জঙ্গল পাহাড়ের দুঃস্বপ্ন
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বীভৎস ব্যাপারস্যাপার নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা এই সব কাহিনি-টাহিনি কোথাও কোনও একটা উৎস আছে বলেই মনে করেন। সে সব কাহিনি পড়লে গায়ে কাঁটা দেয় তো বটেই, সেই সঙ্গে মুচকি হাসি, মনের কোণে কোণে খেলে বেড়াতে থাকে। সে হাসি অবিশ্বাসের হাসি, কিন্তু যুক্তি তর্ক বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যায় না, এমন সব ঘটনাও তো এই পৃথিবীতে ঘটেছে এবং ঘটছে। কিম্ভূতকিমাকার দানবিক জীবদেহ নিয়ে একদা যাঁরা কলম চালনা করে গেছেন, মনে হতে পারে তাঁরা অতিকল্পনায় আক্রান্ত হয়ে অসম্ভব অপ্রাকৃতদের দুরন্ত কল্পনায় টেনে এনে যেন মাদকাসক্তের মতন কলম চালিয়ে গেছেন। গ্রিক উপকথায় গর্গনদের কথা ফলাও করে লেখা আছে। তারা ছিল তিন বোন। ইউরিয়ালে, মেডুসা আর এসথেনো। তাদের মাথায় চুলের বদলে সাপ কিলবিল করত। বহু মুণ্ড দানবদের কাহিনিও আছে এই গ্রিক কিংবদন্তিতে। একটা মুণ্ড কেটে ফেললে সে জায়গায় দুটো মুণ্ডু গজিয়ে যেত, এহেন দানবদের নাম ছিল হাইড্রা। কিন্তু এ সবই কি উর্বর কল্পনা প্রসূত? একটা কিছু উৎস নিশ্চয় ছিল। ভয়াবহ সেই সুদূর অতীতের অধুনালুপ্ত সত্তারাই কল্পনার ডালপালা মেলে আশ্রয় নিয়েছে কল্পকাহিনি লেখকদের কলমে, এহেন ধারণা একেবারেই অযৌক্তিক নয় বলেই আমি মনে করি।
কিন্তু সে সবই তো প্রতিলিপি, আসল যা তার নকল। মূল যা, তা আজও আমাদের মধ্যে বিরাজ মান। আছে, আছে, আজও তাই আছে। থাকবেও চিরকাল। তারা যাবার নয়। তাদের স্থায়িত্ব যে অনন্তকাল ধরে, তাহা তো মাঝে মধ্যেই আমাদের গা ছম ছম করে ওঠে সম্পূর্ণ অজানিত কারণে। লোমহর্ষক কেন যে ঘটে, তা বুঝতে পারি না, কারণ অন্বেষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হই বলেই বলি, সব ভ্রান্তি, সবই মনের ছায়ামায়া কল্পনা, এরকম উদ্ভট অবাস্তব কিছু ছিল না, নেই, থাকবেও না।
ভুল, ভুল, একেবারেই ভ্রান্ত মনের এহেন ছলনা। যা অজ্ঞাত, তার স্বরূপ না জানতে পারলে মনকে প্রবোধ দেওয়ার ছেলেমানুষি প্রয়াস।
এই যে ছায়ামায়া আতঙ্কনিচয়, এরা কী ইচ্ছে করলে আমাদের এই কলেবরগুলোকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে না?
পারে। কেননা, এইসব আতঙ্কঘন নিতঙ্ক সত্তা এরা যে অনেক, অনেক অনেক প্রাচীন… সেই প্রাচীনতার অঙ্ক আমাদের দূরতম কল্পনা দিয়ে আঁচ করতে পারি কখনও সখনও, কিন্তু এহেন মানবিক কল্পনা তেমন সুদূরপ্রসারী নয় বলেই সম্যক ধারণা মগজের মহাকাশে ফুটিয়ে তুলতে পারি না।
এই যে অতিপ্রাচীন আতঙ্কনিচয়, এরা ছিল আছে থাকবে, বসুন্ধরা যতদিন থাকবে, ততদিন এরা আসবে এবং অবস্থান করবে, বিবিধ ছায়ামায়া রচনা করে যাবে রকমারি কায়া পরিগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। এরা যখন কায়াহীন অবস্থায় থাকে, তখনও তাদের উপস্থিতি অস্থি মজ্জায় টের পাইয়ে দেয়— এমনই অপ্রাকৃত এদের শক্তি। তখনই আমাদের মনে হয়, এহেন শক্তিনিচয় নিশ্চয় কোনও কায়াহীন দৈবশক্তির রকমারি প্রকাশ। প্রকাশমান হওয়ার আগের ছায়ামায়ার সেই রোমাঞ্চকর দুনিয়ায় যারা বিচরণ করতে সক্ষম, এরাই হাড়ে হাড়ে টের পায়, তারা সুদূর অতীতকাল থেকে বারংবার বিচরণ করে যাচ্ছে পৃথিবী পৃষ্ঠে… রকমারি অভিলাষ নিয়ে। তারা ছিল… আছে… থাকবে।
১
চিররহস্যময় হিমালয় এই ভারতবর্ষের পুরো উত্তর দিকটায় মেঘছোঁয়া পাঁচিলের মতন দাঁড়িয়ে আছে সুবৃহৎ গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই উপমহাদেশ সৃষ্টির সময়কাল থেকে। এই কাহিনি সেখানকারই এক সুদূর গ্রাম্য শহরে কাহিনি। সভ্যতার আলো এখন সেখানে কিছু কিছু পৌঁছলেও হিমালয় আজও বিশ্বের বহু রহস্য অব্যাখ্যাত অবস্থায় জঠরের মধ্যে রেখে দিয়ে বিরাজমান বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। তাই তো হিমালয় বড় কুহেলিময় ছিল, আছে, থাকবে। উত্তূঙ্গ পর্বতশীর্ষ বিজয়ের অভিলাষ নিয়ে আজও যাঁরা অভিযান চালাচ্ছেন দুরাধিগম্য এহেন অঞ্চলে, তাঁরা কী বিস্মিত হচ্ছেন না রহস্য কুহেলিমণ্ডিত হিমালয় দর্শনে? এই তো সেদিনের কথা। বদ্রীনাথ থেকে কেদারনাথ সবাই যায় চেনা পথে, গৌরীকুণ্ড হয়ে। কিন্তু সম্প্রতি এমনই এক লুকোনো জলদি-পথের সন্ধান পাওয়া গেছে, যে পথ মাত্র ৫৮ কিলোমিটার লম্বা, চেনা পথ তো ২৪৭ কিলোমিটার।
লুকোনো এই পথের ধারে আছে অদ্ভুত একটা দেশ। পুরাকালে সে দেশ দিয়ে হয়তো মহাপ্রস্থানের পথে রওনা হয়েছিলেন পৌরাণিক পথিকরা, কিন্তু সে দেশ এখন প্রায় অজানা বললেই চলে। মহাপর্বত হিমালয় এমনিভাবেই অনেক অজানা প্রহেলিকা লুকিয়ে রেখে দিয়েছে নিজের সুদীর্ঘ জঠরে। আজও সেই সব জায়গায় বিরাজমান হিমালয়ের ভয়ঙ্কররা অজানা আতঙ্করা, যেমন ইয়েতি। এবং অনেক কিছু। এহেন এক প্রহেলিকা নিয়েই রচিত হচ্ছে এই কাহিনি… সত্য কাহিনি।
একে তো লুকোনো পাহাড়ি রাস্তা, লম্বা লম্বা গাছ আর বড় বড় বোল্ডার পাথরে সমাকীর্ণ, তারপর এক জায়গায় রাস্তাটা কাঁচির মতন দু-ভাগ হয়ে গেছে। বোল্ডার আর বনবৃক্ষদের দৌলতে সে রাস্তা চোখে পড়ার কথা নয়, কিন্তু কোনও সন্ধানী আর অনুসন্ধিৎসু পর্বতারোহী যদি ঢাকাঢুকি দেওয়া সেই পর্বত পথ দিয়ে হেঁটে যায়, তাহলে এসে যাবে অদ্ভুত একটা নিঃসঙ্গ পর্বতালয়ে।
সে পথে যেতে গিয়েই দেখা যাবে পায়ের তলার জমি একটু একটু করে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। দু-পাশের ঝাকড়া-মাকড়া পাদপগণ একটু একটু করে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছে পথের ওপর। বিদঘুটে প্রস্তর প্রাচীরের রং পর্যন্ত পালটে যাচ্ছে একটু একটু করে। রাস্তায় যত কাঁকড়, ধুলো তার চাইতে বেশি। এ যেন ঘটোৎকচ অশ্বত্থামাদের বেড়ানোর জায়গা। তারা যে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে অভ্যস্ত। কিন্তু সাধারণ মানুষদের দম বেরিয়ে যায়। বৃক্ষনিচয় বেধড়ক লম্বা হয়ে রয়েছে। হিমালয়ের হাওয়ায়, ঝোপঝাড় উদ্দাম হয়েছে। খেয়ালখুশি মতন, বনলতা আর পাহাড়ি ফুল যেখানে পেরেছে সেখানেই গজিয়ে পথটাকে ভয়ঙ্কর সুন্দর করে রেখেছে। মানুষজন যেখানে বসবাস করে, এহেন উদ্দামতা সে সব জায়গায় সুবিধে করতে পারে না।
তাই বলে জায়গাটা যে একেবারেই পাণ্ডববর্জিত তা তো নয়। কে জানে একদা হয়তো পাণ্ডবগণ এই পথ বেয়েই মহাপ্রস্থানের পথে গেছিল বেচারি দ্রৌপদীকে নিয়ে। পঞ্চস্বামীর গুঁতোয় রক্তাক্ত চরণে তাকে হেঁটে যেতে হলেও গিন্নীসুলভ গুঁতো দিয়ে মাঝে মাঝে জিরোতে জিরোতে গেছে দু-চারদিন অথবা দু-চার মাস ধরে। মেয়েরা ঘর বাঁধতেই যে ভালোবাসে, ঘর ভাঙা স্বভাব কিন্তু ব্যাটা ছেলেদের। সৃষ্টির প্রথম প্রহর থেকে। বংশানুর আঁচ।
সেই সব ঘরকন্নার বেশ ধরে পরবর্তীকালে পাহাড়ি মানুষরা নিশ্চয় পাণ্ডব পরিত্যক্ত এইসব অঞ্চলে বসতি বানিয়েছিল একদা। পাহাড় কিন্তু অ-বশ্য, চিরকাল। কাউকে বড় একটা পাত্তা দেয় না। নিজের নিয়মে নিজের ছন্দে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। উদ্দামতাই পাহাড়ের অলঙ্কার।
মানুষও বড় ঢ্যাঁটা। বড় জেদি। গোঁয়ার পাহাড়কে বশ মানিয়ে সেখানে চাষআবাদ করবার চেষ্টায় কসুর করেনি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বুঝি হার মেনেছে পাহাড়ি গুঁতোর কাছে। কিন্তু কাছে গেলে দেখা যাবে বুনো মোষের মতন বুনো পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় খেত খামারের চেষ্টা চালিয়ে গেছে মনু-র পুত্রগণ। দূরে দূরে পাহাড়ের কোলে আর খাঁজে ছোট ছোট মাথা গোঁজবার মতন ঠাঁই বানিয়েও নিয়েছে। যদিও সেসব আস্তানা কখনওই এক জায়গায় গুঁতোগুঁতি করার মতন অবস্থায় নেই, হিমালয় যখন উদার আর জমি যেখানে দেদার, সেখানে মানুষ নামক ঢ্যাঁটা জীবগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেখানে দরকার সেখানে ছত্রভঙ্গ মতাদর্শে ছাউনি বানিয়ে রেখেছে। যদিও সেইসব ছাউনির বয়স আন্দাজ করতে গেলে থমকে যেতে হয়, অথচ বিস্ময়করভাবে সব ক-টা ছাউনির গড়ন আর প্যাটার্ন প্রায় একই রকমের এবং ছন্নছাড়া চেহারাতেও মিল আছে যথেষ্ট।
মাঝে মাঝে খাড়া একক প্রহরীর মতন প্রস্তর কুটিরগুলোর চৌকাঠে বসে থাকা ভ্রূকুটিময় বাসিন্দাদের পথের ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেও সাহস পায় না দুর্গম পথের পথিকরা। তাদের চোখ মুখের ভাব দেখে মনে হয়, আপদ এসেছে নির্জন আলয়ে, বিদেয় হলেই যেন বাঁচে। নতুন মানুষ দেখলেই কেন যে এত বিরাগ আর বিতৃষ্ণা এই পর্বতালয় বাসিন্দাদের, তার কারণ অনুমান করতে অক্ষম হয় দুর্গমের অভিযাত্রীরা। চোখমুখ দেখে মনে হয়, স্রেফ চাহনি দিয়ে তারা যেন বলতে চাইছে— পালাও পালাও, কেন মরতে এসেছ এহেন আতঙ্ক আলয়ে। তারপর যখন পাহাড়ি রাস্তা একটু একটু করে উঠে যায় পাহাড়ের একদম ওপর দিকে, পর্বতশীর্ষ যেখানে মেঘমহলের সঙ্গে কোলাকুলি করতে ব্যস্ত, সেইখানে, নিবিড় জঙ্গলমহল ছাড়িয়ে অনেক অনেক ওপরে কিন্তু জায়গাটার অদ্ভুত একটা প্রহেলিকা আরও গ্যাঁট হয়ে চেপে বসে মনের মধ্যে। পর্বতশীর্ষগুলো সে জায়গায় বড় বেশি গোলাকার, মসৃণ আর পরস্পরের সঙ্গে মানানসই ছকে তৈরি। দেখে মন ভরে যায়, প্রকৃতি যেন নিজেই ভাস্কর হয়ে চুড়োগুলোকে গড়ে নিয়েছে মনের মতন করে, এরই মাঝে আকাশের প্রেক্ষাপটে যেন সবিশেষ পরিচ্ছন্নতা নিয়ে উঁচিয়ে থাকতে দেখা যায় বিশেষ একটা পর্বতচুড়ো ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সমুন্নত প্রস্তর স্তম্ভদের, মানানসইভাবে গড়া প্রতিটি থাম, সমান ব্যবধানে স্থাপিত হয়ে হুবহু আংটির মতন ঘিরে রেখেছে বিশেষ সেই পর্বত শীর্ষকে। যেন মহারাজার মাথার মুকুট। দেখে থমকে যেতে হয়। কিছুটা বিস্ময়ে, কিছুটা অজানিত ভয়ে। প্রকৃতির উদ্দাম আলয়ে এমন ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা দেখিয়ে গেল কারা? দ্রৌপদীর দলবল নিশ্চয় নয়। তারা তো চলে ছিল মহাপ্রস্থানের পথে— শেষের পথের পথিক হয়ে… তাহলে? কারা নির্মাণ করেছে অলঙ্কার প্রতিম এহেন বলয়াকার স্তম্ভ মালা? এমন সুদীর্ঘ? এমন নিখুঁত? নিপুণ কারুকার্যময়?
পাহাড়ি পথের কিনারা দিয়ে নেমে গেছে যে সব গিরিখাদ, সে সবের গভীরতা যে কতখানি, সে হিসেব মাথার মধ্যে আনা যায় না, কিছুক্ষণ ঘাড় হেঁট করে চেয়ে থাকলে মাথার মধ্যে আনা যায় না, কিছুক্ষণ ঘাড় হেঁট করে চেয়ে থাকলে মাথার মধ্যে ঘুরপাক লেগে যায়। মাঝে মাঝে থাকা নড়বড়ে কাঠের সেতুগুলোয় পা দিয়ে ভয় হয়, এই বুঝি হুড়মুড় করে ধসে নেমে যাবে নিতল গিরিখাদ। খাদ পেরিয়ে আসবার পর গিরিপথে ফের পা দিয়ে দেখা যায় দু-পাশে থুকথুক করছে কাদাটে জলাভূমি। দেখেই গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে। সন্ধের দিকে সেই সব বিদিগিচ্ছিরি জলাভূমির দিকে তাকালে গা ছমছম করতে থাকে, তখন সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে থাকে রক্তচোষা জঘন্য এক রকম মশকবাহিনী যাদের সম্মিলিত ডানানাড়ার গুনগুন আওয়াজ কানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে রক্ত জমিয়ে দিতে চায়, তালে তালে মিলিয়ে কোরাস গান গেয়ে যায় একটানা একঘেয়ে সুরে বড় বড় পাহাড়ি ব্যাঙ, দেখা যায় জোনাকিদের অস্বাভাবিক বিরাট বাহিনী। পাহাড় ঘিরে ঘিরে উঠে যাওয়া আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দেখে মনে হয় যেন পথ তো নয়, যেন পৌরাণিকী প্রকাণ্ড অজগর… আমাজনের অতিকায় অ্যানাকোন্ডা… জলচর না হয়ে জন্মেছে এই উঁচু জায়গার উদ্দাম বন্য পরিবেশে।
এহেন সমুন্নত পাহাড়নিচয় যখন পথিকদের কাছাকাছি চলে আসে, তখন কিন্তু পাহাড়চুড়োদের দিকে থেকে নজর চলে আসে দু-পাশের নিবিড় জঙ্গলের দিকে। সেখানে যে তখন বিরাজ করছে ঘন অন্ধকার। খাড়াই গা দিয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে গাঢ় সবুজ পাদপবাহিনী। দেখেই গা হিম হয়ে যায়। মন চায় না ভেতরে ঢুকতে। অথচ ভয়াল সুন্দর সেই বনস্পতিদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এবড়োখেবড়ো উঁচুনিচু পথ চলে গেছে নিবিড় নির্জন নিকেলদের বুক ফুঁড়ে। কিন্তু যেহেতু অন্য পথ আর নেই, তাই দুরুদুরু বুকে যেতেই হয় সেই ভয়াল সুন্দর বনপথ দিয়ে।
ছাউনি দেওয়া একটা সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে চোখে পড়ে ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ি ঝরনা নদী গোল পাহাড়ের খাড়াই গা বেয়ে উদ্দাম নাচ নাচতে নাচতে নেমে গেছে গ্রামের পাশ দিয়ে। সে গ্রামের বাড়িটাড়িগুলো যেন মান্ধাতার আমলের কারিগর আর স্থপতিদের হাতে তৈরি। পাথরের চাকতি দিয়ে গড়া মাথার ওপরকার ঢালু ছাউনি। এই ধরনের স্থাপত্য দেখা যায় না কিন্তু পাহাড়ের নীচের দিকে। একটু কাছে গিয়ে দেখলে গা ছমছম করবেই। কেননা, বেশির ভাগ কিম্ভূত গৃহ খাঁ-খাঁ করছে, জনপ্রাণী নেই যত্ন না নেওয়ার ফলে ভেঙে ভেঙে পড়ছে সুদূর অতীতের সেইসব প্রস্তর নিকেতন। মহাকাল মন্দিরের মস্ত চুড়োটাও হেলে পড়েছে। এখন সেখানকার উঠোনে পাহাড়ি মানুষদের নানান জিনিসের বেচাকেনার হাট বসে। এমন জায়গায় যেতে গেলে যে পর্বতসেতু পেরোতে হবে, সেখানে থুক থুক করে বড় বড় সাইজের পাহাড়ি গুবরে পোকা। পা দিতে মন চায় না। উপায়ও নেই। যেতেই হবে এই সাঁকো পেরিয়ে, আর তো পথ নেই। ভয়ে ভয়ে সাঁকো পেরিয়ে আসবার পর বিচ্ছিরি একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে ভেসে আসে পাহাড়ি গ্রামের পথে পা দিয়েই, যেন কয়েকশো বছর ধরে অনেক কিছু পচে গলে অসহ্য দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। এমন একটা জঘন্য জায়গা পেরিয়ে আসবার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়। তারপরেই পাওয়া যায় পাহাড়ের গোড়ার দিকে সঙ্কীর্ণ পথ, যে পথ বিশেষ এই পাহাড়টাকে ঘুরে ঘুরে পাকসাট দিয়ে উঠে গেছে ওপর দিকে। কিছুটা ওঠবার পর বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে সমতল হয়ে গেছে সেই পাকদণ্ডী। মাসুল আদায়ের ঘাঁটি রয়েছে এইখানেই। মাসুল দিয়ে তবে ঢুকতে হয় শহরে। শহরের নামটা অদ্ভুত। শুনলেই খটকা লাগে। মহাকাল। শহরের নাম মহাকাল।
এহেন শহরে বাইরের লোকজন আসে খুবই কম। না আসতে পারলেই যেন বাঁচে। এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবৃত্তি যুগ যুগ ধরে, জন্মগতভাবে জাগ্রত হয়ে রয়েছে পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে বিশেষ একটা আতঙ্ক সময়ের পর থেকে সে সব সাইনবোর্ডে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা ছিল মহাকাল শহর রয়েছে কোনদিকে, সেগুলোকেও টেনে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যদিও এখানকার সিন-সিনারি স্থানীয় চোখে গা সওয়া মামুলি মনে হলেও বাইরের লোকের চোখে অতুলনীয়। অপূর্ব। এতৎসত্ত্বেও এ জায়গায় গ্রীষ্মের অবকাশ কাটাতে শিল্পী মহোদয়রা আসে না, টুরিস্টরাও জায়গাটা মাড়াতে চায় না। দুশো বছর আগে যখন শয়তান-পুজো, ডাইনি-রক্ত আর অদ্ভুত জঙ্গলে বিভীষিকাদের নিয়ে মাতামাতি হয়নি, তখনও এহেন জায়গাকে এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা গেছিল বন পাহাড়ের দৃশ্য অভিলাষীদের মধ্যে।
এযুগে অবশ্য আমরা যুক্তিবুদ্ধির হিসেবে চলি। কুসংস্কারের নিগড় আমরা কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু ১৯২৮ সালে মহাকাল শহরে যে সব উৎপাত, যে সব আতঙ্ক রক্ত জমিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছিল, সে সব নিয়ে যাবতীয় রটনা যখন ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন বিশেষ করে যারা মহাকাল শহরের মঙ্গল চায় এবং এই পৃথিবীর সক্কলের মঙ্গল চায়, তারাও তো দেখা যাচ্ছে এমন শহরটাকে এড়িয়ে চলতে পারলেই যেন বেঁচে যায়। কেন যে মহাকাল শহর তাদের অস্থিমজ্জা রক্তপ্রবাহে নিতল নিতঙ্ক নিয়ে এখনও জেগে আছে, তার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হ্যাঁ এই পৃথিবীর অনেক প্রাচীন অঞ্চলের বাসিন্দাদের বংশলুপ্তি তো ঘটে যাচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মে, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মুছে গেছে এবং মুছে যাচ্ছে ধরণীর আদিম বাসিন্দাদের অনেক জীবই। যেমন ডোডো পাখি। এখন যেমন বাঘের সংখ্যা হু হু করে কমে আসছে পৃথিবীময়। অতীতের প্রজাতিরা থাকবে না, আসবে নতুন প্রজাতি, বিপুলতর মগজ সমারোহ নিয়ে। বিশ্বস্রষ্টার এইটাই তো নিয়ম। সেই নিয়ম মেনেই সুপ্রাচীন এই পর্বতালয়ের অনেক বাসিন্দাই বিলুপ্ত হয়েছে ধরাপৃষ্ঠ থেকে। নবাগতরা জানে না এই তথ্য। জানে না যে এখানকার, এই পর্বতালয়ে অতি-আদিম বাসিন্দারা একদা বিপুল সমারোহ নিয়ে অতি উন্নত এক মানব প্রজাতি হয়ে গেছিল। তারপর একটু একটু করে পতন ঘটতে থাকে তাদের, হারিয়ে ফেলে মগজের উৎকৰ্ষ, শারীরিক দক্ষতা। এখন তাদের যে বংশধররা বিরাজমান এই পর্বতালয়ে, তাদের গড় বুদ্ধিবৃত্তি খুবই নিম্নমানের। উপরন্তু, বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্নাম। গুপ্ত হত্যা, আদিম শক্তি সমূহের আবাহন, নরবলি আর উল্লেখ করা সমীচীন নয় এমনতর বিবিধ কুকর্মের জন্যে বিলক্ষণ কুখ্যাত গোটা তল্লাটটা জুড়ে। জনসংখ্যা কমে এসেছে খুবই। বংশগতিতে দেখা দিয়েছে অবক্ষয়। নামটুকুই শুধু টিকে আছে, যে নাম শুনলে জান পহচান মানুষরা নিমেষে বুঝে নেয় এহেন পার্বত্য বাসিন্দারা কোন অত্যুন্নত মানুষদের বংশধর। এখন অবশ্য কদর্য কালিমা নিয়ে টিকে রয়েছে তাদেরই এহেন অপদার্থ উত্তরসূরীরা। মাঝে মাঝে এদের কেউ কেউ ছিটকে চলে যায় এই ভারতের বড় বড় শহরে নিজেদের গড়ে নেওয়ার জন্য নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিকতম সুশিক্ষার আঁচে, তারা কিন্তু আর ফিরে আসে না নরক প্রতিম এই আদিম বাসস্থানে। যেখানে একা দাপিয়ে গেছে তাদেরই পূর্বপুরুষরা।
ইদানিং যে সব রক্ত জল করা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এই পর্বতালয়ে, সে সব সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নয় কেউই। লোকমুখে অবশ্য শোনা যায় অনেক হাড় হিম করা কাহিনির আভাস। সে সব কাহিনি অতীত কিংবদন্তির অপভ্রংশ হলেও হতে পারে। ওই যে গোলাকার শীর্ষ পর্বত, ওখানে নিশীথ রাত্রে নাকি জাগ্রত হয় গুরুগুরু গুমগুম শব্দস্রোত, মাটির তলা থেকে ফেটে আসে যেন জোরালো পটকা ফাটার আওয়াজ, পাহাড়চুড়োর আনাচেকানাচে তখন নাকি উঁকি দিয়ে যায় কত কী অজানা ছায়া করাল কুটিল অবয়ব নিয়ে। ১৭৪৭ সালে নাকি ওখানকার মহাকাল মন্দিরের পুরুতঠাকুর আচার্য ব্রহ্মানন্দ মহাসমারোহে যজ্ঞটজ্ঞ করে ছিলেন অদৃশ্য আততায়ীদের অঞ্চল ছাড়া করার জন্য। তখনই নাকি আভাস দিয়েছিলেন— এখানে আছে এমনই এক নারকীয় সত্তা, আকারে বেঁটে মর্কট, তার দলবলও অনুরূপ দেহধারী। এরা খর্বকায় বামনাকার, কিন্তু পৈশাচিক শক্তির অধিকারী। এরা একদা ছিল, তখন দাপিয়ে গেছে এখানকার গিরিকন্দর, আছে আজও ফের মাথা চাড়া দেওয়ার জন্যে। এরা মূর্তিমান বিভীষিকা, এদের কোনওরকম বর্ণনায় আনা যায় না। এরা রক্তজল করা আকৃতির অধিকারী। দিন পনেরো আগে এই রকমই এক ভয়াবহ সত্তার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার… আমার কুঠিরের পেছনের খাদে যার নিবাস। সেখানে আজও রয়েছে বিস্তর গিরিগহ্বর, পর্বতগুহতি প্রস্তর কন্দর। আজও সেইসব নিষিদ্ধ অঞ্চলে তারা রয়েছে গভীর গহন গুপ্ত নিবাস রচনা করে। তাই তো মাঝে মাঝে এই তল্লাটের পাহাড় কেঁপে ওঠে তাদের পাতালিক প্রলয় নিশ্বাসের প্রভঞ্জনে। তাদের গজরানি আর গুঞ্জনের গুরু গুরু নিনাদে। তাদের নিকেতনে নির্ণয় করতে পারে শুধু প্রলয়ঙ্কর মন্ত্র আর পাহাড়ি যজ্ঞ, তখনই অর্গল মুক্ত হয়ে ঠিকরে ধেয়ে আসবে নারকীয় বিভীষিকারা, সাবধান! যেন তাদের খোঁচানো না হয়। তারা ছিল, আছে, থাকবে। তাদের আরাধনা করতে যাওয়া মানেই পার্বত্য প্রলয়কে আহ্বান করা। এহেন আবাহনের আভাসমাত্রও যেন কারও মগজের মধ্যে না আসে। এই পাহাড়ে তাদের আবির্ভাব, এই পাহাড়েই তারা থাকে, এই পাহাড়েই তারা থাকবে। তারা ভয়ঙ্কর, তারা প্রলয়ঙ্কর, তারা বিভীষক। হুঁশিয়ার! তাদের ঘাঁটাতে যেওনা। নিষিদ্ধ নগরীতে তারা নরক রচনা করতে পারে চক্ষের নিমেষে। তারা কল্পনাতীত, তারা এই পৃথিবীর আদিম বাসিন্দা। তারা অসীম ক্ষমতার অধীশ্বর।
এহেন হুঁশিয়ারি দেওয়ার অনতিকাল পরেই যেন শূন্যে বিলীন হয়ে গেছিলেন আচার্য ব্রহ্মানন্দ। কিন্তু দেবনাগরী হরফে লেখা তাঁর বক্তিমে যে ভূর্যপত্রে লিখে রাখা হয়েছিল, বৃক্ষত্বক দিয়ে তৈরি সেই পুঁথি আজও রয়ে গেছে মহাকাল মন্দিরের গর্ভগৃহে। পাহাড়ের আওয়াজ, গিরিগহ্বরে সঞ্জাত কোলাহল, অদ্ভুত রুধির জমানো শব্দনিচয় অব্যাহত থেকেছে আজও। বরং বেড়েই চলেছে বছরে বছরে। প্রাকৃতিক ভূপ্রকৃতিবিদ আর ভূতাত্ত্বিকরা বিলক্ষণ বিমূঢ় হয়ে থেকেছেন এহেন অদ্ভুত শব্দরাশির কারণ অনুমান করতে না পেরে।
এছাড়াও কানাঘুসোয় শোনা যায় আরও অনেক অদ্ভুত কাহিনি। পাহাড়চুড়ো ঘিরে ওই যে মুকুটবলয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে সারবন্দি প্রস্তর স্তম্ভ, সেখান থেকে ঠিকরে আসে নাকি বিষম বিকট দুর্গন্ধ, মাঝে গিরিবর্ত্মের নিতল পাতাল অঞ্চল থেকে হু হু করে ধেয়ে আসে দামাল উত্তাল হাওয়ার ঝাপটা, মনে হয় যেন অষ্টপ্রহরের কোনও একটা বিশেষ সময়ে কিছু একটা সত্তা হানা দিয়ে যায় সেই সব সুগভীর পাতালের পাকচক্রে; লোমহর্ষক এহেন ব্যাপারস্যাপার কাউকে স্পন্দরহিত রেখে দেয়, কাউকে বাচাল করে তোলে… অর্গল মুক্ত মুখে হুড়মুড় করে বলে যেতে থাকে মহাপাতালের মহাপাতালিকদের নর্তনকুর্দনের বিবিধ ব্যাখ্যা… নরক থেকে নাকি কল্পনাতীত সত্তারা উঠে এসে উল্লোল নৃত্য করে যেখানে, এসব শব্দ নাকি জাগ্রত হচ্ছে সেই পাথুরে চত্বরে… যেখানে ঘাস পর্যন্ত গজায় না… যেখানে প্রাণের ছোঁয়া লাগেনি সৃষ্টির প্রথম প্রহর থেকে অদ্যাপি, স্বয়ং কালান্তক নাকি কালনৃত্য নেচে চলেছে সেখানে আজও।
এই তো গেল এক জাতীয় পাখনাওলা গুজব কাহিনি। আর এক ধরনের রটনায় শুনতে পাওয়া যায় আরও তাজ্জব ধরনের একটা গুজব। ছাগল ভেড়ার রক্তচোষা মশককুল নাকি উষ্ণ নিশীথে বিলক্ষণ হট্টগোল শুরু করে দেয় একদম ন্যাড়া যে পাথার তল্লাটে, সেখানে। এহেন থমথমে অঞ্চলেই নাকি কিছু পাখি যমদূতের কাজ করে মৃতের আত্মাকে পিঠে চাপিয়ে যমের দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। মুমূর্ষু যখন মৃত্যুযন্ত্রণা সইতে সইতে যমের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, তখন নাকি বিপুল পাখা ঝটপটানি দেয় এই সব যমালায় বিহঙ্গরা শিহরন জাগানো ঐকতানে মুমূর্ষুর শেষ নিশ্বাসের ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে। প্রাণপাখী দেহপিঞ্জর থেকে বেরিয়ে এলেই অট্ট অট্ট ওঠে নাকি এই কালান্তক বিহঙ্গকুল, কিন্তু যখন প্রাণটাকে দেহের খাঁচা থেকে টেনে বের করতে অক্ষম হয়, তখন নিঃসীম নৈরাশ্যে একটু একটু করে স্তব্ধ করে দেয় যাবতীয় নারকীয় হাঁকডাক।
এই যে সব রুধির শীতল করা কাহিনি, এসব গালগল্প এখন আর শোনা যায় না। জনমতে খারিজ হয়ে গেছে এহেন কপোলকল্পিত কাহিনি নিচয়। সে কালের কথা একালে কেউ তা বিশ্বাস করতে চায় না। সেকাল বলতে অতি-সেকাল, সেই সময়কালের হিসেব হারিয়ে ফেলেছে একালের মানুষ। মহাকাল শহরের জায়গাটার বয়সও তো কম নয়। বয়স এত বেশি যে শুনলে হেসে গড়িয়ে পড়তে হবে। তিরিশ বর্গ মাইল জোড়া তল্লাটে মহাকালের মতন সুপ্রাচীন শহর বা মন্দির আর নেই, এখানে এককালে যে মনুর পুত্রগণ বসতি স্থাপন করেছিল, বয়সের হিসেবে তারা নাকি অতি আদিম একজাতের মর্ত্যবাসী— অন্য এক অঞ্চল থেকে নাকি তাদের আগমন ঘটেছিল এখানে একদা গোটা পৃথিবীগ্রহে বিজয়ধ্বজা তোলবার বাসনা নিয়ে হিমালয়ের জাদুকরী হাওয়ার প্রতাপে। মহাকাল শহরের তিরিশ মাইলের মধ্যে যে সব পার্বত্য উপজাতিদের নিবাস, তাদের চেয়ে সৃষ্টি কৃষ্টি সভ্যতায় অনেক বেশি আগুয়ান কিন্তু এখানকার, তৈরি হয়েছিল ১৭০০ সালে। ১৮০৬ সালে তৈরি হয়েছিল হাওয়া কল— আধুনিক সভ্যতার কারিগরি দক্ষতার ছাপ বুকে নিয়ে আজও তা দাঁড়িয়ে আছে। এহেন স্থাপত্য এই তল্লাটে আর কোথাও তো দেখা যায় না। তবে কলকারখানা এখানে মাথা তুলতে পারেনি। ছন্নছাড়া দু-একটা প্রচেষ্টা টেকেনি।
প্রাচীনতম হয়ে রয়েছে পাহাড়চুড়োর বলয়াকার সজ্জায় খোদাই করা স্তম্ভশ্রেণি। খোদাই কর্মের মধ্যে সূক্ষ্মতার অভাব আছে অবশ্য যথেষ্ট। ধ্যাবড়া, কিন্তু মজবুত, নজর কাড়ার মতো না।
কিন্তু…
এই পর্বতস্তম্ভ যারা নির্মাণ করেছিল, আস্ত পাথর খুদে বানিয়েছিল, তারা নাকি এখানে আগত বাসিন্দাদের চেয়েও বয়সে অনেক প্রাচীন, অনেক আগে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল এই বিজন তল্লাটে, অদ্ভুত স্তম্ভ বলয় নির্মাণ করেছিল কী কারণে, তার যথার্থ কারণ আজও তিমিরাবৃত।
তবে স্তম্ভ বলয়ের মধ্যে পড়ে থাকা রাশি রাশি করোটি আর নর-অস্থি দেখে মনে হয়েছে, একদা এক সুপ্রাচীন জাতি চৌকিদারির জন্যে নিশ্চয় নির্মাণ করেছিল পর্বতশীর্ষের এই প্রস্তর স্তম্ভবলয়, গিরিকন্দরে রয়েছে তাদের ম্যমিদেহ, মানবজাতির বিবরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান বিজ্ঞানীরা অবশ্য এহেন ধারণা পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি, তবে তাঁদেরই এক দলছুট মহল হাজির করেছেন আজব এত তত্ত্ব।
একদা এই তল্লাটে নাকি রাজত্ব করে গেছিল কয়েশীয় কোনও সম্প্রদায়।
হিমালয় অনেক অসম্ভবের আখড়া।
নইলে কী এহেন সৃষ্টি ছাড়া কাহিনি লেখার প্রেরণা পেতাম?
২
এই মহাকাল নগরীতেই একদা আবির্ভূত হয়েছিল ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল জননী সাবিত্রী ক্ষেত্ৰপালের জঠরে। গ্রাম থেকে চার মাইল দূরের একটা পাহাড়ের গায়ের বেশ বড় সাইজের একটা খামার বাড়িতে। আশপাশে ছিল না কোনও বসতবাড়ি। ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এক রবিবারে, ভোর ছটায়। তারিখ, দোসরা ফেব্রুয়ারি ১৯১৩। তারিখটা সবার মনে আছে একটাই কারণে। ওই তারিখেই যে মোমবাতি নিয়ে মিছিল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল মহাকাল মন্দিরের প্রাঙ্গন থেকে। সারা বছর যেন শান্তি বজায় থাকে গোটা তল্লাটে, এই কামনায়। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটে গেছিল ঠিক সেই সময়ে। ভোর ছটায় ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল যখন ধরনির আলো প্রথম দেখেছিল, ঠিক তখনই একসঙ্গে হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছিল তল্লাটের সমস্ত কুকুর। গজরানি শুরু হয়েছিল অবশ্য ক্ষিতি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই। প্রসব যন্ত্রণা চলেছিল সারারাত। কুকুররাও গলাবাজি করে গেছিল সারারাত। সেই সঙ্গে আরও একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এসেছিল প্রত্যেকের কানে। পাহাড় যেন গর্জে চলছে গুমগুম আওয়াজে। সারারাত।
আর একটা ব্যাপারে খটকা লেগেছিল প্রত্যেকেরই। যদিও কুকুর আর পাহাড়ের গজরানির মতন বিষম ব্যাপার সেটা নয়। তবে এক্কেবারে তাচ্ছিল্য করা যায় না। ক্ষিতি ক্ষেত্ৰপালের জননী সাবিত্রী ক্ষেত্রপাল মেয়েটা বিয়ে না করেই বাচ্ছার জন্ম দিয়েছে। দেখতে তাকে আহামরিও নয়। বরং গোটা শরীরটায় আছে একটা বিচ্ছিরি বিকৃতি। বয়স পঁয়ত্রিশ। মা গেছে পরলোকে অনেক আগেই। বাপের বয়স হয়েছে যথেষ্ট। মাথায় ছিট আছে। আধপাগলা। তুকতাক জানে। যৌবনকাল থেকেই নাকি ঝাড়ফুক আর ডাকিনীতন্ত্র নিয়ে মশগুল থেকেছে। অলৌকিক অতিপ্রাকৃত শক্তি আবাহন করার মন্ত্রগুপ্তি নাকি মুঠোর মধ্যে এনেছে পাহাড়ে বনে ঘুরে ঘুরে।
সবচেয়ে বেশি খটকা লেগেছে সাবিত্রী কুমারী থেকেও বাচ্ছার জন্ম দেওয়ায়। কোনও ব্যাটা ছেলের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা করেছিল কি না, তাও জানা যায়নি। এসব ব্যাপারে অবশ্য পাহাড়ি মানুষরা বেশ উদার। দ্রৌপদী গোত্র তো আজও আছে এই অঞ্চলের পাহাড়িদের মধ্যে। এক মেয়ে যদি বহু স্বামী রাখতে পারে, তাহলে স্বামী ছাড়াই মা হতে বাধাটা কোথায়? পাহাড়ি রীতিনীতি অনুযায়ী তাই ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের কুমারী জননীকে সমাজচ্যুত করা হয়নি। এহেন ব্যাপার নিয়ে মুখরোচক আলোচনাও হয়নি, যা হয় শহর-টহরে।
তবে, বাচ্ছার বাপ কে হতে পারে, তা নিয়ে গুজগুজ ফিসফাস কানাকানি হয়েছে বিস্তর। গুজব পাখনা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। সাবিত্রী কিন্তু অহঙ্কারে মটমট করে গেছে এমন একটা শিশুর জন্ম দিতে পেরে, নিজেকে ভাগ্যবতী মা বলে মনে করেছে। অথচ নবজাতককে দেখতে হয়েছিল ঠিক ছাগলের মতন। মায়ের ঠিক উলটো। সাবিত্রীর গায়ে রং ছিল অদ্ভুত সাদাটে, ধবল হলে যে রকম হয় গায়ের চামড়া, সেই রকম। কিন্তু ছেলেটা হয়েছিল মিশমিশে কালো রঙের। সাবিত্রী কিন্তু সেজন্যে মন খারাপ করেনি। উলটে খুব দেমাক দেখিয়েছিল। বলেছিল নাকি, এ ছেলে অনেক রকমের আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। অনেক অদ্ভুত শক্তির খেল দেখাবে ভবিষ্যতে। সে সব শক্তি এমনই অস্বাভাবিক যে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। এককথায় বিরাট ভবিষ্যৎ নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছে ছাগুলে মুখের কদাকার কালো এই শিশু।
সাবিত্রীর মতন মেয়ের মুখেই নাকি এমন কথা মানায়। একা একাই তো থেকেছে এতটা কাল। পাহাড়ে পাহাড়ে যখন ঝড় আর বজ্রবিদ্যুতের প্রলয়লীলা চলেছে, তখন একা একা টহল দিয়েছে সেই সব জায়গায়। একেবারেই পাহাড়ি মেয়ে। গেছো মেয়ের মতো এন্তার পড়ে গেছে বাপের জমানো পুঁথির পাহাড়, যে সব পুঁথি বাপ জোগাড় করেছে মহাকাল শহরের জায়গায় জায়গায় রেখে দেওয়া পুঁথি সঞ্চয় থেকে। কালজীর্ণ সেইসব পুঁথি নাকি রীতিমতন দুর্গন্ধময়। দুশো বছরের প্রাচীন পুঁথি আর কেতাবে বোঁটকা গন্ধ তো থাকবেই। দুশো বছর তো কম নয়। সময়ের আরকে জীর্ণ প্রতিটা পুঁথিই, সেই সঙ্গে লেগেছে পুঁথি পোকা। এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে পাতার পর পাতা। সাবিত্রী মেয়েটা এইসব দুর্গন্ধময় পুঁথিই দু-চোখ দিয়ে গিলে গেছে বছরের পর বছর। স্কুল পাঠশালায় কক্ষনো না গিয়েও। কিন্তু মহাকাল শহরের আনাচেকানাচে জমে থাকা বিক্ষিপ্ত ছন্নছাড়া অতীত কাহিনি আর বিবিধ কিংবদন্তি জমিয়ে রেখেছে মনের খুপরিতে খুপরিতে। স্মৃতিশক্তি তার অসাধারণ।
একটেরে সেকেলে এই খামার বাড়িতে কিন্তু কেউ আসত না। এড়িয়ে যেত। ভয়ে। কারণ একটাই। থুত্থুরে বুড়ো বাপ নাকি নানারকমের জাদুবিদ্যা জানে। অনেক কুহকী মন্ত্র তার কণ্ঠস্থ। অলৌকিক শক্তিদের আবাহন করতে পারে চক্ষের নিমেষে। ভূত প্রেতদত্যি দানব পিশাচ ডাইনি তার পায়ের ভৃত্য। তাকে ঘাঁটালে নাকি রক্ষে নেই। সংক্ষেপে যে বিদ্যেকে বলা হয় কালো বিদ্যে, ব্ল্যাক ম্যাজিক, ক্ষেত্রপাল নাকি এই সব কুহকী বিদ্যায় বিষম বিদ্বান অনেক বছরের সাধনায়, পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে। সাবিত্রী যখন বারো বছরের মেয়ে, তখন তার মা মারা যায় ভয়ানকভাবে। মৃত্যুর কারণ কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু মড়া মানুষের চোখ মুখে এমন ভয়ানক আতঙ্ক যে প্রকট হয়ে থাকতে পারে, এমনটাও কেউ কখনও দেখেনি। তারপর থেকেই ক্ষেত্রপালকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায় না, তার বিজন খামার বাড়ির ছায়া মাড়াতেও কেউ চায় না। সাবিত্রীর বয়স যখন বারো, তখনও কেউ এ জায়গায় ধারকাছ দিয়েও যেতে চায়নি। একা একাই থেকেছে সাবিত্রী, দিন কাটিয়েছে বিবিধ জাদুকরী প্রভাবের মধ্যে, ফলে দিনে রাতে অনেক রকম অকল্পনীয় স্বপ্ন দেখে গেছে, অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা খেলেছে, সেই সব নিয়ে মেতে থেকেছে, অশরীরী বিভীষিকা আর শরীরী আতঙ্কদের সঙ্গে নাকি বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়েছে, অন্যদের কাছে যা রক্ত জমানো, সাবিত্রীর কাছে তা শিক্ষাপ্রদ মজার ব্যাপার হয়ে গেছে। সাংসারিক নিয়মকানুনের ধার ধারেনি। গোটা বাড়িটা যে নোংরার ডিপো হয়ে গেছে, তা নিয়েও কখনও মাথা ঘামায়নি। পুরুষ তো চিরকাল নিজের চারদিকে আবর্জনা জমায়, নারী সে সবের নিত্য মার্জনা করে চলে। সংসারের শ্রী তো মেয়েদের জন্যেই। ক্ষেত্রপালের খামার বাড়িতে কিন্তু এই শ্ৰী ছিল না মোটেই। বিশ্রী, বিকট, দুর্গন্ধময়। এই সবের মধ্যেই বড় হয়েছে সাবিত্রী। তারপর একদিন মা হয়েছে। কীভাবে, কার ঔরসে। তা কিন্তু অজানা রহস্য থেকে গেছে।
ক্ষিতি যে রাতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সে রাতে কিন্তু রক্তজল করা চিৎকারের পর চিৎকার শোনা গেছিল প্রসূতি বাড়ির দিক থেকে— পাহাড় পর্বতের সমস্ত আওয়াজ ছাপিয়ে ওঠা সেই লোমহর্ষক শব্দলহরী শুনতে পেয়েছিল তল্লাটের সক্কলে। সেই সঙ্গে রাজ্যের কুকুরদের গজরানি। অথচ কোনও দাই হাজির থাকেনি সাবিত্রীর সন্তানকে ধরায় আনার জন্যে। সাতদিন কেটে যাওয়ার আগে প্রতিবেশীরাও জানতে পারেনি মা হয়ে গেছে সাবিত্রী, তারপর একদিন ক্ষিতির দাদু পাহাড়ি নিজেই হাটে গিয়ে দিয়েছিল খবরটা। সেই সময়ে একটা সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা গেছিল মানুষটার মধ্যে। পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল এমনিতে খুব দামাল মানুষ। বুকের পাটা আছে। এই বয়সেও ভয়ডর কাকে বলে জানে না। কিন্তু নাতি আগমনের সংবাদ দিতে গিয়ে গলা কাঁপিয়ে ফেলেছিল। চোখে মুখে যে ধরনের ত্রাস বিস্ফোরণ দেখা গেছিল, সেরকমটা তার মতন বেপরোয়া মানুষের ক্ষেত্রে আশা করা যায় না। কথাবার্তাও মনে হয়েছিল কেমন যেন খাপছাড়া গোলমেলে। এ সব সত্ত্বেও মেয়ের কৃতিত্ব নিয়ে মস্ত একটা কাজ করেছে। সেই নাতির বাপের বিষয় যেটুকু তখন বলেছিল, তা পাড়াপড়শিদের মনের মধ্যে এমনই দাগ কেটে বসে গেছিল যে মুছে যায়নি অনেক বছর পরেও।
“লোকে কী বলে না বলে, আমি তার ধার ধারি না। হ্যাঁ, সাবিত্রীর ছেলেকে দেখতে হয়েছে অবিকল তার বাপের মতন। ধারণাতেও আনতে পারবে না সেই চেহারা। সাবিত্রী অনেক পুঁথিটুঁথি পড়েছিল, তাই এমন ছেলের জন্ম দিতে পেরেছে। পেটের মধ্যে এমন বাচ্ছার বীজ পুঁতে নিয়েছে যা তোমরা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। হ্যাঁ, বর পেয়েছে বটে একখানা… পুরুত বিয়ে দেয়নি তো হয়েছেটা কী? বাচ্ছা তো এসে গেছে পেটে। একদিন আসবে যেদিন এই বাচ্ছাই তার বাপের নাম বড়াই করে বলে যাবে… চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলবে… সেইদিন তোমাদের গায়ে কাঁটা দেবে। তল্লাট কাঁপিয়ে ছাড়বে আমার নাতি।
অদ্ভুত এহেন আস্ফালনের পর বেশ কয়েকটা মাস মুখ বুজেই থেকেছে পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল। তারপর একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছিল সবাই। পাহাড়ে চরতে যাওয়া ক্ষেত্রপালের গরু ভেড়ার মধ্যে রক্তশূন্যতা দেখা যাচ্ছে। তাদের গলার কাছে দাঁত ফোটানোর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। অথচ এ অঞ্চলে এতদিন কোনও রক্তপায়ী প্রাণী তো ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের একটু আধটু খবরটবর রাখত, তারা অবশ্য বলেছিল ভারিক্কি গলায় “নিশ্চয় রক্তখেকো পাহাড়ি পিঁপড়ে। পৃথিবীতে মানুষ আসার আগে এসেছিল পিঁপড়েরা। আট কোটি বছর ধরে আছে। এখন রক্ত খেতে শিখেছে।”
কথাটা শুনে প্রথমটায় খুব হাসাহাসি হয়েছিল। রক্তপায়ী ড্রাকুলার গাঁজাখুরি গল্প যারা শুনেছে, তারা কিন্তু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলেছিল হতেও পারে, নাও হতে পারে। আট কোটি বছর ধরে যারা পৃথিবীতে দাপিয়ে আছে, তারা হঠাৎ এই পাহাড়ের গরু ভেড়ার রক্ত খেতে শিখে যায়, এটা কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। ভ্যামপায়ার বাদুড়ের গল্প শোনা যায়, কিন্তু ভ্যাম্পায়ার পিঁপড়ের গল্প তো কখনও শুনিনি।
তারপর একদিন খটকা লেগেছিল বেশ কয়েকজনের অদ্ভুত একটা পাহাড়ি ব্যাপার দেখে দাঁত বসানোর চিহ্ন দেখা গেছে নাকি পাহাড়ি আর সাবিত্রীর গলাতেও। রক্তচোষা পিঁপড়েদেরই যদি অকস্মাৎ আবির্ভাব ঘটে থাকে এই পাহাড়ি জায়গাটায়, তাহলে কি তারা এখন থেকে মানুষের রক্ত খাওয়ায় শুরু করেছে? সেই মানুষদের অজ্ঞাতসারে। ভয়ানক ব্যাপার তো?
পাহাড়ি ক্ষেত্র পাল কিন্তু এই নিয়ে মুখ খোলেনি। কেমন যেন হেসেছে। হাসিটা বড় অদ্ভুত। সেই সঙ্গে চোখের চাহনিটাও যেন কেমনতর।
বাচ্ছার জন্ম দেওয়ার পর সাবিত্রীর খোঁজখবর নিতে আসত একজনই। গাঁয়ের মোড়ল চণ্ড ক্ষেত্রপাল। বুড়ো থুত্থুড়ে। পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে বলেই লাঠি ঠুকঠাক করে আসত সাবিত্রী আর তার বাচ্ছার সংবাদ নিতে। যা গ্রাম দস্তুর। সেই সঙ্গে আসত গ্রামের রয়টার মহিলা শিবাণী। ক্ষেত্ৰপালের গরু-ভেড়ার গলায় দাঁতের নজরে এসেছিল এই মহিলারই। তখন অবশ্য তার মনে হয়েছিল, নতুন ধরনের কোনও ছত্রাকের কাণ্ড। পাহাড়ে কত রকমের ফাঙ্গাস তো দেখা যায়। এটাও নিশ্চয় তাই। রক্তচোষা পিঁপড়েদের গল্প অথবা গুল্প শোনা গেছিল পরে।
তারপরেই পটাপট অক্কা পেতে থেকেছে পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের গরু ভেড়া ছাগল। রক্তশূন্যতার জন্যে নিশ্চয়। কিন্তু এতদিন তো এই আপদ এ তল্লাটে হানা দেয়নি। তাও তো শুধু পাহাড়ি ক্ষেত্ৰপালের গরু মোষ ছাগলের ক্ষেত্রে! অবাক কাণ্ড বটে।
আর ঠিক এই সময়েই একই রকমের দাঁত বসানোর দাগ দেখা গেল পাহাড়ি আর সাবিত্রীর গলায়। দেখে এলো গ্রাম রয়টার শিবানী ক্ষেত্রপাল।
চমকপ্রদ সংবাদ! গ্রাম গরম করে দেওয়ার মতন খবর।
মাস কয়েক পরেই পাহাড়-টাহাড়ে টহল দেওয়া শুরু করে দিয়েছিল সাবিত্রী, বেটপ লম্বা হাতে বাচ্ছাকে বুকের কাছে নিয়ে। পুত্র দর্শনের পর গ্রাম্য গুজব স্তিমিত হয়েছিল অনেকটা, বাচ্ছার দ্রুত বৃদ্ধি নিয়েও কেউ খুব একটা মুখ খোলেনি। যেন বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে শশিকলার মতন। সেই সঙ্গে দেখিয়ে গেছে পেশি শক্তি। গলার স্বরও বেশ বিদঘুটে, কাঁদলেই মনে হয় যেন কড়কড় করে বাজ পড়ছে। কোনও শিশুর ক্ষেত্রে এ রকমটা তো দেখা যায় না। তারপর যখন সাত মাস বয়সেই সেই শিশু কারও সাহায্য না নিয়ে গটগট করে হাঁটতে শুরু করেছে, তখন চক্ষুস্থির হয়েছে সকলেরই। আজব ব্যাপার নয় কী? এ যে এক চলমান বিস্ময়!
এই ঘটনার কিছুদিন পরে এক শিবরাত্রির রাতে বিশালকায় চৌকিদার পাহাড়ের চুড়োর ওপর দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছিল। ওই পাহাড়েই তো আছে মস্ত সেই গোল পাথরের টেবিল… বিরাট চাকার মতন বেদি… দেখতে অনেকটা সূর্য ঘড়ির মতন, কিন্তু আকারে অতি বিরাট, সুপ্রাচীন অস্থির স্তূপ জমে আছে সেখানে আজও। অমন একটা জায়গা থেকেই অকস্মাৎ ঠিকরে এসেছিল দাউ দাউ আগুনের আভা। এ আবার কী ব্যাপার? মান্ধাতার আমলে হাড়গোড়ের ওপর এত আগুন এল কোত্থেকে?
টনক নড়েছিল অনেকেরই আর একটা খবর শুনে।
আগুন লেলিহান হয়ে ওঠার ঘণ্টা খানেক আগেই নাকি দুর্দান্ত মজবুত বালক ক্ষিতি ক্ষেত্রপালকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে দেখা গেছে পাহাড় বেয়ে চুড়োর দিকে, পেছনে প্রায় ছুটতে ছুটতে গেছে তার কুমারী মা।
তাজ্জব ব্যাপার তো?
শুধু তাই নয়। দু’জনের পরনেই তখন নাকি ছিল না কোনও পরিধেয়? ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের কোমরে ছিল শুধু একটা বেল্টের মন জিনিস। আর কিছু না। এক্কেবারে উদোম। সেই তাকে যে দেখেছিল ক্ষিতিকে ল্যাংটা অবস্থায়।
এর পর থেকেই আর জীবিত অবস্থায় দেখা যায়নি। কারণটা অনুমান করে গেছিল পরে। ১৯২৮ সালে। যখন থেকে শুরু হয়েছিল একটার পর একটা ভয়ানক ব্যাপার— এই পাহাড়ি তল্লাটে।
যাই হোক, মাস কয়েক পরেই আর একটা দারুণ গুজবে নড়ে উঠেছিল মহাকাল শহর।
পুঁচকে ক্ষিতি নাকি মাত্র এগারো মাস বয়সেই দিব্বি কথা বলছে, লম্বা লম্বা বচন ঝাড়ছে। গুজবটা চাঞ্চল্যকর অনেক কারণে। যে উচ্চারণে কথা বলছে শিশু ক্ষিতি, সে উচ্চারণে মহাকাল অঞ্চলের কেউ তো কশ্মিনকালেও কথা বলেনি, এখনও বলে না। তা ছাড়া, এ বয়েসে সবাই আধো আধো বুলি ছাড়ে, অদ্ভুত শিশু ক্ষিতি কিন্তু অনাড়ষ্ট স্বরে স্পষ্টাস্পষ্টি কথা বলে যাচ্ছে। লম্বা লম্বা বচন ঝাড়ছে। এবং সেই সব বচন কস্মিনকালেও মহাকাল শহরের কেউ কখনও শোনেনি। অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়, অদ্ভুততর বাচনভঙ্গি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো না। তিন-চার বছরেও কোনও শিশু এমন এলেম তো দেখা যায় না। তাই বলে যে শিশু ক্ষিতি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, তা নয়। ভাবে অনেক কথা বলে কম। যেটুকু বলে, তার মধ্যেই থাকে চমক। বাচনভঙ্গি আর বাক্যবিন্যাসও এক্কেবারে অন্য রকম। শব্দ ঝঙ্কার অদ্ভুতভাবে সঙ্কৃত হচ্ছে যেন ভেতরকার অদ্ভুত কোনও স্বরযন্ত্র থেকে। কথা যখন বলে, তখন মুখ দেখে মনে হয়, বেশ পেকেছে, বয়স যেন আশ্চর্যরকম বেশি। মা আর দাদুর মতন তার চিবুক একটু ভেতর দিকে ঢোকানো বটে, কিন্তু নাকখানা বিলক্ষণ শানানো যেন বিজাতীয় কোনও বাজপাখির নাক অস্বাভাবিক বড় চোখ দুটোতেও অদ্ভুত একটা বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক। ঠোঁট দুটো কিন্তু বিদঘুটে, ছাগলের ঠোঁটের মতন। মানুষের মতন নয় মোটেই, ক্রুর কুটিল, পাশবিক। চামড়ার হলুদ আভা। লোমকূপের মতন ছিদ্রময়, কিন্তু লোম নেই। কানদুটো বিচিত্র। বেশ লম্বাটে। গাধার কানের মতন।
এমন একটা চিড়িয়াকে কেউ স্নেহের চোখে দেখতে পারেনি, হোক না বালক। এড়িয়ে চলেছে, যেমন এড়িয়ে চলেছে তার গুণধরী মা আর গুণধর দাদুকে।
সেইসঙ্গে কিন্তু মাথাচড়া দিয়েছে মহাকাল শহরের অতীত কথা। একদা নাকি বিবিধ ত্রুর, কুটিল জাদু ক্রিয়া আর পৈশাচিক কাণ্ডকারখানার পীঠস্থান ছিল এই মহাকাল তল্লাটটা। তখন ওই পাহাড়চুড়োর স্তম্ভবলয়ের মধ্যে রাখা প্রস্তর বেদিতে দাঁড়িয়ে আতীক্ষ্ন স্বরে আবাহন করা হত অন্ধকারের পুঞ্জীভূত আতঙ্ককে অকল্পনীয় রুধির জমানো অসীম শক্তির অধীশ্বরকে দু-হাতে প্রাচীন পুঁথি খুলে ধরে রেখে তমিস্রার পূজারী বন্দনা করে যেত কল্পনাতীত শক্তি পুঞ্জকে…
এর পর থেকেই দেখা গেল, বালক ক্ষিতিকে এড়িয়ে চলছে তল্লাটের সমস্ত সারমেয়। যে নাকি বিবিধ শক্তি প্রয়োগ করে হরণ করে নিয়েছে বেচারিদের গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর ক্ষমতাও।
শব্দহরণ ক্ষমতা নাকি? স্বরযন্ত্রের বিকৃতি? অপ্রাকৃত সাইলেন্সার?
৩
পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল কিন্তু ইতিমধ্যে চুটিয়ে চালিয়ে গেল একটা ব্যাপার। হাট থেকে এন্তার কিনে গেল গরু, ছাগল, ভেড়া। অথচ, গোয়াল আর ছাগল ঘরে খুব একটা গুঁতোগুঁতি হতে দেখা গেল না। একই সঙ্গে চালিয়ে গেল গাছ কাটা। গুঁড়ি থেকে তক্তা বানিয়ে মেরামত করে গেল বাড়ির যে-যে দিকগুলো খুব একটা কাজে লাগেনি এতদিন, সেই সেই দিকগুলো। বাড়ির সাইজ এমনিতেই ছিল বেশ বড়। মাথায় ঢালু চাল, পাহাড় অঞ্চলের বাড়ি যেমন হয়। পেছন দিকটা একেবারেই গেঁথে বসে গেছিল পাহাড়ের গায়ে… পাহাড় তো ওইখান থেকেই ঢালু অবস্থায় উঠে গেছে। পাহাড়ের কোলের বাড়ি বলতে যা বোঝায়, তাই। পাহাড়ি এতদিন এহেন পাহাড়ি নিকেতন নিয়ে মাথা ঘামায়নি। নাতি হওয়ায় দেখা গেল উদ্যোগী হয়েছে ভীষণভাবে। অথচ অত মেহনতের দরকার ছিল না। নাতিকে নিয়ে নিজের আর মেয়ের পক্ষে অতবড় কটেজ প্যাটার্নের নিকেতন ছিল যথেষ্ট।
বুড়োর গায়ে যেন হাতির শক্তি এসে গেছিল সেই সময়ে। তাক লেগে গেছিল পাড়াপড়শিদের। বাইরে ছুতোর না এনে ছুতোরের কাজ করে গেছিল একাই করাত, বাটালি, হাতুড়ি, পেরেক নিয়ে। কী উদ্যম, কী উদ্যম! বুড়ো বয়সের নাতি তো, ফুর্তিতে যেন ফেটে ফেটে পড়েছে অষ্টপ্রহর। লোকে হেসেছে, কিন্তু পাহাড়ি তাতে টলেনি। দেখে মনে হয়েছিল যেন হাজারো হাতির বল এসেছে আধবুড়োর গায়ে। বিপুল উৎসাহ! হাতে হাতে জোগান দিয়ে গেছে গুণবতী কন্যা, যে নাকি বিয়ে না করেই পোয়াতি হয়ে গেছে অম্লানবদনে। মেয়ে বটে একখানা! যেমন মেয়ে, তেমনি বাপ।
হাসি টিটকারিতে কান না দিয়ে কিন্তু ছুতোরগিরি চালিয়ে গেছে পাহাড়ি। বেশ মেপেজুপে। কোনদিকে কতখানি বাড়াতে হবে কাষ্ঠনিকেতন, সে হিসেব আর নকশা যেন মাথার মধ্যে নিখুঁত নিয়মে ঘুরপাক খেয়ে গেছে। কাজে হাত দিয়েছিল নাতি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বিরাম দেয়নি একদিনের জন্যেও। যন্ত্রপাতি রাখার ঘরটাকে বেশ মজবুত করে বানানোর পর দরজায় লাগিয়ে দিয়েছিল ভারী একটা তালা। তারপরেই হাত লাগিয়েছিল ওপর তলায়, যে তলাটা এতদিন কাজে লাগছিল না বলে পড়েছিল অনাদরে অবহেলায়। দেখিয়ে দিয়েছিল কারিগরি দক্ষতা। পাক্কা ছুতোরগিরির চাক্ষুস প্রমাণ। তখনই দেখা গেছিল উৎকট একটা বাতিক। সব ক-টা জানলা বন্ধ করে দিয়েছিল তক্তা মেরে। পাড়াপড়শিরা অবাক হয়েছিল এই দেখে। জানলা বন্ধ করার কোনও দরকার তো ছিল না।
এর চাইতেও উদ্ভট একটা কাণ্ড ভাবিয়ে তুলেছিল পড়শিদের। এমনই একটা কাণ্ড বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যায় না। নীচের তলায় বানিয়ে নিয়েছিল বাড়তি একখানা ঘর শুধুমাত্র নবাগত নাতির জন্যে। সে ঘরে পড়শিদের ঢুকতে দেওয়া হলেও পা ফেলতে দেওয়া হয়নি কাউকেই ওপর তলার ঘরখানায় যে ঘরের সব জানলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বেশ টাইট করে লাগানো তক্তা দিয়ে। এই ঘরখানার দেওয়ালে দেওয়াল তাক বানিয়ে সেই সব তাক ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রাচীন পুঁথি আর কেতাব দিয়ে— যে সব পুঁথি আর কেতাব এতদিন হেলায় গড়াগড়ি গেছিল বাড়িময়। নাতির নাকি এই সব পুঁথি দরকার হবে! খুদে ক্ষিতির বয়স যখন মোটে এক বছর, সাত মাস— ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তখনই তার দৈহিক বাড়বৃদ্ধি চক্ষুস্থির করে ছেড়েছিল প্রত্যেকেরই। ভয়ও পেয়েছিল। এরকম বাড় তো দেখা যায় না। এই বয়েসেই দেখতে হয়েছে অবিকল চার বছরের খোকার মতন। কথাও বলে গেছে গড় গড় করে আধো আধো বুলিতে নয়। কথার মধ্যে ছিটকে ছিটকে গেছে অবিশ্বাস্য বুদ্ধিমত্তা। পরমানন্দ ছুটে ছুটে বেড়াত লাগোয়া খেতের মাঠে, নয়তো দূরের পাহাড়ে। সঙ্গে থাকত কিন্তু মা জননী। অথবা মা জননী যেখানে, ক্ষিতি থাকত সেখানে। এর অন্যথা হতে কখনও দেখা যায়নি। বাড়িতে যতক্ষণ থাকত, পুরো সময়টা কাটাত দাদুর সঙ্গে পুঁথিপাঠ নিয়ে। দাদুও অসীম ধৈর্যে খুদে নাতিকে বুঝিয়ে যেত বিবিধ পুঁথির দুর্বোধ্য বিষয়গুলো। নাতি একমনে দেখে যেত পাতায় পাতায় ছড়ানো উদ্ভট বিকট ছবির পর ছবি, নকশার পর নকশা।
তদ্দিনে সমাপ্ত হয়ে গেছিল পুরোনো বাড়িকে নতুন নকশায় তৈরি পর্ব। এতদিন যারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে গেছে নতুন ছাঁদে বাড়ি তৈরি আর মেরামতি, তাদের কিন্তু খটকা লেগেছিল একটা ব্যাপারে। ওপর তলার একটা জানলাকে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটা দরজা বসাতে গেল কেন পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল? দরজাটাও তো রীতিমতন মজবুত, একখানা আস্ত কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো। নড়ায় টলায় কার সাধ্যি।
এই জানলাটা ছিল কিন্তু বাড়ির পেছনে দিকে। পাহাড় মুখো অবস্থায়। জানলা দিয়ে পাহাড় দেখা যেতে দিব্বি। এখন সেখানে বসে গেল একটা দরজা। শুধু তাই নয়। পাহাড়মুখো পাহাড় লাগোয়া সেই দরজার সামনে থেকে একটা কাঠের সিঁড়িও নামিয়ে দেওয়া হল পাহাড় পর্যন্ত। অবাক ব্যাপারে তো।
সেই সঙ্গে দেখা গেল, যন্ত্রপাতি রাখার যে ঘরে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল নাতি, যে ঘরে জানলা নেই একটাও, যে ঘর এতদিন কাজে লাগেনি বলে পড়েই ছিল, সেই ঘর এখন খাঁ খাঁ করছে। দরজা খোলা থাকছে। প্রতিবেশী লাল সিং একদিন উঁকি দিয়েছিল সেই ঘরে পাহাড় থেকে পাড়ায় ফেরবার সময়ে। সিঁটিয়ে গেছিল বিকট দুর্গন্ধে। এমন ভয়াবহ অপার্থিব গন্ধ নাকি জীবনে শুঁকতে হয়নি লাল সিং মশায়কে। তবে খুব একটা বিচলিত হয়নি। পাহাড়-টাহাড়ে অনেক রকম মড়াপচা গন্ধ পাওয়া যায়। এ গন্ধ যদিও সেই সব গন্ধের চেয়েও অসহ্য, তাহলেও অত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। গ্রাম পাহাড়ের মানুষদের নাকে এরকম কত দুর্গন্ধই তো ভেসে আসে।
পরের মাসে নজর কাড়ার মতন চাঞ্চল্যকর কিছু দেখা না গেলেও প্রত্যেকেই বিচলিত হয়েছে একটা ব্যাপারে। একটু একটু করে বেড়েই গেছিল পাহাড় পর্বতের রকমারি আওয়াজ। ১৯১৫ সালে মহাকাল পুজোর সময়ে গোটা তল্লাট থিরথির কেঁপে গেছিল, পায়ের তলার মাটি দুলে দুলে উঠেছিল, তার ঠিক পরেই পাহাড় পুজোর সময়ে একটা গুমগুম পাতাল নিনাদ শোনা গেছিল— একই সঙ্গে চৌকিদার পাহাড়ে চুড়োয় ঝলকে ভলকে আগুনের শিখা আকাশের দিকে ঠিকরে ঠিকরে গেছিল।
এই সময়টা থেকেই দেখা গেছিল কিম্ভূত বালক ক্ষিতি কেমন জানি অলৌকিকভাবে চড় চড় করে মাথায় বেড়ে চলেছে। চার বছর বয়সেই মনে হচ্ছে যেন দশ বছরের ছেলে। পুঁথির পর পুঁথি পড়ে যাচ্ছে অসীম নিষ্ঠা নিয়ে। তাজ্জব ব্যাপার তো! এইটুকু ছেলের পক্ষে পড়াশুনোয় এতখানি মন দেওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় কী? সেইসঙ্গে কথা বলা অনেক কমে গেছে আগের চেয়ে। কম বকে, পড়ে বেশি।
আর ঠিক এই সময়টাতেই দেখা গেছিল, ক্ষিতির ছাগুলে মুখে ফুটে ফুটে উঠছে একটা অপরিসীম নারকীয়তা। হাড় হিম করে দেওয়ার মতন একটা অমানবিক নিষ্ঠুরতা মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে ঠিকরে আসছে উদ্ভট শ্লোক। দুলে দুলে উঠছে যেন মন্ত্রোচ্চারণের তালে তালে, এমন ভাবে যে শ্রোতা মাত্রের রক্ত জল করে ছাড়ছে।
এখন থেকেই তল্লাটের সমস্ত সারমেয় তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। কাছে ঘেঁষতেও সাহস পেত না। দূর থেকে দেখেই ল্যাজ গুটিয়ে চম্পট দিতো বোবা মুখে। ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তর গুজব ডালপালা মেলে ছড়াতে থাকে তখন থেকেই।
আর ঠিক এই সময় থেকেই দেখা গেছিল, কোমরের বেল্টে খাপে গোঁজা ছোরা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় অদ্ভুত বালক ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল। আশ্চর্য ব্যাপার তো!
লোক দেখানোর জন্যে অবশ্যই নয়। মাঝে মধ্যে এই ছোরা পাকা হাতে চালিয়ে গেছে ক্ষিতি, বেকুব কুকুরদের টুঁটি লক্ষ করে। সেই সব কুকুরদের মালিকরা ক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু ক্ষিতির দাদু পাহাড়ির কাছে দরবার করতে আসার সাহস হয়নি।
মাঝে মধ্যে যারা এসেছে ক্ষেত্রপাল ভবনের রহস্য জানবার জন্যে নিছক গ্রাম্য কৌতূহল নিয়ে, তারা কিন্তু দেখেছে, সাবিত্রী একা বসে আছে একতলার উঠোনে, ওপরতলার কাঠের তক্তা দিয়ে মজবুত রহস্য কক্ষ থেকে ভেসে আসছে ধুপধাপ আওয়াজ আর বিকট চিৎকার।
সাবিত্রী কিন্তু মুখে চাবি দিয়ে রেখেছে আগাগোড়া। নাতিকে নিয়ে দাদু ওপরতলায় কী ধরনের জগঝম্প কাণ্ড কারখানা করছে, তার আভাসটুকুও দেয়নি কাউকে। শুধু একদিন ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল একজন যখন হুড়মুড় করে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঠেলা মেরেছিল ভেতর থেকে তালা দেওয়া দরজায়। দুঃসাহসটা যে দেখিয়েছিল, পেশায় সে মুদী। তার মুখেই শোনা গেছে, সে যখন সাবিত্রীর বারণ না শুনে সিঁড়ি বেয়ে তড়বড় করে উঠে যাচ্ছিল, তখন নাকি সাবিত্রীর মুখ ছাইয়ের মতন ফ্যাকাশে মেরে গেছিল।
সিঁড়ির মাথায় গিয়ে মুদী শুনেছিল কিন্তু একটা অদ্ভুত আওয়াজ। যেন একটা ঘোড়া লাফাচ্ছে খটাখট শব্দে ঘরের মধ্যে।
খবরটা তল্লাটে ছড়িয়ে যেতেই ভাবনায় পড়েছিল প্রত্যেকেই। ব্যাপারটা কী? দোতলায় খুরওলা প্রাণী লম্ফ দিচ্ছে কেন?
তার চাইতেও চিন্তার বিষয়, আচমকা এ তল্লাট থেকে গরু মোষ ছাগল ভেড়া যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কেন? কেন? কেন?
গুজবের ডালপালা থাকে। ছাগবলি আর মোষবলি দিয়ে নাকি পরমায়ু বাড়িয়ে নেওয়া যায়। সেই রকমই কোনও কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে নাকি ক্ষেত্রপালের কাষ্ঠ ভবনে?
তা ছাড়া, বেশ কিছুদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে আর একটা খাপছাড়া ব্যাপার। এই অঞ্চলের সমস্ত কুকুর ক্ষেত্রপাল ভবনের ধারে কাছেও যেতে চায় না। ল্যাজ গুটিয়ে পালায় দূর থেকেই।
এটা আবার কী ব্যাপার! কুকুররা এত ভয় পাচ্ছে কেন ক্ষেত্রপালদের? নাকি শুধু বালক ক্ষিতিকে?
এরপরেই ১৯১৭ সালে এসে গেল পাহাড়ি লড়াই। পাহাড়ে যাদের নিবাস, বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে, সে সব জায়গায় যুদ্ধ-টুদ্ধ লেগেই থাকে বারোমাস। চোরাচালানের পেছন পেছন চলে আসে রক্তারক্তি। পাহাড়ের মানুষদের কাছে গা সওয়া ব্যাপার।
কিন্তু এই রকম সময়েই তো লড়াকু জোয়ানদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্ত অঞ্চলের গাঁ-গঞ্জে থেকে, হানাদারদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্যে। যারা এসেছিল তাগড়াইদের নিয়ে যেতে, তারাই ওপর মহলে দিয়েছিল ভারী অদ্ভুত একটা সংবাদ।
অদ্ভুতকিম্ভূত কাণ্ডকারখানা চলছে ক্ষেত্রপালের কাষ্ঠ ভবনে। কুকুর পর্যন্ত ডরায় সেই বাড়িকে। সে বাড়ির ছেলেটা নাকি সৃষ্টিছাড়া। ওপরতলায় পশুখুরের ঠকঠকানি শুনতে পাওয়া যায়। ছেলেটাও নাকি কী রকম। হু হু করে বাড়ছে মাথায়। এ বাড়ি তন্ত্রমন্ত্রের জন্যে এককালে কুখ্যাত ছিল। অনেক পৈশাচিক কাণ্ডকারখানার আড়ৎ ছিল। বাড়িময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অতি প্রাচীন পুঁথি আর কেতাব— গুপ্ত মন্ত্র লেখা আছে নাকি সেইসব পুঁথির পাতায় পাতায়। পাহাড়ে পাহাড়েও শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত দানবিক আওয়াজে পর আওয়াজ।
ক্ষিতির বয়স তখন মোটে সাড়ে পাঁচ বছর। দেখায় কিন্তু পনেরো বছরের কিশোরের মতন। অকালপক্ক ছোরার মতন দাড়ি গোঁফ গজিয়ে ফেলেছে চিবুকে গালে। গলার আওয়াজেও চিড় ধরেছে।
খবরটা মুখরোচক বড় শহর থেকে যথা সময়ে এসে গেছিল সংবাদ বুভুক্ষ সাংবাদিকরা ক্যামেরাম্যানদের নিয়ে। এসেই টের পেয়েছিল কিছু একটা বিটকেল ব্যাপার ঘটছে পাণ্ডববর্জিত এই তল্লাটে, নইলে বাতাসে ভাসছে কেন এমন একটা বিশ্রী বিটকেল বোঁটকা দুর্গন্ধ? পাহাড়ের হাওয়া হবে স্বাদু ফুরফুরে, এখানকার হাওয়ায় ভাসছে কেন এমন মড়া পচা গন্ধ?
বিশেষ করে দুর্গন্ধ স্রোত ধেয়ে আসছে চৌকিদার পাহাড়ের চুড়োর দিক থেকে, যেখানে কোন পুরাকালে তৈরি পাথরের থাম আংটির মতন ঘিরে রেখেছে প্রকাণ্ড একটা পাথরের বেদিকে।
৪
মহাকাল শহরটাই তো যুগ যুগ ধরে বিখ্যাত বিবিধ গুপ্ত পুজোঅর্চনার জন্যে। পাহাড়ে পাহাড়ে চিরকার ছিল আছে থাকবে এমনি নানারকম শক্তি আরাধনা। প্রকৃতি পুজোয় অভ্যস্ত পাহাড়ি মানুষরা সুদূর অতীতকাল থেকে এমনতর গভীর গোপন গুপ্ত পুজো অব্যাহত রেখেছে নিজেদের মধ্যে। মহাকাল শহর মাথা উঁচিয়ে রয়েছে এহেন পূজারীদের মনের ভেতর। কিন্তু ইদানীং যে সব ব্যাপার ঘটছে ক্ষিতি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে, সে সব তো কস্মিনকালেও কখনও দেখা যায়নি। কেউ কখনও শোনেনি। এ কোন ভয়ঙ্করের আরাধনা চলছে পর্বত শিখরে, লোমহর্ষক স্তম্ভঘেরা প্রস্তর বেদির ওপরে?
হ্যাঁ, অতীতের প্রথা আজও অব্যাহত আছে এখানকার পাহাড়ি মানুষজনের মধ্যে। বছরে দু-বার অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে আসে চৌকিদার পাহাড় চুড়োয়। ঠিক সেই সেই সময়ে নাকি পাহাড়ে পাহাড়ে গুম গুম করে ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি তুলে যায় অদ্ভুত অব্যাখ্যাত একটা শব্দলহরী। পাহাড়ের বাতাসের স্রোত সহসা যেন উদ্দাম হয়ে আছড়ে আছড়ে পড়তে থাকে দিকে দিকে অথচ তখন আকাশ থাকে নির্মেঘ। এই যে শক্তি প্রচ্ছন্ন রয়েছে, গুপ্ত এই শক্তি সঙ্কেতে জানিয়ে যায় তার উপস্থিতির। আওয়াজ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব। আমি পাহাড়ি শক্তি। আমাকে ঘাঁটাতে যেও না। আমার আশ্রয়ে তোমরা নিরাপদ। আমার প্রলয়ঙ্কর প্রভঞ্চক রূপ কখনও দেখতে চেও না। আমি সৃষ্টির মূলে ছিলাম, সৃষ্টির মধ্যে আছি, সৃষ্টির শেষে থাকব। আমিই মহাকাল। মহা ভয়ঙ্কর।
তা না হয় হল। মহাকাল শহরের সক্কলে, শহর ঘিরে বসবাসকারী সবাই কী জানে না এই সব প্রবাদ কাহিনি? কিন্তু কখনও তো এমন ঘটনা ঘটেনি, যেমন এখনটা ঘটছে? ক্ষেত্রপাল কাষ্ঠভবনের দোতলায় কেউ যখন থাকে না, তখনও সেখানে দুপদাপ খড়মড় খটমট আওয়াজ শোনা যায় কেন? এমন উল্লম্ফন কে বা কারা চালিয়ে যাচ্ছে রুদ্ধকপাট কাষ্ঠ কক্ষের ভেতরে? শব্দ স্রোত প্রথম দিকে ছিল মৃদু, ক্রমশ তা প্রখর উগ্র কর্কশ কঠিন হয়ে চলেছে। কোন চরণ তলে জাগ্রত হচ্ছে এহেন শোণিত সঞ্চালক নৃত্যছন্দ?
১৯২৩ সালে ক্ষিতি যখন দশ বছর বয়সের বালক হয়েও দেখিয়ে গেল প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সমস্ত লক্ষণ মন, কণ্ঠস্বর, শরীরের গঠন আর মুখভর্তি দাড়ি গোঁফের মধ্যে। ঠিক সেই সময়ে ছুতোরগিরির দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হয়ে গেল অতি পুরোনো সেই বাড়িময়। ফেলে দেওয়া কাঠকুঠো, ভাঙা তক্তা আর ওপর তলাটাকে পুরোপুরি তক্তামারা অবস্থায় দেখে পড়শিরা বুঝে গেল, দাদু আর নাতি দু’জনে মিলে উড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত পার্টিশন, হয়তো ভেঙে ফেলেছে দোতলার ঘরের মেঝেটাও। একতলার মেঝে আর দোতলার ছাদের মধ্যে হাঁ-হাঁ করছে একটাই মস্ত প্রকোষ্ঠ। ছাদ উঁচু বিরাট একটা হলঘর।
এই ঘটনার ঠিক পরেই বসন্ত ঋতু যখন নৃত্য করতে এল পাহাড়ে পাহাড়ে তখন দেখা গেল আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার। পাহাড়ের খাঁজে-খাঁজে জমে থাকা জলা জায়গা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে রক্তচোষা কালো মাছি— গরুছাগলের গায়ে বসছে ঝাঁকে ঝাঁকে, চুষে চুষে খেয়ে যাচ্ছে তাদের রক্ত। গেরস্তদের রুদ্ধ জানলায় হানা দিচ্ছে নিশুতি রাতে, অদ্ভুত একটা রক্ত জল করা গোঙানির মতন আওয়াজ ছেড়ে যেন বলতে চাইছে— ‘চাই, চাই, আরও রক্ত চাই!’
বুড়ো পাহাড়ি কিন্তু বড় উল্লসিত হয়েছিল বিদঘুটে এই ব্যাপারটার পর থেকেই। প্রায় নেচে নেচে বলে গেছে গাছতলায় রকের আড্ডায়— “এতটাই তো চাইছিলাম। সময় যে হয়েছে, তার জানান দিয়ে যাচ্ছে এরা। এবার নিশ্চয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমার প্রাণপাখিকে। গেলেই বাঁচি, অঙ্কটা তাহলে মিলে যাবে। আমার যাওয়ার পরেই বুঝবে কত ধানে কত চাল।”
১৯২৪ সালে একটা পাহাড়ি উৎসবের রাতে জরুরি তলব দেওয়া হয়েছিল মহাকাল শহরের একমাত্র রোগ চিকিৎসককে। ডেকে এনেছিল রহস্যময় বালক যুবক ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল নিজে। দেখা গেছিল, বৃদ্ধ পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের মরণের আর বেশি দেরি নেই। হার্টের অবস্থা শোচনীয়। শ্বাসপ্রশ্বাস অতিক্ষীণ। খাটের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে শ্বেতিমুখে কন্যা সাবিত্রী আর বিদঘুটে কলেবরের নাতি ক্ষিতি। আর একটা আওয়াজ খটকা লাগিয়েছিল প্রত্যেকের ভেতরে। দূর পাহাড় থেকে ভেসে আসছে যেন তালে তালে ডানা ঝাপটানির আওয়াজ। সেই সঙ্গে যেন কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে যাচ্ছে তালে তাল মিলিয়ে রাতের পাখিদের চেঁচামেচি, ঝাঁকে ঝাঁকে রক্তখেকো কালো মাছিরা ভন ভন করে যাচ্ছে মৃত্যুপথের যাত্রী বৃদ্ধ পাহাড়ির নাক মুখ ঘিরে। পুরো ব্যাপারটা এমনই অলৌকিক যে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল বহুদর্শী বৃদ্ধ ডাক্তারবাবুর, মনে হয়েছিল, গোটা তল্লাটটা যেন অকস্মাৎ প্রাণময় হয়ে উঠেছে। পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের প্রাণবিয়োগের মুহূর্তে।
রাত একটার সময়ে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল পাহাড়ি। ঘড় ঘড় আওয়াজে কয়েকটা শেষ কথা বলে গেছিল নাতিকে।
“ক্ষিতি, ওরে ও ক্ষিতি, আরও আরও জায়গা পেয়ে যাবি খুব শীগগিরই… বেড়েছিস চড় চড় করে… আরও বাড়বি এবার থেকে… নইলে কাজটা হবে কী করে… সে যে তৈরি তোকে গড়ে তোলার জন্য… পাহাড় অপদেবতার ফটক এবার খুলতে হবে তো তোকেই… মন্ত্র পড়ে… লম্বা মন্ত্র… অখণ্ড সংস্করণের ৭৫১ পৃষ্ঠায় পেয়ে যাবি সেই মন্ত্র… পড়লেই আগুন লাগবে পাতাল কারাগারে, পাহাড়ে পাহাড়ে শুনবি কত রকমের আওয়াজ… চৌচির হয়ে যাওয়ার শব্দব্রহ্ম… কেউ আর তাকে রুখতে পারবে না… দূর আকাশের আগুন তাকে ছাই করতে পারবে না…
নির্ঘাৎ উন্মাদ হয়ে গেছিল বৃদ্ধ পাহাড়ি মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেয়ে। প্রলাপ বকে গেছে অনর্গল। অর্থহীন বকুনি। বিরতি দিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে। সেই ফাঁকে উদ্দাম হয়ে গেছিল বাইরে জমায়েত কালো মাছিদের বাহিনী। কালান্তক সেই কৃষ্ণমক্ষিদের সঙ্গে নিশ্চয় একটা যোগসূত্র ছিল পাহাড়ি এক কৃষ্ণশক্তির। নিছক মক্ষিকা গুঞ্জন তো নয়, যেন এক অশুভ প্রলয়ঙ্করকে আবাহনের রুধির নাচানো নিরতিসীম নিষ্ঠুর নিনাদ। কেননা, পাহাড়ির নিনাদের ছন্দে ছন্দে যেন উঠছিল নামছিল কল্পনাতীত সেই মক্ষিকাগুঞ্জন… অথবা মক্ষিকা আবাহন… অথবা অশ্রুতপূর্ব এক করতালি নির্মোঘ…
পাহাড়ি কিন্তু মরণখাদের কিনারায় গিয়েও বকে গেছিল একটানা সোঁ-সোঁ আওয়াজের মধ্যে দিয়ে— “ক্ষিতি, নিয়ম করে রোজ ওকে খাবারের জোগান দিয়ে যাবি… বড় উপোসী ছিল যে অ্যাদ্দিন… কিন্তু সাইজে খুব যেন বেড়ে না যায়… বাড় যেন হুড়মুড় করে না হয়… জায়গায় কুলোবেনা… ফাটিয়ে গুঁড়িয়ে দেবে… তখন আর কোনও কাজ হবে না… ওপার থেকে যারা আসবে, তারাই শুধু ওর বাড়বাড়ন্তর জোগান দিয়ে যেতে পারে… জায়গার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা শুধু তাদেরই আছে… তারা যে চায় ফিরে আসতে…
বকুনির মাঝে মাঝে এসেছে ধুঁকুনি… গলা বুঁজে এসেছি ঘড় ঘড় আওয়াজ শোনা গেছে… দম আটকে আটকে এসেছে… কিন্তু কী এক মরণান্তক দুর্জয় শক্তি কণ্ঠে অধিষ্ঠান নিয়ে যেন অব্যাহত রেখেছে বচনমালা। তালে তাল মিলিয়ে বাইরে জমায়েত ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মাছিরা যেন আর্তনাদ করে উঠেছে। নিঃসীম আতঙ্কে ককিয়ে উঠেছিল পাহাড়িকন্যা সাবিত্রী। ঘণ্টাখানেক ধরে চলেছে মক্ষিকা কলরবের এহেন অনৈসর্গিক উত্থান পতন। যেন ব্যান্ড বাজছে মহাপ্রস্থানের সময়ে। পার্থিব কোনও ভাষা দিয়ে অপার্থিব সেই আওয়াজের বিন্দুমাত্র বর্ণনা সম্ভবপর নয়। ঝাড়া একটি ঘণ্টা ধরে চলেছে এহেন ঐকতান… এক অনৈসর্গিক রুধির নাচানো উত্তাল কাড়ানাকাড়া… তারপর একটা সময়ে একটু একটু করে বুজে এসেছে পাহাড়ির মৃত্যুমন্থর কণ্ঠস্বর… সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর চোখের তারা নির্ভাষ হয়ে যাওয়ার পর… বদ্যিমশায় স্বহস্তে ধীরে ধীরে। কারণও আছে… দুই চক্ষু গোলকের সেই মুহূর্তের মূর্ত বিভীষিকার দিকে চেয়ে থাকা যাচ্ছিল না… চোখ ফাটিয়ে যেন ধড়ফড় করে পিঠটান দিয়েছিল বহুদর্শী পাহাড়ির বিষম আতঙ্কিত প্রাণপাখি।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল কন্যা সাবিত্রী।
কিন্তু…
খুকখুক করে হেসেছিল ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল।
একই সঙ্গে গুরু গুরু শব্দে প্রলয়রূপ নিনাদ ঝঙ্কার কাঁপিয়ে দিয়ে গেছিল কাছের আর দূরের পাহাড়ের পর পাহাড়। পাহাড় পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে যেন এক প্রলয়ঙ্কর অট্টহাসি ঠিকরে ঠিকরে গেছিল দূর গগণের নক্ষত্র রাজ্যের দিকে।
সুরে সুরে মিলিয়ে বলেছিল ক্ষিতি চাপা গলায় পারল না… পারল না… এবার আর দাদুকে পাকড়াও করতে পারল না। মরণের পর এমন উক্তি জীবনে শ্রবণ করেননি হাজারমারী চিকিৎসক। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিলেন অদ্ভুত নাতির কিম্ভূত মুখের দিকে।
তখনই দেখেছিলেন, ঠিক যেন দু-টুকরো মশাল ধিকিধিকি জ্বলে যাচ্ছে গুণধর বিকট কলেবর ক্ষিতি ক্ষেত্র পালের দুই নয়ন তারকায়।
এবং, কালবিলম্ব না করে পিঠটান দিয়েছিলেন তিনি।
পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের নয়নের মণি ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল কিন্তু ইতিমধ্যেই অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়ে দিয়েছিল বিবিধ জ্ঞানার্জনে। দূর দূরান্তের জ্ঞানকেন্দ্রে চিঠিচাপাটি চালিয়ে, বহু গ্রন্থাগারিককে খুঁচিয়ে টুঁচিয়ে নিরন্তর বোঝাই করে চলেছিল মস্তিষ্কের লক্ষকোটি কোষে বিবিধ প্রাচীন জ্ঞান। নানান মঠ মন্দির থেকে সংগ্রহ করে যাচ্ছিল বহুবিধ সুপ্রাচীন পুঁথি আর শাস্ত্র এমনই এক স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে যে রকমের সোনার টাকা কেউ কক্ষনো দেখেনি… অতি প্রাচীন এই সুবর্ণ মুদ্রা এত অধিক পরিমাণে সে পাচ্ছে কোত্থেকে, তা নিয়ে গুজগাজ ফিসফাস চললেও তাকে ঘাঁটাতে কেউ যায়নি। তার সামনে যেতেও সাহস হত না মহাকাল শহরের কোনও মিঞার… এমনই প্রখর ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছিল ওই বয়েসেই… মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যেত তল্লাট থেকে… নিরুদ্দেশ থাকত বেশ কিছুদিন… তারপর ফিরে আসত কাঁড়ি কাঁড়ি অদ্ভুত গড়নের স্বর্ণমুদ্রা আর বিবিধ পুঁথিপুস্তক নিয়ে। তার মহামতী দাদুও তো এমনিভাবে একদা সোনার টাকা ছড়িয়ে গেছে যত্রতত্র। সেই ঐশ্বর্য দিয়ে কিনেছে ছাগল ভেড়া গরু মোষ। একই কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে অশ্বত্থামা আকৃতি ক্ষিতি ক্ষেত্রপালও। শরীরও বাড়ছে হুড় হুড় করে… অত্যাশ্চর্য এক দানবিক হারে… এর মধ্যেই হাইট দাঁড়িয়েছে পাক্কা ছ-ফুট ছ-ইঞ্চি…
অর্ধ-বিকৃতি শ্বেতিময় মা-জননীকে কিন্তু অবজ্ঞার চোখে দেখে গেছে দাদু গত হওয়ার পর থেকে… যেন একটা নিছক আপদ… আবর্জনা …গর্ভধারিণী নামেই… সম্মান নয়… গর্ভে এসে যেন কৃতার্থ করে দিয়েছে সাবিত্রীকে।
বেরোতেও দিত না বাড়ি থেকে। চব্বিশ ঘণ্টা যেন কাঠের খাঁচার মধ্যে আটকে রেখেছে গর্ভধারিণীকে। ঠিক যেন একটা মেশিনকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে, সেই মেশিনের আদর তাই ফুরিয়েছে, এখন একটা জঞ্জাল! কুঁজিয়ে গেছিল সাবিত্রী, কিন্তু ছিল না কোনও মায়াদয়া অনুকম্পা।
১৯২৬ সালে একটু সুযোগ পেয়ে এক পড়শি বুড়িকে বলে ফেলেছিল সাবিত্রী – “বড় ভয় করে ক্ষিতিকে। যেন মানব নয়, দানব। কী যে করতে চায়, বুঝতে পারছি না।”
সেই শিবরাত্রির রাতে ভয়ানক উদ্দাম হয়ে উঠেছিল পাহাড়ে পাহাড়ে অনৈসর্গিক শব্দতরঙ্গ। বাতাস যেন ফেটে ফেটে পড়ছে পাহাড় পর্বতে… গম গমিয়ে দিচ্ছে দিক দিগন্ত… লেলিহান আগুন ঠিকরে ঠিকরে গেছিল চৌকিদার পাহাড়ের চুড়ো থেকে… যেমনটা দেখা গেছিল আগে অনেকবার, তার চাইতেও অনেক বেশি উদ্দাম আর উল্লোল অবস্থায় সে এক অবর্ণনীয় অগ্নি নৃত্য… আগুনের শিখা যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে ছিটকে গেছে দূর আকাশের অতন্দ্রনয়ন নিষ্পলক নক্ষত্রদের দিকে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছিল কালো মাছিদের সংখ্যা। অগনন অবস্থায় বিপুলকার মেঘ তরঙ্গের মতন ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে এসেছে পর্বতের গিরিগহ্বর নিকুঞ্জ নিকেতন থেকে কদাকার কদর্য ক্ষেত্রপাল ভবনের দিকে।… রক্তজমানো শব্দের বাজনা বাজাতে পঙ্গপালের মতন… কিন্তু মাছি উড়লে যে এমন বিশ্রী বিকট আওয়াজ হতে পারে, তা কারও জানা ছিল না… সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড বটে… একি আতঙ্কবীজ রোপণ করে গেল অপয়া পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল এহেন বিজন পর্বতাঞ্চলে? সারারাত ধরে চলেছে মক্ষিকা বাহিনীর আবির্ভাব আর আওয়াজ একটু একটু করে স্তিমিত হয়ে ভোর হতেই থেমে গেছে… কিন্তু থমথমিয়ে গেছে দিকদিগন্ত…
সেইসঙ্গে ঘটে ছিল আরও একটা অপকাণ্ড।
অভাগিনী সাবিত্রী ক্ষেত্রপাল যেন হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেছিল। সেই রাতের পর থেকে সাদাটে বিকৃত অবয়ব কেউ আর দেখতে পায়নি।
১৯২৭ সালের গ্রীষ্মে ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল আর একদফা বাড়ি মেরামতিতে মন দিয়েছিল। লাগোয়া দুটো ছাউনিতে বাড়ির সব পুঁথি কেতাব নিয়ে গিয়ে রেখেছিল। তারপরেও ছুতোরদের কাজ থামেনি বাড়িতে। একতলার সব জানলা আর দরজা তক্তা মেরে বন্ধ করে দিয়েছিল ক্ষিতি। ঠিক যেরকমটা করা হয়েছিল ওপর তলায় চার বছর আগে। নিজে থাকত দুটো ছাউনির একটাতে। অস্বাভাবিকরকম উদ্বিগ্ন অবস্থায়। দেখেছে এক পড়শি। চাপা গলায় প্রত্যেকেই তখন বলে গেছিল একটাই কথা। মা জননীর নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটা ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের অজানা নয়। কর্পূরের মতন নিশ্চয় উবে যায়নি মেয়েটা, কিছু একটা ঘটেছে কিন্তু সেটা জানবার জন্যে ও বাড়ির ছায়া মাড়ানোর সাহস কারও হল না। ক্ষিতি তখন লম্বায় সাত ফুট ছাড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আরও ঢ্যাঙা হবে।
৫
শীতের দাপানি চলে যেতেই ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল পাহাড়ি ডেরা ছেড়ে রওনা দিয়েছিল সমতল অঞ্চলের বড় বড় লাইব্রেরি আর প্রতিষ্ঠানে ঢুঁ মারার জন্যে। এদের সঙ্গে পত্রালাপ চলছিল অনেকদিন ধরেই, এখন গেছিল সশরীরে সুপ্রাচীন অতিশয় গুপ্ত গোপন কিছু কিংবদন্তি সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে, সেই সঙ্গে কিছু তথ্য জোগাড় করতে। বিশেষ একটা গ্রন্থাগারে দিয়ে চেয়েছিল একটা অতিশয় প্রাচীন কেতাব কিছুদিনের জন্যে, যুক্তি ছিল একটাই, এহেন কেতাব মন দিয়ে পড়তে হয় নিশুতি রাতে, যখন তারকা সাম্রাজ্য উঁকি মেরে দেখে যাবে তার পঠন নিরত মূর্তি সুদূর নীহারিকা অঞ্চল থেকে, নইলে নাকি কেতাবের ছত্রে ছত্রে লেখা কূট বিষয়াবলির মর্মে প্রবেশ করার ক্ষমতা কারো হয় না। নক্ষত্রদের নাক্ষত্রিক শক্তি ছাড়া এহেন সুকঠিন কর্ম করার ক্ষমতা দুনিয়ার কোনও মানুষের নেই।
বিশেষ একটা বিশাল পুঁথি নিয়ে এই রকম ধানাইপানাই করে গেছিল আখাম্বা লম্বা প্রায় দৈত্যকার ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল। খটকা লেগেছিল গ্রন্থাগারিকের। তিনি বহুদর্শী অভিজ্ঞ বিজ্ঞ পুরুষ বলেই এই গ্রন্থাগারের দায়িত্বে তাঁকে আনা হয়েছে। চারদিকে পাহাড়ঘেরা বিজন অঞ্চলের বিশেষ এই পুস্তক-পুঁথি মন্দিরে এমন সব দুষ্প্রাপ্য কেতাব সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে যে সবের নাগাল পেতে টাকা ছড়াতে কার্পণ্য করে না এই পৃথিবীর অনেক পুঁথি পাগল। পাহাড়ি ঠান্ডার দৌলতে দুষ্প্রাপ্য পুঁথিটুঁথিদের রক্ষণাবেক্ষণ সহজতর এখানে, কিন্তু কোনও রকমেই একখানা পুঁথিও যেন গ্রন্থদেবালয়ের বাইরে না যায়, সেদিকে তাঁকে খর নজর রাখতে হয়। পৃথিবীর বহু সুপ্রাচীন ভাষায় লেখা পুঁথি সযত্নে এখানে রেখে দেওয়া হয়েছে, এই পাহাড়ের গুপ্ত গুহা-গ্রন্থাগারে, খোদ ইংরেজ গ্রন্থ সংগ্রাহকদেরও সেই সব জায়গায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাই ভৃগু প্রমুখের জ্যোতিষ সম্পর্কিত পূর্ব জন্ম বিষয়ক নিখোঁজ পুঁথি থেকে আরম্ভ করে আরব দেশের উন্মাদ কবি আবদুল আলহাজ্রেডের জঘন্য নেক্রোনমিকনের সংস্কৃত অনুবাদ পর্যন্ত পাওয়া যায় এখানে। রেখে দেওয়া হয়েছে গুপ্ত চেম্বারে, তালা চাবি দিয়ে।
দানবাকার ক্ষিতি এহেন গ্রন্থমন্দিরে যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে ঢুকেছিল, তখন নিরন্তর গলা ফাটিয়ে গেছিল ফটকের অতি কদাকার কালান্তক সারমেয়। এর আগে শহরাঞ্চলে কখনও আসেনি ক্ষিতি, কিন্তু সে জন্যে কোনও দ্বিধা শঙ্কাও দেখায়নি। আটফুট লম্বা ছাগুলে-বদন শরীরখানা দুলিয়ে দুলিয়ে ফটক পেরিয়ে যাওয়ার সময়ে কুকুরদের বিরামহীন চিৎকারে ভ্রূক্ষেপ করেনি। চেন ছিঁড়ে অস্বাভাবিক ক্ষিপ্ততা নিয়ে তেড়ে আসতে চেয়েছিল দানবিক সারমেয় সম্প্রদায়। কারণটা অনুমান করতে পারেনি দ্বাররক্ষক। অনেক বিদেশিই তো আসেন এই পর্বত-গ্রন্থাগারে দুর্লভ পুঁথি পাঠ করার জন্যে, কিন্তু কখনও তো কুকুররা এমন ক্ষেপে যায় না।
লোকালয়ে সেই প্রথম আগমন ক্ষিতির। কিন্তু বেপরোয়া। নিঃশঙ্ক। নির্ভীক। সপ্তদশ শতাব্দীতে কোনও এক পণ্ডিত নেক্রোনমিকন অনুবাদ করে রেখেছে সংস্কৃততে, তা তার অজানা নয়। এতদিন চলেছিল পত্রালাপ। এবার এসেছে সশরীরে। পত্রালাপ চলেছিল অশুদ্ধ ইংরেজিতে, গ্রন্থাগারে ঢুকে ইংরেজি আর সংস্কৃতর জগাখিচুড়ি চালিয়ে গেছিল। খটকা লেগেছিল বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিকের। এরকম উদ্ভট চেহারা কখনও তো দেখেনি। অবাক হয়েছিলেন কুখ্যাত কেতাব নেক্রোনমিকনের ইংরেজি অনুবাদ দেখে— ডক্টর ডি করেছিলেন সেই অনুবাদ। এহেন দুর্লভ অনুবাদ কেতাব হাতে নিয়ে গেছিল ক্ষিতি, পেয়েছিল দাদুর কাছে, চেয়েছিল সংস্কৃত অনুবাদটা। কারণটাও বলেছিল। বিশেষ একটা পরিচ্ছেদ মিলিয়ে দেখতে চায়। ইংরেজি অনুবাদে যে রকমটা লেখা হয়েছে, সংস্কৃততেও কি তাই আছে? পাতা উলটে দেখিয়েছিল ৭৫১ পৃষ্ঠার সেই পরিচ্ছেদটা কেন? কারণটা কী? এই প্রশ্নের জবাবে বিনীতভাবে জানিয়েছিল, বিশেষ একটা মন্ত্র ঝালিয়ে নিতে চায়। পাহাড় অপদেবতা ভয়ঙ্কর যোগ-সোথথকে আবহন করার মন্ত্র। এ মন্ত্র রয়েছে একটা ফরমুলার মধ্যে। বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক সংস্কৃত তর্জমার পুঁথিটা এনে দিতেই ক্ষিতি যখন তা টুকে নিচ্ছে, তখন উঁকি মেরে দেখে ছিলেন গ্রন্থাগারিক মন্ত্রটা কীসের। গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। অশরীরী যে সত্তা শরীরী হলে দুনিয়াকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে, কালান্তক সেই সত্তাকে আবাহন করার সংস্কৃত মন্ত্র খসখস করে টুকে নিচ্ছে ক্ষিতি। কী সর্বনাশ! কল্পনাতীত এই বিভীষিকা মূর্ত যদি হয়, প্রলয়াগ্নি দেখা দেবে যে সৌর জগতের তৃতীয় গ্রহ এই পৃথিবীতে!
বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক সংস্কৃত জানতেন। মন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থেকেই মনে মনে অনুবাদ করে নিয়েছিলেন এবং শিউরে শিউরে উঠেছিলেন। যা বুঝেছিলেন তা এই— মানুষই যে এই পৃথিবীর প্রাচীনতম অথবা সর্বশেষ প্রভু, এরকম ধারণা না থাকাই ভালো। অথবা, প্রাণের স্পন্দন এই পৃথিবীতেই প্রথম নয়। প্রকৃত প্রাচীন যারা— তারা ছিল, আছে, থাকবে। ত্রিমাত্রিক এই বিশ্বের তিন রকম ডাইমেনশনের ফাঁকে ফাঁকে তো বটেই, এছাড়াও বহুবিধ মাত্রা অর্থাৎ ডাইমেনশন বিদ্যমান এই বিশ্বে— সেই সব ডাইমেনশনের ফাঁকে ফাঁকে ওঁৎ পেতে রয়েছে তারা আজও। তাদের দেখা যায় না, কিন্তু তারা আছে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ— সবই রয়েছে এই কালান্তক পর্বত অপদেবতা যোগ-সোথথ-য়ের মধ্যে। ফটক খোলার মন্ত্রগুপ্তি জানে যোগ-সোথথ। এই ফটক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তার। সে জানে, অতীতের ভয়ঙ্কররা ঠিক কোনখান দিয়ে ব্যক্ত হয়েছিল অতিপ্রাচীন কালে, এবং ঠিক কোনখান দিয়ে কীভাবে আবার তারা মূর্তি পরিগ্রহ করতে পারে। এই পৃথিবী তাদের বিচরণ ভূমি। একদা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করে ছেড়েছে, আবার তা করতে পারে। এই মুহূর্তে তারা বিচরণ করছে কোন সময়ক্ষেত্রে, তা জানে শুধু যোগ-সোথথ। তাদের দেখা যায় না, কিন্তু তারা আছে। তাদের গাত্রগন্ধে মানুষ মাঝে মাঝে সচকিত হয়, অনুমান করে নেয়— এই তো তারা রয়েছে অতি নিকটে, কিন্তু তাদের আকৃতি কীরকম, তাদের দেখতে কীরকম, তা কেউ হাজারো নৈশ দুঃস্বপ্ন দিয়েও মনের আকাশে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। আঁচ করতে পারে মাঝে মাঝে অনুরূপ সাদৃশ্য মানবাকৃতিতে যখন পরিস্ফুট হয়। সেইসব আদল প্রেতচ্ছায়াসম থেকে শুরু করে অনেক রকমের হয় বলে মানুষ ধোঁকায় পড়ে যায়— বংশগতির নিয়মভঙ্গ করে একি সৃষ্টিছাড়া শিশু জন্ম নিচ্ছে মনুষ্যলোকে। মূল যারা, তারা কিন্তু আজও বিচরণ করে যাচ্ছে পৃথিবীর অজানা কন্দরে অন্দরে। নিরালা অঞ্চলে, আবাহনের অপেক্ষায়। ডাক দিলেই আসবে, কিন্তু ডাকার মতন ডাকা চাই। আবাহনের মন্ত্র সঠিক হওয়া চাই। বিশেষ ঋতুতে তারা প্রবল হয়ে ওঠে। বাতাস তখন হুহুঙ্কারে আছড়ে আছড়ে পড়ে, মর্ত্যভূমি তখন থরথর করে প্রকম্পিত হয়। এই ভাবেই তারা জানিয়ে দেয় তারা ছিল, আছে, থাকবে। তখন তারা অক্লেশে মাটিতে মিশিয়ে দেয় অরণ্যের বিপুলাকায় মহীরুহদের, ধ্বংস করে দিয়ে যায় নগর নিকেতনের পর নগর নিকেতন। তারা মহাকায়, তারা বিকট দেহী, কিন্তু তারা দৃশ্যমান নয় সাধারণ চোখে। মেরু অঞ্চলে তাদের স্থায়ী নিবাস। সেখানেই অব্যাহিত তাদের নর্তন কুর্দন। সেখানেই আজও আছে, তুহিন তেপান্তরের নীচের তুহিন প্রাসাদে সেইসব মহা ভয়ঙ্কররা, অথবা অথই বরফ সাগরের একদম নীচে। সামুদ্রিক উদ্ভিদ আর প্রবল অরণ্য তাদের নিবাস ঢেকে রেখে দিয়েছে অতি সযত্নে। মহামান্য থুলু তো এদেরই একরকমের ভাই। তা সত্ত্বেও থুলু… মহাভয়ঙ্কর থুলু নিজেও এহেন অপচ্ছায়াদের মতিগতি বুঝে ওঠে না। যখনই যেখানে বিকট দুর্গন্ধ, বুঝবে অদৃশ্য এই বিভীষিকাদের আবির্ভাব ঘটেছে সেখানে, অথচ চর্মচক্ষু দিয়ে তাদের দেখতে পাবে না। একদা ধরাতলের যেখানে সেখানে তারা দাপিয়ে রাজত্ব করে গেছে, মানুষ এখন সেই সব জায়গায় গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে। কিন্তু ঠিক এই সব জায়গাতেই আবার রাজত্ব শুরু করবে এবং গ্রীষ্মের পর শীত, শীতের পর গ্রীষ্ম এই তো নিয়ম। তারাও তাই ধৈর্য ধরে আছে। সময় যখন হবে নিকট, হবে তারা জাগ্রত। ফের মহীতল লুণ্ঠিত হবে তাদের পদতলে।
বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক মহাকাল নগরের খবরটবর রাখতেন। সেখানকার এক অশুভ প্রচ্ছায়া, অব্যাখ্যাত বিভীষিকাদের সংবাদ তাঁর অগোচর ছিল না। লোকমুখে কিছুটা অতিরঞ্জিত হতে পারে, কিন্তু কিছু একটা না ঘটলে লোকের মুখে মুখে কথা ছড়িয়ে পড়বে কেন। সেখানে নাকি এমনই বিভীষিকা সঞ্চরমান হয়েছে যা গায়ে কাঁটা জাগিয়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের জন্ম, বিদঘুটে অবয়ব, বিটকেল গন্ধ, উৎকট কালো মাছির দঙ্গল, পরিশেষে মা’কে খতম করে দেওয়া। এ সবই যে সৃষ্টিছাড়া ব্যাপারস্যাপার। ভাবতে গেলেই কপালে ঘাম দাঁড়িয়ে যায়, এই ঠান্ডার মধ্যেও। যেন কবরখানার পাতালিক শৈত্য হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। হেঁট হয়ে পুঁথি নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে ওই যে ছাগুলে মুখাকৃতি দানবাকার জোয়ান, সে যেন এই মর্ত্যের মানুষ নয়, আবির্ভূত হয়েছে অন্য কোনও লোক থেকে। আকৃতি কিছুটা মানবিক, কিন্তু যোগসূত্র রেখে দিয়েছে যাবতীয় দেশ, কাল, বস্তুর বাইরেকার এক অসীম অনন্ত অকল্পনীয় শক্তি অথবা সত্তার সঙ্গে।
কিছুক্ষণ পরেই হেঁট মাথা সিধে করে নিয়ে কথা শুরু করেছিল ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল নামক আধা দানব এমনই এক স্বরকম্পন দিয়ে যে রকমটা অপিচ শোনেনি বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক, মনে হয়েছিল যেন স্বয়ং স্রষ্টা এই বিদঘুটে মানব দেহ গড়তে গিয়ে কিঞ্চিৎ ভুল করে ফেলেছেন স্বরযন্ত্রটা, তাই মানবদেহের স্বরযন্ত্রের মতন হয়নি।
পাহাড়ি ভাষার টানে যা বলে গেছিল ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল তা এইরকম— “ভেবে দেখলাম, এই কেতাবটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া দরকার। সব অর্থ বুঝতে গেলে বিশেষ কিছু পরিবেশের দরকার। সেই পরিবেশ এখানে নেই। অনুমতি দিন, নিয়ে যাই সঙ্গে। কেউ জানবেনা। এ পুঁথি এমন ভাবে এখানে পড়ে রয়েছে…”
এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেছিল ক্ষিতি। কারণ ছিল। গ্রন্থাগারিকের মুখ শক্ত হয়ে গেছিল প্রস্তাবটা শুনেই। ছাগুলে মুখে তৎক্ষণাৎ খেলে গেছিল ধূর্ততার ঝিলিক।
গ্রন্থাগারিক তখন ভাবছিলেন, বলা যাক টুকে নিয়ে যেতে যেটুকু দরকার। তার পরেই ভাবলেন সেটা বলাটাও সঙ্গত হবে না। ভয়ানক এই গ্রন্থের গুপ্ত গোপন রহস্য যদি এই আধা-দানবটার হাতে যায়, প্রলয় ঘটে যেতে পারে।
তাই সামলে নিলেন নিজেকে। অজানা বহির্জগৎকে বশে আনার নারকীয় মন্ত্রগুপ্তি অজানা থাকাই ভালো।
তিনি যে নারাজ এহেন প্রস্তাবে, তা জানিয়ে দিলেন স্পষ্টাস্পষ্টি।
ক্ষিতি মুচকি হেসে তখন বলেছিল— “তাহলে অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখা যাক,” বলে, মস্ত দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে পেরিয়ে গেছিল প্রতিটা দরজার চৌকাঠ। জানলা দিয়ে দেখা গেছিল, গরিলার মতন আকৃতি নিয়ে ফটকের দিকে এগচ্ছে ক্ষিতি আর একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে সব ক-টা কুকুর গ্রন্থাগারিকের মনের মধ্যে সেই মুহূর্তে ভিড় করে এসেছিল হরেক রকম উপকথা কিংবদন্তি কাহিনি। শুনেছিলেন একবার মহাকাল মন্দির দর্শন করতে গিয়ে। এই পৃথিবীর নানান জায়গায় তো অদেখা প্রহেলিকারা দাপিয়ে বেড়ায়। তারা ত্রিমাত্রিক পৃথিবীর কেউ নয়। তারা যখন ধেয়ে যায়, পূতিগন্ধ ছড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে পাহাড়ের মাথায় দেখা যায় মুখ ঢাকা প্রহেলিকাদের। এখন দেখলেন যেন এইরকম একটা মূর্তিমান বিভীষিকাকে।
নেক্রোনমিকন কেতাবটাকে তুলে রাখলেন তালা দেওয়া আলমারিতে। তা সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে রয়ে গেলে বিশ্রী বিকট একটা নারকীয় দুর্গন্ধ। মনে পড়ে গেল তখনই। ঠিক এই রকম বিকট গন্ধ পেয়েছিলেন তো মহাকাল মন্দির দেখতে গিয়ে ক্ষেত্রপাল ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে। শুনেছিলেন বিবিধ গুজব।
গুজবগুলো ক্ষিতির জন্ম নিয়ে। মানুষ মেয়ের পেটে এরকম আধা ছাগল আকৃতি জন্মায় কী করে? ছাগলের সঙ্গে সহবাস না হলে? বংশানুদের বিকৃত মিলন? অসম্ভবের আবির্ভাব?
ছিঃ ছিঃ! এর চাইতে ন্যক্কারজনক আর কিছু নাকি হয় না। নাম ডোবালো মহাকাল তল্লাটে।
আরও আছে। ক্ষিতি যে রাতে ভূমিষ্ঠ হয়, সেই রাতে নাকি কী এক মাতামাতির বিষম হট্টগোল ভেসে এসেছিল পাহাড়ের দিক থেকে।
সেদিন ছিল অমাবস্যা।
ক্ষিতি তাহলে কী অর্ধেক মানব অর্ধেক পশু? রক্তমাংশের অর্ধেকটা এসেছে মায়ের দিক থেকে, বাকিটা…?
কুকুররা কী অকারণে চেঁচাচ্ছে।
পরের সপ্তাহের সাতটা দিন ধরে বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক মহাকাল শহর সম্পর্কে বিবিধ তথ্য আর তত্ত্ব সংগ্রহ করে গেলেন। পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের মৃত্যুশয্যায় হাজির ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ও যোগাযযাগ করলেন। সেই সময়ে পাহাড়ি কী কী বলে গেছিল, তাও জানলেন।
কিন্তু বিলক্ষণ স্তম্ভিত হলেন নেক্রোনমিকন গ্রন্থটায় চোখ বুলোতে গিয়ে। যে পরিচ্ছেদটা নিয়ে তন্ময় হয়েছিল বিরাটদেহী ক্ষিতি, সেটা খুঁটিয়ে পড়লেন। এবং শিহরিত হলেন।
সন্ধান পেয়ে গেলেন এমন কিছু সূত্রাবলির যা প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে গোটা পৃথিবীতে দূর নক্ষত্রজগৎ থেকে ক্রুর, কুটিল মহাশক্তিকে আবাহন করে।
আলোচনা করলেন অনেক বিদগ্ধ পুরুষের সঙ্গে। বুঝলেন, কিছু একটা করা দরকার মহাকাল তল্লাটে।
৬
মহাকাল আতঙ্ক গোটা তল্লাট কাঁপিয়ে ছাড়ল ১৯২৮ সালের বিশেষ একটা সময়ে। সেই অঘটনের ভূমিকা কালে সাক্ষী হয়ে থাকতে পেরেছিলেন ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক— বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান। অন্য অনেক কলেজ লাইব্রেরিতে যোগাযোগ করে উনি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল গেলে যেন তাকে হাঁকিয়ে দেওয়া হয়, ভয়াল ভয়ঙ্কর নেক্রোনমিকন গ্রন্থ যেন তাকে নিয়ে যেতে না দেওয়া হয়। এই হুঁশিয়ারি পাঠাতে গিয়েই জানতে পারলেন, ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল এর মধ্যেই হানা দিয়েছিল একটা বিরাট লাইব্রেরিতে কিম্ভূত ওই শরীর নিয়ে। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে যত আতঙ্কের আকর ‘নেক্রোনমিকন’ কেতাবের একটা কপি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে অনেক আগেই বিষ্ণু পট্টনায়েক সব লাইব্রেরিয়ানদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন বলে। মস্ত একটা কলেজ লাইব্রেরিতে গিয়ে তো ভীষণ ঘাবড়ে গেছিল ক্ষিতি নেক্রোনমিকন হাতাতে গিয়ে, তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছে বাড়ি ফেরার ব্যাপারে, যেন বেশিদিন বাড়ির বাইরে থাকার ফলাফলটা ভালো হবে না মোটেই।
আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে ঘটে গেল সেই ঘটনাটা, অনেক আগে থেকেই যে ঘটনার আভাস উঁকিঝুঁকি মেরে যাচ্ছিল মনের মধ্যে। বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েকের ঘুম ছুটে গেছিল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে একটা বিষম হট্টগোলের ধাক্কা কানের পর্দায় আছড়ে পড়ায়। সমস্ত কুকুর একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, বন্য বিকট শব্দনিনাদে কর্ণপটহ যেন চৌচির হয়ে যেতে চাইছে। বেপরোয়া সারমেয় মহাপ্রভুর কী এক ভয়াবহ কারণে গজরাচ্ছে, গলার শির তুলে চেঁচাচ্ছে, চেঁচিয়ে মেচিয়ে যেন এমনই একটা অঘটনকে আটকাতে চাইছে যার নজির এই কলেজ ক্যাম্পাসে অপিচ কদাচ দেখা যায়নি। সম্মিলিত হাঁক ডাক তর্জনগর্জন শুনে মনে হচ্ছে যেন অকস্মাৎ উন্মাদ হয়ে গেছে প্রতিটি কুকুর। মাঝে মাঝে অবশ্য একসঙ্গে বিরতি দিচ্ছে হাঁকডাকে, তখন যে নৈঃশব্দ্য নেমে আসছে গোটা কলেজ প্রাঙ্গণ জুড়ে তা রুধির শীতল করে দেওয়ার মতন। যেন একটা জঘন্য ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন রয়েছে মাঝে মধ্যে তাদের কণ্ঠরোধের মধ্যে।
আশ্চর্য ব্যাপার তো? দলবেঁধে চেঁচাতে আচমকা আচমকা স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন বিভীষিকা সারমেয় পুঙ্গবগণ? মনে হচ্ছে, কী এক অলৌকিক অব্যাখ্যাত অস্বাভাবিক শক্তি একই সঙ্গে প্রত্যেকটি সারমেয়র টুঁটি টিপে ধরে তাদের স্বরযন্ত্রগুলোকে একসঙ্গে এক্কেবারে বিকল করে দিচ্ছে। তাজ্জব কাণ্ড? নিশুতি রাতে শান্তির নীড় এই কলেজ প্রাঙ্গনে এবংবিধ উৎপাত, শব্দ ব্রহ্মের এহেন নারকীয় উল্লম্ফন তো কক্ষনো দেখা যায়নি। কুকুরদের কাজ কুকুররা করতে যাচ্ছে, কিন্তু কী এক মহাশক্তি নিমেষে নিমেষে যেন অঙ্গুলি হেলনে তাদের স্বরযন্ত্রগুলো বিলকুল বিকল করে দিচ্ছে। একী ধুন্ধুমার কাণ্ড রাত্রি নিশীথে শান্তির নীড় এই মহাবিদ্যালয়ে? যখন চেঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে, তখন মনে হচ্ছে যেন বিশেষ একটা কারণে বিষম উত্তেজিত হয়েছে। যখন দলবেঁধে বোবা হয়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে যেন এমনই অনৈসর্গিক একটা কাণ্ড ঘটছে যে বেচারিদের গলায় আর হাঁকডাক ফুটছে না, এহেন রুধির শীতল করা অপ্রাকৃত হট্টগোল শ্রবণের অভিজ্ঞতা কারও কখনও হয়নি। বিশেষ করে নিনাদ লহরী হঠাৎ হঠাৎ যখন এক্কেবারে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখনকার হিমেল গাছমছমানির অভিজ্ঞতাটাও কেউ ভাষা দিয়ে ফুটিয়ে উঠতে পারেনি। ঠিক যেন সব ক-টা কুকুরের গলা একই সঙ্গে কেউ টিপে ধরছে, ঝাঁকুনি মেরেই ছেড়ে দিচ্ছে। তখন গজরানির বদলে গলা দিয়ে ঠিকরে আসছে কাতর কুঁই কুঁই আওয়াজ। আর ঠিক সেই সময়ে গজরানি শোনা যাচ্ছে অন্য একটা স্বরযন্ত্রে— এমনই একটা স্বরযন্ত্র যার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই… যেন এক ভিনগ্রহীর অপার্থিব হুঙ্কার। রক্ত জল করার মতন সেই বিকট হুঙ্কারকে ভাষা দিয়ে বুঝিয়ে ওঠা যায় না। শব্দব্রহ্মের পাতালিক প্রকাশ।
ডক্টর পট্টনায়েক আঁতকে উঠে কোনওরকমে গায়ে জামাকাপড় চাপিয়ে ধড়ফড় করে ছুটে গেছিলেন কলেজ ক্যাম্পাসে। যেতে হয়েছিল রাস্তাঘাট পেরিয়ে, কলেজ বিল্ডিং তো তার পরেই। যেতে যেতেই দেখেছিলেন, তাঁর আগেই অনেকে দৌড়চ্ছে। তার মানে, ভয়াবহ পাশব হুঙ্কার আর নিনাদ আগেই তারা শুনেছে। শুনতে পেলেই তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে চলেছে অ্যালার্ম বেল লাইব্রেরিতে। একটা জানলার কপাট খোলা, যেন মুখ ব্যাদান করে রয়েছে উঠোনের দিকে। চাঁদের আলো ঝিকমিকিয়ে যাচ্ছে খোলা জানলার দুই পাল্লায়। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি বলেই জানলায় গরাদ বা গ্রিল নেই। যে নৈশ আতঙ্ক আবির্ভূত হয়েছিল কলেজ ক্যাম্পাসে, নিশ্চয় তার প্রবেশ ঘটে গেছে জানলার মধ্যে দিয়ে, কেননা সম্মিলিত সারমেয় হুঙ্কার এখন শোনা যাচ্ছে ঘরের ভেতর দিকে। চাপা গজরানি।
হুঁশিয়ারি ডক্টর পট্টনায়েক এই পর্যন্ত দেখেই বুঝে নিয়েছিলেন, এখন যা ঘটছে ঘরের মধ্যে, তা চর্মচক্ষু দিয়ে না দেখেই সঙ্গত, মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যেতে পারে। তাই সমবেত সবাইকে আটকে দিয়েছিলেন, আর এগোতে দেননি। নিজেই অগ্রণী হয়ে বারান্দার দরজার তালা খুলেছিলেন। ওর সঙ্গে তখন ছিলেন অন্য দুই অধ্যাপক— প্রফেসর মিশ্র আর প্রফেসর ভাটনাগর। ওঁর মনে সন্দেহ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন শুধু এই দুজনের সঙ্গে। তাই হাতের ইসারায় তাদের বলেছিলেন ওঁর পেছন পেছন ঘরের মধ্যে যেতে। ভেতরের বিদঘুটে আওয়াজ-টাওয়াজ তখন আর শোনা যাচ্ছিল না, শুধু গড় গড় করে গলাবাজি করে যাচ্ছিল একটা ভয়ঙ্কর দেহী কুকুর। কিন্তু খটকা লেগেছিল ডক্টর পট্টনায়েকের অন্য একটা গুনগুন ভন ভন আওয়াজ শুনে। দলে দলে কালোমাছি অকস্মাৎ গোটা তল্লাট থেকে, সমস্ত ঝোপঝাড় থেকে ধেয়ে এসে যেন মুমূর্ষু মানুষটার শেষ নিশ্বাসের তালে তাল মিলিয়ে রক্তজমানো ছন্দিত শোক সঙ্গীত রচনা করে চলেছে। কৃষ্ণবর্ণ মক্ষিকা বাহিনীর এহেন জমায়েত কখনও দেখেননি ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক, মাছির ডানায় এমনভাবে বিষাদ রাগিণী রচনা করার কথাও কখনও শোনেননি।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাতেও ডক্টর পট্টনায়েক টের পেয়েছিলেন একটা বিশ্রী বোঁটকা বিবমিষা জাগানো দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাড়িময়। এমনই একটা উৎকট গন্ধ যা নাকে গেলেও লোমকূপে লোমকূপে শিহরন জাগিয়ে যায়, চিত্ত বিকল করে দিতে চায়। বিশ্রী অপার্থিব এহেন পূতিগন্ধের সঙ্গে এর আগেই পরিচিতি লাভের দুর্ভাগ্য হয়েছিল ডক্টর পট্টনায়েকের। তিনজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ছিলেন হলঘরের মধ্যে দিয়ে কুলুজি বিদ্যাকক্ষের দিকে। ছোট্টঘর। কুলুজি নিয়ে যারা অধ্যয়ন করতে চায়, এ ঘর শুধু তাদের জন্য। চাপা কুঁই কুঁই আওয়াজটা ঠিকরে আসছিল এই ক্ষুদ্র কক্ষের ভেতর থেকেই।
সেকেন্ড খানেকের জন্যে আলো জ্বালানোর সাহস হয়নি কারোরই। তারপর অবশ্য সাহসে বুক বেঁধে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
বিকট চেঁচিয়ে উঠেছিলেন তিনজনের একজন। তিনি কিনি, মানে, তিনি যে কে, তা অবশ্য সঠিক জানা যায়নি।
কেন অমন পরিত্রাহি চিৎকার ছেড়ে ছিলেন?
কারণ, চোখ ঠিকরে গেছিল বলে, সামনেই মেঝের ওপর আধবেঁকা অবস্থায় পড়ে থাকা বিমূর্ত আতঙ্কময় কলেবরটা দেখে। চারদিকে উলটে পালটে ছিটকে মিটকে গেছে টেবিল আর চেয়ার। কল্পনাতীত একটা মূর্তিমান বিভীষিকা পড়ে আছে মেঝেতে।
প্রফেসর ডিক্সিট স্বীকার করেছিলেন পরে, পুরো একটা মিনিটের জন্যে সম্বিৎ হারিয়ে ছিলেন তিনি বর্ণনাতীত সেই বিভীষিকা দেখে, তবে মাথা ঘুরে টলে পড়ে যাননি। দড়াম করে আছড়ে পড়েননি। প্রায় ন-ফুট লম্বা একটা তালঢ্যাঙা আকৃতি পড়ে রয়েছে শিরা নির্গত সবজে-হলদেটে রস আর চটচটে আলকাতরার মতন বিবমিষা জাগানো থকথকে আঠালো পদার্থের মধ্যে। কুকুরের শাণিত দাঁত আর থাবার নখ টেনে ছিঁড়ে এনেছে সমস্ত পরিধেয় সেই সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে গায়ের চামড়া। বমির উদ্রেক ঘটানোর মতন নারকীয় বিভীষিকা-সম অমানবিক ধড়ের মধ্যে প্রাণটা তখনও ধুকপুক করে চলেছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খিঁচে খিঁচে উঠছে অল্প স্বল্প নিঃশব্দে, বুক উঠছে আর নামছে তালে তালে… বাইরের ঝাঁকে ঝাঁকে জমায়েত কালো মাছিদের বাহিনীদের উন্মত্ত হুঙ্কারের তালে তাল মিলিয়ে। সে এক দানবিক ঐকতান। অমানবিক ছন্দ। জুতোর টুকরো টুকরো চামড়া আর পরিধেয়র ছিন্ন অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘর ময়। জানলার ঠিক ভেতর দিকে গড়াগড়ি যাচ্ছে একটা শূন্যগর্ভ ক্যানভ্যাস ব্যাগ, ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল সেই দিকেই। ঘরের মাঝের টেবিলের কাছে পড়ে রয়েছে একটা রিভলভার, ভেতরে রয়েছে একটা কার্তুজ— বেঁকা অবস্থায় নলচের মধ্যে দিয়ে গুলি বেরিয়ে আসেনি সেই কারণেই জানা গেছিল পরে। মেঝের ওপর পড়ে থাকা জিনিসটার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয় এই কারণেই যে কোনও রকম বর্ণনা দিয়ে মূর্তিমান সেই বিভীষিকার বিকৃত বীভৎস রূপ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। গতানুগতিক একটা বর্ণনা দিলেও সে বর্ণনা সঠিক বর্ণনা কখনওই হবে না। কেননা, মানবিক কোনও লেখনী দিয়ে মূর্ত সেই বিভীষিকাকে কাগজে কলমে ফুটিয়ে তোলা যায় না। তবে এই পৃথিবীর মামুলি আর অতি সাধারণ প্রাণময় কলেবরদের সঙ্গে যাদের যৎকিঞ্চিৎ পরিচয়ও আছে, পদার্থের তিন মাত্রা সম্বন্ধে যারা অবহিত আছে, তাদের তিলমাত্র ধ্যান ধারণার সঙ্গে ভূলুণ্ঠিত সেই অতীব কদাকার আকৃতির কোনও মিল নেই। অদ্ভুত কিম্ভূত সেই অবয়ব কিছুটা মানবিক অবিকল মানুষের হাত আর মাথার মতন হাত আর মাথা থাকার জন্যে, চিবুকবিহীন ছাগুলে মুখের মধ্যে রয়েছে ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের স্ট্যাম্প। কিন্তু ধড় আর শরীরের নীচের দিকটা চার-প্রত্যঙ্গে র নিয়মানুসারে উপকথায় বর্ণিত অকল্পনীয় আকৃতির মতন… অবিশ্বাস্য… ধারণাতীত… পোশাকআশাকের বদান্যতায় এহেন কিম্ভূত বিকট আকৃতি এতাবৎকাল ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করতে পেরেছে কারও চক্ষুস্থির না করে দিয়ে।
কোমরের ওপর দিকে সে আধা-মানব; বুকের ছাতির পরিধেয় কুকুরের দংষ্ট্রায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্যে দেখা যাচ্ছে সেখানকার চামড়া জালি-জালি, কুমিরের গায়ের চামড়ার মতন, কুকুর মহাশয়ের নখর যুক্ত থাবা চেপে বসে রয়েছে ঠিক সেই জায়গাটায়। পিঠের দিকটা চিত্ৰবিচিত্র হলদে আর কালোয় মিশোনো, কিছু সাপের গা যেরকম আঁশযুক্ত হয়, সেই রকম। কোমরের নীচের দিকটা আরও জঘন্য। কেননা, মানুষের সঙ্গে সব রকম সাদৃশ্য সেখানে অনুপস্থিত, অবিমিশ্রিত কপোল কল্পনার শুরু সেইখান থেকেই। চামড়া ঢাকা পড়ে গেছে পুরু মোটা কালো রঙের লোমে, পেট থেকে বেরিয়েছে খান কুড়ি বেশ লম্বা লিকলিকে সবজেটে-ধূসর শুঁড় প্রতিটার মুখে কাছে নেতিয়ে প্রকট হয়ে রয়েছে রক্ত চোষার মুখ।
প্রত্যঙ্গগুলোর অবস্থান দেখলেই খটকা লাগে মনে। পৃথিবীতে অথবা সৌরজগতে একেবারেই নেই এই ধরনের জ্যামিতিক নকশা… কিম্ভূত সেই প্যাটার্ন আজ পর্যন্ত মর্ত্যের কোনও মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারে ঠাঁই পায়নি। পাছার দু-দিকে ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় রয়েছে কাছাকাছি ঘেঁষে থাকা একটা করে লুপ্তপ্রায় আদিম অঙ্কুর-চক্ষু, খাঁজ কাটা চক্ষু কোটরের মধ্যে ল্যাজের বদলে রয়েছে গোল গোল বেগুনি রঙের খাঁজ-কাটা একটা শুঁড়, আর রয়েছে হতে গিয়েও হয়ে উঠতে পারেনি এমন একটা মুখ। অথবা গলা। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক দানবিক সরীসৃপদের পেছন দিকের পায়ের মতন, চাপচাপ লোম বাদ দেওয়ার পর, পদযুগলের শেষ প্রান্তে রয়েছে মোটা মোটা শিরাওয়ালা থপথপ প্যাডের পা— যা খুর নয়, থাবাও নয়। বিষমাকার এই জিনিসটা যখন নিশ্বেস নিচ্ছে আর ফেলছে, তখন কোনও এক রকম সংবহন প্রণালী মেনে চলে ল্যাজ আর শুঁড়গুলোর রং পালটে পালটে যাচ্ছে এমনই এক অমানবিক সবজেটে আভা বিকিরণ করে যার নজীর মানব-কুলজিতে নেই; একই সঙ্গে ল্যাজের দিকে প্রকট হয়ে রয়েছে হলদেটে একটা প্রত্যঙ্গ, মাঝে মাঝে সেখানকার বেগুনি বলয়ের মধ্যেকার রং পালটে গিয়ে গা ঘিনঘিনে সাদাটে হয়ে যাচ্ছে। নিখাদ রক্ত বলতে যা বোঝায়, তার বিন্দুমাত্র নেই, তার বদলে গড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধময় সবজেটে হলদেটা একটা রস রক্তরস… অর্ধবৃত্তাকারে দাগিয়ে দিয়েছে মেঝে, পাশের দিকের জায়গা বিরং হয়ে গেছে অদ্ভুতভাবে।
তিন ব্যক্তির উপস্থিতির জন্যেই মনে হল যেন মুমূর্ষু জিনিসটার মধ্যে চেতনা এসে গেল। বিড় বিড় করে কি যেন বলতে বলতে মাথা তোলবার চেষ্টা চালিয়ে গেল। ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক সেই সব আত্মগত বকুনির কিছুই লিখে না রাখলেও জোরের সঙ্গে বলেছেন, কথাগুলো কোনও পরিচিত ভাষার মধ্যে পড়ে না। প্রথম দিকের ছাড়া ছাড়া শব্দনিচয়ের সঙ্গে পার্থিব কোনও ভাষার শব্দের সঙ্গে মিল আছে বলে মনেই হয়নি। তারপর ছাড়া ছাড়া অসংলগ্ন উক্তি শুনে মনে হয়েছে যেন নেক্রোনমিকন কেতাবের কথা আউড়ে যাওয়া হচ্ছে। ভাষা অত্যন্ত অপবিত্র। ঈশ্বর নিন্দায় মুখর। ঐশ্বরিক সব কিছুর মুণ্ডপাত। দানবিক এক শক্তির অন্বেষণে বেরিয়েই ভূলুণ্ঠিত কদার্য কলেবরটার আজ এই পরিণতি। নিভে যাচ্ছে প্রাণের প্রদীপ। টুকরো টুকরো খাপছাড়া উক্তিগুলো এই রকম: ‘এন-গে এন-যা-যা, বাগ-শগগ, ইহাঃ যোগ সোথথ, যোগ-সোথথ’ শেষের দিকে উক্তি আর শুনতেই পাওয়া যায়নি। প্রাণভোমরারর মতন কালো মাছির দঙ্গল বচন ধারার তালে তালে মৃদঙ্গ বাজনার মতন মহা কলরব শুরু করে দেওয়ায়।
তারপরেই যখন শ্বাসপ্রশ্বাস আর খাবি খাওয়াতে একটু বিরতি এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে কিঁউ কিঁউ করে একটানা করুণ আর্তনাদ করে গেছিল সারমেয় প্রবর মুখ উঁচিয়ে। ভূলুণ্ঠিত কলেবরটার হলদেটে ছাগুলে মুখমণ্ডল দেখা গেছিল একটা পরিবর্তন। বিশালকায় মসীবর্ণ চক্ষুতারকায় জাগ্রত হয়েছিল নিরতিসীম আতঙ্ক প্রতিচ্ছবি। জানলার বাইরে কালো মাছিদের আতীক্ষ্ণ কলরব স্তব্ধ হয়ে গেছিল আচমকা, বাইরে জমায়েত কোলাহল মুখর লোকজনের কলরব ছাপিয়ে শোনা গেছিল একটা রক্তজমানো ডানা ঝাপটানির করাল আওয়াজ। আকাশের চাঁদের পটভূমিকায় দেখা গেছিল, ডানাওয়ালা পর্যবেক্ষকদের বিপুল একটা দল মেঘের মতন ভেসে ভেসে উড়ে চলে যাচ্ছে পূর্ণচন্দের পট ভূমিকায়… এসেছিল শিকারকে পাকড়াও করতে, না পেরে নিরাশ হয়ে চম্পট দিচ্ছে বায়ুবেগে।
আচমকা কুকুরটা নিঃসীম আতঙ্কে কুঁই কুঁই করে উঠেছিল গিয়ে খোলা জানলা দিয়ে লাফ মেরে চলে গেছিল বাইরে, ভেতরে এসেছিল তো এই জানলার মধ্যে দিয়েই। হইহই করে উঠেছিল বাইরের জনতা। চিৎকার করে ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক হুকুম দিয়েছিলেন দ্বাররক্ষীদের, পুলিশ অথবা ডাক্তার আসবার আগে যেন কেউ না ঢুকতে পারে ঘরের মধ্যে।
কপাল ভালো, গরাদবিহীন সেই জানলাগুলো মাটি থেকে ছিল যথেষ্ট উঁচুতে, উঁকি দেওয়া ছিল অসম্ভব। পুরু পর্দা টেনে দিয়েছিলেন প্রতিটি জানলায়। ততক্ষণে এসে গেছিল দুজন পুলিশ চৌকিদার। গলিপথে তাদের পথরোধ করেছিলেন ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক। বলেছিলেন, নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই এই মুহূর্তে ওই ঘরে ঢোকাটা সমীচীন হবে না, দুর্গন্ধ অসহ্য। আগে আসুক পরীক্ষক। এই বলে চাদর দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিয়েছিলেন মেঝের ওপর লম্বমান কিম্ভূত কায়াটাকে।
ইতিমধ্যে রক্ত জল করা পরিবর্তনের পর পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল মেঝের ওপর। ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক আর প্রফেসর ডিক্সিটের চোখের সামনেই মেঝেতে পড়ে থাকা কলেবরটা ভেঙে চুরে গুটিয়ে মুটিয়ে এতটুকু হয়ে যাচ্ছিল, মুখ আর হাত ছাড়া ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের অবয়বে নিজস্ব বলতে গেলে কিছুই আর ছিল না। চিকিৎসক যখন এসেছিলেন তখন তিনি দেখেছিলেন খানিকটা চকচকে সাদাটে আধার মতন বস্তু লেগে রয়েছে মেঝেতে, রক্ত জল করা সেই দানবিক দুর্গন্ধও আর নেই বলা চলে। ক্ষিতি ক্ষেত্ৰপালের যেন কোনও করোটি অথবা অস্থিময় কঙ্কাল দেহই ছিল না, দেখেশুনে যা মনে হয়েছে। চেহারাটাকে বাগিয়ে নিয়েছিল অনেকটা তার অজানা পিতৃদেবের আদলে।
৭
অথচ এই সবই কিন্তু মূল মহাকাল বিভীষিকার ভূমিকা, উদ্ভট কাণ্ডকারখানা দেখে বিলকুল বিমুঢ় সরকারি কর্মচারীরা করণীয় যা করবার করে গেছিলেন। অস্বাভাবিক খুঁটিনাটি কিন্তু চেপে যাওয়া হয়েছিল, পাবলিক যেন জানতে না পারে, সেদিকে নজর দেওয়া হয়েছিল। খোঁজ নেওয়া হয়েছিল পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের উত্তরাধিকার খোঁজার ব্যাপারে। প্রকৃত ওয়ারিশ ভূসম্পত্তি তার কাছেই যেন যায়, তাই। এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারিও হয়ে গেছিল।
গোটা তল্লাটটা কিন্তু ক্ষেপে গেছিল এই সময়ের মধ্যেই। কেননা, পাহাড়ে পাহাড়ে শোনা যাচ্ছিল গুরু গুরু গুম গুম আওয়াজ, সেই সঙ্গে নাকে ভেসে আসছিল অস্বাভাবিক দুর্গন্ধ, সেই সঙ্গে ডানা ঝাপটানি ঝটপট আওয়াজ ক্রমশ বেড়ে গেছে এই শব্দলহরী… আওয়াজের উৎসস্থল কিন্তু পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের তক্তামারা আবাসস্থল। এখন খাঁ-খাঁ করছে। কিন্তু অদ্ভুত যত আওয়াজ আসছে তো ওইদিক থেকেই। পাহাড়ির অনুপস্থিতিতে গরু-ছাগল দেখভালের ভার ছিল যে ছোকরার ওপর, সে তো ঘাবড়ে গেল রীতিমতন, হাত-পা ঠান্ডা মেরে যায় আর কী। কেউ নেই ফাঁকা বাড়িতে। কিন্তু এত আওয়াজ করছে কে বা কারা? ভৌতিক ব্যাপার নিঃসন্দেহে তালে তাল মিলিয়ে সরকারি অফিসাররাও হানাবাড়ির ভেতর পা দিতে চাইল না একেবারেই। তদন্ত চালিয়ে গেল শুধু ছাউনিগুলোয়, সেখানে নিবাস রচনা করেছিল পরলোকগত পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল। তাও এই তদন্ত চলেছিল একবারই, নিয়ম রক্ষে করে দ্বিতীয়বার ওই ছাউনি ছায়া মাড়াতেও কেউ আর আসেনি। তারপর ইয়া মোটা একটা রিপোর্ট দিয়েছিল আদালতে, অগণ্য ক্ষেত্রপালদের কে এই হানাবাড়ি দখলে আনবে, কোর্ট তা ঠিক করে দিক। পুঁথিপত্র আর বইয়ের তাক থেকে পাওয়া গেছিল একটা ইয়া মোটা জাবদা খাতা… প্রকাণ্ড একটা দিনলিপি… অদ্ভুত হরফে লিখে ভরিয়ে দেওয়া প্রতিটি পৃষ্ঠা। দুর্বোধ্য শব্দ আর ভাষায় দাঁত ফোটানোর বিদ্যে কারও ছিল না বলে মর্ম উদ্ধার করা যায়নি। রকমারি কালি দিয়ে লেখা। হাতের লেখাও একরকম নয়। অদ্ভুত সেই দিনলিপি মুণ্ড ঘুরিয়ে দিয়েছিল প্রত্যেকের। দিন সাতেক এই নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্কের পর সেই ডায়েরি আর অন্য সব পুঁথিটুঁথি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সবচেয়ে কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ে— তারাই যদি বুঝতে পারে এই সবের অর্থ আর মর্ম। বহু ভাষাবিদ ছাড়া বিদঘুটে এই কেতাব-টেতাবের মানে বুঝবে কে? অতি প্রাচীন যে সব স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দেনা মিটিয়ে গেছে পাহাড়ি আর ক্ষিতি এতদিন, সেই স্বর্ণমুদ্রা ভাণ্ডারের কোনও সন্ধান আর পাওয়া যায়নি।
সেপ্টেস্বর মাসের ন তারিখের অমাবস্যার অন্ধকার রাতে মূর্ত হয়েছিল নিঃসীম বিভীষিকা। সেই দিন রাতে উদ্দাম উল্লোল হয়ে উঠেছিল চৌকিদার পাহাড় রকমারি আওয়াজে। যেন কত কাণ্ডকারখানাই না চলছে সেখানকার গিরিগুহার অন্দরে কন্দরে। সারারাত ধরে তারস্বরে চেঁচিয়ে গেছিল তল্লাটের, সমস্ত সারমেয়। যেন মাথার ঘিলু পর্যন্ত নড়ে গেছিল প্রত্যেকেরই, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম থেকে উঠে পড়া যাদের অভ্যেস, তারা দশ তারিখের ঊষালগ্নে টের পেয়েছিল অদ্ভুত একটা দুর্গন্ধ ভাসছে বাতাসে। সাতটা নাগাদ হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসেছিল ভার্গব উপাধ্যায়— সে থাকে পাশের গ্রামে— যাদের বাঁধাধরা লোক নেই, তাদের গরুমোষ ছাগল নিয়ে যায় পাহাড়ে পাহাড়ে ঘাস জল হাওয়া খাওয়ানোর জন্যে। ভয়ে কাঁপছিল ঠক ঠক করে। পেছনে পিল পিল করে দৌড়ে এসেছিল তার রক্ষণাবেক্ষণে থাকা সমস্ত পশুর দল— তারাও যেন নিদারুন ভয় পেয়ে খুর ঠুকে ঠুকে শিং নেড়ে নেড়ে গলাবাজি করে যাচ্ছিল বিরামবিহীনভাবে। হাঁপাতে হাঁপাতে দম নিয়ে নিয়ে ভার্গব উপাধ্যায় যা বলে গেছিল পাড়ার সকলের মাসি দুর্গা মাসিকে, তা এই:
“মাসি গো, একি দেখে এলাম আমি… পাহাড়ের ফাঁকে যে ঘাস মাঠ, সেখানে যেন দলে দলে হাতি চলে গেছে… কী বিটকেল গন্ধ… বমি পায়… পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যখন গেছে, তখন ঘাস আর ঝোপ এমনভাবে দুমড়ে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে যে দেখলেই মনে হয় যেন আস্ত একটা বাড়িকে সেইসব জায়গা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে… আরও আছে, আরও আছে… রাস্তায় পায়ের ছাপ ফেলে গেছে… গোল গোল বিরাট পায়ের ছাপ… ঠিক যেন পিপের মাথা… মাটির মধ্যে চেপে চেপে বসে যাওয়া দাগ — যেন একটা হাতি গেছে হেঁটে হেঁটে … কিন্তু প্রায় চার ফুট মাপ এক-একটা পায়ের ছাপের হাতির পায়ের ছাপ অত বড় হয় না… বিটকেল সেই সব ছাপের একটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে ভয়ের চোটে আমার প্রাণ উড়ে যেতে বসেছিল… পাঁই পাঁই করে দৌড়েছি… কী ভীষণ? কী ভীষণ? মাঝখান থেকে লাইন চলে গেছে বাইরের দিকে প্রতিটা পায়ের ছাপে… একটা হাত পাখা যত বড় হয়, সাইজের তার চাইতে দু-তিন গুণ বড় অতিকায় এই পা ফেলে ফেলে রাস্তা বরাবর হেঁটে গেছে। এই দৈত্য… সেই সঙ্গে রেখে গেছে বিশ্রী বিকট একটা দুর্গন্ধ… ঠিক যে রকম জঘন্য গন্ধ পাওয়া যায় পাহাড়ি ক্ষেত্ৰপালের জঘন্য বাড়ির মধ্যে… আশপাশে…
এই পর্যন্ত বলেই কথা আটকে ফেলে ছিল বেচারা ভার্গব… ভয়ের চোটে তার চোখ কোটর থেকে প্রায় ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল বললেই চলে। দুর্গা মাসি তার পেট থেকে আর কথা টেনে বের করতে না পেরে খবর দিয়েছিল পাড়াপ্রতিবেশীদের। ফলে, নিদারুণ আতঙ্কের প্রথম সঞ্চার-পর্ব ঘটিয়ে দিয়েছিল গোটা এলাকায়, খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছিল কুন্তীবালা— পাড়ার রয়টার ফলে দাবানলের মতন খবরটা ছড়িয়ে গেছিল গোটা তল্লাটে। কুন্তীবালার ছেলে কর্ণ যেহেতু রাতে ভালো ঘুমোত পারে না, তাই রাত থাকতেই বেরিয়ে যায় মাঠে মাঠে পাহাড়-টাহাড়ে। খবরটা শুনেই সে দৌড়েছিল অদ্ভুত প্রকাণ্ড পায়ের ছাপ দেখতে। দেখেই তিড়িং মিড়িং করে লাফাতে লাফাতে ফিরে এসে বলেছিল দুর্গা মাসিকে— হ্যাঁ গো মাসি, সব সত্যি, যেখানে ঠাকুর মশায়ের গরু ছাড়া থাকে সমস্ত রাত, দেখে এলাম সেই জায়গাটা। পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের বাড়িটাও তো ছাই দেখতে পেলাম না… যেন উড়ে গেছে রাতারাতি… চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঠের কড়ি আর বরগা… যেন ডিনামাইট ফেটেছে বাড়ির মধ্যে… নীচের তলার মেঝেতে থুকথুক করছে। আলকাতরার মতন কুচকুচে কালো কি একটা জিনিস… কি বিচ্ছিরি গন্ধ… কাঠ থেকেও গড়াচ্ছে জিনিসটা… ছাউনির কাছে মাটিতে পড়েছে বড় বড় পায়ের ছাপ… মোষের মাথার চাইতেও বড় ছাপ… ওপর পড়ে চটচটে কী একটা জিনিস… জিনিসটা লেগে রয়েছে ভাঙা বাড়ির সব জায়গায়… ছাপগুলো গেছে মাঠের দিকে… রাস্তা দিয়ে যেখান দিয়ে যেখান দিয়ে গেছে, সেখানকার সব কিছু ভাঙতে ভাঙতে গেছে।
“গরু মোষ ছাগল কিছু চম্পট দিয়েছিল ওদিককার মাঠে, কিছু যেন হাওয়ায় মিলিয়েগেছে… বড় বড় পায়ের ছাপ রয়েছে সব জায়গায় …ঠিক যেন খোদ শয়তান হেঁটে গেছে… ঠিক এইরকমই তো ঘটেছিল একবার… সাবিত্রীর বাচ্ছা হওয়ার সময়ে…
“এই সবের পালের গোদা ওই ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল … তার জন্মের পর থেকেই তো ঘটছে কত কি বিটকেল ব্যাপার… নিজে তো মানুষ ছিল না… যাদের দেখা যায় না, তারাও এখন চলে আসছে এই গ্রামে… যত উৎপাত তো ওর জন্মের পর থেকেই…
“কাল সারা রাত থরথর কেঁপেছে পায়ের তলার জমি ভোরের দিকে কালোমাছিরা বিটকেল চেঁচিয়েছে, ঘুমোতে পারিনি … কালোমাছির দঙ্গল এমন জঘন্যভাবে গোঁ-গোঁ-ভন-ভন করে গেছে যে ও পাড়ার বিষ্টু ঠাকুর পর্যন্ত দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি— সে নাকি কুম্ভকর্ণ কিন্তু তারও ঘুম ছুটে গেছে বিদিগিচ্ছিরি আওয়াজে… তখনই শুনেছে একটা অস্পষ্ট অদ্ভুত আওয়াজ জাদুকর পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের ম্যাজিক বাড়ির দিক থেকে… যেন মড়মড় করে কাঠ ভাঙা হচ্ছে, কাঠের বরগা যেন টেনেমেনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হচ্ছে… এরকম বিটকেল আওয়াজের মধ্যে কেউ কি ঘুমোতে পারে? বীভৎস… বীভৎস… গায়ে কাঁটা দেয়… তাই তো সারা রাত ঠায় বসে থেকেছে… ভোরের দিকে পা টিপে টিপে বেরিয়েছিল পাহাড়ি ক্ষেত্ৰপালের বাড়ির দিকে গিয়ে সারা রাতের হুলস্থুল কাণ্ড দেখবে বলে… যা দেখেছে, তাইতেই নাকি আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাচ্ছিল ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ব্যাপার… তল্লাটের সব জোয়ান যাক, গিয়ে দেখুক, কিছু একটা করুক… এ সব কী দানবিক উৎপাত শুরু হয়ে গেল এমন শান্তির জায়গায়…
“বিরাট বিরাট পায়ের ছাপগুলো গেছে কোন চুলোয়? না, না, মাসি, তোমার বাড়ির দিকে যায়নি… সটান গেছে পেল্লায় ওই পাহাড়টার দিকে… বড় বাজে পাহাড়… তা ছাড়া কালো মাছিরা তো কক্ষনো এইরকমভাবে কাতারে কাতারে গুঙিয়ে যায়নি… জোনাকিরা এরকম পালে পালে নেচে নেচে যায়নি… দেখে মনে হয়েছিল এই পাখিরা প্রাণীই নয়… ভগবানের তৈরি নয়… পিশাচ… পিশাচ। পাহাড় যেখানে খাড়া নেমে গেছে জলের দিকে, সেখানে নাকি সারা রাত ধরে কারা ছুটোছুটি করেছে, ফিসফাস করে কথা বলে গেছে… হে ভগবান… এ সব কী ঘটছে এই তল্লাটে?”
দুপুর নাগাদ মহাকাল শহরের পনেরো আনা মানুষ বেরিয়ে গিয়ে দেখতে গেছিল রাস্তার পেল্লায় অমানবিক প্রকৃতই দানবিক পদচিহ্ন, সেইসব পায়ের ছাপ অথবা থাবার ছাপ যেন পাহাড়ি ক্ষেত্ৰপালের ভেঙে চুরমার মাটিতে মিশে যাওয়া বাড়ির দিক থেকেই চলে গেছে পাহাড়ি প্রান্তরের দিকে, যেখানে বাড়ির দিক থেকেই চলে গেছে পাহাড়ি প্রান্তরের দিকে, যেখানে চরছিল গরু মোষ ছাগল ভেড়া— দেখেছে রক্ত থই থই করছে সেখানে, অসহায় কেষ্টর জীবগুলো এক্কেবারে নিরুদ্দেশ… গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড থাবার ছাপ দেখে… দেখে মনে হয়েছে যেন বিরাট একটা বাড়িকেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের বাড়ির দিক থেকে চৌকিদার পাহাড়ের দিকে… সামনে পা পড়েছে, তছনছ হয়ে গেছে প্রায় খাড়াইভাবে নীচের জলে দিকে নেমে গেছে বিরাট বিরাট সেই পায়ের ছাপ… নীচ থেকে কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি… থমথম করছে চারদিক… নাকে ভেসে এসেছে শুধু একটা দূরায়ত বিটকেল দুর্গন্ধ… সে গন্ধ যে কীসের হতে পারে, অনেক মাথা খাটিয়েও কেউ তা বুঝতে পারেনি… উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সব্বাই কথা কাটাকাটিই করে গেছে, কিন্তু প্রায়-খাড়াই পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে দেখে আসবার মুরোদ কারও হয়নি… সঙ্গে ছিল তিনটে দাঙ্গাবাজ কুকুর… খুব তড়পে ছিল প্রথম প্রথম, তারপর ল্যাজ গুটিয়ে কুঁই কুঁই করে গেছিল… রক্তমাখা মাঠে বা নীচের জলের দিকে যাওয়া মুরোদে কুলোয়নি…
খবরের কাগজের লোকরা অবশ্য এই ছাঁকা খবর পেলে বিষম উৎসাহে তাতে রং ছড়িয়ে পাবলিককে খাওয়ানোর মতো লম্বা লম্বা লেখা লিখে ফেলে। এক্ষেত্রে তার অন্যথা হয়নি। সে সব লেখার মধ্যে ছিল হাসি-টিটকিরি… পাহাড়ি মানুষদের বন্য কল্পনায় নাকি এসে গেছে পাহাড়ের উপদেবতার রংচঙে কাহিনি… তোবা! তোবা!
রাত নামতেই তল্লাটের প্রত্যেকেই সেঁধিয়ে গেছিল যে যার বাড়ির মধ্যে, প্রত্যেকটা বাড়ির বেড়া আর দরজা মজবুত আছে কিনা দেখে নেওয়া হয়েছিল। ঘরের পোষা কোনও প্রাণী যেন খোলা জায়গায় না থাকে, সেদিকে নজর দেওয়া হয়েছিল।
রাত দুটো নাগাদ একটা বিষম বোঁটকা বিদিগিচ্ছিরি দুর্গন্ধ আর তল্লাটে সমস্ত সারমেয়দের একযোগে ঘেউ ঘেউ ডাক সচকিত করে তুলেছিল সব্বাইকে। পাহাড় যেখানে খাড়াই নেমে গেছে জলের দিকে, সেইদিক থেকেই যে একটা ডানা ঝাপটানির আওয়াজ ভেসে আসছে, এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকেনি কেউই। তার পরেই শোনা গেছিল মড়মড় আওয়াজ, ঠিক যেন প্যাঁকাটির মতন মচমচাৎ করে ভেঙে যাচ্ছে বনের গাছপালা। এর পরেই অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ ঠিকরে এসেছিল গরু মোষ ছাগল ভেড়া শুয়োর যেখানে থাকে, সেই দিক থেকে। রক্ত জল করা আর্ত চিৎকার ছেড়ে যাচ্ছে অসহায় চতুস্পদরা… কুকুর পুঙ্গবরা ল্যাজ গুটিয়ে তখন ঠাঁই নিয়েছিল ঘরোয়া মানুষজনের পায়ের তলায়… একজন একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে ছিল অভ্যেস মতন, ঘরের পশুরা যেখানে থাকে সেখানে গিয়ে দেখবে বলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চৌকাঠ পেরোনোর মুরোদ হয়নি। বাড়ির মেয়েরা আর বাচ্ছাকাচ্ছারা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারেনি, সহজাত হুঁশিয়ারি বোধের জন্যে কেউ বলে না দিলেও কে না জানে এরকম অবস্থায় চেঁচালেই প্রাণ উড়ে যেতে পারে নিমেষ মধ্যে… তারপর একটা সময়ে করুণ আর্তনাদ করে উঠেছিল ঘরোয়া জানোয়ারের দল পরক্ষণেই শোনা গেছিল একটা ধুপধুপ মচাৎ মচাৎ আওয়াজ…
সেই আওয়াজ দূর হতে দূরে মিলিয়ে যাওয়ার আগে কেউ আর নড়তে পারেনি যে যার জায়গা ছেড়ে… রহস্যময় রুধির জমানো ধুপধাপ মচাৎ মচাৎ আওয়াজ একটু একটু করে মিলিয়ে গেছিল পাহাড়ের পাশের জলাধারের দিকে…
অমনি একযোগে করুণ আর্তনাদ করে উঠেছিল খাটালে খাটালে গরু বাছুর মোষ, ছাগল ভেড়ারা কুঁই কুঁই আর্তনাদ ছেড়েছিল যে যার আস্তানায়, একটানা গা শিউরোনো ডাক ডেকে গেছিল পল্লীর সারমেয়বাহিনী… ল্যাজ গুটিয়ে রেখে।
আর ঠিক সেই সময়ে মড় মড় করে কী সব যেন ভেঙে ভেঙে গেছিল, দুমদাম শব্দে অনেক কিছু আছড়ে আছড়ে পড়েছিল, খান খান হয়ে ছত্রাকার হয়ে যাচ্ছে যেন কত কী?
এই সবের মধ্যেই ধাপে ধাপে রাগ-রাগিণী বাড়িয়ে নিয়েছিল দূরায়ত কালো মাছিদের কোরাস গান যেন মহা উল্লসিত… এইভাবেই মহাকাল অঞ্চলের দ্বিতীয় পর্বের বিভীষিকা শুরু হতেই খবরটা যেন হাওয়ায় ছাড়িয়ে গেছিল দিকে দিকে… গ্রাম পাহাড়ের মানুষরা এসব ব্যাপারে বড় পোক্ত… কোথায় লাগে এ যুগের ইন্টারনেটের সংবাদ পরিবেশন?
পরের দিনই গোটা তল্লাটে প্যানিক ছড়িয়ে পড়ল বায়ুবেগে। গ্রাম-পাহাড় খবর ছোটে হাওয়ার বেগে। দুরুদুরু বুকে অনেকেই রগড় দেখবার অভিপ্রায় নিয়ে ছুটল পাহাড়ি রাস্তার ওপর আঁকা অমানবিক দানবিক পদচিহ্ন দেখবার প্রয়াস নিয়ে। হুজুগ এমনই জিনিস, দেখা গেল দুটো অতিকায়-পদচিহ্ন পাহাড়ের দিক থেকে গ্রামে ঢুকে ফের ফিরে গেছে পাহাড়ের দিকে পথের সব কিছু তছনছ করতে করতে… ঠিক যেন চলমান প্রলয় …নারকীয় আতঙ্ক… খামার বাড়ি দানবিক পায়ের চাপে দেবে ঢুকে গেছে মাটির মধ্যে… পুরোপুরি…
গরু-বাছুর-মোষ-ছাগল ভেড়াদের চার ভাগের একভাগই পাওয়া গেলে যথাস্থানে বাকি সব নিরুদ্দেশ। যাদের পাওয়া গেল, তারা এমনই অদ্ভুতভাবে জখম অবস্থায় ছিল যে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। আর যারা পড়েছিল অদ্ভুতরকমভাবে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায়, তাদের ওপর গুলি চালনার আর প্রয়োজন হয়নি।
এহেন নৈশ তাণ্ডবের পর করণীয় কী? মাথাওয়ালাদের মিটিং হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সহমত হল প্রত্যেকেই। কল্পনাতীত এই পাহাড়ি উপদ্রবকে ঠেঙিয়ে ঢিট করার ক্ষমতা পুলিশটুলিশের নেই… অপদেবতাদের শায়েস্তা করতে হলে, তাদের রোষবহ্নি নেভাতে গেলে তো দরকার যাগযজ্ঞ। যেমন উপদ্রব, তেমনি মন্ত্র। যেমন কুকুর, তেমনি মুগুড়, উৎপাত আসছে তো চৌকিদার পাহাড়ের থামঘেরা চুড়োর দিক থেকেই… কিংবদন্তি বাসি হলেও তার ধার কমে না দেখাই তো গেল… পাহাড়ের ওপরকার ওই প্রস্তর বেদিই তো এক সময়ে ছিল পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল আর তস্য নমসঃ পুত্রের আরাধনা ক্ষেত্র।
সুতরাং যাগযজ্ঞ মন্ত্রতন্ত্র প্রয়োগ করে আপদ ঠেকানোই হবে সমীচীন পদক্ষেপ।
এহেন প্রস্তাবে একমত হল আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকা গ্রামের আপামর মানুষ। উচ্চনীচ প্রত্যেকে। নৈশ আতঙ্কের সুরাহা করা হোক মারণ মন্ত্র-তন্ত্র দিয়ে।
রাত নামতেই রাস্তার ওপর গাছের গুঁড়ি আর পাথর ফেলে রাস্তা বন্ধ করা হয়েছিল, প্রতিটি বাড়ির দরজার খিল মজবুত করা হয়েছিল। তবে, এ-বাড়ি ও-বাড়ি মিলে মাথা গুঁতিয়ে আড্ডা মারার সাহস আর কারোর হয়নি, গুলতানি মারার জায়গাগুলোয় রকবাজি করার মুরোদ কেউ দেখায়নি।
সকালের দিকে দুর্গা মাসি আর পাড়ার রয়টার কুন্তীবালা গ্রামময় ছড়িয়ে দিল একটা খবর। কুকুরদের চেঁচামেচি ভেসে এসেছে অনেক দূর থেকে, সেই সঙ্গে একটা বিজাতীয় আবছা আওয়াজ, তৎসহ একটা বিষম বিটকেল বর্ণনাতীত দুর্গন্ধ… অনেক দূর থেকে… ভোরের দিকে যারা শয্যাত্যাগ করে প্রাতঃভ্রমণে বেরোয়, তারাও এসে খবর দিল চৌকিদার পাহাড়কে ঘিরে থাকা পার্বত্যপথে ফের দেখা গেছে দানবিক পদচিহ্ন। আগের মতনই পথের দু-পাশের গাছপালা থেকে আরম্ভ করে সব কিছু যেন দানবিক আক্রোশে তছনছ অবস্থায় রয়েছে। সেই সঙ্গে দেখা গেছে দু-সারি টাটকা পদচিহ্ন। চলমান পর্বত যেন পাহাড়ের পাশের জলময় অঞ্চল থেকে দুপদাপ করে এসে ফিরে গেছে সেইখানেই একই পথ মাড়িয়ে। পাহাড়ের তলা থেকে একটা কিছু তিরিশ ফুট জায়গার গাছপালা তছনছ করতে করতে সটান উঠে গেছে ওপর দিকে। এ দৃশ্য যারা দেখেছে, চক্ষুস্থির হয়ে গেছে তাদের একটা ব্যাপারে। এমন খাড়াই পাথুরে জায়গা দিয়ে এমনভাবে কিছু একটা যে পর্বতারোহন করতে পারে, এরকম ঘটনা দূরতম কল্পনা দিয়েও যে ভাবা যায় না। অন্যপথ বেয়ে, পাকদণ্ডী দিয়ে, ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের মাথায় উঠে তদন্তকারীরা দেখেছিল, ভয়াল ভয়ঙ্কর সেই শরীরী আতঙ্ক পাহাড় থেকে একই রকম অবলীলাক্রমে নেমে গেছে সেই পথ দিয়েই।
যে জায়গাটায় উঠে গিয়ে রহস্যজনক এই সত্তা ফের নেমে এসেছে, ঠিক সেই জায়গাটাতেই তো পাথরের বেদির ওপর বিবিধ নারকীয় পূজা অর্চনা যাগ যজ্ঞ এতদিন চালিয়ে গেছিল পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল তার গুণধর বিকৃতদেহী পুত্রকে নিয়ে। এখন দেখা গেল প্রকাণ্ড সেই গোলাকার বেদীর চর্তুদিকের অনেকখানি জায়গা জুড়ে প্রলয় নৃত্য দিয়ে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করে গেছে নিশীথ রাতের পর্বতাকার আতঙ্ক। বেদির মাঝখানটা সামান্য দেবে থাকায় সেখানে জমে রয়েছে বেশ খানিকটা থকথকে আলকাতরার মতন কালো জিনিস, যে জিনিসটা প্রচুর পরিমাণে দেখা গেছিল ক্ষেত্রপাল ভবনের ধ্বংসস্তূপে সেই রাতের পর যে রাতে চম্পট দিয়েছিল নিশীথ রাতের দানবিক বিভীষিকা। শিহরিত কলেবরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সবাই অস্ফুট মন্তব্য করেছে এমনভাবে যে পাশের মানুষও তা শুনতে পায়নি— পাছে করাল কিছু ঘটে যায় এই ভয়ে। তারপর অবশ্য সবাই মিলে তাকিয়ে ছিল পাহাড়ের নীচের দিকে। দেখে মনে হয়েছিল, নৈশ আতঙ্ক যেন যে পথ দিয়ে আরোহন করেছে, সেইরকম অন্য একটা পথ দিয়েই অবতরণ করেছে। সঠিক সিদ্ধান্ত আনা বৃথা।
বৃহস্পতিবারের রাত শুরু হয়েছিল অন্য অন্য রাতের মতনই। তবে রাত ফুরিয়েছে গায়ে কাঁটা জাগিয়ে দিয়ে তল্লাটের সমস্ত ভনভনে কালো মাছি দঙ্গল বেঁধে কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে গেছে, অস্বাভাবিকরকম বিরামবিহীনভাবে, ফলে কেউ ঘুমোতে পারেনি, রাত তিনটে নাগাদ একটা ভয়ানক শব্দ শোনা গেছিল… যেন আকাশ পাতাল একই সঙ্গে কেঁপে গেছিল নিদারুণ সেই শব্দ বিস্ফোরণে… অনেক দূর থেকে ভেসে এসেছিল পরিত্রাহি চিৎকারের রেশ— ‘বাঁচাও! হে ঠাকুর, এই কালান্তকের খপ্পর থেকে বাঁচাও!’ আর্ত চিৎকারটা নারী কণ্ঠের। এক নারীকণ্ঠ নয়, দুই নারীকণ্ঠ। তালে তাল মিলিয়ে যেন রণভেরী বাজিয়ে আকাশ বাতাস চৌচির করে দিতে চেয়েছিল রাজ্যের ভন ভনে কালো মাছির দল তুমুল কাড়া না কাড়া ঐকতানে… সেই সঙ্গে মাটি কাঁপানো একটা চাপা আওয়াজ… তারপর সব চুপচাপ।
ফলে, বাকি রাতটা ঘুম নামেনি কারোর চোখে।
ভোরের দিকে সবাই গুটি গুটি বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। মাটি কাঁপানো নিনাদটা যেদিক থেকে ঠিকরে এসেছিল, সেদিকে গুটি গুটি যেতে যেতে দেখতে পেয়েছিল পথের ওপর রয়েছে সেই রকম অদ্ভুত বিশাল অজানা কিছুর সৃষ্টিছাড়া পায়ের ছাপ।
তারপরেই দেখা গেছিল থকথক করছে মিশকালো আলকাতরার মতন চটচটে একটা বস্তু বিশেষ একটা জায়গায়, যে জায়গায় থাকা উচিত ছিল পাড়ার রয়টার কুন্তীবালা আর দুর্গা মাসির বাড়ি।
এখন নেই। তল্লাট থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে দু-দুখানা পাশাপাশি বাড়ি। যেন ডিমের খোসার মতন ভেঙে গুঁড়িয়ে ঢুকে গেছে মাটির মধ্যে। বাতাসে ভাসছে একটা নারকীয় দুর্গন্ধ। মাটিতে লেগে চটচটে কালচে একটা পদার্থ।
৮
ইতিমধ্যে অন্য একটা নাটক জমে উঠেছে ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক যে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক, সেইখানে। উনি তো শুধু গ্রন্থাগারিকই ছিলেন না, বহুবিধ পাণ্ডিত্যের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা গবেষণা বিভাগের অধ্যক্ষও ছিলেন। তাঁর ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ ছিলেন সংস্কৃতে মহাপণ্ডিত, সেই বংশগতি অর্জন করে তিনি অধ্যায়ন করেছিলেন এই ভূগোলকের বহু প্রাচীন ভাষা। লাইব্রেরিয়ান পদে কৃত থেকেছিলেন স্বইচ্ছায়, অধিকতর জ্ঞান অন্বেষণের স্পৃহায়। চুম্বকের কাছে থাকলে লোহাও নাকি চুম্বক হয়ে যায় এ বিশ্বাস তাঁর আছে।
তাই তিনি ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের ডায়েরি জোগাড় করে নিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত অধ্যায়ন করে গেছেন ঘরে খিল তুলে দিয়ে। দিনলিপি তো নয়, যেন একটা দলিল, লিখে যাওয়া হয়েছে বহু দিবস বহু রজনীতে নিদারণ নিষ্ঠা নিয়ে। নিছক দিনলিপি তাকে বলা যায় না, যেন একটা অদ্ভুত পাণ্ডুলিপি। অবিশ্বাস্য ব্যাপার-স্যাপারের নিখুঁত প্রতিবেদন। ভাষাটা দুর্বোধ্য বলে অনেক মেহনত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামি ভাষাবিদদের দিয়ে তর্জমাও করিয়ে নিয়েছেন। তখনই মাথা ঘুরে গেছিল ভাষাবিদদের। অথচ তাঁদের সমান দখল ছিল প্রাচীন আর আধুনিক— এই দুই ভাষার জগতে। অদ্ভুত পাণ্ডুলিপি হরফগুলোকে মনে হয়েছে যেন মেসোপটেমিয়ার আরব্য ভাষার কাছাকাছি যায়, অনেক বেশি ধোঁয়াটে, এমনই একটা বিচিত্র ভাষা যে ভাষা একেবারেই অজানা নামি ভাষাবিদদের কাছে। অনেক মাথা খাটানোর পর পণ্ডিতরা এক বাক্যে বলেছিলেন, দিনলিপি লেখা হয়েছে একটা কৃত্রিম হরফমালা দিয়ে, দেখলে যেন মনে হয় গুপ্ত সঙ্কেতে লেখা। অথচ সাঙ্কেতিক ভাষার বৈজ্ঞানিকচর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা হালে পানি পাননি বিদঘুটে সেই ভাষা দেখে। সব সাঙ্কেতিক ভাষার মানে বোঝার জন্যে একটা-না-একটা ক্লু অর্থাৎ সূত্র থাকে। এই ভাষার কোনও ক্লু তাঁদের জানা ছিল না। গ্রন্থাগার থেকে টেনে নামানো হয়েছিল অতি প্রাচীন পুঁথি আর কেতাব, বৈজ্ঞানিক আর গ্রন্থাগারিকরা দিবস রজনী মাথা খাটিয়ে গেছেন দুর্বোধ্য হরফের মর্মোদ্ধার করতে, কিন্তু হালে পানি পাননি। সোনার পাত দিয়ে মোড়া একটা পুঁথির হরফগুলো মনে হয়েছিল সংস্কৃত, আদতে তার চেয়েও প্রাচীন। এই পুঁথিটা তুলে দেওয়া হয়েছিল ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েকের হাতে, যেহেতু এই খটমট ব্যাপারটা নিয়ে তিনিই বেশি মাথা ঘামাচ্ছিলেন। তা ছাড়া, তিনি বহুভাষাবিদও তো বটে। সুপ্রাচীন ভাষার মানে বুঝতে পারেন। মধ্যযুগীয় প্রহেলিকার ধোঁয়াশা কাটিয়ে দিতে পারেন।
ওঁর নিজস্ব একটা সিদ্ধান্ত ছিল এই ব্যাপারটায়। ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল যে ভাষায় দিনলিপি লিখে গেছে, সে ভাষা অতি প্রাচীন, চালু ছিল কিছু অধুনা নিষিদ্ধ ধর্মীয় পদ্ধতির মধ্যে। যে সময়ে ধর্মযুদ্ধ হয়, সেই সময়ের আরববাসী মুসলমানদের বলা হত স্যারাসেন। তখনকার জাদুকররা এই ভাষা ব্যবহার করে গেছে তাদের জাদু কেতাবে। কিন্তু তা নিয়ে খুব বেশি ভাবেননি ডক্টর পট্টনায়েক। সাংকেতিক হরফ নিয়ে ভেবে কি হবে? সবই তো প্রতীক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ সবের উৎস জেনেও তো লাভ নেই। উনি আঁচ করে নিয়ে ছিলেন, এ লেখা যার হাত থেকে বেরিয়েছে, সে বিশেষ কিছু ফরমুলা আর মন্ত্র যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্যই অতি-প্রাচীন এই ভাষার শরণ নিয়েছে, নইলে যে অর্থ আর কার্যকারিতা যথাযথ হবে না।
সহযোগীরা বারংবার মানে বুঝতে ব্যর্থ হলেও ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক ধরে ফেলেছিলেন গূঢ় প্রহেলিকা কতখানি জটিল। অতিপ্রাচীন একটা ভাষা ব্যবহার করে প্রচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে অতি আদিম একটা মহাসত্যকে, যার আভাসমাত্রে গা ছমছম করে ওঠে, অথচ নাগাল ধরা যায় না। বুঝে গেছিলেন, কোনও সরল পন্থা দিয়ে এহেন জটিলতাকে বুঝে ওঠা যাবে না। গোটা আগস্ট মাসটা ক্রিপটোলজি অর্থাৎ সাঙ্কেতিক ভাষার বৈজ্ঞানিকচর্চা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। রাশি রাশি কেতাব আর পুঁথি ঘেঁটেছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আর ভাষাবিদদের কাছে ধর্না দিয়েছেন। তারপর বুঝে ফেলেছেন ব্যাপারটা। এ পুঁথি লেখা হয়েছে এমনই একটা ভাষায় যে ভাষার হরফগুলো সাজানো হয়েছে নামতার প্রণালীতে। অজানিত এই বর্ণমালায় অক্ষরের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে একটা করে সাঙ্কেতিক চিহ্ন সে সব প্রতীকি চিহ্নের অর্থ জানে শুধু লেখক নিজে। গুপ্ত মন্ত্রদীক্ষায় দীক্ষিত যে, সে ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় এক-একটা প্রতীকের অর্থ কীরকম ব্যাপক আর গভীর হতে পারে। এহেন প্রতীকি-বর্ণমালা সর্বসাধারণের জন্য নয়, মন্ত্রদীক্ষায় দীক্ষিত যারা, শুধু তারাই জেনেছে উত্তরাধিকার সূত্রে। রহস্যময় পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে লাগবে বলে। মাঝে মাঝে অর্থের সন্নিকটে এসেও ব্যর্থ হয়েছেন, যেন একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে আর এগোতে দেয়নি। মেঘ কাটেনি। তারপর সেপ্টেম্বর মাসে যখন কড়া নাড়ছে, তখন কুয়াশা কাটতে থাকে। স্পষ্ট বুঝতে পারেন। পুরো বয়ানটা লেখা হয়েছে দেবনাগরী ভাষায়। প্রাগবৈদিক আমলে সংস্কৃত যেরকম থাকা উচিত, সেই হরফে। মানব সভ্যতা যখন উন্মলিত হতে চলেছে, তখনকার সময়ের। ভাবতেই ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েকের মস্তিষ্ক ঘূর্ণিত হয়েছিল। এ কোন অতি-আদিম প্রহেলিকা আবর্তে তিনি ঘুরপাক খাচ্ছেন?
সেপ্টেম্বর মাসের দু-তারিখে সন্ধে নাগাদ কেটে গেল শেষ ধোঁকা। সেই প্রথম ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের লেখা দিনলিপির টানা মর্মোদ্ধার করতে পারলেন ডক্টর পট্টনায়েক, অতি-ভয়ঙ্কর দিনলিপি। স্পষ্ট বোঝা গেছিল, এ লেখা যে লিখেছে, তার পেটে বিদ্যে কম, গূঢ় শাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞানটা পাঁচমিশেলি। ১৯১৬ সালের ২৬ নভেম্বরে লেখার প্রথম পৃষ্ঠাটা পড়েই আঁৎকে উঠেছিলেন ডক্টর পট্টনায়েক। সে লেখা লিখেছে সাড়ে তিন বছর বয়সের এক শিশু, যদিও চেহারার দিক দিয়ে সে বারো কী তেরো বছরের সাবালক। আজকের তন্ত্রাচারে কালপুরুষ জবাব দিতে চায়নি পাহাড়ের মধ্যে থেকে, অথবা আকাশ থেকে। ওপরতলা এখনও আমার নাগালের বাইরে। এই পৃথিবীর মগজের বাইরে। সাধু গেঁইয়ার কুকুরটা আমাকে কামড়াতে এসেছিল। দাদু তো বলেই যাচ্ছে গো মন্ত্রটাই ঠিক। হরদম আউড়ে যেতে বলেছে। মনে হল যেন দেখতে পেলাম, দুই মেরুর ভেতর দিকে রয়েছে দুটো শহর, চৌম্বক বিন্দুতে। পৃথিবীকে সাফ করে দিয়ে ওখানেই যেতে হবে আমাকে। তার আগে ধো-না ছবি-সঙ্কেতের মানে বুঝতে হবে। আকাশ থেকে ওরা আমাকে বলে গেল। আর এক বছরের মধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারব। মনে হয়, তার আগেই দাদু মারা যাবে। আমাকে তখন একাই শিখতে হবে সব কৌণিক রহস্য, ছবি সঙ্কেত। বাইরে থেকে ওরা আমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু ওরা যে নররক্ত ছাড়া শরীর ধারণ করতে পারে না। ওপর তলাটাই সঠিক ছাঁচ। ইবেন গাজীর পাউডার ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে অথবা ভুরিশ ছক আঁকলে ওদের আমি দেখতে পাই। পাহাড়ের মাথায়। পৃথিবীর যখন সাফ হয়ে যাবে, কোনও পার্থিব প্রাণী যখন আর থাকবে না, তখন তো এদেরকেই দেখতে হবে। ভয় করছে। যজ্ঞের সময়ে যে এসেছিল, সে তো বলে গেল, আমার চেহারাটা পালটে নিতে হবে, নইলে বাইরের অত কাজ করতে পারব না।
সকালবেলা দেখা গেল দরদর করে ঘামছেন ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক, ভয়ে আর দুশ্চিন্তায়। সারারাত কাটিয়েছেন পুঁথি নিয়ে, তা সত্ত্বেও টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পাতার পর পাতা উলটে যাচ্ছেন— সাংকেতিক লেখার দ্রুত মর্মোদ্ধারের জন্যে। স্ত্রী এসে সকালের খাবার দিয়ে গেছিলেন। উনি খাননি। একটানা পড়ে গেছেন। মাঝে মাঝে উন্মাদের মতন জটিল সঙ্কেতের মানে বোঝবার চেষ্টা করেছেন। দুপুরের আর রাতের খাবারও এনে দিতে হয়েছে পড়বার ঘরে। খেয়েছেন যৎসামান্য। পরের দিন মাঝরাতে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কিন্তু দুঃস্বপ্ন দেখেই ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠেছেন। মানবজাতির অস্তিত্ব যে শেষ হতে চলেছে, স্বপ্নে সেই পূর্বাভাস পেয়েছিলেন। চৌঠা সেপ্টেম্বরের সকালে প্রফেসর ডিক্সিট আর ডক্টর রাজু রাজপুত জেদ ধরলেন, ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েকের সঙ্গে দেখা করে তবে ছাড়বেন। দেখা করার পর ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিলেন কাঁপতে কাঁপতে ছাইবন মুখে। সেই রাতেই ঘুমোতে গেছিলেন বটে ডক্টর পট্টনায়েক, কিন্তু ঘুম নামেনি চোখে। ছটফট করেছেন সারারাত। পরের দিন বুধবারে বসেছেন পাণ্ডুলিপি নিয়ে, চুটিয়ে নোট নিয়েছেন সাম্প্রতিক অংশ থেকে তো বটেই, ইতিমধ্যে যে অংশের সংকেত ভেদ করেছেন সেখান থেকেও। গভীর রাতে অফিসের ইজিচেয়ারে বসে একটু তন্দ্রায় ঢুলেছেন, তার পরেই ভোর হওয়ার আগে থেকেই পাণ্ডুলিপিতে ডুব দিয়েছেন। দুপুরের একটু আগে এসেছিলেন তাঁর চিকিৎসক ডা. আয়ুষ্মন অর্বুদ, তিনিই জোরের সঙ্গে ফরমান দিয়েছিলেন— আর নয়, এবার জিরেন নেওয়া হোক। ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক কর্ণপাত করেননি। কারণ, এই দিনলিপি পড়া শেষ করতে হবে তাঁকে যেভাবেই হোক… অত্যন্ত প্রয়োজন… কারণটা ব্যক্ত করবেন যথাসময়ে। সেই দিনই গোধূলির পর সন্ধ্যা যখন সবে নেমেছে, উনি পাঠ সমাপ্ত করে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলেন চেয়ারে। স্ত্রী তারও পরে রাতের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে স্বামীকে ওই রকম আধমড়ার মতন নেতিয়ে থাকতে দেখে ছিলেন। ডক্টর পট্টনায়েক কিন্তু ওই রকম অবস্থার মধ্যেই গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন স্ত্রী-কে টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে। সেখানেই যে ছিল তাঁর টুকিটাকি পয়েন্ট— দিনলিপি পড়েছেন, ভেবেছেন, আর লিখে লিখে গেছেন। কিন্তু সেই লেখা যেন স্ত্রীর চোখে না পড়ে, তাই অমন কড়িকাঠ কাঁপানো চিৎকার ছেড়ে ছিলেন, চেঁচিয়ে উঠেই টলতে টলতে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে খুচখাচ লেখা সমস্ত কাগজপত্র একটা বড়সড় খামের মধ্যে রেখে, খামটা ঢুকিয়ে রেখে ছিলেন নিজের পকেটে। বাড়ি যাওয়ার মতন শক্তি ছিল শরীরে, কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল ডাক্তার দেখানো দরকার এখুনি। তাই এসেছিলেন ডক্টর আয়ষ্মান অর্বুদ। উনি ওকে জোর করে যখন বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছেন, তখন তাঁকে অস্ফুট কণ্ঠে বলতে শোনা গেছিল— “হায় ভগবান, কিন্তু আমরা কী করতে পারি?”
ওষুধের প্রভাবে ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক তৎক্ষণাৎ অকাতরে ঘুমিয়ে পড়লেও পরেরদিন প্রলাপ বকে গেছেন থেমে থেমে। ক্ষিতি ক্ষেত্ৰপালের নাম উচ্চারণ করেননি, কিন্তু মাঝে মধ্যে খেয়াল হলেই বলেছেন, এখুনি লম্বা আলোচনা দরকার প্রফেসর ডিক্সিট আর ডক্টর রাজু রাজপুতের সঙ্গে। উদ্দাম অবস্থায় চেঁচিয়ে-মেচিয়ে এমন সব কথা বলে গেছেন যা শুনলে সুস্থ মানুষের টনক নড়ে যায়, যেমন পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের বাড়ির লাগোয়া যে ছাউনিটা তক্তা মেরে বন্ধ করা আছে, সেটা যেন একেবারেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আকারে ইঙ্গিতে আভাস দিয়ে গেছেন, অন্য মাত্রায় থাকা অন্য ডাইমেনশনের এক জগৎ প্রকল্প থেকে এসে অন্য প্রজাতির এক সত্তারা খুব শিগগিরই পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে মুছে দেবে সমগ্র মানব জাতটাকে… তারা নাকি অতি প্রাচীন এক অতি ভয়ঙ্কর সত্তা… গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গোটা পৃথিবীর সব্বাইকে এখন থেকেই হুঁশিয়ার না করলে তো সুপ্রাচীন এই সত্ত্বারা পৃথিবী পৃষ্ঠকে প্রাণহীন করে দিয়ে গোটা তৃতীয় গ্ৰহটাকেই হ্যাঁচকা টান মেরে যেখান থেকে একদা… অযুত নিযুত কোটি বছর আগে পৃথিবী গ্রহ ছিটকে এসে আটকে গেছিল সৌরজগতের এই কক্ষপথে। এই সব আবোল তাবোল প্রলাপের ফাঁকে ফাঁকে রক্তজল করা নেক্রোনমিকন আর রেমেজিয়ানয়ের ডেমোনোল্যাট্রেইয়া নামক দানবিক-পৈশাচিক গ্রন্থ দুটোর নাম আউড়ে গেছেন মন্ত্র ধ্বনির মতন… কারণ, ওঁর বিশ্বাস, উনি আশা করেন, এই দুই মহা কেতাবে এমন সমাধান সূত্রের উল্লেখ যাদের কাজে লাগালে পৃথিবী গ্রহের আসন্ন মহা বিপর্যয় রোধ করা সম্ভবপর হবে।
গলার শির তুলে চেঁচিয়ে গেছেন খামোকা যখন তখন— “আটকান, আটকান, ওদের আটকান! রুখে দাঁড়ান! ক্ষেত্রপাল বাপ-বেটা ওদের জাগিয়েছে, খাতির করে এনেছে, এখনও সময় আছে! প্রফেসর ডিক্সিট আর ডক্টর রাজু রাজপুতকে বলুন, এখনি কিছু একটা করা দরকার… অন্ধের মতন হাতড়ালে চলবে না… আমি জানি কীভাবে বানাতে হয় গুঁড়োটা… দোসরা অগস্টের পর থেকে ওর পেটে কিছু পড়েনি, সেই সময়েই তো এখানে এসেছিল ক্ষিতি মরবার জন্যে, আর এই ভাবেই…”
তিয়াত্তর বছর বয়সেও ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েকের স্বাস্থ্য বিলক্ষণ মজবুত। সেই রাতে টানা ঘুম দেওয়ার ফলে প্রলাপের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন বড় রকমের কোনও জটিলতার ভেতর যাওয়ার আগেই। কিন্তু চাপা একটা আতঙ্কবোধ যেন ধারালো দাঁত দিয়ে কুরে কুরে খেয়ে গেছে ভেতরটা, সেই সঙ্গে ছটফট করেছেন নিদারুণ একটা দায়িত্ববোধের প্রচণ্ড আত্যন্তিক চাপে। শনিবার অপরাহ্ন নাগাদ লাইব্রেরিতে যাওয়ার শক্তি পেয়েছিলেন। ডিক্সিট আর রাজু রাজপুতকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন টানা লম্বা আলোচনার জন্যে। আলোচনা চলেছিল রাত পর্যন্ত। তিন-তিনটে মগজ এক নাগাড়ে খেটে গেছে বিবিধ বিষয়ের তর্কাতর্কি নিয়ে, অতিশয় মরিয়া হয়ে ওঠা এক বিতর্ক বিষয় নিয়ে। মোটা মোটা ভয়ানক ভয়ানক পুঁথিপত্তর নামিয়ে আনা হয়েছিল বইয়ের উঁচু উঁচু তাক থেকে, গুদোম ঘরের অতিশয় সুরক্ষিত সব জায়গা থেকে। ঝড়ের বেগে নকল করা হয়েছিল রকমারি নকশা আর চিত্র সঙ্কেত, শব্দ সূত্র আর হেঁয়ালি শ্লোক। অদ্ভুত কিম্ভূত সৃষ্টিছাড়া এইসবের যেন শেষও আর নেই, বিরাট বিশাল অনেক প্রাচীন কেতাবালয় তো। এই বিল্ডিংয়েরই একটা ঘরের মেঝেতে ক্ষিতি ক্ষেত্ৰপালের সৃষ্টিছাড়া অবয়বকে পড়ে থাকতে দেখে ছিলেন তো এই তিনজনই। এরপর থেকেই কিন্তু তিনজনের প্রত্যেকেই বুঝে গেছিলেন, ক্ষিতির ডায়েরি পাগলের প্রলাপ মোটেই নয়। উৎকট ভয়ানক বিকট লোমহর্ষক হতে পারে, কিন্তু সব সত্যি, সব সত্যি, সব সত্যি।
পুলিশ মহলে ব্যাপারটা পাঠানো হবে কি না, এই নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল তিন মস্তিষ্ক প্রধানের মধ্যে। শেষমেষ টিকে গেছিল না বাচক সিদ্ধান্ত। প্রমাণ ট্রমাণ ছাড়া কিছুকেই যারা ধর্তব্যের মধ্যে আমল দেয় না, তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার মতন কিছুই যেখানে নেই সেখানে আরক্ষা বাহিনীর নাক উঁচুই থাকে, নীচে নামে না। নিশুতি রাতে যখন একমত হওয়া গেল না মূল ব্যাপারটা নিয়ে, তখন তিনজন ঠিকরে গেলেন তিনদিকে। পরের রোববার সারাদিন হাড়ভাঙা খেটে গেলেন ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক, মিলিয়ে মিলিয়ে দেখলেন বিবিধ চিত্রসঙ্কেত আর ফরমুলা, কলেজ ল্যাবোরেটরি থেকে নানারকম কেমিক্যাল এনে মিলিয়ে মিশিয়ে অনেক কিছু উৎকট বিটকেল মিশ্র রাসায়নিক প্রস্তুত করলেন। নারকীয় ডায়েরির লেখা নিয়ে যতই মস্তিষ্ক উত্তপ্ত করলেন, ততই এলেন একটা স্থির সিদ্ধান্তে— ক্ষিতি ক্ষেত্রপাল যে অমানবিক সত্তাটাকে অর্গল মুক্ত করে রেখে দিয়ে গেছে ধরাতলে, মেদিনী কাঁপানো ত্রাস সঞ্চার করতে চলেছে সে আর ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই স্মরণীয় করে রেখে দিতে চলেছে মহাকাল আতঙ্ক নিচয়কে।
ফলে, সোমবারটা কেটেছে নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে। মুহূর্তের জন্যেও স্বস্তিবোধ করেননি। যে কাজ হাতে নিয়েছেন, সে কাজ সাঙ্গ করতে গেলে তো দরকার অনেক গবেষণা, অনেক এক্সপেরিমেন্ট। দানবিক দিনলিপিটাকে আর একবার খুঁটিয়ে অবধান করতে গিয়ে দেখলেন অনেক কিছুর পরিবর্তন দরকার পরিকল্পনায়, তা সত্ত্বেও যে শেষের শেষ প্রহরে অনেক কিছুই অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে যাবে— নিশ্চিত হলেন সে ব্যাপারে। মঙ্গলবারে সুনির্দিষ্ট একটা কর্মপন্থা এনে ফেললেন মাথার মধ্যে। তখন মনে করলেন, হপ্তাখানেকের মধ্যেই মহাকাল তল্লাটে তাঁর যাওয়া দরকার। বুধবার ঘটে গেল ঘিলু পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়ার মতন ঘটনাটা, স্থানীয় সংবাদপত্রের ভেতরের পাতার এক কোণে চোখে-পড়ে না এমন একটা জায়গায় ছোট ছোট হরফে ছাপা হল ছোট্ট একটা খবর— মহাকায় এক রেকর্ড-ভঙ্গ-কর জঘন্য এক দানবের কল্পনা জাগ্রত হয়েছে নাকি দেশি তাড়ি খাওয়ার পরিণামে। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠালেন ডিক্সিট আর রাজু রাজপুতকে। শলাপরামর্শ হল গভীর রাত পর্যন্ত। পরের দিনই শুরু হয়ে গেল পুরোদাম প্রস্তুতি পর্ব— ঘূর্ণিঝড়ের বেগে। ভয়ানক এক শক্তির পেছনে যে কাঠি দিতে যাচ্ছেন, বিষ্ণু পট্টনায়েক তা জানতেন। কিন্তু অন্য উপায়ও খুঁজে পেলেন না। ওঁর আগেই অন্যরা ঘোল ঘেঁটে দিয়ে যে কাণ্ড বাঁধাতে চলেছে, ভয়ানক গভীর সেই সর্বনাশকে রুখতে গেলে যা করণীয় তা এখনই যে করতে হবে।
৯
শুক্রবার ভোরের দিকেই রওনা হলেন পট্টনায়েক, ডিক্সিট আর রাজু রাজপুত মোটর গাড়ি নিয়ে মহাকাল অভিমুখে, পৌঁছে গেলেন দুপুর একটা নাগাদ। দিনটা ছিল বেশ ফুরফুরে, কিন্তু সূর্যালোকিত অমন ঝলমলে দিনেও থমথম করছিল চারিদিক যেন একটা কুলক্ষণ চেপে বসেছিল অদ্ভুত গম্বুজাকৃতি পাহাড়টার চারপাশের পাহাড়ি তল্লাটের ছায়ামায়া জায়গায় জায়গায়, বিষাদ নিবিড় গিরিখাদ কন্দর গুহায়। পাহাড় চুড়োয় গোলাকার থামের মতন সাজানো পাথরগুলো বহন করে যাচ্ছিল একটা অশুভ সঙ্কেত। নীল আকাশের পটভূমিকায় এহেন স্তম্ভশ্রেণী যেন ইসারায় আহ্বান করে যাচ্ছে নিদারুণ অমঙ্গল কোনও এক বর্ণনাবহির্ভূত সত্তাকে।
গাঁয়ের মুদিখানায় পাওয়া গেল দুঃসংবাদটা। সেখানে জমায়েত লোকজনের মুখ থমথম করছে আশু অমঙ্গলের পূর্বাভাসে। ফের ঘটে গেছে অতীব কদাকার কিছু একটা সেটা যে কী, তাও জানা গেল জিজ্ঞাসাবাদ করতেই। কুন্তীবালা আর দুর্গামাসির বাড়ির পাতাল প্রবেশের লোমহর্ষক সংবাদ চমকে দিয়ে গেল সদ্য আগত তিন বিজ্ঞান জানা পণ্ডিতদের। একী অমানুষিক প্রলয়কাণ্ড চলছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বঞ্চিত এই অজানা অসুর মহলে?
সারা বিকেল তিন মূর্তিমান গাড়ি নিয়ে টো টো করে গেলেন পুরো অঞ্চলটায়। সেখানে পাঁচজনের জমায়েত আর গুলতানি, সেইখানে দাঁড়িয়ে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন বিবিধ ব্যাপার। বিস্ফারিত চোখে দেখে গেলেন ক্ষেত্র পাল, কুন্তীবালা আর দুর্গামাসিদের বাড়িগুলোর পাতাল প্রবেশ। এতদিন কানে শুনেছিলেন, এবার চোখে দেখলেন। মাথার চুল খাড়া হয়ে যাওয়ার মতন সেই দৃশ্য দেখে এহেন প্রলয়কাণ্ডের কোনওরকম জাগতিক ব্যাখ্যা মাথায় আনতে পারলেন না। দেখলেন রক্ত মাখা চারণভূমি, একদা যেখানে অসহায় গরু মোষ ছাগল ভেড়াদের অমানুষিক পন্থায় টুকরো টুকরো করা হয়েছে। দেখলেন নানান তল্লাটের গাছপালাদের প্যাঁকাটির মতন ভেঙে ভেঙে যাওয়া অবস্থা— নিদারুণ সেই লণ্ডভণ্ড কাণ্ড কোনও প্রাকৃতিক প্রলয়ের পক্ষে সম্ভবপর নয়। সভয়ে নিরীক্ষণ করলেন মাটিতে চেপে চেপে বসে থাকা বিরাট বিরাট পদচিহ্ন। অপার্থিব নিঃসন্দেহে। নিরতিসার আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন চৌকিদার পাহাড়ের মাথায় বলয়াকারে সাজানো মহাশয় প্রস্তর স্তম্ভদের দিকে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য— প্রকৃতির হাতে গড়া অবশ্যই নয়— তাহলে কী? গা ছমছম করতে থাকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই। এত রটনা যে অকারণে নয়, এত আতঙ্ক বোধ যে ভিত্তিহীন নয়— তার চাক্ষুস প্রমাণ যেন ওই পাহাড়চুড়োর থামগুলো— যাদের কেন্দ্রে রয়েছে প্রকাণ্ড একটা পাথরের বেদি। যেন একটা প্রাকৃতিক বধ্যভূমি।
এই সবের পর তিন সত্যান্বেষী বিজ্ঞানী পুলিশদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তারা ছুটে এসেছে কুন্তীবালা আর দুর্গামাসিদের দুই বসতবাড়ির মাটিতে ঢুকে যাওয়ার খবর পেয়ে তদন্ত করতে। দেখতে পেলেন পুলিশ জিপগাড়িটা। পাঁচ পুলিশ পুঙ্গব গেছে পাহাড়ের পাশের জলা জায়গাটায়— সেখানে থেকে চাপা বজ্রধ্বনির মতন ভেসে আসে ভনভনে কালো মাছিদের ক্ষিপ্ত ব্যান্ড বাজনা।
শিউড়ে উঠে এঁদের বলেছিল গাঁয়ের একজন— “আমি তো বারণ করলাম ওদিকে যেতে। আমার কথা শুনল না।”
শুনেই প্রায় থেমে গেলেন তিন বিজ্ঞানজানা মানুষ বহুবিধ বিজ্ঞান নিয়ে তাঁরা এসেছেন বিজ্ঞানের বাইরের অপ্রাকৃত তাণ্ডবলীলার স্রষ্টার সঙ্গে মোকাবিলা করতে। কিন্তু এই অপদার্থ পুলিশগুলো অবিশ্বাসী মন নিয়ে এসেছে সেই মহাশক্তির সঙ্গে টক্কর দিতে। কী সর্বনাশ?
বিষ্ণু পট্টনায়েক কিম্ভূত দিনলিপিটা আগাগোড়া পড়ে নিয়েছিলেন বলেই জানতেন, কিছু একটা ঘটবেই। কিন্তু তা নিয়ে স্থানীয় কারুর সঙ্গে কথা বলেননি। এমনিতেই ভয়ে আধমরা হয়ে রয়েছে, আরও ভয় পেয়ে যাবে।
দিনের আলো যখন চলে যাচ্ছে, ছায়া ঘনাচ্ছে একটু একটু করে, স্থানীয় বাসিন্দারা টুক টুক করে সরে পড়ল যে-যার ঘর বাড়ির দিকে, যেন দরজায় খিল তুলে দিয়ে বাঁচতে চায় এমন এক নৈশ আতঙ্কের খপ্পর থেকে যার প্রকাণ্ড থাবা চক্ষের নিমেষে আস্ত বাড়িটাকেই ডিমের খোলার মতন টুকরো টুকরো করে দিয়ে চকিত চমকে ঢুকিয়ে দিতে পারে পাতালের দিকে।
দুর্গামাসি আর কুন্তীবালার পাতাল প্রবিষ্ট বাড়ি দুটোর কাছেই কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন বিজ্ঞানজানা তিন দুঃসাহসী। গুটি গুটি সরে পড়তে পড়তে অঞ্চলের মানুষরা কৃপার চোখে দেখে গেল তাঁদের। ভাবখানা এই মরতে এসেছে মরুক গে। ভোর হওয়ার আগেই ফর্সা হয়ে যাবে তো তিনজনেই।
সেই রাতে গুরু গুরু গুম গুম ধ্বনির দামামা বেজে গেল পাহাড়ে পাহাড়ে। রক্ত জমানো শব্দ প্রকম্প জাগিয়ে ঐকতান সৃষ্টি করে গেল ভনভনে মক্ষিকা বাহিনী। আচমকা একটা ঝাপটা বাতাসে চৌকিদার পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে এল অতিশয় উৎকট দুর্গন্ধ— যে দুর্গন্ধ নাকে আনার দুর্ভাগ্য তিন অভিযাত্রীর হয়ে গেছে ইতিপূর্বে। মুমূর্ষু একটা অর্ধনর প্রাণীর কলেবরের সন্নিকটে স্তম্ভিত দেহে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে। একই বিকট উৎকট জঘন্য অবর্ণনীয় দুর্গন্ধ। এখন ধেয়ে আসছে বাতাসকে বাহন করে। প্রতিটি রোমকূপে নিঃসীম প্রত্যাশা নিয়ে এতৎসত্ত্বেও দাঁড়িয়ে ছিলেন তিন ডাকাবুকো বয়োবৃদ্ধ। কিন্তু প্রত্যাশার পূরণ ঘটেনি। বিমূর্ত বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। অবিমিশ্র আতঙ্ক দর্শনদান করেনি।
ধীর ছন্দে ঢিমিয়ে এসেছিল প্রত্যুষ। নৈশ শব্দলহরী ছন্দে ছন্দে বিলীন হয়ে গেছিল নৈঃশব্দ্যের মহল-গুম্ফায়। তারপরেই মৃদু ছন্দে শুরু হয়েছিল বৃষ্টিপাত ফিকে ঊষাকে ম্লান করে দিয়ে।
তিন অভিযাত্রী দোটানায় পড়েছিলেন। কী করবেন এখন? ক্ষেত্রপালদের টিকে থাকা একটা ছাউনির নীচে আশ্রয় নিয়ে ক্রমবর্ধমান বৃষ্টিধারা থেকে মাথা বাঁচিয়ে রেখে তর্কবিতর্ক করে গেছিলেন নিজেদের মধ্যে। করবেনটা কী এখন? জুজুর ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন না, বনপাহাড় দিয়ে এগিয়ে যাবেন নামহীন সেই বিভীষিকার অন্বেষণে, যার সঙ্গে টক্কর দিতে এসেছেন এতদূরে?
বৃষ্টিধারা তখন একটু ঢিমেতালে চলছে, দূর দূর থেকে ভেসে আসছে মেঘের বার্তা— গুরু গম্ভীর গজরানি। বজ্রধ্বনি যে এরকম নিনাদ আর রক্তজল করা হয়, তা তো জানা ছিল না। প্রকৃতির এহেন প্রচ্ছন্ন রুদ্ররূপ তিনজনের কেউই তো আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেননি। এহেন নির্ঘোষ কখনও শ্রবণ করেননি।
তারপর ফিকে হয়ে এসেছিল আকাশজোড়া মেঘের দীপ্তি। পরক্ষণেই যেন গুলতি নিক্ষিপ্ত হয়ে একটা বাজবাহাদুর এঁকেবেঁকে আকাশ থেকে নেমে গেছিল দূরের বনরাজিনীলার মধ্যে পাহাড় যেখানে ছন্দে ছন্দে অবতরণ করেছে নীচের জলাধারের দিকে। আকাশের প্রলয় যেন হাতে হাত মিলিয়ে সঙ্কেত পাঠাচ্ছে নিচের প্রলয়ঙ্করকে, অভিশপ্ত পর্বত অরণ্যকে প্রদীপ্ত করে দিয়ে, ফ্ল্যাশলাইটের ঝলক মেরে মেরে। কী ভয়ানক! কী ভয়ানক!
তমিস্রা তখনও বেশ নিবিড়। লোমরন্ধ্রে শিহরন জাগানোর মতন। আকাশের আলো হার মেনে যাচ্ছে মর্ত্যের আঁধারের কাছে। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতন সেই আবছা আঁধার ঠেলে সহসা দৌড়তে দৌড়তে এসেছিল এক গ্রামবাসী।
“শীগগির আসুন… এখনি …এখুনি… হা ভগবান! এবার যে দেখছি দিনের বেলাতেও ঘটছে… ফের শুরু হয়েছে।”
বলতে বলতে দম আটকে এসেছিল বক্তার। চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। দৌড়তে দৌড়তে এসেছিল আর একজন।
হাঁফাতে হাঁফাতে দুই চোখ প্রায় ঠেলে বের করে এনে সে যা বলেছিল, সংক্ষেপে তা এই: দুর্গামাসির যে কাজের ছেলেটা গরু মোষ নিয়ে পাহাড়ে যায় ঘাস খাওয়াতে, সে যখন ফিরে আসছে ঝড়জলের ভয়ে, তখন দুম করে বাজ পড়েছিল আকাশ থেকে। সেই আলোয় দেখতে পেয়েছে এঁকে বেঁকে যাওয়া বড় বড় গাছ দুলে দুলে দু-ফাঁক হয়ে যাচ্ছে… কাদায় বড় বড় পিপে সাইজের প্রকাণ্ড থাবার ছাপ পড়েছে… সেই ছাপ নেমে এসেছে চৌকিদার পাহাড়ের দিকে থেকে… গেছে জাদু মাস্টার পাহাড়ি ক্ষেত্রপালের বাড়ির দিকে। তারপর দেখেছে যেন একটা বিরাট হাতি ছুটে যাচ্ছে ভাঙা বাড়ির দিকে দু-পাশের সব কিছু তছনছ করতে করতে বিকট বিচ্ছিরি একটা গন্ধ নাকে এল… একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল সমস্ত কুকুর— যেন একটা পাহাড় ছিটকে গেল বাড়িটার পাশ দিয়ে… ওদিককার সাবিত্রী মাসির আস্ত বাড়িটা দুম করে ঢুকে গেল মাটির মধ্যে! তারপর সব চুপচাপ! শুধু ধপ ধপ দুম দুম আওয়াজ মিলিয়ে গেল পাহাড়ের দিকে! হে মহাকাল! এসব কী ঘটছে! এখন যে দিনের বেলাতেও!
এরই মধ্যে গ্রামের আরও অনেকে ছুটে এসেছে। নিঃসীম আতঙ্কে পাংশু মুখ প্রত্যেকেরই।
নিমেষে বুঝে গেলেন পট্টনায়েক, সময় হয়েছে নিকট, এখন কর্তব্য করতে হবে।
বললেন গলা চড়িয়ে— পেছন পেছন যেতে হবে। যেখান থেকে এসেছে, সেখানে যেতে হবে। ক্ষেত্রপাল জাদু জানত। তার ছেলেও জানত। ছেলের লেখা ডায়েরি আমি পড়েছি। পুরোনো পুঁথি পড়েছি। যে সব পুঁথি সে পড়েছে। ঠিক কী মন্ত্র মেরে এই শয়তানকে শায়েস্তা করা যায়, আমি তা জানি। আর দেরি নয়। সে এখন একা। এক থেকে দুই হওয়ার আগেই পালটা মার দিতে হবে, এসো। শর্টকাট দেখাও।
পথ দেখিয়েছিল গ্রামবাসী। নিয়ে গেছিল বিরাট বিরাট সৃষ্টিছাড়া পায়ের ছাপের পাশ দিয়ে বনের মধ্যে। সেখানে গিয়েই ঝোলা থেকে দূরবিন বের করেছিলেন পট্টনায়েক।
দেখেছিলেন, দূরের পাহাড়ের বনরাজিনীলার মাঝের একটা রেখা বরাবর বড় বড় গাছ দুলে দুলে উঠে সরে সরে যাচ্ছে, কখনো ভেঙে ভেঙে পড়ছে।
মহা আতঙ্ক ফিরে যাচ্ছে চৌকিদার পাহাড়ের নিতঙ্ক নিকেতনে!
১০
তিন ডান পিটে বিজ্ঞান-তাপস রওনা দিয়ে ছিলেন পাহাড়চুড়ো অভিমুখে। অনেক ভেবেচিন্তেই দূরবিনটা রেখে গেছিলেন গ্রামবাসীদের কাছে। দূর থেকেই তারা নজর রেখে যাক অভিযাত্রীদের ওপর। অসম সাহসিকতার পরিণামটা সুফল দেয় না কুফল দেয় না কুফল দেয়— স্বচক্ষে দেখুক। যদি দেখে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, নামহীন আতঙ্ক রুদ্ররোষে ফেটে পড়ে ফের ধেয়ে আসছে, প্রাণ নিয়ে যেন পালায়।
দূরবিনের দৌলতেই দেখা গেছিল, তিন অভিযাত্রী চৌকিদার পাহাড়ের দিকে সরাসরি না গিয়ে এগোচ্ছে একটা ছোটখাটো চুড়োর দিকে, যে চুড়া থেকে ভালোভাবে দেখা যাবে গাছপালা লণ্ডভণ্ড হচ্ছে যেখানে, সেই জায়গাটা। অদৃশ্য নারকীয় সত্তা একটু আগেই তো গেছে যেখানে দিয়ে, বনবৃক্ষদের কাহিল অবস্থাই তার চাক্ষুস প্রমাণ, তারপরেই দেখা গেছে দূরবিনের মধ্যে দিয়ে ডক্টর বিষ্ণু পট্টনায়েক এগিয়ে যাচ্ছেন হাতে একটা স্প্রে গান নিয়ে। দূরপাল্লার স্প্রে গান। নিশ্চয় অদৃশ্য বিভীষিকাকে ক্ষণেকের জন্যেও দৃশ্যমান করার অভিপ্রায়ে। আরেকজনের হাতে রয়েছে শক্তিশালী একটা চূর্ণ। মারণ গুঁড়ো কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে উচাটন বশীকরণের ক্ষমতা নিশ্চয় আছে। নইলে অস্ত্র বলতে নিছক এই গুঁড়ো নিয়ে এহেন বিজ্ঞব্যক্তিরা অমন একটা বর্ণনাতীত বিভীষিকার সামনে যাওয়ার সাহস পেলেন কী করে?
দূরবিন যাদের চোখে ছিল না, তারা তখন দেখতে পেয়েছে ধোঁয়াটে মেঘের মতন একটা চকিত ঝলক… সাইজে প্রকাণ্ড একটা বাড়ির মতন… পাহাড়ের চুড়োর কাছে…
দূরবিন যার হাতে ছিল, তার হাত কেঁপে যাওয়ায় দূরবিন খসে পড়েছিল মাটিতে। গলা থেকে ঠিকরে এসেছিল চাপা চিৎকার— “এই সেই… এই সেই …এই সেই…!”
ভূলুণ্ঠিত ব্যক্তির মুখ দিয়ে বাক্য সরেনি। বিস্ফারিত চোখে শুধু জাগ্রত হয়েছিল বর্ণনায় আনা যায় না এমন একটা বিভীষিকার যেন প্রতিচ্ছবি নরক সন্দর্শন করেছে এখুনি।
কথা না বাড়িয়ে আর-একজন কুড়িয়ে নিয়েছিল মাটিতে ঠিকরে যাওয়া দূরবিন।
তারপরেই ছাড়া ছাড়া উক্তি শোনা গেছিল প্রথম জনের ভয়ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে— খামার বাড়ির চাইতেও বিরাট… চারদিকে লিকলিক করছে অসংখ্য দড়ির মতন… জাহাজের খোলের মতন বিরাট মুরগির ডিমের সাইজ… ডজনখানেক শুঁড়… যেন জেলি দিয়ে তৈরি শুঁড়ের ডগাগুলো শুয়োরের মাথার মতন পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ হচ্ছে… খুলছে… হাঁ করছে… হাঁ বন্ধ করছে।
নিরেট নয়… জেলির মতন থলথলে সারা শরীরে ছড়িয়ে অনেক অনেক বড় বড় ঠেলে বের করা চোখ-চারপাশে দশ-বিশটা মুখ অথবা শুঁড়… পাইপের মতন মোটা… মুখগুলো খুলে খুলে যাচ্ছে… বন্ধ হয়ে যাচ্ছে… প্রতেকটা শুঁড়ে আংটির মতন ধোঁয়াটে দাগ… একটু নীল… একটু বেগুনি… ওপর দিকে অর্ধেক মুখের মতন কী যেন একটা… হে ভগবান… একি দেখলাম?
এই পর্যন্ত বলেই আছড়ে পড়েছিল বক্তা।
বাইনাকুলার চলে গেছিল আর-একজনের হাতে। ঠিক তখনই শোনা গেছিল একটা গুরু গুরু নিনাদ… পাহাড়ের নীচের দিক থেকে… ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মাছিরা শুরু করে দিয়েছে ঐকতান।
দূরবিনের মধ্যে দিয়ে দেখা গেছিল তিন মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়চুড়োর কিনারায় খাদের প্রান্তে… পাথরের বেদির সমান্তরাল জায়গায়… কিন্তু অনেক তফাতে… একজন মাথার ওপর দু-হাত তুলে দুলে দুলে যেন স্তোত্রপাঠ করছে… মাঝে মাঝে দুলুনি থামছে, ফের শুরু হচ্ছে… প্রত্যেকেই তখন শুনতে পেয়েছে দূর থেকে ভেসে আসা একটা খুব অস্পষ্ট স্তোত্র পাঠের মতন। ছন্দোময় সুর… খুব জোর গলায় যেন আকাশ বাতাস ফাটিয়ে দিয়ে চলছে স্তোত্রপাঠ… দুলে দুলে… এত জোরে যে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসীরাও তা শুনতে পেয়েছে… যেন কত কী ফেটে ফেটে পড়ছে বিপুল শক্তি নিয়ে সেই মারণ উচাটন বশীকরণ মন্ত্রের মধ্যে… কিম্ভূত পর্বত শিখরকে মনে হচ্ছে যেন একটা অপচ্ছায়া… কিম্ভূতকিমাকার কিন্তু মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতন আকৃতি… ভাষা দিয়ে সেই ভয়াল রূপকে ফুটিয়ে তোলা যায় না… একই সঙ্গে নিনাদ রচনা করে চলেছে মক্ষিকা বাহিনী উদ্দাম সুরে… অদ্ভুত একটা ছন্দহীন ঐকতানে… মন্ত্ৰপড়ার ছন্দের সঙ্গে তাল কেটে যাওয়া সুরে… যেন বেতাল ঠুকে তাল কেটে দেওয়ার অব্যাখ্যাত এক প্রচেষ্টা।
আচমকা মনে হয়েছিল যেন নিষ্প্রভ হয়ে আসছে সূর্যালোক— অথচ সূর্যের মুখ ঢাকা দেয়নি কোনও মেঘের দঙ্গল। সে এক অতি বিচিত্র পরিস্থিতি। নজরে পড়েছে প্রত্যেকেরই। শোনা গেছে একটা চাপা গুড় গুড় গুম গুম নির্ঘোষ, অদ্ভুত সেই শব্দলহরীর উৎস যেন অদ্রি অঞ্চলের তলদেশ থেকে পাহাড় নিচয়ের গভীর গোপন গুপ্ত অঞ্চল থেকে উত্থিত হচ্ছে হাজারো দামামার অদ্ভুত আওয়াজ… সেই সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বুঝি আকাশ থেকে নেমে আসা একটা রক্তজল করা তাথৈ তাথৈ চাপা নিনাদ… ব্যোম আর মহীর হাতে হাতে হাততালি দেওয়ার মতন ধিকি ধিকি ধক ধক শব্দ লহরী… সে এক বিচিত্র শব্দ সমন্বয়… ভাষার অতীত। আকাশ আর পৃথিবীর অট্টহাসি যেন এক অশ্রুতপূর্ব মিলিত মিশ্র কাল ভৈরবরাগিণী। একাধারে সম্মোহক আর ভয়ানক।
ঝড় আসছে নাকি মাদল বাজাতে বাজাতে? কিন্তু এ যে এক অদ্ভুত ঐকতান। তিন দুঃসাহসী নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছেন বিরামহীন সেই শব্দ যুগল শব্দনৃত্য… তাই বুঝি দু-হাত তুলে তালে তাল মিলিয়ে হাত নাড়ছেন… মন্ত্রধ্বনির উত্থান পতনও ঘটছে এহেন অনৈসর্গিক ঐকতানের তালে তালে। পেছনে অনেক দূর থেকে সারমেয় বাহিনী সহসা ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে তাই বুঝি গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে হাহাকার রবে।
দিবালোকের গরিমা পালটে গেছে অকস্মাৎ, সবিস্ময়ে দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকতে হয়েছে জমায়েত মানুষজনকে। সহসা সুনীল গগন থেকে প্রেতচ্ছায়াসম একটা বেগুনি রঙের আঁধার পুঞ্জ অবতরণ করছে পাহাড়-টাহাড়ের ওপর, ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমে ক্রমে… বিদ্যুৎ দীপ্ত মেঘমালা মুহুর্মুহু চমকে উঠছে… আগের চেয়ে অনেক বেশি দীপ্তিময়… উপস্থিত জমায়েত প্রত্যেকেরই মনে হয়েছিল দূরের ওই চৌকিদার পর্বতের শিখরস্থ প্রস্তর বেদির ওপর রচিত হচ্ছে করাল কায়ার মতন একটা নিরেট কুয়াশা। দূরবিন ছাড়াই দেখা গেছে সেই অনৈসর্গিক দৃশ্য। আর ঠিক সেই সময়ে উদ্দামতর হয়ে উঠেছে মক্ষিকা বাহিনীর সমর সঙ্গীত অথবা আবাহন গান… নিরেট সেই কুয়াশা যেন ধিকি ধিকি কেঁপে কেঁপে উঠেছে কালো মাছিদের করাল বাজনার তালে তালে। চক্ষুস্থির প্রত্যেক গ্রামবাসীই অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছে। আসল একটা কিছু এইবার বুঝি মূর্ত হতে চলেছে ভয়ানক কায়া নিয়ে… আকাশ বাতাস বুঝি নিরুদ্ধ নিশ্বাস সেই কারণেই।
বিন্দুমাত্র পূর্ব সঙ্কেত দিয়ে, আগাম জানান না দিয়ে, আচম্বিতে গভীর কুটিল কর্কশ কঠোর কণ্ঠ নিনাদ আছড়ে আছড়ে পড়েছিল প্রত্যেকের কর্ণপটহে। ভয়াল ভয়ঙ্কর আশ্চর্য গম্ভীর সেই আওয়াজ পরম্পরা জাগ্রত হয়নি কোনও মনুষ্য কণ্ঠে, কেননা মহীতলের কোনও মানুষের স্বরযন্ত্র এহেন শব্দ ঐকতান সৃষ্টি করার জন্যে গড়া হয়নি। বরং মনে হয়েছে বিকট কর্কশ করাল কঠিন সেই শব্দ স্রোত যেন ঠিকরে আসছে নিতল গহ্বরের ভেতর থেকে, অবশ্যই এহেন পাতাল কূপ রয়েছে পাহাড়ের ওই বিষম বেদির ঠিক নীচেই। সেই শব্দ বিস্ফোরণকে শব্দ বলাটাও ভুল বললেই চলে, কেননা এমন চাপা আওয়াজ তো কেউ কখনও শোনেনি… সে এক অতি করাল শব্দ স্রোত… তলাতল কাঁপানো এক গুরু গুরু গুম গুম আওয়াজ লহরী… কান নয়, ব্রেনে ধাক্কা মারার মতন আশ্চর্য সেই শব্দ প্রত্যহ হাতে হাত দিয়ে তালি বাজিয়ে গেছে মহাকালের অতিকায় ডুগডুগি… ডঙ্কা বাজনাও সেই তুলনায় এমন রুধির শীতল করা নয়।
সেই সঙ্গে ভেসে এসেছে তিন অভিযাত্রীদের একজনের কণ্ঠের বিরামবিহীন মন্ত্রধ্বনি… জাদুকরী বচনমালা… মোহকর ভাষার উচ্ছ্বাস… শব্দব্রহ্ম যেন নটরাজনৃত্য নেচে নেচে গেছে অনৈসর্গিক আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যাদের দেখা যায় না সেই সব শুভ সত্তাদের আবাহন করে গেছে। কণ্ঠযন্ত্রের আকুল আর্তি দিয়ে… অস্তিত্বহীন সত্তাগণ যখন অস্তিত্বময় হওয়ার জন্যে উন্মুখ, উৎকণ্ঠা কঠিন সেই মুহূর্তে মন্ত্রধ্বনির রণদামামা যেন আকাশ বাতাস পাতাল ফালা ফালা করে দিয়ে বিদেহী আতঙ্কদের দেহ ধারণ করতে দিচ্ছে না। মন্ত্রশক্তির মহিমা দিয়ে অশরীরী কালান্তকদের অদৃশ্যলোকেই আটকে রাখছে।
তালে তালে বেড়ে যাচ্ছে মন্ত্রধ্বনি… হচ্ছে দ্রুত থেকে দ্রুততর …শব্দশক্তি বুঝি ফেটে ফেটে পড়েছে আকাশে বাতাসে নিরেট পাথরের পাথরে। সেই সঙ্গে তিন দুঃসাহসী প্রবল বেগে হাত নেড়ে নেড়ে দুর্বোধ্য এক অদৃশ্য ছক এঁকে যাচ্ছে শূন্যে।
তারপরেই শোনা গেছিল একটা হুহুঙ্কার। অতি মহাজাগতিক অঞ্চল থেকে নিনাদী স্বরে কী এক অজানা আতঙ্ক যেন জাহির করে যাচ্ছে নিজ অস্তিত্ব। বহু প্রাচীন আদিম এক সত্তা যেন করাল ক্রোধে মুহুর্মুহু গর্জন করে যাচ্ছে নিষ্ফল আক্রোশে অপরাজেয় মন্ত্রশক্তির কাছে।
পরক্ষণেই গোটা পার্বত্য এলাকা থরথর করে প্রকম্পিত হয়েছিল বিপুল ভয়ানক অতি করাল কঠিন একটা নিনাদী আওয়াজে। হাহাকার রবে সেই শব্দ পরম্পরা যেন পৃথ্বী জঠর ফুঁড়ে ঠিকরে এসে বিলীন হয়ে গেছিল দূর গগনে একটু একটু করে। শব্দের উৎস যেন সেই পর্বতচুড়োর প্রস্তর বেদি …জঘন্য উৎকট একটা দুর্গন্ধ স্রোত অদৃশ্য বন্যার মতন উত্তাল হয়ে ধেয়ে এসেছিল পাহাড়চুড়োর স্তম্ভ বলয়ের কেন্দ্রস্থল থেকে… বিষম বিকট একটা ঝাপটা দুর্গন্ধে দম আটকে এসেছিল থরহরিকম্প গ্রামবাসীদের।
দূরে দূরে শোনা গেছিল সারমেয় নির্ঘোষের ঐকতান… অতীন্দ্রিয় অতি-অনুভূতি দিয়ে তারা যেন টের পেয়েছে এক অতি-আতঙ্কের পরাজয় এবং প্রস্থান। ছিটকে ছিটকে গেছিল পাহাড়ের সবুজ ঘাস আর রুগ্ন গাছপালার হলদেটে ধূসর ডাল আর পাতা। গোটা তল্লাটটা ঢেকে গেছিল মরা কালো মাছিদের মড়ায়।
দুর্গন্ধ বিদায় নিয়েছিল এক সময়ে। কিন্তু গাছপালা ঘামপ্রান্তর উদ্ভিজ্জ… বৃক্ষ লতা তৃণ গুল্ম শেওলা ছাতা… আর কোনও দিনই ফিরে পায়নি আগের চেহারা। আজও সেই পাহাড়ি অঞ্চল রয়ে গেছে এহেন দুরবস্থায়… তাণ্ডব লীলার পর স্বয়ং প্রকৃতির শ্মশান গোরস্থান চেহারা। বিষম বিকট সেই দুর্গন্ধ উড়ে গেছে পবনদেবের কৃপায়।
তিন অভিযাত্রী ফিরে আসবার পর গ্রামবাসীরা ছেঁকে ধরেছিল তাঁদের।
বিষ্ণু পট্টনায়েক বলেছিলেন “সে আর আসবে না। বিদায় নিয়েছে চিরকালের জন্যে। মূর্ত হয়েছিল যে উপকরণের সমন্বয়ে, বিলীন হয়েছে সেই সব উপকরণের মধ্যেই। অনৈসর্গিক সেই সব উপকরণ উপাদান পেয়েছিল মহাশূন্য থেকে… কৃষ্ণ বস্তু… আজও যা রহস্যময় পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের কাছে… ডার্ক ম্যাটার… ভয়াল ভয়ঙ্কর করাল কুটিল বিধ্বংসী। পুলিশ গেছিল এই শক্তিকে পাকড়াও করতে। কোথায় তারা?
না, তাদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। যেন বিলীন হয়ে গেছে শূন্যে, অথবা শেষশয্যা রচনা করেছে মক্ষিকাকুলের আবাসস্থলে, পাঁক আর কাদার গর্ভে।
গ্রামবাসীরা কিন্তু দূরবিনের মধ্যে দিয়ে দেখেছিল যে আর একটা ভয়াবহ মুখাবয়ব। অর্ধেক মুখ, অর্ধেক আঁধার পুঞ্জ। সে মুখে টকটকে লাল রঙের চোখ… চুল লালচে চিবুক নেই… অবিকল ক্ষিতি ক্ষেত্ৰপালের মুখের মতন। কি সেটা? অক্টোপাস না, শতপদী না, মাকড়সা জাতীয় কিছু… কিন্তু ওপর দিকে ছিল যে একটা মানুষের মুখের মতন আধ-গড়া মুখ… ঠিক যেন ক্ষিতি ক্ষেত্রপালের মুখাবয়ব… কিছুটা… ধারে কাছে না এলেও সে কে? সে কে? “একটা শক্তি,” বলেছিলেন বিষ্ণু পট্টনায়েক “এ শক্তি রয়েছে মহাকাশের ভেতরে …কালো শক্তি… ডার্ক ম্যাটার… কৃষ্ণ বস্তু… নাম একটাই। রূপ ধারণ করতে পারে অনেক কিছুর, আবাহন যেমন, কায়া সেই রকম। জাদুকর পিশাচ যারা, তারা জানে সেই ডাকিনী মন্ত্র। পাহাড়ি ক্ষেত্রপাল শিখেছিল এই কালো জাদু… ব্ল্যাক ম্যাজিক… শিখিয়েছিল গুণধর অর্ধনর পুত্র ক্ষিতি-কে… ক্ষিতির সেই ডায়েরি আমি পুড়িয়ে ছাই করে দেবো… তবেই নিস্তার পাবে পৃথিবী… চৌকিদার পাহাড়ের মাথার সব ক-টা থাম ভেঙে ফেলে দেব… ওখানকার সত্তারা চেয়েছিল পৃথিবী থেকে মানুষ জাতটাকে শেষ করে দিতে, গোটা পৃথিবী গ্রহটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে মহাশূন্যের নামহীন একটা তল্লাটে নামহীন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে।
“কিন্তু তা হল না। তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হল যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। কাজ হাসিল করতে চেয়েছিল ঝটপট, কম সময়ের মধ্যে। ক্ষিতির আকৃতি বেড়েছে তাই অমন বেধড়কভাবে। না, না, ক্ষিতি তাকে ডেকে আনেনি। সে যে ক্ষিতিরই যমজ ভাই। কিন্তু চেহারা প্রায় পিতৃদেবের মতনই— যার ঔরসে তার আবির্ভাব ঘটেছিল সাবিত্রীর গর্ভে।”
এইচ পি লাভক্র্যাফটের The Dunwich Horror অনুসরণে
পুনঃমুদ্রিত
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, অনুবাদ উপন্যাস, উপন্যাস, এইচ পি লাভক্র্যাফট, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা