হেলথ টনিক
লেখক: সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১. বুদবুদ
ছয় জন ডুবুরি বঙ্গোপসাগরের জলতল থেকে কয়েক ফুট নীচ দিয়ে দক্ষিণ দিকে সাঁতরে আসছিল। প্রেশারাইজড পোশাকের পিঠে লাগানো প্রপেলার অবলীলায় জল কেটে তাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ছয় জনের হাতে ধরা বিরাট জাল, তাতে জড়িয়ে আছে কিছু নতুন প্রজাতির আগাছা। সমুদ্রের স্বচ্ছ জলের নীচে পিছনে সরে যাচ্ছে মহীসোপানের সমতল ভূমি, তাতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মাছের ঝাঁক। ছয়জন সাঁতারু আরো এগিয়ে চলল। মলিন নীলচে-সবুজ আলোর মধ্যে দিয়ে দূরে চকচক করে উঠল এক সুবিশাল, চ্যাপটা গম্বুজ।
বাইরে থেকে গম্বুজের পলিমারের দেওয়ালের ওপারে হাওয়া ভরা শহরের ঘরবাড়িগুলো অদ্ভুত দেখায়। ভিতর দিকে জলের চাপ থেকে শহরকে বাঁচাতে উচ্চ সহনশীলতার জ্যামিতিক কাঠামো থাকলেও বাইরেটা নিটোল বক্রতল। মহীসোপান যেখানে শেষ হয়ে মহীঢাল হয়ে অতলে নেমে গিয়েছে, সেই বিরাট সিঁড়ির কিনারায় লেগে আছে আট কিলোমিটার ব্যাসের নিউ ক্যালকাটা বুদবুদ।
বুদবুদের পরিধিকে সমান ছয় ভাগে ভাগ করে রেখেছে ছ-টা সুড়ঙ্গপথ। তাদের একটার ভিতর ঢুকে ডুবুরিরা শহরের ভিতরের এক ঘাটে উঠে এলো।
একটি যুদ্ধ-ডুবোজাহাজ, একাধিক শৌখিন প্রমোদ-ডুবোজাহাজ ও অনেকগুলো জল-রিকশার ভিড় এড়িয়ে ঘাটের এক পাশে কয়েকজন মানুষ ক্যারিয়ারওয়ালা এক ক্লান্ত গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। আগন্তুক দলের একমাত্র মহিলাটি ডুবুরির পোশাক ছাড়তে ছাড়তে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করল, “মুখ ব্যাজার কেন, রামস্বরূপ?”
“আজকে একটা জালও ভর্তি হল না?”
“হুঁ, অন্য রাস্তা দেখতে হবে,” বলে মহিলা তার সঙ্গীদের সঙ্গে গাড়ির পিছনের ক্যারিয়ারে জাল আর দড়িদড়া তুলে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই আগাছা যাবে বিধাননগর গরীব আশ্রয়ের কারখানায়; অতি-বিরল ও দুর্মূল্য চটের ব্যাগের শস্তা বিকল্প হিসেবে শহরের মানুষ এই “উইড ব্যাগ” পছন্দ করে। নামটা নিউ ক্যালকাটারই কোনো ফাজিল ব্যক্তি রেখেছিল নিশ্চয়ই; তার ধন্যবাদ প্রাপ্য। মীমের বহুমুখী উৎস এই উইড ব্যাগের কাটতির একটা কারণ তার নাম; আর সেই নাম ভাঙিয়ে গরীব আশ্রয়ের অনেকের পেট চলছে।
মহাবৃত্ত নামক রাস্তা ধরে ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে চলল গাড়ি। বৃত্তাকার শহরকে পরিধি বরাবর ঘিরে থাকা হাইওয়ের পক্ষে যুৎসই নাম। রাস্তার বাঁ দিকে কয়েক মিটার ফাঁকা জায়গায় পর্যটকদের বসার জন্য বিভিন্ন বিন্যাসে রাখা চেয়ার, তারপর স্বচ্ছ দেওয়াল। তার বাইরে সমুদ্র। ডাঙার মানুষ সেদিকে তাকালে চোখ ফেরাতে পারে না। ডানদিকে সার বেঁধে রয়েছে পেল্লায় হোটেল ও বিলাসবহুল দোকান। কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্র এখান থেকে অনেক দূর। বাইরের নয়নাভিরাম নীল যে আসলে নির্বিকার আতঙ্ক। কোনো দুর্বিপাকে শহরের দেওয়ালে ফাটল ধরলে জল সবার আগে ভাসিয়ে দেবে মহাবৃত্তের পথ। জনবসতি তাই পরিধি থেকে দূরে, গম্বুজের কেন্দ্রের কাছাকাছি।
গম্বুজের অভ্যন্তর ভাগ বাইরের দেওয়ালেরই উপাদানে নির্মিত স্বচ্ছ দেওয়াল দিয়ে অনেকগুলো প্রকোষ্ঠে ভাগ করা। বৃহৎ বুদবুদের মধ্যে ঠাসা ছোটো ছোটো বুদবুদ। এরকম তিনটে দেওয়ালের গেট পেরিয়ে গাড়ি ডান দিকে বাঁক নিল। দোকানপাট শেষ হয়ে দেখা গেল গরীব আশ্রয়ের সাদামাটা কোয়ার্টার। সেখানেই দুই বাড়ির মাঝে এক ফাঁকে অপরিসর জায়গায় গুটিসুটি হয়ে ঢুকল গাড়ি।
২. জ্ঞানেন্দ্র মশাট
সে মহাকাশ দেখেছে। মঙ্গল ঘেঁষে গ্রহাণুপুঞ্জে একাধিক বার যাতায়াত করেছে; একবার শনির বলয় পর্যন্ত গেছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের বাইরে পৃথিবীর চেহারা তার দেখা হয়নি। এই গবেষণা প্রকল্পে যোগদানের সুবাদে সেই সুযোগ পেয়ে সে তার নতুন বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ। স্বাধীন বিজ্ঞানী নিজস্ব যান পাঠিয়ে দিয়েছেন, স্রেফ তার জন্য! এক ঘণ্টার ইন্টারভিউতে তার মধ্যে কী এমন দেখলেন, যাতে প্রাথমিক গবেষণা সহায়ক হিসেবে তাকে পছন্দ করে ফেললেন? যাই হোক, এই রহস্য উন্মোচনে মন দেওয়া এখনই তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার সামনে অনেক কাজ।
নিউ ক্যালকাটার উত্তর-পশ্চিম গেটে সকালে নির্ধারিত সময়ে সে হাজির হয়েছিল। স্মৃতি থেকে বুঝতে পেরেছিল, তাকে নিয়ে যেতে আসা যানটি ডাঙার সবজি পটলের আকৃতিবিশিষ্ট, লেজটুকুই যা মেলে না। সে দুটি আসনের একটিতে বসতে সিটবেল্ট আপনা থেকেই তাকে জড়িয়ে ধরল। পেটের মধ্যে তাকে পুরে নিয়ে অটোপাইলট চালিত যান অবলীলায় গেটের জলে ডুব দিয়ে সুড়ঙ্গের বাইরে এলো। সে দেখল, স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপারে পটলের দু-দিক থেকে বার হচ্ছে দুটি পাখনা। স্নিগ্ধ নারীকণ্ঠে ঘোষণা হল, “যানের পরিধির উপরে একটি এবং তার একশো কুড়ি ডিগ্রি কোণে দু-পাশে দুটি পাখনা জলের মধ্যে চলতে সাহায্য করে।” তারপর এক সেকেন্ড থেমে কণ্ঠ ফের বলল, “এই যান আপনার দৃষ্টি লক্ষ করে আপনার আগ্রহের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাধ্যমতো ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। ব্যাখ্যা সংক্রান্ত তথ্য ও সাধারণ নিরাপত্তা নির্দেশাবলী আপনার সামনের ড্যাশবোর্ডে রয়েছে। দেখতে চাইলে ক্লিক করুন। স্বয়ংক্রিয় ব্যাখ্যা বন্ধ করতে চাইলে বলুন, “চুপ করো।” নির্দিষ্ট বস্তু সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হলে সেইদিকে তাকিয়ে বলুন, “ব্যাখ্যা করো।” এই দ্বিতীয় ঘোষণাটা হল দু-বার।
সে চমৎকৃত হয়ে বসে রইল। তাকে নিয়ে প্রবল বেগে জল কেটে যান ছুটে চলল। ঘোষকের কথামতো ঠিক মাথার উপরেও হাঙ্গরের পিঠের মতো একটা পাখনা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে হয়তো একটু বেশিক্ষণ নজর রেখেছিল সে, কারণ আবার ঘোষণা শুরু হল, “যানের পরিধির উপরে একটি এবং তার একশো কুড়ি ডিগ্রি কোণে…”
সে তাড়াতাড়ি বলল, “চুপ করো।” ঘোষণা থেমে গেল।
নীচের দিকে আর পিছন দিকে টান অনুভব করে সে আন্দাজ করল, যান যথেষ্ট খাড়া কোণ বরাবর সমুদ্রতলের দিকে এগোচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রতল ভেদ করে হাওয়ায় ছিটকে উঠল সব্যসাচী যান। চটপট পিঠের পাখনা দু-ভাগ হয়ে ছাদের সঙ্গে সমান হয়ে শুয়ে পড়ল। পাশের পাখনা দুটো আরো চওড়া ও পাতলা হয়ে ডানার আকার নিল; সেই সঙ্গে একটু করে উপর দিকে উঠে এলো। তাদের গায়ে কব্জা লাগানো ছোটো ছোটো প্যানেল, হাওয়ার গতির সঙ্গে তাল রেখে বিভিন্ন কোণে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে।
সে ড্যাশবোর্ডে তাকিয়ে দেখল, এক সহজ সরল মানচিত্রে যানের গতিপথ দেখা যাচ্ছে। তাকে এই যান নিয়ে চলেছে উত্তর-পশ্চিমে, ভারতের মূল ভূখণ্ডের দিকে।
বর্ষাকাল। মেঘের মধ্যে প্রবেশ করে যান ভূপৃষ্ঠের সমান্তরাল গতিপথে থিতু হতে সে দেখল, ডাইনে-বাঁয়ে, উপরে ও নীচে হরেক রকম মেঘ ছাড়া কিছু চোখেই পড়ছে না। একটু দমে গিয়ে সে ভিউ স্ক্রিন খুলে বসল।
অনেকক্ষণ পর আবার ঘোষণা শোনা গেল, “আমরা আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যাবো।” সে স্ক্রিন অফ করে সামনে তাকাল। আকাশ থেকে মেঘ অদৃশ্য হয়ে গেছে। নীল সমুদ্রের মতোই অতলান্ত, কিন্তু স্নিগ্ধ ও শান্ত ট্রপোস্ফিয়ারের ঠিক উপরে ট্রপোপজ অঞ্চল দিয়ে সে ভেসে যাচ্ছে। ঘন হাওয়ার সমুদ্রে ডুব দিতে নীচে ফুটে উঠল আদিগন্ত বিস্তৃত বালুপ্রান্তর। মানচিত্রে সে দেখল, যান তাকে মরুভূমিতে এনে ফেলেছে।
সামনে বহুদূরে দেখা গেল এক ভাসমান আলোর বিন্দু। দ্রুত সেই বিন্দুর আয়তন বাড়তে লাগল। সূর্য প্রায় মাথার উপর, সেই কিরণে ঝকমক করছে রোদেরই রঙের এক বাড়ি। সে বলল, “ব্যাখ্যা করো।”
ব্যাখ্যা হল, “আকাশ বাংলো নং ছয় চার বাই দুই চার নয়। নির্মাতা, হিমেল্সডর্ফ। মালিক, আচার্য জ্ঞানেন্দ্র মশাট।”
এতক্ষণে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি উত্তেজনায় বাড়তে থাকল। কোথায় জ্ঞানেন্দ্র মশাট, আর কোথায় সে! হঠাৎ তার মনে হল, এই আকাশবাড়িতে তাকে নিয়ে এই ব্যক্তি যা খুশি করতে পারে। প্রত্যন্ত সমুদ্র শহরের “ফ্রিলোডার” তায় অনাথ সে; আইনকানুন কি তার জন্য মাথা ঘামাবে?
তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল ভাসমান বাড়ির কারুকাজ। মেঘের মতো এক বিশাল গদির উপর বড়ো বড়ো জানালা ও সামনে ঘাসের প্রশস্ত মাঠওয়ালা দোতলা বাড়ি। বাড়ির তিন দিকে ঘন জঙ্গল; সেই জঙ্গলের গাছে পাতার বদলে রয়েছে সৌর প্যানেল। গদির নীচের দিকে বাতাস থরথর করে কাঁপছে। সে আন্দাজ করল, কোনো ধরনের শক্তিপ্রবাহ এই বাড়িকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখার জন্য অবিরাম নীচের বায়ুস্তরে বলপ্রয়োগ করে চলেছে।
বাড়ির ঠিক সামনে এক চৌকো অংশে ঘাস নেই; যান সন্তর্পণে সেই ফাঁকা জায়গাটিতে এসে দাঁড়াল। ভিতর থেকে সে অনুভব করল, শক্ত জমিতে দাঁড়াতে যানের নিশ্চয়ই পা গজিয়েছে।
স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে এগিয়ে এলেন এক মাঝারি উচ্চতার মানুষ। পরণে তাঁর সাদা পোশাক, লম্বা সাদা চুল চুড়ো করে বাঁধা। চোখে কাজল, দাড়িগোঁফ কামানো মুখ। টুকটুকে লাল লিপস্টিকে হাসি ঝলসে উঠল।
“এসো এসো, ধৃতিমান সমদর্শী, নবকলকাতাবাসী নবযুবক, এ তোমার নিজের বাড়ি বলেই মনে করো!”
যান থেকে নামতেই এই নাটকীয় অভ্যর্থনায় ধৃতিমান যেন আরেকটু সংকুচিত হয়ে গেল। তারপর এগিয়ে গেল বিশ্বের আড়াইশোটা আকাশ বাংলোর চতুঃষষ্টিতম বাংলোর দিকে।
৩. মোলাকাত
গাড়ি থামতেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কলকল করে উঠল। জালে কী উঠেছে তাই দেখতে ওরা মুখিয়ে থাকে। আজকে অবশ্য প্রত্যেকের মনোযোগ জালের দিকে নেই।
একজন চেঁচাল, “রঙ্গনা আন্টি, তোমায় কে খুঁজছে!” আরেকজন জুড়ে দিল, “ডাঙার লোক!”
চালকের পাশের আসন থেকে নামতে গিয়ে রঙ্গনা অবাক হল। ডাঙা থেকে কে তার খোঁজে আসবে…
তার কোয়ার্টারের কমন রুমে বসে থাকা লোকটিকে দেখে রঙ্গনা প্রথমেই চিনতে পারল না। পূর্ব এশীয় গড়নের ছিপছিপে চেহারা, মধ্যবয়স্ক মানুষ। সচ্ছল ও পরিচ্ছন্ন পোশাক। ধৃতিমান ছেলেটা তার সঙ্গে খোশগল্প জুড়েছে। হাসতে গেলে তার চোখের কোণে অনেকগুলো ভাঁজ পড়ছে। রঙ্গনার আগমন টের পেয়ে লোকটি মুখ তুলে চাইল। রঙ্গনা এক মুহূর্তের জন্য দেখল, তার চাউনিতে চাপা উৎকণ্ঠার ভাব।
“মিস রায়, বহুদিন পর দেখা!” উৎকণ্ঠার আভাসমাত্র না দিয়ে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে উঠে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল আগন্তুক।
রঙ্গনা প্রত্যুত্তর দিয়ে বলল, “আপনাকে স্বাগত। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…”
বার দুয়েক চোখ পিটপিট করে লোকটি ভুরু দুটোকে কপালে তুলে ফেললো। “ওঃ হো আপনি চিনতে পারেননি। আমি ইশিদা ওরিহারা, দিল্লিতে দেখা হয়েছিল। আপনারা শনির বলয়ে বরফ কুড়োতে যাচ্ছিলেন, কারা প্রোডিউসার ছিল সেটা মনে নেই…” লোকটির বাংলায় হালকা বিদেশি টান।
দু-সেকেন্ড ভাবতে রঙ্গনার মনে পড়ল। প্রোডিউসার ছিল দেবগুরু স্পেস কর্পোরেশন। বছর তিনেক আগে তারা এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিযানের তোড়জোড় শুরু করে। এ যাবৎ এশিয়ার স্পেস এলিভেটর থেকে উৎক্ষিপ্ত প্রতিটা বহির্গ্রহ অভিযানেরই লক্ষ্য ছিল সৌরজগতের আশপাশে ডজন খানেক আলোকবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্থানীয় আন্তঃনক্ষত্র মেঘের মাঝে ভাসমান তারারা। দেবগুরু স্পেস কর্পোরেশন নতুন মহাকাশযানের ফ্লিট বানিয়ে এবং ব্যয়বহুল ওয়র্মহোল প্রযুক্তি প্রয়োগের অনুমতি আদায় করে সেই মেঘের বাইরে হাত বাড়ায়। তারা এপসিলন ইন্ডি নক্ষত্রকে নিশানা করে।
মহাকাশযাত্রার প্রস্তুতি পর্বে কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন দিল্লিতে এসেছিল। তাদের মধ্যে ধনকুবের এবং খুচরো শেয়ার হোল্ডার যেমন ছিল, তেমনি মূল অভিযানে অংশ নিতে ইচ্ছুক অনেক বিজ্ঞানীও এসেছিল উমেদারি করতে। জাপানি বিজ্ঞানী ইশিদার সঙ্গে সংক্ষেপে আলাপ হয়েছিল রঙ্গনার।
“আপনি নিউট্রিশনে ছিলেন, তাই না?” রঙ্গনা জিজ্ঞেস করল।
“একদম ঠিক!” তর্জনী তুলে তারিফ করল ইশিদা। “আমি মহাকাশচারীদের পুষ্টি নিয়ে গবেষণা করি, তখনও করছিলাম।”
“কিন্তু আপনি শেষ পর্যন্ত ওদের সঙ্গে যাননি।”
দুঃখের হাসি হেসে ইশিদা বলল, “ওরা আমাকে নেয়নি।”
রঙ্গনা জিজ্ঞেস করল, “আমরা কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”
এ-কথার জবাবে ইশিদার চোখ একবার কমন রুমের চারপাশটা মেপে নিল। কিন্তু কিন্তু গলায় সে বলল, “আপনি এখানে কেন রয়েছেন? আপনার তো আরো ভালো জায়গায় থাকার কথা।”
রঙ্গনা বলল, “ছাঁটাই হয়ে গেছি। কলোনির এই সেক্টরে আমরা প্রত্যেকেই ইন্ডিয়ান অ্যাস্টেরয়েড মাইনিং কোম্পানি থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক।”
বোঝা গেল, ইশিদা হতাশ হয়েছে। “একথা জানতাম না,” বিব্রত হয়ে বলল সে। “আপনাদের মাঝে আলটপকা এসে পড়া উচিত হয়নি আমার।”
হাত তুলে রঙ্গনা তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল। “আমরা চালিয়ে নিচ্ছি। আপনি দুপুরবেলা এসেছেন, কিছু খাওয়াদাওয়াও করে যাবেন। কিন্তু আগে আসল কথাটা বলুন।”
এক মুহূর্ত চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশিদা বলল, “আপনাকেই বলবো। তবে একটু নিরিবিলিতে বলতে পারলে সুবিধে হত।” কমনরুম সারাদিন সরগরম থাকে। তায় নানা বয়সের লোকজন এখন আড়চোখে ইশিদাকে লক্ষ করছে। অস্বস্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
রঙ্গনা ঘাড় হেলিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, “তাহলে এখন খান, বিশ্ৰাম নিন। বিকেলবেলা আপনাকে নিরিবিলিতে নিয়ে যাবো।”
ইশিদা সামনে সামান্য ঝুঁকে সম্মতি জানিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে গেল। ধৃতিমান হাত তুলে ইশারা করল, “আমিও যাবো!”
রঙ্গনা পালটা ইশারায় “না” বলে কমন রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
৪. গবেষণার বিষয়
ধৃতিমানের চমকের পর চমক লাগছিল। যান থেকে নামার কিছুক্ষণ পরেই তার সারা শরীরের চামড়ায় অদ্ভুত রুক্ষতার অনুভূতি আরম্ভ হল। সরাসরি সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসার ফলে চোখ মেলে তাকাতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। জ্ঞানেন্দ্র মশাট দাঁড়িয়ে থেকে তাকে সময় দিলেন। কমলা রঙের এক রীতিমতো যান্ত্রিক-দর্শন যন্ত্রমানব তাকে একটি চেয়ার এনে বসতে দিল। “কি দুরবস্থা, বলো? মানুষের আর হাওয়া, রোদ্দুর সহ্য হয় না!” আচার্য মশাট ছদ্ম হতাশার ঢঙে বললেন। ধৃতিমান তাঁর দিকে তাকিয়ে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাসল। হিসেবমতো এঁর বয়স একশোর কাছাকাছি হওয়ার কথা। চালচলনে সেই বয়সের চিহ্ন নেই।
ধাতস্থ হওয়ার পর ধৃতিমান উঠে দাঁড়াল। অধ্যাপকের সঙ্গে প্রবেশ করল বাংলোর ভিতর। ঢুকেই এক বড়োসড়ো বৈঠকখানা। তার একপাশে বেতের নীচু টেবিল ঘিরে তিনটে লোভনীয় নরম সোফার একটায় ধৃতিমানকে বসতে ইঙ্গিত করে আরেকটায় নিজে বসলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। সবুজ রঙের এক যন্ত্রমানব টেবিলে দুটি গেলাস ভর্তি শরবত এনে রাখল। জ্ঞানেন্দ্র মশাট তাঁর ভিউ স্ক্রিন অন করে ডান হাতে গেলাস তুলে নিলেন। ধৃতিমান দেখাদেখি তাই করল। অধ্যাপক সটান জিজ্ঞেস করলেন, “কাজের ছকটা দেখেছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“জানো তো, আমি গত দু-বছর কোনো সহকারী নিইনি। তোমার কাজ করার অভিজ্ঞতাও মহাকাশযানে, অনেকটাই অন্যরকম ব্যাপার স্যাপার। এই ব্রেক থ্রুর সম্ভাবনাটা তোমার চোখে পড়ল কীভাবে সেটা ভাবছি…”
“জীববিদ্যায় আমার আগ্রহ অনেকদিনই ছিল, স্যার। কাজটা কিছুটা অনিচ্ছায় নিতে হয়েছে। আর ব্রেক থ্রু-র সম্ভাবনাটুকুই আমার চোখে পড়েছে। এই কাজ তো আমার দ্বারা হওয়ার নয়। আমি শুধু আপনার সঙ্গে থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে পারলেই খুশি হবো।”
“সেই সঙ্গে সিভি-টা বেশ ভারীও হবে, বলো?” মিষ্টি করে হাসলেন আচার্য মশাট।
ধৃতিমান দাঁত বের করে রইল।
“আচ্ছা ধৃতিমান, তারপর, সেই ভারী সিভি নিয়ে কী করবে তুমি? কোথায় যাবে?” উৎসুক গলায় জানতে চেয়ে ধৃতিমানের দিকে ফিরলেন অধ্যাপক। ভিউ স্ক্রিন বন্ধ করে দিলেন।
ধৃতিমান চটপট জবাব দিল, “অ্যাপ্লাই করব স্যার। বাইরে পেলে খুব ভালো, কিন্তু দেশের মধ্যে হলেও চলবে।” সেও স্ক্রিন বন্ধ করে দিয়েছে।
“এখন তো আমাদের দেশকে কেউ সেকেন্ড অপশন মনে করে না, ধৃতিমান। তুমি বাইরে যাওয়ার কথাই আগে ভাবছ কেন?”
“দেশের ব্যবস্থাটা খুব সুবিধের মনে হয় না, স্যার,” একটু চুপ থেকে ধৃতিমান বলল। “অন্তত আমার মতো লোকের জন্য নিশ্চয়ই নয়।”
“আমি ঠিক আন্দাজ করে থাকলে তুমি কাজ ছাড়া কখনো ডাঙায় আসোনি। এসেছ কি?”
“আজ্ঞে না।”
“দেশটা যে বিরাট। ডাঙায় না উঠেই তুমি গোটা ব্যবস্থাটাকে দোষী বলে দিচ্ছ কীভাবে?”
“গোটা দেশ থেকেই লোক নিউ ক্যালকাটায় বেড়াতে আসে, স্যার।”
জ্ঞানেন্দ্র মশাট ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন। “হুঁ, মনে হচ্ছে তোমায় কিছু বেশি নমুনা দেখে এই সিদ্ধান্ত নিতে হত।”
ধৃতিমান চুপ করে রইল।
“যাইহোক,” অধ্যাপক তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, “পদোন্নতি আর খ্যাতির বিচারে আমার আর কিছু পাওয়ার নেই। এক প্রতিভাবান সহকারীর সিভি ভারী করতে পারলে আমি খুশিই হব। ধৃতিমান, এই ব্রেক থ্রু যদি সম্ভব হয়, তুমি চাইলে তার প্রথম দাবিদার হতে পারো।”
ধৃতিমান বার বার বিজ্ঞানীকে ধন্যবাদ জানাল; প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রতি এমন উদাসীনতা কারো পক্ষে সম্ভব বলে বিশ্বাস ছিল না তার।
শরবতের পর পেট ভরে খাওয়া হল। এমন সুস্বাদু ভোজনের সৌভাগ্য ধৃতিমানের আগে কখনো হয়নি। তার খাওয়া দেখে জ্ঞানেন্দ্র মশাট মন্তব্য করলেন, “বুঝলে, নিউ ক্যালকাটায় সিনথেটিক আলোয় সবজি বাড়ে; এই স্বাদ ওখানে পাবে না।”
৫. গোপন কথা
সন্ধের অন্ধকার সমুদ্রগহ্বরে কোনোকিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। শহরের কিছু আলো সব সময়ই জ্বলে; এখন সমস্ত আলো জ্বলে উঠেছে। মাঝে মধ্যে দেওয়ালের বাইরের অন্ধকারে ছোটো ছোটো শরীরে সেই আলোর রুপোলি চকচকে প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিল ইশিদা। দু-একবার তার মনে হল, জমাট অন্ধকারের মতো কয়েকটা অতিকায় ছায়ামূর্তি বেশ কিছুটা দূর দিয়ে ঘুরে ফিরে যাচ্ছে। তার আর ওই অন্ধকারের মাঝে শুধু এই কাচের মতো দেখতে দেওয়াল। কত পুরু? একটা তিমি যদি এসে গুঁতো মারে, এই দেওয়াল টিকবে? তিমিরা কি এমন খামখেয়ালী হয়?
উলটোদিকের চেয়ারে রঙ্গনা চুপ করে বসে আছে। তাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিচ্ছে। খাওয়ার পর হালকা ঘুমিয়ে নিয়েছে ইশিদা। তারপরেই তাকে নিয়ে রঙ্গনা চলে এসেছে দক্ষিণ দিকের গেটের কাছে মহাবৃত্তপথের একটি অংশে। এখানে মহীসোপানের সমতলভূমি কিছুদূর গিয়েই শেষ। শহরের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে খাতের কিনারা। চেয়ারগুলো খালি। রাত্রে টুরিস্টরা পারতপক্ষে সমুদ্র দেখতে আসে না; বোরিং। ইশিদার মনে হল, ভয়ানকও বটে। সব মিলিয়ে নিউ ক্যালকাটায় এমন নিরিবিলি জায়গা আর নেই।
মহাবৃত্তের ধারে আলোগুলো সব শহরমুখী; সমুদ্রের দিকে তাগ করা নয়। আলো আঁধারিতে তাই রঙ্গনার চেহারাটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। এখানকার বাসিন্দাদের গায়ের রং ফ্যাকাসে, বেশির ভাগই জীবনে রোদ্দুর পায়নি। রঙ্গনাও কার্যত অনেকদিন এখানে বন্দি। ইশিদার গা শিরশির করে উঠল; সে জান্তব প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে সংযত করে শুরু করল নিজের বক্তব্য। কাউকে বলতে না পেরে অস্থির লাগছিল; আর কিছু না হলেও স্রেফ মন খুলে কথা বলতে পারার মধ্যে একরকম শান্তি আছে। সামনের মানুষটা তাকে সাহায্য করুক বা না করুক, অন্তত ঠকাবে না।
রঙ্গনার প্রতি ইশিদা একরকম আকর্ষণ অনুভব করছে। এই আকর্ষণ শারীরিক নয়। যেন কোনোভাবে রঙ্গনার কাজে লাগতে পারলে ভালো হত, এমন এক অনুভূতি। সে যদিও এসেছিল নিজের ভাগ্য উদ্ধারের জন্য। সেই আশা অনেকটাই ঘুচে গেছে। সরকারি চাকরিটাই যখন নেই, রঙ্গনার ক্ষমতা আর কতটুকু? তবু তার চেয়ে উপযুক্ত কারো কথা ইশিদা ভাবতে পারছে না। তার আবিষ্কারকে ঠিক পথে কাজে লাগাতে রঙ্গনাই পারবে।
মনের এক কোণে ইশিদা ভাবছে রঙ্গনার ছাঁটাই হওয়ার কথা। জানতে হবে কেমন করে হল। গোটা কলোনি রঙ্গনাকে সমীহ করে চলে এটা ইশিদা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বুঝতে পেরেছে। তার ছাঁটাই হওয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু ইশিদার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর রঙ্গনা আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ দিল না। “বিরাট ব্যাপার। ভেবে দেখতে হবে। যা কিছু বললেন সেই সবের প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”
“সব নিয়ে এসেছি!” ইশিদা বাঁ হাতের ব্যান্ডে ভিউ স্ক্রিনের সুইচ অন করে বলল, “আপনার স্ক্রিনটা একবার…”
এক লহমায় তার বাঁ হাত জাপ্টে ধরে সুইচ অফ করে দিল রঙ্গনা। চোখের সামনে স্নিগ্ধ আলোর আয়তক্ষেত্র জ্বলে উঠতে না উঠতেই দপ করে নিভে গেল। “সাবধানের মার নেই, মি. ওরিহারা। কলোনিতে চলুন, সবাইকে একসঙ্গে দেখাবেন।”
“কিন্তু অত লোক…” বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ইশিদা অনুযোগ করল।
রঙ্গনা হেসে বলল, “আপনি আমাকে নেতা মনে করছেন, মি. ওরিহারা। কিন্তু কলোনিতে আমরা সবাই কাজকর্ম একসঙ্গে করি। গোটা কলোনি আমার ভরসার জায়গা।”
ইশিদার তটস্থ ভাব তবু কাটল না। রঙ্গনা বলল, “বেশ। আমি আপনার ভয় ভাঙানোর দায়িত্ব নিলাম। আপনি গরীব আশ্রয়ে কিছুদিন আসুন। সবার সঙ্গে কথা বলুন। আমার ভরসা যতদিন আপনার মনেও না তৈরি হচ্ছে, আমরা একসঙ্গে কাজ শুরু করব না।”
একটু ইতস্তত করে ইশিদা বলল, “আরেকটা অনুরোধ আছে আমার।”
“শুনি?”
“আপনাদের হেঁশেল থেকে কিছু স্যাম্পল যদি দিতে পারেন। মানে, অথরিটি যদি জিজ্ঞেস করে, কী করতে আমি গরীব আশ্রয়ে যাতায়াত করছি, ওদেরকে একটা ছুতো দেখাতে হবে…”
রঙ্গনা হেসে বলল, “চিন্তা নেই, পেয়ে যাবেন।”
গাড়ি ছুটল গরীব আশ্রয়ের দিকে।
৬. বেড়াতে বেড়াতে
“এবার,” জ্ঞানেন্দ্র মশাট খাওয়ার পর পায়চারি করতে করতে বললেন, “আমি তোমাকে কয়েকটা জিনিস দেখাতে চাই। আমার মনে হয় দেখা দরকার। সেইসঙ্গে দরকার ভাবা।”
ধৃতিমান সোফায় নড়েচড়ে বসল। কিন্তু আচার্য মশাট বললেন, “চলে এসো! বসে দেখার জিনিস নয়, বেড়াতে বেড়াতে দেখার জিনিস।” বলে তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘাসে ঢাকা লনে। ধৃতিমান পিছন পিছন এলো।
এবার দুই আসনের পটল-যানের একটা আসনে বসলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট, অন্যটাতে বসল ধৃতিমান। অধ্যাপক ড্যাশবোর্ডে কিছু নির্দেশ দিলেন। যানের চারদিকে একটা আলোর গোলক চমক দিয়ে উঠল, তারপর যান শূন্যে ভেসে উঠল।
ধৃতিমান জিজ্ঞেস করল, “আপনার যানে ইনার্শিয়া বাফার রয়েছে? আসার সময়ে দেখিনি…”
“বলো, “জাড্য প্রশমক।” তোমাকে অত জোরে আসতে হয়নি, কিন্তু এখন দরকার।” অধ্যাপকের মুখে চওড়া হাসি।
সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। পটল-যান বিদ্যুদ্বেগে সূর্যকে ডান দিকে রেখে ছুটে চলল। ধৃতিমান দেখল নীচে দিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় বালি, তারপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কৃষিজমি ও গ্রাম-শহর সরে যাচ্ছে। “বুঝলে ধৃতিমান, তোমার অনমনীয় অধ্যবসায়কে আমি সম্মান করি,” বললেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। “তোমার সিভি থেকে এটা বোঝা যায়। তুমি বাইরে চলে যেতে চেয়ে একদম ঠিক কাজ করেছ। চলো তোমাকে দেখাই এদেশের মূর্খদের কিছু কীর্তি।”
কিছুক্ষণ পর যানের গতি কমে এলো। সমুদ্রের তীরে এক ভগ্নস্তূপের উপর দিয়ে ধীরগতিতে উড়ে চলেছে তারা। উচ্চতা কমিয়ে আনতে দেখা গেল অর্ধনিমজ্জিত অট্টালিকার সারি। উপকূলের কয়েক মাইল দূর পর্যন্ত স্থাপত্যের চিহ্ন প্রসারিত রয়েছে! যানের দেওয়ালের গায়ে প্রায় নাক ঠেকিয়ে দেখছিল ধৃতিমান। টেনে টেনে জ্ঞানেন্দ্র মশাট বললেন, “মুম্-বা-ই।”
“যত এগোবে, সমুদ্রের ধারে ধারে তত ধ্বংসের চিহ্ন দেখবে। যেমন নিউ ক্যালকাটা হয়েছে তেমনি এখান থেকে সমুদ্রের পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে নয়া মুম্বাই তৈরি হয়েছে। ওই পাহাড়গুলোর দিকে দেখো। পুরোনো মুম্বাই একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি। কিন্তু পাহাড়ের গা ঘেঁষে যেটা আছে সেটাকে আর শহর বলা যায় না।”
ধৃতিমান ভাবছিল, তাকে এসব দেখানোর মানে কী। কিন্তু সেই সঙ্গে এমন অদ্ভুত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নষ্ট করার ইচ্ছে তার আদৌ ছিল না। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আচার্য মশাট খেয়ালী মানুষ। যদি হঠাৎ চটে যান তাহলে ধৃতিমানের বিপদ।
“এই প্রাক-মুম্বাই গ্রামগুলোই বলো বা ওই নয়া মুম্বাই বলো, এসব জায়গায় প্রতিভার কোনো দাম নেই।” ধৃতিমান জানত না, ডাঙার মানুষেরাও সকলে সচ্ছল নয়। “তুমি যেখানে বড়ো হয়েছ, সেখানেও নেই। গ্রহ কারিগর থেকে তোমার নাম সুপারিশ করল, নাহলে কি আমিই জানতে পারতাম…” স্বগতোক্তির মতো বললেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট।
পটল-যান মুম্বাই ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণে এগোতে লাগল। অধ্যাপক তার গতিবেগ বাড়িয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “ইতিহাস নিয়ে তোমার ধারণা কীরকম?”
ধৃতিমান বলল, “খুব পরিষ্কার নয়, তবে মন্দ লাগত না।”
“তোমাদের মতো শহরগুলো প্রথমে এরকম ম্যাদামারা ছিল না,” নির্ভেজাল ভাষণের সুরে আরম্ভ করলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। “পরিবেশের বারোটা বেজে যাওয়ার সময়ে ওগুলো তৈরি হয়। খাদ্য উৎপাদন বিপজ্জনকভাবে ওঠাপড়া করছিল। পৃথিবীর বেশির ভাগ কাজকর্ম উপকূলের শহরগুলোতে হত; সেসব চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছিল। মরিয়া হয়ে উপকূল থেকে কিছুদূরে তখনকার বড়ো বড়ো দূরদর্শী ও কুশলী মানুষজন জোট বেঁধে এক-একটা সমুদ্র শহর বানানোর পরিকল্পনা করেন। নীতি নির্ধারকদের হাতে তাঁদের সাহায্য করা ছাড়া উপায় ছিল না। মহাকাশ তখনও বাগ মানেনি।
“অতঃপর সমুদ্র শহরগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনধারণের এক একটা চমৎকার নিদর্শন তৈরি হয়। প্রায় এক একটা ক্লোজড সিস্টেম, বন্ধ কাচের বয়ামে জল দিয়ে রাখা গাছপালার মতো। ক্লোরেলা চাষ করা মহাকাশযানের মতো। সমুদ্র শহর হল সমাজের উন্নততম পর্যায়। যারা সেখানে থাকার সুযোগ পেল, তারা যৌথভাবে এক… নজিরবিহীন গর্ব অনুভব করল।”
ধৃতিমান স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। এই পর্যন্ত তার কমবেশি জানা। অধ্যাপক জিজ্ঞেস করলেন, “অবাক লাগছে?”
“না, এই অবধি স্কুলের ইতিহাস বইতে লেখা থাকে। কিন্তু আমি আমার চারপাশের লোকজনের মধ্যে কখনো এই গর্বের চিহ্ন দেখিনি।”
৭. নতুন বন্ধু
ইশিদার সঙ্গে আলাপ করে ধৃতিমানের মনে এক আলোড়ন শুরু হয়েছে। তিন বছর আগে দিল্লিতে সে রঙ্গনার দলে ছিল, কিন্তু জমায়েত হওয়া লোকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি। এবার সে অনেক কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। ইশিদা সেই বিরল মানুষদের একজন প্রমাণিত হয়েছে, যাদের সঙ্গে বসলে ধৃতিমানের কথা ফুরোয় না। গ্রহ কারিগর সংস্থার হয়ে ইশিদা গবেষণা করে, যারা এপসিলন এরিড্যানি তারার কক্ষপথে একটা গ্রহ তৈরিও করেছে। মার্কিন-জাপানি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ না করে গ্রহ কারিগরে কেন এলেন, জিজ্ঞেস করতে সে মজার ছলে বলল: গ্রহ কারিগর ভারতের গর্ব, আর ভারত আমার গর্ব! বাস্তবিক, ইশিদার বাংলা শুনে তাকে অবাঙালি বলে বোঝা যায় না। তার মারাঠীও নাকি সাবলীল। ভালোবাসা না থাকলে এমন করে ভাষা রপ্ত করা সম্ভব নয়।
“তোমার মাথা এত পরিষ্কার, তুমি ইউনিভার্সিটি যাওনি কেন?” ইশিদার গলায় কৌতূহল।
তারা দু-জন উইড ব্যাগ কারখানার যন্ত্রপাতির জরিপ করছিল। ভিউ স্ক্রিনে কোনো যন্ত্রের দশা পরীক্ষা করতে গিয়ে ধৃতিমান একটু থমকালো। তাদের আলোচনা এই প্রথম বিজ্ঞানের গণ্ডি পেরোতে চলেছে।
“পয়সা ছিল না আমার,” তাকে বলতে হল; ইশিদার দৃষ্টিতে ব্যথার চিহ্ন দেখতে পেল সে।
তার দুর্দশায় কেউ সমবেদনা জানালে ধৃতিমান বিব্রত হয়। অস্বস্তি এড়াতে সে কথা চালিয়ে গেল। “অনেকেরই থাকে না। অনাথ আশ্রমে ছিলাম, কলেজ-ইউনিভার্সিটি আমাদের জন্য নয়। দেবগুরু লোকসানটা না করালে এতদিনে আমার অ্যাডমিশন হয়ে যেত। অবশ্য আমি ডাঙার লোক হলেও সেটা হয়ে যেত। জলের নীচে তো ভোট কম। লোক ছাঁটাই করার জন্য ভাবতে হয় না।”
ইশিদা বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল। এসব কিছুই গত কয়েক দিনের মধ্যে তার শোনা হয়ে গেছে। “শিশু উদ্যানের জীবনযাত্রার মান কোথাও এত নীচু নয়।”
“আসলে, অনেক দেশেই নীচু। আপনারা জানতে পারেন না।” ধৃতিমান শুধরে দিল।
“কিন্তু তারাই তো দেশের ভবিষ্যৎ! বাচ্চারা তো বলতে গেলে সবাই কোনো না কোনো শিশু উদ্যানে রয়েছে।”
“জাপানে রয়েছে নিশ্চয়ই, বা হয়তো ডাঙায় রয়েছে। জলের তলায় এখনো পরিবার রাখে লোকজন।”
“হুঁ, রঙ্গনার একটি মেয়ে আছে দেখেছি।”
ধৃতিমানের মুখে হাসি ফুটল। “হ্যাঁ, আমার সঙ্গে রুনুর ভারী ভাব।”
“আমারও এক মেয়ে আছে। নিজের কাছে রেখেছি বলে লোকে স্বার্থপর বলে, কিন্তু আমিও খুশি, আমার কিমিকোও খুশি।” ইশিদার বয়স্ক মুখ লাজুক হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে এক পলকের মধ্যেই ফের গম্ভীর হয়ে গেল।
“রঙ্গনাকেও ছাঁটাই হতে হয়েছে মানে কোম্পানির অবস্থা নেহাত খারাপ ছিল বলতে হবে।”
ধৃতিমান অবাক হয়ে তাকাল। “ওঃ, এটাই কেউ বলেনি আপনাকে? বসকে ওরা ডাঙায় গিয়ে থাকার অফার দিয়েছিল। বাঁকুড়া, বেঙ্গালুরু, রাঁচি— অনেকগুলো অপশন ছিল। ও-ই যায়নি।”
এবার ইশিদার অবাক হওয়ার পালা। “তোমরা বড়ো ভাগ্যবান।” একটু থেমে আবার বলল, “এমন মানুষের অধীনে যে কোনো খাটুনিই মেনে নেওয়া যায়।”
ধৃতিমান হাসল। সে তো খাটছে; ক্যাম্পাসিংয়ে মাইনিং কোম্পানির কেউকেটাদের নজরে পড়েছিল যেদিন, সেদিন থেকেই খাটছে। টিম লিডার রঙ্গনাকে সে শ্রদ্ধা করে, চাকরি হিসেবেও এর থেকে ভালো অপশন হয়তো সে পেত না। কিন্তু দু-বছর আগে ছাঁটাই হয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। উইড ব্যাগের আইডিয়াটা ভালো ছিল, কিন্তু শহরের মধ্যে সেই উইড চাষ করার উপায় নেই। উইডের খোঁজে প্রতিবার আরো, আরো দূর সমুদ্রে পাড়ি দিতে হচ্ছে। এখন যা অবস্থা, রঙ্গনার বিকল্প পরিকল্পনা ছাড়া হয়তো সত্যিই উপায় নেই।
ইশিদা ওরিহারা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কারখানার দরজার দিকে এগিয়ে গেল। একে কি দলে নেওয়া যায়?
৮. আপৎকালীন স্বেচ্ছা-বন্দিত্ব
জ্ঞানেন্দ্র মশাট ধীরে ধীরে উপর নীচে মাথা নাড়লেন। “ঠিক। সমুদ্র শহরের পরিস্থিতি আর সেখানকার নাগরিকদের মানসিকতায় একটা পরিবর্তন হয়েছে, যার খবর তোমাদের ইতিহাস বই হয়তো চেপে যায়। ব্যাপারটা হল, সমুদ্র শহর তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির সাহায্যে পরিবেশের হাল ফেরানোর চেষ্টাও শুরু হয়ে যায়। ওজোন স্তরের ফুটো মেরামত করার কথা জানো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। হাজার বছর আগে, তাই তো…”
“চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে,” আচার্য মশাট খুশি হয়ে বললেন। “তখনই বোঝা গিয়েছিল আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষমতা কতদূর যেতে পারে। একশো-দেড়শো বছর চূড়ান্ত অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খলতার পর আবহাওয়া এক নতুন ভারসাম্যে উপনীত হয়। গ্রীনল্যান্ড আর কুমেরু বাদে পৃথিবীতে আর বরফ রইল না, কিন্তু ঋতুচক্র অনেকটা নিয়মিত হয়ে এলো। ডাঙার ভোগান্তি শেষ হয়ে সমৃদ্ধি ফিরে আসতে লাগল।” এই পর্যন্ত বলে আচার্য মশাট চুপ করলেন, যেন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করছেন।
“সমুদ্র শহরগুলোকে তখন আমরা ছেড়ে দিয়ে ডাঙায় ফিরে গেলাম না কেন?” ধৃতিমান আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করল। আচার্যের ভাষণ ইতিহাস বই আর নিউ ক্যালকাটায় পাওয়া ইন্টারনেট থেকে বেরিয়ে গেছে।
তিনি বললেন, “ততদিনে সমুদ্রের তলায় কয়েকটা বদল ঘটে গিয়েছিল। প্রথমত, নিজেদের জীবনযাত্রার উৎকর্ষ— আরো ঠিকঠাক বললে পবিত্রতা— সম্পর্কে অনেকের গর্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, তারা স্বেচ্ছায় সেখানেই থেকে যেতে চাইল। দ্বিতীয়ত, অনেকের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে, ডাঙায় থেকে গেলে প্রকৃতির খামখেয়ালির মোকাবিলা করতে হবে। তৃতীয়ত,” বলে জ্ঞানেন্দ্র মশাট একবার ধৃতিমানের দিকে আড়চোখে চেয়ে নিলেন, “ডাঙার অনেক সরকার ও সংস্থা সমুদ্র শহরগুলোকে অতীতের জীবন্ত নিদর্শন হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে উৎসাহী হয়ে উঠল।”
ধৃতিমানের ভুরু কুঁচকে গেল। “ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
একটা ছদ্ম হয়রানির ভঙ্গি করে জ্ঞানেন্দ্র মশাট বললেন, “আমি বলতে পারি চিড়িয়াখানার মতো, বা অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো, কিন্তু সেগুলোর ভিডিয়ো কি তোমাদের দেখতে দেয়?”
ধৃতিমানের মনে প্রবল বিতৃষ্ণার উদ্রেক হল। সে নীরস গলায় বলল, “হ্যাঁ, দেয়।” তারপর আবার বলল, “আপনি বলতে চান আমরা ওই টুরিস্টগুলোর কাছে খাঁচার জন্তু?”
জ্ঞানেন্দ্র মশাট প্রশংসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার মাথা খুব ঠান্ডা, মানতেই হবে। যাইহোক, হ্যাঁ, তোমরা ওদের কাছে খানিকটা তা-ই। তিনটে জিনিস লক্ষ করবে। এক, নিউ ক্যালকাটায় দু-তিনরকম টায়ারে ইন্টারনেট চালু আছে, মানে এক এক পেশার মানুষ এক এক রকম ইন্টারনেট পায়; দুই, তোমরা দরকারের বাইরে একেবারে সাম্প্রতিক খবরাখবর খুব একটা পাও না, আমাকে যেমন স্যার বলছ; তিন, পর্যটকরা তোমাদের সঙ্গে খুব কম মেলামেশা করে। ওদের উপর হুকুম থাকে, তোমাদের সংস্কৃতিকে যতদূর সম্ভব অক্ষত রাখার।”
রাগে ধৃতিমানের গা রি রি করছিল। সে গুম হয়ে বসে রইল। আচার্য মশাট হয়তো খেয়াল করলেন না। তিনি বলে চললেন, “এটাকে কিন্তু অন্যভাবেও দেখা যায়। ডাঙায় অনেক উদারমনস্ক মানুষ আছেন, যাঁরা তোমাদের “ফলিত আদর্শবাদ” নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। কোনো সরকার সমুদ্র শহরগুলোকে মূলধারায় আনার কথা বললেই তাঁরা চটে যান। সেই আদর্শবাদে আধুনিক সভ্যতার ক্ষতিকর স্পর্শ প্রতিহত করতে তাঁরা চেষ্টা করেন।”
“আর আপনি? আপনি কী মনে করেন?” ধৃতিমান নিজের গলার ঝাঁঝ লুকোতে পারল না।
আচার্য জ্ঞানেন্দ্র মশাট হেসে বললেন, “আমি মনে করি সব মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিত। একদল স্পেস এলিভেটর বানাবে, ওয়র্মহোল বানাবে, মায় আস্ত আস্ত গ্রহ বানাবে; আরেক দল বিপদ কেটে যাওয়ার পরেও চিরকাল আপৎকালীন স্বেচ্ছা-বন্দিত্বের দশায় থাকবে এটা আমি মানি না। মানলে তোমাকে এইসব বলতাম না।”
৯. বিবেচনা
ডর্মিটরির বিছানায় বসে রুনু পড়াশোনা করছে। অঙ্ক তার প্রিয় বিষয়। রঙ্গনা লক্ষ করল, সে রিডারে পেন্সিল নিয়ে অঙ্কই করছে। আচমকা জিজ্ঞেস করল, “মা, আমরা বাইশশো চল্লিশ বঙ্গাব্দে রয়েছি তো?”
“হ্যাঁ রে, আমরা বাইশশো চল্লিশ বঙ্গাব্দে রয়েছি।”
“তাই তো ভাবি,” রুনু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “রামসাগর বলছিল নাকি আগেকার দিনে লোকে খ্রিস্টাব্দ ধরে চলত।”
“এখনো অনেকেই চলে রে। ইতিহাস দারুণ জিনিস, পড়তে শুরু কর।”
সদ্য পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পা দিয়েছে রুনু। তার নিজস্ব গাইডেড ভিউ স্ক্রিন হয়েছে। সরকার এখনো এইটুকু দিচ্ছে বলেই জীবন পুরোপুরি দুর্বিষহ হয়ে যায়নি। অবশ্য, ভিউ স্ক্রিন দিয়ে সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় না। অনেক পাপ আবার এই স্ক্রিনের মাধ্যমেই ছড়ায়।
দুপুরবেলা রঙ্গনা খেতে বসল পাসোয়ান আর তার বন্ধুদের সঙ্গে। মাসখানেক ধরে বুঝিয়ে বলার পর মাইনিং কোম্পানির প্রাক্তনদের অনেকেই রঙ্গনার সঙ্গে থাকবে কথা দিয়েছিল। কেবল এই দলটাই বাকি। আজকে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে।
“আমাদের ভুল বুঝো না রঙ্গনা, আমরা এখানে খুশি নই। কিন্তু এইভাবে কোনো বিক্ষোভ দেখাতে পারব না। কিছু চাইতে গেলে ওরা বলবে লোভী। বাইরের মানুষ কত ভালো আছে বললে বলবে পরশ্রীকাতর। মুখ খুললেই বলবে অলস।” রামস্বরূপ পাসোয়ান বলল।
“বলবে ভেবেই ভয়ে মরছ তোমরা? বললে কী এসে যায়? এমনিতেই তো বস্তিতে একঘরে হয়ে আছো!”
“তবু তো আছি!” সরফরাজ উত্তেজিত হয়ে উঠল। “ওই যে তারাশঙ্কর ভট্ট না চট্ট সেদিন মরে গেল, তোমার মনে হয় মাত্র নব্বই বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে মরেছে?”
রঙ্গনা স্থির গলায় বলল, “কী বলতে চাও?”
“আমি বলতে চাই আমাদের মেয়র ওকে খুন করেছে,” টেবিলে বাঁ হাতের তর্জনী ঠুকে ঠুকে হিসহিস করে বলল সরফরাজ। “ও উচিত কথা বলত। কিনতে পারেনি, তাই মেরে দিয়েছে।”
রামস্বরূপ সরফরাজের কাঁধে হাত রেখে বলল, “রঙ্গনা, আমাদের বেঁচে থাকাটা এখন কারো কাছে প্রয়োজনীয় নয়। বেগড়বাঁই করলে আমাদের মেরে দেবে।”
মঞ্জুষা নটরাজন হাত তুলল। রঙ্গনার সম্মতি পেয়ে বলল, “রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করলে মিডিয়ায় বদনাম হবে। কিন্তু উপর থেকে দুটো দেওয়াল ভাঙলেই আমাদের সেক্টরে জল ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব। একটা মাঝারি মাপের পাথর অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট থেকে টিপ করে ফেলতে পারলেই হল। উল্কাপাত বলে চালিয়ে দেবে।” বাকিরা ব্যগ্রভাবে সায় দিল।
রঙ্গনার কাছে এর যুৎসই জবাব নেই। এরা হোমওয়ার্ক করে এসেছে। খাওয়া শেষ করে রঙ্গনা বলল, “আজ সন্ধেবেলা এই হলে একটা ঘোষণা হবে। একটা ভালো প্ল্যান তৈরি হওয়ার আশা আছে। তোমরাও থেকো। রামস্বরূপ, তুমি তো প্ল্যানই চাও।”
রামস্বরূপ ও তার চেলারা জানাল, আসবে। অবশ্য একদিক দিয়ে এই নতুন পরিকল্পনায় ঝুঁকি বেশি। তবু আশাও বড়ো বেশি। রুনুর মুখ মনে করে, ছাঁটাই হওয়ার সময়ে ধৃতিমানের মুখ মনে করে রঙ্গনা শক্ত হল। উদাসীনতা আর করুণার দানে খাঁচার জীবন বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে না।
১০. বাকি ৭,৪৯,৯৯৯ জন
পটল-যান অস্ত্যমান সূর্যকে পিছনে রেখে বাঁ দিকে বাঁক নিল। কিছুক্ষণ আকাশে এক বিশাল বৃত্তচাপ এঁকে প্রথমে পূর্ব ও তারপর উত্তর অভিমুখে ফিরতে লাগল। তাদের নীচে তখন আরেক নিমজ্জিত শহর। জ্ঞানেন্দ্র মশাট বললেন, “তিরুবনন্তপুরম। ওই দেখো!” বলে পশ্চিম দিকে ইঙ্গিত করলেন।
ধৃতিমান দেখল, আরব সাগরের আকাশে আগুনের মতো মেঘের আড়ালে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তার নীচে, দিগন্তের কাছাকাছি, সমুদ্রের অন্ধকার জলের মাঝে এক নীল আলোর ছোপ। ওই আলো আসছে জলের তলা থেকে।
জ্ঞানেন্দ্র মশাট বললেন, “ওটা পুতিয় তিরুবনন্তপুরম। পশ্চিম উপকূলে ছ-টা সমুদ্র শহর আছে, এটা সবচেয়ে দক্ষিণে। আসার সময়ে অন্ধকার থাকলে মুম্বাইয়ের কাছে নয়া মুম্বাই দেখতে পেতাম, কিন্তু সেই পথে আমরা ফিরব না।”
অন্ধকার ঘন হয়ে আসছিল। এক সময়ে আপনা থেকে পটল-যানের ভিতরে আলো জ্বলে উঠল। ধৃতিমান দেখল, যানের ছাদের কিছুটা অংশ অস্বচ্ছ হয়ে গিয়ে মৃদু বাদামি আলো ছড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ধৃতিমান জিজ্ঞেস করল, “স্যার, এই শহরগুলোর সঙ্গে কি আমাদের গবেষণার কোনো সম্পর্ক আছে?”
অধ্যাপক বললেন, “না না! এমনিই তো বেড়াচ্ছি। তুমি তো এসব বেশিদিন দেখতে পারবে না, অনেকদূর চলে যাবে।”
“মানে?” ধৃতিমানের হঠাৎ খটকা লাগল।
জিভ কাটলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। বললেন, “দুঃখিত। বলছি যে, গবেষণার সময়ে তুমি বাংলোতেই থাকবে, আর তারপর বাইরে কোথাও চলে যাবে। দেশে তো থাকতে চাও না, এটাই।”
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, স্যার। আমি, একটুও বাড়িয়ে বলছি না, স্বপ্নেও ভাবিনি এমন সুযোগ পাবো।” ধৃতিমান বাস্তবিক অভিভূত হয়ে পড়ছিল।
জ্ঞানেন্দ্র মশাট ড্যাশবোর্ডে কিছু নির্দেশ দিলেন। যান ঘিরে খেলে গেল জাড্য প্রশমকের চমক। তীব্র বেগে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে উত্তরে ছুটল যান। তারপর তিনি মুখ খুললেন।
“তোমার আনন্দই আমার আনন্দ, ধৃতিমান। কিন্তু ধন্যবাদ দেওয়া যথেষ্ট নয়। তোমাকে নিজের মতো করে বড়ো কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। দেখাতে হবে যে, তুমি সমুদ্র শহরের মানুষ হলেও বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারো। কারো চেয়ে তুমি কম নও।” এই প্রথম জ্ঞানেন্দ্র মশাটের গলা গম্ভীর শোনালো।
ধৃতিমান বলল, “আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব।”
আচার্য মশাট বললেন, “তুমি বুদ্ধিমান। মনে রেখো, তোমার ভাগ্য তোমার হাতে। নিউ ক্যালকাটার জনসংখ্যা কত যেন?”
“সাড়ে সাত লক্ষ হবে…”
“বেশ। তুমি মনে রেখো, ওই বাকি সাত লক্ষ ঊনপঞ্চাশ হাজার নশো নিরানব্বই জনের দায় তোমার নয়। তুমি করবে নিজের কাজ। যোগ্যতমের উদ্বর্তন হবে।”
এই কথাটা ধৃতিমানের অদ্ভুত লাগল। জ্ঞানেন্দ্র মশাট তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে হাসার চেষ্টা করল, বুঝতে পারল না হাসিটা ঠিকঠাক এলো কিনা।
১১. রুনু
ছুটির দিন বলে রুনু দুপুরে সুকুমার রচনা সমগ্র গিলছিল। ভিউ স্ক্রিন পাওয়ার পর থেকে তার দুপুরবেলার ঘুম বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁচ-সাত মিনিট অন্তর উটকো উটকো বিজ্ঞাপন এসে জ্বালাতন করে ঠিকই, কিন্তু রুনু ভেবে পায় না এত, এত বই পড়ার সুযোগ ছুড়ে ফেলে তার বন্ধুরা এইসব বিজ্ঞাপনে কীভাবে মজে যায়। তার মায়ের কিছু বই রিডারে আছে; রুনু সেইসব বই ঠিক বুঝতে পারে না। আশা করে, কোনো একদিন বুঝতে পারবে।
গোলতু আর মিছিমিছি খেলার জন্য ডাকতে এলো। রুনু ভেবে দেখল, মা বলে দিয়েছে সারাদিন ভিউ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে শরীর খারাপ হবে, আর মাথাটাও একটু ধরেছে। সে স্ক্রিন অফ করে দু-জনের সঙ্গে কোয়ার্টারের কাছে পার্কে গেল। তিন জন দেখল, রাস্তাঘাট শুনশান, বাচ্চারা কেবল ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে মাঠে খেলছে। বাকিরা সবাই গেল কোথায়?
তারপর তাদের চোখে পড়ল, কমন রুমের কাছে দাঁড়িয়ে মেহতাব ব্যস্তভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তারা কাছে যেতে সে বলল, কোনো দরজা দিয়ে নাকি ছোটোদের ঢুকতে দিচ্ছে না। খুব দরকারি কিছু একটা হচ্ছে। রুনু ভাবল, তাদের কী। বড়োদের মিটিং তো আর নতুন নয়। মেহতাব বলল, এটা একটু বেশি সিরিয়াস হতে পারে। ইশিদা নাকি কমন রুমে ঢোকার সময়ে খুব গম্ভীর হয়ে ছিল। সে তো গম্ভীর হওয়ার মানুষ নয়।
এদিক সেদিক দিয়ে আড়ি পাতার চেষ্টা করেও কোনো ফল হল না। একটা বাড়ির একতলায় কমন রুম, কিন্তু নজিরবিহীনভাবে আজ দোতলার ডর্মিটরির দরজাও তাদের ঢুকতে দিল না, ফলে মেঝেতে কান পেতে শোনার সুযোগ নেই। মেহতাব আফসোস করে বলল, “বড়োদের বুদ্ধি বাড়ছে।” অগত্যা তারা নিজেদের খেলা আরম্ভ করল। কিছুক্ষণ পর কমন রুম থেকে ভেসে এলো গুঞ্জন। মিটিং শেষ। রুনুরা দৌড়ে গেল। সবাই বেরিয়ে আসছে। কারো মুখেচোখে চাপা আনন্দ, কিন্তু বেশির ভাগেরই মুখ থমথমে। রুনুর আন্দাজ মতো রঙ্গনা তখনও কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়ের দিকে চোখ পড়তে একগাল হেসে বলল, “ভালো খবর আছে, বুঝলি!”
ধৃতিমান পাশ থেকে বলল, “গ্রহ কারিগরে আমরা কাজ পেতে পারি।”
রুনু হাঁ করে কয়েকবার চোখ পিটপিট করল। রঙ্গনা বলল, “ডর্মিটরিতে যা এখন, পরে সব বলব।”
ডর্মিটরিতেও সবার মধ্যে উত্তেজনা। কিছু না বুঝেও রুনুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। গ্রহ কারিগরে কাজ মানে মহাকাশে যাওয়া, আবার ফেলে আসা মাইনিং-এর দিনের মতো। কয়েকজন তবু ব্যাপারটাকে পছন্দ করছে না, মনে হল রুনুর। ইশিদা তার বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছিল। রুনু তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি মা-দের কাজ দেবেন?”
ইশিদা হা-হা করে একচোট হেসে নিয়ে বলল, “কাজ দেওয়া আমার এক্তিয়ারে নেই, ভাই রুনু। আমি ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারব বলেছি। তাতে চান্স পেলে তোমার কলোনির বড়োরা সেখানে কাজ পাবে। তবে আমি জানি যে, তোমার মা পাবেই পাবে।”
তারপর রুনু গেল তার বন্ধুদের কাছে। কেউ তার মতো বিভ্রান্ত, কেউ খুব খুশি। সবচেয়ে বেশি লাফাচ্ছে মেহতাব। “জানিস, গ্রহ কারিগর আমাদেরকে একদম মিশনে পাঠিয়ে দেবে। গ্রহ বানাতে যাবো!” সে সত্যিই স্থির থাকতে পারছে না।
রুনু জিজ্ঞেস করল, “মিশনে মা যেরকম যেত তো? অনেক দিন বাইরে থাকবে, তারপর ফিরে আসবে?”
মেহতাব এক ফুঁয়ে রুনুকে উড়িয়ে দিল। “ফিরে আসবে আবার কি! গ্রহ বানাতে অন্য তারায় যেতে হয়। যারা যায়, সেখানেই থেকে যায়।” একটু ভেবে আবার বলল, “যদি বা ফেরে, অনেক বছর লেগে যাবে।”
রুনুর বুকটা ধড়াস করে উঠল। “কী বলছিস! আমাদেরকে ফেলে রেখে ওরা চলে যাবে?”
মেহতাবকে অধৈর্য দেখালো। “ওরে, আমরাও সঙ্গে যাবো ওদের! টা টা নিউ ক্যালকাটা!”
রুনুর গলা শুকিয়ে গেল।
১২. ত্রিলোকব্যাপ্ত মহানগর
মানচিত্রে দেখা গেল, জ্ঞানেন্দ্র মশাটের বাংলো পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। ধৃতিমান বলল, “আপনি বললেন সমুদ্র শহরের লোকজনকে খাঁচার মধ্যে রাখে। কিন্তু নিউ ক্যালকাটার কেউ কেউ ডাঙায় যেতে চায়। বাইরে কাজ নেওয়ার জন্য পড়াশোনা করে। তাদেরকে আমি তো আটকাতে দেখিনি।”
অধ্যাপক বললেন, “তাদেরকে আটকালে আর আমাদের সঙ্গে আদিম বর্বরদের তফাৎ কোথায় থাকত? সব সমুদ্র শহর থেকেই নিয়মিত কিছু লোক বাইরে কাজ নিয়ে বেরিয়ে যায়। তারা প্রত্যেকেই ক্রমশ বাইরে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাদের সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি নয় কেন।”
ধৃতিমান চুপ করে রইল। আচার্য মশাট বললেন, “কেবল এক আছে টোকিও। সেখানে জল থেকে ডাঙাতে যেমন লোক যায়, তেমনি ডাঙা থেকে জলেও নামে। আবার জল আর ডাঙা থেকে আকাশেও যায়।”
ধৃতিমান হাঁ করে আছে দেখে তিনি বললেন, “অবশ্যই টোকিওর কথা তুমি শোনোনি।”
ধৃতিমান এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল।
“টোকিও একমাত্র শহর যার একসঙ্গে তিনটে ভাগ আছে। জল, স্থল, আকাশ। এখনো ওরা ছাড়া আর কেউ আকাশে আস্ত শহর বসাতে পারেনি। বা হয়তো বসায়নি। আমার বাংলোটার মতো খুচরো প্রাইভেট প্রপার্টি বানায়, ব্যাস। জাপানে বড়ো বড়ো কর্পোরেশন সরকারের সঙ্গে একজোটে কাজ করে, তাই হয়তো বানাতে পেরেছে। এর পাশাপাশি ফোর্স ফিল্ড আবিষ্কার হওয়ার পর ওরা পুরোনো টোকিওর উপকূল বরাবর এলাকাটাকে ফোর্স ফিল্ড দিয়ে ঘিরে পাম্প করে জল বার করে দিয়েছিল। তারপর তার মধ্যে কংক্রিট আর ফাইবারের বাঁধ বানায়। পুরোনো টোকিও চমৎকারভাবে ফের গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর একমাত্র ত্রিলোকব্যাপ্ত মহানগর।”
দূরে আকাশ বাংলোর আলো দেখা গেল। দিনের বেলায় তার যা চেহারা দেখেছিল, ধৃতিমানের মনে হল এখন তা যেন একদম পালটে গেছে। অন্ধকার চরাচরের মাঝে একটি ভাসমান আলোর বিন্দু; ফুঁ দিলেই যেন নিভে যাবে। আশপাশে কিছু তো নেইই, নীচে মাটির নিশ্চিত আশ্বাসটুকুও নেই। আকাশে তারার মেলা ফুটে উঠেছে, কিন্তু তাতে বাংলোকে ঘিরে থাকা নিরেট একাকীত্বের ভাবটুকু মুছে যাচ্ছে না। ধৃতিমানের ভয় হল।
পাশ থেকে জ্ঞানেন্দ্র মশাট বললেন, “তাই আমার মনে হয়, টোকিওর মানুষের মধ্যে এই জল আর ডাঙার জাতিভেদটা নেই। আর কেউ টোকিও থেকে নিউ ক্যালকাটায় এমন কোনো গবেষণা করতেও আসতে পারে না, যা সে টোকিওতে বসেই আরো ভালোভাবে করতে পারতো না।”
ধৃতিমান বলল, “আপনি কি ইশিদার কথা বলছেন? ও গ্রহ কারিগরে কাজ করে।”
“জানি,” বললেন আচার্য মশাট। “কিন্তু টোকিওতে ওর বাড়ি। আর গ্রহ কারিগর টোকিওতে গবেষণার ব্যবস্থা করতে পারত না এটা আমি মানি না। ভারত-জাপান সম্পর্ক ভালো।”
পটল-যান আকাশ বাংলোয় এসে নামল। দুই দিকের দরজা খুলে দুই আরোহী বাইরে এলেন। জ্ঞানেন্দ্র মশাট জিজ্ঞেস করলেন, “ইশিদা ওরিহারাকে তুমি কতটুকু চেনো?”
ধৃতিমান বলল, বেশিদিন না, তবে আমাদের বন্ধুত্ব আছে।”
বাংলোর দরজা পেরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে আচার্য মশাট বললেন, “হুঁ।”
১৩. সেটিং
বিরাট কমন রুমে সব সময়েই কেউ না কেউ থাকে, কিন্তু বেশি লোকসমাগম কখনো হয় না। সেখানে ঠাসা ভিড় আর পিন-পতন নৈঃশব্দ রঙ্গনার অদ্ভুত লাগছিল। সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ; এমনকি উপরের ডর্মিটরির দরজাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে বাচ্চারা আড়ি পাততে না পারে। হলের এক পাশে একটা টেবিলের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে রঙ্গনা ও ইশিদা। সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে।
“গত একমাস ধরে ইশিদা ওরিহারা আমাদের কলোনিতে আসছেন,” পাশে দাঁড়ানো বিজ্ঞানীর দিকে ইঙ্গিত করে রঙ্গনা শুরু করল। “তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই তাঁর কথাবার্তা হয়েছে। কেউই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করোনি, বরং অনেকে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ।”
ঘরে প্রশংসাসূচক গুঞ্জনের ঢেউ ছড়িয়ে গেল।
রঙ্গনা বলে চলল, “আমিও ইশিদার বন্ধু, আর বন্ধুর মতোই তাঁকে বলেছিলাম, যদি আমাদের দুর্দশা লাঘব করা ওঁর পক্ষে সম্ভব হয়। উনি জানিয়েছেন, গ্রহ কারিগরে লোক লাগবে। এখনো বাইরেকার তারামণ্ডলে বেশি কেউ যেতে চায় না। আনাড়ি লোকজনকে তালিম দিয়ে কাজ চালাতে হয়। সেখানে আমরা এতজন পেশাদার যদি একসঙ্গে অ্যাপ্লাই করি, তারা হাতে চাঁদ পাবে।”
গুঞ্জনের মাত্রা বাড়তে লাগল। হাত তুলে রঙ্গনা তাদের শান্ত হতে অনুরোধ করল। তারপর বলল, “ড. ওরিহারা এই ব্যাপারে কিছু বলবেন। প্লিজ মন দিয়ে শুনুন।”
ইশিদা গলা খাঁকরে নিয়ে বলল, “গ্রহ কারিগরে চাকরির ইন্টারভিউ হয়। কিন্তু ইন্টারভিউতে সবাই সুযোগ পায় না।”
অন্য রকম ইঙ্গিত পেয়ে হলঘর শান্ত হয়ে গেল।
“আপনারা সবাই পেশাদার হলেও এরকম ইন্টারভিউতে ওপরতলার পছন্দের কিছু লোক থাকে, যাদের নিতেই হয়। সেরকম হলে আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যায়ভাবে বাদ চলে যাবেন।”
কেউ কোনো কথা বলছে না। ইশিদা বড়ো করে শ্বাস নিয়ে আবার বলল:
“আমার চেনা একজন ক্যাপ্টেন মি. রায়ের সহপাঠী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তিনি রাজি হয়েছেন…”
হঠাৎ কেউ বলে উঠল, “অতদূর যেতে চাই না আমি! অনেক বিপদ! আপনি আমাদেরকে জোর করে নিয়ে যেতে পারেন না!”
রঙ্গনা বলল, “জোর জবরদস্তির প্রশ্নই উঠছে না। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সিদ্ধান্ত একমাসের মধ্যে আমাদেরকে জানাবে। আমরা যারা যেতে চাই, তারাই কেবল যাবো।”
আবার গুঞ্জন শুরু হল। রামস্বরূপ বলল, “কিন্তু ক্যাপ্টেনের সেবা করার সাধ্য কি আমাদের আছে? নিজেদের পেট কীভাবে ভরবে তার নেই ঠিক…”
ইশিদা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। রঙ্গনা বলল, “ক্যাপ্টেন ঘুষ চান না।”
রামস্বরূপ সন্দিগ্ধ গলায় বলল, “আচ্ছা? তাহলে তাঁর শর্তটা কী?”
“কোনো শর্ত নেই। নতুন প্রোজেক্টের টিমে তিনি নিজেও থাকবেন। তিনি কাজ জানা লোক চান। আমরা কথা দিয়েছি আনকোরা কাউকে তাঁর ঘাড়ে চাপাবো না। সবার রেকর্ড তিনি একবার চেক করে নিয়েছেন।”
আর কারো বিশেষ কিছু বলার ছিল না। কিছুক্ষণ পর মিটিং শেষ হল। হল ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর রঙ্গনা দেওয়ালে সাঁটা এক বাক্সের তালা খুলে একটা সুইচ অফ করে আবার বাক্সটা বন্ধ করে দিল।
ইশিদা জিজ্ঞেস করল, “এটা কী করলে?”
রঙ্গনা বলল, “হলের মধ্যে সব ভিউ স্ক্রিন জ্যাম করা ছিল। জ্যামিং অফ করলাম।”
ইশিদা একটু ঠেস দিয়ে বলল, “এই কলোনি যে তোমার ভরসার জায়গা?”
রঙ্গনা জবাব দিল, “সাবধানের তবু মার নেই।”
১৪. আনাড়ি
বৈঠকখানায় ঢুকে আগের মতোই একটা সোফার দখল নিলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। ধৃতিমানকে আরেকটায় বসতে বললেন। সে বসলে বলে উঠলেন, “জলের তলায় থেকে থেকে মানুষের বুদ্ধিও হয়তো জোলো হয়ে যায়।”
“কী বলতে চান?” ধৃতিমান কথার ইঙ্গিতটা ধরতে পারল না।
“মানে এতদিন ধরে রয়েছে, আলো নেই, বাতাস নেই। পাখি নেই গাছপালা নেই।” যন্ত্রভৃত্যের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুমুক দিলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। “বেরিয়ে এসে দেখতেও চায় না! ইন্টারনেট নাহয় কমই দেয়, কিন্তু দেয় তো! তাতে ডাঙার ছবি দেখেও তাদের বিকার নেই। সব একই জায়গায় থাকবে, বুড়ো হবে, মরেও যাবে।”
ধৃতিমান প্রতিবাদ না করে পারল না। “কেউই তার বাড়ি ছেড়ে পারতপক্ষে যেতে চায় না, স্যার। ওই পুরোনো মুম্বাইয়ের গ্রামগুলোর কথাই ভাবুন? ওরা কেন ওখানে পড়ে আছে?”
“আরে ছোঃ,” এক হাতের ইশারায় ধৃতিমানের বক্তব্য নস্যাৎ করে দিলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। “অজুহাত দিও না, বুঝলে। তুমি হলে যাকে বলে পাঁকে পদ্মফুল, তাই বলে পাঁককে পাঁক বলে স্বীকার করবে না!”
যেন পরিমিত, মার্জিত স্বভাবের বিজ্ঞানী হঠাৎ বদলে গেছেন। প্রগলভ, সংকীর্ণ এক অন্য মানুষ। চায়ের কাপ তুলে নিয়ে নিঃশব্দে তাতেই মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল ধৃতিমান।
“ইশিদা ওরিহারা জাপানে একজন আসামী।” আচমকা বলে উঠলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। “সে কিছু ইউনিয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টোকিওর জনজীবন বিপর্যস্ত করতে চেয়েছিল।”
ধৃতিমান ভেবে পেল না কী বলবে। আজ থেকে দু-মাস আগেও সে ইশিদাকে চিনত না, এ-কথা ঠিক। কিন্তু তাই বলে…
জ্ঞানেন্দ্র মশাট ভিউ স্ক্রিন চালু করে তাকেও নির্দেশ করলেন। চোখের সামনে ধৃতিমান দেখতে পেল নিউ ক্যালকাটার মহাবৃত্তের পাশে, সমুদ্রের ধারের কোনো এক স্থান। ক্যামেরার সামনে একটু দূরে আলো-আঁধারিতে বসে রয়েছে রঙ্গনা ও ইশিদা। সন্ধেবেলার কোনো রেকর্ডিং; ক্যামেরা ভেসে রয়েছে দু-জনের মাথার উপর। তারা ক্যামেরার উপস্থিতি টের পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
কয়েক মুহূর্ত ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে জ্ঞানেন্দ্র মশাট থামলেন। ধৃতিমানের চোখ চলে গেল এক কোণে রেকর্ডিং-এর তারিখের দিকে। ইশিদার নিউ ক্যালকাটায় প্রথম আগমনের দিন। তারপর ইশিদা কথা বলতে শুরু করল।
তার কথা শুনতে শুনতে ধৃতিমানের মুখ হাঁ হয়ে গেল। এখানে আসার আগে ওরা তাকে যা কিছু বলেছিল, ইশিদার মুখ থেকে তার আদ্যোপান্ত সে তো শুনলোই, তার সঙ্গে শুনলো আরো কিছু। টোকিওর ত্রিস্তর বিশিষ্ট কাঠামো থেকে লোকজন সত্যিই ভিনদেশে যায় না। তবে তার কারণ মনে হল জ্ঞানেন্দ্র মশাট যা বলেছিলেন অত সামান্য নয়। ইশিদার জবানিতে ধৃতিমান জানলো, টোকিও মহানগর নিগম নিউ ক্যালকাটা কর্পোরেশনের মতোই কঠিন করে রেখেছে বাইরে যাওয়ার পথ। তফাৎ বলতে এটুকুই যে, টোকিওর আয়তন বড়ো; জল ও ডাঙার মধ্যে চলাচল আছে। ডাঙার দু-দিকে পর্বত ও বাকি দুই দিক বাঁধ দিয়ে ঘেরা, ফলে জায়গাটাকে সত্যি সত্যি ডাঙা বলা যায় না। আকাশে ভাসমান স্তরের বাসিন্দারা কার্যত বাকি দুই স্তরের শ্রমিকদের উপর গত সহস্রাব্দের তুলনীয় শোষণ চালাচ্ছে। তাই ইশিদা এক গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেয়, যারা টোকিও মহানগর নিগমের বিরুদ্ধে জাপান সরকারের কাছে অভিযোগ জানানোর চেষ্টা করে চলেছে।
“আমি অবাক হয়ে ভাবি,” রেকর্ডিং ফুরিয়ে গেলে জ্ঞানেন্দ্র মশাট শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “একটা আনাড়ি লোককে গুপ্তচরগিরির অ-আ-ক-খ টুকু না শিখিয়ে এমন বিপজ্জনক মিশনে পাঠিয়ে দিল। বলিহারি যাই… ওঃ, আর আরেক আনাড়ি এই হলে গিয়ে তুমি! বলি, তোমাদের পালের গোদারা কি পড়াশোনা করে না?”
ধৃতিমানের মাথার মধ্যে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। ভয় আর বিস্ময় তালগোল পাকিয়ে তাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। কত আশা নিয়ে নিউ ক্যালকাটা ছেড়ে বেরিয়েছিল সে; এখন মনে হচ্ছে যেন সেই আসার থেকে হাস্যকর কিছু হতে পারে না।
১৫. এমপ্যাথ
নিউ ক্যালকাটা শহরের ছ-টা গেট থেকে ছ-টা রাস্তা সরলরেখা বরাবর বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে মিশেছে। এই ছ-মাথার মোড়ের অন্যতম আকর্ষণ এক প্রাসাদ। সাধারণ, বিশেষত গরীব আশ্রয়ের ঘরবাড়ির মতো কেজো নকশা তার নয়। বিশাল দোচালা মন্দিরের আদলে গড়া বহুমূল্য পোড়ামাটির ইঁটের এই প্রাসাদটি ছয় রাস্তার মোড়ের উত্তর দিকের দুটো রাস্তার মাঝের ব্যবধান জুড়ে দণ্ডায়মান। মোড়ের দিকে মুখ করে থাকা চালাটিতে সুদৃশ্য অক্ষরে লেখা, “ভারতীয় জাদুঘর, নব কলকাতা।” একই কথা বাংলার নীচে অন্য অনেকগুলো ভাষায় পুনরাবৃত্ত।
পুরোনো কলকাতা ক্রমশ অগভীর সমুদ্রগর্ভে চলে যাওয়ার সময়ে সেখানকার ভারতীয় জাদুঘরের যতগুলো সম্ভব শিল্পকীর্তি ও নমুনাকে এনে এই প্রাসাদে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। গরীব আশ্রয়ের বাসিন্দারা শহরের যে কয়েকটা জায়গায় অবাধে ঘুরতে পারে, জাদুঘরের সামনের ত্রিকোণ বাগান সেই হাতে গোনা জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। ভিতরে ঢুকতে পয়সা লাগে, অবশ্যই, তাই ধৃতিমান রুনুকে নিয়ে বাগানেই বেড়াতে এসেছিল।
রুনুর মধ্যে কিছুদিন যাবৎ অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা টের পাচ্ছে ধৃতিমান। মাঝে মধ্যেই অন্যমনস্ক হয়ে যায়; ভিড়ের মধ্যে যেতে চায় না। ধৃতিমানের সঙ্গে বেড়াতে যেতে সে সব সময়ে এক পায়ে খাড়া থাকে, কিন্তু আজ যে সে রাজি হল, তাও যেন কিছুটা নিমরাজি হওয়ার মতো, অথবা নিয়মরক্ষা। ধৃতিমান একটা বেঞ্চে বসে জিজ্ঞেস করল, “তোর মন খারাপ?”
রুনু বলল, “কই না তো!”
“গুটিসুটি মেরে আছিস তাহলে? দ্যাখ কী সুন্দর শহর, রাস্তা, দোকানপাট, সমুদ্র…”
রুনু চেনা দৃশ্যে কিছুক্ষণ চোখ বোলালো। ছ-মাথার মোড়ে গম্বুজের উচ্চতা সবচেয়ে বেশি; উপরে কয়েক মিটার মাত্র জল। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সকাল থেকে সন্ধ্যা সুন্দর শহর, রাস্তা, দোকানপাট ও জাদুঘরের উপর ঢেউয়ের আলোছায়ার খেলা চলে। তারপর আস্তে করে বলল, “আমরা তো এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”
ধৃতিমান ভাবলো, ওঃ এই ব্যাপার। বলল, “দাঁড়া আগে ইন্টারভিউ হতে দে…”
“আমি যেতে চাই না।”
“রুনু, তাকা তো আমার দিকে।”
রুনু চোখ তুলে চাইতে ধৃতিমান বলল, “তোর মনে হয় না আমরা এই মিউজিয়ামটায় ঢুকতে পারি না কেন? বেড়া দেওয়া পার্কগুলোয় যেতে পারি না কেন? তোর আর তোর মায়ের একটা আলাদা বাড়ি হোক, একটা ভালো স্কুলে তুই যা, এসব তুই চাস না?”
রুনু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। এগুলো কি ওর কাছে “বড়োদের কথা” মনে হচ্ছে? বুঝতে পারছে না? বিমর্ষ হল ধৃতিমান।
কথা নেই, বার্তা নেই, রুনু হঠাৎ নিজে থেকেই চমকে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। ধৃতিমানও তার সঙ্গে পিছন ফিরতে দেখল এক ফর্সা, গোলগাল চেহারার যুবক জাদুঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাদেরকে লক্ষ করছে। দু-জনকে ফিরে তাকাতে দেখে মুচকি হেসে তাদের দিকে এগিয়ে এলো।
কয়েক সেকেন্ড ভেবেও ধৃতিমান ঠিক করতে পারল না একে কোথায় দেখেছে। লোকটি সামনে এগিয়ে এসে হাত বাড়ালো, “ধৃতিমান! আমি বরুণদেব।”
বরুণদেব এত মোটা হয়ে গেছে! না বলে দিলে ধৃতিমান সত্যিই চিনতে পারত না। স্কুলের সহপাঠী বরুণদেব ও ধৃতিমান ছিল দুই ভালো ছেলে। কিন্তু বরুণদেবের বাড়ির লোকের পয়সা ছিল, আর ধৃতিমানের বাড়িই ছিল না। সেখানেই যা তফাৎ হওয়ার হয়ে যায়। গত কয়েক বছর বরুণদেবের সঙ্গে দেখা হয়নি ধৃতিমানের।
“অনেক বদলে গেছিস,” মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল ধৃতিমান।
“হুঁ, জানি, সারাদিন বসে বসে কাজ… তোকে চিনতে আমার কোনো অসুবিধেই হয়নি।”
“কী করছিস এখন?” ধৃতিমান জিজ্ঞেস করল।
“স্পেস এলিভেটরের মাল সাপ্লাই। আমার হাতে তিনটে কারখানা। একটা চিনে, একটা সুমাত্রায়, একটা সুমাত্রার কাছাকাছি, প্লেট ফল্টলাইনের পাশে। বড়ো টিম, আমাকে শুধু কতগুলো বোতাম টিপতে হয় আর নজর রাখতে হয়। সুমাত্রাতেই থাকি, এখন এক হপ্তা ছুটি। তুই কী করছিস?”
“উইড ব্যাগ ডিজাইন!” জোর করে গলা হালকা রাখতে হচ্ছে।
“এটা কে?” রুনুর দিকে তাকিয়ে বরুণদেব জিজ্ঞেস করল।
“বসের মেয়ে,” রুনু ধৃতিমানের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।
বরুণদেব কয়েক পলক একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ধৃতিমানের মনে হল তার সেলে কেনা টি শার্ট, রুনুর বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকের চটি, তাদের চুলে জেলের অভাব এগুলোর যেন নোট নিচ্ছে। সে বলতে যাচ্ছিল, তাহলে আসি এবার? কিন্তু বরুণদেব বলে বসল, “পরীক্ষাটায় আরেকটু যদি কন্ট্রোল রাখতে পারতিস নিজের উপর…”
“সবাই সব পারে না।” ধৃতিমান চটে উঠল। “আমরা আসি। ভালো থাকিস।” রুনুর হাত ধরে সে হনহন করে ট্রাম লাইনের দিকে হাঁটা দিল।
ধৃতিমান খুব ছোটোবেলায় পরীক্ষা জিনিসটাকে যমের মতো ভয় পেত। পড়াশোনায় বরাবর ভালো হলেও পরীক্ষার হলে ঢুকলেই মারাত্মক টেনশনে তার গা গুলোত, হাত পা কাঁপত। গুছিয়ে কিছুই ঠিকঠাক লিখতে পারত না আর জানা জিনিস ভুল করে আসত। মিডল স্কুলে পড়ার সময়ে স্নেহপরায়ণ এক শিক্ষিকার সাহচর্যে সে এই ভয় কাটিয়ে ওঠে। তারপর তার রেজাল্ট ধারাবাহিকভাবে ভালো হতে থাকে স্কুল জীবনের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বেঙ্গালুরুতে আন্তর্জাতিক এমপ্লয়েবিলিটি টেস্ট দিতে গিয়ে কোনো অজ্ঞাত কারণে তার ছোটোবেলার পরীক্ষাভীতি আবার চাগাড় দিয়ে ওঠে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বমি হয়ে গিয়ে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে সে। সেবার আর পরীক্ষা দেওয়া হল না; পরের পরীক্ষার আগে ক্যাম্পাসিং হয়ে গেল। ধৃতিমান শিওর ছিল না যে, আবার পরীক্ষা দিলেও সে সুস্থ মনে পরীক্ষায় বসতে পারবে।
রুনু অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। গরীব আশ্রয়ে ঢুকতে গিয়ে সে মুখ খুলল, “লোকটা আমাদের দেখে খুব মজা পেয়েছে।”
ধৃতিমান বলল, “হ্যাঁ, স্বাভাবিক। আমাদের কিছু নেই, আর ওর অনেক কিছু আছে।”
রুনু বলল, “না, আমি টের পেলাম ও মজা পেয়েছে। আর তোমার মুড ইচ্ছে করে অফ করে দিয়েছে।”
“তাই নাকি?”
রুনু ভুরু কুঁচকে ধৃতিমানের দিকে তাকাল। অতটুকু মুখে সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা দেখে ধৃতিমান হাসবে কি কাঁদবে ঠিক করতে পারল না। রুনু বলল, “তুমি বিশ্বাস করছ না।”
ধৃতিমান এবার কী বলবে! রুনু কচি গলায় কেটে কেটে বলল, “জানো, আমি বুঝতে পারি কে কী ভাবছে। কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যে বলছে।”
১৬. ত্রাতা
জ্ঞানেন্দ্র মশাট উত্তেজিতভাবে বৈঠকখানার এধার থেকে ওধার পর্যন্ত পায়চারি করতে করতে বললেন, “একটা সভ্যতা যখন হাইপারজাম্প করতে পারছে, স্পেস এলিভেটর তৈরি করতে পারছে, একশো পেরোনো মানুষকে তরতাজা রাখতে পারছে,” এইখানে থেমে একবার নিজের মসৃণ হাতের দিকে তাকিয়ে ফের হেঁকে উঠলেন, “তাহলে তারা যে মাইক্রো-প্রোবও বানিয়ে ফেলে থাকবে এটা আন্দাজ করতে কি গোয়েন্দা হতে হয়? আর তুমি অস্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকলে সেরকম দু-দশটা প্রোবকে যে তোমার লেজুড় রাখা হবে এটা তো জানা কথা!”
ধৃতিমান আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসছিল। বোঝার চেষ্টা করছিল কীভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারে। যে কোনো নতুন জিনিসই একবার জানতে পারলে সহজ মনে হয়, কিন্তু জানা না থাকলে প্রায় কেউই সেটার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না— এ-কথা বলে জ্ঞানেন্দ্র মশাটকে চটানো উচিত নয় বলেই সে স্থির করল।
“দেওয়াল, বর্ম, সুরক্ষা-আ কবচ্,” তালু আর জিভের ফাঁকে হাওয়া পিষে রাগ দেখালেন উত্তেজিত অধ্যাপক, “আড়াল করার যে কোনো কৌশলই বিফল, বুঝলে। ভর দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সবকিছুই শেষ বিচারে শক্তি; ভরও জমাট বাঁধা শক্তি। শক্তির এনট্রপি বেশি। জগৎ জুড়ে এনট্রপি বাড়ছে মানে একদিন না একদিন সমস্ত ভর, শক্তিতে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। তখন কোথাও কিছুর আড়াল থাকবে না!”
কোথা থেকে কোথায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন! ধৃতিমান ভাবল।
যেন তার ভাবনার আওয়াজ তাঁর কানে গেছে, এমন ক্ষিপ্রতায় তার দিকে ফিরে তাকালেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। “বাড়িয়ে বলছি না, ধৃতিমান!” তাঁর উত্তেজনার মধ্যে একটা পরিবর্তন এলো। কেমন যেন ব্যাকুল ভঙ্গিতে তিনি বললেন, “যা সত্যি তাই বলছি। কিছুই চাপা থাকে না, থাকতে পারে না।”
ধৃতিমান আবার একটু ঘাবড়ে গেল। অধ্যাপকের গলায় কি এবার অনুনয়ের ছোঁয়া? তা ছাড়া উনি তার মনের কথা এমন হুবহু বুঝলেন কী করে?
ধীরে ধীরে শতায়ু বিজ্ঞানী ধৃতিমানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। “আমি এমপ্যাথ, ধৃতিমান। মানুষের মনের ভাব মোটামুটি টের পাই। সেটা এখন বড়ো কথা নয়। আমি জানি শেষমেষ কিছু লুকোনো যায় না। কিন্তু সমস্ত আড়াল ঘুচিয়ে পৃথিবী এখন যেদিকে চলেছে তা দেখে আমার ভয় হয়!”
ধৃতিমান স্থির দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার সবটুকু মনোযোগ তাঁর কথার দিকে।
“মাইক্রো-প্রোব! স্মার্ট দেওয়াল! আক্ষরিক অর্থে দেওয়ালের এখন কান থাকে। হাতে হাতে সেন্সর। রক্তে ন্যানোবট। মগজে গাঁথা চিপ। উপকারিতা আছে, অবশ্যই এই সবকিছুর ভালো দিক আছে। কিন্তু এগুলোর জন্যই ইশিদা ওরিহারার সমিতিও যে প্রথম থেকেই হেরে বসে আছে! তোমাদের কাছে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎটুকু বাঁচাতে তাই পালিয়ে এলো।” একটু থেমে আবার বললেন, “আনন্দিত হও, খাঁচার জীব ধৃতিমান। তোমাদের যারা দেখতে আসে তারা তোমাদের থেকেও বেশি বন্দি।”
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। ধৃতিমান স্তব্ধতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?”
আচার্য জ্ঞানেন্দ্র মশাট জবাব দিলেন, “হ্যাঁ।”
১৭. আসল কাজ
সন্ধে হয়ে গেছে। কমন রুম থেকে ভেসে আসছে কথাবার্তা, হাসির আওয়াজ। ডাইনিং হলে কারো থাকার কথা নয়, তবু হলের এক কোণায় আলো জ্বলছে। ধৃতিমান, রঙ্গনা আর ইশিদা বসে আছে। রঙ্গনা বলল, “তাহলে ধরে নিতে হবে যে, আমার মেয়ে একজন এমপ্যাথ। ওকে সাবধানে রাখতে হবে। নানা দিক থেকে চাপ আসবে।”
ইশিদা টেবিলের উপর দুই হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে বসেছিল। সে বলল, “আমাদের প্ল্যান সফল হলে অবশ্য তুমি যেরকম চাপের কথা ভাবছ, সেরকম চাপ আসবে না।”
ধৃতিমান দু-জনের প্রতিক্রিয়া দেখছিল। আজ সন্ধেবেলার গোপন মিটিং-এ এই দু-জনই তাকে ডেকেছে, কিন্তু রুনুর খবর শোনার পর মিটিং-এ আসলে কী হওয়ার কথা ছিল, সেটা মনে হচ্ছে দু-জনের কারোরই খেয়াল নেই। ধৃতিমান মনে করিয়ে দিল।
“হ্যাঁ ঠিক,” রঙ্গনা বলল, “ধৃতিমান, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। বড়ো কাজ।”
ইশিদা বলল, “সময় লাগবে, কিন্তু এটাই আসল কাজ।”
ধৃতিমান শুনতে থাকল। মানুষের শরীর জলের নীচে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসবাস করার উপযুক্ত নয়। সূর্যের আলোর ভিটামিন ডি ছাড়াও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক রসদ ডাঙার আলো-বাতাস ও খোলা হাওয়ায় চলে ফিরে বেড়ানোর অধিকার থেকে মানুষ সংগ্রহ করে চলে। নিউ ক্যালকাটা প্রভৃতি সমুদ্র শহর তৈরি হওয়ার সময়ে তাই বাসিন্দাদের আহার্যে বিশেষ বিশেষ সাপ্লিমেন্টের জোগান দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। কয়েক প্রজন্ম গবেষণা চালানোর পর এখন একটিমাত্র পানীয়ের মধ্যে সমস্ত জরুরি উপাদান পুরে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যাকে জগৎজোড়া সমুদ্র-শহরের বাসিন্দারা হেলথ টনিক নামে চেনে। এই হেলথ টনিকে সম্প্রতি কিছু রদবদল করেন বিজ্ঞানী জ্ঞানেন্দ্র মশাট। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছিল, এতে টনিকের আয়ু ও শক্তিবর্ধন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নকারী বিজ্ঞানীও বিভিন্ন সরকার, সমুদ্র শহর কর্তৃপক্ষ ও বৈজ্ঞানিক সংস্থার কাছ থেকে বিপুল অর্থমূল্যের পুরস্কার পান। কিন্তু ইশিদা গ্রহ কারিগরের হয়ে মহাকাশচারীদের পুষ্টি নিয়ে গবেষণা করার সময়ে মুহূর্তের খেয়ালে হেলথ টনিকের সাম্প্রতিক নমুনার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে এবং অবাক হয়ে যায়। টনিকে সে মহাজাগতিক রশ্মির হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর উপযুক্ত কিছু উপাদানের সন্ধান পায়।
এই বদলের পিছনে জ্ঞানেন্দ্র মশাটের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। তিনি হেলথ টনিকের স্বত্বের সিংহভাগ কিনে ফেলে কার্যত স্বাধীন বিজ্ঞানীর জীবন যাপন করছেন; নিজস্ব গবেষণাগার ও একাধিক যন্ত্র-ভৃত্য নিয়ে একটি আকাশ-বাংলোয় তাঁর বাস। ধৃতিমান যদি এই পানীয়ের ফর্মুলাটি কোনোভাবে হস্তগত করতে পারে, তাহলে গ্রহ কারিগরের নতুন গ্রহ-নির্মাণ অভিযানে তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে।
“কীভাবে আধিপত্য বিস্তার করব সেটা তোমার বসের উপর ছেড়ে দিতে পারো,” ধৃতিমানের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ইশিদা হেসে বলল। “তবে শেষ লক্ষ্য হবে পৃথিবীর সমস্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচা।”
“কীভাবে আমি জ্ঞানেন্দ্র মশাটের আকাশ-বাংলোয় যাবো?”
ইশিদা বলল, “আমি দেখেছি বায়োলজিতে তোমার জ্ঞান মন্দ নয়। আমার বিশ্লেষণটাকেই তুমি নিজের বলে দাবি করবে আর বায়োমেকানিক্সে তার কিছু কিছু অগ্রগতির সম্ভাবনার কথা বলবে। আমি ঠিক করে রেখেছি কী বলতে হবে; তোমাকে বুঝিয়ে দেবো।”
ধৃতিমান একটু বিভ্রান্ত হল। “কিন্তু আপনি নিজে গেলেই তো সবচেয়ে ভালো!”
“আমার যাওয়ার জো নেই, ধৃতিমান,” ইশিদা মাথা নাড়ল। “যেতে পারলে তোমাকে বলতাম না।”
পাশ থেকে রঙ্গনা মুখ খুলল, “ও যেতে পারবে না রে। তুইই সবচেয়ে বড়ো ভরসা।”
ধৃতিমান চোয়াল শক্ত করল। সে বাস্তবিক নিউ ক্যালকাটায় পড়ে থাকতে চায় না। যে পৃথিবী নিজের রূপ দেখার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে এক বুদবুদে বন্দি রেখেছে, সেই পৃথিবীর উপরও তার মায়া নেই।
১৮. দলছুট
“কীভাবে সাহায্য করবেন আমাকে? নিউ ক্যালকাটায় তো ওদের প্রোব ভর্তি এখন।” ধৃতিমান আশ্বস্ত হতে পারল না।
“আমি কয়েকশো নিজস্ব প্রোব নিউ ক্যালকাটায় ছেড়ে এসেছি। তোমাকে আনতে গিয়ে এই গাড়িই তাদের পৌঁছে দিয়েছিল। তারা জাপানি প্রোবগুলোকে অকেজো করতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস, যেহেতু জাপানিরা ব্যাপারটা আশা করছে না।”
“নিজেদের প্রোব খারাপ হয়ে যেতে দেখলে ওরা সন্দেহ করবে।”
“যদি সন্দেহ করে, তবুও ওরা নিরুপায়, কারণ ভারতের সমুদ্র শহরে প্রোব ঢোকানো বেআইনি।” আত্মতুষ্টির হাসি হাসলেন জ্ঞানেন্দ্র মশাট। “ইশিদাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পলাতক আসামী ঘোষণা করেনি জাপান; ভেবেছিল চুপচাপ পুরো প্ল্যান ভেস্তে দেবে। কিন্তু এর ফলে ওদের নিজেদের হাত-পা-ই বাঁধা হয়ে গেছে।”
“কেন ঘোষণাটা করেনি?” ধৃতিমান সংশয়ী।
“ওঃ,” তার অজ্ঞতা নতুন করে খেয়াল করলেন অধ্যাপক। “ইশিদা ওরিহারার কাজকর্ম আইনত অপরাধ বলে গণ্য হওয়ার নয় যে,” তিনি বোঝালেন। “এ এক ভয়ঙ্কর অভ্যাস। আইনে লেখা থাকবে এক, কিন্তু চলবে জঙ্গলের রাজত্ব। এর মধ্যেও আড়াল করার ব্যাপার থাকে বটে, কিন্তু এনট্রপির ভরসায় সব ছেড়ে দেওয়ার ধৈর্য এখনো রপ্ত হয়নি আমার।”
“কিন্তু আমাকে অন্তত একবার নিউ ক্যালকাটায় ফিরতে হবে। ফর্মুলাটা দিয়ে আসতে হবে।”
করুণার চোখে ধৃতিমানের দিকে তাকালেন আচার্য মশাট। “তোমার ভিউ স্ক্রিন নিউ ক্যালকাটার বাইরে থেকে ভিতরে চালান করতে পারে না, না? চিন্তা নেই, জাপানের সব প্রোব নিকেশ করার পর আমার প্রোবগুলোই তোমার বিশ্বস্ত এক বা একাধিক লোকের চিপে নিজেদেরকে যুক্ত করবে। টনিকের ফর্মুলা বলে দেবে।”
“আমিই তো ফিরে যেতে পারি।”
“তুমি এখানে আমার সঙ্গেই থাকলে ভালো। নিউ ক্যালকাটায় রহস্যজনকভাবে ওদের সব প্রোব নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অন্তত আমি তোমার উপর নজর রাখছি এইটুকু সান্ত্বনা ওরা পাবে। তুমি তোমার “গবেষণার” কাজ করবে। এখান থেকেই ইন্টারভিউ দিয়ে আসবে।”
ধৃতিমানের মনে এলো এক নতুন চিন্তা: “আর, গ্রহ কারিগরের প্ল্যানেটিয়ার শিপ রওনা হয়ে যাওয়ার পর? আপনার কী হবে?” রঙ্গনা, রামস্বরূপ, মঞ্জুষা, রুনুর সঙ্গে সঙ্গে তার জ্ঞানেন্দ্র মশাটের জন্যও ভাবনা হল।
জ্ঞানেন্দ্র মশাট হেসে বললেন, “আমার কোনো বিপদ হবে না। আমি ভারতের নাগরিক। বললাম না, ইশিদাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ান্টেড ঘোষণা না করে জাপান সরকার নিজেদের হাত-পা বেঁধে ফেলেছে।”
ধৃতিমান আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। জ্ঞানেন্দ্র মশাট বলে চললেন, “বিজ্ঞান এগোলে আর বিপ্লব না এলে পৃথিবীতেই আমি অনেকদিন বাঁচব।” এই তোমাদের মতোই কারো আশা করে বসেছিলাম বলেই মনে হচ্ছে উন্নত হেলথ টনিকের পুরো বিদ্যেটা কাউকে বলিনি। তোমাদের প্ল্যান ঠিকঠাক চললে নতুন গ্রহে কম টেরাফর্মিং করেও তোমরা থাকতে পারবে।”
ধৃতিমান উঠে দাঁড়িয়ে জ্ঞানেন্দ্র মশাটের উদ্দেশ্যে ডান হাত এক পাক ঘুরিয়ে কপালে ঠেকাল। তিনি আশীর্বাদ করলেন। বললেন, “যে সব নতুন গ্রহে সভ্যতা ছড়াচ্ছে, সব জায়গায় এক ধাঁচের শাসন ও শোষণব্যবস্থা। ভয়ঙ্কর একমুখীনতা। মঙ্গলেও তাই, শুক্রেও তাই, গ্যাস দানব গ্রহগুলোর উপগ্রহগুলোতেও তাই, সেন্টাউরিতেও তাই। বৈচিত্র্য থাকাটা নিতান্ত দরকার। কয়েকটা গ্রহ দলছুট হওয়া দরকার।”
রাতের আকাশে মরুভূমির উপর ভেসে রইল আকাশ বাংলো নং চৌষট্টি বাই দুশো ঊনপঞ্চাশ। তাকে ঘিরে রইল মহাশূণ্য, যার বিপুল নিঃসঙ্গতার মাঝেই একদল মানুষ পাড়ি দেবে বিপুলতর সৌহার্দ্যের সন্ধানে।
(এই বড়োগল্পটি কল্পবিশ্ব সপ্তম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত গুপ্ত ইরাবতী গল্পের প্রিকুয়েল)
Tags: সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়