বাবলা বীজের সাহিত্যিক
লেখক: মূল রচনা: উরসুলা কে. লে গুইন, অনুবাদ: সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এবং প্রাণীভাষাবিদ সমিতির পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত আরও কিছু অংশ
পিঁপড়ের ঢিপিতে পাওয়া পাণ্ডুলিপি
কলোনির গভীরের একটা স্তর থেকে বেরিয়ে আসা এক সরু, আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় বীজাণুমুক্ত বাবলা বীজের সারির উপর স্পর্শগ্রন্থি নিঃসৃত রস দিয়ে কথাগুলো লেখা ছিল। বীজগুলোর সুচারু সজ্জা লক্ষ করেই তদন্তকারী প্রথম আকৃষ্ট হন।
বার্তাগুলো অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। যেটুকু অনুবাদ করা গেছে তা নির্ভুল নয় এবং অনেকাংশে অনুমানভিত্তিক। কিন্তু স্রেফ অন্যান্য উদ্ধার করা পিঁপড়ে লিপির নমুনার সঙ্গে এর আমূল পার্থক্যের কারণেই এই বিশেষ নমুনাটি নিয়ে চর্চা হওয়া দরকার।
বীজ ১-১৩
[কারো] শুঁড় ছোঁব না। বোলাবো না। শুকনো বীজে মনের মাধুরী উজাড় করে দেবো। [আমি] মরলে হয়তো [কেউ] খুঁজে পাবে। এই শুকনো কাঠ ছুঁয়ে [দেখো]। ডাকছি! এই যে [আমি]!
আবার, এই অনুচ্ছেদের বিকল্প পাঠ এরকমও হতে পারে:
[কারো] শুঁড় ছুঁয়ো না। বুলিও না। শুকনো বীজে মনের মাধুরী উজাড় করে দাও। [তুমি] মরলে হয়তো [কেউ] খুঁজে পাবে। এই শুকনো কাঠ ছুঁয়ে [দেখো]। ডাক ছাড়ো: এই যে [আমি]!
আমাদের চেনা সমস্ত পিঁপড়ে-উপভাষায় ক্রিয়ার পুরুষ বলতে শুধুমাত্র উত্তম পুরুষের বহুবচন, আর প্রথম পুরুষের একবচন ও বহুবচনের নির্দিষ্ট রূপ আছে। আলোচ্য লিপিতে ক্রিয়ার মূল অংশটুকুর ব্যবহার রয়েছে। তাই উপরের অনুচ্ছেদটা আত্মজীবনীও হতে পারে, ম্যানিফেস্টো বা ইস্তাহার জাতীয় কিছুও হতে পারে। নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই।
বীজ ১৪-২২
সুড়ঙ্গ বড়ো দীর্ঘ পথ। সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়নি যে পথে, সে পথ দীর্ঘতর। কোনো সুড়ঙ্গ সেই না-খোঁড়া পথের শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। না-খোঁড়া পথ আমরা দশ দিনে [মানে অসীম সময়ে] যতদূর যেতে পারি, তার চেয়েও দূর পর্যন্ত যায়। জয় হোক!
‘জয় হোক’ বলে যে চিহ্নটার অনুবাদ করা হয়েছে সেটা পিঁপড়েদের সাধারণ সম্ভাষণ ‘মহারানি জিন্দাবাদ!’ বা ‘মহারানির জয় হোক!’-এর অর্ধেক। কিন্তু ‘মহারানি’ সূচক চিহ্নটা এখানে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বীজ ২৩-২৯
বিদেশি শত্রু পিঁপড়েদের হাতে পিঁপড়ে যেমন মারা যায়, তেমনি পিঁপড়ে ছাড়া পিঁপড়েও মারা যায়। কিন্তু পিঁপড়ে ছাড়া থাকা মধুর মতোই মিষ্টি।
কোনো পিঁপড়ে নিজের কলোনি ছেড়ে অন্য কলোনিতে গিয়ে পড়লে সাধারণত তাকে মেরে ফেলা হয়। অন্য পিঁপড়েদের থেকে আলাদা হয়ে কোনো পিঁপড়ে একা একা দু-একদিনের বেশি বাঁচতে পারে না। তবে “পিঁপড়ে ছাড়া” কথাটা হল এই অনুচ্ছেদে মুশকিলের জায়গা। আমরা এরকম জায়গায় “একা” বলতাম, কিন্তু পিঁপড়েদের ভাষায় “একা” কথাটার কোনো প্রতিশব্দ বা চিহ্ন নেই।
বীজ ৩০-৩১
সব ডিম খেয়ে ফেলা হোক! মহারানি উঁচুতে যাক!
৩১ নম্বর বীজের অনুবাদ নিয়ে এর মধ্যেই অনেক বিতর্ক হয়ে গেছে। প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কেবল এই শেষ, চূড়ান্ত আহ্বানের আলোতেই এর আগের প্রতিটা বীজের লেখার অর্থ সম্পূর্ণভাবে বোঝা যায়। ড. রসবোন বলেছেন, এখানে ডানাবিহীন, বন্ধ্যা স্ত্রী কর্মী লেখকটি ডানাওয়ালা পুরুষ হওয়ার নিষ্ফল আশা ব্যক্ত করছে। এক নতুন রানির সঙ্গে উপর দিকে উড়ে গিয়ে বৈবাহিক উড্ডয়নের পর নতুন কলোনি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে। উদ্ধার হওয়া লিপি থেকে অবশ্যই এরকম পাঠের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। কিন্তু আমরা নিশ্চিত যে, লিপির কোনো অংশেই এর সমর্থনে কিছু পাওয়া যায় না। বিশেষ করে এর ঠিক আগের ৩০ নম্বর বীজে এর সরাসরি বিপরীত ভাব ব্যক্ত হয়েছে। “সব ডিম খেয়ে ফেলা হোক!”- এই পাঠ অপ্রত্যাশিত হলেও বিতর্কের ঊর্দ্ধে।
আমাদের প্রস্তাব হল এই যে, ৩১ নম্বর বীজের অর্থ উদ্ঘাটনে যে ধন্দ, তার মূলে রয়েছে ‘উঁচুতে’ শব্দটার জাতিকেন্দ্রিক অনুবাদের প্রবণতা। আমরা ‘উঁচুতে’ বলতে ‘ভালো’ বুঝি। একজন পিঁপড়ে তা বোঝে না, অন্তত বেশির ভাগ সময়ে বোঝে না। ‘উপর’ থেকে সে খাবার পায় ঠিকই, কিন্তু ‘নীচেই’ হল তার নিরাপত্তা, শান্তি, ও বাসস্থান। ‘উপরে’ বা ‘উঁচুতে’ আছে জ্বলন্ত সূর্য; রাতের হিম ঠান্ডা; সুড়ঙ্গের নিরাপত্তার অভাব; নির্বাসন; মৃত্যু। তাই আমাদের প্রস্তাব হল, এই অদ্ভুত লেখক তার নির্জন সুড়ঙ্গের আড়ালে প্রকৃতপক্ষে একজন পিঁপড়ের পক্ষে যা সবচেয়ে বড়ো অধর্মের কথা, তা-ই বলতে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। মানুষের ভাষায় তাই ৩০ ও ৩১ নম্বর বীজের সঠিক অর্থ হবে:
“সব ডিম খেয়ে ফেলো! মহারানি নিপাত যাক!”
পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কারের সময়ে ৩১ নম্বর বীজের পাশে এক ক্ষুদ্র কর্মী পিঁপড়ের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। সম্ভবত কোনো সৈনিক পিঁপড়ে তার মাথাটিকে ধড় থেকে ছিঁড়ে দিয়ে যায়। বাবলার বীজগুলো যত্ন করে কয়েকখানা কবিতার স্তবকের আকারে সাজানো ছিল; সেগুলো কেউ এলোমেলো করেনি। (সৈনিক পিঁপড়েরা নিরক্ষর হয়, তাই এই ঘাতক পিঁপড়েটিও সম্ভবত বেকার, অপাচ্য কতগুলো বীজে বৃথা নজর দেয়নি।) গোটা কলোনিতে একটিও পিঁপড়ে বেঁচে ছিল না। বাবলা বীজের লেখকের মৃত্যুর কিছু পরে পাশের এক কলোনির সঙ্গে যুদ্ধে তারা মারা যায়।
জি. ডার্বে, টি. আর. বার্ডল
একটি অভিযানের ঘোষণা
জলের তলায় ছবি তুলতে সক্ষম ভিডিয়ো ক্যামেরার ব্যবহারের ফলে পেঙ্গুইন পাঠ এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। ফিল্মের গতি কমিয়ে তাদের ভাষার সাবলীল অঙ্গভঙ্গির খুঁটিনাটি স্পষ্টভাবে বোঝার চেষ্টা করা যায়। চাইলে একটা ফিল্মকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার দেখাও যায়। অবিরাম পুনরাবৃত্তি ও ধৈর্য সহকারে চর্চা চালিয়ে গেলে এই গর্বিত ও প্রাণবন্ত সাহিত্যের অনেকগুলো উপাদানকেই বুঝতে পারব আশা করি; যদিও এর সূক্ষ্ম তারতম্য ও সারবত্তার নাগাল হয়তো আমরা কখনও পাবো না।
অধ্যাপক ডোবি, পেঙ্গুইন অভিব্যক্তির সঙ্গে মেটে রাজহাঁসদের অভিব্যক্তির ক্ষীণ সাদৃশ্য চিহ্নিত করে প্রথম আনুমানিক পেঙ্গুইন অভিব্যক্তি-কোশ নির্মাণের পথ করে দেন। তার আগে পর্যন্ত ডলফিনের সঙ্গে যে হাতে গোনা কয়েকটা সাদৃশ্যের কথা বলা হত, সেগুলো খুব একটা কার্যকর হয়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তিকর প্রমাণিত হয়েছে।
বাস্তবিক, যে ভাষা আগাগোড়া ডানা ও গলার ভঙ্গি এবং হাওয়ার স্রোতে লেখা হয়, তা কীভাবে বেঁটে গলা, পাখনা-ডানার অধিকারী জল-সাহিত্যিকদের কবিতার জট খুলবে এই নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। কিন্তু হাজার হলেও পেঙ্গুইনরা যে আদতে পাখি, এই সহজ কথাটা মনে রাখলে এই যোগসূত্র আবিষ্কার করতে আমাদের এত বেগ পেতে হত না।
ডলফিনের সঙ্গে পেঙ্গুইনের রূপের সাদৃশ্য দেখেই এটা ধরে নেওয়া আমাদের ভুল হয়েছে যে বিষয়বস্তুতেও সেই সাদৃশ্য মিলবে, আর তা মেলেওনি। অবশ্যই দুই ভাষায় দেখি এক রকম বুদ্ধির ঝলক, একই রকম কৌতুক, সৃষ্টিশীলতা, আর অননুকরণীয় গরিমার ছাপ। মাছেদের হাজার হাজার ভাষার সাহিত্যে হাসির ছোঁয়া বিরল; সামান্য কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া গেলেও তা সরল ও অমার্জিত। অন্যদিকে হাঙর ও টার্পন মাছের দুর্দান্ত গাম্ভীর্য যে-কোনো তিমি বা ডলফিনের আনন্দ-উচ্ছল তেজ থেকে একেবারেই আলাদা। ডলফিনের আনন্দ, তেজ ও কৌতুকের সব ক’টিই পেঙ্গুইনে পাওয়া যায়; এমনকি অনেক সূক্ষ্মরুচি সিলমাছও এই রসে বঞ্চিত নন। গরম রক্তের প্রাণীদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু মস্তিষ্ক ও গর্ভের গঠনের পার্থক্য তফাৎ গড়ে দেয়। ডলফিনরা যে ডিম পাড়ে না, এই সরল সত্যের উপরেই গড়ে উঠেছে আসমান-জমিন ফারাক।
যেদিন অধ্যাপক ডোবি আমাদের মনে করিয়ে দিলেন যে পেঙ্গুইনরা আদতে পাখি, যে তাদের সাঁতারকে সাঁতার না বলে “জলের ভিতর ওড়া” বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত, সেদিন থেকেই প্রাণীভাষাবিদের পক্ষে পেঙ্গুইনদের সামুদ্রিক সাহিত্যকে সঠিক অবস্থান থেকে বোঝার চেষ্টা করা সম্ভব হল। সেদিন থেকেই আমরা ফিল্মে ধরে রাখা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেকর্ডিং থেকে আসল অর্থ ও ছন্দের উদ্ধারের কাজ আরম্ভ করতে পারলাম।
কিন্তু অনুবাদের সমস্যা আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
এডেলির ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। ০° সেলসিয়াস ঠান্ডায় প্ল্যাঙ্কটনে ভরা, ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সমুদ্রে তাদের দলবদ্ধ নৃত্যালাপ রেকর্ড করতে যাওয়ার অনেক ঝুঁকি, কিন্তু রস আইস ব্যারিয়ার সাহিত্যচক্রের অধ্যবসায়ের ফল মিলেছে শরতের গান সংগ্রহের ‘হিমশৈলের তলদেশে’-র মতো কিছু অনবদ্য স্তবকের উন্মোচনে। লেনিনগ্রাদ ব্যালের সদস্য আনা সেরেব্রাকোভার উপস্থাপনার কল্যাণে স্তবকটি আজ বিখ্যাত। কোনো বাক্যাশ্রয়ী অনুবাদ শ্রীমতি সেরেব্রাকোভার উপস্থাপনার ধারেকাছে আসতে পারবে না; কারণ, মূল প্রদর্শনীটির বহুমুখিতা বর্ণনা করার ক্ষমতা কোনো লিপির নেই। শ্রীমতি সেরেব্রাকোভা লেনিনগ্রাদ ব্যালে কোম্পানির পুরো দলকে মঞ্চে নামিয়ে সুন্দরভাবে সেই বহুমুখী শিল্পকীর্তিটি উপস্থাপন করেছেন।
বাস্তবিক, যাকে আমরা এডেলির ‘অনুবাদ’ বলে থাকি—বা যে-কোনো দলবদ্ধ নৃত্যালাপের অনুবাদ বলতে যা বোঝানো হয়, তা প্রকৃতপক্ষে টিপ্পনি মাত্র। সুর ছাড়া স্বরলিপি। ব্যালে উপস্থাপনাটিই প্রকৃত অনুবাদ। শব্দে লেখা কিছু দিয়েই ব্যাপারটাকে ঠিকঠাক ধরা যাবে না।
তাই এই সভায় উপস্থিত সভ্যদের বিরক্তি ও উপহাসের পাত্র হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই আমি একটি প্রস্তাব দিচ্ছি। শিল্পী ও অপেশাদারদের কথা বাদ দিলে পেশাদার প্রাণীভাষাবিদের পক্ষে পেঙ্গুইনদের গতিশীল সামুদ্রিক রচনার চর্চা থেকে তেমন কিছু পাওয়ার নেই। তদুপরি এডেলি আমাদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সরল ও মনোহর হলেও এম্পারার পেঙ্গুইনের পাঠোদ্ধার করতে পারলে আমাদের অনেক বেশি লাভ।
উপস্থিত সভ্যরা এ’কথা শুনেই হয়তো আঁতকে উঠেছেন। এম্পারার! পেঙ্গুইনের সমস্ত উপভাষার মধ্যে সবচেয়ে স্বতন্ত্র ও সবচেয়ে কঠিন! স্বয়ং অধ্যাপক ডোবি যে উপভাষার সম্পর্কে বলেছেন, “এম্পারার পেঙ্গুইনদের সাহিত্য খোদ আন্টার্কটিকার হিমশীতল হৃদয়ের মতোই ভীতিপ্রদ ও দুর্গম। হতে পারে তার সৌন্দর্য অলৌকিক; কিন্তু সেই সৌন্দর্য আমাদের উপভোগের জন্য নয়।”
হবেও বা। এই কাজ কত কঠিন আমি জানি। এম্পারার পেঙ্গুইনদের মনস্তত্ত্বও একটা চ্যালেঞ্জ। তারা অন্য যে-কোনো পেঙ্গুইনের চেয়ে গম্ভীর ও নির্লিপ্ত। কিন্তু আপাতভাবে স্ববিরোধী মনে হলেও এই নির্লিপ্তির মধ্যেই আমি আশার আলো দেখতে পাই। এম্পারার পেঙ্গুইনও দলবদ্ধ জীব। প্রজননের সময় তারা ডাঙায় উঠে এডেলির মতো কলোনি বানিয়ে থাকলেও সেই সমস্ত কলোনি আয়তনে অনেক ছোটো ও অনেক শান্ত হয়। এম্পারারদের কলোনির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে যে বন্ধন, তা প্রকৃতিগতভাবে যত না সামাজিক, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত। অর্থাৎ এম্পারার পেঙ্গুইন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। তাই আমি প্রায় নিশ্চিত যে তাদের সাহিত্যে পাওয়া যাবে একক রচয়িতাদের কীর্তি; সমবেত প্রয়াস নয়। ফলে তা মানুষের ভাষায় সহজে অনুবাদযোগ্য হবে। গতিনির্ভর হবে ঠিকই, তবু বিস্তৃত স্থানে দ্রুতগতিতে ঘটমান বহুসুরছন্দসমন্বিত সামুদ্রিক যৌথ রচনার থেকে হবে সম্পূর্ণ পৃথক। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং অনেক বেশি সৎ ভাবানুবাদ অবশেষে সম্ভব হবে।
তো আমার সমালোচকদের কী মত? কুমেরুর শীতের অন্ধকারে, তুষার ঝড়ের −৬০° ঠান্ডায় জমাট বরফের উপর পায়ের ফাঁকে ডিম নিয়ে বসে থাকা কয়েকজন অদ্ভুত পাখির অদ্ভুত কবিতা রেকর্ড করার আশাটুকু মাত্র সম্বল করে আমরা কি তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্ধকার কোজিয়ার অন্তরীপে −৬০° ঠান্ডা তুষার ঝড়ের উদ্দেশে রওনা হব?
আমার মতে, যাওয়াটা আমাদের কর্তব্য। কারণ অধ্যাপক ডোবির মতোই আমার মন বলছে যে, ওদের কবিতা এই পৃথিবীর বুকে আমাদের খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে অপার্থিব বস্তু বলে প্রমাণিত হবে।
আমার যে সহকর্মীদের মনে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও নান্দনিকতার খাতিরে ঝুঁকি নেওয়ার ঝোঁক আছে, তাঁদেরকে বলি, কল্পনা করুন: বরফ, তিরের বেগে বইছে তুষারের স্রোত, অন্ধকারে ঝড়ের অবিরাম গর্জন। সেই নিশীথ মরুভূমির বুকে গুটিসুটি জড়ো হয়ে বসে আছে একদল কবি। তাদের অনেকদিন খাওয়া হয়নি; কয়েক সপ্তাহ ধরে চলবে তাদের উপবাস। প্রত্যেকের জড়ো করা দু’পায়ের উপর, তলপেটের পালকের উষ্ণতায় ঠান্ডার মারাত্মক কামড় থেকে সুরক্ষিত রয়েছে একটা করে বড়োসড়ো ডিম। এই কবিরা পরস্পরকে দেখতে পায় না, শুনতেও পায় না। তারা কেবল পরস্পরের শরীরের উষ্ণতার ছোঁয়াচটুকু পায়। তা থেকেই তাদের কবিতা, তাদের শিল্প। গতিনির্ভর অন্য সাহিত্যের মতো এই সাহিত্যও নিঃশব্দ; কিন্তু সেই সমস্ত সাহিত্যের বিপ্রতীপে এর ভাবভঙ্গি অত্যন্ত ধীর, অতি মৃদু। একটু পালক ফোলানো, একটু ডানা নাড়ানো; পাশের জনের শরীরের গরম ছোঁয়া। অবর্ণনীয় হতাশার অন্ধকার একাকিত্বের মাঝে একটু আশ্বাস। অবশতার মধ্যে অনুভূতি ও মৃত্যুর মাঝে জীবনের আশ্বাস।
ইউনেস্কোর বদান্যতায় যথেষ্ট অনুদান পেয়েছি। অভিযানের প্রস্তুতিও শেষ। এখনও চারজনের জায়গা খালি আছে। বৃহস্পতিবার আন্টার্কটিকা রওনা দেবো। কেউ যদি আসতে চান, সানন্দে আসুন!
ডি. পেত্রি
সম্পাদকীয়: প্রাণীভাষাবিদ সমিতির অধ্যক্ষের কলমে
ভাষা কাকে বলে?
প্রাণীভাষাবিদ্যায় কেন্দ্রীয় এই প্রশ্নের জবাব বিজ্ঞানের এই শাখাটির অস্তিত্ব থেকেই যথেষ্ট সন্তোষজনকভাবে পাওয়া যায়। ভাষা হল ভাবের প্রকাশ। এই স্বতঃসিদ্ধটি আমাদের যাবতীয় তত্ত্ব ও গবেষণার ভিত এবং যাবতীয় আবিষ্কারের উৎস। আবার সেই সমস্ত আবিষ্কারকে এই স্বতঃসিদ্ধের প্রমাণ হিসেবেও গণ্য করা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত একটি পৃথক প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনও দিইনি: শিল্পকলা কাকে বলে?
এই প্রশ্নকেই শিরোনাম করে তলস্তয় একটি বই লেখেন এবং সেখানে স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে এর উত্তর হিসেবে বলেন: শিল্পকলাও ভাবের প্রকাশ। আমার মনে হয় প্রাণীভাষাবিদরা এই উত্তরটিকে যথেষ্ট গবেষণা ও সমালোচনা ছাড়াই মেনে নিয়েছেন। এর প্রমাণ চাইলে জিজ্ঞেস করতে হবে, প্রাণীভাষাবিদরা কেন কেবল প্রাণীদের নিয়েই চর্চা করেন?
কেননা উদ্ভিদ ভাব প্রকাশ করে না।
উদ্ভিদ ভাব প্রকাশ করে না; এ’কথা ঠিক। অতঃপর উদ্ভিদের ভাষা নেই। বেশ কথা; আমাদের মূল স্বতঃসিদ্ধ থেকে আসে এই সিদ্ধান্ত। অতঃপর উদ্ভিদের শিল্পকলাও নেই। কিন্তু দাঁড়ান! এই কথাটি কিন্তু আমাদের মূল স্বতঃসিদ্ধ থেকে এল না; বরং এল তলস্তয়ের অপরীক্ষিত অনুসিদ্ধান্ত থেকে।
যদি শিল্পকলার সঙ্গে ভাব প্রকাশের অলঙ্ঘনীয় সম্পর্ক না থেকে থাকে, তো?
বা, যদি কোনো কোনো শিল্পের দ্বারা ভাব প্রকাশিত হয়, আর কোনো কোনো শিল্পের দ্বারা না হয়, তো?
আমরা যেহেতু প্রাণী, সক্রিয় ও আদতে শিকারী, তাই আমরা (স্বাভাবিকভাবেই) সক্রিয়, আগ্রাসী, আত্মপ্রকাশশীল শিল্পের খোঁজ করি, আর খুঁজে পেলে সেই শিল্পকে চিনতে পারি। চেনার এই ক্ষমতা এবং এর কদর করার যোগ্যতা অর্জন আমাদের অতি সাম্প্রতিক এবং অতি গৌরবজনক কীর্তি।
কিন্তু আমি মনে করি যে, প্রাণীভাষাবিদ্যায় বিগত কয়েক দশকের বিস্ময়কর অগ্রগতি সত্ত্বেও আমরা এই নতুন আবিষ্কারের যুগে পদার্পণ করছি মাত্র। স্বতঃসিদ্ধের দাসত্বে আমরা যেন আটকে না পড়ি। আমরা এখনও আমাদের সামনের বিস্তীর্ণ দিগন্তের দিকে চোখ তুলে চাইনি। আমরা উদ্ভিদ শিল্পের অকল্পনীয় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হইনি।
যদি কোনো প্রকাশবিমুখ, উদ্ভিজ্জ শিল্পকলার অস্তিত্ব থাকে, তাহলে তার উদ্ধার করতে গেলে আমাদেরকে আমাদের বিজ্ঞানের একেবারে কেন্দ্রীয় উপাদানগুলো নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে, আর একটা গোটা শাস্ত্র উদ্ভাবন করতে হবে।
কারণ বেজির হত্যারহস্য, ব্যাঙের ইরোটিকা, বা কেঁচোর সুড়ঙ্গ মহাকাব্য বোঝার তত্ত্ব ও কৌশল কাজে লাগিয়ে নারকেল বা ধুঁধুল গাছের শিল্পকলার উদ্ধার অসম্ভব।
এই তথ্য কলকাতায় ড. শ্রীবাসের বীরোচিত ব্যর্থতা থেকে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তিনি টাইম ল্যাপস ফোটোগ্রাফির সাহায্যে সূর্যমুখীর অভিধান তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হতই, কারণ তিনি গতিনির্ভর পদ্ধতিতে কাজ করছিলেন। সেই পদ্ধতিতে কচ্ছপ, ঝিনুক বা স্লথের প্রকাশশীল শিল্পের উদ্ধার করা সম্ভব। তাঁর চোখে ধরা পড়ল গাছের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অতি ধীর গতি, আর সেটুকুই তিনি সমাধানযোগ্য সমস্যা বলে বুঝলেন।
আসল সমস্যা ছিল অনেক বড়ো। যে শিল্পের খোঁজ তিনি করছিলেন তার অস্তিত্ব যদি থাকে, তবে তা হবে প্রকাশবিমুখ এবং খুব সম্ভবত গতিবিমুখ। এমন হওয়া খুবই সম্ভব যে, সমস্ত প্রাণীর শিল্পের ধারক ও অন্যতম মূলগত উপাদান যে সময়, উদ্ভিদের শিল্পে তার আদৌ কোনো ভূমিকা নেই। উদ্ভিদের রচনা হয়তো বাঁধা হয় অনন্তের ছন্দে। আমরা জানি না।
আমাদের জানা নেই। আমরা কেবল এইটুকু জানি যে, উদ্ভিদের সম্ভাব্য শিল্প অবশ্যই প্রাণীদের শিল্প থেকে আদ্যোপান্ত পৃথক। সেই শিল্পের প্রকৃতি কেমন হবে আমাদের পক্ষে বলা অসম্ভব; আমরা এখনও তার নমুনা আবিষ্কার করতে পারিনি। তবু আমি যথেষ্ট নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি যে তার অস্তিত্ব আছে, আর যখন তা আবিষ্কৃত হবে তখন দেখা যাবে যে সেই শিল্প ক্রিয়ামূলক নয়, বরং প্রতিক্রিয়ামূলক। ভাবের প্রকাশ নয়, বরং ভাবের আত্মীকরণ। তা হবে আমাদের চেনা ও জানা সমস্ত শিল্পকলার ঠিক বিপরীত; আমাদের জানা প্রথম নিষ্ক্রিয় শিল্প।
আমাদের পক্ষে কি আদৌ এমন জিনিসকে জানা সম্ভব? কোনোদিনও বোঝা সম্ভব?
এই কাজ হবে অকল্পনীয় রকম দুরূহ। এ’বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবু আমরা যেন হতাশ না হই। মনে রাখবেন, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও অনেক শিল্পী বিশ্বাস করতেন না যে, মানুষের মস্তিষ্ক কোনোদিন ডলফিনের ভাষাও বুঝতে পারবে, বা সেই ভাষা বোঝার প্রয়োজন আছে! আজ থেকে এক শতাব্দী পরে হয়তো আমাদের ধারণাগুলোও সেরকমই উপহাসের পাত্র হয়ে উঠবে। কোনো তরুণ ভাষাবিদ তাঁর বন্ধু তাত্ত্বিককে বলবেন, “ভাবতে পারো, ওরা বেগুন লতা পর্যন্ত পড়তে পারত না?” তারপর আমাদের অজ্ঞতায় স্নেহের হাসি হেসে তাঁরা হয়তো সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে লাইকেনের সদ্য আবিষ্কৃত শিল্প উপভোগ করতে যাবেন।
আর তাঁদের সঙ্গে বা তাঁদের পর কি আসবেন না সেই শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রী, প্রথম ভূভাষাবিদ, যিনি লাইকেনের মিহি, ক্ষণস্থায়ী গীত উপেক্ষা করে পড়বেন তার নীচের পাথরের আরও প্রকাশবিমুখ, আরও নিষ্ক্রিয়, কালের প্রবাহের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, শীতল আগ্নেয় কবিতা; এক একটি খণ্ডে এক একটি ভাব; কত যুগ আগে, মহাকাশের বিপুল একাকিত্বে ও বিপুলতর সৌহার্দ্যে, স্বয়ং পৃথিবীর দ্বারা ব্যক্ত!
The Author of the Acacia Seeds and Other Extracts from the Journal of the Association of Therolinguistics গল্প অবলম্বনে।
লেখিকা: উরসুলা কে. লে গুইন
প্রথম প্রকাশ: Fellowship of the Stars: Nine Science Fiction Stories (১৯৭৪)
Tags: অনুবাদ, অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, উরসুলা কে. লে গুইন, কল্পবিজ্ঞান, সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়