রিগিং
লেখক: ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ডেটা-সলভ করপোরেশনের মিটিং রুমের সামনে সবাই ঘোরাফেরা করছে। এম-ডি পুরো টেকনিকাল টিমের মিটিং ডেকেছেন। গুজব শোনা যাচ্ছে যে অনেক দিন পরে নাকি ডেটা-সলভ একটা বিরাট গভর্নমেন্ট অর্ডার পেয়েছে।
সাত্যকি পাল একজন সিনিয়ার অ্যানালিস্ট। সে একটু নার্ভাস বোধ করছে। কারণ যদি গোলমেলে কাজ হয়, এম-ডি-র স্বাভাবিক প্রবণতা হল সেটা তার দিকে ঠেলে দেয়া। অথচ মাইনে বাড়ানো বা প্রোমোশনের সময়, কিন্তু তার কথা এম-ডি-র মনে থাকে না।
অবশেষে মিটিং রুমের দরজা খুলল। অডিটোরিয়ামের মতো করে পর পর চেয়ার সাজানো আছে, আর স্টেজ যেখানে থাকার কথা সেখানে, উলটোদিকে মুখ করা এম-ডির-চেয়ার। প্রায় জনা চল্লিশেক লোক বসার জায়গা আছে। এই মুহূর্তে সেখানে জনা পনেরো লোক রয়েছে।
মিটিং রুমে বেয়ারা ঢুকে সবাইকে কফি দিয়ে গেল। এই সময়েই এম-ডি ঢুকলেন। আজ তাঁর মুখ বেশ গম্ভীর। এরকম তো হবার কথা ছিল না! এম-ডি বেয়ারাকে দরজা বন্ধ করে বাইরে লাল লাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। সাত্যকির মনে হল ব্যাপার খুবই সিরিয়াস।
এম-ডি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ওয়েল লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন। আমাদের কোম্পানি একটা গুরুতর বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আপনারা জানেন যে শেষ তিনটে কোয়ার্টারে কোম্পানি প্রায় কিছুই কাজ জোগাড় করতে পারেনি। ফলে লসের পরে লস খেয়ে চলেছে। এখন আমি এমন একটা প্রস্তাব পেয়েছি, যেটা যদি আমরা করে দিতে পারি তাহলে ভারতের সবচেয়ে বড়ো তিনটে ইনফোটেক কোম্পানির, একটা হয়ে উঠব। আর যদি না পারি, কোম্পানিতে লালবাতি জ্বালা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।” এম-ডি এসির কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও একবার নিজের মুখ মুছলেন।
সাত্যকি ভাবল দু-দিকেই লাল! একদিকে লালবাতি, অন্যদিকে লাল হয়ে যাওয়া।
“এখন গোপনীয়তাই হলে এই কাজটির ওয়াচ-ওয়ার্ড। তাই আমাকে আপনারা ১৫ জন এখনই কথা দিন এখানে যা শুনবেন তা কোনোভাবেই যেন বাইরে না যায়। এমনকি আপনাদের পার্টনাররাও যেন একথা ঘুণাক্ষরে জানতে না পারে।”
সবাই চুপ করে রইল। সাত্যকির বুক দুরদুর করছিল। এই বয়সে চাকরিটা চলে গেলে অনেক ঝামেলা।
“আপনারা জানেন যে বিগত সাধারণ নির্বাচনে রিগিং এবং পালটা রিগিং এর অভিযোগে নির্বাচন কমিশন জেরবার হয়ে গেছে। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে নির্বাচন কমিশন চাইছেন এমন একটা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যেটা ভোটে রিগিং হলে নিজে নিজেই সেই বুথের ভোট বাতিল করে দেবে। এটার জন্য নির্বাচন কমিশন একটা অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা দিতে রাজি হয়েছে। প্রিয় বন্ধুরা, আমার প্রশ্ন, এটা কি আদৌ সম্ভব?”
বিগ-ডেটা সেকশনের সুধাকরন বলল, “রিগিং যে হয়েছে, তা কীভাবে বোঝা যাবে?”
এম-ডি বললেন, “এ কাজটা যখন প্রশাসনকে দেয়া হয়নি, তখন নিশ্চয়ই ভোট পড়ার চেহারা দেখে।”
সুধাকরন বলল, “প্লিজ, আর একটু এক্সপ্লেইন করুন স্যার।”
“কোনো বুথে মারদাঙ্গা হলে বা ইভিএম দখল হলে, বোঝা যায় রিগিং হয়েছে। কিন্তু এসব খবর রাখা হল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাজ। তারা যখন পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে পড়ে তখন তো আর বোঝা সম্ভব নয়। এখন কী ভাবে বা কী অর্ডারে ভোট পড়ছে, সেটা থেকেই রিগিং হচ্ছে কি না বুঝতে হবে।”
সুধাকরন আরো কেবলে গিয়ে বলল, “এটা কি করে সম্ভব?”
অচিন্ত্য বলে ছেলেটি টেস্টিং-এ সদ্য জয়েন করেছে। সে বলল “ধরা যাক একটা বুথে দেখা গেল কোনো একটা পার্টি, সেন্ট পারসেন্ট ভোট পেয়েছে। বুঝতে হবে, খুব সম্ভবত সেখানে রিগিং হয়েছে।”
“কিন্তু যদি অপোনেন্টের দিকে কয়েকটা ভোট পড়ে?”
“মাত্র কয়েকটা হলেও, একই কথা।”
“তাহলে অন্য পক্ষে ক-টা ভোট পড়লে ধরা যাবে রিগিং হয়নি।”
“সেটা গত ইলেকশনের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে।”
“কীভাবে বোঝা যাবে?”
“একটু বুদ্ধি খাটালেই বোঝা যাবে।”
“সেই বুদ্ধিটা কে খাটাবে অচিন্ত্য? ইভিএম?”
“না মানে…”
“ঠিক আছে তুমি বসো।”
অপ্রস্তুত অচিন্ত্য বসে পড়ল। এম-ডি অচিন্ত্য আর সুধাকরের তর্ক শুনছিলেন। বললেন, “ওয়েল, এটা একটা ব্রেন-স্টর্মিং সেশান হোক। সবাই যার যার আইডিয়া বলতে থাকুন। যতই অসম্ভব মনে হোক না কেন, প্লিজ কাম আউট উইথ ইট।”
দু-এক জনে বলার চেষ্টা করে ঠিকই কিন্তু দেখা যায় কেউই এ সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট কথা বলতে পারছে না। এমন সময়ে কোডিং টিমের হেড অলক চক্রবর্তী উঠে দাঁড়ায়। সাত্যকি ভাবে, এই লোকটার মতো খচ্চর, সচরাচর দেখা যায় না। এ সবসময়ে সাত্যকিকে বিপদে ফেলে মজা পায়।
অলক বলল, “এম-ডি স্যারের কথা অনুযায়ী আমরা কেবল মাত্র ইভিএম মেশিনে যে অর্ডারে ভোট পড়েছে, সেই অর্ডারটা জানব। আর সেই টাইম সিরিজ প্যাটার্ন থেকেই বুঝতে হবে রিগিং হয়েছে কি না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এটা একটা প্যাটার্ন রিকগনিশন প্রবলেম। আমরা জানি আমাদের লার্নেড কলিগ সাত্যকি পাল, রিসেন্টলি প্যাটার্ন রিকগনইশনে ট্রেনিং পেয়েছেন। তিনিই বরং সমস্যাটা আমাদের বুঝিয়ে বলুন, এবং সম্ভব হলে সমাধানের দিকে একটা ইঙ্গিত দিন।”
সাত্যকি প্রমাদ গুনল। “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়” প্রবাদটা এমনভাবে খেটে যাবে সে ভাবেনি। একথাটা ঠিক যে গত বছর সে কোম্পানির পয়সায় একটা এক সপ্তাহের ট্রেনিং-এ গিয়েছিল। সেখানে আর পাঁচটা জিনিসের মতো প্যাটার্ন রিকগনিশনের দু-একটা লেকচার হয়েছিল। হতভাগা অলক সেটা মনে রেখে ঠিক জায়গায় ফাঁসিয়ে দিল। আচ্ছা, দাঁড়া, এক মাঘে শীত যাবে না, তোকেও আমি দেখে নেব।
সাত্যকি উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই বলে, “প্যাটার্ন রিকগনিশনের অনেকগুলি কায়দা হয়। আমাদের সর্ট কোর্সে…”
এম-ডি বাধা দিয়ে বলেন, “না, না। তুমি এই প্যাটার্ন রিকগনিশন ব্যাপারটা কি সেটাই আগে বল।”
“একটু সময় পাওয়া গেল,” ভাবল সাত্যকি, “এবারে ব্যাপারটাকে ভালোভাবে গুলিয়ে দেয়া যাবে।”
সাত্যকি বলতে শুরু করে, “আমরা মানুষের মুখ কত সহজে চিনতে পারি, এমনকি তিরিশ বছর বয়সে দেখেও স্কুলের বন্ধুকে চিনতে পারি। কিন্তু কীভাবে পারি জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারব না। দুর্বোধ্য হস্তাক্ষর পড়তে পারি। কিন্তু কীভাবে বুঝলাম এটা a আর এটা o তার কোনো নিয়ম তৈরি করতে পারি না। আর সেই জন্য মেশিনকেও সেটা চেনানো খুব শক্ত। আসলে আমরা অই a আর o চিনি কিছু অন্তর্নিহিত প্যাটার্ন দেখে, যেটা আমাদের ব্রেন খুব সহজে চিনতে পারে। কম্পিউটারকে এই প্যাটার্ন চেনানোর চেষ্টা করার নামই প্যাটার্ন রিকগনিশন।”
এম-ডি বললেন, “সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং। তা এখানে এই ব্যাপারটা কীভাবে আসবে?”
“সেটা তো স্যার অলকদাই বলতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে এটা যে প্যাটার্ন রিকগনিশন প্রবলেম সেটা তো অলকদাই বলেছেন!”
চমৎকার দক্ষতায় সার্ভিস ফিরিয়ে দিয়ে বসে পড়ে সাত্যকি, মন ভরা আনন্দ!
অলক চক্রবর্তী দমে না, বলে, “ভোটিং সিকুয়েন্স হল একটা প্যাটার্ন, ঠিক যেমন মানুষের ছবি একটা প্যাটার্ন। আর চিনতে পারা না পারা যেমন একটা ডিসিশন, সেরকমভাবেই রিগিং হয়েছে কি না এটা একটা ডিসিশন। এতে তো না বোঝার মতো কিছু নেই?”
“ব্র্যাভো”, বলে ওঠেন এম-ডি, “সো সাত্যকি, নাউ ইট ইস ইয়োর টার্ন।”
খচ্চরটা চমৎকার বল ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন সাত্যকি কী করে! বলতে শুরু করল, “অলকদা ব্যাপারটাকে ওভার সিমপ্লিফাই করেছেন স্যার। এখানে সব সময়েই একটা ট্রেনিং-লার্নিং অ্যালগরিদম থাকে। মেশিনকে প্রচুর ছবি দিয়ে একটা ছবির সঙ্গে ম্যাচ করতে দেয়া হয়। মেশিন ভুল করলে, তাকে জানান হয় সে ভুল করেছে, তখন সে নিজের অ্যালগরিদম বদলায়। আর যদি বলা হয় সে ঠিক করেছে, সে নিজের অ্যালগরিদমকে আরো স্ট্রং করে তোলে। এখানে ট্রেনিং হবে কোন ডেটা দিয়ে? কে বলে দেবে কম্পিউটার ঠিক বলছে না ভুল?”
অলক ছাড়ার পাত্র নয়, সে বলল, “এই দুটো কাজই নির্বাচন কমিশনকে করতে হবে। তা ছাড়া আমরা ডেটা পাব কোথায়?”
এম-ডি বললেন, “দাঁড়াও অলক। ইউ মিন আমরা ইলেকশন কমিশনের কাছে, প্রত্যেক বুথের জন্য, বিগত বছরের ভোটিং প্যাটার্ন আর সেই বুথে রিগিং হয়েছিল কি না জানতে চাইব?”
“ইয়েস স্যার।”
“বুথ ধরে ধরে, কোন পক্ষে কত ভোটিং হয়েছিল, এ তথ্য পেতেও পারি, কিন্তু কি সিকুয়েন্সে ভোট পড়েছিল তা তো ইভিএমএ থাকে না। আর ওই বুথে রিগিং হয়েছিল কি না, তাই বা নির্বাচন কমিশন কীভাবে বলবে?”
“তা হলে এই ইলেকশনে সেই ব্যবস্থা করা হোক, পরের ইলেকশনে আমরা সফটওয়ার দিতে পারব।”
এবারে ঘরে হট্টগোল শুরু হল। সাত্যকি যাকে বলে মহা খুশি। অলকদা বেশি বুদ্ধি দেখাতে গিয়ে নিজেই ছড়িয়ে ফেলেছে। এবারে বাজে বকার জন্য নিশ্চিত ধমক খাবে। সহসা এম-ডির আওয়াজ শোনা গেল।
“সাইলেন্স! সাইলেন্স প্লিজ!”
সবাই চুপ করল। এম-ডি বললেন, “অলক, তোমার প্রস্তাবটা আমার একটু অবাস্তব মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি গুছিয়ে বল তো তুমি নির্বাচন কমিশনের কাছে ঠিক কী চাও?”
অলক চক্রবর্তী বলল, “স্যার আমার প্রথম প্রস্তাব হল এ বারের লোকসভা নির্বাচনে আমাদের কোম্পানি ইভিএম দেবে। সেই সমস্ত ইভিএম ওয়াই ফাই দিয়ে নেটে কানেক্ট করা থাকবে। আর সমস্ত ডেটা আমাদের সার্ভারে আসবে। যাতে আমরা প্রত্যেক বুথের ভোটিং সিকুয়েন্স বুঝতে পারি। মানে ধরুন তিনটা পার্টি ইলেকশন লড়ছে। এ, বি, সি। এবারে ভোটিং প্যাটার্ন হতে পারে, এরকম একটা সিকুয়েন্স “AABCAACBBBAACAAABCAA…” অর্থাৎ প্রথম ভোট পেল এ পার্টি, দ্বিতীয় ভোটও তারাই পেল, তৃতীয় ভোট পেল বি পার্টি, চতুর্থ ভোট পেল সি পার্টি, অ্যান্ড সো অন।” প্রত্যেক বুথের জন্য এই সিকুয়েন্স সাজান থাকবে। আমাদের সফটওয়ার ভোটিং প্যাটার্ন দেখে একটা ডিসিশন দেবে রিগিং হয়েছে কি না। সেটা ঠিকও হতে পারে ভুলও হতে পারে।
এবারে নির্বাচন কমিশন ইলেকশনের সময় প্রত্যেক বুথে একজন নিরপেক্ষ অবসার্ভার পাঠাবে, যাকে কেউ চেনে না। সে লোকাল লোকও হতে পারে। সে লক্ষ রাখবে কোনো দুনম্বরি হল কি না। তার রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা আমাদের সফটওয়ারকে ট্রেইন করব, সফটওয়ার ভোটিং প্যাটার্ন দেখে ঠিক বলছে কি ভুল বলছে।”
এম-ডি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “অলক, ডু ইউ থিঙ্ক ইট উইল রিয়েলি ওয়ার্ক?”
“না করার কোনো কারণ তো নেই স্যার। আমাদের কোম্পানিতে প্যাটার্ন রিকগনিশনের এক্সপার্ট আছে। গোটা প্রবলেমটাই তাদের কাছে পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। তারা নিশ্চয়ই এবারে একটা সলিউশন নিয়ে আসতে পারবে।”
এম-ডির চোখ সাত্যকির দিকে ঘুরে গেল। অলক হারামজাদা পুরো সর্বনাশ করে দিয়েছে। সাত্যকি মরিয়া হয়ে বলল, “এটা এত সহজ কাজ না কি? এক একটা বুথে প্রায় হাজার ভোটার থাকে। এতে কত মিলিয়ান বিলিয়ান প্যাটার্ন হতে পারে জানেন? সেই প্যাটার্ন চেনা কি সাধারণ মেশিনের কাজ? বিরাট কম্পিউটেশনাল ফেসিলিটি লাগবে, আর তা ছাড়া…”
এম-ডি গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা একটা ডু-অর-ডাই সিচুয়েশন। হয় আমরা কাজটা করব, অথবা আমরা শেষ হয়ে যাব। সো স্টপ গিভিং এক্সকিউজেস। আমার প্রশ্ন ক্যান ইট বি ডান বাই আস?”
সাত্যকি হাল ছেড়ে দিল, চাকরিটা গেলই মনে হচ্ছে। শেষ চেষ্টা হিসাবে বলল, “এই প্রশ্নের উত্তর দিতে, আমার অন্তত সাত দিন সময় চাই।”
“অত দিন সময় দেয়া তো সম্ভব নয়।”
সাত্যকি হতাশ গলায় বলল, “দেন আই কুইট, অন্য কেউ চেষ্টা করুক।”
এম-ডি বাকি দের দিকে তাকালেন কেউ উচ্চবাচ্চ্য করল না। অলক বলল, “সাত্যকি হ্যাজ দি কোর কম্পিটেন্স। হাউ ক্যান হি কুইট অ্যাট থিস মোমেন্ট?”
সাত্যকি নিষ্প্রাণ গলায় অলকের উদ্দেশ্যে বলল, “আমি স্বীকার করছি, যে এ ব্যাপারে আমার কম্পিটেন্স নেই। আর ইউ স্যাটিসফায়েড নাউ?”
এম-ডি, অলককে বললেন, “তোমার কোনো অলটারনেটিভ সাজেস্ট করার আছে?”
“মানে, এখন…”
“দেন কিপ ইয়োর মাউথ শাট।”
অপমানে অলকের কালো মুখ বেগুনী হয়ে গেল। এম-ডি পাত্তাও দিলেন না।
মিটিং-এ সবাই চুপ করে রইল। এম-ডি বললেন “ঠিক আছে মিটিং ইজ ওভার।”
সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। এম-ডি ইশারায় সাত্যকিকে থেকে যেতে বললেন। সবাই চলে যাবার পরে বললেন, “দ্যাট, অলোক ইস আ রোগ। কিন্তু সত্যিই কি কিছু করার নেই? মাই চাইল্ড, আমাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। যদি এই প্রোজেক্টটা না করতে পারি, তাহলে কিন্তু সত্যিই আমাদের কোম্পানি উঠে যাবে। সেক্ষেত্রে শুধু তুমি না, উই অল হ্যাভ টু কুইট। মাথা ঠান্ডা করে আমায় বল দেখি সমস্যাটা কোথায়?”
সাত্যকি একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “স্যার এটা সত্যিই একটা অসম্ভব প্রজেক্ট। আমরা আদৌ জানি না, ভোটিং প্যাটার্ন থেকে রিগিং প্রেডিক্ট করা যায় কি না? ধরে নিচ্ছি যায়, তাহলেও এই কাজটা করতে একটা অসম্ভব বড়ো কম্পিটেশনাল ফেসিলিটি দরকার। এমন একটা সিস্টেম, যার ইনপুট এক হাজার, যদি মোটে তিনটে পার্টিও ইলেকশন লড়ে, তাহলেও থ্রি টু দি পাওয়ার থাউজ্যান্ডটা পসিবল প্যাটার্ন মনে রাখতে হবে। মানে একের পিঠে দুশোটা শূন্য। সমস্যাটা এবারে আন্দাজ করতে পারছেন? এমন কোনো মেশিন আগামী দশ বছরেও তৈরি হবে বলে মনে হয় না।”
এম-ডি একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু কোনো উপায়ই কি নেই? ডুবে যাবার আগে তো মানুষ খড়কুটো ধরেও বাঁচার চেষ্টা করে। যাও, ভাবো। আগামী সাত দিন তোমার অফিসে আসার দরকার নেই। শুধু ভাবো, কোনো উপায় আছে কি না! গুড ডে!”
সাত্যকি খুব সাবধানে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে এল। এম-ডি ভাবতে বলেছেন! আরে ভেবে কী হবে? একটা অসম্ভব প্রবলেম কি ভেবে সলিউশন করা যাবে? নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। ইন্ডাস্ট্রির যা অবস্থা, কোনো ট্রেনিং বা পড়ানোর কাজ পাওয়াই বোধহয় সহজ হবে। পর্ণার সঙ্গে আজ দু-বছর ডিভোর্স হয়ে গেছে। পর্ণা একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে স্ট্যাটিস্টিকস পড়ায়। সে সময় ও সাত্যকিকে বার বার পড়ানোর কাজ নিতে বলত। আসলে ডিভোর্সটা খুব একটা তিক্ততার মধ্যে দিয়ে হয়নি বলে, এখনো পর্ণার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায়ে আছে। পর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলে হয়, একটা ডেটা সাইন্স পড়ানোর কাজ কোথাও পাওয়া যাবে কি না।
এখন পর্ণা নিশ্চয়ই ইউনিভার্সিটিতেই আছে। ফোন করে দেখা যেতে পারে। ক্লাস না থাকলে ধরবে নিশ্চয়ই। প্রথমবার ফোন বেজে গেল। একটু পরে পর্ণার নাম্বার থেকে ফোন এল, বেশ খুশি খুশি গলা, “তোমার কি খবর? অনেকদিন তো ফোন কর না।”
দু একটা সাধারণ কথা বলার পর সাত্যকি চাকরির কথাটা পাড়ল। পর্ণা হঠাৎ খুব সিরিয়াস হয়ে গেল। বলল, “তুমি পড়াতে চাও? কেন? তোমার চাকরিটা ছেড়েই বা দেবে কেন? সব খুলে বল দেখি। আমার এখন ক্লাস নেই।”
একটু একটু করে সবটাই বলে ফেলে সাত্যকি। পর্ণা কম্পিউটেশনের ব্যাপারটা ভালোই বোঝে। তাই সে ও সমস্যাটা বুঝতে পারে। কিন্তু পর্ণা খুব পজেটিভ স্বভাবের মেয়ে। বলল, “তুমি পড়াতে আসতে চাও, ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে প্রথমেই হার স্বীকার করে নিও না। চেষ্টা করে দেখ না! প্যাটার্ন রিকগনিশন ব্যাপারটা কিন্তু এখনো রহস্যময়। যতটা সম্ভব পড়াশোনা করে দেখ। আমিও দেখছি। সাত দিন সময় আছে তো, এই সময়টা একেবারে টুথ অ্যান্ড ক্ল লড়ে যাও।”
সাত্যকির মনে পড়ল পর্ণার একটা প্রিয় কথা, “হারবো বললেই হারেগা? খামচে খুমচে মারেগা!”
মেয়েটা বেশ মজার ছিল, ইনফ্যাক্ট এখনো আছে। ওর সঙ্গে কি থাকা যেত না? কে জানে! হয়তো সাত্যকির আরো খানিকটা চেষ্টা করা উচিত ছিল। যাকগে! পর্ণা ঠিকই বলেছে। পড়াশোনায় মন দেয়া উচিত।
পর্ণাকে ফোন করার পর তিন দিন কেটে গেছে। এই তিন দিন সাত্যকি যতটা সম্ভব পড়াশোনা করে দেখেছে। কিন্তু তার মনের ধাঁধা বেড়েছে বই কমেনি। প্যাটার্ন রিকগনিশন শাস্ত্রটার একটা বড়ো অংশ হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ-আই। এখন তিন ধরনের এ-আই মডেল এখানে কাজে লাগতে পারে। প্রথমত হল নিউরাল নেটওয়ার্ক, দ্বিতীয়ত হল সেলুলার অটোমাটা, আর তৃতীয় হল জেনেটিক অ্যালগরিদম। এখানে যে ধরনের প্যাটার্ন চিনতে হবে তার জন্য নিউরাল নেটওয়ার্ক সবচেয়ে উপযুক্ত।
মানুষ বা প্রাণীদের মস্তিষ্ক আর কম্পিউটার, এদের চলন সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু একটাই মিল, সেটা হল মস্তিষ্ক আর কম্পিউটার দুইই চলে ইলেকট্রিক সিগনাল দিয়ে। কিন্তু কম্পিউটার হল ডিজিটাল সিস্টেম, আর মস্তিষ্ক অ্যানালগ সিস্টেম। কম্পিউটারকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে হলে তাকে আগে বলে দিতে হবে কীভাবে কী করতে হবে, যাকে বলে অ্যালগরিদম। ওদিকে যে কোনো প্রাণীর মস্তিষ্ক চলে পুরোনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। মানে আগে কী করেছিলাম? ঠিক করেছিলাম, না ভুল করেছিলাম? যদি ঠিক করে থাকি সেটার আবার করো, যদি ভুল করে থাকি অন্য কিছু করো।
নিউরাল নেটওয়ার্ক হল এমন এক ধরনের অ্যালগরিদম, যেখানে ডিজিটাল কম্পিটারকে কতকগুলো অ্যানালগ সার্কিটের মতন ব্যবহার করা হয়। তারপর সেই সার্কিটকে মস্তিষ্কের স্নায়ু যেভাবে জট পাকানো আছে, সেইভাবে জুড়তে হয়। এবারে ইনপুটে কিছু প্যাটার্ন দিলে আউটপুটে, ইয়েস বা নো এই জাতীয় সিগনাল পাওয়া যায়। যদি আউটপুট ভুল হয় তবে জট যেভাবে পাকানো হয়েছে তার চরিত্র বদলাতে হয়। এইভাবে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে, অগ্রসর হতে হয়।
এসব শুনতে খুবই ইন্টারেস্টিং, কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে সেই পুরোনো কথাটাই ফিরে আসছে। ইলেকশন কমিশনের কাজটার মতো, এত বড়ো একটা কাজ করার মতো নেটওয়ার্ক তৈরি করতে যে বিরাট মেশিন লাগবে তা এখনো তৈরি হয়নি। এদিকে ওদিকে অন্য কায়দাগুলো পড়তে গিয়ে সাত্যকির নিজের নিউরাল নেটওয়ার্কেই জট পাকিয়ে যাবার জোগাড়।
এমন সময় পর্ণা ফোন করল। খুব সিরিয়াস গলা। বলল, “তোমার কাছে একটা মেয়েকে পাঠাচ্ছি। মেয়েটা ফিজিওলজি নিয়ে রিসার্চ করে। একটু কথা বলে দেখ। পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।”
সাত্যকি রসিকতার চেষ্টা করে, “অমূল্য প্রেমধন পায়ো?”
পর্ণা বলল, “আগে নিজের চাকরি বাঁচায়ো, তারপর দেখা যাবে। অলি কখন যাবে? তোমার নম্বর ওকে দিয়ে দিয়েছি।”
“ফুল রেডি, মৌমাছি যখন খুশি আসতে পারে।”
“ওঃ খুব রস হয়েছে তো?”
“হ্যাঁ, আচ্ছা, এই চাকরিটা ছেড়ে দিলে তুমি ফিরে আসবে?”
পর্ণা হাসি হাসি ভাবেই বলল, “না।” তারপর ফোন রেখে দিল।
ঘণ্টা খানেক পরে সাত্যকির ফোন বেজে উঠল। “হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে ভীষণ মিষ্টি গলায় কেউ বলল, “আমি অলি লাহিড়ী, সপ্তর্ষি অ্যাপার্টমেন্টের গেটে আছি। সিকিউরিটিকে একটু বলে দেবেন প্লিজ?”
সাত্যকি সিকিউরিটিকে জানায় মেয়েটিকে তার ফ্ল্যাট দেখিয়ে দিতে।
মিনিট পাঁচেক পরে সাত্যকির ফ্ল্যাটের বেল বেজে ওঠে। দুয়ারে অলি লাহিড়ী।
অলির গলা আর চেহারার মধ্যে একটা বিরাট কনট্রাস্ট আছে। অলিকে দেখতে যে খারাপ তা নয়। কিন্তু চেহারাটার মধ্যে কীরকম একটা শুকনো বুড়িয়ে যাওয়া ভাব রয়েছে। অথচ অলির বয়স তিরিশের নীচেই হবে।
কিছু এদিক সেদিক কথার পর অলি পয়েন্টে এল। হ্যাঁ পর্ণার কাছ থেকে সে শুনেছে যে সাত্যকির একটা বিরাট বড়ো নিউরাল নেটওয়ার্ক দরকার। এখন অলি ক্রায়ো-প্রিসার্ভেশন অফ হিউম্যান অর্গান নিয়ে কাজ করে। তার কাছে একটি হিউম্যান ব্রেন আছে। সেটিকে কি কাজে লাগানো সম্ভব?
সাত্যকি আঁতকে উঠে বলল, “হিউম্যান ব্রেন?”
“হ্যাঁ, এতে আশ্চর্য হবার কি আছে?”
“না আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু মৃত মানুষের ব্রেন দিয়ে তো আর ইলেকট্রিক পালস চলাবে না।”
অলি গম্ভীর ভাবে বলল, “এ ক্ষেত্রে চলবে।”
“কীভাবে?”
“কারণ মস্তিষ্কটি এখনো জীবিত।”
সাত্যকি ঘটনার অভিঘাতে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তার মানে মস্তিষ্কটি এখন কারো দেহের মধ্যেই আছে?”
“হ্যাঁ।”
“আর সে লোক জীবিত?”
“হ্যাঁ, তবে ডিপ কোমায় আছে। ফেরার সম্ভাবনা শূন্য।”
“তাহলে তার ব্রেন কীভাবে, মানে, আপনি কি মজা করছেন?”
“না একেবারেই মজা করছি না। আমি মাথায় ন্যানো সার্জারি করে লোকটির চোখ এবং কানের ইনপুট স্নায়ুগুলোর সঙ্গে, আর মাসলের আউটপুট স্নায়ুগুলোর সঙ্গে কার্বন ন্যানো টিউব কানেক্ট করেছি। এখন আমি বিভিন্ন ইনপুট দিয়ে ইলেকট্রিকাল পালস পাঠিয়ে আউটপুট ইলেকট্রিক পালস পাচ্ছি। শুনলে অবাক হবেন এই সিস্টেম দিয়ে দিব্যি ছোটোবেলার ছবি আর বড়োবেলার ছবি চেনা সম্ভব।”
সাত্যকি বলল, “মানে আপনার সিস্টেম প্যাটার্ন রিকগনাইজ করছে? মানে একই লোকের ছোটোবেলার ছবি আর বেশি বয়সের ছবি যে এক সেটা ধরতে পারছে?”
“খুব সহজেই, কারণ ব্রেন তো সে কাজ করে অভ্যস্ত।”
“ম্যাডাম আপনার ধারণা আছে, আপনি কি ভয়ংকর একটা অপরাধ করছেন?”
অলির ভ্রু কুঁচকে গেল। বলল, “কেন, এটা অপরাধ কীসে?”
“একটা জ্যান্ত মানুষের ব্রেন নিয়ে আপনি… ও গড!”
অলি বলল, “আইনগত কিছু সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে আমি পারফেক্টলি অল রাইট। লোকটিকে আমি মারিনি। তার কোমায় যাবার ব্যাপারেও আমার কোনো হাত নেই। আমি শুধু তার দেহটা বিজ্ঞানের কাজে ব্যবহার করছি মাত্র।”
“সেটার জন্য কি তার পারমিশন নেয়া হয়েছে?”
“কোমায় যাওয়া মানুষ কি করে পারমিশন দেবে?”
সাত্যকি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। অলি বলল, “একটা বিশেষ কারণে আমি আইনের নজরের বাইরে, এই লোকটিকে নিয়ে কোনো ইস্যু হবে না। এখন আপনি যদি চান তাহলে আমি আমার হিউম্যান নেটওয়ার্কটি ব্যবহার করতে দিতে পারি। অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। আমার রিসার্চ চালাবার জন্য অনেক টাকা দরকার। অত টাকা আমার ইন্সটিটিউট দিতে পারছে না। আপনার কাজটা করে দিতে পারলে, আপনারও লাভ আমারও লাভ।”
“আপনি এই লোকটিকে কোথা থেকে পেলেন?”
“তা দিয়ে কি আপনার কোনো দরকার আছে? শুনুন, অতিরিক্ত জ্ঞান হচ্ছে সব ঝামেলার মূল। আপনার দরকার কাজ, আমার দরকার টাকা। রাজি থাকলে বলুন, না থাকলে গুড বাই।”
সাত্যকি কয়েক সেকেন্ড ভাবল, বলল, “আমাকে দুটো দিন ভাববার সময় দেবেন?”
“হ্যাঁ, কেন নয়? কিন্তু থানা পুলিশ বা মিডিয়ায় কোনো রকম বোকামি করার চেষ্টা করলে কিন্তু আপনিই বিপদে পড়বেন।”
“না না, সে সব কিছু নয়। আমি এখনো বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝখানে আছি।”
“বেশ তো, মনস্থির করে আমাকে জানান। আমি আপনাকে আমার ল্যাবে নিয়ে গিয়ে সমস্ত সিস্টেম ফাংশনিং দেখিয়ে আনব। আমার কার্ড রেখে গেলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার কল না পেলে গোটা ব্যাপারটাই ভুলে যাব। আর হ্যাঁ যত কম লোক ব্যাপারটা জানবে ততই ভালো কেমন? তাহলে আজ আসি, বাই।”
অলি চলে যাবার পরে সাত্যকি নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল, সে জেগে আছে কি না। এ রকম একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ডর সঙ্গে নিজেকে জড়ান একদমই ঠিক হবে না। এ তো যাকে বলে সিনেমার ভাষায় জিন্দা লাস!!
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাত্যকি ভাবতে শুরু করল আচ্ছা এতে অন্যায়টাই বা কোথায়? আর যদি কোনো আইনি সমস্যা হয়, মেয়েটার হবে। কিন্তু যদি এই প্রজেক্টটা সাকসেসফুল হয়, তাহলে সাত্যকি কোথা থেকে কোথায় উঠে যাবে, সেটাও তো ভাবতে হবে? এই বাজারে চাকরি যাওয়া, আর ভারতের তিন নম্বর কোম্পানির সিনিয়ার অ্যানালিস্ট হওয়ার মধ্য আকাশ পাতাল তফাত।
নানা ভাবে নিজেকে প্রবোধ দিলেও শেষ পর্যন্ত একটা জীবন্ত মানুষের মাথা দিয়ে কম্পিউটেশন হচ্ছে, ভাবলেই সাত্যকির প্রবল অস্বস্তি লাগছে।
অবশেষে দু-দিন পরে সমস্ত অস্বস্তি দমন করে সাত্যকি, অলি লাহিড়ীকে ফোন লাগাল।
অলি যেন জানতই সাত্যকি রাজি হয়ে যাবে। বলল, “হ্যাঁ, আমার ল্যাব দেখতে কবে আসছেন?”
“সে যে কোনো দিন গেলেই হবে। আচ্ছা বলুন তো আপনার সিস্টেম কতগুলো ইনপুট নিতে পারে?”
“এই মুহূর্তে পাঁচশো বারো। তবে বললে এক হাজার চব্বিশ করে দিতেই পারি। যদি তার বেশি চান তাহলে মাসখানেক সময় লাগবে।”
“আউটপুট ক-টা?”
“আপনার ক-টা চাই?”
“আপতত একটাই, তবে দু-চারটে এক্সট্রা রেখে দিতে পারলে ভালো হত।”
“নো প্রবলেম, যখন বলবেন তখনই পাবেন।”
“ঠিক আছে, আমি কবে আপনার ল্যাব দেখতে গেল আপনার সুবিধা হবে?”
“আজই আসুন না, আমি লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
ঘণ্টা চারেক পরে সাত্যকি অলির ল্যাবের বাইরে বসে কফি খাচ্ছে। এখনো ধাক্কাটা সে ভালো করে সামলাতে পারেনি।
ল্যাবের একটা কোণে একটা পার্টিশন মতো করা ছিল। সেখানেই একটা হসপিটালের খাটে একটি মানুষের দেহ শোয়ানো আছে। সারা শরীরে গ্লুকোজ, স্যালাইন, আরো নানারকম নল লাগান। অলি বলল লোকটির রেসপিরেশন এবং সার্কুলেশন দুইই আর্টিফিশিয়ালি চলছে। মানে হার্ট এবং ফুসফুস দুটোই বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে দেখলে লোকটি অতি গভীর কোমায় আছে, এবং সেই কোমা থেকে ফেরার সম্ভাবনা শূন্য।
লোকটির সমস্ত শরীরের উপর একটি প্লাস্টিকের স্বচ্ছ ঢাকনা দেয়া আছে। এটা নাকি ইনফেকশন যাতে না হয় তার ব্যবস্থা। লোকটির মাথার উপরে একটি আধা হেলমেট পরানো আছে। ফলে লোকটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। ওই হেলমেট থেকেই বেরিয়ে এসেছে অনেক তারের একটি গুচ্ছ, যেটা পাশের একটা প্লাস্টিকের বাক্সে ঢুকেছে। আর সেই বাক্সের সঙ্গে কম্পিউটারের ইউ-এস-বি পোর্ট লাগান আছে।
অলি বলল, “এই মেশিনটায় আমরা কাজ করি না। বাইরের মেশিনের সঙ্গে এটার নেটওয়ার্ক করে নিই। এখানে আপনার অসুবিধা হবে। চলুন বাইরে যাই।”
সাত্যকির পরের আধ ঘণ্টা যেন ভেল্কি দেখে কাটল। ও নিজের একটা ছোটোবেলার ছবি আর রিসেন্ট পাসপোর্ট সাইজ ছবি এনেছিল। সেই সঙ্গে এক বন্ধুর ছবি ক্রপ করে পাসপোর্ট সাইজে প্রিন্ট করে নিয়ে এসেছিল। কম্পিউটারে ছবি তিনটে স্ক্যান করে দিয়ে প্রোগ্রাম চালু করতেই মেশিন বলে দিল, এই দুটো ছবি এক, আর এটা আলাদা। সফটওয়ার মুখ চিনতে পারে ঠিকই, কিন্তু ছোটোবেলার ছবি থেকে মোটেও পারে না। এরপর ছোটোখাটো নানা প্যাটার্ন রিকগনিশনের সমস্যা মেশিন, অনায়াসে সলভ করে দিল। সাত্যকি এমন কাণ্ড খুব কমই দেখেছে।
সাত্যকির কফি শেষ হয়ে এসেছিল। অলি বলল, “তাহলে ডিলটা কি হচ্ছে?”
“দাঁড়ান, আগে এম-ডির সঙ্গে কথা বলি। তবে মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে চুক্তিটা দুই ধাপে হবে। প্রথম ধাপে আমরা বেশ কিছু ট্রেনিং প্যাটার্ন দিয়ে দেখব সলিউশন আসছে কিনা। এলে আপনাকে চুক্তির এক অংশ পেমেন্ট করা হবে। বাকিটা কাজ সফল হলে তারপর।”
অলি হাসল, বলল, “প্রথম টাকার পরিমাণটার উপর নির্ভর করছে আমি কাজটা করব কি না?”
“সে তো আপনার ইচ্ছা।”
এরপর প্রায় ছ-মাস কেটে গেছে। ডেটা-সলভ আর নির্বাচন কমিশনের চুক্তি পাকা হয়েছে। অলি লাহিড়ী তার প্রথম কিস্তির টাকা পেয়ে গেছে। একটা লোকসভা নির্বাচনও সদ্য হয়ে গেল যার সমস্ত তথ্য এখন ডেটা সলভের সার্ভারে। সেই তথ্য ক্রমে ক্রমে ফ্যানটম মেশিনে লোড করে তাকে ট্রেনিং দেয়া চলছে। হ্যাঁ এই আজব মস্তিষ্ক মেশিনের নাম দেয়া হয়েছে ফ্যানটম। যদিও কাউকেই ফ্যানটম মেশিনের আসল রহস্য জানানো হয়নি।
সাত্যকি অলির কাছ থেকে ইতিমধ্যে জানতে পেরে গেছে, যে এই লোকটি একটি বেওয়ারিশ মানুষ। এক রাতে একে রহস্যজনকভাবে কেউ হাসপাতালের গেটে ফেলে যায়। শরীরে গভীর ছুরির ক্ষত। হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে লোকটির মর মর অবস্থা, পুরো লাইফ সাপোর্টে রাখতে হচ্ছে। পুলিশ একটা নাম কা ওয়াস্তা রিপোর্ট নিয়ে যায়। লোকটি আস্তে আস্তে গভীর কোমায় চলে যায়। এদিকে হাসপাতালে বেডের প্রচণ্ড অভাব। বাধ্য হয়ে ডাক্তারবাবুরা যখন লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার কথা ভাবছেন, তখন অলি খবর পায়।
অরগ্যান প্রিসার্ভেশনের কাজের জন্য অলি প্রায়ই এই হাসপাতালে আসত, ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল। অলি লোকটাকে নিজের কাছে রাখতে চাইল, উইদ ফুল লাইফ সাপোর্ট। ডাক্তাররা খুশি হয়েই পারমিশন দিয়ে দেন। লোকটি মারা গেলে তাকে হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেটও দেয়া হবে জানান হয়েছে। লোকাল থানাকেও ব্যাপারটা আনফিসিয়ালি জানান হয়েছে, তারাও আপত্তি করেনি। তবে হাসপাতাল বা থানা, কেউই জানে না অলি লোকটির মাথা নিয়ে একটা বিচিত্র এক্সপেরিমেন্ট করছে।
এই ছ-মাসে অলি আর সাত্যকির মধ্যে একটা বিচিত্র বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অলির সোজা সাপটা কথা, এবং বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ সাত্যকির খুবই ভালো লাগে। কিন্তু এই বন্ধুত্বটাকে প্রেমের দিকে নিয়ে যেতে সাত্যকির কোথাও যেন আটকাচ্ছে। তা ছাড়া অলির একজন রহস্যময় বয়ফ্রেন্ড রয়েছে। এই খবরটা সাত্যকি আচমকাই জেনে ফেলেছে।
একদিন অলির ফ্ল্যাটে বসে সাত্যকি কথা বলছিল। কথায় কথায় মানুষের মাথার গড়ন নিয়ে কথা উঠল। অলি বলছিল, “আমাদের নার্ভ সেলের মেইন দুটো ভাগ। অ্যাক্সন আর ডেনড্রন। নার্ভ সেলের গা থেকে অনেকগুলো ফ্যাকড়া বার হয়। এইগুলোকে বলে ডেনড্রন। আর একটা লম্বা ল্যাজের মাথায় আরো কয়েকটা ফ্যাকড়া বার হয়। এই পুরো জিনিসটাকে বলে অ্যাক্সন। অ্যাক্সনের ফ্যাকড়াগুলো আলাদা আলাদা ডেনড্রনের ফ্যাকড়ার সঙ্গে জুড়ে থাকে। এবারে যেগুলো ইনপুট সেল, তার ডেনড্রনগুলো আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের রিসেপটারগুলোর সঙ্গে জোড়া থাকে। আর যেগুলো আউটপুট সেল, তার অ্যাক্সনগুলো মাসলের সঙ্গে জোড়া থাকে। নার্ভ সেলগুলো ডেনড্রন দিয়ে ইলেকট্রিক সিগনাল রিসিভ করে, আর অ্যাক্সন সেগুলোকে পরিবহন করে নিয়ে যায় আউটপুটে। এরই মধ্যে নার্ভসেল সিগনালটাকে বাড়িয়ে দেয় বা কমিয়ে দেয়। ফলে অ্যাক্সনের আউটপুট যেন ডেনড্রনের ইনপুট সিগনালগুলোর, ওয়েটেড অ্যাভারেজ।
“মানে বলতে চাইছ, ইনপুট ভোল্টেজগুলোকে, আলাদা আলাদা সংখ্যা দিয়ে গুন করে, তার গড় করে, তবে আউটপুট অ্যাক্সনে পাঠান হয়?”
“ঠিক তাই, আর এই সংখ্যাগুলোর উপরে নির্ভর করে, কোন ইনপুটকে কতটা পাত্তা দেয়া হচ্ছে।”
“বুঝলাম, কিন্তু এ কাজটা তো কম্পিউটারও করতে পারে?”
“একটা সেলের কাজ নিশ্চয়ই পারে, কিন্তু, ওই সব সেলগুলো আবার অন্য সেলে সিগনাল পাঠায়, সেই সব সেল থেকে আরো অন্য সেল। পুরো বিষয়টার জটিলতার একটা আন্দাজ পাবে যদি, আমি বলি মানুষের মাথায় মোটামুটি একশো কোটি সেল রয়েছে।”
“বাপরে!”
“হ্যাঁ, মানুষের মাথার জটিলতা সে কতটা, সে বিষয়ে আমরা খুব কমই জানি।”
“আচ্ছা, মানুষের স্মৃতি কোথায় থাকে?”
“এই সব জটিলতার মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে থাকে, কিন্তু আমরা ঠিকঠাক জানি না।”
“তারপরে ধরো ভালো, ভালো জিনিসগুলো, যেমন আদর্শ, মায়া, মমতা!”
“তুমি গাছে না উঠেই ফলের খোঁজ করছ। সামান্য স্মৃতি কোথায় থাকে তাই জানি না, তো আদর্শ, মায়া, মমতা! হুঁঃ।”
ঠিক এই সময়ে অলির ফ্ল্যাটের বেল বেজে উঠল। অলি একটু ভুরু কুঁচকে বলল, “এমন সময়ে কে এল?”
কিন্তু দরজা খুলতেই অলির গলার স্বর পালটে গেল। ত্রস্ত গলায় বলল, “তুমি? কোথা থেকে?” ওপাশ থেকে কি উত্তর পাওয়া গেল জানা নেই। অলি ফিরে এসে সাত্যকিকে বলল, “সরি, আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু তুমি এখন এস।”
সাত্যকি উঠতে উঠতে প্রশ্ন করল, “কে এল?”
অলি ব্যস্ত ভাবে বলল, “পরে বলব।” সে তখন যেন সাত্যকিকে বের করে দিতে পারলে বাঁচে।
সাত্যকি বেরিয়ে যেতে যেতে লক্ষ করল, লোকটি তাল ঢ্যাঙা এবং তার টিয়াপাখির মতো বাঁকা নাকটা এতই বড়ো, যেন মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। লোকটি কিন্তু নিজের মুখ আড়াল করার চেষ্টাই করছিল।
বাড়ি ফিরে এসে সাত্যকির একটু খারাপই লাগছিল। এরকম ক্ষেত্রে অলির কি উচিত ছিল না, আগন্তুকের সঙ্গে সাত্যকির আলাপ করিয়ে দেয়া? অবশ্য, অলি যে একটু অদ্ভুত প্রকৃতির মেয়ে, সে তো আর সাত্যকির অজানা নয়, কাজেই এই খারাপ লাগাটা বেশিক্ষণ রইল না।
ইতিমধ্যে একটা লোকসভা নির্বাচনের পুরো তথ্য দিয়ে ফ্যানটমের নেটওয়ার্ককে ট্রেইন করা শেষ হয়ে গেছে। কাজেই সাত্যকি আর নিয়মিত অলির ল্যাবে যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে খবর এল দুটো বিধানসভা কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন হবে। এই দুটো বিধানসভার বুথগুলোয় পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে, নেটওয়ার্ক কীরকম রিগিং ধরতে পারে, তার একটা টেস্টিং করার কথা ভাবা হচ্ছে। সেই সূত্রে অলিকে ফোনে যোগাযোগ করল সাত্যকি।
বিভিন্ন কাজের কথা হবার পরে সাত্যকি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে, “সেদিনের সেই ভদ্রলোক কে বল তো?”
অলি বলে, “আমার শনি,” তারপরেই হেসে বলে, “মানে আমার বয়ফ্রেন্ড।”
“বয়ফ্রেন্ড, তা আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না তো? আমাকে তাড়াতাড়ি সরে পড়তে দেখে কী না কী ভাবলেন ভদ্রলোক।”
অলি শুকনো গলায় বলল, “ও কি ভাবল তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। আর এর কথা যত কম লোক জানে ততই ভালো।”
“আহা, যখন বিয়ে করবে তখন তো সবাই জানতে পারবে, তা…”
অলি বলল, “আমি আবারও বলছি, লিভ হিম অ্যালোন।”
সাত্যকি একটু ক্ষুণ্ণ হয়েই ফোন রেখে দিল।
উপনির্বাচনে ফ্যানটম অসাধারণ কাজ দেখাল। পর্যবেক্ষক যে যে বুথে গোলমাল আছে বলেছিল, সেই সব ক-টা বুথ ফ্যানটম রিগিং হয়েছে বলে রিপোর্ট দিল। শুধু তাই নয়, দুটো বুথে ফ্যানটম বলেছিল রিগিং হয়েছে, কিন্তু সে কথা পর্যবেক্ষক বলেনি। ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, পর্যবেক্ষকের নজরের আড়ালেই রিগিং হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন, খুশি হয়ে ডেটা-সলভকে চুক্তির টাকার একটা বড়ো অংশ মিটিয়ে দিল। সাত্যকির একটা বিরাট প্রমোশন হল। অলিও টাকার দ্বিতীয় কিস্তি পেয়ে গেল। দু-জনেই যাকে বলে ড্যাম গ্ল্যাড!
এর মধ্যে একদিন খবর এল, একটি রাজ্যে বিরাট রাজনৈতিক গোলযোগ হয়ে সরকার পড়ে গেছে। বিধানসভা ভেঙে নতুন নির্বাচন হবে। ভোটে দুর্নীতি নিয়ে এই বিশেষ রাজ্যটির যথেষ্ট দুর্নাম। নির্বাচন কমিশন ডেটা-সলভকে জানাল, এই প্রথমবার, তাদের যন্ত্র, পুরোপুরি নির্বাচনের রিগিং ধরার কাজে ব্যবহার করা হবে।
নির্বাচনের বাকি দু-মাস। ট্রেনিং পেয়ে নেটওয়ার্ক পুরো রেডি। কাজেই অলি বা সাত্যকি দু-জনেই বেশ খোসমেজাজে আছে। এমন সময় একদিন রাত তিনটেয় অলির ফোন।
“সর্বনাশ হয়ে গেছে সাত্যকি!”
“কী হয়েছে?”
“ফ্যানটম মারা গেছে, ব্রেন ডেথ! আর লাইফ সাপোর্ট দিয়েও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়!”
“না, না এটা অসম্ভব! তাহলে দু-মাস পরে যে এতবড়ো কাণ্ডটা…”
ফোনের ওপারে অলির শীতল গলা শোনা গেল, “অস্বীকার করে তো লাভ নেই, আমরা একটা বিরাট ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেলাম।”
“ঝামেলা মানে? আসল কাজের সময়ই যদি ডেটা-সলভ পিছিয়ে আসে, তাহলে কত বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে জানো?”
“বাজে কথা বলে লাভ কি সাত্যকি? ইউ হ্যাভ টু অ্যাক্সেপ্ট, ফ্যানটম ইস নো মোর। নাও এখন ফোন ছাড়ো। তোমার হাহাকার শুনে আমার কোনো লাভ নেই। তবে এই মুহূর্তে তোমার অফিসকে কিছু জানিও না। আমি একটা ডেসপারেট অ্যাটেমট করব। তারপর যা হয় হবে।”
ফোন ছেড়ে সাত্যকি কিছুক্ষণ ভোঁ হয়ে বসে রইল। একটা ছোটো ব্ল্যাক আউটও হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। একটু পরে নিজেকে বিছানার উপরে শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করল সে। প্রথমে ভাবল দুঃস্বপ্ন, কিন্তু ফোন চেক করে যখন দেখল অলি মিনিট পাঁচেক আগেই কল করেছে, তখন বুঝল ব্যাপারটা রূঢ় বাস্তব।
সারাদিন বাড়িতেই রইল সাত্যকি। বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ি বা একগাদা ঘুমের ওষুধ খাই। কিন্তু কিছুই না করে সে জুবুথুবু হয়ে বসে রইল। রাত বারোটা নাগাদ অলি ফোন করল।
“কী খবর? খুব দুশ্চিন্তা করছিলে?”
“তো আর কি করব?”
“চিন্তার কারণ নেই, ব্যবস্থা করে ফেলেছি।”
“ব্যবস্থা? কী ব্যবস্থা?”
“সব বলব, কিন্তু তার আগে তুমি দিন সাতেক নিজের ফোন সুইচ অফ করে, কলকাতার বাইরে কোনো জায়গা থেকে ঘুরে এসো তো। আর এই সময়টা আমাকে ফোন করবে না। অবশ্য করলেও ফোন সুইচ অফ পাবে।”
“অলি আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
“ভরসা রাখো, সাত দিন পরে যোগাযোগ করো।”
সাত্যকির মাথায় একটা সন্দেহ বিজবিজ করে ওঠে। বলে, “অলি, তুমি কি কেটে পড়বার তাল করেছ নাকি?”
“কেটে পরতে চাইলে তোমাকে এত কথা না বলে, কালকেই কেটে পড়তাম।”
“তাহলে এই সাত দিনে কী হবে? আমাকে চলে যেতে বলছ কেন?”
“ওফ! এত কথার জবাব দেবার সময় নেই। কাজটা হওয়াতে হবে তো? না কি?”
সাত্যকি বুঝতে পারে অলি বিরক্ত হচ্ছে। এখন আর কোনো কথার জবাব পাওয়া যাবে না। সে দার্জিলিং এর টিকিটের সন্ধানে ল্যাপটপ খোলে।
এত দুশ্চিন্তা নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ দার্জিলিং ঘুরেছে মনে হয় না। কথামত ঠিক সাত দিনের মাথায় সাত্যকি কলকাতা ফিরে সোজা অলির ল্যাবে দেখা করতে যায়। দেখে অলি হাসিমুখেই তাকে অভ্যর্থনা করল। বলল, “ভালো সময়ে এসেছ। এবারে আমার কাজ শেষ, তোমার কাজ শুরু।”
“মানে?”
“মানে ফ্যানটম টু হাজির। আর এই সাত দিন আমি তার মাথার নার্ভগুলোয় ন্যানো-টিউবের কানেকশান বানালাম। এবারে একে পুরোনো ডেটা সেট দিয়ে নতুন করে ট্রেনিং দিতে হবে। সময় খুবই কম। উঠে পড়ে লাগো।”
“ফ্যানটম টু মানে? আবার একটা কোমার কেস?”
“বলতে পারো।”
“পেলে কোথা থেকে?”
“ভগবান জুটিয়ে দিলেন।”
অলির মুখে এই প্রথম ভগবানের নাম শুনে সাত্যকি যত না ঘাবড়ালো, তার থেকেও বেশি ঘাবড়াল আরেকটা কোমার কেস শুনে। কিন্তু এখন যাইই ঘটুক না কেন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। মাস দেড়েকের বিনিদ্র দিন-রাত্রির জন্য তৈরি হতে হবে। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনের সেই বিপুল ডাটা দিয়ে আবার ফ্যানটম টু কে ট্রেইন করাতে মাস দুয়েকের বেশিই লাগা উচিত।
দীর্ঘ অক্লান্ত সময়ের পর একদিন অলি আর সাত্যকি ল্যাবে বসে আছে। আজ সকাল থেকে সেই বিশেষ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ইভিএমের ডেটা সন্ধ্যা নাগাদ ওদের সার্ভারে এসে যাবে। বহু দিন পর কাল সন্ধ্যা থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ওরা দু-জন ঘুমোতে পেরেছে।
অলি বলল, “যাক! অল ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল। তাই না?”
সাত্যকি বলল, “এখনো এন্ড হয়নি। আসলে কিছুটা ডেটা বাদ পড়ে গেল। সমস্ত অ্যাভেইলেবল ডেটা দিয়ে ট্রেনিং করা সম্ভব হল না, সময় এত কম ছিল। অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।”
“তুমি একটা বাজে নিরাশাবাদী। ফ্যানটম ওয়ান মারা যাবার পরে, তোমার সেই হাহাকার আমি জীবনে ভুলব না।”
“আরে! এতেও যদি হাহাকার না করি তো হাহাকার শব্দটা ডিক্সানারিতে আছেই বা কেন? কিন্তু তুমি যে একদিনের মধ্যে ফ্যানটম টু জোগাড় করে ফেলবে, তা কি করে বুঝব?”
অলি মুচকি হেসে বলল, “হিন্দিতে একটা কথা আছে না? ‘মেরে সাথ রহোগে তো আয়েশ করোগে’, এ হোল সেই ব্যাপার। আমি সব সময় রেডি থাকি।”
সাত্যকির একটা রসিকতা করতে ইচ্ছা হল। বলল, “আমার তো তোমার সঙ্গে তো থাকার খুবই ইচ্ছে। কিন্তু বাদ সাধছে তোমার লম্বা নাক তালঢ্যাঙা বয়ফ্রেন্ড।”
অলির মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলে গেল, বলল, “ওর দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকতে পার। ও আর কোনো রকম বাদ সাধতে পারবে না।”
“কেন?”
“কারণ ও ই হল, ফ্যানটম টু।”
ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলেও সাত্যকি এতটা চমকে উঠত না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, “এরকম মজা কোরো না।”
অলির মুখে এখনো সেই হাসিটা মাখান, “আমি মজা করছি না। নিজের ঘরে ছিল, না হলে এত চটপট ফ্যানটম টু কোথায় পেতাম?”
“নিজের ভালোবাসার লোককে…” সাত্যকি আর বল উঠতে পারে না।
অলির মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে, “কোনো এক সুদূর অতীতে আমি ওর ভালোবাসায় পাগল ছিলাম ঠিকই। কিন্তু শেষ কয়েকটা বছর ও ছিল আমার জীবনের শনি। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। কিন্তু অই যা হয়, পড়ল রাজনৈতিক নেতাদের খপ্পরে। এ পার্টি ও পার্টি করে শেষে মাওবাদী হয়ে দাঁড়াল। আমি হয়ে গেলাম ওর শেলটার আর টাকা জোগানোর মেশিন। শেষের দিকে কোথায় কাদের খুন করে এসে আমার ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিল। যেদিন এলো, সেদিনই তুমি ওকে দেখেছ। আমার জীবনটা ওর জন্যই ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছিল। যখন ফ্যানটম ওয়ান মারা গেল, আমি দেখলাম এরকম সুযোগ আর পাব না। ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ল্যাবে নিয়ে গেলাম। সেখানে, ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করলাম। তারপর আর কি, যত যন্ত্রণা আমায় দিয়েছে, সব কিছুর শোধ হয়ে গেল।”
অলি এত নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলছিল যে সাত্যকির মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা শিরশিরে কিছুর স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। কি সাংঘাতিক মেয়ে! এর সঙ্গে সাত্যকি রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবছিল?
সাত্যকি পণ করল, এবারের ইলেকশন পার হয়ে গেলেই এম-ডির সঙ্গে অলির আলাপ করিয়ে দিয়ে, সে ডেটা-সলভের চাকরি ছাড়বে। আর কোনোভাবেই এই মেয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখা নয়। বরং পর্ণাকে হাতে পায়ে ধরে যদি ফিরিয়ে আনা যায়, সেটার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কিছু না হলে সে পুনে বা ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবে, তবু অলি লাহিড়ীর ত্রিসীমানায় নয়।
শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে নিজের ফ্যাটে ফিরে এল সাত্যকি। কাউন্টিং হবার আগেই সমস্ত ডেটা ফ্যানটমের সার্ভারে এসে যাবে। পর দিন সকালের মধ্যে ফ্যানটম জানিয়ে দেবে, কোন কোন বুথে রিগিং হয়েছে। সেখানে নির্বাচন কমিশন আবার নির্বাচন ঘোষণা করবে। এর জন্য ল্যাবে যাবার দরকার নেই। বাড়ি থেকেই সাত্যকি সমস্ত ব্যাপারটা অনলাইনে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
বেশি রাতে ফ্যানটমের সার্ভারে লগ ইন করে সাত্যকি। সমস্ত বুথের নম্বর দিয়ে একটা ফাইলে ভোটিং প্যাটার্ণ রাখা আছে। তাই ফাইলটাকে ইনপুট হিসাবে দিয়ে, ফ্যানটমের প্রোগ্রামটা চালালে দুটো নতুন ফাইল আসবে। একটায় ঠিকঠাক ভোট হওয়া বুথের লিস্ট। আর একটা ফাইলে রিগিং হওয়া বুথের লিস্ট।
ফ্যানটমের প্রোগ্রামটা চালায় সাত্যকি। প্রোগ্রামটার পুরো কাজ হতে ঘণ্টা দুয়েক লাগার কথা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই টার্গেট ফাইল দুটো এসে পড়ে। কি হল?
একটা ফাইল খোলে সাত্যকি। দেখে স্পষ্ট লেখা আছে, “পার্লামেন্ট হল শুয়োরের খোঁয়াড়।” ব্যাস আর কিছু নয়।
অন্য ফাইলটাতেও তাইই লেখা। আর ইনপুট ফাইলটা ডিলিট হয়ে গেছে।
মাওবাদীর মস্তিষ্ক তার নিজের স্লোগান কোথায় রেখেছিল কে জানে? এত ট্রেনিং-এর পরেও ভোলেনি। ঠিক সময়ে সেটা বার করে দিয়েছে।
Tags: ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, বড় গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
সিম্পলি ফাটাফাটি লেখা! যেমন জানায়, তেমন ভাবায়, তেমনই শিউরে উঠতে বলে।
Last er end ta darun.. Khub e informative..
বেশ ভালো মানের সায়েন্স ফিকশন। জটিল টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো খুব সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করায় পড়তে বেগ পেতে হয়নি। শুভেচ্ছা রইলো। এমন গল্প লেখা চালিয়ে যাবেন আশা করি। পড়ার জন্যে মুখিয়ে আছি।
ভাল লাগল। টেকনিকাল জিনিসগুলি বেশ উপভোগ্য লাগল।