দ্য গোলাঞ্চ বুক অফ সাউথ এশিয়ান সায়েন্স ফিকশন
লেখক: দেবরাজ মৌলিক
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
গোলাঞ্চ (Gollancz)-এর আগে প্রায় একশো বছর ধরে হাজার হাজার কল্পবিজ্ঞান, রহস্য ও ফ্যান্টাসি বই পাঠককে উপহার দিয়েছে, তবে এই সংকলনটি আলাদা কেন?
তার কারণ এই প্রথমবার একটি ব্রিটিশ সংস্থা দক্ষিণ এশিয়া আর উপমহাদেশের কিছু বাছাই করা কল্পবিজ্ঞান দুই মলাটে তার পাঠককে উপহার দিয়েছে, তার জন্যেই তাদেরকে কুর্ণিশ।
পোস্ট-কলোনিয়াল থিয়োরির দিক থেকে ভেবে দেখতে গেলে এটি একটি বড় পদক্ষেপ। কিন্তু তারা কি ঠিকঠাকভাবে গল্প বাছাই করেছে? এই বইয়ের নামকরণের মধ্যেই বড় সমস্যা রয়েছে, কারণ এর সূচিপত্রের মধ্যে রয়েছে ফ্যান্টাসি, রয়েছে প্যারোডি আর তার সঙ্গে স্যাটায়ার। পাঠকদলের কাছে আমার এই আবেদন রইল তারা যেন সিধুজ্যাঠার মতো মনের সব দরজা খুলে এই বইটা পড়েন।
প্রস্তাবনা আর ভূমিকাটা নজর কেড়েছে আমার, কল্পবিজ্ঞান নিয়ে যদি প্রবন্ধ লিখতে চান এটা তবে অবশ্যই পড়ে ফেলুন।
দক্ষিণ এশিয়া বলতে নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা আর মায়ানমার আর তার সঙ্গে আরও অনেক জায়গা বোঝায়। কিন্তু এই সংকলনটি কেবল তিনটি দেশ— ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়েই গ্রন্থিত করেছে।
সংকলনটিতে রয়েছে প্রচুর বড় ও ছোট গল্প আর রয়েছে কিছু কবিতা। আধুনিক সাহিত্যের জনরা অস্পষ্ট হয়ে যায় জানি, এখানেও সেটা হয়েছে।
এবার যে যে গল্পগুলো নজর কেড়েছে তাদের কথা বলা যাক। প্রথমে বলব সামি আহমদ খানের ‘১৫০০৪’, যেখানে ভিনগ্রহের অধিবাসীরা উত্তরপ্রদেশের একটা রেল স্টেশনের দক্ষ-যজ্ঞ বাঁধিয়ে দিয়েছে, গল্প খুব দ্রুতগতিতে এগিয়েছে।
সম্পাদক তরুন সেইন্ট নিজে দেশভাগ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন আর এখানে দেশভাগের অনুভূতি উঠে এসেছে ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মধ্য দিয়ে, একটি ফিউচারিস্টিক থিম পার্কে। গল্পের ন্যারেটিভের জন্য এটাকে আমি এগিয়ে রাখব।
এই সংকলনে দেশভাগের পটভূমিকায় লেখা কায়সর হকের ইউটোপিয়ান কবিতা ‘সেভেনটি ইয়ার্স আফটার সেভেনটি ইয়ার্স অব পার্টিশন’ আমাদের দেশকে একটু অন্যভাবে চিনিয়ে দেয় বা খুব চেনা একটা দেশে আমাদের টাইম ট্র্যাভেলে নিয়ে যায়। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘টোয়েনটি সেকেন্ড সেঞ্চুরি’-তে একটি ইউটোপিয়ান দুনিয়ার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে যেখানে শ্রেণি বা জাতবৈষম্য নেই, পড়শি-দেশের সঙ্গে যুদ্ধ নেই, ছুঁয়া-ছুঁৎ বালাই নেই, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মানবজাতিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে— এইসব ভবিষ্যৎবাণী আমরা যে মার্কিন কল্পবিজ্ঞান টিভি সিরিজ স্টার ট্রেক বা ওইরকম সিনেমায় হরবখত দেখতে পাই, তার থেকে এই লেখা প্রায় তিরিশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল।
অনিল মেননের ‘শিট ফ্লাওয়ার’ সাইবার প্রযুক্তিতে ধুঁকতে থাকা ভবিষ্যৎ-দুনিয়ার একটি অন্যরকম ছবি এঁকেছে। সত্যি কথা বলতে গল্পটি বাজিমাৎ করে দিয়েছে। শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে হেলাফেলা করা যাবে না, সব সময়ে প্রযুক্তির উপরে ভরসা করাও ঠিক কি না, ‘শিট ফ্লাওয়ার’ সেটি মজ্জায় মজ্জায় বুঝিয়ে দিয়েছে।
বিশ্ব উষ্ণায়নকে উপেক্ষা করার উপায় নেই, আর কল্পবিজ্ঞানের কাঁধে বন্দুক রেখে এটা ফারুখী তার ‘স্টিলিং দ্য সি’ গল্পতে বুঝিয়েছেন। না তবে অগস্ত্য মুনির সেই কাহিনি নয়। সাগর চুরির কথা উঠল যখন তখন মিমি মন্ডলের ফ্যান্টাসি ‘দ্য সি সিংস অ্যাট নাইট’ এর কথা অগ্রাহ্য করা যাবে না। এটি একটি প্রেমের কাহিনি যা পড়তে পড়তে পাঠক একটা ঘোর বা হ্যালুসিনেশানে চলে যাবে। গল্পে দু-রকম প্রজাতির মানুষ রয়েছে— ১) ডাঙার আর ২) সমুদ্রের – ডিসি কমিক্সের অ্যাটলান্টিসের অধিবাসীর মতো।
ফেমিনিজম বা নারীবাদ কল্পবিজ্ঞানের জগতে বেশ দাপিয়ে বিচরণ করেছে, বেগম রোকেয়ার ১৯০৮ সালে লেখা সুলতানা’স ড্রিম একটি ঐতিহাসিক কীর্তি যা ভারতবর্ষের কল্পবিজ্ঞানকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছিল। সেই পরম্পরা বজায় রেখে নূর নাসরিন ইব্রাহিম ‘উই ওয়্যার নেভার হিয়ার’ গল্পটি পাঠকসমাজকে উপহার দিয়েছেন। এই কাহিনিতে সকল নারীগোষ্ঠী নিখোঁজ হয়েছে আর তারপর কী ঘটেছে সেটাই রহস্য।
ভারতবর্ষে কল্পবিজ্ঞানের উপরে কাজ আগেও হয়েছে আর এখনও সেই ধারা অব্যাহত। সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু, জয়ন্ত নারলিকারের বামন আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা ছাড়া ভারতে আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কল্পবিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা এখনও দূরের স্বপ্ন। কারণ পাঠক-সচেতনতার অভাব, প্রকাশকের নাক-সেঁটকানো আর তার সঙ্গে রয়েছে সঠিক তথ্যের অভাব। সঠিক তথ্যের অভাবে অদ্রীশ বর্ধনের ‘প্ল্যানেট অব টেরর’ আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘হোয়াই দ্য ওয়ার এন্ডেড’ এই গ্রন্থে নথিভুক্ত হয়েছে, না হলে অদ্রীশ বর্ধন বাংলা কল্পবিজ্ঞানে যে সব অমর সৃষ্টি করে গেছেন সে তুলনায় এই গল্প নির্বাচনটি খুব কাঁচা মানের হদিশ দেয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদাকে বাদ দিলে পিঁপড়ে পুরাণ, কুহকের দেশে, মঙ্গল বাড়ি আর শুক্রে যারা গিয়েছিল-র মতো তাবড় তাবড় লেখা এই গ্রন্থে নথিভুক্ত হতে পারত।
সেইন্টের ‘দ্য গোলাঞ্চ বুক অব সাউথ এশিয়ান সায়েন্স ফিকশন’-এ কিছু ভুলত্রুটি রয়েছে। কিন্তু এটি একটি বড় পদক্ষেপ ভারতবর্ষের কল্পবিজ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য। ওই যে বললাম মনের দরজাগুলো খুলে পড়ে ফেলুন, টেস্ট আর আফটার টেস্ট দুটোই পাবেন। ভবিষ্যতের বাংলা তথা ভারতবর্ষ কীরকম হতে পারে তা জানতে হলে সেইন্টের ‘দ্য গোলাঞ্চ বুক অব সাউথ এশিয়ান সায়েন্স ফিকশন’ বইটার আপনার বুক শেলফে স্থান পাওয়া উচিৎ।
Tags: গ্রন্থ পরিচিতি, দেবরাজ মৌলিক, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
বিশ্লেষণী পাঠ-প্রতিক্রিয়া। সমৃদ্ধ হলাম।।
এই বইটার কথা জানার পর থেকেই পড়বার ইচ্ছে রয়েছে। এই রিভিউ-টা পড়ে ইচ্ছে আরো অনেক গুন বেড়ে গেল।