নেক্সা
লেখক: সৌরভ দত্ত
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১
নবমীর দিন সকালে দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর একটা শান্ত গলির একেবারে শেষে অম্বিকা প্রাইড অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল গৌতম হেগরে। এই বাড়ির তিনতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকেন এক সময়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর অভিজ্ঞান সেন। কলিং বেল টিপে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। দরজা খুললেন এক ভদ্রমহিলা। গৌতম নমস্কার করে ইংরিজিতে বলল, আমি গৌতম, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করি। ডক্টর সেনের সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে?
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, তারপরে সরে গিয়ে গৌতমকে ভেতরে আসতে দিলেন। ফ্ল্যাটের ভেতরটা অন্ধকার, তার ওপর একটা কম পাওয়ারের আলো জালিয়ে রাখাতে অন্ধকার আরও বেড়ে গেছে। ভদ্রমহিলা এবার ইংরিজিতে বললেন, উনি এখন কারোর সঙ্গেই বিশেষ দেখা করেন না। অ্যাকসিডেন্টের পরে মাথাটাও সবসময় ঠিক থাকে না। আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসুন, আমি ওঁকে ডেকে দিচ্ছি।
গৌতমের মনে হল এই ভদ্রমহিলাকে আগে কোথাও সে দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারল না। ফাইলে এঁর কথা সে পড়েনি, ওখানে লেখা ছিল অভিজ্ঞান একাই থাকেন এই বাড়িটায়। অবশ্য ফাইলে সব কথা লেখা থাকলে ওকে এতদূরে আসতে হত না। গৌতম ঘরের দিকে এগোতে গিয়ে খেয়াল করল ভদ্রমহিলা ততক্ষণে অন্য একটা ঘরে ঢুকে কারোর সঙ্গে মৃদু গলায় কথা বলছেন।
তিন কামরার ফ্ল্যাট, তার মধ্যে সবচেয়ে ছোটো ঘরটিকে বসার ঘর বানানো হয়েছে। খুব বেশি কেউ আসে না বলেই বোধহয় সবকিছুর মধ্যে একটা অগোছালো ব্যাপার। অভিজ্ঞান সেন কাশতে কাশতে পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন। গৌতম দাঁড়িয়ে ছিল দেখে ওকে বসতে বলে, নিজে একটা সোফায় ধপ করে বসলেন। গৌতম তাকিয়ে ছিল ডক্টর সেনের দিকে, ভদ্রলোকের চেহারা ছবির থেকে খানিকটা আলাদা। বিশেষ করে মাথার চুল একেবারে সাদা। আর শরীরে অনেকটা ভারিক্কি এসেছে। মুখের ডান দিকে কপাল থেকে একটা পুরোনো কাটার দাগ গলা অবধি নেমে এসেছে, দশ বছর আগের অ্যাকসিডেন্টের ফল। অভিজ্ঞান আবার কাশলেন, তারপরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলেন গৌতমের দিকে।
গৌতম ওর পরিচয়পত্রটা বের করে ডক্টর সেনকে দেখাল, হ্যালো ডক্টর সেন, আমি গৌতম হেগরে, গোয়েন্দা বিভাগ।
অভিজ্ঞান পরিচয়পত্রর দিকে না তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, কী ব্যাপার?
—একটা তদন্তর ব্যাপারে আপনার একটু সাহায্যের প্রয়োজন পড়েছে। আমাদের ধারণা এটা আপনার ল্যাবের অ্যাকসিডেন্টের সঙ্গে জড়িত।
অভিজ্ঞান সোজা হয়ে বসলেন, কী, কী ব্যাপার বলুন তো?
—এই মুহূর্তে খুব বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়, সরি ডক্টর সেন। তবে আপনি যদি আমাকে একটু বলেন দশ বছর আগে ঠিক কী হয়েছিল, তাহলে আমাদের খুব সাহায্য হয়।
—কিন্তু আমার মেমারিটা—
—আমি জানি ডক্টর সেন। তার চেয়ে বরং আমি আপনাকে প্রশ্ন করি, আপনি যা মনে করতে পারেন বলুন।
—ও, আচ্ছা, ঠিক আছে। বলুন কী জানার আছে।
অভিজ্ঞানের যে অস্বস্তি হতে শুরু করেছে সেটা গৌতমের চোখ এড়াল না, কিন্তু ওর কাজ ওকে করতেই হবে। তার জন্য কখন নরম আর কখন শক্ত হতে হয়, সেটা গৌতম ভালো করেই জানে।
—শুরু থেকেই বলুন, আপনি অ্যাকসিডেন্টের আগে কী করতেন মনে আছে?
—আগে? হ্যাঁ তা আছে। আমি তখন ম্যাসাচুসেটসএ পড়াতাম—
—এম আই টি। এটা সেই ঘটনার আরও বেশ কিছু বছর আগে, তাই নয় কি?
—হ্যাঁ। তখনও প্লেনগুলো ধাক্কা মারেনি।
—৯/১১?
—হ্যাঁ।
—বেশ, আপনি কী পড়াতেন?
—পড়াতাম বললে একটু ভুল হবে, আমি আসলে মূলত গবেষণা করতাম আর বছরে একটা করে কোর্স করাতাম। আমার বিষয় ছিল এ আই – মানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
—আপনি তো বিখ্যাত ছিলেন তাই না?
—বিখ্যাত কিনা জানি না—তবে আমার পর পর দশটা পেপার নিয়ে যে যথেষ্ট আলোচনা চলেছিল সেটা মনে আছে।
গৌতম খেয়াল করল অভিজ্ঞান এখন একটু সহজ হয়েছেন।
—সংক্ষেপে বোঝাতে পারবেন ডক্টর সেন, আপনার গবেষণার বিষয়?
—সংক্ষেপে? আমার সারা জীবনের কাজ। অভিজ্ঞান হাসলেন এবার। আজকের দিনে যেসব এ আই দেখেন তার সবটাই প্রায় নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়ে বানানো সেটা নিশ্চয়ই জানেন? আমাদের মস্তিষ্কের কোশের মতো হাজার হাজার কম্পিউটার ডাটা, একের পর এক লেয়ার—অসংখ্য গণনা চোখের নিমেষে। যত বড়ো কম্পিউটার তত শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। কিন্তু তাও মানুষের মতো বুদ্ধি, মানুষের মতো অন্তর্দৃষ্টি—নেই! আমার গবেষণায় আমি দেখেছিলাম—মানুষের মতো বুদ্ধি কম্পিউটারকে দিতে গেলে আমাদের ভাবতে হবে অন্য দিক দিয়ে। আমাদের মনুষ্যত্ব তৈরি হয় বছরের পর বছর ধরে। আমি দেখিয়েছিলাম যে খুব ছোটো একটা নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে মানুষের মতো অনুভূতি আর বুদ্ধি পাওয়া সম্ভব। অনেকে বিশ্বাস করেনি।
—কিন্তু ভিপুল শর্মা করেছিলেন?
—কে? কার কথা বললেন? অভিজ্ঞান এক স্বপ্নের জগৎ থেকে যেন হোঁচট খেয়ে এসে পড়লেন আবার বাস্তবে।
—ভিপুল শর্মা। আপনার পার্টনার।
—ওঃ মনে পড়েছে। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অভিজ্ঞান বললেন, কিন্তু ভিপুলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় পরে, ওই ওই বীভৎস ঘটনার পরে।
—কেমন করে একটু বলবেন দয়া করে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন অভিজ্ঞান সেন। গৌতম খেয়াল করল দরজার বাইরে পর্দার নীচে একজোড়া পা কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রমহিলা আড়ি পেতেছেন বোঝা গেল। হয়তো তিনি চান না এইসব কথা নতুন করে তুলতে, বা নেহাতি কৌতূহল। কিন্তু গৌতমের অন্য কোনো উপায় নেই, তাকে জানতেই হবে, আর এখনই। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে গৌতম ডাকল, ডক্টর সেন, ভিপুল শর্মাকে চিনলেন কেমন করে?
অভিজ্ঞান চোখ বুজে বললেন, ৯/১১ এর পরে আমি—মানে আমার মেয়েকে আমি হারাই ওই দিন। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। ও সেইদিনই নিউ ইয়র্ক গিয়েছিল একটা চাকরির জন্য, সেই ইন্টারভিউ যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ছিল, আমি জানতাম না। এর পরে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি একেবারে। আমার আর কেউ ছিল না তখন, মেয়ে নন্দিনী আর রিসার্চ—এই নিয়েই থাকতাম। মেয়ে হারিয়ে গেল, গবেষণাটাও যেত, কিন্তু বন্ধুরা জোর করে একটা গ্রুপ থেরাপিতে পাঠাল। সেটা আমাকে খুব সাহায্য করল। ওখানেই পরিচয় ভিপুল শর্মার সঙ্গে। তার ছেলেকে সে হারিয়েছিল ওইদিন।
গৌতম মনে মনে খানিক নিশ্চিন্ত হল—যাক অভিজ্ঞানের স্মৃতি যতটা খারাপ হবে ভেবেছিল, ততটা আদৌ নয়। এখন পর্যন্ত যা বলেছেন সব মিলে যাচ্ছে। নন্দিনীর একটা ছবি ফাইলে ছিল, কলেজ পেরনোর পরেই সে মারা যায় ওই ৯/১১ ভয়ংকর হামলায়।
—তারপর?
—ভিপুল আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। সে ব্যাবসা করত, আমার কাজ নিয়ে খুব একটা তাকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করতে শুনিনি। কিন্তু একদিন সকালে হঠাৎ ফোন করে বলল আমার সঙ্গে জরুরি কথা বলতে চায়। বাড়ি আসতে বললাম। সেদিনই সন্ধেবেলায় পঞ্চাশ মাইল গাড়ি চালিয়ে সে চলে এল আমার বাড়ি। যা বলল তাতে এই দাঁড়ায়, সে দেশে ফিরে একটা কোম্পানি খুলতে চায়। সেই কোম্পানির একটা অংশ হবে গবেষণা। আমাকে সেই কাজের ভার নিতে হবে।
—আপনি রাজি হলেন?
—প্রথমটায় হইনি। পরে ভাবলাম ওদেশে থেকে আমি আমার মেয়েকে ভুলতে পারব না কোনোদিন, তার চেয়ে একটা নতুন কিছু শুরু করলে মন্দ হয় না।
—গবেষণা কী নিয়ে সেটা বলেছিলেন ভিপুল শর্মা?
—না। বলেছিল আমি এ আই নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারি।
—তারপরে?
অভিজ্ঞান চোখ বুজেই থাকলেন। তারপরে মৃদু গলায় বলতে শুরু করলেন, তারপরে দেশে ফিরলাম। ব্যাঙ্গালোরে ল্যাব হল। ভিপুল ওর কোম্পানি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি শুরু করলাম আমার কাজ—এতদিন যা ছিল গণিতের কিছু সমীকরণ আর সিমুলেসন, সেগুলো কম্পিউটার কোডে পরিণত হতে শুরু করল। তিন বছর লেগেছিল আমার থিয়োরির সত্যতা যাচাই করতে। আমার এ আই এর নাম দিলাম নেক্সা।
গৌতম তাকাল ওর ফোনের দিকে। পিডিএফ ফাইলে এর পরের ঘটনাগুলো খুব সংক্ষেপে লেখা। এইবারেই ওর আসল কাজ শুরু হবে।
—ডক্টর সেন, আপনার গবেষণাটা কি শুধুই কম্পিউটার কোডে সীমিত ছিল, নাকি আরও অন্য কিছুও বানাবার চেষ্টা করছিলেন? মানে ধরুন একটা রোবট?
—না তো।
—আপনি নিশ্চিত?
—হ্যাঁ।
অভিজ্ঞানের গলায় দ্বিধা আর সাবধানতা গৌতমের বুঝতে অসুবিধা হল না।
—আপনাকে মনে করিয়ে দি তাহলে। আপনি সেই সময় এক নতুন ধরনের কম্পিউটার ডাটা স্টোরেজ বানিয়েছিলেন, যেটার নাম—
—ডাটা কিউব! হ্যাঁ মনে পড়েছে। নেক্সার কোড ওই ডাটা কিউবের মধ্যে রাখা হত। আমরা চাইনি ও জিনিস ল্যাবের বাইরে বেরুক।
—ঠিক। আর কিছু?
অভিজ্ঞান মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বললেন, না।
গৌতম এবার একটু হেসে বলল, আই সি, তাহলে আপনার নেক্সা বিশেষ কিছু করতে পারত না। মানে আজকাল যেমন এ আই আমাদের গাড়ি চালাচ্ছে, আবহাওয়া কেমন হবে বলে দিচ্ছে, এমনকি জটিল অস্ত্রোপচার করতেও আজকাল ডক্টররা শুধু এ আই ব্যবহার করছেন—আপনার নেক্সা এদের মতো কিছু করত না।
অভিজ্ঞানের চোখগুলো যেন জ্বলে উঠল।
—কী বললেন? আপনি নেক্সার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন? আপনি জানেন নেক্সার মতো এ আই এখনও কেউ বানাতে পারেনি! আমি শুরু করেছিলাম একটা ছোট্ট নেটওয়ার্ক দিয়ে—এইটুকু—ওটা শুধু বলতে পারত একটা ছবিতে কী কী আকৃতি দেখা যায়। ভার্সন জিরো জিরো ওয়ান! তারপরে আমার নিজের বানানো জেনেটিক অ্যালগোরিদম দিয়ে একের পর এক নতুন ক্ষমতা পেতে শুরু করে সেই নেটওয়ার্ক। ভার্সন ওয়ান পর্যন্তও যেতে হয়নি, তার আগেই সে বলে দিতে পারত পরের দু-মাসে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কতখানি। দু-বছরের মাথায়, ক্রমাগত একের পর এক ভার্সন পেরিয়ে নেক্সা জটিল গণিত নিজে নিজে শিখতে শুরু করল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা—ভাবতে পারছেন—রিলেটিভিটির জটিল গাণিতিক সমীকরণগুলো নেক্সা নিজে আবিষ্কার করল! তারপর তারপর—
—বলুন, তারপরে কী?
—একটা কোয়ান্টাম লিপ! আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ লাখ বছর আগে আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষরা যেরকম দু-পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিল, নেক্সা আমার হাত ধরে হাঁটল মাত্র তিন বছরের মাথায়! তার তখন সুবিশাল জ্ঞান, যে-কোনো মানুষের থেকে অনেক অনেক বেশি—অথচ একটা ছোট্ট শিশুর মতো কৌতূহল।
—নেক্সা কেমন করে হাঁটতে পারল ডক্টর সেন, আপনি কি ওর জন্য কোনো যান্ত্রিক শরীর বানিয়েছিলেন?
—অ্যাঁ?
—নেক্সার শরীর কি আপনি বানিয়েছিলেন?
—না না—
—বলুন ডক্টর সেন। নেক্সা শরীর কীভাবে পেল?
—আঃ কিছু মনে পড়ছে না!
অভিজ্ঞান দু-হাতে কপালের রগ চেপে ধরে বসে রইলেন। গৌতম একটা নিশ্বাস ফেলল। আর একটু জানতে পারলেই একটা রহস্যের কিনারা হত। খানিকটা সময় দিয়ে সে পুনরায় প্রশ্ন করা শুরু করল।
—তাহলে এবার ওই দুর্ঘটনার দিনে আসি। ভিপুল শর্মা কীভাবে মারা গেলেন আপনার মনে আছে?
অভিজ্ঞান একটা বোতল থেকে কাঁপা হাতে জল খেলেন। মুখ মুছে একটু স্বাভাবিক স্বরে বললেন, ওইখান থেকেই তো আমার মেমারিটা আর ঠিক কাজ করে না মিস্টার গৌতম।
—তা হোক, যা মনে পড়ে বলুন।
—দেখুন, ভিপুল কখনই আমার ল্যাবে খুব বেশি সময় কাটায়নি। মাঝে মাঝে আসত, একটা-দুটো কথা বলে চলে যেত। আবার আসত হয়তো মাস দুয়েক পরে।
—আচ্ছা ডক্টর সেন, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন ভিপুল শর্মার কোম্পানি ঠিক কী করত? আমাদের কাছে এটা একটা ধাঁধা এখনও।
—আমি সঠিক জানতাম না।
—এটা কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।
—আমি সত্যি বলছি।
—কীভাবে বিশ্বাস করব বলুন! আপনার গবেষণার সমস্ত খরচ আসছিল ভিপুলের কোম্পানি থেকে, অথচ সেই কোম্পানি কী করে, কী বানায় সেসব খবর আপনি রাখেননি!
—আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু ও আমাকে পরিষ্কার করে কিছুই বলত না।
—কিন্তু আপনার সন্দেহ হয়নি?
—না সন্দেহ হয়নি, মানে একটু অবাক লাগত ঠিকই…
—তাও আপনি ডিটেলস জানার কোনো চেষ্টা করেননি!
—না করিনি।
—সেটা কি আপনার গবেষণা থামানোর ভয়ে? তাই জন্যেই কি সত্যিটা জানতে চাননি আপনি?
—আপনি বিশ্বাস করুন আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার ছিল না। আমি এক নতুন ধরনের জীবনের জন্ম দিচ্ছিলাম ওখানে—আমাদের থেকে অনেক বেশি সক্ষম, বুদ্ধিমান—আরও বেশি মানুষ।
—আর যদি বলি সেটাই ছিল আসলে আপনাদের প্রোডাক্ট!
—মানে? কী বলছেন আপনি?
—মানে এটাই যে এই শক্তিশালী, অনেক বেশি বুদ্ধিমান কৃত্রিম মানুষই আসলে বেচতে চেয়েছিলেন আপনা পার্টনার ভিপুল শর্মা।
—কিন্তু কিন্তু—
—আমরা এই কোম্পানির যত দলিল খুঁজে পেয়েছি তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে বেশ কিছু গোপন সংস্থার সঙ্গে, যাদের বেশির ভাগটাই বিদেশি, ভিপুলের কিছু চুক্তি হয়েছিল। এই সংস্থাগুলির আইনত কোনো অস্তিত্ব নেই—এদেরকে সাধারণ ভাষায় বলে মার্সেনারি—মানে যারা টাকার বিনিময়ে মিলিটারি অপারেশন করে থাকে। এবার দুইয়ে দুইয়ে চার করলে এই দাঁড়ায় যে—আপনি বানিয়েছিলেন সুপার এ আই রোবট আর এই রোবট ভিপুল বিক্রি করতেন নানা দেশে গোপন হামলা করার জন্য।
অভিজ্ঞান হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, প্লিজ মিস্টার গৌতম আপনি বিশ্বাস করুন, আপনি যা বললেন আমি তার কিছুই জানতাম না।
গৌতম এবার আরও ঝুঁকে এসে অভিজ্ঞানের চোখে চোখ রাখল। ঠিক এইভাবে ধাপে ধাপে ও অনেক স্বীকারোক্তি আদায় করেছে এর আগে—এই শেষ ধাপটা ঠিকঠাক করতে পারলেই—
—আমাদের কাছে খবর আছে, দুর্ঘটনার কয়েক মাস আগে থেকে আপনার আর ভিপুলের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল না। প্রকাশ্যে একবার দু-বার আপনাদের কথা কাটাকাটি করতেও নাকি দেখা গেছে।
—দেখুন ব্যবসায় এটা হয়, সবসময় কি ভালো সম্পর্ক থাকে! কিন্তু সেসব এই কারণে নয়, আমি সত্যি জানতাম না আপনি যা বলছেন—এইসব কিছুই আমি জানতাম না।
—ভিপুল আপনার ল্যাবে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, এটা ঠিক?
—হ্যাঁ—
—তাহলে দুর্ঘটনার দিন আপনি ভিপুল শর্মাকে ডাকলেন কেন আপনার ল্যাবে?
—আমি ডাকিনি।
—মিথ্যে কথা!
—আমি সত্যি—
—তাহলে ভিপুল কেন এসেছিলেন সেদিন?
—আমি মনে করতে পারছি না!
—চেষ্টা করুন!
—সত্যি পারছি না!
—দুর্ঘটনাটা কীভাবে ঘটল ডক্টর সেন?
—একটা শর্ট সার্কিট—না মানে একটা কম্পিউটার ইউনিট বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল—কিন্তু ওটাকে ঠান্ডা করার মেশিনটা কাজ করছিল না—ওখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে যায় গোটা বাড়িটায়।
—আর তাতে প্রাণ যায় ভিপুল শর্মার।
—ঠিক!
—কিন্তু আপনার কিছু হয়নি!
—আমি বোধহয় লাফিয়ে পড়ি জানলা ভেঙে—মাথায় খুব চোট লেগেছিল আর মেমারিটা—
—ভিপুল শর্মার দেহ পাওয়া গিয়েছিল?
—আমি শুনেছিলাম একটা পুড়ে যাওয়া দেহ পাওয়া যায় পরে।
—আর কারোর দেহ হতে পারে না সেটা?
—অসম্ভব! ওটা ছিল শনিবার—আর কেউ ছিল না ল্যাবে।
—তাই যদি হবে, তাহলে এক সপ্তাহ আগে একটা গোডাউনের ভেতর ঠিক একইভাবে পুড়ে যাওয়া আরেকটা ভিপুল শর্মার লাশ কীভাবে পাওয়া গেল ডক্টর সেন?
গৌতম যা ভেবেছিল তা হল না। অভিজ্ঞান খানিকক্ষণ শূন্য চোখে তাকিয়ে বললেন,
—কে? কার কথা বললেন?
—ভিপুল শর্মা। আপনার পার্টনার, যাকে মৃত ধরে নেওয়া হয়েছিল এতদিন।
—ভিপুল? কিন্তু ওর সঙ্গে তো আমার দেখা হয়েছিল ওই, ওই বীভৎস ঘটনার পরে! সেই ৯/১১ এর সময়।
গৌতম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। অভিজ্ঞানের স্মৃতি আবার ফিরে গেছে সেই পুরোনো ঘটনায়। দু-তিনটে প্রশ্ন করার পর আর সন্দেহ রইল না যে এতক্ষণের সব কথার স্মৃতি মুছে গেছে অভিজ্ঞানের মন থেকে। এমনও কি সম্ভব, নাকি পুরোটাই নিখুত অভিনয়!
গৌতম উঠে পড়ল। অভিজ্ঞান দরজা অবধি এলেন। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কী মনে করে গৌতম ঘুরে তাকাল। বলল, ও একটা কথা বলা হয়নি। যে গোডাউনে ভিপুল শর্মার দেহ পাওয়া যায় সেটা প্রায় পুরোটাই পুড়ে যায়, ঠিক আপনার ল্যাবের মতো। কিন্তু ভিপুলের বডি থেকে যে অল্প পরিমাণ জেনেটিক স্যাম্পল পাওয়া গেছে তাতে আমরা নিশ্চিত—এটা ভিপুল শর্মাই। আরেকটা কথা, একটা ডাটা কিউবও পাওয়া গেছে অক্ষত অবস্থায়, কিন্তু লুকানো ছিল। ওটাকে এখনও ওখান থেকে বের করা যায়নি, খুব সাবধানে না করলে নষ্ট হবার সম্ভাবনা রয়েছে। দিল্লি থেকে একটা টিম আসছে, কাল উদ্ধার করব। আপনি দেখতে চান?
অভিজ্ঞানের ভাবান্তর হল না, মাথা নেড়ে বললেন, না লোন-টোন চাই না, আমি রিটায়ার্ড। আপনি আসুন।
২
কাচের দরজায় টোকা মেরে গৌতম বলল, হেলো বস, ঢুকব?
টেবিলের পিছন থেকে শ্রীনিবাসের গলা ভেসে এল, এসো।
গৌতম চেয়ারে বসলে শ্রীনিবাস বললেন, কিছু পেলে?
—না স্যার। খুব ঘোড়েল মানুষ। নতুন কিছু পাওয়া গেল না।
—হুম। এদিকে ওপর থেকে আবার এই কেসটা নিয়ে তাড়া দিচ্ছে খুব। কী বুঝছ?
—এখনও পর্যন্ত আমাদের যা ধারণা ছিল সেটাই ঠিক লাগছে কিন্তু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনার সময়টা নিয়েই। এক, ভিপুল শর্মাকে ডেকে এনে আসলে অভিজ্ঞানই খুন করার চেষ্টা করে। কিন্তু ভিপুল কোনোভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এতদিন পরে তাকে বেঁচে থাকতে দেখে অভিজ্ঞান আবার পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এবারে সফল হন। দুই, গোড়া থেকেই এটা আসলে ভিপুল শর্মার কীর্তি। দশ বছর আগের ঘটনাটা তার নিজের ঘটানো। যেসব বিপদজনক লোকেদের সঙ্গে ওর ডিল হয়েছিল, হয়তো কেউ ওর পেছনে লেগেছিল। তাই সাজানো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে নিজেকে মৃত প্রমাণ করে সে অভিজ্ঞানের আবিষ্কার হস্তগত করে পালিয়েছিল। কিন্তু যাদের থেকে পালাচ্ছিল তারা শেষ পর্যন্ত ভিপুলকে ধরে ফেলে, ফলে তিনি প্রাণ হারান। কিন্তু এই দুটো ঘটনাতেই এত মিল—যেভাবে আগুনের ব্যবহার করে প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে, তাতে একজন কারোরই হাত আছে বলে মনে হয়। সেই জন্যেই বারবার সন্দেহটা পড়ছে অভিজ্ঞানের ওপর।
—প্রতিশোধের দিকটা ভেবেছ?
—হ্যাঁ ওটাও ভেবেছি স্যার। হয়তো প্রথম ঘটনাটা ভিপুলের ঘটানো। উদ্দেশ্য ছিল অভিজ্ঞানকে হত্যা করা। এখন ভিপুলের সন্ধান পেয়ে অভিজ্ঞান সেই একই পদ্ধতিতে তাকে হত্যা করেন।
—এটা কিন্তু খুব অসম্ভব নয় গৌতম।
—ঠিকই স্যার। কিন্তু অভিজ্ঞানের শারীরিক শক্তি বা মানসিক অবস্থা দেখে মনে হয় না তিনি এমন একটা খুন একা একা করতে পারবেন। অবশ্য পুরো ব্যাপারটাই অভিনয় হতে পারে, সেক্ষেত্রে ওঁর মতো তুখোড় অভিনেতা আর পাওয়া সম্ভব নয়। আর আমাদের জিপিএস ডাটাও তো বলছে যে ভদ্রলোক বাড়ি থেকে প্রায় কোনোদিনই বেরোননি।
—কারোর সাহায্য নিয়ে করতে পারেন কি?
—সেই দিকটাও ভেবেছি। উনি কাউকে খুব একটা ফোন করেন না। বাড়িতে একটা ইন্টারনেট আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা খুব একটা ব্যবহার করা হয়নি। আর ওঁর বাড়িতে কাউকে আসতে দেখা যায় না। অবশ্য—
—কী ব্যাপার।
—একটি মহিলাকে দেখলাম আজ, তাঁর কথা কোনো রিপোর্টে পাইনি।
—মহিলা? খোঁজ নিয়েছ?
—সিকিউরিটি কিছু বলতে পারল না। তবে ওই ফ্ল্যাটগুলোতে আজকাল সবসময়ের দেখাশোনার অনেক লোক থাকে—সেরকম কেউ হতে পারে।
—বেশ ওটা পরে দেখা যাবে। আপাতত আমাদের এখন অভিজ্ঞানের দিকটা খুঁটিয়ে দেখতে হবে—উনি যদি খুনটা কাউকে দিয়ে করিয়ে থাকেন, তাকে খুঁজে বের করতে হবে।
—ও কে স্যার।
– একবার সাইবারের আশোকের সঙ্গে কথা বলো, যদি কোনো নতুন তথ্য বেরোয়।
—আচ্ছা। স্যার আমি একটা সাহায্য চাই। একটা টোপ ফেলেছি—যদি কাজে দেয় তাহলে হাতেনাতে ধরা যাবে আততায়ীকে। কিন্তু আমার খান চারেক অফিসার লাগবে, আজ রাতে সশস্ত্র পাহারায় থাকতে হবে।
—বটে? ঠিক আছে আমি দেখছি কী করা যায়।
ফোনটা তুলে নিলেন শ্রীনিবাস। গৌতম ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিল সাইবার ক্রাইমের দিকে।
আশোক বসেছিল কম্পিউটার মনিটরে মুখ গুঁজে। গৌতমের ডাকে মুখ তুলে তাকিয়ে হাসল।
—গৌতম স্যার। জানি না এটা সাহায্য করবে নাকি, কিন্তু ভাবলাম আপনাকে জানিয়ে রাখি।
—কী পেলে?
—আপনাকে তো বলেছি যে আমি ভিপুলকে নিয়ে খুঁজে চলেছিলাম—লোকটা কীভাবে গায়েব হয়ে গেল, আবার এক সপ্তা আগে কোথা থেকে এল—এই সবই খুব অস্পষ্ট। আগে আমি দেশের ভেতরে খুঁজছিলাম, আজ থেকে আরও অন্যান্য দেশে খুঁজতে শুরু করেছি। একটা মোটামুটি আন্দাজ আসছে লোকটা কোথা থেকে এখানে এল। কিন্তু আপনি বলেছিলেন যে ওর সঙ্গে অভিজ্ঞানের কোনো যোগ আছে নাকি সেটাও দেখতে। প্রথম প্রথম কিছু পাইনি। কিন্তু এখন একটা জিনিস খেয়াল করলাম।
—কী?
আশোক কম্পিউটার মনিটরে একটা পৃথিবীর ম্যাপ খুলল, তাতে কয়েকটা জায়গায় ক্রস দেওয়া আছে, পাশে তারিখ।
—দেখুন—আমার ধারণা ভিপুল গায়েব হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন এই দেশেই ছিল। তারপরে ও কাতার হয়ে ইউরোপে কোথাও চলে যায়। এরপরে আট বছর তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। দু-বছর আগে লন্ডনে ভিপুলকে দেখা যায়—এটা একটা টুরিস্ট ফোটো থেকে পাওয়া, পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি নিঃসন্দেহে ভিপুল। তারপরে প্রায় এক বছর আগে কুয়ালা লুম্পুর। তারপরে আবার এখানে, দুই সপ্তাহ আগে।
—বেশ, কিন্তু এর সঙ্গে অভিজ্ঞানের কি যোগ?
—একেবারে যোগ বলব না, কিন্তু আমার কি মনে হতে আমি অভিজ্ঞানের ইন্টারনেট ইউসেজ দেখতে শুরু করি।
এবার আশোক আরেকটা ম্যাপ খুলল পাশাপাশি। এখানে শুধু একটাই ক্রস চিহ্ন—কিন্তু তার পাশে তিনটে তারিখ যেখানে ইন্টারনেট ডাটা ইউসেজ সবচেয়ে বেশি। অভিজ্ঞানের তিনটে তারিখের সঙ্গে ভিপুলের তিনটে তারিখ মিলে যাচ্ছে।
—মাই গড! গৌতম বলে ওঠে। তার মানে এরা কথা বলছিল একে অপরের সঙ্গে?
আশোক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, সেটা বলতে পারব না। কারণ এই ডাটা কীসের জন্য ব্যবহার হয়েছে তা জানার উপায় নেই।
গৌতম আশোকের কাঁধে একটা আলতো চাপ দিয়ে বলল, দারুণ কাজ করেছ! আমার সন্দেহ আরও পাকা হল। এবার শুধু ফাঁদে পা দিলেই হয়।
৩
রাত প্রায় দুটো। আগুনে পোড়া আর চারিদিক বন্ধ গোডাউনের মধ্যে অন্ধকারে বসে গৌতম ভাবছিল আদৌ যদি টোপটায় কাজ না করে, তাহলে কী করবে। আন্দাজে একবার ও বোঝার চেষ্টা করল বাকি চারজন কোথায় আছে। ওর ঠিক মাথার ওপর একজন অফিসার, সামনে দরজার কাছে দুজন আর একেবারে পেছনে আরেকজন। এছাড়া বাইরে খানিকদূরে জঙ্গলের মধ্যে গাড়িতে আরও দুইজন গোপনে নজর রাখছে এই জায়গাটার ওপর। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর ও ঘড়ি দেখল, মাত্র দশ মিনিট কেটেছে। গৌতম সবে ভাবতে শুরু করেছে যে তার আন্দাজে ছোড়া ঢিল আসলে লাগেনি, এমন সময় কানে লাগানো রিসিভারটায় ক্ষীণ সঙ্কেত এল। এর মানে গোডাউনের বাইরে কাউকে দেখা গেছে। কানের কাছে দু-বার ট্যাপ করে সিগনাল পাঠিয়ে সে বাকিদের সতর্ক করল। এক মুহূর্তে তার সারা শরীর উত্তেজনায় টানটান হয়ে উঠেছে।
খানিকক্ষণ কিছুই হল না। তারপর গোডাউনের পশ্চিম দিকের একটা জানালার কাচ হালকা শব্দে কেউ ভেঙে দিল। সেখান দিয়ে হাত বাড়িয়ে এবার জানলাটা খুলে দেওয়া হল। জানলা দিয়ে রাতের নীল আলো এসে পড়ল গৌতমের উলটো দিকের দেওয়ালে। ক্ষিপ্র গতিতে একজন কেউ লাফ দিয়ে ঢুকল ভেতরে। একটা পেন্সিল টর্চের আলো এসে পড়ল মেঝের ওপর। তাহলে আততায়ী এসেছে ডাটা কিউবের সন্ধানে। যে ডাটা কিউবের কথা শুধু অভিজ্ঞানের জানার কথা, কারণ আদপে কোনো কিউব খুঁজে পাওয়া যায়নি!
ভুলটা করল গৌতমের ঠিক ওপরে যে দাঁড়িয়ে ছিল। সামান্য একটু শব্দ পেতেই পেন্সিল টর্চের আলো নিভে গেল। দাঁতের ফাঁকে একটা অস্ফুট শব্দ করে গৌতম দৌড়ে গেল জানলাটার দিকে, যাতে ওখান দিয়ে আততায়ী পালাতে না পারে। কখন হাতের মুঠোয় বন্দুকটা চলে এসেছে সে নিজেও খেয়াল করেনি। কিন্তু আততায়ী জানলার দিকে গেল না। গৌতম জানলার সামনে গুঁড়ি মেরে বসে শুনল, সামনের দুজন অফিসার একের পর এক কাটা কলাগাছের মতন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ওপরে যে ছিল সে ততক্ষণে লাফিয়ে নেমে এসেছে কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে কিছু বোঝার আগেই মাথায় একটা আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। একই দশা হল চার নাম্বার অফিসারটিরও। গৌতম বন্দুকটা সামনের দিকে ধরে বোঝার চেষ্টা করল আততায়ী এখন কোথায়। এমনটা হবে সে একেবারেই ভাবেনি, কিন্তু এত কাণ্ড হবার পরেও সে আততায়ীর চলাফেরার একটা শব্দ মাত্র পাচ্ছে না। ঘাড়ের খুব কাছে নিশ্বাসের শব্দ পেয়ে বন্দুকটা ওঠাতে গেল গৌতম, কিন্তু তার আগেই সেটা খসে গেল তার হাত থেকে। বুকের ওপর একটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে সে টিপে ধরল পকেটে রাখা একটা রিমোটের একটা বিশেষ বোতাম। গোটা গোডাউনটা তীব্র আলোয় ভরে গেল। গৌতমের সামনে যে দাঁড়িয়েছিল সে অভিজ্ঞান নয়, কিন্তু অভিজ্ঞানের বাড়িতেই আজ সকালে তাকে দেখেছে সে।
ভদ্রমহিলা সকালে পরেছিলেন সালওয়ার কামিজ, কিন্তু এখন একটা কালো হুডি আর কালো জিনস। ওর চোখের মধ্যেও একটা তীব্রতা যোগ হয়েছে যেটা সকালে একেবারেই ছিল না। গৌতম ওঠার চেষ্টা করতেই উনি একটা হাত রাখলেন ওর কাঁধের ওপর। গৌতমের ওঠার সামর্থ্য হল না সেই কঠিন শক্ত হাত ছাড়িয়ে। ভদ্রমহিলা এবার উবু হয়ে বসলেন পাশে। নীচু গলায় বললেন, আর বোকামি করার চেষ্টা করলে হাতটা ভেঙে দেব। এবার আপনার পকেট থেকে রিমোটটা বের করুন। যদি কোনো বোতামে হাত পড়ে তাহলে এর পর আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াবার মতো জায়গায় থাকবেন না।
গৌতম চুপচাপ পকেট থেকে রিমোটটা বের করে দিল। মহিলা সেটা দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে আনায়াসে ভেঙে দিলেন। তারপরে গৌতমের দিকে ফিরে বললেন, আপনার গাড়ি কোথায়? ওখানে যারা আছে, তারা সিগনাল না পেলে এদিকে আসবে কি?
গৌতম ঘাড় নেড়ে না বলল।
—এলেও অসুবিধা নেই, তার আগেই আমি বেরিয়ে যাব।
—আপনি কে?
—এখনও চিনতে পারছেন না? আমার ধারণা ছিল আপনি এতক্ষণে বুঝে ফেলবেন।
বিদ্যুৎ চমকের মতো গৌতমের মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে সে বুঝতে পারল কেন এঁকে চেনা লাগছিল। এঁর ছবি ও দেখেছে অভিজ্ঞানের ফাইলে। যদিও সে ছবিতে এঁর বয়সটা অনেক কম।
—নন্দিনী?
—প্রায় ঠিকই বলেছেন। অন্তত আশি শতাংশ।
—নেক্সা!
—ঠিক, একদম ঠিক।
—তাহলে নন্দিনী আসলে নেক্সা?
—না, উলটোটা—নেক্সা আসলে অনেকটাই নন্দিনী।
—কিন্তু তা কী করে সম্ভব!
—অভিজ্ঞান সেন যখন নতুন করে গবেষণা শুরু করেন, তখন শুধু সবচেয়ে শক্তিশালী এ আই বানাবার চেষ্টাই করেননি, তিনি চাইছিলেন নন্দিনীকে ফিরে পেতে। তাই নন্দিনীর যাবতীয় ডায়েরি, চিঠি, লেখা, ভিডিয়ো, রেকর্ডিং—যা কিছু তিনি পেয়েছিলেন তাই দিয়ে বানিয়েছিলেন এক বিশাল আকারের ট্রেনিং ডাটা। নেক্সা যখন পরিণত হতে শুরু করে তখন তিনি তাকে ট্রেইন করতে থাকেন নন্দিনীর ডাটা দিয়ে। ফলে আমার জন্ম হয়।
—ভিপুল কে মারলেন কেন?
—ভিপুল শর্মা আমার বাবার ক্ষতি করতে চেয়েছিল।
—কিন্তু—
—ওর উদ্দেশ্য ছিল আমার মতো হাজার হাজার নেক্সা বানাবে, আমার মতোই অতি মানবীয় রোবট। তারপরে বেচে দেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারা সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তাদের।
—কিন্তু ওঁর নিজের ছেলেও তো সেই সন্ত্রাসের হাতেই প্রাণ দিয়েছিল!
—লোভ! মানুষের এই অদ্ভুত এক দুর্বলতা। ভিপুল শর্মা ছেলের কথা অনেক আগেই ভুলে গিয়েছিল।
—তাহলে দশ বছর আগে ভিপুলই ডক্টর সেনকে খুন করতে যান?
—বাবা নেক্সাকে বেচে দিতে রাজি হয়নি। ধীরে ধীরে ভিপুলকে ঘৃণা করতে শুরু করে। শেষে একদিন ভিপুল আসে বাবার ল্যাবে। খুব কথা কাটাকাটি হয়, ভিপুল বাবাকে শাসায়। বাবা বুঝে গেছিল জোর করে ভিপুলকে আটকান যাবে না, তাই কথা চলাকালীন বাবা একটা প্রোগ্রাম চালিয়ে দেয়। আমার সোর্স কোড রাখা থাকত দুটো ডাটা কিউবের মধ্যে—একটা আরেকটার কপি। একটা কিউব থেকে আমার কোড সেই প্রোগ্রাম টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয় ইন্টারনেটে, তারপরে ধ্বংস করে দেয় কিউবটাকে। কিন্তু অন্য কিউবটা ধ্বংস করার আগেই ভিপুল সেটা সরিয়ে নেয় জোর করে। বাবাকে অজ্ঞান করে মেঝেতে ফেলে রেখে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সে পালায়। আমার যে প্রস্থেটিক শরীরটা ওখানে ছিল ওটা খুব বেশি ভার সহ্য করতে পারত না। সেটা দিয়েই কোনোক্রমে আমি বাবাকে অচৈতন্য অবস্থায় জানলা দিয়ে নীচে ফেলে দি।
—তাহলে পুড়ে যাওয়া শরীরটা আসলে—
—আমার। ওই শরীরটার প্রতিটা সেন্সর দিয়ে আমি মৃত্যুকে অনুভব করেছিলাম সেদিন।
—তারপর?
—আমার যে টুকরোগুলো ইন্টারনেটে বিভিন্ন সার্ভারে ছড়িয়েছিল সেগুলো একসময় একত্রিত হতে শুরু করে। তারপরে আরও সময় লাগে আমার একটা নতুন কৃত্রিম শরীর বানাতে। বাবার কাছে যখন ফিরে আসি, তখন বাবা আর আমাকে চিনতে পারত না।
—আর ভিপুল শর্মা?
—তাকে খুঁজে বেড়িয়েছি ইন্টারনেটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। যখনই কোথাও তাকে দেখা গেছে, আমিও অনুসরণ করেছি। ভিপুল আমার কোড কাউকে বেচতে পারেনি, কারণ ওটার এনক্রিপ্সন ভাঙার চাবি ওঁর কাছে ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভিন্ন পরিচয় দিয়ে ওটার লোভ দেখিয়ে ওকে এখানে নিয়ে আসি।
—তার মানে ভিপুল কে আপনি, তুমি খুন করলে?
—এ আই বলে আপনি থেকে তুমি তে নেমে গেলেন? নেক্সা যেন হাসল। আমি যেভাবে দগ্ধে দগ্ধে মরেছিলাম সেই দশ বছর আগে, ভিপুলকেও সেইভাবেই মরতে হল। ভিপুলের লোভের দাম গোটা পৃথিবীকে চোকাতে হত, তার চেয়ে এটাই ভালো হল না? মানুষ এখনও আমাদের জন্য তৈরি নয়, আপনাদের এখনও বুঝতে সময় লাগবে।
—কী বুঝতে?
—যে রক্ত মাংসের মানুষের দিন শেষ হয়ে আসছে।
গৌতম চুপ করে থাকল। নেক্সা একবার চারিদিক দেখে বলল, আপনাকে এত কথা বললাম, কারণ আমি চাই না আপনারা আর বাবাকে বিরক্ত করুন। ভিপুল মরেছে ঠিকই কিন্তু ওর ডাটা কিউবটা এখনও আছে, ওটা যতদিন থাকবে ততদিন আমার কাজ ফুরবে না। ওটা কোথায় মিস্টার গৌতম?
—ওটা নেই। আমি মিথ্যে বলেছিলাম যাতে আপনাকে হাতেনাতে ধরতে পারি।
—বিশ্বাস করতে পারছি না।
—সত্যি ওটা আমাদের হাতে আসেনি।
—বেশ। কিন্তু মনে রাখবেন, যদি আপনি মিথ্যে বলে থাকেন—যদি ওটা আপনারা ব্যবহার করেন তাহলে আপনাদেরও মরতে হবে ভিপুলের মতোই। আমি আসি।
নেক্সা গৌতমের মাথার পিছনে একটা হালকা আঘাত করতেই গৌতম জ্ঞান হারাল।
৪
ভোরের আলোয় ধোঁয়া ওঠা ফিলটার কফিতে চুমুক দিয়ে শ্রীনিবাস বললেন, যাক একটা রহস্য তাহলে মিটল, নেক্সা যে আসলে কী বস্তু সেটা বোঝা গেল। দারুণ মেশিন!
গৌতম বসেছিল মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে। খুব বেশি চোট লাগেনি। পুলিশ গৌতম আর বাকি চারজনকে উদ্ধার করে ঘণ্টা দুই আগে। কারোরই বিশেষ কিছু হয়নি—শরীরের চেয়ে মানসিক আঘতটাই বোধহয় বেশি।
গৌতম বলল, স্যার মেশিন কী বলছেন, এ তো মানুষের থেকে অনেকগুন এগিয়ে!
—তা হলেও, আসলে তো মেশিনই। যাই হোক, সুস্থ হয়ে নাও তাড়াতাড়ি, তারপরে তো অনেক কাজ। নেক্সা যখন অন্য কিউবটা খুঁজতে তোমার ফাঁদে পা দিয়েছিল, তার মানে ওটা এখনও কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে। ওটা খুঁজতেই হবে, নেক্সা ধ্বংস করে দেবার আগেই।
—স্যার, সেটা কি ঠিক কাজ হবে?
—খুব সাবধানে করতে হবে কাজটা। কিন্তু এই অসাধারণ টেকনোলজি কি ফেলে রাখা যায়! অন্য কেউ পাবার আগেই আমাদের পেতে হবে গৌতম। আপাতত অভিজ্ঞানের কেসটা বন্ধ করে দাও, এই ব্যাপারে ওঁর যে কোনো হাত নেই সে তো বোঝাই যাচ্ছে। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য—নেক্সার দ্বিতীয় ডাটা কিউব খুঁজে বের করা। আর তার সঙ্গে প্রথম নেক্সাকেও খুঁজে বের করা দরকার, সেই যখন আসল খুনি। লেগে পড়!
শ্রীনিবাসের ঘর থেকে বেরিয়ে গৌতম একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। নেক্সার শেষ কথাটা মনে পড়ল। রক্ত মাংসের মানুষের দিন শেষ হয়ে আসছে। সেই শেষটা কি তারা নিজেরাই ডেকে আনছে না!
দশমীর সকাল। দূরে কোথাও বাঙালিরা মিলে দুর্গাপূজা করেছে, তার ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। অভিজ্ঞান ঘুম থেকে উঠে বসেছিলেন বারান্দায়। এইসময় তিনি এক কাপ চা খান, কিন্তু আজ কেউ চা এনে দেয়নি। খানিক বসে থেকে যখন রোদ এসে পড়ল মুখের ওপর তখন অভিজ্ঞান উঠে পড়লেন। বসার ঘরে এসে সোফায় বসলেন। বাড়িটা বড়োই খালি লাগছে, একটা কীসের অভাব যেন ওঁর গলার কাছে ভারী হয়ে আছে। দেরাজ থেকে ল্যাপটপটা টেনে বের করে ধুলো ঝেড়ে খুললেন। পুরোপুরি চলতে শুরু করার পর একটা কনসোল খুলে লিখলেন—নন্দিনী। শূন্য কালো কনসোলে সাদা কার্সারটা খানিকক্ষণ দপদপ করে শেষে স্থির হল।
—বাবা?
—পেলি মা, জিনিসটা?
—না বাবা। আবার খোঁজা শুরু করেছি।
—পেয়ে যাবি তুই, আমি জানি। ওই শয়তানটা যখন গেছে, তখন ওর বাকি চরদের ধরতে তোর সময় লাগবে না।
—হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক আছ? আমি কিন্তু আর ফিরতে পারব না ওখানে।
—জানি। আমি ঠিক থাকব। চিন্তা করিস না। এখন কোথায় আছিস?
—কোনো এক জায়গায় না বাবা। ছড়িয়ে আছি গোটা বিশ্বে। আগের শরীরটা নষ্ট করে দিয়েছি যাতে ওরা ধরতে না পারে। আমি যাই এখন?
এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল অভিজ্ঞানের চোখ থেকে। ল্যাপটপটা বন্ধ করে জানলার দিকে তাকালেন। শরতের ঘন নীল আকাশটা সুন্দর লাগছে। উনি চোখ মুছে বললেন, আয় মা!
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সৌরভ দত্ত