কিছু বিশ্লেষণমূলক বক্তব্য লেখা। ওই সময়ে কোনো খবর জনসাধারণের সামনে আসেনি। তাই ডায়েরিতে যা উল্লিখিত আছে, সেটুকুই ভরসা। অতীতে হদিস পাওয়া সেই বস্তুটির পরামিতি আর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রিওর দেখা বস্তুটির বিস্তর মিল আছে। সেই আশ্চর্য জ্যোতিষ্ক নিয়ে অত বছর আগে তোলপাড় হয়েছিল বৈজ্ঞানিক মহল। “ফ্যান্টম অর্ব” নামে চিহ্নিত সেই গোলকটি কখনো ৭০০, কখনো ১০০০ বছর আবার কখনো হয়তো ৩০০০ বছর পর, একবার করে চলে আসে পৃথিবীর আবর্তনপথে। এই অর্ব যে আদৌ কোনো সৌরজগতের সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে, না কি একাধিক সৌরজগতের, না কি আমাদের ধর্তব্যের বাইরে কোনো বৃহৎ অজানা তারাকে প্রদক্ষিণ করছে, সেটা এখনো গবেষণার স্তরে।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে সেই অপরিচিত গোলকটিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একেবারে কাছাকাছি দেখা গেছে বেশ কয়েকবার। এর প্রভাব দৃশ্যত শূন্য হলেও, ডায়েরির বক্তা নভোচারীর অনুমান, এর পেছনে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপস্থিতি আছে। কী সেই শক্তি, তা জানা যায়নি। তবে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে, গবেষণার যাবতীয় কাজ অত্যন্ত গোপনীয় স্তরে চলছিল। পৃথিবীর কাছাকাছি আসলেও, একে দেখতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ এই জ্যোতিষ্কের আরেকটা বৈশিষ্ট্য আছে… রং বদলানো। বিরলতম ক্ষেত্রে এর রং হলুদ হতেও দেখা গেছে। মানে বস্তুটির ভেতরটা সম্পূর্ণ জ্বলন্ত সূর্যের মতো হলুদ। তার থেকে ধূসরে পরিণত হতে হতে সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে যায়। মনে হবে ওই বস্তুটির বাইরে দিয়ে বুঝি কোনো উজ্জ্বল সূর্য বেরিয়ে গেল। যেমনটা একটা অন্ধকার ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে মাথার ওপরের ছাদে গোলাকার ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে বাইরের সূর্যের গতিবিধি দেখলে মনে হবে, কিছুটা সেই রকম। বেশির ভাগ সময়েই অর্বটি সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়। কীসের প্রভাবে এত মহাকায় বস্তুর এরকম স্পষ্টত রং বদলানো সম্ভব, সেটাও গবেষণাযোগ্য বিষয়। কয়েক বছর পর, ওই উধাও হয়ে যাওয়া অর্ব নিয়ে গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ যথেষ্ট তথ্যের অভাবে আর কিছুটা রাজনৈতিক প্রভাবে। রিও দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবে, এই অর্ব সাক্ষাৎ রাহু!
৩
সাবমেরিন ছেড়ে, ডুবুরিবেশে নোরা ডুব দিয়েছে অতলান্ত সাগরের সব থেকে গভীরতম খোয়াইয়ে পৌঁছনোর উদ্দ্যেশে। মেরিন বায়োলজিস্ট নোরার গবেষণার বিষয় পৃথিবীর সর্বনিম্ন সাগরাঙ্কে অবস্থান করা সামুদ্রিক জীব। তার দলের অভিযানের লক্ষ্যই এই সমস্ত সামুদ্রিক জীবকে পর্যবেক্ষণ করা। এত অন্ধকার জগতে যে প্রাণীরা বেঁচে থাকে, তাদের জন্য সমুদ্রের বাইরে, গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে সেখানে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। নমুনা সংগ্রহ এক শ্রমসাধ্য ব্যাপার। জলজ জগৎটা বেশ রহস্যময়। হাজারো আইনকানুনের চক্করে এইসব সফর বারংবার করা সম্ভবপর নয়। দীর্ঘ আট মাস পরে, নোরার টিমের বৈজ্ঞানিকদের আবারও এই সুযোগ এসেছে। এবারে নিপুণ দক্ষতায় কাজটা সমাপন করা অবশ্যকর্তব্য। এবারের মিশনে নোরার সঙ্গে রয়েছে আরো দু-জন। প্রায় পঁচিশ হাজার ফিট নীচে, এতটা জলীয় চাপের মধ্যে এ বুঝি এক পৃথক পৃথিবীই। চাক্ষুষ না দেখলে, দ্বিধা হয় মানতে যে এখানে কিছু প্রাণী কত সাবলীলভাবে বসবাস করে। যে জায়গাটায় নোরা এসেছে, সেটা একটা সামুদ্রিক পাহাড়ের চূড়া। ডুব দিয়ে আরো গভীর নীচে সে পাহাড়ের খাদে নেমে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই এলাকা নোরাদের গন্তব্য নয়। তারা এই ভিন রাজ্যে এক ধরনের স্বচ্ছ মাছের হদিস পেয়ে এসেছে। বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায় সেই মাছের অভ্যন্তরীণ গড়ন। নোরা আর বিলম্ব না করে নমুনা সংগ্রহের জন্য ইশারা করল অন্য দু-জনকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটল ঘটনাটা। একটা বীভৎস কালো দানবীয় আকৃতি ঠিক ওদের মাথার ওপর দিয়ে ভেসে চলে গেল।
