নিষিদ্ধ ফল
লেখক: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
পূর্বকথা
অনন্ত আঁধার বেয়ে বহে আসে তুচ্ছ সৃষ্টিবীজ
এই কাহিনির সূচনা কারিউজ নামে একটি মৃত গ্রহে। মরবার কথা তার ছিল না। ধনে, সম্পদে, শক্তিতে তার কাছাকাছি কেউ ছিল না গ্যালাক্সির গোটা বাহুটিতেই। তবু তাকে মরতে হল! নিজের সন্তানেরই হাতে। কারণ তার এক দেশপ্রেমিক সন্তান নিজের দেশের জন্য গড়ে দিয়েছল এক অমোঘ অস্ত্র। সে যন্ত্র গ্রহটির পেট থেকে শুষে আনতে পারত তার জমে থাকা উত্তাপকে। তারপর সেই তাপতরঙ্গকে শত্রুদেশের ওপর নিশানা করলেই হল। ভারী সহজ মারণাস্ত্র। সস্তা ও দূষণহীন।
নীতিবাগীশরা বলেছিলেন, ওতে অনেক প্রাণী মরবে। নীতিনির্ধারকরা জবাব দিয়েছিলেন, ভালোই তো। তাতে মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ বাড়বে বই কমবে না। যারা বাঁচবে তারা বেশি সুখে বাঁচবে। সারা দেশের লোক তাতেই সায় দিয়েছিল। যুদ্ধ বেশ উত্তেজক বস্তু। ত্রিমাত্রিক টিভির পর্দায় ঘরে বসে দেখতে ভারী মজা। বিশেষ করে এই নতুন ভূতাপ কামানের ধ্বংসলীলার ভিশ্যুয়ালের তো তুলনা ছিল না কোনো।
শুধু, যখন প্রযুক্তিটা নানা অন্ধকার পথ ধরে এক দেশ থেকে আর এক দেশ হয়ে গোটা গ্রহতেই ছড়িয়ে পড়ল, তখন পাঁচটি যুযুধান দেশের পাঁচজন বিজ্ঞানী আরও একটা মত দিয়েছিলেন। বারবার তাপ শুষে নিলে গ্রহের পেটের ভেতরটা সূক্ষ্মভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। ভূপৃষ্ঠের গায়ে তার ধাক্কা এসে লাগে। এ ধাক্কার শক্তি যত বাড়বে ততই বাড়বে গ্রহের মাটির নীচেকার পাথুরে আবরণ ফেটে যাবার ভয়। আর, সে আবরণ একবার ফাটলে তাতে মৃত্যু হবে গোটা গ্রহটারই।
নীতিনির্ধারকরা তখন বসলেন অংকের খাতা নিয়ে। দেখা গেল, সে মুহূর্তে গোটা গ্রহে এমন কামান আছে মাত্র দশটা দেশের হাতে। কামানের সংখ্যা একশো। একশো কামান একসঙ্গে দাগলে গ্রহ ফাটবার সম্ভাবনা মাত্রই এক কোটিতে তিন। হাস্যকর সংখ্যা। অতএব নাহোক ভয় দেখাবার দায়ে পাঁচ বিজ্ঞানীর চাকরি গেল। খেতাব টেতাব সব ছিনিয়ে নেওয়া হল। এই শাস্তিদান উপলক্ষ্যে দুই যুযুধান শিবিরে ভাগ হয়ে থাকা সেই পাঁচটি দেশ বহুকাল পরে একবারের জন্য একমত হয়েছিল।
বিতাড়িত পাঁচ বৃদ্ধ কিন্তু হাল ছাড়লেন না। জনহীন বিষুব অঞ্চলের ছোটো একটা দ্বীপে গিয়ে একসঙ্গে বাসা বাঁধলেন। নির্জন দ্বীপে, লোকচক্ষুর আড়ালে গড়ে উঠল তাঁদের গবেষণাগার।
ওদিকে গ্রহটির বাকি লোকজন অবশ্য তখন ভারি সুখে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের টেলিভিশনের পর্দায় কেবলই উঁকি মেরে যায় একের পর এক জনপদের অগ্নিময় ধ্বংসলীলার রোমাঞ্চকর ধারাচিত্র। সে ভারি আকর্ষণীয় দৃশ্য বটে। আর এমনভাবেই কয়েক বছরের মধ্যে সারা পৃথিবীতে তাপ কামানের সংখ্যা বেড়ে যখন সতেরোশো-তে দাঁড়াল, ধ্বংস তখন একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝা যাচ্ছিল, এ যুদ্ধ থামবার নয়।
ওদিকে সেই পাঁচ বৃদ্ধ জানতেন, শেষলগ্নের বেশি দেরি নেই, এবং তাকে আটকাবার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। ফলে এক সম্পূর্ণ নতুন পথে তাঁরা এই সমস্যার সমাধান তৈরি করলেন।
দীর্ঘ কয়েক বছরের শ্রমে তাঁদের তিনজন মিলে তৈরি করলেন একটি ভাইরাস, একটি প্রজাপতি আর একটি গোলক। ছোট্ট গোলকযানটি, নক্ষত্রের আয়নবাত্যাকে নিজের ভেতর সংহত করে মহাকাশে সুদীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দেবার শক্তি ধরে। তার একমাত্র আরোহী সেই প্রজাপতি। তার শক্তিমান যন্ত্রমস্তিষ্কে, পরবর্তী কর্মপদ্ধতি নিখুঁতভাবে লিখে দেয়া আছে। রামধনু রঙয়ের ডানাদুটি দেহের দু-পাশে ভাঁজ করে রেখে সে ঘুমিয়ে থাকে গোলকের ভেতরে। প্রজাপতির দেহের ভেতর, পুষ্টিকর তরলে ভরা একটি নিশ্ছিদ্র পাত্রে সেই ভাইরাসটির বাস। তার দেহের একটিমাত্র যুগ্ম ডিএনএ তন্তুতে লেখা রয়েছে এ গ্রহের উন্নততম জীবটির দেহমনের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের নিখুঁত খবর। অন্য দুই বিজ্ঞানী এই সময়টা দ্বিতীয় একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। নক্ষত্রমণ্ডলের অজস্র বাসযোগ্য গ্রহের মধ্যে, ক্যারিউসের অতীত রূপটির সঙ্গে মেলে এমন একটি গ্রহের অবস্থান নির্ণয় করা তাঁদের লক্ষ্য ছিল। সে কাজে সফল হবার পর, গোলকযানের যন্ত্রমস্তিষ্কে তার পথটি তাঁরা সযত্নে লিপিবদ্ধ করে দিলেন।
এরপর এক অন্ধকার রাতে সকলের চোখের আড়ালে, হাতের মুঠির মতো বড়ো সেই ছোট্ট গোলকযান উড়ে গেল নিকট মহাকাশে। গ্রহের দ্বিতীয় চাঁদটির আড়ালে গোপনে ভেসে থেকে এ অপেক্ষায় রইল পরবর্তী সংকেতের।
সেই উড়ানের ঠিক একশো সাতাশ দিন পড়ে গ্রহটির মৃত্যুর দিন এসেছিল। তার পূর্ব গোলার্ধে তখন ঠিক দুপুরবেলা। যুদ্ধ সেদিন উন্মাদনার তুঙ্গে। গোটা গ্রহ জুড়ে বারে বারেই আগুন ওগরাচ্ছে হাজার হাজার তাপ কামান। এমন সময় হঠাৎ বৃদ্ধদের যন্ত্রগণক সংকেত দিল, সময় হয়েছে। অবিরত প্রবল সংকোচন প্রসারণে অবশেষে মাটির তলার পাথরের স্তরে শুরু হয়েছে অন্তিম স্পন্দন। তাঁরা একে অন্যের দিকে ফিরে দেখলেন একবার। কোনো শোকার্ত শব্দোচ্চারণ নয়, শুধু এক বৃদ্ধের শিক্ষিত আঙুলের স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে উঠল একটি সুবিশাল কালো পর্দা। তাতে, তারাভরা অনন্ত আকাশের পটভূমিতে ভেসে ছিল তাঁদের আশার গোলকটির ছবি। গ্রহটির মৃত্যুর ইঙ্গিতবাহী এই স্পন্দন তরঙ্গের রেশ তখন পৌঁছে গেছে গোলকের গ্রাহকযন্ত্রেও। এই সংকেতটির জন্যই সে অপেক্ষা করছিল এতদিন। নিজের ঘূর্ণন বন্ধ করে একমুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে। তারপর তার পেছন দিকে সহসা বের হয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ল সুবিশাল এক নক্ষত্রপাল। তার গায়ে নক্ষত্রের আয়নবাত্যার ধাক্কা তাকে মুক্তি দিল মরণোন্মুখ গ্রহটির করাল আকর্ষণ থেকে। পাঁচ বৃদ্ধের তৃপ্ত চোখের সামনে পলকে গতি বাড়াল গোলকযান, তারপর একটি তীব্র আলোর ঝলক ছড়িয়ে তিন মাত্রার বেড়া ভেঙে হারিয়ে গেল দেশকালহীন অতিমহাকাশের অন্ধকার প্রদেশে।
বাইরে তখন উত্তাল হয়ে উঠেছে গ্রহের পৃষ্ঠতল। বড়ো বড়ো অগ্নিময় ফাটল, কল্পকথার মহানাগেদের মতো মরণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরছে গ্রহটির সবুজ দেহকে। আসন্ন মৃত্যুর সংকেত পেয়ে উদ্দাম হয়ে উঠেছে সমুদ্রও। যন্ত্রের পর্দায় তাকিয়ে থাকা বৃদ্ধরা খেয়ালও করলেন না, কখন সামনের সমুদ্রটা একটা সুবিশাল তরল পাহাড়ের রূপ নিয়ে উঠে এল সেই দ্বীপের মাটির ওপর, তারপর এক ত্বরিত উল্লম্ফনে ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ল তাঁদের সমুদ্রতীরের সেই ছোট্ট গবেষণাগারটির ওপরে—
কারিউজের নিষ্প্রাণ ধ্বংসস্তূপটি, মহাকর্ষের অমোঘ নিয়মে আবর্তন করে চলে তার কেন্দ্রীয় নক্ষত্রকে। ওদিকে গোলকযানটি সেই সময় অতিমহাকাশের দেশকালহীন অনস্তিত্বের মহাসমুদ্রে নীরবে সাঁতার দেয়। বহুদূর পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে। তার যন্ত্রমস্তিস্কে লেখা রয়েছে অন্তিম গন্তব্যের ঠিকানাটি—গ্যালাক্সির অপর প্রান্তে এক হলুদ তারার সংসারের একটি নীল গ্রহ। আর সেই ধাবমান গোলকটির জঠরে, সৃষ্টির বীজকে নিজের ভেতর বহন করে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে একটি রঙিন প্রজাপতি, উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায়।
২
ঈশির ও ইবা
সন্ধের মুখে ওরা দুজন পাহাড়ের মাথায় গিয়ে পৌঁছেছিল। লালচে রঙের চাঁদটা সবে তখন ঝিলের জলের ভেতর থেকে মুখ বের করেছে। হাওয়া টলমল জলে হলদে রঙের চাঁদের গুঁড়ো ছড়িয়ে ঝিলের ওপর দিয়ে আলোর রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে একখানা। সেইদিকে তাকিয়ে ইবার আর চোখ ফেরে না। আর সেই প্রথম আলোয় ইবার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরে না ঈশিরের। চাঁদের আলো আস্তে আস্তে রুপোলি হচ্ছে। ইবার চকচকে বাদামি নিরাবরণ ত্বকে পিছলে যাচ্ছে সেই দুধসাদা চাঁদের আলো। পিঙ্গল কেশদাম ছড়িয়ে পড়েছে পিঠ জুড়ে। সুন্দরী ইবা!
ঈশিরকে অবশ্য ঠিক সুন্দর বলা যাবে না। তবে তার সুবিশাল বক্ষপটে, দেহজোড়া ঢেউ তোলা পেশিগুলিতে ও সর্বোপরি তার টলটলে স্বচ্ছ দুটি চোখে সেই চৌম্বকীয় টানটি আছে যা মেয়েদের রক্তে আগুন ধরায়। মাত্রই কয়েক চাঁদ আগে জুটি বেঁধেছে তারা। পরিচয়টি এখনও গভীর নয়। ইবা আড়চোখে একবার ঈশিরের দিকে ঘুরে দেখল। তালাইয়ের জন্য কষ্টই হচ্ছিল তার। তালাই সুন্দরী। হয়তো বা ইবার চেয়েও বেশি। তবু, ঈশির ইবাকেই নির্বাচন করল! শক্তিশালী ঈশির।
অবশ্য ঈশির যদি কখনও চায় তো ইবার সঙ্গে সঙ্গে তালাইয়ের গর্ভেও বীজবপন করতেই পারে। গোষ্ঠীর জন্য আহার ও বাসস্থানের সংস্থান করবার মতো, নারীর গর্ভসঞ্চারও তো পুরুষের কর্তব্যই বটে। কিন্তু তা বাদে ঈশির তার—শুধুই তার একার!!
কাঁধের কাছে একটি মৃদু স্পর্শে চমক ভাঙল তার। ঈশির ডাকছিল—দেখো দেখো ইবা। আকাশ থেকে তারা খসে পড়ছে। মুখ তুলে ঈশিরের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে ফিরে তাকাল সে। চাঁদের আলোয় ধোয়া একখণ্ড পাথরের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল তার পুরুষটি। আর তাকে ছাড়িয়ে, পশ্চিম আকাশে স্থির হয়ে থাকা তারাগুলির পটভূমিতে একটা ছোট্ট আলোকবিন্দু নড়ছিল। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর ক্রমশই তার গতি বাড়তে বাড়তে হঠাৎ এক চোখ ধাঁধানো নীলচে আলোর ধারা হয়ে তীক্ষ্ণ একটি শিসের শব্দ করে তা উড়ে গেল তাদের মাথার ওপর দিয়ে। তার ছটায় ম্লান হয়ে গেল রুপোলি জ্যোৎস্না। তবে সে কেবল একটু মুহূর্তের জন্য। তার পরেই, সারা আকাশ আলোকিত করে তারাটি গিয়ে আছড়ে পড়ল পাহাড়ের গোড়ার গভীর অরণ্যের মাঝখানে। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ।
মানুষ ও মানুষীটি সেইদিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তাঁদের সদ্যোজাত ভাষার সামান্য শব্দভাণ্ডার এই অসামান্য দৃশ্যটিকে প্রকাশ করতে পারে না। তবে বিস্ময়টা অবশ্য বেশিক্ষণ রইল না। বছরের এই সময়টাতে মাঝেমাঝেই আকাশের তারা এসে বনভূমিকে আঘাত করে। অতএব ব্যাপারটা যে একেবারেই নতুন তা নয়। ওদিকে রাত্রিটি মোহময়য়। হালকা ঠান্ডা বাতাসও বইছে পূর্ব দিক থেকে। পাশে সঞ্চিত ফলের স্তূপটির দিকে হাত বাড়াল ইবা। তার পুরুষটি এই আহার সংগ্রহ করে এনেছে তার জন্যই। একটি রসালো ফলে কামড় বসিয়ে অর্ধভুক্ত ফলটি ঈশিরের মুখের দিকে এগিয়ে ধরল সে—
রাত্রি গভীর হয়েছে। রুপোলি পূর্ণচাঁদটি এখন মধ্যগগনে। ঝিলের অকলঙ্ক তীরভূমিতে, আকাশ ও ধরিত্রীর সন্তানদুটি একে অন্যকে বড়ো সুখে আলিঙ্গন করে ঘুমায়। পাহাড় থেকে নেমে আসা রাত্রির শীতল বাতাস তাদের দেহে সুখদ স্পর্শ দিয়ে যায়, আকাশ থেকে ঝরে পড়া গলিত রুপোর মতো চন্দ্রধারা তাদের নিরাবরণ দেহদুটিকে আবৃত করে রাখে।
ঠিক সেই সময়েই অরণ্যের গভীরে, বনস্পতিদের নিবিড় ছায়ার আড়ালে, মাটির অল্প গভীরে প্রোথিত একটি ছোটো গোলক নড়েচড়ে উঠল একবার। গ্রহটির বায়ুমণ্ডল দিয়ে অবতরণের সময় উত্তাপে তার দেহের বাইরের দিকটি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। তীব্রগতিতে ভূমিস্পর্শ করবার ফলে নরম মাটি ভেদ করে খানিকটা ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল সে। তার উত্তপ্ত শরীরে সেই সুগন্ধি নরম ও শীতল মাটির স্পর্শটি বড়ো সুখদায়ক হয়েছিল।
অবতরণের পরবর্তী প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি শেষ হয়েছে এতক্ষণে। গ্রহটির পরিবেশ, গোলকবাসী ঘুমন্ত যাত্রীটির পক্ষে একেবারেই আদর্শ। এইবারে তবে তাকে বাইরে আনা যেতে পারে। ধীরে ধীরে মাটি ফাটিয়ে বাইরে বার হয়ে এল গোলক। তারপর একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে তার মাথার দিকটা খুলে পড়ল একপাশে। ঝাঁকুনির স্পর্শে প্রজাপতির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উন্মুক্ত বাতাদের স্পর্শ দেহে লাগামাত্র তার মুখের ভেতর গুটিয়ে থাকা মধুশোষক নলটি বাইরে বার হয়ে এসে বাতাসের একটি ক্ষুদ্র নমুনা শুষে নিল দেহের ভেতরে।
রাসায়নিক বিশ্লেষণটি শেষ করতে কয়েক মুহূর্তমাত্র সময় লাগল তার। সব ঠিক আছে। প্রভুগ্রহের সঙ্গে সম্পূর্ণই মিলে গেছে এ গ্রহের বাতাসের উপাদান। আর দেরি নয়। গোলকের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে এল সে। তারপর রামধনু রঙের ডানা চারটি মেলে ধরে নিঃশব্দে ভেসে গেল রাত্রের আকাশে।
অন্ধকার বনস্পতিদের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য হয়ে উড়ে চলেছিল সে। তবে একজনের তীক্ষ্ণ চোখে ঠিকই ধরা পড়ে গিয়েছিল তার এই উড়ান। মাথার ওপরের একটি অন্ধকারে ঢাকা গাছের ডালের ওপর থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টির মালিকটি এইবারে ডানা মেলে নিঃশব্দে ঝাঁপ দিল সুস্বাদু এই খাদ্যপতঙ্গটির ওপর।
তার অবলোহিত সুবেদি চোখে ঠিকই ধরা পড়েছিল তার আক্রমণকারীর গতিপথ। কিন্তু তবু, পালাবার কোনো চেষ্টাই করল না প্রজাপতিটি। লোভনীয় একখণ্ড খাবারের মতো সে ভাসছিল বাতাসের ভেতর। মাত্র দু’তিনটি মুহূর্ত, তারপরেই দুটি শক্তপোক্ত ঠোঁট বাতাস থেকেই সরাসরি তাকে মুখে তুলে নিল।
পতঙ্গটা বড়োই বিস্বাদ। ঠিক বিস্বাদ নয়, কোনো স্বাদই নেই তার। তবে আসল ব্যাপারটা হল, খাদ্য খাদ্যই। প্রজাপতিটাকে মুখে পুরে পেঁচাটি আবার ফিরে গেল তার অন্ধকার ডালে। এবারে পরবর্তী খাদ্যের জন্য প্রতীক্ষা।
প্রাণীটির পাকস্থলীতে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র জারকরসের বিন্দু বিন্দু ধারা এসে পড়ছিল তার শরীরে। সেগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে নিয়ে প্রজাপতি তার কাজ শুরু করল। প্রাণীটির কোশের ভেতর সঞ্চিত দেহসংকেতের সঙ্গে এবারে তুলনা করতে হবে তার স্মৃতিভাণ্ডারে জমা হয়ে থাকা প্রভু জীবের দেহকোশের রাসায়নিক সংকেতের।
কাজটি সরল। শেষ করতে বেশিক্ষণ সময়ও লাগল না তার। লক্ষাধিক বৈশিষ্ট্যসংকেতের মধ্যে প্রথম দু-একটি মিলিয়ে নিয়েই সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, এ প্রাণীটি একেবারেই ভিন্নজাতীয়। জিন প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। নষ্ট করবার মতো সময় ছিল না তার কাছে। অনেক কাজ রয়েছে হাতে। এইবার তার মাথার ওপরে বসানো পুঞ্জাক্ষি থেকে বের হয়ে এল চুলের মতো সূক্ষ্ম এক আলোকময় শক্তিধারা। পাকস্থলীর আবরণ কেটে মুহূর্তে একটা গোল গর্ত তৈরি হয়ে গেল পাখিটির পেটের নীচের দিকটিতে। প্রজাপতিই আবার উড়ে বের হয়ে এল বাইরের মুক্ত আকাশে। মৃত পাখিটি গাছের ডাল থেকে খসে পড়ল নীচের ঝোপঝাড়ের ভেতর। সে কখনও জানবে না—
—সমস্ত রাত ধরে পতঙ্গটি উড়ে বেড়ায় বনভূমি জুড়ে। বহুতর প্রাণবৈচিত্রে সমৃদ্ধ এই গ্রহটি। রাত্রের বাতাসে তাদের চিন্তাতরঙ্গের বহুবিচিত্র ধ্বনি এক অপরূপ সঙ্গীতমূর্চ্ছনার মতোই ধরা দেয় তার অতিসংবেদি যন্ত্র ইন্দ্রিয়ে। তবু, তাদের একটির সঙ্গেও কোনো মিল নেই প্রভুজীবের মস্তিষ্ক তরঙ্গের। তার আরদ্ধ কাজটি হল প্রভুজীবের দেহসংকেত ও মস্তিষ্ক তরঙ্গের সঙ্গে তুলনীয় একটি জীবকে খুঁজে বার করে নিজেকে তার খাদ্যে পরিণত করা। প্রভুগ্রহের অধিকাংশ প্রাণীর কাছে প্রজাপতি অতি প্রিয় খাদ্য। বিশেষত প্রভুজীবের কাছে সে, গ্রহের শ্রেষ্ঠতম খাদ্যগুলির মধ্যে একটি। সৃষ্টিকর্তারা তাই তাকে এই আকার দিয়েছেন। এ কথা সে জানে। উপযুক্ত প্রাণীটির পেটের ভেতর গিয়ে পৌঁছে গেলেই তার কাজ শেষ। এর পরের দায়িত্ব নেবে তার ভেতরে অপেক্ষা করে থাকা ভাইরাসটি।
স্রষ্টারা আজ মৃত। অতিদূর মহাকাশের কোনো এক অজানা কোণে ছড়িয়ে আছে হয়তো বা তাঁদের দেহভস্ম। পতঙ্গটি তবু তাঁদের দিয়ে যাওয়া কাজটি এগিয়ে নিয়ে যায়—নিঃশব্দে, ধাপে ধাপে—
***
শেষরাত্রের দিকে সে তার অভীষ্ট লক্ষ্যবস্তুটিকে খুঁজে পেল। বনের পার্শ্ববর্তী ঝিলটির তটভূমিতে দুটি প্রাণী ঘুমিয়ে ছিল খোলা আকাশের নীচে। এদের আকৃতির সঙ্গে প্রভুজীবের চেহারার অদ্ভুত মিল। প্রকৃতির কোন অজ্ঞেয় লীলায়, গ্যালাক্সির দুটি গ্রহে সৃষ্টি হয়েছে একই রকমের আকৃতির দুটি জীব, হয়তো বা সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিব্যক্তির পথ ধরেই।
শেষ রাত্রের আবছা আলোকিত আকাশে ভাসতে ভাসতে প্রজাপতিটি নীরবে দেহদুটিকে দেখে। সবল, সতেজ দুটি শরীর। এখনও পোশাক পরতে শেখেনি। ঘুমের মধ্যে যে সামান্য নড়াচড়া করছে—তাতেও কি সুন্দর ভঙ্গীগুলি ফুটে ওঠে একেক বার। স্বপ্ন দেখছে জীবদুটি। সে স্বপ্নগুলি পড়ে নিতে কোনো অসুবিধে হয় না যন্ত্রপতঙ্গের। সরল উল্লাস ও নিবিড় প্রেমের তুচ্ছ অথচ মোহময় সব স্বপ্ন।
একসময় রাত্রি শেষ হল। সূর্যের প্রথম রশ্মিটির ছটা এসে পড়েছে প্রাণীদুটির চোখে। চিন্তাতরঙ্গের ধারাগুলি বদলে যাচ্ছে দ্রুত। প্রাণীদুটি জেগে উঠছে। আলো ওদের ঘুম ভাঙায়!! এবার—
একেবারে কাছে এসে তাদের নাগালের মধ্যে ভাসতে শুরু করল প্রজাপতি। মেয়ে প্রাণীটি জেগে উঠেছে। চোখ খুলে দেখল সে এবারে। সরল অথচ তীক্ষ্ণ চোখদুটি স্থির হয়েছে এসে ভাসমান রঙিন পতঙ্গটির ওপরে। হাতটি বাড়িয়ে ধরল সে। প্রজাপতিটি এসে বসেছে তার প্রসারিত করতলে। হাতের ভেতর মুঠো করে তার পাগুলো ধরে ইবা ঈশিরকে মৃদু ধাক্কা দিল একবার, “চোখ খোলো ঈশির। চেয়ে দেখো একবার—কী সুন্দর!!”
দুটি মাথা ঘনিষ্ট হয়ে এসেছে। ইবার হাতে বন্দি পতঙ্গটি তার রঙিন ডানাদুটো ঝাপটায়। নতুন সূর্যের আলোতে ঝিলমিল করে ওঠে ডানাদুটি। দুটি লালাসিক্ত মুখগহ্বর তার একদম কাছাকাছি চলে এসেছে—আর মাত্র একটি মুহূর্ত—
কিন্তু, পুরুষপ্রাণীটির চোখদুটি হঠাৎ নরম হয়ে এল। কথা বলছে সে, “ওর ব্যথা লাগছে ইবা। কেন ধরে রেখেছ ওকে? আমরা তো এদের খাই না। ছেড়ে দাও।”
ডানাদুটি ছড়িয়ে দিয়ে বসন্তের সুগন্ধি বাতাসে ফের ভেসে চলে প্রজাপতিটি। ঝিলটির নীল জলে হালকা ঢেউ উঠছে। প্রাণীদুটি তাকে ছেড়ে দিয়ে বনের দিকে চলে গেছে অনেকক্ষণ হল। প্রভুজীবদের মানসিক কাঠিন্যের ছিটেফোঁটাও নেই এসের ভেতরে। বিশ্রী কোমল মন!
আর একটা তফাতও আছে। এরা প্রজাপতি খায় না। কে জানে, এরা হয়তো একেবারেই আমিষাশী নয়! চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রাণীদুটির খাদ্যের উচ্ছিষ্টগুলোকে যত্ন করে একবার পরীক্ষা করে সে। বাদাম ও দুয়েক ধরনের ফল।
বাতাসে ভাসতে ভাসতেই তার বর্তমান কর্মপদ্ধতিটাকে বন্ধ করে দিয়ে প্রথম বিকল্প পদ্ধতি চালু করে দিল সে। তারপর উড়ে চলল কাছের বনটির চিকে। এদের খাদ্য যে কোনো একটা ফলের গাছকে খুঁজে বের করতে হবে ওই বন থেকে।
সন্ধান পেতে বেশি দেরি হল না। বনের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। তারই পাশে তার উদ্দিষ্ট গাছটিকে পাওয়া গেল। এখানে বন অপেক্ষাকৃত হালকা। একটা গোলাকার ঘাসজমির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল গাছটা। তার পাশ দিয়ে জন্তুদের চলাচলের পথ চলে গেছে। ফুল ধরেছে গাছটাতে। উড়তে উড়তেই একটা ফুলকে বেছে নিল প্রজাপতি। তারপর তার মধুশোষক নলটি ঢুকিয়ে দিল তার মধ্যে।
ফুলটির অন্তঃস্থল ভেদ করে নলের মাথাটি গিয়ে পৌঁছল তার ডিম্বাশয়ে। এইবারে নলের মাথা থেকে একটি সূক্ষ্ম ফাঁপা ছুঁচ বার হয়ে এসে একটি ডিম্বকোশের ওপরে এসে স্থির হল। তারপর প্রজাপতির গর্ভে সঞ্চিত ছোট্ট পাত্রটির মধ্যে জমা করে রাখা তরলের একটি ফোঁটা সেই ছুঁচের ভেতর দিয়ে এসে ছড়িয়ে গেল কোশটির দেহে। এবারে, একটি পরাগকণাকে সযত্নে সেই ডিম্বকোশটির গায়ে এনে স্থাপন করে, ধীরেসুস্থে নলটিকে আবার নিজের মুখের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে বাতাসে ভেসে গেল রঙিন পতঙ্গ।
কোনো সাক্ষী রইল না। শুধু নদীতে জল খেতে আসা একটি বন্য হরিণ একবার মাথা তুলে দেখেছিল, ফুলের গায়ে উড়ে বসেছে একটা রঙিন প্রজাপতি। পতঙ্গ তার খাদ্য নয়। হরিণটি অতএব সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে, নদীতে মুখ ডুবিয়ে জলপান সেরে ফিরে চলল তার চারণভূমির দিকে। পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসা নরম সবুজাভ আলো ও সারাদেহে বসন্তের গন্ধ নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সে ফুলবান গাছটি।
এইবারে অপেক্ষার পালা। কত কাল প্রতিক্ষা করতে হবে সেই প্রজাপতিটিকে কে জানে! অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা নেই। সময় তার পক্ষে। তার পারমাণবিক বিদ্যুৎকোশ আগামী কয়েক লক্ষ বছর তাকে নিয়মিত শক্তি জুগিয়ে যাবে। অপেক্ষা যদি তার চেয়েও দীর্ঘায়িত হয়, সেজন্য সৌরতড়িৎ উৎপাদক ডানাদুটি তো রইলই!
এই বিকল্প পদ্ধতিটি কাজে না করলে আবার নতুন পথে চেষ্টা করতে হবে। আরও অনেক পথ আছে—তার মস্তিষ্কে মুদ্রিত আছে সেসব কৌশলের অনুপুঙ্খ বিবরণী।
ফুলের ডিম্বকোশটি এক অজানা প্রোটিনের উপস্থিতি টের পেয়েছে। সে যুদ্ধের জন্য তৈরি হল। বিষাক্ত অ্যান্টিবডির একটা ধারা ছুটে এল ভিন্ন জাতের প্রোটিনটির ওপর। ভাইরাসটি অক্লেশে সহ্য করে নিল এই আক্রমণ। তার প্রোটিন আবরণ অটুট রইল। তারপর আটটি সূক্ষ্ম পা দিয়ে সে কোশের দেয়ালটিকে আঁকড়ে ধরে ছোট্ট একটা গর্ত খুঁড়ল তার গাঁয়ে। তার মধ্যে দিয়ে ভেতরকার ডিএনএ তন্তুটি হিলহিলিয়ে ঢুকে এল ডিম্বকোশের ভেতরে—
—অ্যান্টিবডির আক্রমণ ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। শূন্য প্রোটিন আবরণীটি আর বাধা দিল না। ধীরে ধীরে গলে মিশে হারিয়ে গেল সে। ওদিকে ততক্ষণে কোশটির ভেতরে নিউক্লিয়াসের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে তার ডিএনএ তন্তুটি। নিজের চেহারায় সামান্য অদলবদল ঘটিয়ে সে কোশের নিউক্লিয় জালিকার সঙ্গে মিশে গেল। এখন থেকে এই পরিবারেরই এক সদস্য বলে সে গৃহীত হবে। কোশ থেকে কোশান্তরে ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে। বাহক বীজটি একসময় বদলে যাবে নতুন বৃক্ষে। কিছুকালের মধ্যে সেই গাছে ফল ধরবে—ফলের প্রতিটি কোশের মধ্যে নীরবে অপেক্ষা করে যাবে প্রভুজীবের সংকেতবাহী তন্তুটির একটি করে প্রতিলিপি—
৩
নিষিদ্ধ বৃক্ষের পদতলে
দশটি বসন্তকাল। কত দীর্ঘ সময়! তাদের যৌথ গুহাটির সামনে সে পা দুটি ভাঁজ করে বসেছিল। জায়গাটি নীরব। প্রথম বসন্তের বাতাসে শীতের মৃদু কামড়। সময় তার ওপরে বিশেষ ছায়া ফেলতে পারেনি। সেই আগেরই মতো সতেজ, সুন্দর রয়ে গেছে ইবা।
অথচ তালাই তো আর সুন্দর নেই। তাকে দেখলে বৃদ্ধা মনে হয়। তার চামড়ায় বয়সের কুঞ্চন। তার পেটটি সর্বদাই উঁচু হয়ে থাকে কোনো এক অজ্ঞাত রোগের প্রকোপে। দশ বছরে আটটি সন্তান হলে এইরকমই হয়। মনে মনে নিজের সঙ্গে তালাইয়ের শরীরের তুলনা করে একটা বিকৃত আনন্দ হচ্ছিল ইবার। অথচ, হৃদয়ের গভীরে সে তালাইকে হিংসা করে। তীব্র, বিষময় ঈর্ষা!! তালাইয়ের দু’দুটি ছেলের পিতা তার ঈশির। অথচ এতদিনেও সে ইবাকে একটিও সন্তান দিতে পারল না। মাত্রই কিছুদিন আগে তালাই আর তার আট সন্তানের জন্য ইবাকে তার ঝিলের পাড়ের গুহাটি ছেড়ে দিতে হয়েছে। গুহাটি প্রশস্ত ও আরামদায়ক। অতএব তেমন বাসস্থান তালাইয়েরই প্রাপ্য। সন্তানবতী মায়ের আদর সকল গোষ্ঠীতেই বেশি। ইবার ভাগ্যে এখন জুটেছে পাহাড়ের মাথার শীতল অঞ্চলের এই ছোট্ট গুহাটি। বন্ধ্যা মেয়ের এর বেশি কী-ই বা আর প্রাপ্য হতে পারে! তাতে অবশ্য ইবার কোনো দুঃখ নেই। স্বেচ্ছায়, বিনা প্রতিবাদে সে ছেড়ে দিয়েছে তার আরামপ্রদ গুহাটিকে। গোষ্ঠীজীবনের এ-ই তো নিয়ম!
ইবার অবশ্য একটি বিরল সৌভাগ্য আছে। গত দশ বছরে তার প্রতি ঈশিরের আনুগত্য ও ভালোবাসাতে ঘাটতি পড়েনি কোনো। তাদের জুড়িটি এখনও গোষ্ঠীর অন্য মেয়েদের ঈর্ষার বস্তু। শুধু—একটি সন্তান—নিজের প্রাণ দিতে পারে ইবা একটি সন্তানের জন্য। তবু ঈশির কেন তাকে সেটুকু দিতে পারে না! কোন অভিশাপে—
—নীচের থেকে দ্রুত পদক্ষেপের শব্দে চমক ভাঙল ইবার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দুটি শক্তিশালী বাহু এসে ঘিরে ধরল তাকে। তার দেহে অরণ্য ও চন্দ্রালোকের সুগন্ধ। ইবা ঈশিরের কোল ঘেঁষে এল। তার চোখের জল ধুইয়ে দিচ্ছিল ঈশিরের বুক। কিছু পরে নিজেকে সংযত করে সরে বসল সে। তারপর দৃঢ়স্বরে বলল, “বনের মধ্যে বৃক্ষদেবতার কাছে যাব আমি।”
ঈশিরের গলাটা যেন কেঁপে উঠল একবার—“কিন্তু—তিনি যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর অধীশ্বর!! যে প্রাণী তাঁর কাছে যায় তারই যে মৃত্যু অবধারিত! বৃদ্ধেরা কি আমাদের বারে বারে সাবধান করে দেন না!!? তাঁর কাছে যেতে নেই। খেতে নেই তাঁর ফল!”
“কিন্তু ঈশির—ঈশির—তিনিই যে সবচেয়ে শক্তিমান দেবতা! যাঁর নামে স্বয়ং গোষ্ঠীপতিও ভীত হয়ে নতজানু হন, তিনিই কি প্রকৃত ঈশ্বর নন? যিনি অরণ্যের সবচেয়ে শক্তিমান জীবকে মুহূর্তে হত্যা করতে পারেন, ইচ্ছা করলে কি তিনি সামান্য একটি জীবন উপহার দিতে পারবেন না আমার দেহের ভেতরে? ঈশির আমায় সন্তান দেয়নি। এবারে হয় সেই সেই দেবতা আমাকে একটি সন্তান দেবেন, অথবা দেবেন চোখের পলকে মৃত্যু। এই দুটির মধ্যে একটি ছাড়া আর আমার কিছু প্রয়োজন নেই ঈশির।”
ঈশিরের মনের ভিতরটি ভয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল কিন্তু ইবাকে সে জানে। জগতের কোনো ভয়, কোনো প্রলোভনই আর তাকে থামাতে পারবে না এখন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, “ঠিক আছে। তবে আজ রাতে নয়। কাল। সূর্যোদয়ের পর।”
অরণ্যের কেন্দ্রস্থলে, নিষিদ্ধ গাছটি নদীর পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকে। মাত্র দশ বছর বয়স তার। তবু, এই বয়সেই উচ্চতায় সে অরণ্যের বহু গাছকেই ছাড়িয়ে গেছে। এখন তার ফল ধরবার ঋতু। লালে হলুদে মেশানো উজ্জ্বল ফলগুলি যেন আলো করে রেখেছে গাছটিকে। তার নীচের ডালগুলি ফলভারে মাটিকে ছুঁয়ে থাকে প্রায়।
একটি হাতি পরিবার সকালের দিকে নদীতে স্নান করতে এসেছিল। কিছু আগে তারা ফিরে গেছে। দলের সবচেয়ে ছোটো সদস্যটি একটি ফল শুঁড়ে ধরে পরীক্ষা করতে গিয়েছিল। তার মা তাকে মাথা দিয়ে ধাক্কা মেরে মেরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ফের। সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূত ওই গাছটিকে তারা সকলেই চেনে। গোটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র হাড়গোড় ও পচাগলা মৃতদেহ ওই মৃত্যুদুতের শক্তির সাক্ষ্য বহন করে।
ঝোপঝাড় ভাঙবার মৃদু একটা শব্দ উঠল কাছেই কোথাও। প্রথমে একটি শুঁড়, তারপর তার পেছন পেছন সম্পূর্ণ শরীরটাই এবারে বার হয়ে এল বাইরে। হস্তিশিশুটি ফের ফিরে এসেছে। লোভেরই জয় হয়েছে শেষে। মা নেই কাছাকাছি। নিঃশব্দ পায়ে সে এবারে এগিয়ে এল গাছটির কাছে। শুঁড়ে তুলে পরখ করে নিল একটি ফল। তারপর সেটিকে মুখে পুরে দিল। অপুর্ব স্বাদ। এবারে আরও একটা—
—পেটভরতি করে ফল খাবার পর একটু নেশার মতোই হয়ে গিয়েছিল তার। ফলগুলোতে সামান্য মাদক ভাব আছে। শিশুটি এইবারে জলের ধারে রৌদ্রে গিয়ে বসল। তারপর একটি আরামের শব্দ করে আলস্যে শরীর এলিয়ে দিল মাটিতে। তার চোখে ঘুম আসছে—
—পেটের ভেতর ফলের কোশগুলি দ্রুত ফেটে পড়ছিল। লক্ষ লক্ষ ভাইরাল ডিএনএ তন্তু তাদের নিউক্লিয়াসের বাসা ছেড়ে বার হয়ে আসছিল। পাচকরস তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। অর্ধপাচিত খাদ্যের সঙ্গে মিশে তারা এগিয়ে গেল অন্ত্রের দিকে। তারপর সেখান থেকে পাচিত খাদ্যরসের সঙ্গে রক্তস্রোতে মিশে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল আক্রমণকারীরা।
হস্তিশিশুটি নরম রৌদ্রে পিঠ দিয়ে ঘুমায়। ফলের মাদকরস তার নার্ভতন্ত্রকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর ঠিক সেই সময় তার দেহের প্রতিটি কোশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল এক একটি আগন্তুক ডিএনএ তন্তু। আমূল বদল আনছিল কোশের গঠনে। কোশগুলি বদলে যাচ্ছিল প্রভুজীবের দেহকোশে। বদলালো না শুধু দেহের গঠন ও স্মৃতি। সেটা পরবর্তী প্রজন্মের সৃষ্টির আগে সম্ভবও নয়।
পড়ন্ত রোদের আলোয় ঘুম ভাঙল শিশুটির। মাদকের নেশা কেটে গেছে। সেই আচ্ছন্নতার মধ্যেই নিজের অগোচরে সে নিজেও বদলে গেছে ভেতর থেকে। চোখ পিটপিট করে চারদিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল সে একবার। আর তার পরেই টলে উঠে আছড়ে পড়ল মাটির বুকে। সদ্য পরিবর্তিত, মানবকোশের মতো করে গড়ে তোলা দেহকোশগুলি একটা হাতির দেহকাঠামোকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম নয়। সমস্ত দেহ ও চেতনাটাই তার একটা চূড়ান্ত বিভ্রান্তির সম্মুখীন হয়েছে। একে একে তার শরীরের প্রধান যন্ত্রগুলি অচল হয়ে আসে। তারপর, এক তীব্র যন্ত্রণাদায়ক সময়ের পরে তার হৃৎপিণ্ডটি থেমে গেল।
আছড়ে পড়া মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে দেখল একবার প্রজাপতিটি। আরও একটি ব্যর্থ পরীক্ষা! আরও একটি মৃত্যু!
***
গাছের পাতার ফাঁকে রৌদ্রের ঝিলিমিলির মধ্যে দিয়ে নদীর ধার ধরে গভীর বনের দিকে এগিয়ে চলেছিল ঈশির ও ইবা। পথ হারাবার কোনো ভয় নেই। নদীটিই তাদের পথের নিশ্চিত নিশানা। এই পথেই আগে কোথাও রয়েছে বনের মৃত্যুদেবতার আবাস। মানুষের চোখে তিনি দেখা দেন একটি গাছের অবয়বে। এইটুকুমাত্র তারা শুনেছে বৃদ্ধদের মুখে।
সূর্যোদয়ের মুখে রওনা হয়েছিল তারা। পথ চলতে চলতে সূর্য এখন মাথার ওপরে। ঈশিরের মনে ক্ষীণ একটা আশা জাগছিল, বৃক্ষরূপী মৃত্যুদেবতা হয়তো বা আজ আর দেখা দেবেন না তাদের। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই তাদের সামনের দিক থেকে নদীপথ ধরে ছুটে এক মৃত্যুদেবতার নিশ্বাসের মতোই এক ঝলক উত্তরের হাওয়া। নদীর জলে ঢেউ তুলে দক্ষিণের ঝিলটির দিকে চলে গেল তা। তীব্রগন্ধি সেই বাতাসে মিশে ছিল পচা শবদেহ ও পাকা ফলের মিশ্রিত ঘ্রাণ। তাদের গন্তব্য আর তবে বেশি দূরে নয়। ঈশির আতংকিত দৃষ্টিতে ইবার দিকে একবার ফিরে দেখল। ইবার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। চেতনার গভীরতম স্তরে সে শুনতে পাচ্ছিল এক অমোঘ আহ্বান, “মা ভৈ! কাছে এসো। একটি ফল খাও। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে—”
স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো সে হেঁটে চলে গন্ধটির উৎসের দিকে। ঈশির অসহায়ভাবে একবার চেয়ে দেখল আকাশের দিকে। ইবার ঠিক মাথার ওপরে উড়ে চলছে রামধনুবর্ণ একটি প্রকাণ্ড প্রজাপতি। যেন কোনো অদৃশ্য লতার বন্ধনে তার গতিটি ইবার গতিপথের সঙ্গে বাঁধা। কে জানে, হয়তো ওই ফলের গন্ধেই প্রলুব্ধ হয়ে প্রজাপতিটিও চলেছে বৃক্ষদেবতার উদ্দেশেই!
“—ইবা! শোন!! চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ওই অজস্র গলিত শবদেহ ও কংকাল কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না? দেখ—একটি হাতির শিশু অবধি এই দেবতার বলি হয়েছে।”
ইবার মুখে এক বিচিত্র হাসি ছড়িয়ে পড়ল, “কিন্তু ঈশির, আমায় যে যেতেই হবে! সেজন্যই তো আমার এখানে আসা! দেবতার কাছে প্রার্থনা করে তাঁর আশীর্বাদ পাবো বলেই তো—আহা! দেখো! দেখো! তুমি ভুল করছ ঈশির! ওই রঙিন প্রজাপতিটি কেমন গাছটির ডালে ডালে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ও তো মরছে না! আমি ভয় পাই না ঈশির! আমি যাব—”
“না, তুমি যাবে না। গাছটা অশুভ। ও মৃত্যু দেয়। আমি তোমাকে যেতে দেব না ইবা—” দুটি লৌহকঠিন হাত মেয়েটিকে এক প্রবল আলিঙ্গনে বন্দি করে নেয়—
প্রজাপতিটি প্রাণপণে মানুষদুটিকে নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। পুরুষটির মস্তিষ্ক অনেক ভোঁতা। তার মানসিক সংকেত ধরবার উপযুক্ত নয়। কিন্তু মেয়েটি অনেক বেশি সংবেদনশীল। মস্তিষ্কটি অনেক বেশি সূক্ষ্ম! প্রজাপতি তার মনটিকে এবার সরাসরি এক সুতীব্র আঘাত হানল—
তীব্র, চোখ ঝলসানো একটা যন্ত্রণা, মুহূর্তের জন্য ঝিকিয়ে উঠল ইবার মাথায়। একটা অন্ধ, অকারণ রাগ গড়ে উঠছিল তার মস্তিষ্কের কোশে কোশে। তারপর হঠাৎ সেই রাগটির বহিঃপ্রকাশ ঘটল তার দেহের প্রতিটি পেশিতে। এক দানবিক শক্তির মুহূর্তের বিস্ফোরণে পুরুষটি ছিটকে পড়ল মাটিতে—তাকে সেখানেই ফেলে রেখে গাছটির দিকে ছুটে গেল ইবা—
***
—গাছটির গুঁড়ির কাছে পাশাপাশি বসে ছিল তারা দুজন। পুরুষটি নিজের ভয়কে জয় করে তার নারীকে শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করেছে। ফলগুলি তাদের পরিচিত। সুস্বাদু, রসালো এবং সুগন্ধযুক্ত। একটি সুপক্ক ফলের গায়ে কামড় দিল ইবা। উষ্ণ, মিষ্টি স্বাদটি ছড়িয়ে পড়ছে তার মুখের ভেতর!
“দেখ ঈশির! আমি মরিনি। এমন স্বাদু ফল তুমি কখনও খাওনি! খাও ঈশির, খাও—”
ইবার ধূসর, উজ্জ্বল চোখে চোখ রাখল ঈশির। সেখানে যন্ত্রণা বা মৃত্যুর কোনো চিহ্ন নেই। জীবনীশক্তিতে পূর্ণ চোখদুটি এলোমেলো চুলের ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। একটা সুতীব্র সুখানুভূতি ছড়িয়ে পড়ছিল ঈশিরের শিরায় শিরায়—ইবা—একগুঁয়ে ইবা—তার দুর্দম, দুর্দান্ত, সরল ইবা—তার জীবন ও মৃত্যুর একমাত্র সঙ্গিনী—
—আধখাওয়া ফলটি ঈশিরের মুখের সামনে ধরে রেখেছিল সে। ঈশির তার হাতটি টেনে এনে ফলটির গায়ে মুখ ঠেকালো—
***
রাত গভীর হয়েছে। আকাশে মেঘের অবিরাম আনাগোণা। বিদায়ী শীতের শেষ কামড়ের মতোই ঝিলের বুক থেকে উঠে আসে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া। পাহাড় চূড়ার নিরালা গুহাটিতে শুকনো ঘাসের স্তূপে আকণ্ঠ ডুবে থেকে তারা দুজন ঘুমায়। স্বপ্নহীন চেতনাহীন এক সুগভীর নিদ্রা! এই মুহূর্তে মস্তিষ্কটি তাদের সম্পূর্ণ কর্মহীন। কিন্তু দেহের প্রতিটি কোশ সজাগ রয়েছে। চূড়ান্ত কর্মব্যস্ততা চলেছে তাদের অন্দরমহলে। ঝড়ের বেগে বদলে যাচ্ছে তাদের জিনসংকেতগুলি।
প্রজাপতিটি নিখুঁত যান্ত্রিকতায় অচেতন প্রাণীদুটির শারীরিক লক্ষ্মণগুলি পরীক্ষা করে চলে। সবই স্বাভাবিক আছে। এঁদের দেহ ও মস্তিষ্কের গঠন প্রভুজীবদের সঙ্গে অনেকটাই এক। ফলে পরিবর্তনটিকে খুব সহজেই গ্রহণ করতে পারছেন এঁরা। চমৎকার!! কোনো গরমিল হয়নি।
অন্ধকার তরল হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য উঠবে। প্রজাপতি নীরবে তার পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি চালায়। পরিবর্তনের কাজটি অবশেষে শেষ হয়েছে। এই জীবদুটি আর কেবলমাত্র প্রভুজীবসদৃশ ভিনগ্রহী নয়। এঁরা এখন পুরোপুরি তার সৃষ্টিকর্তা প্রভুজীবই বটে। এখনও আদিম, তবে এবারে এঁরা দ্রুত পরিবর্তিত হবেন। নতুন করে গড়ে উঠবে প্রভুগ্রহের মহান সভ্যতা।
তাদের চেতনার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণটি সসম্মানে সরিয়ে নিয়ে গুহা ছেড়ে উড়ে গেল প্রজাপতি। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমন্ত মস্তিষ্কদুটিতে স্বপ্নেরা ভিড় করে আসে—
—নিহত তালাই রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে এক কোণে। হ্রদের পাশে তার প্রিয় গুহাটি থেকে তালাইয়ের সন্তানগুলিকে ছুড়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দেয় ইবা। এই এখন তার গুহা—
ওদিকে ঈশির তার স্বপ্নের জগতে ক্রমাগতই যুদ্ধ করে চলে—বিরাট একখণ্ড রক্তমাখা পাথর হাতে করে একের পর এক শত্রুকে আঘাত করতে করতে সে এগিয়ে চলে সামনে—তার পায়ের নীচে পিষ্ট হচ্ছে অসংখ্য ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মানবদেহ—কী আনন্দ!! কী সুখ!! সেই তীব্র উল্লাস হঠাৎ এক ভয়াল রণহুংকার হয়ে বের হয়ে এল তার গলা থেকে—আদিম মানবের প্রথম রণহুংকার—
ঘুম ভেঙে উঠে বসল ঈশির। ইবা আগেই জেগে উঠেছিল। সদ্যজাগ্রত ঈশিরের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে সে বলল, “আমার ঝিলের পাশের গুহাটা আমায় জয় করে এনে দাও ঈশির।”
“কিন্তু ইবা, তালাই! তার সন্তানগুলি—”
“—তালাই একটা ডাইনি। আমি আজ নিজে হাতে তার চোখদুটি উপড়ে নেবো। তুমি কি আমায় ভালোবাসো ঈশির? তবে চলো, আমায় সুখী করো—”
ঈশির নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। তালাইয়ের জুটি তানুক বড়ো শক্তিশালী শিকারি। সাবধানে কাজ সারতে হবে। গুহার বাইরে গিয়ে খুঁজেপেতে দুটি হালকা, লম্বা ও ধারালো পাথরের টুকরো খুঁজে আনল সে। যুদ্ধটা বেশ মজার হবে আজ। ঘুমন্ত তানুক আর তালাই কিছু বোঝবার আগেই—আচ্ছা, মানুষের রক্তের স্বাদ কেমন? আজ ঈশির সেই স্বাদ নিয়ে দেখবে। যুদ্ধ শেষে তানুকের রক্তমাখা পাথরটি একবার লেহন করে নিলেই হবে—
প্রাকপ্রভাতের ধূসর অন্ধকারে, তীক্ষ্ণধার পাথরের অস্ত্র হাতে পাথর থেকে পাথরে লাফ দিয়ে নেমে চলে তারা দুজন—সদ্য পরিব্যক্ত হোমো সেপিয়েন্স, এই গ্রহের হোমো ইরেক্টাস বাসিন্দাদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে চলেছে—
—প্রজাপতি নিঃশব্দে সব দেখে। সৃষ্টিকর্তা প্রভুজীব দুজন এই যুদ্ধে জিততে বাধ্য। নারীজীবটির অকেজো জরায়ুটিকে কাল রাতে তাদের ঘুমের মধ্যেই নিরাময় করে দিয়েছে সে। এবারে সে বহু সন্তানের জননী হবে। পুরুষটিও আরও বহু নারীর গর্ভসঞ্চার করবে। এইভাবে ক্রমাগতই সংখ্যায় বেড়ে চলবেন প্রভুজীবেরা। তারপর একসময় নতুন করে এই আদিম গ্রহে গড়ে উঠবে মহান কারিউজ সভ্যতা—
উপসংহার
ইন্দোনেশয়ার জঙ্গলে এক ফুট লম্বা বার্ডুইং প্রজাপতিদের মধ্যে একটি মৃত্যুহীন প্রজাপতি বাস করে। বহু সহস্রাব্দ ধরে সে বেঁচে আছে, এবং নিজেদের হোমো স্যাপিয়েন্স বলে পরিচয় দেওয়া এই গ্রহের শাসক জীবটির অগ্রগতি লক্ষ করে চলেছে। বারবার রক্তস্রোতে পৃথিবীকে ভাসিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছে হোমো সেপিয়েন্সদের জয়যাত্রা। প্রথমে শান্তিপ্রিয় হোমো ইরেক্টাসদের রক্তাক্ত বিলোপ, তারপর এই গ্রহে যখন তাদের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না, তখন নিজেদের মধ্যেই বারংবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নেমেছে তারা। নির্দ্বিধায় ধ্বংস করেছে একে অন্যের জনপদ।
পাশাপাশি বিজ্ঞানকে তারা এগিয়ে নিয়ে চলেছে ঝড়ের গতিতে। প্রথমে আগুন, তারপর আণবিক শক্তি, অবশেষে মহাকাশযান—মাত্রই কয়েকটি সহস্রাব্দির মধ্যে!! তবু আরও বহু পথ বাকি আছে। অতি আলোকগতিতে তারকাভ্রমণের প্রযুক্তি আবার নতুন করে আয়ত্ব করতে হবে এই প্রভুজীবদের। অস্ত্রে ও প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে এক বিশাল মহাকাশ সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিল কারিউজবাসীরা। তাদের জয় করা উপনিবেশগ্রহগুলিতে আজ তারা কেবলই অতীতের দুঃস্বপ্নমাত্র। তাদের জনশূন্য অতিকায় যন্ত্রচালিত যুদ্ধযান ও মহাকাশদুর্গগুলি নিঃশব্দে ভেসে থাকে মহাকাশের গভীরে। এই পৃথিবীর প্রভুজীবেরা তারকাভ্রমণের কৌশল পুনরাবিষ্কার করবার পর তাদের প্রকৃত পরিচয় ও ইতিহাস তাদের হাতে তুলে দিয়ে, এবং উপনিবেশ গ্রহগুলির ও যন্ত্রচালিত যুদ্ধগুলির মহাকাশস্থানাংক তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তবে তার ছুটি হবে। প্রজাপতি অপেক্ষা করে চলে।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য