দায়
লেখক: সৌজন্য চক্রবর্ত্তী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
একটা কোলাহলের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি বাড়ির পাশ দিয়ে জনা চার-পাঁচেক লোক একরকম পাঁজাকোলা করেই একটা বয়স্ক মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। ওরা সবাই প্রায় আমার মুখচেনা। এ পাড়াতেই থাকে। কিন্তু এই রাতদুপুরে হঠাৎ কী কারণে এভাবে ছুটোছুটি করছে, সেটা বুঝলাম খানিক পরে আমার বাড়ি মালিক বিনয়বাবুর কাছ থেকে। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে হাউসস্টাফশিপের সময় দু-মাস আমার রুরাল পোস্টিং পড়েছে খাতরা থেকে গাড়িতে মিনিট কুড়ি পথ দূরে এই রাধানাথপুর গ্রামের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তাই আপাতত মাস দুয়েকের জন্য এই বাড়িতেই একটা রুম ভাড়া নিয়ে আছি। সপ্তাহে তিন দিন খাতরা হাসপাতালেও ডিউটি থাকে অবশ্য। কাজের চাপ নেহাত কম নয়।
তবে এই গ্রামটা বেশ শান্তশিষ্ট, শহুরে আধুনিকতা যান্ত্রিকতা থেকে একরকম যেন গা বাঁচিয়েই আপন খেয়ালে রয়েছে। সামনেই কংসাবতী নদী আর তার চারপাশের জঙ্গল ঘেরা গ্রামটা আমার বেশ লেগেছে। একটা হাইস্কুলও রয়েছে এই গ্রামে। সেই স্কুলের মাঠটাতে দিন পাঁচেক হল যাচ্ছি মর্নিংওয়াকে। সকালবেলায় মাঠে গিয়ে একটু ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে দু-চার রাউন্ড চক্কর মেরে তারপর ফিরে আসি। এমন সতেজ স্বাস্থ্যকর পরিবেশে ডাক্তারির সঙ্গে সঙ্গে শরীরটাও বেশ বাগানো যাবে এই দু-মাসে। ইতিমধ্যেই পাড়াপ্রতিবেশীদের অনেকের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে আমার।
বাড়ি মালিক বিনয়বাবুর কাঠের কারবার। পাশের জঙ্গলের গাছ কেটে ওঁর কাঠের মিলে কাঠ চেরাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম কাঠের কাজ করে থাকেন লোক দিয়ে। তারপর সেসব গাড়িতে করে শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে বেশ ভালোই উপার্জন করেন বলা যায়। আমার এক পরিচিত বন্ধুর মারফত এই বাড়িটা আশপাশের শহরের থেকে প্রায় অর্ধেকেরও কম ভাড়ায় পেয়ে যাই। তাই আর দেরি না করে চলে আসি এখানে। আপাতত মাসদুয়েক তো কাটাতে হবে এখন এই গ্রামেই।
এতক্ষণে আমার কৌতূহলী ভাবটা কাটিয়ে বিনয়বাবুকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে দেখে লোকগুলোর দিকে নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপার কী বলুন তো? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এভাবে?”
তিনি বললেন, “দেখো আবার কাকে সাপে কাটল। বুড়োটাকে দেখে তো দত্তপাড়ার কালীবাবু বলেই মনে হচ্ছে। বোধহয় সাপে-টাপেই কেটেছে, নইলে এমন রাতদুপুরে কেউ ছোটে না এভাবে। সেই জন্যই অমন ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে ও পাড়ায়।”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “কিন্তু, ওঁকে তো ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এখানে নিয়ে যাবে কোথায়? কাছেপিঠে তো কোনও বড় হাসপাতাল নেই!”
আমি যে একথা বলব তা যেন আগেই টের পেয়েছিলেন বিনয়বাবু। উনি মুচকি হেসে বললেন, “ডাক্তারবাবু, আপনি তো এই গ্রামে নতুন এসেছেন। আস্তে আস্তে সব জানতে পারবেন। এ অঞ্চল তো একপ্রকার সাপখোপের রাজত্ব বলতে পারেন। সব বাড়িতে আবার ইলেকট্রিসিটিও নেই। আর দেখছেনই তো গ্রামের গরীব চাষাভুসো লোকজন সন্ধে হলেই রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে লন্ঠন হ্যারিকেন নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।
“বাড়ির কত্তারা অনেকেই এই গ্রীষ্মকালে বাইরে খোলা আকাশের নিচেই দাওয়ায় বিছানা পেতে শোয়। তাই অন্ধকারে সাপের কামড় খাওয়াটাও আশ্চর্যের কিছু নয়। তবে রাতবিরেতে সাপে কাটলে সবাই ছোটে ও পাড়ার হরেনখুড়োর কাছে। হরেনখুড়ো মানে হরনাথ মুখুজ্জে, আজ বহু বছর হল এ গাঁয়ের সাপে কাটা রোগীদের প্রাণ বাঁচিয়ে আসছে।”
আমি কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করলাম, “উনি… মানে ডাক্তার? নাকি ঝাড়ফুঁক টারফুঁক…?”
“না না ওসব কিছু না। হরেনখুড়োর কাছে বিষমৌরি আছে একখানা। মন্ত্রপড়া ওই পাথর কাটাস্থানে লাগিয়ে সাপের বিষ তুলে নেয় রোগীর গা থেকে,” আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলেন বিনয়বাবু।
এবার আমার আরও অবাক হওয়ার পালা। খানিক অবিশ্বাসের সুরেই বললাম, “অদ্ভুত! এরকম জিনিসও হয় নাকি আবার! আর গাঁয়ের লোকেরা এসব তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাসও করে?”
“যে জিনিসে রোগী বেঁচে ফিরে আসে, সে জিনিস তো মানুষ বিশ্বাস করবেই, ডাক্তারবাবু। আজ পর্যন্ত সাপে কাটা যতজনকেই হরেনখুড়োর কাছে নিয়ে গেছে, সবাই একেবারে সুস্থ হয়ে বেঁচে ফিরেছে। সাপের বিষ তুলতে ওর ওই বিষমৌরি একেবারে অব্যর্থ।”
আমার মুখটা প্রায় হাঁ হয়ে যায়। বিষমৌরি! এমন নাম তো শুনিনি কোনওদিন। নিছক পাথর হয়তো নয় এ জিনিস। কোনও সামুদ্রিক প্রাণী নাকি? যার গুণই হয়তো সাপে-কাটা লোকেদের ক্ষতস্থান থেকে কোনও এক বিশেষ উপায়ে সাপের বিষ শুষে নেওয়া! বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এমন অদ্ভুত জিনিসও যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তাই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। তবে এইসব জঙ্গল, নদী ঘেরা গ্রামগুলো এমন অনেক রহস্য লুকিয়ে রাখে, বিজ্ঞান যেখানে পৌঁছতেও পারে না সবসময়।
“আচ্ছা, এই হরেনবাবু লোকটা কেমন, মানে কী করেন টরেন আর কি?” আমার অবাক ভাবটা কাটাতে বিনয়বাবুকে প্রশ্নটা করলাম।
উনি একটু কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, “হরেন মুখুজ্জে এককালে তোমাদের কোলকেতার কলেজে প্রাণিবিদ্যা নিয়ে পড়াতেন শুনেছি।”
“ম… মানে, প্রফেসর!” আমি সবিস্ময়ে বলি। অবাক হই কারণ এ গ্রামে আমি দিন সাতেক হল এসেছি। কিন্তু গাঁয়ের প্রাক্তন হেডমাস্টার নগেন চৌধুরী ছাড়া কাউকেই তেমন চিনি না যাকে মোটামুটি উচ্চশিক্ষিত বলা চলে। সেখানে এই হরেনবাবু, যিনি আবার জুলোজির প্রফেসর, তিনি কেন যে এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছেন সেটাই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করেই বুঝি বিনয়বাবু মুখ খুললেন আবার,
“তবে লোকটা বড্ড খামখেয়ালী জানেন? জোয়ান বয়সে শুনেছি মাঝে মধ্যেই দেশবিদেশে পাড়ি দিত আশ্চর্য সব পোকামাকড়, গাছগাছড়া সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। বিয়ে থাও করেনি। এখন বয়স হয়েছে, তাই এই গ্রামের বাড়িতেই আপাতত থিতু হয়েছে। আজকাল আর ঘর থেকে বেরোয় না খুব একটা। সারাদিন ঘরেই থাকে ওসব পোকামাকড়দের নিয়ে। সকালবেলা শুধু গাঁয়ের ওই হাইস্কুলের মাঠটাতে হাঁটতে বেরোয়।”
আমি বিনয়বাবুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “ও… উনি! সকালে তো আমিও হাঁটতে যাই ওই মাঠেই। অবশ্য আমি যতক্ষণে মাঠে গিয়ে পৌঁছোয় ততক্ষণে ওঁর প্রায় ফেরবার সময় হয়ে যায়। তাও এই ক-দিন যা দেখেছি তাতে বয়স তো আন্দাজ আপনার চেয়ে প্রায় বিশ বাইশ বছরেরও বেশি বলে মনে হয়।”
এবার একটু হাসলেন বিনয়বাবু, “তোমাকে বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না। ওর বয়স পঞ্চান্ন কি ছাপ্পান্ন হবে। আমার চেয়ে মোটে ছ-সাত বছরের বড়। কিন্তু দেখে মনে হয় বয়স আশি বছর। সেই জন্যই পাড়ার সকলে হরেনখুড়ো বলেই ডাকে। বয়সের তুলনায় যেন একটু বেশিই বুড়ো।”
আমি বেশ আশ্চর্যই হলাম। এর উলটোটা আমরা সচরাচর দেখি যেমন অনেকেই বয়সের অনুপাতে একটু কমবয়েসি লাগে। কিন্তু এঁকে যে প্রায় পঁচিশ বছরের বেশি বয়সি দেখায়… এ তো বাড়াবাড়ি রকমের বয়সের পার্থক্য। জেনারেলি আমাদের শরীরে ডিএনএ রিপেয়ার প্রসেসের গোলমাল হলে এরকম বয়সের হেরফের দেখা যায়। কিন্তু সে তো ভীষণ রেয়ার কেস।
মনে মনে ঠিক করলাম, কালই একবার গ্রাউন্ডে হাঁটতে গিয়ে যদি দেখা হয়, তবে নিজে থেকেই কথা বলব ওঁর সঙ্গে। বিষমৌরির ব্যাপারটাও জিজ্ঞেস করা যাবে। জিনিসটা কীভাবে কাজ করে জানা দরকার। এমন আজগুবি জিনিস দেখার লোভ সামলানো দায়।
পরদিন সকালবেলা একটু তাড়াতাড়িই পৌঁছলাম গ্রাউন্ডে। সেই সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে, যদিও পুবদিগন্ত লাল হয়ে উঠতে তখনও বেশ দেরি। মোটামুটি এইরকম সময়েই আসেন ভদ্রলোক। কিন্তু ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেও হরনাথবাবুর দেখা পাওয়া গেল না আজ। তাই, অগত্যা বাড়ি ফিরতে হল। স্নানটান সেরে রেডি হয়ে হসপিটাল বেরিয়ে পড়লাম। সারাদিন হসপিটালের কাজের চাপে হরনাথবাবুর ব্যাপারটা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল পুরো। ঠিক তার পরেরদিন সকালে যেন আচমকাই দেখা হয়ে গেল হরনাথবাবুর সঙ্গে। আজ তিনি গ্রাউন্ডে এসেছেন। এবং ঠিক সময়েই এসেছেন। আমারই বরং একটু দেরি হয়েছে, বরাবর যেমন হয় আর কি। তাই গ্রাউন্ডে ঢোকার পথে দেখলাম উনি হাঁটা শেষ করে বাড়ি ফেরার জন্য এগিয়ে আসছেন। তাই আগ বাড়িয়ে নিজেই আলাপ করতে গেলাম।
প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর ওঁর কালেকশন আর বিষমৌরির ব্যাপারটা তুললাম আমি। উনি প্রথমটায় একটু ইতস্তত করলেও পরক্ষণেই অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে ঈষৎ হেসে আমাকে ওঁর বাড়ি যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন আজ বিকেলে। বললেন, “আসলে গ্রামের লোকের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলা যায় না তো তেমন। আপনি শিক্ষিত ডাক্তার মানুষ। আসুন না আজ বিকেলে। গল্প হবে, সঙ্গে আমার কালেকশনও দেখাব আপনাকে।”
আমিও আজ মোটামুটি ফাঁকাই আছি বিকেল থেকে। তাই ভাবলাম ঘুরেই আসা যাক। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে গ্রাউন্ডের দিকে পা বাড়ালাম।
বিকেল ঠিক সওয়া চারটে নাগাদ ওঁর বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে দরজায় টোকা দিলাম বারকয়েক। কিছুক্ষণ পর একটা সাদা চেক গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে হরনাথবাবু দরজা খুলে দিয়ে বললেন, “আসুন আসুন ডাক্তারবাবু, ভেতরে আসুন।” ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন আমার জন্য আর নিজে একটা বেতের চৌকিতে বসলেন। তারপর বললেন, “দাঁড়ান এক কাপ চা বানিয়ে আনি আপনার জন্য। আসলে আমি কাজের লোক রাখি না ডাক্তারবাবু। একলা মানুষ বুঝতেই পারছেন। নিজেই দু-বেলা ফুটিয়ে নিই। আপনি মিনিট দুই বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি।”
ওঁকে ইতস্তত করতে দেখে আমি বললাম, “আরে না না আপনাকে এত ব্যস্ত হতে হবে না। আমি সকালেই যা এক কাপ চা খাই। সারাদিনে আর চায়ের নেশা নেই আমার। তার চেয়ে বরং বসুন। জমিয়ে গল্প করা যাক কিছুক্ষণ। তারপর না হয় আপনার কালেকশন দেখা যাবে।”
এই শুনে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে।
চৌকিটা টেনে বসতে বসতে বললেন, “বুঝলেন ডাক্তারবাবু, এইসব প্রাণী, উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ নিয়ে আমি একসময় প্রচুর রিসার্চ করেছি। তাই মাঝে মধ্যে আপনার মতো আগ্রহী কাউকে পেলে বেশ ভালই লাগে। আমার কালেকশন নিয়ে কথা বলার লোক পাওয়া যায় অন্তত একটা। নইলে গ্রামের খেটেখাওয়া মানুষজন এসব দেশবিদেশের পোকামাকড়দের গপ্পো শুনতে আসবেই বা কেন, বা এলেও সব বুঝতে পারে না কেউই। তাই ওরা সচরাচর আসে না। শুধু কাউকে সাপে-টাপে কাটলে তবেই নিয়ে আসে এখানে রোগীকে। আমি বিষমৌরি লাগিয়ে শরীর থেকে সব বিষ টেনে আবার আগের মতো ওদের সুস্থ করে দিই।”
“কিন্তু আপনি নিছক খেয়ালের বশে কলকাতা ইউনিভার্সিটির জুলজির অধ্যাপনা ছেড়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে রয়েছেন তাই বলে! আপনি তো চাইলেই একটা বেটার লাইফ লিড করতে পারতেন। রিসার্চের ব্যাপারেও আরও অনেক বেশি সুযোগ সুবিধেও পেতেন।” আমার মুখে কথাগুলো শুনে খানিকক্ষণ চুপ থেকে হরনাথবাবু বললেন, “তা হয়তো পারতাম ডাক্তারবাবু, কিন্তু একটা দায়িত্ব রয়েছে আমারও এই গ্রামের মানুষগুলোর জন্য। আগে সাপে কাটলে গাঁয়ের লোকেরা বড় হাসপাতালে যেতে যেতেই রোগী মারা যেত। এখন আর কেউ মারা যায় না সাপের ছোবলে। এ দায় এড়ানো খুব কঠিন ডাক্তারবাবু…আহ্, ওসব ছাড়ুন। চলুন আপনাকে আমার সংগ্রহশালায় নিয়ে যাই।”
…এই বলে এগিয়ে গেলেন পাশের ঘরটার দিকে। সেখানে প্রবেশ করতেই বুঝলাম এটা একটা বেশ বড় হলঘর যেটাকে হরনাথবাবু একটা ল্যাব বা সংগ্রহশালা হিসেবে ইউজ করছেন। চারিদিকে নানান কাচের জারে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ, সামুদ্রিক প্রাণী, অ্যাকোয়ারিয়ামে অদ্ভুত আকার আকৃতির মাছ ইত্যাদি। উনি একটা একটা করে দেখাচ্ছেন আর সেগুলোর নাম, সায়েন্টিফিক নাম, কোনওটা আফ্রিকা, কোনওটা উরুগুয়ে, কোনওটা সুমাত্রা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ব্রেজিল থেকে নিয়ে এসেছেন সেসব গল্প বলে চলেছেন। এর অধিকাংশই আমি প্রথমবার দেখছি। এমন অদ্ভুত সব ক্রিয়েচার পৃথিবীতে থাকে বলে জানতামই না এসব না দেখলে।
একটা লম্বা টেবিলে পর পর সব সাজানো রয়েছে সেসব জার। একে একে হরনাথবাবু প্রতিটা জারে রাখা পতঙ্গগুলো সম্বন্ধে নানান চমকপ্রদ ইনফরমেশন দিয়ে যাচ্ছেন। যেমন প্রথমেই একটা ছোট্ট মাকড়শা দেখিয়ে বললেন, “এটা দেখছেন? এটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান পিকক স্পাইডার যার সায়েন্টিফিক নাম ম্যারাটাস জ্যাকটাটাস। খুব সুন্দর না দেখতে?”