“কী ছিল ওটা?” ইঙ্গিত করল নোরা।
বাকি দু-জন প্রত্যুত্তরে জানাল, কেউই কিছু দেখেনি। নোরা হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। বাকি দু-জনকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে সে সন্তর্পনে কিছুটা ওপরের দিকে উঠে এলো। জলীয় জীবটি এই রকম জায়গা দিয়েই তো গেছে। অল্প কিছুটা এগোতেই আবারও চোখে পড়ল সেটা। হেডলাইটের আলোয় দেখা গেল একটা ডিম্বাকৃতি মাথার একাংশ। ব্যাস ওইটুকুই। আবারও হারিয়ে গেল অবয়বটি। কিছুক্ষণ পর জীবটির চারপাশ জুড়ে একটা অদ্ভুত সোনালি আলোর বলয় দেখা দিল। ততক্ষণে অবশ্য নোরা বেশ খানিকটা সাঁতরে গেছে অদ্ভুত জীবটার চলন-বলন খেয়াল করতে গিয়ে। বলিরেখা দেখে আঁতকে উঠে পেছোতে গিয়ে খেয়াল হল, সমুদ্রপর্বতের খাদের বেশ ভেতরে চলে এসেছে সে। এই জগৎকেই বুঝি বলে পাতাল। এত অন্ধকার, এত গভীর, এত ভিন্, এ উপরিতলের পৃথিবীর থেকে বুঝি অনেকটা দূরে, অন্য কোনো ছায়াপথে! কিন্তু যা দেখল, সেটা কী করে এখানে আসা সম্ভব? এত বড়ো পরিমাপের জীব এই জলীয় চাপের অভ্যন্তরে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়। অথচ নোরা স্পষ্ট দেখেছে, একটা বিশাল ডিম্বাকৃতি মাথা দুলতে দুলতে এগিয়ে গেছে। তার চারদিকে বিন্যস্ত আটটি পায়ের দ্রুত গতিতে সেফালোপডটি হারিয়ে গেল নিমেষে। থমকে গেল নোরা। কোথায় পাবে জীবটি? সামনে থেকে না দেখলে কিছুতেই স্বস্তি হচ্ছে না। সামান্য একটু এগিয়ে সামনের টিলাটা পেরোল সে। নীচে আরো অনন্ত অন্ধকার গহ্বর। হঠাৎ তারই একপাশ থেকে আবছা নীলচে স্ফুরজ্যোতির্ময় একটা বহিরবয়ব চোখে পড়ল। বুঝতে বাকি রইল না নোরার, যে জলের প্রাণীটি আসলে সত্যিই একটা অক্টোপাস। কিন্তু সেটা এতটা নীচের স্থানাঙ্কতে কীভাবে টিঁকে আছে, বোঝা দায়। প্রাণীটি আরো নীচে, আরো নীচে নেমে যাচ্ছে ক্রমশ আর তার সঙ্গে নিয়ে চলেছে অদম্য কৌতূহল জেগে ওঠা নোরাকে। এ কি আদৌ কোনো অক্টোপাস না কি নতুন কোনো অজানা প্রাণী, সেটা জানতেই হবে ওকে। কে বলতে পারে, সামুদ্রিক বিজ্ঞানের একটা নতুন দিক খুলে যাবে হয়তো তার এই চমকপ্রদ আবিষ্কারের মাধ্যমে!
একটু হয়তো বেশিই আবেগতাড়িত হয়ে এগিয়ে চলেছিল নোরা। শান্ত জলে তড়িৎগতিতে একটা উত্তেজনা দেখে বুঝল, প্রাণীটি তার অস্তিত্ব টের পেয়েছে। একটা বন্য গাছের বিশালাকৃতি পাতার ফাঁক দিয়ে আবারও দেখা গেল তাকে। কিন্তু এবার সেটি আর এগিয়ে না গিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল গাছটার আড়াল থেকে। সর্বনাশ! নোরা প্রমাদ গুনল। ওকে আক্রমণ করবে না কি? কিন্তু একি? যতটা দানবিক আকৃতির দেখেছিল প্রাণীটিকে, সে কি তার থেকে আরেকটু সঙ্কুচিত হয়ে গেল নিমেষে? অক্টোপাসটির সারা শরীরে ক্রমে ফুটে উঠছে অদ্ভুত বিন্দু বিন্দু সোনালি আলোকবিন্দু। একটু আগের কালো জলে মিশে থাকা অক্টোপাস এখন স্পষ্ট আকৃতি নিয়ে ধরা দিচ্ছে এই নরকীয় জলে। এত কিছুর মধ্যেও বিস্মিত হল নোরা। এ কি প্রাণীটির জিন রুপান্তরণ করার প্রতিফলন? অক্টোপাস শোনা যায় খুব বুদ্ধিমান প্রাণী যার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে নিজের বংশানুকে পালটে ফেলার। সেটা আবার ডি.এন.এ বদলে নয়, এরা বদলায় এদের আর.এন.এ। ফলত, অক্টপাস নিজে নিজেকে পালটে ফেললেও, তার আদিম সঙ্কেতে প্রথমেই কোনো অদলবদল আনে না। আর.এন.এ বদলের ফলে যদি মনঃপুত ফলাফল না পাওয়া যায়, তবে ফের এর অবস্থায় ফেরত যেতে বেগ পেতে হয় না। কারণ আসল সঙ্কেত তো ওই ডি.এন.এ-তেই সংরক্ষিত আছে, যেটা অপরিবর্তিত। অবাঞ্ছিত আর.এন.এ-টিকে নষ্ট করে দিলেই কার্যসিদ্ধি হয়ে গেল। এই জীন এডিটিংয়ের ক্ষমতা সেফালোপডদের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় অক্টোপাসে। শুধু কি তাই? এই ভিনগ্রহীপ্রায় জীবটি ভালো রকম বুদ্ধির ধারক। অল্পবিস্তর শিখেও নিতে পারে এরা। আর দেখতে যত বড়োই হোক না কেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে নিমেষে সুরুৎ করে গলে যেতে পারবে! এখন কি তবে চোখের সামনে তাই হচ্ছে? তবে এরকম ভাবার কোনো কারণ খুঁজে পেল না নোরা। কারণ সামনে কোনো গর্ত অথবা পালানোর জায়গা নেই। শুধু কালো জল। তাহলে কোথায় অন্তর্ধান হচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে অত বড়ো জলজ্যান্ত জীবটি? একটু আগেও যাকে মনে হচ্ছিল আক্রমণের উদ্দেশে বেরিয়ে আসছে, এখন সে ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে ছোটো থেকে আরো ছোটো হয়ে আসছে। তার বর্ণবলয়ের চারপাশে একটা অদ্ভুত ফিকে সোনালি গোলকের পরিসীমা দেখা যায়। কিন্তু কী ওটা? চুম্বকের মতন বুঝি আকৃষ্ট করছে জীবটিকে। সে যে ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে সেঁধিয়ে যাচ্ছে না, সেটা নোরা বুঝল অক্টোপাসটির বেরিয়ে আসতে চাওয়ার ব্যাকুলতা দেখে। বারংবার সেটি মাথা দুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু ওই অপ্রতিরোধ্য শক্তির কাছে হার মেনে যাচ্ছে। স্তম্ভিত নোরা অনুভব করল, তার আর বিলম্ব না করে ওই জায়গা থেকে সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু ভাবাই সার। এতটা ঝটিকায় সামনের পরিবর্তনটা হতে লাগল যে কিছু করে ওঠার আগেই অক্টোপাসের সমস্তটা একটা নিরেট অস্তিত্বহীন অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল। হালকা সোনালি রিংটাও আর দেখা যায় না। একটু আগেই যেখানে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল জল, সেখানে এখন শুধুই নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে অপার শান্ত কালো জল। কোথাও কিচ্ছুটি নেই।
৪
ধড়মড় করে নিজের বিছানায় উঠে বসল রিও। এইমাত্র কি তাহলে স্বপ্ন দেখছিল? গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সমস্ত শরীর ঘামে জবজব করছে। রিও ভেবে পেল না, এত বছর পরে ওর এক প্রায় ভুলতে বসা সিনিয়র কলিগের কথা কেন এভাবে স্বপ্নে ভেসে উঠল। আর ওই গভীর কালো জলে ওটা কি ছিল? না না ওই অক্টোপাস নিশ্চয়ই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেনি? মেয়েটিকে বাঁচাতেই কি তবে কোনো অদৃশ্য শক্তি ওই জীবটিকে নির্মমভাবে শুষে নিয়ে তাকে হারিয়ে দিল শূন্যতায়? গেল কোথায় ওটা? এরকম অদ্ভুত স্বপ্নে কেমন যেন একটা চোরা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল রিওর মধ্যে।
রিও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল জল খেতে। বাইরে নিশ্চুপ রাত্রি আর ঘুমন্ত পৃথিবী। এই মহাজাগতিক আকাশতলে, তারাদের সাক্ষী রেখে যে কত অজস্র বিচিত্র ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, তার খবর আমরা কি রাখি? আকাশ দেখতে দেখতে আবারও নেশা লেগে গেল রিওর। সম্মোহিতের মতন ছাদে উঠে টেলিস্কোপে চোখ রাখল সে। ওই বুঝি নক্ষত্রপুঞ্জেরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। কিন্তু হাত বাড়ালেই কি পাওয়া যায় অজানার দেশ? যদি ধরা যেত, তাহলে এই মায়াজাল বিস্তৃত ছায়াপথে, জোনাকিদের মতন তারাগুলো একে অপরের থেকে ছিটকে যেত না। তাদের শত-সহস্র আলোবর্ষ দূরের থেকে আসা বিন্দু বিন্দু আলো এত এত রহস্যের কথা বলে নিভে যেত না। কী যেন একটা আছে ওই শূন্যতায়, ইদানিং বড্ড ভাবায় রিওকে। ডক্টর পাওলো বলেন, নভপদার্থবিদ রিও মনে মনে সন্ন্যাসলাভ করছে। হেসে ওঠে সে আনমনে।
রিওর চোখ চলে যায় সেই বিতর্কিত অর্বের দিকে। গোলকের পরিধিটা বুঝি আগের দিনের থেকে যৎসামান্য হলেও বেড়েছে। আরো কাছে আসছে পৃথিবীর। আচ্ছা, বৈজ্ঞানিক মহলে এই নিয়ে কোনো হেলদোল হচ্ছে না কেন? এবারে কি সবাই ইচ্ছাকৃতভাবে চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে? আদৌ কি কেউ দেখতে পাচ্ছে গোলকটি? যেমনভাবে ধরা দিচ্ছে রিওর চোখে? একটা অদৃশ্য-প্রায় ফিকে সোনালি রিং ঘিরে রয়েছে ওই নিরেট কালো অন্ধকারকে। হঠাৎ ছ্যাঁত করে ওঠে বুকটা। ওই গোলোকটিকেই কি রিও একটু আগে স্বপ্নে দেখল, যেটা টেনে নিয়েছিল অক্টোপাসটিকে? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? বহুদূরে থাকা ওই বিতর্কিত বস্তু হাজার হোক আকাশে আছে। জলে তার উপস্থিতি অসম্ভব। অবশ্য নিশ্চিত তাই কি? মহাসাগরের গভীর নীচে আরেক স্তর রহস্য লুকিয়ে আছে, যার বেশিটাই এখনো মানুষের নাগালের বাইরে। হালকা একটা সুর ভেসে আসছে কি অন্য কোনো সুরলোকের জগৎ থেকে? ওই অর্বের থেকে?
৫
আজ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি হয়ে গেছে। অরণ্যভূমির সর্বত্র বৃষ্টিস্নাত। জায়গায় জায়গায় জল কাদা জমে রয়েছে। ইতিউতি ঝরে পড়ছে কিছু আলগা উড়ো পাতা। ধূসর দিগন্তে আবছা সূর্য ডুবন্তপ্রায়। একটা ঝিঁঝিঁ অনবরত ডেকে চলেছে— চিরিপ্, চীপ্, চী, চী, চিরিপ্…
স্যাঁতসেঁতে বন্য বাতাসে আদিম সৃষ্টির গন্ধ।
একটা ভ্রমর তার আর্দ্র চটচটে পাখনা সামলে কোনোরকমে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগিয়ে চলেছে। ওই সামনের ঘাসের ঝোপে পৌঁছতে পারলে নিশ্চিন্ত। এই তার চেনা পৃথিবীর পরিসর। কিন্তু পৌঁছনো আর হল কই? ছপ করে বিশাল এক ফোঁটা জল ওক গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়ল তার ওপর। বিধ্বস্ত ভ্রমর ভাবল এই জলেই তার সমাপ্তি। মুহূর্তমধ্যে একটা তীব্র আলো শূন্য থেকে এসে স্পর্শ করল ভিজে মাটি। উত্তপ্ত সেই শিখার প্রভাবে ঝলসে গেল ভ্রমর। শুকিয়ে গেল বেশ কতগুলো জলা জায়গা।
ঘুমন্ত পৃথিবীর গভীর নীচে, শতাব্দী ব্যাপী নিদ্রা ছেড়ে জেগে উঠল টার্ডিগ্রেডটি। আজ তার পুনর্জন্মলাভের দিন! শতবর্ষ আগে, এই অরণ্য ক্ষত-বিক্ষত ছিল পঙ্কোদগারী গিরির প্রভাবে। শরীরের সমস্ত জল ত্যাগ করে, বিপাক ক্রিয়া থামিয়ে ক্রিপ্টোবায়োসিসে আত্মসমর্পণ করেছিল সে। সঙ্গে ছিল তার বসতির আরো লক্ষ কোটি সহ টার্ডিগ্রেড। এখন পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। সেই অস্থির মাটি ক্রমে শীতল হল পরিবেশ বদলের সঙ্গে সঙ্গে। সেই মাটিতেই আজ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গহীন সবুজ মহীরুহের দল। অবশ্য জাগরণের পর, সে জানল না যে সে একাই জেগে উঠেছে। আর সকলে তখনও অনুকূল অবস্থা না পাওয়ায় নিদ্রারত। দীর্ঘ সময় ধরে টার্ডিগ্রডটি অধোলোক ভেদ করে উন্মুক্ত সূর্যতলে এসে পৌঁছল। ওই তো, ওই দূরে তার জন্য অপেক্ষা করছে খাদ্য। বৃহৎ একটা ফুল। স্বর্গীয় রসাস্বাদনের আশায় সে এগিয়ে চলল সব থেকে কাছের ওই সুগন্ধী আরকের আধারের দিকে।
অনতিদূরে, নেমাটোডটি তার শিকারের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কিন্তু টার্ডিগ্রেডটি যেদিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেদিকে যাওয়ার খুব একটা ভরসা পেল না সে। কিছুক্ষণ আগেই একটা আলোর গোলক অরণ্যের মাটিতে আছড়ে পড়েছে সবেগে। সেটা মিলিয়ে গেলেও, রয়ে গেছে একটা গল্ফ বলের আকারের আলো। আলোটা অদ্ভুত। গ্রহণের সূর্যের মতন তার আকার। বুঝি এক ফোঁটা শিশিরবিন্দু। একটা সরু আলোর রিং ঘিরে রয়েছে অদ্ভুত একটা অন্ধকারকে। অবোধ টার্ডিগ্রেডটি সেই দিকেই এগিয়ে চলেছে। কি যে ভ্রম হয়েছে তার কে জানে?
বহুক্ষণ পরে যখন অবশেষে আলোকের বৃত্তের মধ্যে পৌঁছল সে, তখন নেমাটোডটি খেয়াল করল, আলোর ব্যাসার্ধটি ধীরে ধীরে কমছে। যতই আকৃষ্ট করছে টার্ডিগ্রেডটিকে তার নিজের কাছে, ততই সঙ্কুচিত হচ্ছে তার পরিধি। সমান পরিমাপে টার্ডিগ্রেডও ছোটো হচ্ছে। শেষে কমে একটা ক্ষুদ্র আলোকবিন্দুতে পরিণত হল গোলকটি। ততক্ষণে টার্ডিগ্রেডটি চোখের অন্তরালে চলে গেছে, এতই ছোটো হয়ে গেছে সে। এরপর সবার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে নিভে হারিয়ে হয়ে গেল আলোর গোলকটি। শুধু নেমাটোডটি সাক্ষী রইল এই অজাগতিক ঘটনার।
টার্ডিগ্রেডটি মহাদ্বন্দ্বে পড়েছে। ফুলটা এভাবে সজোরে তাকে শুষে নেবে কে জানত? তার অভিপ্রায় ছিল তার নলাকার মুখ দিয়ে ফুলের সমস্ত রস নিষ্কর্ষ করা। কিন্তু একটা অচেনা অন্ধকার হাঁ তাকে গিলে নিল সজোরে, যেটা ক্রমে বৃহত্তর হতে লাগল। সুড়ঙ্গপথের মতন একটা গমনপথের ভেতর দিয়ে তীব্র গতিতে উড়ে চলল সে। বন্দুকের নল থেকে ছিটকে বেরোলে মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তার থেকেও তীব্র গতিবেগে এগিয়েও, কী করে সে বেঁচে রইল? ক্রিপ্টোবায়োটিক অবস্থাতেও ফিরতে পারছে না এই চলনপথে। অনেকক্ষন পর, হুঁশ করেই সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গ তাকে টেনে এনে ফেলল এক নরম আলোর বাগানে। বিশাল সেই বাগান। সেই ফুলের উদ্ভব কি তবে এই বাগান থেকে? শয়ে শয়ে এমনই অজস্র ফুল ছড়িয়ে আছে বাগান জুড়ে। তবে আর কোনো ফুলের দিকে এগোনোর সাহস অবশিষ্ট রইল না তার।
৬
রুশী আজ খুব খুশি, বাবা মায়ের সঙ্গে দাদাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে দেরাদুনে। রুশীর দাদাই, মিস্টার শঙ্খদীপ সেন, শিক্ষক মানুষ ছিলেন। পেল্লায় বড়ো বাড়িতে বড়ো বড়ো বারান্দা, মস্ত বড়ো উঠোন, বিশাল লাইব্রেরিতে রাশি রাশি বইয়ের সম্ভার। একাশি বছরের দাদাইয়ের এখনো ফুলের বাগান আর বই পড়ার শখ অটুট। বাগানবাড়িতে অফুরন্ত সময় ধরে খেলে বেড়ালেও ছুটির দিনগুলোতে মা কিচ্ছুটি বলে না, এতেই নয় বছরের রুশী আনন্দে আত্মহারা। শুধু বাগানবাড়ির সীমানার বাইরে যাওয়া নিষেধ।
সারাদিন খেলে ক্লান্ত হয়ে সেদিন রুশী সময়ের আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমটা ভেঙে গেল একটা অদ্ভুত কীট-কীট আওয়াজে। অনেক রাত তখন। চোখ কচলে উঠে বসল রুশী। শব্দটা কেমন কর্কশ, কানে লাগছে। যেমন বোর্ডে চক ঘষলে অথবা থালায় আঁচড় কাটলে অনেকের অস্বস্তিকর এক অনুভূতি আসে, ঠিক সেইরকম। আওয়াজটা কোনো নিশাচরের নয়। কেমন যেন যান্ত্রিক, শক্ত পাথরের ওপর ধাতব কিছুর ক্রমাগত ঘর্ষণের মতো। শব্দটা আসছে সামনের বাগান থেকে। দোতলার খোলা জানলা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে কখনো খুব আস্তে, কখনো খুব জোরালো হয়ে ভেসে আসছে আওয়াজটা।
রুশী দেখল পাশে বাবা মা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কেউ এই আওয়াজে এতটুকু বিচলিত নয়। একবার কি ডাকবে কাউকে? জানলার কাছে এসে দাঁড়াতে হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল ওর। ওই দূরে, যেখানে বাগান শেষ হয়ে আলুথালু জঙ্গলের সীমানা শুরু হয়েছে, ঠিক সেইখানে একটা কিছু চকচক করে উঠল। একইভাবে যে উজ্জ্বল, সেটা নয়। দ্যুতি কমছে, বাড়ছে, হাতছানি দিয়ে বুঝি ডাকছে রুশীকে। কী ওটা?
বারান্দায় খুট করে একটা আওয়াজ হতে রুশী দেখল দাদাই সেখানে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে নির্নিমেঘ তারাখচিত আকাশ দেখে চলেছে। এবার একটু সাহস এলো ওর মনে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ডাকল দাদাইকে। ওমন শূন্যদৃষ্টিতে কী দেখছে দাদাই?
“ও দাদাই? কী হল? এত রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“আরে!” চমক ভাঙ্গার মতন তাকালো মানুষটা। “তুমি এত রাতে এখানে কী করছ দিদিভাই? ঘুম ভেঙে গেল বুঝি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি বলো কী দেখছিলে একটু আগে?” দাদাইও নিশ্চয়ই ওই জ্বলজ্বলে জিনিসটা দেখেই এখানে এসেছে, মনে মনে ভাবল রুশী।
“একটা গল্প বলি দিদিভাই। শুনবে?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই!” লাফিয়ে উঠল রুশী। গল্প শোনার জন্য স্থান কাল লাগে নাকি?
“তবে বলি শোনো। আমাদের পৃথিবীতে যখন তুষারযুগ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এই গল্প সেই সময়ের। হিমালয়ের দক্ষিণে থাকার কারণে, এখন যে ভারতবর্ষ দেখছ, তার অনেকটাই অক্ষত ছিল। ওই সময়, প্রায় বারো হাজার বছর আগে, বেশ কিছু জায়গায় কিছু গাছের বীজ রাখা করা হয়েছিল মাটিতে। খেয়াল করো, রাখা হয়েছে বললাম, বপন করা হয়েছে বলিনি কিন্তু। এই বীজগুলো সম্ভবত এমন কিছু গাছের, যেগুলো কয়েকশত বছর বাঁচতে পারে। কে অথবা কারা এই বীজ পুঁতেছিল কেউ জানে না, সেগুলো মাটির অনেক গভীরে ছিল। শোনা যায়, সেগুলো এখনো ঘুমোচ্ছে, তাদের ভেতরের ডি.এন.এ সংরক্ষিত রেখে। অপেক্ষা করছে কোনো অজানা মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য, যখন কেউ এসে তাদের নিয়ে যাবে, যথার্থ মাটিতে যত্নে বেড়ে উঠতে দেবে” এতটা বলে বয়স্ক মিস্টার সেন ফের আকাশের দিকে তাকালেন।
“এটা কেমন গল্প?” রুশী বুঝি মনক্ষুন্ন হল। “এই গল্পে গল্প কই? কিছুই তো হল না?”
হো হো করে হেসে উঠলেন প্রবীণ মানুষটি।
“কে বলেছে গল্প শেষ? গল্প তো সবে শুরু। যুগ যুগ ধরে এই আজব খণ্ডটুকুই শুনে আসছে এখানকার মানুষজন। তারপরের খণ্ড এখনো রচিত হয়নি যে। জানো দিদিভাই, এখানে লোকমুখে চলে যে ওই বীজগুলো আমাদের পৃথিবীর নয়। অন্য কোনো জায়গা থেকে এসেছে। পৃথিবীর জীবন সংজ্ঞার তথ্য শুষে নেওয়ার জন্য এই বীজগুলো বহু বছর ধরে সুপ্ত অবস্থায় থেকেও নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। এমন একদিন আসবে, যখন তারা ওই দূর নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে এসে এদের নিয়ে যাবে। আমি মাঝে মধ্যে অবারিত আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই আগন্তুকদের হদিস পাওয়ার চেষ্টা করি!”
“তুমি এসব বিশ্বাস করো দাদাই? পৃথিবীর বাইরে তো প্রাণ নেই!”
“পৃথিবীর বাইরে পৃথিবী নেই কি? কি জানি! কতটুকুই বা জানি? আমরা তো এই পৃথিবী নামক মহানাট্যমঞ্চের পূত্তলিকা মাত্র। একদিন হয়তো দেখব, সবই ভ্রম, সবই ধোঁয়া, সবই মিথ্যে! হতেও পারে, একদিন তারা এসে ফেরত চাইবে তাদের রেখে যাওয়া মূলধন” অন্ধকার আকাশের দিকে ফের মনোনিবেশ করল মানুষটা।
“কী?” রুশী এসব কথার কোনো মাথামুণ্ডু বুঝল না, বোঝার আগ্রহও পেল না। দাদাই মাঝেমধ্যে এমন আজগুবি বকে! রুশীর আবার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
পরেরদিন সকালে উঠে যখন রুশী ফের বাগানে গেল, তখন আগের রাত্রের কথোপকথনের কথা সে বেমালুম ভুলে গেছে। আর বাগানে পৌঁছেই কি মজা হল! দুটো আস্ত কাঠবিড়ালী কোত্থেকে একটা ক্ষতবিক্ষত বাদাম নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে ব্যস্ত। তেড়ে যেতেই দুটিতে বাদাম ভুলে দৌড় লাগাল। ফেলে গেল বাদামটা। রুশী মিচকি হেসে বাদামটা তুলে ফেলতে গিয়েও থেমে গেল। কি অদ্ভুত আকৃতি বাদামটার! যেমন বড়ো, তেমন শক্ত আর তেমনই অদ্ভুত এক গন্ধ আসছে সেটা থেকে। প্রাচীনকালের গন্ধ!
আবার ওই কীট-কীট আওয়াজটা শুরু হয়েছে। রুশী মাথা তুলে তাকাল। বাগানের ত্রিসীমানায় এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে। এদিকটায় কেউ নেই। কিন্তু ওই সামনের ঝোপে, জ্বলজ্বল করছে একটা ধাতব বল। বুঝি খাঁটি সোনার তৈরি। একবার কি টুক করে দেখে আসবে? পেছনে ফিরে কাউকে না দেখতে পেয়ে, বাদামটা জামার পকেটে ভরে, রুশী সন্তর্পনে গেটের দরজা খুলে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ঝোপটার দিকে। বলটা আটকে আছে ঝোপের ভেতরে। হাত বাড়িয়ে নিতে গেল সেটা। আরেকটু, আরেকটু ভেতরে ঢুকলেই পেয়ে যাবে… ওই তো, ওই তো আরেকটু…
রুশীর মনে হল, অনেকক্ষণ ধরে তো এগোচ্ছে ওইটুকু ঝোপের মধ্যে, তবু বলটা কেন যে নাগালের বাইরে? নিষ্প্রাণ একটা খেলনাও মস্করা করছে ওর সঙ্গে? বেরিয়ে আসাই ঠিক হবে। পরক্ষণেই একটা হ্যাঁচকা টানে মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়ে রুশী আতঙ্কিত হয়ে দেখল, বলটা আর বল নেই, একটা বিরাট শূন্য গহ্বর মুখ হাঁ করে গ্রাস করতে এসেছে তাকে!
৭
ফের নিজের বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসল রিও। আবারও একটা অদ্ভুত স্বপ্ন। কিন্তু কি জীবন্ত! আর এইবার একটা ছোট্ট অচেনা মেয়েকে ঘিরে। ওই অর্বটা এবার মেয়েটাকে নিতে এসেছিল। ধুকপুক ধুকপুক বুক নিয়ে রিও বাড়ির ছাদে উঠতে লাগল।
টেলিস্কোপটা সম্যক অবস্থায় এনে নিকষ অন্ধকার আকাশটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে। আজকাল স্বপ্নগুলো আরো অদ্ভুত, আরো কাছের, আরো জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে ওই নক্ষত্র জগতে মিশে থাকা অন্ধকার অর্বটি। রিও বেশ বুঝতে পারছে কি কারণে গোলকটি বৈজ্ঞানিক মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। এই কয়েক রাত্রেই ওর নিজের যে মানসিক অবস্থা হল, সেটা থেকে বেরোতে বেশ বেগ পেতে হবে। আজ গোলকটি আগের তুলনায় অনেকটা বড়ো। না কি অনেকটা কাছে এসে গেছে? একনাগাড়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই কালো অন্ধকার নেমে আসে রিওর চোখে। শেষ মুহূর্তে একটা তীব্র নীলচে-বেগুনি আলো খেলে যায় তার চোখের মণিতে।
৮
চারদিকে ঘন অন্ধকার। চোখ মেলে তাকিয়ে কিছুক্ষণ অনেক চেষ্টা করেও কিছুই দেখতে পেল না রিও। কিছু না দেখতে পেলেও গমগমে আওয়াজে সজাগ হয়ে গেছে সে। আওয়াজটা আসছে কথোপকথনের, একেবারে সামনে থেকে, কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না। কান পেতে রেখে চোখ বন্ধ করে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় আপাতত নেই।
“আমরা কি সব নমুনা পেয়ে গেছি অ্যান্ড্রু?”
“হ্যাঁ পল্, সব রেডি। এবারের নমুনা সংগ্রহের জন্য বিশেষ বেগ পেতে হয়নি, যথেষ্ট সহজলভ্য ছিল”
“তাহলে আমাদের স্পেসিমেন বানাতে কত সময় লাগবে বলে আশা করা যায়?”
“সময় তো লাগবে। একটা নতুন সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে বৈকি। বিশেষ করে যেখানে তুখোড় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া মানুষ জড়িত”
“তা মানছি। এতদিন এতটা উন্নতমানের পরীক্ষাও অবশ্য আমরা করে দেখিনি”
“কিন্তু পল্, এদের কোন পরিবেশে ফের বপিত করা হবে? সেটা কি প্রস্তুত? তুমি এখনো এই ব্যাপারে আমাকে কিছুই বললে না”
“স্পেসিমেন যখন উন্নত করা হচ্ছে, তখন তার আধারও হবে উন্নতমানের। তুমি নিশ্চিন্তে কাজ শুরু করে দাও অ্যান্ড্রু”
“আমি কি সেই মাল্টিভার্সটি একবার দেখতে পারি?”
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর আবার ভেসে আসে কণ্ঠস্বর, এবারে আরো কাছে, আরো উচ্ছসিত ভঙ্গিতে।
“এই সেই মাল্টিভার্স অ্যান্ড্রু, যেখানে আমরা উন্নত মানের মানুষকে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্ল্যান্ট করব। একবার ঝালিয়ে নিই ঠিক কি করতে হবে।
আমাদের আনা নমুনার থেকে সেই মানুষটির বুদ্ধাঙ্ক হবে নীল পৃথিবীর হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্সের থেকে অনেক মাত্রায় বেশি। তার জীনে থাকবে আর.এন.এ এডিট করে বদলানোর ক্ষমতা। থাকবে নিজেকে সূক্ষাতিসূক্ষ পর্যায়ে সংশোধন করতে পারার চাবিকাঠি। ঠিক আমাদের নিয়ে আসা অক্টোপাসটির মতন। কোনো বৈশিষ্ট্য ভুল থাকলে যাতে সে আগের সঠিক সংস্করণে ফেরত যেতে পারে।
থাকবে টার্ডিগ্রেডের মতন অমর হতে পারার বিরল শক্তি। কোনো চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখে যাতে এই প্রজাতি ক্রিপ্টোবায়োসিসের মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে, সেই মূলমন্ত্র তুমি উদ্ধার করে এই স্পেসিমেনের জীনে প্রবেশ করাবে।
বাকি রইল গাছের বীজ। এর মধ্যে রয়েছে সব থেকে কাছের তারার আলো, সূর্যরশ্মি শুষে নিয়ে সেটা শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারার সংজ্ঞা। যা দিয়ে শরীরের কোষগুলি উজ্জীবিত থাকবে, সর্বক্ষণ সক্রিয় থাকবে।
আপাতত এইটুকুই। কি, পারবে তো?”
