সূত্র
লেখক: আইভার যর্গেনসন (পল ওয়ারেন ফেয়ারম্যান-এর ছদ্মনাম), অনুবাদ: সম্রাট লস্কর
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ওটারকিয়ান যানটি নিজেদের গ্রহে ফেরার জন্য লম্বা যাত্রাটা শুরু করার ঠিক দশ মিনিট আগে খুনটা হয়েছিল। আর খুনের ব্যাপারটা জানা গেল যাত্রা শুরুর দশ মিনিটের মধ্যেই। খুনি এক দুর্বিনীত পাহাড়ি যে এই অভিযানে একেবারে শেষ মুহূর্তে যোগ দিয়েছিল রক্ষীর পদে। সে নিজেই সার্জেন্টের কাছে নিজের কাজের বড়াই করছিল।
হাসতে হাসতে বলছিল, “ব্যাটা একটা পাথরের আড়াল থেকে আমাদের যানটি দেখছিল। আমি ধীরে ধীরে ওর পিছনে গেলাম। তারপর মট্ করে ওর ঘাড়টা ভেঙে দিলাম। ব্যাটা বুঝতেই পারে নি ওর সঙ্গে কী হল। তারপর ওর দেহটা নিয়ে যা করলাম…”
খুনি রক্ষীকে নিয়ে যাওয়া হল কমান্ডারের কাছে। কমান্ডারের মুখ রাগে লাল কিন্তু কণ্ঠস্বর শান্ত।
“এই অভিযানের পরিণতি কত সরু সুতোয় ঝুলছে তা তুমি জানতে না?”
“জানতাম, কমান্ডার।”
“এই অভিযান কতটা গোপনীয়তার সঙ্গে আমরা করছি তা তোমার জানা ছিল না?”
“ছিল, কমান্ডার।”
“মহান ওটারকিয়ান কাউন্সিলের হয়ে তোমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করার আগে এটা আমার জেনে নেওয়া প্রয়োজন ছিল।”
“হ্যাঁ, কমান্ডার।”
কমান্ডার আর কথা না বাড়িয়ে নিজের আগ্নেয়াস্ত্রটা তাক করলেন খুনির দিকে। ট্রিগারে চাপ দিতেই লোকটার দেহ লুটিয়ে পড়ল।
কিন্তু দুশ্চিন্তাটা তো রয়েই গেল। কমান্ডার সহকারীর সঙ্গে পরামর্শে বসলেন।
“আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো।”
“কিন্তু আমরা যখন পৌঁছোব তখন তো মধ্য দুপুর”, সহকারী সময় হিসেব করে বলল।
“আমরা অন্ধকার নামার জন্য অপেক্ষা করতে পারি।”
“তা বটে।”
“কিন্তু পনেরো ঘণ্টার দিনের আলো কেটে যাবে তার মধ্যে।”
“জায়গাটা বেশ ফাঁকা। তেমন কেউ ওখানে যায় না।”
“যদি ওখানে আমাদের জন্য কোনো ফাঁদ পাতা থাকে?”
সহকারী একটু ভাবল, “মৃতদেহ যদি ওরা খুঁজেও পায় তাতে কীই বা প্রমাণিত হবে? আমাদের সঙ্গে এই হত্যার
কোনো যোগ আছে তা প্রমাণ করা অসম্ভব।”
“আমাদের অভিযানের সাফল্য পুরোটাই গোপনীয়তার ওপর নির্ভর করছে। যদি আমাদের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয় …”
“অবশ্যই হবে, কমান্ডার।”
“আমিও সেই আশাই করি। বেশ চল, নিজেদের গ্রহেই ফেরা যাক …”
* * *
আরিজোনা মরুভূমির একটা ফাঁকা জায়গায় টম ব্রেজিয়ার আর ফ্র্যাঙ্ক ব্রুক্স যখন ম্যাক স্টাইল্সের মৃতদেহটা খুঁজে পেল তখন দুপুর দু’টো বেজে গেছে। স্টাইল্স সময়মতো রিপোর্ট না করায় ওরা দু’জন জিপ নিয়ে ওকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। এক জায়গায় স্টাইল্সের জিপটা তেরছা ভাবে থেমে আছে দেখে ওরা থামে। জিপ থেকে নেমে চারপাশটা ঘোরাঘুরি শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা মৃতদেহটা দেখতে পায়। দু’জনের মুখেই যুগপৎ বিস্ময় ও আতঙ্ক।
“ও যিশু”, ব্রেজিয়ারের গলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে শব্দ দুটো।
“ওকে এভাবে কে মারল?”
“ওর পা দুটো দেখো। যেন মেশিন দিয়ে পিষে দিয়েছে কেউ।
“কোনো মানুষের কাজ নয় এটা।”
ব্রুক্সের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ব্রেজিয়ার এগিয়ে গেল সামনে। একটা সাদা সমতল ভূমি, ক্ষারে ভর্তি। কিছুটা এগিয়ে ও থামল। চোখ চারিদিকে ঘুরছে। প্রথমে কিছুই নজরে এল না। তারপর সমতলটার একটা ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা দাগ চোখে পড়ল। ব্রেজিয়ার চোখ তীক্ষ্ণ করে দেখতে লাগল চারদিক। একটা নয়, মোট চারটে দাগ। ঠিক যেন এক বিশাল বর্গক্ষেত্রের চারটি কোনা। চারটি কোনার মাঝখানে কি কিছু একটা ছিল? বিশাল আকারের? নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল।
“ওইদিকে একটা শহর আছে।”
ব্রুক্স পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিত করছে এক দিকে। সত্যিই, কোণের দিকের বিশাল পাথরের ফাঁকটা দিয়ে তাকালে একটা শহর দেখা যাচ্ছে। খুব একটা দূরেও নয়।
“আছে তো। তুমি আগে দেখ নি ওটা?”
“বোধহয় দেখেছি। এটা সেই শহরটা না যেটা নচ্ড বাট রোড থেকে মোটামুটি মাইল দুয়েক দূরে? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ, সেটাই।”
ওরা দু’জনই চল্লিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে যে মিলিটারি ক্যাম্প আছে সেখান থেকে এসেছে। ব্রেজিয়ারের পদমর্যাদা ব্রুক্সের উপরে। জিপের দিকে ফিরতে ফিরতে ও ব্রুক্সকে বলে, “ফোন করে একটা রিপোর্ট দিয়ে দাও। ওদের আসতে বল এখানে।”
“আমরা কি অপেক্ষা করব না?”
“না, আমরা ওই শহরটায় যাব।”
“ওই শহরটায়? আমরা কয়েকজন তো সপ্তাহখানেক আগেই এই শহরটাই দেখে এলাম।”
“জানি তো, কিন্তু …”, টম ব্রেজিয়ার ভ্রূ কুঁচকে তাকাল।
“কিন্তু কী?”
“শহরটায় কিছু একটা গোলমাল আছে—কিছু একটা ঠিকঠাক নেই।”
“গোলমাল? আমাদের তো কিছু তেমন মনে হয় নি।”
ব্রেজিয়ার অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। “আমি একা শহরটায় ঘুরে এসেছি একবার।”
“সে কী, আমাকে বল নি তো আগে?”
“তেমন কিছু বলার ছিল না। সমস্যাটা কোথায় সেটাই ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“দেখে তো মনে হয় এই শহর অনেকদিনের।”
“তা বলতে পারো। ১৮৯০ সাল নাগাদ রুপোর খনির খোঁজ পাওয়া যায় এখানকার পাহাড়ে। ব্যাস, আর কী। জমজমাট হয়ে পড়ে এই শহর। তবে রুপো শেষ হতে বেশি বছর লাগে নি। তখন আর লোকে কেন থাকবে এখানে? কিছুদিনের মধ্যেই শহরটা পরিত্যক্ত হয়।”
“অল্প সময়ের সুখ।”
“সময়টা অল্প সেটা ঠিক। সুখের কথা জানি না। যাই হোক, রুপো ফুরিয়ে যাওয়ার পর এই শহর পুরোটাই পরিত্যক্ত হয় বলা যায়। তবে যাতায়াতের পথে বিশ্রামের জন্য কেউ কেউ শহরটাকে ব্যবহার করত।”
“এখনও তো চল্লিশ-পঞ্চাশ জন শহরটাতে আছে দেখলাম। এরা কোত্থেকে এল?”
“বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই এসেছে। তার বেশি কিছু জানি না।”
“তোমার যদি কোনো সন্দেহ থেকে থাকে আরেকবার ভালো করে শহরটা দেখে আসা যাক। তবে মনে হয় না এরা অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছে।”
“হোটেলের মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। বুড়ো এল্ পাসো থেকে এসেছে। দু’জন ইউরেনিয়াম-সন্ধানীর ব্যাকগ্রাউন্ডও ঠিকঠাক লাগল।” ব্রেজিয়ারের ভ্রূ আরো যেন কুঁচকে গেছে, “তবে কী জানো তো ব্রুক্স, মানুষগুলো নিয়ে আমার কোনো অস্বস্তি হয় নি।”
“তাহলে?”
“আরে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না…”, ব্রেজিয়ারের গলা রুক্ষ।
ব্রুক্স একটু অবাকই হল, “বেশ, বেশ। চটছ কেন? আমি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে দিচ্ছি।”
* * *
জিপে যেতে যেতে তেমন কথাবার্তা হল না। দু’জনেই চুপ করে ভাবছে একই কথা। কিছু নতুন, অভাবনীয় তথ্য মিলিটারির কাছে এসেছে যা খুবই উদ্বেগজনক। উড়ন্ত চাকী এখন আর কোনো মজার বিষয় নয় বরং প্রকৃত দুশ্চিন্তার বিষয়। ভিন গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীর চারপাশে ঘোরাফেরা শুরু করেছে আর তাদের উদ্দেশ্য আমাদের গ্রহ দখল করা। অবশ্যই এই সব কথা সাধারণ মানুষদের জানানো হয় নি।
ধীরে ধীরে আরো তথ্য সামনে এসেছে। এই এলিয়েনরা উন্নতবুদ্ধিধারী হলেও তাদের একেবারেই মানুষদের মতো দেখতে নয়। কোনোভাবেই তারা মানুষের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারবে না। যতদূর জানা গেছে ওদের কাছে তেমন শক্তিশালী কোনো অস্ত্রও নেই যা দিয়ে তারা পৃথিবী দখল করতে পারে। তবে প্রাণীগুলো খুবই হিংস্র আর ধূর্ত, যে কোনো ভাবে ওরা পৃথিবীর দখল নিতে চায়।
ওদের জিপ একটা সাইনবোর্ডের পাশ দিয়ে শহরে ঢুকে গেল। সাইনবোর্ডে লেখা, ‘মেসা ফ্ল্যাট্স—পপ. ২১’। হরফগুলো অস্পষ্ট। বেশ কষ্ট করে পড়তে হয়।
শহরে ঢুকে একটু এগোতেই একটা বড়ো বিল্ডিং চোখে পড়ল। এখানে সামনের সাইনবোর্ডটা অবশ্য স্পষ্ট, ‘এল্কহর্ন হোটেল।’ ওরা জিপ থেকে নেমে এগিয়ে গেল হোটেলের গেটের দিকে। বাইরে দু’জন বয়স্ক মানুষ হেলানো চেয়ারে বসে আছে। দেখেই বোঝা যায় স্থানীয় মানুষ। ওদের মধ্যে একজন মুখ ঘুরিয়ে আগন্তুকদের দিকে একবার তাকাল। অন্যজন পাত্তাও দিল না। তামাক চিবোতে চিবোতে মরুভূমির দিকে চেয়ে রইল।
রিসেপশনে সেই এল্ পাসোর বুড়োটা যার সঙ্গে ব্রেজিয়ারের কিছুদিন আগেই কথা হয়েছিল। বুড়ো ওদের দেখেই “আসুন, আসুন” বলে রেজিস্টার আর একটা আধভাঙা পেনসিল এগিয়ে দিল।
ব্রেজিয়ার যখন রেজিস্টারে ওদের নাম নথিভুক্ত করছিল, ব্রুক্স চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নিল। বড়োই সাধারণ হোটেল কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই তো তেমন মনে হল না। কিছু তেমন না পেয়ে বুড়োকেই জিজ্ঞেস করে বসল, “তা এই হোটেলটা কতদিন ধরে চালাচ্ছেন, দাদু?”
“তা বছর দশেক হবে। তবে বাবা, আমার নাম ফ্র্যাঙ্ক সিব্লি। বিয়ে-টিয়ে করা হয় নি। ছেলে-মেয়েই নেই, তো দাদু আর কী করে হব? দাদু-টাদু বলে আর কষ্ট দিও না।”
হাসিমুখেই বুড়ো কথাগুলো বলল। এক নিমেষে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে নেমে এসেছে। ব্রুক্সও পালটা হাসল।
“এখানকার রেস্তোরাঁর খাবারের মান কী রকম?” ব্রেজিয়ার জিজ্ঞেস করল।
“ভালোই তো। শুধু ভাজা বিন-ই পাবে অবশ্য। আর চেষ্টা করলেও বিন ভাজা খারাপ করা যায় না।”
“খুব করা যায়”, ব্রুক্স বলে।
“তা ক’দিন থাকা হবে?”
“দিন দুই থাকব। পাহাড়গুলোয় একটু ঘোরাঘুরি করব। বলা তো যায় না ইউরেনিয়ামের খোঁজ পেয়েও যেতে পারি। তখন আবার জিনিসপত্র নিয়ে আসতে হবে।” ব্রেজিয়ার উত্তর দিল।
“তোমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক। ঘরটা দোতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে দ্বিতীয় দরজা।”
“ধন্যবাদ।”
ওরা ঘরে না গিয়ে শহরটা ঘুরতে বেরোয়। রাস্তায় কিছু লোকজন আছে, মহিলা, পুরুষ, বাচ্চা, সবাই। ওদের দু’জনকে দেখে কেউ তেমন অবাক হল না। বাইরের লোকজন তার মানে এখানে আসে।
দু’জনেই প্রথমে চুপচাপ ছিল। একটু পর ফ্র্যাঙ্ক ব্রুক্স বলে, “এখানে কি কোনো বিশ্বাসঘাতক থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয় টম? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। এখানকার লোকজন তো খুব-ই সাধারণ। এলিয়েনরা নিশ্চয় এদের মধ্যে থেকে…
“আমি মোটেই ওসব ভাবছি না। খিদে পেয়ে গেছে। লাঞ্চটা করে নেওয়া যাক।”
ওরা রেস্তোরাঁয় ঢোকে। এক বেশ মোটাসোটা মহিলা ওদের সার্ভ করে। খাবারের মান ঠিকঠাক। এই সব জায়গায় এর থেকে ভালো আশা করা যায় না।
খেয়ে দেয়ে ওরা আবার বাইরে আসে। ব্রেজিয়ার মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়েই থাকে।
“কী হল আবার?”
“বুঝতে পারছি না, কিন্তু কেন পারছি না? এই শহরে নিশ্চিত কিছু গোলমাল আছে। কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছে না গোলমালটা কোথায়…”
“টম তুমি বিষয়টা নিয়ে একটু বেশি-ই ভাবছ না তো?”, ব্রুক্সের গলায় স্পষ্ট উদ্বেগ।
“একেবারেই নয়। আচ্ছা, তোমার এ’রকম কখনও হয় নি যে কোনো জায়গা থেকে ফেরার পর মনে হয়েছে যে না ওখানে কিছু একটা গোলমাল ছিল। কিছু একটা তোমার চোখ এড়িয়ে গেছে।”
“টম তোমার মতো এত সংবেদনশীল আমি নই তবে আমি বোধহয় বুঝতে পারছি তুমি কী বলতে চাইছ। তবে আমার মনে হয় এটা এক ধরনের বিভ্রম। এই শহরটার সঙ্গে তুমি নিশ্চয় অন্য কোনো জায়গাকে মিশিয়ে ফেলছ। এরকম হয় মাঝে মাঝে।”
“তা হতে পারে। চল, পুরো শহরটা আরো ভালো করে ঘুরে আসা যাক।”
* * *
জিপে চেপে ওরা সেটাই করল বাকি দিনটা। কেউ ওদের বিরক্তও করল না, তেমন পাত্তাও দিল না। সন্ধেবেলায় ফিরে আবার সেই রেস্তোরাঁয় ডিনার। সেই মোটা মহিলাই ডিনার সার্ভ করল। তারপর হোটেলে ফেরা। হোটেলের ঘরের বাল্বের আলোটা এত দুর্বল যে ওরা দু’জন শুয়ে পড়াই ঠিক করল। বিশেষ করে ব্রুক্স। ও আর পারছিল না যেন। সারাদিন এত ঝামেলা আর পরিশ্রম হয়েছে। বালিশে মাথা দিতেই ও গভীর ঘুমে ডুবে গেল।
কিন্তু বেশিক্ষণ আর ঘুম হল কই। কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল।
“কী… কী হয়েছে?”, ধড়মড় করে উঠে বসল ও।
“আমি বুঝে গেছি ব্যাপারটা।”
“কী বুঝেছ? কোন্ ব্যাপার?”
ব্রেজিয়ার যেন কথাটা শুনতেই পায় নি। ঘরের আলো জ্বালিয়ে ও বিছানায় বসে আছে। চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল, মুখে দৃঢ়তা।
“এদের এমনি এমনি এখানে রেখে যায় নি, বুঝলে। নিশ্চয় কিছু একটা দিয়ে ওদের নিয়ন্ত্রণ করছে দূর থেকে। কিছু একটা আছে এখানে। তাড়াতাড়ি ড্রেস করে নাও।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। শার্টটা পরতে পরতে ব্রুক্স বলে, “কিন্তু আমরা ঠিক কী খুঁজছি?”
“নিশ্চিত বলতে পারছি না। তবে মেশিনের মতো কিছু হবে।”
ওরা দু’জন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বড়ো হল ঘরে এল।
“মেশিনের মতো কিছু হলে সেটা সেলার বা বেসমেন্টের মতো জায়গাতেই থাকা উচিত, তাই না?”
“তাই তো মনে হয়। আর সেটা থাকবে শহরের সব থেকে বড়ো বিল্ডিংয়ের নিচে।”
“সব থেকে বড়ো বিল্ডিংটা তো এই হোটেলটাই।”
“এখানেই কোনো গুপ্ত দরজা থাকবে তাহলে।”
নিজেদের পকেট টর্চ বের করে খুব সাবধানে ওরা হোটেলটা খুঁজল। কিন্তু কোনো লুকোনো দরজা বা সুড়ঙ্গের মুখ নজরে এল না। এই হোটেলটার নিচে কিছু নেই এটা নিশ্চিত।
“আমাদের অন্য বিল্ডিংগুলো খুঁজতে হবে”, ব্রেজিয়ার হাল ছাড়তে নারাজ।
এবং যা খুঁজছিল তা ওরা পেয়ে গেল রেস্তোরাঁর নিচে। পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই কাউন্টারের পিছনে একটা গোপন দরজা দেখতে পেল। হাতল ধরে ব্রেজিয়ার টান দিতেই দরজাটা খুলে গেল।
একটা হালকা নীল আলোয় ভরা সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামল একটা স্টিলের দেওয়াল ঢাকা ছোট্ট ঘরে। মাঝখানে মেশিনটা রাখা আছে। নীল আলোটা মেশিন থেকেই আসছে। একটা মৃদু গোঁ গোঁ শব্দও ভেসে আসছে মেশিনটা থেকে। মনে হচ্ছে এই ধাতব দানবটা যেন ধ্বংসের অপেক্ষায় বসে আছে।
“তুমি যা বলেছিলে একদম সেটাই হল। আমরা যা খুঁজছিলাম সেটাই পেলাম। আমি বলছি যে …”
“আমাদের এখনই রিপোর্ট পাঠাতে হবে। অবশ্য জানি না আমরা এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারব কি না।” ব্রুক্সকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ব্রেজিয়ার বলে উঠল।
ব্রুক্স একেবারেই ভয় পায় নি। ওরা যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে অনুসন্ধানের কাজ করেছে। ও নিশ্চিত শহরের কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি। গোপন পথের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে ও ব্রেজিয়ারকে নিয়ে রেস্তোরাঁর পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। আর বাইরে এসেই থমকে দাঁড়াল।
ওরা সবাই সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেসা ফ্ল্যাটের প্রত্যেক বাসিন্দা। যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, এমনকি বাচ্চারাও—সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা অর্ধচক্রের আকার নিয়ে। কারো মুখে রাগ, হিংস্রতা, ঘেন্না এসব কিছুই নেই। কোনো আওয়াজও নেই। কিন্তু নীরবতাটা কী ভীষণ অস্বস্তিকর। ব্রুক্সের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন এক ভয়ের তরঙ্গ নেমে গেল। সামনের অর্ধচক্রটা ইতিমধ্যে ওদের দিকে এগোতে শুরু করেছে।
ব্রুক্স দেখল ব্রেজিয়ার কোটের পকেটে হাত দিয়ে বের করেছে তার অটোমেটিক পিস্তলটা। টম কী করতে চায়? এদের সবাইকে গুলি করে মারা সম্ভব নাকি?
ব্রেজিয়ার ওর সব থেকে কাছের লোকটাকে গুলি করল পর পর দু’বার, পয়েন্ট ব্ল্যাংকে। কিছুই হল না। লোকটা ধেয়ে এল ব্রেজিয়ারের দিকে।
“যিশুর দিব্যি, চুপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে গুলি চালাও। নয়তো বাঁচতে পারবে না।” ব্রেজিয়ার চেঁচিয়ে উঠল। ব্রুক্সকে অনেকেই ঘিরে ধরেছে ততক্ষণে।
ব্রেজিয়ার গুলি চালিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। “কোথাও তো একটা দুর্বল জায়গা থাকবে এদের দেহে। বুকে নয়, মাথায় নয়, গলায় নয়, তাহলে কোথায়?”
সৌভাগ্যক্রমে সেই দুর্বল জায়গাটা খুঁজে পাওয়া গেল। প্রথম যাকে গুলি করেছিল ব্রেজিয়ার, তার হাত ততক্ষণে প্রায় পৌঁছে গেছে ওর গলায়। ব্রেজিয়ার মরিয়া হয়ে যে গুলিটা চালাল সেটা লাগল লোকটার পায়ে। মুহূর্তে ও লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
“বাঁ পায়ের থাই। ওখানেই কন্ট্রোল আছে। ওদের বাঁ পায়ের থাই লক্ষ্য করে গুলি চালাও।”
ব্রুক্সের একদম গায়ের কাছে এসে গেছে রেস্তোরার সেই মোটা মহিলাটা। ও গুলি চালাল বাঁ পায়ের উপর দিকে। মহিলাটিও লুটিয়ে পড়ল। ব্রেজিয়ারের পরপর গুলিতে একটা সামান্য বেরোবার রাস্তা মতো তৈরি হয়েছে।
“ছোটো”, ব্রেজিয়ার চেঁচিয়ে উঠল।
“জিপটা তো হোটেলের সামনে…”
“নিকুচি করেছে জিপের…দৌড় লাগাও।”
ওরা দু’জন দৌড় লাগাল।
* * *
ক্যাম্পের ল্যাবরেটরিতে দেহগুলোর ব্যবচ্ছেদ চলছিল। চারিদিকে গোল হয়ে সবাই দেখছিল। কোনো আওয়াজ নেই কারো মুখে। সত্য আর মিথ্যার মধ্যে ব্যবধান এতটাই কম তা যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ওদের।
“দেহে রক্তের মতো একটা তরলও আছে দেখছি। বেশ ইন্টরেস্টিং”, কম্যান্ডিং অফিসার বললেন, “পরীক্ষা করে দেখতে হবে কী কী উপাদান আছে।”
ফ্র্যাঙ্ক ব্রুক্স টেবিলে যে দেহটার ব্যবচ্ছেদ হচ্ছিল সেটার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করল। “ওটা কি দেহ-মাংস নয়? ওগুলো কি হাড় আর চামড়া নয়?”
“হ্যাঁ আর না, দুটোই বলা যায়”, কম্যান্ডিং অফিসার উত্তর দিলেন, “এক ধরনের সিন্থেটিক দিয়ে তৈরি এগুলো। আমাদের মাংস, অস্থি আর চামড়ার থেকে আলাদা করা মুশকিল।”
“পায়ের মধ্যে কন্ট্রোল ইউনিট রাখার আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ”, টম ব্রেজিয়ার বলে ওঠে।
চারধারের উদ্বেগপূর্ণ মুখগুলো দেখে কম্যান্ডিং অফিসার স্ক্যালপেলটা টেবিলে রাখলেন, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা বেশ গুরুতর সন্দেহ নেই তবে পরিস্থিতি যতটা খারাপ মনে হচ্ছে ততটা কিন্তু নয়। এই আবিষ্কারের ফলে আমরা অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। বোঝাই যাচ্ছে কিছু বছর আগে ওরা মেসা ফ্ল্যাটে এসে হাতে গোনা যে ক’টা লোক ছিল তাদের হত্যা করে। তারপর কোনো উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমে মৃত মানুষদের মতো একইরকম অ্যান্ড্রয়েড তৈরি করে। এক ধরনের ক্লোনিং বলা যায়। তারপর ধীরে ধীরে আরো অ্যান্ড্রয়েড তৈরি হয়। শহর জমজমাট হতে শুরু করে।”
“কিন্তু এরা যদি মানুষের মতো অ্যান্ড্রয়েড তৈরি করতে পারে…”, ব্রুক্সের গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট।
“অত চিন্তার কিছু নেই। ওরা জানে আমাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে পারবে না। তাই এ’রকম চোরা অনুপ্রবেশ। কিন্তু আমাদের কাছে যা তথ্য এসে গেছে তাতেই হবে। আমরা ঠিক ওদের হারিয়ে দেব।”
কম্যান্ডিং অফিসার তারপর ব্রুক্স আর ব্রেজিয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে এর কৃতিত্ব অনেকটাই তোমাদের দু’জনের। খুব ভালো কাজ করেছ তোমরা।”
“আমি? আমি তো কিছুই করি নি। সবই তো…” ব্রুক্স বলে ওঠে।
“ব্যাস, ব্যাস। আর নয়। মিটিং এখানেই শেষ। ব্যবচ্ছেদের কাজ এখনও বাকি। তোমরা সবাই যেতে পার।” কম্যান্ডিং অফিসারের আদেশের পর আর কিছুই বলার থাকল না।
* * *
বাইরে এসে ব্রুক্স ব্রেজিয়ারের দিকে ফিরে বলল, “এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। সবই তো তুমি করলে। আমি কেন প্রশংসা পাব? তুমিও তো নিজের মুখে কিছু বলতে পারতে।”
“আরে, তুমি তো বললে যা বলার। তাছাড়া এটা টিম ওয়ার্ক। তুমি যথেষ্ট করেছ।” ব্রেজিয়ার হাসি মুখে বলল।
“আমি তো এখনও বুঝলাম না মাঝরাতে তোমার মাথায় এমন কী এল যাতে তুমি আমায় ঘুম থেকে তুলে মেশিন খুঁজতে নিয়ে গেলে। কী এমন সূত্র যেটা আমি এখনও ধরতে পারলাম না।”
“তোমার মনে আছে আমি বারবার বলছিলাম শহরে কিছু একটা গোলমাল আছে?”
“অবশ্যই মনে আছে কিন্তু …”
“মাঝরাতে ব্যাপারটা মাথায় এসে গেল বুঝলে। যদি শহরটাতে লোক বসবাস মাত্র কয়েক মাস আগে শুরু হত তাহলে একটাও না থাকার কারণ বোঝা যেত …”
“কোন্টা না থাকার কথা বলছ?”
“কিন্তু দশ বছর ধরে যেখানে লোক বসবাস করছে, বুড়ো হোটেল মালিকের কথাটা মনে আছে নিশ্চয়, সেখানে একটাও থাকবে না, এটা খুবই অদ্ভুত।”
“আরে, কী একটাও থাকবে না? কীসের কথা বলছ?”
“কবরস্থান।”
ব্রুক্সের মুখ হাঁ হয়ে গেল, “ঠিক তো, শহরটায় তো একটা কবরও চোখে পড়ে নি।”
ব্রেজিয়ারের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত, “তাহলে দেখা গেল অতি চালাকের গলায় দড়ি। অতি বুদ্ধিমান এলিয়েনরা এখানকার বাসিন্দাদের মেরে তাদের দেহগুলো ধ্বংস করে না দিলে এই সমস্যাটা হত না। একটা কবরস্থানের কথা ওদের উন্নত মস্তিষ্কে এলে আমি কোনো সন্দেহের সূত্রই পেতাম না।”
“টম তোমার তো মেডেল পাওয়া উচিত”, আন্তরিক স্বরে ব্রুক্স বলে ওঠে।
“আরে ধুর্, ধুর্। তার থেকে কড়া কফি খেলে কাজ দেবে। চল, চল, আমায় সঙ্গ দেবে।”
দু’জন হাঁটা দেয় ক্যান্টিনের দিকে।
*****
লেখক ও গল্প পরিচিতি
পল ওয়ারেন ফেয়ারম্যান (১৯০৯-১৯৭৭): আমেরিকান লেখক ও সম্পাদক। নানা ধরনের গল্প লিখলেও মূলত কল্পবিজ্ঞান গল্প লিখেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি তিনি বিখ্যাত ‘অ্যাামেজিং স্টোরিজ’ আর ‘ফ্যান্টাস্টিক’ পত্রিকা দুটি একই সঙ্গে সম্পাদনা করতেন। ‘মিস্ট্রি অ্যাট মেসা ফ্ল্যাট’ গল্পটি আইভার যর্গেনসন ছদ্মনামে লেখা। গল্পটি ‘ইম্যাজিনেশন স্টোরিজ অব্ সায়েন্স অ্যান্ড ফ্যান্টাসি’ পত্রিকার জুন ১৯৫৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কল্পবিজ্ঞান আর ডিটেকটিভ — এই দুই জঁরেরই দেখা মেলে এই লেখায়। গল্পটি পাবলিক ডোমেইনে উপলব্ধ।
Tags: অনুবাদ গল্প, আইভার যর্গেনসন, পল ওয়ারেন ফেয়ারম্যান, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সম্রাট লস্কর