এক প্রহেলিকার জন্ম
লেখক: সুমন সেন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বিঃদ্রঃ- এই গল্পটি কল্পবিশ্ব পত্রিকার “তৃতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা”য় প্রকাশিত আমার গল্প “সময়ের আতঙ্কে”(https://kalpabiswa.in/article/%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%87/)-এর পরবর্তী অংশ। সুতরাং, কেউ চাইলে এটা পড়ার আগে ওটা পড়ে নিতে পারেন। তবে ওটা না পড়া থাকলেও এটা বুঝতে কোনোরকম অসুবিধা হবে না।
এক
১৯৮১ সাল, ব্যারাকপুর:
গঙ্গার ঘাটে বসে ছেলেটা দেখেই চলেছে নদীটার বয়ে চলা। তার চোখ রক্তাভ আভা ধারণ করেছে। মাঝে মাঝেই অক্ষিপল্লব বেয়ে বড়ো বড়ো জলের ফোটা গড়িয়ে আসছে। বহু চেষ্টা করেও সেগুলোকে ধরে রাখতে পারছে না সে। মাঝে মাঝে জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিতে হচ্ছে। এভাবে বছর বিশেকের একটা ছেলেকে কাঁদতে দেখলে সবাই ব্যঙ্গই করবে।
সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে তার। এমনটা ঘটে যাবে সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। কেন? কেন? এত চেষ্টার পরেও কেন সে একটু শান্তির মুখ দেখতে পাচ্ছে না? দিনের পর দিন এত নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কেউ কি বাঁচতে পারে? কী দোষ করেছে সে? তার সঙ্গেই কেন এরকম হচ্ছে বারবার?
নিত্যগোপালবাবু অনেক্ষণ ধরেই ঘটনাটা লক্ষ করছিলেন। ছেলেটার মতি-গতি ঠিক মনে হচ্ছে না। দেখে তো ভদ্রবাড়ির সন্তান বলেই মনে হচ্ছে! কোনো মানসিক অশান্তিতে ভুগছে হয়তো! এভাবে গঙ্গার পাড়ে এসে বসেছে— ভালো-খারাপ কিছু করে ফেলবে না তো! এখনকার ছেলে-পিলেরা বড়োই অধৈর্য। ব্যর্থতা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এই ছোঁড়াটার মতলবটা জানা অবশ্যই দরকার।
নিত্যগোপাল ব্যানার্জী প্রতিদিন এই ঘাটে এসে স্নান, আহ্নিক সারেন। তারপর সোজা বাড়ি গিয়ে অফিস যাবার জন্য প্রস্তুত হন। আজ এই অচেনা ছেলেটাকে দেখে একটু বেশি সময়ই যেন থেকে গেলেন গঙ্গার ঘাটে। নিজের কাজ করতে করতে আড়চোখে লক্ষ করতে থাকেন ছেলেটার হাবভাব। কিন্তু আর দেরি করা যাবে না। তাহলে ওদিতে অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে, যা সময়নিষ্ঠ নিত্যগোপালবাবু মেনে নিতে পারবেন না। তিনি উঠে সোজা ছেলেটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি কিছু সমস্যা হয়েছে? আমায় তুমি বলতে পারো… যদি আমি তোমার কোনো সাহায্য করতে পারি…”
এই উটকো ঝামেলার জন্য ছেলেটা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। লোকটা তার অবস্থা দেখে কিছু আঁচ করতে পেরেছে নিশ্চয়ই। সে কী বলবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল লোকটার মুখের দিকে। তারপর বলল, “আসলে… আমার স্কুল-পাশের সমস্ত মার্কশীট, সার্টিফিকেট, মানি পার্স, এমনকি সমস্ত পরিচয়পত্রও হারিয়ে গিয়েছে আজ। আমি সেগুলো একটা ব্যাগে ভরে ট্রেনে করে আসছিলাম এদিকে। ব্যাগটাই ট্রেনে ফেলে রেখে চলে এসেছি। ট্রেন নাম্বারও আমার জানা নেই…”
“তা তুমি থাকো কোথায়?” নিত্যগোপালবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
ছেলেটা যেন একটু ভেবে বলল, “শিলিগুড়ি। আমার একটা কাজের ইন্টারভিউ ছিল এদিকে, আসতে গিয়েই সর্বনাশটা হল।”
“আচ্ছা, এই ব্যাপার তাহলে! তুমি চিন্তা কোরো না, আমার সঙ্গে এসো। আমি দৈনিক খবরের কাগজগুলোতে বিজ্ঞাপন দেবার ব্যবস্থা করছি। লোকাল থানাতেও জানিয়ে রাখছি। কেউ যদি তোমার জিনিস পেয়ে থাকে তাহলে নিশ্চই ফিরে পাবে। আর যতদিন সেগুলো ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না ততদিন আমার বাড়িতে থেকে যেও। কেমন?” নিত্যগোপালবাবু ছেলেটিকে শান্তনা দিয়ে বললেন। যদিও তিনি মনে মনে সন্দীহান রইলেন— ছেলেটা আদৌ সত্যি বলছে তো!
কিছুক্ষণ ভাবল ছেলেটা। আর তো কিছু করারও নেই তার। পুরো জায়গাটাই কেমন অচেনা লাগছে তার কাছে। এই ব্যারাকপুরের যেই জায়গাটায় সে থাকত সেটা এখন একটা ফাঁকা মাঠ হয়ে পড়ে আছে। সহায়-সম্বলহীন, আশ্রয়হীন তার কাছে এই লোকটা এরকম একটা প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তো আসলেই দেবদূত হয়ে! হাতের মুঠোয় চেপে ধরে রাখা অদ্ভুত যন্ত্রটাকে লোকটার চোখের আড়াল দিয়ে খুব সন্তর্পনে পকেটস্থ করল সে।
“তাহলে… কী সিদ্ধান্ত নিলে?” লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল।
“আচ্ছা… চলুন…” ছেলেটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠে দাড়াল।
নিত্যগোপালবাবু প্রফুল্লতার হাসি হেসে, “বাহ্… সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ।” বলে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুটা গিয়েই আবার থমকে দাঁড়ালেন। পিছন ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “এই দেখ… তোমার নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হল না…”
“মৃ…” বলেই যেন আটকে গেল ছেলেটা। তারপর কিছু একটা ভেবে বলল, “মৃন্ময়… আমার নাম মৃন্ময় মুখার্জী। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ কাকাবাবু। একজন অপরিচিত ছেলের জন্য আপনি যা করলেন…!”
“এই দেখ… বামুনের ছেলে বলে কথা… সে বিপদে পড়েছে, আর আমি তাকে এটুকু সাহায্য করতে পারব না?” নিত্যগোপালবাবু হাসতে হাসতে বললেন।
***
২০১৭ সাল, ব্যারাকপুর:
স্মার্টফোনের যুগে এই অদ্ভুত কোম্পানির অদ্ভুত গুণ-সম্পন্ন কী-প্যাড ফোনটা হাতে নিয়ে বারে বারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে মৃদুল। এই ফোনটা, যেটা আসলে একটা ছোটো টাইম মেশিন— তার জীবনে আসার পর থেকে জীবনটা যেন আরো বেশি জটিল করে তুলেছে। আগে অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে তার দুর্ভাগ্যটাকে সে যেমন মেনে নিতে পারত, এখন আর তা পারে না। এখন মাঝে মাঝেই একটা একরোখা জেদ জন্মায় মনে— খারাপ ভবিষ্যতকে পালটাতেই হবে, যে কোনো মূল্যেই হোক। এই যেমন কয়েকদিন ধরে এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে যাতে তার সরকারি চাকরি পাবার সম্ভাবনাটা হাতের বাইরেই চলে গিয়েছে প্রায়। ফোনটার সাহায্যে বহুবার অতীতে গিয়ে সে তার আসন্ন ভবিষ্যতটাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো না কোনোভাবে সেই সরকারি চাকরি পাওয়ায় বাধা সৃষ্টিকারী একটা ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।
ছোটোবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে বড়ো হয়েছে সে। মেধা থাকা সত্ত্বেও অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। বছরখানেক হল একটা মোবাইল ফোন সারানোর ব্যাবসা খুলেছে সে, আর টুকটাক কম্পিউটার শেখায় বাচ্চাদের। তার মায়ের বয়স হয়েছে। চোখে ভালো দেখতে পায় না। সেলাইয়ের কাজে আগে যতটা সাবলীল ছিল— সেটা এখন যেন একটু দমে গিয়েছে। বাবাকে তো জন্মের পর থেকে কোনোদিন দেখেইনি মৃদুল। সুতরাং, চাকরি পাওয়াটা তার কাছে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে যতই ভবিষ্যত পরিবর্তন করার চেষ্টা করুক না কেন— একটা না একটা বিপদ এসে তার আর চাকরির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেই প্রতিবার। একসময় বিরক্ত হয়ে সে হাল ছেড়েও দিয়েছিল। কিন্তু আজ যখন সেলাই করতে গিয়ে মেশিনের ছুঁচটা হাতে লেগে ফুটো হয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল তার মায়ের— তখন আর কিছুতেই সে তার মাথা ঠিক রাখতে পারল না। এত কষ্ট আর মেনে নেওয়া যায় না। ভবিষ্যত তাকে পরিবর্তন করতেই হবে। একবার শেষ চেষ্টা করেই দেখা যাক!
মোবাইল ফোনটার ক্যালেন্ডার খুলে এবার সে অতীতের একটু দূরবর্তী সময় সেট করে ফেলল, একটু অন্যমনস্কভাবেই। ১৯৮১ সাল। তারপর চেপে দিল ওকে বাটন।
সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে একটা কাঁপুনি বয়ে গেল মৃদুলের। যখন কাঁপুনি থামল। তখন দেখল আশপাশটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে যেইমাত্র তারিখটা চোখে পড়ল তেমনি মুখ দিয়ে “চুক্-চুক্” করে একটা অনুশোচনামূলক আওয়াজ করল সে। ২৮ মে, ১৯৮১। এতটা পিছনে আসার তো দরকারই ছিল না! এখন কী করা যায়! এই সময়ে তো তার জন্মও হয়নি!
ফোনের ক্যালেন্ডারটা খুলে আবার সে একটা দিন সেট করল— ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০। তারপর ওকে বাটন চেপে দিল। কিন্তু আশ্চর্য! ফোনটা আর কাজ করছে না! শরীরে কোনোরকম কাঁপুনিও অনুভব হচ্ছে না তার। আশপাশের জিনিস যেমন ছিল তেমনই আছে। ফোনে তারিখ দেখাচ্ছে ২৮ মে, ১৯৮১। দু-তিনবার আরো চেষ্টা করল সে। ফোন সুইচ-অফ করে দেখল, ফোনের ব্যাটারিটা খুলে আবার লাগিয়ে দেখল— কিছুতেই ফোন আর কাজ করছে না। প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেল এভাবে চেষ্টা করতে করতে। একসময় ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়ে ফোনটা নিজে থেকেই সুইচ-অফ হয়ে গেল। সর্বনাশ! চার্জার তো সে সঙ্গে আনেনি! আর এটা ১৯৮১ সাল। এই মোবাইল ফোনের চার্জার সে আর পাবে কোথায়!
যেটা মৃদুল সেদিনও বুঝতে পারেনি, সেটা হল ফোনটা আসলে কাজ করে কীভাবে? তারিখ সেট করে ওকে বাটনে চাপ দিলেই ফোনটার ভিতরে একটা হাই-ফ্রিকোয়েন্সি পালস তৈরি হয়। আশপাশের মোবাইল ফোনের টাওয়ারগুলোর দ্বারা সেই ফ্রিকোয়েন্সি রিসিভ হয় এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত সমস্ত কণাগুলো আয়নিত হয়ে একটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। যার ফলে সেখানে একটা দরজা খুলে যায় সময়-সরণিতে পাড়ি দেবার জন্য। কিন্তু উক্ত সময়ে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য মোবাইল ফোন বাজারেই আসেনি। সুতরাং, ফোনের টাওয়ারই বা কোথায়?
এখন অনেকের মনে হতে পারে— সেই সময়ে ফোনের টাওয়ারের অস্তিত্ব যদি নাইই থাকে তাহলে মৃদুল সেই সময়ে পৌঁছোলো কীভাবে? প্রশ্নকারীদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি— এই প্রক্রিয়ায় সময়-সরণিতে পাড়ি দেবার দরজাটা হয় অনেকটা একমুখী ভাল্ভের মতো। যার মাধ্যমে বরাবরই শুধু একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়া যায়, ফিরে আসা যায় না। ফিরে আসতে গেলে আবার নতুন দরজা খুলতে হয়। একপাশের দরজা খোলার কাজ ২০১৭ সালে ফোনের মাধ্যমে সৃষ্ট ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড করে দিয়েছে। কিন্তু অন্যপাশে যাবার পর সেখানে যথাযথ উপকরনের অভাবে আরেকটা দরজা খুলে মৃদুল ফিরে আসতে পারেনি।
***
১৯৮১ সাল, ব্যারাকপুর:
“ইলা… শুনছ?… কই গো… একবার এদিকে এসো…” মৃন্ময়কে সঙ্গে নিয়ে নিত্যগোপালবাবু বাড়ির দরজায় এসে ডাকাডাকি করেন।
স্ত্রী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজায় দাঁড়াতেই, নিত্যগোপাল বাবু মৃন্ময়কে দেখিয়ে বলেন, “এই যে ওকে দেখছ… ওর নাম মৃন্ময়। ও এখন থেকে কিছুদিন আমাদের সঙ্গেই থাকবে। আমাদের স্টোর রুমটাতে তো বিশেষ কিছু নেই… ওখানে একটা চৌকি পেতে দেব, ওর বিছানা রেডি করে দিও তো…”
ইলা দেবী মৃদু হেসে মৃন্ময়কে ভিতরে বসতে বললেন। এবং নিত্যগোপালবাবুকে একবার রান্নাঘরে আসতে বললেন।
নিত্যগোপালবাবু রান্নাঘরে যেতেই ইলা দেবী ফিস্ফিস্ করে বলেন, “কে ওটা? কোথা থেকে ধরে নিয়ে এলে? চেনো না জানো না তাকে আমাদের বাড়িতে রাখবে বলছ? আর ছেলেটা জামাকাপড় কীরকম পরেছে দেখেছ? আমাদের এখানে কে পরে ওরকম জামাকাপড়? প্যান্টটা দেখেছ? কিরকম জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া, ভিতরের চামড়া দেখা যাচ্ছে! লজ্জা-শরম নেই নাকি? আর তোমারও বলিহারি… ঘরে একটা বয়স্কা মেয়ে আছে, আর তুমি একটা রাস্তার ছেলেকে ধরে নিয়ে চলে এলে বাড়িতে রাখবে বলে?”
“আরে থামো থামো… এত প্রশ্ন একসঙ্গে করলে আমি উত্তর দেব কীভাবে? ছেলেটার উপর দিয়ে আজ একটা বড়ো ঝড় বয়ে গেছে। ও শিলিগুড়ির ছেলে। একটা ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে করে আসছিল; তাতে ওর সমস্ত সার্টিফিকেট, মানি পার্স সবকিছু ছিল। সেই ব্যাগটাই হারিয়ে গেছে। আমি ওকে কথা দিয়েছি সেগুলো খোঁজার ব্যবস্থা করে দেব। যতদিন খুঁজে না পাচ্ছে— ততদিন আমাদের এখানে থাকবে।” নিত্যগোপালবাবু বললেন।
“আর ছেলেটা যদি কোনো সন্ত্রাশবাদী দলের লোক হয়? খবরে দেখ না— সন্ত্রাশবাদীরা এখন ছোটো ছোটো ছেলেকে দিয়েই খারাপ কাজ করায়। ওকে তো দেখে মনেই হচ্ছে না ও আমাদের দেশের লোক!”
“কই আমার তো দেখে খারাপ কিছু মনে হল না… আর ওর প্যান্টটা হয়তো কিছুতে খোঁচা লেগে ছিঁড়ে গেছে। তোমাকে বললাম না ওর উপর দিয়ে আজ অনেক ধকল গেছে।”
“হ্যাঁ, তুমি তো সবজান্তা… খোঁচা লেগে এক জায়গায় ছেঁড়ে, চোদ্দো জায়গায় নয়। নিশ্চই কারুর সঙ্গে মারামারি করে এসেছে। তোমার এই পরোপকারী মনোভাব দেখো তোমায় একদিন বিপদে না ফেলে…”
গোমরা মুখ করে ইলা দেবী স্টোর রুমটা পরিষ্কার করতে চলে গেলেন। নিত্যগোপাল বাবু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ন-টা পেরিয়ে গেছে। অন্যান্য দিন এই সময়ে অফিসের পথে থাকেন। আজ এখনো খাওয়াই হল না। অর্থাৎ আজ আর অফিস যাওয়া হবে না।
***
“কম্পিউটার! কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানো তুমি?” নিত্যগোপালবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন মৃন্ময়কে।
প্রায় তিন মাস কেটে গিয়েছে মৃন্ময় নিত্যগোপালবাবুর বাড়িতেই আছে। নিত্যগোপালবাবু প্রায় সব কটি বড়ো খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন মৃন্ময়ের হারিয়ে যাওয়া জিনিস খোঁজার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এতদিন কেটে যাওয়া সত্ত্বেও সেগুলোর কোনো রকম খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি নিয়মিত লোকাল থানাতেও যোগাযাগ রেখেছেন এতদিন। কিন্তু কিছুতেই কোনো ফল হয়নি। এই কদিনে ইলা দেবীও মানিয়ে নিয়েছেন মৃন্ময়কে। ওঁদের চৌদ্দ বছরের কন্যা পাপড়িও পড়াশোনা সম্পর্কিত যেকোনো সমস্যা নিয়ে মৃন্ময়ের কাছে আসে সমাধানের জন্য। এখন বলতে গেলে সে এই ব্যানার্জী বাড়িরই একজন সদস্য। আজ রাতে সকলে মিলে খেতে খেতে হঠাৎ নিত্যগোপালবাবু মৃন্ময়ের অতীত ও পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে জানায় – সে কম্পিউটার জানে।
“হ্যাঁ, কাকাবাবু… কম্পিউটার ব্যবহার করতে তো আমি জানিই, তা ছাড়াও কম্পিউটারের যে কোনো সমস্যার সমাধানও আমি করতে পারি।” মৃন্ময় বলল।
“বল কি হে! কম্পিটার রিপেয়ার করতে পারবে?” নিত্যগোপালবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ, পারব।” মৃন্ময় বলল।
নিত্যগোপালবাবু গর্বের চোখে একবার ইলা দেবীর দিকে দেখে নিলেন। তারপর আবার মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদের অফিসেও বছর দুয়েক হল কম্পিউটার এসেছে, বুঝলে? যদিও আমি ওসব পারি না। আমার জন্য টাইপ মেশিনই ঠিক আছে। তবে যারা কম্পিউটারে কাজ করে কোম্পানি তাদের ভালো মাইনা দেয়। আর কম্পিউটারে কোনো সমস্যা হলে বাইরে থেকে লোক ডাকতে হয়। তাদের আবার হাই ডিমান্ড! তাদের খুশি রাখতে কোম্পানি শুধু মোটা টাকাই দেয় না, তাদের খুব যত্ন-আত্তিও করে। তা… তুমি তো এখানে কাজের সন্ধানেই এসেছিলে… তাই না? তুমি কতটা কাজ জানো আমি পুরোপুরি জানি না, তবে আমি যদি সুপারিশ করি তাহলে আমাদের অফিসে তুমি নিশ্চই একটা কাজ পেয়ে যাবে… করবে?”
“হ্যাঁ, কাকাবাবু। নিশ্চই করব।” মৃন্ময় খুশি হয়ে বলল।
***
“কাকাবাবু… আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন, আর একটা উপকার যদি করেন খুব ভালো হয়…” মৃন্ময় বলল নিত্যগোপাল বাবুকে।
প্রায় বছরখানেক কেটে গিয়েছে মৃন্ময় এখানে আছে। এখন সে নিত্যগোপালবাবুর কোম্পানিটাতেই কাজ করে এবং ভালো মাইনাও পায়। এর মধ্যে সে নিত্যগোপালবাবুর সাহায্যে নতুন পরিচয়পত্রও বানিয়ে নিয়েছে। অফিসে তার খুব খাতির। স্বয়ং মালিকের নেক নজর আছে তার উপর। কোম্পানিতে একটা স্থায়ী পদে হিসেব রাখার কাজও করে, আবার কম্পিউটারগুলো মাঝে মাঝে গণ্ডগোল করলে তা সারাইও করে। ভাগ্যিস ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেম-এর ব্যবহার, এবং মাউস ছাড়া কাজ করার অভ্যেস ছিল তার!
“হ্যাঁ, বল বাবা।” নিত্যগোপাল বাবু মুখের খাবারটা শেষ করে বললেন।
“আমাকে কম পয়সার মধ্যে ধারে-কাছেই একটা ভাড়া বাড়ি দেখে দিতে পারবেন? বছরখানেক তো আপনাদের ঘাড়ের উপরেই চেপে রইলাম। এখন তো আমার অল্প-স্বল্প রোজগার আছে, তাই আর আপনাদের কষ্ট দিতে মন চায় না।” মৃন্ময় বলল।
নিত্যগোপালবাবু যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন, তারপর হাসিমুখে বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চই! তুমি ইয়াং ছেলে… তোমার একটা সেপারেট জায়গা দরকার বৈকি! আমি কালকেই খোঁজ করছি। এছাড়াও একজন ঠিকের কাজের লোক আর একজন রান্নার লোকের ব্যবস্থা করেও দেব।”
***
দুই
১৯৯৬ সাল, ব্যারাকপুর:
নিত্যগোপালবাবুর মেয়ে পাপড়ির সঙ্গে মৃন্ময়ের প্রেমটা ওদের বাড়ি থেকেই শুরু হয়েছিল। তখন অবশ্য ব্যাপারটা শুধুই ভালোলাগা ছিল। পরে পরে সম্পর্কে গভীরতা বেড়েছে। একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া— এভাবে বহু বছর কেটেছে তাদের। যদিও আশপাশের অনেকেই নিশ্চিত ছিল ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে। তবে কেন জানা নেই মৃন্ময় খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছিল না। মেয়ের বয়স বাড়ছে বলে ইলা দেবী মৃন্ময়কে বিয়েটা সেরে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আশপাশের লোকেরা বাঁকা চোখে দেখে। তাদের কটুক্তিতে ইলা দেবীর মনেও মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে ভীতির প্রসার হচ্ছিল। পরের বছর ত্রিশ পূর্ণ হবে পাপড়ির। নিত্যগোপালবাবু মারা গেছেন মৃন্ময় ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার বছর দেড়েকের মধ্যেই। ক্যান্সারের কীট বাসা বেঁধেছিল তাঁর শরীরে। তারপর থেকে মৃন্ময়ই দেখাশোনা করত পাপড়ি আর ইলা দেবীর।
এই কয়েক বছরে মৃন্ময় যেন ভুলেই গিয়েছে সেই মোবাইল ফোনটার কথা, যেটা সঙ্গে নিয়ে সে প্রথমদিন এখানে এসেছিল। যেটা তার পর থেকে আর কোনোদিনও সে ব্যবহার করতে পারেনি। ৭-৮ বছর আগে অবশ্য একদিন পুরোনো জিনিসপত্র ঘাটতে গিয়ে ফোনটা হাতে পড়েছিল তার। একটা ক্যাসেট-প্লেয়ারের ব্যাটারি-চার্জারকে কায়দা করে ফোনের ব্যাটারিটার চার্জার বানিয়েছিল সে। চার্জ দিয়ে ওটা ব্যবহার করার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু সেদিনও সে ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর থেকে ওটা বন্দি হয়ে পড়ে আছে তার আলমারির গোপন দেরাজে। এখন পুরোনো সবকিছু ভুলে পাপড়িকে নিয়ে সুখেই আছে সে। পুরোনো কথা মনে করে লাভটাই বা কী? সে তো এমনই একটা সুখের জীবন চেয়েছিল! প্রেমিকার ভালোবাসা, আশপাশের লোকজনের সম্মান, ভালো চাকরি, তা নাই বা হোক সরকারি— মাইনা এবং অন্যান্য আয় তো খারাপ নয়! যেই ভালোবাসা, সম্মান সে কোনোদিন পায়নি; যেই সুখে সে কোনোদিন থাকতে পারেনি— হঠাৎ করে সেই সবকিছু পেয়ে গিয়ে সে ভুলেই গেল তার অতীতের অন্ধকার রহস্য। প্রথমদিকে মায়ের জন্য মনটা খারাপ করত তার। তবে যত দিন কেটেছে মায়ের স্মৃতি ততই আবছা হতে হতে হারিয়ে গেছে মৃন্ময়ের মন থেকে।
ইলা দেবীর প্রস্তাবটা ভেবে দেখেছিল সে, এবং আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলেছে পাপড়ির সঙ্গে।
***
১৯৯৭ সাল, ব্যারাকপুর:
খুব সুখেই দিন কাটছিল মৃন্ময় আর পাপড়ির। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বাচ্চাও আসে পাপড়ির পেটে। বাচ্চা আসার পর থেকে পাপড়ির খুব খেয়াল রাখে মৃন্ময়। তার যত্নের কোনোরকম ত্রুটি হতে দেয় না। দু-জন আয়াও রেখেছে সে সবসময় পাপড়ির দেখাশোনা করার জন্য। পাপড়ি এখন ন-মাসের গর্ভবতী।
কোনো এক রবিবার, মৃন্ময়ের অফিস ছুটির দিনে সে নিজের টেবিলে বসে কিছু একটা কাজ করছিল। এমন সময় পাপড়ি তার স্ফীত পেট নিয়ে মৃন্ময়ের পাশে দাঁড়ায় এবং মৃন্ময়ের একটা হাত নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখে। “দেখো বদ্মাশটার কাণ্ড!” বলে পাপড়ি।
মৃন্ময় হাসে।
তারপর হঠাৎ পাপড়ি বলে ওঠে, “এই… জানো তো… আমি ভেবেছি তোমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাচ্চার নাম দেব। ছেলে হলে মৃদুল, আর মেয়ে হলে মৃত্তিকা। ভালো না বলো?”
সঙ্গে সঙ্গেই যেন মৃন্ময়ের মুখের অভিব্যক্তি পালটে গেল! দ্রুত পাপড়ির পেটের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিল সে। এবং নিজেও কিছুটা পিছিয়ে গেল। তার চোখের সামনে যেন সারা পৃথিবীটা ঘুরপাক খেয়ে গেল একবার! গোটা মুখমন্ডল হতে দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে তার। আজ তারিখ তো ২ মার্চ ১৯৯৭। ১৩ মার্চ ১৯৯৭ তো তার নিজের জন্ম তারিখ। তার আসল জন্ম তারিখ। আর মৃদুল তো তারই আসল নাম! পাপড়ি বা পাপড়ির পরিবারের কেউ তো সেসব জানতও না কখনো! সে তো এত বছর ধরে এখানে মিথ্যা পরিচয়ে আছে! থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে মৃন্ময়।
স্বামীর এইরূপ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল পাপড়ি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি শরীর খারাপ করছে?”
মৃন্ময় কোনো উত্তর না দিয়ে একটু কাছে এগিয়ে এল। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে পাপড়ির ঘাড়ের কাছে চুলটা সরিয়ে দেখল। সর্বনাশ! ঘাড়ের ঠিক এই জায়গায়, ঠিক এরকমই একটা তিল তো তার মা তৃণা দেবীরও ছিল! এটা এতদিন তার চোখে পড়েনি কেন? মাথাটা যেন আরো জোরে জোরে ঘুরতে শুরু করল মৃন্ময়ের। বারবার একটা কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল—’ জ্ঞান হবার পর থেকে সে বহুবার তার মায়ের মুখে শুনেছে, তাকে নাকি একেবারে তার বাবার মত দেখতে। সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখ… যেই অতীতকে সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিল— সেই অতীত দুর্যোগের ঘনঘটা নিয়ে ভিড় করল মৃন্ময়ের জীবন আকাশে।
নিজেকে আর সামলাতে পারল না মৃন্ময়। মাথা ঘুরিয়ে সে চেয়ার থেকে নীচে পড়ে গেল।
***
মৃন্ময়ের যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে নিজেকে কোনো এক হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করল।
কোনোরকম টেস্ট-রিপোর্টেই খারাপ কিছু না থাকায় একবেলার মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে যায় সে। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকেই কেমন যেন পালটে যায় মৃন্ময়। ঘরে থাকা কমিয়ে দিল সে, বিশেষ করে পাপড়ির ধারে-কাছে থাকা। ছুটির দিনেও সে বাইরে বাইরেই দিন কাটিয়ে দিতে শুরু করল। একজন গর্ভবতী মহিলার যেটা সবথেকে বেশি দরকার—স্বামীর যত্ন ও ভালোবাসা, সেটার অভাব বোধ করতে শুরু করল পাপড়ি।
মৃন্ময় বোধ করল সে সত্যিই মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছে। “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু” প্রবাদটা সে ছোটোবেলা থেকেই শুনে এসেছে। আজ সেটা প্রত্যক্ষ করছে সে। তার সরকারি চাকরির লোভের জন্য সর্বশক্তিমান তাকে শাস্তিস্বরূপ এরকম একটা জীবন দিয়েছেন। মায়ের সঙ্গে সহবাস! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ভাবলেও গা গুলিয়ে ওঠে মৃন্ময়ের। এখন এই সবকিছু থেকে অব্যাহতি পেতে— মৃত্যুই একমাত্র পথ। বহুবার তার মনে হয়েছে চলন্ত ট্রেনের চাকার সামনে গলা পেতে দেবে সে। কিন্তু সুখী মানুষেরা তো বরাবরই ভীতু প্রকৃতির হয়!
তবে একটা ব্যাপার কিছুতেই মেলাতে পারে না মৃন্ময়— পাপড়ি মুখার্জী আর তৃণা ব্যানার্জী যদি একই মানুষ হয়, তাহলে তাদের নামের পার্থক্যটা হল কীভাবে? মায়ের হঠাৎ নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজন হল কেন?
***
১৯৯৭ সাল, হাওড়া:
“আচ্ছা বিকাশ… আমি যদি তোকে বলি যে আমি এখানকার লোক নই। তাহলে তুই বিশ্বাস করবি?” মৃন্ময় বলল।
বিকাশ মৃন্ময়ের বহুদিনের বন্ধু, অফিস কলিগ। সুখে-দুঃখে অল্প-আধটু কারণ সেবনও হয় তাদের একসঙ্গে। আজ সেজন্যই মৃন্ময় বিকাশের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে।
বিকাশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে মৃন্ময়ের কাজকর্মে মন নেই, সারাক্ষণ যেন কিছু ভাবছে, কারুর সঙ্গে বিশেষ কথাও বলছে না। এমনকি তার সঙ্গেও না। কিছুদিন আগেও যেমন হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব হত সেসব যেন মৃন্ময় ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে চলছে। বাচ্চা হবে বলে মানুষকে এভাবে পালটে যেতে হয় নাকি! তাই আজ বিকাশ জোর করেই তাকে ধরেছে মনের কথা প্রকাশ করার জন্য। অফিস থেকে ফেরার পথে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
বিকাশের বাড়ি অফিসের কাছেই। দাদা বিনোদ, স্ত্রী নিম্মি— এদের নিয়ে বিকাশের সংসার। বিনোদ বিয়ে করেননি। বিকাশ আর নিম্মির তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে। তবে এখনো কোনো সন্তান নেয়নি তারা।
অনেক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর দু-পেগ গলায় ঢেলে মৃন্ময় কথা শুরু করেছে।
“তবে কোথাকার? অন্য জগতের?” বিকাশ পালটা জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, তা বলতে পারিস… এলিয়েন নয় তাই বলে…”
“হ্যাঁ, কেন বিশ্বাস করব না? অবশ্যই বিশ্বাস করব, এবং বিশ্বাস করার মতো আমার কাছে যথেষ্ট কারণও আছে…”
“তাই নাকি? কীরকম?”
“সেসব গল্প পরে হবে, আগে তোর কী ব্যাপার বলতো…”
“আচ্ছা, শোন…”
মৃন্ময় নিজের জীবনের সমস্ত কথা খুলে বলল বিকাশকে।
“হুম… বুঝলাম… দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ, হেরোশিও…” বিকাশ বিজ্ঞের মতো ভাব করে বলল।
“এই… আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল, আর তুই আমার কানের গোড়ায় শেক্সপীয়ার ক্যালাস না তো!” বিরক্ত হয়ে বলল মৃন্ময়।
“আরে ক্যালাচ্ছি কোথায়? আমি তো তোকে জানাচ্ছি… আচ্ছা দেখ…” বলে বিকাশ স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ডাকল, “এই নিম্মি… একবার এদিকে এসো তো…”
পাশের ঘর থেকে নিম্মি দেবী আসতেই বিকাশ তাকে ঈশারা করে বলল, “দেখাও ওকে।”
নিম্মি দেবীর পানপাতার মত মুখমন্ডলে ঘন কালো একরাশ চুল কপাল থেকে নেমে কানের পাশ দিয়ে মাথার পিছন দিকে চলে গেছে। সেই চুল নিম্মি দেবী অতি সন্তর্পণে দুই হাতের আঙুল দিয়ে সরিয়ে ঢাকা কান দুটোকে অনাবৃত করলেন। মৃন্ময় বিষ্ফারিত চোখে দেখল নিম্মি দেবীর কান সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষের কানের উপরিভাগের গোলাকার অংশটা যেমন হয়, ওঁরটা সেরকম নয়! ওঁরটা সূঁচোলো হয়ে অনেকটা বেরিয়ে এসেছে। ঠিক যেমন শেয়াল জাতীয় প্রাণীদের হয়! মৃন্ময় উঠে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে, সে যেন তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে সে হাতই দিয়ে ফেলল নিম্মি দেবীর কানে। মুহূর্তে দু-পা পিছিয়ে গেলেন নিম্মি দেবী। ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইল মৃন্ময়, “স্-সরি… সরি…”
“তোর বৌদিও এখানকার মানুষ নয়।” বিকাশ বসে থাকা অবস্থাতেই বলল।
“কীভাবে…?” আর কিছু মুখ থেকে বেরোলো না মৃন্ময়ের।
“ও যেই জগতের মানুষ, সেই জগতের নাম জাম্বুসি। সেই জায়গায় গিয়ে “সময়” নিয়ে আমিও কিছু জ্ঞান অর্জন করেছি। হয়তো তোর কিছু উপকার হলেও হতে পারে তাতে। আমি তোকে পুরোটা বলব। তবে আজ নয়। সুস্থ মস্তিস্কে সবটা শুনিস। আমি তোকে জাম্বুসিতে নিয়েও যাব। আর তার আগে তোর আমাকে কথা দিতে হবে— আমি তোকে যা বলব তা আর কাউকে বলবি না। এসব পাঁচ কান হলে নিম্মির এবং আমাদের— দুটো জগতেরই ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে গিয়েছিস কখনো? মীর্জাপুর-বাঁকিপুর বলে একটা জায়গা আছে জানিস?”
“না যাইনি। আর আমি কথা দিচ্ছি এসব কাউকে জানাবো না। এবার বল প্লিজ…”
“বললাম তো আজ নয়। তবে তোর কেসটায় তুই যদি দুটো টাইমলাইনকে পুরোপুরি আলাদা করে দেখিস, তাহলে বোধহয় আত্মগ্লানি থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারবি।”
“সম্ভব নয় রে… যেই মানুষটা সারাক্ষণ আমার সামনে স্ত্রী রূপে আছে সে একই সঙ্গে যে আমার মা-ও, সেটা আমার কম্পলিট মেমোরি লস না হওয়া পর্যন্ত তো আমি ভুলতে পারব না। তা ছাড়া আমার যেই সন্তানটা পৃথিবীতে আসতে চলেছে, সে কথা শিখে বাবা বলে যাকে ডাকবে সেটা আসলে ও নিজেই— এটা জাস্ট আমি ভাবতে পারছি না!”
“সম্পর্ক নিয়ে এত কিছু ভাবিস না। তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে এই পৃথিবীর সবাই সবার ভাই-বোন। দেখ… আমার বাবা রাস্তার পাশের কালী মন্দিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় ঠাকুর প্রণাম করে বলতেন, “মা, আমার পরিবারের সবাইকে সুখে রেখো”। একই মন্দিরে আমার মা প্রণাম করে বলতেন, “মা, আমার বুবলুটা এ বছর পাশ করতে পারলে তোমায় শাঁখা বাঁধানো দেব”। আর এখন আমি মন্দিরের সামনে গিয়ে প্রণাম করে বলি, “মা, আমার ইন্ক্রিমেন্টটা দেখো…”। তাহলে ভাব… এই জগৎ সংসারের “মা” যদি একজনই হন, তাহলে তো আমরা সবাই একে অপরের ভাই-বোন হলাম।” বলে একবার ফিক করে হেসে দিল বিকাশ।
“ধুস… তোকে বলাটাই আমার বেকার হয়েছে। আমি মরছি ভীষণ জ্বালায়, আর তুই ফাজলামি মারতে বসেছিস!” বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মৃন্ময়।
“রাগ করিস না বন্ধু… এই ভাই-বোনের তত্ত্বটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে কিন্তু…”
হঠাৎ বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোয় মৃন্ময়ের মাথাটা যেন একটু ঘুরে গেল। মেঝেতে পড়েই যেত, যদি না বিকাশ ঠিক সময়ে ধরে ফেলত।
“শোন না… আজ রাতটা এখানে থেকে যা। আমি বৌদিকে ফোন করে বলে দিচ্ছি তুই কাল ফিরবি।” বিকাশ বলল।
“ফোন করে” কথাটা শুনেই মৃন্ময়ের অভিব্যক্তি যেন পালটে গেল। তার মনে পড়ে গেল সেই মোবাইল ফোনটার কথা, যেটা এখন তার আলমারীর গুপ্ত দেরাজে লুকোনো আছে। “ভাই, একটা রিকোয়েস্ট করব? আজ তুই আমাকে তোর গাড়িতে করে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আয় প্লিজ…” সে বিকাশের হাতদুটো চেপে ধরে বলল।
***
বিকাশের বাড়ি থেকে ফিরেই মোবাইল ফোনটা তার আলমারি থেকে বের করে চার্জে দিল মৃন্ময়। এত বছরে সে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছে ফোনটা কীভাবে কাজ করে! এর আগে যতবার সে ফোনের সাহায্যে টাইম-ট্রাভেল করার চেষ্টা করেছিল ততবার সে ব্যর্থ হয়েছে কারণ, তখন তো ফোন বাজারেই আসেনি! কিন্তু বছর দুয়েক হল ভারতে জনসাধারণের জন্য মোবাইল ফোন পরিষেবা চালু হয়েছে। সুতরাং এইবার চেষ্টা করলে সফলতা আসতেও পারে!
ঘণ্টা দুয়েক ফোনটা চার্জ দিয়ে সে ক্যালেন্ডার অপশনে গেল। তারপর তারিখ বাছল— ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, এবং মুহূর্তের মধ্যে ওকে বাটন চেপে দিল। কিন্তু কিছুই হল না। উক্ত তারিখে পৌঁছোল না মৃন্ময়। আর দু-তিনবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু কোনো ফল হল না।
ফল হবেই বা কী করে? ২০১৭ সালে সে যখন ফোনটা পেয়েছিল, তখন যেই নেটওয়ার্ক সার্ভিস ছিল – সেটার তো জন্মই হয়নি এখনো। রাগে-দুঃখে মৃন্ময় সামনের দেওয়ালটার উপর সজোরে ছুড়ে মারল মোবাইল ফোনটা। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল সেটা।
***
তিন
১৯৯৭ সাল, মীর্জাপুর-বাঁকিপুর:
“দেখ… আমি কোনো বৈজ্ঞানিক নই। তবে তোকে এখন যেটা বলতে যাচ্ছি সেটা যদি তিন বছর আগে সবাইকে জানাতাম, তাহলে এতদিনে আমাকে নিয়ে হইহই পড়ে যেত। সেলেব্রিটি হয়ে যেতাম আমি। কিন্তু নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার চেয়ে আমার মনে হয়েছে— দুটো জগতের ভারসাম্য রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই এতদিন আমি কাউকে কিছু জানাইনি এই জায়গা সম্পর্কে। তুই আমার খুব কাছের বন্ধু এবং একটা বিপদে পড়েছিস, তাই আমি তোকে সবটা জানাচ্ছি। তুই আমায় কথা দে— এখন যা অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করবি তা আমাদের দু-জনের বাইরে কোনো কাকপক্ষীও টের পাবে না।” বিকাশ বলল।
মৃন্ময় অবাক দৃষ্টিতে বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি…”
“এই যে জলাশয়টা দেখছিস… এই জলের অপর প্রান্তে একটা অন্য জগৎ আছে। জাম্বুসি তার নাম। আমার বউ নিম্মি সেখানকারই মেয়ে। একদিন হঠাৎই আমি এটা আবিষ্কার করে ফেলি এবং পৌঁছে যাই ওদের জগতে। সেখানেই আমার সঙ্গে পরিচয় হয় নিম্মির বাবার। উনি ওখানকার একজন বৈজ্ঞানিক এবং এসব সম্পর্কে আমার শিক্ষাগুরু। আশা করি ওঁর সঙ্গে কথা বলার পর তোর সমস্যার পুরোপুরি সমাধান না হলেও তোর এখনকার কর্তব্য নিয়ে কিছু ধারণা পাবি। হয়তো মানসিক শান্তিও পাবি কিছুটা।” বিকাশ বলল।
তারপর তারা যেই জলাশয়টার সামনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথাবার্তা বলছিল সেটার জলে ঝাঁপ দিল বিকাশ, এবং জলে ডুব দেবার আগে মৃন্ময়কে বলল একবুক বাতাস ভরে নিয়ে তাকে অনুসরন করতে। মৃন্ময়ও তার পিছু পিছু জলে ডুব দিল।
জলের ভিতরে ডুব সাঁতার দিতে দিতে মৃন্ময় দেখল জলের নীচের দিক থেকে সূর্যের আলোর মতো প্রবল রশ্মি ঠিকরে বেরোচ্ছে। বিকাশ ক্রমশ সেইদিকেই এগিয়ে চলেছে দ্রুত। তাকে পিছু করতে করতে একসময় মৃন্ময় জলের উপরিতলে ভেসে উঠল। মাথার উপর খোলা আকাশ দেখে অবাক হল অবাক হল সে। তারা তো এতক্ষণ জলাশয়ের নীচের দিকে এগিয়ে চলছিল! তাহলে…!
“উঠে পড়… জামাটা খুলে নিংড়ে নে, আর প্যান্টটারও যতটা সম্ভব জল ঝেড়ে নে।” বিকাশের কথায় সম্বিৎ ফিরে এল মৃন্ময়ের।
***
একটা মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল তারা। চারিদিকে অদ্ভুত ডিজাইনের সব বাড়ি, যা আগে কোনোদিন দেখেনি মৃন্ময়।
“ওয়েলকাম টু জাম্বুসি, মাই ফ্রেন্ড।” বিকাশ বলে উঠল।
মৃন্ময় কিছু বলল না। শুধু অবাক হয়ে দেখল।
“আমাদের পৃথিবী আর জাম্বুসি— এই দুটো হল দুটো প্যারালাল জগৎ। আর আমরা যেই জলাশয়টার মধ্যে দিয়ে এলাম, সেটা আসলে হচ্ছে একটা ওয়ার্মহোল। যা এই দুটো জগৎকে একটা সোজা রাস্তা দিয়ে যুক্ত করেছে। জানিস এইরকম বহু ওয়ার্মহোল আমাদের পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, মানুষ হয়তো জানেই না সেগুলোর সম্পর্কে।”
“আচ্ছা।”
“জানিস এই প্যারালাল জগৎ তৈরি হয় কীভাবে?”
“না।”
“তুই “শ্রডিঙ্গারস্ ক্যাট” নামক থট-এক্সপেরিমেন্টের নাম শুনেছিস?”
“পড়েছিলাম কোথাও… ওই বাক্সের ভিতর বিড়াল… আরো কী যেন…”
“হ্যাঁ, একটা বাক্সের ভিতর একটা জীবিত বিড়াল, একটা বিষের শিশি, আর একটা রেডিয়োঅ্যাক্টিভ পদার্থ একসঙ্গে রেখে দেওয়া হবে। একটা মনিটর সর্বদা লক্ষ রাখবে – ভিতরে যদি কোনোরকম রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি দেখা যায় – তাহলে একটা ছোট্ট ধাতুর হাতুরি বিষের শিশিটাকে ভেঙে দেবে, এবং বিষের প্রভাবে বিড়ালটা মারা যাবে। কিন্তু শ্রডিঙ্গার বলছেন – যতক্ষণ না বাক্সের ঢাকনা খোলা হয় ততক্ষণ বিড়ালটা একইসঙ্গে বেঁচেও থাকবে আবার মরেও যাবে। অথচ বাক্সের ঢাকনা খোলা মাত্রই আমরা বিড়ালটাকে যে কোনো একটা অবস্থায় পাব। তখন আমরা বুঝতে পারব বিড়ালটা বিষের প্রভাবে মারা গেল নাকি বেঁচে রইল। তবে যদি বিড়ালটা বেঁচে যায় তাহলে তার স্মৃতিতে শুধুমাত্র জীবিত থাকার ঘটনাটাই ধরে রাখতে পারবে, মরে যাবার ঘটনাটা একেবারে ভুলে যাবে। এখন ঠিক এইখানেই, বন্ধ বাক্সের ভিতরে দুটো প্যারালাল জগৎ তৈরি হয়। বাক্সের ঢাকনা খোলার পর যদি বিড়ালটাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চই আরো একটা জগৎ আছে যেখানে বিড়ালটা জীবিত অবস্থায় রয়েছে।”
“বাপরে… তুই তো দেখছি বিজ্ঞানীই হয়ে গেছিস! এতদিন তোর সঙ্গে মিশছি কখনো বুঝতে দিসনি তো?” মৃন্ময় ঠাট্টা করার চেষ্টা করল, তবুও মন থেকে হালকা হতে পারল না।
“আরে না না… তিন বছর আগে জাম্বুসি থেকে ফেরার পর এইসব নিয়ে একটু পড়াশোনা করেছিলাম, তাতেই এগুলো জানতে পেরেছি।”
***
“ঋদক, এ আমার বন্ধু মৃন্ময়।” মৃন্ময়কে দেখিয়ে বলল বিকাশ। “আর ইনি ঋদক, আমার শ্বশুরমশাই এবং সেই বৈজ্ঞানিক যাঁর কথা তোকে বলছিলাম।” সামনে অদ্ভুতবেশা ভদ্রলোককে দেখিয়ে মৃন্ময়কে বলল বিকাশ।
মৃন্ময় করজোড়ে অভিবাদন জানাল। ঋদক ওদের বসেতে বলে একজন ভৃত্য গোছের লোককে অদ্ভুত ভাষায় কিছু নির্দেশ দিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে মাটির পাত্রে বিস্কুট জাতীয় কিছু নিয়ে এল লোকটা, সঙ্গে জল।
“এগুলো খেয়ে একটু বিশ্রাম করো তোমরা। আমি বিকেলে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে।” ঋদক বললেন।
***
মাটি দিয়ে বাধাই করা ঘরের একটা ফাঁকা দেওয়ালে খড়ি জাতীয় কিছু দিয়ে একটা রেখাচিত্র এঁকে ফেললেন ঋদক। তার আগেই অবশ্য মৃন্ময়ের থেকে সমস্ত কথা শুনেছেন তিনি।
“ধরো, কোনো ব্যক্তি A বিন্দুতে জন্মগ্রহণ করেছে। তারপর সে সোজা পথে হেঁটে চলেছে তার ভবিষ্যত C বিন্দুর দিকে। এখন C বিন্দুতে এসে সে একটা টাইম মেশিনের সন্ধান পেল, এবং তার মনে হল B বিন্দুতে সে একটা ভয়ানক ভুল করে এসেছে এবং সেটা যে করেই হোক পালটাতে হবে। সে টাইম মেশিনের সাহায্য নিয়ে অতীতে B বিন্দুতে গেল এবং নিজের ভুলটা সংশোধন করার চেষ্টা করল। এখন যদি সে ভুলটা সংশোধন করতে অক্ষম হয়, তাহলে সে আবার তার সোজা পথ ধরে C বিন্দুর দিকে এগোতে থাকবে। এক্ষেত্রে সেটাকে তোমরা “ভাগ্য” বলে ডাকো। কিন্তু সে যদি সেই ভুলটা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়, তাহলে ততক্ষণাৎ একটা অন্য জগতের সৃষ্টি হয়। যেটা আসলে অন্য একটা মাত্রা। যেটা এখানে দেখানো হয়েছে BD সরলরেখা দিয়ে। ব্যক্তিটি তখন তার পরিবর্তিত ভাগ্য নিয়ে C গন্তব্য ছেড়ে B বিন্দু থেকে D গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হয়। এভাবে দুটো প্যারালাল জগতের সৃষ্টি হয়। যদিও তোমরা বলো প্যারালাল জগৎ, কিন্তু জগৎ কখনই প্যারালাল হয় না। এরকম জগৎগুলি সবসময় সৃষ্টি হয় নির্দিষ্ট একটা সাধারণ বিন্দু থেকে এবং সেখান থেকে একটা কোণ করে এগিয়ে চলতে থাকে। এভাবেই কোনো এক সময় হয়তো আমাদের জগৎটা তৈরি হয়েছে। হয়তো তোমাদেরটাও। মুখ্য জগৎ আসলে কোনটা সেটা এইরকম অবস্থান থেকে বলা খুব কঠিন। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করো – এই BC এবং BD দুটো জগৎকে আমি আরেকটা সরলরেখা XY দিয়ে যুক্ত করেছি। এটা হল দুটো জগতের মধ্যে পারাপার হবার একটা রাস্তা। যাকে তোমরা ওয়ার্মহোল বলো। ঠিক যেমন তোমরা একটা জলাশয়ের মধ্যে দিয়ে জাম্বুসিতে এলে, সেই জলাশয়টা আসলে একটা ওয়ার্মহোল।” এতদূর বলে ঋদক থামলেন।
মৃন্ময় ও বিকাশ চুপচাপ শুনে চলেছে তাঁর কথা। ঋদক পাশে রাখা একটা মাটির পাত্র থেকে কিছুটা জল পান করে, মৃন্ময়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আবার শুরু করলেন, “তবে তোমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা হল— তুমি C বিন্দু থেকে একেবারে তোমার জন্মের আগে N বিন্দুতে চলে গেছ। এবং স্বাভাবিক সরলরেখটারই একটা অংশ হয়ে গেছ। তোমার কাছে এটা দুর্ভাগ্য মনে হলেও এটাই আসলে তোমার স্বাভাবিক অবস্থান। এটাই তোমার ভবিতব্য। এর জন্য তোমার অপরাধ বোধ করা উচিৎ নয়। যা ঘটে গেছে সেটা ভুলে যাও। এখন ভাবো তুমি আগামী দিনে কী করবে। তুমি যা করবে তার উপর নির্ভর করছে তোমার ভবিষ্যত কী হবে।”
“কিন্তু বাচ্চাটা তো ইতিমধ্যে চলে এসেছে। আর কয়েকদিনের অপেক্ষা। তারপরেই তো জন্ম নেবে সে। এখন আমি যাইই করি না কেন, এই ঘটনার তো পুনরাবৃত্তি হয়েই চলবে! আচ্ছা… আমি যদি বাচ্চাটাকেই শেষ করে দিই তাহলে?” মৃন্ময় জিজ্ঞেস করল।
“তোমাদের জগতে “গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স” বলে একটা থিয়োরি আছে, যেখানে কোনো ব্যক্তি যদি অতীতে, তার নিজের ঠাকুরদার যখন কোনো সন্তান হয়নি সেই সময়ে গিয়ে তাকে মেরে ফেলে— তাহলে তার নিজের জন্মই হবে না। এক্ষেত্রে সেটাই তোমার উপর প্রযোজ্য। ওই বাচ্চাটা তুমি নিজেই। সুতরাং ওকে মেরে ফেললে তোমার নিজেরই কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।” ঋদক বললেন।
“আচ্ছা… দুটো প্যারালাল জগতের মধ্যে একটায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার প্রভাব কি আরেকটায় পড়ার কোনোরকম সম্ভাবনা আছে?” মৃন্ময় আবার জিজ্ঞেস করল।
“একবার দুটো জগৎ আলাদা হয়ে গেলে আর কোনোভাবেই একটার প্রভাব আরেকটাতে পড়ে না। সরাসরি তো একেবারেই না। তখন দুটো স্বতন্ত্র জগৎ নিজেদের মতো করে এগিয়ে চলতে থাকে।” ঋদক বললেন।
***
“শোন… চাপ নিস না। যা ঘটছে সেটাকে স্বভাবিকভাবেই গ্রহণ কর। জটিলতা ভুলে যা। স্বাভাবিকভাবে বাঁচ। আমিও কথা দিচ্ছি— আমিও এই সব কিছু ভুলে যাব। আমার তরফ থেকে এই ব্যাপারটা কোনোদিন কারুর সামনে আসবে না। এখানে কিছুদিন থাক। মনটা হালকা হবে, ভালো লাগবে তোর।” বিকাশ বলল।
“না রে… আগামী তেরো তারিখ অর্থাৎ পরশু দিন পাপড়ির বাচ্চা হবে। ওই দিনটা তো অন্তত আমার ওর পাশে থাকা উচিৎ।” মৃন্ময় বলল।
“চিন্তা করিস না। তুই এখানে যতদিনই থাকিস না কেন, ওই জগতে কোনো সময়ের পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ তুই যখন এখান থেকে বেরোবি তখন ঠিক যেই দিন যেই সময়ে এখানে এসেছিলি সেই দিনে সেই সময়েই ওপাশে গিয়ে উপস্থিত হবি।” বলে একটা চোখ টিপে দিল বিকাশ। তারপর আবার বলল, “আচ্ছা… তোর ওই মোবাইল ফোনটা আমাকে একবার দেখাস তো।”
“ওটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি রে…”
“কী বলছিস কী?”
“হ্যাঁ, সেদিন রাত্রে যখন তোর বাড়ি থেকে ফিরলাম তখন ওটা শেষবারের মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলাম। হল না। রাগের মাথায় ঘরের দেওয়ালে ছুড়ে মেরেছি ওটা। একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।”
“যাহ্… তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, গেছেই তো…”
“আচ্ছা… তুই ওই টুকরোগুলোই দিস। আমি দেখব ওটা কোনোভাবে সারাবার ব্যবস্থা করা যায় কিনা!”
“তুই জানিস ২০১৭ সালে আমার মুখ্য পেশা কী ছিল?”
“না।”
“মোবাইল ফোন মেকানিক। আর আমি টুকরোগুলো ভালোভাবে দেখে নিয়েছি… আর কোনোভাবে সারাবার অবস্থায় নেই ওগুলো।”
“আচ্ছা তাও দিস একবার…” খানিকটা বিরক্তিভরে বলল বিকাশ।
***
১৯৯৭ সাল, ব্যারাকপুর:
পাপড়ি একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলের জন্ম দিয়েছে আজ। হাসপাতালের জন্মের প্রমাণ-পত্রে বাচ্চার নাম লিখিয়েছে মৃদুল। মৃন্ময় বাবা হিসেবে সমস্ত ফর্ম্যালিটিই করেছে। একবার আবেগের বশে নিজের সদ্যজাত শিশুকে কোলেও তুলে নিয়েছিল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মিষ্টতা ভুলে হিংস্রতা ফুটে উঠেছিল তার চোখে-মুখে। তার কঠিন হাত সদ্যজাতটির সরু কণ্ঠনালীর দু-পাশে চেপে বসেছিল। কিন্তু শিশুটির চাপা গোঙানীর ফলে সে তাড়াহুড়ো করে তাকে তার মায়ের পাশে রেখে, হন্হন্ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
***
দু-দিন ধরে বাচ্চাটাকে মৃন্ময় যত দেখছে, তত তার ভিতরে একটা বিশ্রীরকম অস্বস্তি কাজ করছে। সে কিছুতেই ভাবতে পারছে না— এই বাচ্চাটাই একদিন বড়ো হয়ে নিজের মায়ের সঙ্গেই…! ঋদক আর বিকাশ যাই বলুক, এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। কোনো সাধারণ মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না। নিজের উপর ঘৃণা হয় তার। এত অসহায়তা সে আর কোনো ব্যাপারে অনুভব করেনি।
অবশেষে দু-দিন পর সে চরম সিদ্ধান্ত নেয়। সে পালিয়ে যাবে এইসব ছেড়ে-ছুড়ে। তবেই হয়তো এই বিরক্তিকর পরিস্থিতি থেকে কিছুটা নিস্তার পাওয়া যাবে!
বিকাশকে একটা চিঠি লিখল মৃন্ময়—
“আমি চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিন ফিরব না। আমায় খোঁজ করার চেষ্টা করিস না। করলেও পাবি না। শুধু একটা অনুরোধ, মাঝে মধ্যে পাপড়ির খোঁজ নিস। মোবাইল ফোনের ভাঙা টুকরোগুলো দিলাম তোকে। আমার জীবনটা তো ছাড়খাড় করে দিল এটা, তুই চেষ্টা করে দেখ এটা ঠিক করে ভালো কাজে লাগাতে পারিস কিনা!”
ফোনের টুকরোগুলোর সঙ্গে চিঠিটা একটা কাগজের বাক্সে ভরে সেটা বিকাশের ঠিকানায় কুরিয়ার করে দিল সে।
কুরিয়ারটা হাতে পাবার আগেই বিকাশ জানতে পেরেছে— মৃন্ময় নিরুদ্দেশ। কাউকে কিছু না বললেও নিজের মনে সে নিশ্চিত ছিল যে, মৃন্ময় জাম্বুসিতেই গেছে। কিন্তু আরেকটা আশঙ্কাও একই সঙ্গে তার মনে দেখা দেয়— জাম্বুসিতে বছর ধরে থাকলেও এই জগতে সময়ের কোনো পার্থক্য ঘটে না। অর্থাৎ সেখান থেকে তার ফিরে যাওয়া উচিৎ সেই একই দিনে যেদিন সে গেছিল, বড়োজোড় একবেলা সময় যাবে। মীর্জাপুর-বাঁকিপুর থেকে ব্যারাকপুর যাতায়াত করতে একবেলা তো যাবেই। এতদিনেও ফিরল না মানে কি সে বাকি জীবনটা সেখানেই থেকে গেল, এবং বুড়ো হয়ে সেখানেই মারা গেল? এটা হতে দেওয়া যাবে না। তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এমনিতেও গোল কানের কোনো ব্যক্তি সেখানে গিয়ে বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না, ঠিক ধরা পড়ে যাবে এবং ঋদকের কানে খবর চলে যাবে। বিকাশ ঠিক করে সে নিজেই জাম্বুসিতে যাবে এমং খুঁজে নিয়ে আসবে মৃন্ময়কে।
ওদিকে পাপড়ি পাগলের মতো হয়ে উঠেছে। উন্মত্ত পাপড়িকে তার মা ইলা দেবী কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছেন না। আর পাপড়ি ভাবতেই পারছে না— মৃন্ময় নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে ছেড়ে কীভাবে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে! কোনো সদ্যজাত শিশুকে ছেড়েও কি কোনো বাবা চলে যেতে পারে?
***
চার
২০০০ সাল, ব্যারাকপুর:
কার্গিলের যুদ্ধ আগের বছরই হয়ে গেল। যুদ্ধের মাঝেই পাকিস্তান ভারতকে নিউক্লিয়ার হামলার হুমকি দেয় এবং ভারতও পাকিস্তানকে পালটা হুমকি দেয়। সেই সময় আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রবলভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আরেকটা মহাযুদ্ধ বাঁধার আশঙ্কাও করেছিল সবাই। এখন যুদ্ধ শেষ হলেও তার ক্ষত কিন্তু মিটে যায়নি। দুই দেশের বুকেই ধিকিধিকি ক্ষোভের আগুন জ্বলেই রয়েছে।
আজ হঠাৎ টিভি, খবরের কাগজ জুড়ে একটাই খবর— পাকিস্তানি মিলিট্যান্ট গ্রুপ “লস্কর-এ-খালিদি” সরাসরি হুমকি দিয়েছে ভারতকে। ভারতীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনোরকম অন্যায় মেনে নেবে না তারা। প্রয়োজনে ভারতকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার ক্ষমতা রাখে তারা। ওই গ্রুপের প্রধান উমর খালিদ-এর একটা বড়ো করে ছবিও বেরিয়েছে সব ক-টা দৈনিকে। বক্তৃতা দেবার সময়ের একটা ভিডিয়ো ক্লিপও দেখাচ্ছে নিউজ চ্যানেলগুলো।
খবরের কাগজটার প্রথম পাতাতে চোখ আটকে গেল পাপড়ির। এই চোখ, এই নাক, এই ঠোঁট— সে কোনোদিনও ভুলতে পারবে না। মাথায় জড়ানো সাদা কাপড়ের টুকরোটা সরিয়ে নিলে, আর লম্বা দাড়িটা কেটে ফেললেই এই মানুষটা যে তার মৃন্ময়!
খবরের কিছুটা অংশ পড়ল সে। এই লোকটার নাম উমর খালিদ। লোকটার দ্বারা একটা হুমকি দেওয়া হয়েছে তার দেশকে। এছাড়া মূলত ওই মিলিট্যান্ট গ্রুপটা সম্পর্কে লেখা আছে— বছর দুয়েক আগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এই গ্রুপটা। তার আগে বিশেষ নাম শোনা যায়নি।
পাপড়ি তড়িঘড়ি করে টিভিটা চালাল। নিউজ চ্যানেলগুলোতে যেই ভিডিয়ো ক্লিপটা দেখাচ্ছে তাতে মুখের চারপাশটা ভালো করেই দেখা যাচ্ছে উমর খালিদ নামক লোকটার। এখন সে একেবারেই নিশ্চিত— এটা মৃন্ময় ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। কিন্তু কেন? কী এমন প্রয়োজন পড়ল মৃন্ময়ের, যার জন্য এতকিছু?
প্রায় তিন বছর কেটে গিয়েছে মৃন্ময় ওদের সঙ্গে নেই। পাপড়ি অনেক কষ্ট করে বাচ্চাটাকে বড়ো করার চেষ্টা করছে। ওর মা ইলা দেবী সঙ্গে না থাকলে ও যে কোন অকূল-পাথারে গিয়ে পড়ত তা ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে ওর। মৃন্ময় নিরুদ্দেশ হবার পর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, থানা-পুলিশ সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছে সে। কিন্তু কোনো জায়গা থেকেও একটা আশাজনক খবর পায়নি। তবুও হাল ছাড়েনি পাপড়ি। এই তিন বছরের প্রতিটা দিন সে বিশ্বাস নিয়ে কাটিয়েছে – এই বুঝি তাকে চমকে দিয়ে ফিরে আসবে মৃন্ময়! আর বলবে “কেমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম বলো?” তারপর খুব অভিমান করে থাকবে পাপড়ি। একদম কথা বলবে না মৃন্ময়ের সঙ্গে। তারপর একদিন সব অভিমান ভুলে মৃন্ময়ের বুকে মাথা রেখে খুব কান্না করবে সে। কিন্তু ভাবনারা বাস্তব হয়ে ফোটে ওঠে কোথায়?
এই কয়েক বছরের মধ্যে বিকাশ বেশ কয়েকবার জাম্বুসিতে গিয়ে খোঁজ করেছে মৃন্ময়ের। কিন্তু কোনো খবর পায়নি। পৃথিবীর মানুষ জাম্বুসিতে গিয়ে লুকিয়ে থাকা খুব একটা সোজা কাজ নয়। স্থানীয়দের কাছে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এখন সে প্রায় নিশ্চিত যে মৃন্ময় জাম্বুসিতে যায়নি।
আজ হঠাৎ পাপড়ি ফোন করে জরুরি তলব দিয়েছে বিকাশকে। ব্যারাকপুরে ওদের বাড়িতে যেতে হবে তাকে। এমনিতে খুব প্রয়োজন না হলে বিকাশকে ডাকে না পাপড়ি। নিজের প্রয়োজনে অন্যকে কষ্ট দেওয়াটা পছন্দ করে না সে। যদিও বিকাশ সবসময়ই পাপড়িকে সাহায্য করতে চায়। তবে দূরত্বের কারণে বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থাকাটা তার সম্ভব হয়ে ওঠে না।
বিকাশ আসতেই পাপড়ি একটা ভাঁজ করা খবরের কাগজ ধরিয়ে দিল তাকে। কাগজের উপরের অংশটায় একটা লোকের মুখের ছবি। উমর খালিদ। লস্কর-এ-খালিদির প্রধান।
“দেখুন তো দাদা, এই লোকটাকে আপনার চেনা চেনা মনে হচ্ছে?” পাপড়ি বলে।
বিকাশ ভালো করে দেখে বলে, “চেনা চেনা তো মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না।”
পাপড়ি ছবিটার মাথার দিকটা এবং থুতনির নীচের দিকটা দুটো হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, “এবার দেখুন তো…”
“মুখের কাটিংটা খুবই পরিচিত মনে হচ্ছে, বুঝলে! কিন্তু…” বিকাশ বলল।
“এটা মৃন্ময়…” পাপড়ি বেশি ভনিতা না করেই বলল।
পাপড়ির কথা শুনে বিকাশ হেসেই ফেলেছিল, কিন্তু পাপড়ির গম্ভীর মুখ দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না না… সেটা কী করে হতে পারে… এটা মৃন্ময় নয়… এ তো উমর খালিদ… এই দেখো নামও লেখা আছে…”
“হ্যাঁ আছে… আরো পড়ুন। এই মিলিট্যান্ট গ্রুপটা বছর দুয়েক হল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তার আগে কেউ এদের নাম শোনেনি। আমি নিরানব্বই শতাংশ নিশ্চিত যে এটাই মৃন্ময়। আমি তো চিনি ওকে… আমার কাছে এই চোখ-মুখ কোনোদিনও ভোলবার নয়। তা ছাড়া আপনারাও তো অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছেন। আপনার কি তাই মনে হচ্ছে না?”
“দেখো… একে দেখতে অনেকটাই মৃন্ময়ের মতো— এটা ঠিক। তাই বলে এই লোকটা মৃন্ময় নয়। কেন হতে যাবে? দেখতে একইরকম লোক তো অনেকই আছে দুনিয়াতে। আমি কোথাও একটা পড়েছিলাম – হুবহু একই রকম দেখতে সারা পৃথিবীতে সাত জন লোক থাকে। সেরকমই কেউ…”
“আমি এতকিছু জানি না দাদা… আমি আপনাকে বললাম – আমি নিরানব্বই শতাংশ নিশ্চিত। বাকি এক শতাংশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। আমি জানি – মিডিয়াতে আপনার চ্যানেল আছে। আপনি চাইলে এটুকু সাহায্য করতেই পারেন। প্লিজ দাদা…”
ওদের মধ্যে কথা চলতে চলতে হঠাৎই পাশের ঘর থেকে ছুটে চলে এল বাচ্চাটা। ছোট্ট মৃদুল। বিকাশকে দেখেই কোলে উঠতে চাইল।
“এই বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকান দাদা। এই নিষ্পাপ শিশুটা যখন বড়ো হয়ে জানবে ওর বাবা একটা টেররিস্ট, তখন কি ওর ভালো লাগবে? প্লিজ… হেল্প মি…” পাপড়ি কাকুতির স্বরে বলল।
বিকাশ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মনে মনে বলল, “এটা যদি সত্যিই হয় তাহলে ওর বাবা না, ও নিজেই টেররিস্ট।” কিন্তু মুখে বলল, “ঠিক আছে। আমি দেখছি কী করা যায়।”
***
২০০০ সাল, পাকিস্তান:
বিকাশ অনেক রেফারেন্স খাটিয়ে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তাও আবার ভুয়ো নিউজ রিপোর্টার সেজে। এটা লস্কর-এ-খালিদির বেস ক্যাম্প। কথামত লাহোর এয়ারপোর্টের বাইরের রাস্তা থেকে একটা লোক তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে উঠতেই আরেকজন লোক চোখে কালো কাপড় বেঁধে দেয় তার। তারপর পুরো রাস্তা একটাও কথা হয়নি গাড়ির ভিতরে। একসময় গাড়ি থেকে নামিয়ে তার চোখ খুলে দেওয়া হয় এবং সোজা গিয়ে ডানদিকে মোড় ঘোরার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিছুক্ষণ একটা ফাঁকা ঘরে বসে থাকার পর, একজন সাদা আলখাল্লা পরিহিত ও মাথায় সাদা কাপড় জড়ানো লোক এসে বিকাশের সামনে দাঁড়াল। বিকাশও উঠে দাঁড়াল। ফুটখানেক লম্বা দাড়িটা না থাকলে তাকে দেখতে একেবারে মৃন্ময়ের মতো! কিছুক্ষণ ভালো করে বিকাশকে দেখে লোকটা তাকে বুকে টেনে নিল। তারপর কোনোরকম ভনিতা না করেই কানের পাশে ফিস্ফিস্ করে বলল, “তাহলে শেষ-পর্যন্ত আমাকে খুঁজে বের করেই ছাড়লি?”
বিকাশ রাগে অভিমানে লোকটাকে দূরে ঠেলে দিল। বলল, “তার মানে ব্যাপারটা সত্যি! তুই টেররিস্ট হয়ে গেলি! কিন্তু কেন?”
লোকটা হাসি হাসি মুখ করে দুই ঠোঁটের মাঝে আঙুল রেখে সাবধান করল, “শ্শ্শ্শ্… এরকম কথা এখানে বলিস না। তাহলে কিন্তু আমিও তোকে বাঁচাতে পারব না। টেররিস্ট তো তোরা নাম দিয়েছিস, আমরা তো আমাদের যোদ্ধা বলে পরিচয় দিই। ন্যায়ের যোদ্ধা।”
“ছিঃ ছিঃ… আমার ভাবতেও খারাপ লাগছে যে তুই আমার বন্ধু! ওদিকে তোর বউ-বাচ্চা কেমন আছে, কীভাবে দিন কাটাচ্ছে খবর রাখিস? তাদের প্রতি তোর সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য জলাঞ্জলি দিয়ে তুই এখানে এসে মারন খেলায় মেতেছিস! তোর খারাপ লাগে না?” বিকাশ শ্লেষোক্তি করল।
নিমেষে শক্ত হয়ে এল লোকটার চোয়াল। তার পরের মুহূর্তেই আবার নরম হয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, “পাপড়ি কেমন আছে?”
“পাগল হয়ে গেছে তোর অপেক্ষা করতে করতে। মেয়েটা এখনো এই আশা নিয়ে বেঁচে আছে যে, তুই নিশ্চই ফিরে আসবি। ও কী দোষ করেছিল বল? দোষ যদি কেউ করে থাকে তাহলে তো সেটা তুই করেছিস। তোর দোষের শাস্তি তুই সবাইকে দিচ্ছিস কেন?” বিকাশ বলল।
লোকটার ঠোঁট দুটো যেন সামান্য কেঁপে উঠল। তার পরের মুহূর্তেই আবার শক্ত হয়ে বলল, “সেই জন্যেই তো আমি আমার দোষের প্রায়শ্চিত্ত করছি। আমি যাদের সঙ্গে অন্যায় করেছি আমি সব ফিরিয়ে নেব।”
“এটা প্রায়শ্চিত্তের নমুনা? এসব করে তুই কী উদ্ধার করতে চাইছিস? নিজের নাম পালটে, ধর্ম পালটে, এখানে এসে আতঙ্কবাদী হয়েছিস। সাধারণ মানুষকে আরো কষ্ট দিচ্ছিস। আর সবথেকে হাস্যকর ব্যাপার কী জানিস? তুই নিজের নামে একটা গ্রুপ খুলেছিস মানুষের অনিষ্ট করবি বলে!”
“একটু ভুল বললি। আমি আমার নাম দিয়ে গ্রুপ খুলিনি। গ্রুপটা তো আগে থেকেই ছিল। আমি ওই নামটা ধার করে আমার নামের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছি শুধুমাত্র। খালিদ মানে কী জানিস? যা চিরন্তন… অমর। লস্কর-এ-খালিদি হচ্ছে – অমরত্বের সৈন্যদল। নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। দেখ… ঠিক যেমন আমি… আমার সত্বাটাও সারাজীবন পৃথিবীতে রয়ে যাবে। তার মৃত্যু নেই। মরলেও থেকে যাবে আরেক রূপে। কি ভালো, না?”
“এই… আমি তোর এইসব জ্ঞান শুনতে আসিনি। তোর উদ্দেশ্যটা কী বলত?”
“উদ্দেশ্য?… হুম… বলব তো… তোর মনে আছে তুই আমাকে “শ্রডিঙ্গারের বিড়াল”-এর থিয়োরি শুনিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ।”
“আমার ক্ষেত্রে বিড়ালটা প্রতিবারই বাক্সের ভিতর থেকে জ্যান্ত অবস্থায় বেরিয়েছে রে… বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার আমি অনেকরকম চেষ্টা করেছি। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু আমার ভাগ্য…! কোনো না কোনোভাবে বাচ্চাটা ঠিক বেঁচে গিয়েছে। একটা সময় হাল ছেড়ে দিয়েছি। অন্যভাবে চেষ্টা শুরু করেছি…”
“কীরকম?”
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি – আমি এই জগৎটাকেই ধ্বংস করে দেব। তাহলে বাঁশও থাকবে না আর বাঁশিও বাজবে না।”
“তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“আরে তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? তুই বৌদিকে নিয়ে জাম্বুসিতে চলে যা। তোর মনে আছে ঋদক বলেছিলেন – একটা জগতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার প্রভাব অন্য জগতে পড়ে না।”
উমর খালিদের কথা শুনে বাক্রুদ্ধ হয়ে যায় বিকাশ। দুই হাত মাথার উপর তুলে চুপচাপ শুনে যায় তার কথা।
উমর খালিদ বলতেই থাকে, “এই পর্যন্ত পৌঁছোতে ধর্ম পরিবর্তন করাটা আবশ্যিক হয়ে পড়ে আমার কাছে। উদ্দেশ্য সফল করতে আমার WMD চাই, ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাক্শন। নতুন নামে, নতুন অবতারে আমি এই গ্রুপ জয়েন করি। এবং আমার যোগ্যতায় আমি গ্রুপের “আমীর” হই, অর্থাৎ প্রধান। এখন আমি আমার উদ্দেশ্যের অনেক কাছে পৌঁছে গেছি রে।”
“সর্বনাশ! তুই নিউক্লিয়ার হামলা করানোর পরিকল্পনা করেছিস!”
“ইয়েস মাই ডিয়ার…”
“কিন্তু তোরা তো কাশ্মিরের পিছনে পড়ে রয়েছিলি না?”
“হ্যাঁ, এখনো রয়েছি তো। উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য একটা ইস্যু তো চাই…”
“পাগল তুই! পাগল হয়ে গেছিস তুই… এসব বন্ধ কর। এগুলো কোনো সমাধানের রাস্তা নয়। তুই ফিরে আয়। আমরা বসে ভাবব কী করা যায়, কী করা উচিত…”
“ভাবা-ভাবির দিন শেষ হয়ে গেছে রে… এখন আমি আমার উদ্দেশ্য থেকে পিছু হঠতে পারব না, আর ফিরে যেতেও পারব না। বরং তুই ফিরে যা। জাম্বুসিতে গিয়ে পরিবার নিয়ে ভালো থাক। আমার লোকেরা তোকে অক্ষত অবস্থায় আবার এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসবে। আর শোন… এখানে বেশি হিরোগিরি দেখাতে যাস না… তাহলে কপালে দুঃখ আছে।”
কথা শেষ করে উমর খালিদ একজনকে ঘরে ডাকল। তারপর তাকে বুঝিয়ে দিল বিকাশকে কোথায় ছেড়ে আসতে হবে।
নতুন লোকটা এসেই বিকাশকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল। তারপর আবার চোখে কালো কাপড় বেঁধে গাড়িতে তুলল।
***
২০০০ সাল, ব্যারাকপুর:
বিকাশের চোখ-মুখ দেখেই পাপড়ি বাকি এক শতাংশ, অর্থাৎ পুরো একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, উমর খালিদ এবং তার স্বামী মৃন্ময় আলাদা ব্যক্তি নয়।
পাপড়িকে পুরো সত্যি কথাটা বলে না বিকাশ। শুধু এটুকু বলে, “আমাদের খুব বিপদ। পুরো ভারতবর্ষের খুব বিপদ। কীভাবে সব ঠিক হবে জানি না। চলো তোমাকে আর মৃদুলকে একটা সেফ জায়গায় রেখে আসি…”
কিন্তু পাপড়ি কোথাও যেতে রাজি হয় না। সে মৃন্ময়ের এরকম হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে।
“পুরো কথা মৃন্ময় আমাকে বলেনি। তবে যেটুকু বুঝলাম ও কোনোভাবে ওদের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল, এবং তারপর থেকে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।” পাপড়ির মানসিক অবস্থার কথা ভেবে বাধ্য হয়ে এটুকু মিথ্যার আশ্রয় নিল বিকাশ।
***
মৃন্ময়কে নিজের জীবন থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি পাপড়ি। সে প্রতিজ্ঞা করে যে তার ছেলের উপর টেররিস্ট বাবার ছায়া কোনোদিন, কোনোভাবেই পড়তে দেবে না। নিজের সমস্ত পরিচয় পালটে ফেলে সে। ঘৃণায় মৃন্ময়ের দেওয়া পদবীটা পালটে ফেলে নিজের বাবার পদবী ব্যবহার করতে শুরু করে সে। এমনকি নিজের নামটাও পালটে ফেলে। পাছে মৃন্ময়ের অপছায়া কোনোভাবে গ্রাস করে মৃদুলকে সেই ভয়ে। পাপড়ি মুখোপাধ্যায় হয়ে ওঠে তৃণা বন্দ্যোপাধ্যায়।
***
পাঁচ
মৃন্ময় অর্থাৎ বর্তমানের উমর খালিদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কোনো মূল্যেই হোক এই জগৎটা ধ্বংস করতেই হবে। তাহলে সকলের সঙ্গে বাচ্চাটাও মারা যাবে এবং তার নিজের অস্তিত্বও শেষ হয়ে যাবে। ব্যাপারটা এভাবে ঘটলে বাচ্চা নিধনে তার সরাসরি হাত থাকবে না, এবং এতে তার ইচ্ছাপূরণ হবার একটা সম্ভাবনাও আছে। ব্যাস… তাহলেই তো সে চিরতরে মুক্তি পেয়ে যাবে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে। এখন একটা নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বাঁধাতে পারলেই হল। কয়েকটা মানুষ মরবে বটে… তাতে ক্ষতি কী? মানুষ তো কতই মরে প্রতিদিন… কত কষ্ট পেয়ে মরে! পৃথিবীতে জন্মানো মানেই প্রতিনিয়ত কষ্টের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। এখানে বেঁচে থাকাটাই যেন একটা পাশবিক প্রতিযোগিতা। লোক মেরে সে বরং তাদের ভালোই করছে, কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে সোজা জান্নাতের দরজায় পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের।
আর যদি ব্যর্থ হয়… তাহলে এই জগৎ থেকে অনেক দূরে, সবকিছুর থেকে সমস্তরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে, চলে যাবে জাম্বুসিতে। এযাবৎ সে যা অর্থ সঞ্চয় করতে পেরেছে তাতে নিশ্চিন্তে বিশ্বের যেকোনো বড়ো কসমেটিক সার্জেনের কাছে গিয়ে ওই জগতের লোকগুলোর মতো নিজের কান বানিয়ে ফেলতে পারবে সে। এবং নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারবে ওদের জগতে, ওদেরই মাঝে। ওখানে কারুর কোনোরকম সন্দেহই হবে না তাতে। কানের গঠন ছাড়া তো এই জগতের মানুষের সঙ্গে ওই জগতের মানুষের আর কোনো পার্থক্যই নেই!
এরপর বেশ কয়েকটা ঘটনা পরপর ঘটে গেল। এই বছরেই ডিসেম্বর মাসে দিল্লির লাল্ল কেল্লায় সন্ত্রাশবাদী হামলা হয়ে গেল। দু-জন ভারতীয় সৈনিক এবং একজন দারোয়ানের মৃত্যু হল তাতে।
ঠিক একবছর পর আবার হামলা হল দিল্লিতে। এবারের স্থান ভারতীয় সংসদ। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ফুঁসে উঠল এবার। “অপারেশন পরাক্রম” নাম দিয়ে পাঁচ লাখ সৈন্য সহ ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করল কাশ্মীর বর্ডারে। পাকিস্তানও একইভাবে তিন লাখ সৈন্য সহ ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করল। ভারত ঠিক করল ১৪ জানুয়ারি ওদের উচিৎ শিক্ষা দেবে।
এই সব কিছুর পিছনে বসে থাকা উমর খালিদ উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। সে বুঝতে পারল এইবার তার লক্ষ্যপূরণ হতে চলেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই পাকিস্তান জঙ্গী সংগঠনগুলোকে দমন করার সিদ্ধান্ত নিল। ফলে দুই দেশের মধ্যে যতটা যুদ্ধ প্রবণতা তৈরি হয়েছিল— সেটা খানিকটা হলেও স্তিমিত হল। উমর খালিদের পরিকল্পনা যেন তার চোখের সামনে ভেস্তে যাচ্ছিল।
১৪ মে কিছু আত্মঘাতী সন্ত্রাশবাদী কালুচক্ সৈন্য-শিবিরে ঢুকে ত্রিশ জনের বেশি মানুষকে গুলি করে হত্যা করল এবং প্রায় পঞ্চাশ জন আহত হল। যাঁরা মূলত ছিলেন ভারতীয় সেনা্দের স্ত্রী ও সন্তান। সারা পৃথিবী নিন্দা করল এই বর্বরোচিত কাজের। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে পাকিস্তানের সরকার-পক্ষ বাধ্য হল উমর খালিদ সহ বেশ কিছু জঙ্গী সংগঠনের কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করতে। কিন্তু ভারত এতে চুপ থাকল না। তারা এই জঙ্গিদের উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুতি শুরু করল। সেই মাসেই ভারত-পাকিস্তান বর্ডারে আবার শুরু হল যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ভয়াবহতার ছবি মহাকাশ থেকে দেখতে পাওয়া যায়। আবার নিউক্লিয়ার যুদ্ধের হুমকি আসে উভয় দেশ থেকেই। দুই দেশই নিজেদের নিউক্লিয়ার মিসাইল পরীক্ষা করে নেয়।
নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতায় শঙ্কিত পড়ল গোটা পৃথিবী। গোপন সূত্র থেকে খবর পাওয়া যায় পাকিস্তান নিউক্লিয়ার ক্ষেপনাস্ত্র প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলে গেল গেল রব উঠল। সারা পৃথিবীর বড়ো বড়ো নেতারা ভারত সরকারকে অনুরোধ করে যাতে তারা কড়া পদক্ষেপ না নেয়। এবং এই আশ্বাস দেয় তারা পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলবে শান্তি রক্ষার জন্য।
অন্যদিকে, জাতিসঙ্ঘে গোপন বৈঠক হল। বৈঠকে স্থির হল— প্রতিবাদী মনোভাবাপন্ন ভারতের এই সরকারকে যে করেই হোক গদিচ্যুত করতে হবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে। ততদিন দুই দেশকেই চাপে রেখে শান্ত রাখতে হবে। নয়তো গোটা পৃথিবীর সমূহ বিপদ।
উমর খালিদ ততদিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পাকিস্তানেই গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছে। সে আবার ব্যর্থতার জ্বলায় জ্বলে উঠল। সে দেখল— তার চোখের সামনে হয়ে চলা দুই দেশের যুদ্ধ আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে। যা ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।
২০০৪ সালের মে মাসে ভারতে নতুন সরকার গঠন হল। উমর খালিদ বুঝল তার লক্ষ্যপূরন এখন প্রায় আশাতীত। দুই দেশের সরকার নিউক্লিয়ার দম্ভে ভর করে একে অপরের বিরুদ্ধাচরন না করলে তার মনোবাসনা কখনই পূর্ণ হবে না। খেলাটা তো বেশ ভালোই জমে উঠেছিল… কিন্তু এ কী হল শেষে! যে সুন্দর এবং সুপরিকল্পিত ভাবে দাবার বোর্ডে গুটিগুলো সাজিয়েছিল সে, তা ফল এনে দিতে পারল না তাকে! এতভাবে মাথা খাটানো সত্ত্বেও মাত হয়ে গেল তার! যা জেতা খুবই সোজা মনে হয়েছিল একসময়, তাতেই সে হেরে গেল রাজনীতির মার-প্যাঁচের কারণে। হেরে সর্বশ্রান্ত হয়ে যাওয়া রাজার মতই একাকী ক্ষোভে ফুঁসতে থাকল সে।
এর পরের মাসেই গৃহবন্দি অবস্থা থেকে রাতারাতি পালিয়ে গেল উমর খালিদ। কোনোভাবে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। যেভাবে হঠাৎ এসেছিল, সেভাবেই যেন উবে গেল সে!
***
২০০৪ সাল:
২৬ ডিসেম্বর ঠিক সকাল আটটা বাজতে দুই মিনিট আগে কেঁপে উঠল সুমাত্রা ও আন্দামানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা সর্বোচ্চ ৯.৩ ম্যাগ্নিটিউড। বিশাল জলোচ্ছাসে ভেসে গেল ভারতীয় উপমহাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো। প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হল। প্রচুর হতভাগ্য প্রাণ গেল। সারা পৃথিবী সেদিন প্রথম জানতে পারল “সুনামি” কথার অর্থ।
কিন্তু আসলে যা ঘটল তা কোথাও প্রকাশ হল না। দুনিয়া জানল না সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পিছনের গল্প। অথবা জানতে দেওয়া হল না। সব ঘটনা তো জনসাধারণের জানার জন্য নয়। কিছু ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই হয় বেশি।
***
হিমালয়ের একটা বিশেষ জায়গায় একটা পারমাণবিক বোমা প্রতিস্থাপন করা হয়। বোমাটা বরফের মধ্যে বেশ কিছুটা খোদাই করে প্রবেশ করানো হয়। উদ্দেশ্য— এই বোমা ফাটিয়ে হিমবাহের সমস্ত বরফ একেবারে গলিয়ে ফেলতে পারলে গোটা পূর্ব ভারত জলের তোড়ে ভেসে যাবে।
বোমাটা যখন ফাটে তখন ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে যতটা না প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়, নিম্নে প্রভাব দেখা যায় তার থেকেও বেশি। বিষ্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে হিমবাহ থেকে বেশ কিছু বরফ খসে গিয়ে উপর থেকে সেটিকে আরো চাপা দিয়ে দেয়। কিন্তু নীচের দিকে সেটার প্রভাব পড়ে গোটা ভারতীয় টেকটনিক প্লেটের উপর। ভারতীয় প্লেটটাকে যেন মৃদু ঠেলে দেয় বিষ্ফোরণটা। ফলে দক্ষিণে সেটা সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে বার্মা টেকটনিক প্লেটে। এবং ভারতীয় প্লেটের ওই অংশ ঘষা খেয়ে ঢুকে যায় বার্মা প্লেটের নীচের দিকে। এর ফলে সেখানেও ভীষণ কম্পন ও জলোচ্ছাসের সৃষ্টি হয়।
***
খবরটা শুনেই জাম্বুসির এক নাতিব্যস্ত রাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে গেল লোকটা। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক পৈশাচিক হাসি। যাক, পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি তাহলে! চিন প্রদেশকে সে মনে মনে ধন্যবাদ জানাল সহযোগিতা করার জন্য। এই তো সবেমাত্র শুরু… আগামীতে তো অনেক কিছুই করার বাকি!
এখন কী নামে ডাকা যায় লোকটাকে— মৃন্ময়, মৃদুল, উমর খালিদ, নাকি অন্য কিছু?
Tags: বড় গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সুমন সেন