“জটিল কাজ পল্, তবে আমাকে পারতেই হবে। নীল পৃথিবী এত শত কোটি মাল্টিভার্স থাকতেও ওই একটাই। তার সমাপ্তি আসন্ন। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না। মানুষ আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির একজন। দরকার শুধু তাকে আরেকটু পরিমার্জিত করার। দরকার জেনেটিক মন্থন”
আচমকা সব আওয়াজ থেমে গেল। একটা ক্ষীণ আলোয় রিও দেখল সে একটা বৃহদাকার ঘরের একদম কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা এতটাই উঁচু যে তার ছাদ দেখা যায় না। সামনে সারি সারি ঘাসের গালিচার ওপর ঝলমল করছে রাশি রাশি ছোটো ছোটো আলোর গোলক। কখনো তাদের ঔজ্বল্য বাড়ছে, কখনো ফিকে হয়ে আসছে। যখন ফিকে হয়ে আসছে, দেখে মনে হচ্ছে বুঝি তারা এক একটা ছায়াপথের অতিক্ষুদ্র সংস্করণ। ধুকপুক করছে তাদের মধ্যে এক একটা পৃথক বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। এরা সবই অলীক? সবই তুচ্ছ গবেষণার পাত্র! রিও বেশ বুঝতে পারে, সেইই সেই মানুষ যাকে নমুনা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। তার জেনেটিক সংজ্ঞার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাবে অন্য কোনো মহাবিশ্বের অন্য কোনো পৃথিবীর ভবিতব্য। সেই ফ্যান্টম অর্ব তাহলে সত্য, মহাসত্য। ওই অন্ধকার গোলকটি আসলে কোনো গোলকই নয়, সেটা এই ক্ষুদ্র এক একটি ছায়াপথ থেকে বাইরের বৃহত্তর জগতে আসার ছাঁকনি-পথ। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে রিওর। কোনটা ফ্যান্টম অর্ব, সেইটা যাকে নিজের আকাশ থেকে দেখেছিল, না কি আসলেই এই ঝলমল করতে থাকা মাল্টিভার্সগুলো, যেগুলো আসলে একটা গবেষণাগারের শিশিরবিন্দু?
৯
চোখ খুলে তাকাতে একরাশ আলো এসে পড়ল রুশীর চোখে। ঝপ করে চোখটা বন্ধ করে নিল সে। খুব চেনা একটা কণ্ঠস্বর পেল তখনই,
“ওই তো, রুশী জেগে উঠেছে, জেগে উঠেছে ডক্টর!”
মায়ের গলা! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মাকে, কিন্তু মাথাটা এখনো টনটন করছে ওর।
একটা অচেনা কণ্ঠস্বর ফের শোনা গেল,
“মিরাকেল ম্যাডাম। পেশেন্টের হার্টরেট আর ব্রেনের কার্যকলাপ এত কমে গিয়েছিল, তারপরেও যে ও কোমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারল, সেটাই এক চমৎকার! আমরা রুশীকে পর্যবেক্ষণে রাখব। স্থিত অবস্থা দেখলে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম সরিয়ে নেব”
“একদম ডাক্তারবাবু” এবারের কণ্ঠস্বর রুশীর বাবার।
“ওই দেখ, মেয়ে হাসছে না? ও কি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে?” উদগ্রীব হলেন মিসেস সেন।
“সব ঠিক হয়ে যাক। নয় নয় করেও এক বছর তো পেরিয়ে গেল সেই দিনটার থেকে, যেদিন আমরা ওকে বাবার বাগানের বাইরে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম! ফিরে আসুক রুশী হাসি নিয়েই” বললেন মিস্টার সেন।
এক বছর! এই তো দুই মুহূর্ত আগেও রুশী অনুভব করছিল, ও দৈববলে কোনো বাইরের জগতে পৌঁছে গেছে। না, ঠিক আমাদের সৌরলোকের মধ্যে বা বাইরে নয়। এ এক অন্যরকম জগৎ। পেঁয়াজের যেমন স্তরের পর স্তর, আর তার একদম কেন্দ্রে একটা নিখুঁত সাদা গোলক, রুশী অনুভব করল, এই বর্তমান ছায়াপথেরাও ঠিক তেমনই। বর্তমানে অবস্থান করা মহাবিশ্বের বাইরে রয়েছে তারই আরেক স্তর, যেটা এর থেকেও বৃহৎ। হয়তো তার বাইরে রয়েছে আরেকটা, তারও বাইরে আরেকটা, অগুনতি এমন… বিহ্বল হতে হয় ভাবতে গিয়ে। আর ঠিক তেমনই পরের স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল সে। না, তার প্রয়োজন ছিল না সেখানে। বিরল এক ভুলের কারণে, সে বাহকের রূপ নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সেই অনন্য জগতে, যেখানে ভেতরের স্তরের কেউ গেলে আর ফিরে আসতে পারে না। রুশী কাঠবিড়ালী খাওয়া সেই অদ্ভুত বীজটির বাহক হিসেবে গিয়েছিল, যেই বীজটি সংরক্ষিত হয়েছিল নীল পৃথিবীর মাটিতে হাজার হাজার বছর আগে। তার প্রয়োজন শেষে, রুশীকে ফিরিয়ে দিয়েছে ওরা, জেগে উঠেছে ও দীর্ঘ কোমা থেকে। রুশী জানে, ওর কথা কেউই বিশ্বাস করবে না। সত্যি মিথ্যের গণ্ডিটা আজ বড্ড ধূসর। বড্ড ধূসর এই ইহ অলীক মায়া জগৎ, এই ফ্যান্টম অর্ব!
Tags: অবন্তী পাল, গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা