ফিনিক্স
লেখক: বুমা ব্যানার্জী দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড
২০১৬
মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ সরায় রেচেল। হাতের পাতা দিয়ে আলতো করে চোখ ঘষতে থাকে। যা দেখছে সেটা সত্যি কিনা নিশ্চিত হতে পারছে না যেন। বিড়বিড় করতে করতে চোখ রাখে মাইক্রোস্কোপের আইপিসে। মগ্ন হয়ে যায় আবার।
আচমকা পিঠে কার আলতো ছোঁয়া পেয়ে প্রায় চমকে ওঠে রেচেল।
—রাত কত খেয়াল আছে?—প্রোগ্রাম ডিরেক্টর প্রোফেসর সারা গ্যাবট পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
—এখুনি আপনাকে পিং করতাম ম্যাম, দেখুন—আইপিসের দিকে ইঙ্গিত করে রেচেল।
খানিক বাদে চোখ তুলে রেচেলের দিকে তাকান প্রোফেসর গ্যাবট। সুডৌল কপালে কুঞ্চন, উজ্জ্বল চোখ দুটোতে স্পষ্ট বিস্ময়।
—এতো স্পষ্ট লেন্স সহ রেটিনা টিস্যু। তার মানে এই ৩০০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো ফসিল যার সে একসময় রীতিমতো দেখতে পেত। অথচ এখন আর—
—এটা কী করে সম্ভব প্রোফেসর?—রেচেলের গায়ে কাঁটা দেয়।
কনফারেন্স রুম কানায় কানায় ভরতি। বিশ্বের তাবড় তাবড় জীবাশ্মবিদ, জীববিজ্ঞানীরা ছাড়াও গবেষক ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠেছে ঘরটা। কিছু সাংবাদিকও আছে, তবে তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না ভয়ানক কিছু উৎসাহ নিয়ে এসেছে তারা। এসব খবর যাকে বলে পাবলিক খায় না খুব একটা। পোডিয়ামের উপর উঠে আসেন ছিপছিপে চেহারার প্রোফেসর সারা গ্যাবট। দর্শকাসনে বসা বিজ্ঞানীরা একটু নড়েচড়ে বসেন। ইনি বাজে বকার মানুষ নন।
—এক আশ্চর্য আবিষ্কার বিবর্তন সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য দেবে আমাদের—গ্যাবট বলে চলেন—হ্যাগফিশ নামক প্রাণীটিকে আমরা দৃষ্টিহীন বলেই জানি। চোখের জায়গায় দুটো স্পট থাকলেও চোখ বলা যেতে পারে এমন গঠন তার নয়। আসলে এদের দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজনও বিশেষ হয় না। সমুদ্রের তলদেশে অন্ধকার গুহায় এরা বাস করে, অনুভবশক্তি আর ঘ্রাণশক্তি কাজে লাগিয়ে খাবার খুঁজে নেয়। কিন্তু—একটু চুপ করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলেন প্রোফেসর—সম্প্রতি ইলিনয়ের মেজন ক্রিক থেকে হ্যাগফিশের একটি জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়। আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো।
একটা মৃদু গুঞ্জন উঠেই আবার নিঃশব্দ হয়ে যায় কনফারেন্স রুম। রিপোর্টারদের একজন রুমালের আড়ালে হাই তোলে।
সারা গ্যাবট বলতে থাকেন—এই ফসিল পরীক্ষা করে আশ্চর্য একটা জিনিস আমার টিম আবিষ্কার করেছে। ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে হ্যাগফিশ দেখতে পেত। তার পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি ছিল, এবং চোখের গঠন ছিল পরিণত।
কিন্তু—
প্রোফেসর গ্যাবটকে বাধা দিয়ে একেবারে সামনের সারিতে বসা একজন সাংবাদিক বলে ওঠে—অর্থাৎ আগে দেখতে পেত এখন আর পায় না?
—ঠিক তাই—মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্যাবটের মুখে—আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই একটা ক্ষেত্র ছাড়া প্রাচীন আর আধুনিক হ্যাগফিশের মধ্যে খুব বেশি তফাৎ কিন্তু নেই। তাই—
—এটা তো তাহলে উলটো বিবর্তন নাকি?—আবার সেই সাংবাদিক বাধা দেয়—আগে ছিল এখন নেই।
—উলটো বিবর্তন বলে কিছু হয় না—সারার কণ্ঠস্বরে ঈষৎ বিরক্তি ধরা পড়ে—অপ্রয়োজনীয় জিনিস লোপ পাওয়ার নামও বিবর্তন। কোনো একটা সময়ে এই প্রাণী সমুদ্রের গভীরে প্রায় তলদেশে বসবাস করতে শুরু করে, সেখানে চোখ থাকলেও আলোর অভাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না বলেই একসময়ে হ্যাগফিশ হয়ে পড়ে দৃষ্টিহীন। একে বলে প্রত্যাবর্তী বা রিগ্রেসিভ ইভোল্যুশন। তবে বিবর্তন সবসময়েই সামনের দিকে চলে, পিছন দিকে নয়—শেষ কথাটা প্রোফেসর গ্যাবট সামনের সারির দিকে তাকিয়ে বলেন।
—তাহলে প্রোফেসর আপনি বলছেন যে আমাদের আবার হঠাৎ করে বনমানুষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই? নিশ্চিন্ত হলাম—হলের পিছন থেকে উটকো রসিকতাটা ভেসে আসে। কেউ কেউ হেসে ওঠে কথাটা শুনে।
—আপনার ক্ষেত্রে বলতে পারছিনা, তবে বাকিদের সে ভয় সম্ভবত নেই—স্পষ্ট গলায় উত্তর দেন গ্যাবট।
জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি, নাসা
ক্যালিফোর্নিয়া, ২০৩৬
দীর্ঘ একটা বিপ বিপ বিপ শব্দে চমকে ওঠেন প্রবীণ বিজ্ঞানী ডক্টর বেরিল ফার্গুসন। বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে আছেন সকাল থেকে। তিরাশি বছর বয়স কি কম কথা। এখনও স্মৃতিশক্তি দিব্য কাজ করে তাঁর। তা না হলে কি এই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারতেন তিনি। কত বছর ধরে এই ল্যাবরেটরিই ছিল তাঁর বাড়ি, এই ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক তাঁর বিচরণভূমি। তবে এত উন্নত কি আর ছিল তখন।
সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ছে আজ। তিনি তখন তেইশ-চব্বিশ বছরের অনভিজ্ঞ ইন্টার্ন। নাসা থেকে ইন্টার্নশিপের অফার আসাতে এমনিতেই বেশ ঘাবড়ে গেছিলেন। সারা তো ভেবেই নিয়েছিল তাদের সম্পর্কটা আর টিকবে না, নাসাতে কাজ পেয়ে গেলে বেরিল কি আর তাকে মনে রাখবে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ডক্টর ফার্গুসনের। সেই সারাও চলে গেছে আজ কত বছর হয়ে গেল।
লম্বা এক বিপ বিপ শব্দ হয়ে চলেছে, সামনের বড়ো স্ক্রিনটাতে দ্রুত ফুটে উঠছে পর পর বেশ কিছু সংখ্যা। ঘর জুড়ে চঞ্চলতা। স্ক্রিনের সামনে ভিড় করে আসে বেশ কিছু নবীন ও প্রবীণ বিজ্ঞানী।
—সময় হল ডক্টর ফার্গুসন—পাশে দাঁড়ানো লিন্ডা প্রায় ফিসফিস করে বলে ওঠে।
কাউন্ট ডাউন শুরু হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। টেন… নাইন… সিক্স… থ্রি… ওয়ান… জিরো।
সামনের স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় বিপ বিপ শব্দ।
ডক্টর ফার্গুসনের চোখের কোণদুটো ভিজে আসে, মুহূর্তে মন চলে যায় সেই ১৯৭৭-এ।
ভয়েজার ১, ভয়েজার ২ পরপর দুটো স্পেস প্রোব উৎক্ষেপ করা হল। উদ্দেশ্য সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যবর্তী এলাকার তথ্য সংগ্রহ করা। তখন অবশ্য তিনি ডক্টর ফার্গুসন নন, স্রেফ ইন্টার্ন বেরিল। অবাক চোখে ভয়েজারের ম্যাগনেটোমিটার স্পেক্ট্রোমিটারগুলো দেখতেন। তবে চমক তখনও বাকি ছিল। আরও অদ্ভুত একটা জিনিস ভয়েজারের সঙ্গী হল। একটা সোনালি রঙের গোল রেকর্ড। সে যুগের লং প্লেইং রেকর্ডেরই মতো। সেখানে ধরা রয়েছে পৃথিবীর অসংখ্য ছবি, ৫৫টি ভাষায় অভিবাদন, কিছু বিখ্যাত গান, শিশুর কান্না, আর কিছু প্রাকৃতিক শব্দ। রেকর্ডের সঙ্গে আটকানো আছে সেটা চালানোর স্টাইলাস, আর গায়ে আঁচড় কেটে ছবি এঁকে নির্দেশ দেওয়া আছে কীভাবে সেই স্টাইলাস বসালে শোনা যাবে শব্দ, উদ্ধার করা যাবে তাতে ভরে রাখা ছবি। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ম্যাকনাট এই রেকর্ড দুটোর নাম দিয়েছিলেন সাইলেন্ট অ্যাম্বাসেডর, অর্থাৎ পৃথিবীর নীরব প্রতিনিধি।
—আজ থেকে ভয়েজার ১ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হল পৃথিবী থেকে, ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের আওতার বাইরে। এতদিন আমরা একটা একটা করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বন্ধ করে দিচ্ছিলাম, আজ সম্পূর্ণভাবে শাট ডাউন করা হল। হিসাব অনুযায়ী এর প্লুটোনিয়াম ব্যাটারি চলত হয়তো আর মাস ছয়েক, কিন্তু তার আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল নাসার পক্ষ থেকে—নির্লিপ্ত গলায় বলে যায় নাসার প্রতিনিধি। দেওয়ালজোড়া স্বচ্ছ পর্দায় আবার ভেসে ওঠে সংবাদপাঠিকার অতি উৎসাহী মুখ—পৃথিবীর নীরব প্রতিনিধি হয়ে ভয়েজার কিন্তু ভেসে যাবে নিরুদ্দেশের পথে, হয়তো চেনা সৌরজগতের বাইরে অজানা কোনো গ্রহের উদ্দেশে। সেখানে হয়তো—
অতি নাটকীয়তা সহ্য করতে না পেরে এবার বিরক্ত মুখে সম্প্রচার বন্ধ করে দেন ডক্টর ফার্গুসন। অবশ্য তিনি টিভি বলতে যা বুঝতেন তার সঙ্গে এই দেওয়ালজোড়া পর্দার কোনো মিলই নেই। ধীরে ধীরে জানলার সামনে এসে দাঁড়ান তিনি। আজ আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, ঘনায়মন অন্ধকারে একটি-দুটি করে নক্ষত্র ফুটে উঠছে। সেই দিকে তাকিয়ে বোধহয় ভয়েজারের কথাই ভাবতে থাকেন তিনি।
২০২৬, ভারতবর্ষ
নাম্মা মেট্রো, বেঙ্গালুরু
ঠিক সকালও নয়, আবার দুপুরও বলা চলে না। এই সময়টায় মেট্রো স্টেশন মোটামুটি ফাঁকা থাকে। অফিস যাত্রী আর স্কুল-কলেজের ভিড় সামলে মেট্রো স্টেশনটাও যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। খুব ধীর পায়ে বছর চব্বিশের এক যুবক এসে দাঁড়ায় প্লাটফর্মে। পিঠে ব্যাকপ্যাক, ধোপদুরস্ত জামাপ্যান্ট পরনে। মাথার উপর ডিসপ্লে বোর্ড দেখাচ্ছে পরবর্তী ট্রেন আসতে আর মিনিট দুয়েক বাকি। স্থির দৃষ্টিতে মেট্রোর লাইনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যুবক। মুখ দেখে তার চিন্তা ভাবনার হদিশ পাওয়ার উপায় নেই। আসলে মিনিট চল্লিশ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই যেন বার বার চোখের সামনে ফুটে উঠছে তার।
—উই রিয়্যালি অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট য়্যু আর আ ভেরি গুড প্রোগ্র্যামার নীলাঞ্জন, বাট য়্যু নো—কাঁধ ঝাঁকায় নীলাঞ্জনের প্রজেক্ট ম্যানেজার দীপেশ ভার্গব—লাস্ট দুই বছরে কোম্পানি পলিসির প্রচুর রদবদল হয়েছে। তুমি যেই লেভেলের প্রোগ্রামিং করো, এ আই কোড বট খুব সহজেই সেটা হ্যান্ডেল করতে পারে। কোম্পানির কাছে সেটা ওয়ান টাইম ইনভেস্টমেন্ট। তাকে মাস মাস মাইনে দিতে হয় না, পার্কস দিতে হয় না, সে মাইনে বাড়াতে বলবে না, সর্বোপরি তার উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। তুমি এক ঘণ্টায় যে ক-টা লাইন বাগ ফ্রি কোড লিখতে পারবে, কোড বট পারবে তার থেকে অনেক বেশি, সে কথা নিশ্চয়ই স্বীকার করছো।
মাথা নীচু করে বসে ছিল নীলাঞ্জন, কী-ই বা বলবে। আট মাসও হয়নি এই চাকরিটা সে পেয়েছে।
—এমন তো নয় যে কোড বট বা এ আই তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের সবার চাকরি কেড়ে নেবে। সে সরকারের বিরোধীপক্ষ যাই বলে চেঁচাক না কেন, কোম্পানি উইল স্টিল নিড রিয়্যাল ইন্টেলিজেন্ট পিপল ইন হাইয়ার লেভেলস—ভার্গব এবার নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে।
—দেখো ইয়ং ম্যান, তুমি সবে তোমার জীবন শুরু করছ। তা ছাড়া ভার্গবের কথাতেই বুঝলাম তোমার যোগ্যতাও আছে, তোমার চিন্তা কী। দেখবে হয়তো বট এ্যালগো লিখছ ক-দিন পর। উই আর সরি, কিন্তু উই রিয়্যালি হ্যাভ টু লেট য়্যু গো—ভার্গবের পাশে বসা মোহন চট্টরাজকে সামান্য ক্লান্ত দেখায়। এই নিয়ে কত নম্বর কর্মীকে ছাঁটাই মানে ওদের ভাষায় লেট গো করতে হয়েছে আজ কে জানে।
ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে। কী করবে এবার নীলাঞ্জন? কলকাতায় ফিরে যাবে, না এখানেই থেকে অন্য কাজ খুঁজবে? কিন্তু তার মতো প্রায় ফ্রেশারদের কেই বা নেবে। তার লেভেলের প্রায় সবরকম কাজই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা করা সম্ভব। তার উপরের লেভেলে উঠতে গেলে চাই অভিজ্ঞতা। চাকরি না পেলে অভিজ্ঞতাটা আসবে কোথা থেকে বুঝতে পারে না নীলাঞ্জন। কুলি বা মিস্ত্রী হলে অবশ্য অন্য কথা, তাদের এখনও কৃত্রিম বুদ্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়নি। এক মুহূর্তের জন্য নীলাঞ্জনের চোখের সামনে তাদের উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি গলির ভাঙাচোরা এজমালি বাড়িটা ভেসে ওঠে। ওই বাড়ির লোকজনকে টেনে শক্ত জমিতে দাঁড় করানোর দায়িত্ব নিয়ে এখানে এসেছিল সে। মাথাটা একবার নেড়ে ছুটে আসা ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলাঞ্জন।
মহাশূন্য, আন্তঃনাক্ষত্রিক অঞ্চল
(২০৯০—পৃথিবীর হিসেবে)
ভেসে চলাই তার কাজ। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বহু দিন, পৃথিবীর শেষ ছবি তুলেছিল ঠিক একশো বছর আগে, পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব তখন ছয় বিলিয়ন কিলোমিটার। পৃথিবীর মানুষ সে ছবির নাম দিয়েছিল পেল ব্লু ডট। এখন নিকষ কালো অন্ধকারে কেবল ভেসে যাওয়া। সব যন্ত্রপাতি এখন বন্ধ, ছবি তোলার কাজও আর নেই। নয়তো ওফিউকাস নক্ষত্রমণ্ডল দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তার ছবি তোলা যেত। পৃথিবীর মানুষ হয়তো ভুলেই গেছে ভয়েজার ১-কে।
তৃতীয় মহাদেশ সম্মেলন
ভারতবর্ষ, ২০৭০
উত্তর আমেরিকা মহাদেশের প্রতিনিধি উঠে দাঁড়ালেন উত্তেজিতভাবে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন—সর্বক্ষেত্রে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠত্ব তো একরকম মেনেই নিয়েছি। তাহলে এই ব্যাপারে এত নাটক করার মানে ভারতবর্ষের প্রতিনিধি কি বুঝিয়ে বলবেন?
—আমি ২০৬৫-এর এ আই এ্যাক্টের কথা মনে করিয়ে এইটুকুই বলতে চাই যে সাতটি মহাদেশের সম্মানীয় প্রতিনিধিদের সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মানবকুলের সামান্যতম ক্ষতি হয় এমন বিষয়ে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেব না—ভারত মহাদেশের প্রতিনিধি মধ্যবয়সি শ্রীময়ী আচরেকর শান্ত স্বরে বলেন। মাত্র মাস ছয়েক হল ভারতীয় উপমহাদেশ পূর্ণ মহাদেশের সম্মান পেয়েছে। তাই এই প্রথম মহাদেশ সম্মেলনে ভারতবর্ষ থেকে তার নিজস্ব প্রতিনিধি এসেছে।
—জনসংখ্যার নিরিখে আপনার দেশ তো সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে মিস আচরেকর।
সম্মেলনে বেশ গোলমাল শুরু হয় এরপর।
জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি, নাসা
ক্যালিফোর্নিয়া, ২০৯০
মাঝ রাত। অবশ্য সেই হিসেবে সময়ের কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই এখন এখানে। সময়ের প্রভাব পড়ে মানুষের উপর, হিউম্যানয়েডের উপর নয়। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র মনুষ্যজাতীয় কর্মী টিকে আছে এখনও। তাদেরও ডেজিগনেশন বা পদ বলে কিছু নেই আর। শহরের এদিকটায় কোনো মানুষের বসবাসও নেই। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা এখন বেশ কম। একসময় নাকি খাদ্য, খনিজ সম্পদ, জ্বালানীর তুলনায় মানুষের সংখ্যা ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছিল। নিজেরা এই সমস্যার সমাধান খুঁজে না পেয়ে বিশ্বের প্রধান উন্নতশীল দেশগুলো একজোট হয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শরণাপন্ন হয়। ততদিনে চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। সাধারণ অস্ত্রোপচার রোবটরাই করে থাকে, মানুষদের আর লাগে না।
জিনবাহিত রোগের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য ভ্রূণ অবস্থাতেই জিনের গঠনের সূক্ষ্ম পরিবর্তন আনার কাজ বহু আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরামর্শে এর পর শুরু হয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ।
এ আইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী বেছে বেছে অসুস্থ, দুর্বল বা কম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের গর্ভস্থিত ভ্রূণের জিনের গঠন পরিবর্তন করে তাদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়ার কাজ চালু করা হয়েছিল পুরোদমে। যতটা প্রতিরোধ আশঙ্কা করেছিল রাষ্ট্রনেতারা তার কিছুই হয়নি। আসলে ততদিনে মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে। প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করার অভ্যেসটাই আর ছিল না সাধারণ মানুষের, হয়তো চিন্তা করার অভ্যেসটাও হারিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। বলা বাহুল্য জনসংখ্যা খুব সাফল্যের সঙ্গেই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
ল্যবরেটরির ভিতর বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রাম চালু হয়ে আছে। কোনোটা পৃথিবীর চারপাশের অগুনতি উপগ্রহ থেকে আসা আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখছে, কোনোটা বা মঙ্গলগ্রহের নির্মীয়মান বসতির নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখছে।
ল্যাবের পশ্চিম কোণ থেকে হঠাৎ অদ্ভুত একটা বিপ বিপ শব্দ ওঠে। দুটো ছোটো বিপ পরপর, তারপর একটা লম্বা বিপ। বার বার হতে থাকে। লম্বা পা ফেলে একটা রোবট চলে যায় পশ্চিম দিকের স্বচ্ছ স্ক্রিনের কাছে। এটা বিপদের ধ্বনি। ল্যাবরেটরির এইদিকে বেশ পুরোনো একটা কম্পিউটার বসানো আছে। এটা পৃথিবীর দিকে ছিটকে আসা গ্রহাণুগুলোর দিকে নজর রাখে। পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সংকেত দেয়। বছর পঁচিশ আগে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তখন অবশ্য এই ল্যাবে মনুষ্যজাতীয় কর্মীই বেশি ছিল। ছোটো একটা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে ধাক্কা লাগানো হয়েছিল গ্রহাণুটির সঙ্গে। টুকরো টুকরো হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে গেছিল সেটা। তারপরেই এই স্বয়ংক্রিয় প্রহরীকে তৈরি করা হয়েছে।
রোবটটি ঝুঁকে পড়ে স্ক্রিনের দিকে। এই ভি৭৮৩ সিরিজের রোবট অত্যন্ত কর্মক্ষম। নির্দিষ্ট কিছু ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এদের। যেমন এখন এই বিশেষ গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের সত্যি সম্ভাবনা আছে কিনা আর থাকলেও তা কতটা বিধ্বংসী সেটা বিচার করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম সে। অবশ্য কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে গ্রহাণুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত যদি নিতেই হয়, সেক্ষেত্রে ডিরেক্টরের অনুমোদন আবশ্যক।
নাহ্, পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা লাগার সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও এখনও তার অনেক দেরি। এ গ্রহাণু এখনও অনেক দূরে। তা ছাড়া বিশেষ ক্ষতির সম্ভাবনাও নেই। তবে লব্ধ তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে গ্রহাণুটির সঙ্গে সংঘর্ষ পথে আরও একটি বস্তু রয়েছে। সেটি যে কী তা অবশ্য একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার গতিপথ সম্পূর্ণ উলটোদিকে। সুতরাং আর কোনো তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়ে না ভি৭৮৩এমের। মানুষ হলে হয়তো করত।
৭০০ কেজির একটা বাক্স বই তো নয়। এ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে ভয়েজারকে। তার আশপাশে কী আছে এখন জানতেও পারছে না সে আর। তার রাস্তায় কিছু চলে এলেও তার পক্ষে টের পাওয়া আর সম্ভব নয়। এখনকার যানগুলো অবশ্য অনেক উন্নত। তাদের যাত্রাপথে কিছু চলে এলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে গতিপথ সংশোধন বা কোর্স কারেকশন করে সংঘর্ষ এড়াতে পারে।
হঠাৎ প্রচণ্ড একটা ধাক্কায় নিজের গতিপথ থেকে ছিটকে যায় ভয়েজার। প্রায় ট্রাকের আকারের একটা গ্রহাণু এক ধাক্কায় তার রাস্তা থেকে ভয়েজারকে সরিয়ে দিয়ে তীব্রবেগে বেরিয়ে যায়। ভাগ্যিস কেবল ছোঁয়া লেগেছিল। সরাসরি ধাক্কা লাগলে চুরচুর হয়ে যেত ভয়েজার। কিন্তু একি, ওফিউকাস নক্ষত্রমণ্ডল আর দেখা যাচ্ছে না তো, লেন্সের বারোটা বাজল নাকি?
পৃথিবীর কেউ জানতে পারল না ভয়েজার ১ তার গতিপথ পালটে সম্পূর্ণ অন্যদিকে চলে গেছে। সে ভেসে চলেছে মঙ্গলগ্রহের দিকে, যেন সে নিজেই একটা গ্রহাণু। ভাগ্য ভালো গোল্ডেন রেকর্ডটি অক্ষত থেকে গেছে।
ল্যুভর মিউজিয়াম, প্যারিস
২০৯৫
—কাল থেকে এক্সিবিশন শুরু আর আজ তুমি বলছ এখনও কাজ শেষ হয়নি?—খিঁচিয়ে উঠে বলে লুই।
তার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকা রোগা লম্বা ছেলেটির কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না।
—এত দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে তো চলে না গেব্রিয়েল, ঠিক এই জন্যই নতুন শিল্পীদের কাজ আমি নিতে চাই না—লুইয়ের কর্কশ গলা ছড়িয়ে পড়ে করিডোরে। যে দুই একজন পর্যটক ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিল তারা ফিরে তাকায়। আজকাল আর ল্যুভরে ভিড় হয় না বিশেষ। লোকে বাড়ি বসে ভার্চুয়্যাল ভ্রমণেই বেশি আনন্দ পায় বোধহয়। যে যত দরের টিকিট কাটে, তত কাছ থেকে নিজেদের পছন্দমতো শিল্পকীর্তি দেখতে পায়। অত ডিটেইলে সম্ভবত এখানে এসে দেখা সম্ভব হত না। কিন্তু অনেক বছর পর সাম্প্রতিক শিল্পীদের নিয়ে একটা এক্সিবিশন হচ্ছে। ভার্চুয়্যাল নয়, সেই অনেকদিন আগে যেমন হত, সেরকম। কিউরেটর হিসেবে লুই্য়ের পনেরো বছরের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম। তাই মাথাটা বেশ গরম হয়ে আছে বেচারার। তার মধ্যে শিল্পীদের নানা বায়নাক্কা।
—কাজ আমার শেষ হয়েই গিয়েছিল মিস্টার কিউরেটর—এতক্ষণে মুখ খোলে গেব্রিয়েল ছোকরা—কিন্তু—
—কিন্তু কী? কাজ শেষ তো এনে ধন্য করনি কেন?—আবার চেঁচায় লুই।
—ভিঞ্চিপ্রো অনুমোদন করছে না যাই করি না কেন—দাঁত চেপে বলে গেব্রিয়েল।
এবার থমকে যায় লুই। ভিঞ্চিপ্রো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক আশ্চর্য নিদর্শন। যে কোনো ছবিকে তার গুণগত মান ও বিক্রয়যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচার করে সেটা মিউজিয়ামের সংগ্রহে রাখার উপযুক্ত কিনা তা জানানোই ভিঞ্চিপ্রোর কাজ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন করলে ছবিটা গ্রহণযোগ্য হবে সেই পরামর্শও দেয় ভিঞ্চিপ্রো। ল্যুভর সহ পৃথিবীর প্রায় সব বড়ো বড়ো আর্ট গ্যালারিতেই এখন এই ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যেই ছবি বা ভাস্কর্যের গুণাগুণ বিচার করা হয়।
—মিউজিয়াম পলিসি অনুযায়ী ভিঞ্চিপ্রো অনুমোদন না করলে সে ছবি তো আমরা নিতে পারি না হে—আমতা আমতা করে লুই—তা কী পরিবর্তন করতে হবে সে ব্যাপারে কোনো পরামর্শ দেয়নি?
গেব্রিয়েলের চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলে ওঠে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লুইয়ের দিকে। তারপর কেটে কেটে বলে—না, দেয়নি।
—দেয়নি, না তুমি মানতে চাওনি?—লুইয়ের গলা আচমকা নরম হয়ে আসে।
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে গেব্রিয়েল মোনে। চোখ মেঝের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়।
দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে লুই। বড়ো ভালো আঁকে ছেলেটা, কিন্তু বড্ড জেদি আর খেয়ালি। কে জানে, খাঁটি শিল্পীরা বোধহয় এমনই হয়। ছোকরার কোনো এক পূর্বপুরুষ নামী শিল্পী ছিলেন, এই ল্যুভরের আর্কাইভে আছে তাঁর আঁকা ছবি।
সিটি হসপিটাল, ক্যালিফোর্নিয়া
প্রসূতি বিভাগ
২১১৫
প্রসববেদনা উঠেছে জেনেটের। মাথার উপর বসানো অজস্র ইলেকট্রোড। সেগুলো যন্ত্রণার পরিমাণ মাপছে প্রতি মুহূর্তে। যন্ত্রণার প্রান্তিক সীমা অতিক্রম করলেই স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক হাত এসে যন্ত্রণানাশক ওষুধের ইনজেকশন দিয়ে যাবে। তারপর শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় হলে সত্যিকার ডাক্তারের দেখা পাওয়া যাবে। সমস্ত শিশুর আইনানুগ অভিভাবক এখন রাষ্ট্র। জন্মের পরই তার জিনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্ধারণ করে নেওয়া হয় সে কোন পেশার জন্য উপযুক্ত। যেহেতু যে-কোনো নাগরিকের শিক্ষার ভার সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের, সেই অর্থ যাতে অপচয় না হয়, বা ভুলভাবে ব্যবহৃত না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া জিনবাহিত কোনো রোগ থাকলে বা বুদ্ধিবৃত্তির স্বাভাবিক বিকাশের লক্ষণ না থাকলে গর্ভস্থিত শিশুর প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে অনেকদিন। জেনেটের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। তার সন্তান অক্ষত, কোনোরকম সমস্যা নেই তার।
তলপেটে তীব্র চাপ অনুভব করে জেনেট। দ্রুতপায়ে ঘরে ঢোকেন সাদা পোশাক পরা একজন মানুষ। আচ্ছা, ইনিই তাহলে ডাক্তার। জেনেট এর আগে কখনও মানুষ ডাক্তার দেখেনি। চাপটা বাড়তে থাকে, জেনেট বুঝতে পারে তার পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন ডাক্তার।
জোরালো চিৎকারে জেনেটের ঘোর কেটে যায়। সদ্যজাত শিশুর প্রথম চিৎকার। চোখের সামনেটা ধোঁয়া ধোঁয়া, তাও জেনেট বুঝতে পারে ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত চঞ্চলতা তৈরি হয়েছে। একজন নয়, তার পায়ের কাছে এখন দুইজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। আকুল হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে জেনেট। তার সন্তান, কোথায় সে?
পিছন থেকে রোবোটিক হাত এসে তার কাঁধ ধরে শান্তভাবে তাকে আবার শুইয়ে দেয়। নড়াচড়া টের পেয়ে ডাক্তার দুজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা বন্ধ করে ফিরে তাকান।
—আমার বাচ্চা? কই?—কোনক্রমে বলে জেনেট।
—হ্যাঁ এই যে—চাকা লাগানো স্ট্যান্ডের উপর বসানো জীবাণুমুক্ত স্বচ্ছ একটা বাক্স জেনেটের দিকে গড়িয়ে নিয়ে আসেন ওনারা। সদ্যজাত শিশুদের প্রায় একমাস পর্যন্ত এই জীবাণুমুক্ত বাক্সে রাখাই নিয়ম। ভিতরে শুয়ে থাকা ক্ষুদ্র প্রাণীটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে জেনেট। এমনিতে তো সব ঠিকঠাক, আঙুলের মাথাগুলো যেন ছোট্ট ছোট্ট মুক্তোর দানা। কিন্তু মাথার গঠনটা যেন কেমন অদ্ভুত। জেনেট হাত বাড়িয়ে চাকা লাগানো স্ট্যান্ডটা আর একটু টেনে আনে নিজের দিকে, তারপর খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। মাথার উপরটা যেন একটু বেশি চ্যাপটা। একদিকে সামান্য কাত হয়ে আছে মাথাটা, পুরো দেখা না গেলেও জেনেটের মনে হয় মাথার পিছন দিকটা যেন একটু বেশি লম্বাটে। কপালটা যেন কিছুটা সামনে এগিয়ে ঝুঁকে পড়েছে চোখের উপর। নাক থেকে চোয়াল পর্যন্ত গঠনটাও কেমন স্বাভাবিক নয়, যেন সামনে এগিয়ে গেছে খানিকটা। মুখের বাকি অংশের তুলনায় নাকটা অনেক বেশি বড়ো কি?
এ কেমন বিকৃতি নিয়ে জন্মালো তার সন্তান? চোখভরা প্রশ্ন নিয়ে ডাক্তার দুজনের দিকে তাকায় জেনেট। কিন্তু তাঁরা কখন যেন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটগুলোকে জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা উত্তর হয়তো পাওয়া হবে, কিন্তু জেনেটের এদের সঙ্গে কথা বলতে ঠিক ইচ্ছা করল না।
সিটি হসপিটাল ঘিরে বিশাল বাগান। ডাক্তার দুজন দ্রুত পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ান। খানিকক্ষণ সব চুপচাপ।
—এই নিয়ে পাঁচ নম্বর।
—কিন্তু এদের জেনেটিক কোডিং এ আইয়ের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে কেন?
—ডক্টর আর্চার, এআই নির্দিষ্ট কয়েকটা প্যাটার্ন খোঁজে গর্ভস্থ শিশুর দেহে। তা না পেলে ওয়ার্নিং দেওয়ার প্রশ্ন তো ওঠে না, তাই না?
জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি, নাসা
ক্যালিফোর্নিয়া, ২১২০
ভারত মহাদেশ থেকে সিটিজেন পৃথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিটিজেন অস্কার, আফ্রিকা মহাদেশের সিটিজেন ওবেলো, ইউরেশিয়ার প্রতিনিধি সিটিজেন পাবলো আপনারা চারজন মঙ্গলগ্রহের ধরিত্রী কলোনির প্রথম বাসিন্দা হতে চলেছেন। আপনাদের হার্দিক অভিনন্দন। দুর্ভাগ্যবশত পৃথিবী আর বেশিদিন বাসযোগ্য থাকবে না। তাই আপনাদের যাত্রা ও বসতি সফল ও সার্থক হোক। ধরিত্রী কলোনি বসবাসের উপযুক্ত করার জন্য নাসার বিশেষ টিম গত তিন বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে তা তো আপনারা জানেনই। আপনাদের সাত মাসের যাত্রাপথ নিরাপদ ও আনন্দদায়ক হবে নিশ্চয়ই। কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন—ডিরেক্টর সিটিজেন সামান্থা এক এক করে চারজনের মুখের দিকে তাকান। অবশ্য প্রশ্নটা কে করবে ভালো করেই জানেন তিনি। ঠিক তাই। পৃথার হাতটা উপর দিকে উঠে আছে।
—আমরা যদি সফল হই, পৃথিবীর বাসিন্দাদের কীভাবে ধরিত্রী কলোনিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে? যতদূর জানি সে কলোনি সীমিত জনসংখ্যার জন্য তৈরি।
—পৃথা, দেখুন এ তো শুধু প্রথম ধাপ। সমস্ত পৃথিবীবাসীকে মঙ্গলে নিয়ে চলে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়, সে অনেক লম্বা পদ্ধতি এবং অবশ্যই অস্বাভাবিক খরচসাপেক্ষ—সামান্থার কপালে ভাঁজ পড়ে। বিজ্ঞানী হিসেবে প্রথম সারির হলেও পৃথা বড়ো অকারণ প্রশ্ন করে।
—কে যাবে আর কে থেকে যাবে কীভাবে নির্ধারণ করা হবে ডক্টর সামান্থা?—কাটা কাটা ভাবে জিজ্ঞেস করে পৃথা।
—এটা ঠিক আমাদের আওতায় পড়ে না সিটিজেন পৃথা—সামান্থার গলা ঠান্ডা শোনায়।
—অর্থাৎ কারা বাসযোগ্যতা হারানো পৃথিবীতে থেকে যাবে সেটা নির্ধারণ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত কোনো সিস্টেম, তাই নয়?—তিক্ততা ঝরে পড়ে পৃথার গলা থেকে।
গোল জানলায় প্রায় নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পৃথা। আর মাস দুয়েক, তারপর শুরু হবে মঙ্গলগ্রহের নতুন অধ্যায়। পৃথিবীকে এখন একটা নীলচে সবুজ বলের মতো লাগছে। মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবীর বহু পুরোনো ছবির সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে, নীল অংশের পরিমাণ বেড়েছে, সবুজ অংশের বেশ কিছু জায়গায় এখন ধূসর ছোপ। সেই অর্থে পৃথার আপনজন কেউ নেই ওই সবুজ নীল গ্রহে। এই মিশনে যাদের নির্বাচন করা হয়েছে, তাদের কারুরই আপনজন কেউ নেই। তাও পৃথা অদ্ভুত একটা টান অনুভব করে হঠাৎ।
—কী ভাবছ?—ওবেলো এসে দাঁড়িয়েছে পাশে—ওই গ্রহকে এবার ভুলে যাও।
এই পাঁচ মাসে ওবেলোর সঙ্গে খানিকটা সখ্যতা তৈরি হয়েছে পৃথার। অস্কার আর পাবলো কাজের কথা ছাড়া অন্য কথা বলে না।
—জানো, আমার একটা ভাই হয়েছিল। আমি অবশ্য দেখিনি কখনও তাকে, বছর দুয়েক বয়স তখন আমার।
—তুমি দেখনি মানে?—ওবেলো পৃথার দিকে স্ট্র লাগানো একটা সিল করা পাউচ এগিয়ে দেয়। ওতে কফি আছে।
—ইদানীং যেমন অদ্ভুত খুলির গঠন নিয়ে কেউ কেউ জন্মাচ্ছে, মাথার উপরটা চ্যাপটা, পিছন দিকটা লম্বাটে, নাক থেকে চোয়াল সামনের দিকে এগিয়ে আসা? তার খুলির গঠনও তেমন ছিল।
—তারপর?—ওবেলোর চোখ বলছে তারপরের ঘটনা সে আন্দাজ করে নিয়েছে।
—শুনেছি এরকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো বাচ্চাদের কোনো জঙ্গলের অবজারভেশন সেন্টারে নাকি রাখে, সেখানেই হয়তো আছে কোথাও। এদের সংখ্যা তো দিন দিন বাড়ছে বলে শুনেছি। নিশ্চয়ই একা নেই—পৃথার চোখের কোণটা ভিজে ওঠে।
—এদের কী নাম দেওয়া হয়েছে জানো তো পৃথা?
—জানি, নিওনিয়ানডার্থালেনসিস—গোল জানালাটা দিয়ে আবার বাইরে তাকায় পৃথা। লাল গ্রহকে একটা লাল টিপের মতো দেখাচ্ছে আকাশে।
ঘন জঙ্গল, ভারত মহাদেশ
২১৫০
স্টিলের মোটা ঘন জালের ফাঁক দিয়ে জঙ্গলের দিকে সন্ধানী চোখে তাকান বৃদ্ধ। একটু আগে ওখানে একটা নড়াচড়া চোখে পড়েছিল। একটা হরিণের মৃতদেহ পড়েছিল ওখানে, এখন আর সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। এই অঞ্চলে এক সময়ে অনেক বাঘ ছিল, এখন একটা দুটো দেখতে পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। যে দুটো ব্যাঘ্র শাবককে এই জঙ্গল থেকে মঙ্গলগ্রহের ধরিত্রী কলোনিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তারা বাঁচল কিনা কে জানে। বৃদ্ধ বিজ্ঞানী মঙ্গলের খবর রাখেন না।
এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল সুন্দরবন, এখন নাম সেক্টর ৭৫০বি। আশপাশে মানুষ বোধহয় আর নেই। অন্তত চোখে পড়েনি বছর দশেক। দূষণের ফলে প্রায় সমস্ত শহরাঞ্চল বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল অনেক আগেই। মরু অঞ্চলের সমস্ত বরফ গলে বছর তিরিশ আগে এক বিশাল প্লাবন উপস্থিত হয়। নিমজ্জিত হয় বেশ কিছু শহর। ততদিনে অবশ্য মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে, দূষণজনিত নানা অসুখে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমে গেছিল অনেক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়েছিল তারও আগে। মজার ব্যাপার হল, পৃথিবী পরিত্যক্ত হওয়ার পর অনেকাংশেই এখন দূষণমুক্ত। জঙ্গল অঞ্চলেরও উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেছে।
মঙ্গলগ্রহে তাঁর মতো জীববিজ্ঞানীর প্রয়োজন ছিল নিঃসন্দেহে, তিনি যেতে রাজি হননি। বলেছিলেন—আমি এখানেই মরতে চাই। তা ছাড়া এখানেও তো কাজ করছি।
তা করছেন বটে। একটা প্রায় পরিত্যক্ত গ্রহে বসে অদ্ভুত কিছু প্রাণীকে নিয়ে গবেষণা করছেন। কার কাজে লাগবে এই গবেষণা তিনি জানেন না। সোলার সেলগুলো চলছে তাই রক্ষে। বিদ্যুৎ এখনও পাওয়া যায়। তাঁর খাওয়াদাওয়ারও বিশেষ কোনো সমস্যা নেই। তাঁর বাসস্থানের সামনে একটা সব্জির বাগান করেছেন, তা ছাড়া প্রচুর পরিমাণে টিনের মাছ মাংস কর্ন রয়েছে এখনও। এগুলো নানা মানুষের রেখে যাওয়া। তিনি যে স্বেচ্ছায় থেকে যাচ্ছেন এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন অনেকে। তাদেরই আনা এসব খাবার। তাঁর জীবদ্দশায় এই খাবারের ভাঁড়ার ফুরানোর সম্ভাবনা নেই।
জঙ্গলের প্রান্তে রাখা একটা ক্যারাভান। এটাই বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর আস্তানা। এই এলাকা আর মূল জঙ্গলের মধ্যে স্টিলের ঘন জাল। বেড়ার মতো করে ঘেরা। ক্যারাভানে ঢুকে নিজের ল্যাপটপটা টেনে নেন তিনি। খালি মনে হচ্ছে তিনি আর বেশিদিন নেই, কিছু কথা লিখে যাওয়া প্রয়োজন। যদিও উত্তরসূরী বলে কেউ নেই, কেউ কোনোদিন উত্তরসূরী হয়ে আসবে কিনা তাও জানা নেই। তবুও তিনি লিখবেন। কয়েক মুহূর্ত মনিটরের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ল্যাপটপটা ঠেলে সরিয়ে দেন তিনি। পাশ থেকে টেনে নেন বহু পুরোনো একটা ডায়েরি। ডায়েরির গায়ে বসানো একটা খোপ। তাতে প্রায় ক্ষয়ে আসা একটা পেন্সিল। এগুলো একটা মিউজিয়াম থেকে সংগ্রহ করা। এসবের ব্যবহার অনেক দিন বন্ধ হয়ে গেছিল। লিখতে শেখার প্রয়োজনও আর ছিল না। পড়তে আর টাইপ করতে শেখানো হত বাচ্চাদের। তিনিও ছোটোবেলায় লিখতে শেখেননি। অনেক বড়ো হয়ে নিজের ইচ্ছায় শিখেছিলেন। ক্লাস হত একটা মিউজিয়ামে। সেখানের স্মারক বিক্রির দোকানে পেয়েছিলেন এই ডায়েরি আর পেন্সিল। ডায়েরির পাতাগুলো ফাঁকাই থেকে গেছে।
মাথা নীচু করে কী যেন ভাবেন তিনি। তারপর প্রথম পাতা খুলে লিখতে থাকেন—
—প্রায় একশো তিরিশ বছর আগে সারা গ্যাবট নামে এক বিজ্ঞানী বলেছিলেন বিবর্তন কখনও পিছন দিকে হাঁটতে পারে না। তবে যে অঙ্গের ব্যবহার নেই বিবর্তনের পথে তা বাদ যেতেই পারে। আর বিবর্তন হতে যে সব সময় হাজার বা লক্ষ বছর লাগে তাও নয়। এটা পারিপাশ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। যত দিন যাচ্ছে বিবর্তনের গতি তত দ্রুত হচ্ছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ বোধহয় একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছিল। কাজের সুবিধার জন্য নিজের অনুকরণেই তৈরি করেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ধীরে ধীরে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়ে উঠল মানুষের থেকেও বেশি কর্মক্ষম। প্রথমে সাধারণ কিছু কাজ, পরে জটিল থেকে জটিলতর কাজ মানুষের থেকে অনেক বেশি দক্ষতায় করতে শুরু করল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই। ফলে মানুষের কাজের পরিধি কমে যেতে থাকল ধীরে ধীরে। উচ্চ পর্যায়ের কিছু কাজ ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকল না মানুষের মস্তিষ্কের জন্য। সে সব কাজ যাদের পক্ষে করা সম্ভব হত না, তারা কায়িক পরিশ্রমের উপর নির্ভর করতে শুরু করল। এমনকী শিল্পীরাও ছবি আঁকতে, সঙ্গীত সৃষ্টি করতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিতে শুরু করেছিল। শুনেছি আমার এক পূর্বপুরুষ নাকি শিল্পী ছিলেন, কিন্তু তাঁর কোনো সৃষ্টি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কোনো কারণে তাঁর আঁকা কোনো কিছুই কোথাও সংরক্ষিত নেই। তবে সেই পূর্বপুরুষের নাম অনুসারেই আমার নাম রাখা হয়েছিল এটা শুনেছি।
সে কথা থাক, ঠিক এরকম সময়ে মানুষের খুলির গঠনে এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা যেতে শুরু করল। হোমো সেপিয়ানরা আসার আগে যে হোমো নিয়ানডার্থালেনসিসদের উদ্ভব হয়েছিল, এদের খুলির গঠন ঠিক তাদের মতো। অবশ্য এমন নয় যে এ হোমো নিয়ানডার্থালেনসিসরা সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর হোমো সেপিয়েনদের আবির্ভাব ঘটেছিল, এই দুই প্রজাতি সহাবস্থান করেছিল বহু বহু বছর। বলা বাহুল্য এরকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের শুরু থেকেই আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল সমাজ থেকে। অত্যন্ত গোপনে ঘন জঙ্গলের ভিতর বিশেষভাবে তৈরি ঘেরা জায়গায় রাখা হত এদের। এই জঙ্গল এমনই একটি অঞ্চল। প্রথম প্রথম বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জীববিজ্ঞানীরা এদের দেখভাল করত, ধীরে ধীরে এদের সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়ার পর এদের মধ্যে যারা নারীজাতীয় ছিল, তারা নিজে থেকেই শিশুদের লালন পালনের ভার নিতে শুরু করেছিল। আজ প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল আমি একা এখানে এদের নিয়ে গবেষণার কাজে নিযুক্ত। ঠিক সংখ্যাটা জানি না, তবে পৃথিবীতে এখন এদের সংখ্যাই বেশি। যা বুঝেছি এরা বুদ্ধিমান, পাথর কেটে অস্ত্র বানিয়ে শিকার করে কাঁচা মাংস খায়, গাছের ফলমূলও খায়। ঠিক যেন এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ প্রাণী ফিরে গেছে তার প্রাগৈতিহাসিক রূপে।
সভ্যতার একটা ধাপে পৌঁছে মানব সভ্যতা তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, প্রযুক্তি নিয়ে পাড়ি দিয়েছে অন্য একটা গ্রহে, আর ফেলে যাওয়া এই গ্রহ যেন ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছে তার এত বছরের সভ্যতার ইতিহাস পেরিয়ে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে। হয়তো এখানেই শেষ এই নীলচে সবুজ গ্রহের সভ্যতার ইতিহাস।
আমি বৃদ্ধ, নতুন গ্রহে গিয়ে নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই এদের সঙ্গেই এখানে বসে যবনিকা পতন দেখব না হয়।
লেখা শেষ। নীচে স্বাক্ষর করার আগে সামান্য থমকে যান বৃদ্ধ। পদবী ব্যবহারের চল বহুদিন নেই। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নাম সিটিজেন গেব্রিয়েল। সেইভাবেই স্বাক্ষর করেছেন চিরটাকাল। আজ জীবনে প্রথম তিনি স্বাক্ষর করলেন—গেব্রিয়েল মোনে।
হঠাৎ জঙ্গলের দিক থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ ভেসে এল, যেন একদল প্রাণী আনন্দে কোলাহল করে উঠছে। এ তো নিওনিয়েনডার্থালরা করছে বলে মনে হচ্ছে। শক্তিশালী দূরবীনটা ঝট করে তুলে নিয়ে জঙ্গলের দিকে এগোলেন বৃদ্ধ জীববিজ্ঞানী।
ধরিত্রী কলোনি, মঙ্গলগ্রহ
পৃথিবীর হিসাবে ২১৫০
ছোট্ট একটা পাত্রে সাবধানে জল দিচ্ছিল পৃথা। জল বড়ো মূল্যবান এই গ্রহে। বহু পরিশ্রমে মঙ্গলগ্রহের বরফের চাঁই খুঁড়ে তাকে শোধন করে ব্যবহারযোগ্য জল নিষ্কাশন করা হয়। পৃথারা বলে জলের খনি। কিন্তু এই পাত্রে একটু জল তো দিতেই হবে তাকে। পাত্রে ছোট্ট সবুজ পাতার ফাঁকে ধপধপে সাদা একটা ফুল। পৃথিবী থেকে এই গাছের বীজ এনেছিল পৃথা, সেখানে এই ফুলের নাম ছিল টগর। ওই নামই থাক না হয়, মৃদু হাসে পৃথা। পৃথিবীর হিসেবে তিরিশ বছর হয়ে গেল, এই গ্রহের হিসেবে পনেরো। কেমন অবস্থা পৃথিবীর কে জানে, সেখান থেকে ছবি বা খবর আসা অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে।
অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল পৃথা, হঠাৎ স্পিকার চালু হল—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রহরী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক মুহূর্ত মঙ্গলের আকাশ পর্যবেক্ষণ করে এই প্রহরী। কান খাড়া করে শুনেই কেবিনের দরজার দিকে দৌড়ায় পৃথা। চোখের পলকে পরে নেয় কলোনির কৃত্রিম আবহাওয়ার বাইরে যাওয়ার মতো উপযুক্ত স্পেস স্যুট।
অনেকদিন পর কলোনির বাইরের অঞ্চলে এল পৃথা। এর মধ্যে আরও অনেকেই এসে জড়ো হয়েছে। ওবেলো হেসে হাত নাড়ল। ওদের সম্পর্কটা হয়তো দানা বাঁধতে পারত। পৃথাই রাজি হয়নি, কী হবে জটিলতা বাড়িয়ে।
—কীসের ইমপ্যাক্ট ওয়ানিং এল?—পালটা হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করে পৃথা।
—ওইদিকে পড়েছে—সূর্যাস্ত যেদিকে হচ্ছে সেদিকটা দেখায় ওবেলো—খুব প্রাচীন একটা মহাকাশযান মনে হচ্ছে। চিহ্ন দেখে বোঝা যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষের তৈরি। কেমন যেন চেনা লাগছে, কোথাও বোধহয় ছবি দেখে থাকব, কিন্তু মনে পড়ছে না।
পুরোনোই বটে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে যানটা। প্যারাবোলিক অ্যান্টেনাটা নীচের দিকে, রেডিয়ো অ্যান্টেনাটা সোজা উঁচিয়ে আছে উপর দিকে। পৃথিবী হলে বায়ুমণ্ডল আর মাধ্যাকর্ষণ মিলে চুরচুর করে গুঁড়িয়ে দিত এতক্ষণে। স্প্রেকট্রোমিটার আর ম্যাগনেটোমিটারটা যান থেকে আলাদা হয়ে দুইপাশে পড়ে আছে। কী এটা।? মঙ্গলের লাল ধুলো ভেদ করে হঠাৎ সোনালি রঙের কিছু চকচক করে ওঠে যানটার গায়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে পৃথার। কাঁপা গলায় বলে ওঠে—আমি বোধহয় এটা চিনতে পেরেছি ওবেলো।
খুব পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া ছিল সোনালি চাকতিটাতে। কীভাবে তাতে রেকর্ড করা অডিয়ো ফাইল বাজাতে হবে, কীভাবে তাতে সংরক্ষণ করা ছবিগুলো আর অডিয়ো ফাইল বিষয়ক তথ্য উদ্ধার করা যাবে, সব সুন্দরভাবে বলা ছিল। মঙ্গলগ্রহের অত্যাধুনিক ল্যাবের মেঝেতে পা মুড়ে বসে আছে কিছু তুখোড় বিজ্ঞানী। সামনে দেওয়ালজোড়া স্বচ্ছ পর্দায় ভেসে উঠছে ছবি। পৃথিবীর নানা দৃশ্য। এই এক ঝাঁক বাচ্চা পিকনিক করছে, ওই তো মেলায় বেলুন উড়ছে কতগুলো, কত সবুজ, কত লাল, হলদে, গোলাপি, নীল রং। সত্যি এত রং ছিল ওই বাসযোগ্যতা হারানো গ্রহটার! এবার সুর বাজছে ওই সোনালি চাকতিটা থেকে। ঢেউয়ের আওয়াজ, পাখি ডেকে উঠল কতকগুলো। পাতার মধ্যে দিয়ে হাওয়া বয়ে গেলে বুঝি এমন শব্দ হয়?
লাল গ্রহের আকাশে অন্ধকার নেমেছে। ধরিত্রী কলোনির ল্যাব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভৈরবী রাগিণী। বিজ্ঞানী ওবেলো শিল্পীর নামটা পড়ে শোনায়—ইনি যে তোমার দেশের মানুষ পৃথা, নাম কেশরবাঈ কেরকর। সমগ্র গ্রহ যেন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বিজ্ঞানীরা বুঝতেও পারেন না বহুদিন বাদে জল নেমেছে তাঁদের চোখ বেয়ে।
শেষ কাজটাও মিটল ভয়েজারের। তার সোনালি চাকতি সে পৌঁছে দিয়েছে ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের কাছে। তাদের জানিয়েছে পৃথিবী নামের এক অপরূপা গ্রহের কথা।
ঘন জঙ্গল, ভারত মহাদেশ
২১৫০
শক্তপোক্ত স্টিলের জালের এপারে দূরবীন চোখে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। তাঁর পা কাঁপছে।
ওপারে ঘন জঙ্গলের ফাঁকে প্রায় মনুষ্যাকৃতি একটি প্রাণী নিবিষ্টমনে কিছু করছে। তার খুলির গঠন অবশ্য মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা। পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী হোমো নিয়ানডার্থালেনসিসের সঙ্গেই তার মিল বেশি। সে নানারকম আওয়াজ করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে বটে, তবে ভাষা সম্বন্ধে কোনো ধারণা তার নেই। এখন দৃষ্টি একাগ্র করে দুটো চ্যাপটা পাথরের টুকরো সে ঘষছে। মাঝে মাঝে ঘষা খেয়ে কেমন উজ্জ্বল ফুলকি বেরিয়ে আবার নিভে যাচ্ছে। তাতে উৎসাহ পেয়ে প্রাণীটি আরও জোরে ঘষা লাগছে পাথরের টুকরো দুটোতে। হঠাৎ নিভে না গিয়ে কয়েকটা ফুলকি ছিটকে পড়ে মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো ঘাসে। দপ করে ধরে যায় শুকনো ঘাসগুলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রাণীটি। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে। তাকে ঘিরে থাকা তার সঙ্গীরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
ফিরে চলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। তাঁর ডায়েরিতে আরও একটা লাইন যোগ করবেন তিনি। লিখবেন—আর ভয় নেই হে নীল গ্রহ, তোমার ফিনিক্সরা এসে গেছে।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, বুমা ব্যানার্জী দাস