এত সুন্দর, এত অন্ধকার
লেখক: অনুষ্টুপ শেঠ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“রুহানা!”
মণীন্দ্র ডাকছে ওকে। কিছু দরকার নিশ্চয়! লোকটা এমনিতে চুপচাপ, অকারণ বাজে বকে না। রুহানার ক্লান্ত লাগছিল, কিন্তু ডাকটা অগ্রাহ্য করা উচিত হবে মনে হল না।
তা ছাড়া, অগ্রাহ্য করতে চাইলেও করতে পারত না বোধ হয়। ‘সৌজন্য’ বাধা দিত।
সোজা সরলরেখায় রাস্তা, দুপাশে বাড়িগুলো পর পর একই রকম দেখতে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় লেগো দিয়ে বানানো খেলনা শহর। তবে রং আলাদা। বাসিন্দারা নিজেদের পছন্দের ডিজাইন আর রঙের কম্বিনেশন চয়েস করতে পারে, তবে আশপাশের বাড়ির সঙ্গে বেখাপ্পা হলে স্যাংশন হয় না।
রুহানার বাড়িটা আইসক্রিমের মতো সাদা আর গোলাপি ডোরাকাটা। আর তার কিছুটা আগে, রাস্তার এপাশে মণীন্দ্রের বাড়িটা সাদার উপর কালো দিয়ে জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি কাটা। বেশ আভিজাত্য আছে। মণীন্দ্রের চেহারাতেও আছে সেটা, মুখ চোখ বেশ কাটা কাটা, সুন্দর। বয়স অনেক হয়েছে, সত্তর তো বটেই! তবে এখনও টানটান ফিট।
মিষ্টি হাসল রুহানা। যে-কোনো অন্য মানুষকে দেখলেই তার মুখে এই হাসিটা ফুটে ওঠে।
“বলো, কী ব্যাপার?”
“একবার পপিকে দেখে যাবে প্লিজ? আমি বুঝতে পারছি না ঠিক, কেমন ঝিমোচ্ছে।”
পপিকে চেনে রুহানা। ঝাপুরঝুপুর চুলের একটা কুকুর। বেঁটে বেঁটে পা, ফুলো ল্যাজ। খুবই আদুরে দেখতে।
“চলো, দেখি কী হল।”
কুকুরটা জানলার সামনের গদিতে গোল হয়ে পড়ে ছিল। রুহানা নেড়েচেড়ে দেখল, পপি আপত্তি করল না।
“শেষ কখন খেয়েছে?”
“খেয়ে… ও আচ্ছা। সকাল নটায়, যেমন রোজ দিই।”
পিঠ থেকে ব্যাগ নামায় রুহানা। ছোটোখাটো যন্ত্রপাতি ওর সঙ্গেই থাকে সব সময়ে। অভ্যস্ত হাতে পপিকে চিত করে ফেলে সে, হাত পা আটকে রাখার ব্যবস্থা করে।
মণীন্দ্র খুবই চিন্তিত বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু এই অবস্থায়ও মুখে আলগা হাসি এনে সে জানতে চায়, রুহানা চা-কফি কোনটা খাবে?
“ঠান্ডা কিছু নেই?”
“আছে, অরেঞ্জ ড্রিঙ্ক। দেব?”
তাই দিতে বলে রুহানা। চা বা কফি কোনোটাই ওর পোষায় না। সেকেলে পানীয়, এই অরেঞ্জ বা অ্যাপল ড্রিঙ্কের মতো চনমনে করে দেওয়ার ক্ষমতা ওগুলোর নেই। মণীন্দ্রের মতো বয়স্করা ওসব খায়। ওরা না।
এই তো, সমস্যাটা পেয়ে গেছে। রুহানা পপির পেটের উপর ঝুঁকে পড়ে।
অরেঞ্জ ড্রিঙ্ক নিয়ে যখন মণীন্দ্র ফিরে এল রুহানার কাজ শেষ। উঠে হাতে স্প্রেয়ার দিয়ে পরিষ্কার করে ড্রিঙ্কের গ্লাসটা হাতে তুলে নিল সে, মুখে বলল, “সকেটের অ্যালাইনমেন্ট বিগড়ে গেছিল, তাই চার্জ হচ্ছে না আসলে ঠিক করে। ঠিক করে দিয়েছি, এবার চার্জে দাও আবার। নর্মাল হয়ে যাবে।”
মণীন্দ্রের চোখ ঝলমল করে উঠল, পপিকে তুলে নিয়ে গিয়ে চার্জিং-পয়েন্টে কানেক্ট করে দিল সে। সারাই যে নিখুঁত হয়েছে তা প্রমাণ করে রুহানার বেরিয়ে আসার আগেই পপি আবার স্বাভাবিক গলায় ডাকাডাকি শুরু করে দিল। এই ডাকটাই রুহানার জানলা খোলা থাকলে শোনা যায়, আর শোনা গেলেই ওর মিউ সড়াৎ করে খাটের নীচে ঢুকে পড়ে।
যদিও মিউও পপির মতোই রোবট। পপি চাইলেও ওকে কামড়ে দিয়ে কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। কামড়াবেও না, ওটা ওদের প্রোগ্রামে থাকে না। কিন্তু পোষ্যদের মধ্যে এমন কিছু কিছু অদ্ভুত আচরণ প্রোগ্রাম করে দেওয়া আছে কোনো এক বড়োকর্তার বুদ্ধিতে। তাতে নাকি মানুষদের ওদের বেশি রোবট মনে হবে না!
ঘরে ঘরে চার্জিং পয়েন্ট। নিয়ম করে রোজের চার্জ দেওয়া। বাধ্যতামূলক নিয়ে হাঁটতে বেরোনো নেই, খাবার বা জল দেওয়া নেই, ভ্যাক্সিন ডিওয়ার্মিং করানো নেই। ভালো না লাগলে সুইচ অফ করে রেখে দাও, বা স্লিপ মোডে।
তবু নাকি রোবট মনে হবে না!
আর মনে হলে কী ক্ষতি? আসল পোষ্যের চেয়ে রোবটের হাঙ্গামা অনেক কম তো!
অথচ ছুঁয়ে দেখো মিউকে! নরম তুলতুলে লোমে ঢাকা, একদম আসলের মতো কিলবিল করে কোলের মধ্যে! কত অঙ্গভঙ্গি করে গা চেটে চেটে সাফ করে আবার!
মণীন্দ্রের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির দরজা অবধি আসতে আসতে রুহানার ভ্রূ কুঁচকে গেল।
পপির সকেটের অ্যালাইনমেন্ট বিগড়োল কী করে?
বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য রোবোট-পোষ্য প্রোডাক্ট কোয়ালিটি কন্ট্রোলে পাস হতে গেলে যে কী পরিমাণ টেস্টিং-এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা রুহানা খুব ভালো করেই জানে। ওটাই ওর কর্মক্ষেত্র। মেটিরিয়ালে এতটুকু একচুল ত্রুটি থাকলেও সেটা বাতিল।
আর যে জিনিস দিয়ে, যে টেকনোলজিতে ওগুলো বানানো, তাতে রীতিমতো গায়ের উপর বোমা না ফাটলে সকেটে কিছু হওয়ার তো কথা নয়! এমনি পড়ে যাওয়া বা ধাক্কা লাগায় ওসব টসকায় না।
ওটা ঠিক না করে সম্ভবত রিটার্ন নিয়ে যেতে বলা উচিত ছিল ওর।
এই সময়ে দরজা খুলে ফেলল ও আর মিউ লাফিয়ে কোলে উঠে এল! মণীন্দ্র, পপি, পপির সকেট সব রুহানার মাথা থেকে বেরিয়ে গেল তখনকার মতো।
***
রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল রুহানা। এমনিতেই এসব স্বপ্ন টপ্ন আজকাল আর লোকে বিশেষ দেখে না। পৃথিবী থেকেই ব্যাপারটা প্রায় মুছে গেছে।
অবশ্য পৃথিবী বলতে এখন যেটুকু বোঝায় আর।
অতীতের নীল গ্রহ কবেই ধূসর হয়ে গেছে। বিকিরণের ফল। ক্রমাগত যুদ্ধ আর ধ্বংসের ফল। বহুলাংশে মানুষের অজ্ঞতার ফলও।
একবিংশ শতক ইতিহাসে ‘মারণ শতক’ বলে পরিচিত। পৃথিবী উপচে পড়ছে তখন মানুষে। যেমন হু হু করে জনসংখ্যা বাড়ছিল, তেমনি নির্বিচারে সবুজ উপড়ে ফেলে কংক্রিটের জঙ্গল বেড়ে চলেছিল বছরের পর বছর। যত মানুষ তত খাদ্য নেই, পানীয় জল নেই… যুদ্ধটা অনিবার্য ছিল।
সাত বছর ধরে টানা যুদ্ধ চলার পর দেখা গেল পৃথিবীর এক খণ্ডাংশ মাত্র বেঁচে আছে। বাকি অংশের হয় সলিলসমাধি ঘটেছে, নয় পুড়ে ঝামা হয়ে গেছে সবকিছু।
এই টুকরো পৃথিবী আর তাতে পড়ে থাকা মানুষেরা—এই নিয়ে শুরু হয়েছিল এ আই যুগ। মানুষের কমতি যথাসম্ভব যন্ত্রে পূরণ করা।
আস্তে আস্তে আবার সুন্দর হয়ে উঠেছিল এই নতুন পৃথিবী। আজ এই ২১৩৩ সালে দাঁড়িয়ে রুহানা এটা জোর গলাতেই বলতে পারে যে আগের চেয়ে আকারে অনেক সীমিত হলেও, এই নতুন পৃথিবীর সৌন্দর্য, মানুষের এখানে টিকে থাকার ক্ষমতা, জীবনযাপনের মান আগের পৃথিবীর চেয়ে ঢের ভালো।
খালি কিছু জিনিস কালের নিয়মে লোপ পেয়েছে। যেমন গান গাওয়া। বা এই স্বপ্ন দেখার অভ্যাস।
যদিও, খুব সুন্দর আলো ঝলমলে দিন হলে হুট করে কেউ কেউ গুনগুন করে ফেলে যেমন, তেমন এক আধটা স্বপ্নও অবরেসবরে দেখে ফেলে সবাই-ই। বেশির ভাগই ভুলে যায় ঘুম ভাঙার পর। বাকিরা ও নিয়ে ভাবে না বিশেষ, কারণ তারাও ভুলে যেতে চায়।
রুহানাও ভুলে যেতে পারলে খুশি হত। স্বপ্নটা দেখতে দেখতে প্রচণ্ড ভয়ে ঘুম ভেঙে গেছিল তার। ঘুম ভাঙার পরও বুক ধড়ফড় করছিল, গায়ে ঘাম হচ্ছিল, মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না।
বেশ খানিকটা সময় লাগল ধাতস্থ হতে।
বোতল থেকে জল খেল রুহানা, গায়ে মাথায় জল দিল উঠে গিয়ে। বেসিনের উপরে লাগানো টালির সামনে হাত বোলাল একবার, টালিটা স্বচ্ছ হয়ে আয়নায় পরিণত হল, পিছন থেকে আলো বিচ্ছুরণ হচ্ছিল সেটার।
নিজের মুখের দিকে বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে রইল রুহানা। পাতলা ঠোঁট, ঢালু কপাল, সামান্য উপরে তোলা টানা চোখ, মণির রং গাঢ় বাদামি।
সে চোখ এখনও অল্প বিস্ফারিত।
আতঙ্কে।
স্বপ্নে ল্যাব থেকে দৌড়ে বেরোচ্ছিল সে। কী যেন একটা সাংঘাতিক কারণে… ফায়ার অ্যালার্ম? ভ্রূ কুঁচকোল রুহানা। মনে পড়ছে না কারণটা। কিন্তু অমনই সাংঘাতিক কিছু একটা… ওকে চারতলা থেকে নেমে যেতে হবে সিঁড়ি দিয়ে… এক্ষুণি!
কেউ কোথাও নেই। এই দিকটায় এমনিও খুব বেশি লোকজন থাকে না… আজ ভোঁ-ভাঁ করছে খালি। নীলচে আলো জ্বলছে চারদিকে… আর ওর মনের মধ্যের সেই তাগাদা—পালাও, পালাও, পালাও!
তলাগুলো বেশ উঁচু, ফলে সিঁড়িটা টানা নয়; প্রতি তলার মধ্যে দুটো ভাগে মোড় ফিরে উঠেছে। হুড়মুড় করে একটা ভাগ নামতে গিয়ে আঁতকে উঠে থেমে গেছিল রুহানা। সিঁড়ির পরের ভাগটা আর নেই, চাঁছাছোলা দেওয়াল একটা সেখানে। সোজা সেই দেওয়ালে গিয়েই এই সিঁড়িটুকু শেষ। আরেকটু হলে নামার ঝোঁকে ও মুখ থুবড়ে পড়ত ওই দেওয়ালের উপর।
রেলিং-এর উপর দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ও নীচে সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে পৌঁছবার জায়গাটা শূন্য। সামনে এগোনোর পথ… বন্ধ।
মাথার মধ্যে ‘পালাও, পালাও’ চিৎকারটা আরও জোরালো হয়ে উঠছিল… আর রুহানা টের পাচ্ছিল ওর চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে… পাথরের মতো নিরেট আর বরফের মতো ঠান্ডা অন্ধকার…
বুকে হাপরের পাড় নিয়ে এই অবস্থায় জেগে উঠেছিল রুহানা।
এখনও, নিজের ঘরে, নিজের খাটে বসেও সেই দমবন্ধ করে দেওয়া ভয়টা ও টের পাচ্ছিল বুকের মধ্যে।
ভয়?
তার চেয়েও বেশি কিছু। এক চরম অসহায়ত্বের বোধ… বলা যায়…
শুয়ে পড়ার পরও আরও অনেকক্ষণ সেই বোধ তাকে জাগিয়ে রাখল…
***
সকালে বেলা করেই বেরিয়েছিল আজ রুহানা। উঠতে দেরি হয়েছিল, তারপরও শরীর মন ঠিক চাঙ্গা হতে চাইছিল না।
তবে দরজা বন্ধ করে কয়েক পা হাঁটতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যেতে শুরু করল।
সত্যি, তাদের পৃথিবী কী যে সুন্দর! এখন যদি অতীতের কোনো মানুষ এসে দাঁড়ায়, তার মনে হবে সে সাক্ষাৎ স্বর্গে এসে হাজির হয়েছে!
টিকে থাকা সবুজ গাছপালাগুলোকে নিরলস চর্চা আর যত্নে মাপমতো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভূখণ্ড জুড়ে। ফলে রাস্তার কিছু দূরে দূরেই কয়েকটা করে গাছ, তার নীচে বসার বেঞ্চ, মোড়ে মোড়ে জলের ফোয়ারা।
আকাশ ঝকঝকে নীল সারাক্ষণ, তাতে সময় হলেই থোকা থোকা সাদা মেঘ ভেসে যায়। বছরের কিছু নির্দিষ্ট দিনে কালো মেঘ ঘনায়, বৃষ্টি হয়, রাত্রে বিদ্যুৎ চমকায়। সবই আগে থেকে নোটিস দিয়ে হয়।
শুধু যে সুন্দর, তাই না। সব সমান – এখন সব মানুষ সমান সুযোগ সুবিধা পায়।
ল্যাবে পৌঁছনোর আগের মোড়ে লম্বা বিনুনি মহিলার সঙ্গে দেখা হল রুহানার। একহারা দীঘল চেহারা, পরনে সাদা-সবুজ ফুল ফুল ছাপা জামা। নাদুসনুদুস শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি তাকে দেখাচ্ছিলেন, সেদিনের মেঘটা কেমন কুকুরছানার মতো দেখাচ্ছে!
বাচ্চাটা ফুলো ফুলো হাত নেড়ে মেঘটাকে ডাকছিল। হাসি-হাসি মুখে অবোধ্য শব্দ করছিল।
রুহানার সেদিকে তাকিয়ে আচমকাই বুকের মধ্যে খুব খালি লাগল।
এই বাচ্চা নেওয়া নিয়েই সর্বেশের সঙ্গে তার সম্পর্কটা টিকল না। বাকি সব দিব্যি ছিল, একসঙ্গে কাজ করা, পছন্দ অপছন্দের মিল… এগুলো দেখেই ম্যাচিং সফটওয়্যার ওদেরকে পরস্পরের নাম সাজেস্ট করেছিল।
কিন্তু সর্বেশ… ঝামেলা চায়নি। চাইত না।
রুহানা চাইত।
খুব। এইরকম একটা গুবলু বাচ্চা…
এইখানে মহিলা ওর দিকে চেয়ে হেসে ‘সুপ্রভাত’ জানালেন। রুহানার মুখে আপনা আপনি সেই সুন্দর হাসিটা ফুটে উঠল, সুরেলা গলায় সেও সুপ্রভাত বলল।
বাচ্চাটা মুখ ঘুরিয়ে দেখছে। রুহানার খেয়াল হল, প্রায় দিনই এদের সঙ্গে দেখা হলেও, আজ অবধি সে জানে না বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে। বা ওদের কার কী নাম।
জিজ্ঞাসা করবে ভেবেও কাঁধ ঝাঁকাল সে। বাচ্চার মনোযোগ আবার আকাশে ফিরে গেছে। মহিলা মিষ্টি হাসি নিয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছেন। সম্ভবত ওর এইভাবে দাঁড়িয়ে পড়াটা দৃষ্টিকটু হচ্ছে। হাত নেড়ে এগিয়ে গেল সে দ্রুত পায়ে।
হ্যাঁ, মহিলা যদি ওর আচরণ দৃষ্টিকটু ভেবেও থাকেন, ওঁর মুখে সে ভাব কখনও দেখা যাবে না। কথাতেও না।
এইটেই এই নতুন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য।
মানুষ এখন সর্বাংশে সুন্দর।
চেহারার খুঁত ঢেকে ফেলা তো আদ্যিকালের ব্যাপার, সবারই ছোটো থেকেই সেসব করেকশন করে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন, মানে গত আড়াই বছর ধরে মানুষের ব্যবহারের সব খুঁতও ঢেকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
এখন কেউ আর রাগ করে না, বিরক্ত হয় না, ঝগড়া করে না… হাসিমুখে ছাড়া কথা বলেই না। বলতে পারেই না, বস্তুত!
মনে যদি বা তেমন কোনো চিন্তা আসেও, সে চিন্তা চোখে মুখে কোনোদিন প্রকাশ পাবে না আর। মস্তিষ্কের মধ্যে সুকৌশলে বসিয়ে রাখা মাইক্রোচিপটা ছাঁকনির মতো সে চিন্তাকে আটকে ফেলবে।
ওই চিপটাই “সৌজন্য”।
গত তিন দশকের সবচেয়ে সাড়া ফেলে দেওয়া আবিষ্কার।
পৃথিবীর মানুষদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু যে মানুষ নিজেই, এবং আর একটিবারও অমন মহাযুদ্ধ শুরু হলে যে সবশুদ্ধু রসাতলে যাবে—এ দুটো বোঝার পর থেকেই এই গবেষণা শুরু হয়েছিল। আদ্যিকালের কোনো এক পদ্যের লাইন নাকি ছিল তার অনুপ্রেরণা—‘আপন দুটি চরণ ঢাকো তবে/ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে!’
এত সিকিউরিটি, এত সার্ভেয়ালেন্স, এত মনিটরিং, পুলিশ, জেল, সিসিটিভি, রেডিয়ো সেন্সর… কিচ্ছুটি লাগবে না যদি মানুষের আচরণ থেকেই এই হিংস্র প্রবৃত্তিগুলো মুছে ফেলা যায়।
প্রথমে প্রোটোটাইপ ছিল। ভার্শন এ, ভার্শন বি, ভার্শন ২.০। তারপর সেগুলোর অভাবিত সাফল্যের পর ব্যাপারটা সবার জন্য আবশ্যক করে দেওয়া হল। এখন তো শিশু জন্মাবার এক বছরের মধ্যে অপারেশনটা হয়ে যায়। ওই বাচ্চাটারও হয়ে গেছে নিশ্চয়, রুহানা ওকে কখনও কাঁদতে দেখেনি।
এখনকার বাচ্চাগুলো যেন রোবট! পপি বা মিউ যেমন কখনও কাঁদে না।
এইটে মাথায় আসার পর ধক করে রুহানার মনে পড়ল, আজ সকালে মিউকে চার্জে বসাতে ভুলে গেছে।
একবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছিল। সন্ধ্যা অবধি চার্জ থাকবে না। বাড়ি ফিরে দেখবে সোনালি শরীরটা কোথাও একটা নেতিয়ে পড়ে আছে—এইটে ভাবতে ভালো লাগছিল না।
কিন্তু না, এমনিই দেরি হয়ে গেছে ওর আজ।
তা ছাড়া, কিছু হবে না। ওদের কিছু হয় না একদিন বাদ গেলে। রাতে ফিরে করলেই হবে।
***
অভ্যাসমতো, এগারো মিনিট পর পর একবার করে সামনের ডিসপ্লে মনিটর থেকে মুখ তুলে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল রুহানা।
সাদা দেওয়ালের ল্যাব কোমর অবধি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ছোটো ছোটো খোপে ভাগ করা। পুরোটা জুড়ে ঘুম-ঘুম মৃদু নীলচে আলো আর খুব হালকা সুরের বাজনা। এই পরিবেশে শরীর রিল্যাক্স হয়, মন টেনশন-ফ্রি হয়ে যায়। ফলে কাজও এগোয় তরতর করে।
এই আলোর ঠিক এই ঔজ্জ্বল্য, বাজনার ঠিক এই লয় বা এই যে ঠিক এগারো মিনিট বাদে বাদেই চোখ তুলে অন্যদিকে তাকালে যে চোখের স্বাস্থ্য এবং মনের তরতাজা ভাব সঠিকভাবে বজায় রাখা যাবে—এইসব প্যারামিটার বহুকাল আগেই এক্সপেরিমেন্ট করে করে ঠিক করা হয়ে গেছে। পৃথিবীর সর্বত্র এগুলো হুবহু একভাবেই মেনে চলা হয়।
কিন্তু সব মেনে চলেও, কাজে আজ মন বসছে না।
গত তিন মাস ধরেই এ জিনিসটা হচ্ছে। কম বেশি। মন খুঁতখুঁত করছে। কিন্তু এদ্দিন এত স্পষ্ট করে লাগেনি।
আজ লাগছে। শুধু রুহানা নয়, ও জানে ওর উলটোদিকের খোপে বসা এতদিনের পার্টনার, চোখে চওড়া ফ্রেমের বাহারি চশমা কোঁকড়া চুলের সুমিত্রারও আজ কাজে মন বসছে না।
আজ নিয়ে চার বার।
তিন মাসে, চার চারটে রিপোর্ট।
ব্যাপারটা আর কাকতালীয় বা চান্স-এরর বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
একটা কুকুর, দুটো বেড়াল, একটা খরগোশ।
এর মধ্যে একটা বেড়াল বেশ পুরোনো, প্রায় ছ বছর আগে ডেসপ্যাচ করা। সেটা যদি বা পুরোনো বলেই সরিয়ে রাখা যায়, বাকি তিনটে পোষ্যই গত দু-বছরের মধ্যে তৈরি। তাদের কারো অমন বিচ্ছিরিভাবে সকেট বেঁকে যাওয়া, বা সার্কিট ড্যামেজ হওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই।
অথচ, হয়েছে।
রুহানার মনে অস্বস্তিটা তীব্র হয়েছে আজকের বিড়ালটা আসার পর থেকে।
এটার সকেটের সমস্যাটা হুবহু পপির মতো, তবে আরও বেশি।
তিন মাস আগে দেখা পপির কেসটা ও রিপোর্ট করেনি। তখন এমন কিছু মাথায় আসেওনি। কে জানে আরও কিছু এমন রিপোর্ট না হওয়া পরিস্থিতি আছে কিনা! এ রোবোটগুলো সারানোর ক্ষমতা অনেকেরই আছে এখন। হয়তো পোষ্যদের মালিকদেরও…!
হয়তো, এইরকম আচমকা বিগড়ে যাওয়া পোষ্যের সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি?
কিন্তু কেন? কিছু গ্লিচ হচ্ছে কি ওগুলোর লেটেস্ট সফটওয়্যার আপগ্রেডে? ওভারহিটিং হচ্ছে নাকি চার্জিং-এর সময়ে?
আজকের বিড়ালটার মালিক কিছুটা অসংলগ্ন কথাও বলছিলেন। ওঁর বক্তব্য ছিল বিড়ালটা নাকি ইচ্ছা করে এরকম নেতিয়ে পড়ে থাকছে, ওঁকে খাটানোর জন্য।
হেসে হেসেই বলেছিলেন। খুবই আদুরে পোষ্য ওঁর, বোঝা যাচ্ছিল সে হাসি থেকে।
কিন্তু বড়ো বেশিবার বলছিলেন।
বার বার।
“কী দুষ্টু হচ্ছে দিন দিন! আমি আর সামলাতে পারছি না!”
“কিচ্ছু করবে না, খালি পড়ে থাকবে। আমায় কোলে করে চার্জ করাতে নিয়ে যেতে হবে, আমায় বোতাম টিপে মোড সেট করতে হবে… ”
“বড্ড দুষ্টু জানেন। আগে এমন ছিল না।”
“ওঠে না, কিছু না। ভালো লাগে না আমার!”
মিষ্টি হাসি, অভিযোগহীন সুমিষ্ট গলায় এই অভিযোগগুলো শুনতে কেমন অবাস্তব লাগছিল রুহানার নিজেরই। ব্যাপারটাতে যে ওদের বসেরও খটকা লেগেছিল, তা বোঝা গেল পরের নির্দেশে।
মহিলাকে বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে বস ল্যাবে এলেন। সুমিত্রা তখন নেতিয়ে থাকা সাদা-কালো বিড়ালটাকে নেড়েচেড়ে দেখছে।
“প্যাক করো, ফুল মেমরি স্ক্যান করতে পাঠাও।”
এই প্রথম এ নির্দেশ শুনল রুহানা। একসময়ে এটা প্রায়ই করা হত, সে পড়েছে। কিন্তু তার কাজে জয়েন করার আগের কথা সেসব। এখন একদমই জরুরি কারণ ছাড়া হয় না, কারণ ওখানে পাঠালে জন্তুটা… মানে, রোবোটটা বাতিল হয়ে যায় পাকাপাকি—ওটার সব পার্টসই পুরো খুলে ফেলা হয়। ওর শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকোনো মেমরি কার্ড কী কী ধরে রেখেছে, সেটা জানার জন্য এভাবে পুরো টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়।
এই চরম নিরাপত্তা ব্যবস্থা তখন বানানো হয়েছিল, যখন বাড়িতে হামলা করে খুন রাহাজানি বেড়ে গেছিল বেশ। তখন পোষ্য রোবট ধ্বংস করে দিয়ে গেলেও, এই কার্ডগুলো উদ্ধার করা যেত, তা দিয়ে অপরাধীদেরও ধরা যেত।
‘সৌজন্য’ পুরোদমে আসার পর থেকে এগুলো আর দরকার পড়েনি। মানুষ মানুষের ক্ষতি করে না আর। করতে পারে না।
কিন্তু ফিচারটা আছে।
“কিছু বলল?”
অর্ণব। ডার্করুম থেকে এই নিয়ে চতুর্থবার বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করল।
সুমিত্রা ‘না’টা বেশ জোরে ছুড়ে দিল। রুহানা নিশ্বাস ফেলে জোর করে স্ক্রিনে মন দিল আবার।
যদিও ও জানে, রিপোর্টটা না আসা অবধি ওরা কেউই মন দিয়ে কাজ করতে পারবে না আজ।
***
রুহানার হাত কাঁপছিল। এই অনুভূতির সঙ্গে ও পরিচিত নয়।
ও একা নয়। এই মিটিং-এ উপস্থিত সবাইকেই ও কমবেশি চেনে কাজের সূত্রে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সবাই-ই নার্ভাস এই মুহূর্তে। অর্ণব নখে নখ ঘষছে। সুমিত্রা নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরছে থেকে থেকে। দোতলার ল্যাবের গোঁফওয়ালা লোকটা বার বার নাকের ডগা চুলকোচ্ছে।
রিপোর্ট এসেছে। সে রিপোর্ট… এক কথায় অবিশ্বাস্য।
ওই সুন্দর হাসিমুখের মহিলা?
যার প্রতি কথায় বিড়াল ‘টোবি’র প্রতি আদর ঝরে পড়ছিল?
অমন ভয়ানকভাবে সকেট বেঁকে ডিসলোকেট করিয়ে দেওয়াটা ওই মহিলা স্বয়ং করেছেন?
কে বিশ্বাস করবে এ কথা?
অথচ…
মেমরি কার্ড তো স্পষ্ট তাই দেখাচ্ছে। মহিলার ইলেকট্রিকাল ডিভাইস হ্যান্ডলিং-এর ট্রেনিং আছে। বাড়িতে সেসব যন্ত্রপাতিও ছিল। নিপুণভাবে একটু একটু করে ড্যামেজ করে গেছেন তিনি টোবিকে দিনের পর দিন।
টোবি কি টের পেয়েছিল? আত্মরক্ষার আইন মেনেই অল্প বাধা দিয়েছিল শেষ দিন?
সে দৃশ্যের ভিডিয়ো প্রোজেক্টরে দেখেছে সবাই খানিক আগে।
মৃদু ‘ম্যাও!” ডাক, একটা থাবা আপত্তি করার ভঙ্গিতে তোলা।
ব্যস।
পরক্ষণেই, কী নির্মম আঘাতে টোবির ছোট্ট শরীরটা ছিটকে গিয়ে দেওয়ালে আছড়ে পড়ল! দেখে অবধি অসুস্থ লাগছে রুহানার।
“মহিলাকে তোলা হচ্ছে। দেখতে হবে ওঁর চিপে কোনো গ্লিচ হয়েছে কিনা। এমন কেন করলেন উনি, দেখতে হবে। এটা না সমাধান হওয়া অবধি সব নতুন রোবোট-পোষ্য ডেসপ্যাচ বন্ধ থাকবে।”
বসের অর্ডারটা পরিপাক করল ওরা নীরবে। তারপর যে যার মতো বেরিয়ে গেল।
কথা বলার ইচ্ছে বা মনের জোর কারোই ছিল না।
***
পরের মিটিং-এ নতুন অর্ডার এল।
“মহিলার লাইফে পর পর অনেকগুলো সেটব্যাক আছে। পার্টনার মারা গেছিল, বাধ্যতামূলক রিটায়ার করতে হয়েছিল বয়স হয়ে যাওয়ায়, একমাত্র ছেলেটি ভলান্টিয়ার হয়ে ধ্বস্ত পৃথিবীর অভিযাত্রী টিমে চলে গেছে, বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না আর। করার কিছু ছিল না। কথা বলারও সেভাবে কোনো জায়গা ছিল না বলেই মনে হচ্ছে।”
“তাহলে… এসব ক্ষেত্রেই তো পোষ্যরা… ?”
“টোবি ওঁর পার্টনারের পোষ্য ছিল, আসলে। উনি কেন যেন খুব একটা অ্যাটাচ হতে পারেননি টোবির সঙ্গে… ডাটা তেমনই দেখাচ্ছে।
চিপের গ্লিচ কী আর কতটা এখনও বোঝা যায়নি। সত্যি বলতে কি গ্লিচ কিছু পাওয়াই যায়নি। আরও খতিয়ে দেখতে হবে। উনি ডিসফাংশনাল, আপাতত।”
ডিসফাংশনাল মানে যে মানুষকে খরচার খাতায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
বসের গলায় বিন্দুমাত্র তাপ উত্তাপ নেই। সামান্য ধাতব সুর মেশানো সুরেলা অ্যান্ড্রয়েড কণ্ঠস্বর।
“তোমরা এমন কিছু কেস আশপাশে দেখলেই রিপোর্ট করবে।”
রুহানা মুখ খুলতে গিয়েও সামলে নিল।
***
বেলটা বাজাতে গিয়ে একবার ইতস্তত করল রুহানা। তারপর মনে জোর এনে আঙুল চেপে ধরল।
“আরে! রুহানা!”
“এই, এমনি এলাম! পপি কেমন আছে এখন?”
“এসো, এসো।”
মণীন্দ্র হেসে বলল। রুহানা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল বলেই কি হাসিমুখের সঙ্গে বেমানান চোখ দুটো তার চোখে পড়ল?
ক্লান্ত।
মণীন্দ্র খুব ক্লান্ত। অসন্তুষ্টও।
কার উপর? ও এরকম হুট করে এল বলে?
“কী নেবে, চা না কফি?”
“অরেঞ্জ ড্রিঙ্ক নেই?”
রুহানা কি ভুল দেখল? মণীন্দ্রের চোখের অসন্তোষ আরও গাঢ় হল কি?
কই, নাঃ! ওই তো হাসছে মণীন্দ্র।
“ভুলে গেছি, তোমরা তো আবার… দাঁড়াও দিচ্ছি।”
মণীন্দ্রের এক গার্লফ্রেন্ড ছিল, আচমকাই খেয়াল হয় রুহানার। তাকে অনেকদিন দেখছে না যেন? গতবারও বাড়িতে আর কেউ ছিল বলে মনে হয়নি।
মণীন্দ্র ফিরে আসতে কথাটা জিজ্ঞাসা করেই ফেলল রুহানা।
“নিয়াশা চলে গেছে। আমাকে ওর বোরিং লাগছিল।”
মণীন্দ্র হাসছে। ঝলমলে হাসি।
অথচ রুহানার মনে হচ্ছিল ওর চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে।
বাড়ি ফিরল এলোমেলো পায়ে।
সর্বেশ…
“কী সব বায়নাক্কা! না, আমার ল্যাঠা নেওয়ার ইচ্ছা নেই।”
“তোমায় কিচ্ছু করতে হবে না! আমি সব করে নেব। সব সামলে নেব।”
“আইন জানি না আমি? আজ এসব বলবে, তারপর আমার নাকে দড়ি দিয়ে ভরণপোষণ, টাইম শেয়ারিং, কেরিয়ারে স্যাক্রিফাইস… সব আদায় করবে! নো ওয়ে!”
“আচ্ছা… ছাড়ো। আমি আবার প্রোটেকশন শুরু করে দিচ্ছি। তাহলে থাকবে?”
“পা-গল! একবার দুম করে নিজে নিজে প্রোটেকশন বন্ধ করে ফেলেছ, আবার কখন ইচ্ছে হবে, চুপিচুপি করে বসে থাকবে! সে রিস্ক নেব নাকি আমি! নিজের রাস্তা নিজে দেখে নাও বাপু—আমি আর নেই তোমার ব্যাপারে।”
“আরেকবার ভাববে না? আমরা এতদিন একসঙ্গে এত ভালো ছিলাম… ?”
“কে ভালো ছিল? অসহ্য, বোরিং সব দিন। নেহাত ম্যাচিং সফটওয়্যার বলেছে বলে… এনাফ!”
‘সৌজন্য’ তখনও আসেনি। এলে কি কিছু পালটাত?
শব্দগুলো… কথাগুলো… হয়তো এমন সরাসরি, চাঁছাছোলা হত না। কিন্তু সর্বেশ থাকত না। এই তো নিয়াশাও কেমন চলে গেছে।
মানুষ থাকতে না চাইলে কে আটকাবে?
হয়তো ‘সৌজন্য’র পরের কোনো আপগ্রেড…
কিন্তু রুহানার এতগুলো বছর কি আর ফিরবে তখন! দুজনের একসঙ্গে প্রায় পাঁচ বছর, তারপর একা একা আরও তিন বছর কেটে গেল তো! ম্যাচিং সফটওয়্যার এখনও ওকে নতুন লাইফের জন্য ‘রেডি’ বলে ছাড়পত্র দেয়নি।
রুহানাই কি নিজেকে ‘রেডি’ ভাবতে পারে, এখনও?
এত ক্লান্ত লাগে আজকাল…
***
পরদিন বাড়ি ফেরার পথে আবার অসীম ক্লান্তি ছেয়ে ধরছিল রুহানাকে।
মনের মধ্যে বেশ লড়াই করেই একটা কাজ করেছে সে আজ। কঠিন কর্তব্য।
মণীন্দ্রকে অনেকদিন ধরে চেনে সে। পছন্দও করত। কিন্তু…
পপির সকেটে আবার ড্যামেজ শুরু হওয়ার লক্ষণ দেখেছে সে গতকাল।
মণীন্দ্র এসবে এক্সপার্ট না। কিন্তু আনাড়ি হাতেও, স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে ইচ্ছে করে চাপ দিলে একটু একটু করে সকেটটা বেঁকে যাওয়া সম্ভব।
দেখে মনে হয়েছিল, সেরকমই হচ্ছে।
এত খারাপ লোক মণীন্দ্র! ভাবতে পারছিল না রুহানা। তবে কিচ্ছু টের পেতে দেয়নি সে। যদি পালায়!
খুব সহজভাবে সাদামাটা গল্পগুজব করে চলে এসেছিল। ভাগ্যিস ‘সৌজন্য’ আছে!
আজ পপি আর মণীন্দ্রের নাম দিয়ে পাঁচ নম্বর কেস ফাইল খোলা হয়েছে। প্রমাণ যথেষ্ট ছিল। বস প্রশংসা করলেন। কিন্তু রুহানা খুব একটা খুশি হতে পারল না। কেন কে জানে!
মণীন্দ্রকে তুলে আনার পর কেমন করে যেন চেয়ে ছিল ওর দিকে। হাসিমুখে… ঈশ্বর, সেই অদ্ভুত খুশি খুশি হাসিটা!
এখনও ও নিজের মধ্যে রাগের মতো কিছু একটা জ্বালা টের পাচ্ছে। কী বিশ্রি তেতো লাগছে মুখটা!
সেই মোড়ে আবার মহিলার সঙ্গে দেখা হল। কোলের বাচ্চাটা খুব হাত পা ছুড়ছে, যদিও মুখে হাসি।
মহিলাও হাসছে। উজ্জ্বল চোখে, গালে টোল ফেলে। বাচ্চাটাকে সামলাতে চাইছে। পারছে না ঠিক। বাচ্চাটার সম্ভবত কিছু কষ্ট হচ্ছে। হয়তো গায়ে জামা টাইট হচ্ছে? মহিলা দেখছে না কেন জামাকাপড় নেড়েচেড়ে? কাঁদে না বলে কি কষ্ট হতে পারে না? উজবুক লোক…
এইসব আতাক্যালানে লোকজনেরই কপালে সুখ আছে … দ্যাখো!
বাচ্চাটা কী মিষ্টি।
কিন্তু ও কি হেঁচকি তুলছে? কেমন মা এ… চেয়ে দেখে না নাকি?
এই মুহূর্তে মহিলার সঙ্গে চোখাচোখি হল রুহানার। ঝকঝকে নীলচে কালো চোখ… তীব্র, সুন্দর, পাথরের মতো নিষ্পলক।
রুহানা দেখল, সে চোখের মণিতে দানা বাঁধছে অতল অন্ধকার…
ঘুরপাক খাচ্ছে… মাথা কুটে মরছে দেওয়ালে…
মহিলা বাচ্চাটাকে দু-হাত টান করে উপরে তুলে ধরল…
নিজের অজান্তেই রুহানা ঝুঁকে পড়ল সামনে, যেন বা ও জানে ওই মহিলা রাগে পাগল হয়ে বাচ্চাটাকে এবার কোল থেকে ছুড়ে ফেলে দেবে, যেন বা ও জানে কোলের এই বোঝা মহিলার কাছে কতখানি অসহ্য হয়ে উঠেছে এই মুহূর্তে…
অথচ সেসব কিছুই হল না। মহিলা হাওয়ায় দুলিয়ে নিয়ে আবার বুকে চেপে ধরল বাচ্চাকে। খেলা পেয়ে ছটফটানি থেমে গেল তার, মা আর বাচ্চা দুজনেই অবাক আর প্রীত হাসি নিয়ে ঘুরে তাকাল তার দিকে।
রুহানা চোখ সরিয়ে নিল যেন চাবুক খেয়েছে, পালিয়ে যাওয়ার মতো ছুটে সরে এল সেখান থেকে।
বাকি রাস্তা ফিরল একটা ঘোরের মধ্যে। অমন স্নিগ্ধ হাসিভরা দৃশ্যর মধ্যেও তার চোখে পড়েছিল, দুজনের চোখেই একটা চকিতে সরে যাওয়া ছায়া। ঝাপসা। কালো। অন্ধকার।
বাড়ি ফিরেও মাথার মধ্যের শূন্যতা কিছুতেই যায় না। হোঁচট খেতে খেতে দরজা খোলে রুহানা। ছায়ার মতো অন্ধকারটা যেন ওর সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে এসেছিল এতক্ষণ, খোলা দরজা পেয়েই ঝাঁপ মেরে ঢুকে গেল ওর বাড়িতে।
ছায়া ছায়া ঘর। কালো কালো আসবাব।
বিচ্ছিরি, আর বোরিং একটা বাসস্থান।
আলো জ্বেলে এদিক ওদিক তাকাল রুহানা।
মিউ?
ওঃ!
আজও তো ওকে চার্জ দেয়নি সকালে। প্রায়ই ভুলে যাচ্ছে আজকাল।
একেক দিন রাতেও ফিরে এসে আর দিতে ইচ্ছে করে না। সেটা ঠিক হচ্ছে না যদিও। ব্যাটারি খারাপ হয়ে যেতে পারে বেশিক্ষণ ফেলে রাখলে।
খুঁজে খুঁজে, রান্নাঘরের পাশ থেকে মিউকে তুলে নিয়ে গিয়ে সকেটে গুঁজল রুহানা।
***
রাত্রে সেই স্বপ্নটা আবার ফিরে এল।
সেই ল্যাব, সেই পালানোর আকুল আকুতি, সেই দেওয়াল গেঁথে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিঁড়ি।
রুহানা ঘামছিল। ছটফট করছিল।
কত কিছু ওর বলতে ইচ্ছে করছিল। কত কথা… জমানো কথা… চিৎকার… সব ওই নিপাট সাদা দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছিল।
বেরোনোর রাস্তা নেই। নেই। নেই…
আচমকা ওর বুকের উপর জোরালো একটা ধাক্কা লাগল।
ঘুমের অতল থেকে উঠে আসতে আসতে রুহানার প্রথম কথা মনে হল, “উফ! কী অন্ধকার!”
দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুকের উপরে ভারটা নড়াচড়া করছিল। নখের খোঁচা লাগল গায়ে।
রুহানার মনে পড়ল, ঘুমোনোর আগে মিউকে স্লিপ মোডে দেয়নি আজ। ভুলে গেছিল।
এই সব দায়… চার্জ করো, মোড সেট করো… আঃ! বিরক্তিকর! বিরক্তিকর! ও তো চায়নি এগুলো। ও তো চেয়েছিল একটা কোল ভরা বাচ্চা নিয়ে ওই মহিলার মতো ঘুরে বেড়াতে…
ওই মহিলা কীসে ওর থেকে বেশি ভালো? ও কেন পায়? রুহানা কেন পায় না?
চার্জিং-এর পর কিছুটা সময় মিউয়ের খেলাধুলোর মোড অন হয়ে থাকে। চার্জিং সকালের বদলে রাত্রে হয়েছে বলে তো সে সিকোয়েন্স আপনা থেকে চেঞ্জ হবে না! অতএব খুব আদর করে রুহানার গালে নাক ঘষে দিতে লাগল মিউ, থাবা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে একটু যেন আঁচড়েও দিল। রুহানার নাকে লোম এসে লাগল…
আর অমনি এতক্ষণ ধরে ওর চারদিকে ঘুরপাক খাওয়া অন্ধকারটা রুহানার মধ্যে ঢুকে গেল। নাকি ওর মধ্যেই এতকাল লুকিয়ে ঘুমোচ্ছিল আর বড়ো হচ্ছিল সেটা… এখন, এই মুহূর্তে, বিপুল বিস্ফোরণে সেটা আছড়ে পড়ল মস্তিষ্কের কোশে কোশে?
কে আটকাবে দেওয়াল তুলে আর? ‘সৌজন্য’?
সে তো শুধু অন্য মানুষের ক্ষেত্রে, তাই না? মিউ তো মানুষ নয়…
***
পরদিন বিড়ালটার বিশ্রিভাবে থেঁতো হয়ে যাওয়া দেহটা মেমরি স্ক্যানে পাঠিয়ে ছ’ নম্বর কেস ফাইল অ্যাপ্রুভালে পাঠালেন রুহানাদের অ্যান্ড্রয়েড বস।
“রুহানা এম টি ০০৭৬০৮। রেকমেন্ডেশন—মার্ক অ্যাজ ডিসফাংশনাল।”
সব চুকেবুকে যাওয়ার পর, রুহানার ল্যাব পার্টনার সুমিত্রা নিজের জায়গায় ফিরে এসে চোখ বুজে বসে ছিল। ক্লান্তি এলে যা করে মানুষেরা এখন। অবশেষে তার নিজের পড়ে থাকা কাজ শেষ করার কথা খেয়াল হল।
চোখ খুলেই গলা তুলতে বাধ্য হল সে, “এত অন্ধকার! কে আলো কমিয়ে দিয়েছে? কেন?”
Tags: অনুষ্টুপ শেঠ, অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান
অতিরিক্ত যান্ত্রিকতার শেষ এটাই