দ্বিতীয় বৈচিত্র্য
লেখক: মূল রচনা: ফিলিপ কে. ডিক, অনুবাদ: রুদ্র দেব বর্মন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
শুরুর দিকের নখরচক্রগুলো খুব একটা কিছু কাজের ছিল না—শুধু গড়িয়ে গড়িয়ে চলা ঘিনঘিনে আর কদাকার ছোটো ছোটো যান্ত্রিক মৃত্যুদূত। পরের দিকে যখন সৃষ্টি নিজেই শুরু করল স্রষ্টার অনুকরণ করতে, তখনই শুধু একবার মানব জাতির সামনে এসে গিয়েছিল শান্তি স্থাপনের সেই পরম সুযোগ—হায়! শুধু যদি সে তখন সেটাকে কাজে লাগাতে পারত!
টিলাটার ও-পাশের অসমান পাথুরে ঢাল বেয়ে আমেরিকান সৈন্যটি উদ্বিগ্নভাবে উঠে আসছে। তার হাতের বন্দুক উদ্যত। তার মুখ শুকনো, জিব দিয়ে ঠোঁট চাটছে আর তাকাচ্ছে চারদিকে। চলাফেরায় একটা ত্রস্ত ভাব। চলতে চলতে মাঝে মধ্যেই গ্লাভস পরা হাত দিয়ে ঘাড়ের উপর গড়িয়ে নেমে আসা ঘাম মুছে নিচ্ছে। কোটের কলার টেনেটুনে ঠিক করে নিচ্ছে।
আহমেদ ঘুরে তাকায় লেফটেন্যান্ট লাখন সিং-এর দিকে। “তুম্ পাকড়োগে? না ম্যাঁয় পাকড়ু?” সে ভিউ সাইটের অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে শুরু করে। এখন তার ভিউ সাইটের কাচের পুরোটা জুড়েই আমেরিকানটার শরীর। লক্ষ্য স্থির করার যোগ চিহ্নের মতো দাগ দুটোর ছেদ বিন্দুটা তার শক্তপোক্ত অথচ মলিন আর বিষণ্ণ শরীরটাকে ছুঁয়ে ফেলেছে।
লাখন ভেবে নিচ্ছিল। আমেরিকানটা এখন অনেকটা কাছে চলে এসেছে। খুব তাড়াহুড়ো করে হাঁটছে। প্রায় দৌঁড়োচ্ছেই বলা যায়। “ফায়ার মত করো। থোড়া আউর দেখতে হ্যায়।” লাখন যেন চিন্তায় পড়ে গেছে। “মেরে কো নেহি লাগতা হ্যাঁয় কি হমে কুছ ভি করনা পড়েগা।”
আমেরিকানটা তার চলার গতি ততক্ষণে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বুটের ধাক্কায় ছিটকে উঠছে ছাই আর মাটির ওপরের জমা রাবিশের টুকরো। একটু পরে টিলাটার মাথায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হাঁফাচ্ছে। তাকাচ্ছে চারদিকে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ধূসর রঙের ধূলিকণা ভরতি মেঘের দল ভেসে চলেছে। এখানে ওখানে শুধু কিছু পত্রবিহীন গাছের গুড়ি আকাশের দিকে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। টিলার মাথাটা সমতল আর ফাঁকা। চারপাশে ইট কাঠ কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিবর্ণ হলদেটে হয়ে ওঠা কিছু ভাঙাচোরা বাড়ির পরিত্যক্ত কঙ্কাল।
আমেরিকান সৈনটি অস্বস্তি বোধ করে। সে বোধহয় বুঝতে পারছে কোথাও কিছু একটা গড়বড় আছে। তবু সে এবার টিলার এদিকে নামতে শুরু করে দেয়। এখন সে তাদের বাঙ্কার থেকে আর সামান্যই কিছুটা দূরে। আহমেদ অস্থির হয়ে পড়েছে। হাতের পিস্তলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সে লাখনের দিকে তাকিয়ে আছে।
“চিন্তা মত করো,” লাখন ভরসা দেয়। “শালে, এহা তক্ কিসিভি হালত মে নেহি পৌঁছেগা। উসকি দেখভাল ওহি লোগ করেঙ্গে।”
“ক্যায়া তুমকো একিন হ্যাঁয়? সালে আভিভি বহুত দূর হ্যায়।”
“আবে, ওহ সব তো বংকর কে করীব হি ঘুমতে রহতে হ্যাঁয়। আভি উস্কে বুরে ওয়ক্ত আনে হি বালে হ্যাঁয়। তৈয়ার হো জাও!”
আমেরিকানটা এবার তাড়াহুড়ো করার জনো টিলার ঢালটা ব্যবহার করে সড়সড়িয়ে পিছলে নামতে শুরু করল। ঢালের উপরে জমে থাকা ধূসর ছাইয়ের গাদায় তার পায়ের বুট পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে। চেষ্টা করছে হাতের বন্দুকটা উপরে তুলে রাখতে। এক মুহূর্তের জন্য একবার দাঁড়াল। ফিল্ডগ্লাসটা তুলে ধরল চোখের সামনে।
আহমেদ বলল, “শালা, আমাদের দিকেই তাকাচ্ছে।”
আমেরিকানটা আরও কাছে এসে পড়েছে। এতটাই কাছে যে তার চোখ দুটোও এখন এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেন দুটো নীল রঙের মার্বেল। মুখটা অল্প হাঁ হয়ে আছে। গালময় খড়খড়ে দাড়ি গজিয়ে আছে। বেশ ক’দিন কামায়নি মনে হচ্ছে। একদিকে চোয়ালের উঁচু হয়ে ওঠা হনুর ওপরে একটা চৌকো টেপ লাগানো। ধারগুলো নীলচে হয়ে গিয়েছে। ছত্রাক গজিয়ে গিয়েছে। গায়ের কোটটা ছেঁড়া আর ধুলোয় ধূসর। দৌড়ে আসছে বলেই বোধহয় বেল্টের লেজটা ক্রমাগত উপর-নীচ লাফিয়ে যাচ্ছে।
লাখন সিং আহমেদের কনুইয়ের পাশটা ধরে টান দেয়। “ওই যে একটা আসছে।”
বিস্তৃত মাঠের উপর দিয়ে ধাতব পিচ্চি মতো কিছু একটা আসছে। দুপুরের এই ঝিমোনো রোদ্দুরেও সেটা থেকে আলো ঝলসে উঠেছে। একটা ধাতব গোলক। গোলকটা তীব্র গতিতে টিলার ঢাল বরাবর আমেরিকানটার দিকে ছুটে যাচ্ছে। চাকার ঘূর্ণন এত দ্রুত যেন প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটা সেই ছোটোগুলোর একটা। বাঁকানো নখগুলো ইতিমধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে। ঠিক যেন দুটো বাঁকানো ক্ষুর। তীব্র গতিতে চক্রাকারে পাক খাচ্ছে। গতির তীব্রতায় নখগুলো আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা অস্পষ্ট সাদাটে স্টিলের চক্র। আমেরিকানটা শুনতে পেয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে গিয়ে গুলি চালিয়ে দিল। গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল গোলকটা। কিন্তু ততক্ষণে দ্বিতীয় আরেকটা বেরিয়ে এসে আমেরিকানটাকে ধাওয়া করা শুরু করে দিয়েছে। আমেরিকানটা আবার গুলি চালাল।
তৃতীয় একটা গোলক লাফিয়ে উঠল আমেরিকানটার পায়ের উপরে। কচাং কচাং। চক্রাকারে তীব্র গতিতে ঘুরে চলেছে ধারালো ক্ষুরের মতো ইস্পাতের বাঁকানো পাত দুটো। ঘুরন্ত চক্র উঠে গেল আমেরিকানের শরীর বেয়ে। ধারালো ইস্পাতের ক্ষুর গেঁথে গেল তার গলার ভেতরে।
আহমেদ যেন হাঁফ ছাড়ল। “ওঃ হো, কী ভয়ানক জিনিস। খোদা কসম, ওই বেঘেন্না জিনিসগুলো দেখলেই আমার হাত-পা সব অবশ হয়ে যায়। কখনও কখনও তো মনে হয় যে আমরা আগেই ভালো ছিলাম।”
“ওগুলো যদি আমরা না বানাতাম, তো ওরা বানিয়ে ফেলত।” লাখন একটা সিগারেট ধরায়। হাত কাঁপছে তার। “কিন্তু আমি ভাবছি আমেরিকানটা একা একা এতদূর কেন আসতে গেল! কাউকে তো পেছন থেকে ওকে কভার করতেও দেখলাম না!”
এই সময়ে টানেল বেয়ে বাঙ্কারে এসে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন শেন জিনলং। “কী হয়েছে? স্ক্রিনে মনে হল কেউ আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে?”
“একটা ইয়াঙ্কি।”
“শুধু একজন? একা?”
আহমেদ ভিউস্ক্রিনটা ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে আসে। জিনলং স্ক্রিনে ঝুঁকে পড়েন। এখন সেখানে অসংখ্য ধাতব গোলোক উপুড় হয়ে পড়ে থাকা আমেরিকানের শরীরের উপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনুভূতিহীন ধাতব গোলকগুলোর ঘূর্ণায়মান চক্র ঘুরছে আর কচাং কচাং করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ছোটো ছোটো টুকরোয় কেটে ফেলছে।
জিনলং দেখতে দেখতে বিড়বিড় করেন, “বাপরে, এ তো গাদা গুচ্ছের চক্র গিজগিজ করছে।”
“এগুলো যেন মাছির মতো ভনভনিয়ে ভিড় করে চলে আসে। আর বেশিক্ষণের খেলা বাকি নেই। শেষ করেই ফেলেছে প্রায়।”
জিনলং বিতৃষ্ণায় চোখ সরিয়ে নিলেন। “সত্যি মাছির মতোই ভনভন করছে। আমি ভাবছি লোকটা আদৌ এখানে এল কী করতে। ওরা তো জানে যে আমাদের নখরচক্র এখানে চারদিকে ছড়িয়ে আছে।”
ওদিকে একটা বড়ো মতো রোবট এখন ছোটো গোলোকগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এই-ই এখন পুরো কাজকর্ম পরিচালনা করছে। এর চোখগুলো আবার সামনের দিকে বেরিয়ে আছে। একটা লম্বা ভোঁতা ধরনের নলের ডগায়। সৈন্যটার শরীরের আর বেশি কিছু বাকি নেই। ইতিমধ্যেই কাটা টুকরোগুলো সব নখরচক্রের দল টিলার ঢাল বেয়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
লাখন বলে ওঠে, “স্যার, যদি বলেন তো আমি একবার ওখানে গিয়ে লোকটাকে দেখে আসি।”
“কেন?”
“এমনই। হয়তো সঙ্গে করে কিছু নিয়ে এসেছিল।”
জিনলং ভেবে দেখেন প্রস্তাবটা। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে অবজ্ঞার সুরে বলেন, “ঠিক আছে। কিন্তু খুব সাবধানে।”
“আমার কাছে ট্যাব আছে।” লাখন হাতের কবজির ধাতুর পট্টিতে চাপ দেয়। “আমি ওগুলোর আওতার বাইরেই থাকব।”
রাইফেলটা তুলে নেয় লাখন। তারপর কংক্রিটের চাঁই আর ইস্পাতের কাঁটার ঝাড় এড়িয়ে এঁকেবেঁকে নীচু হয়ে সাবধানে পা বাড়ায় বাঙ্কারের মুখের দিকে। একটু উপরে উঠতেই বাতাসে একটা হিম হিম ভাব। ছাই ঢাকা জমির ওপর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে লাখন এগিয়ে যায় সৈন্যটার পড়ে থাকা দেহের অবশিষ্টাংশের দিকে। বাতাসের একটা দমকা ঝাপটা উড়ে এল তার দিকে। উড়িয়ে আনল সাদাটে ধূসর ছাইয়ের কণা। ছড়িয়ে দিল সারা শরীরে। মুখময় ছাইয়ের আস্তরণ। চোখ মুখ কুঁচকে বাতাসের দমকা ঠেলে এগিয়ে চলল লাখন।
কাছাকাছি পৌঁছতেই নখরচক্রগুলো খানিকটা পিছিয়ে গেল। কয়েকটা আবার সেখানেই পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লাখন ট্যাবটা ছুঁয়ে থাকে। ইয়াঙ্কিটা এরকম জিনিস একটা পেলে বর্তে যেত! ট্যাব থেকে নির্গত হচ্ছে কোমল কঠিন বিকিরণ। অসাড় করে দিয়েছে নখরচক্রগুলোকে। এমনকি দুটো প্রসারিত দোদুল্যমান অক্ষিপুঞ্জসহ বড়ো রোবটটাও লাখনকে দেখতে পেয়েই সম্মান দেখিয়ে পিছিয়ে গেল।
ইয়াঙ্কি সৈন্যটার দেহের অবশিষ্টাংশের উপরে ঝুঁকে পড়ে দেখছিল লাখন। সৈন্যটার গ্লাভস পরা একটা হাত মুঠো বন্ধ অবস্থায় শক্ত হয়ে পড়ে আছে। কিছু একটা আছে মুঠোর ভেতরে। লাখন গ্লাভস পরা আঙুলগুলো ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করে। একটা সিল করা অ্যালুমিনিয়ামের ডিবে। এখনও চকচকে করছে।
মুঠো থেকে ডিবেটা টেনে বের করে আনে লাখন। পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটতে শুরু করে দেয় বাঙ্কারের উদ্দেশে। পেছন ঘুরতেই নখরচক্রের দল জীবন ফিরে পায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাকি থাকা কাজ শেষ করার জন্য। বোঝা উঠিয়ে আবার মিছিল করে ধূসর ছাইয়ের মধ্যে দিয়ে ধাতব গোলকগুলো চলতে শুরু করে দেয়। লাখনের কানে আসে তাদের চলার সড়সড় শব্দ। সেই শব্দে তার সারা শরীর যেন শিরশির করে উঠতে থাকে।
জিনলং তীক্ষ্ণ নজরে লক্ করছিলেন এতক্ষণ। লাখন ডিবেটা পকেট থেকে বের করতেই বলে উঠলেন, “এটা ছিল লোকটার কাছে?”
“হাঁ, জি। মুঠ্ঠিকে অন্দর,” লাখন অ্যালুমিনিয়ামের ডিবেটার ঢাকনা প্যাঁচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ফেলে। ঢাকনা খোলা ডিবেটা এগিয়ে দেয় জিনলং-এর দিকে। “স্যার, মনে হয় এটা আপনার দেখা দরকার।”
জিনলং ডিবেটা হাতে নেন। নলাকার অ্যালুমিনিয়ামের ডিবে। খোলা মুখটা হাতের তালুতে উলটে দিতেই জিনিসটা বেরিয়ে আসে। সযত্নে ভাঁজ করা রেশম কাগজের ছোটো একটা টুকরো। আলোর সামনে বসে কাগজটার ভাঁজ খুলতে শুরু করলেন ক্যাপ্টেন শেন জিনলং।
আহমেদ দেখার চেষ্টা করে। “কী এটা, স্যার?”
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন অফিসার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এলেন। সামনেই মেজর সোনারাম হাঁসদা।
তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন জিনলং। “মেজর,” স্যালুট ঠুকে বললেন, “এটা দেখুন, স্যার।”
হাঁসদা হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলেন। একটা চিঠির মতো কিছু। চিঠিটা পড়লেন হাঁসদা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি এইমাত্র এল?”
“একজন বার্তাবাহক স্যার। একা এসেছিল। এইমাত্র, স্যার।”
“এখন কোথায় সে?” হাঁসদা কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“নখরচক্ররা লোকটাকে ধরে ফেলেছিল।”
মেজর হাঁসদা বিড়বিড় করে উঠলেন। “এই যে আপনারাও দেখুন।” কাগজের টুকরোটা সঙ্গীদের দিকে এগিয়ে ধরলেন। “আমি বলেছিলাম না যে এটাই হওয়ার আছে। যদিও একটু বেশিই অপেক্ষা করতে হল। ওরা ফালতু ফালতু এতগুলো দিন বরবাদ করল।”
“তার মানে ওরা এবার আলোচনা শুরু করতে চাইছে,” জিনলং বুঝে নিতে চাইছেন পুরো ব্যাপারটা। “আমরা কী আলোচনায় রাজি হচ্ছি?”
“সেটা ঠিক করার ক্ষমতা আমার হাতে নেই।” হাঁসদা অল্প কথায় শেষ করে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “কি, আমাদের কমিউনিকেশন অফিসার কোথায় গেলেন? মুন বেস-এর সঙ্গে আমাকে কথা বলান, জলদি।”
কমিউনিকেশন অফিসার যখন সাবধানে বাইরের অ্যান্টেনাটা উপরে ওঠাচ্ছিলেন লাখন তখন মনোযোগ দিয়ে স্ক্যানিং করছিল আকাশে কোনো আমেরিকান নজরদারি জাহাজ ওঁত পেতে বসে আছে কিনা।
জিনলং মেজর হাঁসদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, “স্যার, একটা ব্যাপার আমার খুব আশ্চর্য লাগছে। ওরা হঠাৎ করে এখন কেন আলোচনা চাইছে সেটা বুঝতে পারছি না। এই নখরচক্র তো আমরা গত প্রায় এক বছর ধরেই ব্যবহার করছি। এখন হঠাৎ করে ওদের এই গুটিয়ে যাওয়াটা কিন্তু রহস্যজনক।”
“হয়তো নখরচক্রগুলো এখন ওদের বাঙ্কারে ঢুকে পড়তে শুরু করে দিয়েছে।”
“দিয়েছে তো! বড়োগুলোর একটা, ওই লম্বা কাঠির ডগায় চোখওয়ালাগুলোর একটা তো গত সপ্তাহেই ইয়াঙ্কিগুলোর বাঙ্কারে ঢুকে পড়েছিল,” আহমেদ তড়িঘড়ি বলে ওঠে। “শুধু ঢোকেনি, ওরা ঢাকনা বন্ধ করার আগেই ওদের গোটা একটা প্লাটুনকে সাবড়ে দিয়েছিল।”
“তুমি কীভাবে জানলে?”
“আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল। ওটা তো ফিরেও এসেছিল—বেশ কিছু দেহাবশেষ নিয়ে।”
কমিউনিকেশন অফিসার এই সময় বলে উঠলেন, “স্যার, মুন বেস।”
স্ক্রিনে চন্দ্র ঘাঁটির যোগাযোগ অধিকর্তার মুখ ভেসে উঠেছে। তার উর্দি চকচকে এবং নিভাঁজ। এই বাঙ্কারে উপস্থিত মানুষগুলোর উর্দির সাপেক্ষে পুরোপুরি অন্য স্তরের। মানুষটা দাড়ি গোঁফ কামিয়ে একদম তকতকে এবং ঝকঝকে। সংক্ষিপ্ত বাক্যে সে তার অবস্থান জানান দেয়, “মুন বেস বলছি।”
“ফরোয়ার্ড কমান্ড এল-হুইসেল, পৃথিবী থেকে বলছি। জেনারেল দাসাংলু মোসাং-এর সঙ্গে কথা বলান।”
মনিটরটা একবার ম্লান হয়েই আবার ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এখন স্ক্রিনে জেনারেল দাসাংলু মোসাং-এর ভারী চেহারা ঝকঝক করছে। “কী ব্যাপার, মেজর?”
“আমাদের নখরচক্রগুলোর হাতে একটা ইয়াঙ্কি ধরা পড়েছে। ইয়াঙ্কিটা একাই এসেছিল। মনে হচ্ছে লোকটা ছিল বার্তাবাহক। যে খবরটা নিয়ে এসেছে সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা নিশ্চিত নই সেটার উপরে ঠিক কতটা ভরসা করা উচিত—আগেও ওরা এই ধরনের চালাকি করার চেষ্টা করেছিল।”
“তা সেই গুরুত্বপূর্ণ খবরটা কী?”
“আমেরিকানরা চায় যে আমাদের নীতি নির্ধারক স্তরের কোনো একজন অফিসারকে আমরা তাদের সীমানায় পাঠাই। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য। কিন্তু আলোচনা কী নিয়ে সেই বিষয়ে তারা কোনো কিছুই খোলসা করেনি। চিঠিতে যতটুকু যা লিখেছে—” তিনি হাতের কাগজটা একবার দেখে নিলেন। “—কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইউনাইটেড এশিয় বাহিনীর প্রতিনিধি আর তাদের মধ্যে এই মুহূর্তে একটা আলোচনা হওয়া অত্যন্ত জরুরি।”
কথা শেষ করে হাতের কাগজটা তিনি স্ক্রিনের সামনে তুলে ধরলেন যাতে জেনারেল স্বচক্ষে দেখে নিতে পারেন। জেনারেল মোসাং তীক্ষ্ণ নজরে কাগজটা দেখতে শুরু করলেন।
মেজর হাঁসদা জানতে চাইলেন, “আমাদের এখন কী করা উচিৎ?”
“একজন কাউকে পাঠিয়ে দিন।”
“আপনার কী কোনো সন্দেহ হচ্ছে না যে এটা একটা ফাঁদ হলেও হতে পারে?”
“হতেই পারে। কিন্তু ওদের সম্মুখ ঘাঁটির যে অবস্থান এখানে দিয়েছে সেটা একদম সঠিক। সেই জন্যই যে কোনো মূল্যে এটা আমাদের করা দরকার।”
“ঠিক আছে। আমি একজন অফিসারকে বাইরে পাঠাচ্ছি। তারপর সে ফিরে এলে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে কী হল না হল জানাচ্ছি।”
“ঠিক আছে, মেজর।” দাসাংলু মোসাং সংযোগ ছিন্ন করলেন। স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল। অ্যান্টেনা উপর থেকে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল।
মেজর হাঁসদা কাগজটা ভাঁজ করে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। লাখন হঠাৎ বলে ওঠে, “ম্যায় জাউঙ্গা।”
“কিন্তু ওরা তো নীতি নির্ধারক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কাউকে চাইছে,” চিবুকে হাত বোলাচ্ছেন মেজর হাঁসদা। এখনও যেন চিন্তামগ্ন। “নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো… আচ্ছা। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল আমি বাইরে যাইনি। তাহলে আমিই যাই—একটু বাইরের হাওয়া খেয়ে আসি।”
“আপনারা কী এর মধ্যে কোনো বিপদের ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছেন না?”
ইতিমধ্যে ভিউ সাইট-টা তুলে সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন হাঁসদা। আমেরিকানটার দেহাবশেষ সব উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দৃশ্যপটে একটাই নখরচক্র এইমাত্র নজরে এল। সেটাও এখন থাবার মধ্যে নখর গুটিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। একটু পরেই বিস্তৃত ছাইয়ের স্তরের মধ্যে কোথাও হারিয়ে গেল। ঠিক যেন একটা কাঁকড়া। দাঁড়াটাড়া গুটিয়ে মিশে গেল ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ আর ছাইয়ের গাদায়। ঠিক একটা ঘিনঘিনে ধাতব কাঁকড়া মতোই…
“সেটাই তো শুধু একমাত্র ব্যাপার যা নিয়ে আমি এখনও ভেবে যাচ্ছি।” ভিউ সাইটের মধ্যে বাইরের দৃশ্যপটে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কব্জিতে বাঁধা জিনিসটা ঘষতে ঘষতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলছিলেন, “আমি জানি যতক্ষণ আমার কাছে এটা আছে ততক্ষণ আমি নিরাপদ। কিন্তু ওগুলোর মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার আছে। ওই ঘিনঘিনে জঘন্য জিনিসগুলোকে আমার কখনোই সুবিধার বলে মনে হয় না। আমার সবসময়ই মনে হয় যে ওগুলো উদ্ভাবন না করলেই আমরা ভালো করতাম। ওদের মধ্যে কিছু একটা গড়বড় আছে। ওই ক্ষুদ্রকায় নিষ্ঠুর—”
“যদি আমরা ওগুলো উদ্ভাবন না করতাম, তবে ইয়াঙ্কিগুলো করত।”
হাঁসদা ভিউ সাইটটা পিছনে ঠেলে দিলেন। “সে যাই হোক, মনে হচ্ছে আমরা যুদ্ধটা জিততে চলেছি। যা মনে হচ্ছে এত কিছুর মধ্যে এটাই একমাত্র ভালো খবর।”
“মনে হচ্ছে আপনি যেন ইয়াঙ্কিগুলোর মতো ঠিক একই রকম ভয় পাচ্ছেন।”
হাঁসদা তার কব্জিতে বাঁধা হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলেন। “মনে হয় আমার এখনই বেরিয়ে পড়া উচিত। একমাত্র তাহলেই হয়তো অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে সেখানে পৌঁছতে পারব।”
বুক ভরে একটা গভীর লম্বা শ্বাস নিয়ে এবার বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পা রাখলেন বাইরের ধূসর ধ্বংসের দুনিয়ায়। মিনিট খানেক পরেই আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে নিজের চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন। আদিগন্ত বিস্তৃত গোটা ল্যান্ডস্কেপটাই যেন মরে গিয়েছে। কোথাও কোনো জীবনের লক্ষণ নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু ছাই আর স্ল্যাগ, আর ধ্বসে পড়া বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপ। দূরে দূরে শুধু গুটিকয়েক গাছপালার অবশিষ্টাংশ। নিস্পত্র এবং শাখাপ্রশাখাবিহীন গুঁড়িগুলো শুধু এখনও দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপরে ধরা আর সূর্যের মধ্যে ধূসর রঙের চিরন্তন ঘূর্ণায়মান মেঘের দল ভেসে আছে।
মেজর হাঁসদা এখন চলতে শুরু করে দিয়েছেন। একটু পরেই তার ডান দিকে কিছু একটা সড়সড় করে উঠল। গোলাকার ধাতব কিছু একটা। কোনো নখরচক্রই হবে মনে হচ্ছে। ক্ষিপ্রগতি। নিশ্চিত কোনো কিছুর পেছনে ধাওয়া করেছে। সম্ভবত কোনো ছোটো আকারের জানোয়ার। ইঁদুর হতে পারে। ওরা অবশ্য ইঁদুরও ধরে থাকে। ফাঁকা সময়ের সদ্ব্যবহার আর কী!
ছোটো টিলা পাহাড়ের উপরে উঠে পড়েছেন এখন। ফিল্ডগ্লাসটা উঠিয়ে চোখে লাগলেন তিনি। এখান থেকে আরও কয়েক মাইল দূরে গিয়ে আমেরিকানদের সীমানা শুরু হয়েছে। ওখানেই কোথাও একটা অগ্রবর্তী ঘাঁটি আছে ওদের। খবর বয়ে নিয়ে আসা ইয়াঙ্কি সৈন্যটা ওদিকের কোথাও থেকেই এসে থাকবে।
একটা বেঁটে মতো হোঁতকা রোবট তার ল্যাকপ্যাকে হাত দুলিয়ে তাকে পেরিয়ে গেল এইমাত্র। হাতের ভঙ্গি এমন যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিছু। তবে দাঁড়াল না, চলে গেল নিজের মতো। একটু পরেই হারিয়ে গেল ধ্বংসস্তূপের ভিড়ের মধ্যে কোথাও। হাঁসদা তাকিয়ে ছিলেন রোবটটার চলে যাওয়ার দিকে। এই ধরনের রোবট তিনি এর আগে কখনও দেখেননি। দিন দিন এরকম কখনও না দেখা রোবটের সংখ্যা ক্রমশ যেন বেড়েই যাচ্ছে। নানান জাতের নানান আকারের আর আকৃতির বিভিন্ন রোবট ভূগর্ভস্থ কারখানায় পয়দা হয়েই চলেছে।
হাঁসদা সিগারেটটা নিভিয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন। সত্যিই যত সব আশ্চর্য ব্যাপার স্যাপার আজকাল ঘটে চলেছে। বিশেষ করে যুদ্ধের কাজে এই কৃত্রিম গঠনগুলোর ব্যবহার। কীভাবে এসব শুরু হল? দরকার পড়ে গিয়েছিল বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকের যুদ্ধে দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করেছিল। যুদ্ধটা যেহেতু সেই শুরু করেছিল তাই প্রতিপক্ষের চাইতে প্রস্তুতি তার ভালো ছিল। পোল্যান্ড, ইউক্রেন, চেকশ্লোভাকিয়াসহ রাশিয়ার গোটা ইউরোপিয়ান অর্ধাংশ বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণে পৃথিবীর মানচিত্র থেকেই উবে গেল। অবিশ্যি, প্রতিরোধও এসেছিল খুবই তাড়াতাড়ি। যুদ্ধ শুরুর বহু আগে থেকেই আকাশে ডিস্ক-বোমারু বিমানের দল পাক খেত। প্রাথমিক আঘাতে হতচকিত হয়ে গেলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মস্কো সামলে নিয়েছিল। আদেশ পেতেই ডিস্ক-বোমারু বিমানগুলো পঙ্গপালের মতো দলে দলে আমেরিকার আকাশ ঢেকে দিয়েছিল।
কিন্তু এতেও রাশিয়া তেমন কিছু সুবিধা করে উঠতে পারল না।
পেরেস্ত্রৈকার উদার হাওয়ার ঝড়ে বহুদিন আগেই সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া টুকরো হয়ে গিয়ে যথেষ্ট ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। তারপরেও ইউক্রেন আর চেকশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে বহুদিন ধরে যুদ্ধ চলতে থাকায় এমনিতেই সামরিক সক্ষমতায় টান পড়েছিল। তবে অভাবিত সাহায্য এসেছিল দক্ষিণ থেকে। বহু কাল আগের এক বন্ধু দেশ থেকে।
আমেরিকা যুদ্ধ শুরু করতেই পাকিস্তান ভেবেছিল সে একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে। যাবতীয় দাঁত-নখ সহ সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্তে। ভেবেছিল ব্যতিব্যস্ত রাশিয়া ভারতকে সাহায্য করতে পারবে না। আমেরিকা তো নিজেই যুদ্ধ চাইছে। আর চিন তার নিজেরই সামরিক দোস্ত। কিন্তু সব হিসেব উলটে দিয়েছিল ভারত। ততদিনে ধর্মের ধ্বজাধারী দক্ষিণপন্থি সরকারের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষ মধ্যপন্থি সমাজতন্ত্রী সরকারের অধীনে নতুন ভাবে গড়ে উঠেছিল। ডিআরডিওর গোপন গবেষণাগারে আবিষ্কৃত নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান ভারতবর্ষ মোক্ষম জবাব দিয়ে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটাকেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিয়েছিল যুদ্ধ শুরুর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। সোনায় সোহাগা হয়েছিল তৎকালীন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর নতুন জেনারেল। ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের এক পাহাড়ি জনজাতির মানুষ, মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্নাতক, জেনারেল দাসাংলু মোসাং। তার রক্তে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বহমান ছিল রণ-কৌশল। সময়টাও তাকে সঙ্গ দিয়েছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চিনের দ্বিধান্বিত দোদুল্যমান অবস্থান। তার একদিকে তখন বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে চোখের সামনে রাশিয়াকে প্রায় পর্যুদস্ত করে আমেরিকার ক্রমশ এগিয়ে আসা। এই অবস্থায় সে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছিল ভারতবর্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে। তৈরি হয়েছিল অল এশিয়ান ইউনাইটেড ফোর্স বা আউফ।
কিন্তু তাতেও এশিয়া মহাদেশের খুব বেশি কিছু লাভ হয়নি। যুদ্ধ জারি রইল। আমেরিকান বাহিনী এগিয়েই আসতে থাকল।
যুদ্ধের প্রথম বছরেই ইউনাইটেড এশিয়ার সরকার সরে যায় চাঁদের ঘাঁটিতে। খানিকটা বাধ্য হয়েই। অবশ্য এছাড়া খুব বেশি আর কিছু করারও ছিল না। গোটা ইউরোপ আর রাশিয়ার প্রায় অর্ধেক শেষ করে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ততদিনে আমেরিকা ঢুকে পড়েছিল আফগানিস্তানে। তারপর তো চারদিকে শুধু ঝামা হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ আর পোড়া কঙ্কাল; ধূসর সেই ধ্বংসের জগতে জীবিত প্রাণ বলতে তখন শুধুই কালচে হয়ে যাওয়া এক রকম আগাছা। উত্তর ভারতের প্রায় বেশির ভাগ জায়গা মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। বীজ রোপনের উপযুক্ত এক টুকরো জমি বেঁচে নেই। প্রাণ ধারণের সম্পূর্ণ অযোগ্য ভূখণ্ড। লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু মানুষের কেউ চলে যায় দক্ষিণ ভারতের সমতল ভূমির দিকে, কেউ কেউ চলে যায় উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে জঙ্গলে। কিন্তু যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে আমেরিকান প্যারাসুটিস্টরা নামতে শুরু করে দেয় ভারতের মাটিতেও। প্রথমে অল্প সংখ্যক, তারপর ক্রমশ বাড়তে শুরু করে তাদের সংখ্যা। প্রথম দিকে তারা নিজেদের বিকিরণ-প্রতিরোধী সরঞ্জাম ব্যবহার করলেও পরের দিকে ভারতের পরিত্যক্ত উৎপাদন কেন্দ্রগুলো দখল করে নিজেদের সামর্থ্য আরও বাড়িয়ে নিতে পেরে যায়। ভারতীয় শিল্প আর শিল্পপতিদের বেশির ভাগই ততদিনে সরকারি সহায়তায় চাঁদের বুকে চলে গেছে। সঙ্গে গিয়েছে বুদ্ধিজীবী আর আমলাদের দলবল। আর গিয়েছে তারা যাদের পুঁজি তাদের ব্যক্তিগত পরিবহনের সামর্থ্য যোগাতে পেরেছিল। সরকার সমাজতান্ত্রিক হলেও এ বিষয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই রয়ে গিয়েছিল মধ্য আর নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা। যাদের অধিকাংশই মারা পড়েছে ডিস্ক বোমার বিস্ফোরণে। শুধু যারা চলে গিয়েছে সুদূর দক্ষিণে বা উত্তর-পূর্বে, তারাই এখনও তবু কায়েক্লেশে পলাতকের জীবন যাপন করে চলেছে বনে-জঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহা কন্দরে।
আর আছে সেনারা। ধরার বুকে লড়ার জন্য রেখে যাওয়া সেনা দল। সঠিক অর্থে ছেড়ে যাওয়া সেনাদের অবশিষ্টাংশ। এখনও টিকে থাকা এই সেনারা যে যেখানে যেভাবে পারে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এখানে কয়েক হাজার, তো সেখানে এক প্লাটুন। তারা কোথায় থাকে কীভাবে থাকে তা কেউ জানে না; বাস্তবিক তারা যেখানে পারত সেখানেই থাকত, রাতে ঘোরাফেরা করত, ধ্বংসস্তূপে, নর্দমায়, সেলারে, ইঁদুর আর সাপের সঙ্গে লুকিয়ে থাকত। একটা সময় অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল আমেরিকা যুদ্ধ প্রায় জিতেই গিয়েছে। চাঁদ থেকে প্রতিদিন কয়েকটা মাত্র নিয়ম রক্ষার মুষ্টিমেয় ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া ছাড়া, তাদের বিরুদ্ধে আর অন্য কোনো অস্ত্র প্রায় ব্যবহার করাই হল না। তারা যেভাবে খুশি আসছিল আর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যুদ্ধটা বলা যেতে পারে যে সবরকম বাস্তব অর্থে শেষ হয়ে গিয়েছিল। যেটুকু যা হচ্ছিল সেগুলো শুধুমাত্র ছুটকো ছাটকা লড়াই। প্রকৃত যুদ্ধ মনে হচ্ছিল শেষ হয়েই গিয়েছে।
আর তারপরেই আবির্ভূত হল প্রথম যুগের নখরচক্রেরা। অমনি রাতারাতি বদলে গেল যুদ্ধের রং।
শুরুর দিকের এই নখরচক্রগুলো ছিল বেঢপ। শ্লথ। মাটির তলার সুড়ঙ্গ বেয়ে ওগুলো উঠতে না উঠতেই ইয়াঙ্কিরা ওদের প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলে। কিন্তু আস্তে আস্তে ওগুলো উন্নত হতে শুরু করে। আরও গতিময়, আরও ধূর্ত। ওগুলো সব তৈরি হচ্ছিল পৃথিবীর কারখানাগুলোতেই। মাটির অনেক নীচে, ভারতীয় সীমানার অনেক ভেতরে সেই সব কারখানা। যেখানে অনেক দিন আগে তৈরি করা হত নানান সব আণবিক ক্ষেপণাস্ত্র। যেগুলোর কথা মানুষ এখন প্রায় ভুলেই গিয়েছে।
নখরচক্রেরা যেমন যেমন আরও দ্রুত গতি-সম্পন্ন হয়ে উঠতে থাকল তেমনি ক্রমশ তাদের আকার-আকৃতিও বাড়তে শুরু করে দিয়েছিল। আবির্ভূত হতে শুরু করে দিল আরও নতুন নতুন ধরনের, নতুন নতুন ক্ষমতা সম্পন্ন নখরচক্রেরা। তাদের কেউ কেউ অনুভূতি সম্পন্ন তো কারো আছে উড়ে বেড়ানোর ক্ষমতা। কেউ কেউ ছিল যারা আবার লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে পারে।
সেরা সেরা প্রযুক্তিবিদেরা চাঁদে বসে সেগুলোর বিভিন্ন নকশার উপরে কাজ করছিল। আরও বেশি বুদ্ধিমান আরও বেশি পরিবেশ-মানানসই নতুন প্রজন্মের নখরচক্রের নকশা তৈরি হচ্ছিল। তাদের রহস্যময়তা ক্রমশ আরও বেড়ে গেল। ইয়াঙ্কিরা তখন ঝামেলায় পড়তে শুরু করল। কিছু কিছু ক্ষুদ্রকায় নখরচক্রেরা তখন নিজেদের লুকিয়ে রাখতে শিখে নিয়েছে। ধ্বংসস্তূপ আর ছাইভস্মের গাদায় তারা ঢুকে পড়ে। লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করে শিকারের।
আর তারপরে তো একদিন ওগুলো আমেরিকানদের বাঙ্কারে ঢুকে পড়তে শুরু করে দিল। বাইরের হাওয়া বাতাস অথবা চারপাশে নজরদারি করার জন্য যে মুহূর্তে ঢাকনা খোলা হয়, অমনি তক্কে তক্কে থাকা তাদের কেউ না কেউ টুক করে ঢুকে পড়ে ভেতরে। একটা বাঙ্কারের ভেতরে শুধু একটা নখরচক্র, ধাতব একটা গোলক আর তার বাঁকানো ক্ষুরের ঘুরন্ত চক্র—এই ছিল যথেষ্ট। আর সবচেয়ে ভয়ংকর হল একটাও যদি কোনোভাবে ঢুকে পড়তে পারে তো তখন তার পিছনে পিছনে আরও অসংখ্য চক্রগোলক ঢুকে পড়ে। এমন অস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তো আর বেশিদিন চলতে পারে না।
আসলে হয়তো ইতিমধ্যে শেষই হয়ে গিয়েছে।
গন্তব্যে পৌঁছনোর পরে হয়তো সেই খবরটাই সে পেতে চলেছে। হয়তো পেন্টাগন সেই সিদ্ধান্ত এবার নিয়ে ফেলেছে। দূর্ভাগ্য এটাই যে সিদ্ধান্তটা নিতে এতগুলো দিন তারা পার করে দিল। ছ-ছটা বছর। যেভাবে তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে তার পক্ষে সময়টা অত্যন্ত লম্বা। হাজারে হাজারে প্রতি-আক্রমণকারী স্বয়ং-সন্ধানী চাকতির দল প্রতিশোধ-লিপ্সায় সারা ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে তখন ঘুরেছে। কত রকমের জৈব অস্ত্র—ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস—তাদের অভিযোজিত বিভিন্ন রূপ। বাতাসে শিষের শব্দ ছড়িয়ে উড়ে বেড়ানো আমেরিকান সেই সব দূর-নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র। নিরবচ্ছিন্ন বোমার অবিশ্রান্ত বিরামহীন বিস্ফোরণের ধারাবাহিকতা। আর তারপর এগিয়ে এল এই রোবট দল, নখরচক্র—
এই নখরচক্র গোলকগুলো বাকি অন্য অস্ত্রশস্ত্রের মতো শুধু আরেকটা কোনো যেমন তেমন অস্ত্র নয়। এমনকি শুধু যে কোনো একটা অসাধারণ অস্ত্র তা-ও নয়। এরা বাস্তবিক এক জীবন্ত অস্ত্র। জীবনের সংজ্ঞার যে কোনো দিক দিয়েই দেখা হোক না কেন দেখা যাবে এরা জীবন্ত। তা সরকার সেটা মানুক বা না মানুক, সরকারিভাবে সেটা ঘোষিত হোক বা না হোক। এরা শুধু যন্ত্র নয়। এরা সব জীবন্ত যন্ত্র। চক্রের মতো ঘূর্ণায়মান, সরীসৃপের মতো বুকে হাঁটা জীবন্ত এই যন্ত্রেরা ধূসর ভস্মের গাদা থেকে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের উপর। উঠে যায় তার শরীরে, লক্ষ্য তার গলার দিকে। আর এই কাজের জন্যই তাদের সৃষ্টি, তাদের নীল-নকশায় খোদাই করা আছে এই উদ্দেশ্য।
আর সেই কাজ তারা খুব ভালোভাবেই করে থাকে। বিশেষ করে পরের দিকের আরও উন্নত নকশায় তৈরি হওয়া যন্ত্রগুলোর সার্বিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত। এখন আবার নিজেদের মেরামত তারা নিজেরাই করে নিচ্ছে। এখন তারা স্বয়ং সম্পূর্ণ। রেডিয়েসন ট্যাব থাকায় আউফ বাহিনীর লোকজন রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু যদি কেউ তার ট্যাবটা খুইয়ে বসে তো সে নখরচক্রের জন্য একদম সহজ শিকার; তা তার উর্দির রং যাই হোক না কেন। ভূপৃষ্ঠের নীচের কারখানাগুলোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের হাতে তাদের সৃষ্টি। মানুষের সংস্পর্শ থেকে বহু দূরে। তাদের কাছে যাওয়াটাই মারাত্মক বিপজ্জনক। কেউই তাদের ধারে কাছে থাকতে চায় না। তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের নিজেদের হাতে। তাতে ক্ষতি তো কিছু দেখা যাচ্ছে না। আপাতদৃষ্টিতে তো মনে তো হচ্ছে যে তারা তাদের কাজকর্ম বেশ ভালোই চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন নকশার আমদানিগুলো আরও দ্রুত গতিবেগ সম্পন্ন, আরও জটিল আর বুদ্ধিমান। আরও দক্ষ।
মনে হচ্ছে যুদ্ধটা তারা এবার জিতেই গিয়েছে।
***
মেজর সোনারাম হাঁসদা আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। পরিবেশের বিষণ্ণতা তাকে খানিকটা দমিয়ে দিয়েছে। ছাই-ভস্ম আর একদা সভ্যতার ভগ্নাবশেষ ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তিনি যেন নিঃসঙ্গ এক মানব, পৃথিবী নামক সূর্যের এই তৃতীয় গ্রহের একমাত্র জীবিত প্রাণী। তার ডান দিকে কোনো শহরের ধ্বংসাবশেষ, ভাঙাচোরা কয়েকটা দেয়াল আর চারদিকে পাহাড়ের মতো উঁচু ঢিবি হয়ে ওঠা বাড়িঘরের ভগ্নাবশেষ। নিভে যাওয়া দেশলাই কাঠিটা আঙুলের টোকায় দূরে ফেলে দিয়ে গতি বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন আবার। একটু পরেই হঠাৎ আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। এক ঝটকায় তুলে ধরলেন হাতের বন্দুকটা। উত্তেজনায় তার গোটা শরীর টানটান হয়ে উঠেছে। এক মিনিটের জন্য মনে হল—
ধ্বসে পড়া একটা বাড়ির ভাঙা দেয়ালের আড়াল থেকে একটা অবয়ব বেরিয়ে এল। খানিক ইতস্তত ভাব। তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল শরীরটা।
সোনারাম চোখ কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার বন্দুক তাক করে চিৎকার করে উঠলেন, “দাঁড়াও।”
ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল দেখে সোনারাম বন্দুক নামিয়ে নিলেন। নড়াচড়া করছে না ছেলেটা এখন। চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছোটোখাটো রোগা পাতলা একটা শরীর। কম বয়সি কোনো ছেলে হবে। সম্ভবত বছর আটেক বয়স। সঠিক আন্দাজ করা একটু কঠিন। বেঁচে থাকা বেশির ভাগ বাচ্চাই কেমন যেন দরকচা মেরে গিয়েছে। ছেলেটার পরনে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া নোংরাস্য নোংরা নীলচে সোয়েটার আর হাফ প্যান্ট। তামাটে রং-এর লম্বা চুলগুলো জট পাকিয়ে কপালে, কানের পাশে আর ঘাড়ের পেছনে ঝুলে পড়েছে। ছেলেটার হাতে কিছু একটা ধরা আছে।
“তোমার হাতে ওটা কী?” সোনারাম কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
ছেলেটা তার হাতটা বাড়িয়ে ধরল। হাতে ধরা একটা খেলনা। একটা টেডি বিয়ার। ছেলেটার চোখ দুটো বেশ বড়ো বড়ো। কিন্তু কেমন যেন ভাবলেশহীন।
সোনারাম নিশ্চিন্ত হলেন। “আমার দরকার নেই। ওটা তোমার কাছেই রাখ।”
ছেলেটা তার খেলনা বাচ্চা ভালুকটাকে ভালো করে আঁকড়ে ধরল।
সোনারাম জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কোথায় থাকো?”
“ওই… ওখানে।”
“ওই ধ্বংসস্তূপে?”
“হ্যাঁ।”
“মাটির নীচে?”
“হ্যাঁ।”
“ওখানে ক’জন থাকো?”
“ক’জন?”
“সংখ্যা, তোমার সঙ্গে যারা আছে। তুমি ছাড়া আর কে কে থাকে সেখানে?”
ছেলেটা উত্তর দেয় না।
সোনারাম ভ্রু কুঁচকে তাকান। “তুমি নিশ্চয়ই একা থাক না, না কি একাই থাক?”
ছেলেটি মাথা নাড়ায়।
“একা একা কীভাবে বেঁচে আছো? খাও কী?”
“খাবার আছে।“
“কীরকম খাবার?”
“সে আছে একরকম।”
সোনারাম বুঝতে পারছেন না। বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। “তোমার বয়স কত?”
“তেরো।”
অসম্ভব। এ হতেই পারে না। নাকি এটাই হচ্ছে আজকাল? ছেলেটার চেহারা রোগাটে ধরনের, দরকচা মার্কা। আর সম্ভবত স্টেরাইল। বিকিরণের প্রভাব হতে পারে। এতগুলো বছর তো একনাগাড়ে এর মধ্যেই কাটাচ্ছে। শারীরিক অসংগতি তৈরি হওয়া কিছু আশ্চর্যের নয়। হাত-পাগুলো কাঠির মতো হয়ে গিয়েছে। গাঁট সর্বস্ব। আর পলকা। সোনারাম ছেলেটার হাতটা ছুঁয়ে দেখেন। শুকনো আর খড়খড়ে চামড়া। বিকিরণের প্রভাব নিশ্চিত। নীচু হয়ে ছেলেটার মুখটা দেখলেন। ভাবলেশহীন মুখ। চোখ দুটো বেশ বড়োসড়ো, আর অদ্ভুত রকমের ঘন কালো।
জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি অন্ধ নাকি?”
“না। তবে একটু আবছা দেখতে পাই।”
“নখরচক্রগুলোর হাত থেকে বেঁচে আছো কী করে?”
“নখরচক্র?”
“ওই ধাতুর গোল্লাগুলো। যেগুলো দৌড়ে বেড়ায়। লুকিয়ে থাকে।”
“আমি বুঝতে পারছি না।”
তার মানে নখরচক্রগুলো এদিকে আসে না। অবশ্য এদিকের পুরো জায়গাটাই প্রায় ফাঁকা। জনহীন। আর ওগুলো সাধারণত বাঙ্কারের আশপাশের এলাকাতেই বেশির ভাগ ঘোরাঘুরি করে। এমন সব জায়গায় যেখানে মানুষ থাকে। জীবিত প্রাণীর রক্তের উষ্ণতা খোঁজার সক্ষমতা নখরচক্রগুলোর আভ্যন্তরীণ নকশায় তাদের জন্ম মুহূর্তেই খোদাই করে দেওয়া হয়েছিল।
“তুমি ভাগ্যবান।” সোনারাম উঠে সোজা হয়ে শরীরটা টানটান করে নিচ্ছিলেন। “বুঝলে? এখন কোন দিকে যাবে তুমি? ফিরে যাবে তো—যেখান থেকে এলে?”
“আমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?”
“আমার সঙ্গে?” সোনারাম তার হাত গুটিয়ে নিলেন। “আমি অনেক দূর যাব। বহু দূরে। আমাকে অনেক জোরে হাঁটতে হবে।”
তিনি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিলেন। “অন্ধকার নেমে আসার আগেই আমাকে সেখানে পৌঁছতে হবে।”
“আমি যেতে চাই।”
সোনারাম হাত ঢুকিয়ে তার সঙ্গের ব্যাগপত্র ঘাটছিলেন। কিছু খুঁজে পেতে চাইছিলেন তিনি। “উঁহু, এগুলো কোনো কাজের কথা নয়। অন্তত এখন।” তিনি ব্যাগ থেকে একটা খাবারের ক্যান বের করে আনলেন। নামিয়ে দিলেন ছেলেটার সামনে। “তুমি এগুলো নিয়ে ফিরে যাও। ঠিক আছে?”
ছেলেটা কিছু বলল না।
“আমি এই পথে ফিরে আসব। একদিনের মধ্যে। আমি ফিরে আসার সময় তুমি যদি এখানে থাকো তবে তখন আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে নেব। ঠিক আছে?”
“আমি এখনই তোমার সঙ্গে যেতে চাই।”
“অনেকটা হাঁটতে হবে কিন্তু।”
“আমি হাঁটতে পারি।”
সোনারাম অস্বস্তি বোধ করেন। এতে ঝামেলা হতে পারে। দুজন লোক পাশাপাশি হাঁটছে সেটা খুব সুবিধার হবে না। সহজেই নজরে পড়ে যেতে হবে। একদম ইজি টার্গেট হয়ে যেতে হবে। তা ছাড়া ছেলেটার জন্য তার হাঁটার গতি-ও অনেক ধীর হয়ে যাবে। কিন্তু এটাও ঠিক যে তিনি ফেরার সময় হয়তো এ পথেই ফিরলেন না। কিন্তু এই ছেলেটা যদি সত্যি সত্যিই একদম একা হয়ে গিয়ে থাকে—
“ঠিক আছে। চলো তবে।”
ছেলেটা উঠে এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। মেজর সোনারাম হাঁসদা পা চালাতে শুরু করলেন। উনি হাঁটতে শুরু করতেই ছেলেটা তার পাশাপাশি চলতে শুরু করল।
বেশ খানিকক্ষণ চলার পরে সোনারাম ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
“রাফীদ লস্কর দিলোয়ার।”
“রাফীদ? তোমার—ইয়ে, তোমার মা-বাবার কী হয়েছিল?”
“মরে গেছে।”
“কীভাবে মারা গেছেন?”
“বিস্ফোরণে।”
“কত দিন আগে?”
“ছ-বছর।”
চলতে চলতে কথা হচ্ছিল। কাটা কাটা ছোটো ছোটো প্রশ্ন। তেমনি ছোটো উত্তর।
সোনারাম এবার চলার গতি কমিয়ে আনলেন। “এই ছ-বছর ধরে তুমি একাই আছো?”
“না। আগে আরও অনেকে ছিল। সবাই চলে গেছে।”
“আর তারপর থেকে তুমি একাই ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
সোনারাম চোখ নামিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা অদ্ভুত, কথা খুব কম বলে। একটু যেন উদাসীন আর অন্তর্মুখী। হয়তো এই প্রজন্মের শিশুদের যারা যারা বেঁচে রয়েছে তারা সবাই এরকম। শান্ত। নির্বিকার। সব কিছু অদ্ভুতভাবে যেন নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। কোনো কিছুই আর তাদের অবাক করতে পারে না। যা হচ্ছে তার সব কিছুই তারা মেনে নিয়েছে। ভরসা করার জন্য তাদের সামনে আর কিছুই বেঁচে নেই। যা কিছু স্বাভাবিক, দৈহিক হোক বা মানসিক, তারা আর কোনো ভালো কিছুর আশা রাখে না। কোনো স্বাভাবিক রীতি, নীতি বা সংস্কৃতি, কিছুই এরা শেখেনি। শেখার কোনো পরিস্থিতিই আর নেই। এদের জন্যে শুধু পড়ে আছে প্রতি দিনের নৃশংস অভিজ্ঞতা।
সোনারাম একটু যেন নরম হয়ে পড়েছেন। জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কি খুব জোরে হাঁটছি?”
“না।”
“তুমি আমাকে দেখতে পেলে কীভাবে?”
“আমি অপেক্ষা করছিলাম।”
“অপেক্ষা?” সোনারাম হতবাক হয়ে গেলেন। “তুমি কীসের জন্য অপেক্ষা করছিল?”
“যদি কিছু ধরতে পারি, সেই জন্য।”
“কী ধরার জন্য?”
“খাওয়ার জন্য যা হোক কিছু।”
“ওহ্।” সোনারাম চুপ করে গলেন। বলার মতো আর কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। যেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে ভরা দুনিয়ায় তেরো বছরের একটা ছেলে ইঁদুর কিংবা ছুঁচো, আর নয়তো কুড়িয়ে পাওয়া পচা-ধচা খাবার খেয়ে শহরের ধ্বংসস্তূপের নীচের কোনো গর্তে-খোঁদলে লুকিয়ে একাকী বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, যেখানে জলে কুমীর আর ডাঙ্গায় বাঘের মতো পায়ের কাছে নখরচক্র আর আকাশে চক্কর কাটছে আমেরিকান ডাইভ-মাইন, সেখানে বলার মতো কিছু খুঁজে পাওয়া সহজ কথাও নয়।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?” রাফীদ জিজ্ঞেস করল।
“আমেরিকানদের ওদিকে।”
“আমেরিকান?”
“আমাদের শত্রু। এরাই তো যুদ্ধ শুরু করেছিল। এরাই প্রথম তেজস্ক্রিয় বোমা ফেলে। এরাই তো এই সব শুরু করেছে।”
ছেলেটি শুধু মাথা নাড়ে। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখা গেল না।
সোনারাম কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন, “আমি একজন ভারতীয়।”
এবারও কোনো অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখা গেল না। কোনো উত্তরও পাওয়া গেল না।
এরপর আর কোনো কথাবার্তা হল না। নীরবে ওরা দুজন হাঁটতে থাকল। সোনারাম একটু এগিয়ে আছেন। নোংরা হয়ে যাওয়া খেলনা বাচ্চা ভালুকটাকে বুকের কাছে জাপটে ধরে তার পেছন পেছন হাঁটছে রাফীদ।
***
খাওয়ার জন্য যখন তারা থামল তখন বিকেল প্রায় চারটে বেজে গিয়েছে। কতকগুলো ভেঙে পড়া কংক্রিটের স্ল্যাবের আড়ালে আগাছা-টাগাছা পরিষ্কার করে এদিক ওদিক থেকে বেশ কিছু কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে নিলেন সোনারাম। আমেরিকানদের এলাকা আর খুব বেশি দূরে নেই। তার আশপাশের এই জায়গাটা কখনও একদিন সবুজ একটা উপত্যকা ছিল। বিঘার পর বিঘা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন ফলের গাছ আর আঙুরের মাচা। এই এলাকায় একদা ভূস্বর্গ বলে পরিচিত সেই বিখ্যাত উপত্যকা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এখন যদিও সেখানে সে সবের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আছে শুধু কিছু কালো হয়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ি আর দূরে দূরে দিগন্ত জুড়ে প্রসারিত পাহাড়। না, শুধু তাই বা কেন, আরও আছে তো! আছে পাক খাওয়া ছাইয়ের মেঘ যা সারাক্ষণ বাতাসে উড়ছে, ভেসে বেড়াচ্ছে। সারাক্ষণ ঝরে ঝরে পরছে, জমা হচ্ছে গজিয়ে ওঠা আগাছার ওপরে, বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষের ওপরে। কোথাও কোথাও ছাই জমে জমে ঢিপি হয়ে উঠেছে। যেখানে কখনও একদিন হয়তো ছিল মানুষের চলার পথ।
সোনারাম কফি বানালেন। খানিকটা প্যাকেট করা সেদ্ধ মাংস আর রুটি গরম করে নিলেন। রাফীদকেও দিলেন সেই সেদ্ধ মাংস আর রুটি। “এই নাও।”
রাফীদ হাঁটু দুটো ভাঁজ করে উবু হয়ে আগুনের ধারে বসে ছিল। তার পা দুটো গাঁট ওয়ালা আর বেশ শক্তপোক্ত। একটু ফ্যাকাশে, যেন রক্তহীন। সে খাবারটা হাতে নিয়ে প্রথমে দেখে নিল খানিকক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে ফিরিয়ে দিল সেটা।
“খাবে না?”
“না।”
“না? একটুও খাবে না?”
“না।”
সোনারাম মাথা নেড়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়েন। ছেলেটা সম্ভবত মিউট্যান্ট, এ ধরনের খাবার মুখে রোচে না। যাক গে, কী-ইবা এসে যায় তার। খিদে পেলে নিজেই নিজের খাবার খুঁজে নেবে। ছেলেটা যথেষ্ট অদ্ভুত। অবশ্য বিভিন্ন অদ্ভুত ধরনের পরিবর্তন এই দুনিয়ায় এখন তো রোজ রোজ হয়েই চলেছে। জীবন আর এখন আগের মতো নেই। আগের মতো আর কখনও হবেও না। আজ হোক বা কাল, মানুষ একদিন না একদিন এটা বুঝতে শিখবে।
ছেলেটার উদ্দেশে সোনারাম বললেন, “ঠিক আছে। যেটা তোমার ইচ্ছে।”
তিনি নিজের ভাগের রুটি আর মাংস খেতে শুরু করলেন। বলা উচিত কফি দিয়ে সেগুলো গলধঃকরণ করে নিচ্ছিলেন। হজমের অসুবিধা এড়াতে খাওয়া শেষ করলেন সময় নিয়ে। ধীরে ধীরে। খাওয়া শেষ হলে উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে টিপে টিপে আগুনটা নিভিয়ে দিলেন।
রাফীদও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটার বুড়োটে মার্কা তরুণ চোখ দুটো এখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
সোনারাম ছেলেটাকে আশ্বস্ত করেন, “আমাদের যেতে হবে এবার।”
“ঠিক আছে।”
সোনারাম আবার হাঁটতে শুরু করেছেন। বন্দুকটা হাতে তৈরি আছে। তিনি নিজেও সজাগ। তারা এখন খুব কাছে এসে পড়েছেন। তার ভেতরে উত্তেজনা এখন চরম স্তরে। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তিনি এখন তৈরি। এটা নিশ্চিত যে আমেরিকানরা আউফের তরব থেকে কোনো একজন দূতের অপেক্ষায় অবশ্যই থাকবে। তাদের নিজেদের দূতের জবাব হিসেবে তারা আশা করবে যে কেউ না কেউ আসবে। তবে ইয়াঙ্কিরা অত্যন্ত চতুর। কাজেই একটা গোপন বদমাইশি কিছু থাকার সম্ভাবনা থেকেই যায়। চারদিকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেপে করে নিচ্ছিলেন সোনারাম। কোথাও তেমন কিছু নজরে আসছে না। শুধু শীতল ধাতুমল আর ছাই, কয়েকটা মাঝারি টিলা, ঝলসানো গাছ-পালা আর কংক্রিটের দেওয়াল। সামনে ওই দিকেই কোথাও থাকবে আমেরিকানদের প্রথম বাঙ্কারটা, ওদের ফরোয়ার্ড কমান্ড। মাটির নীচে। কোনো গোপন গহ্বরে। ওখানেই কোথাও থেকে উঁকি মারবে একটা পেরিস্কোপ আর গোটা কয়েক বন্দুকের নল। হয়তো একটা অ্যান্টানাও।
“আমরা কি পৌঁছে গেছি?” রাফীদ জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ। তুমি কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ?”
“না তো। ”
“তাহলে জিজ্ঞেস করছ কেন?”
রাফীদ উত্তর দেয় না। যেমন পিছনে পিছনে চলছিল তেমনি ছাই ঢাকা পথে সাবধানে পা ফেলে চলতে থাকল। তার জুতো থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত ছাই আর ধুলোয় ধূসর হয়ে গেছে। তার কৃশকায় মুখের ফ্যাকাশে সাদা চামড়ার ওপর দিয়ে ধূসর ছাইয়ের রেখা পাহাড়ি ঝরনার শতধা ধারার মতো নেমে এসেছে। তার মুখ চোখ সম্পূর্ণ রংহীন, বিবর্ণ। নোংরা নর্দমা, ধ্বংসস্তূপের খোঁদলে অথবা মাটির নীচের সেলারে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে যেমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
সোনারাম চলার গতি কমিয়ে দিলেন। ফিল্ডগ্লাস তুলে আশপাশের এলাকা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ওরা কী এখানেই, আশপাশে কোথাও তার জন্য অপেক্ষা করছে? ঠিক সেভাবেই তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে, যেভাবে তার দলের লোকজন আমেরিকান সৈন্যটাকে লক্ষ করছিল? ভাবনাটা মাথায় আসতেই মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হীম শীতল কনকনে স্রোত বয়ে গেল। হয়তো ওরা এতক্ষণে ওদের বন্দুক উঠিয়েই নিয়েছে, এমনকি গুলি করার জন্য ট্রিগারে আঙুল ইতিমধ্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, ঠিক যেভাবে তার লোকেরা প্রস্তুতি নিয়েছিল। ঠিক সেভাবেই এরাও হয়তো তাকে মেরে ফেলার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে।
সোনারাম দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুখে মাথায় জমে ওঠা ঘাম মুছে নিলেন। “ধ্যাৎ তেরিকা।” এ সব নিয়ে ভাবতেই একটা প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। যদিও জানেন যে এখানে তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তিনি সম্পূর্ণ অনাহুত নন। তিনি যে আসতে পারেন সে বিষয়ে এদের একটা ধারণা নিশ্চয়ই আছে। যদিও দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমেরিকান সৈন্যটার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম।
সামনের ছাই ঢাকা জমির ওপর দিয়ে আবার এগোতে শুরু করলেন তিনি। বন্দুকটা শক্ত করে চেপে ধরে রয়েছেন দু-হাত দিয়ে। রাফীদ আসছে পেছনেই। সোনারাম দাঁতে দাঁত চেপে চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে এগোচ্ছেন। যে কোনো মুহূর্তে এখন বিপদ আসতে পারে। কংক্রিট বাঙ্কারের গভীর থেকে কেউ না কেউ নিশ্চিত খুব সাবধানে লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছে। প্রথমে চোখ আসবে সাদা আলোর একটা বিস্ফোরণ, তার ঠিক পরে পরেই শোনা যাবে ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ।
তিনি হাত দুটো উপরে তুলে গোল করে ঘোরাতে শুরু করলেন।
এখনও পর্যন্ত তো কোথাও কিছু নড়াচড়া নজরে পড়ল না। তার ডান দিকে একটা লম্বা পাথরের চাতাল। সেদিকে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে অসংখ্য শুকনো মৃত গাছের গুড়ি। গুড়িগুলোর আশপাশে দিয়ে কিছু বুনো লতাগুল্ম গজিয়ে উঠেছে। একদা সবুজ বনভূমির বর্তমান অবশিষ্টাংশ। আর রয়েছে কালচে অবিনশ্বর আগাছার ঝাড়। সোনারাম তীক্ষ্ণ নজরে পাথরের চাতালটা খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন। ওখানে কি কেউ আছে? ওঁত পেতে বসে থাকার একদম উপযুক্ত একটা জায়গা। সতর্কভাবে তিনি এগিয়ে গেলেন চাতালটার দিকে। রাফীদ নিঃশব্দে তার পেছনে পেছনে আসছে।
এটা তার অধীনস্থ এলাকা হলে তিনি নিশ্চিত এখানে পাহারাদারির ব্যবস্থা রাখতেন যাতে কেউ অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করলেই ধরা পড়ে যায়। অবিশ্যি এটাও ঠিক যে এটা তার এলাকা হলে পূর্ণ সুরক্ষার জন্য এখানে অবশ্যই নখরচক্রের দল ছাড়া থাকত।
এবার কোমরের দু-পাশে দু-হাত রেখে পা দুটো ফাঁক করে দাঁড়িয়ে পড়লেন সোনারাম হাঁসদা।
“পৌঁছে গিয়েছি?” রাফীদ জিজ্ঞেস করে।
“প্রায়।”
“তবে আমরা দাঁড়িয়ে আছি কেন?”
“আমি কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাই না।”
সোনারাম সতর্কভাবে একপা-দু-পা করে এগোচ্ছেন। পাথরের চাতালটা এখন ঠিক তার ডান পাশে। এলিয়ে পড়ে আছে। যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার অস্বস্তি আরও বেড়ে গিয়েছে। ওখানে যদি একজন ইয়াঙ্কিও লুকিয়ে থেকে থাকে তবে তাদের আজ আর রক্ষা নেই। তিনি আবার দু-হাত তুলে নাড়াতে থাকেন। অ্যালুমিনিয়ামের ডিবেতে ভরে পাঠানো চিঠির জবাবে তাদের তো এখন আউফের ইউনিফর্ম পরা কাউকে আশা করা উচিত। যদি না পুরো ব্যাপারটাই একটা ফাঁদ হয়ে থাকে।
“আমার কাছে কাছে থাকবে,” তিনি রাফীদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে নিলেন। “পিছিয়ে যেও না।”
“তোমার কাছে?”
“আমার পাশে! আমার কাছাকাছি। আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। চলে এসো।”
“আমি ঠিক আছি।”
রাফীদ তার পিছনেই আছে। যদিও একদম সেঁটে নয়, বরং কয়েক পা দূরে। এখনও তার খেলনা ভালুকটাকে সে বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
“ঠিক আছে। যা ভালো বোঝো।”
সোনারাম তার ফিল্ড গ্লাসটা আবার তুলে নিলেন। তারপরেই হঠাৎ উত্তেজনায় তার গোটা শরীর যেন টানটান হয়ে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল—ওদিকে কিছু কি নড়াচড়া করল? পাথুরে চাতালের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত সাবধানে দেখে নিলেন তিনি। চারদিক সম্পূর্ণ নিথর নিস্তব্ধ। মৃত। কোথাও কোনো প্রাণের লক্ষণ নেই। শুধু গাছের গুঁড়ি আর ছাই। আর রয়েছে কয়েকটা ইঁদুর। বড়ো বড়ো কালো ইঁদুর। এরা নখরচক্রদের হাত থেকে এখনও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। এগুলোও অবশ্য মিউট্যান্ট–লালা আর ছাই দিয়ে এরা নিজেদের আশ্রয় তৈরি করতে শিখে গিয়েছে। কিছু বিশেষ ধরনের প্লাস্টার। অভিযোজন। তিনি আবার সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলেন।
সবে এগোনো শুরু করেছেন, ঠিক তখনই সামনের পাথরের চাতালের উপরে আবির্ভাব হল জোব্বার মতো ঢিলাঢালা একটা ধূসর-সবুজ আলখাল্লা পরা লম্বা একটা শরীরের। একটা আমেরিকান। পরের মুহূর্তেই ঠিক তার পেছনে আরও একজন সৈন্য হাজির। আরেকটা আমেরিকান। দুজনের হাতেই উদ্যত বন্দুক। লক্ষ্য স্থির তাদের দিকেই।
সোনারাম যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েছেন। কোনো ক্রমে তিনি শুধু মুখ একবার হা করতে পারলেন। সৈন্য দুজন ইতিমধ্যেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে, ঢালের পাশ দিয়ে তারা নীচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওদিকে ধূসর-সবুজ পোশাক পরিহিত ছোটোখাটো চেহারার তৃতীয় আরেকজন এসে এখন চাতালের শীর্ষে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সম্ভবত একজন মহিলা। প্রথম দুজন সৈন্যর ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে।
সোনারাম এবার এতক্ষণে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারলেন। “দাঁড়ান!” তিনি পাগলের মতো তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াচ্ছিলেন। “আমি—”
তিনি সম্ভবত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, পারলেন না। তার আগেই আমেরিকান সৈন্য দুজন গুলি চালিয়ে দিল। সোনারামের ঠিক পিছনে একটা হালকা ধাম্ করে শব্দ হল। আর আগুনের মতো গরম একটা হাওয়ার স্রোতের ঢেউ এসে তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন তিনি। ছাই ভস্মে ঢাকা পাথুরে জমির ঘষায় কেটে ছড়ে গেল তার মুখ, টুকরো-টাকরা ঢুকে গিয়েছে তার চোখের ভেতরে, নাকের ভেতরে। একটা দমবন্ধ ভাব। কোনো রকমে হাঁটু ভাঁজ করে শরীরটা গুটিয়ে ছোটো করে নিলেন তিনি। তার মানে এটা একটা ফাঁদই ছিল। তিনি পা দিয়ে ফেলেছেন সেই ফাঁদে। গাধার মতন মরতে চলে এসেছেন তিনি। চোখে পড়ল চাতালটার ঢাল বেয়ে নরম ছাইয়ের উপর দিয়ে সরসর করে পিছলে পিছলে দ্রুত গতিতে তার দিকে নেমে আসছে সেই মহিলা সহ সৈন্য দুজন। সোনারাম অসাড় হয়ে পড়ে ছিলেন। তার মাথাটা দপদপ করছে। হ্যাচোড়প্যাচোড় করে কোনোরকমে তিনি তার রাইফেলটা তুলে নিয়ে লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করলেন। কাজটা সহজ নয়। বন্দুকটার ওজন যেন অনেক বেড়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন অন্তত হাজার টন ওজন। বুঝতে পারছেন আর বেশিক্ষণ তিনি এটা ধরে রাখতে পারবেন না। তার নাক আর গাল তিরতির করে কাঁপছে। বাতাস বিস্ফোরণের গন্ধে ভরতি। এক তিক্ত তীব্র দুর্গন্ধ।
“ডোন্ট ফায়ার,” আমেরিকান টানের ইংরেজি উচ্চারণ আর ভারী গলায় প্রথম আমেরিকানটা বলে উঠল। এখন ওরা তিনজনে তাকে ঘিরে ধরেছে। “তোমার রাইফেল নামিয়ে দাও, ইন্ডি,” দ্বিতীয়জন বলে উঠল।
সোনারাম হতবাক। সব কিছু যেন ঝড়ের মতো ঘটে গেল। তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন। আর ছেলেটাকে এরা উড়িয়ে দিয়েছে। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। রাফীদ আর নেই। শুধুমাত্র তার নশ্বর দেহের অবশিষ্টাংশ চারপাশ জুড়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
তিন আমেরিকান তাকে কৌতূহলী নজরে লক্ষ করছিল। সোনারাম এখন উঠে বসেছেন। বসে বসে তার নাক থেকে গড়িয়ে আসা রক্ত মুছছিলেন, নাকে মুখে ঢুকে যাওয়া ছাইয়ের টুকরো বের করছিলেন। মুখ-চোখ খানিকটা পরিস্কার হতেই তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাইলেন। “আপনারা কেন এরকম করলেন?” তিনি অনুচ্চস্বরে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন। “একটা বাচ্চা ছেলে।”
“কেন করলাম জানতে চাইছেন?” সৈন্যদের একজন যে তাকে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করছিল সে এবার সোনারামকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাল। তারপর বলল, “দেখে নিন।”
সোনারাম একবার তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
“দেখুন! দেখে নিন!” দুই আমেরিকান তাকে টেনে এগিয়ে নিয়ে গেল। “দেখুন, তবে একটু তাড়াতাড়ি করুন। খুব বেশি সময় আমাদের হাতে নেই, ইন্ডি!”
সোনারাম আবার চোখ খুলে তাকালেন। তাকাতেই তিনি চমকে উঠলেন। তার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।
“দেখলেন? এখন বুঝতে পারছেন তো?”
চোখের সামনে পড়ে থাকা রাফীদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শারীরিক অবশিষ্টাংশের মধ্যে থেকে একটা ধাতব চাকা গড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। এখনও ঘুরছে সেটা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে রিলে, চকচক করছে ধাতুর টুকরো টাকরা। নানান যন্ত্রাংশ আর সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসা বৈদ্যুতিক তারের ছিন্নাংশ। আমেরিকানদের একজন রাফীদের শরীরের অবশিষ্টাংশের মধ্যে একটা লাথি মারল। সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো টুকরোটাকরা ছিটকে গেল এদিক ওদিক। গড়িয়ে গেল নানান আকৃতির চাকা, স্প্রিং আর ধাতব দণ্ড। একটা আধপোড়া প্লাস্টিকের যন্ত্রাংশ সামনে বেরিয়ে এল। সোনারাম কেঁপে উঠলেন একবার। নীচু হয়ে ভালো করে দেখলেন। এটা মাথার সামনের দিকের অংশটা। তিনি ভালোই চিনতে পারছেন ওই সব মস্তিষ্কের জটিল গঠন, বৈদ্যুতিক তার আর বিভিন্ন রিলে, খুদি খুদি টিউব আর স্যুইচ, কয়েক হাজার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্টাড—
“ওটা আসলে একটা রোবট,” যে আমেরিকান সৈনিক তার হাত ধরে ছিল সেই বলে যাচ্ছিল, “ওটা যে আপনাকে ট্যাগ করে ফেলেছে সেটা আমরা বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম।”
“আমাকে ট্যাগ করেছিল? ট্যাগ?”
“ওটা ওদের একটা কায়দা। ওরা প্রথমে আপনাকে ট্যাগ করে নেবে, তারপর আপনার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে। আর এভাবেই ওরা বাঙ্কারের মধ্যে ঢুকে পড়ে।”
বিস্ফারিত চোখ মেলে সোনারাম তাকিয়ে আছেন, এখনও হতবাক। “কিন্তু—”
“সে সব কথা পরে হবে। এখন আসুন আপনি।” তাকে নিয়ে এবার সবাই পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল। “এখানে আমাদের বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। জায়গাটা মোটেও নিরাপদ নয়। চারপাশে ওইরকম শ’য়ে শ’য়ে থাকতে পারে।”
ছাইয়ের ওপরে তার পা পিছলে যাচ্ছিল। কোনো রকমে ঘষটে ঘষটে তারা তিনজন মিলে তাকে ঠেলেঠুলে পাথুরে চাতালের ওপরে ওঠালো। মহিলাটি সবার আগে চূড়ায় পৌঁছে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
“ফরওয়ার্ড কমান্ড।” সোনারাম তখনও বিড়বিড় করে করছিলেন। বললেন, “আমি এসেছি আমেরিকান ফরওয়ার্ড কমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করতে—”
“ফরোয়ার্ড কমান্ড বলে এই মুহূর্তে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ওরা ঢুকে পড়ে ছিল। চলুন, আমরা আপনাকে সব কিছু খুলেই বলব।”
তারা এখন চাতালটার শীর্ষে এসে পৌঁছেছেন। “আমরা এই ক-জনই শুধু যা বেঁচে আছি, এই আমরা তিনজন। বাকিরা সবাই বাঙ্কারে ছিল।”
“এই দিকে। এটা দিয়ে নীচে নামতে হবে।” মাটির সঙ্গে মিশে আছে একটা ধূসর রঙের ঢাকনা। একটা ম্যানহোল কভার। মহিলাটি ঢাকনাটা ঘুরিয়ে খুলে ফেললেন। বললেন, “ঢুকে পড়ুন।”
সোনারাম নিজে নিজেই নামতে পারলেন। সৈনিক দুজন আর সঙ্গী মহিলা তার পিছনে পিছনেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। সবাই নেমে আসতেই মহিলাটি ঢাকনা বন্ধ করে শক্ত করে জায়গা মতো খিল আটকে দিলেন।
“ভাগ্য ভালো যে আমরা আপনাকে দেখতে পেয়ে গিয়েছিলাম,” সৈনিক দুজনের একজন ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলে ওঠেন। “যা দেখলাম ওটা আপনাকে তো অনেক আগেই ট্যাগ করে ফেলেছিল।”
“একটা সিগারেট ছাড়ুন দেখি এদিকে,” মহিলাটি হাত বাড়িয়ে দিলেন। “বেশ কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল আমি ইন্ডিয়ান সিগারেট খাইনি।”
সোনারাম প্যাকেটটা তার দিকে ঠেলে দিলেন। মহিলা নিজে একটা সিগারেট নিয়ে প্যাকেটটা সঙ্গী দুই সৈন্যের হাতে দিয়ে দিলেন। ছোট্ট ঘরটার এক কোণে একটা আলো জ্বলে উঠল। নীচু ছাদের একটা ঘুপচি ঘর। তারা চারজন একটি ছোটো কাঠের টেবিলের চারপাশে বসলেন। একপাশে কয়েকটা নোংরা থালাবাসন জমে আছে। একদিকে একটা ছেঁড়া-ফাটা পর্দা। তার পিছনে আরেকটা ঘরের খানিকটা চোখে পড়ছে। সোনারাম সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন একটা খাটের একদিকের একটা কোণায় ভাঁজ করে রাখা কিছু কম্বল, আর দেয়ালের হুকে ঝোলানো খান কয়েক জামাকাপড়।
“আমরা তখন এখানেই ছিলাম,” তার ঠিক পাশেই যে সৈনিকটি বসেছিলেন, তিনি কথাটা বলতে বলতে মাথা থেকে হেলমেট খুলে নামিয়ে রাখলেন। একমাথা সোনালি চুল ঝাপটে বেরিয়ে পড়ল। সৈনিকটি হাত তুলে সেগুলো পেছনে ঠেলে দিলেন। “ওঃ হ্যাঁ, আমি কর্পোরাল মাইকেল ব্র্যাডলি। ব্রিটিশ। ব্রিটেন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর থেকেই মার্কিন বাহিনীতে আছি।” তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন মেজরের দিকে।
সোনারাম প্রথমে একটু ইতস্তত করলেন বটে, তবে হাত মেলাতে তারপরে আর খুব বেশি দেরি করলেন না। “মেজর সোনারাম হাঁসদা।”
“মার্কোস আলভারেজ।” দ্বিতীয় সৈনিক এবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ইনি পাতলা চুলের একজন ছোটোখাটো কালো মানুষ। দেখে মনে হচ্ছে একটু যেন নার্ভাস। কেমন যেন ঘাবড়ে রয়েছেন। কান চুলকোচ্ছেন বারবার। হাত-টাত মেলানো হয়ে গেলে বলে উঠলেন, “আমি আর্জেন্টিনার মানুষ। ভগবান জানেন কবে থেকে মার্কিন বাহিনীতে আছি। এখন তো আর মনেও পড়ে না। তবে হ্যাঁ, আমরা তিন জনেই তখন এখানে ছিলাম। আমি আর মাইক দুজনেই ছিলাম এই তাশির সঙ্গে।” হাত দিয়ে মহিলার দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। “আর এখানে ছিলাম বলেই বেঁচে গিয়েছি। বাকিরা তো সবাই বাঙ্কারে ছিল।”
“আর—সেই সময়ে ওরা ঢুকে পড়েছিল?”
আলভারেজ একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। “একটা। প্রথমে ওদের মাত্র একটাই ঢুকেছিল। ওই আপনাকে যেটা ট্যাগ করেছিল, ওই ধরনের একটা। তারপর ওটা বাকিদের ঢুকিয়ে নেয়।”
সোনারাম সজাগ হয়ে ওঠেন। “ওই ধরনের একটা? মানে আরও নানা ধরনের আছে নাকি?”
“ওই যে বাচ্চা ছেলে। রাফীদ। রাফীদ আর তার আঁকড়ে ধরা খেলনা ভালুক। এগুলো হল গিয়ে তৃতীয় প্রকারের। তবে সবচেয়ে কার্যকর।”
“ওটা তৃতীয় প্রকার? এরকম আর কত প্রকার আছে?”
আলভারেজ তার কোটের পকেটে হাত ঢোকায়। “দেখাচ্ছি।” সুতো দিয়ে বাঁধা বান্ডিল করা একটা ফোটোগ্রাফের প্যাকেট বের করে টেবিলের উপর ফেলে দেয় সে। “নিজেই দেখে নিন।”
সোনারাম বান্ডিলের গিঁট খুলতে শুরু করলেন।
“আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন,” মাইকেল ব্র্যাডলি বলতে শুরু করে, “কেন আমরা জরুরি ভিত্তিতে সন্ধিপত্র পাঠিয়ে কথা বলতে চেয়েছি। আমরা, মানে আমেরিকানরা। মাত্র এক সপ্তাহ আগে ব্যাপারটা প্রথম জানতে পারি আমরা। বলতে গেলে হঠাৎ করেই জানতে পারলাম যে আপনাদের নখরচক্রেরা এখন নিজেরাই নতুন ডিজাইনের পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করতে শুরু করেছে। অবিকল নয়, কিন্তু তাদের মতোই, তবে নতুন আকারের আর নতুন ধরনের। আরও উন্নত। তৈরি হচ্ছে আমাদের এলাকার বাইরে আপনাদের ভূগর্ভস্থ কারখানায়। আপনারাই ওদের নিজেদের মেরামত করার অধিকার দিয়েছেন। নিজেদের কপি তৈরি করতে সুযোগ দিয়েছেন। আর সেই সুযোগে ওরা নিজেদের আর উন্নত, আরও জটিল করতে শুরু করে দিয়েছে। এই সব কিছুই হয়েছে আপনাদের দোষে।”
সোনারাম ছবিগুলো পরীক্ষা করছিলেন। ছবিগুলো দেখে যা বোঝা যাচ্ছে যে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করে এই ছবিগুলো তোলা হয়েছে; বেশ ঝাপসা আর অস্পষ্ট ছবি সব। প্রথম কয়েকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাফীদকে। একটা ছবিতে রাফীদ একা একটা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। আরেকটা ছবিতে রাফীদের সঙ্গে আরেকজন রাফীদ। একটাতে তো তিন-তিনজন রাফীদ। সবাই হবহু একই রকম। প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে সেই জীর্ণ খেলনা ভাল্লুক।
সব ক-টা ছবি এমনই যে চেহারা দেখলেই মায়া হবে।
“বাকিগুলোও একবার দেখুন,” পাশ থেকে তাশি বলে ওঠে।
পরের ছবিটা আরও অনেকটা দূর থেকে তোলা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভয়ংকরভাবে আহত কোনো একজন সৈনিক পথের পাশে বসে আছে, তার একটা হাত স্লিং বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে, একটা পায়ের হাঁটুর নীচের অংশ নেই আর কোলের উপর একটা ক্রাচ রাখা আছে। তার পরেরটায় দুজন সেই একই আহত সৈনিক। দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি।
“এই যে এটাই হচ্ছে গিয়ে সেই প্রথম প্রকারের বৈচিত্র্য। আহত সৈনিক।” মার্কোস আলভারেজ হাত বাড়িয়ে ছবিটা তুলে নেয়। “ভালো করে দেখে নিন। আপনারা নখরচক্র বানিয়ে ছিলেন মানুষ মারার জন্য। খোঁজো-ধরো আর মারো। প্রতিটা পরের প্রজন্মের নখরচক্রগুলোকে তার আগেরটার চেয়ে আরও বেশি ভালো, আরও বেশি দক্ষ করে তৈরি করলেন আপনারা। যত দক্ষতা বাড়ছিল তত ওগুলো আমাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলতে শুরু করে দিচ্ছিল। ভাঙতে ভাঙতে আরও আরও কাছে চলে আসার মতো ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে ছিল। কিন্তু তারপরেও, দিনের শেষে ওগুলো ছিল শুধু একটা গোলকের মতো নানান ধাতু দিয়ে তৈরি অনুভবী যন্ত্র মাত্র। ধারালো ক্ষুরের মতো তাদের দাঁত, নখ আর শিং থাকলেও অন্য যে কোনো যন্ত্রের মতোই ওগুলোকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করা যায়। প্রাণঘাতী রোবট ওগুলো সবই, কিন্তু দেখলে চেনা যায়। বোঝা যায়। আর একবার দেখতে পেলে আমরা—”
“কিন্তু তারপর, এই প্রথম প্রকারের বৈচিত্র্য এসে আমাদের উত্তর দিকের গোটা দলটাকে শেষ করে দিয়েছিল,” মাইক ব্র্যাডলি এবার শুরু করে। “শেষ পর্যন্ত যতক্ষণে এদের একটাকে ধরা গেল, ততক্ষণে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গিয়েছে। তার থেকেও বড়ো কথা ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই ওরা পৌঁছে গিয়েছিল। আহত সৈনিক সব। তাদের কাতর অনুরোধ একটু শুধু আশ্রয়ের জন্য। আর করুণাবশত আমরা ওদের ভিতরে ঢুকতে দিয়ে দিলাম। আর ঢুকেই ওরা সব দখল নিয়ে নিল। ওদিকে যন্ত্রগুলোর খোঁজে তখনও আমরা বাইরে নজর রেখে বসেছিলাম… ”
মার্কোস আলভারেজ বলল, “তখন ভেবেছিলাম যে ওই নতুন বৈচিত্র্য শুধু একটাই। কেউ তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে পেছনে আরও নানান বৈচিত্র্য আসছে। এই পরের ছবিগুলো তখন সবে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমাদের দূতকে যখন আপনাদের কাছে পাঠানো হল, তখনও আমরা শুধু একটাই বৈচিত্র্যের কথা জানতাম। এই প্রথম ধরনেরটা—এক নম্বর বৈচিত্র্য। আহত সৈনিক। আমরা ভেবেছিলাম এটাই সব।”
“আপনাদের সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা তাহলে কারা ভাঙল—”
“বৈচিত্র্য নম্বর তিন—তৃতীয় বৈচিত্র্য। রাফীদ আর তার ভালুক। এটার কাজকারবার আরও দূর্দান্ত।” আলভারেজ তিক্তভাবে হাসল। “বাচ্চা দেখলেই তো সৈনিকদের দরদ উছলে ওঠে। বেচারারা বহুদিন ঘর ছাড়া কিনা! আমরাই ওদের নিয়ে এলাম। নিয়ে এসে পেট ভরে খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম। ওরা যে কী ভয়ংকর জিনিস সেটা তো আমরা তখন বুঝিনি। পরে বুঝতে পারলাম। অন্তত, যারা তখন বাঙ্কারে ছিল, তারা হাড়ে হাড়ে টের পেল।”
“আমরা এই তিনজনই শুধু ভাগ্যবান,” ব্রাডলি বলল। “আলভারেজ আর আমিও তার একটু আগেও ওখানেই ছিলাম—তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে ঘটনাটা ঘটার খানিক আগেই আমরা তাশির সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এই এটাই হচ্ছে তাশির সেই ঠেক।” সে দু-হাত ছড়িয়ে চারদিক দেখায়। “এই ছোটো সেলারটা। তারপর যখন আমরা এখানকার কাজকর্ম সেরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পাথুরে চাতলটায় পৌঁছেছি, তখন আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। তখনও ওরা ওখানেই। লড়াই তখনও চলছিল বাঙ্কারের চারপাশে। রাফীদ আর তার সেই খেলনা ভালুক। তাও একটা না, শত শত রাফীদ। প্রথমেই রাফীদের যে ছবিগুলো দেখলেন, সেগুলো আলভারেজ সেই সময়ে তুলেছে।”
মার্কস আলভারেজ তখন মাথা নীচু করে একমনে ফোটোগ্রাফগুলো আবার বান্ডিল করে বেঁধে নিচ্ছিল।
“আর এই সব তোমাদের গোটা এলাকা জুড়ে চলছে?” সোনারাম জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ।”
“আমাদের এলাকার অবস্থা কেমন?” কিছু না ভেবেই হাতের ট্যাবটা একবার ছুঁয়ে নিলেন। “ওরা কী—”
“আপনাদের এই রেডিয়েশন ট্যাবে ওদের কিচ্ছু আটকাবে না। এমনিতেও আপনি ইন্ডিয়ান না আমেরিকান, নাকি চাইনিজ কিংবা বৃটিশ, থোড়াই তাতে ওদের কিছু এসে যায়। ওদের কাছে সব সমান। ওরা ঠিক সেটাই করবে যে উদ্দেশ্যে ওদের বানানো হয়েছে। মূল উদ্দেশ্য পূর্ণ করাই ওদের একমাত্র কাজ। ওরা শুধু জিন্দা শরীর খুঁজে বেড়ায়। আর যেখানেই সেটা পাবে, সাঁ করে সেখানে পৌঁছে যাবে।”
“ওরা গরম ঠান্ডার ফারাক খোঁজে। লক্ষ্য জ্যান্ত শরীরের উষ্ণতা,” আলভারেজ বলে ওঠে। “আপনারা প্রথম থেকে এইভাবেই ওদের বানিয়ে ছিলেন। অবশ্য, আপনারা নিজেদের বাঁচাতে রেডিয়েশন ট্যাব বানিয়ে নিলেন। ওগুলো পরে থাকলে ওরা আটকে যায়। কিন্তু এখন ওরা সেটারও জবাব খুঁজে নিয়েছে। এই নতুন প্রজন্মেরগুলো সিসার আবরণে ঢাকা।”
“আর বাকি থাকা অন্য বৈচিত্র্যটা কী?” সোনারাম জিজ্ঞেস করলেন। “একটা তো হল রাফীদ ধরনের, একটা আহত সৈনিক—আর অন্যটা?”
“আমরা জানি না।” মার্কোস দেয়ালের দিকে ইশারা করল। দেয়ালে দুটো ধাতব পাত ঝোলানো রয়েছে, দুটোরই দু-প্রান্তে একটা করে ফুটো। সোনারাম উঠে গিয়ে ওগুলো দেখতে শুরু করলেন। দুটোই যেন চোট লাগা—বাঁকা আর টাল খাওয়া।
“বাঁ দিকেরটা একজন আহত সৈনিকের কাছ থেকে পাওয়া,” ব্র্যাডলি বলল। “আমরা ওদের একটাকে ধরতে পেরেছিলাম। ওটা তখন আমাদের পুরোনো বাঙ্কারের দিকে যাচ্ছিল। আমরা ওই পাথরের চাতাল থেকে ওটাকে ধরেছিলাম, ঠিক যেভাবে আপনাকে ট্যাগ করে আসা রাফীদটাকে উড়িয়েছি আমরা।”
ধাতব পাতটায় খোদাই করে I-V লেখা আছে। ফার্স্ট ভ্যারিয়্যান্ট। প্রথম বৈচিত্র্য। সোনারাম পাশের পাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “আর এটা ওই রাফীদের থেকে পাওয়া?”
“হ্যাঁ।”
সেটায় খোদাই করা আছে: III-V. থার্ড ভ্যারিয়্যান্ট—তৃতীয় বৈচিত্র্য।
আলভারেজ সোনারামের চওড়া কাঁধের উপর দিয়ে প্রায় ঝুঁকে পড়ে দেখছিল। এবার ধাতব পাত দুটো দেখিয়ে বলল, “আপনি নিজেই দেখে নিন আমাদের কাদের কাদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। দেখতে পারছেন তো যে এই দুটো ছাড়া অন্তত আরও একটা বৈচিত্র্য আছে। হতে পারে যে সেটা তেমন কাজের হয়নি বলে পরিত্যক্ত। তবে অবশ্যই দ্বিতীয় বৈচিত্র্য একটা কিছু থাকবে। এক আর তিন তো আপনি দেখতেই পেলেন।”
“আপনি কিন্তু মশাই ব্যাপক ভাগ্যবান,” ব্রাডলি মাথা নাড়ে, “রাফীদ আপনাকে সারাটা রাস্তা ট্যাগ করে চলে এল, কিন্তু স্পর্শ পর্যন্ত করল না। মনে হয় আশা করেছিল যে আপনি ওকে কোনো না কোনো একটা বাঙ্কারে বা ওইরকম কোথাও ঢুকে পড়তে সুযোগ করে দেবেন।”
“আর একটা কোনোভাবে ঢুকে পড়তে পারলেই তো সব শেষ,” মার্কোস বলে ওঠে। “মারাত্মক দ্রুত এদের গতি। একজন যদি কোনোভাবে ঢুকে পড়ে তো ব্যাস, হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি সবাইকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেবে। তেমনি দৃঢ়সংকল্প আর একরোখা। অভীষ্ট লক্ষ্যের প্রতি নিবেদিত প্রাণ যন্ত্র সব একেকটা। এদের তৈরি করাই হয়েছে একটাই মাত্র উদ্দেশ্যে।”
কপালে জমে ওঠা ঘাম মুছে নেয় সে। তারপর আবার বলে, “আমরা স্বচক্ষে তার প্রমাণ দেখেছি।”
সবাই চুপ করে রইল।
একটু পরে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে তাশি বলে ওঠে, “হাই ইন্ডি, আমাকে আরেকটা সিগারেট দিন দেখি। আপনাদের এই সিগারেটগুলো কিন্তু দারুণ। আমি তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে ওগুলো কেমন খেতে।”
***
এখন রাত নেমে এসেছে। আকাশ কুচকুচে কালো। পাক খেয়ে চলেছে ভাসমান ছাইয়ের মেঘেরা। মেঘে ঢাকা আকাশে একটাও নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না। মার্কোস খুব সাবধানে ঢাকনাটা উঠিয়ে ধরল যাতে সোনারাম বাইরেটা দেখতে পান।
মাইকেল অন্ধকারের মধ্যে একদিকে ইশারা করে দেখাল। “ওই যে—ওই দিক দিয়ে বাঙ্কারে যাওয়ার রাস্তা। যেখানে আমরা থাকতাম। আমাদের এখান থেকে আধ মাইলের বেশি হবে না। আমাদের ভাগ্য ভালো যে মার্কোস আর আমি তখন ওখানে ছিলাম না যখন ঘটনাটা ঘটে। লোকে আমাদের চরিত্রের দোষ দেবে। কিন্তু আমাদের এই দৈহিক চাহিদাই আজ আমাদের জান বাঁচিয়ে দিয়েছে।”
“বাকি সবাই নিশ্চিত মারা গিয়েছে,” মার্কোস আলভারেজ নীচু গলায় ফিসফিস করে। “এত তাড়াতাড়ি সব কিছু হয়ে গেল যে কিছুই করা গেল না। অথচ দেখুন, আজ সকালেই পেন্টাগন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল। আমাদের ফরোয়ার্ড কমান্ডকে তারা জানিয়েও দিয়েছিল। এমনকি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দূত আপনাদের উদ্দেশে রওনাও দিয়ে দিয়েছিল। আমরা তাকে আপনার এলাকার ভিতরে ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত পাহারা দিয়েছি। আমরাই তো তাকে কভার করছিলাম যতক্ষণ না সে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।”
“অ্যান্ড্রু রড্রিগেজ। আমরা দুজনেই তাকে চিনতাম। প্রায় ছ’টার কাছাকাছি সময়ে সে নিখোঁজ হয়। সূর্য তখন সবে উঠে এসেছে। তারপর দুপুর নাগাদ মার্কোস আর আমি ঘণ্টাখানেকের জন্য ছুটি পেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজন লুকিয়ে বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে পড়ি। কেউ অবশ্য লক্ষ রাখছিল না। আমরা সোজা এখানে চলে আসি। এদিকে আগে একটা ছোটো শহর ছিল। বেশ কিছু বাড়ি ছিল, রাস্তাঘাট সব কিছুই ছিল। এই সেলারটা ছিল একটি বড়ো খামারবাড়ির অংশ। আমরা জানতাম তাশি এখানে থাকবে। তার এই ছোট্ট জায়গায় লুকিয়ে থাকবে। আমরা আগেও এখানে এসেছি। বাঙ্কার থেকে আরও অনেকেই এখানে এসেছে। আজ ছিল আমাদের পালা।”
“আর তাই আমরা বেঁচে গেলাম,” মার্কোস বলে ওঠে। “আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল। আমাদের জায়গায় আজ অন্য কেউও থাকতে পারত। কিন্তু কপাল জোরে আজ আমরাই ছিলাম। আমরা—মানে, ইয়ে, অবশ্য এখানকার ব্যাপারটা শেষ করেই বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তারপর ফেরার পথে যখন টিলাটার ওপাশের পাথুরে চাতালে গিয়ে পৌঁছেছি, সেই সময় আমরা ওদের, মানে রাফীদদের দেখতে পেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বুঝতে পেরে গেলাম। আমরা অবশ্য আগেই প্রথম বৈচিত্র্য, মানে আহত সৈনিকের ছবি দেখেছিলাম যখন আমাদের কমিশনার ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যাসহ আমাদের জানিয়ে ছিলেন। আমরা যদি ওদের না খেয়াল করে আর মাত্র কয়েক পা এগিয়ে যেতাম, তাহলেই ওরা আমাদের দেখতে পেয়ে যেত। তাও তো আমাদের ফেরার পথে দু-দুটো রাফীদকে উড়িয়ে দিতে হয়েছিল। নইলে হয়তো ফিরতে পারতাম না। বাঙ্কারের চারপাশে তো তখন শ’য়ে শ’য়ে রাফীদ গিজগিজ করছিল—ঠিক পিঁপড়ের মতো। আমরা দূর থেকেই ওগুলোর ছবি তুলে নিয়েই এখানে আবার ঢুকে পড়লাম। তবে ঢোকার সময় অবশ্য ঢাকনাটা শক্ত করে আটকে দিতে আমরা কোনো ভুল করিনি।”
“তবে একটা ব্যাপার আমরা খেয়াল করেছি যে একটা একলা রাফীদ কিন্তু তেমন বিপজ্জনক নয়। আমরা তো ওদের চেয়েও জোরে দৌড়োতে পেরেছি। তবে ওরা কিন্তু লক্ষ্যে অটল আর অনমনীয়। ঠিক জীবন্ত প্রাণীদের মতো না। ঠিক যেন যন্ত্রের মতো সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। আর আমরাও সোজা গুলি চালিয়ে ওদের উড়িয়ে দিয়েছি।”
মেজর সোনারাম হাঁসদা সুড়ঙ্গে ঢোকার ঢাকনার কিনারায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চারপাশের নিকষ কালো অন্ধকার পরিবেশের সঙ্গে চোখের দৃষ্টি খাপ খাইয়ে নিতে চাইছেন তিনি। হঠাৎ তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন। “ঢাকনাটা এভাবে খোলা রাখা কি ঠিক হচ্ছে?”
“ঠিক কিনা জানি না। তবে সাবধান তো আমাদের থাকতেই হবে। কেননা এছাড়া আর কীভাবেই বা আপনি আপনার ট্রান্সমিটার ব্যবহার করবেন?”
সোনারাম তার বেল্টের থেকে ছোটো ট্রান্সমিটারটা ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে কানের কাছে চেপে ধরলেন। ধাতব শীতল আর স্যাঁতসেঁতে একটা স্পর্শানুভূতি। ট্রান্সমিটারের ছোটোখাটো অ্যান্টেনাটা উপরে তুলতে তুলতে তিনি মাইকে ফুঁ দিতে শুরু করলেন। এখন তার কানে আসছে শুধু একটা হালকা ভনভন শব্দ। তিনি সঙ্গীদের উদ্দেশে বললেন, “সেটা অবশ্য ঠিক, আমার নিজেরও তাই মনে হচ্ছে।”
বললেন বটে কিন্তু তারপরও তার অস্বস্তি রয়েই গেল।
মার্কোস খেয়াল রাখছিল। বলল, “চিন্তা করবেন না। যদি তেমন কিছু দেখি তাহলে আমরা আপনাকে টেনে ঢুকিয়ে নেব।”
“ধন্যবাদ।” মেজর হাঁসদা ট্রান্সমিটারটা কাঁধের উপরে রেখে সংযোগ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ কী ভেবে বলে উঠলেন, “আশ্চর্য ব্যাপার কিন্তু, তাই না?”
“কোনটা আশ্চর্য ব্যাপার?”
“এই, এত এত নতুন বৈচিত্র্য। নতুন নতুন জাতের নখরচক্র। আমরা পুরোপুরি যেন তাদের দয়ায় বেঁচে আছি, তাই না? এর মধ্যেই হয়তো ওরা আমাদের বাঙ্কারেও ঢুকে পড়েছে। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে যে আমরা হয়তো বা একটা নতুন প্রজাতির উদ্ভবের সাক্ষী থাকছি। নতুন একটা প্রজাতি। বিবর্তন। মানুষের পরের ধাপ।”
মাইকেল ব্র্যাডলি প্রায় গর্জে ওঠে। “মানুষের উপরে আর কোনো প্রজাতি হতেই পারে না।”
“পারে না? কেন পারবে না? হয়তো এই আমরা এখন সেটাই দেখছি, মানব প্রজাতির অবসান আর নতুন এক প্রজাতির সৃষ্টি।”
“এরা কোনো জাতিও না, কোনো প্রজাতিও না। এরা শুধু যন্ত্র—মানুষ মারার যন্ত্র। হত্যার উদ্দেশ্যে যাদের সৃষ্টি করেছেন আপনারা। এরা শুধু সেটাই করতে পারে। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সৃষ্ট একটা যন্ত্র মাত্র।”
“সেরকমই হয়তো মনে হচ্ছে এখন। কিন্তু এর পরে কী হবে? যখন এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে? হতেই তো পারে যে যখন আর ধ্বংস করার মতো কোনো মানুষ বেঁচে থাকবে না, তখন এদের ভেতরে বর্তমানে সুপ্ত অবস্থায় থাকা যাবতীয় প্রকৃত সম্ভাবনাগুলো প্রস্ফুটিত হতে শুরু করবে।”
“আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন এরা সব জীবন্ত প্রাণী!”
“তাই নয় কী?”
সবাই চুপ করে যায়।
নীরবতা ভেঙে মাইকেল ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে, “না। এরা শুধুই যন্ত্র। এরা যতই মানুষের মতো দেখতে হোক না কেন, এরা আসলে শুধুই এক-একটা যন্ত্র।”
মার্কস আলভারেজ বাধা দেয়। “এসব ছেড়ে আপনি আপনার ট্রান্সমিটারটা ব্যবহার করতে শুরু করুন, মেজর। আমরা তো এখানে চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।”
ট্রান্সমিটারটা শক্ত করে ধরে মেজর সোনারাম হাঁসদা মাইকের সামনে মুখ রেখে কমান্ড বাঙ্কারের কোড উচ্চারণ করেন। একবার… দুবার… তিনবার। তিনি অপেক্ষা করছেন, কান পেতে আছেন। ওদিক থেকে এখনও কোনো সাড়া নেই। শুধুই নীরবতা। তিনি আবার ট্রান্সমিটারের তার-টার সাবধানে পরীক্ষা করলেন। সবকিছুই তো দেখা যাচ্ছে একদম ঠিকঠাক আছে।
“শেন!” তিনি আবার চেষ্টা শুরু করলেন। মাইকের সামনে মুখ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। “ক্যাপ্টেন শেন জিনলং, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?”
কোনো উত্তর এল না। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। ট্রান্সমিটারের গেইন যতটা বাড়ানো সম্ভব বাড়িয়ে দিলেন তিনি। আবার চেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু ফাঁকা স্ট্যাটিকের একটা কড়কড় আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। ওদিক থেকে এখনও সম্পূর্ণ নীরবতা।
“ওদিক থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছি না কেন কে জানে। হয়তো ওরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু কোনো কারণে ওরা উত্তর দিতে চাইছে না।”
“ওদের বলুন এটা জরুরি।”
“ওরা হয়তো ভাবছে আমাকে ফোন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তোমরা আমার উপরে জোর জবরদস্তি করছো।” তিনি আবার চেষ্টা করলেন। কোনো সাড়া না পাওয়া সত্বেও এখনও পর্যন্ত যা যা দেখেছেন আর শুনেছেন তার সংক্ষিপ্ত ধারাবিবরণী দিয়ে দিলেন। কিন্তু তারপরও মৃদু একটা কড়কড় আওয়াজ ছাড়া ফোনটা চুপ করেই রইল।
একটু অপেক্ষা করে মার্কোস বলে ওঠে, “অনেক সময় তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্য সম্প্রচার তরঙ্গ আটকে যায়। মনে হচ্ছে সেরকম কিছু হচ্ছে।” ওর বলার ভঙ্গিতে রীতিমতো একটা আফসোসের সুর।
সোনারাম ট্রান্সমিটারটা বন্ধ করে দিলেন। “কোনো লাভ নেই। উত্তর দিচ্ছে না। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ? হতে পারে। কিংবা এমনও হতে পারে যে ওরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু উত্তর দিতে চাইছে না। সত্যি বলতে কী, আমি হলেও হয়তো এরকমই করতাম যদি দেখতাম যে আমাদের দূত মার্কিন ঘাঁটি থেকে ফোনে কথা বলতে চাইছে! ওরা কেনই বা এমন ফোনের কথা শুনতে চাইবে। এখান থেকে আমি যাই বলি না কেন সেটা ওখানে বসে কেউ বিশ্বাস করবেই না। ভাববে সব বানানো গল্প। আমাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে। এখনও হয়তো আমার সব কথা ওরা শুনেছে, কিন্তু উত্তর—”
“কিংবা আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি।”
সোনারাম ঘাড় নাড়েন। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুকের ভেতর থেকে।
“মনে হয় ঢাকনাটা বন্ধ করে আমাদের ভেতরে ঢুকে যাওয়া উচিত। ফালতু ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানে হয় না।” মাইকেলকে দেখে মনে হচ্ছে ভালোরকম ঘাবড়ে গিয়েছে।
তাই করা হল। সবাই নীচে নামতে শুরু করেছে। মার্কোস ছিল সবার পেছনে। সাবধানে এদিকে ওদিকে দেখে নিয়ে সে ঢাকনাটা ভালো করে আটকে দিয়ে খিল তুলে দেয়। সবাই তারপর নেমে জড়ো হল রান্নাঘরের মধ্যে। এমনিতেই বদ্ধ জায়গা। এখন মনে হচ্ছে তাদের চারপাশের হাওয়া যেন ভারী হয়ে গিয়েছে।
“ওরা কী এত তাড়াতাড়ি সব কিছু শেষ করে দিতে পারে?” মেজর সোনারাম হাঁসদা যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। “আমি বাঙ্কার ছেড়ে বেরিয়েছি এই তো আজ দুপুরে। কতক্ষণ হবে—ঘণ্টা দশেক? কীভাবে ওরা এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল?”
“খুব বেশি সময় ওদের লাগে না। অন্তত প্রথমটা কোনোভাবে ঢুকে যাওয়ার পর তো নয়ই। তারপর তো বন্যার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপনি তো ভালো করেই জানেন ছোটো হলেও ওই নখরচক্রগুলো কী করতে পারে আর না পারে। একটার ক্ষমতাই কেমন যেন অবিশ্বাস্য। ওই ঘুরন্ত বাঁকানো ক্ষুরগুলো! ওঃ, অসম্ভব! পাগল করে দেওয়ার মতো।”
“হে ভগবান!” মেজর সোনারাম হঠাৎ উঠে পড়লেন। তাকে যেন উদ্ভ্রান্ত মনে হচ্ছে। তিনি উঠে গিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
“কী হল?” মার্কোস জানতে চাইল।
“মুন বেস! হে ঈশ্বর, যদি ওরা ওখানেও পৌঁছে যায়—”
“মুন বেস?”
মেজর হাঁসদা এবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন সামনের মানুষগুলো ভেদ করে দূরে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। “নাঃ, ওরা কোনোভাবেই চাঁদের ঘাঁটিতে পৌঁছতে পারে না। কীভাবেই বা ওরা ওখানে যেতে পারে? অসম্ভব, এ হতেই পারে না। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না।”
“এই মুন বেস মানে কী? আমরা একটা গুজব শুনেছি, কিন্তু সঠিক কিছু জানা নেই। আসলে জিনিসটা কী? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি যেন ভয়ংকর বিপদে পড়ে গিয়েছেন।”
“আমাদের সবকিছুই তো এখন চাঁদে। এখন ওখানই তো আমাদের সব কিছু আসে। আমাদের সরকারবা প্রশাসন বলতে যা কিছু, সবই তো এখন ওখানেই। চাঁদের মাটির নীচে। আমাদের সব লোকজন আর যাবতীয় কারখানা—সবই তো ওখানে। সে সবের ভরসাতেই আমরা এগিয়ে চলেছি। এখন এরা যদি কোনোরকমে পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পেয়ে যায়—”
“শুধু একটা পৌঁছে গেলেই হল। যেই একটা ঢুকে পড়বে, অমনি বাকিদের জন্য রাস্তা খুলে যাবে। তারপর তো শ’য়ে শ’য়ে, সব ক-টাই একরকম—হুবহু অবিকল। আপনার চোখে পড়লে বুঝতে পারতেন। একদম এক। পিঁপড়েদের মতো।”
তাশি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “ঠিক যেন বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্র, একটা আদর্শ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। সমস্ত নাগরিক বিনিময়যোগ্য।”
মার্কোস আলভারেজ গরগর করে ওঠে। বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট বিরক্ত। আর রেগেও গিয়েছে। “যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এত বকবক না করে আসল কথায় আসা যাক, নাকি? কথা হচ্ছে আমরা এখন কী করব?”
ঘরটার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পায়চারি করছেন মেজর সোনারাম হাঁসদা। ঘরটা ছোট্ট। ভেতরের বাতাস খাবার আর ঘামের গন্ধে ভরপুর। বাকিরা সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে তাশি হঠাৎ বলল, “আমি একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছি।” বলেই আর দাঁড়াল না। পর্দা সরিয়ে পাশের ঘরটায় ঢুকে গেল।
তাশি পর্দার আড়ালে চলে যেতে মাইকেল আর মার্কোস টেবিলটার ওপরে বসে পড়ল। তাদের দৃষ্টি এখনও সোনারামের দিকেই।
বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সোনারামের উদ্দেশে মার্কোস বলল, “এখন আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই করব আমরা। আপনাদের ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা তো কিছুই জানি না।”
সোনারাম মাথা নাড়লেন। কোনো উত্তর দিলেন না।
“এটা একটা সমস্যা।” মরচে পড়ে যাওয়া একটা পাত্র থেকে মাইকেল একটা কাপে টইটম্বুর করে কফি ঢেলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, “আমরা এখানে হয়তো আরও কিছুক্ষণের জন্য নিরাপদ, কিন্তু এখানে আমরা চিরকাল থাকতে পারব না। না আছে পর্যাপ্ত খাবার, না আর কেউ আছে যে আমাদের খাবার এনে দেবে।”
“কিন্তু আমরা যদি বাইরে যাই—”
“আমরা বাইরে বেরোলে দুটো সম্ভাবনা থাকবে। এক, ওরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলবে। কিংবা, দুই, যেটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, খানিকক্ষণ পরে আমাদের ধরে ফেলবে। যাই হোক না কেন, আমরা খুব বেশিদূর যেতে পারব না। আপনাদের কমান্ড বাঙ্কার কতদূরে, মেজর?”
“তিন থেকে চার মাইলের মতো।”
“তাহলে আমরা হয়তো পারব। আমরা চারজন। কাজেই চারজনে আমরা চার দিকে নজর রেখে এগোতে পারি। পেছন থেকে এসে ওরা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না। আমাদের তিনটে রাইফেল আছে। তিনটেই ব্লাস্ট রাইফেল। তাশি আমার পিস্তলটা নিয়ে নেবে।” মাইকেল তার বেল্টে টোকা দিয়ে দেখাল। “আমাদের কাছে খাবার না থাকতে পারে, বন্দুকের অভাব নেই। আমেরিকান সেনাবাহিনীতে ইদানিং জুতোর সরবরাহ কম হচ্ছিল, কিন্তু গুলির সরবরাহে কমতি নেই। আমরা চারজনই যেহেতু সশস্ত্র, কাজেই সম্ভাবনা হচ্ছে আমাদের একজন অন্তত আপনাদের বাঙ্কার পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। সেক্ষেত্রে সেই মানুষটা আপনি হলেই সবচেয়ে ভালো হবে, মেজর।”
“কিন্তু ওরা যদি ইতিমধ্যেই ওখানে পৌঁছে গিয়ে থাকে?” মার্কোস প্রশ্ন করল।
মাইকেল কাঁধ ঝাঁকায়। “তাহলে আর কী-ইবা করা যেতে পারে? সেক্ষেত্রে আমরা এখানেই আবার ফিরে আসব।”
সোনারাম পায়চারি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। “তোমাদের কী মনে হচ্ছে, যে ওরা এর মধ্যেই আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে?”
“সঠিক বলা মুশকিল। তবে সম্ভবত সেরকম কিছু হয়ে থাকতেই পারে। ওরা অসম্ভব ধরনের সংগঠিত। ভালো করেই জানে ওদের ঠিক কী করতে হবে। আর একবার ওদের কোনো একজন যদি কোনোভাবে ঢুকে পড়তে পারে, তো তারপর ওদের বাকিরাও পঙ্গপালের মতো সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লক্ষ্যে পৌঁছনোর সম্পর্কে ওরা রীতিমতো ওয়াকিবহাল, আর খুব তাড়াতাড়ি সেই লক্ষ্যে ওরা পৌঁছতে চাইছে। ওরা ওদের লক্ষ্য গোপন রাখতে চাইছে, আর সম্ভবত সেই জন্যই ওদের এত তাড়া। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা কাজ সেরে ফেলতে চায়। যাতে হতচকিত অবস্থায় আমরা কোনোরকম বাধার সৃষ্টি না করতে পারি।”
“আচ্ছা, এই তাহলে ব্যাপার,” সোনারাম বিড়বিড় করেন।
“মেজর?” পাশের ঘর থেকে তাশির গলা শোনা গেল।
সোনারাম পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলেন। “কী?”
ভেতরে তাশি একটা চৌকিতে গা এলিয়ে অলসভাবে শুয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “তোমার কাছে কি আর এক-আধটা ইন্ডিয়ান সিগারেট ইন্ডিয়ান বেঁচে আছে?”
সোনারাম ঘরটায় ঢুকে পড়লেন। চৌকির পাশে একটা কাঠের ছোটো টুল। সেটায় গিয়ে বসলেন তিনি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে নিলেন একবার। “না। সব শেষ।”
“দুঃখজনক খবর।”
“তুমি কোন দেশের মানুষ?” খানিকক্ষণ পর সোনারাম জিজ্ঞেস করলেন।
“তিব্বত।”
“তিব্বত? তুমি কীভাবে এখানে এসে পৌঁছলে?”
“এখানে? মানে? বুঝলাম না।”
“এই জায়গাটাকে এক সময় ফ্রান্স বলা হত। এটা নরম্যান্ডির একটা অংশ ছিল। তুমি কি আমেরিকান সেনাবাহিনীতে কাজ করো? না ওরা ধরে নিয়ে এসেছে?
“কেন?”
“এমনই, জানতে চাইছি।” তিনি তাশির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাশি বোধহয় ঘরটায় ঢুকেই তার কোট খুলে ছুঁড়ে ফেলেছিল। সেটা এখন দেখা যাচ্ছে খাটের শেষ প্রান্তে পড়ে আছে। মেয়েটি পূর্ণ যুবতী, বয়স কুড়ির কাছাকাছি আন্দাজ হচ্ছে। স্লিম চেহারা। তার লম্বা চুল এখন বালিশের উপর ছড়িয়ে আছে। তিনি যে খুঁটিয়ে দেখছেন সেটা লক্ষ করেও তাশি চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখ কালো আর বেশ বড়ো। দীঘল চোখের মেয়ে মনে হয় এদেরই বলা হয়।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাশি হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠল। “কিছু ভাবছেন আমাকে নিয়ে?”
“না। কিছুই না। তোমার বয়স কত?”
“আঠেরো।” তাশি চোখের পলক না ফেলে এক দৃষ্টিতে মেজরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাত দুটো ভাঁজ করে মাথার নীচে রাখা রয়েছে। তার পরনে আমেরিকান সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম। প্যান্ট আর শার্ট। গাঢ়-নীল। কোমরে মোটা চামড়ার বেল্ট। কার্তুজের পাউচ। মেডিসিন কিট।
“তুমি আমেরিকান সেনাবাহিনীতে আছো?”
“না।”
“তুমি এই ইউনিফর্ম কোথায় পেলে?”
সে কাঁধ ঝাঁকায়। মুখে একটা রহস্যময় হাসি।
“এটা আমি জোগাড় করেছি।”
“তুমি যখন এখানে এসেছিলে তখন তোমার বয়স কত ছিল?”
“ষোলো।”
“অত ছোটো?”
তাশির চোখ কুঁচকে যায়। “আপনি কি বলতে চাইছেন?”
সোনারাম চিবুকে হাত বোলাচ্ছেন। দাড়িগুলো খচখচ করতে শুরু করেছে। গতকালের পরে আর কাটা হয়নি। তিনি সরাসরি তাকিয়ে আছেন তাশির দিকে।
“শুধু যদি এই যুদ্ধটা না শুরু হত তাহলেই তোমার জীবন একদম অন্যরকম হতে পারত। ষোলো। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তুমি এখানে এসে পড়েছ। এইভাবে বেঁচে থাকার জন্য।”
“বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই করতে হয়।”
“কিছু মনে করো না যেন। আমি তোমাকে নৈতিকতা শেখাতে চাইছি না।”
“তোমার জীবনটাও তাহলে অন্যরকম হতে পারত,” তাশি বিড়বিড় করে বলে। সে নীচু হয়ে এক পায়ের জুতো খুলতে শুরু করে। ফিতে খোলা হয়ে গেলে হাত না লাগিয়ে পা ঝাড়া দিয়ে জুতোটা খুলে ফেলে। জুতোটা ছিটকে মেঝেতে গিয়ে পড়ে।
“মেজর, আপনি কী একটু পাশের ঘরে চলে যাবেন? আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“ও, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।” উঠে পড়লেন তিনি। তাশির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটাও একটা সমস্যা হবে। আমরা চারজন মানুষ। আর এই এইটুকু জায়গায় আমাদের থাকতে হবে। এখানে কি এই দুটোই ঘর?”
“হ্যাঁ।”
“এই সেলারটা আসলে কতটা বড়ো? এটা কি আগে আরও বড়ো ছিল? ধ্বংসাবশেষ নীচে কী আর কোনো ঘর ঠিক আছে? তাহলে তার মধ্যে থেকে এক-আধটা আমরা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।”
“থাকতে পারে। কিন্তু আমি ঠিক জানি না।” কোমরের বেল্ট ঢিলে করে নিল তাশি। খাটের উপর আরাম করে বসে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করল। “আপনি নিশ্চিত যে আপনার কাছে আর সিগারেট নেই?”
“উঁহু। আমার সঙ্গে শুধু একটাই প্যাকেট ছিল।”
“খুব বাজে ব্যাপার। তবে আমরা যদি আপনাদের বাঙ্কারে পৌঁছতে পারি তাহলে হয়তো ওখানে কিছু খুঁজে পেতে পারি।”
অন্য পায়ের জুতোটাও খুলে ছুড়ে ফেলল তাশি। হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচটা ধরে আরেকবার তাকাল সোনারামের দিকে। “শুভ রাত্রি।”
“তুমি এখন ঘুমোতে চাইছ?”
“ঠিক ধরেছেন। শুভ রাত্রি।”
ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। সোনারাম উঠে পড়লেন। পর্দা সরিয়ে রান্নাঘরে এসে ঢুকলেন।
ঢুকেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। স্তম্ভিত তিনি।
মাইকেল দেয়ালের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ঘামে বিজবিজ করছে সারা মুখ। একবার মুখটা হা করে আবার বন্ধ করে নিল মাইক। কোনো আওয়াজ বেরিয়ে এল না। মার্কোস দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার সামনে। একদম মুখোমুখি। তার হাতের পিস্তলের নলটা চেপে বসেছে মাইকেল পেটের উপরে। দুজনের কেউই একটুও নড়ছে না। মার্কোসের গোটা শরীর টানটান। হাতটা শক্ত করে বন্দুকটা চেপে ধরে আছে। ডানা ছড়ানো ইগলের মতো দেয়ালের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল।
“কী হচ্ছে কী এইসব—” সোনারাম বিড়বিড় করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মার্কোস তাকে বাধা দিল।
“শান্ত হন, মেজর। এদিকে আসুন। আপনার বন্দুকটা বের করে নিন। জলদি বন্দুক বের করুন।”
সোনারাম তড়িঘড়ি তার পিস্তল বের করে নিলেন। এখনও কিন্তু ঠিক করে কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। “কী হচ্ছে কী এই সব?”
“তাগ করে রাখুন,” বলতে বলতে মার্কোস তাকে সামনে এগিয়ে আসতে ইশারা করে। “চলে আসুন আমার পাশে। তাড়াতাড়ি!”
মাইকেল এবার এতক্ষণে একটু নড়েচড়ে উঠল। হাত নামিয়ে নিল সে। সোনারামকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেয়েছে সে। তার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে জিব দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিল মাইকেল। এখন তার চোখ দুটো আবার চকচক করছে। কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গালের উপরে। সে স্থির নিবদ্ধ দৃষ্টিতে মেজর সোনারাম হাঁসদার দিকে তাকিয়ে আছে এখন। “মেজর, ও পুরো পাগল হয়ে গিয়েছে। দয়া করে ওকে থামান।” তার গলা থেকে বেরিয়ে আসা আওয়াজ এখনও ঘ্যাসঘ্যাসে আর মৃদু। এতটাই যে প্রায় যেন শোনাই যাচ্ছে না।
“কী হচ্ছে এসব?” সোনারাম জানতে চাইলেন।
মার্কস ওর হাতের পিস্তল না নামিয়েই উত্তর দিল। “মেজর, একটু আগে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছিলাম মনে আছে আপনার? সেই তিন রকমের বৈচিত্র্য? যাদের এক আর তিনের সম্পর্কে অনেক কিছুই আমরা এখন জানি। জানতাম না শুধু দু নম্বর নম্বরের সম্পর্কে। দ্বিতীয় বৈচিত্র্য। অন্তত, একটু আগেও আমরা কিছুই জানতাম না।”
মার্কোসের হাতের আঙুলগুলো বন্দুকের বাটটার চারপাশে যেন আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল।
“আগে জানতাম না বটে, কিন্তু এখন আমরা জানি।”
সে ট্রিগার চেপে দিল। বন্দুক থেকে উজ্বল সাদা আগুনের ঝলকানি বেরিয়ে এসে মাইকেলের শরীরের উপরে বিস্ফোরিত হল। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় মাইকেলের শরীরটা ঢেকে গেল।
“মেজর, এই হচ্ছে সেই দ্বিতীয় বৈচিত্র্য।”
পর্দা সরিয়ে তাশি এসে ঘরটায় ঢোকে। “মার্কোস, এটা তুমি কী করলে?”
মার্কোস তখনও দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে ছিল। মাইকেলের জ্বলন্ত শরীরটা ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছে। একটু পরেই পোড়া শরীরটা দেয়াল ঘেষে ধীরে ধীরে মেঝেতে পড়ে গেল। মার্কোস তখনও সেদিকেই তাকিয়ে আছে। “তাশি, এই দ্যাখো সেই দ্বিতীয় বৈচিত্র্যের স্বরূপ। এখন আমরা সব ক-টা বৈচিত্র্যকেই চিনে ফেলেছি। আমাদের বিপদের সম্ভাবনা এখন অনেক কম। আমি—”
তাশি মার্কোসকে দেখছিল না। মার্কোসকে ছাড়িয়ে সে তখন তার বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে মাইকেলের পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর, কালো আংড়া হয়ে যাওয়া, তখনও পর্যন্ত ধোঁয়া ওঠা শরীরটার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর কিছু না পোড়া কাপড়ের টুকরোগুলোর দিকে।
“তুমি… তুমি ওকে মেরে ফেললে।”
“ওকে? উঁহু, বরং বলতে পারো ওটাকে। আমি নজর রেখে বসেছিলাম। মনে সন্দেহ একটা হচ্ছিল, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। অন্তত, আজকের আগে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আজকে এই সন্ধ্যাবেলায় আমি নিশ্চিত হলাম।”
মার্কোস এখনও উত্তেজিত। এখনও বিচলিত। নড়াচড়ায় একটা নার্ভাস হাবভাব। এখনও পিস্তলের বাটে হাত ঘষে যাচ্ছে। “আমাদের কপাল ভালো। বুঝলে? এখনও বুঝতে পারছ না? বড়ো জোর আর একটা ঘণ্টা! তারপরেই হয়তো এটা আমাদের—”
“তুমি নিশ্চিত তো?” তাশি তাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে যায়। গিয়ে উবু হয়ে বসে তাকায় সামনে পড়ে থাকা শরীরটার দিকে। তখনও পোড়া শরীরটার অবশিষ্টাংশ থেকে ধোঁয়া উঠে আসছে। তাশির মুখে একটা কঠিন ভাব।
“মেজর, আপনি নিজের চোখে দেখুন। এই যে হাড়। মাংস।”
মেজর সোনারাম এগিয়ে এসে তার পাশে নীচু হয়ে তাকালেন। সামনে পড়ে থাকা দেহাবশেষ অবশ্যই মানুষের দেহাবশেষ। পোড়া মাংস আর হাড়ের টুকরো, মাথার খুলির অংশ। লিগামেন্ট, ভিসেরা, রক্ত। দেয়ালের সামনে রক্তের একটা পুকুর।
তাশি শান্ত স্বরে উচ্চারণ করল, “কোন চাকা টাকা কিছুই নেই।” বলতে বলতে সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। “কোন চাকা নেই, যন্ত্রাংশ নেই, রিলে নেই। এ নখরচক্র নয়। এমনকি কোনো দ্বিতীয় বৈচিত্র্যও নয়।”
বুকের কাছে হাত দুটো জড়ো করে সে মার্কোসের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। “আশা করছি এই ঘটনার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা তুমি করতে পারবে।”
মার্কোস টেবিলের উপর উঠে বসল। তার মুখ থেকে হঠাৎ যেন সমস্ত রং মুছে গিয়েছে। দু-হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে। তার শরীরটা সে ক্রমাগত সামনে পেছনে পেন্ডুলামের মতো দোলাচ্ছে।
“জবাব তোমাকে দিতেই হবে।” তাশির হাতের আঙুলগুলো মার্কোসের কাঁধের উপর শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। “তুমি কেন এরকম করলে? ওকে মারলে কেন?”
“মনে হচ্ছে ও আতঙ্কে পাগল হয়ে গিয়েছে,” সোনারাম তাশির দিকে তাকালেন। “চারদিকে এই সব যা হয়ে চলেছে তাতে আমরা কিন্তু প্রত্যেকেই কম বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছি।“
“হতে পারে। না-ও হতে পারে।”
“তাহলে? তোমার কী মনে হচ্ছে?”
“আমার মনে হয় মাইকেলকে মেরে ফেলার কোনো বিশেষ কারণ আছে। একটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ।”
“কী সেই কারণ?”
“হয়তো মাইকেল গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু জেনে ফেলেছিল।”
মেজর সোনারাম তাশির ম্লান অথচ বিষণ্ণ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি বিষয়ে?”
“ওর বিষয়ে। মার্কোসের বিষয়ে।” তাশির কঠিন দৃষ্টি তখন মার্কোসের দিকে স্থির।
মার্কোসের আলভারেজ চকিতে মাথা উঠিয়ে তাকাল। তার দৃষ্টি এখন মেজর সোনারামের উপরে নিবদ্ধ। “আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন না ও কী বোঝাতে চাইছে। ও বলতে চাইছে আমিই সেই দ্বিতীয় বৈচিত্র্য। আপনি এবার বুঝতে পারছেন, মেজর? ও এখন চাইছে আপনি বিশ্বাস করুন যে আমি মাইকেলকে জেনে শুনে খুন করেছি। এটা আমি—”
“তাহলে তুমি নিজেই বলো যে ওকে মারলে কেন?” তাশি বাধা দেয়।
“আমি তো তোমাকে বললাম,” মার্কোস ক্লান্ত ভাবে মাথা নাড়ল। “আমি ভেবেছিলাম ও একটা নখরচক্র। আর আমি ভেবেছিলাম আমি সেটা ধরতে পেরে গিয়েছি।”
“কেন?”
“আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরেই ওকে নজরে রেখেছিলাম। আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা সন্দেহ জেগে উঠেছিল।”
“কেন?”
“আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন কিছু দেখেছি। কিছু একটা শুনেছি। আমি ভেবেছিলাম আমি—” সে হঠাৎ থেমে গেল।
“বলে যাও।”
“আমরা দুজনেই এই টেবিলে বসেছিলাম। তাস খেলছিলাম। তোমরা দুজন তখন অন্য ঘরে ছিলে। এখানে তখন সম্পূর্ণ নিস্তদ্ধতা। সেই সময় আমার মনে হল আমি যেন কিছু একটা শুনতে পেলাম—একটা অদ্ভুত ঘড়ঘড় আওয়াজ।”
মার্কোস চুপ করতেই ঘরটা আবার পুরো নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
“আপনি এই সব বিশ্বাস করছেন?” তাশি মেজর সোনারামের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ। আমার মনে হয় ও সত্যি কথাই বলছে।”
“আমার তা মনে হচ্ছে না। উলটে মনে হচ্ছে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যেই ও মাইকেলকে খুন করেছে।” ঘরটার এক কোণে একটা রাইফেল রাখা ছিল। তাশি এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে নেয়। রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে তাকাল মেজর সোনারামের দিকে। তার চোখে এখন সমর্থন আদায়ের একটা প্রচেষ্টা। “মেজর—”
“না।” মেজর সোনারাম মাথা নাড়েন।
“এসব পাগলামি এখনই বন্ধ কর। একজনই যথেষ্ট। ওর মতো আমরাও আতঙ্কিত, আমরা সবাই। এবার আমরাও যদি ওকে মেরে ফেলি তবে তো ও মাইকেলের সঙ্গে যা করেছে আমরাও সেটাই করছি।”
মার্কস চোখ তুলে তাকাল মেজর এর দিকে। তার দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। “ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমি ভয় পেয়েছিলাম। সে তো বুঝতেই পারছেন, তাই না? এখন এ-ও ভয় পাচ্ছে। ঠিক আমার মতোই। তাই এখন ও আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে।”
“না। আর কেউ কাউকে মারবে না।” যেন শেষ কথা বলে দিয়েছেন এমনভাবে কথা শেষ করে সোনারাম ঘরটার শেষ প্রান্তে থাকা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। “আমি উপরে যাচ্ছি। আরেকবার ট্রান্সমিটার চালু করে চেষ্টা করব। তারপরও যদি আমি যোগাযোগ না করতে পারি, তবে আগামীকাল সকালে আমরা আমাদের এলাকার উদ্দেশে রওনা দেব।”
মার্কোস তড়িঘড়ি উঠে পড়ল। “আমি আপনার সঙ্গে আসছি। যতটা পারি সাহায্য করব।”
***
রাতের হাওয়ায় হিমের পরশ। ধরিত্রী শীতল হচ্ছেন। মার্কোস ফুসফুস ভরে একটা লম্বা শ্বাস নেয়। মেজর সোনারামের সঙ্গে সেও সুড়ঙ্গ বেয়ে উঠে এসে এখন সেলারের বাইরের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সতর্ক সে। পা দুটো ফাঁক করে উদ্যত রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখে সতর্কতা আর কান সজাগ। সুড়ঙ্গের মুখে মেজর সোনারাম উবু হয়ে বসেছেন। হাতের ছোটো ট্রান্সমিটারটা চালু করছেন তিনি। একাগ্র চিত্তে টিউন করে করে একটা বিশেষ তরঙ্গ ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এখন ভাগ্যই ভরসা। কিছুক্ষণ পরে মার্কোস জিজ্ঞেস করল, “পেলেন কিছু?”
“এখনও না।”
“দেখুন চেষ্টা করে। ওদের জানান এদিকের অবস্থা।”
মেজর সোনারাম চেষ্টা চালিয়েই গেলেন। কিন্তু কোনো লাভ হল না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরে শেষ পর্যন্ত তিনি অ্যান্টেনা নামিয়ে দিলেন। “কোনো লাভ নেই। ওরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। অথবা ওরা আমার কথা শুনছে কিন্তু উত্তর দিচ্ছে না। আর নয়তো—”
“আর নয়তো তাদের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।”
“আমি আর একবার চেষ্টা করব।” মেজর সোনারাম ট্রান্সমিটারের অ্যান্টেনা আবার ওঠালেন। “জিনলং, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? উত্তর দাও!”
তিনি কান পেতে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু শুধু ঘড়ঘড় করে একটা আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। তারপরে হঠাৎ একটা খুবই মৃদু আওয়াজ ভেসে আসে—
“জিনলং বলছি।”
তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে। “জিনলং! তুমি জিনলং বলছ?”
“হ্যাঁ। জিনলং বলছি।”
মার্কস তার পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। “আপনার দলের লোক?”
“জিনলং, শোন। তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছ? ওই নখরচক্রগুলোর সম্পর্কে। তুমি কি আমার পাঠানো বার্তা পেয়েছ? তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?”
“হ্যাঁ।” ঘড়ঘড়ে শব্দের সঙ্গে সঙ্গে যেটুকু কথা ভেসে আসছে তা একদমই হালকা। ঠিকঠাক কিছুই শোনা যাচ্ছে না। যেটুকু শুনতে পেলেন তাতে তিনি কোনো অর্থ উদ্ধার করতে পারলেন না।
“তুমি আমার বার্তা পেয়েছ? বাঙ্কারে সব ঠিক আছে তো? ওদের কেউ ঢোকেনি তো?”
“সব কিছু ঠিক আছে।”
“ওগুলো কি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছে?”
কণ্ঠস্বর খুবই দুর্বল।
“না।”
সোনারাম মার্কোসের দিকে ঘুরে তাকালেন। “ওরা সবাই ঠিক আছে।”
“ওদের উপরে হামলা হয়েছে?”
“না।”
সোনারাম তার কানের কাছে ফোনটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলেন। “জিনলং, আমি তোমার কথা একদমই শুনতে পাচ্ছি না। তুমি কি চন্দ্র ঘাঁটিতে খবর দিয়েছ? ওরা কি জানেন? ওরা কি সতর্ক হয়েছেন?”
আর উত্তর নেই।
“জিনলং! শুনতে পাচ্ছো?”
কোনো আওয়াজ নেই।
সোনারাম ক্লান্তি বোধ করছেন, ইতিমধ্যেই তার মাথা ভার হয়ে উঠেছে। “আওয়াজ তো একদম শোনাই যাচ্ছে না. মনে হচ্ছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বাধা দিচ্ছে।”
মেজর সোনারাম আর মার্কোস দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছেন না। কিছুক্ষণ পরে মার্কোস বলে উঠল, “যার গলা শোনা গেল সে কি আপনার দলের লোক? গলাটা কার চিনতে পেরেছেন?
“গলার আওয়াজটা ঠিক স্পষ্ট ছিল না।”
“তার মানে আপনি নিশ্চিত নন?”
“না।”
“তাহলে তো এমন হতেই পারে যে—”
“আমি জানি না। তবে এটাও ঠিক যে এখন আর আমি কোনো কিছু নিয়েই নিশ্চিত নই। যাক গে, চল নীচে যাই। ঢাকনা যত তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেওয়া যায় ততই ভালো।”
ক্লান্ত শরীর আর অবসন্ন চিত্তে তারা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে নীচের সেলারের উষ্ণতার আশ্রয়ে ঢুকে পড়ল। মার্কোস সুড়ঙ্গের মুখ ঢাকনা শক্ত করে এঁটে দিল। তাশি অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। তার মুখ চোখ এখনও ভাবলেশহীন।
“কী, এবার ভাগ্য ফিরল?” তার গলার স্বর এখনও তেমনি ভাবলেশহীন। যেন প্রশ্ন করতে হয় বলে করা।
ওদের কেউই সেই প্রশ্নের জবাব দেয় না।
মার্কোস বরং আগের কথার খেই ধরে থেকে মেজরের উদ্দেশ্যে আবার সেই একই প্রশ্ন করে, “তাহলে? আপনার কী মনে হচ্ছে মেজর? আপনার কথার উত্তর কে দিল—আপনার কোনো অফিসার, না কি বজ্জাতগুলোর মধ্যেকার কেউ?”
“আমি জানি না।”
“তার মানে একটু আগেও আমরা যেখানে ছিলাম এখনও সেখানেই রয়ে গেলাম।”
সোনারাম মাথা নামিয়ে এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। ক্রমশ তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতে শুরু করল। একসময় তিনি বলে উঠলেন, “আমাদের যেতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে।”
“এমনিতেও এখানে আমাদের জন্য মাত্র কয়েক সপ্তাহের খাবার আছে। তাই, কাল হোক বা পরশু, শেষ পর্যন্ত আমাদের উপরে যেতেই হবে।”
“সে রকমই তো মনে যাচ্ছে।”
“কী হয়েছে?” বাধা দিয়ে তাশি আবার প্রশ্ন শুরু করে। “আপনি কি শেষ পর্যন্ত আপনাদের বাঙ্কারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেন? কী হল তারপর?”
মেজর সোনারাম তাশির ভাবলেশহীন মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। তারপর মার্কোসের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “হতে পারে আমার দলেরই কেউ ওপ্রান্তে ছিল। কিন্তু আবার এমনও হতে পারে যে সে ওদের মধ্যের কোনো একটা। তবে সে যেই হোক না কেন, আমরা কিছুতেই এখন আর এখানে বসে থাকতে পারি না।”
তিনি তার ঘড়িটা একবার দেখে নিলেন। তারপর মার্কোস আর তাশির দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলো ভেতরে ঢুকে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। আগামীকাল আমাদের সকাল সকাল উঠতে হবে।”
“সকাল সকাল?”
সোনারাম উদাসীনভাবে যেন নিজেকেই বলছেন এমন ভাবে বললেন, “নখরচক্রের দল এড়িয়ে ওদিকে পৌঁছনোর একমাত্র সুযোগ পেতে হলে আমাদের উচিত সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া।”
***
আজকের সকালটা একদম সতেজ আর ঝকঝকে পরিষ্কার। ফিল্ড গ্লাসের মধ্যে দিয়ে মেজর সোনারাম চারপাশের মাঠ-প্রান্তর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিলেন।
পাশ থেকে মার্কোস উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কিছু দেখা যাচ্ছে?”
“উঁহু।”
“আপনি কি আমাদের বাঙ্কারটা একবার খুঁজে দেখবেন?”
“কোন দিকে?”
“এই যে।” সোনারামের বাড়িয়ে দেওয়া ফিল্ড গ্লাসটা মার্কোস চোখে লাগিয়ে নিয়ে নব ঘুরিয়ে ঠিকঠাক করছিল। “আমি জানি কোন দিকে দেখতে হবে।” অনেকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে রইল সে। মুখে কোনো কথা নেই।
তাশি সুড়ঙ্গের মাথায় বেরিয়ে এসেছে। মাটিতে পা রেখে সে জিজ্ঞেস করল, “কিছু চোখে পড়ছে?”
“না।” মার্কোস ফিল্ড গ্লাসটা ফিরিয়ে দেয় মেজরের হাতে। “ওরা সবাই চোখের আড়ালে কোথাও আছে। চলে এসো। চলুন মেজর, এখানে থাকলে আমাদের চলবে না।”
তিনজনেই এবার একসঙ্গে চলতে শুরু করেছে। টিলাটার পাশের দিক দিয়ে নরম ছাইয়ের উপর দিয়ে ঘষটে নীচে নেমে আসছিল তারা। চ্যাটালো একটা পাথরের উপর দিয়ে একটা গিরগিটি চকিতে ছুটে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই থেমে গেল। স্থির। শ্বাস প্রায় বন্ধ।
“ওটা কী ছিল?” মার্কোস ফিসফিস করে বলল।
“একটি গিরগিটি।”
যে গিরগিটিটা দৌড়ে এসেছিল সেটা ইতিমধ্যেই ছাইয়ের স্তূপের ভেতরে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। অদ্ভুতভাবে ওটার গায়ের রংটাও হুবহু ছাইয়ের মতো একরকম।
অদৃশ্য গিরগিটিটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মার্কোস বলে ওঠে, “কী ভয়াবহ নিখুঁত অভিযোজন! তবে কী আপনাদের ওই রাশিয়ান লাইসেঙ্কো যা বলেছিল সেটাই ঠিক? আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এটা প্রাকৃতিক নির্বাচন।”
টিলার নীচে পৌঁছে তারা থেমে গেল। তিনজনেই এখন নিজেদের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। সবাই চারপাশটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে।
“চলো, এগোনো যাক,” সোনারাম এবার আবার হাঁটতে শুরু করলেন। “আমাদের কিন্তু অনেকটা লম্বা রাস্তা যেতে হবে। আর তার পুরোটাই পায়ে হেঁটে।”
মার্কোস তার পাশেপাশে হাঁটতে শুরু করল। তাশি হাঁটছে তাদের খানিকটা পেছনে। তার হাতের পিস্তল সজাগ। শূন্যে উদ্যত।
কিছুক্ষণ হাঁটার পরে মার্কোস বলল “মেজর, আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলাম।” সোনারাম হাঁটা থামালেন না। শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মার্কোসের দিকে তাকালেন একবার। মুখেও কিছু বললেন না।
মার্কোস বলল জিজ্ঞেস করল, “ঠিক কোথা থেকে ওই রাফীদটা আপনার পেছনে জুটে ছিল? মানে, ওই যে রাফীদটা আপনাকে ট্যাগ করে ছিল সেটার কথা বলছি।”
“এদিকেই কোথাও। এখানে আসার পথে ওটাকে পেয়েছিলাম। কোনো একটা ধ্বংসাবশেষের আশপাশে।”
“আপনাকে ঠিক কী গল্প শুনিয়ে ছিল ওটা?”
“তেমন কিছু না। মোদ্দা বলে ছিল যে ও নাকি একদম একা। অনেকদিন থেকেই একা একা বেঁচে আছে।”
“ওটা যে আসলে একটা যন্ত্র, সেটা আপনি বুঝতেই পারেননি না? আচ্ছা, ওটা কী জ্যান্ত মানুষের মতোই কথা বলছিল? ইয়ে… মানে, আপনার একবারও সন্দেহ হয়নি?”
“তেমন বেশি কথা তো কিছু হয়নি। আর যেটুকু যা হয়েছে তাতে অস্বাভাবিক কিছু তো আমার নজরে পড়েনি।”
“সত্যিই আশ্চর্য ব্যাপার, এই যন্ত্রেরা এতটাই মানুষের মতো যে আমাদের বোকা বানানো কোনো ব্যাপারই না। একদম যেন জ্যান্ত। আমি তো আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি শুধু এটা ভেবেই যে এইভাবে চললে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কোথায় যে গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে।”
পেছনেই আসছিল তাশি। এতক্ষণ চুপচাপ হাঁটছিল। এবার বলে উঠল “ওরা তো ঠিক সেটাই করছে, ঠিক যে জন্যে এশিয়ানরা—মানে, আপনারা ওদের সৃষ্টি করেছেন। ওদের তো আপনারা সৃষ্টিই করেছেন জীবন্ত প্রাণ খুঁজে খতম করে দেওয়ার জন্য। সেটাই তো ওরা করছে। জীবন্ত মানুষ খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেখানে পাচ্ছে খতম করে দিচ্ছে।”
হাঁটতে হাঁটতেই মেজর সোনারাম ঘাড় বেঁকিয়ে মার্কোসকে আপাদমস্তক দেখছিলেন। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “তুমি আমাকে কেন এই সব জিজ্ঞেস করছ বলতো? তোমার মাথায় ঠিক কী চলছে?”
“কিছু না,” মার্কোস উত্তর দেয়।
“মার্কোস মনে করে হয়তো আপনিই দ্বিতীয় বৈচিত্র্য,” তাশি তাদের পিছন থেকে শান্তভাবে কথাটা ভাসিয়ে দেয়। “এখন ওর নজর আপনার উপরে।”
রোদে জলে তামাটে হয়ে আসা মার্কোসের মুখটা লাল হয়ে ওঠে। “না মনে করার কী আছে? আমরা একজন দূত পাঠিয়েছিলাম ইন্ডি লাইনে আর তার বদলে ফেরত এলেন ইনি। হয়তো ইনি ভেবেছিলেন যে খুব সহজেই শিকার করতে পারবেন।”
মেজর সোনারাম হেসে ফেললেন। পোড় খাওয়া সৈনিকের রুক্ষ নির্মম হাসি। “আমি আউফের বাঙ্কার থেকে এসেছি। সেখানে শুধু আমি না – আমার চারপাশের সবাই মানুষ।”
“হয়তো আপনি আমেরিকান এলাকায় ঢোকার সুযোগ খুঁজছিলেন। হয়তো আপনি ভেবেছিলেন যে এটা আপনার একটা বড়ো সুযোগ। হতে পারে আপনি-”
“আপনাদের এলাকা তো অনেক আগেই ওদের দখলে চলে গিয়েছিল। আমি যখন আমাদের বাঙ্কার ছেড়ে বেরিয়েছি তার আগেই তো ওরা আপনাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।এটা কিন্তু ভুলে যেও না।”
তাশি এবার পিছন থেকে এগিয়ে এল। “এতে কিছুই প্রমাণ হয় না, মেজর।”
“কেন হবে না?”
“বিভিন্ন বৈচিত্র্যগুলো মধ্যে সেরকম কোনো পারস্পরিক যোগাযোগ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। এমনিতেও প্রত্যেকটাই তো আলাদা আলাদা কারখানায় তৈরি হয়। এমনকি একসঙ্গে কাজ করে বলেও তো মনে হয় না। হতে পারে যে আমেরিকান এলাকার উদ্দেশ্যে আপনি যখন রওনা হয়েছিলেন তখন অন্য বৈচিত্র্যগুলোর কাজকর্ম বিষয়ে আপনি কিছুই জানতেন না। শুধু কাজকর্ম কেন, এমনও হতে পারে যে বাকি বৈচিত্র্যগুলো কোনটা কেযন দেখতে তাও আপনার জানা ছিল না।”
“তুমি এই নখরচক্র আর তাদের বিভিন্ন বৈচিত্র্য সম্পর্কে এত কিছু জানলে কিভাবে?” সোনারাম ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন।
“আমি তো দেখেছি। শুধু দেখিনি, বলতে পারেন পর্যবেক্ষণ করেছি। যখন ওরা আমেরিকানদের বাঙ্কারগুলোর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সময় তো খুবই কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।”
“তুমি তো অনেক কিছুই দেখেছ দেখছি,” মার্কোস অবাক চোখে তাশিকে দেখছিল। “তবে যাই বল আর তাই বল, তুমি যতটুকু যা দেখেছ খুব কম সময়ের জন্যে দেখেছ। অবশ্য আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এই দেখে যে তারপরেও তুমি এতটা বুঝতে পেরেছ। তোমার এই মারাত্মক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার তারিফ তো করতেই হবে।”
তাশি হেসে ফেলল। “তুমি কি এবার আমাকেও সন্দেহ করতে শুরু করলে?”
“এখন এই সব ফালতু কথা ভুলে যাও,” মেজর সোনারাম হাঁসদা সময় নষ্ট করতে চাইছেন না। এরপর আর কেউ কোনো কথা বলল না। তারা তিন জনে নীরবে পথ চলতে শুরু করে দেয়।
“আমরা কি পুরোটাই এভাবে পায়ে হেঁটে যাব?” বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পরে তাশি মুখ খুলল। “এতটা হাঁটার আমার অভ্যাস নেই।” দাঁড়িয়ে পড়েছে তাশি। দেখছে চারদিকটা। এখান থেকে যতদূর দেখা যাচ্ছে ততদূর পর্যন্ত মাঠ-ঘাট খেত-প্রান্তর ধ্বংসস্তূপ সবকিছুই ছাইয়ে ঢাকা। শুধু ছাই আর ছাই। “কী ভয়ংকর।”
“মনে হচ্ছে গোটা পথটা এই রকমই থাকবে,” মার্কোস দিগন্তের দিকে চোখ রেখে উত্তর দেয়।
“একেক বার আমার মনে হচ্ছে যে আক্রমণের সময় তুমি তোমার বাঙ্কারে থাকলেই ভালো হত।”
“আমি না হলে অন্য কেউ এখন তোমার সঙ্গে থাকত,” মার্কোস গজগজ করে ওঠে।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাশি মার্কোসকে দেখছিল তীর্যক দৃষ্টিতে। এখন মার্কোসকে গজগজ করতে দেখে হেসে ফেলল সে। মাথা নেড়ে বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছে।”
চারপাশের বিরাজমান নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত দিগন্ত বিস্তৃত ছাইয়ের বিশাল সমভূমির দিকে চোখ রেখে তারা আবার হাঁটতে শুরু করল।
***
সূর্য ইতিমধ্যে অস্তাচলে ঢলে পড়তে শুরু করেছে। মেজর সোনারাম ইশারায় মার্কোস আর তাশিকে তার পেছনে অপেক্ষা করতে বলে নিজে সামনের দিকে নজর রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন। মার্কোস তখন বন্দুকের কুঁদোটা মাটিতে ঠেকিয়ে তার উপরেই শরীরের ভর রেখে উবু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
তাশি এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা কংক্রিটের স্ল্যাব খুঁজে পেয়েছে। কটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে তার উপরে বসে পড়েই বলল, “একটু বিশ্রাম নিতেই হবে।”
“চুপ, চুপ,” মার্কোস হিস্ হিস্ করে ওঠে।
ওরা যেখানে বসেছে সেখান থেকে একটু এগিয়ে জায়গাটা ক্রমশ উঁচু হয়ে একটা ছাই ঢাকা ছোটোখাটো টিলার মতো হয়ে রয়েছে।
মেজর সোনারাম ইতিমধ্যেই টিলাটার প্রায় মাথার কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। এবার বুঝতে পারছেন এটাই হচ্ছে সেই টিলাটা, আগের দিনই যেটা পেরিয়ে আমেরিকান সৈনিকটি তাদের বাঙ্কারের দিকে নেমে এসেছিল। তিনিও এবার হাঁটু গেড়ে একটা আড়াল দেখে বসে পড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে শরীরটা নামিয়ে বুকে ভর দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে ফিল্ড গ্লাসটা চোখে লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন সামনে এখন ঠিক কী অবস্থা।
সেরকম কিছুই অবশ্য তার চোখে পড়ল না। শুধু ছাই ঢাকা ঢালু একটা প্রান্তর আর তারই মাঝে মাঝে দু-একটা গাছ। পরিচিত জায়গা। সামনেই, টিলার ঢালটা যেখানে নেমে গেছে সেখান থেকে পঞ্চাশ গজের মতো দূরে তাদের ফরোয়ার্ড কমান্ড বাঙ্কারের প্রবেশদ্বার থাকার কথা। যে বাঙ্কার থেকে তিনি গতকাল বেরিয়ে এসেছিলেন। সোনারাম সেদিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। কোথাও কোনো নড়াচড়ার আভাস নেই। জীবনের কোন চিহ্ন কোথাও নেই। অপরিবর্তনীয় স্থির দৃশ্যপট। কোথাও কোনো কিছুই নড়াচড়া করছে না।
বুকে হেঁটে শরীরটা ঘসটে ঘসটে মার্কোস তার পাশে এসে পড়ল। “কোথায় আপনাদের বাঙ্কার?”
“ওই যে নীচে, ওখানে।” সোনারাম তাকে ফিল্ড গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন। সন্ধ্যার আকাশ জুড়ে পাক খাচ্ছে ছাইয়ের মেঘ। পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসছে। তাদের হাতে বেশি সময় নেই। আর বড়ো জোর দু – এক ঘণ্টা আলো থাকবে। হয়তো তাও না।
“আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,” মার্কোস ফিল্ড গ্লাসটা ফেরত দিয়ে দেয়।
“ওই যে ওখানে। ওই গাছটা, গাছ ঠিক না, গাছের গুড়ি। পাশেই এক পাঁজা ইট ডাঁই করে রাখা আছে। বাঙ্কারের দরজা ঠিক ওই ইটের পাঁজার ডানদিকে।”
“আপনি যা বলবেন সেটা তো মানতেই হবে।”
“তুমি আর তাশি আপাতত এখানেই থাকো। আমাকে কভার দেবে। বাঙ্কারের দরজার মুখ পর্যন্ত গোটা পথেই আমাকে তোমরা সরাসরি নজরে রাখতে পারবে।”
“আপনি একাই নামবেন?”
“আমার কব্জিতে এই ট্যাবটা থাকায় আমার কিছু হবে না। এমনিতে বাঙ্কারের চারপাশে যতটা জায়গা চোখে পড়ছে পুরোটাই নখরচক্রদের জন্যে খোলা ময়দান। আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এই ছাইয়ের স্তরের ভেতরে ভেতরে ওরা জ্যান্ত কাঁকড়ার মতো ঘুরে বেড়ায়। এটাই ওদের চাঁদমারি। ট্যাব ছাড়া আপনারা কিছুতেই বাঙ্কার পর্যন্ত জ্যান্ত পৌঁছতে পারবেন না।”
“সম্ভবত আপনি ঠিকই বলছেন।”
“এমনিতে খুব ধীরে সুস্থেই হাঁটব আমি। তারপর যে মুহূর্তে আমি নিশ্চিত হব—”
“যদি ওগুলো কোনো ভাবে বাঙ্কারের ভিতরে ঢুকে গিয়ে থাকে তবে আপনি আর এখানে ফিরে আসতে পারবেন না। ওরা মারাত্মক দ্রুতগতি সম্পন্ন। আপনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা কাজ সেরে ফেলবে।”
“তোমার হিসেবে তাহলে কী করতে বলছো?”
মার্কোশ চিন্তা ভাবনা করে। “আমি জানি না। তবে আপনি ওদের বাইরে বেরিয়ে আসতে দিলে ভালো করবেন। তাহলে অন্তত দূর থেকেই আপনি ওদের দেখতে পেয়ে যাবেন।”
মেজর সোনারাম বেল্ট থেকে ট্রান্সমিটারটা টেনে বের করে আনলেন। অ্যান্টেনা ওঠাতে ওঠাতে বললেন, “তাহলে শুরু করা যাক এবার।”
মার্কোস তাশিকে ইশারা করল। অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে তাশি বুকে হেঁটে চড়াই বেয়ে ওরা যেখানে বসেছিল সেখানে উঠে এল।
“উনি একাই নামবেন,” মার্কোস চাপা গলায় কথা বলছিল। “আমরা এখান থেকেই ওনাকে কভার দেব। যেই দেখবে উনি ফিরে আসতে শুরু করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ওঁর পেছনের দিকে গুলি বৃষ্টি শুরু করবে। ওগুলো কিন্তু প্রচণ্ড গতিতে ধাওয়া করে আসে।”
তাশি ঢালের নীচের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার মার্কোসের দিকে চোখ তুলল। “তুমি মোটেও আশাবাদী নও দেখছি।”
“না আমি নই।”
মেজর সোনারাম হাতের বন্দুকের ব্রীচ খুলে সাবধানে পরীক্ষা করছিলেন। বললেন, “হয়তো সবকিছু ঠিক ঠাকই আছে।”
“আপনি ওগুলোকে দেখেননি। ওরা আসে শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে। সবগুলো এক রকম। পিঁপড়ের মতো গিজ্ গিজ্ করে আসে।”
“সব থেকে ভালো হত যদি না নামতে হত। যদি অত দূর না গিয়ে আমি এখান থেকেই খোঁজ খবর করতে পারতাম।” সোনারাম বন্দুকের ব্রীচ লক্ করে নিলেন। সেটা এক হাতে আঁকড়ে ধরে, অন্য হাতে ট্রান্সমিটার নিয়ে তিনি এবার তৈরি। “ঠিক আছে, আমার জন্য প্রার্থনা করুন।”
মার্কোস তার হাত বাড়িয়ে দিল। “আপনি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পুরো নীচে যাবেন না। এখান থেকেই আপনার লোকেদের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের জানান আপনি ফিরে এসেছেন।”
মেজর সোনারাম উঠে দাঁড়ালেন। চারদিক একবার দেখে নিয়ে পা বাড়ালেন ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া টিলার ধারের দিকের পথে।
এক মুহূর্ত পরে তিনি মরা গাছের গুঁড়ির পাশে সেই ইটের পাঁজা আর ধ্বংসাবশেষের স্তূপের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন। ওই দিকেই রয়েছে ফরোয়ার্ড কমান্ড বাঙ্কারের প্রবেশপথ।
কোথাও কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ছে না। তিনি ট্রান্সমিটারটা উঠিয়ে ধরলেন। একটা ক্লিক শব্দ করে ওটা চালু হল। “জিনলং? শুনতে পাচ্ছো?”
কোন আওয়াজ নেই।
“জিনলং! আমি মেজর হাঁসদা বলছি। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? আমি বাঙ্কারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ভিউ সাইটে দেখলেই তুমি এখন আমাকে দেখতে পাবে।”
ট্রান্সমিটারটা শক্ত করে কানের পাশে চেপে ধরে রইলেন তিনি। শোনার চেষ্টা করছেন। যা কিছু। সামান্য কোনো শব্দ। কিন্তু ট্রান্সমিটারটার স্ট্যাটিক কিড়কিড় ছাড়া এখনও আর কোনো শব্দ নেই। অনোন্যপায় হয়ে তিনি এবার সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। ছাই ঢাকা জমির মধ্যে থেকে একটা নখরচক্র বেরিয়ে এসে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কয়েক ফুট দূরে এসে ওটা থেমে গেল। থেমে গিয়ে প্রস্তর মূর্তির মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পেছনেই আরেকটা নখরচক্র হাজির হয়েছে। এটা সেই বড়ো চেহারারটা। যেগুলোর স্পর্শক আছে সেগুলোর একটা। এটা তার অনেকটা কাছে এগিয়ে এল। একদম সামনে। মনোযোগ দিয়ে তাকে পরীক্ষা করে তার পেছনে পেছনে চলতে শুরু করে দিল। কয়েক পা পেছনেই প্রভুভক্ত পোষা কুকুরের মতো আসছে এটা। এক মুহূর্ত পরে আরেকটা একই রকমের বড়ো নখরচক্র এসে ওটার জুড়িদার হয়ে চলতে শুরু করল। তিনি ধীরে ধীরে বাঙ্কারের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন আর নখরচক্রগুলো তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করছে।
সোনারাম থামলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তার পিছনে অনুসরণ করে আসা নখরচক্রগুলো থেমে গেল। তিনি এখন লক্ষ্যের কাছাকাছি এসে পড়েছেন। প্রায় বাঙ্কারের ঢোকার মুখটায়।
“জিনলং! তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? আমি এখন ঠিক তোমার মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে। বাঙ্কারের উপর। তুমি কি উত্তর দেবে না?”
কোনো উত্তর এল না। তবু অপেক্ষা করছেন তিনি। তার রাইফেল শূন্যে উদ্যত। ট্রান্সমিটারটা কানে চেপে ধরে আছেন। সময় পার হয়ে চলেছে। তিনি কান খাড়া করে আছেন। তার সমস্ত মনোযোগ এখন ট্রান্সমিটারে আবদ্ধ। কিন্তু সেটা নিস্তব্ধ। মৃদু একটা স্ট্যাটিক আওয়াজ ছাড়া সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। এখনও পর্যন্ত।
তারপর একটা আওয়াজ ভেসে এল। যেন বহু দূর থেকে আসছে। একটা ধাতব আওয়াজ—
“জিনলং বলছি।”
ভেসে আসা কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ আবেগহীন। শীতল। গলাটা তিনি ঠিকঠাক চিনতে পারলেন না। অবশ্য এটাও ঠিক যে ইয়ারফোনটাও খুবই সাধারণ।
“জিনলং! শোনো। আমি এখন ঠিক তোমার মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছি। এখানে ভূপৃষ্ঠে, বাঙ্কারের দরজার দিকে তাকিয়ে আছি।”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
“ভিউ সাইট দিয়ে? ওটা তুমি আমার দিকে ঘুরিয়ে রেখেছ তো?”
“হ্যাঁ।”
মেজর সোনারাম গোটা ব্যাপারটা আর একবার পুরো ভেবে নিলেন। ইতিমধ্যে নখরচক্রদের একটা বড়োসড়ো দল গোল হয়ে তার চারদিকে ঘিরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ধূসর ধাতুর শরীরগুলো স্থির আর শান্ত। অপেক্ষা করছে তারা।
“বাঙ্কারের খবর কী? সব ঠিক আছে তো? অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে নাকি?”
“সব ঠিক আছে।”
“তুমি কি একবার ওপরে আসবে? সামনাসামনি কথা বলার আছে।” সোনারাম গভীর একটা শ্বাস নিলেন। তারপর আবার বললেন, “বাইরে এসো তুমি। তোমার সঙ্গে কিছু দরকারি কথা বলার আছে।”
“আপনি নীচে চলে আসুন।”
“আমি তোমাকে বাইরে আসতে আদেশ করেছি।”
আবার চুপ।
“তুমি কি আসছ?” সোনারাম কান খাড়া করে আছেন। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। “আমি তোমাকে বাইরে আসার নির্দেশ দিচ্ছি।”
“আপনি নীচে আসুন।”
মেজর সোনারামের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বলেন, “লেফটেন্যান্ট লাখন সিং কোথায়? ওকে দাও। আমি লাখনের সঙ্গে কথা বলব।”
এবার আবার একটা লম্বা সময় ওদিক থেকে কোনো উত্তর নেই। সোনারাম চুপচাপ স্ট্যাটিকের আওয়াজ শুনে যাচ্ছেন। তারপর এল একটা গলার আওয়াজ, কর্কশ অথচ মৃদু। তবে সেই ধাতব আওয়াজ। ঠিক আগের জনের গলার মতো একই রকম। “এই যে আমি লাখন বলছি।”
“মেজর সোনারাম বলছি। আমি ওপরে আছি। বাঙ্কারের দরজার সামনে। আমি চাই তোমাদের মধ্যে কোনো একজন এখানে এসো।”
“আপনি নীচে আসুন।”
“আমাকে কেন নীচে আসতে হবে? আমি তোমাদের একজনকে বাইরে আসতে আদেশ করছি!”
নীরব হয়ে গেল ট্রান্সমিটার। সোনারাম ট্রান্সমিটারটা নামিয়ে নিলেন। তিনি আরেকবার তার চারপাশের পরিস্থিতি মনোযোগ দিয়ে দেখে নিচ্ছেন। বাঙ্কারে ঢোকার মুখটা ঠিক তার সামনে। প্রায় তার পায়ের কাছে। তিনি অ্যান্টেনা নামিয়ে নিয়ে ট্রান্সমিটারটা তার বেল্টে বেঁধে নিলেন। এবার সাবধানে, তিনি তার রাইফেলটা দু-হাতে চেপে ধরলেন। তিনি এক-পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। যদি ওরা তাকে নজরে রেখে থাকে তবে ওরা বুঝে নেবে যে উনি প্রবেশদ্বারের দিকে এগোতে শুরু করেছেন। তিনি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলেন।
তারপর চোখ খুলেই তিনি তার পা রাখলেন নীচে নামার সিঁড়ির প্রথম ধাপটায়।
দু’টো রাফীদ তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মুখ চোখ অবিকল একরকম। এবং অভিব্যক্তিহীন। তিনি দুটোকেই বিস্ফোরিত করে গুঁড়িয়ে দিলেন। নীচ থেকে আরও দলে দলে ছুটে আসছে রাফীদেরা। নিঃশব্দে। পুরো এক দঙ্গল রাফীদ। সব ক-টাই ঠিক একরকম।
মেজর সোনারাম পেছনে ঘুরে গেলেন। দৌঁড়োতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাঙ্কার থেকে দূরে সরে যেতে হবে। তিনি টিলার উদ্দেশে দৌঁড়োতে শুরু করলেন।
ইতিমধ্যেই টিলার উপর থেকে তাশি আর মার্কোস নীচের দিকে গুলি চালাতে শুরু করেছে। ছোটো নখরচক্রগুলো তার মধ্যে দিয়েই বানের জলের মতো ছাইয়ের প্রান্তর ভাসিয়ে ওদের দিকে ছুটে যেতে শুরু করেছে। চকচকে ধাতব গোলকগুলো প্রচণ্ড গতিতে ছাই উড়িয়ে উন্মত্তভাবে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবার মতো সময় তখন ছিল না তার কাছে। তিনি দ্রুত হাঁটু গেড়ে উদ্যত রাইফেল হাতে বসে পড়লেন। লক্ষ্য বাঙ্কারের প্রবেশপথের দিকে স্থির। কুঁদোটা তার গালে চেপে বসেছে। রাফীদরা দল বেঁধে বেরিয়ে আসছে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে। সবার হাতে তাদের সেই খেলনা ভাল্লুকগুলো আঁকড়ে ধরা। সরু ল্যাকপ্যাকে পা চালিয়ে রাফীদরা সব এক এক করে সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়েই সোজা ধেয়ে আসছে তার দিকে। মেজর সোনারাম একের পর এক গুলি চালিয়ে চললেন সরাসরি রাফীদগুলোর শরীর লক্ষ করে। সামনের ঝাঁকের রাফীদগুলো প্রথম চোটেই ফেটে গেল। গাদাগুচ্ছের সব চাকা আর স্প্রিং চার দিকে উড়ে বেড়াচ্ছে। উড়ন্ত সব টুকরো-টাকরার ধাতু আর প্লাস্টিকের কুয়াশা ভেদ করে তিনি আরও গুলি চালাতে থাকলেন।
একটা দৈত্যাকার চেহারা বাঙ্কারের প্রবেশপথের ঠিক মুখটায় এসে পৌঁছেছে। খুঁড়িয়ে হাঁটছে। অনেকটা লম্বা শরীর। হাঁটার তালে তালে দুলছে এদিক থেকে ওদিকে। সোনারাম থমকে গেলেন যেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। একটা মানুষ। সৈনিক। লোকটার একটাই পা। একটা ক্রাচের উপরে ভর দিয়ে এক পায়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
“মেজর!” তাশির গলা কানে আসে। আরও গুলিবর্ষণ করেন তিনি। বিশাল অবয়বটা এগিয়ে আসছে, তার চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে রাফীদেরা। চিত্রার্পিত অবস্থা থেকে মেজর সোনারাম জেগে উঠলেন। এ তো সেই প্রথম বৈচিত্র্য। আহত সৈনিক।
তিনি লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে গুলি চালালেন। বিস্ফোরণে সৈনিকটি সঙ্গে সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। অসংখ্য রিলে আর যন্ত্রাংশের টুকরো হাওয়ায় ছিটকে উঠল। এদিকে অসংখ্য রাফীদ এখন বাঙ্কারের সুড়ঙ্গ পথ থেকে বেরিয়ে বাইরের সমতল জমির উপরে এসে পৌঁছেছে। তিনিও এক নাগাড়ে কখনও দাঁড়িয়ে তো কখনও হাঁটু গেড়ে বসে স্থির লক্ষ্যে গুলি চালাতে চালাতে ধীরে ধীরে নিজেকে পিছিয়ে নিয়ে চলেছেন।
টিলার ওপর থেকে, মার্কোস নীচের দিকে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। টিলার এপাশের চড়াইয়ের দিকটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে নখরচক্রের দল চড়াই বেয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সোনারাম চড়াইয়ের দিকে পিছিয়ে চলেছেন। নীচু হয়ে দৌড়াচ্ছেন তিনি। তাশি এখন মার্কোসের পাস থেকে সরে গিয়েছে। ধীরে ধীরে আরও ডান দিকে সরে যাচ্ছে তাশি। টিলার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল সে।
একটা রাফীদ অনেকটা কাছে চলে এসেছে, তার ছোটোখাটো সাদাটে মুখটা ভাবলেশহীন, বাদামি চুলগুলো কপাল ঢেকে চোখের সামনে ঝুলছে। রাফীদটা হঠাৎ তার শরীরটা বাঁকিয়ে হাত ওঠালো। হাতের খেলনা ভালুকটা ছুড়ে দিয়েছে। মাটিতে পড়েই সেটা লাফিয়ে তার দিকে ঝাঁপ মারল। সোনারাম গুলি চালালেন। ভাল্লুক আর রাফীদ দুজনেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। সোনারাম দাঁতে দাঁত চেপে ক্লিষ্ট হাসি হেসে উঠলেন। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। সব যেন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
“এখানে উপরে!” ডান দিক থেকে তাশির গলা কানে আসে। সোনারাম তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাশি এখন দাঁড়িয়ে আছে ধ্বসে পড়া একটা বাড়ির ভগ্নপ্রায় দেয়াল আর ভেঙে পড়ে থাকা গোটা কয়েক কংক্রিটের স্তম্ভের আড়ালে। তার হাতে মার্কোসের দেওয়া পিস্তলটা। সেটা দিয়ে সে মেজর সোনারামকে পাশ কাটিয়ে গুলি চালাচ্ছে।
“ধন্যবাদ।” মেজর সোনারাম তাশির কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলছেন। তাশি তার কোমরের বেল্ট খুলতে খুলতে মেজর সোনারামকে কংক্রিটের আড়ালে টেনে নিয়ে এল।
“আপনার চোখ বন্ধ করুন!” সে তার কোমর বন্ধনী থেকে একটা গোলাকার কিছু বের করছে। দ্রুত হাত চালিয়ে সেটার ঢাকনাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ফেলে কিছু একটা টিপে দেয়। “চোখ বন্ধ করে নীচু হয়ে থাকুন।”
তাশি বোমাটা ছুড়ে দিল। বোমাটা একটা নিখুঁত বৃত্তচাপ বাতাসে এঁকে ঘুরপাক খেতে খেতে গিয়ে পড়ল ঠিক বাঙ্কারের প্রবেশদ্বারে। দুজন আহত সৈনিক তখনও ইটের পাঁজার কাছে অনিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে ছিলই। তাদের পিছন থেকে আরও এক ঝাঁক রাফীদ ঠিক তখনই বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এল। আহত সৈনিকদের মধ্যে একজন এক পায়ে ক্রাচে ভর দিয়ে দৃশ্যকটু কুৎসিত ভঙ্গিতে বোমাটার দিকে এগিয়ে এসে নীচু হল বোমাটা তোলার জন্য।
ঠিক সেই মুহূর্তে বোমাটা বিস্ফোরিত হল। বিস্ফোরণের আঘাতে সোনারাম একপাক ঘুরে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। তার শরীরের উপর দিয়ে গরম বাতাসের একটা ঝড় বয়ে গেল। অস্পষ্টভাবে তিনি দেখতে পেলেন একটা আধ ভাঙা স্তম্ভের পিছনে তাশি দাঁড়িয়ে আছে। দূরে বাঙ্কারের মুখে বিস্ফোরণ পরবর্তী সাদাটে আগুনের মেঘ বলয়। সেই আগুনের মধ্যে থেকে দু-একটা করে রাফীদ ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে। আর সেই রাফীদগুলোকে একটা একটা করে খুঁজে তাদের দিকে ঠান্ডা মাথায় তাশি গুলি চালিয়ে যাচ্ছে।
ওদিকে টিলার চড়াইয়ের ঢালে মার্কোস তখনও লড়ে যাচ্ছে। তাকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে নখরচক্রগুলোর একটা ঝাঁক। মার্কোস চেষ্টা করছে পিছিয়ে আসার। নখরচক্রগুলোর দিকে বৃষ্টির মতো গুলি চালাতে চালাতে সে পিছিয়ে চলেছে। চেষ্টা করছে নখরচক্রগুলোর বলয় ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়ার।
সোনারাম কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালেন। পায়ে জোর পাচ্ছেন না। মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। চোখেও কেমন যেন কম দেখতে পাচ্ছেন। সবকিছুই ঝাপসা ঝাপসা। গা-হাত-পা গোটা শরীরে একটা জ্বালা জ্বালা ভাব। চারপাশটা যেন প্রচণ্ড গরম হয়ে গিয়েছে। সব কিছু যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। সব শেষে টের পেলেন তার ডান হাতটা নাড়াতে পড়ছেন না।
তাশি তাকে টেনে নিয়ে চলেছে। “চলে আসুন। আমাদের যেতে হবে।”
সোনারাম টিলার দিকে তাকালেন। “মার্কোস—ও তো এখনও ওখানেই।”
“চলে আসুন!” তাশি মেজর সোনারামকে টেনে কংক্রিটের ভাঙা স্তম্ভগুলোর থেকে দূরে নিয়ে গেল। সোনারাম মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাভাবনা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলেন। তাশি তাকে দ্রুত দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি দেখলেন তাশির চোখ দুটো ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। তার চোখ এখন তীক্ষ্ণ নজরে বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পাওয়া নখরচক্রগুলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
একটা রাফীদ আগুনের ঘূর্ণায়মান মেঘের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল। তাশি তৎক্ষণাৎ ওটাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। বিস্ফোরিত হয়ে গেল রাফীদটা। আর কোনো রাফীদকে এখনও দেখা যাচ্ছে না।
“কিন্তু মার্কোস। ওর কি অবস্থা?” সোনারাম থেমে গেলেন। তাকে অস্থির মনে হচ্ছে। তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন। “ও—”
“চলে আসুন!”
পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করেছেন তারা। বাঙ্কার থেকে যত দূর সম্ভব তত দূরে সরে যাচ্ছেন তারা। কয়েকটা ছোটো নখরচক্র বেশ কিছুক্ষণ তাদের অনুসরণ করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত খানিকক্ষণ পরে হাল ছেড়ে দিয়ে তারা ফিরে চলে গেল।
অনেকটা দূরত্ব পেরিয়ে আসার পরে তাশি একসময় দাঁড়িয়ে পড়ল। “মনে হচ্ছে এবার এখানে আমরা খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারি। একটু দম না নিয়ে নিলে আর পারব না।”
জায়গাটায় একদা মানুষের ঘরবাড়ি ছিল। এখন ছাইয়ের প্রলেপে ঢাকা শুধু কিছু ধ্বংসাবশেষ। মেজর সোনারাম সেরকম কিছুরই একটা স্তূপের উপরে বসে পড়েছেন। হাঁপাচ্ছেন তিনি। হাঁপাতে হাঁপাতেই ঘাড় মুছলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমরা মার্কোসকে ওখানেই ফেলে এলাম।”
তাশি কোনো উত্তর দিল না। সে তখন তার পিস্তলটা খুলে ম্যাগাজিনে নতুন এক রাউন্ড তাজা বিস্ফোরক কার্তুজ ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
সোনারাম তাশির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মাথায় ভাবনাটা হঠাৎ চিড়িক মেরে জেগে উঠল। ভাবনাটা আসতেই তিনি যেন হতবাক হয়ে গেলেন। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে তাশির উদ্দেশে বলে উঠলেন, “তুমি ইচ্ছে করে ওকে ফেলে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছ। এর মধ্যে নিশ্চিত তোমার কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।”
তাশি কোনো জবাব দিল না। তবে হঠাৎ একসঙ্গে দুটো বন্দুকই এক ঝটকায় হাতে তুলে নিল। উদ্যত দু-দুটো বন্দুক হাতে সে এখন তাদের চারপাশের ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছু যেন খুঁজছে। তার মুখে অবশ্য কোনো অভিব্যক্তি দেখা গেল না। যেমন ভাবলেশহীন মুখে ওকে সাধারণত দেখা গেছে এখনও ঠিক সেরকমই। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে সে কিছু একটা যেন খুঁজছে।
“কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে নাকি?” তাশির তৎপরতা দেখে মেজর সোনারাম জানতে চাইলেন। “তুমি কী কিছু খুঁজছ? কেউ আসছে নাকি?” কোনো উত্তর নেই। তিনি মাথা নেড়ে তাশির দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোঝার চেষ্টা করছেন। কী করছে মেয়েটা? কিসের সন্ধান করছে? তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না। এখন যেখানে আছেন সেখানে তাদের চারপাশে শুধু ছাই, ছাই আর ধ্বংসাবশেষ। মাঝে মাঝে এক আধটা শুকনো আর পোড়া গাছের গুড়ি, শাখা-প্রশাখা বিহীন, পাতা বিহীন। “কী-”
কথাটা বলা শুরু করতেই তাশি তাকে বাধা দিল। “স্থির হয়ে থাকুন।” তার চোখ কুঁচকে গিয়েছে। হঠাৎ সে পিস্তলটা উঠিয়ে দূরে কোথাও তাগ করল। হতচকিত মেজর সোনারাম তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘোরালেন।
যেদিক দিয়ে তারা এখানে এসেছে, সেই দিকে একজন কাউকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অবয়বটার এগিয়ে আসছে তাদেরই দিকে। কিন্তু তার এগিয়ে আসার মধ্যে একটু যেন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেমন যেন অস্থির আর এলোমেলো ভাবে এগিয়ে আসছে। অবয়বটার মালিক যেই হোক না কেন তার পরনের জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে। আসছে খুব ধীরে ধীরে আর সাবধানে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে অবয়বটা। মাঝে মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়ছে। যেন বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া সামর্থ্য ফিরে পেতে চাইছে। একবার তো পড়েই গেল। পর মুহূর্তে আবার নড়বড় করতে করতে উঠে দাঁড়াল। তারপর আবার এগিয়ে আসতে শুরু করল।
মার্কোস।
মেজর সোনারাম ক্লান্ত অবসন্ন শরীরেও তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। “মার্কোস!” তিনি তার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলেন। “এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার—”
কথাটা পুরো শেষ করার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই কান ঘেঁষে বিস্ফোরণের আওয়াজ। তাশি গুলি চালিয়ে দিয়েছে। মেজর সোনারাম সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালেন। তাশি আবার গুলি চালাল। পিস্তলের ব্লাস্ট মেজর সোনারামের শরীরের একদম কাছ ঘেঁষে তাকে পেরিয়ে চলে গেল। মনে হল যেন গরম হাওয়ার একটা তীব্র স্রোত তাকে ছুঁয়ে চলে গেল। গুলি সোজা গিয়ে আঘাত করল মার্কোসের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে সে সম্পূর্ণ বিস্ফোরিত হয়ে গেল। ছোটো বড়ো বিভিন্ন আকৃতির গিয়ার আর চাকা উড়ে গেল চারদিকে। আরও কয়েক মুহূর্ত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন শরীরটা যেমন হাঁটছিল তেমনি হাঁটতে থাকল। তারপর শরীরটা যেন সামনে পেছনে দুলতে শুরু করল। একটু পরেই কাটা কলা গাছের মতো দড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার হাত দুটো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে ছিটকে পড়ল। সেই সঙ্গে আরও কতকগুলো চাকা গড়িয়ে গিয়ে ছড়িয়ে গেল।
এবার নিস্তবদ্ধতা।
তাশি এগিয়ে এসে দাঁড়ায় মেজর সোনারামের পাশে। “এখন বুঝতে পারছেন তো কেন ও মাইককে খুন করেছিল।”
মেজর সোনারাম আবার ধীরে ধীরে বসে পড়লেন। তিনি শুধু ক্রমাগত তার মাথা নাড়ছেন। তার বোধবুদ্ধি সব যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে। তিনি কোনো কিছুই আর ভাবতে পারছেন না।
“এখন নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছেন, নাকি?” তাশি মেজর এর কাঁধে স্পর্শ করে। “আপনি এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?”
মেজর সোনারাম কিছুই বলে উঠতে পারলেন না। চারপাশের সবকিছু যেন ঝড়ের গতিতে সাঁ সাঁ করে তার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। ঘন কৃষ্ণ এক অন্ধকার ঘূর্ণাবর্ত তাকে যেন তীব্র গতিতে ঘুরপাক খাইয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতল জলের গভীরে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
তিনি চোখ বন্ধ করে নিলেন।
মেজর সোনারাম চোখ খুললেন অত্যন্ত ধীরে ধীরে। তার সারা শরীরে এখনও ব্যথা। তিনি উঠে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু একটু নড়াচড়া করার চেষ্টা করতেই তার হাত আর কাঁধে যেন অসংখ্য সূঁচ ফোটার মতো একটা ব্যথা জেগে উঠল। তিনি কঁকিয়ে উঠলেন।
“এখনই ওঠার চেষ্টা করবেন না,” তাশি বাধা দেয়। নীচু হয়ে সে তার ঠান্ডা হাতটা মেজরের কপালে ছোঁয়ায়।
রাত এখন যথেষ্ট গভীর হয়েছে। ভাসমান ছাইয়ের মেঘের ফাঁকে ফোঁকর দিয়ে বেশ কিছু নক্ষত্র আকাশে জ্বলজ্বল করছে দেখা যাচ্ছে। মেজর সোনারাম দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে রইলেন। তাশি নিঃশব্দে তাকে লক্ষ করে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যেই সে কিছু কাঠ আর আগাছা জোগাড় করে তাই দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে ছিল। একটা সসপ্যান এখন সেই আগুনের উপরে ঝুলছে। নীচে ধিকি ধিকি করে জ্বলছে আগুন। কাঠ-কুটো ফাটার একটা চড়-চড় শব্দ। আর অগ্নিকুণ্ডের উপর ঝুলে থাকা ধাতব সসপ্যান থেকে বেরিয়ে আসা একটা হিস-হিস শব্দ। এছাড়া চরাচর ঢাকা অন্ধকারে আর সবকিছু যেন নিস্তব্ধে অপেক্ষা করছে। দপদপ করতে থাকা অস্থির অগ্নিশিখার ওপাশে শুধু নিথর নিস্তরঙ্গ অন্ধকার।
“তাহলে ও-ই ছিল দ্বিতীয় বৈচিত্র্য,” সোনারাম যেন নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠলেন।
“আমি প্রথম থেকেই সেরকম কিছু আন্দাজ করেছিলাম।”
“তবে আরও আগে কেন ওকে শেষ করে দাওনি?” তাশির কাছে জানতে চাইলেন তিনি।
“আপনিই তো আমাকে তখন আটকে দিলেন।”
তাশি অগ্নিকুণ্ডের সামনে থেকে উত্তর দেয়। ধাতব সসপ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আগুনে শিখায় তার ভাবলেশহীন মুখটা চকচক করছে। “কফি প্রায় তৈরি হয়েই এসেছে। আর একটু পরেই খাওয়ার মতো হয়ে যাবে।”
সে ফিরে এসে মেজরের পাশে বসল। এখন সে মনোযোগ দিয়ে তার পিস্তলটা খুলছে। মেজর ঘাড় কাত করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন। আশ্চর্য নির্বিকার মানসিকতার মেয়ে। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও তার মুখে চোখে ভয় বা ক্লান্তির কোনো লক্ষণ নেই। সেই একই রকম নির্বিকার একটা হাবভাব। যুদ্ধ এই প্রজন্মের মানুষের মধ্যে অনুভূতি নামের কোনো গুণাবলী বোধহয় তৈরিই হতে দেয়নি। নির্ণিমেষ মেজর সোনারামের অবাক চোখের সামনেই কোনো দিকে না তাকিয়ে তাশি এখন পিস্তলের ম্যাগাজিন আর ব্যারেল খুলে আলাদা করে ফেলেছে। সেগুলো এক এক করে চোখের সামনে তুলে ধরে অগ্নিকুণ্ডের থেকে যতটুকু আলো আসছে তাতেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।
“দারুণ একটা বন্দুক এটা,” তাশি হঠাৎ অর্ধস্ফুট স্বরে বলে ওঠে। “যেই বানাক, দুর্দান্ত বানিয়েছে।”
“আর ওগুলো কেমন? ওই নখরচক্রের দল?”
“বোম মারলে কিন্তু ওগুলো বেশির ভাগই অকেজো হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সূক্ষ্ম কারিগরীর কাজ, কিন্তু পলকা। তবে আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এমনিতে ওগুলো অত্যন্ত মারাত্মক ধরনের সংঘবদ্ধ।”
“রাফীদগুলোও?”
“অবশ্যই।”
“তোমার কাছে ওই সব বোমা এল কীভাবে?”
তাশি ঘাড় কাত করে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় সোনারামের দিকে। তারপর ঠোঁট উলটে বলে, “আমরাই এটা ডিজাইন করেছি। মেজর, তুমি কিন্তু আমাদের প্রযুক্তিকে দূর-ছাই করতে পারো না। এই রকম বোমা ছাড়া তুমি আর আমি এখন এখানে থাকতাম না।”
“সে ঠিক, কাজের জিনিস তো বটেই।”
তাশি তার পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দেয়। আগুনের তাপে তার পা গরম করছে। “আমার কিন্তু এটা ভেবে অবাক লাগছে যে মাইকেলকে মেরে ফেলার পরেও কেন আপনি বুঝতে পারেননি। কেনইবা আপনি তখন ভেবেছিলেন যে মার্কোস—”
“আমি তো তোমাকে তখন বলেছিলাম বলেই যেন মনে হচ্ছে। আসলে আমি ভেবেছিলাম যে মার্কোস আতঙ্কের চোটে ওই কাণ্ড করে ফেলেছে।”
“সত্যি? জানেন মেজর, একটা সময়ে তো আমি আপনাকেই সন্দেহ করতে শুরু করেছিলাম। যখন আপনি আমাকে ওকে খতম করতে দিলেন না। তখন ভেবেছিলাম আপনি নিজেও তাই বলেই ওকে বাঁচাতে চাইছেন।” কথাটা শেষ করে তাশি হাসে।
“আমরা কি এখানে নিরাপদ?” মেজর সোনারাম জানতে চাইলেন।
“কিছুক্ষণের জন্য। যতক্ষণ না ওরা অন্য কোনো জায়গা থেকে নতুন দলবল জোগাড় করতে পারছে।” তাশি একটা ন্যাকড়া দিয়ে বন্দুকের নলটা পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। সাফাই শেষ করে সে খোলা যন্ত্রাংশগুলো জায়গা মতো জুড়ে ম্যাগাজিনটা ঠেলে ব্যারেল আটকে দিল। সব শেষ করে এখন ব্যারেলের উপরে হাত বোলাচ্ছে তাশি।
“আমরা সত্যিই ভাগ্যবান,” মেজর সোনারাম মৃদু স্বরে উচ্চারণ করেন।
“হ্যাঁ। সত্যিই আমরা ভাগ্যবান।”
“আমাকে এত দূর বয়ে আনার জন্যেও অনেক ধন্যবাদ।”
তাশি কথাটার উত্তর দিল না। শুধু তাকিয়ে রইল বড়ো বড়ো চোখ মেলে। আগুনের আলোতে তার চোখ দুটো ঝকঝক করছে। সোনারাম বেশিক্ষণ সেই চোখের অপলক দৃষ্টির সামনে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজের হাত দুটো পরীক্ষা করতে। আঙুল নাড়াতে পারছিলেন না। মনে হচ্ছে পুরো অসাড় হয়ে গিয়েছে। শরীরের মধ্যেও একটা চাপা চিনচিনে ব্যথা।
“এখন কেমন লাগছে?” তাশি প্রশ্ন করল।
“মনে হচ্ছে আমার দুটো হাতই গেছে।”
“আর কিছু?”
“ভেতরেও চোট আছে মনে হচ্ছে।”
“বোমাটা ফাটার সময় আপনি তো পুরো লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়তেই পারলেন না।”
সোনারাম কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি শুধু তাশির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাশি সসপ্যান থেকে একটা কাপে কফি ঢালছে। তাশি কফি ভরতি কাপটা তার কাছে নিয়ে আসছে।
“ধন্যবাদ।” কফিটা খেতে কিন্তু যথেষ্ট ঝামেলা হল। মুখে নেওয়া পর্যন্ত সামলে নেওয়া গেলেও গিলতে প্রচণ্ড কষ্ট হল। তারপর যেই খানিকটা উষ্ণ তরল পেটে গিয়ে পৌঁছল, গোটা শরীর যেন তার মোঁচড় দিয়ে উঠল। তিনি কাপটা সরিয়ে দিলেন। “আর এখন খেতে পারব না।”
তাশি একাই বাকি কফিটা সময় নিয়ে শেষ করল। আরও কিছু সময় পার হল। মাথার উপরের অন্ধকার আকাশে ছাইয়ের মেঘেরা ভেসে ভেসে কোথায় কতদূরে চলে গেল। অবসন্ন সোনারাম বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তার মন এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। অনেকক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারলেন যে তাশি তার সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখছে।
“কী হয়েছে?” তিনি বিড়বিড় করলেন।
“এখন আপনার কেমন লাগছে?”
“মোটামুটি।”
“জানেন মেজর, আমি যদি আপনাকে টেনে নিয়ে না আসতাম তবে ওরা আপনাকে ধরে ফেলত। এতক্ষণে আপনিও মারা পড়তেন। মাইকেলের মতো।”
“আমি জানি।”
“আপনি কী জানতে চান না যে কেন আপনাকে বাঁচাবার জন্যে আমি এত কষ্ট করলাম? আমি তো আপনাকে ছেড়ে পালিয়ে আসতেই পারতাম। আপনাকে ওখানে ছেড়ে পালিয়ে এলে এতক্ষণে অনেক দূর চলে যেতে পারতাম। এতো পরিশ্রম করতেও হত না আমাকে।”
“সত্যিই তো, কেন তবে আমাকে শুধু শুধু টেনে আনতে গেলে?”
“কারণ আমাদের এখান থেকে শুধু দূরে না, অনেক দূরে সরে যেতে হবে।”
অগ্নিকুণ্ডটা ইতিমধ্যে নিভে আসতে শুরু করেছে। তাশি নির্বিকার মুখে সেদিকে তাকিয়ে একটা কাঠি দিয়ে অগ্নিকুণ্ডটা খোঁচাতে শুরু করে।
“এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারবে না। যখনই ওরা ওদের শক্তি বাড়িয়ে নিতে পারবে তখন আমাদের আর কোনো বাঁচার সুযোগ থাকবে না। আপনি যতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলেন ততক্ষণে আমি এ নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। ওরা ফিরে আসার আগে আমাদের হাতে সম্ভবত ঘণ্টা তিনেকের মতো সময় আছে।”
“আর তোমার ধারণা যে আমি চাইলেই আমরা অনেক দূরে চলে যেতে পারব?”
“সেটা ঠিক। আমার মনে হয় আপনি সাহায্য করলে আমরা দূরে কোথাও চলে যেতে পারব।”
“আমি ছাড়া পারবে না?”
“না। কারণ আমার অন্য আর কোনো উপায় জানা নেই।” তাশি সরাসরি মেজর সোনারামের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ আগুনের নিভু-নিভু আলোতে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তার অপলক চোখের তারা উজ্জ্বল। “আপনি যদি আমাদের এখান থেকে বের করতে না পারেন তবে ওরা আর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আমাদের মেরে ফেলবে। সামনে আর অন্য কোনো উপায় আমি কিছুই দেখছি না। বুঝতে পারছেন তো অবস্থাটা, মেজর? এবার বলুন আপনি কি করতে চাইছেন? আমি সারারাত অপেক্ষা করেছি। এতক্ষণ যখন আপনি অজ্ঞান হয়ে ছিলেন আমি এখানে বসে অপেক্ষা করছিলাম আর আপনার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনছিলাম। এখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। রাত প্রায় শেষ।”
সোনারাম গোটা বিষয়টি তলিয়ে ভেবে দেখলেন। “আশ্চর্য ব্যাপার,” শেষ পর্যন্ত এইটুকুই শুধু বললেন।
“আশ্চর্য ব্যাপার?”
“আশ্চর্য না? তুমি আগেই ধরে নিয়েছ যে আমি আমাদের দুজনকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারব। আমি কতটা কী করতে পারি বলে তুমি ধরে নিয়েছ সেটা ভেবেই আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।”
“আপনি আমাদের চাঁদের ঘাঁটিতে নিয়ে যেতে পারবেন না?”
“চাঁদের ঘাঁটিতে? কীভাবে?”
“কোনো না কোনো উপায় অবশ্যই থাকবে।”
সোনারাম মাথা নাড়লেন। “না। অন্তত আমার জানা কোনো উপায় নেই।”
তাশি কিছু না বলে চুপ করে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তার স্থির নজর যেন কেঁপে গেল। মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ উলটোদিকে ঘুরে গেল সে। তার পায়ে যেন আর জোর নেই। চলাফেরায় একটা নড়বড়ে ভাব। সে হাঁটুতে ভর দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। “আর একটু কফি?”
“না।”
“যা ভালো বোঝেন।” তাশি নিঃশব্দে কফি খেতে শুরু করল।
সোনারাম এখন তার মুখ আর দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাথা ঠিক কাজ করছে না, তবু মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেছিলেন। শরীরের এই অবস্থায় সঠিক চিন্তাভাবনা করা কঠিন। এখনও তার মাথায় ব্যথা হচ্ছে। সারা শরীরে একটা অসাড় ভাব। দৃষ্টি এখনও আবছা। সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আছে।
“একটা উপায় বোধহয় আছে,” তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন।
“তাই?”
“ভোর হতে কত দেরি আছে?”
“ঘণ্টা দুয়েকের মতো। সূর্য আর কিছুক্ষণ পরেই উঠবে।”
“এখানে কাছাকাছি কোথাও একটা জাহাজ থাকার কথা। আমি দেখিনি কখনও। কিন্তু আছে যে কোথাও সেটা আমি জানি।”
“কী ধরনের জাহাজ?” তাশির গলার স্বর আবার সেই আগের মতোই তীক্ষ্ণ।
“একটা ক্রুজার রকেট।”
“ওটা কী আমাদের নিয়ে উড়তে পারবে? চাঁদের ঘাঁটিতে পৌঁছে দিতে পারবে?”
“পারার তো কথা। এইরকম জরুরি অবস্থার জন্যেই ওটা রাখা।” আর পারছেন না ভাবতে। বেশি চিন্তা ভাবনা করতে গেলেই মাথায় ব্যথাটা বেড়ে যাচ্ছে। মেজর সোনারাম আঙুল দিয়ে কপাল টিপে ধরলেন।
“কিছু অসুবিধা হচ্ছে?”
“আমার মাথাটা। এটা খুব ঝামেলা করছে। ঠিক করে কিছু ভাবতেই দিচ্ছে না। জোর করে ভাবতে গেলেই—মাথা যেন ফেটে যাচ্ছে। বোমা ফাটার মতো।”
“জাহাজটা কী এখানেই কাছাকাছি কোথাও আছে?” তাশি তার কাছ ঘেঁষে পাশে এসে মাটিতেই বসে পড়ে। “এখান থেকে কত দূর? জায়গাটা কোথায়?”
“আমি মনে করারই চেষ্টা করছি।”
তাশির আঙুলগুলো সোনারামের হাতের মধ্যে চেপে বসে যায়। “কাছেই কোথাও?” তার গলার স্বর ইস্পাতের মতো কঠিন। “জায়গাটা কোথায় হতে পারে? মাটির নীচে কোথাও রাখা থাকতে পারে কি? ভূগর্ভস্থ কোনো গোপন জায়গায়?”
“ঠিক। ঠিক বলেছ তুমি।এবার মনে পড়ছে—একটা স্টোরেজ লকারে।”
“আমরা কীভাবে জায়গাটা খুঁজে বের করব? ওখানে কোনো মার্কা করা আছে? কিংবা চেনার মতো কোনো সংকেত?”
মেজর সোনারাম চোখ মুখ কুঁচকে ভাবার চেষ্টা করছেন। “না। কোনো মার্কা নেই। কোনো সংকেত টংকেতও কিছু নেই।”
“তাহলে?”
“শুধু একটা চিহ্ন।”
“কী রকম চিহ্ন?”
সোনারাম উত্তর দিলেন না। মনে করতে চেষ্টা করছেন। তাকিয়ে আছেন দূরের দিকে। তাকিয়ে আছেন কিন্তু যেন কিছুই দেখছেন না। দপ দপ করতে থাকা অগ্নিশিখার আলোয় তার চোখ দুটো চকচক করছে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে দুটোই যেন দৃষ্টিহীনের অক্ষিগোলক। তাশি গভীর আগ্রহে মেজরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার আঙুলগুলো মেজরের হাতে এমনভাবে চেপে বসেছে যেন ভেতরে ঢুকে যাবে।
“কী ধরনের চিহ্ন? কেমন সেটা?”
“আমি—আমার মনে পড়ছে না। আমাকে আরও খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে দাও।”
“ঠিক আছে।” তাশি সোনারামের হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সোনারাম মাটির উপরেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। তাশি তার কাছ থেকে সরে গিয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়াল। দুটো হাত পকেটে ঢোকানো। পায়ের সামনে পড়ে থাকা একটা পাথরের টুকরোয় লাথি মেরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। রাতের অন্ধকার ইতিমধ্যে ধূসর হয়ে যেতে শুরু করেছে। সকাল হয়ে আসছে।
পিস্তলটা শক্ত করে চেপে ধরে তাশি আগুনের কুণ্ডের চারদিকে চক্রাকারে হেঁটে চলেছে। পাশেই মাটির উপরে মেজর সোনারাম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। শ্বাস প্রশ্বাসের লক্ষণ টুকু ছাড়া তার শরীরের আর কোনো নড়াচড়া নেই। আকাশ হালকা হয়ে আসছে। ধূসরতা প্রথমে দেখা দিল দিগন্তের কাছে, তারপর দিগন্ত ছাড়িয়ে উপরে, আরও উপরে ক্রমশ বাড়তেই থাকল। ধীরে ধীরে চারপাশের ল্যান্ডস্কেপ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। যতদূর দেখা যাচ্ছে শুধুই ছাইয়ের প্রান্তর। শুধুই ছাই আর ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, এখানে-ওখানে কিছু ভাঙা দেয়াল, কংক্রিটের স্তূপ, শাখাপ্রশাখা পত্রবিহীন গাছেদের নগ্ন কাণ্ড।
বাতাস এখন বরফের মতো শীতল আর ক্ষুরের মতো ধারালো। দূরে কোথাও একটা পাখি অস্পষ্ট আওয়াজে ডেকে উঠল।
মেজর সোনারাম নড়েচড়ে উঠলেন। চোখ খুললেন তিনি। “ভোর হয়ে গেছে? এত তাড়াতাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
সোনারাম এবার উঠে বসলেন। “তুমি তখন কিছু জানতে চাইছিলে। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলে মনে হচ্ছে।”
“এখন মনে পড়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“চিহ্নটা কী?” তাশি উত্তেজনায় টগবগ করছে। “বলুন, বলুন। চিহ্নটা কী?” সে উত্তেজনায় একই প্রশ্ন আবার করে।
“একটা কুয়ো। একটা ধ্বসে যাওয়া কুয়ো। জাহাজটা ওই কুয়োর নীচের একটা স্টোরেজ লকারে থাকার কথা।”
“একটা কুয়ো।” তাশি হাঁফ ছাড়ে। তাকে অনেক নিশ্চিন্ত লাগছে এখন। “তাহলে আমাদের এখন আগে একটা কুয়ো খুঁজে বের করতে হবে।” সে হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। “আমাদের হাতে প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় আছে, মেজর। আপনার কি মনে হয় যে আমরা এই এক ঘণ্টার মধ্যে জায়গাটা খুঁজে পেয়ে যাব?”
“তাহলে তোমার হাতটা একটু বাড়াও,” সোনারাম এবার উঠে পড়ার উদ্যোগ করেন।
তাশি পিস্তলটা সরিয়ে রাখে। হাত বাড়িয়ে দেয় মেজর সোনারামের দিকে। তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। “আপনার পক্ষে হাঁটাহাঁটি সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
“হ্যাঁ, সেরকমই মনে হচ্ছে।” সোনারাম দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ব্যথা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। “তবে মনে হয় না আমাদের খুব বেশিদূর যেতে হবে না।”
আর দেরি না করে তারা হাঁটতে শুরু করল। সকালের কিশোর সূর্য এখনও ততটা তেতে ওঠেনি বলে তাদের খুব বেশি গরম এখনও লাগছে না। যে পথে তারা এখন হেঁটে চলেছে সেই জায়গাটা মোটামুটি সমতল এবং অনুর্বর। যতদূর তারা দেখতে পাচ্ছে ততটাই ধূসর আর প্রাণহীন। তাদের অনেক উপর দিয়ে দু-চারটে পাখি নিঃশব্দে আকাশে ধীরে ধীরে চক্কর দিচ্ছে।
“কিছু চোখে পড়ছে?” সোনারাম জিজ্ঞেস করলেন। “কোনো নখরচক্র?”
“না। এখনও চোখে পড়েনি।”
ইতিমধ্যেই তারা পেরিয়ে এসেছে একটার পর একটা ধ্বংসাবশেষ, অসংখ্য আধ ভাঙা কংক্রিটের দেয়াল, বেশ কিছু ভাঙাচোরা ইটের পাঁজা। মাঝে এক জায়গায় একটা লম্বা চওড়া সিমেন্টের তৈরি ফাউন্ডেশন-ও চোখে পড়েছে। মাঝে মধ্যে ইঁদুরেরা কিঁচ কিঁচ শব্দ করে এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে চলে গিয়েছে। আর তাশি তাই দেখে ভয়ে লাফিয়ে সরে গিয়েছে।
“এটা কোনো একদিন একটা জমজমাট শহর ছিল,” সোনারাম এক সময় বললেন। একবার বললেন, “এটা একটা গ্রাম ছিল। গঞ্জ বলতে পারো। একসময় বললেন, “এই জায়গাটাকে একদিন আঙুরের রাজ্য বলা হত। আমরা এখন এই যেখানে আছি।”
একটু পরে তারা এসে পৌঁছায় ধ্বংসস্তূপের ভেতরের দিকে। একটা রাস্তায় এসে উঠে পড়ে তারা। আগাছা আর ফাটলে ভরতি রাস্তাটা। ডানদিকে একটা পাথরের চিমনি ভগ্নপ্রায় অবস্থায় কোনোক্রমে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
“সাবধানে হাঁটবে।” সোনারাম তাশিকে সতর্ক করেন।
রাস্তার শেষ মাথায় বিশাল একটা খোলা মুখের গর্ত। হাঁ করে মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এটা একটা খোলা বেসমেন্ট। একদিকে জট পাকানো অসংখ্য পাইপের জঙ্গল। বিচ্ছিন্ন পাইপগুলো প্রান্তের দিকে বেঁকেচুরে একে অন্যের মধ্যে ঢুকে জট পাকিয়ে গিয়েছে। একটা ভেঙে পড়া বাড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল তারা। বাড়িটার একদিকে একটা বাথটাব দেয়ালের বাইরে চলে এসেছে। একপাশে একটা ভাঙা চেয়ার। বোন চায়নার কিছু ভাঙা বাসনকোসন আর কিছু চামচ পড়ে রয়েছে একদিকে। রাস্তার মাঝখানে মাটিতে ধ্বস নেমে তলিয়ে গেছে। ধ্বসের চারপাশে আগাছা, ধ্বংসাবশেষ আর হাড়গোড় ছড়িয়ে রয়েছে।
“এখানে,” সোনারাম বিড়বিড় করে বললেন।
“কোথায়?”
“ওই তো ডান দিকে।”
ডান দিকে ঘুরেই একটা একদা-মহাশক্তিধর ট্যাঙ্কের অবশিষ্টাংশ শরীর পার হল তারা। মেজর সোনারামের বেল্ট কাউন্টারটা হঠাৎ ভয় পাইয়ে দিয়ে টিক টিক শব্দ করতে শুরু করল। ট্যাঙ্কটা তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণে বিস্ফোরিত হয়েছিল। ট্যাঙ্ক থেকে কয়েক ফুট দূরে একটা মমি হয়ে যাওয়া শরীর মুখ খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। রাস্তার ঠিক ওপারে একটা সমতল মাঠ। পাথর আর আগাছা ভরতি। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে অজস্র ভাঙা কাচের টুকরো।
“ওইদিকে,” সোনারাম আঙুল দেখালেন।
একটা পাথরের দেয়াল ঘেরা কুয়ো। দেয়ালের পাথর কিছু ভেঙে খসে পড়েছে। বেঁকেতেড়ে গেছে এখানে ওখানে। এপাশে ওপাশে কয়েকটা সাইন বোর্ড পড়ে আছে। কুয়োটার একদিকের অনেকটাই ধ্বসে গিয়েছে। সেদিকটা পুরো ভাঙাচোরা আবর্জনায় ভরা। তাশিকে পাশে নিয়ে সোনারাম এলোমেলো পা ফেলে সেদিকে এগোলেন।
“এখানে? আপনি কি নিশ্চিত?” তাশি জিজ্ঞেস করে। “দেখে কিন্তু সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না।”
“আমি নিশ্চিত।” মেজর সোনারাম কুয়োর ধারে গিয়ে বসলেন। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছেন। নাক দিয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছেন। ঘেমে গিয়েছেন তিনি। হাত দিয়ে মুখ থেকে ঘাম মুছে নিলেন। “এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল যাতে সিনিয়র কমান্ড অফিসার তেমন দরকার পড়লে পালিয়ে যেতে পারেন। যদি তেমন কিছু কখনও দরকার হয়। যদি বাঙ্কার দখল হয়ে যায়।”
“তার মানে আপনার জন্যে?”
“হ্যাঁ।”
“জাহাজটা কোথায়? ওটা কি এখানে?”
“আমরা ওটার উপরেই এখন দাঁড়িয়ে আছি।” সোনারাম কুয়োর পাথরের দেয়ালে হাত বোলান। “এটার গুপ্ত দরজার তালা শুধু আমাকেই চেনে, অন্য কাউকে না। এটা আমার জাহাজ। কিংবা বলতে পারো আমার জন্যে রাখা জাহাজ।”
একটি জোরালো ক্লিক করে শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে তারা শুনতে পেল তাদের নীচে কোথাও থেকে একটি নীচু ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসছে।
“পিছিয়ে এসো,” সোনারাম বললেন। তাশিকে নিয়ে তিনি কুয়োর পাশ থেকে খানিকটা পিছনে সরে এলেন।
জমির চৌকো মতো একটা অংশ একটু নীচু হয়ে গিয়ে একপাশে সরসর করে সরতে শুরু করেছে। সোনারাম আর তাশির চোখের সামনে অংশটা পাশের দিকে মাটির নীচে ঢুকে গেল। ছাইয়ের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে জেগে উঠতে শুরু করল একটি ধাতব আকৃতি। রাজ্যের ভাঙা ইটের টুকরো আর আগাছা দূরে সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছে ধাতব আকৃতিটা। উঠে এল। এখন যাবতীয় নড়াচড়া বন্ধ হয়ে সবকিছু স্থির হয়ে গিয়েছে। জাহাজটা এখন চোখের সামনে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
“এই তো এটা আছে,” মেজর সোনারাম হাঁফ ছাড়লেন।
একটা ছোটো জাহাজ। তারজালির দোলনায় একটা ভোঁতা মোটা সূঁচের মতো অবস্থায় ঝুলছে। যেন নিঃশব্দে বিশ্রাম নিচ্ছে। যেখান থেকে জাহাজটা উঠে এল, চারপাশ থেকে একরাশ ছাই বৃষ্টির মতো সেই অন্ধকার গহ্বরে নেমে গেল। মেজর সোনারাম এগিয়ে গেলেন জাহাজের কাছে। তারজালির প্ল্যাটফর্মে উঠে দাঁড়িয়ে জাহাজের হ্যাচটা খুলে তুলে দিলেন। এখন জাহাজের ভিতরের কন্ট্রোল বাঙ্ক আর প্রেসার সিট দেখা যাচ্ছে।
তাশিও এগিয়ে এসেছে। তার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে এখন। উঁকি মেরে দেখছে জাহাজের ভেতরটা। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বলল, “আমি রকেট পাইলটিং করতে জানি না।”
সোনারাম তার দিকে তাকালেন। “আমি পাইলটিং করব।”
“তুমি করবে? কিন্তু এটাতে একটাই তো সিট আছে, মেজর। আমার মনে হয় এটা শুধু একজনকে নিয়ে ওড়ার জন্য তৈরি হয়েছে।”
মেজর সোনারাম চমকে উঠলেন যেন। তার শ্বাসপ্রশ্বাস বদলে গেল। এটা তিনি খেয়াল করেননি। তিনি এবার ভালো করে জাহাজের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। ঠিক, তাশি ঠিক বলেছে। একটাই মাত্র আসন রয়েছে। জাহাজটা শুধুমাত্র একজনকেই বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
“হুম্, তাই তো দেখছি, এটায় শুধু একজন মানুষই যেতে পারবে,” তিনি কথাগুলো বলছিলেন খুব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে। “আর তুমি সেই একজন হতে চাইছ।”
তাশি মাথা নাড়ল।
“অবশ্যই।”
“কেন?”
“কারণ আপনি গেলে আমাদের কারও কোনো লাভ হবে না। আপনার শরীরের যা অবস্থা মনে হয় না আপনি এতটা ধকল নিতে পারবেন। আপনি রীতিমতো আহত। সম্ভবত সেখানে জীবিত পৌঁছতেই পারবেন না।”
“বাঃ, দূর্দান্ত যুক্তি তোমার। কিন্তু তুমি একটা কথা ভুলে গেলে, আমাদের দুজনের মধ্যে শুধু আমিই জানি ঘাঁটিটা চাঁদের ঠিক কোথায় রয়েছে। তুমি মাসের পর মাস চাঁদের চারদিকে ঘুরপাক খেতেই থাকবে, কিন্তু কখনোই খুঁজে পাবে না। চন্দ্র ঘাঁটি খুব ভালোভাবে লুকানো আছে। ঠিক কী খুঁজতে হবে তা না জানলে—”
“তা হোক। এই ঝুঁকি টুকু আমাকে নিতেই হবে। এমনিতে নিজের জোরে হয়তো খুঁজে পাবো না। হয়তো কেন, আমি জানি পারব না। কিন্তু আমি এটাও জানি যে আপনি প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য আমাকে দেবেন। কারণ আপনার নিজের জীবন নির্ভর করবে আমার সাফল্যের উপরে।”
“কীভাবে?”
“যদি আমি চাঁদের ঘাঁটি ঠিক সময়ে খুঁজে পাই, তাহলে ওখানে বলে কয়ে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি হয়তো অন্য একটা জাহাজ পাঠাতে পারব। মনে রাখবেন, শুধু যদি আমি সময়মতো চন্দ্র ঘাঁটি খুঁজে পাই, তবেই সেটা সম্ভব। আর সেটা যদি আমি না পারি, তাহলে আপনার বাঁচার আর কোনো সুযোগ নেই। আমি ধরে নিচ্ছি জাহাজে রসদপত্র যথেষ্ট আছে। কাজেই খোঁজাখুঁজি করার মতো আমি যথেষ্ট সময় পাব, কিন্তু—”
মেজর সোনারাম চেষ্টা করেছিলেন দ্রুত আঘাত হানার। কিন্তু আহত হাতটা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। তাশি খুব সহজেই নিজেকে সময় মতো সরিয়ে নিতে পারল। সরে গিয়েই তার হাত বিদ্যুৎগতিতে উঠে এল। সোনারাম বন্দুকের বাটটা নেমে আসতে দেখেছিলেন। আঘাতটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি, কিন্তু তাশির নড়াচড়া মারাত্মক দ্রুত। ধাতব বাটটার আঘাত এসে লাগল তার মাথার পাশে, তার কানের ঠিক উপরে। অসাড় করে দেওয়া একটা ব্যথার স্রোত তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে গেল। শরীরময় বেদনা আর মস্তিষ্কে ঘূর্ণায়মান কালো মেঘ। তিনি সেই ঘূর্ণী স্রোতে তলিয়ে গেলেন। তার শরীরটা ওই অবস্থাতেই সরাসরি পড়ে গেল মাটিতে।
অস্পষ্ট হলেও তিনি টের পেলেন তাশি তার উপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। জুতোর সামনের অংশ দিয়ে ঠোক্কর মারছে তার পাঁজরের কাছে।
“মেজর! মেজর! উঠে পড়ুন।”
তিনি চোখ খুললেন। এখনও কাতরাচ্ছেন তিনি।
“আমার কথা শুনুন।” তাশি নীচু হয়, তার হাতের পিস্তলের নলটা সোজাসুজি সোনারামের মুখের দিকে উঁচিয়ে রাখা। “আমাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। বেশি সময় বাকি নেই। জাহাজ চালু হওয়ার জন্য তৈরি, আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাব। যাওয়ার আগে আপনি আমাকে আমার জন্য জরুরি তথ্যগুলো আমাকে দিয়ে দিন।”
মেজর সোনারাম তার মাথা ঝাঁকালেন, চেষ্টা করছেন চিন্তাভাবনা পরিষ্কার করে নেওয়ার।
“তাড়াতাড়ি করুন! বলুন চাঁদের ঘাঁটির অবস্থান ঠিক কোথায়? আমি কীভাবে ওটা খুঁজে বের করবো? আমি ঠিক কী খুঁজব?”
সোনারাম কোনো উত্তর দিলেন না।
“জবাব দিন!”
“দুঃখিত। মনে পড়ছে না।”
“মেজর, জাহাজে প্রচুর রসদ বোঝাই করা আছে। আমি বেশ কয়েক সপ্তাহের জন্য পাক খেতে পারব। তার মধ্যে আমি শেষ পর্যন্ত ঘাঁটিটা ঠিক খুঁজে পাব। এদিকে আর আধ ঘণ্টার মধ্যে আপনি মারা যাবেন। আপনার বেঁচে থাকার একমাত্র সুযোগ—” তাশি মাঝপথে হঠাৎ চুপ করে গেল।
দূরের ঢালু দিকটা বরাবর, যেখানে চূর্ণবিচূর্ণ ধ্বংসাবশেষগুলো সব পড়ে আছে, সেখানে কিছু একটা নড়াচড়া করল। ছাইয়ে ঢাকা ধ্বংসাবশেষের আড়ালে ওদিকে কিছু একটা আছে। তাশি দ্রুত ঘুরে গিয়েই লক্ষ্য স্থির করে নিল। পরের মুহূর্তেই সে গুলি চালাল। দূরে একঝলক অগ্নি শিখা লাফিয়ে উঠল। ছাইয়ের গাদার মধ্যে দিয়ে কিছু একটা গড়িয়ে দ্রুত দূরে সরে গেল। তাশি আবার গুলি চালাল। নখরচক্রটা বিস্ফোরিত হয়ে গেল এবার। দেখা গেল বেশ কিছু চাকা আর রিলে এদিকে ওদিকে ছিটকে গেল।
“দেখলেন?” তাশি আরও ঝুঁকে আসে এবার। “একটা সন্ধানী নখরচক্র। তার মানে দলের বাকিগুলো খুব বেশি দূরে নেই।”
“তুমি ওদের বলে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করবে?”
“হ্যাঁ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
সোনারাম তাশির দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটাকে নিবিড়ভাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। “তুমি সত্যি বলছ?” তার মুখে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি, প্রচণ্ড একটা আকুতি। “তুমি কি আমার জন্য ফিরে আসবে? তুমি আমাকে চাঁদের ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে?”
“কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে চাঁদের ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু এখন তাড়াতাড়ি বলুন ওটা ঠিক কোথায় আছে! হাতে আর মাত্র অল্প সময় বাকি আছে।”
“ঠিক আছে।” সোনারাম কোনোরকমে নিজেকে খানিকটা উঠিয়ে আধ-বসা হয়ে পাশে পড়ে থাকা একটা পাথরের টুকরো হাতে তুলে নিলেন। “এখানে দেখ।”
সোনারাম ছাইয়ের উপরে পাথরের টুকরোটা দিয়ে আঁচড় কাটতে শুরু করেছেন। তাশি পাশে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে পাথরের টুকরোটার নড়াচড়া দেখে যাচ্ছে। সোনারাম তখন চাঁদের একটা কেজো মানচিত্র আঁকছিলেন।
“এই হচ্ছে তোমার অ্যাপেনাইন রেঞ্জ। আর এই যে এখানে আর্কিমিডিসের গহ্বর। আমাদের চন্দ্র ঘাঁটিটা আছে অ্যাপেনাইন রেঞ্জ যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকে প্রায় শ’দুয়েক মাইল দূরে। ঠিক কোথায় সেটা আমি জানি না। শুধু আমি না, পৃথিবীর কেউ জানে না। তবে অ্যাপেনাইন রেঞ্জের ঠিক উপরে পৌঁছে তোমাকে সংকেত পাঠাতে হবে। প্রথমে একটা লাল ফ্লেয়ার আর একটা সবুজ ফ্লেয়ার জ্বেলে সংকেত পাঠাবে, আর তারপরেই দ্রুত পর পর দুটো লাল ফ্লেয়ার। ঘাঁটিতে থাকা স্বয়ংক্রিয় মনিটর তোমার সংকেত রেকর্ড করবে। যতদূর জানি ঘাঁটিটা আছে চন্দ্র পৃষ্ঠের নীচে। সেখান থেকেই তারা তোমাকে ম্যাগনেটিক গ্র্যাপল দিয়ে পথ দেখাবে।”
“আর রকেটের নিয়ন্ত্রণ? সেটা আমি কীভাবে করব?”
“নিয়ন্ত্রণগুলো সবই স্বয়ংক্রিয়। তোমাকে যা করতে হবে তা হল সঠিক সময়ে সঠিক সংকেত দেওয়া।”
“সেটা আমি পারব।”
“উড়ানের শুরুতে যে ধাক্কাটা আসবে তার বেশির ভাগটাই বসবার আসনটা শুষে নেবে। ভেতরের বায়ু আর তাপমাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। জাহাজ প্রথমে পৃথিবীর বন্ধন ছাড়িয়ে মহাশূন্যে পৌঁছবে। তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পথ খুঁজে নিয়ে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি দেবে। শেষে চাঁদের পিঠের প্রায় একশো মাইল উপরের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে পাক খেতে শুরু করবে। সেই কক্ষপথেই তুমি ঘাঁটির উপরে পৌঁছবে। তুমি যখন অ্যাপেনাইন অঞ্চলে থাকবে, তখন সংকেত পাঠানোর ফ্লেয়ার রকেটগুলো ছেড়ে দেবে। ব্যাস। ”
তাশি গিয়ে জাহাজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। নিজেকে বসিয়ে নিল প্রেসার সিটের জায়গা মতো। আর্ম লকগুলো তার চারপাশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আঁট হয়ে বসে গেল। কন্ট্রোল প্যানেলের উপর সে তার লম্বা লম্বা আঙুল রেখে ছুঁয়ে দেখে নেয়। “মেজর, আপনি যেতে পারছেন না বলে আমার খুব খারাপ লাগছে। এই সব কিছু এখানে রাখা হয়েছিল আপনার জন্য, অথচ আপনিই যেতে পারছেন না।”
“তাশি, তোমার পিস্তলটা আমাকে দিয়ে যাও।”
তাশি তার বেল্ট থেকে পিস্তলটা টেনে বের করে এনে সেটাকে হাতের তালুতে রেখে হালকা করে দোলাতে থাকে যেন পিস্তলটার ওজন আন্দাজ করাটা এখন খুব প্রয়োজন। “এখান থেকে খুব বেশি দূরে কিন্তু চলে যাবেন না। এদিককার যা অবস্থা তাতে পরে আপনাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।”
“না, না। কোথায় আর যাব! আমি এখানে এই কুয়োটার ধারে কাছেই থাকব।”
তাশি টেক-অফের সুইচটা মুঠোয় চেপে ধরেছে। মসৃণ ধাতুর উপর তাশির সরু সরু আঙুলগুলো নড়েচড়ে বেড়ায়। “জাহাজটা খুব সুন্দর, মেজর। দারুণ বানিয়েছেন আপনারা। আপনাদের দক্ষতার প্রশংসা আমাকে করতেই হবে। অবশ্য আপনারা চিরকালই খুব ভালো কাজ করেন। চমৎকার সব এক একটা জিনিস নির্মাণ করেছেন আপনারা। আপনাদের এই সব কাজ, আপনাদের যাবতীয় সৃষ্টি, এই পৃথিবীতে এসবই আপনাদের সবচেয়ে বড়ো অবদান।”
“সে ঠিক আছে। আমাকে পিস্তলটা তো দিয়ে দাও,” মেজর সোনারাম হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে এবার অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। এমনিতেও এতক্ষণ একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাও এখন তার জন্য একটু কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
“বিদায়, মেজর।” তাশি পিস্তলটা ছুড়ে দিল। পিস্তলটা এসে মাটিতে আছড়ে পড়ল সোনারামের সামনে, পড়েই সামান্য লাফিয়ে উঠে গড়াতে শুরু করল। সোনারাম তাড়াহুড়ো করে প্রায় দৌড়ে গিয়ে নীচু হয়ে পিস্তলটা তুলে নিলেন।
ওদিকে জাহাজের হ্যাচ বন্ধ হয়ে গেল। হ্যাচের খিল জায়গায় পড়ে গেল। সোনারাম পিস্তলটা হাতে নিয়ে জাহাজের দিকে এগোলেন। হ্যাচের ভেতরে দরজাও বন্ধ হয়ে গেল। সোনারাম তড়িঘড়ি পিস্তল তুললেন।
কান ফাটানো একটা গর্জন। একটা বিস্ফোরণ। ধাতব খাঁচাটা খুলে গেল। তারজালির কাঠামোটা প্রায় সম্পূর্ণ ছিঁড়ে দিয়ে সেখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ল জাহাজটা। অনোন্যপায় মেজর সোনারাম একরকম বাধ্য হলেন নীচু হয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে আসতে। ঘূর্ণায়মান উড়ন্ত ছাইয়ের মেঘের মধ্যে দিয়ে জাহাজটা লাফিয়ে উঠে মুহূর্তের মধ্যে আকাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সোনারাম অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্থির নিঃস্পন্দ হতবাক সোনারাম দাঁড়িয়েই রইলেন যতক্ষণ না রকেটের ছেড়ে যাওয়া সাদাটে দাগটাও আকাশের বুকে মুছে গেল। এখন আর কোথাও কোনো আলোড়ন নেই। তার মতোই সবকিছু যেন থমকে গিয়েছে। সকালের হাওয়ায় একটা হিম ভাব। কোথাও কোনো শব্দ নেই। অনেকক্ষণ পরে, যেদিকে দিয়ে তারা এসেছিলেন, উদ্দেশ্যহীনভাবে সেই দিকেই তিনি আবার চলতে শুরু করে দিলেন। এদিক ওদিক চলতে থাকাই ভালো। সাহায্য আসতে অনেক সময় লাগবে—যদি শেষ পর্যন্ত তা আসে।
চলতে চলতে তিনি পোষাকের ভেতরের আর বাইরের সবগুলো পকেটে তল্লাশি চালিয়ে গেলেন যতক্ষণ না একটা সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পেলেন। বিষণ্ণ হৃদয়ে তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। ওরা সবাই তার কাছে বেশ কয়েকবার সিগারেট চেয়েছিল। কিন্তু তিনি তখন এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সিগারেট এখন অত্যন্ত দূর্লভ জিনিস।
একটা গিরগিটি ছাইয়ের মধ্যে দিয়ে সড়াৎ করে তাকে পেরিয়ে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেলেন। পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। খণ্ডমুহূর্তের মধ্যেই গিরগিটিটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মাথার উপরে, সূর্য এখন আকাশে অনেকটা উঠে এসেছে। একটা মাছির দঙ্গল তার পায়ের একপাশে একটা চ্যাটালো পাথরের উপর এসে বসল। সোনারাম তাদের উদ্দেশ্যে সটান একটা লাথি চালালেন।
তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে উঠেছে। গরম লাগছে এখন। তার মুখ মাথা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে ঘাড়ে নেমে আসছে। তার মুখ আর গলা ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গিয়েছে।
তিনি হাঁটা থামিয়ে দিলেন। এখন বসে পড়েছেন একটা ধ্বংসাবশেষের উপর। ওষুধের কিটটা খুলে ফেললেন তিনি। কয়েকটা নার্ভ চাঙ্গাকারী ক্যাপসুল বের করে গিলে ফেললেন। চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন। কোথায় পৌঁছেছেন তিনি এখন?
সামনে কিছু একটা পড়ে আছে। লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। নীরব এবং নিস্পন্দ।
সোনারাম সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক বাগিয়ে ধরলেন। মনে হচ্ছে যেন কোনো মানুষের শরীর। আর তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ে গেল। এটা হচ্ছে মার্কোসের দেহাবশেষ। দ্বিতীয় বৈচিত্র্য। তার মানে এটাই সেই জায়গা যেখানে তাশি মার্কোসকে গুলি করেছিল। দূর থেকেই তিনি দেখতে পেলেন শরীরটার চারপাশে ছাইয়ের উপরে বেশ কিছু চাকা, রিলে আর ধাতুর টুকরো-টাকরা পড়ে রয়েছে। সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। আলোর ঝিলিক মারছে।
সোনারাম উঠে পড়লেন। পায়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলেন। পা দিয়ে টোকা মেরে জড় শরীরটা উলটে দিলেন। এখন তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন শরীরটার ধাতব কাঠামোটা, অ্যালুমিনিয়ামের পাঁজর আর কঙ্কালের গড়ন। গাদা গুচ্ছের তার-ফার ছিঁড়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। নাড়িভুঁড়ির মতোই মনে হচ্ছে সেগুলোকে। পড়ে রয়েছে তারের গাদা, গণনাতীত সুইচ আর রিলে। অসংখ্য ছোটো বড়ো মোটর আর ধাতুর রড।
উবু হয়ে তিনি বসে পড়লেন পাশটায়। মস্তিষ্কের খাঁচাটা ভেঙে পড়ে আছে। সেই খাঁচার ভেতরে থাকা কৃত্রিম মস্তিষ্ক দেখা যাচ্ছে। তিনি ভালো করে সেটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। অসংখ্য সার্কিটের একটা বিশাল গোলকধাঁধা। অগণন ছোটো ছোটো নল। সব কিছু যে তার দিয়ে জোড়া সেগুলো সব চুলের মতো সূক্ষ্ম তার দিয়ে তৈরি। তিনি মস্তিষ্কের খাঁচাটা স্পর্শ করলেন। স্পর্শ করতেই সেটা একপাশে উলটে গেল। একটা ধাতব পাত দেখা যাচ্ছে। কিছু খোদাই করা অক্ষর রয়েছে তাতে। সোনারাম পাতের উপরে খোদাই করা অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিল। সাদা হয়ে গিয়েছেন তিনি।
ধাতব পাতে খোদাই করে লেখা আছে ‘IV—V’। ফোর্স ভ্যারিয়েন্ট। চতুর্থ বৈচিত্র্য।
অনেকক্ষণ তিনি পাতটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চতুর্থ বৈচিত্র্য। দ্বিতীয় নয়। তারা ভুল ভেবেছিলেন। বৈচিত্র্যের সংখ্যা অনেক বেশি। শুধু তিনটে নয়। অবশ্যই আরও অনেক বেশি। অন্তত পক্ষে চারটে তো বটেই। আর মার্কোস কোনোভাবেই দ্বিতীয় বৈচিত্র হতে পারে না।
কিন্তু মার্কোস যদি দ্বিতীয় বৈচিত্র্য না হয়-
হঠাৎ তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। সামনের টিলাটার ওপাশ থেকে ছাইয়ের গাদা পেরিয়ে কিছু একটা আসছে। কী ওটা? নজর তীক্ষ্ণ করে চোখ কুঁচকে তিনি দেখার চেষ্টা করেন। চোখে পড়ল কয়েকটা অবয়বটা যেন নড়াচড়া করছে। একটু পরেই ছবিটা আরেকটু পরিষ্কার হয়ে উঠল। অবয়বগুলো ধীরে ধীরে ছাইয়ের গাদার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে।
তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
দ্রুত বন্দুকটা বাগিয়ে ধরে কনুইয়ে উপর ভর রেখে মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন সোনারাম। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে তার চোখে এসে পড়ছে। অবয়বগুলো যত তার কাছে এগিয়ে আসছে ততই তাকে নিজের মনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে।
প্রথমটাই একটা রাফীদ। সেটাই তাকে সবার আগে দেখতে পেল। তাকে দেখেই সে তার চলার গতি বাড়িয়ে দিল। তার সঙ্গীরাও দেখাদেখি অমনি তাদের গতি বাড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে তার পেছনে ছুটল। দ্বিতীয়টাও একটা রাফীদ। তৃতীয়টাও। তিনজন রাফীদ, সবাই একইরকমভাবে, নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে আসছে, প্রত্যেকের ভাবলেশহীন মুখ, শুধু তাদের লিকলিকে ঠ্যাংগুলো উঠছে আর নামছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে খেলনা ভালুক।
তিনি লক্ষ্য স্থির করে নিয়েই গুলি চালাতে শুরু করলেন। প্রথম দুটো রাফীদ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে গেল। তৃতীয় রাফীদটা তাও এগিয়েই আসছে। আর তার পেছনে পেছনে আসছে আরেকটা অবয়ব। ধূসর ছাইয়ের পাহাড় পেরিয়ে এই নতুন অবয়বটাও তার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। এটা সেই আহত সৈনিক, রাফীদটার চেয়ে এক মাথা উঁচু। আর—
আর সেই আহত সৈনিকের ঠিক পিছনে দুজন তাশি। পাশাপাশি হাঁটছে। পরনে ভারী বেল্ট, মার্কিন আর্মি প্যান্ট, শার্ট, লম্বা চুল। সেই অতি পরিচিত চেহারা, যেমন খানিকক্ষণ আগেই তিনি দেখেছেন। জাহাজের প্রেসার সিটে বসে ছিল। ঠিক অবিকল সেই রকম দু-দুটো স্লিম, নির্বাক চেহারা। দুজনই অবিকল এক রকম।
তারা এখন খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। রাফীদটা হঠাৎ নীচু হয়ে তার হাতের খেলনা ভালুকটা মাটিতে ফেলে দিল। দিতেই খেলনা ভালুকটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। ছাইয়ের উপর দিয়ে এখন সোনারামের উদ্দেশে দৌড়াতে শুরু করেছে খেলনা ভালুকটা। সোনারাম নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই ছিলেন। তার ডান হাতের তর্জনী নিজে নিজেই শক্ত হয়ে বন্দুকের ট্রিগারটা চেপে দিল। ভালুকটাও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়ে ছাইয়ের রাজত্বে মিশে গেল। তারপর রাফীদটাও। অভিব্যক্তিহীন দুজন তাশি কিন্তু ধূসর ছাইয়ের রাজত্বে পাশাপাশি হেঁটে এগিয়ে আসতেই থাকে।
যখন তারা তার অনেকটাই কাছে এসে পড়েছে, বন্দুকের পাল্লা মধ্যে, সোনারাম পিস্তলের নলটা উঁচিয়ে ধরে গুলি চালালেন।
দুটো তাশি-ই মিলিয়ে গেল। কিন্তু ইতিমধ্যেই অন্য আর একটা নতুন দল টিলার উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। দলটায় পাঁচ থেকে ছ’জন তাশি রয়েছে। সবাই অবিকল একই রকম। দ্রুত গতিতে দলটা একটা সরলরেখায় সোনারামের দিকে এগিয়ে আসছে।
সোনারাম এখনও নির্বাক। সামনে পাঁচ-ছ’জন তাশি। তিনি তখনও ভাবছিলেন প্রথম তাশির কথা। তিনি তাকে তার জাহাজ দিয়ে দিয়েছেন। গন্তব্যে পৌঁছনোর সংকেতের সন্ধান দিয়ে দিয়েছেন। তার জন্যেই সে এখন চাঁদের পথে, হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্র ঘাঁটিতে পৌঁছে যাবে। তিনি নিজেই এটা সম্ভব করে দিয়েছেন।
তবে এটাও ঠিক যে, বোমার ব্যাপারে তিনি কিন্তু একদম সঠিক ধরেছিলেন। বোমাটা তৈরির ডিজাইনে নখরচক্রদের কোনো না কোনো বৈচিত্র্যের জ্ঞান অবশ্যই যুক্ত ছিল। তা সে রাফীদ হোক বা আহত সৈনিক। কিংবা মার্কোস টাইপ। ওই ডিজাইন অবশ্যই মানুষ করেনি। মানুষের কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভূগর্ভস্থ কারখানাগুলোর কোনো একটাতে ওই বোমার ডিজাইন করা হয়েছে।
তাশিদের এই নতুন দলটা ইতিমধ্যে তার কাছে এসে পৌঁছেছে। সোনারাম স্থির চিত্তে তাদের দেখছেন। সেই চেনা মুখ, বেল্ট, ভারী শার্ট, বোমাটা সাবধানে জায়গা মতো রাখা।
বোমা—
তাশিগুলো যখন তাকে ধরল, সেই সময় সোনারামের মুখে একটা শ্লেষাত্মক হাসি খেলা করছিল। মনে একটা বিদ্রূপাত্মক চিন্তা। যা ভাবতে গিয়ে এই শেষ মুহূর্তেও তিনি যেন একটু হলেও শান্তি পেলেন। চিন্তাটা শুরু সেই বোমা নিয়েই। এটা বানিয়েছে এই দ্বিতীয় বৈচিত্র্যেরা। মানুষ সহ অন্যান্য বৈচিত্র্যগুলো ধ্বংস করার জন্য। বোমা—যেই বানাক, তার লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে সেই ধ্বংস সাধন।
শেষ মুহূর্তেও সোনারাম হাসছিলেন। এই সব বৈচিত্র্যেরাও তো এরই মধ্যে একে অপরকে মারবার জন্য নিত্য নতুন অস্ত্র ডিজাইন করতে শুরু করেই দিয়েছে।
মূল গল্প: সেকেন্ড ভ্যারাইটি
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ফিলিপ কে. ডিক, রুদ্র দেব বর্মন
গল্পটা পড়ার পর লেখকের তারিফ না করে পারলামন না। এতো অবলিলায় উনি গল্পটি অনুবাদ করেছেন যে আমার মনে হচ্ছিলো আমি ওনার মৌলিক গল্প পড়ছি। বাংলায় এরকম আরও অনুবাদ হোক রুদ্র বাবুর কলম থেকে সেই প্রার্থনা করছি।
মূল গল্পখানার সর্বনাশ হল। গল্পের মধ্যেও কমিউনিজম এর নোংরা ইনজেকশন না ঢোকালে চলছিল না? কী বিরক্তিকর লোকজন। সকালে পেট পরিষ্কার করার সময়েও ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে পরিষ্কার করেন নাকি?
ভদ্রভাবে কমেন্ট করবেন, নইলে ব্লক করা হবে।