অলীক বাস্তব
লেখক: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“ইওর অ্যাটেনশান প্লিজ। বি এম এয়ারলাইনের বুন আইল্যান্ড—ডেনসবার্গ ফ্লাইটে আপনদের স্বাগত জানাচ্ছি, আমি ক্যাপ্টেন কেভিন হর্স্ট। ১২ ঘণ্টার এই যাত্রায় আপনাদের…”
কানে ইয়ারফোনদুটো গুঁজে দেয়াতে ম্যাট আর বাকি কথাগুলো শুনতে পেল না। শোনবার প্রয়োজনও বিশেষ নেই। মাসে গড়ে দু-তিনবার করে শুনতে শুনতে পাখিপড়া মুখস্ত হয়ে গেছে কথা ক-টা, এমনকি কথার সঙ্গে সঙ্গে চলা বিমানকর্মীর মুকাভিনয়ের প্রতিটা ভঙ্গীও।
এই মিউজিকটা বহুবার শোনা। তবু বারবার শুনতে ভালো লাগে জন ম্যাটের। কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই। কণ্ঠসঙ্গীতও নয়। তার বদলে ইয়ারফোনে ভেসে এল, ঝরঝর করে ঝরে পড়া ঝরনার জলের শব্দ, হঠাৎ হাওয়ায় পাতায় পাতায় ঘষা লেগে বন জুড়ে শিরশির আওয়াজ, পাখির ডাক, বৃষ্টির শব্দের ভেতর জেগে ওঠা হঠাৎ মেঘের গর্জন… ম্যাট টেরও পেল না, কখন মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেছে তাদের প্লেন।
“আপনার ব্রেকফাস্ট সার।”
একটা মিষ্টি গলার শব্দে চমক ভাঙল। মেয়েটি নীচু হয়ে প্রায় কানের কাছে মুখটা এনে কথা বলছে। প্লেয়ার বন্ধ করল ম্যাট। মনে মনে একটা পাহাড়ি ঝরনার ধারে বসেছিল এতক্ষণ। দূরে পাহাড়ের চুড়ো ঘিরে বৃষ্টির মেঘ। সেদিক থেকে ছুটে আসা শিরশিরে হাওয়ায় চারপাশের জঙ্গলে সড় সড় আওয়াজ তোলে…
সব মিলিয়ে গেল। ওর চারপাশে সারি সারি মানুষ, ব্যাটারি লাগানো পুতুলের যান্ত্রিকতায় শুধু হাত আর মুখ নেড়ে চলেছে একই তালে। এক হাতে ছুরি দিয়ে খাবারের টুকরো ছিঁড়ে অন্য হাতে কাঁটায় গেঁথে সেই টুকরো মুখে তোলা, তারপর চোয়ালের খানিক ওঠানামা, তারপর আবার আর এক টুকরো ছেঁড়া…
ছুরি-কাটা-চোয়াল-ছুরি-কাটা-চোয়াল—চলছেই—চলছেই—
“চুলটা ছেঁটেছেন মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ। গত সপ্তাহে তুমি অত করে বললে। না শুনে পারি?”
“ঠিকই বলেছিলাম দেখছি। দুর্দান্ত হ্যান্ডসাম লাগছে এবারে। আমার পারফিউম এনেছেন?”
“ব্রিফকেসে আছে। কাল সন্ধেবেলা পাবে। এখন নয়।”
“ওকে। সি ইউ দেন।”
নীল চোখে ঝিলিক দিয়ে, খাবারের ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে পেছনের দিকে এগিয়ে গেল মণিকা।
১ক
মিটিং শেষ হতে হতে বিকেল সাড়ে সাতটা বাজল। তখনও দিনের আলো দিব্যি আছে। এখানে সন্ধে অনেক দেরিতে হয়। বুন আইল্যান্ডের ফ্যাক্টরির কাজ প্রায় শেষ। ওখান থেকে ছাড়া পাবার পর এবারে ওরা সম্ভবত ম্যাটকে ভারতে পাঠাবে। ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার কোনো একটা জায়গায় একটা দু-হাজার মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসাবার বরাত পেয়েছে কোম্পানি। তারই একটা প্রাথমিক রিপোর্ট নিয়ে নাড়াচাড়া চলল অনেকক্ষণ।
লাঞ্চ আওয়ারে কার্ল প্রস্তাব দিয়েছিল, সন্ধেবেলা থিয়েটারে নিয়ে যাবে। এখানকার একটা নতুন অপেরা নিয়ে নাকি খুব মাতামাতি চলছে গোটা ইউরোপে, তারই একটা শো-তে। সবিনয়ে মানা করে দিয়েছে ম্যাট তৎক্ষণাৎ। যে দিন বা রাতগুলোতে সে আর মণিকা এক শহরে থাকে, সেগুলো অন্য কোথাও গিয়ে নষ্ট করবার কোনো মানেই হয় না।
ওদের প্রথম আলাপ হয়েছিল বার্ন-এ। প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। ম্যাট এয়ারপোর্টে আসছিল ট্যাক্সি করে। পথে হাত দেখিয়ে লিফট চাইল একটা মেয়ে। চোখটানা রূপ। কিন্তু দেখানেপনা নেই একেবারে। গোটা পথে একটাও কথা বলেনি। এয়ারপোর্ট আসতে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নেমে চলে গিয়েছিল। পরে ফ্লাইটে উঠে ম্যাট হঠাৎ দেখে সেই মেয়েটাই খাবার নিয়ে আসছে। ডিনারের পরে ম্যাটকে একটা অসাধারণ চকোলেট ড্রিংক খাইয়েছিল এনে। ওটা এয়ারলাইনের বাঁধা মেনুর বাইরে, ম্যাটের উপরি পাওনা।
সেই থেকে বন্ধুত্ব। স্পেনের মেয়ে। বিয়ে করেনি। ওরই মতো। কারণটাও এক। শেকড় গেড়ে সংসার পাতবার মতো পেশাই নয় যে ওদের! একুশটা দেশে ব্রাঞ্চ আছে ম্যাটদের। প্রজেক্ট চলছে অন্তত পঞ্চাশটা বিভিন্ন লোকেশনে। আর, মণিকার তো দিনরাত কেটে যায় হয় আকাশে নয়তো নানা দেশের হোটেলের রুমেই। মাটিতে পা ওর পড়ে কখন যে শেকড় গাড়বে!
তবু, গত পাঁচ বছরে কোথায় যেন একটা সম্পর্কের শেকড় ছড়িয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ তলিয়ে ভাববার অবসর পায়নি ওরা। তবে এই একসঙ্গে হবার সুযোগগুলোর জন্যে দুজনেই যে বেশ বুভুক্ষু হয়ে থাকে সেটা সত্যি।
বারো তলার ছোটো ফ্ল্যাটটার জানালা দিয়ে অ্যাটলান্টিকের লোনা সুবাস এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল ম্যাটের নাকে। আজ চাঁদ উঠেছে। জানালার নীচের অংশের কালো কাচের ভেতর দিয়ে সারে সারে এগিয়ে এসে আছড়ে পড়া চকচকে ঢেউগুলো চোখে পড়ছিল তার।
“আই মাস্ট গো ডাউন টু দ্য সি-জ এগেইন… টু দ্য ভ্র্যাগ্র্যান্ট জিপসি লাইফ…”
কত লক্ষ কোটি বছর ধরে একই জায়গায় থেকে গেল ওই সমুদ্র আর বেলাভূমি। একের বুকে অন্যে এসে আছড়ে পড়ে, নীল আর হলুদের খুনশুটি করে কাটিয়ে দিল যুগের পরে যুগ। আর ওরা দুজন, ইচ্ছে করলেও একটার বেশি দিনরাত্রি একসঙ্গে পায় না কেন?
হাতের সিগারেট পুড়ে পুড়ে ছোটো হয়ে যায়। নীল নীল ধোঁয়ার স্রোত, রাতের বাতাসের কাঁধে চেপে সমুদ্রের দিকে রওয়ানা দিয়েছে…
“নট দেয়ার ডার্লিং। লুক অ্যাট মি…”
ম্যাট ঘরের ভেতর চোখ ফেরাল। চাপা সোনালি আলোয় বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে সোনায় গড়া মেয়ে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে…
বাইরের সমুদ্র হারিয়ে গেল। প্রাণের আদি উৎস সমুদ্রের অমোঘ ইশারা জেগেছে ওদের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে। অবিশ্রান্ত শব্দ ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ভেঙে পড়ে দুটো গলে মিশে যাওয়া চেতনার ভেতরে।
তবু তারই ভেতরে কোথায় যেন কে বলে উঠছে বারে বারে…
“ভালো লাগে না।”
অবিশ্রান্ত সফরের পর সফর, উড়ানের পর উড়ান, আর তারই ফাঁকে আহার নিদ্রা মৈথুনের অনিঃশেষ চক্রে ঘুরে চলা।
আঃ… এইবারে প্রতিধ্বনি উঠেছে! সাড়া আসছে মণিকার কাছ থেকে। প্রথমে ক্ষীণ, তারপর ক্রমশই আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার উত্তর…
“ভালো লাগে না—ভালো লাগে না—এ জীবন নয়, নয়…”
বেশির ভাগ সময়েই ব্যাপারটা এভাবেই ঘটে। যে পরিবেশে যে চেহারাতেই থাকুক না কেন, সাধারণত বদলের ইচ্ছেটা যে কোনো একজনের মনে আগে জাগবে। তারপর সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে, অন্যজন কখন সাড়া দেবে তার জন্য। দুটো মনের ফ্রিকোয়েন্সি না মিললে তো বদল সম্ভব নয়! এবারে অবশ্য একটু বেশিই সময় লাগল মণিকার, মনস্থির করতে।
আবছা আলোয় ওর চোখের একদম কাছে মণিকার চোখদুটো চিকমিক করে উঠল… “চলো তবে, এবারে নতুন করে…”
একে অন্যকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ওরা দুজন। তীব্র আলোর ছটায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। সমুদ্র আকাশ, এই ঘর, ম্যাট, মণিকা সবাই গলে মিশে গিয়ে এক অত্যাশ্চর্য নীল পটভূমি…
২
–মণি, ব্যাগটা দাও।
–পারব না।
মণিমালা মুখটা গোঁজ করে বসে রইল। ওর দিকে চেয়ে বুকটা হু হু করে ওঠে মাতুর। কী ছিল, আর কী হয়েছে!
ষোল বছরের মেয়ে মণিমালা যখন বিয়ে হয়ে মাতুর ঘরে এল, একটা ফুরফুরে পাখির মতো উড়ে ঘুরে বেড়াত গোটা বাড়ি জুড়ে। বন্ধুরা হিংসে করে বলেওছে কতবার, “বউ বটে মাতুর! বাঁদরের গলায় অমন মুক্তোর হার জোটালি কোত্থেকে বল তো!”
ত্রিশটা বছর কেটে গেছে তারপর। উনুনের পাশে, দুটো হাঁটু বুকের কাছে জড়ো করে বসে থাকা ওই হাড়সর্বস্ব মানুষটাই কি ওর সেই মণি! মাঝে মাঝে মাতুর বিশ্বাস হয় না।
অবশ্য কী-ই বা দিতে পেরেছে ও মণিকে! এবেলা ভাত জোটে তো ওবেলা জোটে না। বছরে একজোড়া কাপড় কিনে দিতেও নাভিশ্বাস ওঠে। একটা ছেলেপিলেও দিতে পারল না মাতু বেচারার কোলে। অবশ্য তার জন্য মাতুর যেমন, মণিরও তেমনই আক্ষেপ।
“তুমি যাবে না আর ওই সব্বনেশে খেলা খেলতে।”
“চুপ চুপ। খেলা বলিস নে মণি। আমি না শিবের সন্ন্যাস নিয়েছি? ও তো শিবের পুজো!”
“পুজো না ছাই। পিঠে লোহার আকশি গেঁথে অত ওপর থেকে ঝোলা—তোমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, আমি কোথায় দাঁড়াব?”
“ছিঃ মণি। দেবতাকে অবিশ্বাস করতে নেই। তার দয়াতেই তো বেঁচেবর্তে আছি রে।”
“ছাই দয়া। অতই যদি দয়া তবে কোলে একটা দিল না কেন? অতই যদি দয়া, তো বছর বছর তোমার পিঠটাকে অমন করে দেগে দেয় কেন?”
মাতুর মেরুদণ্ডের দুপাশে সিকির মতো ক্ষতচিহ্নগুলোর ওপর খরখরে আঙুল বোলাতে বোলাতে মণির চোখের জল বাঁধ মানে না।
মাতুর চোখদুটো কোমল হয়ে আসে, “দেখ মণি, আজ দু-জায়গায় ঝুলব। পাঁচশো পাঁচশো হাজারটা নগদ টাকা। দুটো কাপড়। চাল-ডাল যা পাব, তাতেও কোনো না মাস চলে যাবে…”
“চাই না তোমার টাকাপয়সা। ও চাল-ডালের মুখে আগুন। ওগো, আমার মন যে বারে বারে কু’ডাক ডাকে! কিছু একটা যদি হয়ে যায় তোমার! ওগো… শোনো…”
বেড়ার দরজা খুলে হন হন করে ছুটে যাওয়া মূর্তিটার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর চোখের জল-টল মুছে উঠল মণি। রাজ্যের কাজ পড়ে আছে ওদিকে। বসে বসে কাঁদলে তার চলবে কেন? ভালো খাওয়া-পরা ঘরের মেয়ে ছিল। মামা অনেক দেখেশুনে বিয়েও দিল ভালো ঘরে ঘরে। একসময় এই এলাকায় নগেন বিশ্বাসের ধানী জমিই ছিল দেড়শো বিঘা। চাকর বাকর মুনিশ রাখাল মিলে সকাল বিকেল পঞ্চাশটা পাত পড়ত ওই উঠোনে। পুত্রবধূ মণিকে মা লক্ষ্মী বলে ডাকতেন নগেন।
কিন্তু সংসারে আসল লক্ষ্মী ছিলেন উনি নিজেই। উনিও দেহ রাখলেন, সংসারেও আগুন লাগল। রাক্ষসী গঙ্গা মাত্র তিন বছরের মধ্যে দেড়শো বিঘে সরেস জমি চেটেপুটে খেয়ে রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে গেল ওদের। দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে কী ঘরে এসে দাঁড়িয়েছিল মণি, আর কী ঘর হয়ে গেল!
কাজকর্ম সব সারতে সারতে সন্ধে। তুলসীতলায় আলো দেখাতে দেখাতে ওই অন্ধকার উঠোন আর এখানে ওখানে ভেঙে পড়া বাড়িটার দিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ মনটা হু হু করে উঠল মণির… আর না। ঠাকুর, এবারে তুমি আমায় নাও—নিয়ে যাও আমারে…
গ্রামের একটেরেতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নির্জন পোড়ো বাড়িতে ভরসন্ধের ঝাপসা অন্ধকারে কেউ শুনতে পেল না তার সেই আকুল আকাঙ্খার কথা। কিন্তু সেই তীব্র ইচ্ছের সংকেত গিয়ে ধ্বনি তুলল আর একটি চেতনার দরজায়…
২ক
মোটা, লম্বা একটা খুঁটির গোঁড়ায় ধুতি গামছা জড়ানো। ঘেঁটুর মালা, ধুতরো ফুলের চোঙ, কাপড় গামছা, সিধে, সব কিছু এখনও রাখা রয়েছে চড়ক গাছের গোড়ায়। ওসব কেউ ছোঁবে না এখন। কাটা ফলপ্রসাদটুকু আর পুরুতের সিধে, দক্ষিণা বাদে বাকি সবই মাতুর প্রাপ্য। ওপর থেকে দুলে দুলে ওদিকে তাই কড়া নজর রাখছিল মাতু। লোকজনকে বিশ্বাস নেই। কে কোনটা সরিয়ে ফেলবে আবার কে জানে! আজকাল ধর্মভয় বলে কিছুই তো নেই আর।
চড়কগাছের মাথায় আড়াআড়িভাবে দাঁড়িপাল্লার মতো আটকানো বাঁশের একপাশে একটা দড়ি। তার মাথাতে আটকানো জোড়া হুকে গাঁথা মাতু মাটি থেকে হাত দশেক ওপরে ঝুলছে। বাঁশের অন্য প্রান্তে একগাছা লম্বা দড়ি বেঁধে, তাই ধরে মাতুসুদ্ধু বাঁশটাকে বন বন করে ঘোরাচ্ছে দশবারোটা ছেলে।
মাতুর চোখের নীচে কালো কালো মাথার মাঠজোড়া জঙ্গলটা দুলে দুলে ওঠে বারবার… সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এক একবার এগিয়ে আসে আর পিছিয়ে যায়… ঢেউয়ের গর্জনের মতোই শব্দ ওঠে মাঠজুড়ে, “শিবো হে…”
দড়িটা ঘোরার বেগে টানটান হয়ে গেছে। হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে হুকে গাঁথা মাতু, অবিকল একটা পাখির মতোই শূন্যে ভেসে যায়। গলায় ঝোলানো একটা পোঁটলার থেকে রাশি রাশি বাতাসা নিয়ে ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছে নীচের দিকে। সেই বাতাসার গতিপথ অনুসরণ করে বারবার ছুটে যায় কালো কালো মাথার স্রোত…
…মণি একবার দেখে যা। তোর না-মরদ মাতু আজ কেমন দেবতা হয়েছে! তার হাতের বাতাসা কুড়োতে, এমনকি লাঠিওয়ালা খাকি পুলিশও ছুটে ছুটে যাচ্ছে কেমন! হা হা…
এক অদ্ভুত আনন্দে, দুই হাতে হাওয়া কেটে ভেসে ভেসে উড়ে যায় ক্ষণিকের দেবতা মাতঙ্গ বিশ্বাস।
তবে হ্যাঁ! ভয় পেয়েছিল বটে প্রথমবার। পিঠে যখন বড়শি গাঁথল, তখন ব্যথা লেগেছিল জোর কিন্তু ভয় লাগেনি। অমন ব্যথায় অনেক অভ্যেস আছে মাতুর। ভয়টা লেগেছিল, যখন ওকে দড়িতে ঝুলিয়ে আকাশে তুলল, তখন। পায়ের তলায় মাটি নেই, চার হাতে পায়ে ধরবার মতো কোনো অবলম্বন নেই, শুধু বন বন করে ঘোরা। নিজের কাছে স্বীকার করতে আর লজ্জা কী, হা হা করে কেঁদে উঠেছিল মাতু তখন। আর তাইতেই খুব নামডাক হল মাতুর। গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী গিন্নিবান্নিরা মণির কাছে গিয়ে ব্যাখ্যান করে শুনিয়েছিল, “আহা মানুষ নয় গো! দেবতা! দেবতা! গাছে গিয়ে চড়লেন, ভক্তিতে গদগদ, চক্ষুতে গুলের ধারা, হা হা করি কাঁদতিছেন, গা দিয়ে জ্যোতি বার হয়।”
এহেন প্রশংসার জবাবে মণি কিছু বলেনি। নীরবে বসে বসে অপেক্ষা করেছিল শুধু, কখন ফিরবে মাতু। সেদিন গভীর রাতে, অন্ধকারের মধ্যে মণির চোখদুটি ছুরির মতো হঠাৎ ঝিকিয়ে উঠেছিল মাতুর নীচে থেকে… দৃঢ় আলিঙ্গনের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পুরুষটির কানে হিস হিস করে গরল ঢেলে দিয়েছিল তার সঙ্গিনী, “ভক্তি না ছাই। ভয় পেয়েছিলা তুমি। বলো সত্যি করে—”
খানিক পরে, তার হাতের বাঁধনের বাইরে, চৌকির এক কোণায়, বেড়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকা অসহায় নির্বস্ত্র মানুষটার ওপর কী যে করুণা হয়েছিল মণির! ক্ষমতা নেই বটে কোনো, তবু মণিকে ভালো তো বাসে লোকটা! নইলে ওই ভিতু মানুষ, পয়সার লোভে চড়কের গাছে চড়তে যায়! কার জন্যে?
এগিয়ে গিয়ে আবার তাকে কাছে জড়িয়ে নিয়েছিল মণি। তারপর ফিসফিস করে বলেছিল, “বলো, আর কোনোদিন পয়সার জন্য এমন পাগলামো করতে যাবে না, বলো, বলো…”
কথা দিয়ে ফেলেছিল মাতু। কিন্তু রাখতে পারেনি। পরের বার চৈত্রমাস কাছে আসতেই চোখে ভেসে উঠেছিল, হাজার হাজার কালো কালো মাথার সেই ঢেউ, আর তাদের মাথার ওপর দিয়ে তার সেই একদিনের ভগবান হয়ে উড়ে ভেসে যাওয়া…
সেই দ্বিতীয় বছরে ফাল্গুনের শেষাশেষি একদিন দুপুরে পুকুর থেকে চান করে ফিরে মণি দেখে মাতু গেরিমাটি দিয়ে ধুতি ছোপাচ্ছে বসে বসে। তার মানে, ফের শিবের সন্ন্যাস নেবে। ফের ওই চড়কের গাছে…
একটা তীব্র বিষাদ ছেয়ে গিয়েছিল মণির সর্বাঙ্গে। কিন্তু তবু, চড়কের দিন বিকেলে যখন মাতু বার হল বাড়ি থেকে, মুখ ফুটে বলতে পারেনি, যেও না।” একবার কথা দিয়ে সে কথা রাখেনি মাতু। নির্লজ্জর মতো তাকে আবার সেই একই কথা বলতে সম্মানে বেধেছিল মণির। ফিরে আসবার পরে মাতুর বাড়িয়ে দেয়া পোঁটলাটা হাত পেতে নিয়েছিল বটে, কিন্তু সে রাতে মাতুকে পেট ভরে খাইয়ে নিজে উপোস করে থেকেছিল।
সেই দু-নম্বর বারের পর থেকে আর কখনো এ নিয়ে তাকে কিছু বলেনি মণি। অথচ আজ, এতদিন বাদে যে কেন অমন অবুঝের মতো করল সে! শুভ কাজে বার হবার মুখে কু’ডাক ডাকা।
উড়ে যাবার ফাঁকে ফাঁকে বারবার ওর মুখটাই মনে পড়ে যাচ্ছিল মাতুর। ওর কথাগুলো। যাক গে। বলুক। এবারেই তো শেষ! রাণাঘাটে সস্তায় একটা দোকান ঘরের খোঁজ পাওয়া গেছে। ইস্টিশান থেকে খানিকটা দুরে। গেরুয়া টেরুয়া তো আছেই। তাই নিয়ে জ্যোতিষ হয়ে গিয়ে বসবে ওখানে। খুদকুঁড়ো যা জোটে দুজনে মিলে চলে যাবে। আবার একটা নতুন জীবন! একটা নতুন…
…কোলে কে যেন একটা ছোট্ট বাচ্চা ধরিয়ে দিয়ে গেছে কোন ফাঁকে। চড়কের গাছে ছোটো বাচ্চাকে ঘোরালে সে বাচ্চার অশেষ সৌভাগ্য হয় নাকি। তাকে দু-হাতে আগলে ধরে হাওয়ায় উড়ে ঘুরতে ঘুরতে তার চোখদুটির দিকে চেয়ে দেখল মাতু। কাঁদছে না মোটেও। চকচকে, নীলচে দুটো চোখ! ঠিক মণির ছোটোকালের চোখদুটোর মতো। যেন তার গভীর আসঙ্গ আলিঙ্গনে বাঁধা কিশোরী মণি চেয়ে আছে তার চোখের গভীরে…
চিকমিকে চোখদুটি কত কথা বলে যায় আকাশচারী মাতুকে! কত পুরোনো স্মৃতির দরজা খুলে যায় মাতু বিশ্বাসের চোখদুটির সামনে…
…ডাক এসেছে। ওই চোখদুটির মধ্যে দিয়ে তার খবর এসেছে মণীর কাছ থেকে!
এবারে মণি আগে। জবাবে, সাড়া জাগছে উড়ন্ত, ঘুরন্ত মাতুর চেতনার গভীরেও। যেন এক গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠছিল সে…
ঘূর্ণন থেমে এসেছে ততক্ষণে। বাচ্চাটি ফিরে গেছে, সম্ভবত তার কোনো আত্মীয়ের কোলেই।
উঁচু বেঞ্চটার ওপর উপুড় করে শুইয়ে পিঠের হুকদুটোখুলে নিতেই সটান উঠে দাঁড়াল মাতু। তার দ্রুত হেঁটে যেতে থাকা শরীরটার পেছন থেকে মানুষের হাঁকডাক উঠে আসে… “ওকী ও? সব পাওনাগণ্ডা ফেলে গেলা যে… ও সন্নিসি…”
থাক গে। পড়ে থাক সব। এই মাঠ, ঘাট, লোক, জন, টাকা, কাপড়, সিধে—গলে মিশে সবই তো সেই শূন্যই হবে! হোক! মাতুকে এখন যেতে হবে। মণি অপেক্ষা করছে—খানিক আগে কোলের শিশুটির চোখে মণির সেই অপেক্ষমান চোখদুটির নীল ঝলক দেখেছে মাতু…
আকাশে আজ চাঁদ নেই। মণি উঠোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। তারার আলোয় বাড়ির সামনের বাঁশে দরজার কাছটা আবছা আবছা দেখা যায়।
তারপর, একসময় বাইরের গাঢ়তর অন্ধকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটুকরো লম্বা ছায়া এসে দাঁড়াল সেই দরজাটার মুখে। মণি এগিয়ে গেল তার দিকে…
…তারার আলোর নীচে দুটো ছায়া এসে মিশে গেল একসঙ্গে। তারপর, এক সর্বগ্রাসী অন্ধকার এসে তার তরল তমিস্রায় ডুবিয়ে দিল ঘর বাড়ি, আকাশ বাতাস, মাতু মণি, সবকিছুকে… ফাঁকা একটা নীল ক্যানভাসের বুকে মিলিয়ে গেল অবয়বহীন দুটো চেতনা। আবার নতুন পথে…
৩
শ্রীচরণেষু বাবা,
যখন তুমি এই চিঠি পাবে ততক্ষণে তোমার এই দুষ্টু, কথা-না-শোনা মেয়েটা অনেক দূরে। এত দূরে যে হাজার চেষ্টা করেও তুমি আর কোনোদিন তার নাগাল পাবে না। বড়ো হয়ে ওঠবার পর কোনোদিন তোমার কথা শুনিনি। সেই নিয়ে তোমার আক্ষেপ ছিল অনেক। যা বলেছ, তার উলটোটা করেছি চিরটাকাল। তোমার ইচ্ছে ছিল, তামিলে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনটা করি; তারপর তোমার পছন্দের পাত্রটির সঙ্গে সুখে ঘরকন্না করি। আমি কিন্তু জেদ করে বি-কম পড়তে গেলাম শহরের কলেজে। ইচ্ছে ছিল, এম-কম শেষ করে একটা ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি নেব। হয়তো বিদেশেও যাব আরও উচ্চতর পড়াশোনার খোঁজে। সেই নিয়ে কত ঝগড়া তোমার সঙ্গে। আদর্শ নারীর কর্তব্য কী কী তা শেখাতে কম চেষ্টা করোনি তুমি আর মা মিলে। ঘরের মেয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে পড়তে যাবার স্বপ্ন দেখছে, এ নিয়ে এক সময় কত হেসেছ তোমরা।
শুনে সুখী হবে, তোমার মতেরই জয় হয়েছে। ওসব ইচ্ছে আমি বিসর্জন দিয়েছি। এই দেশের মাটি ছেড়ে আমি আর কখনো কোথাও যেতে চাই না। কিন্তু তাই বলে, শখের একটা ডিগ্রি নিয়ে তারপর একজন বিশ্বাসঘাতকের গলায় মালা দিয়ে তার সন্তানধারণের লাইসেন্স অর্জন করাটাকেও আমি গর্বের ব্যাপার বলে মনে করি না।
এখন আমাদের সামনে অনেক কাজ বাবা। অমানুষিক অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে আমাদের জাতটার মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার চেষ্টা করছে ওই শয়তান সরকার। এর প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের দিকে নজর দেয়া আমাদের পক্ষে পাপ। আর যদি কেউ তা করে, আমাদের কোড অব কন্ডাক্টে সে একজন ‘বিশ্বাসঘাতক’। জানি, সরকারি ফায়ার পাওয়ারের কাছে আমরা তুচ্ছ। হয়তো বা খড়কুটোর মতই উড়ে যাব। কিন্তু একটা কথা জানবে, একজন শহীদ এক হাজার জন বিপ্লবীর জন্ম দেয়। আজ আমাদের রক্তের বিনিময়ে আগামী দিনে যে ঝড় উঠবে তার হাত থেকে ওদের নিস্তার নেই। সেই ঝড় কেটে গিয়ে যখন শান্তির দিন ফিরবে এ দেশের বুকে, দেখবে বাবা, লোকে আঙুল দিয়ে তোমার দিকে দেখিয়ে বলবে, ওই যে শহীদ মণিমল্লিকার বাবা!
ও হ্যাঁ। এই প্রসঙ্গে বলি, তোমার পছন্দের পাত্র মুথুস্বামীকে এখন আমরা একজন বিশ্বাসঘাতক বলেই মনে করি। পাঁচ বছর বয়স থেকে ওকে আমি দেখছি। একসঙ্গে খেয়েছি, শুয়েছি, খেলা করেছি, মারপিট করেছি কতদিন। মনে মনে জানতাম চিরটাকাল এইভাবে একসঙ্গেই কাটবে আমাদের। ও যেবার জেলার মধ্যে ফার্স্ট হয়ে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক্স পড়তে গেল, গর্বে আমার বুক দশ হাত হয়ে গিয়েছিল।
মনে আছে বাবা, ও কলম্বো চলে যাবার আগে একদিন তোমার পারমিশন নিয়ে আমার মুভি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল আন্না টকিজ-এ? সেই দিনটা এক অর্থে আমার জীবনের গতিমুখ ঠিক করে দিয়েছিল। তার জন্য মুথুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
সিনেমা দেখতে দেখতে আমার ডানহাতটা মুঠোয় টেনে নিয়ে মুথু বলেছিল, “এবারে কী করবে তুমি?”
আমি বলেছিলাম, “তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
“আর কিছু?”
“ওই কলেজে যাব মাঝে মাঝে। নইলে সময় কাটবে কী করে?”
মুধু শুনে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তারপর খানিক বাদে বলল, “না মণি। তুমি তা করবে না।”
“মানে? তোমার জন্য অপেক্ষা করব না? তুমি… তুমি কী অন্য কাউকে…” আমায় তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিয়ে ও বলল, “না না, সেকথা নয়। পাগলী, তোমাকে ছাড়া আমার কখনো চলবে নাকি? কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“যুগ বদলাচ্ছে মণি। তুমি আমি ছোটোবেলা থেকে আমাদের মা, মাসিদের যেভাবে জীবন কাটাতে দেখেছি এভাবে আর চলবে না। মেয়েদের এখন ঘরে বাইরে ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হবে। একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি চাইব আমার স্ত্রী শুধুমাত্র আমার শোকেসের একটি পুতুল না হয়ে নিজের একটা পরিচয় গড়ে তুলুন। তোমাকে তার জন্য তৈরি হতে হবে। বলো, রাজি?”
যেন একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ঘাড় নেড়েছিলাম। বাবা জানো, পুরুষ বলতে শুধু তোমাকেই কাছ থেকে দেখেছি ছোটোবেলা থেকে। তোমার থেকেই শিখেছিলাম যে তোমরা এই গ্রহের ডমিনেন্ট স্পেসিস। আমরা মেয়েরা জন্মেছি তোমাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান করতে। মনে আছে বাবা, সেই ক্লাস এইটের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার সময়ের কথা! মা’র তখন তিনদিন ধরে জ্বর। বাড়ির যাবতীয় কাজ আর রান্নাবান্না সেরে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলাম তিনদিন ধরে। অঙ্ক পরীক্ষার দিন সকালে তুমি জানালে তোমার গা গোলাচ্ছে। অফিস গেলে না।
মা আমাকে সেদিন পরীক্ষা দিতে যেতে দিল না বাবা! বলল, “ধিঙ্গি মেয়ে! বাপের শরীর খারাপ, আর তুই যাবি পরীক্ষা দিতে! তুই কি মেয়েমানুষ না ডাইনি!”
তুমি মাকে সমর্থন করেছিলে। সেইদিন থেকে বুঝে গিয়েছিলাম, নারী দু-ধরনের। একদল শুধু পুরুষের সেবা করে যান সারাজীবন ধরে। এঁরা হলেন মেয়েমানুষ। অন্যদল পড়াশোনা করে ধিঙ্গিপনা করে বেড়ায়। তাদের বলে ডাইনি। মনকে তৈরিও করে নিয়েছিলাম সেইভাবে। আমি মেয়েমানুষই হব, ডাইনি নয়।
অথচ, সেদিন মুথুর কথা শুনে বুকের ভেতর একটা জানালা খুলে গেল। তাকিয়ে দেখলাম, তুমি ছাড়াও পৃথিবীতে আরও পুরুষ আছে। তাদের একজন চায় আমি আরও লেখাপড়া করি। তারপর পূর্ণ মানুষ হিসেবে তার পাশে এসে দাঁড়াই। বলো বাবা, তার সেই ইচ্ছে কি আমি না মিটিয়ে পারি?
অতএব, তার পরের বছর হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে আমি অ্যাকাউন্টেন্সিতে অনার্স নিয়ে মালাপ্পা শশীধরণ মেমোরিয়াল কলেজে গিয়ে ভরতি হলাম। এই নিয়ে তোমার সঙ্গে দিনের পর দিন কথা কাটাকাটি হয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি যুদ্ধ করতে হয়েছে মা আর ঠাকুমার সঙ্গে। সাংসারিক জীবনে পরিবারের কর্তা হিসেবে তুমি ওঁদের বাধ্য দাসীর মুখটাই দেখেছ চিরকাল। তুমি জান না বাবা, অন্দরমহলের সাম্রাজ্যে কত প্রিডেটরি চেহারা নিতে পারে ওই মুখগুলো!
কমার্স পড়া, কোএডুকেশন কলেজে ভরতি হওয়া, আর সবার ওপরে, বাড়ি ছেড়ে শহরের হোস্টেলে গিয়ে থাকা, এইসব জঘন্য অ-নারীসুলভ কাজের ভবিতব্য কী বলো তো! এই সিচুয়েশনে, নিজের পেটের মেয়ের ব্যাপারে একজন মায়ের ভবিষ্যৎবাণী শোনো…
“ছেলেতে মেয়েতে একসঙ্গে তিন বছর কাটিয়ে ফিরবি, তারপর কোনো মায়ের ব্যাটা পুরুষ ছেলে তোকে ঘরে তুলবে ভেবেছিস? তুই বেশ্যা হবি হারামজাদি। বেশ্যা হবি…”
এগুলো আমার শ্রদ্ধেয়া মায়ের উক্তি। কথাগুলো কেমন মুখস্ত বলে গেলাম দেখলে! একবর্ণ ভুলিনি। ভুলতে পারি? বলো!
সেই দিন থেকে মনে মনে তোমাদের বিসর্জন দিয়েছিলাম। আমি কনফিডেন্ট ছিলাম, আমায় যে ভালোবাসে সে আমায় শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবেও শ্রদ্ধা করে। তার ইচ্ছেকেই মাথায় তুলে নিলাম বাবা। শহরের কলেজে পড়তে চলে গেলাম আমি।
তারপর গত আটটা বছরে কত কী যে বদলে গেল! শুরু হয়েছিল ফার্স্ট ইয়ারের রিগিং দিয়ে। দেখেছিলাম, তামিল আর অ-তামিল এই দু-ধরনের ছাত্রের জন্য দু-ধরনের রিগিঙের বন্দোবস্ত। রিগিঙের নামে আমাদের সঙ্গে জঘন্যতম ব্যবহার করতেও ওদের বাধে না। তারপর আস্তে আস্তে, কলেজে হস্টেলে, পথে ঘাটে গাড়িতে, সিনেমা হলে, সর্বত্র দেখলাম একটাই কথা বারবার আমাদের মাথায় গেঁথে দেবার চেষ্টা চলেছে। তা হল, এত পুরুষ ধরে এ দেশের মাটিতে বেঁচে থাকলেও আমরা এ দেশের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন মাত্র। লজ্জায় অপমানে মাথা হেঁট হয়ে থাকত সবসময়। তোমাদের কখনো কিছু জানাইনি। জানাব কোন মুখে? তোমাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মাথা উঁচু করে বাড়ি ছেড়েছি যে!
তবে হ্যাঁ। মুথুকে জানিয়েছিলাম। স্টাডি ট্যুরে কলম্বো গিয়ে দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। অনেক দুঃখ নিয়ে ওর কাছে সব কথা বলেছিলাম। কিন্তু ওর প্রতিক্রিয়া ছিল ঠিক এইটুকু… “মণি। আমি চাই, এ সব বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চোখ কান বুজে পড়াশোনাটা শেষ করো। তারপর ভারতে গিয়ে একটা ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি নিয়ে ওখানেই সেটল করার কথা ভাবো। কারণ, আমিও কয়েক বছরের মধ্যে সেরকমই কিছু একটা প্ল্যান করছি।”
“কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে…”
“দূর! এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে ও সব দেশ-ফেশ নিয়ে মাথা ঘামানোটা পাগলামি মণি। তুমি আমার স্ত্রী হতে চলেছ। তোমার মধ্যে এই পাগলামি আমি অ্যালাও করব না।”
অর্থাৎ পালাও। আর যতদিন না পালাবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত হচ্ছে, ততদিন মুখ বুজে সব অন্যায়কে মেনে নাও। আমার ব্যাপারে সেটাই তার ইচ্ছে। মানে, আদেশ।
একটা তেতো স্বাদে মুখটা ভরে উঠেছিল। পুরুষমানুষ মেয়ে বলতে পোষা পাখিই বোঝে। তুমি চাইতে খাঁচায় আটকানো পাখি, আর এ খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে বাইরে বার করে এনে দাঁড়ে বসিয়ে দিতে চায়। কিন্তু বটম লাইনটা একই—আমার আদেশ তোমায় মেনে চলতে হবে। সে দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরিকল্পনা করছে; সে ব্যাপারে আমার কথা বলার কোনো অধিকার নেই। ডিসিশান নেবার অধিকার শুধু তার। আমার নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে, ব্যাক্তিগত সেন্টিমেন্টের কোনো গুরুত্বই নেই। তার ইচ্ছেমতো আমাকে নিজের জীবনটাকে সাজাতেই হবে।
ঠিক যেন তোমারই কথার প্রতিধ্বনি শুনলাম সেদিন আমার মুথুর মুখে। তাই যদি হল, তবে কীসের জন্য আমার ঘর ছাড়া? কীসের জন্য এত লড়াই?
তীব্র মানসিক অশান্তিতে যখন ছটফট করছি তখন আমায় পথ দেখিয়েছিলেন ফাদার শ্রীনিবাস উইলিয়াম। আমার মনকে তিনি শান্তির সন্ধান দিলেন। না না, তিনি আমার প্রেমেও পড়েননি, কিংবা ধর্মও বদলাতে বলেননি। শুধু বুঝিয়েছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই মানুষের প্রকৃত ধর্ম। তাঁর কাছেই আমার এই নতুন ধর্মে দীক্ষা, আমার নতুন জন্ম।
আস্তে আস্তে সব ভয়, সংকোচ কাটিয়ে উঠলাম। বুঝতে পারলাম, এই আগুনঝরা হত্যাভূমিতে বুলেটের একমাত্র উত্তর বুলেট।
এই সময়টা নিয়মিত বাড়িতে চিঠি লিখেছি, পরীক্ষা দিয়েছি, ছুটিতে বাড়িতে গেছি। তোমাদের কখনো বুঝতেও দিইনি, সবার চোখের আড়ালে কখন হাতে তুলে নিয়েছি শক্তিমান আকশাই কালাশনিকভ, শিখেছি বুবি ট্র্যাপের ব্যবহার, জাঙ্গল আর সিটি ওয়ারফেয়ারের নিয়মকানুন। পাশাপাশি ফাদারের কাছে চলছিল ইতিহাস অর্থনীতি আর রাজনীতির নিবিড় চর্চা। ভবিষ্যতে যদি কখনো সুদিন আসে আমাদের.. তখন রাষ্ট্রনির্মাণের কাজে সাহায্য করতে হবে যে!
মুথুর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে। সেবার কলম্বো যেতে হয়েছিল কী একটা কাজে। হাত ফাঁকা হতে, একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ ওর ঘরে গিয়ে দেখি, চাকরির পরীক্ষার একটা মোটা বই পড়ছে মন দিয়ে। আমায় দেখে বলল, “মণি এই বইটা দেখো।”
“দেখলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কী?”
“ব্যাপার আর কী! তোমার ইচ্ছে শিরোধার্য করলাম।”
“ধ্যাৎ। আমি আবার করে তোমায় এসব বই পড়তে বললাম?”
“মুখে বলোনি। কিন্তু সত্যি করে বলতো মণি, আমি যে প্ল্যান করেছিলাম, বিদেশে গিয়ে সেটল করব, সেটা তোমার একদন ভালো লাগেনি, তাই না?”
“না লাগেনি। নিজের দেশ ছেড়ে—”
“এখন আসল ব্যাপারটা বলি। আমার প্ল্যান চেঞ্জ করেছি মণি। তোমার যদি এদেশে থাকতেই বেশি ভালো লাগে, তবে তাই সই। দেশের সেবাই করব তবে।”
আমার পায়ের নীচের মাটি সরে যাচ্ছিল একটু একটু করে। আমায় ভালোবেসে, আমারই জন্য এ কোন পথ বেছে নিতে যাচ্ছে মুথু! এ তো আমি চাইনি!
দলের কাজে তখন আমি অনেকদূর এগিয়ে গেছি। আর ফেরার পথ নেই। ফিরতে চাইও না। জানো বাবা, সেদিন আমি মুথুর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। অনেকভাবে বোঝাতে চেয়েছিলাম, দেশকে ভালোবাসবার প্রকৃত পথ ওটা নয়। ও বুঝল না। আমায় সেন্টিমেন্টালিস্ট বলল, দেশদ্রোহীও বলল।
ভাঙা মন নিয়ে সেদিন রাতে কলম্বো ছেড়েছিলাম আমি। বুকের মধ্যে সেই যে আগুন জ্বলেছিল আজও তা নিভল না। শুধু একটাই ধন্দ রয়ে গেল। কখনো বুঝতে পারলাম না, সে আগুন দেশপ্রেমের, না আমার সব ব্যক্তিগত সম্বন্ধ আর ভালোবাসার চিতার আগুন।
কিন্তু আগুনটা আছে। আজও জ্বলে জ্বলে থাক করে দিচ্ছে আমাকে। সেই দহনের জ্বালায় আজ তোমায় এই চিঠি লিখতে বসা। তোমার কাছে একটা সত্যি কথা স্বীকার করে যাব। আমি ভালো করেই জানি, এই চিঠিটা তোমার সহানুভূতি পাবে না। হাজার বছরের সংস্কার আর বিশ্বাসের যে বর্ম তুমি পরে আছ তার গায়ে লেগে ছিটকে ফিরে আসবে তোমার অবাধ্য মেয়েটার এই শেষ চিঠি। তবু তোমাকেই লিখলাম। কারণ আর কাউকে তো চোখে পড়ছে না যার কাছে আমি নিজের কথাগুলো বলে যেতে পারি। ভালো লাগুক আর না লাগুক, চিঠিটা অন্তত তুমি একবার পোড়ো বাবা। ফেলে দিও না।
গত পাঁচ বছরে শুধু পাগলের মতো ছুটে বেরিয়েছি দেশের কোনায় কোনায়। অ্যাসাইনমেন্টের পর অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি। সফল হয়েছি প্রত্যেকটায়। জানো বাবা, আজ যে রেণু আম্মার নামে এ দেশের প্রত্যেকটা অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের ঘুম ছুটে যায়, সে আসলে তোমার আদরের মণি।
এইবারে আমার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট। পুলিশের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট এখনে আসছেন আজ রাতে। গত তিন বছরে, বিদ্রোহ দমনের নামে অসংখ্য নিরীহ মানুষ খুন হয়েছে নাকি লোকটার হাতে। এবারে রেণু আম্মাকে নিকেশ করতেই এখানে আসছে সে। হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশ এসেছিল, নিরাপদ শেল্টারে সরে যাবার সময়ও ছিল। কিন্তু আমি পালিয়ে যাইনি। কারণ, ওই পুলিশ অফিসারের নাম বিক্রম মুথুস্বামী।
কাজটা সহজ। একটা গ্রেনেডের পিন খুলে নিয়ে আড়াল থেকে ছুড়ে ফেলতে হবে লোকটার গাড়িতে। ব্যাস! কিন্তু আমি ঠিক করেছি, ওভাবে নয়। যদি না মরে? যদি কানা খোঁড়া হয়ে বেঁচে থাকে? সে আমি সইতে পারব না বাবা। অপরাধ করেছে, তার শাস্তি পাবে। পাক। আমি নিজে হাতে সুনিশ্চিত শাস্তি দিয়ে যাব ওকে। কিন্তু আমার মুথু, অসহায়, পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকবে তা আমি আমি কিছুতেই চাই না।
অনেক দ্বন্দ্বে ভুগেছি। আর নয়। আমি জানি, আজও ও আমার পথ চেয়ে বসে আছে। ফিরে গেলে, সব আদর্শ, সব কর্তব্যে জলাঞ্জলি দিয়ে ও শুধু আমাকেই ফিরে পেতে চাইবে।
কিন্তু এতটা পথ পেরিয়ে এসে আর তা হয় না। এ জন্মে আর হবেও না। দুজনের পথ দু-দিকে চলে গেছে যে! তাই ঠিক করে নিয়েছি, একসঙ্গেই যাব দুজনে। আমি যদি ওকে না পাই, তবে কেউ ওকে পাবে না। পেতে পারে না। আমার দেশ, এদেশের সরকার, অন্য কোনো মেয়ে, কারও কোনো অধিকার নেই ওর ওপরে। কারও না। চলে যাব আমরা। একসঙ্গে। সে ডাক এসে গিয়েছে বাবা। এবারে যেতে হবে যে আমাদের।
প্রণাম জেনো। মাকে প্রণাম দিও। আর সেইসঙ্গে তোমার ভগবানকে একটু জিজ্ঞাসা কোরো তো, ছোটোবেলা থেকে আমায় যা দিলেন, তা এভাবে কেড়ে নিয়ে তাঁর কি কোনও পাপ হল না? তোমার ভগবানকে আমার শেষ অভিশাপ দিয়ে গেলাম। আমার মুথুস্বামীর তরফেও প্রণাম নিও।
ইতি,
তোমার অবাধ্য মেয়ে,
মণিমল্লিকা।
৩ক
গভীর অন্ধকারের মধ্যে, শুকনো নালাটা পেরিয়ে ভূতের মত এগিয়ে আসে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী। নাইটগ্লাসের লেন্সে ধরা পড়েছে জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট কুঁড়েঘরটা। নিশ্চিত খবর আছে, রেণু আম্মা ওখানেই রয়ে গেছে আজ। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ঠেকেছিল মুথুস্বামীর কাছে। অপারেশনের সাবধানাবাণী দিয়ে রেণু আম্মাকে পাঠানো রেবেল হেডকোয়ার্টারের রেডিয়ো মেসেজটা পুলিশ ইন্টারসেপ্ট করেছিল গতকালই। অপারেশান বাতিল করবার কথা ভাবা হচ্ছে, এই সময় মল্লিকার্জুন খবরটা নিয়ে আসে আজ সন্ধেবেলা। রেণু আম্মা ওর হাইড আউট ছেড়ে বের হয়নি।
অন্য কোনো সোর্স হলে মুথুস্বামী হয়তো ভাবত বাজে খবর অথবা ফাঁদ। কিন্তু মল্লিকার্জুন বাজে খবর দেয় না। ওর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত।
পুলিশের বৃত্তটা আস্তে আস্তে ছোটো হয়ে এসে ঘিরে ধরছিল বাড়িটাকে। রবার সোলের জুতোয় একটা ক্ষীণতম শব্দও তোলেনি এই শিক্ষিত ক্র্যাক ফোর্সের দল। অন্ধকারে রেডিয়াম দেয়া ঘড়ির ডায়াল চিক চিক করে এগিয়ে যায় নির্দিষ্ট মুহূর্তের দিকে।
তারপর, একটা ছোট্ট ইশারায় দপ দপ করে জ্বলে উঠল বড়ো বড়ো সার্চলাইটের আলোগুলো। উপুড় হয়ে কভার নেয়া পঞ্চাশজোড়া হাতে ঝিকিয়ে উঠছে স্টেন কারবাইনের নল। পঞ্চাশজোড়া শিকারী চোখের নিষ্পলক দৃষ্টি ওই কুঁড়েটার দরজার ওপর।
মুথুস্বামী হাতে মাইক্রোফোন তুলে নিল।
“রেণু আম্মা। আমি এএসপি বিক্রম মুথুস্বামী বলছি। আমরা জানি আপনি ওখানেই আছেন। আপনাকে অনুরোধ করব, ধরা দিন। আইনের হতে তুলে দিন নিজেকে। কথা দিচ্ছি, সুবিচার পাবেন। রেণু আম্মা জবার দিন। রেণু আম্মা… আ…
…কে মণি—তুমি? এখানে!”
কুঁড়ের দরজায় এসে দাঁড়াল মণিমল্লিকা। হাত ওপরে তোলা। চোখদুটো চিকমিক করছে।
“হ্যাঁ মুথু, আমি। তোমার মণি, ওরফে রেণু আম্মা। কিন্তু, এত বন্দুক কেন? চিরটাকাল তোমার কাছেই তো ধরা দিতে চাইলাম আমি! আজ তুমি নিজে এলে আমার বাড়িতে, আর আমি তোমার কাছে ধরা না দিয়ে যুদ্ধ করব, একথা তুমি ভাবলে কী করে বল তো! চেয়ে দেখো মুথু, আমার হাতে কোনও অস্ত্র নেই। তোমার হাতেই আমি ধরা দেব আজ। এসো! আমার কাছে এসো… আমার বিক্রম…আমার…”
একদল সশস্ত্র শিকারীর চোখের সামনে, যেন কোন মায়ায় ঢাকা দুটি চোখ নিয়ে এগিয়ে গেল বিক্রম মুথুস্বামী। মণিমল্লিকা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে তার কাছে… হাতদুটো এখন সামনে বাড়ানো… সেই ছোটোবেলার মিটিমিটি হাসিটা নড়াচড়া করছে ওর ঠোঁটে… যেন এক্ষুণি কোনো নতুন দুষ্টমী করে বসবে তার মুত্থুকে নিয়ে।
তারপর… গাঢ় থেকে গাঢ়তর আলিঙ্গনে গলে মিশে গেল দুটি শরীর… সার্চলাইটের ঝলমলে আলোয় দুটো পিপাসার্ত ঠোঁট খুঁজে পেয়েছে অন্য দুটো ঠোঁটকে…
মণিমল্লিকার কোমরের ঠিক ওপরে মুথুস্বামীর দুটো হাত… বেপরোয়া আঙুলগুলো নড়াচড়া করে বেড়াচ্ছে ওর কোমরে বাঁধা বেল্টটার ওপরে…
…তারপর, ভুল করে সঠিক বোতামটিতে একটা অসতর্ক চাপ… বেল্টের নকল আচ্ছাদনের আড়ালে জেগে উঠল প্রাণঘাতী বিস্ফোরকের পাত! আগুনের লকলকে জিব গর্জন করে লাফিয়ে উঠল দুজনকে ঘিরে…
ছিন্নবিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মেদ, মজ্জা, রক্ত, মাংস ছিটিয়ে পড়ছে চতুর্দিকে…
…আর তারই মধ্যে জেগে উঠল নিরস্তিত্ব অন্ধকারের চল! তার অমিত সম্ভাবনাময় শূন্যতার গর্ভে নারী পুরুষ প্রেম অপ্রেম সবকিছু ধুয়েমুছে গিয়ে অবশেষে পড়ে রইল অলীক বাস্তবের এক নীল পটভূমি…
উপসংহার
প্রখর সূর্যের তাপে ধূ ধূ করে প্রাণহীন বায়ুহীন এক মৃত গ্রহের বন্ধ্যা বুক। তার মাটির নীচে এক সুবিশাল ভূগর্ভ গুহায়, ক্লান্তিহীন যন্ত্রদের অনিঃশেষ সেবায় বেঁচে থাকে দুটি আদি প্রাণ প্রোটোপ্লাজমের পিণ্ড। হয়তো বা তাদের কোনো অতীত ইতিহাস আছে। হয়তো বা অতিদূর অতীতের কোনো এক রৌদ্রোজ্বল সকালে তাদের পূর্বপুরুষেরাও মেতেছিল, প্রকৃতিকে অতিক্রম করে সুখ আর আনন্দকে খুঁজে নেবার খেলায়! কে জানে! মহাবিশ্বের প্রত্যন্ত প্রান্তে, এক হলদে তারার মৃত তৃতীয় গ্রহের কন্দরে শুয়ে তারা দুজন মিলে স্বপ্ন সৃষ্টি করে চলে… যন্ত্রের তৈরি মায়াবী জগতে বারংবার প্রক্ষিপ্ত হয় তাদের ইচ্ছেটুকু…
আর সেই অলীক বাস্তবের জগতে, নানা রূপে, নান রঙে, তারা বারে বারে জেগে ওঠে নতুন নতুন জীবনে। সৃষ্টি করে দেশ, কাল, সমাজ, সৃষ্টি করে কালের অলীক বাস্তব ইতিহাস।
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
আবার এক অসাধারণ আখ্যান । মায়াময় লেখনীতে ভালোবাসার টানে বারবার জীবন ছুঁয়ে যাওয়ার কাহিনি । মুগ্ধ।