আমি দেখলাম সত্যিই কী আশ্চর্য সুন্দর সেটা। মাথায় ময়ূরের পেখমের মতোই রংবেরংয়ের ছটা।
“এদের পুরুষ মাকড়শারা আবার স্ত্রী মাকড়শাদের সঙ্গে মিলিত হবার সময় একধরনের সিগন্যাল দেয়, একটা পাকে ওপরে তুলে।” এই বলে হরনাথবাবু মুচকি হাসলেন। তারপর একটা খাঁচার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ওই যে দেখতে পাচ্ছেন… কী বলুন তো?”
আমি দেখলাম একটা বড় লোহার খাঁচায় গোটাকতক ইঁদুর। ছুঁচোও হতে পারে। আসলে দেখতে সাধারণ ইঁদুর বা ছুঁচোর চেয়ে একটু আলাদা। তাই আমি বললাম…
“ও… তো ইঁদুর মনে হচ্ছে। তাই তো… নাকি?”
হরনাথবাবু খাঁচার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ঠিক তাই। এদের নাম নেকেড মোল র্যাট। পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়ার একটা ট্রাইবাল গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলাম, তাও প্রায় পনেরো বছর হল বোধহয়।”
আমি হরনাথবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “তা… কী করে হয়! ইঁদুরেরা তো বছর দুয়েকের বেশি বাঁচে না সাধারণত। খুব বড়জোর তিন কি চার।”
“আপনি যে ইঁদুরের কথা বলছেন সেগুলো আমাদের ঘরের সাধারণ ইঁদুর। তবে এই যে ইঁদুর দেখছেন আমাদের ঘরের নেংটি ইঁদুর বা বড়ো ছুঁচোর মতো দু-চার বছর পর টেঁসে যাওয়ার প্রাণী নয়। এরা প্রায় কুড়ি-তিরিশ বছর দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।”
আমি তো শুনে একেবারে থ, “বলেন কি?”
উনি বলে চললেন, “আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনার হয়তো কাজে লাগবে যদি ভবিষ্যতে রিসার্চ টিসার্চ করেন… দিজ র্যাট্স আর রেজিসট্যান্ট টু ক্যান্সারস। এদের কিছু জেনেটিক মেকআপের কারণে এরা ক্যান্সার থেকে পুরোপুরি সেফ বলতে পারেন। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা, এরা কিন্তু খুব সামান্য অক্সিজেনের পরিবেশেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে, যেখানে আমরা হয়তো মিনিটখানেকও বাঁচতে পারব না।”
একসঙ্গে এতগুলো মাথা ঘোরানো তথ্য শুনে আমার চোয়াল প্রায় ঝুলে গেছে বিস্ময়ে। কী অদ্ভুত প্রাণী!
এইসব শুনতে শুনতেই হঠাৎ চোখ পড়ল পাশের টেবিলে রাখা নীল টবের জবা গাছটায়। ভারী সুন্দর হলদেটে-লাল জবাফুল ফুটে রয়েছে চার-পাঁচটা। তবে যেটা দেখে আমার আরও আশ্চর্য লাগল তা হল গাছটার শাখাগুলো সব হলদে-সবুজ কাঁটায় ভরতি। আমি হরনাথবাবুকে জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না,
“আচ্ছা ওটা তো জবা গাছ? কিন্তু জবা গাছে তো কাঁটা থাকে বলে দেখিনি কোনওদিন।”
তারপর হরনাথবাবু হাসতে হাসতে আমাকে যা বললেন তা শুনে আমি আবার অবাক হলাম। ভাবলাম হয়তো কলম করে কোনও শঙ্কর প্রজাতির গাছ তৈরি করেছেন হরনাথবাবু। না, উনি বললেন, “কে বলেছে ওগুলো কাঁটা?”
“মানে!”
“ওগুলো কাঁটা নয় ডাক্তারবাবু। ওগুলো একধরনের পতঙ্গ। নাম থর্ন বাগস। অবশ্য দূর থেকে দেখলে কাঁটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।” বলে একটু হাসলেন হরনাথবাবু। এদিকে একটার পর একটা চমক দেখতে দেখতে আমি তো প্রায় স্তম্ভিত। সামনে এগিয়ে একটা অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছে যেতেই আঁতকে উঠলাম।
“একি! কুমিরের বাচ্চা নাকি!” অস্ফুটেই বেরিয়ে এল মুখ থেকে। হরনাথবাবু সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আবার একটা চওড়া হাসি মেখে বললেন, “এটা একধরনের মাছ। তবে কুমিরের মতো মুখের আকার ও দাঁতের সারি দেখে ছোটখাটো একটা কুমিরের বাচ্চা বলেই মনে হয়। তাই এর নাম অ্যালিগেটর গার। প্রজাতিটি কিন্তু আজ থেকে প্রায় দশ কোটি বছর আগের, মানে যখন পৃথিবীতে ডাইনোসরেরা রাজত্ব করত, সেই সময়কার।”
কি আশ্চর্য! ডাইনোসরের প্রতিবেশী! ভাবতেও অবাক লাগে।
এর পর জায়ান্ট লং লেগেড ক্যাটিডিড, ভ্যাম্পায়ার ব্যাট, হারকিউলিস বিটলের মতো আরও অনেক অত্যাশ্চর্য কীটপতঙ্গ দেখে সব শেষে উনি নিয়ে গেলেন ঘরের একটা কোনার দিকে যেখানে একটা টেবিলে সাজানো রয়েছে বেশ কিছু ছোটবড় কৌটো। তাতেও দেখলাম রয়েছে অদ্ভুত সব পোকামাকড়। তবে, আমি সবচাইতে বেশি অবাক হলাম যেটা দেখে সেটা হল একদম শেষের সারিতে রাখা একটা সিঁদুরের কৌটো, ঠিক যেমনটা আমরা মায়েদের কাছে দেখে থাকি। ওদিকে আঙুল দেখাতেই হরনাথবাবুর এতক্ষণ উচ্ছসিত মুখটাতে যেন একটা অন্ধকার ছায়া নেমে এলো। মুহূর্তেই সেটা সরে গিয়ে আবার আগের হাসিটা মুখে ফিরিয়ে এনে উনি বললেন,
“ওতেই রয়েছে সেই বিষমৌরি”।
এতগুলো চমকের ধাক্কা সামলে সবশেষ ও সবচাইতে বড় ধাক্কাটার জন্য নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিই। কারণ এটাই যে হরনাথবাবুর সেরা কালেকশন সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না।
হরনাথবাবু সিঁদুরের কৌটোটা খুলে ভেতরের জিনিসটাকে বের করে নিজের হাতের চেটোয় রাখলেন। আমি দেখলাম রম্বস বা খানিকটা উত্তল লেন্স আকৃতির একটা ছোট্ট পাথরের মতো জিনিস। আর সেটার গায়ে এপাশ থেকে ওপাশের পোল অব্দি লম্বা লম্বা লাইন ঠিক যেন মৌরির মতো। মাঝখানটায় একটা গোল কালো অংশ যেটা দিয়ে সম্ভবত বিষ শুষে নেয় ওটা। আর মাঝের লম্বা লাইনটার দু-পাশে চোখের মতো কিছু গোল কালচে দাগ। হরনাথবাবু সেটাকে আবার সিঁদুরের কৌটোয় তুলে রাখার পর আমি বললাম,
“হম, সেরা জিনিস নিঃসন্দেহে।
কিন্তু সিঁদুরের কৌটোতে রেখেছেন কেন, ওটাকে?” কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম আমি।
হরনাথবাবু আলতো হেসে জবাব দিলেন, “ওর খাবার যে শুধু সিঁদুর।”
এটা শুনে আমার মাথার মধ্যে সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে একে একে। এও কি সম্ভব! একটা প্রাণীর খাবার কি সিঁদুর হতে পারে? আমার খুব চেনা বিজ্ঞানও যেন ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে উঠছে আমার কাছে। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে বললাম, “আচ্ছা, এ জিনিস পেলেন কোথায় আপনি?”
এবার যেন অনেকটা সাবলীলভাবেই বললেন হরনাথবাবু,
“তখন আমি সবে জুলোজির প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছি বছর খানেক। পড়ানোর ফাঁকে বিভিন্ন প্রাণী, কীটপতঙ্গ নিয়ে রিসার্চ শুরু তখন থেকেই। সময় পেলেই দেশবিদেশে পাড়ি দিতাম অচেনা অজানা প্রজাতির সন্ধানে। সেরকমই একবার একমাসের ছুটি নিয়ে নাগাল্যান্ডের একটা পাহাড়ি আদিবাসী গ্রামে সাপের এক প্রজাতির খোঁজে যাই যা একমাত্র ওই অঞ্চলেই পাওয়া যেত, তবে বিলুপ্তির পথে ছিল বেশ কিছু বছর আগে থেকেই। দিন কয়েক খোঁজাখুঁজি করেও সে প্রজাতির কোনও চিহ্ন পাইনি আমি। সম্ভবত বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তার আগেই। অগত্যা ফিরে আসার প্ল্যান করছি, ঠিক সেই সময়ই দেখা হয়ে যায় হোকিম সেমা নামের লোধা উপজাতির এক বুড়ো ওঝার সঙ্গে। ওদের অতিথি আপ্যায়নে বেশ খুশি হয়েই থেকে গেলাম কিছুদিন হোকিম সেমার কুটিরে, সেমার আমন্ত্রণে। তারপর আরও বেশ কিছুদিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। ফিরে আসার সময় সেমার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম এই বিষমৌরি।”
আমি এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলাম। হরনাথবাবুর কথা শেষ হতেই আমার মাথায় যে প্রশ্নটা বারবার ছোটাছুটি করছিল সেটাই জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, এ জিনিস ইউজ করেন কীভাবে?”
“হ্যাঁ, বলি তবে… প্রথমেই যখন রুগি আসে, তাকে আগে শুইয়ে এটা ক্ষতস্থানে আটকে দিই। পুরো বিষটা টানা হলে আপনা থেকেই সেটা খসে পড়ে যায় মাটিতে। এরপর ওটাকে দুধের মধ্যে রাখতে হয় কিছুক্ষণ। তাহলে একটা বুদবুদ দেখা যাবে কিছুক্ষণের জন্য। সেই বাবলস থামলে তারপর জলে খানিকক্ষণ রেখে ফের সিঁদুর কৌটোয় ভরে রেখে দিই যত্ন করে।”
হরনাথবাবুর কালেকশন দেখতে দেখতে কখন যে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে হয়ে এসেছে খেয়াল নেই। হরনাথবাবুকে বললাম, “আপনার কালেকশন যে কাউকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে, একথা মানতেই হচ্ছে হরনাথবাবু। আচ্ছা, আজ তাহলে চলি। আমার কিছু কাজ আছে আবার গিয়ে। আরেক দিন আসব না-হয় আপনার সঙ্গে গল্প করতে।”
এই বলে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। সঙ্গে টর্চ ছিল না। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় পথ দেখে চলতে একটু অসুবিধেই হচ্ছিল। চারদিকে বেশ অন্ধকার, ঝোপঝাড়। একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকে কানে প্রায় তালা লেগে যাবার জোগাড়। হঠাৎ দেখি সামনের সরু পথটা বেয়ে শুকনো পাতার ওপর সরসর করে একটা লম্বা কালো মতো কি যেনো পথের এপার থেকে ওপারে চলে গেল। কিছুদূরে মাটির ঘরগুলোতে সন্ধ্যা প্রদীপের কম্পমান শিখা দপদপ করছে। যেনো এক নিঝুম অন্ধকারের চাদর ঢেকে রয়েছে পুরো গ্রামটাকে। মিনিট পাঁচেক পরে বাড়ি যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে আকাশে পেল্লাই সাইজের চাঁদ বাবাজি রীতিমত হাঁকিয়ে বসেছেন মিটমিট করে তাকিয়ে থাকা তারাগুলোর সঙ্গে। আজ পূর্ণিমা টুর্নিমা গোছের কিছু একটা হবে বোধহয়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মাকে একটা ফোন করতে হবে। সকাল থেকে কাজের চাপে একটুও সময় পাইনি।
ফোনটা বের করে দেখি দুটো মিসড কল… মায়ের ফোন থেকেই। তারপর মায়ের সঙ্গে দু-একটা দরকারি অদরকারি কথা বলে ফোনটা রেখে বিছানার পাশে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ সেরে পরের কদিনের কাজের সিডিউল মনে মনে একবার ভেবে নিচ্ছি, হঠাৎ আমার ফোনটা আবার বেজে উঠল। টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, অনেকদিন পর আবার কলেজের বন্ধুরা সবাই ভিডিয়ো কল করে কনফারেন্সে লাগিয়েছে আমাকে।
দেখলাম মান্না, গোপাল, ব্যান্ডো সবাই রয়েছে কলে।
ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ব্যান্ডোর প্রশ্ন, “কি হে ডাক্তার!…কেমন ডিউটি দিচ্ছিস আজকাল হসপিটালে?…” হো হো করে হেসে উঠল বাকিরা।
তারপর কলেজ লাইফের নানান গল্প আড্ডা হতে হতে কখন যে দশটা পেরিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। মাঝখানে রামুদা এসে কখন রাতের খাবারের টিফিনও রেখে গেছে দরজার সামনে।
পরের দিন থেকে টানা বেশ ক-দিন ভালোই কাজের চাপ শুরু হল। যদিও সকালবেলা প্রতিদিনই গ্রাউন্ডে দেখা হচ্ছে হরনাথবাবুর সঙ্গে। তবে এখন আগের চেয়ে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায় আমার। সকালে ওঠার অভ্যেসটা বেশ ভালোই তৈরি হয়েছে এই কদিনে। এখন একটু আগেই পৌঁছে যাই গ্রাউন্ডে। তাই কিছুক্ষণ হরনাথবাবুর সঙ্গে গল্পও হয় ওখানে। এইভাবে বেশ চলছিল। দিন পনেরো পর হঠাৎ আজ আবার হরনাথবাবু এলেন না মাঠে। এখন এমনিতেই কাজের চাপটা একটু কমেছে। তাই ভাবলাম হরনাথবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে এলে মন্দ হয় না। অনেকদিন তাঁর বাড়ি যাওয়াও হয়নি। শরীর-টরির খারাপ হল না তো আবার?
বাড়ি ফিরে চট করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। সোজা মোরামের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে সামনে একটা মন্দির, সেটা পেরোলেই একটা পানাপুকুর পড়বে। সেটাকে পাশ কাটিয়ে বামদিকে গেলে মিনিট খানেকের একটা ইউক্যালিপটাসের ঝোপঝাড়ের মাঝে সরু রাস্তাটার শেষেই শুরু হয়েছে একটা পাড়া। দু-তিনটে ঘর পরেই ওঁর বাড়ি।
হরনাথবাবুর বাড়ি পৌঁছে দরজায় বেশ কয়েকবার টোকা দিতে হল। খানিক পরে দরজা খুলতে হরনাথবাবুকে দেখে একটু অবাকই হলাম।
“একি! আপনার শরীর খারাপ নাকি? চোখদুটো লাল। আর দেখে তো দুর্বলও মনে হচ্ছে বেশ। গ্রাউন্ডে হাঁটতে গেলেন না দেখে একবার খোঁজ নিতে এলাম আপনার” বলে ভেতরে ঢুকে এলাম।
উনি দরজা আটকে ভেতরের ঘরে এসে বিছানায় বসে বললেন, “না না, তেমন কিছু না ডাক্তারবাবু। ওই একটু গা হাত পায়ে ব্যাথা অল্প। তাই আর গেলাম না।”
আমি ওঁর কবজি ধরে পালসটা একবার দেখে নিলাম। নরমাল। শুধু গা-টা একটু গরম আছে।
বললাম, “জ্বর এল কী করে! ওষুধ খেয়েছেন?”
“ও খানিক পরেই ঠিক হয়ে যাবে একটু রেস্ট নিলেই। আপনি চিন্তা করবেন না। তা ছাড়া ওষুধ আনা আছে ঘরেই। সেরকম হলে খেয়ে নেব।” হরনাথবাবুর এই কথা শুনে আমি বললাম, “তাও যদি অসুবিধে হয় বলবেন কিন্তু।”
চোখদুটো পরীক্ষা করে বুঝলাম নাহ্, সেরকম কিছু না, রাতে ঘুম হয়নি ভালো তাই একটু লাল হয়ে আছে।
“কই দেখি আপনার জিভটা একটু দেখান তো” বলে মোবাইলের ফ্ল্যাশটা জ্বেলে দেখতে গেলাম।
হরনাথবাবু বার কয়েক ইতস্তত করে অবশেষে জিভটা বের করলেন।
হঠাৎ সেটা দেখে যেন একটু চমকে উঠলাম। কেমন একটা নীলচে ভাব যেন গোটা জিভটায়। আমি বললাম, “আপনার কি কোনও অসুখটসুখ আছে আগে থেকে? না মানে অন্য কোনও সমস্যা বা কিছু?”
উনি ভাবলেশহীন ভাবে বললেন, “কই তেমন কিছু তো না। ও… সব কিছু না ডাক্তারবাবু। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সেরে যাবে একটু বিশ্রাম নিলে। রাতে ঘুমটা আসলে ভালো হয়নি তো কাল, তাই…”
“আচ্ছা তবে রেস্ট নিন। প্রয়োজন হলে ফোন করবেন কেমন। নাম্বার তো আগের দিনই দিয়েছিলাম। আসছি তবে…”
আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। কথাগুলো বলে দরজাটা ভেজিয়ে চলে এলাম বাড়িতে।
বাড়ি ফিরে বিনয়বাবুর মুখে শুনলাম গতকাল রাত্রে নাকি গ্রামের হাইস্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টার মানে নগেন চৌধুরীকে সাপে কেটেছিল। তারপর সবাই ধরাধরি করে হরনাথবাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ বলা যায় তাঁকে। বিনয়বাবুর কাছে এই ঘটনার কথা শুনে কেন জানি না আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল।
আগের বারেও যখন হরনাথবাবু মাঠে হাঁটতে এলেন না সেবারও কাউকে সাপে কেটেছিল, আর এবারেও তাই। ধুর কীসব ভাবছি যা তা! এমনও তো হতে পারে, ওইদিনও হয়তো রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি ওঁর। রোগীকে বাঁচাতে গিয়ে হয়তো রাত জাগতে হয়েছে।
তাহলেও একটা জিনিস আমার মাথায় খচখচ করছে সকাল থেকে… ওঁর ওই জিভটা। ওটা ওরকম নীলচে ছিল কেন? পেরিফেরাল সায়ানোসিসের বেশ কিছু পেশেন্টদের ওইরকম দেখেছি হসপিটালে, কিন্তু তাহলে তো আঙুলের নখ, ঠোঁট সেসবও নীল হত। হরনাথবাবুর তো সেসব কিছু নেই। মাথার মধ্যে এলোমেলো একরাশ চিন্তা যেন দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। কাল একবার হরনাথবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসা উচিত মনে হয়।
তবে তার আর দরকার পড়ল না। পরদিন সকালেই দেখা হয়ে গেল গ্রাউন্ডে। আজ তাঁকে একদম ফিট লাগছে। নো ট্রেস অফ উইকনেস।
“কেমন আছেন আজ?” আমার প্রশ্নটা শুনতে পেয়ে হরনাথবাবুর সেই চেনা হাসিটা আবার ওঁর মুখে দেখা গেল। একটু হেসে উনি জবাব দিলেন, “এই যেমন দেখছেন, একেবারে ফিট অ্যান্ড ফাইন।”
ওঁর মুখের ওই হাসিটা দেখে আমার সব চিন্তা যেন মন থেকে সরে গিয়ে ওঁর প্রতি একটা শ্রদ্ধা জেগে উঠল নিজের অজান্তেই। একলা বয়স্ক মানুষটা নিজের প্রফেশন, সুখস্বাচ্ছন্দ্য সব ছেড়ে শুধু গ্রামের মানুষগুলোর জন্য এখানে পড়ে রয়েছেন। রাত নেই দিন নেই যখনই কোনও সাপে কাটা রোগী ওঁর কাছে গিয়ে পৌঁছায় উনি যেন জাদুমন্ত্রের মতো ভালো করে দেন। এই গ্রামের মানুষগুলোকে ভালো রাখার, সুস্থ রাখার দায় যেন উনি একা কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল দিন দশেক পরের একটা ঘটনায়। রাতের বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা। অনেকদিন পর আবার হসপিটালের ডিউটি সেরে ফিরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল। দিনের সবচেয়ে শেষ বাসটা থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরে হাঁটছিলাম। বাস স্ট্যান্ড বা বলা ভালো বাঁশ স্ট্যান্ড অর্থাৎ বাঁশের খুঁটি দিয়ে একটা ছোট্ট ছাউনি যেখানে গ্রামের বাস থামে, সেখান থেকে গ্রামের সরু রাস্তা ধরে মিনিট কয়েক হাঁটলেই বিনয়বাবুর ছোটখাটো দোতলা পাকা বাড়ি। মোবাইলে চার্জ ছিল না একদম, তাই চাঁদের আলোই ভরসা। ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে কোনওরকমে পা চালিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেছি অমনি পিচ্ছিল কিছু একটাতে পা ঠেকল আর সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম। মাথাটা যেন ঘুরে গেল হঠাৎই।
বুঝতে বাকি রইল না দুটো বিষাক্ত দাঁত পায়ের গোড়ালির ওপর চামড়া ভেদ করে গভীরে প্রবেশ করে নিমেষের মধ্যে কিছুটা বিষ আমার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। নিজেকে অভয় দিলাম… এ সময় স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না। আরও মিনিট দুই কোনওরকমে পা চালিয়ে বাড়ি পৌঁছে বিনয়বাবুকে ডাকলাম। গলার আওয়াজই বেরোচ্ছে না যেন আমার। বিনয়বাবু পাশের ঘরে ছিলেন। ডাক শুনেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলেন বাইরে। ততক্ষণে আমার শরীর অবশ হয়ে এসেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। চোখদুটো খুলে রাখতে অসুবিধে হচ্ছে। কথাগুলো যেন জড়িয়ে যাচ্ছে একটার সঙ্গে আরেকটা। মাথাটা শুধু কাজ করছে মনে হল তখনও। কোনওভাবেই চোখ বন্ধ করা যাবে না। এ নির্ঘাৎ চিতি কিংবা কালকেউটের কামড় অর্থাৎ নিউরোটক্সিক স্নেক বাইট।
আমার নার্ভগুলো যেন আর আমার কন্ট্রোলে নেই, সবাই ভুলে যাচ্ছে নিজেদের কাজ। এই সময় আমার হসপিটালে থাকা খুব প্রয়োজন। অন্টিভেনোম সিরাম লাগবে ইমিডিয়েটলি। কিন্তু এখন হসপিটালে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব। এর মাঝেই বুঝতে পারছি বিনয়বাবু ব্যাপারখানা আঁচ করেই চিৎকারে লোকজন জড়ো করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে যেন শুনতে পাচ্ছি সবাই বলাবলি করছে, “ডাক্তারবাবুকে সাপে কাইট্যেছে, উ পাড়ায় লিয়ে চ হরেনখুড়ার কাছে।”
আমার বিচার বুদ্ধি যেন লোপ পাচ্ছে। এতদিনের শেখা ডাক্তারি বিদ্যে, বিজ্ঞান সব ভুলে গিয়ে বাঁচার ইচ্ছেটাই এখন প্রবল হয়ে উঠছে। কোনওরকমে নিজেকে শক্ত করে বললাম, “আ… আমাকে হরনাথবাবুর কাছে নিয়ে চলুন… বিনয়বাবু।”
আমার সংজ্ঞা লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে আমি বুঝতে পারছি কয়েকজন লোক ধরাধরি করে আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। তারপর যখন আমার জ্ঞান একটু ফিরল আবছা আবছা দেখতে পেলাম কে যেন আমার পায়ের কাছে একটা কী লাগিয়ে দিতেই সেটা আঠার মতো চিটে গেল আমার পায়ে। তারপর কতক্ষণ অচেতন হয়ে পড়ে ছিলাম মনে নেই। ঘোরের মধ্যেই পায়ের ঘষা লেগে অজান্তেই সেই আঠালো জিনিসটা মনে হল পা থেকে খসে নীচে পড়ে গেল। আর তার খানিকক্ষণ পরেই আমার অচেতন ভাবটা কেটে গেল। মাথা আবার একটু একটু কাজ করতে শুরু করেছে, কিন্তু শরীর ও মস্তিষ্ক দুটোই ব্যথায় অবশ। একটা তীব্র যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথাটা। বিষের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সারা গায়ে। আমি জানি এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি নির্ঘাৎ মারা যাবো। কিন্তু কিছু করার নেই। হঠাৎ আমার মনে হল যেন একটা আবছায়া কেউ এসে দাঁড়িয়েছে আমার পায়ের কাছে। ঘোর লাগা চোখেই দেখতে পেলাম সেই অবয়বটা। আমার খুব চেনা একটা মানুষ।
কিন্তু এ… একি! আমি স্বপ্ন দেখছিনা তো? এ কী করে সম্ভব! সেই আবছায়া অবয়বটা হাঁ করতেই ঝকঝকে দু সারি সাদা দাঁতের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এল একটা প্রায় একহাত লম্বা জিভ। আর সারা জিভ জুড়ে অসংখ্য ক্ষত। না ঠিক ক্ষত নয়… ওগুলো এক একটা বিষমৌরি, ঠিক যেমনটা হরনাথবাবুর সংগ্রহশালায় দেখেছিলাম। সেগুলো সব যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে একসঙ্গে। এক মুহূর্তের জন্য গা-টা আমার শিরশির করে উঠল। সরু লিকলিকে জিভটা এবার নেমে এল আমার পায়ের ক্ষতস্থানটাকে লক্ষ করে। তারপর সেখান থেকে শুষে নিতে থাকল সমস্ত বিষ। আমার শরীরটা ধীরে ধীরে একটা কীসের যেন আবেশে আবার হারিয়ে গেল ঘুমের অতলে।
শরীর থেকে সমস্ত বিষ শুষে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘোরটা হঠাৎ কেটে যেতেই চোখাচোখি হয়ে গেল হরনাথবাবুর সঙ্গে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম সব। একটু আগে যেটাকে দুঃস্বপ্ন ভাবছিলাম সেটা মোটেও আমার দুর্বল অবচেতন মনের নিছক কল্পনা ছিল না। স্পষ্ট দেখলাম ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে জিভটা আবার আগের মতো হাঁ করে থাকা মুখটার মধ্যে ঢুকে গেল।
আমি ভয়ে বিস্ময়ে আঁতকে উঠলাম। একটা মৃদু আর্তনাদ যেন নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল। শরীরের অবশ ভাবটা পুরো কেটে গেছে এখন। মেঝের ওপর উঠে বসলাম আমি। হরনাথবাবু যেন অপ্রস্তুতে পড়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গেলেন খানিকক্ষণ। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “এ… এসব কিী হরনাথবাবু! আ… আপনি যে বলেছিলেন এই সব কাজ বিষমৌরি করে! আসল রহস্যটা কী? আমাকে বলুন।”
হরনাথবাবু প্রায় কেঁদেই ফেললেন।
“আমি বলতে পারব না ডাক্তারবাবু। মাফ করবেন… মাফ করে দিন আমাকে ডাক্তারবাবু।”
“আপনাকে আজ বলতেই হবে। এতদিন ধরে যে সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছেন আজ আমাকে তা বলতেই হবে। কেন গোপন রেখেছেন বলুন, আমি জানতে চাই হরনাথবাবু। বিষমৌরি বলে তাহলে সত্যিই কিছু নেই? সবটাই আপনার মনগড়া একটা গল্প?”
আমার শেষ কথাটা শুনে হরনাথবাবু আর থাকতে পারলেন না। কান্না ভেজা চোখে বললেন,
“না না…না বিষমৌরি মিথ্যে নয় ডাক্তারবাবু। আমি আপনাকে যে বিষমৌরি দেখিয়েছিলাম তা সত্যি। সব সত্যি। সব…”
“কিন্তু আমি যখন অচেতন ছিলাম তখন তো আপনি নিজেই আমার পায়ের ক্ষতস্থান থেকে সাপের বিষ শুষে নিচ্ছিলেন। আমি স্পষ্ট দেখেছি। সেখানে নিশ্চয় বিষমৌরি লাগাননি তাহলে…
তাহলে ওটা কি ছিল, যেটা প্রথমেই আমার পায়ে চিটিয়ে দিয়েছিলেন?”
আমার প্রশ্ন শুনে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে হরনাথবাবু বললেন, “নাহ, ওটা বিষমৌরি ছিল না। আপনি ঠিকই ধরেছেন। ওটা একটা ফেন্টানিল প্যাচ ছিল যাতে ওটা লাগিয়ে আপনাকে কিছুক্ষনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়। সেরকমই ওষুধের একটা নির্দিষ্ট ডোজ ব্যবহার করি আমি প্যাচটায়। এতে আমারও কাজের সুবিধে হত। আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমের মধ্যে রেখে আপনার শরীর থেকে বিষটা শুষে নেওয়া যেত সহজেই। কিন্তু তার আগেই আপনার পায়ে লেগে প্যাচটা কখন খসে পড়ে যায় আমি লক্ষ করিনি। আর ওষুধটা কাজ করার পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় আপনার ঘোর কেটে যায়।”
“ও, ওটা ট্রান্সডার্মাল প্যাচ ছিল তাহলে! তাই ওটা লাগানোর মিনিট কয়েকের মধ্যে আমার এত ঝিমুনি আসছিল। এতসব কী লোকানোর জন্য করছেন, হরনাথবাবু বলুন?
আমার শেষ কথাটা শুনে এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন হরনাথবাবু।
“ডাক্তারবাবু… সব আমার ভুল… আমারই দোষ সব। পাপ করেছি আমি… পাপ। আজও তাই সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি আমি।”
“খুলে বলুন সবটা আমাকে। বিশ্বাস করুন আমাকে, আমি কাউকে এ ব্যাপারে কিচ্ছু বলব না। প্লিজ বলুন আমায়।” আমি একরকম প্রায় জোর করেই বললাম এবার। একরকম হতাশ হয়ে খানিকক্ষণ মাটির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন হরনাথবাবু।
“তাহলে শুনুন ডাক্তারবাবু”… বলে চোখ মুছে এইবার হরনাথবাবু বলতে শুরু করলেন,
“আপনাকে সেই ওঝা হোকিম সেমার কথা বলেছিলাম মনে আছে? নাগাল্যান্ডের পাহাড়ি জঙ্গলে আমার সঙ্গে দেখা হবার পর কিছুদিন তার আমন্ত্রণেই সেমার কুটিরে দিনকতক থেকে যাই।
“সে-ও একাই থাকত কুটিরে। ওদের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন কিছুটা আমাদের আদিবাসীদের সঙ্গে মিল থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে আলাদা কিংবা বলা ভালো অদ্ভুত। এরকম বেশ কিছুদিন আছি সেখানে। একটা ব্যাপার তখন লক্ষ করলাম আমি। সাপে কাটা রোগীরা প্রায়ই আসছে সেমার সাহায্য নিতে। একদিন একটা লোককে বেশ কিছু লোধা সম্প্রদায়ের আদিবাসী ধরাধরি করে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল সেমার কুটিরের কাছে, আর সেমা একটা পাথরের মতো কী যেন দিয়ে কিছু মন্ত্র বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে রোগীর শরীরের সাপে কাটা অংশে লাগিয়ে দিতেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ ও নির্বিষ হয়ে গেল। সেই জিনিসটার প্রতি তখন থেকেই একটা তীব্র কৌতুহল জন্মায় আমার।
“ঐ অঞ্চলের উপজাতির ভাষাও বাংলা। তবে কিছুটা রাজবংশী উপভাষার ছোঁয়া ও কিছুটা লোধা উপগোষ্ঠির স্থানীয় ভাষায় প্রভাব লক্ষ করলাম।
“সেমার কাছে জানতে পারলাম ওটার নাম স্থানীয় ভাষায় বিষমৌরি। ওর গুরু মারা যাবার আগে সেমাকে ওটা দিয়ে যায়। আমার কিন্তু মনে হয় ডাক্তারবাবু, প্রাণীটা এই জগতের প্রাণীই নয়। এধরনের সিঁদুর অর্থাৎ যা আসলে পারদের যৌগ যার একমাত্র খাবার, সেই প্রাণী আর যাইহোক বিশেষ কিছু ক্ষমতার অধিকারী যে হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেমার গুরু তাকে এই বিষমৌরি কোথায় বা কীভাবে পেয়েছিল সে খবর বলেনি, তাই আপাতত সেটা আর জানার উপায় নেই।
“যাইহোক জিনিসটার প্রতি একটু একটু করে আমার লোভ বাড়তে থাকল। এমন জিনিস হাতে পেলে আমি রাতারাতি বিজ্ঞানমহলে সাড়া ফেলে দিতে পারতাম। সেমার সঙ্গে তখন বেশ ভালোই পরিচয় হয়ে গেছে। আমাদের নানান বিষয়ে গল্প আলোচনা হত। এইরকমই একদিন সেমার কাছে বিষমৌরির ব্যাপারে আরও একটা জিনিস জানতে পারি আমি। সেমা আমাকে বলে, ‘এই বিষমৌরি কিন্তু যার তার হাতে কাজ করবে না। এ জিনিস যার অধিকারে থাকবে একমাত্র তার হাতেই কাজ করবে। অন্য কেউ এর ব্যবহার করলে ভয়ানক অনর্থ হবে। এই বিষমৌরির ওপর অধিকার পেতে হলে একটা নির্দিষ্ট পূজাপদ্ধতি অবলম্বন করেই তা সম্ভব। অমাবস্যার রাতে একটা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ একটানা একটা নাগমন্ত্র জপ করতে হবে।’
“এই বলে থলি থেকে লাল শালুতে মোড়া একটা পুরোনো রংচটা পুঁথি মতো বের করে একটা জায়গা নির্দেশ করল সেমা। বাংলা হরফে লেখা থাকলেও সে ভাষা আমার চেনা কোনও ভাষা নয়। পাতার নিচে ছোট ছোট করে পরিষ্কার বাংলায় লেখা কিছু নির্দেশ। সেটা পড়ে বুঝলাম এই নির্দেশে উল্লেখিত উচ্চারনেই মন্ত্রটা পড়তে হবে।
“সেমা বলে চলল, ‘এই সেই নাগমন্ত্র। যেটা ঐ বিশেষ উচ্চারণে পড়তে হয় পুজোর সময়। আমার গুরুর কাছ থেকেই পাই এই পুঁথি। হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম…
‘তারপর মন্ত্রপাঠ হলে বিষমৌরিটাকে দুধের পাত্রে রাখতে হবে খানিকক্ষণ।
‘বুদবুদ থেমে গেলে, একটা জ্যান্ত সাপের রক্ত কয়েক ফোঁটা সেই দুধে মিশিয়ে আবার সেই বীজমন্ত্র জপ করতে হবে আঠারো বার। মন্ত্র পড়া শেষ হলে পুজো শেষে আরেকটা জ্যান্ত সাপের বলি দিতে হবে। সাপের গলাটা ছুরি দিয়ে কেটে সেটাকে পুজোর জন্য জ্বালানো আগুনে আহুতি দিলে তবেই পুজো সম্পূর্ণ হবে আর এই বিষমৌরি অধিকার করা যাবে। কিন্তু সাবধান।
‘পুজো অসম্পূর্ণ থেকে গেলে বা সম্পূর্ণ হবার আগেই যদি ওই বিষমৌরিটাকে ব্যবহার করা হয় তবে শেষবারের মতো কাজ করার পর সেটা মারা যাবে। সঙ্গে পূজারীর ওপর নেমে আসতে পারে ভয়ঙ্কর অভিশাপ।’
“আমি তখন লোভে অন্ধ হয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক কাজটা করে ফেলি যে জন্য আজও আপশোষ হয় আমার। সেসব কথা মনে করলেই ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাই বারবার,” এই বলে আবার ফুপিয়ে উঠলেন হরনাথবাবু।
“কী এমন কাজ করেছিলেন আপনি?”
আমার চোখে কৌতুহল আর ভয়ের ছায়া একসঙ্গে ফুটে ওঠে। হরনাথবাবু ভেজা চোখে বলে চলেন,
“সেমাকে আমি ওই বিষমৌরির লোভে খুন করি। রাত্রিবেলা যখন সেমা মেঝেতে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সেই সময় একটা বিষাক্ত গোখরো সাপ ছেড়ে দিই চুপিচুপি ওর পায়ের কাছে। গোখরোটাকে ধরেছিলাম সেদিন বিকেলেই ওই জঙ্গলে। বিষমৌরিটাকে অবশ্য আগেই সরিয়ে রাখতে হয়েছিল যাতে সেমা সেটা ব্যবহার না করতে পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। গোখরোর একটা মোক্ষম কামড়েই কাজ হয়ে যায়। তবে সেমা, মারা যাবার আগে নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছিল সব। তবু সেমা আমাকে সাবধান করে দিয়ে যায়, ‘এ… এবার থেকে কিন্তু ওই বিষমৌরির সমস্ত দায়… তোমার। সব দায় তোমার ওপর দিয়ে গে… গেলাম।” এই বলে কী একটা মন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে মারা যায় সেমা।
“তার পরদিনই আমি বিষমৌরিটা নিয়ে পালিয়ে আসি গ্রামে। কিছুদিন পর অমাবস্যার এক রাতে পুজোর জন্য দুটো সাপও জোগাড় করি লোক দিয়ে। তারপর বসি পূজায়। পালিয়ে আসার সময় সেমার থলি থেকে আমি মন্ত্রের পুঁথিটা নিয়েই এসেছিলাম। তাই আগুন জ্বালিয়ে পূজার নিয়ম অনুযায়ী একটা বিশেষ উচ্চারণে সুর করে পড়তে লাগলাম সেই নাগমন্ত্র। কী যেন একটা রয়েছে সেই সুরে। অদ্ভুত মায়াবী কিছু একটা। যেন অন্য কোনও এক জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে সেই মন্ত্র।
মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় খেয়াল করলাম সামনে রাখা বিষমৌরিটার গায়ে কালো কালো দুটো গভীর চোখের মতো অংশ লাল হয়ে ধিকিধিকি জ্বলছে। মন্ত্র শেষ হতেই সেটা আবার নিভে গেল। এরপর দুধের মধ্যে সেটাকে কিছুক্ষণ রেখে একটা জ্যান্ত সাপকে কেটে কয়েকফোঁটা রক্ত দিয়ে আঠেরোবার সেই বীজমন্ত্র উচ্চারণ করলাম।
