ভার্গব বসুর হারানো মাথা
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আমার বন্ধু চাণক্য চাকলাদারের কিছু খ্যাতি আছে আজগুবি গল্প বলার জন্যে।
সেদিন সন্ধেবেলা হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে নতুন সায়েন্স-ফিকশন পেপারব্যাকটা তুলে নিয়ে বললে, ‘পানুদা, শুনেছ?’
তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘কী?’
‘মাকড়সার ঘাড়ে মানুষের মগজ।’
‘আবার গাঁজা খেয়েছিস?’
‘তোমাদের সঙ্গে ইংরেজদের তফাত তো এইখানেই। ইংল্যান্ডে জন্মালে রাতারাতি ওরা আমাকে এইচ জি ওয়েলসের মতো বিখ্যাত করে তুলত। আর তোমরা কিনা—’
বলে হু-উ-উ-স করে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে সোফার হাতলে বসে পড়ে শুরু করল, ‘ট্যুরে গিয়েছিলাম, শিলঙে নেমে ডাক্তার-বন্ধু বিরিঞ্চি সান্যালের সঙ্গে দেখা করতেই লাফিয়ে উঠে সে বললে, এই যে চাণক্য, তোর জন্যেই অপেক্ষা করছি।’
সন্দেহ হল। বললাম, ‘ডাক্তাররা তো আমার জন্যে অপেক্ষা করে না। করে আমার স্যাম্পলের।’
কথাটা গায়ে না মেখে বিরিঞ্চি বললে, ‘ভার্গব বসুর নাম শুনেছিস?’
‘কোন ভার্গব? সায়েন্টিস্ট?’
‘হ্যাঁ। সে একটা আশ্চর্য আবিষ্কার করেছে।’
‘খুবই আশ্চর্য কথা। দশ বছর আগে ইলেকট্রন নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট পাওয়ার পর থেকে তাঁকে রিসার্চ করতেই শুনেছি। একটা নতুন ধরনের ইঁদুর-মারা কলও তো আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেননি।’
‘এতদিনে পারেনি, কিন্তু এবার পেরেছে। এবং তা শুনলে তোর মতো গুলবাজ লোকেরও মুন্ডু ঘুরে যাবে।’
এসব রিমার্ককে আমি আমল দিই না কোনওদিন। তাই শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপারটা কী?’
‘ভার্গব এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যা দিয়ে জলজ্যান্ত মানুষকে অদৃশ্য করে ফেলতে পারে।’
‘আচ্ছা!’
‘শুধু তা-ই নয়। মানুষটাকে অদৃশ্য করার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় তৎক্ষণাৎ তাকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘দেখ বিরিঞ্চি—’
‘কথায় কী বা কাজ। চল দেখে আসি। একা যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। তুই আসায়—’
ভার্গব বসু ল্যাবরেটরিতেই ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিতে আমার উদ্দেশ্যটা বলল বিরিঞ্চি।
বিরক্ত না হয়ে খুশি হলেন ভার্গব বসু। হাতের গিনিপিগটা খাঁচায় রেখে বললেন, ‘আসুন।’
বড় বড় কয়েকটা হলঘরে দামি দামি যন্ত্রপাতি ঠাসা। সেসব তারের গোলকধাঁধার ব্যাখ্যা না শুনিয়ে ড. বসু আমাদের নিয়ে গেলেন একেবারে কোণের একটা হলঘরে।
ঘরটা বলতে গেলে একদম ফাঁকা। কিন্তু যেন একটা বিচ্ছিন্ন জগৎ। পুরু কাঠের দরজা। জানলাগুলো বন্ধ। শুধু সিলিং-এর কাছে কয়েকটা ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছিল।
সুইচ টিপতে ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্পের আলোয় ঝলমল করে উঠল ঘরটা। দেখলাম, দুই বিপরীত কোণে বসানো দুটো ছ-ফুট উঁচু আগাগোড়া কাচের মতো পদার্থের তৈরি স্বচ্ছ আলমারি ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই। মধ্যে প্রায় বিশ ফুটের ব্যবধান।
বললেন, ‘এই আমার মডেল-মেশিন। আরও বড় সাইজের একটা করার ইচ্ছে আছে। তা দিয়ে শুধু মানুষ কেন, যে-কোনও জিনিস, তা সে যতই বড় আর ভারী হোক-না কেন, অদৃশ্য করে দিয়ে নিমেষের মধ্যে পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারব আমি। আমার এ আবিষ্কার সমস্ত পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে দেবে—বিজ্ঞানের চরম উন্নতি ঘটাবে। মি. চাকলাদার, প্রথমে শুরু করি আপনার ব্যাগ দিয়ে।’
বলে, আমার হাত থেকে কোম্পানির ছাপ-মারা ব্যাগখানা নিয়ে রাখলেন এদিককার আলমারির মধ্যে। তারপর বেশ করে পাল্লাটা এঁটে দিয়ে পেছিয়ে এলেন। দেওয়ালের গায়ে কয়েকটা সুইচের ওপর হাত রেখে বললেন, ‘দুটো আলমারির ওপরেই ভালো করে নজর রাখুন।’
খটাখট করে কয়েকটা সুইচ টেপার শব্দ হল।
আধ মিনিটটাক কোনও পরিবর্তন দেখলাম। তারপর ধীরে ধীরে কুয়াশার মতো অস্পষ্ট হয়ে এল ব্যাগটা।
চকিতে ওদিককার আলমারিতে তাকিয়ে দেখলাম, ফাঁকা আলমারির মেঝেতে খানিকটা কুয়াশা জমে উঠেছে।
পরমুহূর্তেই দেখলাম আমার ব্যাগখানাকে!
এদিককার আলমারিতে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আলমারি বিলকুল ফাঁকা। বিশ ফুট ব্যবধানের মধ্যে দিয়ে ব্যাগখানা অদৃশ্য হয়ে চলে গিয়েছে ওদিককার আলমারিতে।
চোখ রগড়াব কি না ভাবছিলাম, ভার্গব বসু হেসে বললেন, ‘এ তো গেল জড়বস্তুর উধাও হওয়া। এবার দেখুন জ্যান্ত প্রাণীর খেলা।’ বলে, পাশের ঘর থেকে একটা বেড়ালকে এনে ঢুকিয়ে দিলেন এদিককার আলমারিতে। ওদিক থেকে ব্যাগখানা সরিয়ে আনলাম আমি। ঘটাঘট সুইচ টিপলেন ড. বসু। বেড়ালটা সমানে মিউ মিউ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। আধ মিনিটের মধ্যে গলে গলে সে কুয়াশার মতো অস্পষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু মিউ মিউ চিৎকার থামল না। দেখতে দেখতে ওদিককার ফাঁকা আলমারিতে আবির্ভূত হল খানিকটা কুয়াশা। ক্রমে তা জমাট বেঁধে রূপ নিল একটা বেড়ালের।
এদিককার আলমারির কুয়াশাও দেখলাম মিলিয়ে গিয়েছে—বেড়ালও হয়েছে অদৃশ্য!
এরপর যখন ভার্গব বসু ডা. বিরিঞ্চি সান্যালকেই অদৃশ্য করে এ আলমারি থেকে ও আলমারিতে নিয়ে গেলেন, তখন আমার লোম-টোম এমন খাড়া হয়ে উঠল যে আর ল্যাবরেটরির মধ্যে থাকতে পারলাম না।
ক-দিন পর বিরিঞ্চি ওখানে যেতেই বড় বড় চোখ করে ফিশফিশ করে ও বললে, ‘চাণক্য, শুনেছিস?’
‘ভার্গব বসু আত্মহত্যা করেছে।’
‘অ্যাঁ!’
‘হ্যাঁ। দু-দিন ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ ছিল। ওর স্ত্রী-ও ঢুকতে পারেননি। তৃতীয় দিন সকালে দরজা খোলা দেখে উনি ঢোকেন। ঢুকে দেখেন যে হাইড্রলিক প্রেশারের নীচে ভার্গব বসুর মাথাটা একেবারে পিষে গিয়েছে—চেনা যায় না। দেহটা বাইরে ঝুলছিল, তাই দেখেই শনাক্ত করা হয় ওকে। যে ইলেকট্রনিক থিয়োরির ভিত্তিতে সে যে-কোনও বস্তুকে অণু-পরমাণুতে বিশ্লিষ্ট করে রেডিয়ো ওয়েভের মতো ইথারের মধ্যে দিয়ে যেখানে খুশি নিয়ে যেত—সে সম্পর্কে যাবতীয় কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে উড়ছে ঘরময়। আর-একটা ছোট্ট চিঠি ছিল। খুবই ভয়ানক সে চিঠি।’
‘কী?’
‘অটোমেটিক একটা যন্ত্রের সাহায্যে নিজের ওপর প্রায় এক্সপেরিমেন্ট করেছে ভার্গব। আমরা চলে আসার পর—সে রাতে এ আলমারি থেকে ও আলমারিতে নিজেকে আনার পরেই বুঝল, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে তার।’
‘কীরকম?’
‘প্রথম আলমারিতে আগে থেকেই একটা মাকড়সা ঢুকে বসেছিল। নিজেকে ডিজল্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে মাকড়সাটাও অণু-পরমাণুতে ভেঙে অদৃশ্য হয়ে যায়। দ্বিতীয় আলমারিতেও দুজনের দেহে অণু-পরমাণু একসঙ্গে মিশে রইল। কিন্তু নিজের নিজের রূপ ধারণ করার সময়ে হল বিপদ।’
‘কী বিপদ?’
‘মাকড়সার মাথাটা চলে এল ভার্গব বসুর মাথায়—আর ভার্গবের মাথাটা চলে গেল মাকড়সার মাথায়।’
থ হয়ে গেলাম আমি।
বিরিঞ্চি বলে গেল, ‘প্রথমে মাথায় দারুণ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারেনি ভার্গব। মিনিটকয়েক পরে যখন বুঝল, তখন মাকড়সার অক্ষিপুঞ্জ দিয়ে দেখেও খুঁজে পেল না মাকড়সাকে। দু-দিন অকথ্য দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করেছে। অনাহারে থেকেছে—মাকড়সাকে কিন্তু আর দেখতে পায়নি। তৃতীয় দিনে তাই আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না।’ একটু চুপ করে থেকে সায়েন্স-ফিকশন পেপারব্যাকটা নির্বিকারভাবে নিজের ব্যাগে রেখে বললে চাণক্য, ‘ভাবছ, গুল মারলাম। কিন্তু এই দ্যাখো!’ বলে, মেঘালয় পত্রিকার একটা কাটিং আমার হাতে তুলে দিল। কাটিং-এ রয়েছে এই খবরটা।
একটি মাকড়সার মাথায় মানুষের মুখ (শিলং অফিস)
৫ আগস্ট ক্ষুদ্র একটি মাকড়সা গত দুই দিন যাবৎ শিলং শহরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছে। মাকড়সাটিকে দেখিতে অদ্ভুত ধরনের। ইহার রং সবুজ। মাথায় গোলাপি রঙের মুখ আঁকা। এই মাকড়সার চিত্র ৫০ নয়া পয়সা করিয়া বিক্রয় হইতেছে।
প্রকাশ, এক ভদ্রলোক এই অদ্ভুতদর্শন মাকড়সাটিকে তাঁহার হাতে উঠিতে দেখেন। প্রথমে তিনি উহাকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া দেন, কিন্তু পুনরায় উহা উঠিতে আরম্ভ করে এবং সেই সময়ে তিনি উহার অদ্ভুত আকৃতি লক্ষ করেন।
* একটি বিদেশি সিনেমা অনুসরণে
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা