ম্যাজেরিন
লেখক: শান্তনব রায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“And all my days are trances / And all my nightly dreams / Are where thy grey eye glances / And where thy footstep gleams—/ In what ethereal dances / By what eternal streams.”
১
ইদানীং ঘুম থেকে উঠে বুকের বাঁদিকে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে এরিক। ব্যথাটা আস্তে আস্তে বুকের মধ্যেখানে ছড়িয়ে যায়,একটু পর আর কোনো অনুভূতি থাকে না। দু-একবার ভেবেছে ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখিয়ে আসে কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সেই উপায় হয়ে ওঠেনি। ইদানীং শরীরটাও ঠিক জুতসই লাগে না এরিকের। ক্লান্ত হয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। মঙ্গলবার দুপুর বেলায় বাগানে জমে থাকা আগাছা সাফ করতে গিয়ে তীব্র ব্যথা উঠল বুকে, তারপর ব্ল্যাক আউট। জ্ঞান ফিরলে দেখে ক্লিনিকের বেডে শুয়ে আছে। নাকে বুকে নল পরানো। ওর মেয়ে স্টেসি জানাল এরিকের মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন ছিল। অস্ত্রোপচার হয়েছে। ভাগ্যিস নাতি-নাতনীদের সেদিন বাড়িতে আসার কথা। ঠাকুরদাকে বাগানে পড়ে থাকতে ওরাই আবিষ্কার করে। নাহলে আরও বিপত্তি হত। তবে এই সুযোগে কিছুটা বিশ্রাম পাওয়া গেছে।
ঘুম। ঘুম। আহা! বড়ো আরামের ঘুম। ঘুমের মধ্যে নীল সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে এরিক। কোরাল রীফের উপর দিয়ে মাছের দল আনোগোনা করে চলেছে। শার্ক, সি-হর্স নানারকম অ্যালগি। রীফের মধ্যে থেকে একটা রঙিন আভা বেরিয়ে আসছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতন তার দিকে এগিয়ে যায়। অনেকটা কাছে এসে গেছে। কে যেন পিছনে হাত দিয়ে ডাকে। ঘুমটা ভেঙে যায়।
এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরতে পারে এরিক।
ডাক্তার ভারী কাজকর্ম করতে বারণ করেছে। প্রচুর বিশ্রাম, ব্যায়াম আর সংযমী জীবনযাপন করতে হবে। ধূমপান মদ্যপান বন্ধ।
স্ত্রী ক্যাথরিন দু-বছর আগে মারা যাওয়ার পর এরিক একাই থাকে। সঙ্গে ফন্সী। অস্ট্রেলিয়ান শেফার্ডটিকে এক অন্ধ বৃদ্ধার কাছে কিনেছিল এরিক। এই অতি সক্রিয় কুকুরটিকে নিয়ে বুড়ি বেশ বিপদেই পড়েছিল। একরকম নামমাত্র দামে দিয়েও দিয়েছিল। ক্যাথরিন মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে এসেছিল ফন্সী। এরিকের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। স্টেসি নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে উপকূল থেকে অনেকটা দূরে বড়ো শহরে চলে গেছে অনেকদিন। ওর পক্ষে সবসময় বাবাকে দেখতে আসা সম্ভব হয় না। বাবার দেখভাল করার জন্য একটি নার্স রেখেছিল কিন্তু ছেলেটিকে এরিক দু-তিনদিনের মধ্যেই বিদায় দিয়েছে। অত খরচা করে নার্স রাখার সামর্থ্য এরিকের নেই আর স্টেসি ইতিমধ্যেই ওর চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ করেছে। মেয়ের উপর আর দায় চাপাতে এরিক নারাজ। তা ছাড়া অবসর নিয়ে বাড়িতে বসে গেলে মাছ-ব্যাবসার কাজেরও ক্ষতি। একা বুড়ো ডাকোটা ফিনের উপর চাপ পড়ে যাবে। এরকম অকর্মণ্য জীবন কিছুতেই ধাতে সইবেনা এরিকের। নার্স বিদায় নিতেই দুপুর নাগাদ ফন্সীকে খেতে দিয়ে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে ফিশিং হার্বারের দিকে রওনা দেয়।
ড্রাইভ করতে করতে পাইপ ধরায়। অনেকদিন পর ধোঁয়ার মৌতাত ভিতরে যেতেই জীবনের স্বাদটা আবার ফিরে আসে যেন। এরিকের বয়স বাহাত্তর। মদ্যপানের জন্য চেহারা ভারিক্কি হয়ে গেলেও এখনও শক্তপোক্ত। নৌসেনাতে থাকাকালীন সামুদ্রিক ভেড়ি এলাকার গভীর জঙ্গলে দিনের পর দিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে শত্রুপক্ষের গেরিলা আক্রমণের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। বিছানায় শুয়ে থাকার মানুষ সে নয়। গাড়ি চালাতে চালাতে অনুভব করল গুমোট হয়ে আছে চারিদিক। গত দু-দিন ধরেই আবহাওয়া বেশ গরম। সামান্য কোনো কাজ করতে গেলেই ঘেমে-নেয়ে প্রাণান্তকর অবস্হা হচ্ছে। এমনিতে উপকূলবর্তী অঞ্চলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই ঘাম হয়। কিন্তু এই গরমটা অন্যরকম। দমবন্ধ ভ্যাপসা একটা পরিবেশ। রেডিয়োতে ঝড়ের ফোরকাস্ট হচ্ছে।
ফিশিং হার্বারে গাড়ি রেখে নিজের অফিসে পৌঁছাতেই স্টাফদের মুখের হাবভাবে বুঝল যে খবর সুবিধার নয়। নিজের টেবিলের দেরাজ থেকে মাছ বাছাই করার গ্লাভসজোড়া তুলে নিয়ে ডকের দিকে রওনা দিল। ডকের উপর বন্ধু ডাকোটা ফিন বেজার মুখে পাইপ টানছিল। ফিন ওর ব্যাবসার অংশীদারও। চোখের সামনে পড়ে আছে জালে জড়ানো মরা চিংড়ির স্তূপ। প্রায় চারশো কিলোর স্তূপ। ডাকোটা ফিন পাইপ থেকে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাতাসে ছেড়ে হতাশার সুরে বলল, এ তো দেখছি বেড়েই চলেছে! ব্যাবসা যে ভোগে চলে যাবে। রক্তবীজের ঝাড় যত!
দৃশ্যটা দেখে এরিকেরও ভালো লাগল না।
হাঁটু গেড়ে বসে চিংড়িগুলিকে হাত দিয়ে বার করে পর্যবেক্ষণ করল। মরে কাঠ হয়ে আছে। সম্ভবত একদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে ওদের। জালের বাকি অংশটা দখল করে রয়েছে লালচে কালো রঙের একধরনের সি-উইড বা সামুদ্রিক আগাছা। বিষাক্ত আগাছা।
এই এলাকার সামুদ্রিক পরিবেশ অনেক বছর ধরেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে। তেলের ট্যাঙ্কার লিক করা থেকে শুরু করে জলের মধ্যে বাড়তে থাকা প্লাস্টিকের আবর্জনা, বাদ নেই কিছুই। আর আজ প্রায় এক বছর হল নতুন এই বিপত্তি শুরু হয়েছে। আগাছাগুলো উপকূল এলাকা জুড়ে বিপুল পরিমাণে গজিয়ে উঠেছে। এরা বিষাক্ত করে তুলছে জলের পরিবেশকে। সামুদ্রিক মাছের মহামারী লেগে গেছে। ব্যাপারটা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি হওয়ার পর মাসখানেক আগে একদল সমুদ্রবিজ্ঞানী এসে পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের মতে এই ধরনের আগাছার প্রজাতি একেবারেই নতুন। এদের কীভাবে প্রশমিত করা যায় সেই নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। ওরা স্যাম্পল নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ওই অবধিই, আর কিছু সুরাহা মেলেনি। দেশের সমুদ্র বিভাগ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এককভাবে কোনো মন্ত্রকের না হওয়ায়, সামুদ্রিক এলাকার আইন, অর্থনৈতিক ও পরিবেশের সমস্যাগুলো সমাধান করা নিয়ে বরাবরই বিভ্রান্তি আছে সরকারি মহলে। উপকূল শহরের ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশন এই নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। এভাবে চলতে থাকলে তাদের জীবিকা সঙ্কটে পড়বে খুব তাড়াতাড়ি। মাছের এই স্টকটাও পুরো বাতিল হয়ে গেল।
এরিক বাড়ি ফিরল যখন, বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফোরকাস্ট বলেছে বড়োসড়ো সামুদ্রিক ঝড় আসতে চলেছে। সমস্ত ফিশারমেনদের তীরে ফিরে আসার সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে বারবার। কিন্তু ওরাও নিরুপায়। সমুদ্রে যাওয়ার বিপদ জেনেও পেটের দায়ে ঝুঁকি নিয়ে এসব করতেই হয়। আর এই মাছের মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে ওরাও নতুন ফিশিং পকেট খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সমুদ্রের অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি থাকা পরিবারদের ইভাকুয়েশনের নোটিস জারি করেছে সৈকত পুলিশ। সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে এরিকও দু-একবার মাছ ধরতে গিয়ে পড়েছে। সে অভিজ্ঞতা সত্যিই দুঃস্বপ্নের মতো। বাবা অত্যন্ত দক্ষ নাবিক ছিলেন। সামুদ্রিক ঝড়ের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, ঝড়ের দাপট থেকে ঘরবাড়িকে সুরক্ষিত করতে কী কী সাবধানতা নেওয়া উচিৎ আর কোন পরিস্থিতিতে ইভাকুয়েশন জরুরি তার সমস্তই শিখিয়ে গেছেন। এরিক তাই সহজে ঘাবড়ায় না।
বাড়িতে সব সময় কিছু দরকারি জিনিস মজুদ থাকে তার। যেমন দিন তিনেক জেনারেটর চালাবার মতো জ্বালানি তেল, অতিরিক্ত পানীয় জল, টর্চ, ত্রিপল, কাছিদড়ি, কম্পাস। এছাড়াও রয়েছে একটা কুড়ুল, হ্যান্ডপাম্প, হাওয়া ভরে চালানোর মতো ভেলা আর মাঝারি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটা রেডিয়ো ট্রান্সমিটার।
এইসব সাজসরঞ্জাম দেখে ওর নাতিরা এরিককে রসিকতা করে ‘ডোডো’ নামে ডাকে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পাখি। ওদের মতে, দাদু এখনও দড়িদড়ার জমানায় পড়ে আছে। এরিক ওদের রসিকতায় নিজেও আনন্দ পায় আর মনে মনে হাসে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ওই হাতের ফোন আর কম্পিউটারের বাইরে কিছুই দেখতে বা জানতে শেখেনি। ওদের পুরো দুনিয়াটাই ঢুকে আছে ওই ফোনের মধ্যে। এরিকের চিন্তা হয় বাইরের ঝড়ঝাপটা এলে এরা কীভাবে সামলাবে?
স্ত্রী মারা যাবার পর এরিক এখন একাই বলা চলে। স্টেসি কয়েক সপ্তাহ বাদে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এসে বাবার খবর নিয়ে যায় কিন্তু স্টেসিরা দূরে বড়ো শহরে থাকে। ব্যস্ত জীবনযাত্রা।
২
ঝড়টা সন্ধ্যা নামার মুখেই এল।
এরকম প্রবল ঝড় সচরাচর হয় না। তার সঙ্গে বৃষ্টি পাল্লা দিয়ে। কোনোদিনও থামবে না মনে হচ্ছিল। হাওয়ার দাপট এমন এরিকের মনে হল ঘরবাড়ি সব উড়ে চলে যাবে।
তাণ্ডব চলল একনাগাড়ে গোটা রাত।
পরদিন সকালে বাইরের দৃশ্যটা খুবই হৃদয়বিদারক। গাছ উপড়ে গেছে অনেক। স্টর্মড্রেন সব জলের তলায়। বাড়িগুলো ক্ষতিগ্রস্ত। কয়েকটা ভেঙে পড়েছে। জলে নিমগ্ন এলাকার রাস্তাঘাট। বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই।
এলাকাবাসীর অবস্থা নাজেহাল। উদ্ধারের কাজকর্ম অবশ্য শুরু হয়েছে। আকাশে রেসকিউ টিম আর পুলিশের চপার উড়ে বেড়াচ্ছে। জলে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করছে। রিলিফ সামগ্রী নামিয়ে দিচ্ছে। এরিকের বাড়ির সামনে জল ঢুকে প্রচুর গাছপালা নষ্ট হয়েছে কিন্তু বাড়ির কাঠামোটা আস্ত আছে। কিন্তু পিছনের বাগান, সামনের রাস্তার অবস্থা সঙ্গীন। আরও কয়েকজন পুরোনো বাসিন্দা যেমন ক্রিস ডেভিস, ডাকোটা ফিনের বাড়ির অবস্থাও মোটামুটি সঙ্গত। দফায় দফায় হ্যান্ডপাম্প চালিয়ে সামনের উঠোনের অনেকটা জল বার করা গেছে। রিলিফ অপারেটিভদের কাছ থেকে কয়েক জ্যারিকেন খাবার জল, ব্ল্যাঙ্কেট, টার্পোলিন আর কিছুটা জ্বালানি তেল পাওয়া গেল। যতক্ষণ না বিদ্যুৎ সরবরাহ ফিরছে, জেনারেটরটা বুঝে শুনে ব্যবহার করতে হবে। সারাদিন বাড়ি মেরামত আর জল নিকাশ করে সন্ধ্যা নামার একটু আগে এরিক উপকূলের দিকে গিয়েছিল। পৈতৃক ফিশিং ট্রলারের অবস্থা দেখতে। মাস্তুল আর সামনের ডেকের অংশটা ঝড়ের দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ইঞ্জিন রুম আর ভেতরের যন্ত্রপাতি সব সস্থানেই আছে। এই বোটখানা এরিকের বাবার নিজের হাতে তৈরি। এখনও শক্তপোক্ত আছে কিন্তু কাঠের দেহের পরিচর্যার খরচ অনেক। প্রায় হাতি পোষার মতন। বাইরের অংশের মেরামতির কাজ শুরু করতে হবে তাড়াতাড়ি।
বীচের একটা অংশে ফিশারম্যানদের পুরোনো নষ্ট হয়ে যাওয়া বোটের ধ্বংসাবশেষের স্তূপ ছিল এককালে। স্তূপ না বলে ভাঙাচোরা বোটের মেলা বলা ভালো। মাছ ধরার কাজে ব্যবহার হতে হতে পরিত্যক্ত হয়ে যেত যে বোটগুলো, তাদের ঠাঁই মিলত এখানে। বোটের কাঠ কেটে নিয়ে অন্য কাজেও লাগানো হত মাঝে মাঝে। এরিকের এই জায়াগাটার সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। ছোটোবেলায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে এখানে খেলা করত। ভাঙা নৌকার খোলের ভেতর ঢুকে লুকোচুরি খেলার মধ্যে একটা অন্যরকম মজা ছিল। অনেক সময় বাড়িতে বাবা-মায়ের উপর অভিমান হলে, পালিয়ে এসে এই খোলের মধ্যে লুকিয়ে থাকত। স্ত্রী ক্যাথরিনের সঙ্গেও এখানে কত স্মৃতি! প্রথম যৌনমিলনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল একটা ভাঙা বোটের ইঞ্জিন রুমের মধ্যে। অনেক আগের কথা। তারপর সময় পালটে গেছে। গোটা এলাকাজুড়ে ট্যুরিজমের প্রসার বাড়ছে। সিজনগুলোতে লোক গিজগিজ করে। বীচ আর আগের মতন পরিষ্কারও থাকে না। সতর্কতা আর পুলিশের ফাইন সত্ত্বেও মানুষের জঞ্জাল চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে যায় সমুদ্রেও। সৈকত শহরের কর্তৃপক্ষ বীচ পরিষ্কার করার জন্য ওই ভগ্নাবশেষের বেশির ভাগ অংশই সরিয়ে দিয়েছে। দু-একটা এখনও যা রয়ে গেছে।
জায়গাটার পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে গিয়ে এরিকের চোখ একটা ভাঙা নৌকার গলুইয়ের দিকে তাকিয়ে আটকে গেল। ঝড়ের পর অনেকটা অংশ জুড়ে জল জমে আছে। বোটের ভাঙা কাঠামোগুলিকে প্রাগৈতিহাসিক ফসিলের মতন লাগে। পুরোনো পোকাধরা কাঠের টুকরাগুলি ভাসছে জমে থাকা জলের উপরে। একটা সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। আর তার মধ্যেই পড়ে আছে একটা মেয়ে। গায়ে জামাকাপড়ের চিহ্ন নেই। মৃত না জীবিত দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। এরিকের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ইতিমধ্যে ফন্সী এগিয়ে গিয়ে ওর দেহ শুঁকতে শুরু করেছে।
দ্বিধা জড়ানো পায়ে মেয়েটার পড়ে থাকা দেহের দিকে এগিয়ে গেল এরিক। নীচু হয়ে বসে নাকে হাত দিল। খুবই ক্ষীণ নিশ্বাস চলছে। মেয়েটা এখানে এই অবস্থায় এল কীভাবে? সমুদ্রে ভেসে? নাকি ঝড়ের প্রকোপে বাড়ি ফিরতে পারেনি? এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে হয়তো মারা যাবে। এরিক চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের উইন্ডচিটার খুলে মেয়েটার গায়ে জড়িয়ে নিল। তারপর পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ওর জ্ঞানহীন দেহটাকে। গাড়ি অবধি মেয়েটাকে বয়ে নিয়ে যেতে বেশ হাঁপ ধরে গেল এরিকের। হৃদযন্ত্র এখনও পুরোপুরি জোর ফিরে পায়নি। ওকে পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করল।
ফন্সীও ব্যাপারটাতে বেশ উৎসাহী হয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। সন্ধে নেমে এসেছে। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে লোকেরা ব্যস্ত। মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ঢোকার সময় এরিককে কেউ নজর করল না।
অন্তত এরিকের সেইরকমই মনে হল।
মেয়েটার গায়ের রং বাদামি বর্ণের। একরাশ কালো মাথার চুল। ওইরকম পরিবার অঞ্চলে যে ক-টা রয়েছে তাদের বেশির ভাগকেই এরিক চেনে। বাকিরা অনেক দিন আগেই অন্য শহরে চলে গেছে। ওকে আগে এখানে দেখেছে বলে এরিকের মনে পড়ছে না। হতে পারে কোনো ট্যুরিস্ট। এরিকের ঘরের পাশেই স্টেসির ঘর। নাতি-নাতনিরা এলে এ-ঘরে শোয়। অচৈতন্য মেয়েটাকে সেই বিছানায় শুইয়ে দিল এরিক। ওর সমস্ত শরীরে নোনা জল শুকিয়ে আছে। বয়স দেখে মনে হয় ১৬-১৭ হবে। শরীর বেশ পরিণত। দৃষ্টি আকর্ষণ করার সব বৈশিষ্ট্যই স্পষ্ট।
এরিক হালকা গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে মেয়েটার গা পরিষ্কার করল প্রথমে। তারপর একটা ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে ঢেকে দিল। ওর গায়ে হালকা জ্বর আছে মনে হচ্ছে। হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে এরকম অবস্থায় মেয়েটাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে পুলিশকে না জানিয়েই, সে ব্যাপারটা চিন্তা করল একবার। হতে পারে ঝড়ে কোনো বোটের সলিল সমাধি হয়েছে। মেয়েটা ভেসে পাড়ে উঠেছে। রেডিয়োর খবরে বেশ কিছু ফিশিং বোটের নিখোঁজ হয়ে যাবার সংবাদ বলেছিল। নিখোঁজ মানুষের খোঁজখবর শুরু হলে হয়তো জানা যাবে কিছু। ওকে আগে সুস্থ করে তোলা দরকার। ভাগ্য ভালো পেটে বা শ্বাসনালীতে কোনো জল ঢোকেনি না হলে এতক্ষণে মরে যেত। ব্যাপারটা একটু আশ্চর্যজনক।
এরিক যেটুকু চিকিৎসা জানত সেই জ্ঞান নিয়ে শুশ্রূষা করল। নিজের প্রেশার যন্ত্র দিয়ে
মেপে দেখল রক্তচাপ স্বাভাবিক। এবার হয়তো জ্ঞান ফিরে আসবে। বিছানার পাশে একটা কাঠের চেয়ারে গা এলিয়ে বসল এরিক। আজ অক্লান্ত পরিশ্রম গেছে। স্টেসি বারবার চেয়েছিল এরিক বাড়ি ছেড়ে ওদের কাছে গিয়ে থাকুক। কিন্তু এরিক পৈত্রিক ভিটে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাবে না। চেয়ারে বসে সেনাবাহিনীর পুরোনো স্টিলের হিপ-ফ্লাস্ক থেকে দু-চুমুক রাম ঢালল গলায়। তারপর চোখ বুজে চিন্তামগ্ন হল।
মেয়েটার এইভাবে ওই ভগ্নস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকার অন্য একটা কারণও মাথায় আসছে। কিন্তু ওর দেহে কোনো আঘাত বা অত্যাচারের চিহ্ন নেই। তাই সন্দেহটা পরিষ্কার হচ্ছে না। জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছু জানা যাবে না। ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে এসেছিল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মনে হল চারিদিকে সবুজাভ নীল জল। অতল সমুদ্রের পাদদেশ। কত ধরনের মাছ ওর চারিদিকে খেলা করছে। বহু দূর থেকে যেন একটা অচেনা সুর ভেসে আসছে। কেউ কি গান গাইছে?
মানুষের গলার আওয়াজ?
ঘুম ভাঙতেই দেখল মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে। স্বপ্নে যে সুরটা শুনেছিল সেটা যেন আরও স্পষ্ট শুনতে পেল এবার। উঠে বসে এরিকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে ক্লান্তির ছায়া। এরিক চমৎকৃত হল। মেয়েটার চোখের তারা সবুজাভ নীল। যেন এমারেল্ডের উপর নীল সমুদ্রের ছায়া! মানুষের চোখ এরকম হতে পারে ধারণা ছিল না এরিকের। আরও আশ্চর্য হল মেয়েটা এরিককে দেখে কোনোরকম ভয় বা উত্তেজনা প্রকাশ করল না। শান্ত দৃষ্টিতে এরিকের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। যেন ও জানত চোখ খুলে এরিকের দেখা পাবে। বিছানায় উঠে বসার ফলে বুকের চাদর পড়ে গিয়ে ওর নবাগত যৌবন দৃশ্যমান। চোখের দিকে তাকালে আকর্ষিত না হয়ে উপায় নেই। এরিকের একটু অস্বস্তি হল। মেয়েটার চোখ থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে বলল, এখন কেমন লাগছে?
মেয়েটা উত্তর দিল না।
আমার নাম এরিক ম্যাকফারসন।
তোমাকে বিচের ওপর অচৈতন্য অবস্থায় খুঁজে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছি।
মেয়েটা শুধু তাকিয়ে রইল। এরিক আবার প্রশ্ন করল,
তোমার নাম কী? কী হয়েছিল আমায় বলতে পারো, ভয় পেওনা।
মেয়েটা এখনও তাকিয়েই আছে।
এরিকের আন্দাজ হচ্ছে বিচে ভেসে আসার কোনো স্মৃতিই হয়তো মেয়েটির নেই। বড়ো রকম কোনো আঘাত বা বিপর্যয়ের মধ্যে জ্ঞান হারালে অনেক সময় এটা হয়ে থাকে। আগের ঘটনার স্মৃতি মনে পড়তে চায় না। এরিক ওকে বিশ্রাম করতে বলে বেরিয়ে এল।
মাসখানেক কেটে গেছে। মেয়েটার বাড়ির খোঁজ মেলেনি। পুলিশে খোঁজখবর করেছে। নিখোঁজ মানুষের ইস্তেহারে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ যোগাযোগ করেনি। মেয়েটা নিজেও ওই ব্যাপারে কিছু বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়ে বা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এরিক মেয়েটার নাম রেখেছে কাই।
মাউই ভাষায় সমুদ্রের নাম। ওর চোখের মধ্যে নিবিষ্ট হয়ে আছে অতল সমুদ্রের হাতছানি।
ডাক্তারি পরীক্ষা করেও ওর মধ্যে কোনো গুরুতর মানসিক আঘাতে স্মৃতি লোপ হওয়ার প্রবণতা ধরা পড়েনি। এরকম অচেনা অজানা একটা মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে স্টেসির একদমই মত ছিল না। কিন্তু এরিক ওকে কোনো সরকারি শেল্টার হোমে পাঠাতে নারাজ। স্টেসির মনে হয় বৃদ্ধ বয়সে বাবার মতিভ্রম। সমাজে ইতিমধ্যেই কথা উঠছে এই নিয়ে। স্টেসির নিজের ছেলেমেয়েরাও বড়ো হচ্ছে। লোকের মুখে দাদুকে নিয়ে গুজব শুনতে ওদেরও ভালো লাগে না। স্টেসি এরিকের সঙ্গে তর্ক করেছে কিন্তু এরিক গুজবে পাত্তা দেয় না। এরিকের বন্ধু ডাকোটা ফিনের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবে ভেবেছে স্টেসি। বন্ধুদের কথায় যদি বাবার মতি ফেরে। তবে অপছন্দ হলেও স্টেসি কাইকে সরাসরি কিছুই বলতে পারে না। ওর চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন সন্মোহিত লাগে। কি পবিত্র আর সৌন্দর্যে ভরা টলটলে দুটো চোখ! ঘেন্না বা রাগ কোনোটারই তখন অস্তিত্ব থাকে না। একটা মায়া তৈরি হয় যেন।
সোমবার সন্ধ্যায় ডাকোটা ফিনের বাড়িতে ফিশারমেন সমিতির মিটিং বসেছিল। মিটিং-এর পর নৈশভোজের আয়োজন। কয়েকজন প্রৌঢ় নিজেদের বক্তব্য রাখার পর এরিকের পালা এল। বিয়ারের পাত্রে একটা চুমুক দিয়ে এরিক একবার সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল,
বন্ধুরা, আমাদের এই ছোটো উপকূল শহরকে যারা ভালোবাসো, এর আত্মার সঙ্গে যাদের হৃদয়ের যোগ দীর্ঘকালের তারা সকলেই জানো যে আজ দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছরের প্রচেষ্টায়, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে, অনেক পরিশ্রম করে আমরা এই শহরে মাছব্যাবসার কার্যকরী পরিকাঠামো তৈরি করেছি। আজ প্রায় দুই প্রজন্ম ধরে আমরা বিভিন্ন বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ওই ব্যাবসার পরিকাঠামোকে স্থায়ী রাখতে সক্ষম হয়েছি।
কিন্তু বিগত তিন-চারমাস ধরে আমার মৎসজীবী বন্ধুদের যে দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তা সত্যিই দুশ্চিন্তাজনক। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা ক্রমশ বাড়ছে। তার ভাবগতিক বোঝা দায় হয়ে উঠছে। একমাস আগের বিধ্বংসী ঝড়ে আমাদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। হারিয়েছি বেশ কিছু মৎসজীবি ভাইদের। অন্যদিকে এক নতুন বিপদ আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই সামুদ্রিক আগাছার ঝাড় সমস্ত ফিশিংজোন নষ্ট করে দিচ্ছে। রোজই শুধু মরা মাছের স্তূপ দেখতে হয়। আমাদের জীবিকা আজ বিপন্ন। প্রতিদিনের মরা মাছের স্টক বাতিল করতে করতে ফিশারমেনরা নাজেহাল। কিন্তু বন্ধুরা উপায় আমাদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বীচ কর্তৃপক্ষ, সমুদ্র মন্ত্রক বা প্রশাসনের এখনও অবধি কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখা যায়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কাছে কি উপায় আছে যাতে…
আগে বিজাতীয়কে নিজের ঘরে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করো। কথাটা এরিকের দিকে ছুড়ে দিল উল্ফি। উল্ফি বা উল্ফগ্যাঙ রথ।
সৈকত অঞ্চলে একদল ছোঁড়া আর কিছু পুরোনো বৃদ্ধভাম মিলে সমাজ পরিশোধনকারী দল বানিয়েছে। উল্ফি তার পালের গোদা। ওর বাবা ফ্রাঙ্ক, এরিকের বন্ধু ছিলেন। অপঘাতে মারা যান। গুজব শোনা যায় উল্ফিই নাকি নিজের বাবাকে মেরে ফেলেছিল।
ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাতিবিদ্বেষ। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠ আর ভগবানের অংশবিশেষ বলে ওর দৃঢ় বিশ্বাস। তার বিষ ছড়িয়ে বেড়ায় চারিদিকে। এলাকায় অন্য বর্ণের মানুষদের বা তাদের পরিবারের জীবনযাত্রায় বাগড়া দেওয়া আর অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করা ওর দলের খুব পছন্দের কাজ। সুযোগ পেলেই পরিবারগুলোকে উত্যক্ত করে। সমাজ পরিষ্কার করার নামে ওরা অন্যদের সম্পত্তি ভাঙচুর করে। লুটপাট, মারধরও চালায় সুযোগ পেলে। এছাড়াও উল্ফি বিভিন্ন রকম অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যোগ রয়েছে। ওর নামে কয়েকটা পুলিশ কমপ্লেন হওয়ায়, কিছুদিন হাজতবাসও করে এসেছে। তা সত্ত্বেও দিনের পর দিন ওর উপদ্রব বেড়েই চলেছে। উল্ফি আবার এই ফিশারমেন এসোসিয়েশনের একজন প্রধান সদস্য।
হেই উল্ফি! আস্তে কথা বল, কী বলতে চাইছ?
কেন বুঝতে পারছ না? দুগ্ধ পোষ্য বাচ্চা নাকি? এরিক যে মেয়েটাকে বাড়িতে পুষে রেখেছে সে ওর কে হয়? উল্ফি তীব্র কটাক্ষ ছুড়ে দেয় এরিকের দিকে।
এরিক কিছু বলে ওঠার আগেই ডাকোটা ফিন জবাব দেয়
—সেটা এরিকের নিজস্ব ব্যাপার। তা ছাড়া ও একটা বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করেছে। এতে অপরাধের তো কিছু নেই। তার সঙ্গে আজকের আলোচনার কোনো সম্পর্ক নেই।
ডাকোটা ফিন উল্ফগ্যাঙের দিকে বিরক্তিপূর্ণভাবে উত্তর দেয়। কিন্তু তাতে উল্ফি দমে না। ঘরের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। উল্ফি এবার সুযোগ বুঝে গলার স্বর চড়ায়
—বন্ধুগণ আজ এই বিপদের দিনে আমাদের আরও একত্রিত ও সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া দরকার। আপনারা এখানে সবাই পরিশ্রমী ধর্মপ্রাণ মানুষ।
আজ আমাদের যে বিপদের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে এসব আর কিছুই না, ভগবানের আক্রোশ। তার অভিশাপ। পিতৃপুরুষদের করে যাওয়া পাপের ফল আজ আমাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে। আমাদের নিজেদের জীবিকা, অন্নসংস্থান যখন এতটাই বিপন্ন তখন বাইরের বিজাতীয়দের ঘরে আশ্রয় দিলে সেটা কি খুব পুণ্যের কাজ হবে? এভাবে কি ঈশ্বরের আক্রোশ থেকে আমরা মুক্তি পাব? কথাটা ভেবে দেখবেন!
অন্যদের মধ্যে থেকে এরিকের আরেক বন্ধু মধ্যবয়সি ম্যাকমোনাহান চিৎকার করে ওঠে,
—এই উন্মাদ খুনিটাকে এক্ষুণি এ ঘর থেকে বার করো!
তার প্রত্যুত্তরে আরও দুজন বলে ওঠে,
—এই সমিতিতে সবারই বলার অধিকার আছে। উল্ফি যে প্রশ্নটা করেছে এরিক আগে তার উত্তর দিক।
—চুপ করো! ও ব্যাটা আগে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক তারপর আমাদেরকে জ্ঞান দেবে। এবার উল্ফির দিকে আঙুল তুলে বলে ম্যাকমোনাহান।
কী বলতে চাস? উল্ফি আগ্রাসী চোখে ম্যাকোমোনাহানকে জিজ্ঞেস করে।
—চোখ রাঙাচ্ছিস কাকে?
ট্রলারের খোলে মাছের বদলে কি সাপ্লাই করিস সে আমার জানতে বাকি নেই। আর নিজের বাপটাকে যে…
চুপ কর জানোয়ারের বাচ্চা! তোর জিব টেনে ছিঁড়ে দেব। বলে উল্ফি ঝাঁপিয়ে পড়ে ম্যাকমোনাহানের উপর। ঘরের মধ্যে শুরু হয় একটা ধস্তাধস্তি। চেয়ার টেবিল উলটে একে অপরের গায়ে পড়ে যায়। ডাকোটা ফিন এগিয়ে গিয়ে দুজনের মারামারি থামাতে যায়। উল্ফি উলটো একটা ঘুসি মারে, ফিন ছিটকে পড়ে। এরিক ছুটে গিয়ে উল্ফিকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে সামরিক কায়দার কুস্তির প্যাঁচে মাটির উপর ফেলে দেয়। ওর হাত দুটোকে পিছনে মুড়ে, হাটু দিয়ে পিঠ চেপে ধরে বলে
—ইজি… ইজি
প্রতিহত অবস্থায় আস্ফালন করে উল্ফি বলে,
—এভাবে পার পাবে না। ওই মেয়েটাকে এখান থেকে তাড়িয়ে তবে আমি ছাড়ব।
মিটিং ভেস্তে যায়।
৩
কাই জীবনে আসার পর থেকে অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতা হচ্ছে এরিকের। কয়েকদিন আগে ট্রলারে কাইকে নিয়ে সমুদ্রের ভিতর দিকে গেছিল মাছের খোঁজে। লাঞ্চ সেরে কাইকে জালের দিকে নজর রাখতে বলে ইঞ্জিন ঘরের ভিতর দিবানিদ্রা দিচ্ছিল এরিক। হঠাৎ লোকজনের কোলাহল আর হাসিঠাট্টার শব্দে ঘুম ভেঙে বাইরে এসে দ্যাখে, ডেকের উপর কাইয়ের জামাকাপড় পড়ে আছে। কোত্থেকে যেন ওদের বোটের আশপাশে আরও কয়েকটা বোট এসে জুটেছে। বেশির ভাগই ছেলেছোকরার দল।
ওরা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে শিষ দিচ্ছে, কেউ প্যান্টের নীচে হাত দিয়ে বিচ্ছিরি অঙ্গভঙ্গি করছে। ওরা যেদিকে তাকিয়ে সেদিকে চোখ ফেরাতেই কাণ্ডটা দেখতে পেল এরিক।
কয়েকটা ডলফিন সমুদ্রের উপরের স্তরে গা ভাসিয়ে ডুবসাঁতার দিতে দিতে খেলা করছে।
তার একটাকে জড়িয়ে রয়েছে কাই! শরীর নগ্ন।
ডলফিনের ডুবসাঁতারের সঙ্গে সঙ্গে কাইও উঠছে নামছে। কি অপূর্ব ব্যালেন্স! একবারও পিছলে পড়ছে না ডলফিনের পিঠ থেকে। যেন এই খেলাটা ওর খুবই চেনা। অন্য বোট থেকে একটা ছোঁড়া চিৎকার করল
—ডলফিনদের রেহাই দাও সোনা,এসো আমার উপর চড়ো।
—আমরা আরও ভালো ডুবসাঁতার জানি আরেকজন ইঙ্গিত করল।
এরিক ছেলেগুলিকে ধমক দিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করাতে ওরা নড়ল না। অগত্যা ইঞ্জিন রুম থেকে নিজের হাই ক্যালিবারের দোনলাটা নিয়ে এসে আকাশে একবার ফায়ার করল। তারপর চিৎকার করে বলল
—ভাগ সব এখান থেকে, হতচ্ছাড়ার দল।
নাহলে নৌকা ফুটো করে দেব।
যদিও ওই বন্দুকের গুলিতে ছোঁড়াদের ধাতব নৌকা ফুটো হত কিনা জানা নেই কিন্তু আচমকা বন্দুক আর এরিকের মারমূর্তি দেখে ওরা বোধহয় ভয় পেল। কথা না বাড়িয়ে একে একে সব সরে পড়ল। এরিক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। কাইয়ের মুখের ওই ঔজ্জ্বল্য অপার্থিব মনে হচ্ছিল। প্রকৃতি কতরকম রহস্যময়তা দিয়ে ঘিরে রাখে মানুষকে। এরিক একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে।
এর পরের ঘটনাটা বুঝতে এরিকের বেশ কিছুদিন সময় লাগল। খুব সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন এরিকের আশপাশে ঘটে চলেছে যা এরিক ধরতেই পারেনি। আজকাল খুব ভালো ঘুম হচ্ছে না এরিকের। প্রায়শই বারান্দায় বসে থাকে গভীর রাত অব্দি। ডাক্তারের কাছে এই নিয়ে কথাও শুনতে হচ্ছে। স্টেসিও বাবার অনিদ্রা আর তার জীবনে কাইয়ের উপস্থিতি নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ও বিরক্ত। কিন্তু এরিকের চিন্তাটা সেসব নিয়ে একেবারেই নয়, কাই ওর সঙ্গে ট্রলারে থাকে সারাদিন, হাতের কাজেও ক-দিনেই বেশ চৌখস হয়ে উঠছে। অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, কাই রোজই জলের মধ্যে নিমগ্ন থাকে অনেকটা সময়। আর ঠিক সেই সময় মাছের আনাগোনা বেড়ে যায়। এত মাছ ছিল কোথায়? বিগত তিনমাসে তো শুধু মরা মাছের মিছিল দেখা যাচ্ছিল! ইদানিং ওই বিষাক্ত আগাছাও কমতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা ডাকোটা কে বলবে কিনা বুঝতে পারেনি। আরও কিছুদিন দেখা যাক।
মাঝে মাঝে একটা মিষ্টি গুনগুন কাইয়ের ঘর থেকে ভেসে আসছে। সুরটা হাওয়ায় কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে মনে হয়। একটা অলীক কিছুর আভাস। এরিক মনস্থির করতে পারে না। হয়তো এসব কিছুই নয়। ঘুম জড়িয়ে আসে। মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিড়ম্বনা এই যে, কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজতে অলৌকিকতার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা বোধ করে না। যুক্তির বাইরে কোনো কিছুকেই ভাবতে পারে না, কুযুক্তি হলেও তাতে আপত্তি নেই।
সকাল সকাল ফন্সীর দৌরাত্ম্যে ঘুম ভাঙল এরিকের। খুব একটা ডাকাডাকিতে ফন্সি বিশ্বাসী নয় মোটেই, সে লাফালাফি করতে বেশি ভালোবাসে। তবে আজ এরিককে ঘুম থেকে তোলার জন্যে বড্ড ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাই আজকাল সকালে ফন্সীকে নিয়ে সময় কাটায়, ওকে খেলায় সঙ্গ দেয়, চটপটে ফন্সীর কাইকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছে সেটা এরিক নিশ্চিত বুঝতে পারে। কিন্তু আজ তাহলে কি হল।
একটু পরে এরিক বুঝতে পারল, বসার ঘরে কেউ এসেছে, ফন্সী সেইজন্যেই এরিকের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে।
স্লিপার গলিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখল ডাকোটা বসে আছে, আবার কী হল?
এরিক মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করতেই ডাকোটা উচ্চস্বরে ‘সুপ্রভাত’ বলে উঠল।
এত সকালে তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম, কিছু মনে করো না।
কোনো সমস্যা হল নাকি?
এরিক একটু চিন্তার সঙ্গেই বলল।
—না আসলে, ডাকোটা এবার গলা নামাল,
আসলে গত কয়েকদিন ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করছি বুঝলে!?
কী ব্যাপার?
ওই আগাছাগুলি কোস্টলাইনের দিক থেকে যেন কমতে শুরু করেছে। এমনকী জালের মধ্যে মাছের সঙ্গেও আর দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারখানা কি বলো দেখি ভায়া?
এতক্ষণে এরিক ডাকোটার আগমনের কারণ বুঝতে পারে। তারপর নিজের সন্দেহের কথা পরিষ্কার করে ডাকোটাকে বুঝিয়ে বলে। প্রমাণ ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে হারবারের লোকেদের মধ্যেও বেশ কানাঘুষো শুরু হয়েছে।
সকলেই ওই বিষাক্ত আগাছার হঠাৎ কমে যাওয়া দেখে অবাক হচ্ছে, কিন্তু কারণটা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি, ডাকোটা ফিন অবশ্য এরিকের সঙ্গে পরামর্শ করাটাই সমীচীন মনে করে, কারণ এরিক যুক্তি ও বিবেচনা ছাড়া কাজ করে না। তবে প্রমাণ জোগাড় করতে এরিকের বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেল।
কাইয়ের কাণ্ড এর মধ্যে মিডিয়াও কীভাবে জানতে পেরে গেল। রোজ রোজ নতুন গল্প সাজিয়ে তারা পরিবেশন করতে শুরু করল, কারা নাকি গভীর রাতে কাইকে খোলা চুলে বিবস্ত্র অবস্থায় বীচ থেকে জলে নামতে দেখেছে, তার গায়ে নাকি গোলাপি আভা দেখা যাচ্ছিল, আর মাছ আর ডলফিন সব জলের তলায় ওর কাছে চলে আসছিল, নানারকম গল্প। যত্তসব গাঁজাখুরি!
এরিক খবর দেখা বন্ধ করে দিল। কিন্তু তাতে বাইরের জগতে কারো কিছু আসে যায় না। সংবাদপত্র থেকে লোক এল কাইয়ের সাক্ষাৎকার নেবার জন্যে, কাই ভয়ে কাঠ হয়ে ছিল, এদিকে সেই ছোঁড়া তো কাইয়ের কোনো কেরামতি না দেখে নড়বেই না। শেষে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তাকে তাড়ানো গেল।
এবার এল আরেক ঝামেলা। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ফ্ল্যানেগানের আগমন ঘটল এরিকের বাড়িতে। সে কাইকে নিয়ে যেতে চায়। কিছু গবেষণা করতে চায়। কাইয়ের মাধ্যমে এই বিষাক্ত আগাছা কীভাবে সরে যাচ্ছে তা জানার পর ওরা এর প্রতিকার নিয়ে কাজ করবে, এতে হারবারের লোকেদের স্বার্থও জড়িয়ে রয়েছে। তারা ভবিষ্যতে আর কখনও এরকম বিপদে পড়লে তার প্রতিবিধান ফ্ল্যানেগানের কোম্পানি থেকে কিনতে পারবে। সে কয়েক কোটি টাকা এরিককে দিতে রাজি আছে। কিন্তু ফ্ল্যানেগানের টাকা দিয়ে কাইকে কিনে নিতে চাওয়ার প্রস্তাবে এরিকের মাথা গরম হয় যায়। সে অপমান করে ফ্ল্যানেগানকে বের করে দেয়। ফ্ল্যানেগানও হার মানবার পাত্র নয়। সে ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু এরিক প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করে ফ্ল্যানেগানের প্রস্তাব।
মিডিয়াও এই খবর জানতে পেরেছে,তারপরেই নিত্যদিন শুধু ফোন কল আসছে, স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো রীতিমতো নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে এরিকের ওপর। স্টেসি বাবার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সুশীল সমাজে তার নাকি মুখ দেখানোও দায় হয়ে যাচ্ছে।
এরিক আর কাইকে নিয়ে সমাজে নানা কথা উঠছে। কখনও কখনও সেটা প্রকাশ্যে আসছে। বাকিটা এরিকের পেছনে। এরিক কাইকে নিয়ে বিব্রত নয়, সে নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর এতদিনের চেনা জায়গা, মানুষজনের বদলে যাওয়া আচরণে স্তম্ভিত, ও চিন্তিত। কাইকে চোখের আড়াল করা যাবে না, এরিকের মনে হচ্ছে চারিদিকে ওদের ঘিরে ফাঁদ পাতা। এরিক সবসময় খুঁটিয়ে নজর রাখে। তারপরেও আশঙ্কার শেষ নেই।
উল্ফগ্যাঙ, এরিক আর কাইকে নিয়ে বিভিন্ন গুজব রটাচ্ছে, এরিক সবই বোঝে। আজকাল মিটিংয়েও কাজের কথার চেয়ে বেশি, ওদের নিয়েই কথা হয়। উল্ফি ছোকরা সারাক্ষণ উসকে দিতে চেষ্টা করে সকলকে। এত বছরে এই প্রথম এই শহর, প্রিয় পৈতৃক ভিটে ছেড়ে যাবার কথাও ভাবছে এরিক। ব্যাপারটা ডাকোটা ফিনকেও জানিয়েছে। অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। ব্যাবসাটা ডাকোটাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তারপর আর নয়। কাইয়ের ক্ষতি সে কোনোমতেই হতে দিতে পারে না। আর এভাবে কতদিন ফ্ল্যানেগান বা অন্যদের ঠেকিয়ে রাখবে। উল্ফি তো ওঁত পেতেই রয়েছে।
৪
সামনের জানালা দিয়ে রাতের আকাশ দেখছিল এরিক। অনূদিত চাঁদের আভা দক্ষিণে সমুদ্রের উপরে ঝুলে থাকা জলকণার স্তরে গা এলিয়ে রয়েছে। বাইরের বাগানে বসে কাই গান গাইছে। গান ঠিক না একটা সুর গুনগুন করছে। মাঝে মাঝেই করে। ফন্সী পাশে বসে একমনে শুনছে।
অচেনা একটা সুর। অদ্ভুত একটা আকুতি রয়েছে তার মধ্যে। মনের ভিতরটা কেমন নাড়া দেয়। অনেক যুগ আগের কোরাল রিফের ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া কোনো প্রাণের উপলক্ষকে উদযাপন করছে কেউ যেন। দূরে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ সঙ্গত করছে ওই সুরের তালে তালে। এই গান এরিকের অজানা। তবু একটা সাবলীল যোগ খুঁজে পায় সুরের মধ্যে। এই গান কাই কোথায় শিখল জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেয় না। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশে আস্তে আস্তে সাদা ঝিল্লিময় গোলাকার চাঁদ উঠেছে। আভা মিলিয়ে গিয়ে ঝকঝকে জোৎস্নার আলো ছড়িয়ে গেল চারিদিকে। নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে বালির উপর।
চোখ লেগে গেছিল এরিকের।
মাথায় একটা হাতের ছোঁয়া পেতেই বুঝলো কাই। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, যাও শুয়ে পড়ো রাত হয়ে গেছে অনেক।
তারপর এরিকের মাথায় একটা চুমু খেল।
এরিক বাধ্য ছেলের মতন কাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কাই ওর গায়ে চাদরটা টেনে আলো নিভিয়ে দিল।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল এরিকের খেয়াল নেই। একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেল। বেডরুমের জানলা দিয়ে এখনও রাতের শেষ প্রহরের চাঁদের আলোর ঢুকছে। একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে। অস্বস্তিটা ঠিক কী কারণে হল সেটা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছে এরিক। মনে হচ্ছে এই ঘরটার মধ্যে একটা যুগ পেরিয়ে গেছে। কোথাও যেন একটা ছন্দপতনের আভাস হচ্ছে এরিকের।
বিছানা ছেড়ে উঠে লিভিং রুম পেরিয়ে ডান দিকে দুটো বন্ধ দরজার পাশে গেল। তারপর ডান দিকে ঘুরতেই কাইয়ের ঘর।এখন প্রায় ভোর চারটে বাজছে।
দরজাটা খোলা!
ঘরে ঢুকে দেখল কাইয়ের বিছানা খালি! চাদরটা বেশ এলোমেলো। বিছানার উপর বসে এলোমেলো চাদরটার দিকে তাকিয়ে এরিক কিছু একটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করল। চাদরটার উপর দিয়ে একটা আলোড়ন হয়েছে। এবার খাটের নীচে মেঝের ওপর দৃষ্টি যেতেই বুঝতে পারল যে ঘরে অন্য লোক ঢুকেছিল। মেঝেতে জুতোর ছাপ আছে। বাগানের ভেজা মাটি লাগা। এরিকের আশঙ্কা বাড়ছে। দ্রুতপায়ে বাড়ির বাগানের দিকে আসতেই এরিকের বুকটা কেঁপে উঠল। ফন্সীর অসাড় দেহটা বাগানে পড়ে আছে। দেহে প্রাণ নেই। তীব্র একটা আর্তনাদ এরিকের গলার কাছে এসে পাক খেয়ে গুমড়ে বেরিয়ে এল। যারা এসেছিল সবার আগে ফন্সী ওদের শিকার হয়েছে।
কান্না বাঁধ মানছে না এরিকের কিন্তু এই মুহূর্তে কাইকে বাঁচাতে হবে। নিজের ভেঙে পড়া শক্তিকে আবার একত্রিত করে কাজে লেগে পড়ে।
ঠান্ডা মাথায় যুক্তি সাজাতে চেষ্টা করে। ঘটনাটা
কী ঘটতে পারে,তার সম্ভাব্য একটা ছবি মনে এঁকে নিচ্ছে।
অত্যন্ত দ্রুত মাথা চালাতে চেষ্টা করছে এরিক।
ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে কাইকে?
ভাবতে ভাবতেই গাড়ির চাবিটা নিলো, ফন্সীর জন্যে শোক প্রকাশেরও সময় নেই হাতে।
কী মনে করে এরিক নিজের ট্রলারের দিকে চলল। যাওয়ার পথে ডাকোটাকে ডেকে নেবার কথা মনে হতে সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলল।
ট্রলারের কাছে যেতেই এরিক বুঝতে পারল ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে, এবং সেটা আটকানোর মতো ক্ষমতা এরিকের নেই।
সমস্ত ট্রলারে জমে থাকা শ্যাওলার গন্ধ, আর সেটা ছাপিয়ে আসছে ডিজেলের পোড়া গন্ধ।
এরিক টর্চ ফেলল ট্রলারে, যা ভেবেছিল তাই, তছনছ হয়ে আছে চারিদিক। ট্রলারটা কেউ চালানোর চেষ্টা করেছিল মনে হচ্ছে। দেখতে দেখতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল এরিকের, একটা রক্তের ছোপ, সেটা অনুসরণ করতেই আরও কয়েকটা অস্পষ্ট রক্তের ছাপ। ছাপগুলো ভালো করে দেখতেই এরিকের আতঙ্ক ঠান্ডা একটা রক্তের স্রোতের মতো শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসতে লাগল। কাইয়ের হাতের ছাপ এই বিষয়ে এরিকের কোনো সন্দেহ রইল না। ওর এতদিনের জীবনে ঝড়ঝাপটা অনেক এসেছে কিন্তু এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে এখন সেসব ভাবার সময় নয়। কাই বিপদে পড়েছে এবং প্রকারান্তরে এরিকও। রক্তের ছোপের দিকে এগোতে থাকে এরিক। ট্রলারের পেছন দিকটায় বীচের দিকে যাবার রাস্তায় টর্চের আলো ফেলল এরিক। একটা ধস্তাধস্তির চিহ্ন মনে হচ্ছে। সেই রাস্তায় পা দিতেই কোমরে গোজা ছোটো নাইন মিলিমিটারে হাত দিয়ে দেখে নিল। তারপর অন্ধকারের ছায়া ধরে এগিয়ে যেতে শুরু করল, খুব কড়া তামাকের গন্ধ আসছে হাওয়ায়।
এরিক একটা ঝকঝকে মার্সিডিজ বেঞ্জ দেখতে পেল, অন্ধকারেও চকচকে তার গা। ঠিক যেমন চকচক করত ফ্ল্যানাগানের লোভী চোখ দুটো।
তাহলে ওই শয়তানটাই এইসবের পেছনে রয়েছে? এরিকের বৃদ্ধ শরীরেও যেন আগুন খেলে গেল ঘৃণার। কোমর থেকে পিস্তলটা বার করে সামনে তাক করে এগোল। কিছু লোকের চাপা হাসি কানে আসছে। অল্প আলোয় এরিক খুব সাবধানে গাড়িটা পেরিয়ে এল। কয়েকটা ছায়ামূর্তি। তাদের গায়ে আবছা আলো। এরিক টর্চ নিভিয়ে দিল। লোকগুলোকে ঠাহর করতে পারছে এবার। দাঁড়িয়ে আছে উল্ফগ্যাং, এরিকের দিকে পিঠ দিয়ে কথা বলছে ফ্ল্যানাগানের সঙ্গে। এবার এরিকের কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে। তার মানে ফ্ল্যানাগান স্বার্থসিদ্ধির জন্যে উল্ফির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু কাই কোথায়? এরিকের চোখ এবার দূরে বালির দিকে যায়।
হাত মুখ বাঁধা কাই, অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বালির ওপর। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। শরীরটা স্থির। কিন্তু খুব মৃদু ওঠানামা করছে। তার থেকে আন্দাজ হয়, জ্ঞান হারিয়েছে।
তার পাশে আরও দুটো অল্পবয়সি ছেলে একজনের হাতে ছুরি, আরেকজন সিগারেট ধরিয়েছে, কাইকে পাহারা দিচ্ছে। ফ্ল্যানাগানের সঙ্গে উল্ফির বাগবিতণ্ডা চলছে চাপা স্বরে। এরিক সমুদ্রের গর্জনে বুঝতে পারছে না কথাগুলো, তবে উল্ফি কাইকে মেরে ফেলতে চাইছে বোধহয়। কিন্তু কাই মরে গেলে ফ্ল্যানাগানের কোনো লাভ নেই। ফ্ল্যানাগান পাকা ব্যবসায়ী, তার লাভের বাইরে সে কোনো বাড়তি ঝামেলা নিতে চাইবে না।
এরিক খুব সন্তর্পণে এগিয়ে এসে উল্ফির মাথার খুলিতে পিস্তল ঠেকাল।
কাইকে ছেড়ে দে উল্ফি!
উল্ফি ফ্ল্যানাগানকে ইশারায় কিছু বলতেই সে গাড়ির ভেতর থেকে কিছু বার করতে গেল, এরিক একটা গুলি চালাল ফ্ল্যানাগানের দিকে তাক করে। কিন্তু গাড়ির দরজায় লেগে গুলিটা লক্ষ্য থেকে ছিটকে গেল। ফ্ল্যানাগান দুই হাত মাথার ওপর তুলে দিল ভয়ে,
দ্দে… দে.. দেখো এরিক, তোমার সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আমি তোমাকে তোমার ইচ্ছেমতো টাকাও দিতে রাজি। তুমি বাকি জীবনটা নিরুপদ্রবে কাটাও। শুধু এই মেয়েটাকে আমার চাই। তুমি আর বাগড়া দিয়ো না।
এরিক গর্জে উঠল, জানোয়ার, মানুষকে নিয়ে তোর এই ব্যাবসা আমি কিছুতেই করতে দেব না। একটা নিরীহ নিষ্পাপ মেয়েকে দিয়ে তুই ব্যাবসা করবি, এটা হতে পারে না!
তাহলে কি একা তুমিই সব মজা লুটবে বুড়ো?
উল্ফি বলল এবার। সঙ্গে একটা বিকৃত হাসি। এরিকের মনে হল এক্ষুণি গুলি করে ওর খুলিটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।
কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে ঘাড়ে একটা জোর আঘাত নেমে এল আর সব অন্ধকার হতে শুরু করল। উল্ফি কে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখতে পাচ্ছে এরিক। যেটুকু রিফ্লেক্স এখনও কাজ করছে তার উপর ভরসা করে ওর দিকে তাক করে ট্রিগার টিপতে গেল এরিক কিন্তু মাথার পিছনে আবার কে যেন একটা বাড়ি মারল। বালির উপর মুখ থুবড়ে পড়ল এরিক। বন্দুকটা হাত থেকে ছিটকে গেল। এরিক ছেঁচড়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে তার নাগাল পাওয়ার আগেই উল্ফি ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। হাতে তার উদ্যত মাংস কাটার ছুরি। এরিকের মাথা, গলা লক্ষ্য করে তিন-চারবার কোপ দিতে দিতে উল্ফি হুংকার দিয়ে থাকে
শালা বুড়ো ভাম! এই বয়সেও তোর শখ কমেনি। বেজাতের মেয়েছেলেকে ঘরে তুলে ফুর্তি করবি আর তার ফল ভুগব আমরা। শালা নরকের কীট! তোদের জন্য সমাজটায় দূষণ ছড়াচ্ছে!
সব শালাকে কেটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেব শুয়োর!
উল্ফির প্রত্যেকটা কোপের সঙ্গে সঙ্গে এরিকের আর্তনাদ আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বালির উপর ছিটকে যায়। মাথা থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে বুঝতে পারছে এরিক। রক্তের স্রোত তার দৃষ্টিশক্তিকেও ঢেকে দিচ্ছে। এরিকের হাতে পায়ে যেন আর শক্তি নেই। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তাও ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বন্দুকের কাছে পৌঁছে গেছে এরিক। উল্ফি পঞ্চম আঘাতের জন্য হাত উপরে ওটাতেই একটা ল্যাচ টানার শব্দ হল। শেষ শক্তিটুকু অর্জন করে গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরল এরিকের মুখ থেকে। তারপর গর্জে উঠল নাইন মিলিমিটার। প্রথম গুলিটা উল্ফির ডান দিকের কান উড়িয়ে নিয়ে গেল দ্বিতীয়টা চোখের ভিতর দিয়ে খুলি ভেদ করে। বালিতে ছিটকে পড়ল ওর দেহ। এরিকের হাত থেকেও বন্দুক খসে পড়েছে। চেতনা হারাচ্ছে সে। কিন্তু না, কাইয়ের কথা মনে হতেই এরিকের সমস্ত চেতনা ফিরে এল এক লহমায়।
উল্ফি পড়ে যেতেই কাইকে গাড়িতে বসানোর চেষ্টা করছিল যে ছেলেগুলো হঠাৎ তারা চিৎকার করে পালাতে শুরু করল। ফ্ল্যানাগান ওখান থেকে পালাতে চেষ্টা করে কাইকে নিয়ে। কিন্তু কাই ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে। এবার ফ্ল্যানাগান বুঝতে পারে বাকি ছেলেগুলোর পালানোর কারণ। ওর হাতের যেই জায়গায় কাই ধরে আছে সেখানে ধীরে ধীরে বিষাক্ত আগাছা গজিয়ে উঠছে, গ্রাস করে নিচ্ছে ওর হাতটা। ফ্ল্যানাগান ভয়ে আতঙ্কে ব্যথায় চিৎকার করে পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুদূর যাবার পরেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আগাছাগুলো ওর গোটা শরীর ঘিরে নেয়। কাইয়ের হাতে চপিং নাইফের ক্ষত, হাঁটু থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, উঠে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা নেই। তবু এরিকের পড়ে থাকা দেহটার দিকে বালির উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায় কাই। তার দেহের ক্ষতগুলি থেকে নিঃসৃত রক্তের দাগ বালির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এরিকের মাথাটাকে কোলের উপর তুলে নিল কাই। গলার আর ডান দিকের গালের মাঝামাঝি চপিং নাইফের কোপের থেকে বেরনো রক্তের স্রোত এরিকের সারা মুখটাকে ঢেকে দিয়েছে। এরিকের মুখের কাছে মুখ নিয়ে কাই চুমু খেলো। তার চোখ থেকে জল বেয়ে পড়ছে এরিকের ক্ষতস্থানে। এরিকের বোধগুলো এবার ঝিমিয়ে আসছে, শরীরটাও ঠান্ডা হয়ে আসছে।
কাই সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল এরিককে। তারপর আবার ছেঁচড়ে এগোতে শুরু করল, জলের দিকে, এরিকের প্রাণবায়ু শেষ হয়ে আসছে। সমুদ্রের গর্জন খুব কাছে, একটা বিরাট বড়ো ঢেউ এগিয়ে আসছে বোধহয়। জলের মাঝে এবার দেখা দিল ডলফিনের দল। ঝাঁকে ঝাঁকে ডলফিন। ডুবসাঁতার দিতে দিতে এগিয়ে আসছে তারা সৈকতের দিকে। তাদের সমবেত ধ্বনির সঙ্গে সমুদ্রের গর্জন মিশে একটা পরাবাস্তব শব্দকল্প তৈরি হচ্ছে। পায়ে জল ছুঁল এরিকের। আহ্! সমুদ্র! এরিকের মনে হল কেউ যেন ওকে কোলে তুলে নিল। সেই গানটা আবার শুনতে পাচ্ছে যেন। এরিকের ঘুম পাচ্ছে খুব।আবছা নীল আলোয় প্রশান্তির ঘুম।
এই গল্পের সমস্ত ঘটনা, চরিত্র ও ভৌগোলিক অবস্থান কাল্পনিক।
উদ্ধৃতি: এডগার অ্যালান পো
গল্পBAGISH ব্লগে ২০১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, শান্তনব রায়