ডেভিড কাকার বাড়ি
লেখক: পবিত্র ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
উৎসর্গ: আতঙ্ক সম্রাট হাওয়ার্ড ফিলিপ লাভক্রাফট
ডেভিড কাকার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই বৃষ্টিটা জোরে নামল। আজ প্রায় তিনমাস পর কাকার বাড়ি এলাম। আসলে কাকাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে হঠাৎই সবাই চিন্তিত হয়ে পেড়েছে। এই বিগত তিনমাস এমনিতেই কাকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি, তার ওপর কাল কাকার বাড়ির এলাকার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বাবার দেখা হয়, তাঁর মুখে কাকার ব্যাপারে অদ্ভুত কিছু কথা জানা গেছে। আর সেই থেকে সবাই খুব দুশ্চিন্তায় আছি…
ডেভিড কাকা আমার বাবার একমাত্র ছোট ভাই। ছেলেবেলা থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী কাকার গাছপালার প্রতি অফুরান ভালোবাসা। বটানিতে পিএইচডি করার পর কলকাতারই এক নামি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন আজ থেকে বছর দশ-বারো আগে। আমাদের কলকাতার বাড়ির ছাদে বাগান করেছিলেন কাকা। মানুষজনের চোখ দাঁড়িয়ে যেত বাগান দেখে। কিন্তু কলকাতার বাড়িতে কাকার মন টিকল না। তিনি পাড়াগাঁ ভালোবাসতেন। সবুজের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন। কলকাতার পরিবেশে নাকি তাঁর দমবন্ধ হয়ে আসত। তাই বছর পাঁচেক আগে একদিন বাবা আর ঠাকুমার কাছে সবিনয়ে জানালেন যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক মফস্বলে পাঁচ কাঠা জমির ওপর ছোট্ট একটি বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন সেখানেই পাকাপাকিভাবে থাকতে চান। বাবা আর ঠাকুমা আপত্তি করেছিলেন কিন্তু কাকা ততদিনে বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। এখন আর কিছু করার ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম কাকা হয়তো নিজের বাড়ির চারিদিকে বাগান করবেন, কিন্তু গিয়ে দেখা গেল জনবসতি থেকে তাও প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে রীতিমতো জঙ্গলের ভেতর বাড়ি বানিয়েছেন কাকা।
যাইহোক, আমরা যে যার মতো নিজের নিজের বাড়িতে থাকতে লাগলাম। কাকার বাড়িতে আমি মাঝে মধ্যেই যেতাম। দুই-তিনদিন করে থেকে আসতাম। কাকা যখন কয়েক দিনের জন্য সেমিনার বা অন্যান্য কাজে শহরের বাইরে যেতেন তখনও আমি গিয়ে থাকতাম। কাকা আমাকে অতিরিক্ত চাবি দিয়েই রেখেছিলেন। উনি আমাকে নিজের পুত্রের মতোই স্নেহ করতেন। উনি বলতেন, “আমার তো আর সংসার ছেলেপুলে নেই। তুইই আমার ছেলে রে পিটার। আমি যখন বাইরে কাজে অকাজে বেরিয়ে যাই, তখন এসে একটু ঘরদোরগুলো দেখিস, আমি না থাকলে ও বাড়ি তোরই হবে!”
না! কাকার ছবির মতো সুন্দর বাড়িটা হাতিয়ে নেওয়ার লোভ কোনওদিনই আমার ছিল না। কিন্তু বাড়িটাকে নিজের বাড়ির মতোই ভালবাসতাম। আর তাই সেই টানে টানেই আসতাম।
এরকমই সব চলছিল । তবে গত তিনমাস বাবার শরীরটা খারাপ হওয়ার দরুন, কাকার বাড়ি আসা হয়নি। এর মধ্যে সপ্তাহ তিনেক কাকা গেছিলেন উত্তরাখণ্ড। কী এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারের জন্য। কিন্তু যেদিন উত্তরাখণ্ড গিয়ে পৌঁছলেন তার পরের দিন সকালে টিভি খুলতেই ভয়ে আমাদের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। উত্তরাখণ্ডের একটি রাসায়নিক পরীক্ষাগারে ভয়ানক বিস্ফোরণ! তিনজন নিহত এবং প্রায় তেইশ জন আহত। কাকার সেমিনার ছিল বিকেলে, কিন্তু সকালে কী এক কাজে কোনও এক পরীক্ষাগারে যাওয়ার কথা কাকার ছিল সেটা উনি আমাদের জানিয়েছিলেন। বাবা যেন অস্থির হয়ে উঠলেন। ঠাকুমাকে কিছু জানানো হল না। আমি উপায়ন্তর না দেখে কাকার নম্বরেই ফোন করেছিলাম। দু-চারবার রিং হওয়ার পর যখন ফোন ধরা হল, এবং ওপার থেকে কাকার কণ্ঠস্বর পেলাম, তখন যেন ধড়ে প্রাণ এসেছিল। আগের দিন এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌঁছতে গভীর রাত হয়ে যায় বলে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলেন কাকা। পরীক্ষাগারে তিনি সেদিন যেতেই পারেননি। আমরা সবাই টেনশন করছি শুনে কাকা হো হো করে হেসেছিলেন।
আমার সঙ্গে কাকার সেই শেষ কথা। এর ক-দিন পরেই কাকা বাড়ি ফিরে আসেন বাবার কাছে জানতে পারি। আমার নিজের তখন কলেজে প্রজেক্টের চাপে দমবন্ধ অবস্থা। তাই কাকার সঙ্গে আর কথা বলে হয়ে ওঠা হয়নি। নিজের দুনিয়ায় যেন ডুবে গেছিলাম। সম্বিৎ ফিরল গত রাতে খাবার টেবিলে বসে। বাবার সঙ্গে সেদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে মেট্রোয় উত্তম হাওলাদারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উত্তম হাওলাদার হলেন কাকার পাড়ার লোক। কাকার বাড়িতে গৃহপ্রবেশের সময় আলাপ। উত্তমবাবু কলকাতা এসেছিলেন তাঁর ছেলে শান্তনুর জন্য ল্যাপটপ কিনতে। ছেলে পুনেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আজকালের মধ্যেই বাড়ি আসবে, তাই ছেলের জন্য উপহার দেখতে এসেছিলেন। যাইহোক, তাঁর কাছে বাবা ডেভিড কাকার ব্যাপারে অদ্ভুত একটি কথা জানতে পারেন। উত্তরাখণ্ড থেকে ফেরার পর থেকে নাকি কাকাকে আর বাড়ির বাইরে দেখাই যায় না। এমনিতে কাকা সকাল সকাল কলেজের জন্য বেরিয়ে যেতেন। কিন্তু দুপুর দুপুর বাড়ি ফিরে এসে তারপর একেবারে সন্ধ্যা হওয়ার আগে পর্যন্ত পাড়ার ভেতর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। গাছপালাগুলোর দিকে নজর রাখতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের গায়ে হাত বোলাতেন। কিন্তু এখন নাকি তাঁকে আর বাড়ির বাইরে দেখাই যায় না। সম্ভবত কলেজে পড়াতেও যাচ্ছেন না। তবে সব থেকে আশ্চর্য এবং কিছুটা হলেও ভয়ের ব্যাপার হল কাকা নাকি রাত্রে একা একা কোথাও একটা যান। সন্ধ্যা আটটা বাজার পর থেকেই নাকি গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েন কাকা। উদ্ভ্রান্তের মতো হনহন করে হাঁটেন তিনি। তাঁর নাকি চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। উত্তমবাবু নিজের চোখে দেখেছেন একদিন। অনেক গভীর রাত পর্যন্ত নাকি কাকা এইভাবে ঘুরে বেড়ান। এত রাতে তিনি কোথায় যাচ্ছেন একথা জিজ্ঞেস করায় কাকা উসকোখুসকো চুল এবং পাগলাটে দুই চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ ওঁর দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যান। বেশ অবাক হয়েছিলেন উত্তমবাবু। কিন্তু আরও আশ্চর্যের ব্যাপার উত্তমবাবুর হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বারবার মনে হয়েছে যেন কেউ ওঁর পেছন পেছন জোরে জোরে পা ফেলতে ফেলতে আসছে। দু-একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পাননি বটে, কিন্তু কাকুর বিশেষ বিদেশি পারফিউমের গন্ধটা ওঁর নাকে বার বার এসেছে। বারবার ওঁর মনে হয়েছে যেন অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো কাকাই তাঁকে অনুসরণ করছেন। তাঁর অসংলগ্ন ধুপধাপ পায়ের শব্দ এবং মধ্যে মধ্যে চাপা নিশ্বাসের রেশটুকুও যেন শুনতে পেয়েছেন উত্তমবাবু। অন্ধকার নির্জন রাস্তায় কোনও এক উন্মাদ অশরীরী যেন তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে! ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই উত্তমবাবুর ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। কোনওমতে দৌড়ে ছুটে বাড়ি ফেরেন তিনি। ব্যাপারটাকে নিজের মনের ভুল বলে উড়িয়েই দিতেন হয়তো কিন্তু এই অভিজ্ঞতা তাঁর একার নয়। পাড়ার অনেকের সঙ্গেই এমন হয়েছে। যদিও কাকাই যে তাদের পিছু নিয়েছেন এমন স্পষ্ট কোনও প্রমাণ কারো কাছে নেই। কিন্তু কাকার গতিবিধি যেন দিন দিন সন্দেহজনক হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ি এসে তাঁরা জানাবেন এমন পরিকল্পনাও নাকি করা হচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বাবার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়ে গেল।
“কবে থেকে এইসব হচ্ছে? মানে ডেভিডকে রাত্রিবেলা ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে!” মা জিজ্ঞেস করেছিলেন।
“ওঁর কথা শুনে মনে হল সেই উত্তরাখণ্ড থেকে ফেরার দিনকয়েক পর থেকেই।” বাবা চিন্তিত মুখে বলেছিলেন।
“ভেবে দেখ স্যামান্থা! আমাদের সঙ্গেও কিন্তু সেই তখন থেকেই আর কোনও যোগাযোগ নেই ওর! আমার খুব টেনশন হচ্ছে! ওকে অন্তত বিশ বার ফোন করেছি, অথচ ধরছে না। আজ মায়ের ওষুধ নিয়ে আসার কথা ছিল নয়তো আমি উত্তমবাবুর সঙ্গেই চলে যেতাম ওর বাড়ি। যাক! আমি কালই…!”
“আমি যাবো!” বাবাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বলে উঠেছিলাম, “দেখো! কাকা কেমন খামখেয়ালি জানোই তো! এটাও ওঁর কিছু একটা খেয়াল। ফোন করে যে খুব একটা ওঁকে পাওয়া যায় তেমন সুনামও তো নেই। আর ওই রাতের বেলা মানুষজনকে ধাওয়া করাটা ওই গ্রামের লোকদের মনের ভুল! সব পাড়াগেঁয়ে মানুষজন, এক না হয় এক বলে!”
“হ্যাঁ! ঠিকই!” মা আমার হয়ে বললেন। “তুমি অত মাথার ওপর চাপ নিয়ে শরীর অসুস্থ করো না! পিট কাল গিয়ে দেখে আসবে ডেভিডকে!”
আর তাই আজ আমার আসা। সকালে কলেজ গেছিলাম। একটা খুব জরুরি প্র্যাক্টিকাল ক্লাস ছিল। সব সেরে বেররে বেরতে দুপুর হয়ে গেল এবং কাকার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে। সকালে কাকাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেও পাইনি। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাকা এমনই আত্মভোলা। কিন্তু কাকার বাড়ির সামনে এসে যখন দেখলাম দরজায় তালা ঝুলছে, তখন যেন বুকটা অজান্তেই ধড়াস করে উঠল। ঘড়ি দেখলাম সোয়া ছ-টা বাজে। সন্ধে হয়ে গেছে। তায় আবার মাথার ওপর নভেম্বর মাসের বৃষ্টি। আমি আগে ব্যাগ থেকে কাকার বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবি বের করে তালা খুলে ঘরে ঢুকে পড়লাম।
নভেম্বরের শেষ দিক, মানে ঠাণ্ডাটা অল্প অল্প পড়েছে, তার ওপর বৃষ্টি পড়ছে মানছি কিন্তু তাই বলে কাকার বাড়ির ভেতর পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডায় কাঁপ ধরে যাবে বুঝতে পারিনি। হঠাৎই যেন দাঁতে দাঁত ঠুকে যেতে লাগলো এতই ঠাণ্ডা। কয়েক পা এগিয়ে গেলাম সুইচ বোর্ডটার দিকে। হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালালাম। এখন যেখানে আছি সেটা একটা ছোট বৈঠকখানা বা ড্রয়িংরুম, এরপর সোজা গেলে পড়বে কাকার বেডরুম কাম ডাইনিং কাম সবকিছু। সেটা থেকে ডান দিকে গেলে ছোট একটা স্টাডি। আর বাঁ দিকে কিচেন বাথরুম। এই বাড়ি। ঘরে আলো জ্বলে উঠেই পরিপাটি ড্রয়িং রুমটা দেখে মন জুড়িয়ে গেল। ছোট একটা টেবিলের চারিদিকে ছোট ছোট কয়েকটা বেতের মোড়া। দেওয়ালে তাক ভর্তি বই, নেপালি মুখোশ আর জানলার সামনে সারিবদ্ধ টবে বসানো গাছ। না অস্বাভাবিক কিছুই নেই। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চারদিকটা দেখে বুঝতে পারলাম সেই শেষবার যেমনটা দেখে গেছিলাম তার চেয়ে কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু কাকা কই? একবার ফোন করলাম। রিং হচ্ছে! কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর খেয়াল হল, বেডরুমের ভেতর থেকে ফোনের রিংটোন ভেসে আসছে। আমি দ্রুত পায়ে গিয়ে হাজির হলাম বেডরুমে। আলো জ্বালানোর আগেই বুঝেছিলাম যে ফোনটা কাকার খাটের ওপর পড়ে আছে। আলো জ্বালিয়ে বিছানার কাছে গিয়ে পুরনো আমলের নোকিয়া ফোনটা হাতে তুলে দেখি গুচ্ছের মিস্ড কল! বাবার ফোন থেকে, আমার ফোন থেকে, আরও দু-একজনের… সব মিলিয়ে সাতচল্লিশ। বেডরুমের বাঁ দিকের ডোরাকাটা নক্সার সোফা-কাম-বেডের ওপর বন্ধ জানলার কাচের শার্শির ওপারে বৃষ্টিটা আছড়ে আছড়ে পড়ছে। এবার যেন আমার সত্যিই কাকার জন্য দুশ্চিন্তা হতে লাগলো। কাকা ভুলো প্রকৃতির বটে, কিন্তু এইভাবে ফোন ফেলে রেখে কোথাও কখনও যেতে দেখিনি। ফোনটা সব সময় নিজের সঙ্গেই রাখতেন। তারপর আমার খেয়াল হল, কাকার স্টাডি-রুম দিয়ে পেছনের দিকের জঙ্গলটায় যাওয়ার একটা দরজা আছে। আচ্ছা এমন নয়তো, কাকা বাড়ির সামনের দরজায় তালা দিয়ে পেছনের জঙ্গলটায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন! তাই হয়তো ঘরে ফোন রেখে দিয়ে গেছেন। হ্যাঁ, তেড়ে বৃষ্টি হচ্ছে বটে, কিন্তু কাকা এই বৃষ্টি কাকার কাছে কিছুই না। দিব্বি ছাতা মাথায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এইরকম ধারাবর্ষণেও। একবার দেখে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরেটা দেখে আসলেই হয়। কথাটা ভেবে স্টাডি-রুমের দিকে ফিরতে যাব, কী মনে হল একবার চটকরে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। দরজা খুলে মাথা বাড়াতেই তীব্র একটা ফিনাইলের মতো গন্ধ এসে নাকে আঘাত করল। মনে হচ্ছে কাকা এইমাত্র কিচেন পরিষ্কার করেছেন। দুপুরের রান্না সেরেছে হয়তো কিছুক্ষণ আগে। ঘরটা অন্ধকার, কিন্তু আমি আর আলো জ্বালালাম না। হয়তো কাকা কিছুক্ষণ আগেও ছিলেন কিচেনে। বেশ কিছুক্ষণ কিচেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়য়ে ভাবলাম। হ্যাঁ তাই হবে, কাকা আশপাশেই আছেন। আমি আর দেরি না করে কাকার স্টাডি-রুমে গিয়ে আলো জ্বালালাম। সব স্বাভাবিক। টেবিল, চেয়ার, বইপত্র, কম্পিউটার, আলমারি, গাছের টব ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপকের স্টাডি-রুম যেমন হয়, তার চাইতে অতিরিক্ত কিছুই না। আমি সোজা গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নেমে এলাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। কাকা তো অস্ত দূর দূরান্ত পর্যন্ত একটা ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ পর্যন্ত পেলাম না। ঘরের ভেতর ফিরে এলাম। বৃষ্টিতে শরীরের কিছুটা আর মাথাটা একটু ভিজে গেল। কী জানি সে জন্যেই কিনা ঠাণ্ডাটা যেন বেশ জেঁকে ধরল আমাকে। কাকার সঙ্গে দেখা না করে বাড়ি ছেড়ে যাব না সেটা মনে মনে পণ করেই ছিলাম। মাকে বলেই এসেছিলাম যে আজকের রাতটা এখানে থেকে যাব। আসলে কাকা রাত্রে প্রকৃতপক্ষে কী করেন সেটা জানাটা আগে দরকার ছিল। যাইহোক, আশা করি তিনি নিজের কোনও কাজে বেরিয়েছেন, একটু পরেই ফিরবেন। ততক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। দুপুরে ক্যান্টিনে পেট ভরে খেয়ে এসেছিলাম। তাই খিদে নেই। সময় কাটাবার জন্য ভাবলাম কিন্ডেল ডিভাইসটা বের করে কিছু একটা পড়ি। এই বৃষ্টিতে বেশ জমিয়ে লাভক্রাফট পড়া যেতে পারে। ঘরের তীব্র এলইডি আলোটা নিভিয়ে দিয়ে মৃদু সবুজ আলোটা জ্বেলে জানলার ধারের সোফাটায় গিয়ে পা ছড়িয়ে আধশোয়া হয়ে কিন্ডেলটা বুকের ওপর রাখলাম। বাইরের বৃষ্টির ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁসানি হয়েই চলেছে। ঠাণ্ডা একটা শিরশিরে হাওয়া যেন বন্ধ জানলা ভেদ করে আমার ঘাড়ে মাথায় এসে লাগছে। বিছানা থেকে একটা কম্বল নিয়ে আনব কিনা ভাবছি এমন সময় পায়ের কাছে একটা নরম অথচ উষ্ণ কিছু একটা টের পেলাম। বেশ মোটা একটা কম্বলের মতো চাদর। না কাকার সেই কালো চাদর নয়। হালকা সবুজ আলোয় সঠিক বুঝতে না পারলেও একটুকু বুঝলাম যে চাদরটা বেশ দামি। নরম ঘাসের মতো কাপড় দিয়ে তৈরি এবং গায়ে জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল। এই এতক্ষণের শিরশিরে ঠাণ্ডাটা কেটে গিয়ে বেশ আরাম এবং স্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। কিন্ডেলটা তুলে চোখের সামনে ধরলাম। অহ! এই সময় একটু গরম কফি হলে বেশ হত, কাকার এই ঘরেই কফি মেকার আছে। কিন্তু শরীরের ওপর থেকে উষ্ণতার পরতটা হটাতে ইচ্ছা হল না। চাদরটা আরও বেশ আঁটসাঁট করে জড়িয়ে সোফার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে বুকের ওপর কিন্ডেল ডিভাইসটা ধরে সূচিপত্র দেখতে লাগলাম। ডানউইচ হরর… হ্যাঁ! এই পরিবেশে এরকম একটি ভয়াল উপন্যাসই জমবে ভালো। মনে মনে ঠিক করে নিয়ে গল্পটার ওপর আঙুল দিয়ে একবার টোকা দিতেই সেটা আমার যন্ত্রের স্ক্রিনে চোখের সামনে ভেসে উঠল। বেশ একটু আড়মোড়া ভেঙে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম গল্পটা। বৃষ্টিটা বাইরে এক নাগাড়ে হয়েই চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাইরের দুর্যোগের শব্দ যেন কানের ভেতর ফিসফিসিয়ে যাচ্ছে, যেন ঘুম পাড়ানী গান। শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল। কেন জানি না মনে হতে লাগল বাইরের বৃষ্টিটা ঠিক বৃষ্টি নয়। যেন সেটা এক শয়তানী শক্তি, কোনও এক জাদুকরী, যে কিনা কাকার এই ছোট্ট বাড়ির চারিদিকে এক অশুভ শক্তিবৃত্তের ভেতর গিলে ফেলতে চাইছে। আমার মনে হতে লাগল, সেই যে বাইরে থাকাকালীন বৃষ্টির জলে মাথা ভিজে গেছিল, সেই জন্যই বোধহয় আমার ওপর কোন এক অশরীরী শক্তির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নাহলে, এখন সবে সন্ধে সাতটাও বাজেনি, এখনই আমার গল্পটা পড়তে পড়তে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে কেন? এরকম তো হওয়ার কথা নয়। আমি জোর করে, চোয়াল শক্ত করে চোখ চেয়ে থাকার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য মায়াবলে যেন আমার চোখ বুজে আসতে লাগল… নিজের অজান্তেই যেন কিন্ডেলটা পাশে রেখে, চাদরটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কানের ভেতর সোঁ সোঁ শব্দটা যেন হয়েই চলেছে…
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই। কেমন এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে চোখ খুললাম, যদিও ঘুমের ঘোর তখনও কাটেনি। কানের ভেতর সোঁ সোঁ শব্দটা তখনও হয়েই চলেছে। যেন কেউ কানের কাছে মুখ এনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে শব্দটা করছে। আমি আধ বোজা চোখে কাচের জানলার বন্ধ শার্শির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক-টা বাজে এখন? কাকা কি এখনও ফেরেননি? নিজের চিন্তার মধ্যেই ডুবে আছি, ঠিক সেই সময় হঠাৎ কাচের শার্শির ওপর একটা ব্যাপার লক্ষ করতেই শরীরটা ভয়ে অবশ হয়ে গেল। আমার মাথার পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। না কাকা নয়। ঘষা কাচের মোটা শার্শিতে স্পষ্ট না হলেও এটুকু বুঝতেই পারছিলাম যে একটা লম্বা কেশ বিশিষ্ট ফ্যাকাসে মুখ আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এবং আমি যেমন তাকে দেখছি, সেও কাচের দিকে চোখ রেখে আমার দিকেই দেখছে! কাকার বাড়ি এর আগে বহুবার একা কাটিয়েছি, কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা কখনই হয়নি। আমি নিজেকে সাহসী বলেই জানতাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিজেকে নিয়ে পুনর্বার পর্যালোচনার দরকার। ভয়ে বোধহয় চোখ বন্ধ করেই নিয়েছিলাম এমন সময় কপালে ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ এবং কানের কাছে ফিসফিসিয়ে “পিট” শুনে আমি চমকে উঠে তাকালাম…
ডেভিড কাকা! আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কাকা সত্যিই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ঘর এখন এলইডি টিউবের আলোয় আলোকিত। বলা বাহুল্য একটু আগের সেই লম্বা চুল ফ্যাকাসে ছায়ামূর্তির এখন আর কোথাও কোনও চিহ্ন নেই।
“তু… তুমি কখন এলে?” আমি কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম ঘুম জড়ানো গলায়। খেয়াল করলাম গায়ের চাদরটা আর নেই। সেটা পায়ের কাছে দলা পাকিয়ে আছে। আলোয় দেখলাম সেটার কালচে সবুজ রং। আমিই বোধহয় কখন ঘুমের মধ্যে সরিয়ে দিয়েছি।
আমার প্রশ্ন শুনে কাকা হেসে বললেন, “অনেকক্ষণ ফিরেছি! তুই তো ঘুমাচ্ছিলিস, তাই আর বিরক্ত করিনি। রান্না চাপালাম। তারপর কফি করে তোকে ডাকতে এলাম!”
কাকার কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। তাহলে এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। তাই-ই হবে। তা ছাড়া আবার কি?
বৃষ্টির শব্দ আর পাচ্ছি না। মনে হয় ধরে গেছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখলাম সাড়ে আটটা বাজে। হ্যাঁ একটু কফি হলে মন্দ হয় না, ঘুমের রেশটা ছেড়ে যাবে। সোফার পায়ের দিকে, কিচেনে ঢোকার মুখেই একটা ওয়াশ বেসিন আছে। আমি উঠে মুখ ধুতে গেলাম। সোফার পাশেই ছোট্ট টি-টেবিলে কাকা ট্রেতে করে দু-কাপ কফি এনে রাখলেন।
“তুমি কোথায় গেছিলে বল তো কাকা?” আমি কল খুলে মুখে আঁজলা ভর্তি জলের ঝাপটা দিতে দিতে বললাম।
“ও একটু কাজ ছিল!” কাকা উত্তর দিলেন।
“কী কাজ? আর কীসব শুনছি তোমার নামে?” আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বললাম।
“শুনেছিস বুঝি?” কাকা অদ্ভুতভাবে কথাটা বললেন।
আমি ওঁর দিয়ে এগিয়ে বললাম, “কী হয়েছে বল তো তোমার?”
কাকা যেন আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমার দিকে তাকালেন, “হ্যাঁ? আরে… আরে বোস! কফি খা!”
ঘুমের ঘোর কাটার পর বুঝতে পারছি উওম হাওলাদার ভুল কিছু বলেননি। কাকার মুখ যথেষ্ট ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। স্বস্তির ভাবটা কেটে গিয়ে পুনরায় দুশ্চিন্তা এবং ভয়ের একটি শিরশিরানি অনুভব করতে লাগলাম।
“আরে বোস আগে!” কাকা স্বাভাবিকভাবে বললেন। যদিও আমার মনে হল কাকা কিছু একটা লোকাচ্ছেন।
আমি কাকার উলটোদিকের একটি চেয়ারে বসে স্পষ্টভাবে বললাম, “তুমি রাতের বেলা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াও নাকি?”
কাকা যেন জানতেন আমি ঠিক এই প্রশ্নটাই করব। তিনি আমার দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “সব বলছি তোকে। আসলে…” এইবার কাকা কেমন এক অসহায় চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “তুই হয়তো আজ আমার বাড়ি এসে ঠিক করিসনি! কিন্তু… তোকে তো একদিন না একদিন আসতেই হত!”
“মানে? এ কী আজব কথা?” আমি ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলাম।
কাকা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলতে শুরু করলেন, “উত্তরাখণ্ডের যে পরীক্ষাগারে সেই যে দুর্ঘটনাটা হল। সেটা স্বাভাবিক ছিল না জানিস তো। কেউ বা কারা ইচ্ছা করেই দুর্ঘটনাটা ঘটিয়েছে!”
আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, “তুমি কী ওখানে গেছিলে?”
“হ্যাঁ। আমি সেদিন বিকেলে গেছিলাম। আমার কাছে স্পেশাল পাস ছিল। তাই পুলিশের বেড়াজাল ভেদ করে দুর্ঘটনাস্থলের ভেতরটা ঢুকে দেখতে পেরেছিলাম। পুরোটাই জ্বলে পুড়ে ছাই। খুব প্ল্যান করে না করলে এইভাবে একটি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত রীতিমতো শক্তপোক্ত বিল্ডিংয়ে আগুন লাগানো যায় না!”
“কিন্তু কারা এমন কাজ করেছে?”
“সেটা নিশ্চিত বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা সরকারের তরফ থেকেই এটা করা হয়েছে!” কাকা মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল।
“সেকি? কেন?” আমি কফিতে চুমুক দিয়ে গিয়েও থেমে গেলাম।
“সেটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি, তবে আমার মন বলছে হয়তো এটা একটা চক্রান্ত!” কাকা ভুরু কুঁচকে মেঝের দিকে তাকিয়ে আবার একটু কী যেন ভেবে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “তা সে যা হওয়ার হয়েছে। আমি নিজের মনের কথা মনে চেপে রেখে বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই।”
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। কাকা বলতে থাকলেন, “প্রথম কয়েকদিন কিছু বুঝিনি। তারপর, বোধহয় দু-দিন পর। রাতে ঘুমাচ্ছি। আমার আবার রাতে একটু রেডিয়ো শুনতে শুনতে ঘুমানোর অভ্যেস আছে। কানে হেডফোন গুঁজে রেডিয়ো চালিয়ে চোখ বুজিয়ে শুয়ে থাকি। একটি চ্যানেলে বেশ ভালো ভালো পুরনো দিনের গান হয়, শুনতে শুনতে দিব্বি ঘুম এসে যায়। সেদিনও কানে হেড ছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। যে চ্যানেলে গান শুনছিলাম সেই চ্যানেলটার বোধহয় কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে, তাই শুধু কানের ভেতর টপটপ করে মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি কান থেকে হেড ফোন খুলে মোবাইলের রেডিয়োটা অফ করতে যাব, কিন্তু দেখি মোবাইল বন্ধ। তারপর মনে পড়ল সকাল থেকেই ফোনে চার্জ কম ছিল। রেডিয়ো চলতে চলতে কখন বন্ধ হয়ে গেছে… কিন্তু ফোন যদি বন্ধই থাকবে, তাহলে মৃদু টপটপ করে শব্দ হচ্ছে কীসের? আমি কান থেকে হেড ফোন খুলে উঠে বসলাম। বিছানার দেওয়াল লাগোয়া সুইচ বোর্ডটার দিকে হাত বাড়াতে যাব, এমন সময় খেয়াল হল মেঝের মধ্যে কিছু একটা… বা বলা ভালো কেউ একটা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে! মৃদু শব্দটা হাত আর পা ফেলার শব্দ!”
কাকার কথাটা শোনা মাত্র আমার যেন শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। এই ঘর… এখন যেখানে বসে আছি… এখানেই…
কাকা বলতে থাকলেন, “ঘর অন্ধকার ছিল। কিন্তু তবুও যেন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম কেউ একজন, ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে! যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। ক্ষুধার্ত কোনও পশু নিজের খাঁচার ভেতর পায়চারী করে সেইভাবেই যেন…!”
কাকার কথা শুনে ভয়টা যেন জাঁকিয়ে ধরল আমায়। অন্ধকার ঘরে নিজের বিছানার নীচে কোনও কিছু উন্মাদের মতো চারপায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে সেটা ভাবতেই যেন গায়ে কাঁটা দিতে লাগল। কেন জানি না মনে হতে লাগল একটু আগে কাচের শার্শিতে আমি যার আবছায়া লক্ষ করেছি, কাকা হয়তো তার কথাই বলছেন।
“কিছুক্ষণ বিহ্বলের মতো অপেক্ষা করে আমি হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালালাম।”
“কী দেখলে?” আমি উত্তেজনায় বলে ফেললাম।
“কিছুই না! কেউ নেই!” কাকা কফির কাপে এই প্রথম চুমুক দিলেন। এতক্ষণে কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
আমার যেন ঠাণ্ডাটা আবার লাগতে শুরু করেছে। আমি সোফার দিকে তাকিয়ে দেখি চাদরটা তখনও পড়ে আছে। থাক! আর একটু বেশি যদি শীত করে তখন না হয় তুলে আনব।
কাকা এদিকে বলে চললেন, “তা সেদিনের মতো আর কিছু হল না। আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন কলেজ গেলাম, বাকি কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যা হয়ে গেল ফিরতে ফিরতে। বাইরে খেয়েই এসেছিলাম তাই আর রান্নার ঝামেলা করলাম না। ক্লান্ত ছিলাম বটে, কিন্তু পিছনের জঙ্গলটায় যেন মন টানতে লাগল। পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলাম। সবে এক-দু-পা এগিয়েছি কী এগোইনি, অমনি দূর থেকে একটি মৃদু শব্দ ভেসে আসতে লাগল। প্রথমটা মনে হল কুকুর বা বিড়ালের কান্না ভেসে আছে দূর থেকে… কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল শব্দটা আর ভেসে আসছে আমারই বাড়ির ভেতর থেকে! হ্যাঁ… আমার বাড়ির ভেতর থেকেই, কোনও ভুল নেই। আমার যে একটু ভয় করল না তা নয়। এইমাত্র ঘর থেকে এলাম, কোথাও কিছুই দেখলাম না আর বাইরে বেরতেই এরকম শব্দ! যাইহোক, আমি সাবধানে বাড়ির দিকে এগোলাম। কিন্তু বাড়ির দরজার সামনে আসতেই, শব্দটা যেন থেমে গেল। আমি দরজা খুলে স্টাডি রুমে ঢুকলাম। নাহ! কোথাও কিছুই নেই। সারা বাড়ি খুঁজলাম, কিন্তু কোথাও কোনও কুকুর-বিড়াল বা অন্য কিছুই দেখতে পেলাম না। নিজেকে কী বলে বোঝাব কিছু বুঝতে পারলাম না। মনে আশঙ্কা নিয়ে সে-রাতের মতো শুতে গেলাম। বোধহয় ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। কিন্তু আবারও… কান্নার শব্দ… ভেসে আসছে আমার খুব কাছ থেকে… আর বিড়াল বা কুকুরের নয়… কান্নাটা মানুষের… মেয়ে মানুষের… এবং সেটা ভেসে আসছে আমার রান্নাঘর থেকে… আমার… আমার আর সাহস হয়নি রে, হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালাতে সাহস হয়নি। কান্নার শব্দ শুনতে শুনতেই চোখ বুজিয়ে পড়ে রইলাম। পরদিন চোখ খুলেছিল অনেক বেলায়। কিন্তু মন থেকে শান্তি চলে গেছিল। প্রতি রাতে সেই কান্না আর ঘরের ভেতর হামাগুড়ি, একদিন তো রীতিমতো দাপাদাপি করল। জিনিসপত্র ফেলে দিল। একবার তো আমার মনে হল যেন আমার কানের কাছে এসে চিৎকার করল। একবার মনে হল কোনও তান্ত্রিকের কাছে যাই! কিন্তু বেশির ভাগই যে ভণ্ড! আমার এই সমস্যার সমাধান কী আদৌ হবে? শেষমেশ মনে করলাম তোদের কাছেই ফিরে যাব। এ… এ ভূতুড়ে বাড়িতে থাকবো না। একদম মনে মনে সব ঠিক করে নিয়ে ফেলেছি। সেই রাতটা কাটলেই হয়তো পরদিন আমি কলকাতায় ফিরতাম… কিন্তু… কিন্তু সেই রাতে আর কোনও উপদ্রব হল না। সব শান্ত! নিরবচ্ছিন্ন। বেশ ঘুমলাম সেই রাতে। রাতে ভালো ঘুম হল বলে সকাল সকাল জেগেও উঠলাম। কিন্তু কিচেনে যেতেই চমকে উঠলাম। দেখি মেঝের ওপর একটি বিড়ালের দেহাবশেষ পড়ে আছে… হ্যাঁ… বিড়ালই তো… আধখাওয়া দেহ… সে এক বীভৎস দৃশ্য রে পিট… শুধু এটুকু বলি, প্রাণীটার শুধু রক্তাক্ত চামড়া…ক-টা হাড় আর মাথাটা পড়ে আছে…
আমি ছুটে নিজের ঘরে ফিরে এসে খাটের ওপর বসলাম। কপালে ঘাম দিতে শুরু করেছিল আমার। বেশ কিছুক্ষণ থ হয়ে বসে থাকার বুঝতে পারলাম… কাল রাতে সব শান্ত থাকার কারণ। কাল রাতে সে খেতে পেয়েছে। সে প্রতি রাতে খাওয়ার জন্য কাঁদে। কাল বোধহয় কারও কোনও পোষা বিড়াল আমার বাড়িতে ভুল করে এসে পড়েছিল… আর তাই… তারপর মনে হল, আচ্ছা! আমি যদি রোজ রাতে ওকে একটা বিড়ালের দেহ খেতে দি! তাহলে তো সে আর ঝামেলা করবে না। আর আমাকেও আমার এই প্রিয় বাড়িটা ছাড়তে হবে না। সেদিন সূর্যাস্তের পরই আমি বেরিয়ে পড়লাম খুঁজতে। রাস্তায় তো খুঁজলেই বিড়ালের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সহজে পেলাম না বটে, বেশ একটু গভীর রাতে বড় রাস্তা ধরে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর একটা গাড়ি চাপা পড়া বিড়ালের দেহ পেয়ে গেলাম। বাড়ি ফিরে সেটা কিচেনে রেখে এলাম।”
এই বলে কাকা একটু চুপ করলেন। আমি বলে ফেললাম, “চুপ করে গেলে কেন?”
কাকা একবার মুখ তুলে কিচেনের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা বুঝে নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন, “হ্যাঁ… হ্যাঁ তারপর … কাজ হয়েছিল। সেই রাতেও আর কোনও উপদ্রব হয়নি। আর তারপর থেকে কোনও দিনই হয়নি।”
“ও! তুমি রোজ বিড়াল খুঁজতে রাতের বেলা ঘুরে বেড়াও?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ! তবে বিড়াল কী রোজ পাওয়া যায়! আমি রাতে পাশের জেলে পাড়ায় যাই। কাঁচা মাছ, গোটা মুরগি কিনে আনি! রাতের দিকে সস্তা হয়!”
“কিন্তু তুমি নাকি মানুষদের ধাওয়া করো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ধাওয়া? …” কাকা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, তারপর কী একটা ভেবে বললেন, “আরে ধুর! ওরা সব হিংসে করে আমাকে। আমার নামে ভুলভাল খবর রটিয়ে আমাকে তাড়াতে চায়, বুঝলি না?”
কথাটা বলে কাকা কেমন করে হাসলেন। যেন মনে হল কাকা ইচ্ছা করেই তাদের পিছু ধাওয়া করতেন, কিন্তু আমার কাছে চেপে যাচ্ছেন। কাকার মুখটা আমার কাছে চলে এসেছিল এইসময়… এবং খুব মৃদু হলেও… কাকার নিশ্বাসটা অস্বস্তিকর লাগল… কেউ নিজে যদি কাঁচা মাছ মাংস খেলে এরকম গন্ধ মুখ থেকে বেরোয় কী? নাকি কাকা অনেকদিন ধরে স্নান দাঁত মাজা এসব ছেড়ে দিয়েছেন? নিজের বাড়িতে এরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটলে বাকি সব কিছু ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা কাকার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো? এসব কী আদৌ সত্যি? নাকি ওঁর মনের জল্পনা কল্পনা?
কাকার বলা গল্প আমি একেবারেই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আমি নিজেও কিছুক্ষণ আগে একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি তাই একেবারেই ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারছি না। কাকা চুপ করে বসে আছেন। আমি চোখ তুলে তাকালাম রান্নাঘরের দিকে! আচ্ছা… সে কী ওই রান্নাঘরেই থাকে? আমি তো বিকেল বেলা রান্না ঘরেই মুখ বাড়িয়ে দেখেছি। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাইনি। আচ্ছা এমন নয়তো? আমি যখন অন্ধকারে কিচেনের ভেতর দেখছিলাম তখন সেও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল? ব্যাপারটা মনে হতেই বুকের ভেতর ধুকপুকুনিটা যেন বেড়ে গেল। কিন্তু এরপর আর কিছু ভেবে উঠতে পারলাম না… আমার ভাবনাচিন্তা স্নায়ু শিরা-উপশিরা ঠাণ্ডা করে দিয়ে কিচেনের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল… যন্ত্রণাকাতর… এক অপার্থিব কান্নার শব্দ! আমি ভয়ে সোজা হয়ে বসলাম। কাকাও যেন ছিটকে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ঠোঁটের ওপর আঙুল চাপা দিয়ে চুপ করার ভঙ্গিতে বললেন, “চুপ কর, ভয় পাসনি! আমি এখুনি ওকে খাইয়ে আসছি! তুই একদম উঠবি না! এখানেই বসে থাক!”
এই বলে কাকা আমার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা অদ্ভুতভাবে হাসলেন। কাকার ঠিক উলটোদিকে একটা চওড়া জানলা আছে, সেটার কালো পর্দা। যেন মনে হচ্ছে কাকার মাথায় লম্বা কালো চুল…
কাকা কিচেনের দিকে চলে গেলেন, এবং তিনি প্রবেশ করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কান্না থেমে গেল বটে, কিন্তু আমি যে ব্যাপারটা অনুধাবন করলাম তা আমার হাড় হিম করে দিল। আমি যখন শুয়ে ছিলাম আমার মাথার কাছে কাকাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি সোফার দিকে একবার তাকালাম আর একবার উলটোদিকের জানলার দিকে তাকালাম। হ্যাঁ… হতেই পারে… কেউ যদি সোফার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তার প্রতিবিম্ব ওই শার্শিতে কালো পর্দা সমেত পড়বে, এবং কেউ যদি ঘষা কাচের ওপর ঘুম ঘুম চোখে তাকায়, চোখের ভুলে তার এটা মনে হতেই পারে সে সে কোনও লম্বা চুল বিশিষ্ট ছায়া মানুষকে দেখছে। তাহলে কী কাকাই আমার কানে ফিসফিসিয়ে শব্দ করছিল? তারপর আমি ভয়ে কাঠ হয়ে পড়ে আছি দেখে নিজেই আবার আলো জ্বালিয়ে ডাকলেন আমাকে? কিন্তু? আর… আর এতক্ষণ ধরে যে গল্পটা বললেন সেটা কী আদৌ সত্যি? আর কিচেনে ও কে কেঁদে উঠল… আর কাকা ঢোকার পরই সে চুপ করে গেল কেন? আমি বুঝতে পারলাম হাত-পা কাঁপছে। এখুনি পালাতে হবে আমাকে এখান থেকে। কাকার কী হয়েছে না হয়েছে সেটা অনুসন্ধান করা আমার কাজ নয়। আমাকে এখুনি বেরোতে হবে। উঠে পড়ে ধীরে ধীরে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু কিচেনের সামনে আসতেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। মস্তিষ্ক বলছে পালানো উচিত কিন্তু মন বলছে একবার… জাস্ট একবার দরজাটা খুলে ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে… না হলে…
ভাবতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল জানি না, কিন্তু নিজের হাতটাকে এগিয়ে দিয়েছিলাম দরজার নবের দিকে। এমনিতেই চারদিক নিস্তব্ধ, তার ওপর কী জানি আমার যেন শ্রবণেন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল কী না জানি না! যেন দৃষ্টি আর স্পর্শ ছাড়া আর কোনও অনুভূতি কাজ করছিল না। দরজার ধাতব ঠাণ্ডা নবটা হাত দিয়ে চেপে আস্তে করে ঘুরিয়ে… মাত্র দু-সেকেন্ড অপেক্ষা করেছিলাম… তারপর ঠেলে দিয়েছিলাম ভেতরের দিকে…
সেই বিকেলের ফিনাইলের গন্ধটা পেলাম। তার সঙ্গে একটা অন্য গন্ধও পেলাম। ভেতরটা অন্ধকার, তবে বেডরুমের আলো কিছুটা গিয়ে পড়েছে মেঝের ওপর… বোধহয়… মেঝেতে গাড় কালচে রঙের জমাট বাঁধা তরল। ফিনাইলের গন্ধ ছাড়া আর যে গন্ধটা পেয়েছিলাম, সেটা এই তরলেরই! রক্ত! ঘন জমে থাকা রক্ত! কাকার রক্ত কী? হঠাৎ ফ্যাঁস করে একটা শব্দ পেলাম। যেন একটি নেকড়ে রাগে গরগরিয়ে উঠল। আমি ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, ঘরের একেবারে শেষে, যেখানে আলো গিয়ে পৌঁছায়নি, সেখান থেকে দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! আর শুধু তাইই নয়, চোখ জোড়া আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে! আমি পিছন ফিরতে লাগলাম। আমার মাথা কাজ করছে না তখন, কী করব বুঝতে পারছি না… এদিকে চোখ জোড়া এগিয়ে কিচেনের মেঝের আলোকিত অংশের কাছে এসে দাঁড়াল! আর এরপর যা দেখলাম… সে দৃশ্য আমাকে বাকি জীবনের জন্য উন্মাদ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট! আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম, এক মুমূর্ষু, প্রায় মৃত অথচ মৃদু কম্পন-রত মানুষের টুঁটি কামড়ে ধরে আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন… ডেভিড কাকা! না ঠিক ডেভিড কাকা নয়, ডেভিড কাকার বিকৃত দানবীকৃত রূপ। তাঁর ফ্যাকাশে সাদা চামড়ায় ঠেলে উঠেছে তাঁর সকল শিরাধমনী। তাঁর দুই হাত এবং পা শক্ত করে ধরে আছে তাঁর শিকারের দেহ! কিচেনের মেঝে ভেসে গেছে রক্তে! তাহলে একটু আগে কিচেন থেকে সে যন্ত্রণা কাতর শব্দ পেয়েছিলাম তা এই হতভাগা শিকারের। আমার হাত-পা যেন ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেল। পালাতে পারা তো দূর নড়তেও পারলাম না। কিচেনের ভেতর বসে থাকা সেই দানব ততক্ষণে তাঁর শিকারের টুঁটি ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই দানবের চেহারা আমার কাকার চেয়েও লম্বায় এবং চওড়ায় প্রায় দ্বিগুণ!
না! এ আমার কাকা নয়। সেই নিরীহ শান্তিপ্রিয় উদ্ভিদ-প্রেমী ডেভিড রানেল্সের শরীরটার ওপর দখল করে নিয়েছে কোনও এক অপার্থিব অশুভ শক্তি। আর সে এখন ধীরে ধীরে দু-পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে… আমার শেষ সময় উপস্থিত… আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না!
একী? আমি কী খাচ্ছি? রক্ত নাকি? … ধড়মড় করে উঠে বসলাম এবং চারদিকে অন্ধকার দেখলাম। হাতের কাছেই মোবাইল ফোনটা খুঁজে পেলাম। ছ-টা বিয়াল্লিশ। তারপর দেখতে পেলাম সোফার পেছনে শার্শি বন্ধ করা জানলা। তাঁর বাইরে সকালের পৃথিবীটা আবছা দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু মনে পড়ে গেল। আরে! আমি এখনও কাকার বাড়িতে আছে? আমি তো বিছানায় শুয়ে আছি! মানে রাতে এখানেই ঘুমিয়েছি! হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালালাম। গায়ে জড়ানো কালচে সবুজ চাদরটা সরিয়ে ব্যাগটা তুলে নিলাম। কাকা নেই। কেন জানি না মনে হল ওঁকে এখন অন্তত পাবো না। বেডরুম থেকে বেরতে যাব, পাশে কিচেনটা চোখে পড়ল। না! আর নয়, ভেতরে কী আছে না আছে আর দেখার কোনও ইচ্ছা নেই। আমি ঝড়ের বেগে বেডরুম থেকে বেরিয়ে, ড্রয়িংরুম টপকে বাইরে এসে পড়লাম। তালা দিতেও আর ইচ্ছা করল না, সোজা দৌড় দিলাম বড় রাস্তার দিকে…
এরপর এক সপ্তাহ। কাকার কোনও খবর নেই। সেই রাতের কথা আমি কাউকেই বলতে পারিনি। বাড়িতে বলেছিলাম আমি কাকার বাড়িতে যাইইনি, সেদিন কলেজ থেকে রনাল্ডের বাড়ি চলে গেছিলাম এই কথা বলে কাটিয়েছিলাম। কাকার বাড়িতে আমাদের বাড়ির কেউ খোঁজ করতেও যেতে পারেনি। কারণ আমার সেই রাতের দু-তিনদিন পরই কাকার বাড়ি থেকে পচা গন্ধ বের হতে থাকে এবং তাঁর কিচেন থেকে একটি অর্ধভুক্ত প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটি দেহ পাওয়া যায়। এই দেহটিকেই সে রাতে সেই দানব চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছিল। দেহটি আর কারও নয়, সেটি উত্তম হাওলাদারের একমাত্র পুত্র শান্তনুর। আমার মনে আছে বাবা বলেছিলেন শান্তনু সেই সময় পুনে থেকে ফেরার কথা। সে হয়তো সেই দুর্যোগের দিন সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরছিল। মফস্বলের রাস্তা এমনিতেই ফাঁকা ছিল। কখন তাকে ডেভিডরূপী দানব আক্রমণ করে তুলে নিয়ে এসেছে তা কেউ লক্ষ করেনি। কিন্তু কাকা এরকম হয়ে গেলেন কী করে? সত্যি কথা বলতে কী উত্তর আমি একটা পেয়েছি। সেই উত্তরাখণ্ডের পরীক্ষাগার। ইন্টারনেটে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি রাশিয়ান ওয়েবসাইট থেকে জানতে পারি ওই পরীক্ষাগারে ইউক্রেন থেকে নিয়ে আসা ‘গ্রিমেস’ বলে বিশেষ একধরনের জীবের ওপর পরীক্ষা চালানো হচ্ছিলো। সম্ভবত ভারত এবং রাশিয়ান সরকারের যৌথ উদ্যোগে হচ্ছিল ব্যাপারটা। জীবটি ঠিক উদ্ভিদও নয় প্রাণীও নয়। সেটা দেখতে উদ্ভিদের মতো হলেও সেটা চলাফেরা করতে পারে। কাঁচা মাংস নাকি গ্রিমেসের প্রিয় খাদ্য, তবে সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই জীব অন্য যে কোনও প্রাণী এমন কী মানুষের সঙ্গেও মনের ভাব আদানপ্রদান করতে পারে। কিন্তু পরে জানা যায়, এই গ্রিমেসের সংস্পর্শে থাকলে অন্য প্রাণী তার মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে এবং তার শারীরিক এবং মানসিকভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মনের মধ্যে অবাস্তব ঘটনা ভেবে ভেবে সেগুলোকেই বাস্তবিক ভাবতে থাকে, এবং সেই ঘটনাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার চেষ্টা করতে থাকে। যেমনটা হয়ে ছিল আমার কাকার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত তার কী অবস্থা হয়েছিল তা তো নিজের চোখেই দেখেছি। তিনিও গ্রিমেসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েই প্রথমে বাড়িতে ভূতের উপদ্রব অনুভব করতেন এবং পরে ভূতের জন্য কাঁচা মাংস নিজেই খেতেন। তাই তার মুখ থেকে কাঁচা মাংসের গন্ধ পেয়েছিলাম। আর কিচেন থেকে যাতে গন্ধ চারিদিকে না ছড়িয়ে পড়ে তাই নানারকম রাসায়নিক তরল দিয়ে কিচেনের মেঝে পরিষ্কার করতেন। যেটা আমার ফিনাইলের গন্ধ বলে মনে হয়েছিল।
গ্রিমেস এতটা মারাত্মক সেটা হয়তো পরে জানা গেছিল। কিন্তু রাশিয়ান সরকারকে না চটিয়েই এই অভিশপ্ত জীবকে নিজেদের দেশ থেকে সরানোর জন্যই দুর্ঘটনার ষড়যন্ত্র। কিন্তু ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে কি? গ্রিমেস তার বাহক ঠিক খুঁজে পেয়েছে। প্রফেসর ডেভিড রানেল্স! কাকা গ্রিমেসের সংস্পর্শে এলেন কী করে? হয়তো দুর্ঘটনার দিন বিকেলে যখন কাকা দুর্ঘটনাস্থলে যায়, তখন কোথাও থেকে হয়তো আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া একটুকরো গ্রিমেস রুমালের মধ্যে করে নিয়ে চলে আসেন। হ্যাঁ, এতই সহজ এদের পরিবহন করা। ছোট্ট একটুকরো গ্রিমেস তিন দিনেই বেশ আকার ধারণ করে! কাকা ওই অভিশপ্ত জীবটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং নিজের জীবনে অভিশাপ ডেকে আনেন। অবশ্য অভিশাপ একা ওঁর জীবনে নয়, আমার জীবনেরও ডেকে এনেছেন তিনি। হ্যাঁ সেই রাতের সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতা আমার মনে যথেষ্ট আঘাত রেখে গেছে, কিন্তু সেটা ছাড়াও আমি নিজেও অজান্তেই গ্রিমেসের সংস্পর্শে এসে গেছি! কাকার বাড়ির সেই চাদর… সেই ঘাসের মতো নরম, পাতলা, আরামদায়ক, কালচে সবুজ বস্তু… হ্যাঁ… ওটাই গ্রিমেস… নিজের অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে ঘরের উষ্ণতা কমিয়ে আনবে, এবং তারপর আপনার পায়ের কাছে এসে দলা পাকিয়ে পড়ে থাকবে। তারপর আপনি যেই সামান্য একটি চাদর মনে করে ওকে নিজের গায়ে জড়াবেন, তখনই সে চলে আসবে আপনার সংস্পর্শে! তারপর তার কাজ হয়ে গেলে সে নিজেই সরে যাবে আপনার পায়ের কাছে। কাকার সঙ্গেও হয়তো এরকমই হয়েছিল। হয়তো তিনি রাতে ঘুমানোর সময় তাঁরই আশ্রিত এই শয়তানী জীব এসে ঢেকে দিয়ে ছিল কাকাকে! ঘুমের ঘোরে মানুষ আর কী করে বুঝবেন তিনি গায়ের ওপর কী চাপিয়ে আছেন…
কাকা নিরুদ্দেশ। তাঁর বাড়ি সিল করা। গ্রিমেস কোথায় তাও জানি না। আমার বাড়ির লোকেরা কাকার খোঁজ চালিয়েই চলেছে। কিন্তু রোজ রাতে আমাকেও বেরতে হচ্ছে! আমাদের বাড়ির পুরনো স্টোররুমে কাদের বিদঘুটে এক বাচ্চা এসে রোজ রাত্রে কান্নাকাটি করছে… এতদিন তাকে কাঁচা মাছ… মরা বেড়াল খাইয়েছি… কিন্তু সে খাবার আর তার মুখে ভালো লাগছে না… আজ রাতে তার মানুষ চাই…
Tags: পবিত্র ঘোষ, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, হরর গল্প