বিবর্তন
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বিশাল শহরটাকে প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে জঙ্গলে। প্রাসাদের মতো বাড়িগুলোর ছাদের দখল নিয়েছে উঁচু উঁচু গাছের সারি, তাদের মোটা কাছির মতো শেকড়গুলো সর্পিল ভঙ্গীতে নীচে নেমে এসে বাড়িগুলোকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে প্রেমিকার নিবিড় আলিঙ্গনের মতো। রাজপথের কুলিশ কঠিন আস্তরণ ফাটিয়ে উঠে আসা কাঁটালতা আগলে রেখেছে বাড়ির প্রবেশপথ, তাদের মধ্যে ইতস্তত ছেটানো বুনো ফুলের রঙিন বর্ণালী। পথের মোড়ে একটা লতাপাতার সূক্ষ্ম কারুকার্য খোদাই করা বেদি ঢেকেছে ঘাস আর শ্যাওলার কার্পেটে, তার ওপরে গায়ে এক চিলতে রোদের মেখে ঘাড় তুলে রাজা বাদশার মতো অবজ্ঞায় নবাগতদের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একটা সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী।
নবাগতরা সংখ্যায় বেশ ভারী। অভিযান প্রমুখের দু-পাশে দাঁড়ানো প্রত্নতাত্ত্বিকরা ছাড়াও, পেছনে নানা শাখার বৈজ্ঞানিকদের একটা বড়ো দল। তাদেরও পেছনে, শহরের বাইরের ঘাসে ছাওয়া মাঠে দাঁড়ানো মহাকাশ পাড়ি দিয়ে আসা শিপটা থেকে নানা যান্ত্রিক বাহনে চাপিয়ে রসদ আর যন্ত্রপাতির পেটি বয়ে নিয়ে আসে সহকারীর দল। হাতটাকে কপালের ওপর কার্নিশের মতো করে ধরেন অভিযান প্রমুখ। মাথার ওপরে গনগনে জোড়া সূর্যের প্রখর আলো আড়াল করে নজর ঘোরান শহরটার ওপর।
“তাহলে সমস্ত গ্রহটাই জনশূন্য?”
“হ্যাঁ জেষ্ঠ্যা, নামার আগে যা দেখেছি, সব নগর, জনপদ, জনহীন অবস্থায় পড়ে আছে। প্রাণধারণের কোনো উপাদানের অভাব নেই, অথচ কোনো কারণে গ্রহের অধিবাসীরা সব উধাও হয়ে গেছে।” পাশ থেকে বলেন প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক।
একটা প্রাসাদের মতো অট্টালিকার প্রবেশপথের খিলেন মাথায় ধরে রেখেছে সবুজ শ্যাওলার ছোপ লাগা কয়েকটা স্তম্ভের আয়তনের নারীমূর্তি। তাদের দিকে আঙুল তুলে দেখান দ্বিতীয় প্রত্নত্বাত্তিক। “চেহারায় আমাদের সঙ্গে কিন্তু বড়ো একটা তফাৎ নেই।”
পেছন থেকে গলা খাঁকারি দেন জীববিজ্ঞানী। “ওটা প্রকৃতির নিয়মে। বিবর্তনের খাতায় প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে আকৃতির যা বর্ণনা দেওয়া আছে, তার হিসেবটা খুব বাঁধাধরা। প্রাণীর উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক, বিবর্তন তার আকৃতিকে প্রাণীর প্রয়োজন অনুযায়ী গড়েপিটে যা রূপ দেয় তার মধ্যে খুব একটা রকমফের হয় না।”
একটা হাওয়ার ঝাপটা বাড়ির মাথা গাছগুলো সরসর শব্দে ঝাঁকিয়ে শুকনো পাতার বৃষ্টি নামিয়ে আনে। মাথা থেকে পাতা ঝাড়তে ঝাড়তে প্রত্নতাত্ত্বিক এক কিছুটা বিস্ময় মেশানো স্বরে প্রশ্ন করেন, “মানে উৎপত্তি আলাদা হলেও বিবর্তনের পথে একই গন্তব্যে পৌঁছে আকৃতিও এক হয়ে দাঁড়ায়?”
“হ্যাঁ।” মাথা থেকে পাতা ঝাড়েন জীববিজ্ঞানীও, “স্থলের পশু জলে বাস করতে শুরু করলে ক্রমশ তার আকৃতি যেমন বিবর্তনের চাপে মাছের মতো হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি—”
“তেমনি প্রাণীজগতের চূড়োয় বসে থাকা ধীমান প্রাণীর আকৃতিও একই রকমের হয়ে পড়ে। ছায়াপথের কোথাও এর অন্যথা দেখা যায়নি।” শহরের দিক থেকে নজর না সরিয়েই উত্তর দেন অভিযান প্রমুখ।
নবাগতদের কথোপকথনে রোদ পোয়াতে থাকা সরীসৃপটার শান্তি বিঘ্নিত হয়। তীক্ষ্ণ আওয়াজে বিরক্তি জানিয়ে সেটা নীচে লাফিয়ে পড়ে বেদির শ্যাওলা সবুজ আসন থেকে, দুলকি চালে হেঁটে যেতে থাকে রাজপথের ফাটল ধরা পাথরের ওপর দিয়ে। তার দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলেন অভিযান প্রমুখ, “লুপ্ত সভ্যতা আগেও দেখেছি, কিন্তু এরকম আগে দেখিনি। যুদ্ধ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোনো চিহ্ন নেই। যেন একদিন হঠাৎ এখানের অধিবাসীরা রাতারাতি বাস উঠিয়ে গ্রহ ছেড়ে চলে গেছে। অদ্ভুত!”
চোখ তুলে শহরের দিকে ইঙ্গিত করেন প্রত্নত্বাত্তিক দুই, “প্রত্ন বস্তুর কোন অভাব নেই, জেষ্ঠ্যা। কাজ শুরু হলে এই রহস্যের উত্তর অবশ্যই খুজে পাওয়া যাবে।”
আচমকাই মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতায় যেন ঘূর্ণিঝড় লাগে। পরিত্যক্ত বাড়ির ছায়ার গভীর কালিমা থেকে কোনো একটা বড়োসড়ো পশু বিদ্যুৎবেগে ছিটকে এসে সরীসৃপটাকে মুখে তুলে নিয়ে ফের মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। তার তীক্ষ্ণ আর্তনাদটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে জনশূন্য শহরে প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে যায়। চমকে কয়েক কদম পিছিয়ে যায় সকলেই।
পেছন থেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন নিরাপত্তা সহায়ক, হাতের মুঠোয় ধরা হাতিয়ার। “জেষ্ঠ্যা, এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ নয়।”
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেন অভিযান প্রমুখ, “হ্যাঁ, চলো। ডেরা বাঁধার কাজ শুরু যাক। একবার তোমরা কোথায় কি বিপদ-আপদ আছে দেখেশুনে নিলে তারপর আমরা শহরে ঢুকব।”
শিপ আর শহরের মাঝে রূপ নিতে থাকা অস্থায়ী শিবিরটার দিকে যেতে যেতে শেষবারের মতো আর একবার পেছন ফিরেন তাকান তিনি।
“অদ্ভুত!”
২
সেমিনার হলটা আজ একেবারে ঠাসা— বিভিন্ন কলেজ থেকে আসা অধ্যাপকে হল ভর্তি হয়ে গেছে। বিবর্তন বিজ্ঞানের অন্যতম নক্ষত্রের নাম বসুন্ধরা রায়। তিনি যখন ফ্যাকাল্টি সেমিনারে বলতে আসেন তখন এইরকমই হয়। একটা সিটও খালি যায় না।
পেছনের আলোকিত স্ক্রিনে ফুটে ওঠা বৈজ্ঞানিক নক্সা আর পরিভাষার সামনে টানটান পিঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকান তিনি।
“শুরুটা সবাই জানেন, তাও একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।”
স্পিকারে ছড়িয়ে যাওয়া তাঁর গমগমে কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয় পান সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা।
“সৃষ্টির শুরুতে বিদ্যুৎ আর আলট্রাভায়োলেট রশ্মির তাড়নায় জল, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, অ্যামোনিয়া এইসব সাদামাটা বস্তু মিলেমিশে গিয়ে নানা সুদীর্ঘ শৃঙ্খলাবদ্ধ অণুর জন্ম দেয়।”
হাত তুলে পেছনের স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করেন বসুন্ধরা, “সেই আদিম রসায়নে দৈবাৎ সৃষ্টি হয় এমন কোন অণুর যা তৈরি করতে পারে নিজের প্রতিলিপি। নিজেই নিজের ছাঁচে নিজেকে সেটা সৃষ্টি করতে পারে বারংবার। কিন্তু এই ছাঁচ থেকে সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা নিখুঁত নয়, মাঝে মধ্যেই দেখা যায় নকলটা আসলের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে গেছে। তাই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় সেই প্রথম দীর্ঘ অণু শৃঙ্খলের নানা সংস্করণ। তবে তাদের মধ্যে টিকে থাকে কেবল সেগুলোই যারা তাদের এই বারবার নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টির প্রক্রিয়া জারি রাখতে পারে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। যে প্রাকৃতিক নির্বাচন আর যোগ্যতমের টিকে থাকার কথা ডারউইন বলে গেছেন, এই তার সূচনা লগ্ন।”
সেমিনার হলের ভিড়ের ওপর একবার চোখ বোলান তিনি, “সৃষ্টির আদিলগ্নের সেই দীর্ঘ অণু শৃঙ্খলরা কোথায় গেল কেউ বলতে পারেন?”
“লুপ্ত হয়ে গেছে?” একটা ইতস্তত, সন্দেহ মেশানো উত্তর আসে।
মাথা ঝাঁকান বসুন্ধরা, “না, তারা কোথাও যায়নি। অগুন্তি সংখ্যায় তারা এখন ঝাঁক বেঁধে বাস করে নানা দানবিক জৈবিক বাহনের মধ্যে। সেসব বাহনকে নানা ভাবে ব্যবহার করে তারা নিজেদের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে।”
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তাঁর কথার তাৎপর্যটা সবাইকে বুঝে উঠতে সময় দেন বসুন্ধরা। তারপর প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা করে, ধীরে ধীরে, থেমে বলেন, “সেই দীর্ঘ অণু শৃঙ্খলদের আমরা বলি জিন। আর তাদের শ্রেষ্ঠ বাহন আমরা। মানুষ।”
৩
উলটানো বাটির মতো ডেরার মেঝেতে পুরু গালিচা পাতা। তার একপাশে রংবেরঙের তাকিয়ার স্তূপের মধ্যে ঠেস দিয়ে বসে অভিযান প্রমুখ। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে অভিযানের বাকি সদস্যরা। তাদের সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নেন তিনি।
“বেশ। এবার এক এক করে বলে ফেলো তোমরা যা যা জানতে পেরেছ।”
“শহরের বেশি ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র এখনো পাইনি জেষ্ঠ্যা।” আড়চোখে একবার নিরাপত্তা সহায়কের দিকে তাকিয়ে দেখে নেন প্রত্নত্বাত্ত্বিক এক, “তবে যেটুকু দেখতে পেরেছি, মনে হচ্ছে এদের সমাজ ছিল কঠোরভাবে মাতৃতান্ত্রিক।”
সামান্য উঠে যায় অভিযান প্রমুখের ভ্রুযুগল। “ছায়াপথের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কোনো অভাব নেই। কিন্তু কঠোরভাবে কেন?”
সবার মাঝখানে একটা আলোয় গড়া ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। কোনো একটা ইমারতের দেওয়ালে রিলিফে খোদাই করা প্যানেল। একটা লম্বা শোভাযাত্রার ভাষ্কর্য। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, ধ্বজ হাতে নারীদের মিছিল।
“এটা দেখুন জেষ্ঠ্যা। কোনো উৎসবের অলঙ্করণ। কিন্তু কোনো পুরুষের চিহ্ন নেই।”
ভ্রু কুঁচকোন অভিযান প্রমুখ। “হতেই পারে। এটা হয়তো নারীদের একান্ত কোনো উৎসব। তার থেকে কঠোর মাতৃতান্ত্রিকতা প্রমাণ হয় না।”
“শুধু একটাই নয় জেষ্ঠ্যা, এগুলোও দেখুন।” অন্যদিক থেকে বলেন প্রত্নত্বাত্তিক দুই।
বাতাসে ফুটে ওঠে আরো বেশ কিছু ছবি। ভাস্কর্য, স্থাপত্য, দেওয়ালের মুরাল। শুধুই নারীদের। কোনো পুরুষ আকৃতি নজরে পড়ে না।
কপালের রেখাগুলো আরো গভীর হয় অভিযান প্রমুখের। “হুঁ। কোথা থেকে পেয়েছ এই নমুনাগুলো?”
“শহরের নানা জায়গার অলঙ্করণ থেকে। বাড়িগুলোর ভেতরে ঢোকার অনুমতি এখানো পাইনি। ঢুকতে পারলে হয়তো আরো বিশদে কিছু জানা যেত।” নিরাপত্তা সহায়কের দিকে আর একবার আড়চোখে তাকান প্রত্নতাত্ত্বিক এক।
তাঁর তির্য্যক উক্তিটা বিফলে যায় না, গলার স্বর সামান্য চড়িয়ে প্রতিবাদ জানান নিরাপত্তা সহায়ক।
“বাড়ির ভেতরটা কতটা নিরাপদ আমাদের জানা নেই জেষ্ঠ্যা। হিংস্র, বিষাক্ত প্রাণী ছাড়াও সংস্কারের অভাবে বাড়িগুলোর অবস্থা ভালো না। ভেতরে যাওয়াটা বিপজ্জনক।”
একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলেন অভিযান প্রমুখ। এ ধরনের টানাপোড়েন তাঁকে মেটাতে হয়েছে এই প্রথম নয়।
“সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকতে হলে আমরা গৃহেই থাকতে পারতাম কনিষ্ঠা। অনর্থক ঝুঁকি যাতে কেউ না নেয় তার দিকে নিশ্চয়ই লক্ষ রাখবে। কিন্তু যাতে কাজ এগোতে পারে অন্তত ততটা ছাড় দিও।”
“অবশ্যই জেষ্ঠ্যা।” সম্মতিতে মাথা ঝোঁকান নিরাপত্তা সহায়ক।
হাওয়া ভাসা ছবিগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অভিযান প্রমুখ। “অদ্ভুত!”
৪
সেমিনার হলের ভিড়টার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নেন বসুন্ধরা। যে কোনো সেমিনারে লাঞ্চের বিরতির পর সাধারণত ভিড় কিছুটা কমে যায়। বিষয়বস্তু যাদের নীরস ঠেকে, তারা বিদায় নেয়। কিন্তু তিনি এর ব্যতিক্রম। শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাঁর সেমিনার ছেড়ে যায় না।
“এক্সকিউজ মি ম্যাম!”
তিনি বলা আরম্ভ করার আগেই বাধা পড়ে।
“এক্সকিউজ মি ম্যাম! কিন্তু ডারউইনের যোগ্যতমের টিকে থাকার যে ধারণা, এটা কি এক ধরনের স্বার্থপরতার মতাদর্শ নয়?”
প্রশ্নকর্তার বয়স বেশি নয়। মাথায় একটা ক্যাপ। কণ্ঠে কিছুটা উষ্মার ছাপ।
“অবশ্যই স্বার্থপরতা!” শীতলভাবে উত্তর দেন বসুন্ধরা, “কিন্তু আদর্শ নয়, যোগ্যতমের টিকে থাকার লড়াইয়ের কঠিন বাস্তব।”
“কিন্তু সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান—”
“কিছু মনে করবেন না। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর সমাজবিজ্ঞানের যা রূপ, মনে হয় যেন ডারউইনের জন্মই হয়নি!” গলায় অবজ্ঞার ভাবটা চেপে রাখতে পারেন না বসুন্ধরা। “যে প্রাকৃতিক নির্বাচন যোগ্যতমের টিকে থাকার পথ সুনিশ্চিত করে, তার সাফল্যের জন্যে স্বার্থপরতা অবশ্যম্ভাবী। আর সেই স্বার্থপরতা কাজ করতে আরম্ভ করে প্রাণের সর্বনিম্ন স্তর— জিনের স্তর থেকেই।”
“আর মানুষ? জীবন?”
“জীবনের মানে কী? আমাদের উদ্দেশ্য কী? কাকে বলে মানুষ? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে কোনো কুসংস্কারের, কোনো ধোঁয়াটে মতবাদের আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রজাতির নিরবচ্ছিন্নতা আর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ছাড়া আর জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। বিবর্তনের কাছে আমরা টিকে থাকার যন্ত্র মাত্র। এমন এক যান্ত্রিক বাহন যাকে অন্ধের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় জিন নামক স্বার্থপর অণুতে।”
৫
“জ্যেষ্ঠা, এই একই আকাশে জোড়া সূর্যের অবস্থাটা সম্পূর্ণ স্থিতিশীল নয়।” রঙিন গালিচার এক প্রান্তে বসে বলেন আবহাওয়া বিজ্ঞানী। “মাঝে মধ্যে পরস্পরের আকর্ষণের টানা-পোড়েনে এরা অস্থির হয়ে ওঠে। বিকিরণের মাত্রা বেড়ে যায়।”
গলা খাঁকারি দেন জীববিজ্ঞানী। “এ ধরনের বিকিরণ জিনরাশিতে যে আচমকা রূপান্তর আনে, তাতে জীবজগতে বহু পরিবর্তন আসে।”
“বেশ।” ডেরার অন্যপ্রান্তে তাকিয়ার স্তূপের হেলান দেওয়া অভিযান প্রমুখ তাকান প্রত্নতাত্ত্বিকদের দিকে। “তোমরা কিছু পেয়েছ?”
“হ্যাঁ জ্যেষ্ঠা,” উত্তর দেন প্রত্নতাত্ত্বিক দুই। একটা উঁচু সৌধের ছবি ফুটে ওঠে বাতাসে। “আমরা এর মধ্যে প্রবেশ করেছিলাম।”
ছবিটা পালটে যায়। সৌধের ভেতরে গম্বুজ আকৃতির উঁচু ছাদ। তার গায়ে গায়ে বসানো গবাক্ষের ফাঁক দিয়ে নেমে আসে থামের মতো সূর্যকিরণ। একটা লম্বা পথের দু-পাশে সুউচ্চ থামের সারি তাদের শীর্ষে ধরে রাখে ধনুকের আকারের খিলেন।
“এটা কি?”
“খুব সম্ভব কোনো ধর্মস্থল, জেষ্ঠ্যা।” বলেন প্রত্নতাত্ত্বিক এক, “এই পথের শেষে একটা প্রতিকৃতি আছে।”
পালটে যায় ছবি। থামের সার দেওয়া রাস্তাটার অন্তিম প্রান্তে উঁচু বেদির ওপর বসানো বিশাল আকারের একটা অদ্ভুত স্থাপত্য। নিষ্প্রাণ, নিষ্পত্র একটা গাছ তার অজস্র শাখাপ্রশাখা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে একটা উজ্জ্বল গোলককে।
“এরা কি বৃক্ষপূজারী ছিল?” জানতে চান অভিযান প্রমুখ।
“প্রথমে আমরাও তাই ভেবেছিলাম জেষ্ঠ্যা।” বলেন প্রত্নতাত্ত্বিক দুই, “কিন্তু তারপর এই বেদির নীচে উৎকীর্ণ লিপির অর্থ উদ্ধার করে দেখলাম আমাদের ধারণা ভুল।”
বাতাসে ভেসে ওঠে কোন অজানা লিপির কয়েকটা আঁকাবাঁকা অক্ষর।
“এর অর্থ কি?”
“বিবর্তন মহান।” উত্তর দেন প্রত্নতাত্ত্বিক এক, “এই সভ্যতায় সম্ভবত বিবর্তন ছিল শ্রদ্ধা আর ভক্তির বস্তু।”
“এটা কোনো সাধারণ কোনো গাছ নয় জেষ্ঠ্যা,” ছবির দিকে ইঙ্গিত করেন প্রত্নত্বাত্তিক এক, “এককোষী প্রাণী থেকে বিবর্তনের পথে যেভাবে সৃষ্টি হয় জীব বৈচিত্র, এ তার প্রতীক। বিবর্তন বৃক্ষ!”
“আর ওই উজ্জ্বল গোলক? যেটাকে জড়িয়ে রেখেছে নিষ্পত্র শাখাপ্রশাখায়।”
“ওটা খুব সম্ভব এই গ্রহের প্রতীক।”
“আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে জেষ্ঠ্যা, তবে আর যা যা লিপির পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি মনে হচ্ছে এই সভ্যতায় বিবর্তনই চরম আদর্শ বলে গণ্য হতো।”
“অদ্ভুত!”
৬
নিজের টেবিলে বসে কাজ করার সময়ে ফোন বার তিনেক নাছোড়বান্দার মতো বেজে যাওয়ার পর চার বারের পর ভিডিয়ো কলটা ধরেন বসুন্ধরা।
“মাসি, এই সন্ধেবেলা এখন কথা বলার একদম সময় নেই। পেপার কারেক্ট করার আছে, ক্লাসের জন্যে নোটস নেওয়া আছে। তোমাকে বলেছি রাতের পর ফোন করতে।” কণ্ঠের উষ্মাটা চেপে রাখতে পারেন না তিনি।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন ভিডিয়ো কলের উল্টোদিকের বৃদ্ধা। “খুব প্রয়োজন না থাকলে তোকে ফোন করি না তো জানিস। একটা খুব খারাপ খবর আছে রে!”
“কী হয়েছে?” কণ্ঠে উষ্মার বদলে উৎকণ্ঠার ছোঁয়া লাগে বসুন্ধরার।
“শ্রেয়সী আর ওর দুই মেয়ে মারা গেছে।” গলার স্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে বৃদ্ধার।
“শ্রেয়সী! সে কি! এই দিন সাতেক আগেই তো কথা হল। কী হয়েছিল?”
“অ্যাক্সিডেন্ট। মেয়েদের কলেজে ছাড়তে যাচ্ছিল, সামনে থেকে ট্রাক এসে ধাক্কা মারে।” কান্না চাপতে পারেন না বৃদ্ধা। “এই দু-মাস আগে সাঁতার কাটতে গিয়ে বৈশাখী চলে গেল, আর এবার শ্রেয়সী।” ফোঁপাতে থাকে বৃদ্ধা।
“তুমি একটু ঠান্ডা হও মাসি। চুপ করে শুয়ে পড় গিয়ে। আমি কাজ শেষ করে তোমায় রাতের বেলা কল করছি।”
কলটা কাটতে গিয়েও কেমন ইতস্তত করেন বৃদ্ধা, “একটা কথা বলি তোকে। দিন পনেরো আগে আমাকে শ্রেয়সী বলেছিল কারা যেন ওর ওপর নজর রাখছে। মাঝে মধ্যে অনুসরণ করছে?”
