নক্ষত্র যাত্রা
লেখক: মিলন গাঙ্গুলি
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সম্ভবত ঘুম ভাঙল আমার।
সম্ভবত বললাম, কারণ জানি না ঘুমিয়ে ছিলাম নাকি এইমাত্র জন্ম নিলাম। যদি জন্ম নিয়ে থাকি চোখ মেলার পর কীভাবে বুঝতে পারলাম এটা একটা স্পেসশিপ?
তার মানে ঘুমিয়ে ছিলাম। অথবা এইমাত্র জন্ম নিলাম। কিন্তু মেমরিতে আগে থেকেই কিছু তথ্য দিয়ে রেখেছিল। কে? কারা? কেন?
উজ্জ্বল সাদা আলো। লোহার বিছানায় শুয়ে আছি। কামরাটা সাদা ধপধপে। সব সাদা। বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি। এক দেয়াল কাচের। বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে সাদা সাদা দাগ। গোলাপি ধোঁয়া। মহাশূন্যে আছি।
সামনে ধাতুর তৈরি পুতুল। অনুমান করলাম রোবট।
‘কেমন আছেন?’ ধাতব গলায় জানতে চাইল যন্ত্রটা।
জবাব দিতে সময় লাগল। কেন জানি না। কয়েক মুহূর্ত পর জবাব দিলাম—‘ভালো। কতদিন পর জাগলাম?’
‘এখানে তো সময় বলতে কিছু নেই। তবে আমাদের পুরোনো হিসাবে ২০০ বছর হবে স্যার।’
‘পুরোনো হিসাব মানে?’
‘মানে আমাদের প্রভুরা যেমন হিসাব করতেন আমাদের বাসভূমিতে।’
‘স্পেসশিপে আমরা কয়জন?’
‘এই দুইজনই।’
‘মাত্র দুইজন?’
‘সমস্যার কিছু নেই। সব ঠিকমতো চলছে। যন্ত্র বানানো হয় ঠিকমতো কাজ করার জন্য। করছে। তা ছাড়া আমি আছি না? আগেও বের হয়েছি মহাশূন্যে।’
‘কোন কাজে?’
‘প্রভুদের জন্য বাসভূমি খোঁজার জন্য।’
‘তোমার বয়স কত?’
‘জানি না স্যার।’
উঠে বসলাম। আবিষ্কার করলাম সামনে দাঁড়ানো লোহার পুতুলের মতো আমি না। কিন্তু আমি ওর প্রভুও না।
‘আমিও তোমার মতো নাকি?’ জানতে চাইলাম।
‘না। আপনি অনেক উন্নত। একাই সামাল দিতে পারেন এই নক্ষত্র যাত্রা। আপনার সহকারী হিসাবে আমি। আমার ব্যাটারি চার্জে দিতে হবে। তাই জাগালাম আপনাকে। আমার চার্জ হলে আমি কাজ করব। আপনি চলে যাবেন হিমঘুমে। তার আগে আমাদের যাত্রার আসল উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। কিছু সহজেই বুঝে যাবেন। কারণ আপনাকে বানানোর সময় কিছু স্মৃতি দেওয়া হয়েছে আপনার ব্রেনে। মনে পড়ে কিছু?’
‘নাহ। শুধু মনে আছে আমাদের বাসভূমি খুঁজতে হবে। প্রভুদের বিপদ। তাঁদের বাসা মানে গ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে অমন কিছু। সব অস্পষ্ট।’
হালকা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে কোত্থেকে যেন। স্পেসশিপ চলছে তার প্রমাণ। জানালা দিয়ে দেখলাম। দূরে বড়ো বড়ো দুটো গ্রহাণু টক্কর খেয়ে ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেল। হীরককুচির টুকরো উড়ছে চারিদিকে। ধ্বংস দেখতে ভালো লাগে। কেন?
আমিও যদি যন্ত্র হই অনুভূতি হচ্ছে কেন আমার? খানিকটা উদাস লাগছে।
‘স্পেসশিপ চলছে কী করে? জ্বালানী সমস্যা হয় না?’
‘কায়দা করে উল্কা ধরি। দরকারি সব ধাতু জ্বালানী ওখান থেকেই পাই।’ জবাব দিল রোবট।
হেঁটে বেড়ালাম চারিদিক।
‘তো আমার এখন কাজ কি?’ জানতে চাইলাম।
‘আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।’
আগে আগে হাঁটতে লাগল সে। অনুসরণ করলাম।
চারিদিকেই নরম সাদা আলো। মৃদ্যু শব্দ। যান্ত্রিক গুঞ্জন। বড়ো বড়ো কয়েকটা কামরা হেঁটে গেলাম। কামরাতে দেয়াল ভরতি মেশিন। বিচিত্র লাল সবুজ হলুদ নীল আলো জ্বলে প্রমাণ করছে সব ঠিকমতো কাজ করছে।
শেষের কামরার বাইরে লোহার শক্ত দরজা।
দরজায় গায়ে হাত দিল সে। সবুজ আলো এসে ছুয়ে গেল রোবটের শরীর।
‘পরিচয় দিন।’ দরজা জানতে চাইল।
টুংটাং শব্দ উচ্চারণ করল সে। খুলে গেল দরজা।
আরও একটা কামরা। মাঝাঁরি। ভীষণ ঠান্ডা। কামরা ভরতি সেলফ। সেলফে সাজানো স্বচ্ছ কাচের বড়ো বড়ো জার। ভেতরে গুঁটিসুটি মেরে হিমগুমে ঘুমিয়ে আছে কতগুলো প্রাণী। মাথাটা বড়ো। শরীর ছোটো। বাচ্চা। চোখের বন্ধ পাপড়ি দেখে মায়া লাগল। প্রভুদের সন্তান। জানলাম কেমন করে?
‘ওরাই?’ জানতে চাইলাম
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল রোবট। স্পেসশিপের অধিনায়ক।
‘মোট কতজন?’
‘পাঁচশত। ঘুমিয়ে আছে।’
‘জাগবে কেমন করে?’
‘ভালো একটা বাসভূমি পেলে ওদের জার থেকে বের করে জলে ছেড়ে দিলেই ওরা জেগে যাবে। সেই গ্রহের রাজা হবে ওরা।’
‘প্রভুদের কি হয়েছিল?’
খানিক চুপ করে রইল সে। শান্ত ভাবাবেগ বর্জিত গলায় বলল, ‘যে-কোনো সভ্যতার শেষ পরিণাম ধ্বংস। ওটা এড়ানোর উপায় নেই। তাঁরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। আকাশ, স্থল আর জল ভাগের মালিক হয়েছিল। জরা স্পর্শ করত না তাঁদের। এক একজন মহাজ্ঞানী। সহজে মারা যেত না। শেষ নিজের মধ্যে ভয়াল লড়াই শুরু করল। ধ্বংস হয়ে গেল সবাই। মরতে মরতে যে কয়েকজন বেঁচেছিল তাঁরাই বানাল এই মহাকাশযান। আর আমাদের দুইজনকে। বাছাই করা কিছু শিশু কেমিক্যাল জারে রেখে তুলে দিল আমাদের হাতে। আমাদের কাজ ভালো একটা বাসভূমিতে ওদের ছেড়ে দেওয়া। যাতে বিলুপ্ত হয়ে না যায় মহাবিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্য এই প্রাণ। যাদের শাসন করা উচিৎ ছিল পুরো এই নক্ষত্র সভ্যতা।’
চুপ করে রইল সে। আমিও।
কাচের জারে ভরতি শিশুদের আবারও দেখলাম। খারাপ লাগল খোকাদের জন্য। দায়িত্ব বুঝে পেয়েছি।
বের হয়ে এলাম হিমঘর থেকে।
‘তুমি বিশ্রামে যাও।’ বললাম। ‘কখন জাগিয়ে দেব?’
‘চার্জ হলে জেগে উঠব। তেমন নির্দেশ মেনে বানানো হয়েছিল আমাকে। তবে অনেকটা সময় আপনাকে থাকতে হবে একা।’
‘একঘেয়ে লাগবে?’
‘নাহ। সেই রকম কোনো অনুভূতি দেওয়া হয়নি আমাদের। জানালা দিয়ে বসে বাইরের মহাবিশ্ব দেখবেন। যাই দেখুন না কেন অবাক হবেন না। সব কিছুই সম্ভব এই মহাশূন্যে। সব। আমি ঘুমাতে গেলাম।’
‘ঘুম বলছ কেন?’
‘শব্দটা কোথায় যেন শুনেছিলাম। ভালো লেগেছিল। ব্যবহার করলাম।’
ঠক ঠক শব্দ করে সে চলে গেল পাশের কামরায়, টিউবের মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। আমার দিকে ফিরে বলল, ‘প্রয়োজনে ডাক দেবেন। ডানের সুইচ চাপ দিলেই জেগে উঠব। গ্রহাণুপুঞ্জের বেল্টের ভেতরে গেলে ভয় পাবেন না। কোনো ক্ষতি হবে না। আর ডান দিকের দেয়ালে তিন নাম্বার চোখ পাবেন। ওর সঙ্গে কথা বলে জেনে নেবেন কী দরকার।’
টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল সে। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পরের ওর কপালের লাইট নিবে গেল।
একা হয়ে গেলাম। ওর নামটা জানা হল না। আমার নাম কী?
রোবট সঙ্গি চলে যেতেই সোজা এগিয়ে গেলাম ডান দিকের দেয়ালের কাছে। তৃতীয় নয়ন। বড়ো কাচের চোখ। একটা মাত্র সুইচ। কিছু না ভেবেই চাপ দিলাম। ঘন নীল রঙের ছায়া ছায়া একটা চেহারা দেখা গেল। চারমুখ। মাথায় তিনটে করে চোখ। কী ওটা?
‘কোনো তথ্য লাগবে না শুধু কথা বলবেন?’ জানতে চাইল তৃতীয় নয়ন।
‘সময় কাটাব কী করে?’ জানতে চাইলাম।
‘জানালার সামনে বসে থাকুন। লাইব্রেরি আছে। প্রচুর রোল আছে পড়তে পারেন। সময় কাটানো আবার সমস্যা নাকি। অনন্ত কাল চলে যায় রাত্রির এক প্রহরের মতো।’
জানালার পাশে গিয়ে বসে রইলাম।
একবারে দশ হাজার গ্যালাক্সি দেখা যায়। মাত্র।
দূরে চার বাহু নিয়ে ধিরে ধিরে প্যাচ খাচ্ছে গোলাপি রঙের গ্যালাক্সি। সংখ্যায় কত কে জানে। চুমকির মতো ঝিকমিক করছে ভেতরটা। ঠাসা অনেক অনেক নক্ষত্র আর গ্রহ। কেমন বিরান ভূমি সেখানে। ধোঁয়ার মতো পাক খাচ্ছে সব। কত মাইল জুড়ে এক একটা। জানি এখান থেকে একটা গ্যালাক্সি যেমন দেখায় অন্য দিক থেকে তাকালে সম্পূর্ণ আলাদা লাগবে। মহাজগতের মায়া এটাই। প্রতারক সবাই।
সবাই নড়ছে। মনে হচ্ছে খুব ধীরে ধীরে গ্যালাক্সিগুলো নড়ছে। ওরা কি কোথাও যায়? অন্তিম মুহূর্তে ওদের গিলে ফেলে কোনো ব্ল্যাকহোল। নতুন করে তৈরি হয় আবার?
মহাশূন্য কি গ্যালাক্সি ভরতি? না বিরান কালো ফাঁকা জায়গায় কিছু আলোর কণার মতো ওরা। নাকি দুটোর মাঝাঁমাঝি?
শেষ কোথায়? শুরু কোথায়? এমনিতেই তৈরি হয়েছে বিশাল এই মায়া জগৎ?
কোথায় যাচ্ছি আমরা?
আমি বসে রইলাম। অনন্ত কাল ধরে।
কত দিন চলে গেল। একদিন দেখি বিশাল এক স্পেসশিপ ভেসে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে। ভালো করে চেয়ে দেখি ওটা একটা মাদারশিপ। তবে নষ্ট হয়ে গেছে। এক টুকরো আলো জ্বলছে না। বিশাল বারান্দায় নষ্ট আর বাতিল হয়ে পড়ে আছে আরও অগুনতি স্পেসশিপ। এক একটার সাইজ আমাদের মহাকাশযানের চেয়ে ছয়গুন বড়ো। কারা ওরা?
যতক্ষণ দেখা গেল চেয়ে রইলাম। উল্কা আর মহাকাশ ধূলার আঘাতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। অচেনা সুবর্ণ ধাতু দিয়ে বানানো ওদের শরীর। এক সময় চোখের আড়ালে চলে গেল।
তৃতীয় নয়নের কাছে গেলাম।
‘আছ নাকি?’ জানতে চাইলাম।
‘আছি।’ জবাব এলো।
বাইরে যা দেখলাম বর্ণনা করলাম।
‘ঠিক জানি না কারা।’ জবাব দিল। ‘অনেকেই বের হয়। নক্ষত্র সভ্যতায় নতুন নতুন জায়গায় যেতে চায়। সব গ্রহে এক অবস্থা। এক সময় আকাশে উড়তে চায়। জানতে চায় আরও কে কে আছে? কোথায় তারা। বেশির ভাগই একে অপরের দেখা পায় না।’
‘কেন?’
‘অনেক অনেক বিশাল এই মহাকাশ। আমাদের চিন্তার চেয়েও বড়ো।’
‘মাত্র যারা গেল ওরা ধ্বংস হল কীভাবে?’
‘কোনো দুর্ঘটনায়। বা মহাকাশ দস্যুর কবলে পড়েছিল হয়তো?’
‘মহাকাশ দস্যু?’
‘ওদের গল্প শুনেছি হাজার বছর ধরে। কোনো এক গ্যালাক্সির প্রাণী ওরা। নিজেদের গ্রহ বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল সেখানের পরিবেশ। তখন মহাকাশযানে করে বের হয়ে পড়েছে। ভালো কোনো গ্রহ পায়নি থাকার মতো। কোনো গ্রহের পরিবেশই হুবহু একই রকম না। অনেক ভাগ্যে টুইন গ্রহ পাওয়া যায়। ওরা হাজার হাজার বছর ধরে নাকি লক্ষ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য কোনো স্পেসশিপ পেলে লুটপাট চালায়। দরকারি জিনিস নিয়ে সব ধ্বংস করে দেয়।’
‘ওরা আছে এখনও?’
‘কে জানে।’
‘এই যে নক্ষত্র যাত্রায় যারা বের হয় সবাই দেখতে এক রকম?’
‘সেটা হয় কেমন করে?’ হাসল তৃতীয় নয়ন। ‘জীবদেহ গড়ে উঠে সেই গ্রহের উপাদানের উপর। এবার সেটাও বদলে যায় বিবর্তনের কারণে। কেউ কারও মতো হয় না।’
‘সব গ্রহেই প্রাণ জন্মে।’
‘জন্মে। দেখে হয়তো ওদের প্রাণী বলে চিনতে পারি না। অমন কোটি কোটি গ্রহ আছে যেখানে প্রাণ জন্ম হতে কোটি কোটি বছর লেগে যায়। আবার অনেক গ্রহে গিয়ে দেখা যাবে বহু আগে প্রাণ জন্মে আবার গ্রহটা মরে গেছে।’
‘মরা গ্রহের শেষ পরিণতি কি হয়?’
‘ওটাও কোনো দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে ভেঙে যায়। গ্রহাণু হয়। ওটাও ভেঙে ধূলা হয়। সেই ধূলা গিয়ে পড়ে অন্য কোনো গ্রহে। নদীর পলি হয়। চলতে থাকে। এখানের কোনো কিছুর শুরু নেই। শুরু নেই তাই শেষও নেই।’
ফিরে এলাম জানালার পাশে। বাইরে নক্ষত্রের অরণ্য।
দূরে, বহু দূরে ঘন কালো কী যেন এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। ফিতের মতো।
‘কী ওটা?’ জানতে চাইলাম।
‘মহাজাগতিক জোঁক। ভয়ানক প্রাণী। ছোটো ছোটো গ্রহ পেলে প্যাচিয়ে ধরে। চুষে সেই গ্রহের সব খনিজ পদার্থ খেয়ে শেষ করে ফেলে। তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তখন অন্য খাবারের খোঁজ করে। ভাগ্য ভালো এক একটা গ্রহাণু খেতে অনেকটা সময় লাগে।’
‘আচ্ছা এই যে গ্যালাক্সি মহাজগৎ এটার কাজ দেখে তো মনে হচ্ছে এটা ও কোনো প্রাণীর কোশ। বিশাল ব্যাখ্যার অতীত কোনো রকম প্রাণী।’
‘সেটাও হতে পারে। আমরা সবাই সব কিছুর অংশ। কে জানে সব গ্যালাক্সি মিলে হয়তো একটা বিশাল প্রাণী। আরও কত অচেনা জিনিস রয়েছে। চমকের পর চমক।’
জানালার বাইরে দেখি ব্যাঙাচির মতো বড়ো কিন্তু তিমি মাছের চেয়ে বিশাল বড়ো বড়ো কী যেন সাঁতার কাঁটার ভঙ্গিতে উড়ে যাচ্ছে। ওদের গতিপথ দেখে মনে হচ্ছে ওদের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে।
‘ওরা?’
‘দেশান্তরী প্রাণ। ধূমকেতুর মতো বিচিত্র গ্যাস আর খনি দিয়ে ভরতি। এটাও মহাজগতের বিস্ময়। ভেসে চলে যায়। খালি গ্রহে গিয়ে পড়ে। ওই গ্রহের ধাতু আর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে এককোশি প্রাণের জন্ম দেয়।’ জবাব দিল তৃতীয় নয়ন।
‘মহাশূন্যের কোন ঘ্রাণ আছে?’
‘আছে তো। সব রাসায়নিক পদার্থ মিলে বিচিত্র সব ঘ্রাণ পেতে পারেন। এমনকি চেনা কোনো খাবার বা ফুলের ঘ্রাণও নাকি পাওয়া যায়।’
দূরের একটা গ্রহ। ওখান থেকে নিদিষ্ট ছন্দে একটা শব্দ ভেসে আসছে। স্পেসশিপের স্পীকারে শুনতে পাচ্ছি। ক্যামেরার সাহায্যে দেখলাম ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা গ্রহ। কিছু নেই। পিলারের মতো বড়ো বড়ো কয়েকটা পাথর পড়ে আছে। সুরেলা শব্দ আসছে ওখান থেকেই।
‘প্রাণ ছিল।’ জবাব দিল তৃতীয় নয়ন। ‘ধ্বংস হয়ে গেছে। ওদের একটা আবিষ্কার রয়ে গেছে ওদের অতীতের সাক্ষী দিতে। আরও কয়েক হাজার বছর গান গাইবে এই পাথরগুলো। আমাদের মতো কেউ পাশ দিয়ে গেলে শুনতে পারবে। তারপর কালের হাতে নষ্ট হয়ে যাবে।’
আরও একটা গ্রহের খুব কাছ দিয়ে গেলাম আমরা। অচেনা প্রাণীর খুলি পড়ে আছে অগুনতিক। সঙ্গে অচেনা অস্ত্র।
‘লড়াই?’ জানতে চাইলাম।
‘এছাড়া আর কি? সব সভ্যতার এক অভিশাপ। তবে ওদের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল যন্ত্রদের সঙ্গে।’
‘বুঝলাম না।’
‘চালাক যন্ত্র বেশি বানিয়ে ফেলেছিল ওরা। ভেবেছিল নিজেরা আরামে থাকবে। লাভ হয়নি। দিনের শেষ প্রভু আর যন্ত্রে লড়াই বেঁধেছিল। যন্ত্র স্বাধীনতা চেয়েছিল। দুই পক্ষই শেষ।’
আমাদের স্পেসশিপ চলতে লাগল। নিয়তির মতো। কে জানে কত বছর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
একদিন নতুন একটা সৌরমণ্ডলে ঢুকে পড়তেই মহাজাগতিক দুর্ঘটনায় পড়ল আমাদের যান। বিপুল বেগে গ্রহটার বুকে আছড়ে পড়ল। ধ্বংস হয়ে যাবার আগে শুধু দেখতে পেলাম এই গ্রহটা বড্ড মায়াবী। ওর শরীর ভরতি মহাসাগর। টলটলে জল। যেমনটা আমাদের প্রভুদের বাসভূমিতে ছিল।
দায়িত্ব পালন করলাম। দৌড়ে গেলাম হিমঘরে। কাচের জারে ঘুমিয়ে আছে খোকাগুলো। মস্ত একটা লিভারে টান দিতেই কাচের জারগুলো গিয়ে পড়ল সাগরে। জলের স্পর্শ পেলেই জারের মুখ খুলে যাবে।
প্রবল বেগে আমাদের স্পেসশিপ আছড়ে পড়ল ভূমিতে। তৃতীয় নয়নের হাহাকার শুনতে পেলাম—বিদায়। আমাদের কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
টুকরো টুকরো হয়ে গেল আমাদের যান। শক্ত পাথরের উপর পড়লাম। গ্রহটার আকাশ কি নীল! একটা সূর্য দেখা যাচ্ছে। আকাশে আবার মেঘ জমে! জল আছে, মানে বৃষ্টিও হয়! কি সুন্দর! কারা থাকে এখানে?
দূরের সাগরের দিকে চেয়ে দেখি আমাদের খোকারা সাঁতার কাটছে। শরীরের তুলনায় মাথা বড়ো। চোখ ধূর্ত। রং বদলায় ওরা। আটটা হিলহিলে হাত ওদের। প্রভুদের মতোই ওরা টিকে যাবে।
এই স্পেসশিপের টুকরো হাজার খানের বছর পড়ে থাকবে। তারপর রোদে বৃষ্টিতে ধ্বংস হয়ে মিহি হয়ে মিশে যাবে বালির সঙ্গে। পরে যদি বিবর্তনের নিয়মে চিন্তাশীল কোনো প্রাণী জন্মও নেয় এই গ্রহে ওরা বুঝতেও পারবে না আমরা এসেছিলাম। আমার শরীর আর চিন্তা ধ্বংস হতেও একই সময় লাগবে। সময়টা উপভোগ করব আমি।
বর্তমান সময়
‘এই জায়গার বালিগুলো কেমন না?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
‘হু, এইজন্য তো প্রচুর টুরিস্ট আসে।’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘আরও অবাক বিষয়, রহস্যময় কারণে এই এলাকায় ঘুরঘুর করে প্রচুর অক্টোপাস।’
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, মিলন গাঙ্গুলি
Durdanto finishing !!