হস্তীসঙ্গীত
লেখক: সোহম গুহ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
अपरेयमितस्त्वन्यां प्रकृतिं विद्धि मे पराम् |
जीवभूतां महाबाहो ययेदं धार्यते जगत् ||
১
ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে যখন প্রথমবার আসি, আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছিল এই সুপ্রাচীন আদিম অরণ্য দেখে। কলকাতার কংক্রিটের জঙ্গলে বড় হওয়া শিশু মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পৃথিবীর কোথাও এত গাছ থাকতে পারে? এখন, তিন দশক পর ডোঙ্গিরিতে কাজের সুত্রে ফিরে একটাই আক্ষেপ আমার, কেন পৃথিবীতে এত গাছ আর নেই। সভ্যতার শাপ লেগেছে এই মহীরুহের শহরে।
আর পাঁচটা জায়গার মতো ডোঙ্গিরিও পালটে গেছে। তার বুক চিরে চলে গেছে রেলের ফ্রিট করিডর, চলে গেছে একটা স্টেট হাইওয়েও। আজ, এক সরকারের মাইনেতে পোষা এফএসআই-য়ের অফিসার হয়ে এখানে এসেছি একটাই কাজে, এখানে মাটির নিচে এক বিশাল তৈলভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেই প্রোজেক্টের সাইট সমীক্ষা, এই ইআইএ (এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট)-এর মোটা দলিলে সই করে এই তৈলভাণ্ডারকে অর্থনৈতিক ছাড়পত্র দিতে। পিএইচডি শেষ করে আমার মাথায় কী ভূত চেপেছিল কে জানে।
সরকারের অন্দরমহলে কলকাঠি নাড়া শিল্পপতি রেঞ্জারদের ঘুষ খাইয়ে বশ করেছে আগেই। আমিও ছুটে এসেছি এখানে মোটা টাকার লোভেই। কিন্তু বেঁকে বসেছে এখানকার মাহুতরা। ভ্রমণপিপাসুর আনাগোনা কমে যাওয়ায়, এবং জঙ্গলে বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় তাদের রোজগার বন্ধ বহুদিন। আমার মোটা বুদ্ধিতে আমি ভেবে পাইনি এরা কীসের লোভে এখানে পড়ে। হয়তো লোভ নয়, হয়তো এই মুছে যেতে চলা জঙ্গলের প্রতি এ অকৃত্রিম ভালবাসা।
এসির বাইরে কাজ করার অভ্যাস নেই বলে সার্কিট হাউসের বারান্দায় পাখার তলায় বসে আমি ঘেমেনেয়ে একাকার হচ্ছি, কানের কাছে বিনবিন করে উড়ে আমায় অতিষ্ঠ করে মারছে এক দঙ্গল মশা। সামনে টেবিলে খোলা এখানকার ম্যাপ, আর এখানকার জীববৈচিত্র্যের গত দশ বছরের আধখ্যাঁচড়া হিসাব। জানোয়ারের অধিকাংশই হয় মারা পড়েছে ট্রেন বা গাড়ির চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে, অথবা পাড়ি দিয়েছে অরুণাচলপ্রদেশের দিকে। কিন্তু সেখানেও তো একটা বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের বুকের উপর, হিমালয়ের পাথুরে হৃদয় ফাটিয়ে।
পালাবার পথ কই?
“শুনছেন?” ভাঙা বাংলায় প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তাকালাম। সার্কিট হাউসের সামনের দীর্ঘ খোয়াই বেছানো পথ ধরে ধীর মাপা পদক্ষেপে হেঁটে আসছে একজন। তার ঘোলাটে চোখ আর ডান কানের পাশে অপারেশন করে বসানো নিউরাল ইমপ্ল্যান্ট দেখে তাকে চিনতে পারলাম। হেড মাহুত অন্ধ লালু। কিন্তু তার যষ্টি কই? অনুসন্ধিৎসু চোখে ইতিউতি তাকিয়ে দেখতে পেলাম বট গাছের পিছনে লুকিয়ে থাকা সেই লাজুক চলমান পাহাড়কে। শুঁড়ে তার একটা গোটা কলার কাঁদি। পরমানন্দে সে চিবুচ্ছে, তারিয়ে তারিয়ে। আর অপলকে নজর রাখছে লালু আর আমার উপরে। লালুর জন্মাবধি সহচর, মালতী। তারও মাথার উপরে চকচক করে আরেকটা ইমপ্ল্যান্ট।
গর্বিত ভঙ্গিতে এসে আমার সামনের চেয়ারে বাবু হয়ে বসল লালু। জন্মান্ধ হওয়া সত্ত্বেও ও জানে আমি ওকে অপলকে দেখেছি। লজ্জিত হয়ে নিজেই চোখ সরিয়ে নিলাম ওর ধূসর চোখ থেকে। এখানকার বাকিদের মতো হীনমন্যতায় ভোগে না লালু, নিজেকে সমাজের নিচের তলার বাসিন্দাও গণ্য করে না। যেখানে অন্যান্যদের আমি দেখেছি মাটিতে বসে আমার দিকে জোড়হাত করতে, সেখানে লালু আমার সামনের চেয়ারে ডাঁটিয়ে বসে কানের উপর থেকে একটা বিড়ি টেনে ধরাল। মালতির সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় নিজের ইমপ্ল্যান্টের কেরামতি দেখিয়ে বেড়িয়েছে বলেই হয়তো ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের খামতি নেই। তা ছাড়া ও জানে, ওকে এখান থেকে জোর করে সরানোর সাধ্য না আছে আমার, না আছে আমার উপরতলার মন্ত্রীর।
“আপনি এখানে কী করতে এসেছেন আমি জানি। এই বন আমাদের, ডাক্তার পাত্র। ছিল, আছে, থাকবে। অনেক কিছু ধ্বংস করেছেন আপনারা, শহরের বাবুরা, এখানকার। আর না। আজ আমি এখানে। যতদিন আছি হতে দেব না।” আকাশের দিকে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল লালু। “দিনের বিড়িটা এখানেই খেলাম। মালতী তামাকের গন্ধ একদম পছন্দ করে না।”
বটগাছের তলা থেকে ভেসে এল মৃদু অসন্তোষের শব্দ।
“তোমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে তো সরকার পেছপা নয়। তা ছাড়া তোমার এই দৃষ্টি শক্তি, সেও তো সরকারেরই দয়ায়।”
“সেই দানের তো সুদে-আসলে মিটিয়ে দিয়েছি আমি, পাত্রবাবু। আমি যদি এই…” শব্দটা মনে করতে কিছুক্ষণ সময় লাগল লালুর, “এই পেরেটোটাইপের জন্য স্বেচ্ছাসেবক না হতাম, তাহলে না হত আমার পাতানো বোনটার শাদি, না হত সফল আপনার সরকারের এই যান্ত্রিক ভোজবাজীর পরবর্তী ধাপ।”
কথাটা মিথ্যে না। লালুর এই পেরেটোটাইপ, অর্থাৎ ট্রান্সস্পিসিস সিমবায়োটিক সাইবারোরগ্যানিক নিউরাল ব্রিজ আজ আমাদের দেশের সেনারা ব্যবহার করছে দক্ষিণ মেরু দখলের লড়াইতে। সেই বরফের মরুপ্রান্তরে তাঁদের নিত্য সহচর এক একটি হাস্কি কুকুর, সুদুর অতীতের স্কট বা শ্যাকেলটনের মতো। মেরুতে এই নিউরাল লিঙ্ক যে কতখানি সফল তা আমি জানি। লালুকে তার পরিস্থিতি এগিয়ে না দিলে আজ হয়তো ভূতপূর্ব দক্ষিণ গঙ্গোত্রীর নিকটস্থ এক ইউরেনিয়াম খনির অধিকার হারাতাম আমরা।
আজ থেকে তিন দশক আগে, যখন আমি কলকাতার এক স্কুলের ক্লাস ওয়ানের ঘর দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, তখন ডোঙ্গিরির মাহুতরা লালুকে আবিষ্কার করেছিল এক শাল গাছের তলায়। দূরের গঞ্জ থেকে সেদিন তারা ফিরছিল যাত্রা দেখে। কেউ কেউ তাড়ি খেয়ে ছিল একটু বেসামালও। রাত তখন অনেক, রাতের আকাশের তারারা ঢাকা পড়েছে সরু সিরিয়াস মেঘের চাদরের নিচে। মেঠো পথের পাশে, বনদপ্তরের কল্যাণে, শাল গাছের প্ল্যান্টেশন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ঝাঁকড়া চুলের সুঠাম সৈনিকদের মতো। তার ওপাশে ঘন জঙ্গল, কাজিরাঙ্গার একটা খণ্ড। ডোঙ্গিরি মাহুতপল্লিতে ঢোকার মুখটায় শিশুর কান্না কানে গেছিল পথফেরতা মানুষগুলোর। হ্যারিকেনের আলোয় দেখতে পেয়েছিল চটের থলিতে মুড়ে পথের পাশে রাখা এক শিশু। চোখের মণি তার আকাশের মেঘেদের মতোই ঘোলাটে।
লালু সেই থেকে ডোঙ্গিরির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মালতী ডোঙ্গিরিতে এসেছিল, হয়তো ভাগ্যের চক্রেই, তার আগের সপ্তাহে। তখন বনদপ্তরের টালমাটাল অবস্থার সুযোগে কাজিরাঙ্গা হয়ে উঠেছিল চোরাশিকারিদের স্বর্গরাজ্য। আজ গুল্লি২-য়ের ডোরাকাটা অবয়বের টিকি পাওয়া যাচ্ছে তো কাল জনার্দনের খড়গহীন লাশ পাওয়া যাচ্ছে সল্ট লিকের ধারে।
যে ক-জন কর্মী বনকে ভালোবেসে মাইনে না পেয়েও টিকে গেছিলেন তাঁরা তখন দিশেহারা। আসামের গভীর অঞ্চল থেকে একটা পাল নেমে এসেছিল কাজিরাঙ্গায়। সেই দলের একটা মাদি হাতিকে রাতের বেলা পোচাররা কী করে কে জানে আলাদা করে ফেলেছিল। অন্ধকারে বুঝতে পারেনি সে অন্তঃসত্ত্বা।
সকালে সেই চলমান পাহাড়ের স্থবির দেহ আবিষ্কার করে বনকর্মীরা। ল্যাটেরাইট কাদা মেখে তাকে দেখতে লাগছিল অতিকায় উইয়ের ঢিপির মতো। সেই ঢিপির একপাশে গর্ভের তরল আর কাদা মেখে শুয়ে তার মৃত, দাঁত উপরে নেওয়া মায়ের স্তনদুগ্ধ পানের চেষ্টা করছিল মালতী। তার চার ঘণ্টার জীবন তাকে তখনও শিখিয়ে দেয়নি জীবিত ও মৃতের পার্থক্য।
জন্ম থেকেই জনকদের জানত না বলেই হয়তো লালু আর মালতীর বন্ধুত্বের জন্ম হতে দেরি হয়নি।
লালু বিড়িটা শেষ করে আমায় জিজ্ঞেস করল, “যখন এই জঙ্গলেরও তেল শেষ হয়ে যাবে তখন কোন জঙ্গল ধ্বংস করতে যাবেন আপনারা?”
“লালু, দেশের অর্থনীতির প্রয়োজনে এই তৈলকূপ কতখানি জরুরি তুমি বুঝছ না। এই কূপ হলে তোমাদের চাকরি হবে রিফাইনারিতে, যা টাকা পাবে বসে খেতে পাবে এক পুরুষ,” দুইই সর্বৈব মিথ্যে কথা, ঠুলি পরানোর সুবিধার্থে নেতাদের পাখি পড়া বুলি। ওরা হয়তো আমার দুই মাসের মাইনের কিছু বেশি পাবে। ওদের মতো অশিক্ষিত, নিচু জাতের (কথাগুলো মন্ত্রীমশাইয়ের) সম্প্রদায়কে কে চাকরি দেবে স্বয়ংক্রিয় রিফাইনারিতে? এই অল্প জানা মানুষগুলোর ভিড়ে লালু এক বিপদজ্জনক মিউটেশন। সরকারের ফ্ল্যাগশিপ ডিফেন্স প্রোজেক্টের অংশ হয়ে সে আর মালতী জেনেভা পর্যন্ত গেছে। স্ব-ইচ্ছায় ব্রেইল শিখে ইউএনডিপির পোডিয়ামে ভারতীয় বনবিভাগের প্রতিনিধিত্ব করে ম্যান অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট নিয়ে শেখানো বক্তৃতা পর্যন্ত দিয়েছে, ইউএনএসসির সামনে নিজেদের ইমপ্ল্যান্টের ক্ষমতার মহড়াও দিয়েছে। বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বনসম্পদের গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একটা দশক, এবং ভাগ্য কী করে মানুষকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে, তার প্রমাণ লালু। কিন্তু তার আদবকায়দা, বেশভূষা ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটলেও মানুষটা পাল্টায়নি। নাহলে কেউ ছুটে আসে নিজের শিকড়ের কাছে, আমার ঊর্ধ্বতনের পথের কাঁটা হয়ে?
লালু কিচ্ছুক্ষণ আমার দিকে তার অস্বস্তিকর ধূসর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্লিষ্ট হাসল। “আপনাদের অন্তর্মুখী, স্বার্থপর দৃষ্টিহীনতা আমায় আশ্চর্য করে, ডাক্তারবাবু। এই জঙ্গল উড়িয়ে সম্পদ উত্তলনের কোনও শেষ নেই। এই কাজ আমরা হাজার হাজার বছর ধরে করে যাচ্ছি। শেষ হবে সেই দিন, যেই দিন আর নষ্ট করার মতো জঙ্গল থাকবে না। সেইদিন আমি আপনি থাকব না, থাকবে আপনার সন্তানরা। তাঁদের শ্লেষ মেশানো কটূক্তি সহ্য করতে পারবেন তো? হয়তো নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ছোট হয়ে, বুক ভরে ধোঁয়াটে বিষ টেনে বুঝতে পারবেন কাগজের টাকা আর যাই হোক, খাওয়া যায় না। আপনারা চোখ থেকেও চক্ষুহীন। সামনে নিজেরটুকু বাদে আর দেখতে পান না । আপনাদের ভাষায় এক কবি কতদিন আগে এই কথা উপলব্ধি করে লিখে গেছেন, “যারা অন্ধ তাঁরাই চোখে বেশি দেখে তারা।”
“তুমি কী চাও?”
লালুর যে ব্রেইলে সাহিত্যজ্ঞান টনটনে, তার প্রমাণ আবার পেলাম। “নীলাকাশ আপনার সহ্য হয় না, ডাক্তারবাবু? ভালো লাগে না নির্জনতায় পাখির ডাক? আমার তো লাগে, এখানে বড় হয়ে উঠেও এগুলো কখনও পুরোনো হয়নি আমার কাছে। হবেও না। বিশ্বাস করুন, শহরে গিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠি, মালতীরও পাগল পাগল অবস্থা হয়ে যায়। এত শব্দ, এত দূষণ, এত আলো, কী করে সহ্য করে আছেন আপনারা? আমার ক্ষমতা থাকলে বলতাম— দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।”
“এই কানের কাছে মশার ডাক, তোমার কাছে সান্ধ্যসঙ্গীত?”
“কে জানে, হয়তো তাই। আসলে আপনাদের কৃত্রিম দুনিয়ায় আপনি, আপনার পরিবার, নিদেন পক্ষে আপনার টমি কুকুর বা গোল্ডফিশের বয়াম আর কারুর থাকার অধিকার নেই। কিন্তু আমার দুনিয়া যে অনেক অনেক বড়! সেই দুনিয়া আপনার বুদবুদের মতো ভঙ্গুর না। তাকান চারপাশে আপনার, সৃষ্টির আদি থেকে এই জঙ্গল আছে। হ্যাঁ, আপনাদের লোভের কোপে পড়ে তার গায়ে এখন দগদগে ক্ষত। কিন্তু সে যে এখনও বেঁচে। সামান্য ক-টা টাকার লোভে কী করে আমার পৃথিবীকে বলি দিই, ডাক্তারবাবু? কী করে আশা করেন?”
আমি শিরদাঁড়া খাড়া করে বসলাম। আমার এখানে আসার কিছুটা সুফল পেয়েছি। তৈলকূপ সম্পর্কে লালুর অবস্থান আমার কাছে স্পষ্ট। সে অনড়। ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু এই জগদ্দল পাথরকে সরানোর রাস্তাও জানা আছে আমার ঊর্ধ্বতনের। আঙুল বাঁকিয়ে ঘি তুলতে পারেন বলেই এতদূর আসতে পেরেছেন। বন ও পরিবেশমন্ত্রী তাঁর অফিসের দেওয়ালে সগর্বে টাঙিয়ে রেখেছেন তাঁর অতীত শিকার জীবনের স্মৃতিগুলো। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বাঘা বাঘা পরিবেশ সচেতন মানুষও জিজ্ঞেস করতে পারেননি তাঁর মাথার উপরে একটা ক্লাউডেড লেপার্ডের স্টাফড মাথা শোভা পায় কেন। আমি জিজ্ঞেস করায় উনি এগিয়ে দিয়েছিলেন একটা সার্টিফিকেট, যাতে লেখা জন্তুটা মারা গেছিল স্বাভাবিক কারণেই, বুলেট গিলে না। কিন্তু আমি জানি জন্তুটা কীভাবে মারা পড়েছিল। আর জানে শ্রীনিবাস।
লালুর সঙ্গে আমার মতবিরোধ এবং আদর্শের মিল থাকলেও ওর জন্য একটু কষ্ট হল। লোকটার মধ্যে প্রবল সম্ভাবনা লুকিয়ে। মানুষের মন জয় করতে জানে, জনমত গড়ে তুলতে সে পারদর্শী, নিজের মত প্রকাশে কুণ্ঠা করে না। প্রতিকূল পরিবেশ আর এই অক্ষমতা না থাকলে হয়তো আজ ও কেউ দিল্লীর সেন্ট্রাল ভিস্টার অফিসে বসা কেউকেটা হত। কিন্তু না। আমাদের দেশ বরাবরই গুণীর কদর করতে ব্যর্থ। দূর থেকে ভররভরর আওয়াজে চমকে উঠে দেখলাম মালতির কলার কাঁদি অদৃশ্য হয়েছে অনেকক্ষণ। সে আমার দিকে তার লতপতে কান খাড়া করে আমায় ‘লক্ষ’ করছে। লালুর মতো সেও প্রায় অন্ধ। কিন্তু তার দৃষ্টি কেড়েছে শুকিয়ে যাওয়া কর্নিয়া না, বিবর্তন।
২
“ডক্টর সুকুমার পাত্র,” ক্ষিপ্ত হলে মন্ত্রীমশাই আমায় পুরো নাম ধরে ডাকেন। এনক্রিপ্টেড ভিডিয়ো কলে বসে আমি আরেকটু ঘেমে গেলাম। তিনি বললেন, “সরকারের কত টাকা লগ্নি করা হয়েছে ডোঙ্গিরি পেট্রোলিয়াম রিসার্ভে আপনার কোনও আইডিয়া আছে? দিগবয় নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর এই একটা ভালো খবর তো এসেছে এই স্টেটটা থেকে। সামনে ভোট। শিল্পপতি দাদা সুনিশ্চিত লগ্নি থেকে পিছিয়ে গেলে পার্টির খরচা কোথা থেকে উঠবে?”
আমি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলাম পরিবেশ মন্ত্রকের কাজ এই প্রোজেক্টে চোখ কান বুজে ছাড়পত্র দেওয়া নয়, বরং এই জায়গাগুলোকে এই সব প্রোজেক্টের হাত থেকে রক্ষা করা। ব্যাঘ্রশূন্য রন্থাম্বরে আজকে জেগে উঠছে এক অভ্রের খনি। উত্তর ভারতের নদীগুলিকে জুড়ে তৈরি হচ্ছে এক সুবিশাল নদীকেন্দ্রিক ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক। ম্যানগ্রোভ মুছে দিয়ে তৈরি হচ্ছে বৈদেশিক কোম্পানির সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ভারতবর্ষ চিরকালই এক উন্নয়নশীল দেশ, কিন্তু নিজেকে বিশ্বের সামনে উন্নত প্রমাণ করার জন্য নিজেরই ক্ষতিসাধনের এই আকাঙ্ক্ষা আমি দেখিনি কখনও আগে।
মন্ত্রীমশাই বললেন, “একটা লোক, পাত্র, একটা অন্ধ, নাদুসনুদুস হাতিটাকে বাদই দিলাম। আর তাকেও তুমি সামাল দিতে পারছ না। বয়স হচ্ছে বলে কি সব বুদ্ধি তোমার বেড়েই চলা ভুঁড়িতে গিয়ে জমছে? এইরকম চললে ভবিষ্যতে আমায় তো অন্য কারুর সন্ধান করতে হবে। সেটা তোমার আমার কারুর কাছেই খুব একটা সুখকর পরিস্থিতি হবে না। তুমিও কি সেটাই চাও?” মুখে তাঁর সেয়ানে হাসি। তাঁর উজ্জ্বল টাকে আবছাভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে উপরে বসানো লেপার্ডের বিস্ময় ভরা মুখ।
অপমানটা গিলে নিয়ে একটা চেষ্টা করলাম আমি। “স্যার, লালুর পরিচিতি, ডিফেন্সের এই প্রোজেক্টে ওর অবদান বিশ্ব জানে। আর পাঁচটা মানুষের মতো ওকে যে মানানো যাবে না সেটা আমার থেকে আপনি ভালো জানেন। যশের আশায় আপনারাই এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের রাক্ষসকে বিশ্বের সামনে গর্বের সঙ্গে উপস্থাপিত করেছেন। সেটাকে ঠিক করতে আমার কেন, ভগবানেরও সময় লাগবে।”
চোখ সরু হয়ে গেল তাঁর। “কী বলতে চাইছ সেটা স্পষ্ট করেই উগড়ে ফেল দেখি?”
“আমি মাহুত মহল্লার বাকিদের সঙ্গে কথা বলছি, নাহলে হাত গন্ধ করতে হবে। চিন্তা করবেন না, জলদাপাড়ার মতো এখানেও আপনার প্রভাব কেউ সন্দেহ করতে যাতে না পারে সেটা আমি নিজে দেখব। শুধু শ্রীনিবাসের বিলটা এবারও আপনাকেই মেটাতে হবে।”
এতক্ষণে মন্ত্রীমশাই হাসলেন। তাঁর সেই অতিপরিচিত ক্রুর হাসি। “ওদের মাথায় বসানো নিউরাল ব্রিজ সম্পর্কে তুমি কতটা ওয়াকিবহাল?”
“কাজের প্রয়োজনে যতটা আমার জানা প্রয়োজন।”
“তোমার এই ব্যাপারটাই আমার ভালো লাগে, বুঝলে তো, পাত্র?” বলে পাশ থেকে একটা ফাইল টেনে আনলেন তিনি। “হ্যাঁ। ডিআরডিও এই ফাইলটা গতকালই আমায় পাঠিয়েছে।” আমার চোখের সামনে নাচালেন প্রচ্ছদের লাল কালির কনফিডেন্সিয়াল স্ট্যাম্পটা। “তোমার কাজের সুবিধার জন্যই আমি এটা চেয়ে পাঠিয়েছি। বুঝতেই পারছ, ডিফেন্সের জিনিস, যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমায়। রাত্রে শোয়ার আগে মেল চেক কোরো। ডিজিটাল কপিটা পাঠিয়ে দেব।”
আমার উঁচিয়ে থাকা ভুরুর দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “কী বলছি সেটা কি এখনও বোঝোনি?”
এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লাম অবোধ বালকের মতো।
তিনি বললেন, “এইরকম প্রযুক্তি এখনও পর্যন্ত অন্য কোনও দেশের কেন হস্তগত হয়নি জানো? প্রলোভন, অথবা হুমকি পাওয়া ডিফেক্টেড সৈনিকের সংখ্যা যেখানে নয় নয় করেও তিন? অন্য কোনও রাষ্ট্রের পক্ষে এই প্রযুক্তি রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে আদায় করা এমন কিছু ব্যাপার না। কিন্তু সেই কাজের জন্য সাইবার অরগানিক হ্যান্ডশেক মডিউল, নিউরাল অগ্মেন্টেশন ব্রিজ সার্কিট, এসই ব্যাটারি,” তিনি দেখে দেখে বললেন, “ইত্যাদি অটুট পেতে হবে তো!”
কুমেরু সাগরে ভেসে আসা মুণ্ডুহীন তিন দেহের খবর আমিও পড়েছিলাম। কোনও বিস্ফোরণের ফলে তাদের গতানুগতিক পদ্ধতিতে চেনা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাও, ইচ্ছা করেই বোকা সাজলাম। “কী করে স্যার?”
“এই ইমপ্ল্যান্টের কাজের জন্য দরকার প্রচুর শক্তি, এই এনার্জির চাহিদা প্রথমে ভাবা হয়েছিল আমাদের শরীরই মেটাবে। কিন্তু লালুর দ্রুত শরীর খারাপ হতে আমরা অন্য রাস্তা নিতে বাধ্য হই। লালুর দ্বিতীয় জেনারেশন ইমপ্ল্যান্টের, এবং তার পরবর্তী সবারই, ভেতরে লাগানো একটা ২৯ আমস্ট্রং মতো বড় সিলিকনের পারমাণবিক দানা।”
“কিন্তু সিলিকনের একটা পরমাণু তো ২০ আমস্ট্রং মতো,” মোবাইলের স্ক্রিনে দ্রুত চোখ চালিয়ে বিজ্ঞের মতো বললাম আমি। “তাহলে বাকিটুকু কী?”
এবারে ভ্রু কুঁচকালো মন্ত্রীমশাইয়ের, আমার কথা শুনে না, আমার প্রশ্নের উত্তর ফাইলটায় পড়ে। বিড়বিড় করে বললেন, “হিগস ফিল্ড জেনারেটরটা আবার কী বস্তু?”
এটা আমি জানতাম। ইউপিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময় সিলেবাসের অন্তর্গত অনেক কিছুই আমাদের পড়তে হয়েছে। তার মধ্যে এস&টি বিভাগে ছিল হিগস ফিল্ড জেনারেটরের সম্ভাবিত কার্যাবলী। মন্ত্রীমশাই নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ হয়ে গেছে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ভিডিয়ো কল বন্ধ করে দিলেন। আমিও একচোট হেসে মোবাইল খুলে মনে করলাম কী পড়েছিলাম।
বয়স বেড়ে গেছে, আর আমলাতন্ত্রের চাকায় কলুর বলদের মতো জুতে আছি বলেই কি না কে জানে, পার্টিকাল ফিজিক্সের সূত্রগুলো দুর্বোধ্য হাইরোগ্লিফিক্স ঠেকল এখন। বোসন, গ্লুওন ইত্যাদির পারস্পরিক সাব-অ্যাটোমিক খেলার অঙ্ক পড়ে মাথা ঘুরতে শুরু করায় ফোন বন্ধ করে সার্কিট হাউসের বাইরে একটু পায়চারি খেলাম। মোটা বুদ্ধিতে আমার বেশি কিছু ঢোকেনি, কেবল বুঝেছি, বিগ ব্যাঙের পর থেকে যে বিপুল শক্তি এখনও দুর্নিবার গতিতে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ করে চলেছে, তারই এক ভগ্নাংশ চালিত করছে এই ইমপ্ল্যান্টদের। সিলিকনের ভেতরে স্ট্রং ইন্টের্যাক্সনের মাধ্যমে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অন্তর্নিহিত কোয়ার্কের থেকে এই শক্তি উৎপন্ন করা হচ্ছে। এই অসীম শক্তির পারমাণবিক ব্যাটারির আয়ু আমাদের থেকে অনেক বেশি। একটা মানুষের মাথা এই ব্যাটারি ওভারলোড হয়ে গেলে যে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে এ আর আশ্চর্য কি?
সেই সঙ্গে আরেকটা কথাও মনে হল আমার। ঠিকভাবে কাজে লাগালে এই শক্তি, এই ক্লিন এনার্জি সোর্স, আমাদের গোটা পৃথিবীর অসীম খিদে এক লহমায় মেটাতে সক্ষম। হয়তো মানুষের আকাশ জয়ের জাহাজ তৈরি করাও সম্ভব। কিন্তু না। তাহলে যে নির্বুদপতিদের বুভুক্ষু রোজগারে টান পড়বে। নিজেকে শকুনের মতো মনে হল আমার, মড়ার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু শকুন তো পরিবেশ বন্ধু।
আমি কী?
৩
গোটা ডোঙ্গিরি বস্তিকেই কে জানে কোন মোহে আবিষ্ট করে রেখেছে লালু। তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাকিদের কত বোঝালাম, কত প্রলোভন দেখালাম, কিন্তু তারা নিজেদের বিশ্বাসে অনড়। ভিড়ের মধ্যে না থেকেও লালুর অস্তিত্ব পরতে পরতে জড়িয়ে আছে প্রত্যেকের দৃঢ় বাচনভঙ্গি, আর কঠিন মুখচ্ছবিতে। তাদের পিছনে সার দিয়ে ব্যাসাল্টের পর্বতশ্রেণির মতো দাঁড়িয়ে কুনকি হাতিগুলো।
ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিছু বাচ্ছা, বুকের হাড় বের করা আদুর গায়ে আমার হাতের স্মার্টঘড়ি দেখতে থাকা ডোঙ্গিরির ভবিষ্যৎ। তাদের চোখে এই আমায় নিয়ে অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কোনও ধন্দ নেই তাদের মনে, তাদের বাবা মায়ের মতনই।
দিল্লি থেকে বহু দূরে, যেখানে নিকটবর্তী রেলস্টেশন বিশ মাইল, আর বাসস্টপ এক ঘণ্টার হাঁটা পথ, যেখানে গাছের কোমল পরশ শান্ত করে গ্রীষ্মের রোদে কাহিল গরম মাটিকে, যেখানে মেঠো রাস্তায় দাঁড়ালে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়, সেখানে সারাজীবন থাকা, জঙ্গলের প্রাণীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া এই খেটে খাওয়া অপুষ্টিতে ভোগা মানুষেরাই ভারতবর্ষ। সেই ভারতবর্ষ যার কথা ইতিহাস কখনও লেখেনি, বা ভুলে গেছে ইচ্ছা করেই। সেই ভারতবর্ষ যাকে ঝাঁ চকচকে ইলেকট্রিকের আলোয় মোড়া, কংক্রিটের কৃত্রিম ইন্ডিয়ার মনে পড়ে ভোটের লিস্ট বানানোর সময়, বা ছুটি কাটাতে গিয়ে ফোটোশুটের সময়। বাকি সময় এই ভারতবর্ষ এক অনাবিষ্কৃত ভূমি, এখানে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। গাড়ির শব্দ সুদূরের পথিক। তারারা বলে দেয় এক আলোকদূষণহীন এক অন্য রাত্রির হদিশ। ভারতবর্ষ কেবল কোনও জিওপলিটিকাল সীমানায় বাঁধা পড়া দেশ নয়, তার পরিচয় তার লোকসম্পদ, তার উদ্ভিদ পশুপাখি, তার বৈচিত্র্য এবং প্রাচুর্যে মোড়া অস্তিত্বে। সেই অস্তিত্ব আজ আমার মতো মানুষদের জন্য বিপন্ন।
ব্যর্থ হয়ে সার্কিট হাউসে ফেরার সময় অনুভব করলাম মন্ত্রীমশাই কতখানি ভুল এই মানুষগুলো সম্পর্কে। কোনও কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে তাদের এই অনড় মনোভাব না। না আছে এর পেছনে তাদের কোনও গূঢ় অভিসন্ধি আমার ঊর্ধ্বতনের মতো। অনুভব করলাম, টাকা দিয়ে সব কিছু কেনা যায় না।
লালু আর মালতী ফিরল সন্ধের দিকে। তাদের পেছন পেছন ফিরল আরও তিনটে কুনকি এবং তাদের মাহুত। চোদ্দো কিলোমিটার দূরে এক সল্ট লিকের কাছে চোরাশিকারিরা মাচা বেঁধেছিল তাদের নৈশাভিসারের জন্য। হাতিদের মাধ্যমে সেই মাচা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে তাদের পাতা সমস্ত ফাঁদও। এই স্বেচ্ছাসেবকের দলকে উচ্ছসিত হয়ে অভ্যর্থনা জানালো গোটা পল্লি আর হাতিগুলো। গজ নিনাদ এসে পৌঁছালো আমার ঘর অবধি। সেই তীক্ষ্ণ শব্দে, স্বভাবতই, আমি চমকে উঠলাম।
মাহুতদের পল্লি আর সার্কিট হাউসের মাঝে একটা পাতলা পিয়ালের বন বেড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। রাত বাড়তে আমার কানে এল সমবেত গানের সুর, দেখতে পেলাম খড়কুটো জ্বালিয়ে অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে তার চারপাশে পল্লির মেয়েরা নাচ করছে। বিহু কি? হতে পারে। আগুনের পাশে বসে পুরুষেরা কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, কেউ বা চুপ করে বসে শুনছে বা বাচ্ছা সামলাচ্ছে।
আগ্রহের সঙ্গেই বেরিয়ে পিয়ালের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গান শুনলাম।
“হাতী হেৰালো লিহিৰি বনতে
অ’ ঘোঁৰাও হেৰালো বনে
কুঁহিয়াৰ পেৰুতে ঘৈণী হেৰালো
কোনে বাঁহি-বন কৰে…”
আজ ওদের কোনও এক বিশেষ দিন, কোনও এক ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। হাতিগুলোও দূরে দাঁড়িয়ে এক মনে শুনছে। হঠাৎ লালু ভিড়ের মধ্যে থেকে হাত তুলল। অমনি যেন মন্ত্রবলে থেমে গেল উৎসব। সবাই চুপ, উৎকর্ণ হয়ে কীসের যেন অপেক্ষায়। শেষে, যে গান মালতী সবার আগে শুনতে পেয়েছে, তারপর লালুকে বলেছে, সেই গান আমিও শুনতে পেলাম। বহুদূরে, এই সংরক্ষিত অরণ্যের কোর এরিয়ায় এক যূথবদ্ধ হাতির দল গান বেঁধেছে। গোটা অরণ্যে রাতচোরা পাখিরা, নিশাচর শিকারিরা থেমে গিয়ে যেন সেই গান অপলকে শুনছে। শুনছি আমিও। মনের মধ্যে বহুকাল আগের এক অরণ্যপ্রেমী সাহিত্যিক বলে উঠল, “বাজা তোরা, রাজা যায়।”
এই উপমহাদেশে মানুষ সিন্ধুর তীরে সবে তার নগরীর সাম্রাজ্য স্থাপন করারও কয়েক নির্বুদ বছর আগে থেকে এই অঞ্চল হাতিদের সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের সীমানা পশ্চিমে বিহার, উত্তরে অরুণাচল, দক্ষিণে কেরালা, আর পূর্বে থাইল্যান্ড। তাদের গজেন্দ্রগমন সৃষ্টি করেছে বনের মধ্যে তৃণভূমি, গাছের বীজ তারা বয়ে নিয়ে গেছে দূরদূরান্তে, সৃষ্টি করেছে নতুন বনাঞ্চল। বনের অন্যান্য পশুপাখি তাদের সম্মান করেছে, ছেড়ে দিয়েছে তাদের জন্য পথ।
তারপর, আমরা এলাম। অজাতশত্রু এই সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের বলে নিজের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন, পুরুর শিরস্ত্রাণ পরিহিত হাতির দল থামিয়ে দিল দিগ্বিজয়ীর দর্প ভরা রথের চাকা; তারও বহুকাল পরে জাহাঙ্গীরের হাতিশালায় নাকি ছিল প্রায় নব্বই হাজার রণহস্তী। ভীমভেটকার গুহাচিত্র থেকে ভাইসয়ারের শিকারের অয়েলপেন্টিং, সবেতেই হাতির উপস্থিতি লক্ষণীয়।
আজ? গোটা ভারতে বর্তমানে হয়তো সেই নব্বই হাজারের মাত্র দশ শতাংশ অবশিষ্ট আছে। হাতি, এবং তাদের জঙ্গল আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ইতিহাস বলে বিবেচিত হবে।
“গান শুনতে পেয়েছেন?” চিন্তায় হারিয়ে গেছিলাম বলে কখন লালু এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়লাম আমি।
ও বলল, “যেদিন কোনও সন্তানসম্ভবা হাতি মা হয়, সেদিনই কেবল এই গান শুনতে পাওয়া যায়। হস্তিসঙ্গীত এক দুষ্প্রাপ্য গীত।” একটু থেমে কী ভেবে বলল, “যদি আপনাকে এক ঐশ্বর্যের সন্ধান দিই, আপনি আপনার বসকে বাধ্য করতে পারবেন এই জায়গার উপরে হাত না বাড়াতে? এই স্থান বহিরাগতদের জন্য অভিশপ্ত, আমি চাই না সেই অভিশাপ আপনাদের উপরে পড়ুক।”
কী অভিশাপ বলল না লালু। প্রলুব্ধ কণ্ঠে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী ঐশ্বর্য?”
“গজমুক্তা, যা একমাত্র পাওয়া যায় ঐরাবতের মাথায়, আর হাতিদের কবরখানায়।” লালুর গলায় কি একটু শ্লেষের ইঙ্গিত? “যাবেন তো কালকে চলে আসবেন আমাদের এখানে। মালতী বাদে সেই অঞ্চলে আমাদের প্রবেশাধিকার অসম্ভব।”
৪
ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে এগোচ্ছে মালতী। তার পিঠে চট আর বাঁশের তৈরি হাওদায় বসে উথলে ওঠা দুধের সরের মতো ওলটপালট খাচ্ছি আমি। ক্রমাগত রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছি। গোটা জঙ্গল সকাল থেকে যেন মন্ত্রীমশাইয়ের মতো গুম খেয়ে আছে, একটা পাতাও নড়ছে না। মন্ত্রীমশাই আমার এই শত্রুর সঙ্গে প্রমোদভ্রমণ মানতে পারেননি। কিন্তু তাঁর কুটিল মন এই ভ্রমণের সুযোগ নিতে মুখিয়ে আছে। শ্রীনিবাসের আগমন ঘটেছে ডোঙ্গিরিতে। জলদাপাড়ায় মন্ত্রীমশাইয়ের হৃত পৌরুষ উদ্ধারের জন্য এক গণ্ডারের শিং লোপাট করার পর আজ আবার আজকে সে আমার কাছাকাছি। আবার আমি হত্যার চিহ্ন মুছে দেওয়ার জমাদারের চরিত্রে।
হাওদায় বসে এই প্রবাদপ্রতিম রত্নের কথা আমায় ভাবিয়ে তুলল। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই রত্নের অস্তিত্ব অবিশ্বাস্য লাগে। কিন্তু লালু কি মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে আমায় এখানে টেনে আনবে? আমার মালতীর পায়ে দলিথমথিত মৃতদেহ খুঁজে পেলে যে ঝড় উঠবে সেটা লালু ভালো করেই জানে। পুলিশের বুট মাটিতে মিশিয়ে দেবে গোটা মাহুতপল্লিকে। না, লালু এতটা বোকামো করবে না। আমার মৃত্যু কেবল এই বনাঞ্চল ধ্বংসের অনুঘটক হয়েই সার্থক হবে, মন্ত্রীমশাইয়ের তুরুপের নতুন তাস হয়ে। নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম এই সব স্তোতবাক্য দিয়ে।
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক গজেন্দ্রগমনের পর এক ধ্বস নামা পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে লালু আমায় নামতে অনুরোধ করল। একটু সন্ত্রস্ত হয়েই পা রাখলাম মাটিতে। চোখ সরালাম না মালতীর শুঁড় থেকে। লালু টেনে নামাল এক বাঁশের লাঠি, সেটা দিয়ে এক পায়ে চলা পথের দিকে নির্দেশ করে বলল, “আসুন।”
মালতী একটা শব্দ করল যার সঙ্গে মানুষের অভিমানী স্বরের ভীষণ মিল। ওর কানের লতিতে হাত বুলিয়ে লালু বলল, “চিন্তা করো না মা, আমি ডাক্তার পাত্রকে একটু ঘুরিয়েই ফেরত আনছি।”
জন্তুরা আগে থেকে বোধহয় বিপদের গন্ধ পায়। নাহলে কেন এর উত্তরে মালতি আমাদের পথ অবরোধ করে দাঁড়াল? তার তো জানার কথা নয় আমি আমার জিপিএস লোকেশন কোথায় কার সঙ্গে শেয়ার করছি। যেমন তার জানতে পারার কথা না আমাদেরকে দূরত্ব রেখে নিঃশব্দে অনুসরণ করছে চারজনের একটা দল। জানবে কী করে? জঙ্গলের বাতাস তো বিপরীত দিকে বইছে।
লালু যেন বুঝেও বুঝল না। মালতী তার সামনে মাথা নিচু করে প্রভুভুক্ত কুকুরের মতো বসতে সে তার কপালে নিজের কপাল ঠেকাল। অবাক হয়ে দেখালাম তাদের ইমপ্ল্যান্ট দুটো একই সঙ্গে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। আলোগুলোর মানে তখন জানলে আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুলকে আটকান যেত। কিন্তু না, অবোধ আমি, মূর্খ আমি, প্রোজেক্ট অশ্বত্থামার মেল করা ফাইলের শেষ অংশ ডোঙ্গিরির মানুষের সঙ্গে বাদানুবাদে হতোদ্যম হয়ে পড়ে এড়িয়ে যাওয়া ক্লান্ত আমি।
মালতী উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের পথ ছেড়ে দিল। হাতের লাঠি ঠুকঠুক করে নিজের পথ বুঝে আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল লালু।
মাথার উপরে সূর্য আজকে যেন অতি তীব্র। পথের দু-পাশে একটিও গাছ নেই, একপাশে না শেষ হওয়া বাড়ির ভিত আধ ডুবে আছে মাটির নিচে। লালুকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, “এখানে রিসর্ট তৈরির ছাড়পত্র পেয়েছিল কাছারের এক পুঁজিপতি। এখানের সব গাছ সেই কেটে উড়িয়ে দিয়েছে ‘বিকাশ ও বৃদ্ধির’ নামে। কিন্তু প্রমোদভবনের কাজ শেষ সে করতে পারেনি। এই পাহাড়ই বদলা নিয়েছে আমাদের হয়ে। গাছ কেটে ফেলার ফলে মাটি আলগা হয়ে গিয়েছিল। এক ধ্বস মুছে দিয়েছে তার প্রোজেক্টের সব চিহ্ন। তিনবার শুরু থেকে আবার শুরু করে সে প্রকৃতির বিরুদ্ধে রণে ভঙ্গ দিয়েছে গত বছর।”
লক্ষ করলাম সেই ধ্বসের ধ্বংসলীলায় জন্মানো নতুন চারাগুলিকে। বন তার জায়গা দ্রুত পুনর্দখল করছে।
লালুর গতির সঙ্গে তাল মেলানো আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি যেখানে হাঁপাচ্ছি, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, আমার মেদবহুল বুক ধরফর করছে, সেখানে এত শক্তি এই অন্ধ লোকটা পাচ্ছে কোথা থেকে?
কিন্তু সব কষ্টেরই শেষ আছে। সেই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে আমি আর পারলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় তোমার হাতির কবরখানা? কোথায় গজমুক্তা?”
লালু আমার দিকে ফিরে হাসল। ব্যঙ্গাত্মক হাসি। তারপর তার দুই হাত প্রসারিত করে দেখাল, “আমি সেই কবরের গন্ধ নাকে পাচ্ছি, কানে শুনতে পাচ্ছি, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?”
সেই অনুচ্চ পাহাড়ের চ্যাপ্টা শিখর থেকে অনেকদূর অবধি দেখা যায়। প্রথমে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কোথায় সেই প্রবাদপ্রতিম হাতিদের কবরস্থান, যেখানে যুগের পর যুগ হাতিরা এসে তাদের মৃত্যুকে আপন করে নেয়? ঔপনিবেশিক যুগের শেষের দিকে সাহেবরা শিকারে বেড়িয়ে এইরকম কিছু কবরের সন্ধান পেয়েছিলেন। গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে গেছিলেন তারা হাতির দাঁতের পাহাড়। তাহলে কি কাল আমায় এই সম্পদ থেকে বঞ্ছিত করল? আমি কি ঐরাবতের মুকুটের সেই রত্নের সন্ধানে দেড়শো বছর পরের এক অনাহূত আগন্তুক?
লালু মিথ্যে কথা বলল আমায়? আমার মতো তারও কি অন্য অভিসন্ধি?
ট্রাকের হর্নের শব্দ তখনই শুনতে পেলাম আমি। আমার সামনের জঙ্গল তার অতীত গরিমার ভগ্নাংশ, তার জায়গায় জায়গায় দগদগে ক্ষতের মতো আকাশের দিকে চেয়ে আছে ফাঁকা জমি। অর্বাচীনের মতো গাছ কাটার ফলে সেই অংশে ঘাস বাদে আর কিছু জন্মানোর সুযোগ পায়নি। একটু দূরে আসাম ট্রাঙ্ক রোড। সেখানে বিলুপ্ত চিতার মতো দুর্নিবার গতিতে ছুটে চলেছে ট্রাক। দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সামগ্রি পাঠানোর ইনফ্রাস্ট্রাকচারের তারা এক অবিচ্ছেদ অংশ। শহরের বাইরে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে তারা খেয়াল করে না তাদের সামনে কী পড়ল। জায়গায় জায়গায় জঙ্গল পুড়িয়ে জন্ম নিয়েছে গ্রাম আর তাদের চাষজমি। সেই গ্রামবাসিরা তাদের ফসল রক্ষার জন্য খেতের চারপাশে লাগিয়েছে ইলেকট্রিক ফেন্স। দূরে মৃত মানুষের বিবর্ণ চুলের মতো বয়ে চলেছে দূষিত ব্রহ্মপুত্র, তার বুকে যাত্রী পারাপার করছে স্টিমারের দল, অনর্গল কালো ধোঁয়া আকাশে নিক্ষেপ করছে তারা। আরও দূরে, নদীর ওপারে, ধোঁয়াশায় প্রায় অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথ শহর। অবশিষ্ট জঙ্গলের মাঝে মাঝে ক্যানপির উপরে গর্বোদ্ধত বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ইকোট্যুরিজমের নামে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হোটেলের দল। এবারে আমারও নাকে এল পোড়া ডিজেলের গন্ধ।
লালু আবারও জিজ্ঞেস করল, “আমি সেই কবরের গন্ধ নাকে পাচ্ছি, কানে শুনতে পাচ্ছি, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?”
ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম আমি। খবরের কাগজে প্রায় প্রতিদিনই থাকে ট্রাকের ধাক্কায় বা বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে হাতির মৃত্যু। গত বছরই এইভাবে মারা গেছে প্রায় চব্বিশটি হাতি। লালু বলেছিল সে আমায় হাতিদের কবরখানা দেখাবে। দেখিয়েছে। আমি চোখ থেকেও চক্ষুষ্মান নই।
“আমি দেখতে পাচ্ছি লালু। তুমি কেন আমায় এই দৃশ্য দেখালে?”
“কারণ জগৎসংসারের স্নেহহীন চাকায় পদপিষ্ট হয়েও আপনার বিবেক হয়তো এখনও পুরোপুরি মরে যায়নি। সে দেখবে। সে বুঝবে। আমি আপনাকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়েছি ডাক্তারবাবু, মিথ্যাচারণ করিনি। আপনাকে এই কবরস্থান দেখানোর দরকার ছিল আমার। তাহলেই আপনি গজমুক্তাকে রক্ষা করতে তৎপর হবেন।” সে বুক ভরে শ্বাস নিল। “এই লুপ্তপ্রায় অরণ্যের সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে তার প্রাণীকুলও। যে হাতিদের অবাধ বিচরণ ছিল বার্মা পেরিয়ে সুদূর পূর্বে, তাদেরকে আপনারা গণ্ডিবদ্ধ করেছেন এই সঙ্কীর্ণ পরিসরের গাছপালার মাঝে। আপনার নিজের বাড়ির বেড়াল যেখানে সুযোগ পেলেই বাইরে বেরিয়ে পড়ে, সেখানে আপনারা কী করে আশা করেন এই রাজকীয় জীবকে আবদ্ধ রাখার? এই অরণ্যই আমার গজমুক্তা, আমি সেই রত্নের ধ্বংস কী করে জড়পদার্থের মতো চুপচাপ দেখতে পারি, ডাক্তার পাত্র?”
কতক্ষণ সেই ন্যাড়া পাহাড়ের উপরে আমি মনের দিক থেকে মূক ও বধির হয়ে বসেছিলাম জানি না। আমার সামনে খেলা করছিল কিছু ধনেশ, এই জঙ্গল ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না যাদের। আমার মনস্পটে ভাসছিল সাইবেরিয়ার মিথেন বিস্ফোরণের ভয়ঙ্কর চিত্র, আমাজনের দিগন্তবিস্তারি দাবানল, বা আরল সাগরের উষর বুক। লালু ঠিকই বলেছিল। বিবেক আমার এখনও মরে যায়নি, গেলে এভাবে আমার ভেতরে দাঁত নখ পরখ করত না জেগে ওঠা হায়েনার মতো।
হুঁশ ফিরল পিস্তলের নির্ঘোষে আর লালুর আর্তনাদে। যত দ্রুত পারলাম নামলাম নিচে— কিছুটা দৌড়ে, কিছুটা হড়কে, কিছুটা গড়িয়ে, বাকিটা ঘষটে। নুন ছাল উঠে যাওয়া কনুইয়ের দিকে তাকানোর সময় আমার তখন ছিল না। যখন পাদদেশে পৌঁছালাম, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। অকুস্থলে পড়ে লালুর প্রাণহীন দেহ। বুকে গভীর বুলেটের গর্ত নিয়ে সে অবাক হয়ে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে। মৃত্যুর পরেও সে বিশ্বাস করতে পারেনি আমি তাকে শেষ করার অর্ডার নিয়েই এখানে এসেছিলাম। হ্যাঁ, বুলেট আমি চালাইনি, চালিয়েছে আমার সামনে দাঁড়ানো শ্রীনিবাস ও তার টিম, মন্ত্রীমশাইয়ের একান্ত বিশ্বস্ত গুপ্তঘাতকের দল। কিন্তু বন্দুকের নিশানা কোনদিকে করতে হবে আমিই তো দেখিয়ে দিয়েছি। নরহত্যার পাপে রক্তাক্ত আমার হাতও।
হাঁপ নিতে নিতে শ্রীনিবাসের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম, “হাতিটা কোথায় পড়ে?”
“মিস করেছি, ডাক্তার। আমরা ওটার দিকে টিপ করার আগেই ওটা বোঁ করে জঙ্গলে ঢুকে গেল।” আমায় আঙুল দিয়ে দেখাল ঘাসের গায়ে লেগে থাকা সদ্য হওয়া রক্তের দাগ। “চিন্তা করছেন কেন? স্যারের পথের কাঁটা সাফ। একটা আহত অ্যানিমাল কতটা বাঁদরামো করতে পারে?”
“রোগ হাতির থেকে বিপদজনক আর কিছু নেই, শ্রীনিবাস। ওটাকে এক্ষুনি খুঁজে বের করো। নাহলে কিন্তু তোমাদের ভুগতে হবে।”
“ভয় দেখাচ্ছেন? সুন্দরবনে গিয়ে ম্যানইটার মেরেছি। শ্রীনিবাস তিওয়ারি জানোয়ারের ভয় পায় না।”
আমি উত্তর না দিয়ে সামনের জঙ্গলের দিকে তাকালাম। এ কী করলাম আজকে আমি?
৫
একটা অত বড় আহত জানোয়ার কী করে এইভাবে হারিয়ে যেতে পারে শ্রীনিবাসের মতো ট্র্যাকারও সদুত্তর দিতে পারেনি। আজ, লালুর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে সার্কিট হাউসে আমার সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে সে যা দেখাল তাতে আমার কপালের ভাঁজ বাড়ল বই কমল না। যতগুলো ফাঁদ পাতা হয়েছে, যতগুলো ব্যবস্থা করা হয়েছে মালতীকে নিকেশ করার, সব ব্যর্থ হয়েছে। এই বুদ্ধিমান প্রাণী কোন মন্ত্রবলে ক্যামেরা ট্র্যাপ, হাতিদের চলার পথে বসানো কাঁটা, বিষ মেশানো কলার কাঁদি, সবই এড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, সেগুলিকে সে নষ্ট করেছে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। ক্যামেরাগুলোর একটারও সামনে না গিয়ে সেই শুঁড় দিয়েই ব্যাটারি খুলে নিয়েছে সে।
এর মধ্যে ড্রোনের কথা বলতে গিয়ে শ্রীনিবাসের হাত থেকে চা চলকে পড়ল। ড্রোনের শেষ মুহূর্তের ভিডিয়োটা শুধু কৌতূহলোদ্দিপক না, লোমহর্ষকও। ক্যানোপির উপর থেকে উড়ুক্কু ক্যামেরায় প্রথমে বোঝাই যায়নি নিচে সবুজ পাতার ভিড়ে কিছু লুকিয়ে। কিন্তু মালতী শ্রীনিবাসের ঝানু চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই নিচ থেকে উপরে উড়ে এল টিপ করে ছোড়া পাথর। একটা… দুটো… তিনটে। প্রথম দুটো ড্রোনটাকে মিস করলেও শেষেরটা জ্যামুক্ত তিরের মতো ধেয়ে এল লেন্সের দিকে। ভিডিয়োটা সেখানেই শেষ। নিজের শুঁড়কে গুলতির মতো ব্যবহার করেছে মালতী, তারপর দশরথের মতো ছুড়েছে শব্দভেদী বান, ড্রোনের যান্ত্রিক গুঞ্জন লক্ষ্য করে।
“আমার গুলি খেয়েও বেঁচে যাওয়ার পরেই আমি বুঝেছি, এ হাতি না, অপদেবতা। হাতি এভাবে যন্ত্র ধংস করতে পারে না।”
আমি ওর কাপে আবার চা ঢেলে জিজ্ঞেস করলাম, “এবার?”
“ইনফ্রা অপটিক্স সমেত নতুন রাইফেল আনছি। জন্ত হোক বা অপদেবতা, একদম ঝাঁজরা করে দেব।” নিজেকে আশ্বস্ত করার জন্যই কথাগুলো বলল শ্রীনিবাস।
আমি উত্তর না দিয়ে বাইরে তাকালাম। ডোঙ্গিরিতে সন্ধে নামছে। আকাশ লাল থেকে দ্রুত বেগুনি বর্ণ ধারণ কছে। শিরশির করতে উঠল চারপাশের গাছের পাতাগুলো। একটা খসখস শব্দ ভেসে এল। মনে হল দূরের শালবনের মধ্যে একটা ভারী ছায়া যেন দ্রুত মিলিয়ে গেল।
পরের দিন সকালে সেইস্থানে গিয়ে আবিষ্কার করলাম দুইজোড়া গোল গোল গভীর পায়ের ছাপ। অন্ধকারে অদৃশ্য দাঁড়িয়ে মালতী আমাদের সব কথা শুনেছে। এক কিলোমিটার দূরে থেকেও তার কানের জন্য তার শুনতে কোনও সমস্যাই হয়নি। কিন্তু হাতি মানুষের কথা শুনেও বা কী করবে? হাতির কাছে রাইফেল আর গাদা বন্দুকের পার্থক্যই বা কি? তখনই চোখ গেল পাশের শাল গাছের গুঁড়িতে। পাথর দিয়ে গুঁড়ির গায়ে লম্বালম্বি দাগ কাটা। পরপর অনেকগুলো। আমি গুনলাম – এক, দুই, তিন… আট – ঠিক যতদিন আগে লালু মারা গেছে। একটা কাকারের ডাকে সচকিত হয়ে দেখলাম ঘামেতে জামাটা আমার পিঠ একেবারে অজগরের মতো জাপতে ধরেছে। দূরে শুনতে পেলাম সেই বন্যহস্তীর দলের শব্দ। কেন কে জানে, সেই ডাক আমার কাছে বিসদৃশ ঠেকল। পরে চানঘরে সাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম আমি গুনগুন করে সেই হাতিদের গান গাইছি। না, হস্তীসঙ্গীত না। এখানকার এক লোকসঙ্গীত। কিছুদিন আগে শোনা সেই গান কথা ভুলে গেলেও সুর মনে ছিল।
হাতিরা সেই গান গাইছে। বা তাদের দিয়ে কেউ গাওয়াচ্ছে।
দুপুরে শ্রীনিবাস ও তার টিম অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জঙ্গলে ঢুকল। তাদের প্রত্যেকের কাঁধে লাগানো ক্যামেরা। সেই ভিডিয়ো ফিড স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমার আর মন্ত্রীমশাইয়ের স্ক্রিনে সরাসরি সম্প্রসারিত হচ্ছে।
বর্ষার ঠিক পরে পরে জঙ্গল অদ্ভুত রকমের সবুজ আর সুন্দর। জায়গায় জায়গায় ফুল ফুটে, গাছের গুঁড়ি পাক দিয়ে উঠেছে লতা। পায়ের নিচে কার্পেটের মতো ঘন হয়ে বেছানো পচা পাতার জঙ্গল। শ্রীনিবাস কী শুনতে পেয়ে তার মুষ্টিবদ্ধ করে সবাইকে থামতে বলল। সবাই চুপ, জঙ্গলও চুপ, আমরা উৎকর্ণ হয়ে শুনছি।
নিস্তব্ধতা কানে লাগলো আমার। কোথাও কোনও পাখির ডাক নেই, না আছে পোকামাকড়ের শব্দ। গাছের ডালে বসে বানরের দলও গুলতানি করছে না। গাছ বাদে সব কিছু যেন মরে গেছে এই বনে। অথবা, মৃত্যুর অপেক্ষায় নিরবে বসে।
একটু দূরে কোথায় একটা গাছের ডাল মট করে ভাঙল। তারপর সরসর করে একটা দড়ি যেন খসে পড়ল মাটিতে। শিকারিদের পেছনে ভিজে পাতার কার্পেটের উপর দিয়ে একটা ভারী অথচ লঘুপদ জন্তু যেন দ্রুত চলে গেল। তারপরই একটা খড়মড় হুড়মুড় আওয়াজ। খুব কাছে।
হঠাৎ পেছনে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে শ্রীনিবাস বোঁ করে ঘুরে গেল। তাদের দলের একজন উলটো হয়ে ঝুলছে মাটি থেকে বিশ ফুট উপরে। চিৎকারের পরেই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। তার পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে গেছে একটা সরু করে কাটা গাছের ডাল। তার পায়ে জড়ানো লতা পাকিয়ে বানানো দড়ি। ফাঁদটার অতিকায়ত্ব বাদ দিলে মনে হয় না সে এক অমানুষিক প্রয়াস।
রাইফেল হাতে নিজের চারিদিক নিরীক্ষণ করল মন্ত্রীমশাইয়ের বিশ্বস্ত শিকারি। কিন্তু হাতি কই? চাপা গলায় সে বলল, “বর্শা বানিয়েছে গাছের ডাল পাথরে ঘসে। হাতি এইরকম করে না। গুন্ডা হলে সে মানুষ মারে, কিন্তু সেই হত্যার পেছনে থাকে কেবল রাগ। আর এখানে বুদ্ধিমত্তা। আমি বুঝতে পারছি ও আমাদেরকে এখানে ডেকে এনেছে। চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে। আমরা ওর পদচিহ্ন অনুসরণ করে এখানে আসিনি, ও আমাদের এখানে টেনে এনেছে।”
জায়গাটা পতিত ড্রোনটার থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে, বাফার এরিয়ার এই সেক্টরে সাধারণত মানুষের পা পড়ে না। মালতী নিরবিচ্ছিন্ন অবকাশ পেয়েছে নিজের শুশ্রূষা ও ফাঁদ তৈরির জন্য। কিন্তু হাতি যে অস্ত্রের ব্যবহার জানে না। আমরা জানি, তুষারযুগে মেগাফনার সামনে দাঁড়িয়ে শিখতে হয়েছে। ডোঙ্গিরির ভগ্নহৃদয়, শোকে আকুল কেউ যদি মালতীকে সাহায্য করে না থাকে তাহলে ধরে নিতে হয় সে নিজে শুঁড়কে হাতের মতো ব্যবহার করে এইসব বানিয়েছে। কিন্তু কী করে? হাতির তো এত বুদ্ধি নেই! কেন জানি না মনে হল ইমপ্ল্যান্টটার সম্পর্কে অনেক কিছু আমি জানি না। কিন্তু উৎকণ্ঠায় আর ভাবার সময় হল না আমার।
শ্রীনিবাসদের সামনে মালতী একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। একটা জানোয়ার যে এভাবে জঙ্গলের আলোছায়াকে কাজে লাগিয়ে মিলিয়ে যেতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এবারে যেন ভয় পেয়েই নিজের রাইফেলের ইনফ্রারেড সাইটে চোখ লাগাল শ্রীনিবাস। কিন্তু না, হাতির হিট সিগনেচারের টিকিও দেখা গেল না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পাশ থেকে আবার চিৎকার, আর বাকি দুই সঙ্গী অদৃশ্য। অকুস্থলে হাতির আবছা পায়ের ছাপ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। যেন মালতীর পায়ে চিতার থাবা বসানো।
“আমি ফিরে আসছি, এখুনি।” শ্রীনিবাসের মতো দক্ষ শার্পশুটারের গলা সন্ত্রস্ত, কম্পিত। “দানোয় পেয়েছে এই জানোয়ারকে। একে মারা আমার কর্ম না।”
কিন্তু আমার যুক্তিবাদী মন দানোর অস্তিত্ব মানতে নারাজ। কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে মালতীর মধ্যে, যা আমরা ধরতে পারছি না। সব টেস্ট সাবজেক্টের মধ্যে লালু আর মালতীর নিউরাল সিঙ্ক, হয়তো তারা একই সঙ্গে বড় হয়েছে উঠেছিল বলেই, ছিল প্রায় বিরানব্বই শতাংশ।
“ঠিক আছে, শ্রীনিবাস, ফেরত যাও। একটা জন্তুর পেছনে এভাবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।” হতোদ্যম হয়ে নিজের লিঙ্ক কেটে দিলেন মন্ত্রীমশাই। আমিও উৎকণ্ঠা দূর করতে মন ফেরালাম অন্য দিকে।
প্রোজেক্ট অশ্বত্থামার এনক্রিপ্টেড ফাইলটা আমি কখনই শুরু থেকে শেষ অবধি পড়িনি। শ্রীনিবাসের ফিরতে এখনও এক ঘণ্টা। ওর ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন এখনও জঙ্গলের অপরিবর্তনশীল দৃশ্যপট নিরলসভাবে রেকর্ড করে চলেছে। চোখ বোলাতে গিয়ে অশ্বত্থামার সূচিপত্রের একদম শেষে কমপ্রেসড মেমরি ব্যাকআপ-এর হেডিংয়ে চোখ আটকাল।
কুমেরুর মতো যুদ্ধক্ষেত্র পৃথিবীতে আর নেই। বিশ্বউষ্ণায়নের প্রভাবে তার শৈত্যের সাম্রাজ্য আগের ভগ্নাংশ হলেও এখনও সেই বরফ মরুর গড় তাপমাত্রা মাইনাস দশের ওপরে ওঠে না। এইরূপ ভূখণ্ডে যুদ্ধ যে আত্মহত্যার সামিল বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু নিঃশেষিত পৃথিবীতে আর কোথাও খনিজ সম্পদ তোলা তো বাকি নেই। গহীন আফ্রিকান জঙ্গল উপড়িয়ে বের করা হচ্ছে আকরিক। এখানেও তাই। বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটি সৈনিক সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর ভীষণভাবে একা। সঙ্গের চার পেয়ে সহচর ছাড়া তার ফেরা অসম্ভব। তাই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সংরক্ষণের জন্য সৈনিকদের ইমপ্ল্যান্টে একটা অতিরিক্ত প্রোগ্রাম ইন্সটল করা হয়েছিল। যদি কোনও সৈনিকের বরফ সমাধি হয় কোনওভাবে, তাহলে তার প্রশিক্ষিত সহচর কুকুরের কর্তব্য সেই সৈনিকের স্মৃতি নিজের ইমপ্ল্যান্টে ব্যাকআপ করে রাখা ও বেসে ফেরত আনা। এই প্রোগ্রামের জন্ম কতটা সেই সৈনিকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অধিকারকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য, কতটা স্টেট সিক্রেটকে সিক্রেট রাখার জন্য বলা কঠিন। এই ব্যাক আপের জন্য দরকার দুটো ইমপ্ল্যান্টের এনএফসি ছিপের ডাইরেক্ট কন্ট্যাক্ট। তাহলে কি…?
“পাত্র, আমার মেয়েকে বলবেন আমায় সে যেন ভুল না বোঝে…” আমার তাল কেটে গেল শ্রীনিবাসের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শুনে। মিনিমাইজ করা ট্যাব খুলে দেখি সে রাইফেল নামিয়ে একদৃষ্টে সামনের গাছের গুঁড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গীদের মৃত্যু দেখে নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়ার লোক তো শ্রীনিবাস না।
তাহলে?
টুপ…টুপ…টুপ…শুকনো নিঃশব্দ জঙ্গলে কোথাও বিন্দু বিন্দু জল ঝরে পড়ছে। শব্দটা আসছে ওর সামনের ওই গাছের গুঁড়িগুলো থেকে। ক্যামেরার ফোরকে ব্রডক্যাস্ট সত্ত্বেও বাম দিকে, প্রায় ত্রিশ ফুট দূরে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুটো গুঁড়িকে আমি দেখতে পাইনি প্রথমে। বাকি গাছগুলোর থেকে এই কাণ্ড দুটো একটু আলাদা। প্রথমত, তাদের গা বেয়ে ওঠেনি কোনও লতা। দ্বিতীয়ত, তাদের গায়ে কোনও গ্রাম্যবধু যেন সযত্নে কাদা লেপে দিয়ে গেছে। সেই কাদা-জল মাখানো সেই গাছের মাঝের ক্যানপিতেও। টুপটুপ করে যা ঝরে পড়ছে নিচের এক চ্যাটালো গ্রানাইটে। দুই গাছের মাঝে স্থির হয়ে ঝুলছে এক অজগর। না, ওটা সাপ নয়। ওটা শুঁড়। গোটা গায়ে কাদা মেখেছিল বলেই ইনফ্রারেড সেন্সর ওকে দেখতে পায়নি।
চার্জ করে আসা মালতী শ্রীনিবাসকে চিৎকার করারও অবকাশ দিল না।
৬
দ্রুত জিনিসপত্র গোছাচ্ছি আমি। স্থিরভাবে জানি, এবার আমার পালা। কালকে ভোরে আমায় নিতে গুয়াহাটি থেকে হেলিকপ্টার আসবে। আজকে ভালোয় ভালোয় রাত কাটলেই আমার মুক্তি। একবার এই জঙ্গলের সীমানা পেরোতে পারলে আমায় ধরে কে!
রাতে দই চিঁড়ে খেয়ে শুলেও দুশ্চিন্তার কারণে আমার অম্বল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে জল খেলাম। ঘুম আসছে না। আসবে কী করে? মাথায় তখনও ঘুরছে প্রোজেক্ট অশ্বত্থামার ব্যাকআপ প্রিন্সিপাল। প্রিন্সিপালের মূল সূত্রটি প্রযুক্তির না, দর্শনের।
সত্ত্বা আর স্মৃতি কি অভিন্ন না ভিন্ন? যে প্রশ্নের উদ্ভব প্রাচীন গ্রীসে, যে উত্তর মানুষ আজও খুঁজে চলেছে।
১৮৮৯ সালে তাঁর বন্ধু সুভরিনকে লেখা চিঠিতে অ্যান্টন চেকভ প্রশ্ন করেছিলেন, “শব ব্যবচ্ছেদের সময় একজন ধার্মিকও প্রশ্ন করতে বাধ্য যে এখানে সত্ত্বার অস্তিত্ব কই? শারীরিক এবং মানসিক রোগের লক্ষণ এবং তাদের ঔষধাদির সাদৃশ্য সম্পর্কে কারুর যদি বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকে, তাহলে সে বুঝতে পারবে এই সম্পর্ক বড়ই জটিল।”
এই চিকিৎসক-লেখকের সঙ্গে প্রাচীন সফিস্টিক প্যারাডক্সের কোথাও যেন মিল আছে। প্লেটো তাঁর মেনো আর ফেডো ডায়ালগে তুলে ধরেছেন এনামনেসিস দর্শনতত্বের কথা। সত্ত্বার জন্মপরবর্তী বৃদ্ধি আর বিকাশের জন্য স্মৃতিই একমাত্র পথ। আমাদের গড়ে পিঠে মানুষ করে আমাদের অতীত, এবং সেই স্মৃতিরা আমাদের ইন্দ্রিয়কেও জয় করতে সক্ষম। না হলে মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ বৃদ্ধ বয়সে কোনও হোটেলে খেতে গিয়ে মনে পড়লে আমাদের চোখে জল আসে কেন? হৃদয় ভাঙার দিনটা মনে পড়লেই আমাদের জিভের স্বাদ চলে যায় কেন?
এলঝাইমারে বা অন্য স্নায়ুরোগে ভোগা মানুষ তাই শিশুর মতো আচরণ করে। কারণ সে ভুলে যায় সে কে। তার স্মৃতিবিহীন সত্ত্বা তখন ফাঁকা পাত্র, এক নবজাতকের মতো। আমার সঙ্গে পাহাড়ে ওঠার আগে লালুর মালতীর কপালে কপাল ঠেকানোর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল ওদের ইমপ্ল্যান্টের আলো জ্বলে ওঠাও। প্রোজেক্টের শুরুর দিকে যুক্ত থাকার জন্য লালুর এই ব্যাক আপের কথা অজানা থাকার কথা নয়।
মালতীর মধ্যে নিজের স্মৃতিকে আপলোড করার সময় স্বাভাবিকভাবেই লালু নিজের সত্ত্বাকেও কপি করেছে। এক ছাড়া অন্যের অস্তিত্ব যে অসম্ভব।
জেগে ছিলাম বলেই অতিকায় শুঁড়টার সন্তর্পনে আমার জানলার ফাঁকা ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে ছিটকিনি খুলতে দেখতে পেলাম। বিছানায় কাঠ হয়ে বসে আমি। সেই শুঁড় নাগপাশের মতো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আধো অন্ধকারে দেখলাম ক্যামোফ্লাজের জন্য মালতী নিজের দুটো ছোট ছোট গজদাঁত উপড়ে ফেলেছে। পালানোর রাস্তা নেই। জানলার বাইরে দুটো লাল হলুদ কৃত্রিম জ্যোতিষ্ক জ্বলছে, নিভছে। মালতীর ইমপ্ল্যান্ট। লালুর সত্ত্বা।
মানুষের ইমপ্ল্যান্টের মতো জন্তুগুলোর ইমপ্ল্যান্টেরও যদি একটা বিস্ফোরক কিল সুইচ থাকত!
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, বড় গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সোহম গুহ
আপনি আমার প্রিয়তম লেখকের একজন। কল্পবিশ্বে আপনার লেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। প্রতিবারই পড়ে মুগ্ধ হই। বিষয়বস্তু, ভাষা এবং উপস্থাপনা, সব দিক থেকেই টপ নোচ গল্প। এই গল্পটাও ঠিক একই ভাবে মুগ্ধ করল। বেজায় ভালো লাগল❤️
ধন্যবাদ সুদীপ!
এ কাহিনি শুধু তো কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি নয়, এ গভীর দর্শনের কাহিনি। খুব ভাল লাগল। স্মৃতি আর সত্তার মধ্যে সম্পর্ক কি? কাহিনির শেষে পৌঁছে বিষ্ণু দে-র বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটির নাম কেন মনে পড়ল জানি না। সে কাব্যগ্রন্থের নাম ‘স্মৃতি সত্তা ও ভবিষ্যৎ’!
অকল্পনীয় লেখা। শুধু বাংলায় কেন, এ-জিনিস সোহম ছাড়া আর কারও হাত থেকে বেরোবে না। মানে আমি জাস্ট…
কুর্নিশ, ভ্রাতঃ। কী লিখেছ!
ধন্যবাদ ঋজুদা। পরের বছরও যেন আপনার এই প্রশংসার যোগ্য লেখা লিখতে পারি।
ধন্যবাদ পার্থদা। বিষ্ণু দের কাব্যগ্রন্থটি পড়িনি, কিন্তু এবার পড়তেই হবে।
সোহম, আপনার এই গল্পটা অসামান্য লাগল। এটা তো শুধু হাতির ব্যাপার নয়, এটা সমস্ত পরিবেশ নিয়ে লেখা অত্যন্ত জোরালো একটি প্রতিবাদ। আমি আশা করব আপনি এটা অনুবাদ করে পরিবেশ-চেতনামূলক কিছু আন্তর্জাতিক পত্রিকায় পাঠবেন। আপনার লেখা এর আগে তেমন পড়বার সৌভাগ্য হয়নি আমার, কিন্তু আপনার মধ্যে যে ‘গবেষনা করে তবে লেখা ভাল’ মনোভাবটি আছে, তা দেখে খুব ভাল লাগল।
ইলেক্ট্রিক তারে শক খেয়ে প্রায় প্রায়ই আসাম, উত্তরবঙ্গ ও উত্তরপূর্বের অন্যান্য জায়গায় হাতির মৃত্যুর খবরের রিপোর্ট যখন পড়ি এই দূর দেশে বসে, তখন কিছু করতে না পারার আক্রোশটা কিছুতেই মন থেকে বার করতে পারিনা। মানুষের ভবিষ্যত যে কি তা এখনও পর্যন্ত আমরা কিছু জানিনা। তবে পরিবেশ নষ্ট করে যে আমরা আমাদের নিজেদের শ্রাদ্ধের ব্যাবস্থা করছি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আপনাদের মত লোকেদের জন্য সচেতনতা তবু কিছু বাড়ছে।
সেই সূত্রে বলি, এখন পৃথিবীর বহু জায়গাতেই, বিশেষ করে পশুদের migratory পথের সামনে, যেখানে রাস্তা বা অন্য কোনও অপ্রাকৃতিক বাধা গড়ে উঠেছে industrialization-এর জন্য, সেখানের কোনও কোনও জায়গায় ওই বাধার ওপর দিয়ে ব্রিজের মতন করে মাটির র্যাম্প মতন বানানো হচ্ছে (যেগুলো যথেষ্ঠ ভাবে ভারবহনশালী)। মজার কথা হচ্ছে যে বনের পশুরা কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে কিভাবে বুঝতে পারছে যে সেগুলো ওদেরই পার হবার জন্য তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। তখন আর তারা ট্রেনলাইন বা হাইওয়ে আর পেরোতে যাচ্ছে না, দরকার মতন উজান বেয়ে একটু দূরে যেতে হলেও সেইখান পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে র্যাম্পের ওপর দিয়ে তবে অন্যপারে যাচ্ছে। এই প্রজেক্টগুলো বেশ সফল হচ্ছে, যা খবর পাচ্ছি। ভারতবর্ষে কি এই ধরনের প্রজেক্ট করা হচ্ছে এখন?
অমিতাভ বাবু, আপনার কমেন্টটি বর্তমান সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কলেজের থেকে গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিনারে যাওয়ার সূত্রে আমার আসামের সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা তৈরি হয়, এছাড়া এই গল্প লিখতে সাহায্য করেছে ধৃতিকান্ত বাবুর আর স্টিভ অল্টারের গ্রন্থিত অভিজ্ঞতা। ভারতবর্ষের মাটিতে আপনার বলা প্রজেক্ট চালু হলেও তা ব্যাপক মাত্রায় না। ভারতীয় হাতির ভবিষ্যত তাই ছায়ায় আটকে। আমি অবশ্যই এটি অনুবাদ করে পাঠানোর চেষ্টা করবো।