সব কিছু ঠিকঠাকই হচ্ছিল কিন্তু পুজোর একদম শেষে যে সাপটাকে বলি দেওয়ার কথা সেটাকে থলি থেকে বের করে হাতের ছুরিটা দিয়ে যেই আঘাত করতে যাব অমনি সেটা আমার হাতে একটা বিষাক্ত ছোবল বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই হাত আলগা হয়ে সেটা হাত ফসকে বেরিয়ে পালিয়ে গেল ঝোপের আড়ালে। তীব্র জ্বালা যন্ত্রণায় আমার মাথার ঠিক ছিল না তখন। হাতের কাছে বিষমৌরিটাকে পেয়ে সেটাই ওই কাটাস্থানে লাগিয়ে দিই। বেশ কিছুক্ষণ পর সমস্ত বিষ টেনে সেটা হাত থেকে খসে পড়ে যায় মাটিতে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটু সুস্থ হবার পর বুঝতে পারি কত বড় ভুল করে ফেলেছি আমি।
আমার মাথায় তখন কে যেন বারবার বলে যাচ্ছে মারা যাবার আগে সেমার শেষ কথাগুলো…
“এ… এবার থেকে ওই বিষমৌরির সমস্ত দায় তোমার… সব দায় তোমার ওপর দিয়ে গে… গেলাম।”
হঠাৎ মনে পড়ল পূজা পদ্ধতি বোঝানোর সময় সেমা সাবধান করে দিয়েছিল বারবার পুজো সম্পূর্ণ না হলে পূজারীর ওপর নেমে আসবে ভয়ানক অভিশাপ।
কী সেই অভিশাপ, কী সেই শেষ কথাগুলোর অর্থ তা বুঝেছিলাম দিনকয়েক পরে।
পাশের বাগদি পাড়ার এক বুড়োকে দিন কয়েক পরের এক সন্ধ্যায় সাপে কাটে। আমার কাছে বিষমৌরি আছে জেনে ওরা সব ধরাধরি করে আমার কাছে নিয়ে আসে বুড়োকে। আমি সবাইকে চলে যেতে বলে, বুড়োর পায়ে সাপের দুটো গভীর দাঁতের দাগ লক্ষ করে বিষমৌরিটাকে বসিয়ে দিই। কিন্তু সেটা আটকায় না আর। লাগাতে গেলেই বারবার খসে পড়ে যায়। সামনে বুড়ো অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারি না।
হঠাৎ আমার জিভে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করি। বুঝতে পারছি আমি… ধীরে ধীরে আমার চেতনার ওপর কেউ যেন দখল নিচ্ছে। পরক্ষণেই নেশালাগা চোখে দেখি আমার মুখটা হাঁ হয়ে খুলে গেছে। আর সেখান থেকে আমার জিভটা যেন নিজে থেকেই বেরিয়ে আসছে বাইরে। ধীরে ধীরে লম্বা হচ্ছে এবার সেটা আর সেই তার ওপর ফুটে উঠছে এক এক করে অসংখ্য অপার্থিব সেই ভয়ানক কীট… বিষমৌরি। ধিকধিক করে জ্বলছে লাল চোখগুলো।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি তখনও। অর্ধচেতন হয়ে আমি প্রত্যক্ষ করি সবকিছু। আমার মাথা তখনও কাজ করছে, কিন্তু শরীর অবশ। চাইলেও নিজের ইচ্ছায় কিছুই করতে পারছি না, শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই বিভৎস দৃশ্য দেখা ছাড়া। এ যেন আমার জিভই নয়। সেটার ওপর যেন আমার অধিকার নেই আর। লকলকে জিভটা অদৃশ্য অজানা কারোর নির্দেশে এগিয়ে চলেছে বুড়োর পায়ের দিকে। তারপর সাপে কাটা জায়গাটায় স্পর্শ করে আঠার মতো আটকে গেল সেখানে। আর তখনই জিভের ওপর বিষমৌরিগুলো সব একে একে জীবন্ত হয়ে উঠে নিজেদের কাজ শুরু করে দিল। বুড়োর শরীর থেকে সমস্ত বিষ যেন নিমেষেই শুষে নিতে থাকল জিভটা। তারপর একটা সময় পুরো বিষ টানা হলে আবার আগের মতো ছোট হয়ে মুখের ভেতর প্রবেশ করল সেটা। এতক্ষণ ধরে আমি কোনও এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। চটক ভাঙতে দেখি সব কিছু আগের মতো নর্মাল। বুড়ো আসতে আসতে চোখ খোলে। এবার আমি সব বুঝতে পারি… সেমার মৃত্যুর আগে বলে যাওয়া কথা… অভিশাপ… সব।
পুজোর দিন সত্যি সত্যিই শেষবারের মতো বিষমৌরিটা আমার শরীর থেকে বিষ টেনে নেওয়ার পর মারা যায়। সেই রাতের বিভীষিকার পর আমি ওটাকে দুধের বাটিতে দিয়েও দেখেছি… নিঃসাড়। কোনও বুদবুদ দেখা যায়নি আর।
“মানে? যে বিষমৌরিটা আপনি সেদিন দেখালেন আমায়, ওটা মৃত!”
আমি বিস্ময়ভরা চোখে জিজ্ঞাসা করলাম।
“হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু… বাগদি বুড়োর ঘটনার পর থেকেই আমি বুঝতে পারি এই বিষমৌরির দায় এখন থেকে এবার আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে। চাইলেও এড়ানো কঠিন এ দায়। অনেকবার চেষ্টা করেছি বেরিয়ে আসার কিন্তু পারিনি ডাক্তারবাবু। তারপর গাঁয়ের মানুষের কথা ভেবে… নিজের জঘন্য পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ ভেবে দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আর যতদিন বাঁচব এ দায় কাঁধে নিয়ে চলব।”
কান্নায় ভেঙে পড়েন হরনাথবাবু। আমারও দুটো চোখ এবার চিকচিক করে। কষ্টও হয় এই মানুষটার জন্য একটু।
“তাহলে সেদিন আপনার জিভটা ওরকম নীল লাগছিল…”
আমার কথা শেষ হবার আগেই হরনাথবাবু বললেন,
“আপনি যেদিন দেখেছিলেন তার আগের দিন এরকমই কারোর শরীর থেকে বিষ টেনেছিলাম আমি, বা বলা ভালো আমার এই জিভ। তাই এরকম হয়। যেদিন যেদিন বিষ টানি তারপর দিন বেলা অব্দি জিভটা ওরকম নীল হয়ে থাকে… শরীরটাও ভীষণ খারাপ লাগে। কয়েকঘণ্টা পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যাই।
“ও, তাই আপনি ওই দিনগুলো সকালে হাঁটতে যেতে পারেন না গ্রাউন্ডে।”
এবার বুঝলাম, ক্রমাগত বিষের প্রভাবেই হয়তো শরীরের কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন ওঁর এই অকাল বার্ধক্যের জন্য দায়ী। আমার কাছে এবার সব কিছু প্রায় জলের মতো পরিষ্কার।
লোভ মানুষকে কী ভয়ানক পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে ভাবতেই গা শিউরে উঠছে আমার।
এরপর আর বেশিদিন এই গ্রামে থাকা হয়নি আমার। কলকাতায় এক নার্সিংহোমে পোস্টিং নিয়ে চলে আসি সেই গ্রাম ছেড়ে। তারপর হসপিটাল, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন… নানান কাজের চাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ি বেশ ক-বছর।
হঠাৎ একদিন হসপিটালে একটা সায়ানোসিসের পেশেন্টকে দেখে আমার এক লহমায় মনে পড়ে যায় আবার সেই রাধানাথপুর গ্রামের ঘটনার কথা। পরেরদিন ঠিক করলাম দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে একবার গিয়ে দেখা করে আসব হরনাথবাবুর সঙ্গে। সেই মতো গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম খাতরার পাশের সেই গ্রামটার উদ্দেশে যার সঙ্গে আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত ও রোমাঞ্চকর একটা স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু গ্রামে পৌঁছে দেখলাম ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট আর সেই আগের মতো নেই। এই ক-বছরে বেশ পরিবর্তন এসেছে এখানে। একটু এগোতেই পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানের সামনে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল বিনয়বাবুর সঙ্গে। কুশল বিনিময় ও দুয়েকটা কথা বলার পরই হরনাথবাবুর খবর জিজ্ঞেস করলাম। মুহূর্তের মধ্যে ওঁর চোখে মুখের ভাব পালটে কেমন একটা আতঙ্কের ছায়া নেমে এল যেন। তারপর যা শুনলাম ওঁর কাছে তাতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে গেলো।
মাস চারেক আগেই হঠাৎ কোন এক বিষাক্ত সাপের কামড়ে মারা যান উনি। তবে যেটা শুনে আমার ভয়ে লোম খাড়া হয়ে গেল তা হল, মারা যাবার আগে ওঁর শরীর নাকি পুরো নীল হয়ে গিয়েছিল আর হাঁ করা মুখের ঝকঝকে দু-সারি দাঁতের ফাঁক থেকে বেরিয়েছিল একটা এক হাত লম্বা লকলকে নীল জিভ।
Tags: ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সৌজন্য চক্রবর্ত্তী, হরর গল্প