তিস্তান
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[শুরুতে: এই কাহিনি তৃতীয় সহস্রাব্দীর দ্বিতীয় দশকের। ততদিনে পৃথিবী দূষণ ও শোষণের শিকার হয়ে প্রায় পরিত্যক্ত হয়েছে। তবে তার সন্তানেরা নক্ষত্রলোক জয় করেছে মূলত দু’টি আবিষ্কারের মাধ্যমে। একটি দিয়ে নক্ষত্রের শক্তি ও ভরকে কাজে লাগিয়ে স্থান-কালের পর্দায় লুপ খোলা যায়— যার মাধ্যমে আলোকবর্ষের দূরত্বও অতিক্রান্ত হয় অত্যন্ত কম সময়ে। অন্যটিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানোবট এবং বৃহদাকার উপগ্রহের সংযোগ সাধন করে দূরসঞ্চার, দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিপ্লব এসেছে। ফলে আকাশগঙ্গার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বিস্তৃত হয়েছে মনুর সন্তানদের খেলাঘর।
কিন্তু প্রযুক্তি সবকিছু হাতের মুঠোয় এনে দিলেও মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ যায়নি। তা গেলে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষাতেই বলতে হয়, “মানুষ তাহলে দেবতা হয়ে যেত।” তার বদলে এই বিপুল পরিসর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগণন নক্ষত্র ও তাদের পরিবারে ছড়িয়ে থাকা মানুষদের বসতিও ভাগ হয়ে গেছিল মূলত দু’টি শক্তিজোটের মধ্যে।
এমন বহু বসতি ছিল, যারা শৃঙ্খলা, একটিই আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বৈরাচারী শাসকদের অধীন এমন যাবতীয় বসতি, গ্রহ এবং মহাকাশ-নগরী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এক সম্পদশালী এবং অত্যন্ত শক্তিশালী জোটের অধীনে। তার নামটিতে অনেক শব্দ ছিল, ছিল বিস্তর অক্ষর। তবে সবাই তাকে কনফেডারেশন নামেই জানত ও জানে।
অন্যদিকে ছিল সামাজিক, ধর্মীয়, এমনকি রাজনৈতিক বিচারে রীতিমতো ঢিলেঢালা বহু বসতি। এখানকার নাগরিকেরা সৃজনশীলতা আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং দিয়ে থাকেন। শিক্ষায় এবং বাণিজ্যে উন্নত হলেও সামরিকভাবে এদের শক্তি নিয়ে এরা নিজেরাও সন্দিহান ছিল। কনফেডারেশন তৈরি হলে একরকম নিরুপায় হয়ে এমন বসতিরা একটিই জোটের অধীনে নিজেদের নিয়ে আসে। সবাই সেটিকে রিপাবলিক নামেই জানত ও জানে।
আমাদের কাহিনি যে-সময়ের, তার থেকে এক দশক আগে কনফেডারেশন এবং রিপাবলিকের মধ্যে সংঘাত মতাদর্শ ও বাণিজ্যের স্তর অতিক্রম করে সরাসরি যুদ্ধের আকার নেয়। কিন্তু যুদ্ধের শুরুতে যা অচিন্ত্যনীয় বলে মনে হয়েছিল, ক্রমে সেটিই ঘটতে থাকে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং নাগরিকদের অকুণ্ঠ সমর্থনের ফলে রিপাবলিকের পাল্লা ভারী হতে থাকে। অন্যদিকে কনফেডারেশন বিপর্যস্ত হয় অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। শেষে, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রিপাবলিকের চাপিয়ে দেওয়া নিতান্ত অসম্মানজনক শর্ত মেনে একটি বোঝাপড়ায় আসতে বাধ্য হয় কনফেডারেশন। একদা তাদের অধীনস্থ ছিল এমন অধিকাংশ বসতিই চলে আসে রিপাবলিকের অধীনে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চালিত হতে বাধ্য হয় তারাও।
আমাদের এই গল্পের তথা এই সিরিজের পুনরাবৃত্ত চরিত্ররা সবাই রিপাবলিকের নাগরিক। তাঁদের মধ্যে আছেন প্রফেসর ধৃতিমান— স্পেস-টাইম লুপের প্রযুক্তির অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। আছে রয়— ধৃতিমানের প্রাক্তন ছাত্র, ধৃতিমানের অসুস্থ কন্যা রুচিরা’র প্রেমিক তথা বাগদত্ত, “জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন” জীবন-দর্শনে বিশ্বাসী। আছেন ডক্টর নোমুরা— যাঁকে রোবোটিক্স এবং দূরসংযোগে সর্বার্থে অদ্বিতীয় বলা চলে। প্রথম দু’জন সিভিলিয়ান হলেও রিপাবলিক প্রশাসন তথা সেনাবাহিনীর আস্থাভাজন। তৃতীয়জন সেনাবাহিনীরই একজন। যুদ্ধের সময় এবং তারপরেও এঁরা অত্যন্ত সংবেদনশীল বেশ কিছু অভিযানে তথা মিশনে শামিল ছিলেন। ভঙ্গুর শান্তি বজায় থাকার পেছনে এঁদের অবদান নেহাত কম নয়।
তবে এত কিছুর পরেও, দুই শক্তির সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি; হয়তো হবেও না।
কনফেডারেশন আর রিপাবলিকের সীমায় থাকা প্রায় আদিম স্তরের গ্রহগুলোর অধিকাংশই আজ রিপাবলিকের শাসনাধীন। কিন্তু সেখানে শাসন, প্রযুক্তির উপস্থিতি এবং নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা অত্যন্ত শিথিল। ফলে সেই গ্রহগুলোর বাসিন্দারা নিজেরাই যেভাবে পারেন সেভাবে বাঁচে, মরে…
বা হারিয়ে যায়!]
প্রাক্কথন
কাজলা ক্রসিং, বনাইবুরু টেরিটরি, দু-দিন আগে
“মা…?”
খুব বেশি কথা বলতে পারে না মুনিয়া। কিন্তু মুখের হাসি, হাত-পা নাড়া, আর এই একটা শব্দ— এই নিয়েই একটু-একটু করে বড়ো হচ্ছে সে। তবে যত বড়োই হোক না কেন, ঘুম থেকে ওঠামাত্র এই শব্দটা সে বলে উঠবেই।
কিন্তু এখন তো মা কাছে নেই! তার ঘুম তবে কে ভাঙাল? কী যেন একটা শুনেছিল সে… ওইত্তো!
মৃদু গুঞ্জনের মতো শব্দটা জোরালো হয়ে উঠল। চোখ মেলে, বিছানা থেকে সরে সে তাঁবুর দরজার কাছে এল। বাইরে উঁকি দিতেই মৃদু নীলচে-সবুজ আলোয় মাখা তিনটে শরীর তার চোখে পড়ল।
ওরা এসেছে! মুনিয়া-র মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তাঁবুর উষ্ণতা ছেড়ে রাতের আকাশের নীচে এসে দাঁড়াল সে। তারপর এগিয়ে গেল আলোকিত শরীরগুলোর দিকে।
১
নিউজকর্প অফিস, ইউরোপা, প্রথম দিন
“আমাকে কোথায় যেতে হবে?!”
ইউরোপা-র এই অফিসটা এমনিতে অডিটের রেকর্ড আর হিসেবপত্র রাখার জন্যই কাজে লাগে। খুব কম জনই জানেন যে নিউজকর্প-এর দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক তাঁর “মুখোমুখি” আলোচনাগুলো এখানেই সারেন। রয় ব্যাপারটা জানত; তবে তেমন একটা সাক্ষাতের জন্য এখানেই আসতে হবে— এ-কথা সে ভাবেনি। এখানে এসে অবধি ওই মারাত্মক ব্যক্তিত্বের সামনে সে কিছুটা কুঁকড়েই ছিল। কিন্তু প্রস্তাবটা শুনে সে আর চুপ করে থাকতে পারল না।
“শেষ মেডিকেল চেক-আপ অনুযায়ী তোমার কান ঠিকঠাক কাজ করছে।” গম্ভীরভাবে বললেন ইমন, “হ্যাঁ, তোমায় তিস্তান-এই যেতে হবে।”
“তিস্তান? সে তো…”
“আমাকে ইতিহাস বা ভূগোল শিখিও না, রয়।” ইমনের গলা শান্ত হলেও চোখটা ধারালো হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই সেটা স্তিমিত হয়ে একটা নরম ভাব দেখা দিল, “তিস্তান-এর বিশেষত্বের কথা জানি বলেই ওখানে যাকে-তাকে পাঠাচ্ছি না। শুধু একটা “স্টোরি” বানানোর হলে কারমাজভ বা চুলা থেকে কাউকে পাঠানো যেত। কিন্তু আমার মন বলছে, ওই গ্রহে কিছু একটা ঘটছে। স্থানীয় সংস্থাগুলো এই কথাকে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর জন্য এমন কাউকে দরকার যে ওই গ্রহে নেমে, সম্পূর্ণ খোলা চোখে আর মনে বিষয়টা দেখবে। যে খবরটা তোমাকে দিলাম, সেটা আমাদের সামনে ঠিক ওই কাজটাই করার সুযোগ এনে দিয়েছে। অনেক ভেবেই অন্য কাউকে নয়, তোমাকেই এই দায়িত্ব দিচ্ছি।”
“কিন্তু আমাকেই কেন?” কিছুটা অস্থিরভাবে রয় বলে উঠল। রুচিরা-র একটা থেরাপি ক-দিন পরেই হওয়ার কথা ছিল। এই সময়টা রুচিরা-র পাশে থাকা ভীষণ দরকার।
“তিনটে কারণে তোমাকেই আমি— হ্যাঁ, আমি নিজে— বেছে নিয়েছি। প্রথমত, ওই গ্রহের অন্যরকম আবহাওয়াতে মানিয়ে নেওয়ার মতো শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা তোমার আছে। দ্বিতীয়ত, রিপাবলিক প্রশাসনকে আমি সরকারিভাবে না হলেও কোনোভাবে এই ব্যাপারে জানাতে চাই। তোমার “বন্ধুদের” মাধ্যমে তাঁরা ব্যাপারটা জানতে পারবেন; হয়তো পরোক্ষভাবে পাশেও থাকবেন। তৃতীয়ত, তিস্তান-এর একটা অন্যরকম, আদিম আকর্ষণ আছে— এ-কথা অস্বীকার করা চলে না। তবে তুমি সেই অদ্ভুত সুরে সাড়া না দিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসবে, আমি জানি।”
“কেন?” তর্ক নয়, রয়ের মধ্যে কৌতূহলই জেগে উঠল এবার।
“রুচিরা-র থেরাপি আজ থেকে ঠিক পাঁচ দিন পর, তাই না?” হাসলেন ইমন, “তার আগেই তোমাকে ফিরতে হবে তো!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রয় মাথা দোলাল। সাধে কি আর জেনারেল করিমও এই মহিলাকে সমঝে চলেন!
২
কারমাজভ স্টেশন, গন্তব্য থেকে এক লুপ দূরে, প্রথম দিন
আচ্ছা, এই লোকগুলোর স্নান করতে এত অনীহা কেন?
সৌরজগৎ থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরের এই আলো-ঝলমল বিন্দুতে পৌঁছোনোর পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং রেকর্ড জমা দেওয়ার পর শাটল থেকে বন্দরে নামতেই রয়ের এই কথাটাই মনে হল।
রিপাবলিক আর কনফেডারেশনের মধ্যে বাণিজ্যের সবচেয়ে বড়ো কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হল কারমাজভ। এই কোয়াড্র্যান্টের সবচেয়ে বড়ো স্পেস-স্টেশন শুধু নয়, সবচেয়ে ধনী আর গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুও বলা চলে একে। প্রাসাদোপম অট্টালিকা থেকে শুরু করে একেবারে জীর্ণ ও দুর্গন্ধময় ছাউনি, চোখ ঝলসে দেওয়া সুরক্ষিত পথঘাট আর অন্ধকার, জল-জমা, অপরাধী আর নেশাখোরদের আড্ডা সুড়ঙ্গ— সবই এখানে প্রায় পাশাপাশি অবস্থান করে। বিশ্রাম ও হরেকরকম বিনোদন তথা নেশার ব্যবস্থা আছে কারমাজভ-এ। তবে রয়ের কাছে এই জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল একটিই কারণে— যে লাল দানবটিকে কেন্দ্র করে মহাশূন্যে ধেয়ে চলেছে তিস্তান, সেটি এখান থেকে মাত্র এক লুপ দূরত্বে রয়েছে।
প্রতি মুহূর্তে এখানে এত যান ওঠা আর নামার জন্য তৈরি থাকে যে ফ্লাইট প্ল্যান অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে অনুমোদন করাতে হয়। তবে রয়ের হাতে অত সময় ছিল না। তাই নিরুপায় হয়ে সে ধৃতিমানকে ব্যাপারটা জানিয়েছিল। অধ্যাপকটি প্রথমে ইমনের উদ্দেশে নানা কটূকাটব্য করলেন; তারপর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনে করিম ব্যবস্থা করলেন, যাতে সেই দিনই দুটো লুপ পেরিয়ে রয় কারমাজভ-এ নামতে পারে। তবে সবচেয়ে বড়ো সাহায্যটা এইবার দরকার হবে।
“রয়!”
হরেক রঙের পোশাক পরা যাত্রী, নাবিক, বণিক, সৈনিকদের ভিড় ঠেলে পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট অংশের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছিল রয়। করিম জানিয়েছিলেন, তার জন্য ঠিক করে দেওয়া কন্ট্যাক্ট ওখানেই থাকবে। সেই ব্যবস্থা করবে কারমাজভ ছেড়ে তিস্তান-এর দিকে যায় এমন একটা শাটলে রয়-কে তুলে দিতে, যাতে কোনো সমস্যা না হয়। ইতিমধ্যে চুলা থেকে ক্লিয়ারেন্স পাঠানো হচ্ছিল, যাতে নিউজকর্প-এর একজন সাংবাদিক হিসেবে তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিস্তান-এর ফের্মি বন্দরে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু কারমাজভ-এর এই সাংঘাতিক ভিড় আর প্রতিটি কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন দেখে সে এতই হতাশ হয়েছিল যে রিনরিনে গলায় ডাকটা প্রথমে শুনতেই পায়নি। দ্বিতীয়বার প্রায় চিৎকৃত ডাক শুনে সে চমকে তাকাল একটা ডেস্কের দিকে।
“আরেহ্, আপনি?”
ডক্টর নোমুরা-র চোখদুটো আনন্দে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছিল। তাঁর বিচিত্র ডিজাইনের জামার মতো মুখটাও একেবারে ঝলমল করছিল।
“অবাক হলেন তো?” ডেস্কে বসে থাকা কড়া অফিসারটির সঙ্গে কথা সারা হয়েছিল। এখানে মোতায়েন লোকেদের অনেকেই কনফেডারেশনের আমলে কাজে ঢুকেছিলেন। এখনো সাংবাদিকদের দেখলেই দূর-দূর করে দেওয়ার স্বভাবটা তাঁরা ছাড়তে পারেননি। তবে একে রয়ের সঙ্গে নেভি-র অনুমতি ছিল; তায় নোমুরা নিজে সেখানে বসে ছিলেন। গোমড়া মুখে “সব ঠিক আছে” বলে দিতে একরকম বাধ্য হলেন সেই অফিসার। তারপর ভিড় থেকে বেরিয়ে দু-জনে একটা কফি কিয়স্কে বসেছিলেন।
বিজ্ঞানী হাসতে-হাসতে বলছিলেন, “কিউ.এন.এন.এ কোয়াড্র্যান্টে কাজ ছিল। যারা ডেকেছিল তাদের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছে। এদিকে নেভি-র ব্যবস্থা অনুযায়ী ফেরার শিডিউল অন্যরকম ছিল। রেগেমেগে কারমাজভ-এ চলে এসেছিলাম, নিজের মতো করে ফিরব বলে। করিম খবর পাঠালেন, আপনাকে নাকি ঝটপট তিস্তান-এ যেতে হবে; আমি যেন আপনাকে সাহায্য করি। অন্য কারও জন্য এমন কিছু করতে বললে “সিগনাল আসছে না”— এ-সব বলে কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু আপনার জন্য তো ব্যবস্থা করতেই হয়, তাই না?”
“শুধু অবাক নয়, আপনাকে দেখে খুব-খুব খুশি হয়েছি।” কফিতে চুমুক দিল রয়, “যুদ্ধের সময় কারমাজভ আর চুলা-র আশপাশে অনেকবার আসতে হয়েছে— বিশেষ করে পয়েন্ট ফিশার-এ। কিন্তু সরাসরি এই অঞ্চলে আগে আসিনি। সেখানে এক বন্ধুর দেখা পেলে আনন্দ তো হবেই।”
“বুঝতে পারছি।” সহানুভূতির সুরে বললেন নোমুরা, “এই অঞ্চলে নিউজকর্প-এর তো যথেষ্ট উপস্থিতি আছে। তাও আপনাকে পাঠাতে হল?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রয় বলল, “তিস্তান আসলে সাংবাদিকদের আওতার বাইরেই থাকে। কেনই বা লোকে ওই জায়গাটা নিয়ে মাথা ঘামাবে, বলুন? যুদ্ধের পর এই অঞ্চলে কনফেডারেশন-এর বহু গ্রহ আর গ্রহাণু রিপাবলিকে এসে গেছে। তার মধ্যে অনেকগুলোতেই টেরাফর্মিং চলছে। কোথাও তো সম্পদ আর ভূখণ্ডের ওপর অধিকার নিয়ে ছোটোখাটো যুদ্ধই চলছে। সেইসব জায়গার রোমহর্ষক রিপোর্ট পাঠিয়ে লোকের নেকনজরে আসতেই সবাই চায়। তার ওপর তিস্তান-এ ঘর বেঁধেছিল পৃথিবীর সবথেকে গরিব আর মার-খাওয়া একটা অঞ্চলের বাসিন্দারা। তাদের নীরব অস্তিত্বে না আছে মশলা, না আছে বিজ্ঞাপনদাতার উৎসাহ। একান্তই কেউ তিস্তান-এর বাসিন্দাদের নিয়ে গালগল্প বানাতে চাইলে চুলা বা কারমাজভ থেকে কাউকে পাঠানো হয়। তারা ওখানে নেমে, ওই ভারী বাতাসে হাসফাঁস করতে-করতে স্থানীয় মিলিশিয়া আর কাউন্সিল থেকে কিছু কথা জেনে নেয়। ব্যস।”
“কিন্তু আপনি গালগল্প বানাতে আসেননি, তাই তো?”
নোমুরা-র তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল রয়, “তা আসিনি। তবে কেন এসেছি, সেটা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। আমাকে টেরা স্ট্যান্ডার্ডে কালকের মধ্যে তিস্তান পৌঁছোতেই হবে। এইবার যদি আমাকে শাটলে পৌঁছে দেন, আর…”
“আর?”
“যদি ভালোয়-ভালোয় ফিরে আসতে পারি,” শুকনো হেসে বলল রয়, “তাহলে সবটা শোনাব।”
রয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অদ্বিতীয় রোবোটিস্ট বিজ্ঞানীটি— যদিও তাঁর এই পরিচয়টা অন্য নানা ডিগ্রি আর উপাধির নীচে, যথার্থ “ক্লাসিফায়েড” তথ্যের ধাঁচে, লুকোনোই থাকে। রয়ের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল ওই স্বচ্ছ দৃষ্টির সামনে বসে থাকতে। হঠাৎ নোমুরা বলে উঠলেন, “আমার জন্ম তিস্তান-এ।”
“কী?” একেবারে হাঁ হয়ে গেল রয়। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই ডক্টর নোমুরা শুধু একাধিক পুরস্কার জেতেননি; তিনি রিপাবলিক প্রশাসন তথা সেনাবাহিনীর একজন অ্যাসেটও বটে। কিন্তু তিনি জন্মসূত্রে কনফেডারেশনের নাগরিক— এ-কথা তো কখনো শোনেনি সে।
“হ্যাঁ।” গম্ভীর মুখে বললেন নোমুরা, “তিস্তান-এ বসতি স্থাপন করার জন্য প্রথম যে দলটিকে পাঠানো হয়েছিল, তাতে আমার বাবা আর মা ছিলেন। জানেনই তো, রিপাবলিক-এর অদ্ভুত সাম্যবাদী নীতিতে একজন বিজ্ঞানী— এমনকি তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলেও— এই ধরনের অভিযান থেকে ছাড় পেতেন না। সেজন্য আমার জন্ম ওই মিশনের ক্যাম্প-হাসপাতালেই হয়েছিল।”
“তারপর?”
“আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না?” মুচকি হেসে বললেন নোমুরা।
“হ্যাঁ।” একটু অস্বস্তিভরে উঠে দাঁড়াল রয়, “যে শাটল আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে, তার চালক বিশ্বস্ত তো?”
“আমার ওপর ভরসা আছে তো?” উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কানের দুলে হাত দিয়ে কয়েকটা জায়গায় চাপ দিলেন নোমুরা। তারপর মুচকি হেসে বললেন, “এদের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়েই নির্দেশ দিয়ে রাখলাম। চুলা থেকে আপনার জন্য ক্লিয়ারেন্স তিস্তান-এর উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আপাতত আমাদের রওনা হতে কোনো বাধা নেই।”
“আমাদের?” রয় অবাক হতে-হতে হাল ছেড়ে দিচ্ছিল প্রায়, “আপনি আমার সঙ্গে… কতদূর যাবেন?”
“জন্মভূমিটা দেখেই আসি বরং।” দ্রুত এগোনোর ফাঁকেও ঘাড় ঘুরিয়ে রয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রুজোড়া ঊর্ধ্বমুখী করলেন নোমুরা, “তা না হলে আমাদের গল্পগুলো শোনা হবে না যে।”
৩
শাটল, ডি.কে.আর.এন কোয়াড্র্যান্ট, দ্বিতীয় দিন
“তিস্তান-এর বাসিন্দাদের মধ্য থেকে শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে।” কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রয়।
শাটলের দায়িত্ব অটো-পাইলটের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছিল। তাই পেছনে বসে অবশেষে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন দুই যাত্রী।
রয়ের কথা শুনে নোমুরা কিছু বললেন না। তাঁদের হাতে সময় ছিল। প্রায় অভেদ্য প্লেক্সিগ্লাসের বাইরে কুচকুচে কালো আকাশ দেখলে অবশ্য কেউ ভাবতে পারত যে এই মহাকাশযান বুঝি দাঁড়িয়েই আছে কোথাও। কিন্তু নোমুরা জানতেন, স্প্যাস্কি পয়েন্টের দিকে অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে চলেছে তাঁদের শাটল। ওখান থেকে একটা লুপ পার হলেই সেই সৌরজগতের কাছে পৌঁছে যাওয়া যাবে, যেখানে রয়েছে তিস্তান। বাকিটা শাটল নিজের জ্বালানি আর মহাকর্ষ কাজে লাগিয়েই সেরে নেবে।
“আমার জন্ম ওখানে হলেও তিস্তান সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।” অবশেষে বললেন নোমুরা, “আমি খুব ছোটো থাকতেই সায়েন্টিফিক মিশন পরিত্যক্ত হয়েছিল। আসলে কনফেডারেশন বুঝতে পেরেছিল, বিদ্রোহীরা ছড়িয়ে পড়েছে নানা জায়গায়, এমনকি তাদের বিজ্ঞানী আর সৈন্যদের মধ্যেও। সেই সন্দেহের কারণেই এরপর আমাদের পরিবারকে একরকম টুকরো-টুকরো করে দেওয়া হয়। আমি বড়ো হই সরকারি আকাদেমিতে।”
“তাহলে… রিপাবলিক?”
“যুদ্ধ যখন বাঁধল, তখন রিপাবলিক একটা দারুণ বুদ্ধিমানের কাজ করেছিল।” কষ্ট করে মুখে হাসি ফোটালেন নোমুরা, “আপনার মনে আছে?”
“আছে।” সংক্ষেপে বলল রয়। সেই সময় সেটা একটা দারুণ রণকৌশল হিসেবে মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে আরো অনেকের মতো সেও বুঝেছিল, কত মানুষের জীবন ভেঙেচুরে গেছিল ওই সিদ্ধান্তের ফলে।
“কনফেডারেশনের আকাদেমিগুলো দখল করেছিল রিপাবলিক। তারপর ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়েছিল, ওদের হয়ে লড়তে। কনফেডারেশনের অমানবিক, যান্ত্রিক শাসনে অতিষ্ঠ আমরা প্রায় সবাই সোৎসাহে রাজি হয়েছিলাম। আসলে বাবা আর মা-র সঙ্গে তো আমাদের আর যোগাযোগও ছিল না। রাষ্ট্রই তখন আমাদের বাবা, মা… সব। তখন আমি সদ্য ফেলোশিপ পেয়েছি। গবেষণার অঢেল সুযোগ, রিপাবলিকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর স্বাধীনতা…”
নোমুরা-র চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে রয় বলল, “কনফেডারেশন নিশ্চয় শোধ তুলেছিল, তাই না?”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন নোমুরা। নীচু গলায় তিনি বললেন, “আমি ভাগ্যবান, জানেন। আমার বাবা আর মা ততদিনে মারা গেছিলেন— তবে সেটাও আমাকে জানানো হয়নি। কিন্তু আমার সহপাঠীদের মধ্যেই অনেকের বাবা আর মা-র ওপর বদলা নিয়েছিল ওখানকার বাহিনী। তবে…”
“তবে?”
নোমুরা-র দু-চোখের গভীরে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল একচিলতে আগুন, “আমরাও পরে বদলা নিয়েছিলাম। কনফেডারেশনের সেই সময়ের শাসকদের একেবারে…” কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল তাঁর।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রয় বলল, “শিশুরা বরাবরই দুর্বল, আর অমূল্য। জায়গাটা ধনে-জনে অতুলনীয় রাষ্ট্রজোট হোক বা মহাকাশের একটি প্রান্তিক জংলি গ্রহ, সব জায়গাতেই তারা বিপন্ন হয়।”
“ভালো কথা মনে করিয়েছেন।” গালের ওপর থেকে জল মুছে নিয়ে নোমুরা বললেন, “তিস্তান সম্বন্ধে আর একটু বলুন তো।”
“তিস্তান… গ্রহ হিসেবে বড়ো হলেও তাতে জনবসতি আছে উত্তরদিকের একটাই মাত্র মহাদেশে— যাকে মহাদ্বীপ বলাই ভালো। বাকি গ্রহটা হয় অসম্ভব গরম, নয় মারাত্মক ঠান্ডা। ওই মহাদেশের প্রায় নব্বই শতাংশ জায়গাই জঙ্গল, নদী, পাহাড়, ঝরনা— এইসবে ভরা। দ্বীপের দুই প্রান্তে রয়েছে দুটি বড়ো বন্দর-শহর মহাগুনাস আর অনিগুনাস। শেষ সার্ভে অনুযায়ী তিস্তান-এর মোট জনসংখ্যার প্রায় আশি শতাংশই রয়েছে ওই দুটো জায়গায়। তাদের মাঝখানের বিশাল জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাকি দশ শতাংশ। শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে এই জনগোষ্ঠী বা পরিবারগুলো থেকেই।”
এক নিশ্বাসে সবটা বলে থামল রয়। ভ্রু কুঁচকে নোমুরা বললেন, “প্রশাসন বা পুলিশের তরফে কোনো তদন্ত চালানো হয়নি?”
“ওখানে পুলিশ নেই; তবে একটি মিলিশিয়া আছে। তাদের গতিবিধি ওই দুই শহরের মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ। তারা সেখানে আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা বজায় রাখে। আইন-আদালত চালানোর জন্য নিরাপত্তা দেওয়া, আদালতের আদেশ মেনে গ্রেফতার ও শাস্তিদান, জেলগুলো চালানো— এই হল মিলিশিয়ার কাজ। মাঝখানের জায়গাটার, যা বুঝেছি, সেই অর্থে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।”
“তবু,” সোজা হয়ে বসলেন নোমুরা, “অপহরণ একটা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। রিপাবলিক তো বটেই, কনফেডারেশনও এই ব্যাপারে একেবারে নির্মমভাবে তদন্ত আর বিচার করত। এখানে কেন সেটা করা হয়নি? ওখানে নেভি-র পোস্ট থাকতে বাধ্য। দরকার হলে তারাই তদন্ত করতে পারত।”
“তদন্ত করার পথে দুটো জিনিস অন্তরায় হয়ে উঠেছে।” কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে লুপের ঝিলমিলটা খুঁজছিল রয়, “প্রথমত, অধিকাংশ জনগোষ্ঠী অভিযোগ নিয়ে কারও কাছে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তাদের নিজস্ব আইনি অবস্থান খুব একটা… মজবুত নয়। নেভি তাদের ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবে না। আবার মিলিশিয়া দফতরগুলো থেকে তারা অনেক দূরে থাকে। তাতেও তারা যখন সেখানে অভিযোগ জানাতে গেছে, তারাই স্বীকার করেছে যে কাছেপিঠে অন্য কোনো পরিবার বা গোষ্ঠী নেই যাদের পক্ষে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। নজরদারি, এমনকি কুকুরের পাহারা এড়িয়ে শিশুরা উধাও হয়েছে। তার ওপর এইসব পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশই অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত। কোনোক্রমে পেট-চালানোর মতো চাষ-আবাদ, শিকার, মাছ-ধরা— এই নিয়েই বেঁচে আছে এরা। একেবারে আদিম স্তরের জীবনযাপন বলতে পারেন! মিলিশিয়া এদের কাছ থেকে অভিযোগ নিতেই অস্বীকার করেছে।”
“দ্বিতীয় বাধাটা কী?” শক্ত গলায় জানতে চাইলেন নোমুরা।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রয় বলল, “দ্বিতীয়ত, ওই পরিবারগুলো এই নিয়ে মিলিশিয়ার কাছে যেতে চায় না ভয়ে। তারা মনে করে, তাদের শিশুরা পরিদের কাছে আছে! যদি পরিরা রাগ করে…!”
“ন্যানি?” প্রায় চেঁচিয়ে উঠে গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড ভুলে মাতৃভাষায় ফিরে গেলেন নোমুরা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, “পরি! তার মানে ওই রূপকথার গল্পে যাদের কথা পড়া যায়?”
“রূপকথায় পরিদের খুবই মোলায়েম করে পেশ করা হয়।” ইমনের দেওয়া ডসিয়ার থেকে কথাগুলো মনে করে বলল রয়, “বরং উপকথায় আর লোককাহিনিতে তাদের যে পরিচয় পাওয়া যায় সেটা খুবই বিপজ্জনক এবং রহস্যময়। তাতে তাদের অতিলৌকিক প্রাণী বলে আদৌ মনে হয় না। বরং মনে হয়, তারা যেন অসীম শক্তিধর, অথচ ঈর্ষাকাতর, লোভী, খামখেয়ালি, কুচক্রী, ক্ষেত্রবিশেষে উদার ও মহৎ কেউ।”
“এভাবে বললে তো আমাদের চেনাজানা অনেক রাজনীতিক, বা শাসকের সঙ্গেই পরিদের মিল পাওয়া যাবে।” হাসলেন নোমুরা। পরক্ষণেই তাঁর দু-চোখ বিস্ফারিত হল।
“হ্যাঁ।” রয় সায় দিল, “ঠিক এটাই মনে করেছেন আমাদের সম্পাদক। তাঁর ধারণা, তিস্তান-এ মানুষ আসার আগেও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটেছিল। সেই প্রাণীরাই নিয়ে যাচ্ছে এই শিশুদের।”
“কিন্তু তেমন কোনো প্রাণী থাকলে তা কি কেউ জানতে পারত না?” আপত্তি জানালেন নোমুরা, “তিরিশ বছর আগের সেই মিশনের পরেও কুড়ি বছর এই গ্রহ কনফেডারেশনের অধীনে ছিল। গত দশ বছরে রিপাবলিকের তরফেও ওখানে নিশ্চয় বহু মিশন চালানো হয়েছে। তাতে কাউকে পাওয়া গেছে কি?”
“আপনি যতটা ভাবছেন, ততটা গুরুত্ব দিয়ে তিস্তান-কে আদৌ পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।” মাথা নাড়ল রয়, “ওই কোয়াড্র্যান্টে অন্য অনেক গ্রহ আছে যেগুলো সম্পদে বা অবস্থানের দিক দিয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তান-এর পেছনে সময় আর সম্পদ নষ্ট করার তেমন কোনো কারণই পায়নি কেউ। যারা গেছে তারাও রিপাবলিকে জীবনযাত্রার যা স্তর তার তুলনায় নীচেই বেঁচে আছে। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তারা অন্য কোথাও যাচ্ছে না কেন? কোথায় যাবে তারা? চুলা এবং তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ গ্রহগুলোতে থাকার অধিকার পেতে গেলে বহু শর্ত মানতে হয়। অত শিক্ষা বা অর্থ ওরা পাবে কীভাবে?”
“বুঝতে পারছি।” চিন্তিত ভঙ্গিতে নোমুরা বললেন, “তবু কোম্পানিগুলো নিশ্চয় সার্ভে চালিয়েছিল। তাতে কিছু ধরা পড়েনি?”
মাথা নাড়ল রয়, “তিস্তান-এর জলে মাছ আছে, বনে পাখি আর লোমশ প্রাণী আছে, কাঠ আছে, মাটির নীচে কিছু ধাতু আছে— যার বেশিটাই এত গভীরে যে ওখানকার মামুলি ব্যবসায়ীদের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া কঠিন। এইসব নিয়ে কনফেডারেশন বা রিপাবলিকের কোনো বড়ো প্রতিষ্ঠান মাথা ঘামায়নি। খুবই মামুলি কিছু পর্যবেক্ষণ চালানো হয়েছে। নিওগুনাস আর অনিগুনাসের কাছে কড়া স্ক্যানিং আর ট্র্যাকিঙের ব্যবস্থা হয়েছে— যাতে উলটোপালটা কেউ, বা কিছু ঢুকতে না পারে। রোগজীবাণুর জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে জায়গাটা আদিম, অজানা। বাতাসে নাইট্রোজেন কম, অক্সিজেন বেশি। লোকজন নেভি-র পেটেন্ট নেওয়া একটা ওষুধ খায়, যাতে শ্বাসকষ্ট না হয়।”
নোমুরা-র মুখে একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল, “কেন লোকে এই গ্রহেও থাকতে চাইবে, সেটা এবার একটু-একটু করে বুঝতে পারছি। ওখানে আমাদের তথাকথিত সভ্যতার অনেক কিছুই নেই। তবে স্বপ্ন আছে। রোমাঞ্চ আছে। হয়তো অ্যাডভেঞ্চারও আছে। আর আপনি বলছেন…?”
“পরিও আছে।” হাসল রয়, “লুপ সামনেই। আমরা এবার তৈরি হই।”
“একটা প্রশ্নের শুধু উত্তর দিন রয়।” স্ট্র্যাপ বাঁধতে-বাঁধতে জিজ্ঞেস করলেন নোমুরা, “এখনই কেন? মানে শেষ কোন শিশু হারিয়ে যাওয়া বা অপহরণের ঘটনা ঘটেছে যে ব্যাপারটা আপনার সম্পাদকের কানে পৌঁছেছে, আর তিনিও আপনাকে পাঠিয়েছেন— একরকম তদন্ত করার জন্য?”
“ওই মুক্তাঞ্চলের মধ্যে একটা জায়গাতে কাঠ কাটার জন্য একটা দল ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে গেছিল।” চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল রয়। স্ট্র্যাপগুলো অভ্যস্ত হাতে লাগিয়ে নিতে-নিতে সে বলল, “কুয়াশা আর চৌম্বকীয় ঝড়ের জন্য ওখানে অধিকাংশ জায়গাতেই ড্রোন কাজ করে না। উপগ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও প্রায় নেই বললেই চলে। তাই কুকুর আর বন্দুক দিয়েই জায়গাটাকে সুরক্ষিত রাখা হয়েছিল। তিন দিন পর এক ভোরে সবাই ঘুম থেকে ওঠার পর দেখা যায়, দলপতির দশ বছর বয়েসি মেয়ে হারিয়ে গেছে। অত্যন্ত শক্ত ধাতের সেই ভদ্রমহিলা কনফেডারেশনে থাকার সময় ওই অঞ্চলে আমাদের অন্যতম ডিপ অ্যাসেট ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি নিজের মতো করে বাঁচবেন বলে মেয়েকে নিয়ে তিস্তান-এ চলে আসেন। তাঁর অভিযোগ ওড়াতে পারেনি মিলিশিয়া। তারা খুঁজতে থাকে। তখনই জানা যায়, গত তিরিশ বছর ধরে ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বসতি, খামার, একক বাড়ি— এ-সব থেকে বহু শিশু হারিয়ে গেছে। পাওলি, মানে সেই মহিলা আমাদের সম্পাদককে চেনেন। তিনি সাহায্য চেয়েছেন।”
“এইবার বুঝলাম।” নোমুরাও চোখ বুঁজলেন, “চুলা থেকে আপনাকে ওখানে নামতে দেওয়ার জন্য যে অনুমতিপত্র জারি হয়েছে, তাতে আপনাকে সাংবাদিকের পাশাপাশি ট্র্যাকার হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু অজানা গ্রহে একা আপনি কীভাবে একটি শিশুকে, বা তার অপহরণকারীদের ট্র্যাক করবেন, রয়?”
রয় উত্তর দিল না। এই প্রশ্নটাই তো তাকে তাড়া করছে গতকাল থেকে। আর এখন সে গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গেছে। অথচ…
হঠাৎ চোখ খুলল রয়। তার মাথায় একটা অবিশ্বাস্য আইডিয়া এসেছে। কিন্তু নোমুরা কি…
“আমি ওখানকার প্রধান স্যাটেলাইটে থাকব।” চোখ বন্ধ ছিল নোমুরা-র। তবে তাঁর মুখের মিটমিটে হাসিটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, রয় যে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে— এটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। সেভাবেই তিনি বললেন, “তিস্তান-এ আপনি ওষুধ খাবেন না; বরং লেটেস্ট ডিজাইনের একটা এক্সোস্যুট পরবেন। তার সঙ্গে স্যাটেলাইটের, আর আমি চাইলে ওখানকার সব ড্রোনের— এমনকি নেভির জিনিসেরও যোগাযোগ থাকবে। আমাকে মাত করবে এমন ক্ষমতা ওই গ্রহের নেই। দেখা যাক, পরিরা জেতে, নাকি আমরা।”
৪
পিন্ডার পোর্ট, অনিগুনাস প্রভিন্স, দ্বিতীয় দিন
“নমস্কার। আমি রয়।”
“আমি পাওলি।” শক্তপোক্ত চেহারার মহিলা করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাতটা ঝাঁকাতে গিয়ে রয় টের পেল, মহিলা গায়ে যথেষ্ট শক্তি রাখেন। তবে তাঁর সুশ্রী মুখের ওপর একটা কালচে ছাপ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, দুঃখ আর উদ্বেগ মানুষটিকে ভেতরে-ভেতরে পুড়িয়ে চলেছে।
“মুনিয়া হারিয়েছে আজ নিয়ে পাঁচ দিন হল।” সোজা কাজের কথায় এলেন পাওলি, “আমাকে বলা হয়েছে, হারিয়ে যাওয়ার পর তিন দিন কেটে গেলে নাকি আর… ফিরে পাওয়ার আশা করা উচিত নয়। কিন্তু আমি ও-কথা মানতে রাজি নই। আপনি কীভাবে অনুসন্ধান শুরু করবেন— কিছু ভেবেছেন?”
“আমাকে আগে ওই জায়গাটায় যেতে হবে।” রয় বলল, “সময় বাঁচানোর জন্য আমাদের বোধহয় রোটর বা শাটল ব্যবহার করা উচিত। তবে তার আগে মিলিশিয়া-র কারও সঙ্গে কথা বলে জেনে নেওয়া দরকার, তারা কদ্দূর কী করল।”
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে বেরিয়ে গেলেন পাওলি। আশপাশে তাকিয়ে কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে পেল না রয়। অনিগুনাস থেকে আসা অফিসার তার অনুমতি আর বায়োমেট্রিক্স মিলিয়ে নিয়েই ঝটপট বিদায় নিয়েছিলেন। মেডিকেল চেক-আপ করা ব্যক্তিটিও চলে গেছেন তাঁরই সঙ্গে। কাউন্টারের একপাশে দাঁড়িয়ে কেরানিদের সঙ্গে চাপা গলায় দরাদরি করা বণিক, বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ক-জন রক্ষী, পরের শাটলের জন্য ম্লান মুখে বসে থাকা কিছু যাত্রী— এদের মধ্যে কার সঙ্গেই বা কথা বলবে সে? একরকম বাধ্য হয়েই সামনের জানালার দিকে এগিয়ে গেল রয়।
নামার সময় সে বুঝেছে, মহাদ্বীপের বেশিটাই ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা। এই উঁচু টাওয়ারের মতো জায়গা থেকেও লোকালয় বলতে কিছু নজরে পড়ে না। টাওয়ারের চারপাশে একটা জায়গায় গাছ কেটে ফাঁকা জমি তৈরি করে তাতে বাড়িঘর, ঝুপড়ি, কিছু দোকানপাট বসানো হয়েছে। সেগুলো সবই হয়েছে এই গ্রহে নতুন আসা লোকেদের জন্য, যাতে তারা ওষুধ খেয়ে ও অন্য নানা ব্যবস্থার সাহায্যে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। সেই নোংরা, রিক্ত জায়গা থেকে চোখ তুলে দূরে তাকালেই অবশ্য থমকে যেতে হয়।
কোথাও দেখা যায় পাহাড় থেকে নামা জলপ্রপাতের নীচে রামধনুর জেল্লা। কোথাও আবার অচেনা চেহারার রঙিন পাখিরা ডানা মেলে ঘন সবুজ জঙ্গলের পটভূমিতে। আকাশ থেকেও রয় দেখেছে, সমুদ্র থেকে মাছ আর চর্বি নিয়ে বন্দরের দিকে আসছে সেকেলে, স্টিম-চালিত জাহাজ। শহরের রাস্তায় আধুনিক যান্ত্রিক বাহন আর আকাশযানের বদলে লোকে ব্যবহার করছে ধোঁয়া-ওঠা ট্রেনের মতো আকারের যান। সব মিলিয়ে এ এক আদিম জায়গা— যেখানে শখের বশে, বা শিকার কি অ্যাডভেঞ্চার করতে কেউ আসতে পারে। আর হ্যাঁ, কাঠ, জল, চামড়া, মাছ— এ-সবে আগ্রহ থাকলে হয়তো কিছু ব্যাবসা-বাণিজ্যও চালানো যেতে পারে। তবে যতদিন না গ্রহের অন্য অংশগুলোকেও থাকার মতো করে তোলা হচ্ছে, বানানো হচ্ছে শহর, আর তাদের সঙ্গে এই মহাদ্বীপের যোগাযোগ গড়ে তোলা হচ্ছে, ততক্ষণ এমন একটা জায়গা রিপাবলিক বা কনফেডারেশনের কেউ পছন্দ করবে না।
কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি জিনিসটা এখান থেকে এত দ্রুত হারিয়ে গেল কেন? আবহাওয়া অন্যরকম হলে তো বরং লোকে মরিয়া হয়ে আরো বেশি করে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে— যাতে নিজের আশপাশটা চেনা ধাঁচের করে নেওয়া যায়। এখানে তার বিপরীতটাই হয়েছে।
রয় লক্ষ করল, সে ছাড়া ওখানে আর একজনও এক্সোস্যুট পরেনি। মনে হচ্ছে, তিস্তান যেন ইতিমধ্যেই এদের টেনে নিয়েছে নিজের বুকে। তবে… সেটা কি খুব খারাপ হয়েছে? এই মানুষগুলোর তো অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। ব্যস্ত, চোখ-ধাঁধানো, হাজার একটা টানাপোড়েনে ডুবে থাকা মহাবিশ্ব এদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তিস্তান এদের আপন করে নিচ্ছে। এদের চলাফেরায় এর মধ্যেই কেমন একটা ঢিলেঢালা ভাব এসে গেছে। এইজন্যই কি এরা হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভাবে না? সেইসব শিশুর মতো এরাও কি একটু-একটু করে নিজেদের ছেড়ে দিচ্ছে ভাগ্য আর… পরিদের হাতে?
আরো কতক্ষণ রয় এ-সব ভাবত, তা সে নিজেই জানে না। তবে তার ধ্যানভঙ্গ হল কয়েক জোড়া ভারী জুতোর শব্দে। সে ঘুরে দেখল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে আসতে ইশারা করছেন পাওলি। তাঁর সঙ্গেই আছেন একজন কড়া মুখের, ইউনিফর্ম-পরা অফিসার। আর রয়েছেন ভারী জুতো, দস্তানা, ওভার-অল আর হেলমেট-পরা একজন মধ্যবয়েসি, কঠোর মুখের অথচ নরম চোখের মানুষ।
“ইনি মিলিশিয়া-র প্রতিনিধি— ক্যাপ্টেন মিলিন্দ। আর এ হল জুনো— আমার সহকারী। আপনি যা জানার জেনে নিন; তারপর আমরা কাজলা ক্রসিঙের দিকে এগোব।”
“কাজলা ক্রসিং?”
“যেখান থেকে মুনিয়া হারিয়ে গেছে।” নামটা বলতে গিয়ে পাওলি-র গলা কাঁপলেও চোখ একদম স্থির ছিল।
৫
কাজলা ক্রসিং, বনাইবুরু টেরিটরি, তৃতীয় দিন
“এই জায়গাটা।” শান্ত গলায়, হাত তুলে দেখাচ্ছিল জুনো, “এখানেই তাঁবু খাটানো হয়েছিল। মিলিশিয়া তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল, তবে তেমন কিছু দেখেনি। তাঁবুটা এখনো ওদের থেকে ফেরত পাইনি আমরা। দেখতেই পাচ্ছেন, কাঁটাতার না থাকলেও একটা বেড়া আছে ওপাশে— ফুট পাঁচেকের মধ্যেই। মুনিয়া ওটা পেরোতে পারত না। কুকুর ছাড়া ছিল কম্পাউন্ডে। আলো জ্বলছিল চারপাশে। বন্দুক নিয়ে দু-জন পাহারাতেও ছিল।”
“আপনারা কোথায় ছিলেন?” রয় জানতে চাইল।
“ওইটা আমার আর লগারদের কেবিন।” একটা বড়ো আর খুব শক্তপোক্ত তাঁবু দেখাল জুনো, “ওখানেই ছিলাম। পাওলি এমনিতে এই তাঁবুতেই থাকে। সেই রাতে ওকে নেভি-র সাইটে যেতে হয়েছিল। আমাদের এখানে স্যাটেলাইটের লিংক বা নেটওয়ার্ক বলে কিছু নেই। জরুরি ভিত্তিতে কিছু জানাতে গেলে নেভি-র কম লিংক ব্যবহার করতে ওখানে যেতে হয়। পাওলি-র কাছে পাস আছে; মহাগুনাস-এ একটা শিপমেন্ট পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্য ও কথা বলতে গেছিল সেই রাতে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিভিন্ন তাঁবু আর বেড়ার পারস্পরিক দূরত্বগুলো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিল রয়। তার মন বলছিল, কুকুর, আলো, নজরদারি পেরিয়ে কেউ যদি এই ক্যাম্পে ঢুকতেও পারে, সে বাচ্চাটাকে নিয়ে পালাবে কী করে?
জুনো একটু অস্বস্তিভরা গলায় বলে উঠল, “কুকুরগুলো ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই রাতে। রক্ষীরাও। মনে হয়, ওদের খাবারে ওষুধ মেশানো হয়েছিল।”
ভ্রু কুঁচকে কথাটার অর্থ ভাবছিল রয়। হঠাৎ তার কানে ভেসে এল নোমুরা-র প্রশ্ন, “কী বুঝছেন রয়?”
পিন্ডারে নামার পর থেকেই নোমুরা আর কোনো বলেননি। রয় ভেবেছিল, ওঁর যাবতীয় চেষ্টা সত্বেও হয়তো লিংক কাজ করেনি। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, বিজ্ঞানী চুপচাপ রয়কে নিজের মতো করে দেখতে, শুনতে আর ভাবতে দিচ্ছিলেন।
স্যুটের বাইরের স্পিকারটা বন্ধ রেখে রয় বলল, “আমার মাথায় পরি-ফরি বাদ দিয়ে অন্য একটা সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।”
“কীরকম?”
“এই যে পাওলি-র মতো একজন মোটামুটি নবাগত নেভি-র সঙ্গে পুরোনো যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে এখানে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে— এতে কারও ঈর্ষা হতেই পারে। তা ছাড়া মহিলা, যতটুকু বুঝেছি, কাজের ক্ষেত্রে আপোস করেন না। এক্ষেত্রে শত্রু তৈরি হবেই। তারা কেউ কিছু করেনি তো?”
“কিন্তু এই ক্যাম্প থেকে সবচেয়ে কাছের বসতি অন্তত কুড়ি ক্লিক দূরে।” নোমুরা আপত্তি জানালেন, “মাঝখানে স্রেফ জঙ্গল, আর ওই দুটো প্রায় সমান্তরাল পাহাড়ের হঠাৎ কাছে এসে জট পাকানো। ওখান দিয়ে কে আসবে? কোত্থেকে আসবে?”
“অন্য কোনো রাস্তা?”
“উলটোদিকে ত্রিশ ক্লিক দূরে নেভি-র সাইট। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লগারদের বানানো কাঁচা তবে মোটামুটি মসৃণ রাস্তা ধরে কুড়ি ক্লিক যেতে হয়। তারপর থেকে পথের দু-ধারেই নজরদারির ব্যবস্থা আছে। আমি তার রেকর্ডিং দেখেছি। এমনকি ওই সাইট থেকে করা আর ওখানে আসা কলের রেকর্ডিং শুনেছি।”
“বলেন কী?” রয় মনে-মনে করিমকে অশেষ ধন্যবাদ দিল। এ-জিনিস নোমুরা ছাড়া আর কারও পক্ষে করানো সম্ভবই হত না।
“জুনো ঠিকই বলেছে। পরদিন অনিগুনাস-এ একটা বড়ো চালান নদীপথে পাঠানোর ব্যাপার ছিল। পাওলি একদম সন্ধ্যাবেলায় সাইটে গেছিল, ফিরেছিল পরদিন ভোরে। এ-বাদে ক্যামেরায় আর কাউকে দেখা যায়নি।”
রয়ের হঠাৎ খেয়াল হল, সে আপাতদৃষ্টিতে, কোনো কথা না বলে চুপ করে তাঁবুটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ফলে জুনো রীতিমতো উশখুশ করতে শুরু করেছে। লোকটির দিকে তাকিয়ে হেসে রয় বলল, “কুকুর, বা রক্ষীদের কে ওষুধ খাওয়াতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”
জুনো-র মুখে একটা ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেই সরে গেল; ফিরে এল অভ্যস্ত পাথুরে ভাব। সেভাবেই সে বলল, “কে জানে! তবে ওষুধ না খাওয়ালে একসঙ্গে এত কিছু করা যেত না। আমরা ঠিক উঠে পড়তাম।”
“রয়!” পাওলি-র গলা শুনে ঘুরে রয় দেখল, মহিলা ইতিমধ্যেই বাইরে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে অন্য একটা তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কাছে এসে তিনি বললেন, “কোনদিকে যাব আমরা?”
রয় ছাড়া অন্য কেউ তাঁর কথা শুনতে পাবে না জেনেও নোমুরা ফিসফিস করলেন, “ওই যেখানে দুটো পাহাড় মিশেছে— ওই দিকটায় এগোতে হবে। ওখানে কিছু একটা আছে। স্যাটেলাইটে কিছু ধরা না পড়লেও থার্মাল রিডিং গোলমেলে লাগছে। এটা আপনি বেশ সাবধানে, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বোঝান।”
“আগে আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে হবে।” গম্ভীর মুখে পাওলিকে বলল রয়, “মিলিন্দ আমাকে যা বলেছে, সেটা আপনারও শোনা দরকার।”
কাঠের টেবিলে এই অঞ্চলের একটা রিলিফ ম্যাপ রাখা ছিল। নেভি, বিচ্ছিন্ন স্কাউট, কাঠুরে, শিকারি, লোম আর চামড়ার কারবারি, বিজ্ঞানী— এমন হরেকরকমের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে জিনিসটা বানানো হয়েছিল। তার সামনেই চেয়ার টেনে বসল রয়।
“চারপাশের নিরিখে এই ক্যাম্পের অবস্থানটা লক্ষ করুন।” পাওলি একটা চেয়ার টেনে বসলে রয় বলতে শুরু করল, “বুঝতে পারবেন, এক্ষেত্রে মাত্র দুটো সম্ভাবনা সামনে আসে।
প্রথম সম্ভাবনা, এখানকারই কেউ মুনিয়াকে… কিছু করেছে। তারপর…”
“না!” শক্ত গলায় বললেন পাওলি, “এখানে মিলিশিয়া এমনিতে প্রযুক্তির ব্যাপারে খুবই পিছিয়ে আছে। তবে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে মিলিশিয়া ক্যাম্পের প্রত্যেকের সাইকো-প্রোব করেছিল। মূলত আমার কথা ভেবে, আইন-আদালতের ঝামেলায় না গিয়ে প্রত্যেকে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছিল। তাতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে মিলি সে-রাতে শুয়ে পড়ার পর এই ক্যাম্পের কেউ ওকে দেখেনি।”
রয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মিলিন্দ খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, অপহরণের তত্ত্বে মিলিশিয়া বিশ্বাস করে না। বরং অন্য সব তথাকথিত শিশুদের হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের যা মত, এখানেও সেটাই সরকারি অবস্থান। ক্যাম্পের কেউ শিশুটির সঙ্গে কিছু করে তাকে গায়েব করে দিয়েছে। ক্যাম্প থেকে আধ ক্লিক গেলেই একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে— যার ছোঁয়ায় কিছুটা নীচের পাথরের স্তরের জায়গায়-জায়গায় গর্ত হয়ে গেছে। তাদের কোনো একটার মধ্যে ছোট্ট শরীরটাকে গায়েব করে দেওয়া মোটেই কঠিন নয়। কেউ কিচ্ছু খুঁজে পাবে না। জঙ্গল হয়তো একটা গাছের জন্ম দেবে সেখানেই। তবে পাওলি-র বর্তমান মানসিক অবস্থায় এই কথাগুলো ভেঙে বলতে চাইল না রয়। তা ছাড়া পাওলি কি এগুলো ভাবেননি? যে কোনো মা তো সবচেয়ে আগে এগুলোই ভাবেন!
“দ্বিতীয় সম্ভাবনা, রাতে বা একদম ভোরে ঘুম ভাঙার পর কোনো কারণে মুনিয়া তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। পেছনের বেড়াটা মজবুত; উঁচুও বটে। কিন্তু তার মাঝের কয়েকটা পাল্লা আলগা। সেটা কেউ করে রেখেছিল নাকি নিজে থেকেই হয়ে গেছিল তা বলা কঠিন। তবে সেখান দিয়ে মুনিয়া বেরিয়ে যেতে পারে।”
“কেন যাবে?” পাওলি-র কঠিন, কঠোর ব্যক্তিত্বে একটা ফাটল দেখা দিল মুহূর্তের জন্য, “সাফসুতরো হওয়ার ব্যবস্থা তো তাঁবুর একদিকেই করা ছিল। তা ছাড়া আমি তো আগেও ওকে রেখে বাইরে থেকেছি। মেয়েকে সেভাবেই বড়ো করছি আমি। ও কিন্তু…”
হাত তুলে পাওলিকে নিরস্ত করল রয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা দুর্বল জায়গায় আঁচড় পড়েছে বুঝে সে নরম গলায় বলল, “এর মধ্যে একা থাকার কোনো ব্যাপার নেই। আচ্ছা, মুনিয়া কি ঘুমের মধ্যে হাঁটত?”
“না।”
পাওলি যেভাবে মুখটা বন্ধ করলেন, তাতে রয় স্পষ্টই বুঝতে পারল, ওঁর আরো কিছু বলার ছিল। কিন্তু কোনো কারণে সেটা বলতে চাইছেন না তিনি। মিলিন্দ এটারও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাই রয় আবারও নরম গলায় বলল, “সম্প্রতি কি মুনিয়া-র মধ্যে এমন কোনো প্রবণতা দেখা দিয়েছিল?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন পাওলি। তারপর দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন। তাঁর শরীর নিঃশব্দ কান্নায় দুলে উঠল বারবার। নিজেকে কোনোক্রমে সামলে নিয়ে ভাঙা গলায় পাওলি বললেন, “মুনিয়া বলত, ওরা ওকে খেলতে ডাকছে।”
“কারা?”
“পরিরা!”
৬
পরিদের রাজ্য, বনাইবুরু টেরিটরি, তৃতীয় দিন
“মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারছে না।”
“প্রথম ক-টা দিন সবাই কাঁদে, রানি। তুমিও কি কাঁদনি?” রোদ ঝলসে উঠল প্রজাপতির মতো একটি পতঙ্গের ডানায়। তিরতির করে কাঁপতে থাকা বাতাসে ভেসে এল মৃদু, সুরেলা কণ্ঠ।
“মনে আছে। কিন্তু সেটা ছিল অজানাকে ভয় পাওয়ার কান্না। পরিদের দেখা না পেলে তো আমি বাঁচতামই না। তবু, চেনা মুখগুলোকে হারানোর কষ্টের সঙ্গে মিশে থাকত এই জগতের রহস্য। বুঝতে পারতাম না, কেন আমি একা হয়ে গেছি; তাই কাঁদতাম। এই মেয়েটার ক্ষেত্রে তা হয়নি। মুনিয়া ওর মা-কে না পেয়ে কাঁদছে।”
“কিন্তু ও তো অনেক বড়ো। ওর মা তো ওকে যথেষ্ট শক্তপোক্ত করেই বড়ো করেছে। এখনো সেই মেয়ে মায়ের জন্য কাঁদবে কেন?”
“মেয়েরা কেন যে মায়ের জন্য কাঁদে, তা কথায় কী করে বোঝাই? এতদিন অন্যদের নিয়ে এমনটা হয়নি। তবে মুনিয়াকে তুলে আনা… ভুল হয়েছে।”
“তুমি কি ওকে ফিরিয়ে দেবে?”
একটু কি ভয় আর কষ্ট মিশল ওই কণ্ঠে? হ্যাঁ, এই দুটো অনুভূতির সঙ্গেই তো আজন্ম সহবাস তার। রানি হওয়ার পরেও তার দু-হাত ধরে রেখেছে এই দুই সঙ্গী। সে বোঝে।
“ওর মা-কে নিয়ে আসব এখানে।”
“সে কী? ওর মা তো দানবী!”
“তার আগে সে একজন মেয়ে। আগুনের বদলে জল, মাটি আর আকাশের সঙ্গেই তার সখ্য। সে আসুক এই রাজ্যে। দেখিই না, কী হয়।”
“কিন্তু…”
নদীর ওপর দিয়ে উড়তে থাকা একটা পাখি ছোঁ মেরে মাছকে ঠোঁটের মাঝে বন্দি করল। জলের দানাগুলো ঝিকমিক করে উঠল রোদে। গাছের তলায় গাঢ় হল সবুজ অন্ধকার। কেউ কোনো কথা বলল না। অনেকক্ষণ পর রানি বলে উঠল, “মুনিয়াকে বলো, আমরা ওর মা-কে নিয়ে আসব এখানে। ওরা এদিকে আসবে। আসবেই! তৈরি হও।”
“তারপর কী হবে?”
উত্তর দিল না রানি। উপরে, অনেক উপরে ওই আকাশের ওপার থেকে কে যেন ডাকছে তাকে। এতদিন সে এই ডাক শোনেনি, নাকি শুনেছিল? কিন্তু এখন এই ডাক বড়ো স্পষ্ট। জল, মাটি, আকাশ নয়; এই ডাক আসছে আরো গভীর থেকে। কে ডাকছে তাকে? সে কি যেতে পারবে তার কাছে?
কী করে যাবে? আগুনে তো পরিদের ডানা পুড়ে যায়!
৭
জোড়া-পাহাড়ের কাছে, বনাইবুরু টেরিটরি, তৃতীয় দিন
“এভাবে শুধু আমরা দু-জন এই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি,” হেলমেটের মধ্য দিয়ে পাওয়া আড়ালটুকুর সুবিধে নিয়ে ফিসফিস করছিল রয়, “এটা কি নিরাপদ? আমাদের সঙ্গে তো তেমন কোনো অস্ত্রও নেই।”
“দলবল নিয়ে এদিকে এলে কোনো লাভ হত না।” নোমুরা-র কথার পটভূমি হিসেবে যান্ত্রিক গুঞ্জন আর কি-বোর্ডে দ্রুত আঙুল চালানোর শব্দ ভেসে আসছিল, “এই জায়গায় পাহাড় এতটা এগিয়ে এসেছে যে সিংগল ফাইল এগোতে হয়। নেহাত এই গ্রহের সবক-টা কৃত্রিম উপগ্রহ এই মুহূর্তে আমার কথা শুনে সেইমতো ছবি আর গ্রাফ পাঠাচ্ছে; তা না হলে আমিও আপনাদের দেখতে পেতাম না। তা ছাড়া আমি যাদের খুঁজছি, তারা বড়ো দল আসছে বুঝলে এখান থেকে বহু-বহু দূরে চলে যেত।”
“আমরা কি ওখানে ক্যাম্প করব?”
পাওলি-র প্রশ্ন শুনে একটু চমকে উঠল রয়। নোমুরা-র শেষ কথাটার অর্থ বুঝবার চেষ্টায় সে মগ্ন ছিল। ইতিমধ্যে তার সামনের কাচে, খুব ছোট্ট আকারে হলেও, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া কিছু ছবি আর মানচিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন নোমুরা। সেগুলোতে সামনের পাহাড় আর নিজেদের খুঁজছিল রয়।
“হ্যাঁ।” দিনের আলো মুছে যাচ্ছিল চারপাশ থেকে। কুয়াশা ঘন হচ্ছিল। সবজেটে কালো জঙ্গল কেমন যেন নীলচে, অলৌকিক লাগছিল। পায়ে-চলা পথটা ছেড়ে, নোমুরা-র পাঠানো ম্যাপে লাল রেখায় চিহ্নিত করা একটা ঘাস জমির মধ্য দিয়ে এগোল রয়। মুখে বলল, “আমাদের লক্ষ্য হল সামনে ছোটো টিলার মতো জায়গাটার পাশে যাওয়া; তারপর অপেক্ষা করা।”
“অপেক্ষা! কার… কে আসবে?”
“পরিরা।” গম্ভীর গলায় উত্তর দিল রয়। সে বুঝতে পারছিল, পাওলি আহত চোখে তাকে দেখছেন। হয়তো তিনি ভাবছেন, মিলিশিয়ার মতো করে তাঁর কথা উড়িয়ে না দিলেও রয়-ও তাঁকে বিশ্বাস করেনি। তাই চলতে-চলতেই সে বলল, “একেবারে অন্ধকার হয়ে গেলে কুয়াশার মধ্যে, ভাঙা চাঁদের আলোয় আমি জায়গাটা খুঁজে পাব না। তার আগেই ওখানে পৌঁছোতে হবে। তারপর বুঝিয়ে বলছি।”
পাওলি জবাব দিলেন না; তবে হাঁটাও থামালেন না।
সেদিন দুপুরের পর, দু-দিনের মতো রসদ নিয়ে কাজলা ক্রসিং ছেড়ে এগিয়েছেন ওঁরা দু-জন। শুধু রয়ের ভরসায় এমন একটা জায়গায় অন্য কেউ আসতে রাজি হত না। তবে পাওলি অত্যন্ত শক্তপোক্ত মহিলা। তা ছাড়া রয়ের সরল যুক্তি— মাত্র দু-জনকে কেউ শত্রু বলে ভাববে না— তাঁকে প্রভাবিত করেছিল।
ঘুমের ঘোরে, বা স্বপ্ন দেখে, বা অন্য কোনো কারণে মুনিয়া ক্যাম্প ছেড়ে ওই বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে— এমনটাই বোঝানো হয়েছিল সবাইকে। এর আগে একাধিকবার আশপাশে একেবারে খানাতল্লাশি হয়েছিল। তবে এবার রয় সবাইকে ম্যাপ দেখিয়ে বলেছিল, মুনিয়াকে আশপাশে পাওয়া না যাওয়ার একটাই অর্থ হয়। সে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কোথাও গেছে। যাওয়ার মতো জায়গা বলতে নদীর দিকটা ইতিমধ্যেই দেখা হয়েছিল। পাহাড়টা এমনিতে ন্যাড়া দেখায় বলেই সেটা স্রেফ ওপর-ওপর দেখা হয়েছিল এর আগে। রয় বলেছিল, ওই জায়গাটা ভালোভাবে দেখতে। পাওলি কথাটা মেনে নিয়েছিলেন একটাই কারণে— ওই পাহাড় নিয়ে চাপা স্বরে অনেক কথা তাঁর কানে এসেছিল।
একটা রাতচরা পাখি হঠাৎ ডেকে উঠল। রয় খেয়াল করল, হেলমেটের সুবাদে সবকিছু স্পষ্ট দেখালেও আদতে চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়েছে। পাওলি-কে ইশারা করে হাতের সার্চলাইট জ্বালাতে বলল সে। নোমুরা-র কথা ঠিক হলে ইতিমধ্যেই তাদের এই চলন অন্য পক্ষের নজরে পড়েছে। ঘন হয়ে ওঠা নৈঃশব্দ্য অস্বস্তিকর লাগছিল রয়ের। শুধু পাওলিকে নয়, ইমনের দেওয়া ডসিয়ার পড়ে যা মনে হয়েছে, সেগুলো সে নিজের উদ্দেশেও বলতে শুরু করল।
“যা রটে, তার কিছু সত্যি বটে। পরি নিয়ে কথাগুলোকে মিলিশিয়া বা নেভি গুরুত্ব না দিলেও এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এ-সব কিংবদন্তি অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। লোকে এই তত্ত্বকে গুরুত্ব দেয়নি, আমার মতে, একটাই কারণে।”
“সেটা কী?”
“এই পরিদের সম্বন্ধে যে যা বলেছে তাতে মনে হয়, তারা দেখতে বড্ড বেশি আমাদের মতো।”
পাওলি কিছু বললেন না। রয় আবার মুখ খুলল, “মহাগুনাস এখন বেশি জমজমাট হলেও আগে জনবসতি হয়েছিল অনিগুনাসে। এই বনাইবুরু-কে তখন থেকেই লোকে এড়িয়ে চলে। কেন চলে— তা জিজ্ঞেস করলে কেউ সেভাবে বলে না। পরিদের নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তি, গান, ধাঁধার মতো কথা এই অঞ্চলে চাষি, জেলে, কাঠুরেদের মুখে-মুখে ঘোরে। সেগুলোতে দেখি, তারা আমাদেরই মতো দেখতে— তবে আরো সুন্দর, আরো সুঠাম, আরো… কী বলব… স্বপ্নিল! প্রশাসন বা নিরাপত্তার কেঠো চোখ-কানে এমন বর্ণনা নেশার প্রভাব বা কল্পনা বলেই মনে হবে। যদি এই গ্রহে প্রাণের উদ্ভব হয়েও থাকে, আর যদি সেই প্রাণীরা এখনো থেকে থাকে, তাহলে তারা দেখতে মানুষের মতো হবে কীভাবে? এ তো সম্ভাব্যতার কোনো হিসেবেই দাঁড়ায় না।”
“তাহলে আমরা কাদের সন্ধানে যাচ্ছি?”
“ব্যস!” নোমুরা-র তীক্ষ্ণ গলাটা রয়কে থামিয়ে দিল, “আর কোনো ব্যাখ্যা নয়। আমার পর্যবেক্ষণ বলছে, আপনারা একটা বিশেষ ফিল্ডে ঢুকে পড়েছেন। তাই দিয়ে এরা আপনাদের মন পড়তে পারবে কি না, জানি না। তবে কথা অবশ্যই শুনতে পাবে। আপনার থিয়োরি আপাতত নিজের কাছেই রাখুন। মহিলাকে অন্য কিছু বলুন।”
“আমরা পরিদের রানির কাছে যাচ্ছি।” নীচু গলায় বলল রয়, “গানটা তো আপনিও শুনেছেন, তাই না?”
চুপ করে রইলেন পাওলি। সার্চলাইটের আলোয় এবার দেখা দিল একটা ঘাসজমি— যার পেছনেই খুব কাছে এসে পড়েছে দুটো পাহাড়। মাঝখানে রয়েছে শুধু একটা সরু ব্যবধান। দু-জন মানুষ পাশাপাশি পথ চলতে পারে সেখান দিয়ে। নোমুরা-র পাঠানো ছবির সৌজন্যে রয় জানে, ওই গিরিপথের মতো অংশের ওপাশে খাড়া নেমে গেছে পাহাড়। তার নীচে একটা মস্ত বড়ো জঙ্গুলে জায়গা থাকলেও সেটার একটা বিশেষত্ব আছে। ওই জঙ্গল বনাইবুরুর বাকি এলাকার থেকে আলাদা— অনেক বেশি জটিল আর জড়ানো। বড়ো গাছের বদলে সরু গাছ, গুল্ম, কাঁটাঝোপ আর বাঁশের মতো গাছই ওই জায়গাটাকে একেবারে দুর্ভেদ্য করে রেখেছে।
ঘাসজমিতে পৌঁছে ব্যাকপ্যাক খুলে দ্রুত তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত হলেন পাওলি। রয় অবশ্য তাঁবু খাটাল না। বরং সঙ্গে নিয়ে আসা ক্রিস্টাল আর টিউবের সাহায্যে আলো আর তাপের ব্যবস্থা করল সে। একটু অবাক হয়ে ব্যবস্থাটা দেখলেন পাওলি। তাঁর চোখে রয় মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের দ্যুতি দেখল। ফেলে আসা নাগরিক সভ্যতার জন্য কি একটু হলেও টান জেগেছিল মহিলার মনে? কে জানে! মুহূর্তের মধ্যেই সেই ভাবটা উধাও হয়ে ফিরে এল কিছুটা পাথুরে, অনেকটা উদ্বিগ্ন এক মায়ের দৃষ্টি।
“আপনি কি সেই গানটার কথা বলছেন, যেটা থেকে…?”
“যেটা থেকে কাজলা ক্রসিং নামটা তৈরি হয়েছে।” পাথরে হেলান দিল রয়। নোমুরা-র স্ক্যানার এখনো অবধি আশপাশে আর কোনো বুদ্ধিমান বা বড়ো প্রাণীকে দেখায়নি। তবে তাদের কথাবার্তা যে পরিদের কানে পৌঁছোচ্ছে— এ-বিষয়ে নিশ্চিত ছিল রয়।
“গানগুলো বলে, একসময় এই বনাইবুরুতে পরিরাই থাকত শুধু।” বলছিল রয়, “তারপর একদিন আকাশের ওপার থেকে আগুন আর মৃত্যু নিয়ে এল দানবেরা। তারা পরিদের ডানা কেটে নিল; কেড়ে নিল তাদের গান গাইবার ক্ষমতা। দানবেরা বলল, শুধু তাদের মতো হতে হবে। তখন পরিরা দেখতে হল দানবদের মতোই। তবু রেহাই পেল না তারা। অবশেষে একদিন…”
নোমুরা-র কাছ থেকে নতুন একঝাঁক স্কিমাটিক আর ফোটো এসে পৌঁছোল এক্সোস্যুটে। কথা থামিয়ে রয় সেগুলো দেখতে ব্যস্ত হল।
রাত নামলে তিস্তানে তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যায়— এটা এই ক-দিনেই দেখেছে সে। কিছুটা উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটা যান্ত্রিক পাখি সেই তাপমাত্রার তারতম্য হিসেব করে ফোটো তুলেছে। তাতে স্পষ্ট ধরা পড়েছে এই ঘাসজমিতে তারা দু-জন, আর…
নাহ্, আর কেউ না। রাতচরা পাখি, কিছু সরীসৃপ আর ইঁদুর গোছের ছোটো স্তন্যপায়ী ছাড়া আর তেমন কাউকে খুঁজে পায়নি ড্রোন। তবে পাহাড়ের ঠিক ওপাশে, যেখানে ওই দুর্ভেদ্য জংলি জায়গাটা রয়েছে, তার কাছে বেশ কিছু গাঢ় কালো ছাপ দেখা গেছে। গর্ত, বা জল হবে। তবে ওগুলো কি শেষ ফোটোতে ছিল? রয় পুরোনো ফোটোগুলো তুলনা করার নির্দেশ দিচ্ছিল। হঠাৎ তার খেয়াল হল, পাওলি গুনগুন করছেন। মনোযোগী হল রয়।
“রাতটি হল ওই, নামল আঁধার, মায়ের চোখে নেইকো ঘুম…” গাইছিলেন পাওলি।
“আপনি জানেন গানটা?” টানটান হয়ে বসল রয়।
“এখানে আসার পর থেকে এই অনিগুনাস আর তার লাগোয়া জায়গাগুলোই আমার ঘরবাড়ি।” পাওলি-র মুখে একটা দুঃখমাখা হাসি আলো-ছায়ার মধ্যেও দেখা দিল, “গানটার সুর, তাল এক-এক জায়গায় এক-এক রকম হয়ে যায়। তবে কথাগুলো প্রায় একই থাকে। থাকবে নাই বা কেন? হারানোর গল্প তো বদলায় না।”
“গাইবেন?”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন পাওলি। তারপর খোলা গলায় গাইলেন,
“রাত হল ওই, নামল আঁধার, মায়ের চোখে নেইকো ঘুম;
কোথায় গেল তার মেয়েটি, ঘর কেন আজ রয় নিঝুম?
পরির মেলা উধাও হল, আগুন শুধু যায় দেখা,
খেলার সাথি হাত ছাড়াল, ভাগ্যে তোমার কী লেখা?
এই আঁধারে হারিয়ে গেলে ফিরবে কি আর সুখের দিন?
দানবদের ওই আগুন-আলো থাকবে না তো আর রঙিন।
মায়ের কান্না যায় না সওয়া, দুঃখে যে তার বুক ফাটে;
তাই তো এল, আলোর সাজে, পরির রানি ওই মাঠে!
“উজলা গেছে অনেক দূরে, কাজলা আছে মোর দলে,
আগুন নিভুক, বৃষ্টি নামুক, থাকব মিলে সক্কলে।”
বনাইবুরুর নীল-সবুজে ঠাঁই পেল না লাল দানো,
সঙ্গে থাকলে পরির রানি, হারায় না তাই একজনও!”
গান শেষ হল। রয়ের মনে হচ্ছিল, সত্যিই যেন এই নীল-সবুজ বন আর কুয়াশার মধ্যে সে একটু-একটু করে মিশে যাচ্ছে। কত শান্তি এখানে। কেন যেন সে এসেছে এখানে? যে কারণেই আসুক, এখানেই যদি থেকে যাওয়া যায়… অন্তত আরো ক-টা দিন…
“রয়! ডানদিকে দেখুন।”
নোমুরা-র তীক্ষ্ণ কণ্ঠ রয়কে মুহূর্তের মধ্যে সজাগ করে তুলল। চমকে উঠে সে চারপাশে দেখল।
পাওলি কোথায়?
ওই তো! কিন্তু পাওলি ওই পাহাড়টার দিকে কেন এগিয়ে যাচ্ছেন?
“দাঁড়ান, পাওলি!” এক লাফে উঠে দাঁড়াল রয়, “ওদিকে কেন যাচ্ছেন?”
ওপাশের অন্ধকার কি আরো ঘন হয়ে উঠেছে? দ্রুত হাঁটা, তারপর ছুটতে শুরু করল রয়।
“তিন জন… না, চার জন!” নোমুরা শান্ত গলায় বলতে শুরু করেছিলেন, “আপনি একা চার জনের সঙ্গে মহড়া নিতে পারবেন না। পাওলিকে টেনে এদিকে আনার চেষ্টা করুন। আমি ক্রিস্টালটা দিয়ে একটা ফিল্ড তৈরি করছি।”
কিন্তু রয় সে-সব শুনতে পাচ্ছিল না। তার বিস্ফারিত চোখের সামনে একটু-একটু করে আলোকিত হয়ে উঠছিল একটা ছোট্ট শরীর। মাটি থেকে সামান্য উপরে ভেসে থাকা সেই আলোকিত শরীরটা অস্ফুটে বলে উঠল, “মা?”
“যাবেন না, পাওলি!” চিৎকার করে বলে উঠল রয়, “ওটা হলোগ্রাম!”
“মুনিয়া!” রয়ের অস্তিত্ব উপেক্ষা করে পাগলের মতো ছুটে গেলেন পাওলি। তার পেছনে এগোতে গিয়েই রয়ের সামনে পড়ল জমাট অন্ধকারের মতো একটা শরীর। সাংঘাতিক ঝাঁকুনি খেল সে।
“টেসার!” নোমুরা-র গলাটা খুব ক্ষীণ শোনাচ্ছিল রয়ের কানে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে সে ওঠার চেষ্টা করছিল। তখনই সে দেখল, আরেকটা কালো শরীর তার দিকে এগিয়ে আসছে অন্যদিক থেকে। “পিছিয়ে আসুন, রয়! আপনি একা ওদের সঙ্গে পারবেন না। স্যুটটা সামলে দিলেও…”
ততক্ষণে আধশোয়া অবস্থাতেই রয় দেখেছিল, সেই আলোকিত শরীরটার পিছু-পিছু পাহাড়ের মধ্যেই যেন মিলিয়ে যাচ্ছেন পাওলি। তাঁর ঠিক পেছনেই দু-হাত বাড়িয়ে রয়েছে আরেকটি জমাট অন্ধকার শরীর। অক্ষম ক্রোধ আর অসহায়তা তার মাথায় মুহূর্তের জন্য আগুন জ্বালিয়ে দিল। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রয়।
একজন হাত চালাল তার মুখ লক্ষ্য করে। সেটা এড়িয়ে পরি… প্রাণীটির দিকে সজোরে পা চালাল রয়। আঘাত জায়গামতো পৌঁছোল। ছিটকে গেল অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা আততায়ী। তবু আবার ছুটে এল সে। রয় প্রাণীটিকে কাছে আসতে দিল। তারপর যথাসম্ভব আন্দাজ করে, প্রাণীটির গঠন যদি সত্যিই মানবসুলভ হয় তাহলে যে অংশে কিডনি থাকা উচিত সেই জায়গাটা বুঝে নিয়ে, সমস্ত শক্তি দিয়ে সেখানে ঘুসি মারল। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল শত্রু।
আর তখনই অসহ্য যন্ত্রণা রয়ের চোখের সামনে একটা পর্দা টেনে দিল যেন। জ্ঞান হারানোর সুযোগ অবশ্য সে পেল না। মাথার মধ্যে একটা মৃদু ইলেকট্রিক শক্ তাকে আবার সচেতন করে তুলল। চোখ খুলে সে দেখল, তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আবার পিঠের কাছে, যেখানে এক্সোস্যুটের একটা জয়েন্ট আছে ঠিক সেই বরাবর আঘাত করার জন্য হাত তুলেছে অন্য আততায়ীটি।
নোমুরা-র দেওয়া শক্-টা রয়ের প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে স্বাভাবিকের তুলনায় আরো দ্রুতগামী করে তুলেছিল। তাই এবার সে আর শত্রুকে আঘাত করার সুযোগ দিল না। বরং সরে যেতে-যেতেই স্যুটের একটা কন্ট্রোল চালু করল সে। এগুলো নেভি-র এক্সো-স্যুট নয়; ওই জিনিস নিয়ে তিস্তান-এ নামার অনুমতি পেত না সে। তবে সাংবাদিকদের ব্যবহারের জন্য স্যুটেও কিছু জিনিস থাকে বইকি— যার মধ্যে অন্যতম হল হাতার লাইনিঙের মধ্যে লুকোনো একটা সরু অথচ অসম্ভব শক্ত তার। এমনিতে ওটা দিয়ে স্যুটের বৈদ্যুতিক অংশগুলোকে চার্জ দেওয়া যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে স্যুট থেকে অন্য কোথাও তড়িৎ প্রবাহিতও করা যায় তাই দিয়ে।
বিষাক্ত সাপের মতো শত্রুর গায়ে ছোবল মেরে গেঁথে গেল স্যুট থেকে বেরিয়ে আসা তারটা। তৎক্ষণাৎ বাফার হিসেবে রাখা শক্তির প্রায় সবটুকু ওই তারের মধ্যে চালিত করল রয়। সে নিজে ভয়ংকর ঝাঁকুনি খেলেও শত্রুটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল।
“রয়!” নোমুরা”র গলাটা ক্ষীণ শোনাচ্ছিল আবার। একটু-একটু করে রয়ের শরীরটা ভারী হয়ে আসছিল। সব ঘোলাটে ঠেকছিল। গা গোলাচ্ছিল এতক্ষণের আঘাতের অভিঘাতে। তারই মধ্যে সে শুনল, যেন অনেক দূর থেকে নোমুরা বলছেন, “আমি আপনাকে আর শক্ দিতে চাইছি না। কিন্তু এদের মধ্যে অন্তত একটিকে নিয়ে ক্রিস্টালের কাছে আপনাকে যেতেই হবে। তা না হলে আমি কিচ্ছু করতে পারব না। এটুকু আপনাকে করতেই হবে। রয়!”
তারটা শত্রুর শরীর থেকে বের করে নিল রয়। তার একটা অসাড় হাত ধরে, অজ্ঞান ভারী শরীরটাকে ছেঁচড়ে নিয়ে চলল ক্রিস্টাল আর টিউব দিয়ে সাজানো ধিকিধিকি জ্বলা ওই কৃত্রিম আগুনের দিকে। তার মন বলছিল, হয়তো এখনো আক্রমণ করতে পারে অন্য কোনো পরি… প্রাণী। কিন্তু তার আর কিছু করার অবস্থা ছিল না। কোনোক্রমে ক্রিস্টালের কাছে এসে সে প্রাণীটিকে ছেড়ে দিল; তারপর নিজেও ধপাস্ করে শুয়ে পড়ল।
জ্ঞান হারানোর আগে রয় দেখেছিল, একটা অষ্টভুজের মতো আলোর বৃত্ত তৈরি হয়েছে বেশ কিছুটা দূর অবধি। বহু পোকার ভনভনের মতো শব্দ তুলে মাথার ওপর নেমে এসেছে একটা ড্রোন। সেটা থেকে বেরোনো একটা সোনালি শেকল যেন বেঁধে ফেলছে প্রাণীটিকে— যার আকার মানুষেরই মতো, শুধু তার সর্বাঙ্গে রয়েছে একটা মসৃণ কালো… বডিস্যুট!
৮
জোড়া-পাহাড়ের নীচে, বনাইবুরু টেরিটরি, চতুর্থ দিন— ভোর
“এবার আপনাকে বিলালের সঙ্গে কথা বলতে হবে?”
নরম লালচে আলোতে সবুজ আর নীলে ভরা আশপাশ ভারী মায়াবী লাগছিল। আকাশে ডানা মেলেছিল অচেনা চেহারার পাখিরা। অস্তগামী চাঁদের চেহারাটা তখনও বেশ স্পষ্ট হলেও সেটা গাছের আড়ালে চলে যাচ্ছিল একটু-একটু করে। ভোর হচ্ছিল।
“বিলাল?”
জ্ঞান ফিরলেও রয়ের মাথার মধ্যে জমা কুয়াশা তখনও একেবারে জমাট বেঁধে ছিল। শরীরের যন্ত্রণাটা প্রায় নেই বললেই চএল। এক্সো-স্যুট তার রক্ত-চলাচল স্বাভাবিক করেছে, যন্ত্রণার অনুভূতিও কমিয়েছে। কিন্তু যা দেখছে, আর যা ঘটেছে— দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কটা সে খুঁজে বের করতে পারছিল না। এই যেমন, তার সামনে অজ্ঞান হয়ে রয়েছে একটি প্রায় লোমহীন, কুড়ি-বাইশ বছর বয়েসি পুরুষ। তার দেহের নীচের অংশটা বডিস্যুটে ঢাকা থাকলেও ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। সে কে, বা কীভাবে তার সামনে এসেছে— এ-সবের কিছুই বুঝতে পারছিল না রয়।
“আপনার সামনে যে ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, সে-ই বিলাল।” নোমুরা বললেন, “আমি ড্রোন থেকে পাঠানো কিছু প্রোবের সাহায্যে ওর শরীরের বডিস্যুটের ওপরের অংশটা কেটে ফেলতে পেরেছি। রক্তের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করেছি। ডেটাবেস অনুযায়ী এই ছেলেটি বিলাল। আজ থেকে প্রায় সতেরো বছর আগে মহাগুনাস প্রভিন্স থেকে হারিয়ে গেছিল ছেলেটি। মিলিশিয়া-র কাছে কেউ অভিযোগ জানায়নি। তবে বার্ষিক সেন্সাস নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করায় এর পরিবার থেকে বলা হয়েছিল, ছেলেটি “আর নেই”। সেভাবেই ফ্ল্যাগ করার ফলে আমি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি।”
বাঁধভাঙা বন্যার মতো হু-হু করে গতরাতের স্মৃতি ফিরে আসছিল রয়ের মনে।
পাওলি? মুনিয়া?
রয়ের মনে হল, কথা বলে সময় নষ্ট করার কী দরকার? এই ছেলেটি এখন কী ভাষায় কথা বলবে, কে জানে। এখন প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। সরাসরি সাইকো-প্রোব করার চেষ্টা করলে হয়তো ভালো ফল হবে। কিন্তু প্রস্তাবটা নোমুরাকে দিতে তিনি সোজাসুজি আপত্তি জানালেন।
“আমি পুরোনো রিপোর্টে দেখেছি, পরিদের সঙ্গে ছোটোদেরই শুধু নয়, বড়োদেরও কথাবার্তা হয়েছে অনেকবার। সেগুলো কেউ পাত্তা না দিলেও তাতে এটা পরিষ্কার যে পরিরা গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ডে কথা বলে— তবে একটু পুরোনো ধাঁচে। এগুলো সবই কাঠুরে, জেলে, বা শিকারিদের বানানো গল্প বলে মনে হয় না। এই শ্রেণির মানুষেরা একেবারে দিন-আনি দিন-খাই স্তরে জীবনযাপন করে। তারা এ-সব বানাবে না।”
রয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এক্সো-স্যুট তার দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ-সমৃদ্ধ তরল ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। তবে তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। অনেক ভেবে সে জিজ্ঞেস করল, “পরি বলে কি তাহলে কিছু নেই? সবই তিস্তান থেকেই হারিয়ে যাওয়া ছেলে-মেয়ে?”
তখনই মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটা জড়ানো গলায় ভঙ্গিতে কিছু বলল; তারপর ছটফট করতে শুরু করল।
“ঠিকই ধরেছিলাম।” নোমুরা-র গলাটা তৃপ্ত শোনাল, “ওই বডিস্যুটে বসানো ন্যানোবট দিয়ে এদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমি ওপরের অংশটাকে উড়িয়ে দিয়ে ফিল্ডটা সরিয়ে নিয়েছিলাম। তাই ওরা ওর কাছে সিগনাল পাঠাতে পারছে; তবে সুবিধে করতে পারছে না। সত্যি-সত্যি ছেলেটার বুদ্ধি হাঁটুতে থাকলে অবশ্য সমস্যা হত।”
“ওরা? কারা?”
“আমার একটা ধারণা আছে, তবে সেটার প্রমাণ চাই এবার।” খর গলায় বললেন নোমুরা, “ওকে এবার বাঁধুন; তারপর তুলুন। তবে নিজের হেলমেট-টা খুলে ফেলুন। না হলে প্রথম থেকেই শত্রুতার ভাবটা ওর মধ্যে খুব বেশি হবে।”
বিলাল-কে বাঁধতে-বাঁধতে রয় মাউথপিসে বলল, “প্রশ্নোত্তর কি আপনিই চালাবেন?”
কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে নোমুরা বললেন, “আপাতত আপনাকেই চেষ্টা করতে হবে। তারপর না হয়…”
ছেলেটাকে একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে রয় আস্তে-আস্তে তাকে ঝাঁকাল। তার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল ঠান্ডা জল ঢেলে তক্ষুনি ওকে তুলে দিতে। কিন্তু সেটা বুঝেই নোমুরা ইয়ারফোনে বললেন, “দুম্-দাম্ কিছু করার চেষ্টা করবেন না। সাইকো প্রোবের চেষ্টাও ওই জন্য করিনি। কাল রাতে ছেলেটার মাথার গঠন আর চিন্তার প্রবাহ যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করেছি। তাতেই বুঝেছি, এর দেহের বয়স যেমনই হোক না কেন, মনটা কিন্তু একেবারেই সরল আর ছোটোদের মতো। গায়ে জোর আছে, আদেশ পেলে সেটা পালন করে; কিন্তু একে প্রাপ্তবয়স্ক ভেবে তেমন আচরণ করলে ওর, আর আমাদেরও ক্ষতি হবে।”
আবার আস্তে-আস্তে ছেলেটাকে ঝাঁকাল রয়। ছেলেটা… বিলাল চোখ মেলে তাকাল রয়ের দিকে। তারপর এদিক-ওদিক দেখে হঠাৎ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।
নোমুরা-র আদেশ বা নির্দেশের অপেক্ষা করল না রয়। কাল রাতে যে জিনিসটা তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল, সেই তারের কিছুটা বেরিয়ে এল স্যুটের লাইনিং থেকে। কুঁকড়ে উঠে ধীরে-ধীরে আবার বসে পড়ল বিলাল।
“বিলাল— তাই তো?” মৃদু হেসে বলল রয়। উত্তর দিল না বিলাল; তার চোখে ফুটে উঠল ভয়, রাগ, ঘৃণা। থেমে-থেমে, যথাসম্ভব শান্ত আর নরম গলায় রয় বলল, “আমি মুনিয়াকে খুঁজছি। কাল তোমরা পাওলি— মানে মুনিয়া-র মা-কেও নিয়ে গেছ। তাকেও ফিরিয়ে আনতে চাই আমি। ওরা কোথায় আছে?”
বিলালের নাকের পাটা ফুলে উঠল, কিন্তু সে কিছু বলল না। রয় এটুকু বুঝল যে তার ভাষা ছেলেটা বুঝেছে। সে আবার ধীরে-ধীরে বলল, “ওদের নিয়ে তোমাদের কী লাভ? ফিরিয়ে দাও ওদের। অন্তত বলো, কোথায় গেলে ওদের দেখা পাব আমি।”
বিলাল এবারও কিছু বলল না, শক্ত করে মুখ বন্ধ করে রইল। বারবার কথাগুলো বলল রয়; বোঝানোর চেষ্টা করল, এবারের অপহরণের জন্য নেভিও খুঁজতে শুরু করবে এই অঞ্চলে।
“নেভি ওপর-ওপর খুঁজবে না, বিলাল।” রয় আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছিল না। সে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “তারা যদি পরিদের রাজ্য খুঁজে পায়, তাহলে তারা সবাই কতটা বিপদে পড়বে, তা ভাবো। শুধু ওই দু-জনকে ফিরিয়ে দাও। আমরা চলে যাব এখান থেকে।”
“তোমরা পরিদের খুঁজেই পাবে না।” আড়ষ্ট গলায় বলে উঠল বিলাল।
রয় বুঝতে পারল, বিলালের কথা বলার ভঙ্গিও ছোটোদের মতো। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, “কেন? কাল তো আমরা তোমাদের দেখতে পেয়েছিলাম। যেমন তুমি আমার কাছে রয়েছ, তেমন ওদেরও পাব।”
“রানি-র রাজত্ব কেউ খুঁজে পায় না।” অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল বিলালের মুখে, “আমি বোকা— তাই ধরা পড়ে গেছি। রানি বলেনি, পরিরা কেউ বলেনি; কিন্তু দানো-রা বলত, আমি বোকা। তুমিও দানো, তাই তুমিও জানতে যে আমি বোকা। তাই আমায় ধরতে পেরেছ।”
শেষ কথাটা বলার সময় ফুঁপিয়ে উঠল বিলাল। ধীরে-ধীরে তার চোখ থেকে নেমে এল জলের ধারা। থমকে গেল রয়। নিজের রাগটা আপাতত একপাশে সরিয়ে দিল সে।
“বুঝতে পারছি!” নোমুরা-র গলাটা অদ্ভুত… অনেকটা রুদ্ধ শোনাচ্ছিল— যেন এক প্রবল সত্যের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। সেভাবেই তিনি বললেন, “এইবার বুঝতে পারছি। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!”
“কোনটা সাংঘাতিক ব্যাপার? এই ছেলেটা নিজেকে বোকা বলছে— এই কথাটা?”
“না!” নোমুরা”র গলাটা তীক্ষ্ণ শোনাল, “ছেলেটার মস্তিষ্ক সরল— এটা ওই তথাকথিত পরিদের প্রভাবে হয়নি। ও জন্ম থেকেই বুদ্ধিমত্তা এবং অন্য কিছু বিষয়ে স্পেশাল চাইল্ড! আর… আমি যে বারোটি হারিয়ে যাওয়া শিশু-র মেডিকেল রেকর্ড খুঁজে পেয়েছি, তার অধিকাংশেরই কিছু-না-কিছু সমস্যা ছিল— শারীরিক বা মানসিক। এদেরই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।”
“স্পেশাল…” বিদ্যুৎচমকের মতো রয়ের মাথায় একটা প্রশ্ন এল, “মুনিয়াও কি তাই ছিল?”
“হ্যাঁ। মেয়েটির বয়স দশ হলেও তার চেহারার গড়নটা ছিল ছোটোদের মতো। কথাও বলতে পারত না ভালোভাবে। ওর পড়াশোনা থেকে শুরু করে সবকিছুই পাওলি-র কাছে।”
“কিন্তু কেন? কেউ কি এদের দিয়ে নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়তে চেয়েছিল? তার থেকেও বড়ো কথা, মিলিশিয়া বা নেভি এগুলো বিশ্লেষণ করেনি কেন?”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন নোমুরা। পাথরে হেলান দিয়ে ফোঁপাতে থাকা মস্ত বড়ো চেহারার শিশুটিকে দেখল রয়। তারপর সে নোমুরা-র নীচু গলায়, প্রায় ফিসফিস করে বলা কথাগুলো শুনল, “আপনাকে একটু আগেই বলেছি, পরিদের সঙ্গে বড়োদেরও কথা হয়েছে— এর রেকর্ড আছে। সেই কথাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল একটা তথ্য যে শিশুরা আগের থেকে ভালো আছে। আর হ্যাঁ, এদের নিয়ে আরো একটা কথা ওই “পরি”-রা বরাবর বলেছে।”
“সেটা কী?”
“পরিদের রাজত্বে কেউ হারিয়ে যায় না। তবে আগুন নিয়ে তাদের খুঁজলে পাওয়াও যায় না।”
৯
গ্যানিমিড সেন্ট্রাল, অ্যামব্রোজিয়া অর্গ হাসপাতাল, চতুর্থ দিন
“অপারেশনটা কি এক দিন পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব?”
“এ আপনি কী বলছেন!”
চিফ মেডিকেল অফিসারের মুখচোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ভদ্রলোক একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। রুচিরা-র দিক থেকে তিনি এবার ধৃতিমানের দিকে ঘুরলেন। ধৃতিমান একটা শব্দও উচ্চারণ না করে জানালা দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে রইলেন। অসহায়ভাবে সি.এম.ও রুচিরাকেই বললেন, “এই প্রসিডিওরটা করার জন্য সেদিন বিশেষ টিম কাজে লাগানো হচ্ছে। তিনটি জায়গা থেকে সার্জেন আর মেডিসিনের এক্সপার্টরা আসছেন এই অপারেশন আর তার সঙ্গে জড়িত বাকি কাজের জন্য। এ কীভাবে পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব?”
রুচিরা ব্যথিত চোখে ধৃতিমানের দিকে তাকাল। ধৃতিমানের পাথুরে মুখটা একটু-একটু করে নরম হয়ে গেল। তিনি বললেন, “আসলে, ডক্টর…”
“কী?”
“সব অনুমতিপত্রে সই করেছি ঠিকই। কিন্তু আমি… রুচিরা-র অতীত। ওই অপারেশনের সময় অন্য একজনের থাকা দরকার ছিল। এমন একজন— যে রুচিরা-র ভবিষ্যতের সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ মিশিয়ে দিতে রাজি ছিল, আছে, থাকবে।”
“তাহলে তার অবশ্যই সেদিন এখানে থাকা দরকার। কোথায় সে?”
“অনেক দূরে।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ধৃতিমান, “ওই দিনের মধ্যে সে এসে পৌঁছোতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই রুচিরা বলছিল, যদি একদিন পরে ব্যাপারটা করা সম্ভব হয়, তাহলে সে হয়তো এসে যাবে।”
“না প্রফেসর।” একেবারে অনড় ভঙ্গিতে বলে উঠলেন অফিসার, “যে ওইদিন আসতে পারবে না, সে পরেরদিনও এসে না পৌঁছোতে পারে। এভাবে কতদিন অপেক্ষা করব আমরা? খরচাপাতির ব্যাপারটা ছেড়ে দিন। রিপাবলিক প্রশাসন এর দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু আপনার মেয়ের কষ্টটা ভাবুন!”
চুপ করে রইলেন ধৃতিমান। মেয়ের কষ্টটাই তো তাঁকে ভেতরে-ভেতরে ক্ষয় করে চলেছে। শরীরটা একটু-একটু করে অকেজো হয়ে পড়েছে। সেটাকে যন্ত্রের একটা কাঠামোর মধ্যে ভরে রাখা হয়েছে। কিন্তু এবার ওই কালরোগ হাত বাড়িয়েছে রুচিরা-র মস্তিষ্কের দিকে। তাকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় এই অপারেশন। একে তো সত্যিই আর পিছিয়ে দেওয়া যায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নীচু করলেন তিনি।
“তাহলে?”
“আর ঠিক দু-দিন পর এখানেই হবে অপারেশন আর অন্য প্রসিডিওর। দেখুন, যদি সেই মানুষটি তার মধ্যেই এখানে আসতে পারে। না হলে… আমাদের পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব হবে না।”
১০
জোড়া-পাহাড়ের নীচে, বনাইবুরু টেরিটরি, চতুর্থ দিন— দুপুর
আরেহ্! এত বেলা হয়ে গেছে?
সকাল থেকে বহু চেষ্টা করেও বিলালের মুখ থেকে আর একটা শব্দও বের করা সম্ভব হয়নি। ক্লান্তি আর যন্ত্রণার ভাবটা পুরোপুরি কাটানোর জন্য সে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার ফলে যে এতটা সময় কেটে যাবে, এ তো সে ভাবেওনি। নোমুরা তাকে ডাকেননি কেন?
“এখন আপনার শরীর পুরোপুরি ফিট।” নোমুরা-র মিষ্টি গলা ভেসে এল কানে, “এবার আপনি দরকার হলে একদল পরি-র সঙ্গে মারামারি করতে পারবেন। বিলালের সঙ্গে আরেকবার কথা বলুন।”
“আর কী বলব?” রয়ের কণ্ঠে হতাশার ভাগটা চাপা রইল না, “রুচিরা-র অপারেশন হতে টেরা স্ট্যান্ডার্ডে আর মাত্র দু-দিন বাকি। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে, এই কুহেলি সরিয়ে, মা আর মেয়েকে খুঁজে বের করে কীভাবে ফিরব আমি ছায়াপথের ওপারে?”
বুকের কাছের বোতামে চাপ দিল সে। রুচিরা-র মুখটা তার সামনে ভেসে উঠল। এখনকার, বিছানায় মিশে যাওয়া মানুষটি নয়; বরং প্রথম আলাপের সময়কার সেই রোদ-ঝলমলে মুখের মানুষটা হেসে উঠল তার সামনে। চির-অষ্টাদশী সেই মানুষটির হাসির দিকে তাকিয়ে রয়ের বুকের ভেতরটা যেন গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল আবার। জোর করে চোখ বন্ধ করে বোতামে চাপ দিল সে। ছবিটা মুছে গেল সামনে থেকে।
নোমুরা কোনো কথা বলেননি এতক্ষণ; কিন্তু এবার তিনি ফিসফিস করলেন রয়ের কানে, “চোখ খুলুন, রয়। আপনার সম্বন্ধে বিলাল বোধহয় অন্য কিছু ভাবছে।”
চোখ খুলে রয় চমকে গেল। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল বিলাল; তবে সেই দৃষ্টিতে ঘৃণা ছিল না। কৌতূহলী গলায়, সেই সুরেলা, টানা-টানা ভঙ্গিতে সে বলল, “ও কে?”
“আমার বন্ধু।” রয়ের মুখে একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটল, “তাকে ছেড়ে এসেছি অনেক দূরে। কিন্তু তোমার বন্ধুরা ওই দু-জনকে ফিরিয়ে না দিলে আমি তো তার কাছে ফিরতে পারব না।”
বিলাল গোঁজ হয়ে আবার চুপ করে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর সে খুব নীচু গলায় বলল, “আমি জানি না ওরা কোথায় আছে।”
রয় কোনো কথা বলছিল না। তার খুব হতাশ লাগছিল। তার মাথায় অজস্র প্রশ্ন ভনভন করছিল বিরক্তিকর কোনো পোকার ঝাঁকের মতো।
কে এই স্পেশাল চাইল্ডদের নিয়ে যাওয়া শুরু করল তাদের ঘরবাড়ি থেকে? কেন নেওয়া হচ্ছিল তাদের? যদি জঙ্গলে লুকিয়ে থাকাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেখানে তারা কী করছে? আর… ন্যানোবট লাগানো এই বডিস্যুট কে বানাল? থাকতে না পেরে রয় বিলাল-কে বলল, “পরিরা তোমাদের নিয়ে কী করে?”
“আমরা দৌড়োই!” বিলালের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, “হাসি। গান গাই। আকাশ দেখি। মাছ ধরি। কাঠ কাটি। আর আমাদের কেউ কক্ষনও মারে না, বকে না… বোকা বলে না!”
ছেলেটার মুখ কাঁদো-কাঁদো হয়ে উঠছে দেখে রয়ের সত্যিই বিব্রত লাগছিল এবার। নোমুরা তখনও চুপ। বাধ্য হয়ে সেই বলল, “কাল তোমরা ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে— তোমার মনে নেই?”
“ওই ফাটলের ওপাশে।” হাত তুলে দেখাল বিলাল।
“চলো তো, দেখে আসি জায়গাটা।” উঠে দাঁড়াল রয়।
বিলালের কাছে গিয়ে তার মুহূর্তের জন্য দ্বিধা হল। যদি ছেলেটা পালিয়ে যায়? এই অচেনা গ্রহে ছেলেটার পিছু-পিছু যদি সে ছুটতে না পারে? ওষুধ সে খায়নি; শুধু এক্সো-স্যুট থেকে আসা পরিমিত পরিমাণ রাসায়নিক তাকে হেলমেট ছাড়াও স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে দিচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে তার কাছে আর কী-ই বা উপায় আছে?
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বিলালের পায়ের বাঁধন খুলে দিল রয়। তারপর তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল, “চলো। পাহাড়ের ওপাশে যাই আমরা।”
বিলাল অবাক হয়ে বলল, “দানো-রা পাহাড়ের ওপাশে যায় না তো!”
নোমুরা-র কণ্ঠ শোনা গেল, “এই একটা ব্যাপারে বনাইবুরু-র প্রতিটি পরি-বিষয়ক কিংবদন্তি একেবারে একমত। এদিকের এই জোড়া-পাহাড়, আর এখান থেকে অনেকটা দূরের একটা হ্রদ— এর মাঝের জায়গাটাতে কেউ যায় না। অদ্ভুত ব্যাপার হল, মিলিশিয়া, এমনকি নেভিও এই অঞ্চলটাতে কখনো স্কাউটিং করেনি। মনে হয় যেন ওদের মানচিত্রে জায়গাটার অস্তিত্বই নেই।”
“আমি দানো নই।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল রয়, “আমি যেতে পারব। চলো।”
বিলালের একটা হাত আলতো করে ধরে এগোতে শুরু করল রয়। তবে এবার সে মাথায় হেলমেটটা পরে নিল। তৎক্ষণাৎ নোমুরা-র পাঠানো ম্যাপটা তার চোখের সামনে ধরা পড়ল— যেখানে দুটো পাহাড়ের মাঝে ওই ফাঁকের একটু কাছ থেকেই শুরু হয়েছে একটা ফোর্স ফিল্ড। যন্ত্রের চোখে তার গ্রিডগুলো দেখতে পাচ্ছিল সে।
বোঝাই যাচ্ছিল, এই ফিল্ডটা সবসময় থাকে না। একমাত্র অনুপ্রবেশকারী এলে, বা মাথার ওপর ড্রোন চক্কর কাটলেই ফিল্ডটা হয় তাদের বাধা দেয়, নয়তো একইরকম দৃশ্য দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে দেয়। নোমুরা বিশেষ ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন বলেই এই জায়গার ভিন্নতর চেহারাটা তাতে ধরা পড়েছিল।
একটু-একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল রয় আর বিলাল। তবে ফাটলটা যত কাছে এগিয়ে আসছিল, বিলাল ততই ছটফট করছিল। রয় জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
বিলাল কষ্ট-পাওয়া গলায় বলল, “তোমরা আমার জামা খুলে নিয়েছ কেন? ওটা না থাকলে ওখান দিয়ে যেতে গেলে খুব ব্যথা লাগবে আমার।”
মুহূর্তের জন্য রয়ের চোখের সামনে গত রাতের দৃশ্যটা ভেসে উঠল। পাওলি-র ঠিক পেছনে যে পরি… মানুষটি ছিল, সেজন্যই সে দু-হাত বাড়ানোর ভঙ্গিতে ছুটছিল। সে পাওলিকে জড়িয়ে ধরে এই ফাটলটা পার হতে চেয়েছিল, যাতে ফোর্স ফিল্ড তাকে আহত না করে। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে নোমুরাকে বলল, “ছেলেটা তো ঠিকই বলছে মনে হচ্ছে। আপনি কিছু করতে পারবেন?”
নোমুরা-র হাত যে কি-বোর্ডের ওপর একেবারে ঝড়ের বেগে চলছে, সেটা শুনতে পাচ্ছিল রয়। তারই মাঝে দাঁতে দাঁত চেপে নোমুরা বললেন, “স্যাটেলাইট থেকে ওই পাহাড়টার ওপর একেবারে পুরো দমে আক্রমণ চালালে বা ব্লাস্টার দিয়ে আশপাশ গলিয়ে দিলে কিছু করা সম্ভব। কিন্তু হাতে যে ক-টা ড্রোন রয়েছে, তাই দিয়ে এই ফিল্ডকে আমি নিষ্ক্রিয় করতে পারব না। তবে ওটার একটা কন্ট্রোল ধারেকাছেই থাকবে— যেহেতু গ্রিডটা এখান থেকেই শুরু হয়েছে বলে দেখতে পাচ্ছি।”
“সেটা খুঁজে বের করতে পারবেন?”
এমনিতে অত্যন্ত শান্ত মহিলাও এবার প্রায় খিঁচিয়ে উঠলেন, “সেটা খুঁজে পেলে তো এতক্ষণে ঠিক তার ওপর একটা ব্লাস্টার-ফায়ার করিয়েই দিতাম।”
অসহায় ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ দেখল রয়। এক্সো-স্যুটের আড়ালে সে হয়তো এই ফিল্ড সামলে নিতে পারবে; কিন্তু বিলাল? তাকে ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে কি? একরকম মরিয়া হয়ে রয় বলল, “দানোদের আটকানোর জন্য এখানে কে রয়েছে?”
উত্তর না দিলেও বিলালের ভীত দৃষ্টি ধেয়ে গেল একটা পাথরের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে এমনিতে কিছু না বুঝলেও রয় বিলালকে ছেড়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা যাবেই বা কোথায়? পেছনে ক্রিস্টাল আর টিউব দিয়ে একটা ফিল্ড তৈরি করে রেখেছেন নোমুরা— যেটা ও পেরোতে পারবে না। আর সামনে তো ওই মারাত্মক ফিল্ড রয়েইছে।
পাথরটার দিকে এগোনোমাত্র নোমুরা বলে উঠলেন, “হ্যাঁ! এখানে কিছু একটা আছে। আরো কাছে এগিয়ে যান। আমি স্ক্যান করছি।”
আরো কাছে এগিয়ে যেতেই রয় দেখল, যেটা একটাই মস্ত বড়ো পাথর বলে মনে হচ্ছিল, আসলে তার গায়ে সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম কয়েকটা চিড় রয়েছে। তার ঠিক পাশেই কোনো-কোনো জায়গা যেন সামান্য উঁচু হয়ে রয়েছে বলে তার মনে হল। ওগুলো কি টিপে দেখবে সে?
“দাঁড়ান!” রয়ের মনোভাব বুঝে নোমুরা তাকে আগেই সতর্ক করলেন, “আমাকে পুরোটা একবার দেখতে দিন। ক-টা করে ওই উঁচু অংশ রয়েছে প্রত্যেক চিড়ে?”
গুনতে গিয়ে দুই, তিন, সাত— এই ক-টা পেল সে। পরের চিড়ে এতগুলো ওইরকম উঁচু অংশ ছিল যে তার বারবার গুলিয়ে যাচ্ছিল।
“তেতাল্লিশ!” নোমুরা-র তৃপ্ত কণ্ঠ ভেসে এল, “এটা ইউক্লিড-মালিন সিকোয়েন্স। সচেতনভাবে এই বিন্যাসটা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু… এক মিনিট! পঞ্চম চিড়ের নীচে যান তো একবার।”
রয় দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখল, একটা গোলাকার অংশের মধ্যে, পাথরের সঙ্গে প্রায় মিশে আছে একটা কি-প্যাড!
“এটাকে লুকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে রিপাবলিকের স্ক্যানারকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। ওই কি-প্যাডটার কাছে যান। জিনিসটা দেখা দরকার।”
আদেশ পালিত হওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন নোমুরা, তারপর বললেন, “ডান দিকের নীচের বোতামে চাপ দিন। তারপর একদম দেরি করবেন না! যেমন বলব, সেই সংখ্যাটা টাইপ করবেন।”
বাধ্য ছাত্রের মতো ঝুঁকে তৈরি হয়ে রইল রয়। ডান দিকের নীচের বোতাম টিপতেই ছোট্ট স্ক্রিনটা সবুজ হয়ে উঠল। নোমুরা বলতে লাগলেন, “তেরো! তিপ্পান্ন! পাঁচ! বাষট্টি লক্ষ একুশ হাজার ছশো একাত্তর!”
ধাতু আর পাথর মেশানো একটা অদ্ভুত আওয়াজ তুলে পাথরের গায়ের একটা অংশ সরে গেল। পেছনে দেখা দিল একটা ধাতব প্লেট। তার গা থেকে তীক্ষ্ণ ছুঁচের মতো একটা জিনিস বেরিয়ে ছিল। ভয় পেয়ে একপাশে সরে গেল রয়; তবে কোনো ব্লাস্টারের আঘাত বা অন্য কিছু ছুটে এল না সেখান থেকে। কাছে গিয়ে সে দেখল, ধাতব প্লেটের ওপর কনফেডারেশনের নিজস্ব— এখন বাতিল হয়ে যাওয়া লিপিতে কিছু লেখা আছে।
“কে এল?” ফিসফিস করলেন নোমুরা। রয়ের হঠাৎ খেয়াল হল, ছোটোবেলা থেকে এই লিপিই তো ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানী। নোমুরা পড়ছিলেন, “যদি সত্যিই তুমি এসে থাক, তাহলে পরীক্ষা দাও। তবেই তো বুঝব…”
নোমুরা-র কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। রয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চিন্তিত গলায় জানতে চাইল, “কী হল, ডক্টর?”
বিজ্ঞানী অস্ফুটে বললেন, “দুই শরীর— একটিই মন।”
“মানে?”
“ওই শেষের অংশটুকু আমার মাতৃভাষায় লেখা হয়েছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, এই কথাটা আমি ছোটোবেলায় শুনেছি। কার সঙ্গে যেন…”
অধৈর্য হয়ে রয় বলে উঠল, “সে না হয় হল। কিন্তু ওই ফিল্ডটা সরাব কী করে? আপনি কি এখানেই, মানে এই পাতটার ওপর একবার স্যাটেলাইট থেকে লেজার-স্ট্রাইক করাবেন?”
“না।” নোমুরা নিজেকে সামলে নিতে-নিতেই বললেন, “আপনার স্যুটের ডান হাতের আঙুলের ঠিক সামনেটা চাপ দিন।”
রয় আদেশ পালন করল। সেখান থেকে স্পঞ্জের মতো একটা অংশ বেরিয়ে এল, যাতে এক বিন্দু তরল টলমল করছিল। নোমুরা নীচু গলায় বললেন, “আমি যা ভাবছি তা সত্যি হলে ওই ছুঁচটা ডি.এন.এ টেস্ট করবে। আপনি সেই পরীক্ষায় পাশ করবেন না; কিন্তু আমি বোধহয় করব। তাই আপনার স্যুটের রিসাইক্লার থেকে তৈরি করা ম্যাট্রিক্সে আমি আমার জিনের চিহ্ন রেখে দিয়েছি। দেখা যাক, এই প্রহরী আমাকে চিনতে পারে কি না।”
স্পঞ্জটা সুঁচের গায়ে চেপে ধরতেই সেটা দ্রুত পিছিয়ে গেল পাতের পেছনে। প্রায় দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল রয়। অবশেষে মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ তুলে সরে গেল পাতটা। পেছনে থাকা সুইচ আর লিভারগুলো দেখতে পেল রয়। হাতের ইনসুলেশনটা দেখে নিয়ে উঠে থাকা লিভারগুলোকে একে-একে নামিয়ে দিল সে।
“ফিল্ড সরে গেছে!” নোমুরা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “কিন্তু… রয়!”
কিছু বোঝার আগেই পেছন থেকে সাংঘাতিক ধাক্কা খেল রয়। সরে যাওয়া প্লেটের পেছনের জায়গাটাতে, সুইচ আর লিভারের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। সঙ্গে-সঙ্গে প্লেটটা সরে এল তার পেছনে। পেছন ঘুরতে-ঘুরতে, বন্ধ হতে থাকা প্লেটের পাশ দিয়ে রয় দেখল, দু-হাত বাঁধা অবস্থাতেও প্রাণপণে ওই ফাটলের মধ্য দিয়ে ছুটে পাহাড়ের ওদিকে চলে যাচ্ছে বিলাল!
১১
ইউরি ২.২, তিস্তানের কক্ষপথ, চতুর্থ দিন
দাঁতে দাঁত চেপে কি-বোর্ডে ঝড় তুলেছিলেন নোমুরা। কোডেরা অবিশ্রান্ত ধারায় বয়ে যাচ্ছিল তাঁর আঙুল হয়ে, উপগ্রহের প্রধান কম্পিউটারের মধ্য দিয়ে তিস্তানের নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা যন্ত্রদের দিকে।
রয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হলেও হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। চোখের জল উপেক্ষা করে, বুকের ভেতর হওয়া জ্বালাকে পাত্তা না দিয়ে কাজ চালিয়ে যাবেন তিনি।
ওই পাহাড়টা হয় জ্যামারের মাধ্যমে, বা অন্য কোনোভাবে তাঁর নাগালের বাইরে রয়েছে। কিন্তু গ্রহের বাকি সবকিছু এই মুহূর্তে তাঁর আজ্ঞাবহ। পরে সবাইকে সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যাবে; কিন্তু আপাতত তিনি পাহাড়টার চারপাশ একেবারে ঘিরে ফেলবেন সশস্ত্র ড্রোন দিয়ে। তারই সঙ্গে পাহাড়ের ওপাশের অঞ্চলটা নিয়ে এখনো অবধি যা-যা জেনেছেন তিনি, তার সবটা বিশ্লেষণ করতে হবে।
জায়গাটা দেখে যত সরল বলে মনে হয়, আদৌ তেমন নয়। মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে, পাহাড় আর টিলাগুলোতে যে কিছু যন্ত্র বসানো আছে— সেটা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। জিনিসগুলো সম্ভবত সৌরশক্তিতে চলে। কয়েকটা হয়তো মাটির গভীর থেকে তাপ আহরণ করে। তবে সেগুলো একটা বেশ জোরালো ফিল্ড তৈরি করেছে। ওপর দিয়ে যাওয়া স্যাটেলাইটের রুটিন পর্যবেক্ষণে ওই অঞ্চলের বিশেষত্ব বোঝা যায় না। কিন্তু ড্রোনগুলোর মাধ্যমে খুঁজে-খুঁজে সেই ফ্রিকোয়েন্সিটা নোমুরা বের করতে পেরেছেন— যা দিয়ে ফিল্ডটা তৈরি হয়েছে। ওটা নিষ্ক্রিয় করতেও তাঁর সমস্যা হয়নি।
পরের উড়ানের সময় স্যাটেলাইট থেকে ফোটো তুলিয়ে সেগুলো রয়-কে পাঠিয়েছিলেন নোমুরা। কিন্তু এবার নিজে সেটা ভালোভাবে দেখতে গিয়ে তিনটি বুঝলেন, বনাইবুরুর বাকি জায়গার মতো প্রাইমারি ফরেস্ট নয় এটা। কোনো একসময়ে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জঙ্গল সাফ করে এখানে কিছু একটা হয়েছিল। চাষ-আবাদ? উঁহু। জনবসতি? তাও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অনিগুনাস থেকে এত দূরে এতটা জায়গা জুড়ে কারা থাকতে আসবে? এখানে কাউকে তেমন অধিকার দেওয়া হয়েছে বলেও তো কোনো রেকর্ড নেই।
তাহলে কি এখানেই ছিল কনফেডারেশনের সায়েন্টিফিক ক্যাম্প? নিশ্চয় তাই। পাহাড়ের নীচে ওই কন্ট্রোল-বক্সের ব্যবস্থা তো সেটাই দেখায়। ওটা কি বাবা-র বানানো?
মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হলেন নোমুরা। পরক্ষণেই নিজেকে একরকম ঝাঁকিয়ে আবার স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়লেন তিনি। এই অন্যমনস্কতার জন্যই বিলাল যে কখন রয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটা তিনি খেয়ালই করেননি। যখন তার মতলবটা তাঁর বোধগম্য হয়েছিল, তখন আর…
কিন্তু কনফেডারেশন তো ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলেছিল। তার খবর এখন কার কাছে পাওয়া যাবে? শুধু যদি…
আবার কি-বোর্ডের দিকে মনোযোগী হলেন নোমুরা। একের পর এক লেভেল ঘুরে, নিজের ক্লিয়ারেন্স কাজে লাগিয়ে, বট্-দের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে তিনিও তথ্যের সুড়ঙ্গে ঢুকলেন একটাই আশা নিয়ে।
তাঁর বাবা আর মা অত্যন্ত গোপন কিছু সায়েন্টিফিক মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একসময়। অন্তত বড়ো হতে-হতে তাই জেনেছেন নোমুরা। সেক্ষেত্রে এই মিশনটিও সাধারণ পর্যবেক্ষণ বা টেরাফর্মিঙের বদলে অন্য কিছু নিয়েই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তেমন হলে কনফেডারেশন এই মিশনের যাবতীয় তথ্য আর পর্যবেক্ষণ ক্লাসিফায়েড করে দিতে বাধ্য। যুদ্ধের পর কনফেডারেশনের সম্পূর্ণ ক্লাসিফায়েড তথ্যভাণ্ডার নিজের কবজায় নিয়েছিল রিপাবলিক। সেখানেই যদি কিছু পাওয়া যায়।
এই তো! শুধু জেনারেল করিম নন, লু-শাও-এরও অনুমতি থাকার ফলে ডেটাবেসে ঢুকতে পেরেছিলেন তিনি। তাতেই তো রয়েছে তিস্তান নিয়ে রিপোর্ট। আর… এ কী? এই ফোল্ডারের নামই তো “মিশন পরি!”
দু-হাত ঘষে সামনে ঝুঁকে পড়লেন নোমুরা। রুটিন আর সাব-রুটিন দিয়ে তিনি ব্যবস্থা করেছেন, যাতে রয়ের তরফ থেকে সামান্য সাড়া পাওয়া মাত্র ড্রোনগুলো কাজ করতে পারে। এবার তিনি দেখবেন, কোন রহস্য লুকিয়ে আছে বনাইবুরুর জোড়া-পাহাড়ের ওপাশে। কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে তিনি দরকার হলে আদেশ দেবেন, ওই অঞ্চলে এখনই অপারেশন চালানোর জন্য।
পরিরা বুঝবে, উওজিলি নোমুরা রেগে গেলে কী হয়!
১২
জোড়া-পাহাড়, বনাইবুরু টেরিটরি, চতুর্থ দিন
“ডক্টর নোমুরা! শুনতে পাচ্ছেন?”
হতাশভাবে বসে পড়ল রয়। দঁড়িয়ে থাকলে আরো বেশি রাগ হবে, দুঃখ হবে, ক্লান্ত লাগবে। বরং ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতিটা ভাবা দরকার।
ওই গ্রিড তথা বৈদ্যুতিক বেড়ার কন্ট্রোল-বক্সে আটকা পড়ে গেছে সে। তার চারপাশে এমন কিছুর আবরণ আছে, যেটা তার বার্তাকে বেরিয়ে নোমুরা-র কাছে যেতে দিচ্ছে না। নোমুরা-র কোনো কথাও সে শুনতে পাচ্ছে না। বাইরে থেকে আসা কোনো তথ্য বা ছবিও হেলমেটে দেখা দিচ্ছে না। অর্থাৎ এই মুহূর্তে সে নোমুরা-র সাহায্য পাবে না। বিজ্ঞানী এতক্ষণে অন্তত একটা ড্রোনকে কাছেই নিয়ে এসেছেন নিশ্চয়। কিন্তু লেজার ফায়ার করার ঝুঁকি তিনি নেবেন না— পাছে তাতে রয়ের কোনো ক্ষতি হয়।
তাহলে উপায় একটাই। এই কন্ট্রোল বক্সের লিভারগুলোকে উঠিয়ে-নামিয়ে এটাকে খুলতে হবে। কিন্তু গ্রিডটা আবার চালু হয়ে গেলে সেটাকে যদি সরানো না যায়? বা এদিক থেকে লিভার নাড়াচাড়া করার জন্যও যদি নোমুরা-র জিনের প্রতিলিপি প্রয়োজন হয়?
নোমুরা-র জিন… তার মানে এই কন্ট্রোল-বক্স, হয়তো এই পাহাড়ের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাই বিজ্ঞানীর বাবা আর মা-র নেতৃত্বে তিন দশক আগে তৈরি করা হয়েছিল। তাহলে পরি মানে কি কনফেডারেশনের একটা গোপন দল, যারা এখানে লুকিয়ে প্রত্যাঘাতের সুযোগ খুঁজছে? কিন্তু রিপাবলিকের কাছে এই নিয়ে কোনো খবর থাকবে না— এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। সবচেয়ে বড়ো কথা, স্পেশাল চাইল্ডদের তুলে নিয়ে নিজেদের কাছে রেখে কী করতে চাইছে তারা?
নোমুরাই বা বিলালের ওপর নজর রাখেননি কেন? অবশ্য নিজের হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সঙ্গে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলে যে কেউ ভাববিহ্বল হয়ে যাবে। তবু…
মাথাটাকে ঝাঁকিয়ে পরিষ্কার করে নিতে চাইল রয়। এ-সব ভেবে লাভ নেই। বরং বেরোনোর চেষ্টা করতে হবে। অভ্যাসবশে স্যুটের চার্জ এবং বাকি জিনিসগুলো একবার দেখে নিল সে।
যাক! এ-দিক দিয়ে সে নিরাপদ। অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা তাকে ভালোভাবেই বাঁচিয়ে রাখতে পারবে এক্সো-স্যুট। তার মধ্যে নোমুরা নিশ্চয় কিছু-না-কিছু করবেন। তবে ইতিমধ্যে পাওলি আর মুনিয়াকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আরো কমে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে যাবে। নেভি-কে এই কনফেডারেশনের একটা গোপন শিবির থাকার সম্ভাবনাটা বললে তারা পুরোদমে পরিদের খুঁজতে লেগে পড়বে। কিন্তু সে গ্যানিমিডে ফিরবে কবে?
এবার কিন্তু রয়ের মন এই প্রশ্নটাকে অন্যভাবে নিল। মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে সামনের প্লেটটাকে খুঁটিয়ে দেখল। কিছুক্ষণের পর্যবেক্ষণের পর সে বুঝল, দেওয়াল থেকে জিনিসটা যেভাবে বেরিয়ে এসে আবার দেওয়ালে ঢুকে গেছে, তাতে বিস্ফোরক ব্যবহার করে পাথর না ভাঙলে একে আলগা করা যাবে না। অর্থাৎ জোর-জবরদস্তির চেষ্টা করে লাভ নেই।
লিভার আর সুইচগুলো একে-একে ওঠাতে-নামাতে শুরু করল রয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এমনকি ভেতরের অংশটাতে কোনো আলোও জ্বলছিল না। স্যুটের নরম আলো ছাড়া ওই কন্ট্রোল-বক্সের মধ্যে দেখার কোনো উপায়ই ছিল না। হতাশ হয়ে রয় ভাবল, জিনিসটা কী খারাপ হয়ে গেল?
যন্ত্রপাতি খারাপ হতেই পারে। সত্যি বলতে কি, ওগুলো খারাপ না হলেই বরং অবাক হতে হয়। কিন্তু এগুলোর মেরামত করার জন্য কনফেডারেশন বা অন্য কেউ পাহাড়ের দিক দিয়ে নিশ্চয় লোকেদের পাঠাত না। মেরামতের কাজ পেছন দিক দিয়েই হয়। তাহলে… এই লিভার আর সুইচের পেছনে কী আছে?
স্যুটের আলো আরো জোরালো করে তুলল রয়। তারপর দেওয়াল থেকে শুরু করে পেছনের অংশ— সবটা খুঁটিয়ে দেখল সে। প্রতিফলিত আলো দেখিয়ে দিল, পাথরের ওপর ধাতু আর ফাইবারের মিশ্রণ দিয়ে একটি প্রলেপ দেওয়া হয়েছে— সম্ভবত এই ব্যবস্থাটিকে বাইরের প্রকৃতির প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য। আর একদম পেছনের অংশে দেওয়ালের গায়ে মিশে রয়েছে ধাতু আর ফাইবারের ওই মিশ্রণ দিয়েই তৈরি একটি দরজা!
আর দেরি করল না রয়। এক্সো-স্যুট কাজে লাগিয়ে সে বের করল, ঠিক কোথায়-কোথায় আঘাত দিলে জিনিসটাকে সরিয়ে দেওয়া যাবে। দরজার ওপাশে কী আছে, তা তার জানা নেই ঠিকই। তবে যাই থাকুক না কেন, সে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেবে। অন্তত এই ঘরে বন্দি হয়ে সে আর থাকবে না। এই ফাইবার আর ধাতুর ইনসুলেশনের জন্যই হয়তো নোমুরা-র সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তবে এর বাইরে গেলে সে নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারবে।
সাংবাদিকদের স্যুটে ব্লাস্টার থাকে না। তবে সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলগুলোতে যারা আসেন, তাঁরা আটকে পড়া বা অন্য সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য কিছু জিনিস রাখার অনুমতি পান। কার্বোরান্ডাম-বসানো একটা ছোট্ট ড্রিল রয়ের সঙ্গে ছিল সেভাবেই। ঘণ্টা খানেক ধরে, যথাসম্ভব কম আওয়াজ করে, ওই ড্রিল দিয়ে অনেকগুলো ফুটো করল সে। দরজাটা প্রায় পারফোরেটেড হয়ে গেল তার ফলে! তারপর সজোরে ধাক্কা দিতেই সেটার একটা অংশ ও-পাশে পড়ে যাচ্ছিল। হাত বাড়িয়ে কোনোমতে জিনিসটাকে ধরল সে। ওটাকে ভেতরে এনে শুইয়ে বাইরে তাকাতেই দেখা গেল অন্ধকার। আলো জ্বালাতে ভরসা পেল না রয়। স্যুটের থার্মাল ভিশন থেকে এটুকু বোঝা গেল যে দরজার বাইরেই রয়েছে একটা ছোট্ট সমতল অংশ; থেকে অনেকটা নীচে রয়েছে একটা করিডরের মতো অংশ— যার দু-দিকেই রয়েছে অতলস্পর্শী খাদ। পাথরের গায়ে বসানো হাতল ধরে সেই করিডরে নামতে হয়।
রয় মনে-মনে ভাবল, ভাগ্যিস বদ্ধ জায়গায় থাকা নিয়ে তার কোনো মানসিক সমস্যা নেই! নইলে দরজা ভেঙে সে হুড়মুড়িয়ে ওপাশে যেতে চাইতই। সেক্ষেত্রে ছোট্ট জায়গাটা পেরিয়ে নীচে পড়া একরকম অবধারিত ছিল। এক্সো-স্যুট কিছুটা সামলালেও অতটা নীচে পড়লে… বিস্তর সময় যে লাগত— এ-নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
সাবধানে হাতলগুলোতে হাত আর পা রেখে নীচের করিডরে নেমে এল সে। সম্পূর্ণ গঠনটা তার সামনে স্পষ্ট হল এবার।
একটানা করিডর নয়, সে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে ধাপে-ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে অনেক নীচের অন্ধকারে। তাপমাত্রার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ জায়গাটাই নীল-কালো হয়ে ছিল বলে সে বুঝল, এই জায়গায়, অন্তত এই মুহূর্তে আর কোনো জনপ্রাণী নেই। থাকলে ওই ড্রিল আর স্যুটের তার দিয়ে সে তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারত কি না, তাই নিয়ে মাথা ঘামাল না রয়। বরং সে সিঁড়ি ধরে নীচে নামতে শুরু করল।
নোমুরা-র সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না সে। রিসিভার একেবারে নীরব; তথ্যের কোনো প্যাকেটও এসে পৌঁছোচ্ছিল না তার কাছে। তাহলে কি পাহাড়ের ভেতরে এই জায়গাটাতে নেভি-র রিসিভার আর অন্য স্টেশনগুলোর সিগনালই আসে না? নাকি জ্যামারের মতো কিছু লাগানো আছে এখানে? কিন্তু সেটা থাকলে গ্রিডটা চালু করা যেত না।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতেই রয় বুঝতে পারছিল, ত্রিশ বছর নয়, তার থেকে অনেক-অনেক বেশি বয়স এই কেটে-কেটে তৈরি করা ধাপগুলোর। তাদের ওপর ধুলোর পুরু স্তর পড়েছে। নেহাত জল ঢুকতে পারেনি, না হলে এই অন্ধকারেও পোকামাকড় বসতি করত। সে-সব কিছুই নেই। আর তার থেকেই বোঝা যায় যে এই দিক দিয়ে যাতায়াত করা হয় না। সেক্ষেত্রে কনফেডারেশন, বা পরি-রা গ্রিডটাকে চালায় দূর থেকে, সিগনালের মাধ্যমেই। কিন্তু কীভাবে?
পরে ভেবে দেখা যাবে। আপাতত দেখতে হবে, এই সিঁড়ি কোথায় যায়।
সাবধানে, ফাটল বা অন্য কোনো বিপদের সম্ভাবনা মাথায় রেখে নীচে নামছিল রয়। সিঁড়ির বাঁ দিকে ছিল খাদের মতো খালি আর গভীর শূন্যতা। তার একটু পরে বাঁ দিকের দেওয়াল— তথা পাহাড় খুব কাছে এগিয়ে এল। একটা পাথরের সেতুর মতো অংশ এই সিঁড়িকে দেওয়ালের মধ্যে নিয়ে গেল। তারপর দেওয়ালের ভেতর দিয়ে সিঁড়িটা এমনভাবে নেমে গেল যে একবারে তাতে একজনই উঠতে বা নামতে পারে।
দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে ভেতর ঢুকে নামার আগে নিজের চারপাশটা আরো একবার ভালো করে বুঝতে চাইল রয়। মাথার উপরে একটা ফিকে আলোর আভাস দেখা যাচ্ছিল। রয় অনুমান করতে পারল, ওখানে পাহাড়ের গায়ে একটা ফাটল আছে। সম্ভবত বাইরে থেকে দেখে যাকে একটাই পাহাড় বলে মনে হয়, সেটা আদতে অনেকগুলো গঠনের সমষ্টি। কোনো কৃত্রিম আবরণ সেগুলোকে ওপর দিক দিয়ে জুড়ে রেখে বিভ্রমটাকে জোরালো করে তোলে। তবে সেই আবরণ ধাতু আর ফাইবারের মিশ্রণ দিয়েই তৈরি নিশ্চয়। পাথরের মতো ভারী জিনিস নিয়ে কাজ করা এখানে সহজ নয়।
ওখানে পৌঁছোতে পারলে ড্রিল করে সে বেরিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু অতটা উঁচুতে সে উঠবে কীভাবে? একবার যদি নোমুরা-কে খবরটা পাঠানো যেত! হতাশ ভঙ্গিতে সিঁড়িতে ঢুকে পড়ল রয়। বেশ কয়েক ধাপ নামার পর, পরের পা-টা ফেলতে গিয়েই থমকে গেল রয়।
অনেক নীচ থেকে কি একটা শব্দ এল?
গভীর অন্ধকারে, এক্সো-স্যুটের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে যথাসম্ভব কাজে লাগিয়েও ঠিক নিশ্চিত হতে পারল না সে। তবে… হাওয়ায় একটা মৃদু আলোড়ন অনুভব করল এক্সো-স্যুট। অতি সূক্ষ্ম সেই তারতম্য বদলাতে থাকা অক্ষর আর সংখ্যার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিল, পাহাড়ের মধ্যে এই সিঁড়ির অন্য প্রান্তে কিছু একটা ঘটেছে।
সে আর একা নয়!
মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিল রয়। তার কাছে এমন কোনো অস্ত্র নেই যা নিয়ে একদল শত্রুর মোকাবিলা করা যায়। তাকে উপরেই উঠতে হবে। ওই ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিলে ইঁদুরের মতো মরতে হবে অবশ্য। তবে ওই অকেজো হয়ে থাকা যন্ত্রটাকে চালু করতে পারলে কিছু একটা রাস্তা বেরোবেই।
সিঁড়ি ধরে উপরদিকে ছুটতে শুরু করল রয়।
পেছনে যে বা যারাই আসুক না কেন, তাদের কাছেও এটা বোধহয় অচেনা জায়গাই হবে। এই ভরসা থাকা সত্বেও নিজের নিরস্ত্র অবস্থাটা রয়কে আরো, আরো জোরে ছুটতে বাধ্য করছিল। স্যুটের মধ্যেও সে নিজের ঘামের বিনবিনে স্পর্শ অনুভব করতে পারছিল। অ্যাড্রেনালিন আর শ্রমের মিশ্রণ তাকে অচিরেই ফিরিয়ে আনল কন্ট্রোল-বক্সের দরজার মুখে। কিন্তু এবার?
একটা অস্ত্র জোগাড় করা দরকার। একরকম মরিয়া হয়ে রয় কাছের লিভারটা সর্বশক্তি দিয়ে উপরে টানার চেষ্টা করল। কিন্তু জিনিসটা নড়লও না। হতাশ হয়ে এবার সে ওটাকে নীচে নামানোর চেষ্টা করল। তখনই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ঘরের ওপরদিকের একটা অংশে সবজেটে আলো ঝলসে উঠল একবার।
থমকে গেল রয়। এই জিনিসটার অর্থ সে জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ধৃতিমানের ল্যাবে নানা ধরনের বিদঘুটে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে সে আর রুচিরা প্রায়ই সেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটাত। ধৃতিমান পরে সবটা জেনে রাগে থমথম করলেও, কেন যেন, ওদের বকাবকি করতেন না। সেই সময় এনার্জি সেল নতুন করে চালু হওয়ার আগে এইরকম আলো তুলে দপ্-দপ্ করত। এর অর্থ, কোনোভাবে এই কন্ট্রোল প্যানেলে একটু হলেও শক্তি জোগাতে পারলে জিনিসটা আবার কাজ করবে।
তাই তো!
বহুদিন ধরে এই লিভার আর সুইচের ব্যবহার কেউ করেনি। হয়তো ওপরে বা অন্য কোথাও বসানো সোলার প্যানেল দিয়ে কিছুটা হলেও শক্তি আহরণ করেছে এই যান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু এটির সাহায্যে গ্রিড সরাতে গিয়ে সেই জমানো শক্তিটা খরচ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। হয়তো আবার এটা কাজ করবে। কিন্তু এর কিছুটা শক্তি দরকার।
এবার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেল রয়। একজন নয়, অনেকের পায়ের শব্দ! এই নিস্তব্ধ পরিবেশের মধ্যে তারা হয়তো এখনো অনেকটা দূরে আছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তারা এগিয়ে আসছে এদিকেই!
মরিয়া হয়ে এক্সো-স্যুটের জোরালো আলোটা জ্বালিয়ে লিভার আর সুইচগুলো দেখল রয়। নিজের চোখের ওপর ভরসা না করে সে হেলমেটের স্ক্যানার প্রয়োগ করল বিভিন্ন অংশকে চিহ্নিত করতে। তাতেই দেখা গেল একটা ইউনিভার্সাল পোর্ট!
উত্তেজনায় কাঁপতে-কাঁপতে নিজের স্যুটের লাইনিং থেকে তারটা বের করল রয়। ওটা দিয়ে বেশ কয়েক ধরনের পোর্টে প্লাগ-ইন করা যায়। এরই সরু, লম্বা অংশটা গতকাল রাতে সে কাজে লাগিয়েছিল বিলালের বিরুদ্ধে।
বিলাল! সেই কি রয়ের খবর দিয়েছে পরিদের কাছে? ছোকরাকে হাতে পেলে… কিন্তু পায়ের শব্দগুলো কি আরো কাছে এসে পড়ল এরই মধ্যে?
সাবধানে, মাথা যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে পোর্টে স্যুটের তারটা ঢোকাল রয়। তারপর নিজের স্যুট থেকে একটা পালস্ পাঠাল সে। স্যুট জানাল, পনেরো মিনিটের মতো শক্তিক্ষরণ হয়েছে; কিন্তু ওপরের প্যানেলে কোনো আলো দেখা গেল না। মরিয়া হয়ে রয় এবার দুটো পালস্ পাঠাল, তারপর চারটে। অবশেষে, ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার অবস্থায় পৌঁছোনোর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে পরপর দশটা পালস্ পাঠাল সে।
ঝলসে উঠল ওপরের প্যানেল। তারই সঙ্গে একটা মস্ত বড়ো হৃৎস্পন্দনের মতো গুঞ্জন শোনা গেল লিভার আর সুইচগুলোর গভীর থেকে। নিজেকে সামলে নিয়ে, ডান দিকের নেমে থাকা লিভারটাকে উপরে তুলল রয়।
গুরুগুরু একটা শব্দ যেন গোটা পাহাড়কেই কাঁপিয়ে তুলল। রয় চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখল, প্লেট সরেনি। তাহলে? তখনই দুটো জিনিস সে বুঝতে পারল।
প্রথমত, কন্ট্রোল-বক্সের বাইরের অন্ধকার কমে গিয়ে সেখানটা আগের তুলনায় অনেকখানি স্পষ্ট করে তুলেছে বিকেলের আলো। তাতে দেখা যাচ্ছে, ঘোরানো সিঁড়ির শেষ প্রান্তের কাছে এসে গেছে জমাট অন্ধকারের মতো কালো বেশ কিছু চেহারা। তারা অত্যন্ত দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।
দ্বিতীয়ত, বন্ধ থাকা কান খুলে যাওয়ার মতো করে তার কানের কাছে স্পিকারটা হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারই সঙ্গে হু-হু করে ঢুকতে শুরু করেছে আপডেট আর অন্য নানা তথ্য।
“ডক্টর নোমুরা!” চিৎকার করে উঠল রয়।
নোমুরা কথায় সাড়া দিলেন না, তবে তাঁর উত্তর এল অন্যভাবে। তীব্র উজ্জ্বল সোনালি আলোয় ভেসে গেল পাহাড়ের ভেতরের এই জায়গাটি। তারই সঙ্গে শোনা গেল প্রবল গুঞ্জনের মতো একটা শব্দ।
“যে বা যারা নড়ার চেষ্টা করবে, এই মুহূর্তেই তাদের ওপর ব্লাস্টার ফায়ার করা হবে!”
হাসিখুশি, মিষ্টি স্বভাবের বিজ্ঞানীর এই গলা কোনোদিন শোনেনি রয়। তবে কাটা-কাটা ভঙ্গিতে বলা কথায় কাজ হল। সিঁড়িতেই থমকে গেল বেশ কয়েকজন। রয় এগিয়ে গেছিল বলে দেখতে পেল, পাথরের সেতুটা পেরিয়ে একজন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তৎক্ষণাৎ লেজার রশ্মি আঘাত হানল তার ঠিক সামনেই। গলে গেল পাহাড়ের গায়ের পাথরের কিছুটা অংশ! একেবারে চিত্রার্পিতের মতো থমকে গেল সেই “পরি” বা তাদের প্রতিনিধিটি।
একটা মস্ত বড়ো শ্বাস ফেলে রয় ওপরদিকে হাত তুলে বোঝাল, সে ঠিক আছে। এইবার পরিদের রাজ্যটা বের করতে হবে তাদের, তারপর পেতে হবে পাওলি আর মুনিয়াকে।
কিন্তু তার হাতে আর কতটা সময় আছে?
১৩
পরির রাজ্য, বনাইবুরু টেরিটরি, চতুর্থ দিন— রাত
তিনটে মিলিটারি ড্রোনের আলোতে দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে ছিল অনেকটা জায়গা। সেখান দিয়ে এগিয়ে চলছিল বেশ কিছু মানুষ।
কালো বডিস্যুট পরা নারী ও পুরুষদের প্রত্যেকের হাত বাঁধা ছিল। দুটো পাহাড়ের মাঝের ফাঁকে অবস্থান করছিল নেভির একটা ইউনিট। সর্বোপরি একটা আস্ত উপগ্রহ অনেক নীচে নেমে এসে কড়া নজরে রেখেছিল সবাইকে। তবু রয় ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না।
লোকমুখে এটা পরির রাজ্য নামেই পরিচিত। কেউ আসে না এখানে। ক্যামোফ্লেজের কল্যাণে নেভিও জায়গাটার মহিমা বোঝেনি এতদিন। কিন্তু এবার, নোমুরা-র মাধ্যমে সবটা বুঝতে পেরে তারা তৎক্ষণাৎ এখানে ঢুকতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রথমে নেভি, পরে অনিগুনাস প্রশাসন আর মিলিশিয়ার যৌথ চাপ উপেক্ষা করেছিল রিপাবলিক। কঠোর আদেশ এসেছিল, “মিশন পরি”-র ব্যাপারে নোমুরা-র সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সেই অনুযায়ী একা, নিরস্ত্র রয়ই এই দলটির সঙ্গে ঢুকেছিল এলাকায়।
এক্সো-স্যুট এই অঞ্চলে অন্য কোনো মানুষের অস্তিত্ব এখনো খুঁজে পায়নি। তবে এখানে যে বহু যন্ত্র আছে, আর তারা যে কাজও করছে— সেটা ধরা পড়ছিল স্ক্যানারে। মনে-মনে কনফেডারেশনের প্রযুক্তিবিদদের প্রশংসা করতে বাধ্য হল রয়। প্রায় তিন দশক পরেও যাদের যন্ত্রগুলো ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করে, তাদের তারিফ জানাতেই হয়। কিন্তু ঠিক কী করছিল এরা?
“আমি আপনাকে পরে বলব।” কিছুটা রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিলেন নোমুরা, “এখন আগে ওদের হাত-পা বাঁধুন। ওরা বাধা দিতে পারবে না। যত চালাক-চতুরই হোক না কেন, একজনের হঠকারিতার মাধ্যমে সঙ্গীদের জীবন বিপন্ন করবে না ওরা। তারপর ড্রোন থেকে নামিয়ে দেওয়া হেলমেটটা একজনের মাথায় পরান। এবার আমি কথা বলব!”
রয় বুঝে গেছিল, আর কোনো প্রশ্ন করা বৃথা। নির্দেশগুলো পালন করেছিল সে। আর তারপর…
হেলমেটের মধ্য থেকে কোনো শব্দ আসেনি। তবে নোমুরা-র কথা শুনে যে পুরুষ… ছেলেটির চোখ একেবারে বিস্ফারিত হয়ে গেছিল— এটুকু সে দেখেছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর নোমুরা-র নির্দেশে হেলমেট সরিয়ে নিয়েছিল সে। তারপর শুরু হয়েছিল এই দলের সবার মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধরে আলোচনা বা গুজগুজ-ফুসফুস। অধৈর্য লাগলেও নিজেকে সামলে রেখেছিল রয়। নোমুরা সেই অচেনা, চাপা গলায় বলেছিলেন, “ওদের সময় দিন। সবটা বুঝতে দিন। স্পেশাল চাইল্ড হলেও খুব যত্নে ওদের বড়ো করা হয়েছে। ওরা অনেক কিছু বোঝে, বোঝাতে পারে। ওরাই আমাদের নিয়ে যাবে গন্তব্যে।”
“মুনিয়া… আর পাওলি কেমন আছে?” সবচেয়ে সামনে যে ছিল তাকেই প্রশ্নটা করতে বাধ্য হল রয়।
মেয়েটি তীব্র দৃষ্টিতে রয়ের দিকে তাকাল। রয়ের মুখে ফুটে ওঠা দুশ্চিন্তার ভাব দেখে তার দৃষ্টি একটু নরম হল, তবে কোনো উত্তর এল না।
“বিলালের কী খবর?” অল্প হেসে এই প্রশ্নটাও করে ফেলল রয়, “আমাকে জোর ধাক্কা মেরেছিল ছোকরা।”
এবারও মেয়েটি কোনো কথা বলল না। তবে তার পাশ থেকে একটি ছেলে বলে উঠল, “সালদানা কথা বলতে পারে না।”
হতাশ ভঙ্গিতে রয় তাকেই বলল, “তুমি যখন বলতে পার, তখন না হয় তুমিই বলো। কেমন আছে এরা?”
“মুনিয়া ভালো আছে; ওর মা-ও।” আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল ছেলেটি, “বিলালের নতুন পোশাক বানানো হয়নি বলে ও আমাদের সঙ্গে আসতে পারেনি। কিন্তু… তুমি কি ওই আগুন-দানোর একজন?”
“না।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে রয় বলল, “আমি বহু দূরের মানুষ। আকাশের একেবারে অন্য প্রান্তের লোক বলতে পার আমাকে। এখন আমায় ঘরে ফিরতেই হবে। কিন্তু মুনিয়া আর পাওলিকে উদ্ধার না করে আমি যেতে পারব না।”
“বিলাল তোমার কথা বলেছে।” নীচু গলায় বলে উঠল একজন, “রানি তাই বলেছিল, তোমাকে ধরে তার কাছে নিয়ে যেতে— কথা বলার জন্য।”
“তোমরা যে রাস্তাটা দিয়ে এসেছিলে, সেটা ধরে আমরা রানির কাছে পৌঁছোতে পারতাম?”
“না-না।” এবার অনেকগুলো গলা একসঙ্গে উত্তর দিল। একজন বলল, “ওই পথটা তো পাহাড়ের নীচে একটা নদীতে গিয়ে মিশেছে। বিলাল বলল, তোমরা ওপর থেকে সবকিছু দেখতে পাচ্ছ। তাই আমরা নীচের পথ দিয়ে এলাম। নইলে ওখানে আমরা কেউ যাই না।”
চুপ করে কথাগুলো ভাবতে লাগল রয়। নোমুরা ঠিকই বলেছিলেন, এরা মিথ্যেবাদী নয়, এমনকি শত্রুভাবাপন্নও নয়। তবে এরা আগুন আর দানো— এই দুটো জিনিসকে ভয় পায়। অবশ্য ওই দুটো জিনিসকে কে না ভয় পায়! কিন্তু কনফেডারেশন যদি দানো হয়, তাহলে তাদের কীর্তিকলাপ এরা দেখল কীভাবে? তখন এই গ্রহে জনবসতি হলেও কনফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল ছিল। তারপর, দশ বছর আগে কারবেরাসে মারাত্মক সংঘর্ষের পর রিপাবলিক প্রথমেই প্রান্তিক অঞ্চলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়— যাতে সেই গ্রহগুলোকে লুণ্ঠন করে রসদ জোগাড় করতে না পারে কনফেডারেশন। তারও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তাদের অধিকাংশ সায়েন্টিফিক মিশন পরিত্যক্ত হয়েছিল। গৃহযুদ্ধে বিদীর্ণ শক্তিটি মরিয়া হয়ে সামরিকভাবে দুর্বল রিপাবলিকের বিরুদ্ধে লড়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনানায়ক আর অভিজাতদের অনুকূলে রাখতে চেয়েছিল। বাকিটা ইতিহাস!
“কিছু কথা আপনি জানেন না; কিন্তু সেগুলো জানা দরকার।” নোমুর-র গলাটা এবারও কিছুটা অস্বাভাবিক শোনাল। তবে এও মনে হল যে বিজ্ঞানী একটু-একটু করে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছেন। একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন তিনি।
“এই গ্রহে একেবারে প্রথম সার্ভেতে এমন বেশ কিছু চিহ্ন দেখা গেছিল, যা থেকে মনে হয় যে এই গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীরাও বাস করে, বা করত। কিন্তু পরের সার্ভে আর তেমন কিছু পায়নি। ফলে এটাই ধরে নেওয়া হয় যে তিস্তানে বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব নেই। সেইমতো এখানে একটা সায়েন্টিফিক মিশন পাঠানো হয়। তবে নিছক পর্যবেক্ষণ আর বসতি স্থাপনই তার উদ্দেশ্য ছিল না। ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত ক-টি গ্রহ থেকে জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশকে এখানে পাঠানো যায় কি না— সেই নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের। আমার… বাবা আর মা যে সেই দলে এসেছিলেন, তা আপনাকে আগেই বলেছি।”
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে নোমুরা-কে ঢোঁক গিলতে হয়েছিল। আশপাশ দেখে নিয়ে, সব স্বাভাবিক বুঝে রয় জানতে চাইল, “তাহলে এদের কে তুলে নিয়েছিল?”
“সেটা কনফেডারেশনের রেকর্ডে নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখানে বাস করার সময় বুঝেছিলেন, এই গ্রহে সত্যিই বুদ্ধিমান এবং হিউম্যানয়েড গঠনের একদল প্রাণীর বাস… অন্তত তখন ছিল। তারা আদৌ এই গ্রহের প্রাণী, নাকি অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছিল— এই নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা আছে রেকর্ডে। একাধিক বিজ্ঞানী স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, এরা অন্য কোনো সময়ের মানুষই— তবে কোনো কারণে এরা প্রযুক্তি, বিশেষত অস্ত্র একেবারেই বর্জন করে। এই গ্রহের ক্ষুদ্র আর বৃহৎ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সঙ্গে একটা চমৎকার সহাবস্থানের ব্যবস্থা করে বসবাস করত তারা।”
“এরাই… পরি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু কনফেডারেশনের বিজ্ঞানীরা এদের সন্ধান পাওয়ামাত্র এই প্রজাতিকে ধরে কাটা-ছেঁড়া, সম্ভব হলে অন্য সব ধরনের পরীক্ষা করতে উঠে-পড়ে লাগেন। তাঁরা চেয়েছিলেন, শারীরবৃত্তীয় যে-সব অভিযোজনের মাধ্যমে এই প্রাণীরা তিস্তানের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, সেগুলোকে বুঝে নিয়ে সরাসরি সেগুলোর সাহায্যে এই গ্রহে বসতি-স্থাপন নিশ্চিত করতে। আর এরপরেই, অনেকের মতে এর ফলেই, ক্যাম্পে বেশ কিছু অদ্ভুত রোগ দেখা দেয়। তার ফলে একদিকে এই প্রজাতি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়, নয়তো এখান থেকে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে বিজ্ঞানী ও সৈন্যদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যেতে থাকে অত্যন্ত দ্রুত। যারা বেঁচে ছিল, তাদের অধিকাংশের মধ্যে দেখা দেয় নানা প্রতিবন্ধকতা!”
“স্পেশাল চাইল্ড!” রয়ের সামনে থেকে একটা পর্দা যেন উঠে গেল এবার, “তাই এরা এমন শিশুদের নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে? নাকি উদ্ধার করতে চাইছে?”
“সম্ভবত উদ্ধার করা, আর পরিদের মূল জীবনযাত্রা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা— দুটোই জড়িয়ে আছে এই তথাকথিত অপহরণগুলোর সঙ্গে। তবে এরা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। তা না হলে এই গ্রিড চালানো, ক্যামোফ্লেজের ব্যবস্থা করা, ন্যানোবট-বসানো পাতলা ফাইবারের স্যুট ব্যবহার করা— এগুলো আমরা দেখতে পেতাম না।”
“ন্যানোবট এরা পাচ্ছে কীভাবে?” রয় সত্যিই অবাক হল, “ওই জিনিস তো এই জঙ্গলের মধ্যে বানানো সম্ভব নয়।”
“পরিদের সঙ্গে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের হওয়া কথাবার্তার কিছু বিবরণ আমি পড়েছি।” নোমুরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “জলে মাছ আর জঙ্গলে শিকার পাওয়া যাবে— এটা নিশ্চিত করার জন্য পরিদের ওই একটি জিনিসই ভেট দিতে হত। ন্যানোবট! এটাও পরিদের অস্তিত্বকে সিরিয়াসলি না নেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এতদিন। পরিরা ন্যানোবট নিয়ে কী করবে, বলুন?”
“তার মানে পরি, বা সেই অন্যরকম মানুষেরা এখনো আছে?”
“গানটা ভুলে গেলেন?” নোমুরা-র গলায় একটা গাঢ় বিষাদের স্পর্শ ছিল।
“কোন… ও, পাওলি যেটা গাইলেন সেই রাতে?”
“অনেক দূরের কথা মনে হচ্ছে, তাই না?” হাসলেন নোমুরা, “চব্বিশ ঘণ্টা আগেই শুনেছিলেন আপনি গানটা। কথাগুলো হয়তো আপনার মনে নেই। তবে স্পিকার আর রেকর্ডার সেগুলো ধরে রেখেছে। কথাগুলোর প্রায় সব সত্যি।”
হঠাৎ রয় খেয়াল করল, দলটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। নোমুরাকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে সে বলে উঠল, “কী হল?”
“এখান থেকে আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকব।”
“বেশ।” একটু অস্বস্তিভরে রয় নোমুরাকে বলল, “তাহলে এবার?”
“একটা ড্রোন আপনাদের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে এগোবে।” নোমুরা-র গলা একদম শান্ত ছিল। মুহূর্তের জন্য রয়ের মনে হল, ঠিক যেন কোনো রানির মতোই সবটা দেখে নিয়ে নিজের সৈন্যসামন্তদের যুদ্ধে পাঠাচ্ছেন বিজ্ঞানী। “ওদের হাতের বাঁধন খুলে দিন। যদি পালায়ও, অসুবিধে নেই। ওই দড়ি থেকে বেশ কিছু ন্যানোবট ওদের গায়ে লেগে গেছে; ওই দিয়ে আমি স্বচ্ছন্দে ওদের ট্র্যাক, এমনকি আরো কড়া কিছু করতে পারব। বিলালের অবস্থান ইতিমধ্যেই জানি। ওর গায়ে কাল রাতেই ন্যানোবট বসানো হয়েছিল। এমনকি পাওলি আর মুনিয়া-র মোটামুটি অবস্থানও এখন আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোর ভরসা অর্জন করা দরকার। ওরা আপনাকে আগুন-দানোদের থেকে অন্যরকম ভাবুক।”
বাঁধন খুলে দিল রয়। মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, এরা সবাই মিলে যদি তার ওপর হামলা করে? পরক্ষণেই তার খেয়াল হল, শুধু মাথার ওপরের ড্রোন নয়, অন্য দুটো ড্রোন থেকেও বেরিয়ে এসেছে বেশ কিছু লাল আলোর রেখা। সামনের প্রতিটি মানুষের শরীরে অজস্র লাল বিন্দু ফুটিয়ে তুলেছে তারা।
“অনেক-অনেক দিন আগে টেরা-র এক সন্ন্যাসী একটি সাপ-কে পরামর্শ দিয়েছিলেন।” নোমুরা-র শান্ত, স্থির গলাটা রয়ের কানে এল, “তিনি বলেছিলেন ছোবল না মারলেও সে যেন ফোঁস করে ওঠে। কূটনীতির আসল কথাই হল হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে নরম গলায় কথা বলা। আপনি আমার নরম গলা। কিন্তু লাঠিটা আছে, থাকবে, আর সেটা ওরা জানবেও। এবার এগোন।”
১৪
পিন্ডার স্টেশন, অনিগুনাস প্রভিন্স, পঞ্চম দিন— জিরো আওয়ারের পর
“এ আপনি কী বলছেন, ক্যাপ্টেন?”
“রেকর্ডের ভিত্তিতেই বলছি, মেজর।” চাপা গলায় বললেন মিলিন্দ, “রয় নামের ওই ট্র্যাকার তথা সাংবাদিকটি আসার পর আমার কৌতূহল হয়েছিল এই পরিদের ব্যাপারটা নিয়ে। অফিসিয়ালি আমাদের অবস্থান আগে যা ছিলেও, এখনো তাই আছে। পরি বলে কিছু নেই। কিন্তু রেকর্ড বলছে, তারা ছিল।”
মেজর তূর্য কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। গ্যালেনা কোয়াড্র্যান্টের কূটনৈতিক কাজ থেকে এই অজ জায়গায় বদলি হয়ে আসার পর থেকেই তার মেজাজ খারাপ ছিল। নেভি হেডকোয়ার্টার্স একেবারে আদেশ দিয়ে নোমুরা-কে এই “মিশন পরি”-র দায়িত্ব দেওয়ায় আরো অবাক হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এখন মিলিন্দ এগুলো কী বলছে? তিনি বলেই ফেললেন, “তা বলে পরি!”
“আজ থেকে তিন দশকেরও বেশি আগে কনফেডারেশন এই গ্রহটা নিয়ে মনোযোগী হয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, চুলা সেক্টরের কিছু-কিছু গ্রহ থেকে লোকেদের এই গ্রহে নিয়ে আসা হবে। জোর করে জনসংখ্যায় পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা আর কি, যেমনটা ওরা আরো বহু জায়গায় করেছে। তাদের সায়েন্টিফিক টিম এখানে নামে। তারাই রেকর্ড রেখে গেছে। এগুলো সব ক্লাসিফায়েড রেকর্ড। তবে আমি অনেক ধরাধরি করে, শেষে এই “মিশন পরি”-র কথা বলেই অনুমতি জোগাড় করে এইসব জেনেছি।”
গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন তূর্য। মিলিন্দ থেমে-থেমে বললেন, “এই গ্রহে তখন প্রায় মানুষের মতোই দেখতে, তবে একেবারেই অহিংস স্বভাবের এক ধরনের প্রাণী থাকত। তাদের সুন্দর চেহারা, বড়ো চোখ, লম্বা কান আর ধারালো হনুরেখার জন্য খুব সহজেই লোকজন তাদের পরি বলা শুরু করেছিল। কনফেডারেশনের ক্যাম্পে ওদের ওপর নানা ধরনের পরীক্ষা চলত। তারপরেই সেখানে দেখা দেয় এক অদ্ভুত মড়ক। শিশুরা মারা পড়তে লাগল, নয়তো তাদের মধ্যে দেখা দিল নানা বিকৃতি— বা ত্রুটি। এর ফলে ক্যাম্পের পরিবেশ খুব খারাপ হয়ে যায়। শেষে এখানে বিদ্রোহ দেখা দেয়।”
“এটা আমরাও জানি। কনফেডারেশন যাদের মাধ্যমে একটা টেকনোক্র্যাসি তৈরি করতে চেয়েছিল, সেই বিজ্ঞানীরাই ওদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন।”
“আমি এক সৈনিকের জবানবন্দি পেয়েছি।” মিলিন্দ পড়তে শুরু করলেন, “আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়লাম। অবশেষে একটা বড়ো বাহিনী পাঠানো হল বিদ্রোহ দমনের জন্য। বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে রইলেন, তাঁদের আলাদা-আলাদা জায়গায় পাঠানোর আদেশ এল। ডক্টর নোমুরা, মানে নোমুরা-র বাবা বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি… আমাদের হাতেই মারা পড়েছিলেন।”
“ডক্টর নোমুরা?” তূর্য ভীষণ চমকে উঠলেন এবার, “মানে…”
“উওজিলি নোমুরা-র বাবা।” চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন তূর্য, “তিনি ছিলেন এই সেক্টরের সেরা জীববিজ্ঞানী। তাঁর স্ত্রী ছিলেন সিগনাল আর কমিউনিকেশন বিষয়ক প্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ। তিনিও এই মিশনে ছিলেন। সেই সময় স্বামীর মৃত্যু ছাড়া অন্য একটা কারণেও তিনি তখন মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আসলে ক্যাম্পের অবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে যাওয়ার ফলে একটা ব্যাপার প্রথমে সৈন্যরা বুঝতে পারেনি। প্রতিবন্ধী বাচ্চাগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছিল। ওই পরি, বা কোনো প্রাণী ওদের তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। নোমুরা দম্পতির দুই মেয়ে ছিল। তার মধ্যে একটি— কুওজেলি ছিল স্পেশাল চাইল্ড। সে হাঁটতে পারত না। সেও নিরুদ্দেশ হয়েছিল।”
“আর উওজিলি?”
মিলিন্দ আবার পড়লেন, “ক্যাম্প থেকে সবাইকে সরিয়ে নিয়ে, আগুন দিয়ে পুরো অঞ্চলটা পুড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরা। তবু মহিলাকে নড়াতে পারছিলাম না। এক মেয়ে— উওজিলিকে কোলে নিয়ে তিনি বসে থাকতেন, কবে তাঁর আরেক মেয়ে ফিরবে সেই আশায়। উওজিলি ছিল কনফেডারেশনের চোখে ভেরি স্পেশাল চাইল্ড। সাইকোমেট্রিক টেস্ট থেকে বোঝা গেছিল, ওই মেয়ের মধ্যে সাংঘাতিক প্রতিভা আছে। আমরা রীতিমতো ভয়ে-ভয়ে ছিলাম; ওই মেয়েটা যদি হারিয়ে যায়, মানে পরিদের কাছে চলে যায়, তাহলে কোর্ট মার্শাল অবধারিত। শেষ অবধি কম্যান্ডার ঠিক করলেন, উওজিলিকে নিয়েই তিস্তান ছেড়ে চলে যেতে হবে।”
“মিসেস নোমুরা-র কী হয়েছিল?”
“তাঁকে ঘরের মধ্যে রেখেই ওই সৈন্যরা চুপচাপ মেয়েটাকে, একরকম অপহরণ করে, ওখান থেকে চলে যায়। তারা রেখে আসে পাহাড়ের গায়ে আর অন্য কয়েকটা গ্রিড চালু করার মতো কন্ট্রোল, কিছু ভারী যন্ত্রপাতি— যা নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না, আর বেশ কিছু ট্র্যান্সমিটার ও রিসিভার। মহিলার কী হয়েছিল, তা সৈনিকেরা কেউ-ই জানে না।”
তূর্য মাথা নাড়লেন। ডক্টর নোমুরা-র যতই প্রতিভা থাকুক, তাঁকে এইরকম গুরুত্বপূর্ণ মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হল কীভাবে? ইনি তো স্বচ্ছভাবে চিন্তাই করতে পারবেন না এমন অবস্থায়। শান্ত গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কুওজেলি… বা বাকি শিশুদের কী হয়েছিল?”
“আমার ধারণা,” তূর্যের চোখে চোখ রেখে মিলিন্দ বললেন, “তারা তো বটেই, এই যে-সব ছেলেমেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনি— এরা সবাই এখন ওই পরিদের দলে যোগ দিয়েছে, বা নিজেরাই পরি হয়েছে। কিন্তু যদি আসল পরি, বা এই গ্রহের আদি বাসিন্দাদের একজনও থেকে থাকে, তাহলে তার ওপর নেভি বা রিপাবলিক প্রশাসনেরও আগে অনিগুনাস-এর অধিকার বর্তায়। আমাদের উচিত ওই জায়গাটাতে গিয়ে, তেমন কেউ থাকলে, তাকে নিজেদের জিম্মায় নেওয়া। গ্রহের আইন এই বিষয়ে পরিষ্কার।”
“আইনটা কিন্তু কনফেডারেশনের করা।” তূর্য মিলিন্দকে সতর্ক করলেন।
“রিপাবলিক কিন্তু আইনটা বাতিল করেনি, স্যার। রিপাবলিকের আইন না ভাঙলে তিস্তান-এর নাগরিকদের ওপর অনিগুনাস বা মহাগুনাস-এর আইনই কার্যকরী হবে। এই কোয়াড্র্যান্টের সব গ্রহেই এই নিয়ম আছে। পরি, যদি থাকে, সে তিস্তান-এরই নাগরিক, তাই না?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তূর্য। তারপর দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা যাব কীভাবে?”
“মিলিশিয়ার হেলিরোটর তৈরিই আছে, স্যার। আপনি আদেশ দিলেই আমরা বনাইবুরু-র উদ্দেশে রওনা হব। তার জন্য আমাদের আলাদা করে অনুমতিও নিতে হবে না।”
১৫
পরির রাজ্য, বনাইবুরু টেরিটরি, পঞ্চম দিন— ভোর-রাত
“আর কতদূর?”
ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল রয়। নীচু গাছপালা পেরিয়ে, ঝিল আর ঝরনা এড়িয়ে, টিলার পাশ কাটিয়ে তাদের দলটা অনেকক্ষণ ধরে এগিয়ে চলেছিল। একটা-না-একটা ড্রোন এখনো তাদের মাথার ওপরেই থাকছে। নোমুরা-র পাঠানো ম্যাপ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, তাকে ঘুরপাক খাওয়ানো বা উলটো দিকে নিয়ে যাওয়ার কোনো চেষ্টা করেনি এই দলটা। একটা প্রায় ন্যাড়া জমির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। তবু রয়ের শরীর, এক্সো-স্যুটের আড়ালে থেকেও, এবার বিদ্রোহ করতে শুরু করেছিল।
“এসে গেছি।” গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে খাটো ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল একজন। বাকি দলটাও সেখানেই দাঁড়াল।
চারদিকে তাকিয়ে দেখল রয়। ড্রোনগুলো তখনও জঙ্গলের ওপর, খুব কম উচ্চতায় ভেসে ছিল। তাদের হালকা আলোয় রয় দেখল, এই জায়গার একপাশেই রয়েছে একটা টিলা। সেই জোড়া-পাহাড়ের কাছ থেকে শুরু হওয়া পাহাড়েরই একটা শিরা বোধহয় এটা। ওপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জলকল্লোল খুব ক্ষীণভাবে হলেও শোনা যায় এখান থেকেই। অন্যদিকে শুরু হয়েছে বনাইবুরুর স্বাভাবিক ঘন অরণ্য।
অদ্ভুত! মাঝের এই জায়গাটা এমন কেন?
“এখানে মাটির নীচে একটা কিছু আছে।” নোমুরা-র গলাটা অত্যন্ত চিন্তিত শোনাল, “খুব বড়ো কিছু। জিনিসটা আমার স্ক্যানারের ফিল্ডকে বেঁকিয়ে দিচ্ছে।”
“তাহলে?”
“এগিয়ে চলুন। পরিদের রানি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল— মনে নেই? তার কাছেই পাওলি আর মুনিয়াকে পাওয়া যাবে নিশ্চয়।”
“ওপাশে তো জঙ্গল? সেদিকে…”
কথা অসমাপ্ত রেখে থমকে গেল রয়। ডানা ঝাপটানোর মতো একটা শব্দ তার কানে এসেছিল। পাখি? নাকি রোটর-সহ কোনো শাটল? কিন্তু তার আওয়াজ তো অনেক ভারী। তাহলে… ওটা কী?
দূরের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছিল কালো বডিস্যুট-পরা অনেকগুলো শরীর। তেমন আবরণ ছাড়া, গতরাতে পরে থাকা পোশাকটা পরেই এগিয়ে আসছিলেন পাওলি। তাঁর হাত ধরে, প্রায় নাচতে-নাচতে হাঁটছিল মুনিয়া। আর তাদের ওপরে, বাতাসে ভেসে ছিল একটি শরীর!
“রানি!” অস্ফুটে বলে উঠল অনেকে। তারা ছুটে গেল সামনে দিকে। রয় কিন্তু নড়ল না। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইল সামনে— যেখানে একটি ছোটোখটো নারীশরীর হাওয়ায় ভেসে তার দিকে এগিয়ে আসছিল।
“আমি…” রয় হঠাৎ আবিষ্কার করল, তার গলা শুকিয়ে গেছে, “ওঁদের নিয়ে যেতে এসেছি।”
“শুধু ওদের দু-জনকে?” সুরেলা, ওঠা-নামা করা গলাটা স্পষ্ট শোনা গেল, “এই জঙ্গল, এখানকার পশু-পাখি, এই অসহায় মানুষেরা— এ-সবের ওপর আপনার কোনো লোভ নেই?”
ভাষাটা গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু রয়ের মনে হল, এ আজকের ভাষা নয়। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু… থাকতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “আপনি কি পরি?”
খিলখিল করে হেসে উঠলেন রানি। আলতো করে নীচে, ঘাসের উপর পা রাখলেন তিনি। রয়ের দিকে প্রায় ভেসে আসতে-আসতে তিনি বললেন, “এখন আমি পরিই বটে, তবে আগে দানব ছিলাম— আপনার মতো।”
ক্রুদ্ধ মুখটার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল রয়। এ কাকে দেখছে সে?
ড্রোন এবং এক্সো-স্যুটের ক্যামেরা একই দৃশ্য ইউরি স্যাটেলাইটেও পৌঁছে দিয়েছিল। নোমুরা-র ভাঙা গলা রয়ের কানে এল, “কুওজেলি!”
ঠিক তখনই কট্কট্ করে একটা শব্দ শোনা গেল দূর আকাশ থেকে। প্রতিবর্ত ক্রিয়া মুহূর্তের মধ্যে রয়কে সজাগ করে তুলল। সে মুখ তুলে তাকাল। অন্ধকার আকাশে খালি চোখে কিছু দেখা গেল না। তবে এক্সো-স্যুটের ভিশন তাকে দেখিয়ে দিল, একটা সশস্ত্র হেলিরোটর উড়ে আসছে এদিকে।
মাটির নীচে একটা গুরুগুরু শব্দ শোনা গেল এইবার। নোমুরা আর্তনাদ করে উঠলেন, “গ্রিড চালু হচ্ছে! মাটির নীচে প্লেট দিয়ে ঢাকা ছিল এটা। এইজন্যই মাঠটা এমন লাগছিল। ওখান থেকে সরে যান আপনারা।”
বডিস্যুট-পরা ছেলেমেয়েরা বিপদ বুঝেছিল। তারা সবাই ছুটে গেল সামনের বা পেছনের জঙ্গলের দিকে। কিন্তু পাওলি আর মুনিয়া কী ঘটছে বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রয়ের কানে এল, নোমুরা ইউনিভার্সাল ফ্রিকোয়েন্সিতে হেলিরোটরের উদ্দেশে চিৎকার করে সেটাকে সরে যেতে বলছেন। কিন্তু, যে কোনো কারণেই হোক, তারা সেই আদেশ মানছে না।
রয় দেখল, মাঠের মধ্যে একটা জায়গা নেমে যাচ্ছে। সে তখনই বুঝতে পারল, ওখান দিয়েই তৈরি হবে ফিল্ড। কিন্তু হেলিরোটর-এর দিকে নিশানা করতে হলে তো পাওলি আর মুনিয়া ওই জিনিসের আওতার মধ্যে পড়বে! প্রাণপণে ছুটতে গিয়েও একটা হ্যাঁচকা টানে থেমে গেল সে।
পরিদের রানি… কুওজেলি হাত নেড়ে তাকে বারণ করলেন। তারপর পিঠ থেকে বেরিয়ে আসা ডানার সাহায্যে দ্রুত উড়ে গেলেন পাওলি আর মুনিয়ার দিকে।
রয় দেখল, একটা লালচে-গোলাপি স্তম্ভ তৈরি হল নীচু জায়গাটা থেকে। তারপর সেটা ঘুরে গিয়ে হেলিরোটরটাকে ধরল। একটা প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ হল। জ্বলন্ত টুকরোগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু গ্রিডটা তখনই বন্ধ হল না। সেটা খুঁজতে শুরু করল চারপাশে অন্য লক্ষ্যবস্তুকে। অচিরেই তার স্বয়ংক্রিয়, বিবেচনাহীন মস্তিষ্ক আর দৃষ্টি খুঁজে পেল ড্রোনটিকে। কিন্তু পরের আক্রমণ হানানোর সুযোগ পেল না যন্ত্রটি।
আকাশ থেকে একটা বিধ্বংসী লেজার-ব্লাস্ট এসে পড়ল নীচু হয়ে যাওয়া জায়গাতে। ভয়ংকর বিস্ফোরণের সঙ্গে লালচে-গোলাপি স্তম্ভটা নিভে গেল। ধাতু আর প্লাস্টিক গলে যাওয়ার বীভৎস গন্ধে ভরে গেল চারপাশ। তারই মধ্যে রয়ের চোখে পড়ল, বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়েছে পাওলি আর মুনিয়া। সে ছুটল তাদের দিকে।
নোমুরা-র কণ্ঠ ভেসে আসছিল, “এগুলো সব জাগিয়ে রেখেছিল কেউ। নইলে এতদিনে এই অস্ত্র, দূর থেকে গ্রিডকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা— এগুলো কিছুই কাজ করার কথা নয়। কেউ আছে, যে এদের ব্যবহার জানে।”
রয় কোনো কথায় কান না দিয়ে আগে পাওলি আর মুনিয়া-র কাছে গেল। পাওলি রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, “আমরা ঠিক আছি।” মুনিয়া-র উজ্জ্বল চোখজোড়া দেখে রয় বুঝতে পারল, মেয়েটা অন্তত নতুন করে এ-সব দেখে কোনো আঘাত পায়নি। পাওলি আবার বলে উঠলেন, “রানি? রানির কী হল?”
নোমুরা হঠাৎ চুপ করে গেলেন। রয় পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকাল। আগুনের লম্ফমান শিখা আর ড্রোনের আলো একে অপরকে কাটাকুটি করে কেমন যেন অন্ধকার জাগিয়ে তুলছিল তার দৃষ্টিতে। তারই মধ্যে ছোট্ট শরীরটা, আর পুড়ে যাওয়া ডানাদুটো তার নজরে পড়ল। সেদিকে দৌড়ে গেল সে। ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো শব্দ তুলে নেমে আসতে লাগল প্রথমে একটা, তারপর বাকি দুটো ড্রোনও।
“কুওজেলি?” ছোটোখাটো শরীরটাকে খুব সাবধানে নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল রয়। কিন্তু ডানাটাকে নিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল, গ্রিডের একাংশ ওই জায়গাটাকে ছুঁয়ে পিঠটাকেও পুড়িয়ে দিয়েছে।
চোখ খুললেন কুওজেলি। যন্ত্রণার সঙ্গে সেই দৃষ্টিতে মিশে ছিল এক অদ্ভুত গর্ব। রয়ের মনে হল, সে যেন কোনো রানির সামনেই রয়েছে। যন্ত্রণাকাতর গলায় পরিদের রানি বললেন, “মা আর মেয়ে?”
“তারা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি…”
“সরে দাঁড়ান, রয়।” স্পিকারের মধ্য দিয়ে নোমুরা-র শক্ত, শান্ত গলাটা ভেসে এল, “ওকে আমিই নিয়ে আসব এখানে— ইউরি-তে। ড্রোনগুলো সেই ব্যবস্থা করছে। একটু সময় দিন!”
নোমুরা-র কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। সরে দাঁড়িয়ে রয় দেখল, কুওজেলি-র চারপাশে বেশ কিছুটা জায়গা ঘিরে ফেলা হল ড্রোনের নিজস্ব আলোর বলয় দিয়ে। ন্যানো-মেডিসিনের একটার পর একটা ব্যাচ প্রয়োগ করা হল তার মধ্যে। কিছুক্ষণ পর অনেকগুলো যান্ত্রিক হাতের মাধ্যমে কুওজেলি-র শরীরটাকে সযত্নে একটা স্ট্রেচারে তোলা হল। স্ট্রেচারটা চারদিক থেকে ঢাকা পড়ল অসংখ্য বুদ্বুদের মতো একটা আস্তরণে। সেটাকে নিজের পেটের ভেতর নিয়ে একটা ড্রোন এবার উপরদিকে উঠতে শুরু করল।
যতক্ষণ পারা যায়, সেদিকেই তাকিয়ে রইল রয়। তারপর নিজের আশপাশে তাকিয়ে সে দেখল, উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে ওই মাঠের এক প্রান্তে, জঙ্গলের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো বডিস্যুট-পরা চেহারাগুলো। পাওলি মুনিয়াকে কোলে নিয়ে তার কাছে এসে বললেন, “আমরা কি… ফিরে যাব?”
“হ্যাঁ।” আকাশের একধারে অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছিল। এবার শোনা যাচ্ছিল আরো ভারী, আরো জোরালো একটা শব্দ। মিলিটারি শাটল আসছে এদিকে। সেদিকে তাকিয়ে রয়ের হঠাৎ খেয়াল হল, একটা কথা জিজ্ঞেস করা দরকার। সে পাওলিকে বলল, “আচ্ছা, আমি না এলে আপনি কি এই পরিদের সঙ্গেই থেকে যেতেন?”
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন পাওলি। তারপর বললেন, “তা বোধহয় পারতাম না। তবে এই জায়গাটা এত সুন্দর, এত শান্ত… আপনি ভাবতেও পারবেন না। তবু, আমি বোধহয় পালিয়ে যেতাম। রানি মা এমনিতেও আমাকে সহ্য করতে পারছিলেন না। বলছিলেন, আমি আগুন নিয়ে আসব! তাই মুনিয়াকে নিয়ে আমি এখানে ফিরে আসতে চেষ্টা করতামই।”
রয় মাথা দুলিয়ে মা আর মেয়ের সঙ্গে হাঁটা লাগাল এখন নির্বিষ হয়ে যাওয়া মাঠের দিকে। আকাশের গায়ে একটু-একটু করে বড়ো হয়ে উঠছিল শাটলটা। হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল করে সে থমকে গেল।
“আপনি একটু আগে কী বললেন? রানির মা!”
“হ্যাঁ।” পাওলি বললেন, “তিনি মানুষই, তবে কথা বলেন না। তবু দৃষ্টি দিয়েই, কীভাবে যেন, সব অনুভূতি বুঝিয়ে দেন। আগে বোধহয় বিজ্ঞানী ছিলেন; এখনো আছেন। ওর কাছাকাছির মধ্যে অনেকগুলো ন্যানোবটের একটা ক্লাউড সবসময় থাকে দেখেছি।”
“কোথায় পাব তাঁকে?” উত্তেজিত ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন নোমুরা। প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করল রয়।
“ওই জঙ্গলের মধ্যে, নদীর একদম গা ঘেঁসে একটা বসতি আছে। সেখানেই থাকে এরা। হয়তো ওখানেই আছেন এখন। কিন্তু ওঁকে দিয়ে কী হবে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রয় বলল, “একটা গল্প শেষ হবে।”
১৬
ইউরি ২.২, তিস্তানের কক্ষপথ, পঞ্চম দিন— দুপুর
“কাউকে পেলেন, কমোডোর?”
“অনেককেই পেয়েছি।” কমোডোর জিটা নোমুরাকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন, “অপহৃত স্পেশাল চাইল্ডদের প্রায় সবাইকেই পাওয়া গেছে বনাইবুরু টেরিটরি-র নানা অংশে। কিন্তু আপনি যে মহিলার কথা বলছিলেন, তাঁকে পাইনি।”
রয় এবার জিজ্ঞেস করল, “ওরা, মানে ওই ছেলেমেয়েগুলো কেমন আছে?”
“রানিকে না পেয়ে মুষড়ে পড়েছে।” মৃদু হাসলেন জিটা, “ওরা সুস্থ আছে। আমাদের ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন।”
“ওদের কি এবার অনিগুনাস বা মহাগুনাস-এ নিয়ে আসা হবে?”
“একদম না!” আঁতকে উঠলেন জিটা, “ডাক্তাররাই বলেছেন যে ওদের এই পরিবেশেই আপাতত থাকতে দেওয়া উচিত। অভয়ারণ্যের মতো করে আমরা বনাইবুরু-র মধ্যে অনেকটা করে অংশ আলাদা করে দিচ্ছি। ধীরে, একটু-একটু করে ওদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ভাব-বিনিময় করে আমরা আবার সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করব। তবে আপাতত পরিরা আলাদা থাকুক। নইলে ওদের পক্ষে আঘাতটা বড়ো বেশি হবে”
“ওই গ্রিডটা চালু করিয়েছিলেন মহিলাই।” শক্ত গলায় বললেন নোমুরা, “তিনি আমার আর কুওজেলি-র মা হতে পারেন। তবে মিলিশিয়া-র হেলিরোটর ধ্বংস হওয়ার জন্য তিনিই দায়ী।”
“শুধু তাঁকে দোষ দিও না।” নোমুরা-র হাতের ওপর হাত রেখে ভিজরের সামনে এসে দাঁড়ালেন কুওজেলি— পরিদের রানি। রয়ের মনে হল, নোমুরা-র মতোই দেখতে মানুষটি মেঝেতে ঠিক দাঁড়িয়ে নেই, যেন ভেসে আছেন!
“আমার মা-র সঙ্গে পরিদের বন্ধুত্ব ছিল ভারী… নিবিড়।” জিটা-র চোখে চোখ রেখে বললেন কুওজেলি, “একাকিত্ব আর শোক তাঁকে একটু-একটু করে অন্যরকম করে দিচ্ছিল। পরিরা— মানে সত্যিকারের পরি— যারা এই গ্রহে আগে থেকেই ছিল, তাঁকে যথাসম্ভব ভালো রাখতে চেয়েছিল। রানি নিজের সঞ্চয় থেকে ওষুধ দিয়ে তাঁকে সুস্থ-সবল রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। তবে মা আস্তে-আস্তে অন্য মানুষদের সবাইকে শত্রু বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। রিমোট দিয়ে গ্রিড চালু রাখা, ফিল্ড সক্রিয় রাখা, ন্যানোবটের সাহায্যে আমাদের সবাইকে একই সূত্রে বেঁধে রাখা— এগুলো সব করতেন মা। কিন্তু স্পেশাল চাইল্ড ছাড়া অন্য মানুষদের তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তখন থেকেই রানি একটু-একটু করে তাঁর জ্ঞান আর শিক্ষা দিয়ে আমাকে তৈরি করতে থাকেন পরের রানি হওয়ার জন্য।”
“কেন?” প্রায় একইসঙ্গে প্রশ্ন করলেন জিটা আর নোমুরা।
“পরিদের সংখ্যা তখনই খুব কমে এসেছিল। অত্যাচার বা পরীক্ষার নামে কাটাছেঁড়ার থেকেও বেশি করে তাদের আঘাত দিয়েছিল কনফেডারেশনের আচরণ— সেও নিজের নাগরিক, এমনকি বৈজ্ঞানিকদের প্রতি। ওগুলো দেখে তারা ভেবেছিল, বুঝি মানুষ এখন এমনই হয়ে গেছে। ওদের… বাঁচার ইচ্ছেই যেন চলে যাচ্ছিল। তাই রানি এই গ্রহের ভার আমাদের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন।”
“আপনি… আর ওই স্পেশাল চাইল্ডরা?”
“হ্যাঁ। পরিরা মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে আমাদের সাহায্য করত। তাই প্রত্যেকটি শিশু আমাদের কাছে আসার পর ভালো থাকত, অন্যদেরও ভালো রাখত। আমরা আকাশ আর প্রকৃতি দেখে ভূগোল শিখতাম। পশু-পাখি আর আবহাওয়া দেখে শিখতাম বিজ্ঞানের নানা কিছু। একে অপরকে সাহায্য করতে গিয়ে শিখতাম সহমর্মিতা আর ঐক্য। এভাবেই ছিলাম আমরা। তারপর আমার একটা ভুল…!”
ফুঁপিয়ে উঠলেন কুওজেলি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, “আমি লগারদের ক্যাম্প এড়িয়েই চলি। কিন্তু সেদিন যেতে গিয়ে মুনিয়া-র সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল। তারপর কী যে হল… প্রথমে ওকে নিয়ে এলাম; তারপর আনলাম ওর মা-কে! আমার মা আমার সামনে বিশেষ কিছু বলতে পারতেন না। তবে এইবার উনি খুব রাগ করেছিলেন। সেই রাগ, আর আমাদের এই পরিরাজ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে উনি এমন একটা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।”
“ওই গ্রিডগুলো…?”
জিটা-র প্রশ্নের উত্তরে ছোট্ট করে মাথা নেড়ে কুওজেলি বললেন, “কনফেডারেশন এমন আরো বেশ কিছু জিনিস রেখে গেছে তিস্তান-এর এদিকে-সেদিকে। আমার মা কিন্তু জানেন, সেগুলো কীভাবে চালাতে হয়। তাঁকে খুঁজে পাবেন না আপনারা। তবে তিনি যাতে আর কিছু করতে না পারেন সেইজন্য জিনিসগুলোকে খুঁজে বের করে নষ্ট করার চেষ্টা করুন।”
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে এবার রয়ের দিকে ঘুরলেন জিটা, “ডক্টর নোমুরা বোধহয় এখনই তাঁর বোনকে নিয়ে ছায়াপথের ওপারে পাড়ি দিতে পারবেন না। কিন্তু আমার কাছে আদেশ এসেছে, আপনাকে নিয়ে এখনই চুলা-র দিকে যাওয়ার জন্য। ওখান থেকে লুপের ব্যবস্থা হচ্ছে, যাতে আপনি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গ্যানিমিড ফিরতে পারেন। আপনি তৈরি?”
“হ্যাঁ।” বলে নিজের ছোট্ট ব্যাগটা হাতে তুলে নিল রয়। তারপর তার দৃষ্টি আবার আকৃষ্ট হল কুওজেলি-র পায়ের দিকে।
“মাটিতে পা পড়ে না আমার।” হাসলেন কুওজেলি, “দীর্ঘদিন ধরে রানি কিছু ওষুধ খাইয়ে আর ছোট্ট-ছোট্ট অপারেশন করে আমার পিঠে ওই ডানা গজানোর পাশাপাশি পায়েরও এই অবস্থা করে দিয়েছেন। আমি আগেও হাঁটতে পারতাম না; এখনো পারি না। তবে ভেসে যেতে পারি। উজলা চাইলে, হয়তো আবার উড়তেও পারব।”
“উজলা?” চমকে উঠল রয়।
“আপনাকে বলেছিলাম, মনে নেই?” বোনকে জড়িয়ে ধরে রয়ের দিকে তাকালেন নোমুরা। তাঁর চোখজোড়া চিকচিক করছিল। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না সবটা। সেভাবেই তিনি বললেন, “গানের প্রায় সব কথা সত্যি ছিল বলেছিলাম। পরে বুঝেছি, প্রায় নয়, সব সত্যি! কাজলা ছিল রানির দলে, আর এই উজলা চলে গেছিল লাল-দানো, মানে কনফেডারেশনের সঙ্গে।”
রয়ের অবাক দৃষ্টি আবার নেমে এল কুওজেলি-র পায়ের দিকে। নোমুরা হঠাৎ চমকে উঠে সোজা হয়ে বললেন, “রয়! আমরা কি একবার চেষ্টা করব?”
“চেষ্টা! কীসের?” অবাক হয়ে কুওজেলি নিজের বোনের দিকে তাকালেন।
একটা রহস্যময় হাসি মুখে ফুটিয়ে নোমুরা বললেন, “অসম্ভবের!”
১৭
গ্যানিমিড সেন্ট্রাল, অ্যামব্রোজিয়া অর্গ হাসপাতাল, ষষ্ঠ দিন
“অপারেশন করা যাবে না! এ কী বলছেন আপনি?”
উত্তেজিত ধৃতিমান আর একটু হলে মেডিকেল বোর্ডের চেয়ারপার্সনের কলার ধরে টানাটানি শুরু করতেন। তাঁকে কোনোমতে থামালেন ইমন। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে, আর কিছুটা অপরাধবোধ থেকেই নিউজকর্প-এর দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক এই হাসপাতালে এসেছিলেন। কিন্তু এ কী কথা?
“ব্যাপারটা দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন, প্রফেসর।” ডক্টর খোমেইনি ধৃতিমানকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “রুচিরা-র শরীরের নীচের অংশটার সঙ্গে তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোর সংযোগ আছে এবং থাকবে। আমরা সবদিক খতিয়ে দেখে বুঝেছি, অপারেশন করা হলেও তার দেহের ওই অংশ— যেখানে হকিং ভাইরাস স্থায়ী ক্ষতি ঘটিয়ে গেছে— আবার একই সমস্যার সৃষ্টি করবে। তখন মস্তিষ্ক প্রভাবিত হলে মৃত্যু অবধারিত। তার তুলনায় যন্ত্রের সাহায্যে রুচিরাকে…”
“ওটাকে বাঁচা বলে না!” আর্তনাদ করে উঠলেন ধৃতিমান। অসহায়ভাবে তিনি বললেন, “কেন বুঝতে পারছেন না? যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে মেয়েটা তাও এতদিন মুখ-চোখ দিয়ে অনেক কিছু বলত, কমপক্ষে বোঝাতে পারত। সেটাও যদি আপনারা স্থির করে দেন, তাহলে আমি কীভাবে বুঝব যে সে বেঁচে আছে? মনিটর দেখে?”
খোমেইনি ইমনের দিকে তাকিয়ে বোধহয় সমর্থন খুঁজছিলেন। কিন্তু ইমন কোনো কথা বললেন না। নেভি থেকে পোলানস্কি নিজে এসেছিলেন; তিনিও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তবে তাঁর এবং ঘরের প্রায় প্রত্যেকের মনের মধ্যে একটাই কথা ঘুরছিল।
ধৃতিমানকে বোঝানোর ক্ষমতা রাখা মানুষটি যদি এখন এখানে থাকত!
বাইরে হঠাৎই যান্ত্রিক গর্জন শোনা গেল। প্রত্যেকেরই মুখে রাগ, ভয়, বা অসহায়তা সরিয়ে মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠল বিরক্তি। অ্যামব্রোজিয়া-র পরিবেশ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ রাখাই নিয়ম। চিফ মেডিকেল অফিসার এগোচ্ছিলেন এই নিয়ে কিছু বলার জন্য। পোলানস্কি তাঁকে থামিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললেন, “নেভি-র শাটল নামল! তাহলে কি…?”
ছুটে নয়, প্রায় উড়েই করিডরে এল রয়। ধৃতিমানের হাতে একটা অ্যাম্পুল তুলে দিয়ে সে বলল, “প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। এর পরে জিনিসটা ভেঙে যেতে শুরু করবে। এখনই পুশ করতে হবে।”
“তার মানে! কী পুশ করতে হবে? কে আপনি?” বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন খোমেইনি।
ধৃতিমান কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রশ্ন করলেন, “কোথায় পুশ করলে সবচেয়ে দ্রুত ফল হবে?”
দেহের একটা বিশেষ অঙ্গ দেখিয়ে দিল রয়। খোমেইনিকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন ধৃতিমান। বাকি ডাক্তার আর সার্জেনরা হাঁ-হাঁ করে উঠতে গেছিলেন। কিন্তু ধৃতিমানের রুদ্ররূপ, আর তাঁর পেছনেই পোলানস্কিকে মাথা নেড়ে সবাইকে সরে যেতে বলার ইশারা করতে দেখে তাঁরা চুপ করে গেলেন। খুব সাবধানে ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জে অ্যাম্পুলের সবটুকু নিয়ে নিলেন ধৃতিমান। তারপর ঈষৎ ইতস্তত করে একজন সার্জেনকে ডেকে বললেন, “এইখানে পুশ করুন। সব দায়িত্ব আমার।”
ভীত মুখে, তবে স্থির হাতে সার্জেন ইঞ্জেকশন দিলেন। রয়ের মনে পড়ল কুওজেলি-র কথাটা, “রানি বলেছিল, পায়ের শিরাগুলো আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় এই জায়গা থেকেই। আমি উড়তে পেরেছিলাম। তোমার বন্ধু হাঁটতে পারবেই।”
নোমুরাই বলে দিয়েছিলেন, “এই ন্যানোবট আর ব্লাড ক্রিস্টালের ম্যাট্রিক্স চব্বিশ ঘণ্টার বেশি টিকবে না। রুচিরা আর আমার বোনের ব্লাড গ্রুপ একই। তাই ওই নিয়ে ভাববেন না। যত তাড়াতাড়ি পারেন, আপনি যান!”
অজ্ঞান শরীরটা সাড়া দিল না। তবে মনিটর দেখাল, হঠাৎ দ্রুত হয়ে উঠেছে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া। শূন্য দৃষ্টিতে রয়ের দিকে তাকালেন ধৃতিমান। শুকনো গলায় বললেন, “এবার বলো, কী ছিল ওতে?”
“উপহার।” রয় আঙুল তুলে রুচিরা-র পায়ের সঙ্গে যুক্ত মনিটরের দিকে ইশারা করল। ঘরসুদ্ধ প্রত্যেকের মুখ থেকে বেরিয়ে এল বিস্ময়সূচক নানা মন্তব্য বা অপশব্দ। বুকভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রয় ধৃতিমানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “পরিদের রানি-র উপহার।”
একটার পর একটা মনিটর নতুন করে ফুটিয়ে তুলল প্রাণের স্পন্দন। খোমেইনি, পোলানস্কি, ইমন— সব্বার সব প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে এক বৃদ্ধ আর এক যুবক অনন্ত আশা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষটির মুখের দিকে।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: এই গল্পের ওয়ার্ল্ড-বিল্ডিং-এর জন্য আমি কল্পবিজ্ঞানের গ্র্যান্ড মাস্টার পল অ্যান্ডারসনের হিউগো ও নেবুলা-জয়ী কাহিনি “দ্য কুইন অফ এয়ার অ্যান্ড ডার্কনেস”-এর কাছে ঋণী]
Tags: উপন্যাস, ঋজু গাঙ্গুলী, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
মানুষের মহাবিশ্ব জোড়া সভ্যতার আর দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে টানটান রহস্য উপন্যাস । এককথায় দুর্দান্ত !!