সবুজ বিপ্লবে
লেখক: বামা চরণ ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১
সফলতা জিনিসটা চট করে হাতের মুঠোয় আসতে চায় না, শশাঙ্কের। তিনি এক নাম না হওয়া এক ব্যর্থ বিজ্ঞানী। স্বপ্ন ভাঙতে ভাঙতে আজ অবশিষ্ট বলে আর কিছুই নেই। আজ ত্রিশ বছর ধরে লেগে আছে এই গবেষণাতে—কতজন ছাত্র এল গেল আর কতজনই বা থাকল। যৌবনের রাশিকৃত কালো চুল আজ সাদা, ভরাট দু’খানি গাল গেছে তুবড়ে, দু’একটা দাঁতও আজ স্মৃতির সরণিতে। তুমি তোমার এই ঢং নিয়েই থাক বলে মাধবী তো চলে গেল—সেও বহুকাল। জমাখরচের এমন হিসাব লিখলেও একটা মহাকাব্য হয়ে যাবে, তবুও মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে গেলে এই গবেষণা চালিয়ে যেতেই হবে। তাঁর মাঝে মাঝে নিজেকে আর্কিমিডিসের মতো মনে হয়। সমস্ত রোমান সৈন্যরা তাঁর চারপাশে। সবার হাতেই উদ্ধত খড়্গ। তিনি আত্মমগ্ন। তাঁকে মারতে এলেই তিনি বলছেন, Noli turbare circulos meos!
শশাঙ্ক বুঝতে পারেন জীবন সায়াহ্নে এসে গেছে—কোনোদিন হয়তো বা দীপ নিভে যেতে পারে, তবুও এই গবেষণা থেকে থামার চেষ্টা শশাঙ্ক শর্মা করতে পারে না। ছত্রিশ সালের দুর্ভিক্ষে মানুষ যখন মারা গিয়েছিল তখনই সে ভেবেছিল এমন যদি হয়! তাদের বাড়িতে কত লোক এসেছিল একটুখানি খাবারের আশায়—পারেনি দিতে। কী খায়নি তখন মানুষজন—হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই খেয়েছে। মনে পড়ে গাছের পাতাও মানুষ গোরু ছাগলের মতো খেয়ে ফেলেছিল। আবার কি সেইদিন দেখতে হবে? মনে হয় তাও খুব বেশি দূরের নয়, সরকার জোড়াতালি দিয়ে সমস্যা সাময়িকভাবে মিটিয়েছে, কিন্তু আংশিক সমাধান কোনো ব্যবস্থার সুরাহা হতে পারে না। বরঞ্চ দিনদিন সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন দেশ ও দশের খবর রাখত, কিন্তু এখন আর রাখে না। রেখে লাভও নেই।
এটাও ঠিক পুরোপুরি সমস্যা মেটানোও চাট্টিখানি কথা নয়। পিলপিল করে মানুষজন বেড়েছে—বেশ কয়েকটি জায়গায় হয়েছে জনবিস্ফোরণ। তার মধ্যে ভারতবর্ষ অন্যতম। খাবারের জন্য, জলের জন্য দাঙ্গা হাঙ্গামা খুবই সাধারণ ব্যাপার। চলছে চলবে এইরকম গা’ছাড়া মনোভাব নিয়ে সবকিছু চলছে। ধনীরা আরও শুষে নিয়ে ধনী হয়ে পাড়ি জমাচ্ছে অন্য গ্রহে আর গরীবরা একে অপরের মাথায় লাঠি ঠুকছে।
তাঁর গবেষণার জন্য ন্যূনতম সাহায্যও সরকারের তরফে পাওয়া যায় না। একসময় আবেদন করে থাকতেন শশাঙ্ক। এখন আর করেন না, তাঁর পূর্বতন আবিষ্কারের সামান্য পেটেন্টে কাজটা চলে যায়। তবে হ্যাঁ এই গবেষণায় তিনি যদি সফল হন তাহলে খাদ্যের অভাব বলে কোনোকিছু থাকবে না। পৃথিবীর সমগ্র প্রাণীরা স্বভোজী হয়ে উঠবে।
উজ্জ্বল সেনাপতি তার সর্বশেষ ছাত্র। সে ঠিক করেই রেখেছে এই ছেলেটি চলে গেলে আর কোনো ছাত্রকে তিনি নেবেন না। অনেক হয়েছে আর নয়। সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে এবারে তিনি পাড়ি দেবেন মহাশূন্যের পথে।
আসলে শশাঙ্ক শর্মার বিষয়টি এতটাই ইন্টারেস্টটিং যে-কোনো উঠতি ছাত্রের প্রথমে চরম আগ্রহ জন্মায়। আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য যেমন পোকারা ছুটে আসে ঠিক তেমনই এরাও ছুটে আসে। দু-বছরের মাথায় তাদের সেই স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না। ধীরে ধীরে তারা গুটাতে থাকে নিজেদের—একসময় সরে যায়। উজ্জ্বল নামের ছাত্রটি অনেকদিন টিকে আছে। ব্যর্থতায় পর্যবসিত বিজ্ঞানী কতবার তাকে বলেছেন, অন্য কিছু কর বাপু—সামনে তোমার ভবিষ্যৎ পড়ে আছে।
সে কান দেয়নি, উলটে শুনিয়েছে, স্যার আমরা ঠিক সাফল্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। আপনি একা সেই সাফল্যের ভাগ নেবেন, তাই কি হয়?
শশাঙ্ক হেসেছেন। আবার বলেছেন, তোমার জীবনের দশ বছর—সোজা ব্যাপার নয়। কতজন কত কিছু করে ফেলল। আর তুমি পড়ে আছ আমার কাছে? গো অন উজ্জ্বল।
সে কথা ঘুরিয়েছে। বলেছে, স্যার আসুন, কালকের এক্সপেরিমেন্টটা একবার দেখি। আমার মনে হয় কিছুটা এদিক ওদিক করলে এক্সপেরিমেন্টটা সফল হলেও হতে পারে।
ছোট্ট একটা ল্যাবে তারপর দুজনের সময় কেটেছে অনেকটা। এটা ওটা মিলে আনন্দের ভাগাভাগি হয়েছে দুজনে। প্রৌঢ়ত্বে আসার বহু কাহিনি শুনিয়েছে উজ্জ্বলকে। অনেকটা ভালো সময় তাদের একসঙ্গে কেটেছে।
২
—একটা অ্যাকশন না নিলে কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। রিপোর্ট যা দেখাচ্ছে তাতে ওই এলাকার অক্সিজেন লেভেল কমে গেছে, জলের লেয়ার তো পাওয়াও যায় না। প্রত্যেকটা শিশু হাঁপানি নিয়ে জন্মায়। শ্বাসকষ্টের সমস্যা তো এখানের সাধারণ ব্যাপার। সেইজন্যই কিছু অক্সিজেন উৎপাদক কোম্পানি তো দারুণভাবে ফুলে ফেঁপে উঠছে। তারপরেও এইভাবে ওরা এবারে যেভাবে বনের দিকে হাত বাড়িয়েছে তাতে…
বলতে থাকা তরুণটিকে থামিয়ে দিয়ে প্রধান বললেন, কী হবে? খেতে পাবে না? মরে যাবে? যাক না, তুমি তাকাচ্ছ কেন? দু-একজন না মরলে রাজনীতি করা যায়? মানুষ মরবে, হাহাকার হবে, তবেই না রাজনীতি করার মজা! গেঁয়ো ভূত হয়ে থাকলে হবে না সুবীর—বি পজিটিভ। জাস্ট ইগনোর। বাই দ্য ওয়ে ছত্রিশ সালে তোমার বয়স কত ছিল?
—বারো স্যার।
—শোন মানুষজন সব পারে। বাঁচার জন্য নিজেরা নিজেদের মাংসও খেতে পারে। আমি দেখেছি। তুমি ডারউইন পড়নি? Survival of the fittest. যারা যোগ্যতম তারাই টিকবে। তুমি চিন্তা কর না। জাস্ট চিল…
—কিন্তু…
—নো কিন্তু। আর শোনো ডোন্ট বি ফুলি, এগোতে দাও ওদের। যখন আর উপায় নেই দেখব তখন ব্যবস্থা নেব। এখন বি রিল্যাক্সড। ওখান থেকে ভালোই আসে পার্টি ফান্ডে, এখনই কিছু বলা যাবে না। এখন তুমি বল, তোমার কি প্রোমোশন চাই? মঙ্গলে তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেব? কী বল?
—না স্যার—আপাতত তেমন ভাবছি না। এখানেই ঠিক আছি, ওখানে গিয়ে মানাতে পারব না?
—সুবীর ভবিষ্যৎ ভাবো। পৃথিবী থেকে বাস গোটাতেই হবে—আজ না হয় কাল। আগামী পঁচিশের বছরের মধ্যে আমেরিকা তার জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ, চিন ৩০ শতাংশ, ইংল্যান্ড ৪০ শতাংশ মঙ্গলে সরাবে। বাকি উন্নতশীল কোনো দেশ পিছিয়ে নেই। রাশিয়া আর জাপান তো চাঁদটাকে নিজেদের মতো করে সাজিয়েই নিয়েছে। আর আমরা? অফার সবসময় পাবে না, আবেগের সঙ্গে চললে হয় না, আর পাতি বাংলায় একটা কথা আছে জান?
—কী স্যার?
—চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। ২৫০ কোটির দেশে সবার কথা ভাবতে গেলে হয়? কিছু মরবে, কিছু বাঁচবে—তবেই তো ভারসাম্য থাকবে। সবাই বেঁচে গেলে কী করে চলবে? তুমি স্যামন মাছের কথা পড়নি? তারা কত বাচ্চা দেয় জান? সবাই যদি বেঁচে থাকত তাহলে পৃথিবীটা স্যামন মাছেই ভরে যেত।
সুবীর বিশ্বাস প্রধানের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কথাগুলো শুনে মাথাটা ঝিমঝিম করছে তাঁর। নিজের বিবেকের কাছে বড়ো বেমানান লাগে চাকরিটা। অথচ কী না ভেবে সে জয়েন করেছিল, সেক্রেটারিয়েটের চাকরি। কত স্বপ্ন ছিল—রাজনীতির পাঁকের কথা তখন কী জানত! যত জানছে ততই সে পাঁকে ঢুকে যাচ্ছে। এ যেন কুরুক্ষেত্রের রচিত চক্রব্যূহ, সে অভিমন্যু—ঢোকবার পথ জানে, বেরোবার না।
ঝিলমিলের কাছে যেতে হবে। বেশ কয়েক দিনের বিতৃষ্ণার একমাত্র শান্তি সে। তার বুকে মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকবে। ক্যাবে উঠে চোখটাকে বন্ধ করতেই মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন দানা বাঁধছে, কিছুতেই উত্তর পাচ্ছে না। প্রধান তার কথা শুনতেই চাইছেন না। কিন্তু সংকটের খুব একটা দূর নেই। জনসংখ্যার চাপে চাষের জমি আগের থেকে আরও কমে গেছে। বনও কমেছে। এখন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক জমি কম। মানুষজনের এত চাপ—গ্রাম গঞ্জেও ২৫ তলা ফ্ল্যাট দেখা যাচ্ছে। গ্রামগঞ্জ তো আর নেই বললেই চলে—যেটুকু আছে সেগুলোকেও আর গ্রাম বলা যায় না। পুকুর নেই, বাস্তুতন্ত্র অনেকটাই বিঘ্নিত। সাপ তো কবেই ইতিহাসের পাতায়। তবুও এই রাজনীতির লোকগুলো নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া আর কিছু করবে না ঠিক করেছে। বেশি বাড়াবাড়ি শুরু হলেই মঙ্গলে চলে যাবে। সেখানে বাংলো কিনে রেখেছে। স্ট্যাটিটিক্স অফিস থেকে আসা পরিসংখ্যান বলছে আগামী তিন বছরের মধ্যে মহামারি আরম্ভ হয়ে যাবে। আবার আসন্ন একটা দুর্ভিক্ষ। কিছু গরীব দেশ একবারেই শেষ হয়ে যাবে। উঃ আর পারা যায় না! ভালোবাসা প্রেম দরকার—একটু ফ্রেশ না হলেও এই একঘেয়েমি কাটবে না।
ঝিলমিলের ফ্ল্যাটটা রোহিণী অ্যাপার্টমেন্টের বারো তলায়। ঝিলমিল একাই থাকে। একসঙ্গে থাকাতেও আগ্রহী নয়। স্বাধীনচেতা, সুবীরের দীর্ঘদিনের পার্টনার—কেউ বিয়েতে আগ্রহী নয়। সপ্তাহান্তে একদিন বা দু-দিন একসঙ্গে থাকে—কখন রোহিনীতে কখন বা অন্যকোথাও। সুবীরের ক্যাবটা ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে ঝিলমিলের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াল। নেমে এল সুবীর বিশ্বাস। বেল বাজতেই বেরিয়ে এল নীল নয়না ঝিলমিল। দরজা খুলতেই সুবীরের চোখ গেল লাল স্লিভলেস গাউনটার উপর। মনের অবসাদ যেন এক লহমায় নীচে নেমে গেল। মনের কম্পাঙ্কের সঙ্গে কামনা মিশে যেতেই তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকে ঝিলমিলকে জড়িয়ে ধরে বলল, আই লাভ ইয়্যু।
—ধ্যত।
৩
—বাবা, তুমি আসবে না? এখানের আবহাওয়া কী সুন্দর তুমি না এলে কী করে বুঝবে? এই দ্যাখ নীল রঙের ফুলে বাগিচা ভরে আছে। বিজ্ঞানীদের তারিফ করতেই হবে—মঙ্গলের আবহাওয়াকে এত সুন্দর বানানোর জন্য। এখানে না আছে শীত না আছে গরম। সবই পরিমিত—অনাবশ্যক বৃষ্টিতে মাঠ উপচে পড়ে না, আবার না হওয়া বৃষ্টিতে মাটিও ফেটে যায় না। শুধু শুধু পৃথিবীতে পড়ে আছ কেন? প্লিজ বাবা, সবাই চলে এসেছে—তুমিও চলে এস। তোমার জন্য আমাদের খুব চিন্তা হয়। ডার্টি পলিটিক্স ছাড়া আর কী আছে বল পৃথিবীতে?
—যাব রে সোনা। একটু গুছিয়ে নিতে দে। তোর বাবা এখনও এই ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী। সে নামেও প্রধান কাজেও প্রধান। হঠাৎ করে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যাওয়া যায় না। আমি রাজনীতি করি। এই ডার্টি পলিটিক্সের কেন্দ্র বিন্দু আমার থেকেই। তাই বি পেশেন্ট।
কথাগুলো বলেই এই স্যাটেলাইট টিভিটাকে অফ করলেন প্রধান। এই টিভির মাধ্যমেই কথাবার্তা হয় মেয়ের সঙ্গে। ত্রিমাত্রিকভাবেও কথা বলা যায় কিন্তু প্রধান সেসবের মধ্যে না গিয়ে টিভি দেখার মতো কথা বলেন। মনে পড়ে, কতসব নেতাকে ডিঙিয়ে এই অবস্থায় আসতে তাঁর সময় লেগেছে। মেয়ে তো আর জানে না—এই হাতটার পিছনের রং লাল—রক্তের দাগ, মোছা যায় না। গভীর রাতে যখন ঘুম আসে না তখন সেই অশরীরী আত্মারা এসে প্রধানকে বলে, আমরা তো তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম, তাহলে কেন? প্রধান ভয় পান না, দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেন, আপনারা না সরলে আমার কী হত? রাজনীতিতে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস দুটোই আপেক্ষিক শব্দ। আজকে যে কাছের কাল বহুদূরের লোক। এমনকি নক্ষত্রের হলেও আশ্চর্যের নয়।
ঝানু রাজনীতিবিদ প্রধান জানেন, তাঁর রুটিরুজি সব এই রাজনীতি। তাই যতটা পারা যায় আখের গুছিয়ে নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল, তার শেষবিন্দুটা পর্যন্ত শুষে নিতে হবে। তাঁর আর চিন্তা কী? সে তো এখন ঝাড়া হাত-পা—মঙ্গলে তাঁর পরিবারের স্ত্রী, কন্যা সবাই সিফট হয়ে গেছে।
৬৫টা দেশের বিজ্ঞানীরা মিলে মঙ্গলকে বসবাসের উপযোগী করেছে প্রায় পাঁচ হাজার জন বিজ্ঞানী। প্রথমেই বসবাসের স্থানগুলোতে অভিকর্ষকে পৃথিবীর কাছাকাছি আনা হয়েছে। ঘূর্ণন গতি আর অবস্থান বদল করে এই অভিকর্ষটাকে বাগে আনতে হয়েছে। মানুষ এখানে থাকলে বুঝতে পারবে না—সে মঙ্গলে আছে না পৃথিবীতে। কিন্তু চাঁদে সেই জিনিসটা সম্ভব হয়নি বলেই চাঁদে বাসস্থানের সুবিধা থাকলেও অভিজাত শ্রেণি বেছে নিয়েছেন মঙ্গলকে। কেউই ক্যাঙারুর মতো ছ-হাত লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে পছন্দ করেন না। আর মঙ্গলকেও বসবাস উপযোগী ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন ডোমেনে ভাগ করে নানারকম সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। নানারকম মহাজাগতিক রশ্মির হাত থেকে রক্ষার জন্য বানানো হয়েছে ওজোন গ্যাসের একটা ডোমেন। এছাড়া রয়েছে বিকিরণরোধী ডোমেন, মহাজাগতিক বস্তুর পতনরোধী ডোমেন। আর রয়েছে মানুষ বসবাসকারী ডোমেন—এখানেই রয়েছে নানারকমের জীবন দায়ী গ্যাসের সমাহার, সবই নির্দিষ্ট ওজন অনুপাতে এবং উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের কৌশল। শেষের ডোমেনটি মাটিকে নিয়ে। মাটির গঠনকে বদল করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও স্বাভাবিক নিয়মে গাছেরা বেড়ে উঠে। নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে চাষ হয়। একটি আদর্শ বাস্তুতন্ত্র পরিকল্পনা মাফিক বিগত একশো বছরের চেষ্টায় গড়ে উঠেছে। মঙ্গল হয়েছে মনুষ্য ব্যবহারের উপযুক্ত। তবে মঙ্গলের সমস্ত অংশই এখনও ব্যবহারের উপযোগী হয়নি। ধীরে ধীরে কাজ চলছে। আগামী বছর পঞ্চাশের মধ্যে সেই কাজও সফল হবে।
এখনও পর্যন্ত সমস্ত কাজের স্পনসর করেছে ‘লুথার অ্যান্ড ঠাকুর কোম্পানি’। যেটুকু অংশ সম্পূর্ণ হয়েছে সেটুকু করেই তারা পুরো কাজের পয়সা উসুল করে নিয়েছে। মঙ্গলের একটুকরো জমির দামই পড়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলার। ভারতবর্ষের যারা কিনেছেন তারা সবাই কোরাপটেড নেতা-মন্ত্রী, বড়ো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, উঁচুদরের খেলোয়াড়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ভারতবর্ষের সব সম্পদই তো এই কতগুলি শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত। আভিজাত্যে মোড়া মঙ্গলের কলোনির লোকেরা হয়তো কোনোদিন গরীব, দারিদ্র দেখার জন্য পৃথিবী ভ্রমণ করবে।
৪
—আজই এই বায়োকেমিক্যালটি প্রয়োগ করি, কি বল উজ্জ্বল?
—হ্যাঁ স্যার, আমি এর গঠন দেখে নিলাম, এক্কারে পারফেক্ট। যেকোন জীবের শরীরে সহজেই অ্যাডপ্ট হয়ে যাবে। কোশপর্দার উপরে একটা কোশপ্রাচীর ধীরে ধীরে তৈরি হবে। সেখানেই জমতে থাকবে ক্লোরোপ্লাস্ট। অবশেষে পূর্ণতা পেলেই গাঢ় সবুজ রং ধারণ করবে।
—তাহলে তুমি কী কী জীব জোগাড় করে রেখেছ?
—স্যার সাদা ইঁদুর থেকে সাদা বাঘ পর্যন্ত সবকিছুই আছে।
—মানুষ?
—স্যার ওটা তো পরবর্তী ধাপ, এত ব্যস্ততা কীসের? এদের ওপর সফল হলেই মানুষের উপর তো প্রয়োগ হবেই।
—শোন একটা কথা বলি…
—কী?
—মনে রেখ উজ্জ্বল সর্বপ্রথম সেই মানুষটা হব আমি। কোনো ভাড়া করা ব্যক্তি নয়—আমি হব সেই ব্যক্তি।
—স্যার…
একটা বিকট হাসি হেসে শশাঙ্ক বললেন আবার, এদিকে এস। তাঁর ঘরের বাঁদিকে রাখা বোর্ডের তেরো নম্বর সুইচটা তিনবার অফ অন করতেই চিচিংফাঁকের মতো একটা দেওয়াল খুলে গেল। দশ বছরের কাজে এই ঘরটার হদিশ একবারও পায়নি উজ্জ্বল। যত পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে শশাঙ্ক তত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আর উজ্জ্বলকে দিয়েছেন লম্বা ছুটি।
সে থাকাকালীন তিনবার তারা পশুদের দেহে বায়োকেমিক্যালটি প্রয়োগ করেছেন। ফিরে আসার পরে শশাঙ্ক জানিয়েছেন ব্যর্থতার কথা, কিন্তু কোনোদিন পশুদের দেখাননি। উজ্জ্বলও জানতে চায়নি। সে ভেবেছে, পশুরা মৃত—স্যার সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন। ব্যর্থতা ভুলতে পারলেই নতুন করে কাজ শুরু করা যায়। আজ দেওয়াল খুলতেই দেখা গেল একটা পথ। একটু স্যাঁতসেঁতে, আলোর জোর নেই। ভয় লাগে। কোনো পরিচালক দেখলেই নিশ্চয় কোনো হরর মুভির লোকেশন চুজ করত। উজ্জ্বল ভাবে, এ আবার কী রে বাবা? আরও কিছুটা যেতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, এ আবার কারা? সব কিম্ভূতাকার, বিকট দর্শনের জন্তু। পৃথিবীর কোথাও এমন দর্শনের জন্তু মেলা ভার। শশাঙ্ক বললেন, দ্যাখ উজ্জ্বল—এইসব পশুদের এমন দর্শনের জন্য আমিই দায়ী।
পুনরায় একটা সুইচ অন করতেই ঘরটা তীব্র আলোয় ভরে উঠল। সেই আলোয় উজ্জ্বল খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল পশুদের—একবার চর্মচোখে আর একবার সিসিটিভিতে। একটা জন্তুকে খুব ভালো করে দেখার পরে সিসিটিভির ক্যামেরাটা খুব ভালো করে তার দিকে ফোকাস করল সে।
শশাঙ্ক নিজের ব্যর্থতায় খুবই উত্তেজিত হওয়ার জন্য এইসব পশুদের ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেননি। আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন দীর্ঘদিন। ঘর থেকে বের হননি। বার বার নিজেকে বলেছেন, এদের স্বাভাবিকতা নষ্টে আমিই দায়ী—শুধু আমিই দায়ী। মদের নেশায় চুর হয়ে থেকেছেন বেশ ক’দিন। তারপর আবার বেরিয়ে এসেছেন। সাজিয়েছেন নতুনভাবে কম্পোজিশনটা। তারপর দিনক্ষণ ঠিক করে আবার প্রয়োগ। সেবারেই সাদা বাঘটাকে যখন ইনজেক্ট করেন তখন উজ্জ্বল আসেনি। আগের ছাত্র সুহাস কয়েকদিন আগেই চলে গেছে। একা একাই তিনি সাদা বাঘটার উপর প্রয়োগ কেমিক্যালটা প্রয়োগ করলেন। তারপর নিঝুম হয়ে পড়েছিল বাঘটা পাঁচদিন। সাতদিনের পর থেকে বাঘটার মুখটা কেমন বেঁকে গেল। পাগুলো ফুলে হল খুব মোটা মোটা। গাছের ছালের মতো ফাটাফাটা চামড়া হয়ে গেল। নখ দিয়ে যখন সে চুলকাত তখন সেখান দিয়ে রক্ত বের হত। সেটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে যেত শশাঙ্কের, মন গালি দিত—এইসব অবলা জীবের উপর আর কত অত্যাচার করবে? তোমার নরকেও স্থান হবে না। উজ্জ্বলের কথায় সংবিৎ ফিরল তাঁর, স্যার এইদিকে একবার আসবেন?
মোটা চশমার ফাঁক থেকে একবার চেয়ে, ইনহেলারটা মুখে দু-বার পাম্প করে উজ্জ্বলের কাছে এলেন।
—স্যার দেখুন। সিসিটিভির ক্যামেরায় একটা সাদা চামড়ার বাঘের পায়ের কাছটা জুম করলেন। খুব সামান্য হলেও আছে, ইঞ্চি তিনেক জায়গায় সবুজ রং।
—স্ট্রেঞ্জ!
—হ্যাঁ স্যার। এটা রেজাল্ট। আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি।
—তাহলে চল কেমিক্যালের কম্পোজিশনটা আর একবার চেক করি। আর নতুন এগজামিনের ডেটটা পিছিয়ে দাও- এবারে সফল আমাদের হতেই হবে।
—হ্যাঁ স্যার। সফল আমরা হবই।
৫
জানালার ফাঁকটা দিয়ে হালকা আলো এসে পড়েছিল ঝিলমিলের গালে। আধশোয়া হয়ে সুবীর তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ঝিলমিল গান করছিল, আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কুঁড়ি। বেশ সুন্দর গলা। সারাদিনের অবসাদ দূর হয়ে নিজেকে বেশ হালকা লাগছিল সুবীরের। আবার দুষ্টুমি করার ইচ্ছে জাগছিল। কিন্তু শরীর মনের উত্তাল সুমদ্রের ঢেউ এখন দীঘির জলের মতই শান্ত। সে ঝিলমিলের আরও কাছে সরে গিয়ে বলল, গান শেখাটা ছেড়ে দিলে কেন?
—ধুর আর ভালো লাগে না, দরদ দিয়ে কেউ শেখায় না। কেবল অর্থ আর যশ চিন্তা।
সে উঠে গিয়ে তার সংগ্রহ থেকে একটা মেমোরি কার্ড বের করে নিয়ে এসে বলল, শুনবে?
—হ্যাঁ, শোনাও।
যন্ত্রে ভেসে উঠল দেবব্রত বিশ্বাসের ভরাট কণ্ঠস্বর—পুরোনো সেই দিনের কথা…। ঝিলমিল বলে উঠল, দ্যাখ—গানের প্রতি দরদ দ্যাখ। এখন বাঙালি ফ্যাশানের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে—প্যাশনের জন্য নয়।
সত্যি করেই এমন গলা সুবীর শোনেনি। সে শুনছিল। মন চলে যাচ্ছিল সুদূরে। সে ভাবছিল এমন করে কেন সে এতদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেনি? ঝিলমিল গানের সঙ্গে গুনগুন করছিল, সে হঠাৎ তার কোলে মাথাটা দিয়ে শুয়ে পড়ল, এমন কোথাও জায়গা কি পৃথিবীতে নেই, যেখানে একটু শান্তিতে থাকা যাবে? ঝিলমিলের গা থেকে আসছিল মিষ্টি একটা গন্ধ, হয়তো কিছুক্ষণ আগেই সে স্নান করেছে। সে জানে স্নান করলেই ঝিলমিল আতর মাখে। এই গন্ধটা সেই আতরের। বাইরে জানালা দিয়ে একটু বৃষ্টি নামার দৃশ্য দেখল। কয়েকফোঁটা তাদের ঘরের কাচের জানালায় এসে লাগল।
—জান, একসময় লোকেরা ইচ্ছে করলে বৃষ্টিতে ভিজত? পুরোনো সিনেমায় দেখেছি তাই নয়—বাবা মা’রা বলেছেন তাঁরাও নাকি ছোটোবেলায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খেলাধূলা করেছেন।
—তুমি ভিজবে না কি?
—সে উপায় কি আছে? এখানের বৃষ্টির জলে পিএইচ কত জান? মাত্র ২। স্ট্রং অ্যাসিড—চামড়াও পুড়ে যেতে পারে। একটাও গাছ দেখতে পাচ্ছ? যেগুলো আছে সব ইন্ডোর। বাকি সব শেষ।
—তাহলে এক কাজ কর।
—কী?
—বাথরুমের শাওয়ারটা খুলে ভিজে নাও।
মুখে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে ঝিলমিল বলতেই সুবীর তাকে নিজের দিকে আরও ঘন করে টেনে নিয়ে বলল, চল তাহলে একসঙ্গে ভিজি। দুটো শরীরও জেগে উঠছিল—এইসময় ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। মিউট করে সেটাকে সরিয়ে দিতেই ঝিলমিল বলল, সরিয়ে দিও না। ওটাকে ধর।
—ভালো লাগে না। কোনো জায়গায় সততা নেই। আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই। ফোন ধরলেও আমি কিছু করতে পারব না, তাই…
—তাহলেও ধর।
—কী হবে রিসিভ করে—সেই একই জিনিস। আর ভালো লাগছে না। রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি করছে। আমাদের কথার কোনো দাম নেই। আমরা কেবল দাবার বোড়ে হয়ে যুদ্ধ করছি। আমি জানি কী হবে—শুধু কোথা থেকে হবে সেটাই বুঝতে পারছি না।
—কেন?
—সেটা ঠিক বোঝাতে পারব না।
ফোনটা নিতেই দেখল একগাদা নোটিফিকেশন। ঝটপট সব দেখা সম্ভব নয়—স্ক্রল করতে করতে একজায়গায় গিয়ে আটকে গেল চোখ। তিনদিন ধরে জল না পাওয়ার জন্য রাজস্থানের এক জেলায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে। বেড থেকে লাফ মেরে নীচে নেমে প্যান্ট জামায় কোনোরকমে দেহটাকে গলিয়ে ক্যাবটাকে ডেকে ফেলল।
—দেখলে? কিছু করার নেই এটাই চলবে। যাইহোক, গুড বাই হানি।
ক্যাব উঠতেই সুবীরের হতাশার চোখে চোখ রেখে ঝিলমিল বললে, নিজের কাজকে ছেড়ে কি পালিয়ে যেতে পারবে?
—না, তা পারব না।
—তাহলে সিস্টেমে থেকে যতটুকু পারা যায় ততটুকু ভালো করার চেষ্টা কর, তাতে তুমি অন্তত ভালো থাকবে।
গাড়িতে উঠে সুবীর বলল, আসি তাহলে। আবার কবে আসতে পারব তার ঠিক নেই।
—মনখারাপ করো না, আমি এই সপ্তাহে সময় বের করতে পারলে, যাব।
গাড়িটা অনেকটা এগিয়ে চোখের দৃশ্যপটের বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত ঝিলমিল দরজায় দাঁড়িয়েই থাকল। সুবীরের এই প্রতীক্ষীয়মান চোখদুটোকে বড়ো ভালো লাগল।
৬
আজ সকাল থেকেই কোনো খবরই ভালো আসছে না, প্রধানের। প্রথমেই মঙ্গলের দুঃসংবাদ। গ্রাভিটি লেভেল তিনটি জায়গায় কমে গেছে। মহাজাগতিক চাপ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি কলোনি সেখানে ক্ষতিগ্রস্থ। হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ না হলেও—ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা একবারেই উড়িয়ে দেবার নয়। তবে একটাই চিন্তা নেই প্রধানের পরিবার যেখানে আছে সেখানে এখনও কিছু হয়নি। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। লুথার অ্যান্ড ঠাকুর কোম্পানির টি. যশ ভরসা দিচ্ছেন। লোকটা প্যাটারসনের খুব কাছের লোক। আগামী মঙ্গলের নির্বাচনে তিনিও নাকি মঙ্গলের প্রার্থী—কানাঘুষো তেমনই। তিনি বলছেন, কোনো চিন্তা নেই। মঙ্গলের কিছু জায়গা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও আমরা খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো সাড়িয়ে নিতে পারব। একটা বড়ো আকারের উল্কা খুব তীব্রগতিতে মঙ্গলের ডোমেনে ঢুকে যাওয়ায় সমস্যার শুরু। সেটা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাভিটি ফল করে এবং মহাজাগতিক চাপ বেড়ে যায়। আমাদের বিজ্ঞানীদের টিম প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেছেন। খুব তাড়াতাড়ি আমরা ওভারকাম করব। নমস্কার।
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, কোনো হতাহত?
—না তেমন খবর এখনও নেই।
—তাহলে কি বাকিদের পৃথিবীতে ফেরাচ্ছেন?
—না। ফেরাবার জন্য কি ওখানে বসতি হয়েছে? আপনারা সাংবাদিকেরা যে মাঝে সাঝে এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করেন… বি পজিটিভ ম্যান, উই শ্যুড ওভারকাম।
—স্যার আর একটি প্রশ্ন…
—নো কোশ্চেন প্লিজ…
একদিকে দুশ্চিন্তা হলেও বিশেষ একটা কারণে হেসে উঠলেন প্রধান। মঙ্গলের রাজনৈতিক পালাবদলে এই ঘটনা বেশ বড়ো ভূমিকা নেবে। তাঁর জামাই যে রাজনৈতিক চক্রে জড়িয়ে আছে আর এই লুথার অ্যান্ড ঠাকুর কোম্পানিটি অন্য দলের পৃষ্ঠপোষক, তাই গুটিটা কোনদিক থেকে তিনি সাজাবেন সেটা ভেবে নিলেন। চেষ্টা করলেন, তাঁর পরিবারের খবরটি পাবার।
মাথাটা হালকা ধরেছে প্রধানের। এই মাথা ধরাটা প্রশয় দিলেই এক্ষুনি সমস্ত মাথাটাকে কাবু করে ফেলবে। তিনি উঠে গিয়ে একটা ট্যাবলেট খেতেই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে সুবীর বিশ্বাস। ছেলেটা অতিমাত্রায় সৎ। প্রধান মুচকি হেসে ভাবলেন, ছেলেটা উন্নতি করতে পারবে না। ফোনটা উঠিয়ে বললেন, হ্যালো।
—স্যার ব্যাড নিউজ।
—আই নো। হোয়ার?
—রাজস্থানে।
—মারা গেছে?
—ইয়েস স্যার, তিনশো প্রায়। আহত শতাধিক। ফোর্স পাঠাই?
—একটু ভাবতে দাও। তুমি এখন কারণটা বল।
—জলের জন্য সংঘাত। তিনদিন জল নেই—স্থানীয় একজন জল জমিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। তাঁর পরিবার, গোষ্ঠীর লোকেরা শুধু জল পাচ্ছিল। তাই সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে—দাঙ্গা শুরু হয়।
—মরছে কারা?
—পীড়িতরা, যাদের জল নেই।
আচ্ছা বলে প্রধান একটু থামলেন। তারপরে বললেন, পাঁচশো ছাড়ালে ফোর্স পাঠিও—এখন দেখে যাও। লোকজনকে গ্রেপ্তার করলেও তাদের জল এবং আহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন মরতে দাও, আরও কিছু মরুক—পরে দেখা যাচ্ছে।
ফোনটা কেটে দিয়ে মঙ্গলে তাঁর পরিবারের সঙ্গে আর একবার যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগলেন প্রধান। সেখানকার আবহাওয়া হাল হকিকত জেনে রাখা খুব জরুরি। আগামী দিনে মঙ্গলে বোর্ড নির্বাচন—সেখানে তাঁর জামাইকে কাউন্সিলার করাতেই হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রে না থাকলে বেঁচে থাকাটা বেশ কষ্টকর। অবশেষে তাঁর মেলে একটা বার্তা আসতেই তিনি অনেকটা চাপ মুক্ত হলেন, আগামী ঘণ্টার মধ্যে আপনি আপনার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।
৭
বায়োকেমিক্যালটাকে আগাগোড়া ভালো করে পরখ করে নিল দুজনে। শশাঙ্ক উজ্জ্বলের মুখের দিকে চেয়ে একবার চশমার ফাঁক দিয়ে ঘোলাটে দৃষ্টিতে বললেন, এবারেও কি সম্ভব?
উজ্জ্বল স্যারের এই মনোভাবটাকে একদম পছন্দ করে না। সে বরাবরই আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বর এক যুবক। স্যার ওকে আদর করে মাঝে মাঝে টগবগে ঘোড়াও বলে থাকে। স্যারের দিকে একবার বিরক্তি বোধের চাওনি দিতেই শশাঙ্ক বললেন, বিজ্ঞানে অসফলতা এক ধ্রুবক রাশি। একে তুমি অস্বীকার করবে কি করে?
—না স্যার আমি অস্বীকার কোথায় করলাম? আমি বিশ্বাস করি এই পরীক্ষায় আমরা সফল হবই। আমি ভীষণ পজিটিভ, মনে কোনরূপ দ্বিধা স্থান দিতে চাই না। এই কেমিক্যাল কম্পোজিশনটা একবার দেখুন। আমার মনে হয় এই কেলাসের মধ্যে হাইড্রোজেনের অনুটাকে ৪৫ ডিগ্রী ঘুরিয়ে দিলেই ক্লোরোফিলের স্থায়িত্বটা অনেকটা বেড়ে যাবে। বাকি কোশগুলিতেই ক্লোরোপ্লাস্ট তৈরিও হতে থাকবে।
—দেবে? দাও। এভাবেই শুধু বাকি আছে। দেখা যাক কী হয়? ডেডলি কোনো কম্পোজিশন না হলেই হল। দেহের এক শতাংশে মধ্যেও যদি ক্লোরোফিল তৈরি হয় তাহলেও…
—স্যার বি পজিটিভ। দেখলেন না বাঘটাকে… । আমি এই দেখুন বাঘের পায়ের চামড়ার স্যাম্পেল নিয়ে এসেছি।
—শুধু রং দেখলেই হবে না, উজ্জ্বল। সবুজ রংটা কতটা কার্যকরী সেটাও দেখতে হবে। সবুজ রং তো বিভিন্ন কারণের জন্যও হতে পারে—কিন্তু সেটা ক্লোরোফিল কিনা, সেটা কীভাবে বুঝবে?
—তাহলে কি আপনি সিওর নন?
—না আমি এখনও সিওর নই।
—স্যার তাহলে এটা দেখুন…
উজ্জ্বল পাশের একটা কম্পিউটারে দেখাল বাঘের চামড়ার গঠনটা। কম্পিউটারের পর্দায় ক্রমান্বয়ে ফুটে উঠছিল পরিবর্তন। কীভাবে কোশগুলি পরিবর্তিত হচ্ছিল তার একটা গ্রাফিক্স বেশ মনোযোগ সহকারে দেখছিলেন শশাঙ্ক। কোশপর্দার বাইরে কোশপ্রাচীরও মোটামুটি দৃশ্যমান। এখন তারা বাঘটাকে একটা খাঁচার মধ্যে রৌদ্রজ্জ্বল জায়গায় রেখেছে। তবে সবসময় রোদ নয়, কিন্তু এমনভাবে খাঁচাটাকে ডিজাইন করা হয়েছে তাতে দিনের বেশির ভাগ সময়ের সূর্যের আলো ঠিক যেন বাঘটার পায়ের ওই অংশটার উপরে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে বিজ্ঞানী বললেন, বাঘটা আজ ক’দিন উপবাসে?
—আজ দশদিন স্যার।
—কেমন দেখছ?
—সামান্য দুর্বল। তবে যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমন হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম একবারে নেতিয়ে পড়বে—কিন্তু পড়েনি। আমার মনে হয় খাদ্য কিছুটা হলেও উৎপন্ন হচ্ছে। না হলে এতদিনে…
—জল কতটা করে দিয়েছ?
—স্যার একটা পূর্ণাঙ্গ বাঘের যতটা জল লাগে ঠিক ততটা দেওয়া হয়েছে। বেশি দেওয়া হয়নি।
—ওকে। আজ থেকে চারদিন ওকে আর জলও দিও না। দেখি—তারপরে নতুন করে আমরা গিনিপিগের উপরে পরীক্ষাটি করব।
—তাই হবে স্যার।
৮
দুটি দলের নেতারাই মঙ্গল পর্যবেক্ষণে বেরিয়েছেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ভঙ্গিও পালটে যাচ্ছে। লুথার অ্যান্ড ঠাকুর কোম্পানি যেহেতু প্যাটারসনের ঘনিষ্ঠ, তাই তারা দেখছে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে। তাদের মনোভাব—দুর্ঘটনা তো যে-কোনো ভাবেই হতে পারে। আর চেম্বারলিনের দল দেখছে সব ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে। তাদের যুক্তি যেহেতু মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে তাই এই ত্রুটিকে কোনোভাবেই ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিকে থাকা সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষণ দু’তরফেরই সারাদিন চলল। যশনও ছিল সঙ্গে। দুর্ঘটনার জায়গাটা তাদের কলোনির ঠিক পাশেই। দলের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের পরে সে বাড়ি যখন এল তখন সুদেষ্ণার ভয়ার্ত মুখটা দেখে নিজেরই ভয় পেয়ে গেল। মুখ দেখেই বোঝা যায় সে একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আঞ্জেলিনার সঙ্গে সুদেষ্ণার এখানেই পার্থক্য—সুদেষ্ণার সবেই ভয়, কুচকে থাকে। কিন্তু আঞ্জেলিনা যেন একটা ক্ষুধার্ত বাঘিনী—সবই চেখে দেখার ইচ্ছে, জয় করার স্পৃহা। কিন্তু সুদেষ্ণার বাবার মতো আঞ্জেলিনার বাবা নেই—নইলে হয়তো…
—যশন তুমি এতক্ষণে এলে? আমার খুব ভয় করছিল।
—কেন?
—আবার যদি এমন হত! এবারে যদি আমাদের কলোনিতে ঘটত, তাহলে তো আমরা মরে যেতাম?
—কেন আলতু-ফালতু চিন্তা করছ? এসব চিন্তা করো না—আমরা এখন আগের থেকেও সুরক্ষিত বেশি।
—আমার আর এখানে থাকার ইচ্ছে নেই, যশন। তুমি বাবাকে বলে, ফিরে চল।
—কোথায়? পৃথিবীতে? সেখানে কি দুর্যোগ হয় না? তোমার মনে নেই ওখানে থাকাকালীন ভূমিকম্পের কথা? তখন কোথায় পালিয়ে যাবার কথা ভেবেছিলে? ছেলেমানুষি ছাড়। চল, ভিতরে চল।
ভিতরে গিয়ে প্রধানকে আর একবার ফোন করার চেষ্টা করল যশন। বেশ কয়েকদিন প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। সমস্ত আন্তঃমহাকাশ যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে রেখেছে এখানকার অথোরিটি। আজ থেকে খুলে যাবার কথা। পৃথিবীতে প্রধানও নিশ্চয় চিন্তিত আছেন। তবে একটাই সুরাহা—মঙ্গলের মধ্যে যোগাযোগ মাধ্যম চালু রেখেছে অথোরিটি। তাই ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শাশুড়িকে নিয়ে চলে আসতে পেরেছে। মা-মেয়েতে আলাদা থাকলে আরও নাকাল হতে হত যশনকে। ফোনটা নিয়ে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে যেতেই অবশেষে পৃথিবীতে কানেক্ট হল। কথাটা শোনা গেলেও ভিডিয়োর উপর একটা আবছা ভাব চলে আসছে। বোঝা যাচ্ছে যে মঙ্গলের টেলিসিস্টেমের উপরেও দুর্ঘটনাটি বেশ আঘাত হেনেছে। ফোনে গলাটা শুনেই প্রথম কথা প্রধান যেটা বললেন, সব ঠিক আছ?
—হ্যাঁ।
—হতাহত?
—কুড়ি জন মারা গেছে। আর একশো জনের ট্রিটমেন্ট চলছে। বেশ কয়েকজন আশঙ্কাজনক। তবে মিডিয়াতে এরা মৃত্যুর খবরকে চেপে যাচ্ছে।
—দেখতে গিয়েছিলে?
—হ্যাঁ আজকেই দল পর্যবেক্ষণে গিয়েছিল।
—গুড।
—একটা কথা…
—কী?
—আপনার মেয়ে ট্রমাতে ভুগছে। পৃথিবী ফিরতে চাইছে, কী করা যায়?
—আগামী মাসের স্পেসশিপ বুক করে মা-মেয়ে দুজনকেই পাঠিয়ে দাও। ঘুরে যাক ক’দিন। নির্বাচনের পর পাঠাব। তুমি নিশ্চিন্তে নির্বাচনের কাজ করতে পারবে তাহলে। মনে রাখবে, মঙ্গলের নির্বাচনে জেতাটা খুব জরুরি। চেম্বারলিনের সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে, স্ট্রাটেজি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আশা করি জয় লাভ নিশ্চিত। এই দুর্ঘটনা তোমাদের শাপে বর হল।
এরপর লাইনটা কেটে গেল। যাক একটা ব্যাপারে যশন নিশ্চিন্ত হল। ভিতরের ঘরে ঢুকে সুদেষ্ণাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা তোমাদের ক’দিন পৃথিবীতে ডেকেছেন, যাও ঘুরে এস।
—তুমি?
—আমি গেলে হবে? সামনে নির্বাচন।
মুখটা গোমড়া করে পাশে সরে গেল সুদেষ্ণা। যশন বিকট গলায় একটা গান ধরে বলল, রাগলে তোমায় সুন্দরী দেখায়।
৯
অত্যধিক দ্রুততার সঙ্গে মঙ্গলের ডোমেনগুলি মেরামত হয়ে গেছে। ডোমেনগুলি এখন আরও শক্তিশালী। মহাজাগতিক কোনোকিছুই আর হঠাৎ করে মঙ্গলের মাটিতে আছড়ে পড়তে পারবে না। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে কন্ট্রোল রুমে সিগন্যাল আসবে। আদর্শ কোনো ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে ম্যাচ না করলেই সঙ্গে সঙ্গে ট্যাঙ্গো ফর্টিনাইন তাদের ধ্বংস করে দেবে। মানুষ বসবাস করার সীমানা ক্রমাগত বাড়ছে মঙ্গলের। দুর্ঘটনা ঘটার পরে কয়েকদিন মাত্র এই হিড়িক বন্ধ ছিল—তারপর যা কার তাই। অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে মঙ্গলে একটি বসতি বানানোর একটা হিড়িক পড়ে গেছে। লুথার অ্যান্ড ঠাকুর কোম্পানি একচেটিয়া ব্যাপারটা ধরে রাখলেও আরও তিনটে কোম্পানিও তাদের কলোনি বসাচ্ছে—তারাও বিভিন্ন রকমের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লোকজনকে তাদের কলোনির দিকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টায় রয়েছে। বর্তমানে এখানের লোকসংখ্যা ত্রিশ হাজারের আশপাশে হলেও আগামী বছরের মধ্যে লোকসংখ্যা ষাট ছাড়িয়ে যাবে।
এখন মনপ্রাণ দিয়ে নির্বাচনের কাজে লেগে গেছে যশন। আগের মাসে সুদেষ্ণা আর তার মা’কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারছে। প্রধানও এটাই চাইছিলেন। যশনের শরীর মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করলেও মঙ্গলের অভিজাত কলোনিতে সেই বিদ্রোহ শান্ত করার জায়গার অভাব নেই। শুধু ব্যাপারটা যাতে গোপন থাকে সেই ব্যাপারে সাবধান থাকলেই হল। আজ দু-বছর ধরেই আঞ্জেলিনার সঙ্গে সম্পর্কটা এভাবেই টিকিয়ে রেখেছে। আঞ্জেলিনা প্রায়ই বলে, তুমি খুব চালাক যশন।
—হ্যাঁ তা বটে। বোকা হলে কি তোমার কাছে আসতে পারতাম?
সুদেষ্ণার সঙ্গে যখনই বোরিং লাগে তখনই আঞ্জেলিনার কাছে চলে যায়। এক দু-দিন কাটিয়ে শরীরকে চাঙ্গা করে আবার ফিরে আসে গোয়ালে—হ্যাঁ গোয়ালের গোরুই তো সে। কিন্তু গোরু হওয়ার আগেও একটা জীবন ছিল—কেউ তাকে বলেনি এই জীবন বেছে নিতে, এই ডিসিশান ছিল তার একার। তার উচ্চাকাঙ্খা তাকে এই জীবনে নিয়ে এসেছে—এখন আর দুঃখ করে কী লাভ!
তার কলোনির অফিস রুমে বসে শ্বশুরমশাইকে একবার ধরার চেষ্টা করলেন। সামনেই মনে হচ্ছে এখানে বোর্ড গঠন—একটা স্ট্রাটেজি তৈরি করে না রাখতে পারলে খুব মুশকিল। আর এইসব ব্যাপারে তার রাজনৈতিক গুরু প্রধান—ভারতের একচ্ছত্র প্রাদেশিক শাসন কর্তা। প্রধানের একমাত্র কন্যা সুদেষ্ণাকে বিয়ে করেছে। সেও খুব উঁচুদরের স্কলার ছিল। জীবনটা ভালো রোজগারে, সুখে আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সুদেষ্ণার বাবার সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনি বললেন, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?
যশন চট করে জবাব দিতে পারেনি। প্রধানই আবার বলেছিলেন, রাজনীতি কর। ক্ষমতা হাতে থাকলে বুঝবে আশপাশটা কত তুচ্ছ। তুমি চাকরি করবে কি, তুমি নিয়ন্তা হও, দেশ ও দশের ভাগ্য নিয়ন্তা হও।
সুদেষ্ণা তাকে ছাড়া আর কাউকে চায়নি, বিয়েটা হয়ে গেছিল তারপর। তার প্রতি সুদেষ্ণার প্রচুর আস্থা। এই পথে আসতে তার সময় লেগেছিল। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে এই মানসিকতা গড়তে সময় লেগেছিল তার। কিন্তু যখন একটু একটু স্বাদ পেতে লেগেছিল তখন বুঝছিল ক্ষমতা কী জিনিস! ক্ষমতার স্বাদ, সুদেষ্ণার ভালোবাসা এই নিয়ে গড়গড়িয়ে চলে যাচ্ছিল যশনের জীবন। এমন একদিনে প্রধান এসে বললেন, মঙ্গল নিয়ে তোমার ভাবনাচিন্তা কী?
থতমত খেয়ে যশন বলেছিল, ভালোই। বেশ পোগ্রেসিভ।
—ধুর পোগ্রেসিভ না ইম্প্রেসিভ এইসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তুমি মঙ্গলের রাজনীতি কী ভাবছ? চেম্বারলিনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল?
—না, মানে… তেমন…। এখনও সময় করে উঠতে পারিনি।
—শোন এইসব কাজে দেরি করতে নেই। দুটো দল এর মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। মঙ্গলে যে বোর্ড নির্বাচন হবে সেখানের জন্য দুটো দল। খবর রাখ যশন—এটা তোমাদের ভবিষ্যৎ।
—সরি বাবা।
—নো সরি, শোন। দুটো দল, একটা চেম্বারলিনের আর একটা প্যাটারসনের। প্যাটারসনের নির্দেশেই মঙ্গলে লুথার অ্যান্ড ঠাকুর কোম্পানি কলোনি বিস্তার করছে। এই নিয়ে প্রথমে ব্যাকফুটে থাকলেও এখন অনেকটা এগ্রেসিভ চেম্বারলিন। আগামী দিনের নির্বাচনের আগেই দুই থেকে তিনটে কোম্পানি মঙ্গলে আবাসস্থল বানাবে। আর জোর টক্করও শুরু হবে। তাই ফায়দা নিতে গেলেই এখন থেকেই সঙ্গে থাকতে হবে। আগামী মাসেই তোমরা মঙ্গলে সিফট করছ।
—ওকে বাবা।
সেই থেকেই মঙ্গলেই ওরা। প্রধান আসেননি—কিন্তু যাবতীয় গুটি পৃথিবী থেকে প্রধানই সাজিয়ে দেন। এমনকি চেম্বারলিনও মাঝে মাঝে প্রধানের শরণাপন্ন হন। আজ চেম্বারলিনের সঙ্গে যশনের একটি মিটিং আছে—সেই ব্যাপারেই তার প্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করা খুব জরুরি।
১০
—স্যার খবরটা শুনেছেন?
—কোন ব্যাপারে উজ্জ্বল?
—রাজস্থানের দাঙ্গা নিয়ে।
—না তো। কী ব্যাপার বল তো…
—স্যার, মূলত জলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাধে। একদল জলকে নিজেদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে রাখে। অন্যরা তিন-চারদিন জল না পেয়ে হামলা করে। কিন্তু যারা জলকে কেন্দ্রীভূত করে রাখে তারা কী সাধারণ ব্যক্তি? সব মাফিয়া—জল মাফিয়া। যারা হামলা করতে যায় তারাই বেঘোরে প্রাণ দেয়। একদিকে যেমন তাদের পরিবার জল না পেয়ে প্রাণ দিচ্ছে, অন্যদিকে তারা জল সংগ্রহে গিয়ে প্রাণ দিল। সাতদিন ধরে সংঘর্ষে বহু লোক হতাহত। সরকার প্রথমে কোনো স্টেপ নেয়নি।
—তাই, কেন স্টেপ নেয়নি?
—আমার মনে হয়, সরকারও চাইছে লোকজনের সংখ্যা কমাতে। জন বিস্ফোরণ সরকার স্বীকার করুক আর না করুক, সেটা ঘটে গেছে। তাই স্টেপ না নিয়ে, সংঘর্ষের ইন্ধন জুগিয়ে লোক সংখ্যা কমাচ্ছে।
—এমন যদি হয় তাহলে খুব তো নৃশংস ব্যাপার হে!
—একবারেই স্যার, খুবই নিন্দনীয়। কোরাপটেড লোকজন দেশটাকে চুষে সবাই শেষ করে দিল। টাকা জমাচ্ছে আর মঙ্গলে জমি কিনছে। আমাদের নেতা, মন্ত্রী, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও আরও অনেকে মঙ্গলে ইতিমধ্যে সিফট হয়ে গেছে। খুব যাদের বিবেকবোধ তারা, মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় আর গরীবরা আর কিছুদিন পরে এখানের বাসিন্দা আর কেউ থাকবে না।
—এমন অবস্থা!
—হ্যাঁ, তাহলে আর বলছি কী! পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপনার আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আপনি বললেও আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। এই আবিষ্কারে আপনার সঙ্গে আমাকে থাকতেই হবে।
—আমি আর তোমাকে এই ব্যাপারে বলব না। আমিও পজিটিভিস্ট হয়ে পড়েছি এবারে—সফল হবই। মৃত্যুর আগে অন্তত আমাকে এই পরীক্ষায় সফল হতেই হবে।
হাতে কফির কাপটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন শশাঙ্ক। তার বাড়ির সামনেই একটা ছোটো বারান্দা। তাঁর ঘরটাও খুবই ছোটো—দু’কামরার। সামনে হাত পাঁচেক জায়গায় কয়েকটি ফুলের গাছ। বারান্দার রেলিং বেয়ে কয়েকটি লতানো কুঞ্জলতা। নানা কায়দা করে তাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আর বাকিটা সবটাই মাটির তলায়। আঠারশো স্কোয়ারফিটের ল্যাব রয়েছে মাটির নীচে। যাবতীয় কাজ সেখানেই হয়। সেই ল্যাবের এককোণে প্রায় নশো স্কোয়ার ফিটে বিকৃত প্রাণীদের রাখা। উজ্জ্বল কাজে যোগ দেবার বহু পরে এই জায়গাটা সম্পর্কে জেনেছে। শশাঙ্ক বারান্দায় এসে একটা আরামকেদারায় বসলেন। পিছনে উজ্জ্বলও বেরিয়ে এসেছে। উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আকাশটা দেখছ?
—হ্যাঁ স্যার। ধোঁয়াটে আকাশ।
—হ্যাঁ, কিন্তু এমন ছিল না। আজ দীর্ঘদিন সূর্য উঠা দেখিনি। সারাক্ষণ ধোঁয়াশায় ভরে থাকে। অথচ আমাদের ছোটোবেলায় পূর্বকোণে লাল হয়ে সূর্য উঠত। পাখিরা ডেকে উঠত। নীল আকাশের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ক্লান্তি আসত না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফুটবল খেলতাম। আজ? সব স্মৃতি।
—আমি জীবনে এমন দেখিনি স্যার।
—আমরা যদি এই পরীক্ষায় সফল হয় তাহলে পরের মিশন হবে পৃথিবীকে স্বচ্ছ করার। আমি বেঁচে থাকি আর না থাকি, তুমি আমার এই স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেও।
—অবশ্যই স্যার—আমি আপনার কথা রাখব।
উজ্জ্বল দেখতে পেল স্যারের মোটা চশমার কাচের ভিতর স্বপ্ন দেখা রঙিন চোখদুটি।
১১
সু ইয়ান সভা ডেকেছেন। তার সভাপতিত্বে সভা শুরু হলে তিনি বললেন, তাহলে নির্বাচনের প্রধান রূপরেখা কী হবে, এই নিয়েই আজকের আলোচনা। মনে রাখতে হবে মঙ্গলের এই নির্বাচনে আমাদের জয়লাভটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট থেকে আরম্ভ করে মার্স ডেভলোপমেন্ট বোর্ডের অন্তত তিন চতুর্থাংশ আমাদের দলের থাকতেই হবে। এককথায় আগামীদিনে আমাদেরই হতে হবে মঙ্গলের ভবিষ্যৎ।
টেবিলের একপ্রান্তে বসে ছিলেন আব্দুল। টিকালো নাক, অল্প চুলের মানুষটা ভীষণ বুদ্ধি ধরেন। তিনি বললেন, একদম ঠিক বলেছেন, মিস্টার সু ইয়ান। আমাদের পদ্ধতিগতভাবে এগোতে হবে। একটু কান পাতলে রুলিং দলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আমরা শুনতে পাই, সেই অভিযোগগুলোকে একটু ইন্ধন আমাদের দিতেই হবে। এই ইন্ধনই লোকজনের অভিমুখ বদলাতে পারে।
সু ইয়ান আবার বললেন, মিস্টার আব্দুল এটা ভুলে যাবেন না—এখানে যারা বাস করেন তারা সবাই অভিজাত এবং শিক্ষিত শ্রেণির, তাদের কনভিন্সড করা অত সহজ ব্যাপার না। পৃথিবীর রাজনীতির সঙ্গে এখানের ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেললে হবে না। তবে হ্যাঁ দুর্বলতা তুলে ধরতেই হবে। রুলিং দলের সমস্ত দুর্বলতাগুলো সুচারুভাবে তুলে ধরতে হবে। এবং অবশ্যই তার যুক্তি সংগত ব্যাখ্যা দিতে হবে। এই ব্যাপারে আপনার কী মত মিস্টার যশন?
যশন সু ইয়ানের টেবিলের অন্য প্রান্তে ছিলেন। মাইকটা একটু বেঁকিয়ে মুখটা মাইকের কাছে এনে তিনি বললেন, হ্যাঁ, সু ইয়ান। আমি চিন্তাভাবনা করেছি অনেক—একটা সুচিন্তিত রূপরেখা ছাড়া এমন একটা দলের বিরুদ্ধাচারণ করা সম্ভব নয়। তাই সবার প্রথমে আমদের দরকার পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুসারে আমাদের এগোতে হবে। শুধু তাদের দোষ ধরলেই হবে না, আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও তাদের সামনে তুলে ধরাও জরুরি। চেম্বারলিন, আপনি কী বলেন?
চেম্বারলিন হলেন এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি অনেক খেটে দলটিকে আজকের জায়গাতে দাঁড় করিয়েছেন। সু ইয়ান থেকে যশন পর্যন্ত সবাইকে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে এক ছাদের নীচে এনেছেন। তিনি বলতে শুরু করলেন, হ্যাঁ, কথাটা তো ঠিকই। একটা পরিকল্পনা আমাদের থাকতেই হবে। একটা কথা বলতে গেলেই যুক্তি এবং পরোক্ষ যুক্তি ভেবে রাখতে হবে। না হলে ওপেন ডিবেটগুলোতে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে, যুক্তিতে যদি আমরা জিততে পারি নির্বাচনেও আমরা জিতব। খুব সূক্ষভাবে চলতি সরকারের ত্রুটিগুলি জনমানসে তুলে ধরতে হবে। প্রত্যেক সদস্যকে অন্তত তিনটে করে ওপেন ডিবেটে অংশ নিতে হবে, সেইমত আপনারা প্রস্তুত হন। সেখানে শুধু আপনার বিপক্ষ দলের নেতারা থাকবেন তাই নয়, শিক্ষিত সচেতন নাগরিকরাও থাকবেন। তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা মিলে গেলে ভোটে আমরা অনেকটাই এগিয়ে থাকব।
যশন চেম্বারলিনের পরেই আবার বলতে শুরু করলেন, একদম ঠিক কথা বলেছেন মিস্টার চেম্বারলিন। আমারও সেই মত। ডোমেনগুলোর ব্যাপারেও কথাবার্তা বলতে হবে। হয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যে প্রাণগুলি গেছে সেটিও যেমন তুলে ধরতে হবে তেমনই আমরা ক্ষমতায় এলে ওই ধরনের বিপর্যয় যে আসতে দেওয়া হবে না, তাও সুনিশ্চিত করতে হবে। এ মনে রাখতে হবে মৃত্যুর সংখ্যাটা যতই কম হোক—ফেলে দেওয়ার নয়, মৃত্যু মৃত্যুই। আমার শ্বশুরমশাই মিস্টার প্রধান যে বছর ক্ষমতায় এলেন সেটা মাত্র একটা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেন একটা মৃত্যুও একটা সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর এখানে তো কার্যনির্বাহ কমিটি…
চেম্বারলিন যশনের পুরো কথাটি শেষ করার আগেই বলতে আরম্ভ করলেন, ঠিকই বলেছেন মিস্টার যশন। আগামী তিনদিনের মধ্যেই তাহলে নির্বাচনী প্রচার শুরু হচ্ছে। আপনি এখনও পর্যন্ত কোন কথা বলেননি মিস রোজালিন। আপনার কী অভিমত?
রোজালিন এবারে কথা বললেন, আমি শুনেছি সব কথায় মিস্টার চেম্বারলিন এবং আমি আমার ল্যাপটপে সমস্ত বিষয়ের উপর একটা সারসংক্ষেপ করে নিয়েছি। সেই সঙ্গে মঙ্গলের প্রদেশভিত্তিক কে কোথায় ডিবেটে অংশ নেবেন এবং প্রচারের দায়িত্ব সামলাবেন তারও একটা ছক তৈরি করেছি। আপনি যদি চান পর্দায় আমি দেখাতে পারি। দেরি করে লাভ নেই—নেমেছি যখন আদা জল খেয়ে নেমে পড়াই ভালো। এক্ষুনি সবাই আছেন পরিমার্জনও হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে।
সবাই একসুরে সুর মেলালেন, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক কথা।
রোজালিনের ল্যাপটপে তৈরি হওয়া দায়িত্বগুলি সামনে থাকা বিশাল স্ক্রিনে ফুটে উঠতে থাকল। বেশ ডিটেলিং এর সঙ্গে রোজালিন কাজটি করেছেন। আপত্তির কোনো অংশ আছে বলে কারও মনে হল না। চেম্বারলিন আবার বলতে শুরু করলেন, তাহলে এটাই ফাইনাল। কী বলেন সব?
সবাই সমস্বরে হ্যাঁ বলতেই সু ইয়ান মিটিঙের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
১২
প্রধান তাঁর প্রধান কার্যালয়ে বসেছিলেন, সেখানে সুবীর পৌঁছাতেই জিজ্ঞাসা করলেন, আজকের আপডেট?
সুবীর বলল, স্যার সব মোটামুটি কন্ট্রোলে। দাঙ্গা দমন এবং মৃতদেহগুলিকে সব বিনষ্ট করা হয়েছে।
প্রধান আবার বললেন, আর কিছু?
সুবীর আবার শুরু করল, জল না পাওয়া গোষ্ঠীর লোককে জল দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উগ্রপন্থী কিছু লোককে গ্রেপ্তারও করতে হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি খুব কনফিউজড।
মুখটা ট্যাবের থেকে তুলে প্রধান বললেন, কী ব্যাপার?
সুবীর উত্তর দিল, স্যার যে জল ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে মোটামুটি সাতদিন এক লিটার করে জল মাথাপিছু দেওয়া যাবে। তারপর? আমাদের সামুদ্রিক জলের যে ফিল্টারেশন পাম্পটা ছিল, সেটা আর একবারেই কাজ করছে না। দশ বছরের পুরোনো পাম্প—একবারও সার্ভিসিং হয়নি, কী করে চলবে? ওটা ঠিক না হলে সাতটি অঞ্চলে আবার জল সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন?
প্রধানের ফোনটা বেজে উঠল। সেটা ধরতেই প্রধান বলে উঠলেন, বল মা, কোথায় তোরা? তারপর মিনিট পাঁচেক ধরে এটা ওটা বলে প্রধান বলল, ঘরে ফিরে কিন্তু স্নানটা করে নিবি। এরপর ফোনটা রেখে দিয়ে সুবীরের দিকে ঘুরে বললেন, এসে থেকে ওরা ঘুরেই যাচ্ছে, মনে হয় পৃথিবীতে ওরা ছিলই না। মঙ্গলে সিফট হওয়ার পরে এই প্রথম বার এল, তাই উৎফুল্লতা হয়তো একটু বেশিই। যশন তো ওখানেই রয়েছে। ওখানের নির্বাচনের প্রস্তুতিও খুব চলছে।
সুবীর বুঝতে পারল, প্রসঙ্গ ঘুরে গেল বা প্রধান ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পালটে দিলেন। তাই সুবীর বলল, আচ্ছা।
আবার প্রধান বলতে শুরু করলেন, মঙ্গলের রাজনীতিতে যশনের থাকাটা খুব জরুরি। তোমাকে বলেছিলাম মঙ্গলে আবাসের ব্যাপারে, কী মত?
না স্যার সেভাবে তো চিন্তা করিনি—সুবীর খুব স্পষ্টই বলল।
প্রধান বললেন, তখত ই তাবুদ। ক্ষমতা থাকার বিশেষত্ব ক্ষমতা না থাকলেই বোঝা যায়। সুযোগ আছে, কাজে লাগাও, সব সময় সুযোগ নাও পেতে পার।
মুখে হাসি রেখে সুবীর বলল, হ্যাঁ স্যার, মনে রাখব। কিন্তু সুবীরের মনে একটা ঘেন্না দলা পাকিয়ে উঠে আসতে থাকল। মানুষ জল পাচ্ছে না, আগামী দিনে সঙ্কট আরও বাড়বে। ফিল্টারেশন পাম্প খারাপ—এক লিটার জল কিনতে মানুষকে কয়েকশো টাকা খরচ করতে হচ্ছে, আর ঊনি মেয়েকে স্নান করাবেন। তবুও মুখে কিছু এল না। চুপচাপ থেকে বেরিয়ে আসবার সময় বলল, একটা কথা ছিল স্যার।
—হ্যাঁ বল।
—স্যার আমার কয়েকদিন ছুটি চাই।
—এখনি?
—হ্যাঁ স্যার। একটু রিফ্রেশ না হলে খুবই অসুবিধায় পড়ে যাব।
—ওকে, যাও। কতদিনের?
—স্যার, একমাস।
—অতদিন?
—হ্যাঁ, স্যার।
—আচ্ছা, তাই নাও। তবে ইচ্ছে করলে তাড়াতাড়ি জয়েন করে যেও। বুঝতেই পারছ, তোমার উপর আমি কতটা ডিপেন্ড করি।
—হ্যাঁ স্যার, মুখে বললেও মনে একটা খিস্তি দিল সে। তারপর ঝিলমিলকে ফোন করে বলল সে, আমি ছুটি নিয়েছি—তুমিও ব্যবস্থা কর। তারপর শুধু তুমি আর আমি।
১৩
উজ্জ্বল খুব উৎকণ্ঠার সঙ্গে শশাঙ্ককে ডাকল, স্যার…
শশাঙ্ক তখন চেতনার গভীরে। চারিদিকে কত হারিয়ে যাওয়া জিনিস, কত কিছু। হঠাৎ যেন তিনি শুনতে পেলেন একটা মৃদু ডাক, স্যার। তিনি উত্তর দিলেন, হু।
উজ্জ্বল আবার বলল, কেমন আছেন? যন্ত্রণা হচ্ছে? একটা পেনকিলার দিই?
শশাঙ্ক একটু পাশ ফিরে শুতেই গায়ের উপর থাকা ঢাকাটা নীচে পড়ে গেল। মুখটা সাদা আলোতে ঝলমল করে উঠল। উজ্জ্বল দেখল স্যারের গায়ের মেটে রংটা আর নেই—তার জায়গায় এক গাঢ়, চকচকে সবুজ বর্ণ। এক দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। চোখ বোজা অবস্থায় স্যার শুয়ে আছেন। আবার ডাকল, স্যার। এবার আর কোনো সাড়া নেই। কিন্তু বুকটা হাপরের মতো উঠছে আর নামছে। মুখের বলিরেখাগুলো বরাবর সব ফাটা ফাটা দাগ—ভিতরের লাল আভা। একটু হাত বাড়িয়ে সে মুখের উপর দিল। হাত দিতেই সে চমকে উঠল—এত শক্ত চামড়া! আর মাটি শুকিয়ে গেলে যেমন ফাটা দাগ হয় স্যারের গালটাতে ঠিক সেইরকমভাবেই ফেটেছে। সাদা ইঁদুরের উপর তারা প্রথম বায়োকেমিক্যালটা প্রয়োগ করেছিল। সেটা তারা একমাস ধরে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছিল, কেমিক্যালটি এবারে মানুষের উপরে প্রয়োগ সম্ভব। সে স্যারকে বলেছিল, স্যার একটা জার্নালে প্রকাশ হোক—তারপরে না হয় মানব শরীরে প্রয়োগ করবেন।
—না উজ্জ্বল, তা করলে হবে না। পুরোপুরিভাবে না সিওর হয়ে আমি তা করতে পারি না।
—কেন, স্যার?
—জীবনে অনেক লোকের হাসির পাত্র আমি হয়েছি আর হতে চাই না।
—স্যার, বিজ্ঞানে জয়-পরাজয় আছেই। সবাই কি সফলতা পান?
—তাহলেও… শেষ বয়সে আবার আমি নিতে পারব না।
—তাহলে স্যার কাউকে জোগাড় করি।
—তারও প্রয়োজন নেই।
—কেন?
—আমি চাই পরীক্ষাটি আমার উপরে প্রয়োগ হোক—তোমাকে তো আগেই বলেছি।
—স্যার…
—হ্যাঁ উজ্জ্বল, এটা আমার ডিসিশান।
—কিছু হয়ে গেলে?
—হবে, জন্ম মৃত্যু সব আপেক্ষিক। শ্রীমদ্ভগবত গীতাতে একটা শ্লোক আছে, জাতস্য হি ধ্রুবো, মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি। ব্যাপারটা কত সহজ দ্যাখ, জন্ম হলে মৃত্যু হবে আবার মৃত্যু হলে জন্ম হবে। কিন্তু আমরা অযথা জটিল করে তুলি। মরলে অসুবিধা নেই বাকিটা তুমি এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আর কথা শোনেননি স্যার। প্রয়োগ হল। কিন্তু ইঁদুরের মতো কাজ দিল না। ইঁদুরের দেহে কোনো শক্তভাব ছিল না। দেহের রং পরিবর্তন থেকে শুরু করে ক্লোরোফিল উৎপন্ন সহ সবকিছু হয়েছে স্বাভাবিকভাবে। সবুজ রঙের ইঁদুরটা চোখের সামনেই ঘুরে ফিরে বেড়ায়। সেই হিসাবেই তারা খুব সিওর ছিল মানব শরীরেও এটা ঠিকঠাক থাকবে। কিন্তু…
স্যারের আজ পঁচিশ দিন ভালো করে জ্ঞান নেই। প্রত্যেকদিন উজ্জ্বল পর্যবেক্ষণ করেছে। একটু একটু পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের কোনো স্থিরতা নেই—কখন আসে কখন যায়। আর জ্ঞান এলে যন্ত্রণাদায়ক শব্দ ছাড়া স্যারের মুখ দিয়ে অন্য কিছু উচ্চারিত হয় না। নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হয় উজ্জ্বলের। এখন তার মনে হয় স্যারকে আটকানো উচিৎ ছিল তার।
বেশ ক’দিনের ক্লান্তিতে ঘুম এসে ধরেছিল। একটা ডাকে সে উঠে পড়ল, উজ্জ্বল, উজ্জ্বল…
চোখটাকে ভালো করে কচলিয়ে সে দেখল—সত্যিই বটে, স্বপ্ন নয়। তাড়াতাড়ি উঠে সে বলল, স্যার আপনি! ঠিক আছেন? আমি তো চিন্তায় ছিলাম।
—হ্যাঁ ঠিক আছি। চল কিছু কথা বলি।
নিজের চোখকে যেন কিছতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার—যে মানুষটার ঘণ্টা পাঁচেক আগেও কোনো চেতনা ছিল না, সে একদম… মনে মনে বলে নিল, যাক বাবা ভালো হয়েছে।
ঘরে ঢুকতেই জামাটা খুলে স্যার দেখাল তার শরীরটা। মনে হচ্ছে সারা শরীরে সবুজ প্রলেপ দেওয়া ছিল, সেগুলো ছেড়ে ছেড়ে পড়ছে। আর ভিতর থেকে লাল রক্ত, কেমন যেন স্তরে স্তরে জমাট বাঁধা। এক বীভৎস রূপ সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে শশাঙ্কের। তিনি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বুঝলে?
—স্যার কী হবে? আমরা কি আবার ব্যর্থ?
—না, পুরোপুরি কেন ব্যর্থ? সবুজ ইঁদুরটাকে দেখিয়ে আবার শশাঙ্ক বললনে, সফলতা শুধু একটা দিয়ে কেন বিচার করছ? তবে একটা অনুরোধ, শুধু আমার অবর্তমানে তুমি গবেষণাটা চালিয়ে যেও, থেমে থেকো না।
—স্যার…
—হ্যাঁ। আমি যা বললাম খেয়াল রেখ, থেমে যেও না।
মাথা নীচু করে উজ্জ্বল স্যারের পায়ে হাত দিল। শশাঙ্ক উজ্জ্বলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, জয়তু ভব।
১৪
—সত্যিই তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিলে?
—এছাড়া কি আর কোনো উপায় ছিল, ঝিলমিল?
—তবুও, আর একবার তো ভেবে দেখতে পারতে?
—না, আর ভাবার কিছু নেই। প্রতিনিয়ত বিবেক দংশন আমি আর সইতে পারছিলাম না। একদিকে লালসা আর একদিকে অসহায়তা—এর মাঝে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।
—আচ্ছা, এবারে কী করবে?
—কী আর করব? তোমার গান শুনব আর শুয়ে থাকব। একটা গান করো না- ওই গানটা, আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে…
—ধ্যাত।
ঝিলমিল উঠে পড়ল বিছানা থেকে। সুবীরের অলসতা আবার ঘিরে ধরল তার দেহটাকে—ক্লান্তি যেন কাটতেই চায় না। তার পরিকল্পনা যে অন্য। মাঝে মাঝে তার মনে হয় রাজনীতির পাঁক ঘাটতে ঘাটতে তার গা থেকেও গন্ধ বের হচ্ছে। পূর্বে নাকি গঙ্গাজলে স্নান করে শুদ্ধ হওয়া যেত। ইস, এখন যদি করা যেত তাহলে স্নান করে সে বলত, শুদ্ধ্যাতাং, শুদ্ধ্যাতাং, শুদ্ধ্যাতাং। তাই শুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। তবে সে গঙ্গা নদী এখন ইতিহাস—ফরাক্কার কাছে কিছুটা নোংরা জলের অস্তিত্ব আছে, বাকি সব জায়গায় মজে গেছে বালি আর নোংরাতে। সে আবার ঘুরে শুয়ে পড়ল। তবু ভালো লাগছে চিন্তা করতে। পাশের ঘরে ঠুংঠাং করে আওয়াজ হচ্ছে। মনে হয় ঝিলমিল কিছু বানাচ্ছে। আজকের দিনটা বেশ লাগছে। সুবীর দেখছে পুবকোণে লাল হয়ে ওঠা সূর্যোদয়। সে একটা ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে—বাচ্চা ছেলে। কার ছেলে? তার? বাৎসল্য প্রেম? সে কি তাহলে সন্তান চাই? ছেলেটি আধো আধো গলায় সে বলছে—পাখি সব করে রব, রাত্রি পোহাইল। একটা ঠান্ডা মনোরম বাতাস মৃদুমন্দভাবে বয়ে যাচ্ছিল। সে চিন্তা করতে পারল না পৃথিবীতে এমন পরিবেশ পেয়েছে কি না!
—এই ওঠ, ব্রেকফাস্ট রেডি।
সুবীর ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল। তাহলে সে স্বপ্ন দেখছিল। ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে সে বলল, দিলে তো চটকিয়ে, স্বপ্নটাকে!
—এই সকালে আর স্বপ্ন দেখে কাজ নেই, যাও উঠে পড়।
বিছানা থেকে নেমে জানলাটা খুলে ফেলল সে। কোথায় লাল-মেঘলা আকাশে সূর্য ঝাপসা করে উঠছে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকুক আর না থাকুক সূর্য এখন প্রতিদিন ঝাপসা করেই ওঠে।
—ঝিলমিল একটা কথা বলব?
—বল।
—আমরা কি একটা সন্তান নিতে পারি না?
ঝিলমিল একটু হেসে লাজুক মুখে কিছু না বলেই সরে গেল। সুবীর ভেবে নিল, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। সে ভাবতেই থাকল, সন্তান হওয়ার আগেই এই কাজটা করতে হবে। তার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতেই হবে। মানুষের কাজে লাগতে হবে—তবেই শুদ্ধ হওয়া যাবে। অনেক তো হল—আর কেন? চেতনা ফিরে আসুক মানুষের, সচেতন হোক তারা। পৃথিবীকে আবার বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। একটা প্রতিজ্ঞা সে করেই ফেলল, শুধু তাদের সন্তানই নয়—সমগ্র নবজাতকদের প্রতি হবে এ তার ‘দৃঢ় অঙ্গীকার’। বিপ্লবের আবেশে সকালবেলার খাবার সে গোগ্রাসে গিলতে থাকল। এতদিন সরকারের মধ্যে থেকে সে জানে কোথায় একটু টোকা দিলেই সরকার পড়ে যাবে! সে আবেগে একটু জোরেই বলতে থাকল, আমি বের হচ্ছি ঝিলমিল। আমার আবার সংগ্রাম শুরু হল। নতুন পৃথিবী গড়ার আহ্বান আমাকেই দিতে হবে—আন্দোলনের নেতৃত্ব আমিই দেব। বিচ্ছিন্ন আন্দোলনকে আমিই সংগঠিত করব। এই মানুষের সামান্যতম অধিকারও আমি ফিরিয়ে দেব—এইভাবে বসে বসে মানুষ মারা আমি আর দেখতে পারব না।
ঝিলমিল সুবীরের চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল—তার আর বলা হল না, সে তার সন্তানকে ইতিমধ্যেই গর্ভে ধারণ করেছে।
১৫
নির্বাচনের আগেই প্রধান মঙ্গলে চলে এসেছেন। ভারতে এখন চরম রাজনৈতিক টালমাটাল। গদি টলমল। কোনোভাবেই কোনো সরকারের পক্ষে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। শাসন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। চারিদিকে কেবল বিদ্রোহ। সুবীর আর জয়েন করেনি। প্রধান হাজার চেষ্টা করেও তাকে আর কাছে আনতে পারেনি। মেইল করেছে সে আর চাকরি করতে চায় না। বিক্ষিপ্ত অশান্তি এখানে সেখানে লেগেই আছে। আজকে এখানে তো কাল সেখানে—বিদ্রোহ এখন সর্বাত্মক। মানুষ গোরু-ছাগলের মতো মরে পড়ে থাকছে। খুন জখম হানাহানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
মঙ্গলের নির্বাচনে কোনোভাবেই সামনে আসছেন না প্রধান। তিনি জানেন, তাঁর বিষয়ে ভালোর চেয়ে খারাপের প্রাধান্য বেশি। তাঁর অনেক খারাপ দিক আছে। নির্বাচনের প্রচারে নামলেই সেগুলো সামনে আনবে বিপক্ষ দল। আর সেগুলো খুব সুবিধার হবে না। তাই তিনি অন্তরালে থেকে গুটি সাজাচ্ছেন। কিং নন, তিনি কিং মেকার হতে আগ্রহী বেশি। যশন কতবার বলেছে, আপনি সামনে আসুন।
প্রধান তাঁকে ভৎসনা করে বলেছেন, তুমি কী বোঝ, রাজনীতির?
একটু হকচকিয়ে গেলেও যশন এটা বোঝে তার রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা শ্বশুরের থেকে অনেকাংশে কম। তাই কলুর বলদ হয়েই জীবনটা কেটে যাবে মনে হচ্ছে। প্রধানের খেলার পুতুল হয়েই তাকে থাকতে হবে। তার চাকরি-বাকরি, বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকা শ্রেয় ছিল, কিন্তু প্রধান যখন শ্বশুর তখন সে গুড়ে বালি। তবে প্রধানের মেয়ে খুব খুশি। সে তার বাবাকে প্রায়ই বলছে, বাবা তুমি এখানে আছ, আমি খুব খুশি।
—আমিও রে সোনা।
—পৃথিবীতে আবার লোকে থাকে নাকি?
—হ্যাঁ, সেইজন্যেই তো চলে এলাম—তোর কাছে বেশিক্ষণ থাকা যাবে। আমি এবারে অবসর নেব। অনেক হল—এবারে ছুটি চাই।
—সত্যি বাবা?
মঙ্গলে থাকলেও পৃথিবীর সমস্ত খবর রাখছিলেন, প্রধান। তাঁর কাছে পাক্কা খবর ছিল, বিদ্রোহ দানা বাঁধছে—যে-কোনো দিন আছড়ে পড়ব। তাঁর গোপন এজেন্সি এই বিদ্রোহের নেতৃত্বের খবর দিতে পারছিল না। সমস্ত রকম সুযোগ ভোগ করতে করতে এরা একে একে সব অকেজো হয়ে গেছিল। প্রধানও বুঝতে পেরেছিলেন, শেষের দিন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই ভেবেচিন্তে একদিন ডেপুটিকে দায়িত্ব দিয়ে প্রধান বললেন, ক-দিন আমি একটু মেয়ের কাছ থেকে ঘুরে আসি—তুমি সামলাও। তারপরের দিনই তিনি মঙ্গলে রওনা দিয়েছিলেন। আবার সুদেষ্ণার কথায় সংবিৎ ফিরল তাঁর,
—বাবা তুমি এসেছ এতেই আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। আজ তোমাকে আর একটা খুশির খবর দেব।
—কী রে মা?
—আমার বেবি হবে।
একটা খুশির হাওয়া মনকে প্রফুল্ল করে দিল। তিনি আনন্দে বাচ্চার মতো হাততালি দিয়ে বললেন, আমি তাহলে দাদু হতে চলেছি?
—হ্যাঁ বাবা।
ফোনটার কোনো সময় জ্ঞান নেই—যখন তখন বেজে ওঠে। এই ভালো সময়ে খারাপ খবর নিতে আগ্রহ থাকে না। তবুও ফোনটা তুলতেই হল, আর ওপার থেকে ডেপুটি উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে উঠল, স্যার ওরা বিদ্রোহ শুরু করেছে, যে-কোনো সময়ে আমাদের প্রশাসনিক ভবন আক্রমণ করে বসবে। এত সংগঠন ওরা কীভাবে করল, স্যার?
—সেফ থাক, বিদ্রোহ করতে দাও। সেফ জায়গায় চলে যাও। যে ক্ষমতা নিতে চাই, দিয়ে দাও। আমি এখান থেকে বিবৃতি দিয়ে দিচ্ছি।
—স্যার এভাবে ছেড়ে দেব?
—হ্যাঁ, এছাড়া কোনো উপায় আছে?
—গুলি চালিয়ে দমন করি?
—কাকে নিয়ে গুলি চালাবে? সেও তোমার পক্ষে নেই। পালাও যদি বাঁচতে চাও- রোষের মুখে পড় না। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার পদত্যাগ ঘোষণা করছি। তুমি তারপরে করবে।
—আচ্ছা স্যার তাই হবে। স্যার আর একটা কথা…
—কী কথা?
—আপনি জানেন, বিদ্রোহের নেতা কে?
—কে?
নামটা শুনে এত বছরের রাজনীতি জীবনে এই প্রথমবার প্রধান এত আঘাত পেলেন। ছেলেটার প্রতি তাঁর বরাবরই একটা সফট কর্নার ছিল। তিনি ছেলেটাকে মঙ্গলেও নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। যশনের থেকেও সুবীরের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব বেশি ছিল। সুবীরকেই তাঁর যোগ্যতম শিষ্য ভাবতেন। আর সেই… আঘাত সামলে তিনি মনে মনে এক বিখ্যাত উক্তি আওড়ে নিলেন, ব্রুটাস, ইউ ট্যু!
সব কিছুই আসলে পরিকল্পনা মাফিক হয় না। সাজানো বাগানের শেষকালে এমন হাল হবে, প্রধান বোঝেননি। পাপ বাপকে ছাড়ে না। অথচ মাত্র ক-দিন আগেও কী আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর—এখন সমস্তটা ভেঙে পড়ছে। শেষ আঘাতটা এসেছে মঙ্গলে। মঙ্গলের আঘাত তাঁকে অন্তর্লিন করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন রাজনীতি করে আসা মানুষটা আজ নিঃস্ব, রিক্ত। গরীব, সাধারণ মানুষ নিয়ে রাজনীতি করে আসা প্রধান গুলিয়ে ফেলেছিলেন, পুরোনো স্ট্রাটেজির সঙ্গে। চেম্বারলিনের দলও তাতে আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলের বসবাসকারী সম্প্রদায় যে প্যাটারসনের দলের প্রতি আস্থা দেখিয়ে চেম্বারলিনকে এভাবে ধরাশায়ী করবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। তবে এর জন্য তাঁর জামাই যশন অনেকটা দায়ী। শেষ মুহূর্তে যদি না স্ক্যান্ড্রেলটা না বের হত, আঞ্জেলিনার সঙ্গে সম্পর্কটা না করলেই কি চলছিল না! আর প্যাটারসনের দল তো ওঁত পেতেই ছিল। একটা ভুলই যথেষ্ট। ওদিকে সুবীর—এত ভরসার একটা ছেলে, সেও। হ্যাঁ তাঁর শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, সমস্ত দেশটা এখন বিদ্রোহীদের কবলে। সুবীর দায়িত্ব নিয়েই নতুন করে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। সাধারণ মানুষরাও আশ্বাস পেয়েছে, তারাও সামিল হয়েছে মহাযজ্ঞে।
—বাবা…
মেয়ের ডাকে সংবিৎ ফিরল তাঁর। মেয়েটার দিকে তাকাতেও কেমন লাগে, এই সময় কোথায় আনন্দে থাকবে তা না তার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। তিনি সাড়া দিলেন, বল মা।
—বের হবে না?
—কোথায়?
—চেম্বারে? আজকেই তো…
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত প্রধান ভুলেই গেছিলেন আজ মেয়ের হাসপাতালে যাবার দিন। নতুন জন আজকে আসবে।
—হ্যাঁ রে মা, একটু দাঁড়া রেডি হয়ে নি। যশনকে খবর দিবি না?
—কী হবে, ওকে খবর দিয়ে?
—অভিমান বড়ো খারাপ জিনিসরে মা! ভুল করেছে ক্ষমা করে দে—দ্যাখ শান্তি পাবি।
—না বাবা, ভুলের ক্ষমা হলেও ঠগকে ক্ষমা করা যায় না।
—আচ্ছা, তোর জীবন—তোর ডিশিসান। আমি রেডি হয়ে নিই, একটু দাঁড়া।
অভিমান বড়ো সাঙ্ঘাতিক জিনিস। সামান্য আঘাতেও প্রিয় মানুষও সহসা দূরে চলে যায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে পেন শুরু হয়েছে সুদেষ্ণার। তাড়াতাড়ি করে হাসাপাতালের লোকেরা তাকে নিয়ে গেল ওটিতে।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওটি থেকে কেউ বের হচ্ছে না। উৎকণ্ঠাতে প্রধান করিডরে পা চালি করছেন। যশনও এসে পৌঁছেয়েছে। প্রধানই খবর দিয়েছিল। সে বার বার বলছে, মাফ করে দিন। মনটা দিন দিন দূর্বল হয়ে পড়ছে প্রধানের। আগের দিন হলে এখুনি গুলি করে দিত তাকে। কিন্তু সেদিন আর নেই—রক্তের তেজ কমেছে। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছে যশনের দিকে। অবশেষে এক ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললেন, ভালো খবর—নাতি হয়েছে আপনার।
মনটা নেচে উঠল প্রধানের। আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরল যশনকে। যশনও আনন্দে বলল, আর এমন ভুল করব না।
কিন্তু ডাক্তার আবার বললেন, একটা মারাত্মক খারাপ খবরও আছে।
—কী?
—বেবির মা…
সবকিছু শেষ। ক্ষমা হি পরম ধর্ম নাতিকে যশনের কোলে তুলে দিয়ে বললেন, দায়িত্ব নাও। আর ফোনটা নিয়ে ডায়াল করতেই ওপার থেকে আওয়াজ এল, হ্যালো…
—কনগ্র্যাচুলেশন সুবীর। একটা কথা আছে সংস্কৃতে জানো?
—কী?
—সর্বত্র জয়মিচ্ছুন্তি, পুত্রাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ম।
—অর্থাৎ?
—পুত্র আর শিষ্যের কাছে পরাজয়ই কাম্য।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, বামাচরণ ভট্টাচার্য