“কে ওসব করবে মাসি?” বিস্মিত কণ্ঠে বলেন বসুন্ধরা। “শ্রেয়সী একটা সাদামাটা মধ্যবিত্ত চাকরি করত। ওর ওপর খামোখা কে নজর রাখতে যাবে? এ সব বাদ দাও মাসি।”
“না রে, ইদানীং ও যেন কেমন একটা আতঙ্কে ভুগত। কেমন গুটিয়ে থাকত।”
“শোকে তোমার মাথা ঠিক নেই মাসি। এ সব কথা এখন থাক। তোমার খুব মানসিক ধকল গেছে, তুমি এখন শুয়ে পড়ো।”
“সে যাচ্ছি। কিন্তু তুই একটু সাবধানে থাকিস।”
ভিডিয়ো কলটা কাটতেই চেয়ারের হাতলটা খামচে ধরেন বসুন্ধরা। মাসির সামনে তাঁকে মুখের চেহারাটা নিরাসক্ত রাখতে হলেও কথাটা শ্রেয়সী তাঁকেও জানিয়েছিল। এবং কেবল শ্রেয়সী নয়, মারা যাওয়ার দিন কতক আগে বৈশাখী তাঁকে মেসেজ করেছিল যে তাঁকে তার কিছু কথা বলার আছে। কথাগুলো সে সামনাসামনি বলবে, ফোনে বলা সম্ভব নয়।
তাঁদের ঘিরে কি কেউ ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে? কিন্তু কারা তারা? এতগুলো বছর কেটে গেছে, কখনো তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁদের!
কলিংবেলটা আচমকা ঢং করে বেজে উঠে তাঁর চিন্তার ব্যাঘাত ঘটায়। দেওয়ালের ঘড়ির দিকে চোখ চলে যায় তাঁর। সাড়ে ছ’টা বাজে। তাঁর মেয়ে রীতুর কলেজ থেকে ফেরত আসার সময় হয়ে গেছে।
না, রীতু নয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গ্যাস কোম্পানির ইউনিফর্ম পরা একটা ছেলে। বসুন্ধরা দরজা খুলতেই তাঁর দিকে নিজের আইডি কার্ডটা বাড়িয়ে ধরে সে।
“গুড ইভনিং ম্যাডাম। হিন্দ গ্যাস থেকে আসছি।”
“বলুন।”
“ম্যাডাম, আমরা কোম্পানি থেকে গ্যাসের ব্যবহারের ওপর একটা সার্ভে করছি। আপনার সহযোগিতা চাই। “
“কী করতে হবে আমাকে? “
“আমরা আপনাকে একটা নতুন গ্যাসের সিলিন্ডার দেব। ফ্রী। সিলিন্ডারের ফিল্টারে একটা সেন্সর লাগানো থাকবে। আপনি গ্যাস কখন কখন ব্যবহার করেন, প্রত্যেকবার কতটা গ্যাস খরচা হয়, সব সেন্সরে ধরা পড়বে। আপনার এখনকার সিলিন্ডার শেষ হওয়ার পর আপনি এই নতুনটা ব্যবহার করতে পারেন। ফুরিয়ে গেলে আমরা এসে নিয়ে যাবো। এই বাড়তি গ্যাসের জন্যে আপনাকে কোনো আলাদা পয়সা দিতে হবে না।”
“ঠিক আছে।”
মোবাইলে কি লেখাজোখা করে ছেলেটা। “আমাদের সাপ্লাই এসে গেলে কয়েকদিনের মধ্যেই এই সিলিন্ডারটা দিয়ে যাবো। থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।”
ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ঘরে এসে আর একবার ঘড়ির দিকে তাকান বসুন্ধরা। সাড়ে ছ-টা পেরিয়ে গেছে, রীতুর এখনো দেখা নেই।
রীতু ফের বেশ দেরি করেই। প্রায় পৌনে আটটা নাগাদ।
“কিরে কোথায় গিয়েছিলি? ফোনও বন্ধ।” উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চান বসুন্ধরা।
“সিনেমা গিয়েছিলাম মা।” একটু আড়ষ্টভাবেই বলে রীতু।
“একা?”
“না, বন্ধুর সঙ্গে। হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল, তাই তোমাকে বলতে পারিনি।” আড়ষ্ট ভাবটা যায় না রীতুর।
“কোন বন্ধু? চিনি তাকে?”
“না মা। তুমি চেনো না। সুরিন্দার। আমার কলেজেই পড়ে।” আরো যেন জড়সড় হয়ে পড়ে রীতু।
খানিকটা জোর করেই হাসেন বসুন্ধরা। “সুরিন্দার? বাঙালি নয়?”
“না মা দিল্লীর ছেলে।” উত্তর দেয় রীতু। তারপর কেমন যেন একটু তাড়াহুড়ো করেই যোগ করে, “কিন্তু খুব ভালো ছেলে মা। তুমি দেখলেই বুঝবে।”
“সে ঠিক আছে।” হাসিটাকে জোর করে আটকে রাখেন বসুন্ধরা, “একদিন নিয়ে আসিস না হয় বাড়িতে, তখন দেখবে। তবে পরের বার কোথাও গেলে একটু জানিয়ে যাস। না হলে দুশ্চিন্তা হয়।
“আচ্ছা মা, ঠিক আছে।”
৭
ডেরার গালিচার ওপর আজ জীববিজ্ঞানী বসে সামনের দিকে। তাঁর দিকে তাকান অভিযান প্রমুখ, “বলো, কী জানতে পেরেছ।”
“জেষ্ঠ্যা, আপনি জানেন মধুকরের মতো কিছু সামাজিক কীটপতঙ্গের মধ্যে পুরুষ প্রাণীদের স্থান গৌণ। বংশ বিস্তারে সাহায্য করা ছাড়া তাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই। স্ত্রী প্রাণীদের তুলনায় তারা স্বল্পায়ু। দুর্বল।”
“জানি। নতুন কিছু নয়।”
“ছায়াপথের কিছু কিছু গ্রহে এই ধরনের বৈশিষ্ট্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যেও দেখা যায়।”
“এও জানি। নতুন কিছু নয়।” রসিকতায় চিকচিক করে ওঠে অভিযান প্রমুখের চোখ।
“জেষ্ঠ্যা, ধীমান হয়ে ওঠা কোনো প্রজাতির মধ্যে অতীতে এই বৈশিষ্ট্য থাকলেও, সভ্য হয়ে ওঠার পর স্ত্রী-পুরুষের এই অবস্থান অব্যবহার্য হয়ে পড়ে, কারণ সমাজের অগ্রগতির জন্যে পুরুষের পূর্ণ অংশগ্রহণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এর থেকে নতুন এক সমতার সৃষ্টি হয়।”
“এটাও জানি।” হাসি ছোঁয় অভিযান প্রমুখের ঠোঁট। “এটাও নতুন কিছু নয়।”
মাথা ঝাঁকান প্রাণীবিজ্ঞানী, “কিন্তু জেষ্ঠ্যা, এই গ্রহ ব্যাতিক্রম। দেহাবশিষ্টের যা নমুনা আমরা পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে সভ্যতার বহু অগ্রগতির পরও এখানকার প্রজাতির সেই আদিম জৈবিক বৈশিষ্টের কোনো পরিবর্তন হয়নি।”
“অর্থাৎ?” কপালে দাগ পড়ে অভিযান প্রমুখের। ঠোঁট থেকে মিলিয়ে যায় রসিকতার হাসি।
“জেষ্ঠ্যা, সভ্যতার শিখরে পৌঁছেও এই প্রজাতির সমাজে পুরুষরা ছিল স্বল্পায়ু, দুর্বল। বংশবিস্তারে সাহায্য করে প্রজাতিতে জিন বৈচিত্র আনা ছাড়া তাদের আর কোনো দায়িত্ব ছিল না।”
“আর জেষ্ঠ্যা,” যোগ করেন প্রত্নতাত্ত্বিক এক, “এই অবস্থার উন্নতির বদলে ক্রমশ অবনতি হয়। যা দস্তাবেজ আমাদের হাতে এসেছে, তার থেকে মনে হয় একটা সময়ে সমাজে পুরুষের সংখ্যা দ্রুতগতিতে হ্রাস পেতে থাকে।”
“কিন্তু কেন?”
“এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি জেষ্ঠ্যা।”
“অদ্ভুত!” বলেন অভিযান প্রমুখ।
৮
ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার সময়ে বুক করা ক্যাবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন বসুন্ধরা, পেছন থেকে কেউ ডাক তাঁকে ডাক দেয়।
“গুড ইভনিং ম্যাম।”
দিন কয়েক আগেকার সেমিনারের সেই প্রশ্নকর্তা। অল্প বয়েস, মাথায় ক্যাপ।
“আপনি?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম, এখান দিয়ে যেতে যেতে আপনাকে দেখতে পেলাম। ভাবলাম, আপনার কাছে আরো কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জেনে যাই। সেদিনকে সেমিনারে সুযোগ পাইনি।”
“আপনার কি মনে হয় এই রাস্তাটা অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্সের জায়গা?” ঝাঁজালো স্বরে বলেন বসুন্ধরা। তিনি খেয়াল করেন লোকটার ঠোঁটের কোনে লেগে রয়েছে একটুকরো তাচ্ছিল্যের হাসি।
“না না, ম্যাম। প্লিজ রাগ করবেন না। অ্যাকাডেমিয়াতে আপনি আমার থেকে অনেক সিনিয়র। আপনার কাছ থেকে শেখার সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাই না, এই যা। নাহলে অযথা আপনাকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছে ছিল না।”
ধমকে তাকে চলে যেতে বলতে যাচ্ছিলেন বসুন্ধরা। তারপর ভাবলেন কথায় কথা বাড়বে, কথা কাটাকাটি হলে আশপাশের লোকের চোখেও পড়বে। তার চাইতে যা জানতে চায় তার উত্তর দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া ভালো। এমনিতেই আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাঁর ক্যাব এসে পড়বে।
আগের মতোই ঝাঁঝালো কণ্ঠে তিনি বলেন, “যা বলার আছে তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন। আমার হাতে বেশি সময় নেই।”
“অফ কোর্স ম্যাম!” বিনয়ের অবতার হয়ে হাত কচলায় লোকটা, “আমি জানতে চাইছিলাম, এই যে যোগ্যতমের টিকে থাকার অধিকারের কথা বলা হয়, এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে কি কোনোভাবে সুখী সমাজ গড়ে তোলা যায়?”
“হুঁঃ!” অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা ব্যঙ্গের শব্দ বেরিয়ে আসে বসুন্ধরার গলা দিয়ে। “মশাই, আমরা সুখী হলাম কি দুঃখী হলাম, আমাদের খাদ্য হলাম না খাদক হলাম, বাঁচলাম কি মরলাম, তাতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কিছু যায় আসে না। তার একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের জিনের তথ্যগুলোকে টিকিয়ে রাখা। বুঝলেন?”
“তাহলে মানুষ—”
ফুটপাথ ঘেঁষে ক্যাব এসে দাঁড়ায়। গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করতে করতে বসুন্ধরা বলেন, “বিবর্তন একটা অনুভূতিহীন যন্ত্রগণক। সে কেবল হিসেব কষে জিনের বিস্তারের আর যোগ্যতমের টিকে থাকার। মানুষের তার কাছে আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই।”
গাড়ির জানলার কাছে মাথা নামিয়ে আনে লোকটা “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। অনেক কিছু জানা হল।” তারপর গলা নামিয়ে প্রায় সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে, “তবে আরো বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে গেল। একদিন আসবো আপনার বাড়ি, তাদের উত্তরের জন্যে।”
গাড়িটা এগিয়ে যেতে যেতে বসুন্ধরা টের পান, তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে।
বাড়িতে ফিরে ঘরে এসি চালিয়ে দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেন বসুন্ধরা। মনের মধ্যে তখন তাঁর নানা প্রশ্ন তোলপাড় করছে। কে লোকটা? কি উদ্দেশ্য তার? তাঁর অতীতে সম্বন্ধে সে কি কিছু জানে?
বসুন্ধরা জানেন এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তিনি পাবেন না। তবে তাঁর হাতে হয়তো সময় বেশি নেই। তার আগেই তাঁকে তার কাজ সমাধা করে ফেলতে হবে।
রীতু ফেরে একটু বেশি দেরি করেই। আজকাল তার অধিকাংশ দিনই ফিরতে দেরি হয়।
“কোথায় গিয়েছিলি রীতু, বেড়াতে? “
মাথা নেড়ে সায় দেয় রীতু।
“সুরিন্দারের সঙ্গে?”
এবারেও নীরবে মাথা নাড়ে রীতু।
কোনোরকম ভণিতা করেন না বসুন্ধরা। “রীতু, সুরিন্দরের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন তো ঘুরে বেড়ালি। এবার কাল বাড়িতে ডাক।”
“কালকেই?” বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে রীতুর।
“হ্যাঁ, কালকেই।” দৃঢ়কণ্ঠে বলেন বসুন্ধরা।
৯
আজ কোন কারণে জীববিজ্ঞানীকে কিছুটা পাংশু দেখায়। কিছু যেন তাঁকে গভীর অস্বস্তিতে ফেলেছে।
হাত তুলে তাঁকে আশ্বস্ত করেন অভিযান প্রমুখ, “সংকোচ কোরো না। যা জেনেছ বলো।”
“জ্যেষ্ঠা, কিছু কিছু প্রাণীদের মধ্যে স্বজাতি ভক্ষণের চরিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সঙ্গমের পর স্ত্রী প্রাণীটি পুরুষ প্রাণীটিকে খেয়ে ফেলে।”
“জানি। মূলত কীটপতঙ্গের মধ্যে দেখা যায়।” বলেন অভিযান প্রমুখ, “পুরুষ প্রাণীটির শরীর সন্তান ধারণের পোষণের কাজে ব্যবহৃত হয়।”
“জেষ্ঠ্যা, এই গ্রহে এই জৈবিক চরিত্র কেবল কীটপতঙ্গ নয়, কিছু মেরুদণ্ডী প্রাণীতে দেখা যায়।”
হাওয়ায় ফুটে ওঠে দুটো সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর ছবি। একটা ছোটো, অন্যটা আয়তনে তার প্রায় কয়েকগুণ বড়ো। তাদের দিকে ইঙ্গিত করেন জীববিজ্ঞানী।
“জেষ্ঠ্যা, ওই ছোটো প্রাণীটিকে আমরা প্রথমদিন দেখি। আর দ্বিতীয়টি আমাদের সামনেই একে শিকার করে নিয়ে যায়।”
ছবি নয়, প্রাণীবিজ্ঞানীর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অভিযান প্রমুখ।
“জেষ্ঠ্যা, দুটি একই প্রজাতির প্রাণী। ছোটোটি পুরুষ, বড়োটা নারী।”
দৃষ্টি কঠিন হয়ে আসে অভিযান প্রমুখের। প্রাণীবিজ্ঞানীর অস্বস্তির কারণটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন তিনি।
ছবিটা সরে গিয়ে একটা ঘরের ছবি ফুটে ওঠে, তার ভেতরের ধূলিধূসরিত যন্ত্রপাতির চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সেটা একটা গবেষণাগার।
পাণ্ডুর মুখে ছবিটার দিকে ইঙ্গিত করেন প্রত্নতাত্ত্বিক দুই। “জেষ্ঠ্যা, এখানে প্রবেশ করেছিলাম আমরা। যা প্রমাণ পেয়েছি, জীববিজ্ঞানী যে জৈবিক বৈশিষ্টের কথা বললেন, এখানের ধীমান প্রজাতি তার জিন নিজেদের শরীরে প্রতিস্থাপনের পরীক্ষা চালাত।”
“আর আবহাওয়া বিজ্ঞানী যে সৌর অস্থিরতার কথা বলেছিলেন। সেই রকম এক অস্থিরতার কিছুদিন পর থেকেই এই সব পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়।” যোগ করেন প্রত্নতাত্ত্বিক এক। তাঁর চেহারাও একই রকমের পাণ্ডুর।
কপালের ভাঁজ গভীর হয় অভিযান প্রমুখের “এই ধরনের গবেষণা থেকেই কি এই প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যায়?”
“না জেষ্ঠ্যা, এই প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যায়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তারা দলে দলে এই গ্রহ ছেড়ে চলে যায়।”
কেবল দৃষ্টি নয়, শরীরও কঠিন হয়ে আসে অভিযান প্রমুখের। কারণটা তিনি ভালোই অনুমান করতে পারেন।
“দণ্ডপালিকাতে খবর পাঠাও।” নিরাপত্তা সহায়ককে কঠিন স্বরে আদেশ দেন তিনি।
১০
পরের দিন সন্ধেবেলা সুরিন্দারকে বাড়ি নিয়ে আসে রীতু। বলিষ্ঠ চেহারা, হাতে লোহার বালা, কানে সোনার মাকড়ি। তাকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে চা জলখাবার খাওয়ান বসুন্ধরা, তার বাড়ি কোথায়, বাড়িতে কে কে আছে, এই ধরনের কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করেন, তারপর টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েন।
“তোরা গল্প কর, আমি একটু আসছি। কয়েকটা কাজ আছে।
নিজের ঘরে এসে চুপ করে বসে থাকেন বসুন্ধরা। শুনতে পান ডাইনিং রুম থেকে ভেসে আসা রীতু আর সুরিন্দারের কথোপকথন আর হাসির হালকা শব্দ।
কিছুক্ষণ বাদে থেমে যায় শব্দটা। ছিটকিনি তোলার একটা মৃদু শব্দ আসে। বসুন্ধরা বুঝতে পারেন রীতুর ঘরের দরজা বন্ধ হল।
নিজের ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন তিনি। এর পরের শব্দগুলো শোনা তাঁর পক্ষে সমীচীন নয়।
বেশ রাত করেই ডাইনিং রুমে আসেন তিনি। টেবিলে রাখা একটা প্রেসার কুকার থেকে হালকা মাংসের গন্ধ আসে। তার সামনে দাঁড়িয়ে রীতা। বোঝাই যায় যে সে চান করে উঠেছে। পরিচ্ছন্ন চেহারা। চুল পরিপাটি।
“কীরে? রান্না হয়ে গেল?”
“হ্যাঁ মা!” চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রীতুর। “একটু টেস্ট করে দেখবে?”
“আরে না, না। তুই খা।” আপত্তি করেন বসুন্ধরা।
তাও একটা ছোটো বাটিতে কিছুটা মাংস ঢেলে একটা চামচ সমেত মায়ের দিকে এগিয়ে দেয় রীতু।
চামচে করে মুখে মাংস তোলেন বসুন্ধরা।
“কেমন হয়েছে মা?” উৎসুক মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রীতু।
চিবোতে গিয়ে দাঁতে কাটার অনুপযুক্ত শক্ত মতো কিছু একটা ঠেকে বসুন্ধরার। রীতুকে সে কথা জানতে না দিয়ে উৎসাহের সঙ্গে তিনি বলেন, “খুব ভালো হয়েছে। খেয়ে নে। আমি আসছি।”
বাথরুমে গিয়ে শক্ত জিনিসটা মুখ থেকে বের করেন বসুন্ধরা।
একটা সোনার মাকড়ি।
মাকড়িটাকে কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করে দেন তিনি। রীতুকে বলার দরকার নেই। প্রথমবার ছোটোখাটো ভুলচুক হতেই পারে। ধীরে ধীরে এগুলো শুধরে যাবে।
১১
ডেরাতে আজ অভিযান প্রমুখের পাশে বসে এক প্রবীণ দণ্ডদাত্রী। হাওয়ায় ভাসে বিবর্তনের প্রতীকি ছবি। একটা নিষ্প্রাণ গাছ তার নিষ্পত্র শাখাপ্রশাখা জড়িয়ে রেখেছে একটা উজ্জ্বল গোলককে।
“আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছিল জ্যেষ্ঠা।” ছবির দিকে ইঙ্গিত করেন অভিযান প্রমুখ, “এই গোলকটা এই গ্রহের প্রতীক নয়। এটা সেই সমস্ত গ্রহের প্রতীক যাদের উদ্দেশে এরা পাড়ি দিয়েছে। সেই সমস্ত গ্রহ যাদের এরা নিজেদের জিনের বিস্তারের বজ্রমুষ্টিতে আবদ্ধ করতে চায়।
“কোথায় গেছে এরা জানতে পারা গেছে কি?” প্রশ্ন করেন দণ্ডদাত্রী।
“হ্যাঁ জ্যেষ্ঠা।” একটা ধাতুর পাতলা তক্তি তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরেন প্রত্নতাত্ত্বিক দুই, “এর পর আমাদের কর্তব্য কি জ্যেষ্ঠা?”
“পরগাছা নির্মূল করা।” শীতল কণ্ঠে উত্তর দেন দণ্ডদাত্রী “সংঘের অন্যতম প্রজাতি আমরা, নিরাসক্ত নিরপেক্ষতার অজুহাতে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারি না।”
১২
সকালে উঠেই একটা ভিডিয়ো কল করেন বসুন্ধরা। “মাসি, রীতুকে ছাড়তে আসছি। সব রেডি রেখো।”
কেন রীতুকে বসুন্ধরা ছাড়তে আসবেন সে কথা জানতে চান না বৃদ্ধা। উত্তরটা তাঁর ভালোই জানা আছে। তিন মাসের মধ্যে কেউ সন্তানের জন্ম দিলে তাকে কাজটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই করতে হয়। না হলে সে যে আদতে এই পৃথিবীর কেউ নয়, সে কথাটাকে গোপন রাখা যায় না। তিনি শুধু জানতে চান, “কবে আসবি?”
“দু-তিন দিনের মধ্যেই। কয়েকটা কাজ শেষ করার আছে। আর তা ছাড়া এখনই হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে নানা জনে নানা প্রশ্ন করবে।”
দুপুরের দিকে বসুন্ধরা যাওয়ার জন্যে জামাকাপড় গোছাচ্ছেন, হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে।
দরজা খুলে চমকে ওঠেন বসুন্ধরা। তাঁর সেমিনারের সেই প্রশ্নকর্তা। মাথায় ক্যাপ, ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি।
“বাকি আলোচনাটা সেরে ফেলতে আপনার বাড়িতেই এসে পড়লাম ম্যাম!”
বুকের ভেতরের আতঙ্কটাকে দাবিয়ে রেখে গলার স্বরটাকে প্রয়োজনের চাইতে চড়িয়ে দেন বসুন্ধরা, “আমি এখন ব্যস্ত আছি। কারোর সঙ্গে বাজে কথা বলার সময় নেই।”
“কারোর সঙ্গে না থাক, আমার সঙ্গে বলার জন্যে আছে।” একটা মোবাইল ফোন বসুন্ধরার মুখের সামনে তুলে ধরে লোকটা।
চমকে এক পা পিছিয়ে যান বসুন্ধরা। মোবাইলের স্ক্রিনে একটা ছবি। একটা নিষ্প্রাণ গাছ তার শুকনো ডালপালা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে একটা উজ্জ্বল গোলককে।
“ভয় পাবেন না। আপনার কোনো ক্ষতি আমরা করতে চাই না। অন্তত এই মুহূর্তে না।” একটা নিশ্বাস নেয় লোকটা। “আমাদের একটা প্রস্তাব আছে। আপনি যদি সেটা শোনেন তাহলে ভালো হয়।”
নিজেকে সামলে নেন বসুন্ধরা। এই বিপদ থেকে বেরোনোর একটাই রাস্তা আছে। গলার স্বর যথাসম্ভব নামিয়ে এনে বলেন, “ঠিক আছে। কিন্তু এখানে নয়। মেয়ে বাড়িতে আছে।”
“তাহলে কোথায়?”
“স্টেশনে চলুন। এই সময়টা ফাঁকা থাকে।”
স্টেশনটা বসুন্ধরার বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। নির্জন প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে লোকটাকে সঙ্গে করে ফুটব্রিজে উঠে আসেন বসুন্ধরা। “বলুন।”
বসুন্ধরার চোখে চোখ রাখে লোকটা। “ইতিহাসটা আপনি জানেন, তাও একবার ঝালিয়ে নিই। যে গ্রহে আপনাদের উৎপত্তি সেখানে আপনাদের পূর্বসূরীরা যোগ্যতমের টিকে থাকার মতবাদকে বিজ্ঞান থেকে রূপান্তরিত করে ফেলেছিলেন এক রকমের ধর্মবিশ্বাসে।”
“ধর্ম নয়। ওটা আমাদের আদর্শ। কারণ ওটাই সত্য।” উঁচু গলায় প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন বসুন্ধরা।
হাত তুলে বাধা দেয় লোকটা। “সে আপনি মনে করতেই পারেন। কিন্তু এই তর্কে এখন আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাকি ইতিহাসটুকু বলি। খুব সম্ভব অতিরিক্ত সৌর বিকিরণের ফলে বহু বছর আগে সেই গ্রহে নারীদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। এই সমস্যার অনেকরকম সমাধান হতে পারত। কিন্তু যোগ্যতমের টিকে থাকার মতবাদের ভ্রান্ত ধারণা তাঁদের নিয়ে গেল এক বিকৃতির পথে।”
তিক্ততায় মুখ বেঁকে যায় বসুন্ধরার, “বিবর্তনে বিকৃতি বলে কিছু হয় না। বিবর্তনের একটাই উদ্দেশ্য—”
মাথা নাড়ে লোকটা, “নিজেদের জিনগুলোকে টিকিয়ে রাখা। আর টিকিয়ে রাখার অধিকার কেবল যোগ্যতমের। আপনাদের ওই যুক্তির সঙ্গে আমার ভালোই পরিচয় আছে। সে যাকগে, বাকিটা শুনুন। নিম্নস্তরের কীটপতঙ্গ এবং কিছু প্রাণীর মধ্যে সঙ্গমের পর স্বজাতি ভক্ষণের চরিত্র লক্ষ করা যায়। স্ত্রী প্রাণীটি সঙ্গমের পর পুরুষটিকে খেয়ে ফেলে। এবং তার শরীর থেকে পাওয়া পুষ্টি কাজে লাগায় সন্তানকে বড়ো করে তুলতে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের ব্যবহারে সে ক্ষমতা আপনার পূর্বসুরীরা নিজেদের শরীরে প্রতিস্থাপিত করলেন। আপনাদের প্রজাতিতে পুরুষরা স্বল্পায়ু, দুর্বল। এর আগে পুরুষ মৌমাছির মতো জিন বৈচিত্রের জোগান দেওয়া ছাড়া তাদের কোনো বিশেষ ভূমিকা ছিল না। কিন্তু পরিবর্তনের পর তারা হয়ে দাঁড়াল ভক্ষ্য। গর্ভের সন্তানে বৃদ্ধিকে তরান্বিত করতে তাদের শরীর ব্যবহৃত হয়ে উঠল পোষণের পুঁজি হিসেবে।”
গর্জন করে ফুটব্রিজের নীচ দিয়ে ছুটে যায় একটা মেল ট্রেন। বসুন্ধরার মনের মধ্যে তাঁর পরের পদক্ষেপটা দানা বাঁধতে থাকে। সুযোগ না আসা অবধি কথা বলতে দিতে হবে লোকটাকে।
“আপনার এই অলীক কল্পনা কেউ মানবে না।”
“সে না মানুক। তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। ইতিহাসের বাকিটুকু শুনে নিন। এই স্বজাতি ভক্ষণের ফলে কিছুদিন বাদে দেখা দিল একটি অবাঞ্ছিত কুফল। ধীরে ধীরে আপনাদের প্রজাতিতে পুরুষ জন্মানো বন্ধ হয়ে গেল। বিজ্ঞান হয়তো এরও কোন পথ দেখাতে পারত, কিন্তু আপনাদের পূর্বসুরীদের গোঁড়ামি তখন তুঙ্গে। তাঁদের মনে হল প্রজাতির নিরবচ্ছিন্নতা আর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যে সভ্যতা, সমাজ এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। ছায়াপথের কোনো গ্রহে যেখানে ধীমান প্রাণীর বাস সেখানে তাদের সমাজে মিশে গেলেই হল। কেবল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের সাহায্যে তাদের পুরুষদের সঙ্গে মিলনে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতাটুকু অর্জন করে নিলেই তাদের মধ্যে থেকেই আপনারা টিকিয়ে রাখতে পারবেন আপনাদের প্রজাতিকে।”
“এ সমস্ত কথা আপনি জানলেন কী করে?”
“বহু বছর আগে আমাদের একটা দল আপনাদের গ্রহটা আবিষ্কার করে। ততদিনে আদি গ্রহ ছেড়ে আপনার পূর্বসুরীরা হাওয়া উড়ে যাওয়া বীজের মতো ছড়িয়ে পড়েছেন ছায়াপথের দিকে দিকে। স্বাধীন সভ্যতা থেকে তাঁরা পরিবর্তিত হয়েছেন পরজীবী এক প্রজাতিতে।”
দূর থেকে একটা হালকা গর্জন কানে আসে বসুন্ধরার। আর একটা মেল ট্রেন আসছে।
“আপনারা ঠিক কারা বলুন তো?”
“আমরা আপনাদের মতোই এক ধীমান প্রজাতি। ছায়াপথের এক বিশাল গণসংঘের অন্যতম সদস্য। আমাদের ওপর একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
“কী দায়িত্ব?” জানার ইচ্ছে না থাকলেও, লোকটাকে অন্যমনস্ক করার জন্যে প্রশ্ন করেন বসুন্ধরা
একটা ক্রুর হাসি খেলে যায় লোকটার মুখে, “নবীন ধীমান প্রজাতিরা যাতে টিকে থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যে আগাছা সাফ করা।”
“আমাকে কী করতে হবে?”
হাত নাড়ে লোকটা, “আমার সঙ্গে চলুন। এই পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় আমাদের গোপন আস্তানা আছে। আপনারা সেখানে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেন।”
লোকটার মনে কোনোরকম সন্দেহ না জাগিয়ে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখেন বসুন্ধরা। ফুটব্রিজ জনশূন্য। একটাও লোক নেই।
“মানে বাকি জীবনটা আমাকে আর আমার মেয়েকে জেলবন্দি হয়ে কাটাতে হবে?”
হাত নাড়ে লোকটা, “একরকম প্রায় তাই। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় কি? পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে আমরা আপনাদের থাকতে দিতে পারি না।”
গর্জনটা জোরালো হয়। মেল ট্রেনটা প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে।
“না।” একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করে বসুন্ধরা শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে দু-হাতে আঁকড়ে ধরেন লোকটাকে। তাঁর দৈহিক বল পৃথিবীর মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। লোকটা কিছু বুঝতে পারার আগেই তার শরীরটাকে উঁচু করে ব্রিজের রেলিং টপকে ফেলে দেন দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা ট্রেনের সামনে।
কী হল দেখার জন্যে আর দাঁড়ান না বসুন্ধরা, একরকম ছুটতে ছুটতে ফিরে আসেন বাড়িতে। হ্যাঁচকা টানে কয়েকটা সুটকেস বের করে এনে তাদের মধ্যে জিনিসপত্র ঠাসতে থাকেন পাগলের মতো। কেবল রীতু নয়, এ জায়গা থেকে তাকেও বিদায় নিতে হবে।
তিনি সুটকেসে কাপড়জামা ভরছেন, আচমকা আবার কলিং বেল বেজে ওঠে। হৃৎপিণ্ডটা যেন ছলকে ওঠে বসুন্ধরার, শরীরটা অবশ হয়ে আসতে চায়।
কিন্তু তিনি কি করবেন ভেবে উঠতে পারার আগেই বাইরের দরজা খোলার শব্দ হয়।
“কে এলো রে রীতু?” হাঁক দেন তিনি।
রীতু এসে হাজির হয়। “গ্যাসের সিলিন্ডার দিতে এসেছে মা। বললো তুমি নাকি দিয়ে যেতে বলেছিলে।”
দু-দিন আগে হিন্দ গ্যাস থেকে আসা ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায় বসুন্ধরার। প্রথমে ভাবেন তাকে চলে যেতে বলবেন। তারপরে মনে হয় অহেতুক সন্দেহ বাড়িয়ে লাভ নেই। ছেলেটাকে নিজের মতো করে কাজ করে চলে যেতে দেওয়াটাই ভালো।
বাইরে থেকে সিলিন্ডার গড়িয়ে আনার শব্দ হয়।
“ঠিক আছে। তুই ততক্ষণ আমাকে হেল্প কর।”
রীতুকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুতগতিতে সুটকেশ গোছাতে থাকেন তিনি।
কিছুক্ষণ বাদে তাঁর খেয়াল হয় গ্যাস দিতে আসা ছেলেটার কথা তিনি ভুলে গেছেন।
“রীতু, দেখে আয় তো ছেলেটা চলে গেছে কি না।”
কয়েক মুহূর্ত বাদে রীতুর ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে আসে, “মা!”
দৌড়ে গিয়ে বসুন্ধরা যা দেখেন তাতে আতঙ্কে তাঁর শরীর হিম হয়ে আসে। দরজার সামনে একটা নয়, জড়ো করা অন্তত গোটা পাঁচেক সিলিন্ডার। আর তাদের একটার গায়ে লাগানো একটা ডিজিটাল ঘড়ির মতো ডিসপ্লেতে লাল রঙের সংখ্যাগুলো কমতে কমতে দ্রুত শূন্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দরজার সামনের বাতাস ভারী হয়ে আছে গ্যাসের গন্ধে।
বসুন্ধরার আতঙ্কের চিৎকারটা গলাতেই রয়ে যায়। তার আগেই একটা ভয়ানক বিষ্ফোরণে আগুনের প্লাবন গ্রাস করে ফেলে তাঁকে।
১৩
“সভ্যতার শিখরে উঠলেও সেখান থেকে যে দ্রুত নীচে পতন হতে পারে, এই গ্রহ তার প্রমাণ।” সবার দিকে তাকিয়ে বলেন অভিযান প্রমুখ। “প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে প্রাণীরা ধীমান হয়, সভ্যতা গড়ে তোলে। আর সেই বহু কষ্টে অর্জিত সভ্যতাকে গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে এরা সঁপে দিয়েছিল প্রকৃতির হাতে।”
“কিন্তু জেষ্ঠ্যা, বিবর্তনের বিজ্ঞানে তো কোনো ভুল নেই।” মন্তব্য করেন জীববিজ্ঞানী।
একটা লম্বা নিশ্বাস নেন অভিযান প্রমুখ, “না নেই। আমাদের জৈবিক প্রকৃতি হয়তো আমাদের স্বার্থপর হতেই পরামর্শ দেয়। কিন্তু আমাদেরকেই বা যে তার দাসত্ব করতে হবে তারই বা কি অর্থ আছে?”
হাওয়ায় ভাসে অরণ্য কবলিত এক ধ্বংসপ্রায় নগরীর ছবি। তার দিকে ইঙ্গিত করেন অভিযান প্রমুখ, “যদি এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলতে হয়, যেখানে সমষ্টির মিলিত অভীষ্টের জন্যে প্রতিটি ব্যক্তি উদার, নিঃস্বার্থ ভাবে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে, তার জন্যে জৈবিক প্রকৃতির কাছে থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে সামান্যই। জৈবিক প্রকৃতির বশংবদ হয়ে পড়লে এই পরিণতি অবশ্যম্ভাবী।
Tags: গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সুমিত বর্ধন
যথারীতি অসামান্য লেখা। এগুলো থেকে যে ভাববার মতো কত কী পাওয়া যায়…!
হ্যাটস্ অফ, সুমিতদা। সেলাম নিয়েন।
অসামান্য লেখা। ভাবনাটা নতুন, বিশদ ব্যাখ্যায় স্তরে স্তরে উঠে এসেছে!
অসম্ভব ভালো একটি লেখা। নেচার কালচার প্রতর্কে চিন্তাশীল রসদ হয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে এই গল্পের। একদিকে প্রবৃত্তি ও প্রকৃতির নিরলস অনুসরণ আসলে এক ভিন্নতর ধর্মের অথবা সংস্কৃতির জন্ম দেয়। আবার প্রবৃত্তিগত স্বার্থপরতা এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করে যা প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় মানব প্রজাতিকে। এ তো শুধু গল্প নয় তথাকথিত উন্নত মানুষের সভ্যতার রূপক। নিজে টিকে থাকতে আজ মানুষ এমনই এক প্যারাসাইট যা অচিরেই অপরের ও নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে এই প্ল্যানেট জুড়ে মহামারীর মতো শুধু নিজে টিকে থাকবে ও অপরকে ব্যাবহার করবে বংশ বিস্তারে এই উদ্দেশ্য নিয়ে। আসলে সামাজিক ডারউইনবাদ বিবর্তনের ভুল ব্যাখ্যা। আমি যেটুকু ডারউইন বুঝেছি তাতে বিবর্তন এমনই এক প্রক্রিয়া যা প্রতিটি স্পিশিসকে একে অপরের সাথে যুক্ত করে। সুমিত বাবু কুর্নিশ আপনাকে। বাংলা কল্পবিজ্ঞান শুধু নয়, বিজ্ঞান চিন্তাকেও এই গল্প এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
চমৎকার একটি লেখা। বিবর্তনের ধারণা এমন একটা মোড় নিচ্ছে যেখানে গল্পটা একটা আয়না হয়ে উঠছে। এ তো আমাদের ই প্রবৃত্তির বিবরণ। অনিবার্য আপোক্যালিপটিক ভিশন এর সাথে বেঁচে থাকার আশার আলো কে অভিনব ভাবে মিলিয়েছেন লেখক।
নতুন ভাবে ভাবতে শেখালো এই গল্পটা। খুব ভালো সুমিত বাবু