এ সব আগামীকাল ঘটেছিল
লেখক: দীপ ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
লেখক – অনেকে
সম্পাদক – বাল ফোন্ডকে
ভারতীয় কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় যে বিপুল পরিমাণ কল্পবিজ্ঞান যে শতাধিক বছর ধরে রচনা হয়ে আসছে তা বোধহয় সব থেকে অবহেলিত। বাঙালি পাঠক যেমন মারাঠি কল্পবিজ্ঞানের খবর রাখেন না, তেমনি কন্নড় পাঠকও হিন্দি কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে অপরিচিত থেকে যায়। ভারতের মতো বহু ভাষাভাষী দেশে হয়তো ভবিতব্য এটাই ছিল, তবুও সাহিত্য বোদ্ধা ও প্রকাশন সংস্থাগুলির মধ্যে যদি কল্পবিজ্ঞান আর তার অনুবাদ নিয়ে উৎসাহ দেখা যেত, তাহলে হয়তো অবস্থার কিছু পরিবর্তন হতে পারত। যাই হোক সম্প্রতি কল্পবিজ্ঞান গবেষক তরুণ সেইন্টের সাউথ এশিয়ান অ্যান্থোলজি প্রকাশের পরে বেশ কিছু প্রাদেশিক লেখকের ইংরেজি অনুবাদ কল্পবিজ্ঞান আমাদের হাতে এসেছে, আশা করি ভবিষ্যতেও এরকম কিছু বই আসবে। কিন্তু তারপরেও প্রাদেশিক অনুবাদের ক্ষেত্রে অবশ্যপাঠ্য এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে গেছে এই বইটি অনেকগুলি কারণে।
এই সঙ্কলনটি এনবিটি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ৯০-এর দশকে। অনুবাদ হয়েছিল বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি এবং নানা প্রাদেশিক ভাষায়। সম্পাদক ছিলেন মারাঠি লেখক ও সম্পাদক বাল ফোন্ডকে। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে এরকম একটি সঙ্কলনের কাজ করার সাহস দেখানোর জন্যে ফোন্ডকের নাম ভারতীয় কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। বইটি অনুবাদের কাজ করেছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য এবং বইটিতে সব মিলিয়ে ১৯টি গল্প আছে।
বইটির শুরুতেই একটি ফোন্ডকে সাহেবের একটি তথ্যবহুল ভূমিকা আছে কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস ও ভারতীয় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে। তথ্যে সামান্য কিছু ভ্রান্তি থাকলেও ফোন্ডকে পাঠকের কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছেন এই সঙ্কলনের গল্পগুলি নিয়ে। বৈজ্ঞানিক অভিযান আর বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প তার সংকলনে স্থান পায়নি, বরং স্টার্জিয়নের সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি সেই সমস্ত গল্পকেই বেছেছেন যেখানে মানুষ তার মানবিক সমস্যার মানবিক সমাধান করেছে বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়বস্তুর সাহায্যে। এবং সেই জন্যেই তিনি পাশ্চাত্যের অপবিজ্ঞানমূলক কল্পবিজ্ঞানের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং সেই ধারা যে ভারতীয় লেখকরা প্রভাবিত হয়েছেন তাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এছাড়াও চোখে পড়ার মতো বিষয় ফোন্ডকে সাহেবের মারাঠি অস্মিতার প্রভাব— ভূমিকাতেও প্রচুর অংশে মারাঠি কল্পবিজ্ঞানের প্রশংসা করার সুযোগ তিনি ছাড়েননি। অন্যদিকে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের কাজকে তিনি যথেষ্ট সমালোচনা করেছেন ‘অ্যাডভেঞ্চার সম্বলিত কল্পবিজ্ঞান’ বলে। এই ক্ষেত্রে গ্রন্থ সমালোচক অরুণা সিংহকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন— ‘তিনি পিছনপানে চাইছেন এবং তাঁর রচনায় কল্পবিজ্ঞানের প্রথম পর্যায় ফিরে আসছে’ (অর্থাৎ অ্যাডভেঞ্চারভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান)। তিনি মারাঠি কল্পবিজ্ঞানকে ভারতীয় কল্পবিজ্ঞানের সবথেকে শক্তিশালী ধারা বলে ভূমিকার শেষে ঘোষণা করেই ফেলেছেন। কিন্তু এই দাবী কতটা যৌক্তিক তা বুঝতে গেলে যতটা অনুবাদের প্রয়োজন ছিল তা দুর্ভাগ্যক্রমে শুধু এই বইটি থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
একথা সত্যি যে জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার যে ভূমিকা নিয়েছিলেন মারাঠি কল্পবিজ্ঞানের প্রসারে, সেরকম সদার্থক ভূমিকা কোনও বিখ্যাত বাঙালি লেখক বা বুদ্ধিজীবী সেইভাবে নিতে পারেননি। মারাঠি বিজ্ঞান পরিষদের সক্রিয় সহযোগিতায় নিয়মিতভাবে মারাঠি কল্পবিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা চলেছে, এবং এখনও চলছে। বাংলায় সেই ধরনের উদ্যোগ অদ্রীশ বর্ধনের পরে সেরকমভাবে আর চোখে পড়েনি। আর অদ্রীশের উদ্যোগ ছিল একান্তই ব্যক্তিগত, যতদিন সত্যজিৎ এবং প্রেমেন্দ্রের সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন, তখন তৈরি হয়েছিল কল্পবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। ভুললে চলবে না ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এই বাংলার বুকেই তৈরি হয়েছিল তিনটি কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পত্রিকা এবং সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব। সুতরাং, মনে রাখা উচিৎ, ফোন্ডকে বা আমাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য নেই মারাঠি কল্পবিজ্ঞান ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ মানের কিনা সেই ব্যাপারে। তবে একজন মারাঠি সম্পাদক যখন দাবী করেন যে তাঁর সংকলনে মারাঠি কল্পবিজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ অন্য ভাষার থেকে, তখন অবশ্যই গল্পচয়নের উপর কিছুটা হলেও প্রশ্ন তোলা যায়।
আসুন দেখা যাক এই বইয়ের গল্পগুলি কীরকম। বিভিন্ন ভাষায় লেখা সব মিলিয়ে ১৯টি গল্প স্থান পেয়েছে বইটিতে। আমি গল্পের বর্ণনায় যাব না, তার জায়গায় চলুন দেখি গল্পগুলিকে শ্রেণীবিভাগ করা সম্ভব কিনা।
প্রথম ৭টি গল্প মারাঠি, ৩টি গল্প বাংলা, ১টি তামিল, ২টি কন্নড়, ১টি ওড়িয়া, ৩টি ইংরেজি, এবং ২টি হিন্দি গল্প বইটিতে জায়গা পেয়েছে। স্বভাবতই দেখা যাচ্ছে ফোন্ডকে সাহেব নিজের বিশ্বাস অনুযায়ীই সবথেকে বেশি গল্প বেছেছেন মারাঠি ভাষা থেকেই।
এরপর বিষয়বস্তু অনুযায়ী যদি গল্পগুলিকে সাজানো হয়—
১) পরিবেশ ও দূষণ সংক্রান্ত বিপদ – ৩
২) চিকিৎসাবিজ্ঞান, জিনোমিক্স ও ব্রেন ট্রান্সপ্ল্যান্ট – ৪
৩) পারমাণবিক যুদ্ধ – ১
৪) রোবট – ৫
৫) সামাজিক ডিস্টোপিয়া – ১
৬) সময় ভ্রমণ – ৩
৭) এলিয়েন – ১
৮) অলৌকিক – ১ (আজ্ঞে হ্যাঁ, কীকরে যেন সম্পাদকের নজর এড়িয়ে একখানা অলৌকিক গল্পও এই সংকলনে ঢুকে গেছে, যার সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের দূরদূরান্ত থেকেও কোনও সম্পর্ক নেই)
যদি ধরে নিই নব্বইয়ের দশকে এই গল্পগুলির বেশির ভাগই লেখা তাহলে জিনোমিক্স এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের গল্পের আধিক্যের প্রতি আগ্রহ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, বায়োটেকনোলজি এবং জেনেটিক্স এই সময় ভারতে বেশ চর্চিত ও নতুন বিষয়, সুতরাং সেই জন্যেই প্রায় তিনটি গল্পে আমরা দেখতে পাই একই উপায় একজনের স্মৃতি অন্যের মস্তিষ্কে চালনা করা হচ্ছে আরএনএ-র মাধ্যমে। ঠিক একইভাবে দেখা যায় সমস্ত রোবটের গল্পগুলিই প্রায় আসিমভের রোবট ল-এর দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু এর মধ্যে নিরঞ্জন সিংহের কলমে ভারতীয় দর্শনের মাধ্যমে রোবটের পজিট্রনিক ব্রেনকে শর্ট সার্কিট করার গল্পটি মনে দাগ কেটে যায়। বাঙালি লেখকদের মধ্যে জায়গা পেয়েছেন অনীশ, শীর্ষেন্দু আর নিরঞ্জন। আশ্চর্যের ব্যাপার অদ্রীশ, প্রেমেন্দ্র, সত্যজিৎ, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ বা সিদ্ধার্থ জায়গা পাননি এই সংকলনে। অনীশ দেবের গল্প নীলবর্ণ শৃগালও ওঁর সেরা কল্পবিজ্ঞানের গল্প, একথা সবথেকে বড় ভক্তও বলতে পারবে না।
সংকলনের গল্পগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ গল্পের চরিত্র বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিবিদ। যদিও হালের বাংলা কল্পবিজ্ঞানের মতো তারা পৃথিবী ও মহাকাশব্যাপি অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হন না। কিন্তু তাদের বেশির ভাগের গল্পের মধ্যেই আছে হার্ড সায়েন্সের ছোঁয়া। তারা লাইনের পর লাইন ব্যাখ্যা করেন বিজ্ঞানের অব্যক্ত রহস্য, কীভাবে কী হচ্ছে বা হতে চলেছে, আর বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কহীন আরেকটি চরিত্র বা সাধারণ পাঠক তাদের স্বল্প অভিজ্ঞতায় আন্দাজ করার চেষ্টা করেন গল্পের শেষটা। আবার যদি আমরা ফিরে যাই ফোন্ডকের ভূমিকায়, খেয়াল করলে পাঠক বুঝবেন, বইটির গল্প বাছার সময় ফোন্ডকে সচেতনভাবে বাদ দিয়েছেন এমন সব গল্পকে যার পিছনে শক্ত বিজ্ঞানের কাঠামো নেই। অর্থাৎ বইটির বেশির ভাগ গল্পই হার্ড সায়েন্স ফিকশন। এবং প্রায় সব গল্পই ঘটে চলেছে নগরকেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যে। কোথাও বৈজ্ঞানিক মা মরা ছেলের জন্যে বানাচ্ছেন অতীব সুন্দরী ক্লোন, কোথাও বা রোবটের সঙ্গে স্ত্রীর অ্যাফেয়ারের সন্দেহে জ্বলছেন কোনও প্রযুক্তিবিদ। না, এখানে সেই অ্যাডভেঞ্চার বা অন্য গ্রহে বা অন্য সভ্যতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব নেই, এমনকী বলাই যায় প্রায় প্রত্যেকটি গল্পই কঠোরভাবে স্টার্জনীয় (অবশ্যই সামান্য কিছু গল্প অন্যরকম)। যদি সত্যজিৎ, অদ্রীশ বা প্রেমেন্দ্রের কল্পবিজ্ঞানের দিকে তাকাই, তাহলে সেখানে এই ধরনের গল্পের সংখ্যা হয়তো নগন্য হবে। এবং সেই জন্যেই আরও অনেক ভালো গল্প থাকলেও হয়তো অনীশের নীলবর্ণ বিড়াল গল্পটিকেই বাছা হয়েছে, কারণ গল্পটির নীল ব্যতিত সমস্ত বর্ণ লোপ পাওয়ার পিছনে বিজ্ঞানসম্মত অনুমান কাজ করছে।
ঠিক একই কারণে মারাঠি লেখকদের মধ্যে সিংহভাগই পেশাদার বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ। যে দক্ষতার সঙ্গে তারা বিজ্ঞানের বিশেষ দিকগুলি গল্পের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন তা সাধারণ লেখকের পক্ষে বেশ কঠিন। কিন্তু তার জন্যে বেশির ভাগ গল্পেই পুনরাবৃত্তি হয়ে পড়েছে প্লটের। আগেই যেমন বলেছি স্মৃতি প্রতিস্থাপনের একাধিক গল্প কিছুটা হলেও সঙ্কলনের মান ক্ষুণ্ণ করেছে। রোবটের গল্পগুলির মধ্যেও সেই একই ধারা ফিরে এসেছে বারবার, হয় রোবট পড়েছে মানুষের প্রেমে, নাহলে মানুষ রোবটের প্রেমে হয়েছে পাগল। যদিও গল্পগুলির প্রেক্ষাপট আলাদা, এবং চরিত্রচিত্রনেও তেমন দুর্বলতা নেই, তাও সামান্য ক্লান্তিকর হয়েছে পঠন।
সংকলনের সেরা গল্প যদি বলতে হয় তা হল শুভদা গাগোটের গল্প ‘জন্মগত অধিকার’। রাষ্ট্রযন্ত্র সুকৌশলে যেভাবে অনাগত শিশুদের ভ্রূণাবস্থায় মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করেছে, তা শুধু শিহরণ জাগায় তা নয়, বর্তমান পৃথিবীর নানা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা স্মরণ করায়। সেটাই তো সার্থক কল্পবিজ্ঞানের ধর্ম, সে শুধু পাঠককে সাহিত্যরসের আনন্দ বা অন্য দুনিয়ার চমক দেয় না, সে সাবধান করে তাকে, অনাগত ভবিষ্যৎ থেকে, সে রাস্তা দেখায়, আগামীর উজ্জ্বল ভোরের। সঞ্জয় হাভানুর টাইম ট্র্যাভেল করা লিফট-এর গল্পটিও বহুদিন মনে থেকে যাবে, কারণ সেখানে সময় ভ্রমণ হয়ে উঠেছে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গোপন অস্ত্র।
সব শেষে এটাই বলার যে, কিছু বায়াস এবং রিপিটেশন থাকা সত্বেও বেশির ভাগ গল্পই কল্পবিজ্ঞানের পাঠককে পরিতৃপ্ত করতে সমর্থ হবে। যদিও সংকলনের প্রথম দিকের থেকে শেষের দিকের গল্পগুলির মানের সামান্য হলেও অবনতি ঘটেছে। কিন্তু এই ধরনের আরও সংকলনের অভাবের জন্যে এটি বোঝা সম্ভব নয় যে সেটি গল্প চয়নের দোষ নাকি আঞ্চলিক কল্পবিজ্ঞানের ব্যর্থতা। আরও একটি বৈশিষ্ট হল সঙ্কলনের কোনও গল্পই শিশুতোষ নয়। এই ধরনের বাংলা সঙ্কলন তৈরি হলে তা এই দোষে অবশ্যই দুষ্ট হত। এইখানে মারাঠি বিজ্ঞান পরিষদের সাফল্য যার জন্যে বাল ফোন্ডকে সম্পাদক হিসেবে নিজের সতন্ত্রতা বজায় রাখতে পেরেছেন। নবারুণ ভট্টাচার্য বেশির ভাগ গল্পই অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। দু-চারটি যা গল্পে অনুবাদ কেঠো ঠেকেছে, তা লস্ট ইন ট্রান্সলেশন বলে উপেক্ষা করাই যায়। সব মিলিয়ে এই সঙ্কলনটি যে কোনও কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীর অবশ্যই পড়া উচিৎ, কারণ আঞ্চলিক কল্পবিজ্ঞানের আর কোনও বাংলা অনুদিত প্রতিনিধি এই মুহূর্তে এখনও নেই।
Tags: গ্রন্থ পরিচিতি, গ্রন্থ সমালোচনা, দীপ ঘোষ, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সমালোচনা