সেরার সেরা
লেখক: সঞ্চারী চক্রবর্তী চ্যাটার্জী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“মা ও মা দরজা খোলো। আমার খুব ভয় করছে প্লিজ খোলো না মা। আমি আর কোনওদিন তোমার অবাধ্য হব না মা। প্রতিদিন অঙ্ক করব। কোনও অঙ্ক ভুল করব না।” অন্ধকার ঘর থেকে চিৎকার করে মার্ক বলতে থাকে। এই ঘরটা বেসমেন্টের ঘর। লরেঞ্জ পরিবারের সমস্ত বাতিল জিনিসপত্র এইখানে থাকে। ছোট্ট এই ঘরটায় আলো-হাওয়া ঢোকে না বললেই চলে। অনেক উঁচুতে একটা ঘুলঘুলি আছে সেখান দিয়ে হালকা আলোর রশ্মি আসছে। সেই আলোতে ছোট্ট মার্ক দেখছে কতগুলো ইঁদুর ঘরের মধ্যে ছোটাছুটি করছে। ঘরটা এতটাই জিনিসপত্রতে ঠাসা যে একটা মানুষের দাঁড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা অব্দি নেই। ছোট্ট মার্ক ভয়ে কাঁপছে। কী করে যে আজ ও এত বড় ভুল করে ফেলল? আসলে ও বুঝতেই পারেনি কখন যেন পেছনে মা এসে দাঁড়িয়েছে। ও যদি একবার বুঝতে পারত মা এসেছে তবে আঙ্কেল জর্জকে ওই প্রশ্নটা করতই না। উফফ কী করে এমন একটা ভুল করে ফেলল ও? বাইরে থেকে ভেসে আসছে মা বাবার চিৎকার। বাবা মায়ের মধ্যে রাতদিন ঝগড়া, অশান্তি লেগেই রয়েছে। একদম বনিবনা নেই। মার্ক শুনতে পাচ্ছে ওর বাবা চিৎকার করে বলছে, “তোমার মত অসুস্থ মানসিকতার মহিলার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। তুমি একজন বাতিকগ্রস্থ, শুচিবায়ী, সন্দেহপরায়ণ মহিলা। তোমার সঙ্গে সংসার করা যায় না।”
মা-ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন, “চলে যাও তুমি। কে বলেছে আমার সঙ্গে থাকতে। চরিত্রহীন লোক একটা। আমি কি জানি না মার্গারেটের সঙ্গে তোমার চক্কর চলছে। আমি সব জানি। জ্যানেট আমায় সব বলেছে। তোমার সম্পত্তির অর্ধেক লিখে দিয়ে যেখানে খুশি চলে যাও।”
মার্ক জানে এরপর মা নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করবে, দেওয়ালে মাথা ঠুকে রক্ত বের করে ফেলবে হয়তো বা আরও ভয়ানক কিছু করবে। যদি মা মরে যায়? বাবা যদি মাকে গলা টিপে মেরে ফেলে তবে ও কোথায় যাবে? ওর যে মা ছাড়া আর কেউ নেই। মা ছাড়া ও যে জলে ভেসে যাবে। মার্কের চোখের সামনে দুটো ইঁদুর একটা চীজের টুকরো মিলে মিশে খাচ্ছে আর ওর দিকে কুত কুতে চোখে তাকাচ্ছে। এই সময়ে মার্ক শুনতে পেল মা খুব জোরে জোরে দেওয়ালে মাথা ঠুকছে। মায়ের মাথা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। সে চিৎকার করে বলল, “মা প্লিজ তুমি দেওয়ালে মাথা ঠুকো না। তোমার মাথা ফেটে যাবে, রক্ত পড়বে মা। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে মা গো।” কাঁদতে কাঁদতে দুই হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে মার্ক। চোখের জল আর মুখের লালায় হাত-মুখ মাখামাখি হয়ে যায় তার।
শুনতে পায় কান্না মেশানো কর্কশ গলায় ওর উদ্দেশে মায়ের চিৎকার, “চুপ কর অবাধ্য ছেলে। তুই আর আলাদা হবি কোথা থেকে। বাপের মতোই তো নিমকহারাম, বিশ্বাসঘাতক হবি। একই তো বদরক্তের ধারা বয়ে চলেছে তোর শরীরে। সবার সামনে মাকে অপমান না করলে তো তোর ভাত হজম হয় না, না?”
মার্ক হাউ হাউ করে কেঁদেই চলেছে। একটা ধেড়ে ইঁদুর যেন পায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে গেল। মার্ক ভয়ে সিটিয়ে গেল। উফফ কী কুক্ষণে আজ জর্জ আঙ্কেল এসেছিলেন? মার্ক পড়াশোনায় অসম্ভব ভালো। বলা ভালো অতিরিক্তই ভালো। এতটা ভালো না হলে বোধহয় বিড়ম্বনা কম হত। অতি অল্প বয়সেই সে কঠিন কঠিন অঙ্ক চোখের নিমেষে সল্ভ করে ফেলে। নিজের থেকে উঁচু ক্লাসের পড়ার উত্তর ওর ঠোঁটস্থ। স্কুলে দিদিমণিরা একটু আলাদা চোখেই দেখে। এই সমস্ত কিছু ওর স্বভাবজাতভাবেই আসে, কোনও জোর জুলুম করতে হয় না। অথচ ওর মা লুসি এক অদ্ভুত মহিলা। বাচ্চাদের স্কুলে আগে পড়াতেন। হ্যাম্পশায়ারের অন্তত তিন-চারটি স্কুলে পড়িয়েছেন তিনি। প্রত্যেকটি থেকেই বাচ্চাদের ওপর মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগ এসেছে এবং তিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। এখন তার গিনিপিগ হল মার্ক। মার্কের এই যে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা। যে কোনও বিষয় একবার পড়েই, সেটা আত্মস্থ করে ফেলা, সেটার ক্রেডিট উনি একাই নেবেন। সবাইকে বলে বেড়াবেন যে তিনি একজন অতি উচ্চমানের একজন শিক্ষিকা। ওঁর শিক্ষার ফলেই মার্ক এত ভালো পড়াশোনায়। এটা উনি জনে জনে বলে বেড়াবেন। ভালো কথা, সেই নিয়ে মার্কের কোনও সমস্যা নেই। সে মায়ের এই পাগলামিকে সব জেনে শুনেও প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। লুসির অঙ্ক বিষয়টির ওপর তেমন দক্ষতা নেই তাই সে আজ আঙ্কেল জর্জের থেকে ডেরিভেটিভের প্রবলেমগুলো শিখে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। ও ভালোই বুঝতে পেরেছিল লুসি ওকে যে পদ্ধতি শেখাচ্ছে আদপে তেমন কোনও পদ্ধতির আসলে অস্তিত্বই নেই। আঙ্কেল জর্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের প্রফেসর, এছাড়া তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একটি বিশেষ কাজে বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বাবা তখন স্নানে গেছিলেন আর মা রান্নাঘরে কুকিজ বেক করছিলেন। ছোট্ট মার্ক ভেবেছিল এই ফাঁকে শিখে নেবে জটিল অঙ্কগুলোর কোনও সহজ পদ্ধতি। তাই গুটি গুটি পায়ে সে আঙ্কেল জর্জের কাছে গিয়ে বলেছিল, “আঙ্কেল আমি না এই অঙ্কগুলো ঠিক বুঝতে পারছি না। অনুগ্রহ করে একটু বুঝিয়ে দেবেন?”
আঙ্কেল অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ক্লাস টু-তে পড়ো, এখুনি নাইন টেনের অঙ্ক কষতে শুরু করেছ? অদ্ভুত? তোমার মা বাবা জানেন?”
চাপা গলায়, ভীরু চোখে চারপাশে দেখে মার্ক বলে, “মা কী যে পড়ান কিছুই বুঝতে পারি না, তাই এই প্রব্লেমটা নিয়ে আপনার কাছে এলাম। পুরোটা ঠিক করে শেষটায় এসে মিলছে না।”
জর্জ দেখলেন একটা বাচ্চা ছেলের অঙ্ক খাতায় পাতার পর পাতা ভর্তি শুধু জটিল অঙ্ক। নির্ভুলভাবে কষা সব ক-টা অঙ্ক। অবাক হয়ে গেলেন তিনি। যদিও শুনেছিলেন পিটারের ছেলে মাত্র দুই বছর বয়সে পড়তে শিখে গেছে। চার বছর বয়সে প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে। সে এক বিস্ময় বালক আজ নিজের চোখে দেখে তার বিশ্বাস হল। খাতাটা টেনে নিয়ে তার ওপর খসখস করে অঙ্কটির সমাধান লিখে ফেললেন জর্জ। মার্কের মুখ খুশিতে ভরে উঠল। আনন্দের আতিশয্যে সে বলে উঠল, “ওহ! স্যার জর্জ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি যদি সপ্তাহে একদিন আপনার বাড়ি যাই অঙ্কের বিষয়ে আলোচনা করতে তবে কি আপনার আপত্তি হবে?”
“না না একদমই নয়। ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম অ্যাট মাই প্লেস ডিয়ার।” বললেন জর্জ।
“ওহ থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।” আনন্দে মার্কের দুই হাত তুলে নাচতে ইচ্ছে করল। কিন্তু তার এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। সে ভেতরে যাওয়ার জন্য পেছন ঘুরতেই দেখতে পেল তার মা লুসি কফি আর স্ন্যাক্সের প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে তার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে সে ঝলসে দিচ্ছে মার্ককে। মার্ক আর সেখানে দাঁড়াল না। এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আজ সেই অপরাধের শাস্তিই তাকে পেতে হচ্ছে এই বদ্ধ ঘরে বন্দি হয়ে।
***
আজ ইউনিভার্সিটিতে ডিবেট প্রতিযোগিতা ছিল। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সেই মার্ক মাস্টার্স করছে। হ্যাম্পশায়ার শহর তাকে চেনে “বিস্ময় বালক” নামে। ইতিমধ্যেই তার তিনটে যুগান্তকারী আবিষ্কার বিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন তুলেছে। কিন্তু আজ একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ডিবেট চলাকালীন তার হঠাৎ অসম্ভব পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। মনে হয় গল স্টোনের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে। তড়িঘড়ি হল ছেড়ে বেরিয়ে আসার ফলে বিজয়ীর স্থান তার কপালে জোটেনি। সেই খবর পেয়ে লুসি রাগে পাগল হয়ে গেছে। হলঘরের মাঝখানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মার্ক। ভয়ে সে ঠকঠক করে কাঁপছে, না জানি কী শাস্তি আজ অপেক্ষা করছে ওর জন্য। পেটটা এখনও যন্ত্রণায় টনটন করছে। একটু শুতে পারলে ভালো হত। একটু যদি খাওয়ার জল পাওয়া যেত তো খুব ভালো হত। ভয়ে আর যন্ত্রণায় ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। অপরদিকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে চলেছে লুসি। তার বংশের নামে নোংরা নোংরা কথা বলতে বলতে সে এগিয়ে আসছে মার্কের দিকে। ঝট করে মার্কের হাতটা তুলে নিল লুসি তারপর তার মধ্যে চেপে ধরল সদ্য ফায়ার প্লেস থেকে তুলে আনা জ্বলন্ত কাঠটা। যন্ত্রণায় মার্ক চিৎকার করে উঠল। ওর হাতের সাদা ধবধবে নরম চামড়া প্লাস্টিকের মতো গুটিয়ে দগদগে লাল রক্তাক্ত মাংস বেরিয়ে এসেছে। মার্কের মনে হচ্ছে ওর হাতে যেন অ্যাসিড পড়ে গেছে। অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। কিছুক্ষণ পর কাঠটা তুলে নিল লুসি, তারপর এক ধাক্কায় মার্ককে ঘর থেকে বের করে দিল। মার্ক এখন বসে আছে একটা পার্কে। সেখানের ঝিলে ভেসে বেড়াচ্ছে ধবধবে দুটো সাদা হাঁস। চারদিকে সবুজে সবুজ এই পার্কটা মার্কের বিশেষ পছন্দের। মন খারাপ হলেই সে এখানে এসে বসে থাকে। এক দৃষ্টে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মার্ক দেখল একজন কালো কোট ও টুপি পরিহিত ভদ্রলোক জলের মধ্যে মাছকে খাবার দিচ্ছেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে। মাছগুলো উড়ে আসা খাবারগুলো খাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিচ্ছে। রীতিমতো একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে খাওয়ার ছিনিয়ে আনার জন্য। মাছেদের মধ্যে এই যে প্রতিযোগিতাটা বেশ উপভোগ করছেন ভদ্রলোক। মার্ক ভাবল মনে মনে সর্বত্রই প্রথম হওয়ার কী প্রতিযোগিতা। ছোট থেকে ও সারাজীবন এটাই শুনে এসেছে ওকে সেরার সেরা হতে হবে। সাধারণ হয়ে কোনও লাভ নেই। ও প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে সব সময় তবুও কেন যে মা খুশি হয় না কে জানে? বাবা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মা যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তাকে প্রমাণ করতেই হবে লুসি লরেঞ্জ একজন অসম্ভব ভালো শিক্ষিকা। আর এই এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ কে? মার্ক।
মার্ককে সব কিছুতেই প্রথম হতে হবে, নাহলেই কপালে জুটবে অকথ্য গালাগালি। প্রথম হলেও যে মা খুব খুশি তা কিন্তু নয়। তখনও মুখ বেঁকিয়ে বলবে হুহ এ আর এমন কি? আরও ভালো হলে বুঝতাম। এই ভালোর যেন কোনও শেষ নেই। ঠিক আর কতটা ভালো হলে মা খুশি হবেন কে জানে? জর্জ আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় কিন্তু মাকে সে খুশি করতে পারে না। তবে খুব শিগগিরিই একটা ফরমুলা আবিষ্কার করবে সে। মা যা দেখে খুব খুশি হবে। হ্যাঁ খুশি হবে। ও জানে মা খুব খুশি হবে। ও মাকে দীর্ঘজীবী করে রাখবে। মায়ের মৃত্যু হবে না কোনওদিন। সারাজীবন ওর কাছেই থাকবে আর সব সময় ওকে অপমান করে যাবে। কেউ জানে না মায়ের এই অপমানগুলোই ওকে উদ্বুদ্ধ করে নিত্যনতুন আবিষ্কার করতে, আরও ভালো করতে। তাই মায়ের বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি। আদি অনন্তকাল ধরে যেন মা বেঁচে থাকে। মায়ের যেন মৃত্যু না হয়।
***
“মা তুমি খুশি তো মা? দেখো তোমার ছেলের কত বড় এচিভমেন্ট।” বিছানায় মিশে যাওয়া একজন বয়স্ক মহিলাকে ঝাঁকিয়ে বলে যাচ্ছে আশি বছর বয়সি মার্ক।
মহিলাটি আর কেউ নয় লুসি। তার বয়স এখন ১১০ বছর। সারা শরীর জরার ছাপ স্পষ্ট। শীর্ণকায় হাত পায়ের থেকে শিরাগুলো বেরিয়ে আছে প্রাচীন বট গাছের শিকড়ের মতো। ছেলের দিকে তাকিয়ে তার চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। দাঁতবিহীন ফোকলা মাড়ি বের করে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “মার্ক এবার আমায় মুক্তি দে। আর পারছি না।”
“মুক্তি? তোমায়? সে কি মা, তোমার আমার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগছে না। তুমি তো সারাজীবন আমার সাফল্য দেখতেই চাইতে। আজ দেখো মা তোমার ছেলে কত বড় বৈজ্ঞানিক। বিশ্বজোড়া তার নাম। জানি তুমি এতেও তৃপ্ত হবে না। তুমি চাও আরও উন্নতি করুক তোমার ছেলে। আরও আরও আরও। এই আরওর কোনও শেষ নেই মা। সেই ছোটবেলা থেকে ছুটেই চলেছি আমি। আমার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাকে আমার অভিশাপ মনে হত। মাঝে মাঝে মনে হত আমি আমার সমবয়সি ছেলেদের সঙ্গে খেলি। কিন্তু আমার ক্লাসের সব ছেলেরা আমার থেকে বয়সে বড় ছিল। আমি ওদের ভয় পেতাম মা। খুব ভয়। স্কুলে, কলেজে যেতে আমার ভয় করত মা। আমার বাড়ি ফিরতেও ভয় করত মা। বাড়ি ফিরলেই তোমার তিরস্কার। আচ্ছা মা একটা কথা বলতো তোমার কি কোনওদিন একবারের জন্যেও মনে হয়নি আমায় জড়িয়ে আদর করার কথা, দুটো ভালো কথা বলার ইচ্ছে হত না তোমার। রাতদিন আমার মনের ঘাগুলোকে খুঁচিয়ে তাতে নুন, লঙ্কা ছিটিয়ে দিয়ে কি আনন্দ পেতে? আমায় জ্বলে পুরে কষ্টে মরে যেতে দেখে কি একটুও দয়া মায়া হত না তোমার? আমি তো মানুষ। বলো? আমারও ইচ্ছে করত অন্যান্য মায়েদের মতো আমার মাও আমায় জড়িয়ে আদর করুক, গালে চুমু খাক। না মা আমার কপালে তা ছিল না। যা ছিল তা হল তোমার কদর্য ভাষায় গালাগালি শোনা আর নিজেকে প্রতি মুহূর্তে অকর্মণ্য মনে করা। নিজের অপারগতা আমায় কুড়ে কুড়ে খেত। কেমন যেন জেদ চেপে যেত। আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে। এইভাবে কবে যেন আমি অভ্যস্থ হয়ে গেলাম জানো? তোমার তিরস্কার আমায় মোটিভেট করতে শুরু করল। তোমার অকথ্য ভাষায় করা গালাগালগুলো আমায় উদ্বুদ্ধ করত নতুন নতুন আবিষ্কার করতে। ঠিক এই কারণেই তোমার বেঁচে থাকাটা এত জরুরি মা। তোমার চোখে আরও আরও আরও ভালো এই খিদেটা আমায় মোটিভেট করে। আমি একটার পর একটা আবিষ্কার করে চলি। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে আমার নামে প্রায় হাজারটা পেটেন্ট আছে। এর সংখ্যা আরও বাড়বে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে তোমার বয়স কিন্তু তোমার মৃত্যু হবে না মা। আমার মৃত্যু হবে কিন্তু তোমার হবে না। তোমায় আমি মরতে দেব না কিছুতেই। তুমি মরে গেলে যে সব শেষ হয়ে যাবে। এই ফরমুলা কিন্তু আমি নিজে খাব না কারণ আমি জানি এইভাবে বেঁচে থাকা কী ভীষণ অভিশাপের। তোমার বয়স আরও বাড়বে। তোমার শরীরটা মাটির মতো ঝুরঝুরে হয়ে একসময় মিশে যাবে বিছানার সঙ্গে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে বুড়ো বটগাছের ঝুরির মতো ঝুরি ছড়িয়ে পড়বে তোমার আশপাশে।
আচ্ছা মা তুমি বনসাই দেখেছ? বড় বড় বট, অশ্বত্থ গাছগুলোকে কী সুন্দর ছোট টবের মধ্যে ভরে রাখা হয়। বট গাছ দেখেছ তো কত শত বছর ধরে বেঁচে থাকে। আমার ফর্মুলাটাও সেখান থেকেই তৈরি। দেখো মা ভালো করে তোমার চামড়া কত পাতলা হয়ে গেছে। হাতের শিরা উপশিরাগুলো চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসছে ঠিক ডালপালার মতো। এরপর সেই ডালপালা থেকে পাতা গজাবে। মা, ও মা দেখো তোমার পা’টা। পায়ের লোমকূপগুলো চিরে কেমন শিকড় বেরিয়ে আসছে। একদম গাছের মতো দেখো। তুমিও একটা বটগাছে পরিণত হবে মা। তোমার প্রাণ থাকবে কিন্তু নড়াচড়া করার শক্তি থাকবে না। মনেপ্রাণে মৃত্যু চাইবে, কিন্তু মৃত্যু আসবে না। কেন জানো? আমার তৈরি করা “অমৃত সুধা” ফর্মুলার কারণে। এই ফর্মুলা আমি স্পেশালি বানিয়েছি তোমার মতো মা-বাবাদের জন্য। আর আমার মতো ছেলেদের জন্য কী বানিয়েছি দেখবে মা? দেখবে? দাঁড়াও টিভিটা চালিয়ে দিচ্ছি। দেখো মা। দেখতে পাচ্ছ? সারা পৃথিবী এখন মৃত্যুপুরী। কেন জানো? আমার ফর্মুলার কারণে।
আমি এমন এক ফর্মুলা বানিয়েছি যার প্রয়োগে শুধুমাত্র সুপার ইন্টেলিজেন্ট বাচ্চাই ভূমিষ্ঠ হবে। কোনও দুর্বল মস্তিষ্ক মানুষের জন্মই হবে না। যার পরিণতি জনের মতো হবে না। তোমার জনকে মনে পড়ে মা? আমার ছোট ভাই। তার মাথায় কিছুই ঢুকত না বলে একদিন পড়ার বই ছিড়ে কুটি কুটি করে মুখে ঠেসে ধরেছিলে? আমার ছোট্ট ভাইটা দম নিতে পারছিল না। আমি কাঁদতে কাঁদতে তোমার পা ধরে কত অনুনয় বিনয় করেছিলাম। হাত জোড় করে বলেছিলাম ছেড়ে দাও মা ওকে ছেড়ে দাও। তোমার মাথায় আগুন জ্বলছিল সেদিন। আমার কোনও কথা শোননি। ডিসেম্বরের ওই প্রবল শীতের রাতে ওকে চেপে ধরে রেখেছিলে চৌবাচ্চার কনকনে জলে। ভাইটা আমার শ্বাস নিতে পারছিল না। একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য দুই হাত ছুঁড়ে হাঁকপাঁক করছিল। আমি অসহায়ের মতো দেখছিলাম ওর চলে যাওয়া, আমার কিছুই করার ছিল না। ও চলে গেল। সেইদিন ঠিক করলাম এই পৃথিবীতে কোনও নিম্নমেধার শিশু জন্মাবেই না। সবাই হবে সেরার সেরা। ব্যাস বানিয়ে ফেললাম ফর্মুলা। কী অদ্ভুত জানো মা, এই ফর্মুলা আবিষ্কার হতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। সবাই চায় তাদের সন্তান বেস্ট হোক। সে বড়লোক মা-বাবা হোক কী গরীব। গরীব বাবা মায়েরা নিজেদের ঘটিবাটি বেচে আমার এই ফর্মুলা ইঞ্জেক্ট করাত নিজেদের শিশুদের শরীরে। সবাই চায় তাদের সন্তান ফার্স্ট হোক। সবাই ফার্স্ট হলে লাস্ট কে হবে বলতো মা? কেউ এটা বোঝে না। লাস্ট না থাকলে ফার্স্টের কোনও মূল্যই তো নেই। সারা পৃথিবীর লোক উঠে পড়ে লেগে গেল নিজের সন্তানকে সেরার সেরা বানানোর এই পদ্ধতিতে আর আজ দেখো তারই ফলাফল দেখাচ্ছে টিভিতে।
সেরা হওয়ার তাগিদে মানুষ এখন মানুষকে খুন করছে। চারিদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রাস্তার কোনায় জঞ্জাল ফেলার জায়গায় স্তূপ করে রাখা রয়েছে পচা-গলা লাশ। ডাস্টবিন থেকে উপচে পড়ছে হাড়গোড়।
একজনকে না মারলে আরেকজন এগোতে পারছে না কারণ সবাই তো এক্সেল। এইভাবে ক্রমাগত সেরার সেরার অনুসন্ধান করতে করতে একদিন দেখবে এই সুন্দর পৃথিবীটাই উজাড় হয়ে যাবে। সেই প্রক্রিয়া অবশ্য অলরেডি শুরু হয়ে গেছে আর আজ ঘরে বসে সেই দৃশ্যই দেখছে মার্ক। বলিরেখায় কুঞ্চিত হয়ে যাওয়া গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। তার সর্বনাশা ফর্মুলাই ডেকে এনেছে এই নরমেধ যজ্ঞ। হঠাৎ বেশ কিছু ট্রাকের হর্নের শব্দে বাইরে তাকালেন তিনি। জানালার কাছে গিয়ে দেখলেন লাইন করে বেশ কয়েকটা মিনি ট্রাক চলেছে রাস্তা দিয়ে। প্রত্যেকটা ট্রাক থেকে উপচে পড়ছে লাশ। বন্ধ করা ডালা থেকে বাইরে ঝুলে রয়েছে কারোর নগ্ন পা বা ক্ষতবিক্ষত নিস্তেজ হাত। হঠাৎ বাইরে থেকে কী যেন একটা মার্কের মুখে ছিটকে এসে লাগল। মুখে হাত দিয়ে মার্ক অনুভব করল ভেজা ভেজা কিছু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখল তার সারা মুখে লেগে আছে লাল রক্তের ছিটে। আর্তনাদ করে উঠল মার্ক। তার রক্ত মাখা হাত কাঁপতে লাগল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না মার্ক। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল সে। সেরার সেরা তৈরি করতে গিয়ে ও সৃষ্টি করেছে কতগুলো খুনীদের যারা প্রতিনিয়ত ইঁদুরের মতো দৌড়ে চলেছে। না না শুধু ইঁদুরের মতোই দৌড়াচ্ছেই না, কাঁকড়ার মতো টেনে ধরছে একে অপরের পা। সামনের জনকে টেনে পেছনে এনে নিজে সামনে যাওয়ার অদম্য প্রচেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। এই উন্নয়ন কি মার্ক চেয়েছিল। ঘরের সিলিং-এ ঝুলতে থাকা ফ্যানটার দিকে একদৃষ্টে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মার্ক। এবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় সে। একটা দড়ি জোগাড় করে ফ্যানের সঙ্গে আটকে দেয়। একটা চেয়ার টেনে এনে রাখে একদম ফ্যানটার নীচে তারপর সশব্দে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর শোনা গেল ধপ করে ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ। নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে বন্ধ দরজার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন অসহায়, চলশক্তিহীন মিসেস লুসি লরেঞ্জ।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সঞ্চারী চক্রবর্তী চ্যাটার্জী