ড. ওয়াগনারের পরাজয়
লেখক: বিশু দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[ভূমিকা: এ কাহিনি লেখার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। কী হবে লিখে? অধ্যাপক ফেডিনস্কিই যখন পৃথিবী থেকে চলে গেছেন তখন তাঁর ডায়েরি প্রকাশ করা মানে দুঃখ বাড়ানো ছাড়া আর কি? কিন্তু লিখতে আমাকে হলই শেষ পর্যন্ত। আপনারা হয়তো বলবেন, কেন? আমার আনন্দের ভাগ যদি আপনাদেরও না দিতে পারি তবে মানুষ হয়ে বাঁচার কোন মানেই হয় না—আমার অন্তত তাই মত।]
১
অধ্যাপক ফেডিনস্কির মৃত্যু সংবাদ পাবার পর শোক প্রকাশ করে একটা চিঠি দিয়েছিলাম তাঁর বাড়ির ঠিকানায়। সে-চিঠির উত্তর আসবে একদিন একথা ভাবিনি। জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক মেজনসভের কথা আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, যিনি ডা. রিউমার আর অধ্যাপক ফেডিনস্কির সঙ্গে বহুদিন ধরে পরীক্ষা চালিয়ে ছিলেন মহাশূন্যের আগন্তুকের দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্যে একান্ত গোপনে?
অপ্রত্যাশিতভাবে অধ্যাপক মেজেনসভের চিঠিটা পেয়ে খুবই অবাক হলাম।
বিজ্ঞান পর্ষদ
জ্যোতির্বিদ্যা শাখা
মস্কো
২১ জুলাই, ১৯৭১
প্রিয় দাস,
অধ্যাপক ফেডিনস্কির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে যে-চিঠি তুমি লিখেছ সেটা আমরা পেয়েছি সময়মতোই। তুমি বোধহয় জানতে না যে, অধ্যাপকের আপনার জন বলতে কেউ নেই পৃথিবীতে। তাঁর সমস্ত যন্ত্রপাতি এবং বাড়িটা তিনি গচ্ছিত রেখে গেছেন আমাদের কাছে এই শর্তে যে আমাদের দুজনার (আমার এবং ডা. রিউমারের) মৃত্যুর পর ওই বাড়িতে একটা শিশু-হাসপাতাল তৈরি হবে এবং যন্ত্রপাতি আর বইগুলো দেওয়া হবে জাদুঘরে এবং জাতীয় গ্রন্থাগারে। আমাকে হয়তো তুমি চেন না, কিন্তু তোমার কথা আমি শুনেছি অধ্যাপকের মুখে বহুবার। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গেছেন তাঁর ব্যক্তিগত যে ডায়েরিটা তোমার কাছে আছে—সেটা পড়া হয়ে গেলে রেজেস্ট্রি করে ফেরত পাঠিয়ে দিও আমার নামে। ওর মধ্য থেকে কোনো ঘটনা যদি প্রকাশ করার ইচ্ছে হয় তা করতে পারো, তবে পাত্র-পাত্রীদের নামগুলো পালটে নিও। কারণ, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বেঁচে আছেন এখনও। সবাই চান না তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে। আমার আসল নামও তুমি ডায়েরিতে পাবে, কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে আমাকে অধ্যাপক মেজেনসভ নামেই লিখো। চিঠির প্রাপ্তি সংবাদের আশায় রইলাম।
আশা করি ভালোই আছ। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।
ইতি-শুভাকাঙ্ক্ষী,
অধ্যাপক মেজেনসভ।
২
অধ্যাপকের ডায়েরিটা বার কয়েক পড়েছি, কিন্তু আশা মেটেনি এখনও। আজও মাঝে মাঝে পড়ি পুরোনো ঘটনাগুলো। সুন্দর ঝরঝরে অক্ষরে লেখা, পড়তে এতটুকু কষ্ট হয় না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অধ্যাপকের মুখ। ভাবতেই পারি না যে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন দূরে, অনেক দূরে, আর কোনোদিনই তাঁকে দেখতে পাবো না। চোখের পাতাগুলো ভিজে ওঠে আপনা-আপনি নিজের অজান্তেই। তাঁর মতো জ্ঞানী-গুণী লোকের স্নেহ লাভ করে ধন্য হয়েছি, ভাবতেও আনন্দ লাগে। ডায়েরিটাতে মোট পাঁচটা ঘটনা লিখেছেন তিনি। শেষের ঘটনাটা সম্পূর্ণ করে যাননি। অধ্যাপক মেজেনসভ বলেছেন যে বাকিটুকু তিনিই সম্পূর্ণ করে দেবেন। প্রত্যেকটি ঘটনা সমান কৌতূহলজনক। পড়তে পড়তে চলে যেতে হয় অন্য জগতে।
একটা ঘটনা আজ আপনাদের শোনাবো। অন্যগুলো ভবিষ্যতে শোনাবো যদি সে সুযোগ কোনোদিন আসে। অধ্যাপক যেভাবে লিখেছেন ঠিক সেইভাবেই আমিও লিখছি। এতে আমার কৃতিত্ব কিছুই নেই কেবল অনুবাদ করা ছাড়া।
৩
অধ্যাপক ফেডিনস্কির ডায়েরির কয়েকটি পাতা।
১৪ মে, ১৯৬৭
মাস চারেক আগে খবরের কাগজে দেখলাম, ককেশাস পর্বতের নীচে যেখানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চাষের জমি তৈরি করা হয়েছে কিছুদিন আগে একটা উল্কা এসে পড়েছে সেখানে। আশপাশের গ্রামের লোকেরা প্রথম রাতে একটা উজ্জ্বল আলোর মতো জিনিস পড়তে দেখে মাটিতে। খবরটা মুখে মুখে প্রচার হয়ে পড়ে। শেষে বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রী দল সেই অঞ্চলে পাড়ি দিয়ে উল্কাটাকে খুঁজে বার করেন। সেখানটা তখন ছিল অনুচ্চ পাহাড়ি অঞ্চল। প্রায় দু-হাজার মিটার উপরে পাওয়া যায় সেটার সন্ধান। হেলিকপ্টার দিয়ে উল্কাটা নীচে নামিয়ে আনা হয়। সেটার ওজন প্রায় আড়াই টনের কাছাকাছি। অ্যাসট্রোফিজিক্যাল ল্যাবরেটারিতে উল্কাটা নিয়ে আসার পর জমতে থাকে বিজ্ঞানীদের ভিড়। সবাই দেখবার জন্যে ব্যস্ত।
দর্শকের কৌতূহল নিয়ে আমিও গেলাম দেখতে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরের বারান্দায় এসেই দেখলাম, দর্শকদের ছোটো ছোটো দল এক জায়গায় চাপা স্বরে কী যেন আলোচনা জুড়ে দিয়েছে। সবাইয়ের মুখে কেমন একটা অজানা আশঙ্কার আভাস। ভেতরে ঢোকবার জন্যে দরজা ঠেলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল প্রহরী।
“আপনার কাছে অনুমতিপত্র আছে?” জিজ্ঞেস করল সে।
“অনুমতিপত্র?” অবাক হয়ে বললাম আমি।
“অনুমতিপত্র ছাড়া তো কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আপনি উল্কাটা দেখতে এসেছেন তো? ওপাশে বোর্ডে টাঙানো রয়েছে উল্কাটার কতকগুলো ফোটোগ্রাফ। সেগুলো দেখতে পারেন।” বলেই সেই দিকটা দেখিয়ে দিল আঙুল দিয়ে। অগত্যা কি আর করি, আসল জিনিসটা দেখা যখন হলই না তখন ছবিগুলোই দেখে যাই—দুধের সাধ ঘোলে মেটানো আর কি!
বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি দেখছিলাম তন্ময় হয়ে। আর পাঁচটা উল্কার মতোই দেখতে—কোনো বিশেষত্ব আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে সবার এত বিচলিত হবার কারণটা চিন্তা করছিলাম। ঘূণাক্ষরেও জানি না তখন যে বিরাট এক রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওই উল্কাপিণ্ডটার মধ্যে যার ফলে পৃথিবীময় সৃষ্টি হবে এক বিরাট আলোড়নের।—কার যেন স্পর্শ অনুভব করলাম পিঠে। তাকিয়ে দেখি অধ্যাপক নিকোলায়েফ, ল্যাবরেটরির সহকারী অধ্যক্ষ।
“এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছেন অধ্যাপক ফেডিনস্কি? আসল জিনিসটা দেখেননি?” বললেন তিনি।
একটু হেসে জবাব দিলাম, “না, সে সৌভাগ্য আর হল কৈ? আপনাদের প্রহরী তো ভেতরেই ঢুকতে দিল না। ছাড়পত্র নাহলে কাউকেই নাকি ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই এতক্ষণ ছবিগুলোই দেখছিলাম।”
নিকোলায়েফ একটু লজ্জিত হয়েই যেন বললেন, “কিছু মনে করবেন না, আপনাকে বোধহয় চিনতেই পারেনি। নইলে আপনার মতো স্বনামধন্য বিজ্ঞানীকে ফিরিয়ে দিতে পারত না। আসুন আমার সঙ্গে।” বলেই তিনি এগোলেন তাঁর চেম্বারের দিকে। আমিও গেলাম। আমাকে বসতে বলে দরজাটা ভেতর থেকে ভালো করে এঁটে দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। তারপর যা বললেন, প্রথমে তো বিশ্বাসই হয়নি—মনে হয়েছে নিকোলায়েফ-এর মতো বাস্তববাদী বিজ্ঞানীও অবাস্তব জিনিসে বিশ্বাস করেন।
অধ্যাপক বললেন, “সমস্ত ব্যাপারটা আমরা সম্পূর্ণ গোপন রেখেছি এখন কয়েকটা কারণে। উল্কাটা বেশ রহস্যজনক বলেই মনে হচ্ছে। আশা হচ্ছে যে এটার থেকে দূর গ্রহের প্রাণীজগতের অনেক তথ্য আমরা জানতে পারব! বাইরে থেকে নিরেট একটা পিণ্ড মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। ভেতর থেকে কোনো কিছুর নড়াচড়ার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে মাঝে মাঝে। আজ রাতেই ওটার রহস্য আমরা জানতে পারব বলে মনে হয়। আপনি ইচ্ছে করলে সেই সময় উপস্থিত থাকতে পারেন। সমস্ত ব্যাপারটা স্বচক্ষেই দেখতে পাবেন। আমি আপনার ছাড়পত্রের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কী আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে কে জানে!” এই পর্যন্ত বলে নিকোলায়েফ টেবিলের ড্রয়ার খুলে বার করলেন একটা কার্ড। আমার নাম লিখে তিনি সেটাতে সই করে আমার হাতে দেবার সময় বললেন, “এই নিন আপনার ছাড়পত্র। মনে থাকে যেন, রাত ঠিক একটার সময় আরম্ভ হবে আমাদের কাজ। তার আগেই চলে আসবেন কিন্তু। গেটে কার্ড দেখালে আর কেউ আপনাকে বাধা দেবে না। ওয়েটারকে বলবেন আপনাকে যেন আমার কাছে নিয়ে যায়।”
৪
অনুমতিপত্রটা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। সন্ধের ডাকে আসা চিঠিগুলোর মধ্যে পেলাম একটা এয়ারোগ্রাম। ভার্জিনিয়ার ডাকঘরের ছাপ তার ওপর। বাইরে প্রেরকের নাম-ঠিকানা কিছুই নেই। লিখেছেন ডা. ওয়াগনার, পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রিন ব্যাঙ্ক ন্যাশন্যাল অবজারবেটারি থেকে। তার সঙ্গে কয়েক বছর আগে আলাপ হয়েছিল ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে গিয়ে। সামান্য আলাপ শেষে অস্তরঙ্গতায় এসে দাঁড়ায় চিঠিপত্রের মাধ্যমে। শুনেছিলাম ডাক্তার নাকি নতুন ধরনের একটা পরীক্ষা চালাচ্ছেন যেটা শেষ হলে অত্যন্ত শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান মানুষ সৃষ্টি হবে পৃথিবীতে, যারা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এখনকার থেকে অনেক দ্রুত। চিঠিতে তিনি সম্প্রতি যে উল্কাটা এসেছে পৃথিবীতে সেটা সম্বন্ধে এখানকার বিজ্ঞানীদের মতামত জানতে চেয়েছেন।
ওটা সম্বন্ধে ডাক্তারের কৌতূহলী হওয়া খুবই স্বাভাবিক। হয়তো ওটা অন্য গ্রহে প্রাণীর উদ্ভব সম্বন্ধে কোনো মূল্যবান আভাস দিতে পারে। মাঝে মাঝে তো শোনা যায় যে উল্কাপিণ্ডের মধ্যে জৈব পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রিন ব্যাঙ্ক ন্যাশ্যান্যাল অবজারভেটারির ৮৫ ফুট উঁচু রেডিয়ো টেলিস্কোপটা ডাক্তারের পরীক্ষা চালাবার একটা প্রধান যন্ত্র। ওই টেলিস্কোপ ৯ আলোকবর্ষ দূরের ছায়াপথ থেকে আসা বেতার সঙ্কেত ধরতে পারে অনায়াসে। আজ রাতে তো উল্কাটার রহস্য জানা যাবেই, কাল সবকিছু বিশদভাবে লিখে দেওয়া যাবে ডাক্তারকে। ভারতীয় ভূবিজ্ঞানী মি. জোসেফও চিঠি লিখেছেন ওটার সম্বন্ধে জানবার জন্যে। কাল একই চিঠির দুটো কপি করে দুজনকে পাঠিয়ে দিলেই হবে। ব্যাপারটা যখন একই তখন জনকে দু-বার লেখার কোনো মানে হয় না।
সন্ধে পার হয়ে গেল। বারবার কেবলই ঘড়ি দেখছি। সময় যেন আর কাটতেই চায় না। ভাবছি উল্কাটার মধ্যে নতুন কিছুর সন্ধান পাওয়া যাবে কিনা। নাহলে পণ্ডশ্রমই হবে। ব্যাপারটা জানিয়ে দাসকেও একটা চিঠি দিতে হবে। একটা লেখার খোরাক পাবে অন্তত।
রাত ন-টা বাজল। খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে নেওয়া যাক। সারাটা রাতই হয়তো জেগে কাটাতে হবে। খেতে বসে কিন্তু খেতেই পারলাম না। মানসিক অস্থিরতায় মুখের রুচিই চলে গেছে। কোনোরকমে খাওয়াটা সেরে নিলাম। মাইক্রোফোটোগ্রাফিক ক্যামেরাটা দেখে নিলাম লোড করা আছে কিনা। নোটবুক আর ক্যামেরাটা হাতের কাছে রেখে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এখনও ঘণ্টা তিনেক পরে গেলেই চলবে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালই নেই। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই উঠে দেখি বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। এলার্ম বেজে কখন থেমে গেছে জানতেও পারিনি। ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠেই ক্যামেরা আর নোটবুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
চতুর্দিকে কুয়াশায় ঢেকে গেছে। স্ট্রিট লাইটের আলোটুকু ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ে না। তুষার পড়তে আরম্ভ করেছে। ওভারকোটের বোতামগুলো ভালো করে এঁটে নিলাম। বড্ড ঠান্ডা পড়েছে আজ। এত রাতে ট্যাক্সির জন্যে অপেক্ষা করে কোনো লাভ হবে কিনা ভাবছি—এমন সময় দূর থেকে এগিয়ে আসতে দেখলাম একজোড়া উজ্জ্বল আলো। আমার কাছাকাছি এসেই থামল আলোটা। ড্রাইভার জানলা দিয়ে মুখ বার করে জিজ্ঞেস করল, “আপনিই কি অধ্যাপক ফেডিনস্কি?”
আমি সম্মতি জানাতেই সে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলল।
“আপনার দেরি দেখে অধ্যাপক নিকোলায়েফ আমাকে পাঠালেন আপনার খোঁজে।”
মনে মনে লজ্জিত হলাম। অধ্যাপক যে এত ব্যস্ততার মধ্যে আমার কথা মনে রেখেছেন একথা ভেবে তার ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। সত্যিকার কাজের লোক যারা, সামান্য ঘটনাটিও তারা ভোলেন না—অথচ মিথ্যে ব্যস্ততা দেখাবার জন্যে কত লোক আসল কাজই ভুলে বসেন—এঁরা সত্যিকার কাজের লোক নন।
জমাট কুয়াশার বুক চিরে জনমানবহীন পথের ওপর দিয়ে ছুটে চলল আমাদের যন্ত্রযান। নির্জন রেড স্কোয়ারকে পাশে রেখে এগিয়ে চললাম। ডান দিকে ঘুরতেই দূর থেকে দেখতে পেলাম অ্যাসট্রোফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির চূড়া। মনটা আশ্বস্ত হল—যাক এসে পড়েছি। গাড়ি থামতেই লাফিয়ে পড়লাম নীচে। গেটে কার্ড দেখাতেই ওয়েটার আমাকে নিয়ে চলল। দুজনেই চুপ। কেবল জুতোর শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই নেই কোথাও।
লম্বা বারান্দার শেষে একটা বড়ো হলের মধ্যে এসে ঢুকলাম। এটা বোধহয় ওয়েটিং হল। টেবিলের ওপর একটা কাঠের ছোটো বোর্ডে লাগানো এক সারি নানা রংয়ের প্রেস বাটন। লোকটা একটা বাটন টিপতেই ভেতর থেকে মৃদু ঘণ্টার শব্দ আসতে লাগল। সে আমাকে বসতে বলল, কিন্তু মানসিক উত্তেজনায় বসার কথা ভুলেই গেছি তখন।
মিনিট তিনেক পর ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ হতেই উন্মুখ হয়ে রইলাম। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন অধ্যাপক নিকোলায়েফ নিজে। এগিয়ে এসে করমর্দন করে বললেন, “ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি?”
কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম।
“আসুন ভেতরে, যন্ত্রপাতি সব সাজানো হচ্ছে, কাজ আরম্ভ হতে আর দেরি নেই।” বললেন অধ্যাপক।
আমিও অধ্যাপকের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকলাম। দরজাটা ভেতর থেকে এঁটে দিয়ে এগিয়ে চললাম সামনে দিকে। কাচের বড়ো বড়ো জানালা লাগানো ছোট্ট একটা কংক্রিটের চেম্বারের সামনে এসে থামলাম। চেম্বারটার ভেতরে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে দেখলাম রহস্যময় উল্কাটাকে প্রথমবারের মতো।
কলের হাতের (মেকানিক্যাল হান্ড) লম্বা লম্বা গিয়ারগুলো ঝুলছে ছাদ থেকে। বাইরে থেকে ওগুলো দিয়ে ভেতরের জিনিসটাকে নাড়াচাড়া করা যাবে। চেম্বারের চার কোণে বসানো চারটে শক্তিশালী মাইক্রোফোন। বাইরে অ্যামপ্লিফায়ারের সঙ্গে যুক্ত মাইক্রোফোন তিনটে। আর একটা লাগানো হয়েছে টেপ রেকর্ডারের সঙ্গে। ঘরের ভেতরের প্রতিটি শব্দ রেকর্ড করে নিতে হবে।
৫
লাউড স্পিকার থেকে বেরোতে লাগল প্যাঁচ খোলার মতো একটা বিচিত্র শব্দ। মাইক্রোফোনগুলো রয়েছে চেম্বারের ভেতরে সুতরাং শব্দটা যে ভেতর থেকে আনছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কান খাড়া করে রইলাম। একটু থেমে আবার আরম্ভ হল সেই শব্দ। গভীর নিস্তব্ধ রাত, শব্দটা যেন একটা অপার্থিব আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে সমগ্র জায়গা জুড়ে। কাজ থামিয়ে চুপ করে সবাই শুনছে সেই শব্দ।
অধ্যাপক নিকোলায়েফও এতক্ষণ একমনে শুনছিলেন সেই শব্দ। হঠাৎ খেয়াল হতেই অপারেটারদের তাগাদা দিলেন, “এভরিবডি গেট রেডি। আওয়ার অপারেশান বিগিন্স।” কলের হাতে জ্বলে উঠল উজ্জ্বল ইলেকট্রিক আর্ক। তীব্র আলোর ঝলকে মুহূর্তে ভরে গেল ঘর—আস্তে আস্তে কলের হাতটা এগিয়ে গেল উল্কাটার ওপরে, তারপর একটু একটু করে সেই আগুনের করাত কেটে বসে যেতে লাগল উল্কাটার কঠিন দেহে। চারদিক গোল করে কাটা হতেই ঢাকনির মতো ওপরের অংশটা খুলে পড়ল। আমি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম, “আরে, এ তো দেখছি একটা ফাঁপা নলের মতো জিনিস!” ভেতরটা বেশ চকচকে পালিশ করা। আলো যেন ঠিকরে পড়ছে সেখান থেকে। ইলেকট্রিক আর্ক তখন নিভে গেছে। তার বদলে নলটার মুখে ফেলা হয়েছে তীব্র সন্ধানী আলোক রশ্মি। সেই আলোতে যা দেখলাম, সে-কথা ভাবলে আজও সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে ভয়ে। অসম্ভব আর অবাস্তব কাহিনি এতদিন বইতে পড়তাম, আজ স্বচক্ষে দেখলাম। একটা বিরাট অমানুষিক হাত বেরিয়ে আসছিল নলের বাইরে, সার্চ লাইটের তীব্র আলো পড়তেই বিদ্যুৎগতিতে ঢুকে গেল ভেতরে। সবারই মুখ তখন রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে।
আমি বললাম, “মনে হয় তীব্র আলোর জন্যে বাইরে আসতে পারছে না নলের ভেতরের প্রাণীটি। আলোটা নিভিয়ে দিলে হয়তো বাইরে বেরুতে পারে।”
আমার কথায় অধ্যাপক কি ভাংলেন জানি না—তবে অপারেটারকে সঙ্গে সঙ্গে সার্চলাইটটা নিভিয়ে দেবার আদেশ দিতেই বুঝলাম, আমার কথা তার মনে ধরেছে।
এতক্ষণের উজ্জ্বল আলোর পর মৃদু আলোতে ভেতরটা দেখতে কষ্ট হচ্ছে। জানালার কাচের সঙ্গে নাক ঠেকিয়ে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে আছি। তারপর চলল ধৈর্যের পরীক্ষা। তাকিয়ে আছি তো আছিই। চোখের পলক ফেলতেও ভয় হচ্ছে, যদি মিস করি।
খোঁচা খেয়ে অধ্যাপক নিকোলায়েফ-এর দিকে তাকাতেই তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন নিঃশব্দে। ভালো করে নজর করতেই দেখি আগের সেই হাতটা আবার বেরিয়ে এসেছে খানিকটা। বাইরে লাউড স্পিকারে শোনা যেতে লাগল ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ—অ্যাজমা রোগীদের নিশ্বাস নেবার সময় যেমন শব্দ হয় অনেকটা তেমনি।
ল্যাবরেটরির ডাক্তার ভেরেনসভ বললেন, “ওর বোধহয় নিশ্বাস নেবার কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের প্রেসারটা বাড়িয়ে দেখুন তো।”
অক্সিজেন সিলিন্ডারের স্টপার খুলে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে হুস হুস করে অক্সিজেন ঢুকতে লাগল ভেতরে। কিন্তু ফল হল উলটো। হাতটা ছটফট করতে শুরু করল আর কেমন একটা ঘড়ঘড় শব্দ বেরুতে লাগল লাউডস্পিকারে। তাড়াতাড়ি অক্সিজেন বন্ধ করে ঘরের গ্যাস বেরুবার পাইপটা খুলে দিতেই বাড়তি অক্সিজেন বেরিয়ে যেতে লাগল বাহিরে। চিন্তা করতে লাগলাম, তবে কি ওই হাতের মালিক অন্য কোনো গ্যাসের আবহাওয়ায় বাঁচতে অভ্যস্ত! কথাটা ডা. ভেরেনসভকে বলতেই তিনি বললেন, “আশ্চর্য কিছুই নয়, বরং সেটাই সম্ভব।” কার্বন ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, মিথেন নানারকম গ্যাস সিলিন্ডার তৈরিই আছে। অ্যামোনিয়া গ্যাস ঘরের মধ্যে ঢুকতে লাগল নল দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে হাতটার ছটফট করাও কমে এল ধীরে ধীরে। প্রেশার গজে রিডিং তখন গিয়ে উঠেছে প্রায় সাড়ে ছ-হাজার মিলিমিটারের ঘরে—অর্থাং সাধারণ বাতাসের চাপের প্রায় সাড়ে আট গুনের কাছাকাছি। আগের সেই ঘড়ঘড় শব্দটাও কমে আসতে লাগল। গ্যাস বন্ধ চুপ করে বসে রইলাম তার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়।
হাতটা বেরিয়ে আসছে নলটার বাইরে—তারপরই দেখা দিল ওই রকমের আর একটা হাত। মানুষের মতোই পাঁচটা করে আঙুল প্রত্যেক হাতে। তবে বেশ মোটা আঙুলগুলো। হাতগুলো বিরাট বিরাট পাতার মতো অনেকখানি ছড়ানো। হাতের পরই দেখা দিল একটি অপার্থিব মাথা। মাথার চুল জায়গায় জায়গায় কামানো, আর সেই কামানো জায়গাগুলো ফুলে ফুলে আছে ফোঁড়ার মতো হয়ে। হাঁ করে দেখছি মহাবিশ্বের কোন সুদূর এক গ্রহ থেকে আসা সেই মানুষটিকে। সারা গায়ে মাছের আঁশের মতো একটা আবরণ। এক এক জায়গায় আবরণটা ছিঁড়ে গিয়ে দেখা যাচ্ছে ছোটো ছোটো লোম। চতুষ্পদ জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল সে বাইরে। তারপর তাকাতে লাগল চতুর্দিকে। আমার সঙ্গে হঠাৎ চোখাচোখি হতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। উঃ কি অন্তর্ভেদী সে দৃষ্টি, ভয়ে বুকের স্পন্দন থেমে যাবার জোগাড়। চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
চলার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে জন্তুর মতো চার হাত পায়ে চলাতেই সে অভ্যস্ত—সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। পকেট থেকে ক্যামেরাটা বার করে সবে ছবি তোলবার জন্যে রেডি হয়েছি এমন সময় প্রোফেসর নিকোলায়েফ হাতটা ধরে বললেন, “ছবি তো তুলছেন কিন্তু এ ছবি তো বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন না। ফিল্মটা আপনাকে এখানেই রেখে যেতে হবে। বাইরে যখন খবরটা প্রকাশ করা হবে তখন ছবিগুলো ফেরত পাবেন আপনি, আগে নয়! আশা করি ব্যাপারটার গুরুত্ব আপনি বুঝতে পারছেন? কেবল জিনিসটার গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যেই এরকম কড়াকড়ি নিয়ম করতে হয়েছে এখনকার মতো।”
অধ্যাপকের কথা বুঝলাম। “বেশ, আপনার কথামতোই হবে। ছবি তোলা হলে ফিল্মটা আমি আপনাকেই দিয়ে যাব, সময় হলে আমাকে ফেরত দেবেন”—বললাম আমি।
ওটাকে মানুষ বলব কিনা বুঝতে পারছি না। মানুষের মতো চোখ, কান, মুখ, হাত, পা সবই কিন্তু তবু যেন মানুষ বলতে মন চাইছে না। পায়ের পাতাগুলো বিরাট বিরাট। অদ্ভুত, অভূতপূর্ব এক জীব যা কেউ কোনোদিন কল্পনাও করিনি।
একটু একটু করে এগিয়ে এসে কাচের জানালাটার সামনে কোনোরকমে দাঁড়ালো সে। এ-পাশে আমরা আর ও-পাশে সেই জীবটি, মাঝে একটা কাচের ব্যবধান মাত্র। কাচের ওপর একটা হাত রাখতে দেখলাম কস্টিক সোডায় খাওয়ার মতো চামড়াটা ক্ষয়ে গেছে ।
ডাক্তার ভেরেনসভ বললেন, “কিছু খাবার দিয়ে দেখলে হয়।” খাবার এল। কাঁচা এবং সেদ্ধ করা দুরকমেরই মাংস শাকসবজি দেওয়া হল চেম্বারের ভেতর। সাবমেরিন থেকে জলের নীচে ডুবুরিরা যেভাবে বেরোয় সেই রকম ব্যবস্থা করা ছিল এয়ারলকের। অর্থাং পাশাপাশি দুটো চেম্বারের মধ্যে একটি বায়ু নিরোধক দরজার ব্যবধান। এক নম্বর চেম্বারে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবার পর দু-নম্বর চেম্বারের দরজা খোলা হয়, ফলে ভেতরের গ্যাস বাইরে বেরুতে পারে না । অবশ্য ভেতরে ঢোকার সময় প্রেশারাইজড স্যুট পরে, অক্সিজেন নল লাগিয়ে তবে ঢুকতে হয়েছে।
খাবার কিন্তু সে ছুঁলো না মোটেই। ডেটোগ্রাফ ঘড়িটা দেখে বুঝলাম, একটা রাত আর একটা দিন পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। খিদে, তৃষ্ণা, সব ভুলে গিয়ে আমরা একমনে দেখছি প্রকৃতির বিচিত্র খেলা।
৬
পরের দিন খবরের কাগজে সংক্ষিপ্ত একটা খবর ছাপা হল: “কয়েকদিন আগে ককেশাস অঞ্চলে প্রাপ্ত উল্কাপিণ্ডটি যথেষ্ট রহস্যজনক বলিয়া জানা গিয়াছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন উহা হইতে অন্য ছায়াপথের গ্রহে জীবনের উদ্ভব এবং প্রাণী জগতের বিবর্তন সম্বন্ধে নানা তথ্য জানা যাইতে পারে। উল্কাপিণ্ডটির ভিতর হইতে মৃদু শব্দ পাওয়া যাইতেছে বলিয়া বিশ্বস্তসূত্রে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।…”
ইতিমধ্যে দুটো দিন পার হয়ে গেছে। অবাস্তব প্রাণীটির মধ্যে দেখা দিয়েছে নিস্তেজ হয়ে পড়া ভাব। উঠে বসতেও কষ্ট হচ্ছে—সবসময় মাথা গুঁজে পড়ে আছে চেম্বারের এক জায়গায়। তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মিলিয়ে গিয়ে দেখা দিয়েছে করুণ উদাস চেহারা—নোতরদমের হাঞ্চব্যাকের কথা মনে আছে ?
৭
সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে আকাশ থেকে পড়লাম ডাক্তার ওয়াগনার-কে দেখে। আমার অপেক্ষায় তিনি নাকি বসে আছেন বহুক্ষণ। ঘরে ঢুকতেই তাই বলে উঠলেন, “গুড ইভনিং প্রোফেসর। প্রবাবলি ইউ আর রাদার সারপ্রাইজড!”
“ইয়েস অ্যাম রিয়েলি সারপ্রাইজড।” জবাব দিলাম আমি।
“কাগজে খবরটা দেখামাত্রই ছুটে আসতে হল আপনার চিঠির অপেক্ষা না করেই। আপনি দয়া করে একবার উল্কাটা দেখাবার ব্যবস্থা করে দিন—প্লিজ ডু দিস মাচ ফর মি, আই উড এভার রিমেম্বার ইওর কাইও হেল্প।”
চিন্তিত হলাম। বাইরের কাউকে ব্যাপারটা এখনও জানানোই হয়নি। কীভাবে যে ডাক্তারকে সাহায্য করব সে-কথাই ভাবতে লাগলাম।
ডাক্তার বললেন, “আপনি উল্কাটা দেখেছেন?”
ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম, মুখে কিছুই বললাম না। অধ্যাপক নিকোলায়েফ- এর নির্দেশ মনে পড়ল। ডাক্তারকে বললাম, “দেখুন ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে বর্তমানে। সুতরাং এ বিষয়ে আপনাকে কতটুকু সাহায্য করতে পারব জানি না। চলুন, বরং আপনাকে নিয়েই যাই অধ্যাপক নিকোলায়েফ-এর কাছে। তিনি যদি অনুমতি দেন তাহলেই দেখতে পাবেন সবকিছু নিজের চোখে।”
অধ্যাপক নিকোলায়েফ নিজের চেম্বারেই ছিলেন। আমরা দুজনে ভেতরে গিয়ে ঢুকতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে করমর্দন করলেন। আমি তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর আসল কথাটা পাড়তেই অধ্যাপক যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
ডাক্তার ওয়াগনার বললেন, “হ্যাভ মার্সি অন মি প্রোফেসর নিকোলায়েক, প্লিজ… ফর হেভেন্স সেক।”
একটু চুপ করে থাকার পর অধ্যাপক বললেন, “আপনার পরীক্ষার কথা আমি কিছু কিছু শুনেছি। তা ছাড়া আপনার মতো স্বনামধন্য বিজ্ঞানীকে সবকিছু দেখাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই; তবে একটি শর্ত আপনাকে মানতে হবে। এমন জিনিস দেখাব যা আপনি কল্পনাতেও আনতে পারবেন না।”
এ-কথার পর ডাক্তার আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “আপনি যে কোনো শর্ত বলুন, আমি মানতে রাজি আছি। দয়া করে আমাকে একবার দেখবার অনুমতি দেন। উৎকণ্ঠা আর চেপে রাখতে পারছি না আমি। আপনার কাছে আমি আজীবন ঋণী হয়ে থাকব।” কথাগুলো এক নিশ্বাসে শেষ করে হাঁপাতে লাগলেন তিনি।
অধ্যাপক বললেন, “শর্তটা হচ্ছে যে, আমাদের তরফ থেকে ঘটনাটা বাইরে প্রকাশ করার আগে আপনি কাউকে কিছু জানাবেন না—রাজি?
সহাস্যে রাজি হয়ে গেলেন ডা. ওয়াগনার। শর্তটি যে এত সামান্য তা বোধহয় তিনি ভাবতেও পারেননি।
রাত প্রায় দশটা। ল্যাবরেটারির অপারেটাররা একে একে আসতে আরম্ভ করেছেন। আজও বোধহয় পরীক্ষা চলবে সারারাত ধরে। আমার ধারণাই যে ঠিক বুঝতে পারলাম যখন অধ্যাপক নিকোলায়েফ ডাক্তারকে বললেন, “আজ রাতের পরীক্ষায় আপনি উপস্থিত থাকতে পারেন। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তবে শর্তটার কথা ভুলবেন না যেন।”
৮
অধ্যাপকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পথে আর কোনো কথাই হল না, চুপ করে পার হয়ে এলাম সমস্ত পথ। বাড়িতে এসে চেয়ারটা টেনে বসতে যাচ্ছি হঠাৎ ডাক্তার বলে উঠলেন, “আপনি নিশ্চয়ই আগের পরীক্ষার সময় উপস্থিত ছিলেন? উল্কাটার কিছু বিশেষত্ব আপনার নজরে পড়েছে?”
ভাবলাম একটু পরেই তো তিনি নিজের চোখে সবকিছু দেখবেন। তবে শুধু শুধু চেপে রেখে লাভ নেই। মোটামুটি ঘটনাটা বললাম। কেবল সেই মহাজাগতিক প্রাণীটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বললাম না। আমার কথা শোনার পর তাঁর মুখের ভাবটা যেন হঠাৎ পালটে গেল। ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগলেন, সেই সময়টা কতক্ষণে আসে তারই প্রতীক্ষায়।
ঠান্ডা আজ একটু কম মনে হচ্ছে। খোলা জানালার সামনে বসে আমরা দুজন। ডাক্তার উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। কী ভাবছেন কে জানে। আমিও চুপ করে বসে আছি। তাঁর চিন্তায় বাধা দেবার ইচ্ছে হল না।
মুখ না ফিরিয়েই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “অধ্যাপক বলতে পারেন মহাশূন্যের কোনখান থেকে এসেছে ওই উল্কাটা?”
আমি বললাম, “সে সম্বন্ধে এখনও কোনো অনুসন্ধান করা হয়নি, হলে আপনাকে জানাবো।” তখন স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সেদিন ওই খবর জানাবার আর কোনো প্রয়োজনই তাঁর থাকবে না—জাগতিক প্রয়োজনের মোহ থেকে তখন তিনি থাকবেন অনেক দূরে!
“জানেন প্রোফেসর ফেডিনস্কি,” বলতে আরম্ভ করলেন তিনি, “গত পনেরো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি একটা খবরের আশায়। প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছি গভীর উৎকণ্ঠায়। কিন্তু কই, আজও তো সে খবর এল না।” হতাশায় ভেঙে পড়া কণ্ঠ ডাক্তার ওয়াগনারের।
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। ডাক্তার তাগাদা দিলেন, “চলুন এবার বেরিয়ে পড়া যাক। সময়মতো না পৌঁছতে পারলে… ” কথাটা অসমাপ্তই রইল।
“চলুন, বেরিয়েই পড়া যাক। আপনি তো এর আগে কোনোদিন মস্কোতে আসেননি বোধহয়? খানিকটা হেঁটে গেলে কিছুটা দেখা হবে জায়গাটা।” বলতেই আমার কথায় রাজি হয়ে গেলেন তিনি।
পায়ে হেঁটেই চললাম দুজনে। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলল ঘড়ির কাঁটা। বারোটা বাজে প্রায়। একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে বসলাম দুজনে। সে রাতের মতো ব্যস্ততা নেই আজ, হাতে এখনও কিছুটা সময় আছে।
গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছলাম। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে উঠে গেলাম ওপরে। লম্বা বারান্দা পার হয়ে ওয়েটিং হলের কাছাকাছি আসতেই দেখা হল ওয়েটারের সঙ্গে। আমাদের অনুমতিপত্রগুলো দেখে ভেতরে নিয়ে বসাল। একটা প্রেস বাটন টিপে ভেতরে খবর পাঠাবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন লোক এসে আমাদের নিয়ে গেল। কংক্রিটের চেম্বারের কাচের জানালা পর্দা দিয়ে ঢাকা দেওয়া রয়েছে।
একে একে সবাই এসে জুটতে লাগলেন। আলো জ্বলল—অপারেটাররা সব তৈরি হয়ে দাঁড়ালেন। এবার পর্দা উঠবে, ডাক্তার ওয়াগনার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন আগেই।
ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল ভারী পর্দাগুলো। কম আলোর জন্যে ভেতরটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। চোখ দুটো যতদূর সম্ভব বিস্ফারিত করে ডাক্তার ভেতরের জিনিসটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ভেতরের উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতেই দেখি সেই বিচিত্র প্রাণীটি মাথা গুঁজে পড়ে আছে মেঝেতে। আলো দেখে মুখ তুলে পিটপিট করে তাকাতে লাগল। কিন্তু সেখান থেকে উঠল না। হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলেন ডাক্তার ওয়াগনার। “আমি ভেতরে যাব” বলে চিৎকার করতে লাগলেন।
আমরা তাঁকে থামাবার চেষ্টা করতেই আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন তিনি, “আমি জানি এ কোথা থেকে এনেছে। আমাকে কেবল একবার ভেতরে যেতে দিন।”
ডাক্তারের অসংলগ্ন আচরণে অবাক না হয়ে পারলাম না। তবে কি তিনি যার অপেক্ষায় গত পনেরো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন, একি সেই!
একটু থেমে বলতে লাগলেন ডাক্তার, “আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? বেশ, আমি এমন প্রমাণ দিচ্ছি যে আপনাদের আর কোনো সন্দেহই থাকবে না।” বলেই তিনি পকেট থেকে ছোটো একটা চাকতির মতো জিনিস বার করে দেখালেন। “এই দেখুন সেই সঙ্কেত। আশা করি এবার আর কোনো আপত্তিই থাকবে না আপনাদের।” চাকতিটা কালো রঙের আর তার গায়ে আঁকা রয়েছে গোল গোল তিনটে রঙিন ফোঁটা।
অধ্যাপক নিকোলায়েফ বললেন, “সঙ্কেতটার অর্থ তো বুঝতে পারলাম না। এটা দিয়ে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”
ডাক্তার বললেন, “কেন, এ-রকম একটা চাকতি ওর শরীরে দেখতে পাননি?” বলেই সেই অপার্থিব প্রাণীটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন।
“আমরা তো এখনও ভেতরে যাইনি। তাই সত্যি সত্যি ও-রকম কিছু ওর শরীরে আছে কিনা জানি না।” অবিশ্বাসের আভাস অধ্যাপকের কণ্ঠে।
“নিশ্চয়ই আছে—থাকতেই হবে। আমি জানি এ সে ছাড়া আর কেউ নয়। দয়া করে আপনারা আমাকে ভেতরে যেতে দিন।” অশান্ত গলা ডাক্তারের।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি জানতেন যে একদিন এ আসবেই?”
“এর জন্যই তো অপেক্ষা করে আছি। পনেরো বছর পর আজ সে সত্যি সত্যি এসেছে। ভেতরে যেতে দিন আমাকে দয়া করে।” কান্নায় বুজে এল তাঁর গলা।
ডাক্তারের কথা সত্যি কিনা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে অধ্যাপক নিকোলায়েক অপারেটারকে কলের হাত চালু করার নির্দেশ দিলেন। লম্বা লম্বা লিভারগুলো এগিয়ে আসতে লাগল সেই প্রাণীটার কাছে। ডাক্তার বললেন, “ডান হাতটার কবজিতে দেখুন।”
মাছের আঁশের মতো চামড়ার এক জায়গায় টান মারতেই খানিকটা ছিড়ে গেল পচা কাপড়ের মতো, আর সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতো দেখতে পেলাম তার কবজিতে বাঁধা ঠিক সেই রকমের একটা চাকতি।
এখন আর ডাক্তারের কথা কি করে অবিশ্বাস করি!
নিশ্চিত কণ্ঠে ডাক্তার বললেন, “এবার আর আমাকে ভেতরে যেতে দিতে কোন আপত্তি হবে না, আশা করি।”
সত্যি সত্যি আপত্তি আর হল না। প্রেশারাইজড স্যুট পরে অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে তৈরি হয়ে নিলেন ডাক্তার ওয়াগনার ভেতরে যাবার জন্যে। প্রথমে চেম্বারে ঢুকে স্বচ্ছ মাথার আবরণটা লাগিয়ে অক্সিজেন খুলে দিলেন। তারপর মাঝের দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন অ্যামোনিয়া ভরতি দ্বিতীয় চেম্বারটায়। আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি যদি ওই প্রাণীটা ডাক্তারকে আক্রমণ করে বসে! কিন্তু আক্রমণ করা দূরের কথা, উঠে বসার মতো শক্তিও বুঝি তার নেই তখন। ডাক্তার তার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসতেই তাকাল সে। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে।
একি, ডাক্তারের চোখে জল। স্বচ্ছ মাথার আবরণের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে গাল বেয়ে নেমে আসছে অশ্রুধারা। আনন্দের, না বেদনার কে জানে!
অমানুষিক একটা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তারও বাড়িয়ে দিলেন নিজের হাত। এগিয়ে আসছে দুটো হাত, নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। আর মাত্র কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান। বিস্ময় তখন আমাদের চরমে উঠেছে। হাতটা হঠাৎ থেমে গেল, তারপরই আছড়ে পড়ল কঠিন মেঝেতে। ডাক্তার তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে পাল্স দেখবার চেষ্টা করলেন। তারপর… আজও সে-কথা মনে পড়লে শিউরে ওঠে শরীর। কি বিকট হাসি—প্রচণ্ড অট্টহাসিতে সঙ্কুচিত হয়ে উঠতে লাগল ডাক্তারের দেহ। হাসি আর থামতেই চায় না। একি হল! ডাক্তার কি শেষে পাগল হয়ে গেলেন নাকি?
ডাক্তার ওয়াগনার সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেলেন—একেবারে বদ্ধ পাগল।
পরে প্রাণীটাকে পরীক্ষা করে দেখা গেল, তার প্রাণস্পন্দন থেমে গেছে অনেক আগেই। দেহটি মিউজিয়ামে রেখে দেওয়া হয়েছে একটি মূল্যবান স্পেসিমেন হিসেবে, পৃথিবীতে যা মাত্র একটিই আছে।
১০
দিন-কয়েক পরে ডা. ওয়াগনারকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আজও তিনি বুঝি পাগলা গারদের কঠিন দেওয়ালে মাথা ঠুকছেন দিন-রাত, নিজের ভুলের জন্যে। পৃথিবীর কেউ জানল না কেন এমন মর্মান্তিক নিজের ভুলের জন্যে। অপমৃত্যু ঘটল একটি বিরাট বৈজ্ঞানিক প্রতিভার।
১১
জানি শুধু আমি। ভবিষ্যতে যদি কেউ পড়েন আমার এই ডায়েরি তাঁর কাছে বিনীত অনুরোধ রইল তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন। ডাক্তারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্যায় করেছি আমি এ-কথা স্বীকার না করলে কোনোদিনই শাস্তি পাব না।
ডাক্তারের সুটকেশ, আর ব্যাগ আমার বাড়িতেই ছিল। ওই ঘটনার পরের দিন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। কেবলই মনে হচ্ছে ডাক্তারের সঙ্গে ওই প্রাণীটার কি সম্বন্ধ। হঠাৎ এমনভাবে পাগলই বা হয়ে গেলেন কেন তিনি! ঘরে ঢুকেই নজর পড়ল ডাক্তারের নাম লেখা ব্যাগটার দিকে। হাতড়াতে শুরু করলাম, যদি খুঁজে পাই এই রহস্যের কোনো সমাধান। একেবারে তলার দিকে পেলাম একটা চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি। পরের দিন তার জিনিসপত্র নিয়ে গেল সব, কেবল ডায়েরিটা আমি লুকিয়ে রেখে দিলাম। তার ভেতর থেকেই উদ্ধার করলাম এই বিয়োগান্ত নাটকের শেষ অঙ্ক। বড়ো মর্মস্পশী আর বেদনাদায়ক সে কাহিনি।
১২
ডাক্তারের ডায়েরি থেকেই তুলে দিচ্ছি তার যুগান্তকারী পরীক্ষার ইতিহাস। পড়লেই বুঝবেন, কি কঠোর বিজ্ঞানীর জীবন। ডাক্তারের এত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল!
অন্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলের প্রচণ্ড চাপে আর অত্যধিক মাধ্যাকর্ষণের টানে পৃথিবীর মানুষের দেহে এবং মনে একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে বাধ্য। আমার অন্তত তাই বিশ্বাস। সেই আবহাওয়াতে বাঁচতে হলে চাই প্রচুর শক্তি এবং বুদ্ধি। বুদ্ধি খাটিয়ে তাকে এমন উপায় বার করতে হবে যাতে সেই আবহাওয়ায় সহজ হয়ে আসে তার জীবনযাত্রা। আমাদের প্রকৃতির সঙ্গেই কত লড়াই করে তো বাঁচতে হচ্ছে। …
পৃথিবীর মানুষকে ওই রকমের কোনো গ্রহে পাঠিয়ে পরীক্ষা চালালে আমার মনে হয় নতুন মানুষের সৃষ্টি করা যেতে পারে। যারা দৈহিক শক্তিতে এবং বুদ্ধিতে সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হবে। …
বৃহস্পতি বা শনি গ্রহে যদি কোনো মানুষ অনেক দিন ধরে বাস করে তবে ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে অ্যামোনিয়া, মিথেন ইত্যাদি গ্যাস নিশ্বাসের সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে। তার ফলে অবশ্য দেহের মধ্যে আসবে নানা জটিল পরিবর্তন। আর অত্যধিক মাধ্যাকর্ষণের টানের বিরুদ্ধে চলাফেরা করার জন্যে হাত-পায়ের আকার হবে বিরাট এবং মোটা। সোজা হয়ে দু-পায়ে চলা ছেড়ে অভ্যেস করতে হবে চতুস্পদ জন্তুর মতো চার হাত পায়ে চলার।
কে রাজি হবে এই বিপজ্জনক পরীক্ষায় অংশ নিতে। অজানা পরিবেশে গিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে কিনা তারই তো ঠিক নেই।…
টনিকে দিয়ে পরীক্ষাটা করে দেখব? না, না তা হতে পারে না। আমার একমাত্র সন্তান। আমি তাকে মানুষ করেছি মা-বাবা দুজনের স্নেহ দিয়ে। মায়ের অভাব কোনোদিন বুঝতে দিইনি তাকে। মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব তাকে!…
দেখি না টনিকে একবার কথাটা বলে।…
আমি জানতাম রাজি ও হবেই। আমার জন্যে প্রাণ দেওয়াও শক্ত নয় ওর পক্ষে।…
ছেলেটা জ্বালালে দেখছি। কেবলই তাগাদা, ‘আমাকে পাঠাও না, ড্যাডি। ভয় কীসের? আমি ঠিক ফিরে আসতে পারব, তুমি দেখে নিও। তোমার পরীক্ষা সফল হলে সারা পৃথিবীতে উঠবে এক বিরাট আলোড়ন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে তোমার জন্যে থাকবে বিশেষ একটা স্থান। তোমার ছেলে আমি সে কি আমার কম গৌরবের কথা। তুমি কিচ্ছু ভেব না ড্যাডি।’…
টনি বলছে বটে কিন্তু মন আমার চাইছে না। যদি কোনো অঘটন ঘটে! ওকে হারিয়ে আমার পক্ষে বাঁচাই হবে দুষ্কর। …
ছোট্ট রকেটটাও তো প্রায় তৈরি হয়ে এল। এটা হচ্ছে নতুন ধরনের গ্র্যাভিটি রকেট। অন্য গ্রহের মাধ্যাকর্ষণেই ছুটে চলবে, জ্বালানি খুব সামান্যই দরকার। তবু বেশি করে জ্বালানি নেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অত্যন্ত জটিল সব কলকব্জা। আমার মাথায় ওসব ঢোকে না। ইঞ্জিনিয়ার ছোকরা দুটি বেশ কাজের লোক। মনের মতো জিনিসটি বানিয়ে দিয়েছে।
ব্যাপারটা খুব গোপন করা হয়েছে। মনটা এখনও দোটানায় পড়ে আছে। টনিকে পাঠাব? যদি তার কোনো বিপদ হয়, যদি আর সে ফিরে না আসে?…
শেষ পর্যন্ত মনস্থির করেই ফেললাম। এত দূর এগিয়ে পরীক্ষাটা বন্ধ করে দেব? …
টনির মাথায় অপারেশন করে কয়েকটা রেডিয়ো ক্যাপস্যুল লাগিয়ে দিলাম আজ। ব্রেনের বিভিন্ন অংশে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে বুঝতে পারা যাবে। মাথাটা বড়ো বিশ্রী দেখাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় ফুলে আছে ফোঁড়ার মতো হয়ে।
এমন সুন্দর চেহারাটা আমি বিকৃত করে দিলাম! মনে হচ্ছে, কী হবে এসব পরীক্ষা করে। যাদের জন্যে আমি আরম্ভ করেছি এই বিপদজনক পরীক্ষা তারা কি আমার একমাত্র ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবে মৃত্যুর হাত থেকে!
মিথ্যে ভাবনা আসছে মনে। মন বলছে আমার অনুমানই ঠিক হবে। …
এই প্লাস্টিকের গোল চাকতিটা ওর ডান হাতে বেঁধে দিলাম। আর একটা ওই রকমের চাকতি রইল আমার কাছে। পৃথিবীতে আবার যেদিন ও ফিরে আসবে সেদিন ওই সঙ্কেত দেখিয়ে প্রমাণ করতে পারব যে, ওটা আমারই কীৰ্তি।
রকেটের ওপরে একটা পাথর জাতীয় জিনিসের আবরণ দিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে বা অন্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে আসবার এবং যাবার সময় ভীষণ উত্তাপে রকেটটা নষ্ট না হয়ে যায়। পৃথিবীতে ফিরে আসবার সময় বাতাসের ঘর্ষণে আর অক্সিজেনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আবরণের বস্তু গলে বেরুবার পথ হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে অবশ্য ভয়ের কিছু নেই, কারণ ভেতর থেকে রেডিয়ো সিগন্যাল পাঠালেই বোঝা যাবে ভেতরে কেউ আছে। তখন বার করতে আর কতক্ষণ লাগবে।
রকেট চালাবার লিভারগুলোর কাজ টনিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সামান্য ক-টা মাত্র—তা ছাড়া প্রত্যেকটার তলায় লেখা আছে কোনটার কী কাজ। বুদ্ধিমান ছেলে টনি। ঠিক চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।…
আজ ২১ মার্চ ১৯৫৮ সাল। টনি চলে গেছে মহাশূন্যের পথে। রেডিয়ো টেলিস্কোপে ধরা পড়ছে টনির পাঠানো সিগন্যাল। এখনও সবকিছু ঠিক আছে বৃহস্পতির দিকে ছুটছে রকেট।…
মাঝে মাঝে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে সিগন্যাল। কোনো গোলমাল হল না তো আবার। কই, সিগন্যাল তো পাওয়া যাচ্ছে না আর। রেডিয়ো টেলিস্কোপ তো আর ভুল করবে না। তবে কি…!
তারপর কত চেষ্টা করলাম, আর সিগন্যাল পেলাম না।…
পনেরো বছর হতে চলল টনি তো আর ফিরল না। বুড়ো হয়ে গেছি, কবে মরে যাব—আর বুঝি টনরি সঙ্গে আমার দেখা হবে না।…
আজ কাগজে দেখলাম বিরাট একটা উল্কা নাকি পড়েছে ককেশাস পর্বতের কোথায় যেন। দেখি অধ্যাপক ফোডনস্কিকে লিখে। বৃথা আশা করছি। কত উল্কাই তো পড়ল ইতিমধ্যে… ।
আজ আবার কাগজে দেখলাম উল্কাটার ভেতর থেকে নাকি কীসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তবে কি এতদিন পর আমার টনি, আমার একমাত্র সন্তান ফিরে এল। আজই মস্কো রওনা হতে হবে।
***
পরের ঘটনা তো জানেন। ডাক্তার ওয়াগনার তার ছেলেকে ফিরে পেলেন। পিতা-পুত্রের মিলনও হল আবার, কিন্তু সে মিলনও বড়ো মর্মস্পর্শী, বড়ো করুণ।
ভগবান ওদের আত্মার শান্তি দিন।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, বিশু দাস
Osadharon