হাজার দুয়ারী
লেখক: মিলন গাঙ্গুলি
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এই কাহিনি শোনার আগে আপনার জানা দরকার, আমি পুরোনো পয়সা আর অচল টাকা জমানো শুরু করেছি।
বিদেশে অনেক ক্লাব আছে। দালাল আছে, যারা পুরোনো টাকা পয়সার খোঁজ দেয়। বা কেনাবেচা করে।
বাংলাদেশে এটা অবশ্য বেশ কষ্টের কাজ।
কালির বাজার আর নিতাইগঞ্জের ওখানে ফুটপাথে এক লোক বসে। বুড়ো। মুখ ভর্তি শনপাপড়ির মতো দাড়ি। রোগা। ওঁর কাছে কিছু পুরোনো পয়সা পেয়ে কিনে ফেলেছি। বলেছে, আরো দেবে নাকি। গুলিস্তানেও পেয়েছি এক হেকিম সাহেবকে। তাবিজ বিক্রি করে, সঙ্গে পাথর। আর পুরোনো পয়সা। কিছু বাতিল নোট। গেলেই কিনি। আমার আগ্রহ দেখে দাম বাড়িয়ে ফেলেছে ব্যাটা। তারপরও কিনি। আপনার কাছে থাকলে দয়া করে আমাকে জানাবেন। দাম নিয়ে ভাববেন না। আর হ্যাঁ, জলদি। হাতে সময় কম। খুব কম।
সব খুলে বলি। নাকি?
ঘটনা শুরু হয়েছিল গত বছর।
গরমের মৌসুম চলছিল তখন। শুঁটকি বানানো গরম পড়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে না অনেকদিন। তরমুজের দাম অনেক।
মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে বিড়ালের মতো গুটিগুটি পায়ে।
অফিস শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। হেঁটে। বড়ো রাস্তা পাড়ি দিলেই সামনে রেলষ্টেশন।
বাসায় ফিরতে হবে। ঘামে গা চিটচিট করছে। বাসায় ফিরে লম্বা একটা শাওয়ার দিলেই শান্তি। তারপর বারান্দায় বসে একগ্লাস পুদিনা পাতা আর লেবুর শরবত। এমনিতে বাসে করেই ফিরি। অনেকক্ষণ ধরে বাসের দেখা না পেয়ে আচমকা মনে হল, ট্রেনে করে জলদি যাওয়া যাবে না? অনেকদিন হল, ট্রেনে করে কোথাও যাই না।
ঢুকে পড়লাম ইষ্টিশনে।
কথা হল, আমার মতো সাদাসিধে লোকের জীবনে অমন ঘটনা কেন ঘটবে?
কেন? বলুন?
আমার নাম মিলন। বয়স একত্রিশ। কুঁচকানো বাদামি রঙের স্যুট গায়ে। আর দশ জন লোকের চেয়ে আমাকে মোটেও আলাদা করে কেউ দেখবে না। এই তো, চারিদিকে আমার মতো কত শত লোক হেঁটে যাচ্ছে। আমজনতা না কি যেন বলে? সেটাই। আর সত্য কথা বলতে কী, আমি
বাস্তবতা থেকে পালানোর চেষ্টাও করছিলাম না। একদমই অপেক্ষা করছিলাম না, জীবনে কাকতালীয় কিছু ঘটুক। শুধু জলদি বাসায় ফিরে যেতে চাইছিলাম। শিখা, আমার গিন্নি, অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
ইষ্টিশনে ঢুকে অবাক হলাম।
কেমন সুনসান। বাইরের মতো গরম না। লোকের ভিড় কম। ময়লাও কম। তেমন ফেরিওয়ালা নেই।
অদ্ভুত তো!
হাজারবার এই ষ্টেশনের ভেতর এসেছি আমি। এত পরিষ্কার বা নিঝুম জীবনেও দেখনি। লাইনে দেখি পুরোনো আমলের একটা ধচাপচা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। পরের করিডোরে দিকে গেলাম। ওখান থেকে টিকিট কিনি বারবার। নারায়ণগঞ্জের ট্রেন ওখানেই থাকে। গত মাসেও একবার ওখান থেকে ট্রেনে চেপেছি। টানা কুড়ি কদম হেঁটে যাবার পর দেখি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।
অসম্ভব একটা ব্যাপার।
এই পথ চিনি ভালো করেই, ডানে কয়েক কদম হেঁটে গেলেই বাইরে যাবার রাস্তা। বাইরে দিলখুশ বিরিয়ানি হাউজ। সারাক্ষণ চনমন করা ঘ্রাণ বের হয়। কয়েকবার ওদের বিরিয়ানি খেয়েছি। খাসি বলে গরু চালিয়ে দেয় না। মাংসের কুঁচি নরম। ঘিয়ে ভেজা। আধ ফালি করা ডিম আর গোল আলু দেয় সঙ্গে। ফাঁকি করা অচেনা মসলা। না চাইলেও খানিক সালাদ দেয় সিরামিকের তশতরিতে।
আবার হতেও পারে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। এই ষ্টেশনটা কত প্যঁচানো সেটাও আমি জানি।
গাছের শেকড়ের মতো প্যাঁচানো। এক একটা করিডোর বিশাল লম্বা। শেষ মাথায় টিকিটের ঘর। বেকার, ভবঘুরে, ব্যর্থ জ্যোতিষ আর স্বপ্নে পাওয়া আজগুবি সব ওষুধ বিক্রেতা দেখা যায় প্রত্যেক করিডোরে। মধ্য দুপুরেও ওরা মশগুল থাকে নিজ নিজ ধান্ধায়।
আরো কয়েক কদম সোজা এগিয়ে হতাশ হয়ে আবিষ্কার করলাম রাস্তা বন্ধ।
থামলাম না।
ডানের গলি দিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে। নিজের জুতার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এমন নিঝুম যে গা শিরশির করে উঠে। ফিরে যাব কিনা ভাবছি। ঠিক তখনই, লোকজনের কথা বলার গুঞ্জন কানে ঢুকল।
তীক্ষ্ণ একটা বাঁক শেষ করে দেখি অচেনা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। সামনে কতগুলো টিকিট বিক্রির বুথ। কয়েকটা ট্রেন অপেক্ষা করছে লাইনে। প্রথমে ভেবেছি, ঘুরে ফিরে আবার আগের জায়গায় চলে এসেছি। ভালো করে খেয়াল করে দেখি, না।
ইষ্টিশনের হল রুমের চেয়ে এটা অনেক ছোটো। নরম আলো পিটপিট করছে। ছাদের উপর থেকে কালাই করা টিনের ল্যাম্পশেডে বাল্ব ঝুলছে। সেখান থেকে কমলা ফিনফিনে আলো নেমে আসছে স্বপ্নের মতো। ষ্টেশন মাস্টারের রুমটা কাঠের তৈরি। দেয়ালে দাদুর আমলের ঘড়ি। ভেতরে রোমান সংখ্যা। পিতলের পেল্লাই হারিকেনের মতো কী যেন। বুঝলাম ওটা দুলিয়ে সঙ্কেত দেয় লাইনম্যান। সব কেমন পুরোনো ধাঁচের যেন।
বোকার মতো চেয়ে রইলাম।
সামনে লোহার বেঞ্চিতে এক যুবক বসে আছে। একা। ঢোলা বেলবটম প্যান্ট পরনে। প্যান্টের পায়ের তলা এত ঢোলা, আস্ত একটা গুঁড়া দুধের ডিব্বা ঢুকে যাবে। সিল্কের আঁটসাঁট জামা গায়ে। বল প্রিন্টের ছাপ। জামার কলার বিঘৎ খানেক লম্বা। যুবকের মাথায় ঝাঁকরা চুল। জুলফি নেমে এসেছে ঠোঁটের কোন পর্যন্ত। যুবকের পোশাক দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। পুরোনো দিনের সিনেমায় এমন পোশাক পরতে দেখেছি। আরেকজন বাবু টাইপের লোককে দেখি পকেট থেকে পিতলের একটা ট্যাগ ঘড়ি বের করে সময় দেখে টুক করে আবার পকেটে রেখে দিল।
ভালো করে চেয়ে দেখি, স্টেশনের ভেতরে ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-যুবা যারাই আছে সবার জামকাপড় ঠিক যেন সত্তর বা আশির দশকের লোকদের মতো। বহুদিন অমন চুল দাঁড়ির ছাঁট দেখিনি। এক মহিলাকে দেখি টাইট পায়জামা আর ঢিলা কেমন কামিজ পরে আছে। কানে ঝুমকা দুল। মাথার চুল টেনে ইয়া বড়ো খোঁপা বেঁধে রেখেছে। মনে হয় মাথায় দশ কেজি চুল আছে। চোখে টানা কাজল। গালে কুমকুম। অপূর্ব!
ব্যাপারটা যে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
কী মনে করে কোনার দিকের খবরের কাগজ বিক্রির পিচ্চি দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্টলে সব সাদা কালো রঙের কাগজ। রঙ্গিন কাগজ নেই বললেই চলে। নেই অধুনা চলতি কোনো ম্যাগাজিন। প্রথমেই নজর পড়ল “দৈনিক সকাল” পত্রিকার উপরে। এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর আগে। হেড লাইন দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। “আগামী কাল রানি ভিক্টোরিয়া ঢাকায় আসছেন।”
সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল ঘাড় বেয়ে। ঘেমে উঠলাম। খবরের কাগজের আজকের তারিখ, জুন ১৮, ১৯৭২।
চমকে গেলেও এক লহমায় সব বুঝে গেলাম।
অসম্ভব। কিন্তু হয়েছে।
আজ জুনের ১৮, ২০২০ সাল। কোনোভাবে আমি ৪৮ বছর আগে চলে গেছি। এবং যা হচ্ছে চোখের সামনে একদম নির্জলা বাস্তব।
সোজা টিকিট কাউনটারের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখনই আমার দুইটা টিকিট দরকার। শিখার জন্য। আর আমার জন্য। এই স্টেশনের ট্রেনে চেপে যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারব। এবং সেটা ১৯৭২ সাল।
আহা, কত আরামদায়ক জীবন ছিল সেই পুরোনো আমলে। কোথায় যাব আমি আর শিখা?
চোখের সামনে ভেসে উঠল নিমগঞ্জের দৃশ্য।
গেছেন কখনো আপনি? সুন্দর জায়গা, তাই না?
এই আজকের দম আটকে আসা দিনেও দালানবাড়ি দিয়ে ভর্তি হয়ে যায়নি। শান্ত নিরিবিলি জায়গা। আমার শৈশব কেটেছে ওখানে। বুকটা হাহাকার করে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল নিমগঞ্জের মনোরম দৃশ্য। একতলা সব বাড়িঘর। এক মহল্লায় বড়ো জোর ছয় সাতটা বাড়ি। একটা করে পুকুর আছে প্রতি মহল্লায়। কালো বেত ফলের মতো জল সেই পুকুরে। সবুজ ঘাসের দঙ্গল পুকুরের চারিপাশে। ঢোল কলমি আর হোগলা জন্মেছে। সরু পিচের পথ। দুই পাশে সাইবাবলা আর অচেনা বড়ো বড়ো ঝাঁকড়া গাছ। ছাদে আমের ফালি আর ডালের বড়ি শুকাতে দিয়েছে বুড়ি দিদিমা। বাড়ির রোয়াকে বসে তামাক খাচ্ছে বুড়ো কোনো মানুষ। বা ষোলো ঘুঁটি খেলছে কেউ। বাড়ির গিন্নিরা সবাই দল বেঁধে একে অপরের মাথার চুলের বেনি করে দিচ্ছে। গল্প করছে। সন্ধ্যা পুজার শব্দ।
সাই সাই করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে মিষ্টি একটা বুনো ঘ্রাণ। বাইরে নীল রঙের অন্ধকার। হলুদ আলো জ্বলছে কাচের জানালার ভেতরে। খইবাবলা গাছের প্যাঁচানো গোলাপি ফল পড়ে আছে রাস্তার উপরে। অনেক অনেক পর একটা রিক্সা বিচিত্র ঝুনঝান শব্দ করে চলে যাচ্ছে।
১৯৭২ সালে ওদের জীবন কত আনন্দের ছিল। এই সব শহরের টেনশন নেই। আজকের এত সমস্যা নেই। সব কিছু স্বপ্নের মতো। রাত আটটার সময় পুরো মহল্লা নিঝুম হয়ে যেত। কতবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মনে হত আবার ফিরে গেছি নিমগঞ্জে। সকালবেলা বুড়ো এক লোক বাকরখানি আর রসগোল্লা বিক্রি করতে আসত। আজও মুখে লেগে আছে সেই খাবারের স্বাদ।
আহা জীবন! অমন হওয়াই দরকার। ঠিক পুরোনো দিনের মতো।
কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার দুই টিকিট দরকার। এখনই।
কাউনটারে মধ্যবয়স্ক এক লোক বসে আছে। দেশলাইয়ের শলা দিয়ে কান খোঁচাচ্ছে। চোখ বড়ো বড়ো করে আমাকে দেখল কিছুক্ষণ। গায়ের স্যুট, মাথার চুলের ছাঁট, চোখের চশমা আর হাতের মোবাইলের দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে চেয়ে রইল।
“দুটো টিকিট দিন তো।” ভদ্রভাবেই বললাম।
“কোথায় যাবেন?” তখনও বাতাসার মতো বড়ো বড়ো চোখে আমাকে দেখছে টিকিট বিক্রেতা।
“যেখানে খুশি।”
“মানে?”
“সরি, নিমগঞ্জে।” দ্রুত বললাম।
“তিন টাকা পঁচাত্তুর পয়সা।”
পকেট থেকে লাল রঙের দশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম।
“ইয়ারকি মারান আমার সঙ্গে।” খেঁকিয়ে উঠল কাউন্তারের টিকিটওয়ালা। “ ফালতু নোট আমাকে গছাতে পারবেন না। আমি কানা না। ঠিকমতো টাকা জাল করতে পারেন না? আরেকবার করলে পুলিশে ধরিয়ে দেব মিয়া।”
লোকটার ক্যাশের দিকে তাকালাম। যা ভেবেছি। সেই আদ্দিকালের সিকি, আধুলি, নয়ন তারা ফুলের মতো দশ পয়সা, আর তামার চতুর্ভুজ পাঁচ পয়সা দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে খাকি রঙের এক টাকার নোট। যা বাজারে নেই আজ অনেকগুলো বছর। সব অচল টাকা পয়সা।
লোকটা কেমনভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার হাতের নোটগুলো দেখে ধূর্তভাবে হাসল। চেঁচিয়ে উঠল, “এই গণেশ, কই তুই?”
মোটা মতো একটা লোক জবাব দিল, “কি অইল মুতালেব বাই? আজিরা চিল্লান ক্যান?”
“জলদি পুলিশে খবর দে রে। জাল নোট রে।” ঘেউ ঘেউ করে উঠল দেশপ্রেমিক টিকিট বিক্রেতা।
দৌড়ে ভেগে এলাম। জেলে যেতে চাই না। আর পুলিশি ঝামেলা সব সময়ই খারাপ। হোক সেটা ১৯৭২ সাল। কিছুতেই ওদের বুঝাতে পারব না। শেষে পাগলাগারদে থাকতে হবে আজীবন।
পরদিন অফিসের লাঞ্চ টাইমে বের হয়ে এলাম। গুলিস্তানের মোড় থেকে পুরোনো টাকা পয়সা কিনলাম। বিক্রেতা চালু মাল। আমার আগ্রহ দেখে দাম বেশি রাখল। সাড়ে তিনশো টাকা কিনতে এই আমলের সাত হাজার টাকা লাগল। কিন্তু আমি কেয়ার করছি না। নিমগঞ্জে ১৯৭২ সালে চার আনা হালি ডিম ছিল।
শিখাকে কিছু জানাইনি। ভেবেছি টিকিট কিনে ওকে ফোন দেব। কিন্তু দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত ইষ্টিশনের ভেতরে আঁতিপাঁতি করেও সেই করিডোর আর সরু টিকিট বিক্রির জায়গা খুঁজে পেলাম না। ওরা দাবি করল ওখানে কোনো আন্ডারগ্রাউনড ষ্টেশন নেই।
দিনের পর দিন খুঁজেছি। পাইনি।
অনেক অনেক পরে শিখাকে যখন সব বললাম, অবাক হয়ে গেল। কিছুটা চিন্তিত। আমাকে অনুরোধ করল আর যেন সেই বিদঘুটে ষ্টেশন খুঁজতে না যাই। আমিও বাদ দিলাম।
সব কিছু মুছে ফেলতাম স্মৃতি থেকে। ভাবতাম, হয়তো মায়াবী কোন বিভ্রম। কিন্তু মাস খানেক পর চঞ্চল হয়ে উঠলাম। শিখা আর আমি দুইজনেই।
কারণ আমার বন্ধু বাদল নিখোঁজ হয়ে গেল। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। হারিয়ে যাবার কয়েকদিন আগে, ওর গিন্নিকে নাকি বলেছিল, ট্রেনে করে নাকি পুরোনো কোন জায়গায় যাওয়া যায়। হেন তেন। ওর বউ কানে তুলেনি। টিভি দেখছিল। মনযোগ ছিল টিভিতেই। কী একটা সিরিয়াল দেখছিল। মহিলাদের যা স্বভাব!
কী মনে হতেই চমকে উঠলাম।
মাথায় কি যেন আসি আসি করেও আসছে না।
পাগলের মতো ড্রয়ার খুলে ফাইল বের করলাম। দাদু পুরোনো খাম আর ডাকটিকিট জমাতো। সব এই ড্রয়ারে আছে। ছোটোবেলায় আমিও জমাতাম। তাই সব আমাকে দিয়ে গেছে দাদু। খুঁজে খুঁজে একটা পুরোনো কাঁঠাল পাতা রঙের পোস্টকার্ড বের করলাম। হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম। শরীর কাঁপছে।
সেই কবে, গরমের এক দুপুরে ডাকপিয়ন এসে চিঠিটা বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পোস্ট কার্ডে আমাদের বাড়ির ঠিকানা থাকলেও চিঠিটা আমাদের কাউকে লেখা হয়নি। সে এক রহস্য। বাড়ির সবাই চিঠিটা পড়েছে। লাভ হয়নি। কেউ বুঝতে পারিনি এই চিঠির মানে। কে লিখেছে, কাকে লিখেছে, সবই এক রহস্য ছিল অনেকগুলো বছর ধরে। দাদু পরে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। এই চিঠি পাবার বছর দশেক পর আমার জন্ম হয়েছে।
পোস্ট কার্ডে ছাপ দেখলাম। ১১ আগস্ট ১৯৭২।
চিঠিটা অমন—
“বন্ধু আশা করি তোরা সবাই ভালো আছিস। আমিও ভালো আছি। আমি আসলে হাজার দুয়ারী ইষ্টিশনটা খুঁজে পেয়েছি। দুই সপ্তাহ হল হলুদগড়ে পৌঁছেছি। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। হবার কথা না। সময় আটকে আছে। তুই আর শিখা চলে আয়। আমার বউকেও চিঠি দিয়েছি। তোদের অপেক্ষায় রইলাম। ভালো মতো খুঁজলেই, যে কোনো নির্জন ইষ্টিশনে হাজার দুয়ারীর পথ পাবি। ভালো মতো খুঁজতে হবে। পাবিই পাবি। ওটা আছে। আর এর প্রমাণ আমি নিজে।”
চিঠির নীচে নাম লেখা – বাদল হোসেন। ঠিকানা- হলুদগড়।
পরদিন গুলিস্তানের মোড়ে পুরোনো টাকা কিনতে গিয়ে বিক্রেতাকে বাদলের ছবি দেখালাম। এক পলক দেখেই বলল— উনাকে চিনি। গত সপ্তাহেই অনেক পুরোনো টাকা কিনে নিয়েছিল আমার কাছ থেকে।
(জ্যাক ফিনির ‘দ্য থার্ড লেভেল’ এর ছায়া অবলম্বনে)
Tags: অনুবাদ গল্প, মিলন গাঙ্গুলি, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা