রূপান্তর
লেখক: কেন লিউ, অনু- রনিন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
প্রতিটি রাতে, ঘুমোতে যাওয়ার আগে, রিনা রেফ্রিজারেটরগুলোকে পরীক্ষা করতে ভুলত না।
রান্নাঘরে দুটো রেফ্রিজারেটর রয়েছে। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সার্কিটের সঙ্গে যুক্ত। ওদের একটার দরজায় আবার সুদৃশ্য ‘আইস ডিস্পেন্সার’ আছে। বসার ঘরেও একখানা রেফ্রিজারেটর আছে, টিভিটা তার ওপরে বসানো। আরও একটা সাজানো আছে শোওয়ার ঘরে- ওটা ব্যবহৃত হয় নাইটস্ট্যান্ড হিসাবে। কলেজ ডর্মে যেমন থাকে তেমনি একটি বর্গাকার ছোট্ট রেফ্রিজারেটর দিয়ে সাজানো তার দালানটা। এছাড়াও বাথরুমে সিঙ্কের নিচে রয়েছে একটি ‘কুলার’, রিনা রোজ রাতে নিয়ম করে পুরোনো বরফ পাল্টে সেটাকে সচল রাখে।
রিনা প্রতিটি রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি মেরে দেখে। অধিকাংশই খালি। রিনার তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই বিশেষ। জিনিসপত্রে ওদের ভরিয়ে রাখার কোনও পরিকল্পনা কোনওদিন ছিল না তার। তবে প্রাত্যহিক এই পর্যবেক্ষণটা তার কাছে জীবন-মৃত্যুর মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে নিজের আত্মাকে সংরক্ষন করার এটাই ছিল একমাত্র উপায়।
বরফ জমানোর খোপটা তার ভারী প্রিয়। রেফ্রিজারেটরগুলোর দরজা কয়েক মুহূর্তের জন্য খুলে রাখতে খুব ভালো লাগতো রিনার। জমাট শৈত্যের কুয়াশাকে বাতাসের বুকে মিলিয়ে যেতে দিত সে। আঙুলে, স্তনে, মুখে শীতের অনুভূতি মেখে নিত নিঃশব্দে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিত। মোটরের শব্দ জেগে উঠত রেফ্রিজারেটরের হৃদয়ে।
সবকটা রেফ্রিজারেটরকে দেখে নেবার কাজ শেষ হলে রিনার ঘরে মোটরগুলোর সমবেত কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়াত। অনুচ্চ, আত্মবিশ্বাসী গুঞ্জন। রিনার কাছে ওই শব্দটা নিরাপত্তার সমার্থক।
এ সবের শেষে শোওয়ার ঘরে নিজেকে চাদরে মুড়ে শুয়ে পড়ত রিনা। দেয়ালে দেয়ালে বেশ কিছু হিমবাহ আর হিমশৈলের ছবি টাঙানো আছে। মেয়েটি ছবিগুলোর দিকে চেয়ে থাকতো নির্নিমেষ নয়নে। ফেলে আসা দিনের বন্ধু যেন ওরা। রিনার বিছানার পাশটিতে একটি রেফ্রিজারেটরের ছবি কাঠের ফ্রেমে বন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা এমি’র ছবি। কলেজের রুমমেট ছিল সে একদা। অনেকদিন যোগাযোগ নেই আর। তবুও রিনা ছবিটাকে রেখে দিয়েছে যত্ন করে।
রিনা বিছানার পাশে রাখা রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলত। কাচের রেকাবিতে রাখা নিজের বরফখন্ডটার দিকে চেয়ে রইত কিছুক্ষণ। টুকরোটা যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে আরও। রেফ্রিজারেটর বন্ধ করে দিত রিনা। তার মাথার কাছে রাখা বইটি হাতে তুলে নিত নিঃশব্দে।
**
ভিনসেন্টের হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম, অবশেষে। তার দাবি, সে আমায় ভালোবাসে না আর। কথাটা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। আত্মসংযম হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে সে আমায় রূঢ়ভাবে চলে যেতে বলেছিল। আমি বলেছিলাম, আমায় একটু চা বানিয়ে খাওয়াবে?
ছোঁড়াটাই আমার সর্বনাশ করেছে। খবরটা অজানা ছিল না। তবুও ওর নিজের মুখ থেকে উত্তরটা শুনতে বড় কষ্ট হয়েছিল। বর্বর কোথাকার!
ভিনসেন্ট দুটো সিগারেটে শেষ করল নিজে। আমার দিকে বাড়িয়ে দিল বাক্সটা। মুখে তেঁতো স্বাদ। তাই একটাতেই ক্ষান্তি দিলাম। আমার হাতে ওর লিপস্টিক ধরিয়ে দিল। যাতে ধেবড়ে যাওয়া ঠোঁটজোড়াকে একটু গুছিয়ে তুলতে পারি। কিছুই হয়নি যেন। একেবারে পুরোনো দিনগুলোর মতন। তখন আমরা ভাসের-এ থাকতাম।
“একটা কবিতা লেখো না, আমার জন্য,” আমি বলে উঠেছিলাম। সে অবশ্য আমার অনুরোধ পায়ে ঠেলেনি।
মনে হচ্ছিল ও আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়। যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছে। ভিনসেন্ট ওর মোমবাতিটাকে মোমাধারে রাখল। ওটা আমারই বানিয়ে দেওয়া আসলে। ও তারপরেই মোমবাতির দুটো প্রান্তে আগুন লাগিয়ে দিল। এভাবে যখন ও নিজের আত্মাকে জ্বালাত, তখনই ওকে সবচাইতে অপরূপা মনে হত আমার। ওর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। ওর ফ্যাঁকাসে ত্বকের নিচ থেকে যেন আলোর দ্যুতি উঁকি দিত। চীনা লন্ঠনের কাগজের আস্তরণের মধ্যে যেমন আগুনের বিস্ফোরণ হয়, ঠিক তেমন। দ্রুত পদক্ষপে এমন করে ঘরময় পায়চারি শুরু করল যেন এবার বুঝি দেয়ালগুলোকে ভেঙেই ফেলবে। আমি বিছানায় পা গুটিয়ে নিলাম। ওর টুকটুকে লাল শালে নিজেকে মুড়ে নিলাম। নিজেকে দূরেই রাখলাম আসলে।
ভিনসেন্ট টেবিল চেয়ারে গুছিয়ে বসল। কবিতা লিখল। লেখা শেষ হতেই মোমবাতিটা নিবিয়ে দিল। মোমের অকারণ অপচয়ে মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল ওর। বাতাসে তখন দগ্ধ মোমের সুবাস। আর তাতেই আমার চোখে আবার অশ্রুর ঢেউ দুলে উঠল। নিজের জন্য একটা প্রতিলিপি রেখে আসল কবিতাটা সে আমায় দিল।
“আমি তোমায় সত্যিই ভালোবেসেছিলাম, এলেইনা,” সে বলল, “এবার ভালো মেয়ের মতন আমায় একটু একা থাকতে দাও দেখি।”
ওর কবিতাটা ঠিক এমনি করে শুরু হয়:
What lips my lips have kissed, and where, and why,
I have forgotten, and what arms have lain
Under my head till morning, but the rain
Is full of ghosts tonight, that tap and sigh —
(কার ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিলাম, কোথায় এবং কেন,
মনে নেই আর, কোন সে বাহুর বন্ধনে
আজ ভোরেও মাথা রেখেছিলেম, মনে আছে খালি বরিষণে
আজ রাতের অভিসারে পাওনা শুধু স্মৃতির বিলাপ, আলতো পরশ আর বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস-)
ভিভ, কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল, ওর মোমবাতিটাকে ভেঙে দু’টুকরো করে ফায়ারপ্লেসে ছুড়ে দিই। ওর আত্মাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিই। মনে হচ্ছিল যেন ওকে আমার পায়ের সমানে মূক যন্ত্রনায় দুমড়ে মুচড়ে যেতে দেখি। কাতরকণ্ঠে সে যেন আমার কাছে জীবনভিক্ষা করে, আমি চেয়েছিলাম।
কিন্তু ওর মুখে কবিতাটা ছুড়ে দিয়ে চলে আসা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না।
তারপর দিনভর নিউ ইয়র্কের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ালাম ভবঘুরের মতন। মন থেকে কিছুতেই ওর বুনো সৌন্দর্যের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলাম না। খালি ভাবছিলাম, যদি আমার আত্মা আরও একটু বেশি ওজনদার হত, আরও ভারী হত, তাহলে বুঝি বা আমার গুরুত্ব বাড়ত। সে হবার নয়। আমার আত্মা পাখির পালক, পকেটের মধ্যে মুখ লুকিয়ে থাকা জঘন্য একটি রাজহাঁসের পালক, যে খালি হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় ওর রূপের বহ্নির চারদিকে। নিজেকে আজ পতঙ্গ বলে মনে হচ্ছিল বারবার।
**
রিনা বইটা নামিয়ে রাখল। সে ভাবছিল।
আত্মাকে এমন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবার ক্ষমতা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে অনাবিল নিয়ন্ত্রণের এই যে অপার শক্তি, আলোর এমন অকৃপণ ঔজ্জ্বল্য, কার্যকারণের কথা ভুলে এমন নির্ভীক যাপন- সব কিছুর বিনিময়ে এমন একখানা জীবন পাওয়ার উপায় কী?
মিল্লেই তাঁর মোমবাতির দুধারেই আগুন জ্বালাতে পারতেন। সে ভাবেই কাটিয়ে গেছেন এক দ্যুতিময় জীবন। যখন তাঁর মোমবাতি নিভে গিয়েছিল, তিনি দেহ রেখেছিলেন। অসুস্থ, নেশাতুর, ক্ষণজন্মা মিল্লেই বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিটি সূর্যোদয়ে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করতে পেরেছেন, “আজ কি আবার আমার ভাস্বর হবার ক্ষণ এসে উপস্থিত?”
এই অন্ধকারে ফ্রিজারের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে রাখা বরফের টুকরোটার কথা মনে পড়ল রিনার। শান্ত হও। রিনা ভাবল। ওই বরফটাই তোমার জীবন। মৃত্যুময় ওই ক্ষয়িষ্ণু বিন্দুটাই তোমার অস্তিত্ব। ওর ক্ষয় রোধ করো।
রিনা আলো নেভালো।
**
রিনার আত্মা যখন চূড়ান্ত অবয়ব পেল, কর্তব্যরতা নার্স মহোদয়া সামান্য কিছু সময়ের জন্য মনোযোগ হারিয়েছিলেন। হঠাৎ করেই ইস্পাতের পরিষ্কার আধারে একখানা বরফের ঘনক উদয় হল। ঠিক যেমনটা ককটেল পার্টিতে ঠান্ডা পানীয়ের গ্লাসে ওদের ভাসমান দেখতে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনটাই। আবছাভাবেই ঘনকের ধারগুলো গোল হয়ে ক্ষয়ে আসছিল ক্রমশ।
চটজলদি তাই একটা রেফ্রিজারেটর আনা হল। সেখানেই স্থান পেল আইস কিউবটা।
“দুঃখিত,” ডাক্তারবাবু মায়ের উদ্দেশে বললেন, চোখদুটো যদিও তার সদ্যজাত শিশুকন্যার প্রশান্ত মুখমন্ডলে ন্যস্ত। “যতই যত্নবান হন না কেন, বরফের গলন সম্পূর্ণভাবে রোধ করা কি সম্ভব? তাছাড়া এরকমও তো হয় না যে, রেফ্রিজারেটরে ঘনকটাকে বন্ধ রেখে সেটাকে একবারে দূরে সরিয়ে রাখলেন। আত্মাকে শরীরের কাছেই রাখতে হবে, তা না হলেই শরীর ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে।”
কেউ কোনও কথা বলেনি আর। শিশুটির চারিদিকে বাতাস ভারী। নিস্তব্ধ এবং অস্বস্তিকর। সকলের কণ্ঠেই আটকে জমাট শব্দমালা।
**
শহরের একেবারে মাঝখানে যে প্রকাণ্ড অট্টালিকাটা আছে, রিনা সেখানেই চাকরি করে। বাড়িটার ঠিক পাশেই জেটি ছিল, প্রমোদ তরণী বাঁধা থাকে সেখানে। রিনা কোনওদিন সে সবে চাপেনি কোনওদিন। বাড়িটার প্রতিটি তলায় অফিস। তাদের দেয়ালে বড় বড় জানালা। যে অফিসগুলোর জানালা দিয়ে বন্দর দেখা যায় সেগুলো নামি আর দামি আসবাবে সাজানো।
প্রতিটি তলার ঠিক মধ্যিখানে অনেকগুলো খোপ, ওদের একটা ছিল রিনার নামাঙ্কিত। তার পাশেই দুটো প্রিন্টার। ওদের পেট থেকেও রেফ্রিজারেটরগুলোর মতন গুঞ্জনের শব্দ পাওয়া যায়। প্রিন্ট আউট নিতে অনেককেই রিনার ডেস্কের পাশ দিয়ে যেতে হয়। কেউ কেউ রিনার খোপের পাশে এসে দাঁড়াতো। ভাবতো ফ্যাকাসে চেহারার, তুষারশুভ্র চুল মাথায় নিয়ে আর কাঁধে সোয়েটার ঝুলিয়ে রাখা চুপচাপ কাজে ব্যস্ত মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করবে, “কেমন আছো?” মেয়েটার চোখের মনির রং ঠিক কী, কেউ জানতো না। জানবেই বা কি করে, মেয়েটা কোনওদিন ডেস্ক থেকে মুখ তুলে চাইত না যে।
তবে তার চারধারে ঠান্ডার একটা আবেশ ছিল। ছিল ভঙ্গুর নৈশব্দের অপ্রিতরোধ্য দূরত্ব। রোজ দেখা হলেও অনেকেই জানতো না, মেয়েটার নাম রিনা। কিছুদিন পর নামটা জিজ্ঞাসা করতেও কেমন বাধো বাধো ঠেকত। তাই অফিসের শত কোলাহল আর উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যেও সকলেই মেয়েটাকে একলা থাকতে দিত।
রিনার ডেস্কের নিচেই একটা রেফ্রিজারেটর ছিল। ওদের ফার্মই সে ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
প্রতিদিন সকালে রিনা হুড়মুড়িয়ে ডেস্কের সামনে উপস্থিত হত, তাপ নিরোধক লাঞ্চ-বক্স খুলে সেখান থেকে বার করতো বরফের ঘনক ভর্তি থার্মোসটিকে। সেখানে স্যান্ডউইচ ব্যাগের মধ্যে অনেকগুলো করে বরফের টুকরো। সেখান থেকে তার নিজের বিশেষ আইস কিউবটাকে বার করে সে অনেক যত্নে রেফ্রিজারেটরে ভরে রাখতো। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলত। চেয়ারে বসতো। হৃদয়ের ধড়ফড়ানিকে শান্ত করতে চাইত।
বন্দর থেকে দূরের অফিসগুলোতে যারা কাজ করেন তাদের দায়িত্ব ছিল বন্দরের অপেক্ষাকৃত কাছের অফিসে কর্মরত কর্মচারীদের প্রশ্নের নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর কম্পিউটার থেকে খুঁজে বের করা। রিনার কাজ হল, উত্তরগুলোকে সঠিক হরফে সাজিয়ে নির্দিষ্ট কাগজে লিখে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নকর্তার কাছে পাঠিয়ে দেয়া। ছোট অফিসের কর্মচারীরা ব্যস্ত থাকলে, উত্তরগুলো রেকর্ড করে পাঠাতো। সেই বক্তব্য রিনার হাতে টাইপ হত প্রয়োজন মতো।
নিজের ডেস্কেই লাঞ্চ সারতো মেয়েটি। যদিও আত্মার কাছ থেকে একটুখানি সময়ের জন্য হলেও দূরে যাওয়া সম্ভব। রিনা তবুও ডেস্ক ছেড়ে নড়তো না। ফ্রিজারটাকে আগলে বসে থাকত সারাটা ক্ষন।
খুব দরকারে অন্য কোনও অফিসে খাম পৌঁছে দিতে গেলেই রিনার দু’চোখের সামনে ঝুপ করে আলো নিভে যাওয়ার অনুভূতি ঘনিয়ে আসতো। আর তখনই ব্যস্ত অফিসের ভিড় কাটিয়ে একটি রুদ্ধ্বশ্বাস দৌড়ে সে ফিরত ফ্রিজারের নিরাপত্তায়।
জীবন যে তার প্রতি সদয় নয়- এমন কথা রিনা ভাবতে চাইত না কখনও। রেফ্রিজারেটর আবিষ্কারের আগে যদি তার জন্ম হত তবে তো জন্ম মুহূর্তেই মৃত্যু কেড়ে নিত তাকে। নিজেকে অকৃতজ্ঞ ভাবতে খারাপ লাগত তার। তবে মাঝে মাঝে কষ্টটা বড় দুঃসহ হয়ে উঠত।
কাজের শেষে অন্য মেয়েদের মতন নাচতে যাবার সুযোগ নেই তার। কারোর হাত ধরে ঘুরতে যাবার অবকাশও নেই। একলা ঘরের নিঃসঙ্গ বিছানায় শুয়ে সে শুধু অন্যদের আত্মজীবনী পড়ে। অন্য কারোর জীবনে বাঁচে।
**
মর্নিং ওয়াক উইথ টি এস এলিয়ট: এ মেমোয়ার
১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ অবধি এলিয়ট ‘বুক অফ কমন প্রেয়ার’ এর ‘কমিশন ফর রিভাইজড সালটার’ এর সদস্য ছিলেন। ততদিনে বয়েস বেড়ে গিয়েছে তাঁর। তাই কথায় কথায় কফির টিনে চামচ চালানোর বদভ্যাস একেবারে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
একবারই ব্যতিক্রম হল যখন কমিশন সিদ্ধান্ত নিলেন প্রার্থনা সংগীতের তেইশ নম্বর স্তব হিব্রু থেকে অনুবাদ করার সময় বিশপ কাভারসডেল একটু বেশি মাত্রায় স্বাধীনতা নিয়ে ফেলেছেন। সেটাকে ঠিকঠাক ইংরেজীতে অনুবাদ করতে যে শব্দবন্ধের প্রয়োজন সেটি হল, “the valley of deep darkness.”
সেই সাক্ষাৎকারেই এলিয়টকে বহুদিন পর নিজের হাতে কফি তৈরী করতে দেখলাম আমি। সেই প্রগাঢ় সমৃদ্ধ সুবাস- আজও স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে।
এলিয়ট কফিতে একটা চুমুক দিলেন। যে মোহন কণ্ঠে তিনি ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ পড়ে শোনাতেন তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতাদের ঠিক তেমনি করে আবৃত্তি করে শোনালেন সেই অপরিবর্তিত স্তবটুকু যার প্রতিটি শব্দ প্রতিটি ইংল্যান্ডবাসীর শিরায় বহমান যুগ যুগান্ত ধরে, “Though I walk through the valley of the shadow of death, I shall fear no evil.”
ভোট হল। আর তাতে সর্বসম্মতিক্রমে কভারসডেলের পংক্তিটুকু অপরবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।
আমার ধারণা, এলিয়টের এই দিকটি আবিষ্কার করে সকলেই আশ্চর্য হয়ে যান। ঐতিহ্যের প্রতি, আংলিক্যান চার্চের প্রতি কি প্রগাঢ় বদ্ধমূল ভালোবাসা ছিল মানুষটির ভাবতেই অবাক লাগে। মনে হয় যেন তাঁর আত্মার সঙ্গে ইংরেজি ভাষাটা একেবারে একাত্ম হয়ে গিয়েছে।
সেই বোধহয় এলিয়ট শেষবারের মতন আপন আত্মার স্বাদ পেয়েছিলেন, আমার বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাস থেকেই একটা আশা আমার মনে জন্ম নিয়েছে- যদি সেই সুগন্ধের অনুভূতি আবার কোনওদিন পেতাম! তিক্ত, দগ্ধ, সংযত- একজন সত্যিকারের ইংলিশম্যানের আত্মা যেন। কবিতায় মুখ লুকিয়ে থাকা সৃজনের চিহ্ন যেন।
**
কফির চামচে জীবনকে মেপে খরচ করার ব্যাপারটা ভারী আতঙ্কের বিষয়। রিনা ভাবছিল। সেজন্যই বোধহয় এলিয়টের রচনায় তাঁর কৌতুক বোধের পরিচয় নেই বললেই চলে।
কিন্তু কফির কৌটোয় আবদ্ধ জীবনের ধারণাটাও এক দিক দিয়ে খুব কাব্যিক। তাঁর আত্মা তাদেরকে ছুঁতে পেরেছিল যাঁরা এলিয়টের রচিত জটিল পদ্যের ভাবগম্ভীর পাঠ শুনে ভাবাবেশ থেকে জেগে উঠতেন, মনের দরজা খুলে দিতেন, ছন্দময় অর্থময় আবেশকে অন্তরে গ্রহণ করতেন একদা। এলিয়টের আত্মার সুবাস ছাড়া তাঁর পদ্যের প্রতিটি শব্দে অমন ধারালো অনুভূতি কে যোগাতো, জিভের ডগায় লেগে থাকা স্বাদের আশ্লেষ ছাড়া কেমন করে রচনা হত ‘ফোর কোয়ার্টেট’, কেমন করে জগৎবাসীর অন্তরে প্রবেশ করার পথ খুঁজে পেতেন কবি?
মৎসকন্যাদের গান শুনতে চাই- রাতে ঘুমোতে যাবার আগে এলিয়ট কি কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলেন?
মৎসকন্যাদের বদলে সে রাতে রিনা হিমবাহের স্বপ্ন দেখেছিল। মাইলের পর মাইল শুধু তুষারের আবরণ। হাজার বছর লেগে যাবে সে বরফ গলতে। তুষারের সাম্রাজ্যে কোথাও জীবনের চিহ্ন নেই। ঘুমের মধ্যেই রিনার ঠোঁটে হাসি ফুটল। জীবন আছে নিশ্চয়। সে জীবন রিনার।
**
ছেলেটি যেদিন প্রথম অফিসে এল, রিনা তাকে এক ঝলক দেখেই বুঝেছিল, এ অফিসে তার অবস্থানের আয়ু বেশিদিনের নয়।
জামাটা পুরোনো নয়, তবে স্টাইলটা বহু আগেই তামাদি হয়ে গিয়েছে। জুতোজোড়া মলিন। মাঝারি উচ্চতা, থুতনিটাও তেমন একটা ধারালো নয়। রিনার খুপরি থেকে বেরিয়ে লম্বা হলঘরে ঢুকলে তারই একটা পাশে ছেলেটার ডেস্ক। ছোট্ট চৌখুপি। একটাই মাত্র জানলা। সেটাও বিপরীত দিকের বিল্ডিঙের মুখোমুখি। অফিসের বাইরে নাম লেখা: জিমি কেসনো। ছেলেটার মতন অসংখ্য অনামি উচ্চাকাঙ্খী এবং হতাশ যুবকেরা প্রতিদিন এ অফিসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় নিত্যদিন।
জিমি অবশ্য রিনার দেখা সবচাইতে সহজ মানুষ। যেখানেই থাকে, সেখানেই দিব্যি নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে জানে ছেলেটি। জোরে কথা বলে না, বাক্যালাপে তাড়াহুড়ো নেই। অথচ মানুষ তার কথা শুনতে পছন্দ করে দিব্যি। সামান্য কয়েকটা শব্দে সে সব্বাইকে হাসিয়ে তুলতে পারে। পরে সে সব কথা মনে করে অনেকেই মুখ টিপে হাসে। ছেলেটির হাসিও মায়াবী বড়। সে হাসির মৃদু ছটায় বাকিদের মনেও আত্মবিশ্বাস জেগে উঠতে দেখেছে রিনা। গোটা সকালটাই তাকে অফিস থেকে বেরোতে আর ঢুকতে দেখতো সবাই। ব্যস্ত মনে হত তাকে, তবে সে ব্যস্ততায় আলগা শৈথিল্য জড়িয়ে থাকে সব সময়। কাজের মাঝেই বিরতি নিয়ে পরিচিতদের সঙ্গে দু’দন্ড আলাপচারিতাতে তার আপত্তি ছিল না। সে বেরিয়ে গেলেও অফিসের দরজা খোলা থাকত। কেউ সেটাকে বন্ধ করে দেবার তেমন একটা গরজ দেখাতো না।
রিনা লক্ষ্য করেছে, তার পাশের খোপে বসা মেয়েটি জিমির গলার শব্দ শুনলেই নিজেকে চটজলদি একটু গুছিয়ে নেয়।
জিমির আবির্ভাবের আগেকার অফিসের স্মৃতি এখন সকলের স্মৃতিতেই একেবারে ধূসর ও মলিন।
অমন ছেলেরা কেউই খুব বেশিদিন ওই ছোট্ট খুপরিতে বন্দি হয়ে থাকে নাকি? কোনও একদিন ওরা বন্দরমুখো বড় অফিসে চলে যাবে অথবা সরে যাবে উপরের তলায়। ছেলেটার আত্মা কি তবে রুপোর চামচ? ঝকমকে, আকর্ষণীয়, কাঙ্খিত? রিনা ভাবতো আনমনে।
**
‘দ্য ট্রায়াল অফ জোন অফ আর্ক’ থেকে:
“রাতে সৈনিকরা জোনের সঙ্গেই শয্যা নিত, ভূমিতে। জোন বর্ম খুলে ফেললে আমরা তাঁর স্তন দেখতে পেতাম। কিন্তু তার সৌন্দর্য আমার মনে কোনওদিন একটি মুহূর্তের জন্যও শারীরিক বাসনাকে জাগিয়ে তোলেনি।
“তাঁর সামনে কুবাক্য বললে জোন ভারী ক্রূদ্ধ হতেন। তাঁর উপস্থিতিতে দৈহিক লিপ্সার আলোচনা চললে ভারী বিরক্ত হতেন। যে সব মেয়েরা সৈনিকদের পিছু নিত, জোন তরবারি হাতে তাদের তাড়া করতেন। সৈনিকদের মধ্যে কেউ যদি ওদের কাউকে বিবাহের ইচ্ছে প্রকাশ করত তাহলে অবশ্য জোন তাতে বাধা দিতেন না।
“জোনের পবিত্রতা তাঁর অন্তরাত্মা থেকে বিচ্ছুরিত হত, সেই অন্তরাত্মাকে সর্বদাই তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করতেন- সে ঘোড়ায় চেপে শত্রুর দিকে ধেয়ে যাওয়ার সময় হোক কিংবা রাতে সৈনিকদের সঙ্গে একত্রে নিদ্রা যাপনের সময়ই হোক না কেন।
“ডৌরেমি নামের একটা জায়গা ছিল, জোনের জন্মস্থান। তার খুব কাছেই একখানা মান্ধাতার আমলের ‘বিচ’ গাছ ছিল, নাম- লেডি’জ ট্র্রি। আমার ধারণা, ওই গাছের সঙ্গে জোনের আত্মার ওতপ্রোত সম্পর্ক ছিল। যাঁরাই ওঁর শৈশবের সঙ্গে কোনরকম ভাবে যুক্ত ছিলেন তাঁরা সকলেই এক কথায় মেনে নিয়েছেন, বসন্তে ওই লেডি’জ ট্রি গাছের ডালপালা থেকে যে সুবাস ভেসে আসে জোনের শরীর থেকেও ঠিক তেমন সৌরভ পাওয়া যেত সর্বদাই।
“কেউ যদি পাপী মনে জোনের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করতো, ওই সুবাস কুচিন্তার আগুনকে নিবিয়ে দিত অনায়াসে। ওই সুবাসের জন্যই জোন চিরটা কাল শুদ্ধ ছিলেন, আত্মায় এবং শরীরে। সৈনিকদের সঙ্গে নগ্ন অবস্থায় মেলামেশা করলেও কোনও পাপচিন্তা যে তাঁকে কোনওদিন ছুঁতে পারেনি সে ব্যাপারে আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করতে পারি।”
**
“এই, তোমার নাম কি?”
জিমির গলা।
রিনা উত্তর দিল, “জোন-“
তার গালে তখন গোলাপি আভা, বইয়ের মলাট বন্ধ ততক্ষনে।
“আমার নাম রিনা, আসলে।”
জিমির দিকে তাকাবার বদলে তার চোখ তখন টেবিলে রাখা আধখাওয়া স্যালাডের দিকে। ঠোঁটের কোনায় কিছু লেগে আছে নাকি? একবার কাগজের ন্যাপকিন দিয়ে মুখটা মুছে নেওয়া উচিত হবে কি? না, তাতে বোধহয় আরও বেশি করে দৃষ্টি আকর্ষণের সম্ভাবনা থেকে যায়।
“আরে, সকাল থেকে অফিসের জনে জনে জিজ্ঞাসা করে বেড়াচ্ছি, কিন্তু দেখলাম কেউই তোমার নামটা জানে না!”
রিনা জানে সে কথা। তবে আজ প্রথম ব্যাপারটায় মন খারাপ হল। যেন সে জিমিকে হতাশ করেছে অকারনে। রিনা কাঁধ ঝাঁকালো।
“কিন্তু আজ থেকে আমি এমন একটা গোপন কথা জেনে ফেললাম যেটা এ অফিসের আর কেউ জানে না-” জিমি এমন গলায় বললো যেন এক আশ্চর্য গুপ্ত খবর রিনার কাছ থেকে সে শুনে নিয়েছে।
এয়ার কন্ডিশনের উষ্ণতা কি কেউ বাড়িয়েছে অবশেষে? রিনা ভাবছিল। আগের মতন অতটা ঠান্ডা লাগছে না তো আর! সোয়েটার খুলে ফেলার কথাও মনের কোনায় ঢুঁ মেরে গেল একবার।
“জিমি, এদিকে এসো একবার,” পাশের কিউবিকল থেকে মেয়েটা ডেকে উঠল, “দেখে যাও, আমি ঠিক এই ছবিটার কথাই তোমায় আগে বলেছিলাম।”
“পরে দেখা হবে আবার।” জিমি বলল। লিনার দিকে চেয়ে হাসল। হাসিটা রিনার চোখ এড়াতে পারেনি। কারণ রিনা ডেস্ক থেকে মুখ তুলে চেয়ে ছিল জিমির মুখের দিকে। ছেলেটার মুখখানা সুন্দর। রিনার অন্তত তেমনটাই মনে হল।
**
রোমানদের কিংবদন্তি:
হাতে নুড়িপাথর নিয়েই যেন জন্ম হয়েছিল সিসেরোর। সে জন্যই বোধহয় সমাজ তাঁর কাছ থেকে বিশেষ কিছু আশা করেনি কোনওদিন।
একটু বড় হতেই সিসেরো মুখের মধ্যে নুড়িপাথর ঢুকিয়ে তাঁর বক্তব্য রাখা অভ্যাস শুরু করলেন। কখনও কখনও গলা বুঁজে আসতো তাঁর। সহজ শব্দ, সরল বাক্য- ওভাবেই শিখলেন তিনি। জিহ্বার আড় ভেঙে, নুড়িপাথরের বাধা পেরিয়ে কেমন করে নিজের কণ্ঠস্বরকে শত-সহস্র মানুষের কানে পৌঁছে দিতে হয়, শিখে নিলেন সে বিদ্যেটুকুও।
আপন সময়ের সেরা বাগ্মী হিসাবে ইতিহাসের বইয়ে অমর হয়ে রইলেন সিসেরো।
**
“অনেক বই পড়ো দেখছি-“
জিমির গলা।
রিনা মাথা নাড়ল। তার মুখের দিকে চেয়ে হাসলো।
“তোমার মতন এমন নীল রঙের চোখের মনি আমি আগে দেখিনি-” সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে জিমি বলে উঠল,”সমদ্রের মতন রংটা, তবে যেন সমুদ্রের ওপরে কয়েকটা বরফের আস্তরণ রয়েছে।”
খুব সহজ সরলভাবে বলল জিমি। ভাবখানা এমন, যেন কোথাও ঘুরে এসেছে, কিংবা কোনও সিনেমা দেখে এসেছে- তারই বিবরণ শোনাচ্ছে যেন। আর ঠিক সে জন্যই রিনার মনে হল, ছেলেটা সত্যি বলছে। রিনার মনে হল, সে আরেকটা গুপ্ত খবর সবার অলক্ষ্যে ছেলেটির হাতে তুলে দিয়েছে। যে খবরের অস্তিত্ব সে নিজেই জানতো না এতদিন।
ওরা দুজনেই নির্বাক। এ ধরনের পরিস্থিতি স্বভাবতই অস্বস্তিকর। জিমি কিন্তু সহজভাবেই কিউবিকলের দেয়ালের ওপর শরীর ঝুঁকিয়ে রিনার ডেস্কে রাখা বইয়ের সংগ্রহ ছুঁয়ে দেখল। প্রশংসা করল। নীরবতায় অবগাহন করে তাকে অবলীলায় আপন করে নিল। রিনা তাই নির্জনতাকে সানন্দে পক্ষ বিস্তারের অবকাশ দিল।
“ও, ক্যাটালাস!” জিমি বলে উঠল সাগ্রহে, “কোন কবিতাটা তোমার সব চাইতে পছন্দ?”
রিনা চিন্তায় ডুবল।
“Let us live, my Lesbia, and let us love.”- এই উত্তরটা যেন বড় বেশি সাহসী। “You ask me how many kisses.”- এই উত্তরটা একটু বেশি ভাবাবেগে আলুথালু ন্যাকা ন্যাকা শোনাবে না? উত্তর নিয়ে ভাবনার দোলাচলে বিস্তর দুলল রিনা।
জিমি নীরবে অপেক্ষা করল। উত্তর পাবার জন্য হুড়োহুড়ি করল না মোটেই।
রিনা কোন কথাই খুঁজে পেল না। যেন কেউ গলার কাছে একটুকরো তুষার-শীতল নুড়ি গুঁজে দিয়েছে- কথা বলতে চাইলেও একটা শব্দও বেরোলো না তার মুখ থেকে। ভারী রাগ হচ্ছিল তার। ছেলেটা তাকে নিশ্চয় বোকা ভাবছে?
“দুঃখিত রিনা,” জিমি বলল, “স্টিভ ওদিক থেকে হাত নেড়ে ওঁর অফিসে ডাকছে আমায়। পরে আবার কথা হবে, কেমন?”
**
কলেজে রিনার রুমমেট ছিল অ্যামি। জীবনে কাউকে যদি সত্যিই করুণার চোখে দেখতে রিনা তাহলে সে হল একমাত্র অ্যামি। এক প্যাকেট সিগেরেটের মধ্যে অ্যামি আত্মা বন্দি ছিল।
অ্যামি কিন্তু কখনোই কারোর সমবেদনা চায়নি। রিনার সঙ্গে যতদিনে তার পরিচয় হয়েছে ততদিনে তার বাক্স অর্ধেক খালি হয়ে গিয়েছিল।
“ওগুলো কেমন করে খরচ করে ফেললে?” সন্ত্রস্ত রিনা জানতে চেয়েছিল। নিজের বেলায় এতটা উদাসীন হওয়ার কথা রিনা কখনও ভাবতেও পারতো না।
অ্যামি চাইত রিনা রাতে একটু বেরোক, নাচুক, মদ খাক, ছেলেদের সঙ্গে আলাপ জমাক। রিনার উত্তর সর্বদাই ‘না’ সেখানে।
“আমায় দেখে করুণা হয় যখন, তখন আমার কথা শুনেই চল না একদিন। মাত্র একবারের জন্য, যাবি?”
অ্যামি রিনাকে ওভাবেই একবার শুঁড়িখানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। গোটা পথটায় থার্মোসটাকে বুকে আগলে রেখেছিল রিনা। অ্যামি লুকিয়ে চুরিয়ে থার্মোস থেকে বরফের টুকরোটাকে বার করে মদের গ্লাসে রেখে বারটেন্ডারকে বলেছিল সেটাকে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিতে। সে হুকুম তামিল করেছিল।
ছেলেরা ভাব জমাতে এল। রিনার অবশ্য সেদিকে মন নেই। সে উদ্বিগ্ন। চোখজোড়া ফ্রিজারের দিকে ন্যস্ত।
“মজা পাওয়ার অভিনয়টুকু অন্তত করতে প্যারিস তো?” অ্যামি বলেছিল।
এরপর একটা ছোকরা এল। তাকে দেখেই অ্যামি তার প্যাকেট থেকে একখানা সিগেরেট বার করল।
“এটা দেখেছো?” ছেলেটাকে শুনিয়ে অ্যামি বলল, বারের নিয়ন আলোর জলুসে জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ, “এই সিগেরেটখানা এখন আমি ধরাবো, শেষ ধোঁয়া ছাড়ার আগে যদি আমার বান্ধবীকে হাসাতে পারো তবে আজ রাতে আমি তোমার বাড়ি যাচ্ছি!”
“তার বদলে তোমরা দুজনেই আমার অতিথি হতে পারো।”
“হতেই পারি। তাহলে জলদি কাজে লেগে পড়ো দেখি!” লাইটার জ্বালিয়ে অ্যামি বুকভরে ধোঁয়া টেনে নিল, তারপর মাথা হেলাল, বুকভর্তি ধোঁয়ার কুয়াশা আবার ফিরিয়ে দিল বাতাসে।
“এ ভাবেই বাঁচি আমি,” অ্যামি ফিসফিসিয়ে বলল। তার চোখের মনি দুটো অস্থির, বন্য। “জীবন মানেই অনুসন্ধান-” তার নাসারন্ধ্র থেকে ধোঁয়ার রেশ বেরোচ্ছিল। রিনার শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল তাতে।
রিনা নীরবে দেখছিল মেয়েটাকে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটার মুখোমুখি হয়েছিল। মগজে কেমন যেন একটা হালকা নেশাতুর ভাব। ছেলেটার বাঁকা নাকটা তার চোখে বিসদৃশ হাস্যকর লাগছিল। আবার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল একই সঙ্গে। কেন কে জানে!
অ্যামি আত্মার উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছিল তার অন্তরেও।
“তোকে দেখে হিংসে হয়, জানিস?” পরের দিন সকালে অ্যামি রিনাকে বলেছিল, “তোর হাসিতে বড় আবেদন রে মেয়ে!” সে কথা শুনে রিনা হেসেছিল নিঃশব্দে।
তার বরফের টুকরোটা ছেলেটার রেফ্রিজারেটরে মদের গ্লাসে সযত্নে রাখা ছিল। গ্লাসটাকে পরদিন নিজের বুকে আগলে বাড়ি নিয়ে এসেছিল সে।
সে বারই শেষবারের মতন অ্যামির সঙ্গে বেরিয়েছিল রিনা।
কলেজ শেষ হবার পর দুজনের মধ্যে কখন যেন যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। যখনই মেয়েটার কথা মনে পড়ত, রিনা ভাবত খালি, অ্যামির নিঃশেষিত সিগারেটের প্যাকেটটা নিজে নিজেই ভরে ওঠে যেন।
**
প্রিন্টার থেকে বেরোনো কাগজের স্রোতের দিকে নজর ছিল রিনার। সে জানত, জিমি খুব শিগগিরই উপরতলার অফিসে চলে যাবে। তার হাতে তাই সময় বেশি নেই।
সপ্তাহান্তে কেনাকাটা করল রিনা। কি কিনবে সেটাও অনেক ভেবে স্থির করে রেখেছিল সে। তুষার নীল রংটাই তার সবচাইতে পছন্দের। চোখের মনির সঙ্গে মিলিয়ে নখের রংটাও পাল্টে নিয়েছিল সে।
বুধবারটাই রিনার মনের মতো ছিল। সপ্তাহের প্রথম দিকে অফিসে আলোচনা চলত উইকেন্ডে ঠিক কীভাবে মজা করেছে সবাই সেই বৃত্তান্ত নিয়ে। শেষের দিকে আলোচনা চলত শনি-রবিবারটা তারা কীভাবে কাটাবে তারই পরিকল্পনা করতে। বুধবারে তাই আলোচনার মতন বিশেষ বিষয়বস্তু ছিল না।
রিনা মদের গ্লাসটা সঙ্গে এনেছিল, ওটা সৌভাগ্যের প্রতিভূ। তাছাড়া গ্লাসটা খুব তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়।
লাঞ্চের পরেই রিনা নড়েচড়ে বসল। অনেক কাজ করা বাকি তখনও। ওদিকে চর্চা করার মতন বিষয়ের অভাবে অফিসটাও একটু ঝিমিয়ে পড়েছে।
ফ্রিজারের দরজা খুলে মদের গ্লাস আর স্যান্ডউইচ ব্যাগটা বার করল রিনা। আইস কিউবটাকে বের করে গ্লাসের মধ্যে চালান করে দিল। কাচের গ্লাসের শরীরে শীতল জলের কুচি জমল।
সোয়েটার খুলল রিনা। হাতে গ্লাসখানা ধরে সে অফিসের মধ্যে ঘুরে বেড়াল এলোমেলোভাবে।
যেখানে যেখানে কর্মচারীদের জটলা- রিনা সেখানেই একবার করে ঢুঁ মেরে গেল। কফি মেশিনের ধারে, করিডরে, প্রিন্টারের পাশটিতে- রিনা সর্বত্র সকলের পাশ দিয়ে চলে বেড়াল। হঠাৎ করে যেন হিমের পরশ ছুঁয়ে গেল ওদের সবাইকে। আলোচনা থিতিয়ে পড়ল হঠাৎ। হাসি মস্করার জেল্লা ফিকে হয়ে গেল। সবার যেন হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল, কত কাজ পড়ে আছে করার মতন। খোলা দরজার পাশ দিয়ে রিনা যখন হেঁটে গেল, দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেল সহসা।
যতক্ষণ না গোটা অফিসটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ততক্ষন রিনা ঘুরে বেড়াল। জিমির অফিসের দরজাটাই খোলা ছিল একমাত্র।
গ্লাসের দিকে চোখ ফেরাল রিনা, সেখানে বরফের চারিদিকে গলে যাওয়া জলের ছোট্ট দীঘি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বরফের টুকরোটা জলে ভাসবে।
হাতে সময় আছে এখনও।
Kiss me, before I disappear.
মদের গ্লাসটাকে জিমির দরজার গোড়ায় রাখল রিনা।
আমি তো আর ‘জোন অফ আর্ক’ নই।
সে জিমির অফিসে ঢুকে পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দিল নিঃশব্দে।
**
“হ্যালো,” রিনা বলল। জিমির সম্মুখে একলা সে। তবু কি করবে এবার, ভেবে পেল না।
“তুমি?” জিমি বলল, “আচ্ছা, আজ অফিসের সবাই এত চুপচাপ কেন? কিছু হয়েছে নাকি?”
“Si tecum attuleris bonam atque magnam cenam, non sine candida puella,” রিনা উচ্চারণ করল। “সঙ্গে যদি খাবার আনো অনেকটা, যদি আনো সুন্দরী রমণী- ওটাই আমার সবচাইতে পছন্দের কবিতা।”
রিনার লজ্জা করছে। কিন্তু একটা আলগা উষ্ণতা জড়িয়ে ধরছে তাকে। জিবে কোনও আড়ষ্টতা নেই, গলা চেপে ধরছে না কোনও নুড়ি পাথর। তার আত্মাটা দরজার বাইরে কাচের গ্লাসে পড়েছিল একলা। কিন্তু ভয় করছে না একটুও। রিনা সেকেন্ডের কাঁটা গুনছে না। গ্লাসের মধ্যে আটকে নেই তার জীবনের গল্প আর।
“Et uino et sale et omnibus cachinnis,” জিমি কবিতাতেই প্রত্যুত্তর দিল। রিনাকে সম্পূর্ণ করল। “সঙ্গে যদি আনো মদ আর অনেকটা হাসি-“
জিমির টেবিলে একটা নুন রাখার কৌটো চোখে পড়ল। বিস্বাদ খাবারে স্বাদের অনুভূতি আনে নুন। নুন যেন অনেকটা বাক্যালাপে উৎসারিত কৌতুক আর হাসির মশলা। যা কিছু সাধারণ, নুন তাদের অসাধারনত্বে পাল্টে দেয় বেমালুম। সাদমাটা জিনিসকে অপরূপা করে তোলে, এমনি তার উপস্থিতির জোর। নুন হল জিমির আত্মা।
আর নুনের জন্যই জলের জমাট বাঁধতে এতখানি সময় লেগে যায়।
রিনা হাসল।
সে ব্লাউজ খুলল। জিমি বাধা দেবে বলে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছিল। রিনা মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল। নীরবে হাসল।
দু’প্রান্ত থেকে জ্বালিয়ে দেব এমন মোমবাতি আমার কাছে নেই। কফির চামচে জীবনকে মাপতে পারি না। আকঙ্খার আগুনে জলের আহুতি দেব সে ক্ষমতাও নেই। প্রায়-মৃত্যুর বরফকে দরজার বাইরে রেখে এসেছি অনেকক্ষন হল। এখন হাতে যেটুকু আছে, সেটুকু জীবন মাত্র।
“জীবনের সবটুকুই আসলে অনুসন্ধান-” রিনা বলল।
নিজেকে ব্লাউজের বাঁধন থেকে মুক্ত করল। স্কার্টটাকে বিসর্জন দিল। জিমি দেখল, এই উইকেন্ডে মেয়েটা নিজের জন্য ঠিক কী কিনে এনেছিল।
তুষার নীল- রিনার খুব পছন্দের রং।
**
হাসির স্মৃতি অমলিন। অমলিন প্রতিটি হাসির উত্তরে ছেলেটির হাসির স্মৃতি। প্রতিটি স্পর্শের কথা মনে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল রিনা। প্রতিটি উষ্ণ শ্বাস-প্রশ্বাসের কথা বুকে আগলে রাখতে চেয়েছিল। শুধু মনে রাখতে চায়নি বহমান সময়ের কথা।
দরজার বাইরে জনতার কোলাহল চড়া সুরে বেজে উঠেছিল, ঝিমিয়েও পড়েছিল একসময়। জিমির অফিস থেকে সে সবের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল দিব্যি।
“What lips my lips have kissed.”
রিনার মনের আয়নায় কবিতার লাইনটা ফুটে উঠল যেন। ওদিকে বাইরের কোলাহল আবার নীরবতায় ডুবে গিয়েছে। ঘরের মধ্যে চুঁইয়ে পড়া সূর্যের আলোয় লাল ফাগের পরশ।
রিনা উঠে দাঁড়াল। ছেলেটির বাহুবন্ধন থেকে আলগা হল। ব্লাউজ জড়ালো, স্কার্ট পরল। দরজা খুলে কাচের গ্লাসটাকে হাতে নিল।
তার দৃষ্টি তখন উদ্ভ্রান্ত। চাতক পাখির মতন সে খুঁজে চলেছে বরফের টুকরোটাকে। এইটুকু একটা ছোট্ট স্ফটিক হলেও চলবে। ওটুকুই ফ্রিজারে রেখে সে বাকি জীবনটা এই অফিসে কাটিয়ে যাওয়া কয়েকটি মুহূর্তের কথা ভাবতে ভাবতে খরচ করে ফেলবে। অল্প কয়েকটা মুহূর্ত- যে মুহূর্তে সে বেঁচে থাকা শিখেছে।
গ্লাসে কিন্তু বরফ ছিল না। সেখানে শুধু জল। স্বচ্ছ অমলিন জল।
রিনা অপেক্ষা করল। হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যাওয়ার অপেক্ষা। ফুসফুসের ওঠানামা বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা। রিনা জিমির অফিসে ঢুকল আবার। মরনের মুহূর্তে ছেলেটার মুখচ্ছবি জেগে থাকুক তার স্মৃতিপটে, চোখের মনিতে।
নোনা জলের বরফ হওয়া বেশ কঠিন।
মৃদু উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে তার অনুভূতিতে। কাঙ্খিত মনে হচ্ছে নিজেকে। মুক্ত লাগছে অনেকখানি। হৃদয়ের অন্তঃপুরে যে সব শীতল শান্ত নির্জন প্রান্ত পড়ে ছিল এতদিন অবহেলায় অগোচরে, সেখানে কেমন স্রোতের কুলুকুলুধ্বনি শুনতে পেল রিনা। কানে বাজল সমুদ্রের ঢেউ। কত কথাই তো বলার ছিল ছেলেটাকে। বলার ছিল, সব বই পড়ে ফেলার মতন সময় নেই আর তার হাতে।
**
রিনা,
আশা করি ভালো আছিস। কতদিন হল দেখা সাক্ষাৎ নেই।
চিঠিটা হাতে পেলেই যে প্রশ্নটা তোর মনের মধ্যে প্রথমেই জেগে উঠবে সেটা হল, আমার কাছে আর কটা সিগেরেট আছে এখন? সুখবর হল, আমি সিগারেট টানার বদ অভ্যাসটা ত্যাগ করেছি। খারাপ খবর হল, আমার শেষ সিগেরেটটা ফুরিয়ে গেছে ছ’মাস আগেই।
অথচ দেখতেই পাচ্ছিস, আমি দিব্যি বেঁচে আছি।
আত্মা আসলে ভারী বিচিত্র জিনিস। ভেবেছিলাম, ও ব্যাপারে আমার জ্ঞান টনটনে। জীবনভর ভেবেছি, নিয়ন্ত্রণহীন যাপনে কাটাবো প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ে বাজি খেলব জীবনের জুয়ায়। ভেবে নিয়েছি, এটাই আমার জীবন। প্রতিবার যখন সিগেরেট জ্বালিয়েছি, দু আঙুলে আগুনের উত্তাপ আর ছাইয়ের পরশ পেলে মনে হত ঐটুকু সময়েই বেঁচে নিলাম অনেকটা। অপেক্ষা করেছি ওই সময়টুকুতে এমন কিছু অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটবে যেটা চিরকাল মনের মনিকোঠায় স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে রয়ে যাবে। ওই ক্ষণটুকুর মধ্যেই সতর্ক রইতাম, প্রতিটি কম্পনকে শ্রুতিতে ধরতে চাইতাম, চোখের মনিতে প্রতিটি রঙকে ছবি হয়ে যেতে দেখতাম। জীবন তখন ঘড়ির কাঁটায় ঘুরে চলছিল শেষের দিকে। প্রতিটি সিগেরেটের পরে যে অপেক্ষার প্রহর ছিল, সেটা আসলে মূল অভিনয়ের অনুশীলমাত্র। এমন করেই কুড়িটা নাটক কবেই যেন মঞ্চস্থ হয়ে গেল একদিন।
শেষ সিগারেটটা হাতে নিলাম যেদিন, ভয় করছিল খুব। জীবনের শেষ মুহূর্তের জন্য কত অভাবনীয় ঘটনা ভেবে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, মরব যখন, একেবারে বিস্ফারণের বর্ণচ্ছটা সঙ্গে নিয়েই শেষ হব। কিন্তু শেষের সেই মুহূর্তে সাহসের ঘাটতি হল। যখন বুঝতে পারবি, এই বেলা তোর শেষ নিঃশ্বাস পড়বে, এই বেলা তোর বিদায়ের মুহূর্ত কড়া নাড়ছে তোর দোরে, দেখবি কেমন হাতটা কাঁপছে। লাইটার জ্বালাতে গিয়ে টের পাবি, আঙ্গুল অবশ।
একটা ‘বিচ পার্টি’-তে গিয়ে নেশায় বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলাম। কারোর বোধকরি রক্তে নিকোটিনের মাত্রা কমে এসেছিল। সে ব্যাটা আমার ব্যাগ হাতড়ে শেষ সিগারেটটা হাতিয়ে নিল। যখন জ্ঞান ফিরল, ফাঁকা বাক্সটা আমার পাশেই বালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। একটা কাঁকড়া সেই ফাঁকে ওর মধ্যে ঢুকে সেটাকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে ততক্ষনে।
বলেছিলাম না, আমি মরিনি।
জীবনভর সিগারেটগুলোকে আত্মা ভেবে বুকে আগলে রাখলাম, আর বাক্সটার কথা ভাবারই সুযোগই পেলাম না। কাগজের ফাঁপা চারকোনা আশ্রয়ে শুধু একমুঠো শুন্যতা আর বিষন্নতা ছাড়া কিছুই ছিল না কোনওদিন।
ফাঁকা বাক্সটায় অনেক কিছুর জায়গা হতে পারত। কিছু খুচরো পয়সা, ছেঁড়া বোতাম, ছুঁচ কিংবা সুতো। ব্লাশ, লিপস্টিক কিংবা আই পেন্সিলও কষ্টেসৃষ্টে রাখা যেত। যেমন ইচ্ছে তেমন জিনিসের বাসস্থান হতে পারত ফাঁকা বাক্সটা।
এখন তাই আমার মনের আগল খোলা, মুক্ত, অসংযমী। খাপ খাইয়ে নেয়ায় অনেকখানি অভ্যস্ত আমি। হ্যাঁ, জীবন আসলেই বিচিত্র এক অনুসন্ধান। এমন অবস্থায় আমার কী করণীয়, বলতো? অনেক কিছু, তাই না?
কিন্তু এই অনেক কিছু করার আগে আমায় সবকটা সিগারেট খরচ করতে হয়েছে।
আসলে আমার রূপান্তর হয়েছে। আমার আত্মা একটা সিগেরেটের বাক্স থেকে আরেকটা খালি বাক্সে পরিণত হয়েছে। আর ওই সময়টুকুতে আমি কেমন যেন বড় হয়ে গেছি হঠাৎ।
তোকে চিঠি লিখলাম, কারণ, তোর মধ্যে নিজেকে দেখতাম আমি। তুই ভাবতিস, নিজের আত্মাকে তোর মতন ভালো আর কেউ চেনে না। ভাবতিস, কেমনভাবে বাঁচবি, সেটা একমাত্র তুইই জানিস। জানতাম তোর জানাটা ভুল। তবে সঠিক উত্তরটা আমারও অজানা ছিল এতদিন।
এখন উত্তরটা আমি জানতে পেরেছি। তুই পরিণত এখন। তুই প্রস্তুত। তুই প্রস্তুত তোর রূপান্তরের জন্য।
– তোর চিরকালের বন্ধু, অ্যামি
# # #
(লেখকের মন্তব্য: মার্থা সুকাপ বিরচিত ‘ওয়েকিং বিউটি’ গল্পটির স্বরভঙ্গি, প্রেক্ষাপট এবং প্লট এলিমেন্টের প্রতি একটি বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য আমার এই গল্পটি। কাহিনির ঠমক আবার নিশ্চিতভাবেই ফিলিপ পুলম্যানের ‘গোল্ডেন কম্পাস’ সিরিজ থেকে অনুপ্রাণিত)
Copyright © Ken Liu 2004, All Rights Reserved Unless Explicitly Granted
অসামান্য গল্প। চমৎকার অনুবাদ।