“প্রথম প্রাণের স্পন্দন ও আমরা” রচনার পর্ব – ৫: কেজাহাতান দ্বীপের রহস্য
লেখক: ড. শুভময় ব্যানার্জী
শিল্পী: ড. শুভময় ব্যানার্জী
কফির কাপে চুমুক দিয়ে প্রফেসর সূর্যশেখর বললেন, ‘আপনি কি শিওর ব্যাপারটা আপনার নিজের চোখে দেখা?’
সূর্যশেখরের সামনে বসা আগন্তুককে কিছুটা চিন্তিত মনে হল। সে কথা না বলে ব্যালকনিতে রাখা উজ্জ্বল হলুদ-কমলা অর্কিডগুলোর দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। নভেম্বর মাস, শীত পড়তে শুরু করেছে। সকালের নরম রোদ ব্যালকনিতে পড়ে ঝলমল করছে। এই সকালে সূর্যশেখরের স্টাডিরুমে অতিথি হয়েছেন, ড. বেঞ্জামিন কার্লোস, জার্মানের কেমিওন কোম্পানির নামকরা রসায়নবিদ। জার্মানি থেকে দিল্লিতে বায়োকেমিস্ট্রির এক কনফারেন্সে যোগ দিতে এসেছেন তিনি। দু-দিন কলকাতায় কাটাবেন, অন্তত সেই রকমই কথা হয়েছে সূর্যশেখরের সঙ্গে। বেঞ্জি, মানে ড. কার্লোসের সঙ্গে বছরখানেক আগে আলাপ প্রফেসরের। দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে ভোর রাতে টাইগারহিলে যাবার পথে প্রফেসরের গাড়ি খারাপ হয়। সরু পাহাড়ি রাস্তায় পিছন থেকে গাড়ির লম্বা লাইন ক্রমাগত হর্ন দিচ্ছিল তারস্বরে। প্রফেসর একা মানুষ, লজ্জিত আর ব্যতিব্যাস্ত হয়ে এদিক-ওদিক চাইছিলেন, যদি কোনও সাহায্য পাওয়া যায়। তার সঙ্গে মনে মনে তাঁর নিজের উপরেও একটা রাগ জমছিল, এই রাস্তায় অনভিজ্ঞের মতো একা আসার জন্যে, একটা পাহাড়ি ড্রাইভার সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল… নিজের ভাগ্যকেই দুষছিলেন সূর্যশেখর। এই সময় সামনের কুয়াশা ভেদ করে সামনের জিপ থেকে নেমে এগিয়ে এল এক ব্যাক্তি।
‘এনি প্রবলেম ম্যান?’ জিজ্ঞেস করল বাল্কলাভায় মুখ প্রায় ঢাকা সেই লোক। গাড়ি স্টার্ট হচ্ছে না ভাই! সূর্যশেখরের আর্তি শুনে তাকে অভয় দিয়ে সে ফটাফট গাড়ির বনেট খুলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গাড়ি স্টার্ট করে দিল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন প্রফেসর। তাড়াহুড়োয় তার নাম জানার আগেই সে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল। তবে তার উচ্চারণে একটা ইউরোপিয়ান টান আছে সেটা প্রফেসর আন্দাজ করেছিলেন।
অবসার্ভেটরিতে পৌঁছে প্রফেসর দেখলেন তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাই সানরাইজের অভূতপূর্ব দৃশ্য লেন্সে বন্দি করতে চায়। এর কিছু মিনিটের মধ্যেই সাতরঙা আলোয় বরফের চুড়োয় ম্যাজিক সৃষ্টি করে টাইগার হিলে সূর্য ওঠার অপূর্ব দৃশ্য প্রফেসর উপভোগ করলেন। সঙ্গে পর্যটকদের তুমুল উল্লাস আর মুহুর্মুহু ক্যামেরার ছবি তোলার শব্দ। মনটা খছ খছ করছিল, সেই লোকটার পরিচয় জানা হল না বলে। আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হতে, পর্যটকের দল ছড়িয়ে পড়ল অবসার্ভেটরি টাওয়ার থেকে। প্রফেসর চায়ের সন্ধানে নিচে নামতেই সেই লোকটির দেখা পেলেন। তাঁর মনটা খুশি হয়ে উঠল। প্রফেসর নিজেই এগিয়ে গিয়ে তাকে আবার ধন্যবাদ দিলেন আর কোথায় কোথায় জানলেন ড. বেঞ্জামিন কার্লোসের পরিচয়। সেই থেকেই তাদের আলাপ জমে ওঠে।
‘প্রফেসর, অন্য কেউ হলে আমিও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতাম না, পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতাম, কিন্তু এ যে আমার নিজের চোখে দেখা!’ ড. বেঞ্জামিন প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললেন।
‘ফোনে যেটুকু বলেছ, তার থেকে স্পষ্ট ধারণা পাইনি, অবশ্য কথাও হয়েছে খুব কম সময়ের জন্যে। তোমার থেকে ডিটেলটা শুনতে ইচ্ছে করছে।’ সূর্যশেখরের কণ্ঠস্বরে আগ্রহের ছাপ।
ড. বেঞ্জামিন একটু চিন্তা করে বললেন, ‘সেনগুপ্ত, তোমাকে ফোনে এইটুকু জানিয়েছি যে কেমিওনের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের কাজে আমাকে বোর্নিও যেতে হয়েছিল। নর্থ-ইস্টার্ন বোর্নিও আইল্যান্ডের বিখ্যাত পর্বত কিনাবালু। আগ্নেয়শিলায় তৈরি এই পর্বত সংলগ্ন অঞ্চল গভীর অরণ্যে ভরা। এই জায়গায় সোডিয়ামের এক বিশেষ আইসোটোপের খোঁজ চালাবে আমাদের কোম্পানি। তুমি তো জানো প্রফেসর, মাউন্ট কিনাবালুর সাভা অঞ্চল এখনও অত্যন্ত দুর্গম। এই জায়গার বেশ কিছু আইল্যান্ড আছে যেখানে মানুষের পা পড়েনি বললেই চলে। এখানকার তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ধীরে ধীরে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে কমে যায়। উচ্চতার কারণে কিনাবালু মাউন্টেন রেঞ্জের অনেক অংশে মেঘ আটকা পড়ে এবং বছরের বেশ কয়েক মাস ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। সেই সময়টা বাঁচিয়ে আমার কাজের শিডিউল করতে হয়েছিল।’
‘জানি।’ প্রফেসর বললেন, ‘বিখ্যাত বোটানিস্ট উইলেম মেইজার তাঁর বইতে বোর্নিওর কিনাবালু মাউন্টেন কিনাবালুকে “কুয়াশা ও বৃষ্টির পাহাড়” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রেন ফরেস্ট হিসাবেও বোর্নিওর এই গভীর অরণ্য বেশ নামকরা। কিন্তু বেঞ্জি, তুমি আইল্যান্ডের কোন জায়গায় গিয়েছিলে?
‘আরে সেটাই তো গল্প। মালয়শিয়ার সারওয়াক থেকে আমাকে হেলিকপ্টার নামিয়ে দিল সাভার জঙ্গল ঘেরা সালুং নামের ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রামে। কোটা কিনাবালু থেকে জায়গাটা অনেক দূর। গ্রামে বেশি লোক নেই, শুনলাম ভারী বর্ষা হয় বলে অনেকেই বছরের এই সময়টা পোষা গবাদি পশু, বাক্স-প্যাটরা আর পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এখন সবে বৃষ্টির মরশুম শেষ হয়েছে, লোকজন ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। সেই দিন গ্রামে কাটিয়ে খোঁজ করলাম আমার গন্তব্য স্থানের, মানে যে জায়গা থেকে মাটির স্যাম্পেল নিয়ে অ্যানালাইসিস শুরু করতে হবে। লোকজনের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা ইংলিশে কথা বলে বুঝলাম, জায়গাটা মোটেও তাদের পরিচিত নয়। আমার কাছে যে বোর্নিও-ইন্দোনেশিয়ার ম্যাপ ছিল, তাতে জায়গাটা দেখাচ্ছে ঘন অরণ্যে ঘেরা কিছু দ্বীপপুঞ্জের সমষ্টি হিসাবে। সেখানে যেতে গেলে সোজা সমুদ্রপথে যাওয়া সম্ভব নয়, যেতে হবে জঙ্গলে ঘেরা সরু সরু খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে।’
‘ইন্টারেস্টিং, কাকে সঙ্গে নিলে?’
‘সে বেশ সমস্যা হল। গ্রামের লোক বলতে লাগল সেই জায়গা নাকি ভালো নয়। আমি যেখানে যেতে চাইছি, সেখানে অপদেবতার দ্বীপ আছে। গ্রামের বুড়ো মোড়ল ফিনসু হাত-পা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, সে ভারী ভয়ঙ্কর জায়গা, ‘কেজাহাতান’ আইল্যান্ডের ধারে কাছে যাবার সাহস এখানে কারোর নেই। এই ‘কেজাহাতান’ আইল্যান্ডের ব্যাপারটা কী? মোড়ল বোঝাল ‘কেজাহাতান’ আইল্যান্ডের মানে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় ‘শয়তানের দ্বীপ’। ওই দ্বীপে আছে দুর্ভেদ্য জঙ্গল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল কোনও জন্তুজানোয়ার ওই দ্বীপে নেই, এমনকি পাখি পর্যন্ত নেই। সব সময় রহস্যময় নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। এখনও পর্যন্ত প্রায় পাঁচ জন লোক সেখানে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তাদের কোথাও পাওয়া যায়নি। একেবারে যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। বুঝলাম মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এই ‘কেজাহাতান’ আইল্যান্ড। সন্ধের দিকে ল্যাটিচিউড-লঙ্গিচিউড হিসাব করে বুঝলাম আমার গন্তব্য ওই দ্বীপ না হলেও তার কাছাকাছি কোনও দ্বীপ। সারা সন্ধে অনেক বুঝিয়ে আর তামাকের লোভ দেখিয়ে কিম্বো বলে এক মাঝিকে রাজি করালাম। তবে কোনও ভাড়া বোট পাওয়া গেল না। কিম্বো তার তৈরি ভেলা-নৌকো করে আমাকে দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে দেবে কথা দিল। তার সঙ্গে শর্ত দিল যে সে মোটেও দ্বীপে নামবে না। চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কাজ সেরে আমাকে আবার নৌকোতে ফিরে আসতে হবে সূর্য ডোবার আগেই।
পরদিন আবহাওয়া ভালোই ছিল। অনেক ভোরেই যাত্রা শুরু হল। গ্রাম থেকে প্রায় মাইল দুয়েক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলার পরে ইম্বাক জলপ্রপাত দেখা গেল। ভীষণ সুন্দর দৃশ্য। গভীর জঙ্গলের মধ্যে থেকে নানা দিক থেকে জলধারা এসে মিশছে ইম্বাকে। প্রপাতের জল অঝোর ধারায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে গভীর ইম্বাক ক্যানিয়নের বুকে, সেখান থেকেই নদীর সৃষ্টি। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র সঙ্গেই ছিল, ক্যামেরা ফিট করে নিলাম, নদী যাত্রার অপূর্ব দৃশ্যকে ধরে রাখার জন্যে। নদীতে কিম্বো তার নৌকো ভাসাল। সরু খাঁড়ির মতো নদী, ভালোই স্রোত আছে। নদীর দুই পাশে নয়নাভিরাম গভীর বোর্নিও রেনফরেস্ট। নদীর কুলুকুলু শব্দ, বৈঠা চালানোর ছলাত চলাত শব্দের সঙ্গে চারপাশ থেকে ভেসে আসছে অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আরন্যক নিস্তব্ধতার মাঝে মাঝে বিচিত্র পাখির ডাকও শুনছিলাম। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক যাওয়ার পরে এক অদ্ভুত জায়গায় এসে পৌঁছলাম। এখানে অরণ্য আরও গভীর। দু-পাশের গাছ খাঁড়ির উপর ঝুঁকে পড়েছে। মাঝে মাঝেই গাছ কেটে ভেলা এগোতে হচ্ছে। খাঁড়িগুলো এখান থেকে নানা ভাগে ভাগ হয়ে জঙ্গলের ভিতর হারিয়ে গেছে। এখানে স্রোত কম থাকায় জলের রং গাঢ় সবুজ হতে শুরু করেছে।’
‘প্রচুর প্যাঙ্কটোনিক ব্লুম তা হলে? কোন দিকে এগোলে তুমি?’ প্রফেসরের প্রশ্ন।
‘এই জায়গায় কিম্বোকে দেখলাম চিন্তায় পড়তে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, এর পরের রাস্তা সে ভালো জানে না। যাই হোক, অনেক ভেবেচিন্তে ম্যাপ দেখে আর জলের ক্যামিকেল অ্যানালাইসিস করে একটা খাঁড়ি পথে এগোলাম। কিম্বোর মুখ ভার। বার বার বলতে লাগল, আমি যেন ভেলার মাঝখানে বসি আর যত তাড়াতাড়ি হয় কাজ শেষ করে ফিরে যেতে হবে। একটু পরেই কথাটার মর্ম এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে অনুভব করলাম। সে কথা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। কিম্বোর ভেলা একটা গভীর খাঁড়িতে প্রবেশ করল, এখানে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গাছ প্রায় জল ছুঁয়ে আছে। গাছের ফাঁক দিয়ে সরসর শব্দ আসছে, মাঝে মাঝে শিসের মতো শব্দও পেলাম। কোথা থেকে এই শব্দ আসছে এই কোথা যেই জিজ্ঞাসা করতে যাবো, ঝপ করে আমার সামনে কী একটা লাফিয়ে পড়ল! সঙ্গে সঙ্গেই কিম্বোর চিৎকার শুনলাম— সাবধান সাহেব! পেছিয়ে যান, পেছিয়ে যান। চমকে দেখি সবুজ রঙের বিরাট এক সাপ আমাদের ভেলায় পড়ে ফণা তোলার চেষ্টা করছে! সর্বনাশ, এ তো গ্রিন পিট ভাইপার, বোর্নিওর বিষাক্ত সাপগুলির মধ্যে অন্যতম। যার এক ছোবলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু অনিবার্য। সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও তা বার করার মতো সময় ও পরিস্থিতি তখন ছিল না। মাথাটা অবশ হয়ে আসছে, ভয়ে হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি শব্দ নিজের কানেই শুনতে পারছি… পিট ভাইপার তার লকলকে চেরা জিভ বার করে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দংশনে উদ্যত! জীবনের শেষ বোধহয় আসন্ন। হাত কেমন অবশ হয়ে আসছে, চারপাশ যেন কুয়াশাঘেরা, ঝাপসা…। এই সময়ে কিম্বো বিদ্যুৎগতিতে তার ভেলা থেকে বার করে ফেলল একটা বড় ভোজালি, সেটা চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে নেমে এল পিট ভাইপারের উপর আর এক কোপে তার সবুজ শরীর থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে জলে পড়ল। বাকি শরীরটা লগি দিয়ে জলে ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল কিম্বো। ভরসা দেবার সুরে বলল— ‘ভয় নেই, বড় বেঁচে গেছেন সাহেব। তবে বিপদ খতম।’ সাক্ষাত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আমার হাত-পা কাঁপছিল। অবসন্ন হয়ে বেলায় বসে রইলাম। কিম্বো তাড়াতাড়ি ওই বিপদজনক খাঁড়ি থেকে লগি ঠেলে বার হয়ে এল।’
‘এ তো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বেঞ্জি, এর পরেও এগিয়ে চললে?’ সূর্যশেখর অবাক স্বরে প্রশ্ন করলেন।
‘যে ওই দ্বীপপুঞ্জের দিকে চলে গেছে সেটা খুঁজতে কালঘাম ছুটছিল। কিম্বোর মতো স্থানীয় মাঝিও হালে পানি পাচ্ছিল না। সুবিধার জন্যে আমরা মাঝে মাঝে রঙিন ফ্ল্যাগ জলের গা দিয়ে যে শ্যাওলা ধরা গাছ উঠছে, তার নিচু ডালে বেঁধে রাখছিলাম, যাতে পথ হারিয়ে না যায়। তবুও, খাঁড়ি পথে নানা বাঁক ঘুরে আবার ঘণ্টাখানেক পরেই দেখি ফ্ল্যাগের কাছে ভেলা নিয়ে আমরা আবার উপস্থিত। আবার ম্যাপ, আবার ক্যালকুলেশন… আমি মাঝে মাঝেই নেভিগেশানের জন্যে কেমিওন সাপোর্ট টিমের সঙ্গে রেডিয়ো মারফত যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু, ব্যর্থ চেষ্টা, কোনও নেটওয়ার্ক সিগন্যাল আসছে না। বেলা পড়ে আসছিল, কিম্বো ফেরার জন্যে জোরাজুরি করতে লাগল। অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে রাজি করলাম এই বলে যে শেষ চেষ্টা একবার করব, না হলে ফিরে যাব সালুং এর দিকে। নিমরাজি কিম্বো গম্ভীর মুখে আমার দেখানো এক নতুন খাঁড়িতে ভেলা বাইতে লাগল। আমিও কাজের যন্ত্রপাতি ঠিক করে, রেডিয়োতে স্যাটেলাইট কানেকশান নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। আরও আধঘণ্টা এগোনর পরে কানেকশান পাওয়া গেল। বোর্নিও এক্সপেডিশানের রেস্কিউ টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু রিপোর্ট আর আমাদের লোকেশানটা পাঠিয়ে দিলাম। খাঁড়ি ক্রমশ একটা দ্বীপের কাছে এসে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কিম্বো দ্বীপের কিছুটা আগেই ভেলা থামিয়ে দিল। মুখ বেশ গম্ভীর। বললাম, ‘কী ব্যাপার কিম্বো? ভেলা থামালে কেন?’ দেখলাম কিম্বো বেশ ভয় পাচ্ছে। চুপ করে দূরের দ্বীপটা সে হাত তুলে দেখাল।
‘যা ভয় পাচ্ছিলাম সাহেব। পথ ভুল করে আমরা শয়তানের দ্বীপে এসে পড়েছি।’ কিম্বো বলল। ভালো করে দ্বীপটা দেখলাম। দ্বীপের চারপাশের খাঁড়ির জল বেশ শান্ত। বিশেষ ঢেউ নেই। দ্বীপটা সবুজে ঘেরা। ভেলা নিয়ে আর একটু এগোতে একটা বিশেষ ব্যাপার লক্ষ করলাম। কোনও শব্দ নেই। শুধু জল বয়ে যাওয়ার শব্দ। অদ্ভুত কাণ্ড! কিছু আগেই খাঁড়ি পথে আসার সময় পাখির ডাক শুনেছি, কানে অবিরাম বেজেছে জঙ্গল থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁর ডাক। কিন্তু এখানে কোনও শব্দ নেই… এক রহস্যময় নৈশব্দ যেন বিরাজ করছে সারা দ্বীপ জুড়ে। অনেক জোরাজুরি করে কিম্বোকে নিয়ে দ্বীপে নামলাম। না, কোনও পাখি বা জানোয়ার চোখে পড়ল না। কিম্বো স্থানীয় দুর্বোধ্য এক ভাষায় বিড়বিড় করতে করতে আমার সঙ্গে চলল। কোনও প্রার্থনা করছে হয়তো। চারপাশের গাছগুলো কেমন যেন অদ্ভুত। উজ্জ্বল লাল-হলুদ ফুলে ভরে আছে বেশ কিছু গাছ। ফুলের কোনও গন্ধ পেলাম না। কিছু মাটির স্যাম্পেল নেব বলে, নিচু হয়ে জায়গাটা দেখছি, এমন সময় একটা খটকা লাগল। আমার ঠিক পিছনেই পর পর তিনটে শ্যাওলাধরা মোটা গুঁড়ির গাছ ছিল। এখন পিছন ফিরে দেখি দুটো! কী ব্যাপার। আবার দেখলাম, হ্যাঁ মাত্র দুটো গাছ আছে। আমার দেখার ভুল ধরে নিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাম। কিম্বো কিছুটা দূরে দা দিয়ে ঝোপ কিছুটা কেটে পথ তৈরি করছিল, লতা-গুল্ম আর ছোট গাছে এগোনর পথ নেই। মাথার উপর ট্রপিক্যাল ক্র্যাটোম, মেহগনি আর আয়রন উড গাছ চাঁদোয়া তৈরি করেছে। গাছের শরীর বেয়ে উঠেছে সাদা-হলুদ ছত্রাক আর ফার্ন। কুয়াশা ঘিরে রয়েছে গাছগুলোর মাথা জুড়ে। এই জঙ্গলের ভিতরেও কোনও শব্দ নেই। গাছের পাতা পড়ে পচে গেছে, পথ শ্যাওলাধরা, পিচ্ছিল। আমি ক্যামেরা আর ক্যামিক্যাল অ্যানালাইসিস কিট নিয়ে এগোতে লাগলাম। অনেক আগে থেকেই একটা জলের শব্দ পাচ্ছিলাম, সেই শব্দ লক্ষ করে কিছুটা এগিয়ে দেখি, দ্বীপের একটা দিকে খাঁড়ি বেশ কিছুটা ঢুকে এসে একটা বড় জলাশয় তৈরি করেছে। বেশ মনোরম দৃশ্য। কিম্বো কেন যে একে শয়তানের দ্বীপ বলছে কে জানে?
কিছু পরে একটা খোলা জায়গায় আমরা কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বেলে কফি তৈরি করে কিছু খেয়ে নিলাম। জঙ্গলের আরও গভীরে যাবার প্রস্তুতি শুরু করলাম যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে। কিম্বো আমার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমার সঙ্গী হল। এখানকার মাটির রং কেমন অদ্ভুত, ধূসর সাদা, দেখে মনে হল বালির ভাগ কিছু বেশি। অথচ যেখানে আমরা এসে পৌঁছেছি, সেখান থেকে খাঁড়ি বেশ কিছুটা দূর। বেশ কিছুটা গভীরে ঢোকার পরে গাছপালার একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল। জঙ্গল এখানে ঘন নয়, বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো। কিম্বোকে ফেলে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। চারপাশে দেখলাম মোটা গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে লতানে গাছ উঠেছে, তাতে লম্বা নীল-হলুদ ফুল দেখলাম। বেশ কিছুক্ষণ থেকে হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম। জঙ্গলের যত গভীরে যাচ্ছি, গন্ধটা আরও বাড়ছে। মনে হল গন্ধের উৎসটা ওই নীল-হলুদ ফুলগুলো। ক্যামেরা ঠিক করে কয়েকটা ছবি তুলব বলে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাম। এক জায়গায় গাছগুলির গায়ে অজস্র ওই ফুলের ঝাড় দেখালাম। কিছুটা এগিয়ে ক্যামেরার ফোকাস করছি, এমন সময় মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগল। কী ব্যাপার? শরীর খারাপ হল নাকি? ওয়াটার বটল থেকে কিছুটা জল খেয়ে আবার ক্যামেরা তুলে ফোকাস করতেই তাজ্জব হয়ে গেলাম! সামনে নীল ফুলের জায়গায় ঝলমলে লাল-কমলা ফুল। বাতাসে অল্প দুলছে, চারপাশের গাছেও একই রঙের ফুল! যেন আগুন ধরেছে গাছে। হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। চোখে ভুল দেখছি নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হাত-পা একটু একটু কাঁপছে। জায়গাটা ভালো মনে হল না, চলে গেলেই ভালো হত। কিন্তু, শরীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে… মাটিতে বসে পড়লাম। গলাটাও শুকিয়ে আসছে, আমার কি হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে? কোনও অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশানও হতে পারে। ব্যাগে ডেরিফাইলিন আর এপিনেফ্রিন শট আছে, কিন্তু ব্যাগ খোলার শক্তি নেই। কিম্বো কোথায় আছে কে জানে, চিৎকার করার শক্তিও নেই। এখানে পড়ে থাকলে কেউ জানবে না। মিষ্টি গন্ধটা ক্রমশ ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে, চেতনা অবশ হয়ে আসছে। আবার দেখলাম গাছগুলোর দিকে, একি? কোনও ফুলই নেই… ঘন সবুজ পাতা দুলছে! এবার ভয় পেয়ে কোনও রকমে ব্যাগ নিয়ে টেনে টেনে চললাম ফেরত রাস্তায়। যাবার শক্তি নেই, কিম্বো কোথায়? সামনে শুধু কুয়াশাঘেরা গাছের সারি, মোটা মোটা শ্যাওলাধরা গাছের গুঁড়ি যেন আমাকে ঘিরে ধরেছে। বুড়ো মোড়লের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল কটা শব্দ— ‘শয়তানের দ্বীপ, সাহেব। পালান, পালান…’ জলের বোতল কোথায় পড়ে গেছে, গলা দিয়ে শব্দ বার হচ্ছে না। জীবনের শেষ কি আসন্ন? হাতে জোর নেই, তাও মনের জোরে স্যাটেলাইট ফোন বার করে কানেক্ট করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু, মিথ্যা আশা, কোনও সিগন্যাল নেই। শুধু ভয়াল আরন্যক নিস্তব্ধতা।
অবশ শরীরে কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। পাঁচ মিনিট হতে পারে, আবার এক ঘণ্টাও হতে পারে। সময়ের হিসাব নেই। চিন্তা এলোমেলো। মাঝে মাঝে বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। আমার বাড়ি, বাগানের ফুলগাছগুলো আর আমার স্ত্রী এমিলি। হয়তো আর কোনওদিন দেখা হবে না। বোর্নিওর গভীর জঙ্গলে ঝরা পাতার নিচে আমার শরীর পড়ে থাকবে, কেউ জানবে না…
এমন সময় দূরে কিম্বোর গলা পেলাম। কিম্বো আমাকে চেঁচিয়ে ডাকছে! কিন্তু, আমার সাড়া দেবার ক্ষমতা নেই। ডাক আরও কাছে এল। কিছু পরেই আমার ব্যাগসমেত কিম্বোকে দেখতে পেলাম। ‘একি সাহেব, আপনি এখানে? কী হয়েছে?’ উৎকণ্ঠা নিয়ে সে এগিয়ে আসতে লাগল। যাক! কিম্বো দেখতে পেয়েছে, আর ভয় নেই। সর্বশক্তি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম। কিম্বো আর মাত্র হাত দশেক দূরে। মোটা গাছের গুঁড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে সে এগিয়ে আসছে। ঠিক এই সময় সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে গেল! যা মনে করলে এখনও আমার রক্ত জল হয়ে যায়। কিম্বোর পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট শুনছি, তার সঙ্গে কোথাও একটা তীব্র শিশের শব্দ শুনলাম। আর আমার সামনে, প্রফেসর গায়ে কাঁটা দেয়… একটা মোটা সবুজ গাছের গুঁড়ি বিদ্যুৎবেগে উঠে কিম্বোকে পিছন থেকে আষ্ঠেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরল! কিম্বোর আর্ত চিৎকার আরন্যক নিস্তব্ধতাকে চিরে খান খান করে দিল। কিম্বোকে পেঁচিয়ে শূন্যে উঠে গেল সেই গুঁড়ি! চোখের পলকে তাকে নিয়ে ঘন গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কানে কিম্বোর চিৎকারের প্রতিধনি শুধু শুনতে পেলাম। আতঙ্কে, অবসাদে আমার চেতনা বিলুপ্ত হয়ে গেল।
কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে বোর্নিওর রেস্কিউ ক্যাম্পে আবিষ্কার করলাম। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, সারা শরীর ফোলা, অবশ। ক্যাম্পের ডাক্তারের অক্লান্ত পরিচর্চায় প্রায় এক সপ্তাহ পরে কথা বলার মতো অবস্থায় এসেছিলাম। আমার স্যাটেলাইট সিগন্যাল দ্বীপটাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। রেস্কিউ টিম হেলিকপ্টারে করে এসে প্রায় চার ঘণ্টা পরে আমাকে পায়, অজ্ঞান অবস্থায় এবং একটা অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায়! কীভাবে আমি সেখানে গেলাম তার ব্যাখা আমি আজও পাইনি। কিম্বোর কথা জ্ঞান হতেই বলেছিলাম টিমকে। হেলিকপ্টার নিয়ে গোটা দুই দিন পুরো দ্বীপ সার্চ করেও তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার ভেলাও উধাও। রেস্কিউ টিমের ধারণা সেটা জলের তোড়ে কোথায় ভেসে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে নীল ফুল দেখেছিলাম সেই অভিশপ্ত জায়গাটা আর কখনও খুঁজে পাইনি। জায়গাটা যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। সালুং গ্রামে এর পরে হয়তো কোনওদিন মুখ দেখাতে পারব না। রেস্কিউ টিম আমাকে নিয়ে সাভাতে ফিরে গিয়েছিল।
বেলা হয়ে এসেছে, ঘরে পর্দার আলো খেলা করছে। সূর্যশেখর মন দিয়ে পুরোটা শুনলেন। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বললেন না। নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রফেসর শুরু করলেন, ‘বেঞ্জি তোমার অভিজ্ঞতা ভয়ানক। খুব জোর প্রাণে বেঁচেছ। বোর্নিওর ওই ট্রপিক্যাল ফরেস্টে তোমার একা না গিয়ে টিম নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, তোমার তোলা কোনও ফোটো কি উদ্ধার করা গেছে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘মাত্র কয়েকটা ছবি আমার ক্যামেরায় আছে, তোলার আর সুযোগ পেলাম কই? তবে রেস্কিউ টিমের অনেক ছবি আমার কাছে আছে। তোমার জন্যে সেটা হার্ড ড্রাইভে এনেছি।’
‘গুড, বেঞ্জি। আমার পার্সোনাল সার্ভারে আপলোড করে দাও প্লিজ। দেখি কি রহস্য লুকিয়ে আছে ওই কেজাহাতান আইল্যান্ডে।’ সূর্যশেখর উত্তেজিত।
দশ মিনিটের মধ্যেই ছবি আপলোড হয়ে গেল। প্রফেসর বেঞ্জিকে নিয়ে তাঁর স্টাডিরুমের ল্যাপটপের সামনে বসলেন। স্ক্রিনে দেখা গেল বৃষ্টিভেজা, কুয়াশাঘেরা কাজাহাতান দ্বীপের বার্ড’স আই ভিউ, নানা অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ছবি। বেঞ্জির তোলা ছবি মাত্র চারটে। জঙ্গলের পথে নেওয়া বড় গাছ সমেত উজ্জ্বল রঙের ফুলের ছবি, সবুজ বনবীথি, জলাশয় আর কিম্বো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে আসছে বড় গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে, তার শেষ ছবি। সূর্যশেখর বেঞ্জির ছবিগুলোর দিকে বেশ কিছুক্ষণ মন দিয়ে চেয়ে রইলেন। ফুলের ছবি জুম করে দেখলেন। বেঞ্জির দিকে চেয়ে বললেন, ‘জোর বেঁচে গেছো বন্ধু, জানো এই ফুলগুলো কি?’ বেঞ্জি নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। সে জানে না। সে শুধু জানে এই মনোরম, আপাত নিরীহ ফুলের মাঝে পড়ে তার প্রাণ সংশয় হতে বসেছিল। এখনও সেই ফুলের ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগে…
‘কিউরেরি ভাইন… সঙ্গে ওই লম্বা নীল ফুল সমেত কিছু রেন ফরেস্টে বেড়ে ওঠা অ্যাঞ্জেল’স ট্রামপেট গাছও আছে দেখছি। দুটোই ভায়ানক বিষাক্ত গাছ। কিউরেরি ভাইন ট্রি লতানে প্রকৃতির গাছ। প্রায় তিরিশ মিটার উঁচু পর্যন্ত উপরে উঠতে পারে। ওই যে নরম, সবুজ মখমলে পাতা দেখছ, একে “ভেলভেট লিফ” বলা হয়। এর পাতা আর ফল থেকে পাওয়া রসে বিষাক্ত স্ট্রিকনিন জাতীয় অ্যাল্কলয়েড পাওয়া যায়। সাউথ আমেরিকার প্রাচীন আদিবাসীরা কিউরেরি বিষ সংগ্রহ করে শিকারের জন্যে বিষাক্ত তির তৈরি করত। রক্তে মিশে গেলে, অনেক বড় প্রাণীও এই বিষের প্রভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যায়।’
‘আর ওই রহস্যময় নীল ফুল?’ বেঞ্জির প্রশ্ন।
‘সেটা হল ব্রাগম্যানসিয়া গোত্রের ফুল। এই ফুলের গন্ধে বিষ আছে। এই নীল ফুলের নির্যাস বাতাসে ভেসে যায়। নিশ্বাসের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কে পৌঁছয়। এর জন্যে হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়। মানুষ অতিপ্রাকৃত ঘটনা চোখের সামনে দেখতে শুরু করে। বেঞ্জি, তুমি জানো এই ফুল শামান উপজাতির লোকরা, বিশেষ করে জাদুকর সম্প্রদায় নানা রোগ এবং অন্যান্য দুর্ভাগ্যের পূর্বাভাস দিতে ব্যবহার করে। উদ্ভিদের অ্যালকলয়েড থেকে আসে ফুলের বিষ এবং অনেকক্ষণ বেশি পরিমাণে এই বিষ গ্রহণ করলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কাজ বন্ধ হতে থাকে যার ফল মানুষের জন্য মারাত্মক হতে পারে। আর সেটাই হয়েছিল তোমার অসুস্থতার কারণ’। সূর্যশেখরের চোখ হঠাৎ কিম্বোর শেষ ছবিটায় আটকে গেল। এই ছবি তোলার কিছু পরেই অজ্ঞাত এক বিভীষিকার হাতে কিম্বো হারিয়ে যায় চিরকালের মতো। সেই দিক থেকে ছবিটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, কী সেই অদৃশ্য শত্রু? এই ছবিতে কিম্বোর আশপাশে কেউই তো নেই। সবুজ, ভারী গাছের সমারোহ। অনেকের থেকে বড়, মোটা ঝুরি মাটি পর্যন্ত নেমে গেছে। বেশ কিছু গাছের শ্যাওলাধরা কাণ্ডের গা বেয়ে উঠছে হলুদ-লাল ফুলের পরজীবী উদ্ভিদ। সন্দেহের কিছুই নেই, কিন্তু কী একটা যেন আছে এই ছবিতে। রহস্যময় কিছু, যা চোখে ধরা দিয়েও পড়ছে না।
‘বেঞ্জি, কিম্বো হারিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে কিছু ঘটেছিল? কিছু মনে করতে পারছ? কোনও মুভমেন্ট, কোনও আলো, কোনও শব্দ…’ সূর্যশেখর চিন্তিত।
‘আলো, মুভমেন্ট, শব্দ… শব্দ… মনে পড়েছে।’ বেঞ্জিকে উত্তেজিত লাগল। ‘একটা শিসের শব্দ শুনেছি। বেশ জোরে।’
‘শিস?’ প্রফেসর চেয়ার থেকে সোজা হয়ে বসলেন। তাকে রীতিমতো উত্তেজিত লাগল। ল্যাপটপ স্ক্রিনে ছবিটা মাক্সিমাম জুম করলেন। প্রতিটা পিক্সেল যেন চোখ দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। একটু পরেই তার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, অস্ফুট স্বরে বললেন তিনটি শব্দ— ‘ক্যামোফ্লেজ… কালারেশান… আর… মিমিক্রি।’ জোরে নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘বিবর্তনের এক আদিম রহস্য লুকিয়ে আছে এই ছবিতে। সত্যিই আশ্চর্য।’
‘সেটা কি প্রফেসর?’ বেঞ্জি কৌতূহলী।
‘এই বিরাট বিশ্বে জীববৈচিত্র্য অসামান্য। প্রকৃতির নিয়মে কেউ খাদ্য আবার কেউ বা খাদক। এই নিয়ম চলছে আদি-অনন্তকাল ধরে। পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে সংগ্রাম। শিকার ও শিকারির সংগ্রাম। ডারউইনের সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট। শিকারি তার শিকার চেনার জন্যে সংগ্রাম করে আর শিকার শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্যে সংগ্রাম করে। আর এই সংগ্রাম থেকে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত জীববৈশিষ্ট্য, যার নাম ক্যামোফ্লেজ। মানে এক বিশেষ ছদ্মবেশ, যাকে একটি প্রতিরক্ষা কৌশল হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ক্যামোফ্লেজের সাহায্যে জীব তাদের চেহারা ছদ্মবেশ ধারণ করে পালটে ফেলে, সাধারণত তাদের আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশে যায়। আসলে, জীব তাদের অবস্থান, পরিচয় এবং মুভমেন্টকে লুকিয়ে রাখতে ক্যামোফ্লেজ ব্যবহার করে। এই ক্যামোফ্লেজ সাধারণ থেকে অতি অসাধারণ এবং সূক্ষ্ম হতে পারে। খালি চোখে বহুক্ষণ দেখেও তাদের শনাক্ত করা যায় না। মজার ব্যাপার, এই পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণী দুজনেই ক্যামোফ্লেজ করার ব্যাপারে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। কখনও উদ্ভিদ প্রাণীর ছদ্মবেশ ধরে আবার কখনও প্রাণী উদ্ভিদের। তুমি স্টিক ইন্সেসেকটের নাম শুনেছ? একেবারে ধূসর, শুকনো কাঠির মতো দেখতে। কাছে গিয়ে চোখে দেখেও ফারাক করা যায় না। এমনই ক্যামোফ্লেজ করে। এছাড়া, বিভিন্ন পাখি, জলচর মাছ, কাঁকড়া, সরীসৃপ এবং বহু স্তন্যপায়ী প্রাণীও দুর্দান্ত ক্যামোফ্লেজ করার ক্ষমতা রাখে। তোমার তোলা ছবিতেও সেই রকম একটি অসামান্য প্রাণী আছে।’ সূর্যশেখর থামলেন।
‘প্রাণী? কই, আমি তো কোনও প্রাণী দেখছি না।’ বেঞ্জি অবাক হল।
‘সেটাই তো প্রকৃতির ম্যাজিক। মানুষের মতো উন্নত এবং বুদ্ধিমান প্রাণীকেও বেমালুম চোখে ধুলো দিতে পারে এর ক্যামোফ্লেজ। ভালো করে দেখো, কিম্বোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের গুঁড়িগুলোর দিকে। কিছু বুঝলে?’
‘না তো। সবই তো সবুজ-ধূসর গাছের গুঁড়ি। এর মধ্যে তফাত কোথায়?’
‘তফাত আছে বেঞ্জি। কিম্বোর ঠিক পিছনে যে গাছের গুঁড়ি, তার সঙ্গে অন্য গাছগুলোর গায়ের বাকলের প্যাটার্নের ফারাক আছে। এই বিশেষ প্যাটার্ন কোনও গাছের কাণ্ডে পাবে না, শুধু পাবে সরীসৃপ প্রাণীর শরীরে থাকা চামড়ার স্কেলে।’ সূর্যশেখরের মুখ গম্ভীর হল।
‘মানে… কিম্বো… কিম্বোকে তাহলে…’ বেঞ্জিকে হতবুদ্ধি দেখাল।
‘বোর্নিও রেটিকিউলেটেড পাইথন।’ সূর্যশেখরের গলায় একই সঙ্গে বিস্ময় ও বিষাদের ছায়া। বললেন, ‘মারাত্মক ক্যামোফ্লেজ করেছে। প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা সাপ। আর সেই রকমই মোটা, সবুজ রঙের, অবিকল গাছের গুঁড়ির মতো। বড় শিকার ধরার পর কখনও মাসের পর মাস একই জায়গায় শুয়ে থাকে। গায়ে মাটি-কাদায় শ্যাওলা, মস জন্মে যায়। গাছের থেকে তফাত করার কোনও উপায় থাকে না। শিকারকে মুহূর্তে পেঁচিয়ে শূন্যে তুলে, বিদ্যুৎগতিতে উধাও হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, কিম্বো তার শিকারে পরিণত হয়েছে।’
বেঞ্জি হতবাক। কোনওরকমে বলল, ‘কিম্বো ওই সময়ে না এলে, আমি পাইথনের শিকারে পরিণত হতাম প্রফেসর, আমাকে বাঁচিয়ে কিম্বো তার প্রাণ দিল।’
কেউই কোনও কথা বললেন না। ব্যালকনির টবে রাখা উজ্জ্বল লাল-হলুদ অর্কিডগুলো যেন তাদের দিকে চেয়ে কাজাহাতান দ্বীপের ভয়ঙ্কর স্মৃতির কথা তাঁদের বার বার মনে করিয়ে দিতে লাগল।
(ক্রমশ)
Tags: ধারাবাহিক প্রবন্ধ, প্রবন্ধ, শুভময় ব্যানার্জী, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা