শিকার
লেখক: শাম্ব নিয়োগী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
গ্রেসু গ্রাম পেরিয়ে কয়েক মাইল আসতেই সন্ধে নামতে শুরু করল কার্পেথিয়ার গায়ে। ছোট টিলাটার উপরে পৌঁছে ঘোড়াটাকে দাঁড় করিয়ে চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল দিমিত্রি। বছরের এই সময়টাতে পূর্ব রোমানিয়ায় বেশ তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে। গ্রেসুতে বিশ্রাম নেওয়াটা তাদের উচিত হয়নি। পিছন ফিরে তাকিয়ে খানিকটা দূরে অ্যালেক্সকে দেখতে পেল দিমিত্রি। ঘোড়ার ওপরে বসে ঝিমোতে ঝিমোতে ধীর চালে আসছে সে। বেচারি অ্যালেক্স, কতটুকুই বা আর বয়েস! এতখানি পথ চলার ধকল নেবার শক্তি হয়নি ওর এখনও। দিমিত্রি চেয়েছিল আজকে সন্ধের আগে তুরিয়া গ্রামে পৌঁছে যেতে। তারপর সেখান থেকে কাল বিকেলের মধ্যে সোভাটা। সোভাটার পাশের জঙ্গলেই শিকারের পরিকল্পনা আছে তার। আজকে সন্ধ্যার মধ্যে তাই তুরিয়া পৌঁছতে পারলে ভালো হত। নইলে কালকে ঘোড়া ছোটাতে হবে তাদের। হুড়মুড় করে কোনও কিছু করাই দিমিত্রির ধাতে সয় না। প্রকৃতিকে বড় ভালোবাসে সে। নাহলে তাদের বাড়ি ফোসানি শহর থেকে সোভাটা প্রায় দেড়শো মাইলের উপর রাস্তা। দুর্গম কার্পেথিয়ানের মধ্যে দিয়ে সে দূরত্ব ঘোড়ার পিঠে পেরোতে গেলে কম করে দিনতিনেক তো লাগবেই। বাবার চিঠিটা ডাকে পাঠালেও চলত। তবু দিমিত্রি ভীষণভাবে আসতে চেয়েছিল শুধুমাত্র প্রকৃতির কোলে এই ক-টা দিন সে শান্তিতে কাটাতে চায় বলে। মা যথারীতি আপত্তি করেছিল। সারা ফোসানি দিমিত্রিকে অসম্ভব সাহসী আর ডানপিটে বলে জানলেও মায়ের চোখে সে এখনও দুধের শিশু। প্রথমে রাগারাগি, পরে কান্নাকাটি। নিরুপায় হয়ে বাবা শেষমেশ অ্যালেক্সকে সঙ্গে নিতে বললেন। দিমিত্রির খুব একটা ইচ্ছে ছিল না ভাইকে সঙ্গে নেবার। অ্যালেক্স বাচ্চা নয় ঠিকই, কিন্তু সে চেয়েছিল এই অভিযানটা একাই করতে। তবুও মায়ের শঙ্কা যায় না। শেষমেশ তিনি জোর করে দিমিত্রিকে দিয়ে শপথ করিয়ে ছাড়লেন যে সূর্যাস্তের পরে তারা যেন কিছুতেই পথ না চলে— পরের দিন সূর্যোদয় পর্যন্ত, রাতে অবশ্যই যেন কোনও সরাইখানায় থাকে, পথে যেন অহেতুক দেরি না করে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যেন সোভাটা পৌঁছে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। উপদেশের ঠ্যালায় দিমিত্রি চোখে অন্ধকার দেখছিল। কোনওমতে জিনিসপত্র ঝোলায় ভরে পরের দিন ভোরবেলায় ঘোড়া ছুটিয়ে দেওয়ার পরেই শান্তি পেয়েছিল সে।
প্রথম দিনটা কার্পেথিয়ার জঙ্গলে দারুণ কেটেছে তাদের। ওক, বার্চ, লিন্ডেল, পাইন আর ম্যাপল গাছে ভরা পূর্ব কার্পেথিয়ার জঙ্গল বেশ গা ছমছমে। দুপুরবেলা খাবার জন্যে ভিদ্রা গ্রামে থেমেছিল তারা। পাহাড়ে আর জঙ্গলে ঘেরা ছবির মতন সুন্দর গ্রাম। লোকজন বেশ মিশুকে আর হাসিখুশি। তবে তারা দুজনে যে গ্রেসু পেরিয়ে তুরিয়া যাবার কথা ভাবছে সেটা শুনে কেমন যেন উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল সবাই। বারবার করে বারণ করছিল জঙ্গলের রাস্তা ধরতে। রাস্তাটা নাকি ভালো নয়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর। কেন সেটা কেউ খুলে বলেনি। শুধু বলছিল গ্রেসু থেকে দক্ষিণে গিয়ে জঙ্গলের ধার দিয়ে ঘুরে কাতালিনার রাস্তাটা ধরাই ভালো। সেটা নাকি অনেক নিরাপদ। কিন্তু দিমিত্রি হিসেব করে দেখেছে তাতে তাদের একদিন বেশি সময় লাগবে। সেটা হতে দেওয়া যায় না। তাকে পরশুর মধ্যে সোভাটা পৌঁছতেই হবে। তাই ভিদ্রার লোকজনদের কথায় বিশেষ পাত্তা দেয়নি ও। আর অ্যালেক্সের তো কথাই নেই। ভিদ্রার সরাইখানার বিয়ার পেটে দিয়ে সে কবি হয়ে উঠেছিল। গ্রাম ছাড়া অবধি তার আর কোনওদিকে মন ছিল না। সূর্য অস্ত গেলে পর তার আবৃত্তি থেমেছিল। রাতে থাকার জন্যে কপালজোরে একটা সরাইখানা পেয়ে গেছিল দিমিত্রি। ভিদ্রা ছাড়ার পর আর বিশেষ জনবসতি চোখে পড়েনি তার। ক্রমশই কমে এসেছিল মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ আর বেড়েছিল গাছ, জঙ্গল, উঁচুনিচু জমি, টিলা, পাথর আর পাহাড়। এ অঞ্চলে আর সরাইখানার আশা করেনি সে। তাই হঠাৎ করে সন্ধ্যা নামার পরেই রাস্তার ধারে পুরোনো সরাইখানাটা দেখে বেশ অবাক হয়েছিল দিমিত্রি আর অ্যালেক্স দুজনেই। সরাইখানার মালিক বুড়ো পিওতর আর তার বউ বুড়ি তাতিয়ানা। কাছে নাকি পাউলিস্তা বলে একটা ছোট জনপদ আছে, সেই সূত্রেই তাদের এই সরাইখানার ব্যবসা। তারা জাতে স্লোভাক, অসম্ভব ধর্মভীরু আর কুসংস্কারগ্রস্ত। প্রথমে তো দরজাই খুলতে চাইছিল না। শেষে অনেক জোরাজুরি করে দিমিত্রি তাদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে তারা প্রেতাত্মা নয়। তবেই বুড়ো তাদের ঠাঁই দিয়েছিল তাদের সরাইখানায়। কথাবার্তা তো বিশেষ বলেইনি, উলটে যতটুকু বলেছিল তাও বুকে ক্রুশ আঁকতে আঁকতে। দিমিত্রি বুঝে পায়নি এত ভয় তাদের কীসের। রাতে সে আর অ্যালেক্স ঘুমোতে যাবার আগে এই নিয়ে হাসিঠাট্টাও করেছিল নিজেদের মধ্যে।
পরেরদিন সকালে রওনা দেবার ঘণ্টাখানেক পরে অবশ্য দিমিত্রি আন্দাজ করতে পেরেছিল তাদের ভয়টা কীসের। সকালের ঝলমলে রোদে সামনের পাইন গাছের বনের ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেয়েছিল দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তার মাথায় এক প্রাচীন অথচ জমকালো প্রাসাদদূর্গ। দিমিত্রি নিমেষে বুঝতে পেরেছিল বুড়ো পিওতরের ভয়ের কারণ। বাবার কাছে ওই দুর্গের কথা শুনেছে সে। কুখ্যাত দ্রাকুল বংশের কোনও এক উত্তরাধিকারী ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি করেছিলেন ওই কেল্লা। অত্যাচারী শাসক দ্রাকুল পরিবারকে নিয়ে ওয়ালাকিয়ায় বহু লোককথা প্রচলিত আছে। তাঁরা নাকি শয়তানের উপাসক ছিলেন, রাতের অন্ধকারে মানুষের রক্ত পান করে পেয়েছিলেন অমরত্ব। কার্পেথিয়ার অরণ্য নাকি আজও সেই রক্তচোষাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি। আজও নাকি কোনও কোনও অভিশপ্ত দ্রাকুল এই জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে শিকারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। আপন মনে হেসে উঠেছিল দিমিত্রি। পূর্ব রোমানিয়ার মানুষ সমস্ত কুসংস্কার আর লোকগাথায় বিশ্বাস করে। একশো বছর হল ওই কেল্লায় আর কেউ থাকে না। সময় ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাকে। দ্রাকুলদের কোনও বংশধরকে বহু চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুরস্কের সুলতানের সঙ্গে শেষ ক্রুসেডের পরেই শেষ হয়ে গেছিল দ্রাকুল পরিবার। নিছক বিশালাকার এক ভগ্নপ্রায় প্রস্তরখন্ড ছাড়া ওই দুর্গ এখন আর কিছু নয়। যদিও সেটা পিছু ছাড়েনি দিমিত্রি আর অ্যালেক্সের। গ্রেসু অবধি পুরো রাস্তাতে মাঝে মাঝেই বনের মধ্যে থেকে গাছের ফাঁক দিয়ে অথবা পাহাড়ের কোলে হঠাৎ কোনও সমতল ন্যাড়া জায়গা থেকে দেখা যাচ্ছিল ওই অভিশপ্ত প্রাসাদদুর্গ। আর তাতেই বাধল বিপত্তি। গ্রেসু ছাড়ানোর পরেই এরকম একটা জায়গায় অ্যালেক্সের শখ হল সে ওই পোড়ো কেল্লার ছবি আঁকবে। ব্যস্, তাতেই চলে গেল কয়েক ঘণ্টা। দিমিত্রির আপত্তি থাকলেও সে বাধা দেয়নি। একে তো কার্পেথিয়ার এই রহস্যময় আদিম সৌন্দর্য্য তাকে নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে। তার উপর দিমিত্রি জানে যে তার ছোট ভাইটি ভয়ঙ্কর জেদি। ছবি যখন আঁকার শখ তার হয়েছে, তখন ছবি সে আঁকবেই। তাই টিলার উপরে খাতা পেন্সিল সমেত অ্যালেক্সকে ছেড়ে দিয়ে সে পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঘুরেছে এদিক সেদিক। প্রাণভরে উপভোগ করেছে আদিম প্রকৃতির নিঃশব্দ অহঙ্কার। কার্পেথিয়ান পর্বতমালার পূর্বভাগের পুরোটাই প্রায় জঙ্গলে ঢাকা। রোমানিয়ার জঙ্গলের দুই-তৃতীয়াংশই এই অঞ্চলে। পশ্চিমে উঁচু পর্বতশৃঙ্গগুলো গ্রীষ্মকালেও বরফে ঢাকা থাকে। মূল পার্বত্য অঞ্চলটির পূর্বে গভীর অরণ্য আর পশ্চিমে ট্রানসিলভেনিয়ার মালভূমি। ওক, ম্যাপল, লিন্ডেল, বার্চ, ফার আর পাইন গাছে ভরা এই কার্পেথিয়ান জঙ্গল অত্যন্ত দুর্গম। পাহাড়ের গায়ে ছেয়ে থাকার দরুণ কয়েক মাইল অন্তরই গভীর খাদ বা সংকীর্ণ গিরিখাতের সম্মুখীন হতে হয়। এই জঙ্গলের বেশির ভাগ জায়গাতেই এখনও মানুষের পা পড়েনি। এ অরণ্য আদিম, রহস্যময়, গা ছমছমে। ঢেউ খেলানো সবুজ ঘাসে ঢাকা বিস্তীর্ণ মাঠ আর ছোটখাটো টিলা পেরিয়ে যখন জঙ্গল আরম্ভ হয় তখন অতিসাহসীরও একবার বুক কেঁপে ওঠে। হিংস্র শ্বাপদের অভাব নেই। উপরন্তু তার সঙ্গে আছে গায়ের লোমখাড়া করে দেওয়া সব অলৌকিক কাহিনি আর লোকগাথা। রক্তচোষা বাদুড়, হিংস্র নেকড়েমানুষ, মড়াখেকো পিশাচ, ডাইনি, দত্যি, দানো, প্রেতাত্মা— সবকিছু নিয়ে ভয়ঙ্কর সব গল্প এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের মুখে মুখে ফেরে। পথচলতি মানুষকে ভয়ঙ্কর সব ভূতুড়ে গপ্প শুনিয়ে পিলে চমকে দিতে এদের জুড়ি নেই। অথচ এত সুন্দর পরিবেশে এইসব শুনতে মোটেই ভালো লাগে না দিমিত্রির। এই অঞ্চলের প্রতিটা ঘাস, প্রতিটা গাছ একইসঙ্গে সুন্দর ও নিষ্ঠুর। প্রকৃতি একদিকে একে ঢেলে সাজিয়েছেন, আর যুগের পর যুগ ধরে ওয়ালাকিয়ান কাউন্ট ও ব্যারনেরা এর ওপরে চালিয়ে গেছে তাদের আতঙ্ক আর অত্যাচারের শাসন। এইসব ভাবতে ভাবতে সূর্য যে কখন পশ্চিমে ঢলে পড়তে শুরু করেছে সেটা খেয়াল করেনি দিমিত্রি। খেয়াল হতে সে দ্রুতপায়ে পৌঁছে গেছিল অ্যালেক্সের কাছে। অ্যালেক্সও বুঝতে পেরেছিল আর দেরি করা উচিত হবে না। আঁকাটা অসম্পূর্ণ থাকলেও বাকিটা সে না দেখে শেষ করে ফেলতে পারবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ঝোলা গুটিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ফের রওনা দিয়েছিল দুই ভাই। কিন্তু মাইলখানেক পুরোদমে ঘোড়া ছুটিয়েই দিমিত্রি বুঝতে পারল যে সন্ধে কেন, রাতের আগে তুরিয়া পৌঁছোন সম্ভব নয়। তাই ছোট টিলাটার উপরে পৌঁছে ঘোড়াটাকে দাঁড় করিয়ে চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল দিমিত্রি। পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। পূর্বে পিউট্না নদীর কোল ঘেঁষে একটা গাঢ় কুয়াশার চাদর আস্তে আস্তে কার্পেথিয়ার গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে চারপাশ! ঝোলা থেকে পশমের কোটটা বের করে গায়ে জড়ালো দিমিত্রি। ইতিমধ্যে অ্যালেক্স তার ঘোড়া নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
“কোটটা পরে নে অ্যালেক্স। বেশ ঠান্ডা পড়েছে।”
“হুম্”
“আজকে রাত্তিরটা মনে হচ্ছে আকাশের নীচেই কাটাতে হবে রে,” দিমিত্রি অ্যালেক্সের দিকে তাকায়, “মা যদি জানতে পারে না!”
“হে হে”, অ্যালেক্স দাঁত বের করে হাসে।
“তোর আর কি! তুই হলি পেয়ারের ছোট ছেলে। চোখের মণি! ঝালটা পুরো আমাকেই ঝাড়বে,” অ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে মুঠো পাকায় দিমিত্রি। পরক্ষণেই হেসে ওঠে সে, “তবে এটুকু না হলে আর অ্যাডভেঞ্চার কী হল! মা কে সবটুকু না বললেই হল।”
অ্যালেক্স ঘোড়ার পিঠে চড়েই হাই তোলে। বেশ কষে একটা আড়মোড়া ভেঙে এদিকওদিক তাকায় সে। দিমিত্রি ততক্ষণে ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে।
“দাদা”
“কী রে?”
“দেখতে পাচ্ছিস?”
“কী?”
“ওই দেখ, একটু দূরে, জঙ্গলের মধ্যে, আলো দেখা যাচ্ছে!”
অ্যালেক্স জঙ্গলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায়। সেই বরাবর তাকিয়ে দিমিত্রি দেখে, সত্যিই তো! জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা হালকা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে! তাহলে আজও কি কপালজোরে একটা সরাইখানা জুটে যাবে? অ্যাডভেঞ্চার হলেও এই ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানোটা বিশেষ ভালো ব্যাপার বলে দিমিত্রির মনে হচ্ছিল না। রোমানিয়ায় এই সময় রাতে বেশ ঠান্ডা, হিমও পড়ে। সারারাত হিম খেলে আর সকালে দেখতে হবে না। তার চেয়ে দেখা যাক না, যদি সরাইখানা হয়। মনস্থির করে ফেলল দিমিত্রি, “চল”
বেশি দূর নয়, টিলা থেকে খানিকটা নেমে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে খানিকটা যেতেই দুই ভাই একসঙ্গেই দেখতে পেল বাড়িটা। আকাশ এখন পুরোপুরি অন্ধকার। জঙ্গলের ভেতরটা যেন আরও বেশি। বাড়িটা একবার দেখেই তারা বুঝতে পারল যে এটা সরাইখানা নয়। কারুর বাড়ি। যদিও দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বাড়িটা বেশ প্রাচীন এবং বিশাল। পাথরের তৈরি, ভারী কাঠের দরজা, জানলা। গায়ে গথিক স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট। পাশে একটা আস্তাবল আছে বোঝা যাচ্ছে। তবে সম্ভবত পরিত্যক্ত। যে আলোর আভাস দেখে ওরা এখানে এল, সেই আলোটা কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কী আশ্চর্য! গেল কোথায় আলোটা? তাহলে কি কেউ আলো হাতে একটু আগে বাইরে এসেছিল? এদিক ওদিক তাকিয়ে কিন্তু কাউকে চোখে পড়ল না। দুজনে একবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করলে। “কী রে? যাবি?”, অ্যালেক্স প্রথম কথা বলে।
“ভাবছি।”
“হাঁক মেরে দেখি না, যদি থাকতে দেয়।”
“হ্যাঁ, এই জঙ্গলের মধ্যে দুটো অচেনা লোককে রাতবিরেতে থাকতে দেবে বইকি!”
“দেবে না বলছিস?”
“খুব সম্ভবত, না”, দিমিত্রি কী যেন ভাবে, “তবে আমরা ওই আস্তাবলটায় রাত কাটানোর অনুমতি চাইতেই পারি। তাতে অন্তত হিমের হাত থেকে বাঁচা যাবে।”
“তাই বা মন্দ কি?
“সেটাই”, ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে দিমিত্রি, “চল।”
ভারী কাঠের দরজা। মেহগনি বলে মনে হল দিমিত্রির। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে পাল্লায় ধাক্কা দিলো সে। কোনও সাড়া এল না। চারপাশের জঙ্গলও থমথমে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ধাক্কা দিল দিমিত্রি। তাও কোনও সাড়া নেই।
“কেউ থাকে না নাকি রে?” পেছন থেকে অ্যালেক্স জিজ্ঞাসা করে।
“সেটাই তো ভাবছি।”
“আরেকবার ধাক্কা দে, এবার না খুললে এমনিই আস্তাবলে চলে যাব। নিকুচি করেছে অনুমতির।”
দিমিত্রি তৃতীয়বার ধাক্কা দিতে যেতেই তাকে অবাক করে দিয়ে আর্তনাদ করে খুলে গেল ভারী দরজার পাল্লা। দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক তরুণ। পরনে কালো আলখাল্লা, হাতে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি।
আচমকা দরজা খুলে যেতে একটু চমকে গেছিল দিমিত্রি। ভেতর থেকে কোনও দরজা খোলার শব্দ বা পায়ের শব্দ তার কানে আসেনি। এখন চোখের সামনে গৃহকর্তাকে দেখে সে চকিতে সামলে নিলে।
“মহাশয়, আমাদের ক্ষমা করবেন। এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমরা ভীষণভাবে লজ্জিত।”
তরুণটি তাকে একদৃষ্টিতে দেখছে। কীরকম মরা মাছের মতন দৃষ্টি।
“আমরা পথিক। তুরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলাম। পথে কিছু অনভিপ্রেত কারণে আমাদের বিলম্ব ঘটে। এই মুহূর্তে তুরিয়া পৌঁছোন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ভাবছিলাম আপনাদের আস্তাব—”
“ভেতরে আসুন।”
ফের একবার আচমকা আমন্ত্রণে থতমত খেয়ে যায় দিমিত্রি। তরুণের গলার স্বর অসম্ভব রকম ঠান্ডা আর ফ্যাসফ্যাসে।
“না মানে, আমরা আপনার অসুবিধে সৃষ্টি করতে চাই না, আমাদের ওই আস্তা—”
“বললাম যে, ভেতরে আসুন”, আবার একইরকম ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল ছেলেটি। বলেই দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল সে। “এভাবে অতিথিকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলা আমাদের পারিবারিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। দয়া করে ভেতরে আসুন।”
এভাবে বললে না-বলাটা অভদ্রতা। তাই বাধ্য হয়েই পেছনে পেছনে অ্যালেক্সকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকল দিমিত্রি। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। আর কীরকম ভ্যাপসা।
“কিছু মনে করবেন না। আমার বাবার বয়েস হয়েছে। উনি চোখে ভালো দেখেন না, আলোতে ভীষণ কষ্ট হয় ওঁর। তাই আমাদের ঘর অন্ধকার করে রাখতে হয়। তবে আরেকটু আলোর ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। একটু দাঁড়ান।” বলে ছেলেটি পাশের ঘরে ঢুকে গেল।
“কী রে? বলেছিলি যে তাড়িয়ে দেবে?”, এই সুযোগে পাশ থেকে ফিশফিশ করে টিপ্পনী কাটে অ্যালেক্স।
ছেলেটি হাতে করে আরও দুটি বড় মোমবাতি নিয়ে ফিরে এল। তারপর সামনে রাখা টেবিলে আরো দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলে। সবসুদ্ধ পাঁচটা মোমবাতি জ্বলতে থাকল একসঙ্গে। আলোর বান না ডাকলেও ঘরের মধ্যেকার অস্বস্তিকর অন্ধকারটা আর রইল না। দিমিত্রি চারপাশটা আবছা দেখতে পেল। ঘরের প্রতিটা জানলা আঁটোসাটোভাবে বন্ধ করা। সম্ভবত তরুণের বাবার চোখের কারণে। তাছাড়া ঘরটা আসবাব আর জিনিসপত্রে ভর্তি এবং আশ্চর্যভাবে ওই আবছা আলোতেও দিমিত্রি বুঝতে পারল সেগুলো বেশ প্রাচীন।
“আপনি বললেন আপনাদের ঘর অন্ধকার করে থাকতে হয়। আপনার বাবা ছাড়া কি আরও কেউ থাকেন?”
“আমি দ্রাগোস লিলিয়াক। আমার বাবা ও মা, বেঞ্জামিন আর আমেলিয়া লিলিয়াক। আমাদের তিনজনের পরিবার।”
“এই দেখুন। ছি ছি। আমাদের পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি এখনও। আমি দিমিত্রি লিউপেই আর এ আমার ভাই অ্যালেক্স। আমরা ফোসানি থেকে আসছি।”
“ফোসানি থেকে? সে তো বেশ দূর!”
“আজ্ঞে পারিবারিক ব্যবসার কাজ, বুঝতেই পারছেন,” দিমিত্রি সত্যটা গোপন করাই শ্রেয় বলে মনে করল। কেন সে জানে না। ছেলেটির ব্যবহারে এবং আতিথেয়তায় কোনও খুঁত নেই। তবু যেন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে তার। মোমবাতির আলোয় সে এখন বুঝতে পারছে যে ছেলেটির গায়ের রং অস্বাভাবিক রকমের সাদা! এমনকী মাথার চুল পর্যন্ত সাদা। দাড়ি, গোঁফ মায় ভ্রু পর্যন্ত প্রায় নেই বললেই চলে। এই অবধি তবু ঠিক ছিল। সবচেয়ে অস্বস্তিকর ছেলেটার চোখের দৃষ্টি! কীরকম যেন মরা মানুষের মতন চেয়ে আছে! কথা বলছে, তবু মুখে হাসি নেই। কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে দিমিত্রি।
“আপনাদের বাড়িটা তো ভারী অদ্ভুত জায়গায়। এখানে এরকম বাড়ি দেখতে পাবো, ভাবতেই পারিনি।”
“লিলিয়াকরা ওয়ালাকিয়ার সুপ্রাচীন বংশগুলির মধ্যে অন্যতম মিস্টার লিউপেই। এ বাড়ি আমাদের বংশের অধিকারে থাকা অনেক বাড়িগুলির মধ্যে একটি। তৃতীয় দ্রাকুলের রাজত্বকালে আমার পূর্বপুরুষ এই বাড়ি তৈরি করেন। এই অঞ্চলে তিনি বিশেষ ভারপ্রাপ্ত সেনাপতি ছিলেন। আমরা মাঝে মধ্যে এখানে এসে থাকি। এখানকার নীরবতা আমার বাবা-মা এর স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। দয়া, করে আসন গ্রহণ করুন।”
“দেখুন, আমাদের কিন্তু আস্তাবলে থাকতে কোনও অসুবিধে হবে না। আপনার বাবা মা—”
“তাঁরা আসছেন। তাঁরা আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে একান্তই উদগ্রীব। কিছু মনে করবেন না মিস্টার লিউপেই। আমরা লিলিয়াকরা এমনিতেই নিজেদের বংশমর্যাদা সম্পর্কে একটু অহংকারী। আমার বাবা-মায়ের মধ্যে সেই অহংবোধ বোধহয় আরও একটু বেশি। অতিথি সংক্রান্ত পারিবারিক শিষ্টাচারের প্রতিটা তাঁরা পালন করতে তাঁদের পূর্বপুরুষদের কাছে দায়বদ্ধ। তাই আস্তাবলের কথা ভুলে যান। আজকের রাত্রিটা আপনারা এই গৃহেই যাপন করবেন তাই শুধু নয়, আপনাদের রাত্রিকালীন আহারের দায়িত্বও আমাদের।”
এবারে দিমিত্রির লজ্জা করতে লাগল। এতটা আতিথেয়তা সে সত্যিই আশা করেনি।
“আসুন। পাশেই খাবার ঘর। আপনাদের নৈশাহারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাবা সেখানেই আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।”
অগত্যা অ্যালেক্সকে সঙ্গে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল দিমিত্রি। এই ঘরের জানলাও সব সিল করা। ঘরের মধ্যিখানে একটা বিশাল মেহগনি কাঠের টেবিল। তার উপরে গোটাপাঁচেক মোমবাতি জ্বলছে। টেবিলের ওপারে বসে আছেন এক অশীতিপর বৃদ্ধ। এনারও পরনে ভারী আলখাল্লা। তবে দু-চোখে কালো চামড়ার তাপ্পি পরানো। সম্ভবত আলোর কারণে। দিমিত্রিদের দেখেই তিনি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন।
“সুস্বাগতম, অতিথি মহোদয়। লিলিয়াক বংশের প্রতি বংশধর আজ তাঁদের গৃহে আপনাদের উপস্থিতিতে গর্ববোধ করছেন।”
অভ্যর্থনার প্রতিটা শব্দে আভিজাত্য চুঁইয়ে পড়ছে। দিমিত্রির কীরকম অস্বস্তি লাগছিল। সে যথাসম্ভব সৌজন্যতার সঙ্গে নিজেদের পরিচয় ও কৃতজ্ঞতা জানালে।
“বসুন বসুন, দীর্ঘ পথযাত্রায় আপনারা নিশ্চয় অত্যন্ত ক্লান্ত। আপনাদের খাবার প্রায় প্রস্তুত। আমেলিয়া, আমার স্ত্রী, সেই নিয়েই একটু ব্যস্ত। আশা করি কয়েক মুহূর্তের বিলম্ব আপনারা নিশ্চয় ক্ষমা করবেন। আসুন ততক্ষণে মহান দ্রাকুলদের স্মরণে আমরা কয়েক পাত্র পান করি।”
টেবিলের ওপরে রাখা ভারী কাচের পাত্রে ঢালা লাল মদ ঘরে ঢুকেই চোখে পড়েছিল দিমিত্রির। বৃদ্ধ সেগুলো এবারে একে একে ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে একটি তুলে ধরলেন।
“মহান তৃতীয় দ্রাকুলের আত্মার স্মরণে।”
পাত্রে চুমুক দিল দিমিত্রি। অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের ওয়াইন। দ্রাকুলরা অত্যাচারী হিসেবে রোমানিয়ার ইতিহাসে কুখ্যাত হলেও এঁদের আনুগত্যে এখনও চিড় ধরেনি দেখে অবাক হল সে।
“তাহলে বলুন লিউপেই ভ্রাতৃদ্বয়! কীসের প্রয়োজনে এতটা দুর্গম পথ আপনারা পাড়ি দিচ্ছেন?”, বৃদ্ধ কথা বলতে শুরু করেন।
“পারিবারিক ব্যবসার কাজে আমরা এরকম যাত্রা করেই থাকি, মহাশয় লিলিয়াক,” ওয়াইনে আরেকটা চুমুক দেয় দিমিত্রি। নাহ্, ওয়াইনটা বড্ড ভালো!
“ব্যবসা? বাঃ, বেশ বেশ! অতি উত্তম! কিন্তু ওয়ালাকিয়ার এই অঞ্চলে রাতের বেলায় এভাবে ঘুরে বেড়াতে আপনাদের ভয় করছে না? এ অঞ্চলের উপকথাগুলির সঙ্গে পরিচয় আছে আপনাদের?”
দিমিত্রি হঠাৎ বোধ করল তার ক্লান্তি লাগছে। সারাদিন পথ চলার ধকল। খাবারটা তাড়াতাড়ি দিলে ভালো হয়! আরেক চুমুক মদ খেল সে।
“উপায় তো নেই। আর তা ছাড়া উপকথাই যখন—”
“আপনি বিশ্বাস করেন না?”, বৃদ্ধ কীরকম অদ্ভুতভাবে তার দিকে চেয়ে আছেন।
দিমিত্রির মাথা ঝিমঝিম করছে। এতটা ক্লান্তি তো তার লাগার কথা নয়। তাহলে কি—
“সব উপকথাই সত্যি বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিছু সত্যি হতে পারে। সব নয়—” পাশ থেকে হঠাৎ নেশা জড়ানো গলায় বলে ওঠে অ্যালেক্স। দিমিত্রির চোখ বুঝে আসছে।
বৃদ্ধ হাসলেন।
“তাহলে তো আপনাদের হতাশ করতে হচ্ছে মহোদয়গণ,” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, “দ্রাকুলদের শয়তানকে উপাসনা করার কথা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি তাঁদের অমরত্বের কথা আর তেমনি সত্যি তাঁদের মনুষ্য রক্তপানের কথা।”
দিমিত্রি চারপাশ আবছা হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে যে তারা ফাঁদে পড়েছে, কিন্তু তার আর কিছু করার ক্ষমতা নেই।
“শুধু কিছু তথ্য আপনারা জানেন না। স্বাভাবিকভাবে অমর হলেও দ্রাকুলরা অপরাজেয় ছিল না। হতচ্ছাড়া পাদ্রীগুলো উপায় খুঁজে বের করেছিল তাঁদের হত্যা করার। সেইজন্যে তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা গোপনে প্রদান করে গিয়েছিলেন কিছু বিশ্বস্ত অনুচরকে। আমার পূর্বপুরুষ অগাস্টিন লিলিয়াক ছিলেন সেই অনুচরদের একজন। দ্রাকুলদের সেই ক্ষমতা আমরা আজও আমাদের শরীরে বহন করছি। অমরত্বের পথে চলতে গেলে একমাত্র পাথেয় হল রক্ত। রক্তই জীবন। দ্রাগোস বয়সে তরুণ। বর্তমানে সে আমাদের জন্যে খাবারের সন্ধান করে। কিন্তু আজকে খাবার স্বয়ং আমাদের হাতে এসেছে। আপনারাই নিয়ে এসেছেন।”
দিমিত্রির চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।
“তবে আপনাদের জীবনে আরেকটা দিন আমরা দান করব। আজকে আমাদের আহার সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। কালকে, ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর—”
আর শুনতে পায়নি দিমিত্রি। হুঁশ চলে গেছিল তার। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তার হাত-পা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। মাথাটা ভার হয়ে আছে। পেটে একটা চিনচিনে ব্যথা। কোনওরকমে চোখ খুলে চারপাশটা দেখল সে। আস্তে আস্তে সব কিছু মনে পড়ছে তার। নাহ্, এটা তো সেই খাবার ঘর নয়। অন্য কোনও ঘরে তাকে মেঝেতে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু সে একা কেন? অ্যালেক্স, অ্যালেক্স কোথায়? অ্যালেক্সের কথা মনে পড়তেই একটা হাড় হিম করা আতঙ্ক তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যায়। হে ঈশ্বর, অ্যালেক্স! কী করেছে তাকে ওই পিশাচগুলো? রোমানিয়ান ভ্যাম্পায়ারদের গল্প দিমিত্রি তার মায়ের কাছে অনেকবার শুনেছে। ভয় তার কোনওদিনই হয়নি। কারণ তার ধারণা ছিল যে সে খোলা মাঠে টক্কর নিতে পারবে। কিন্তু পিশাচগুলো যে এরকমভাবে ফাঁদ পেতে শিকার ধরে, সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। করলে হয়তো সে তার মায়ের কাছে গল্পগুলো আরও ভালোভাবে শুনত। আর শুনলে পরে সে নিশ্চয় ওই অস্বাভাবিক সাদা চামড়া, অন্ধকার ঘর, সিল করা জানালা— এসব দেখে আন্দাজ করতে পারত যে সে কোথায় এসে পড়েছে। কিন্তু এখন তো আর সে সব ভেবে লাভ নেই। এখন সে মেঝেতে পড়ে। তার হাত-পা বাঁধা। অ্যালেক্সের কী হাল সে জানে না। মাথার ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে দিমিত্রির। তার নাভির কাছের ব্যথাটা বাড়ছে। অসহ্য কনকনে ব্যথা। বমি পাচ্ছে তার। ঘরে কিছু আছে কি? কোনওরকমে উঠে বসে দিমিত্রি। উঠে বসতেই সামনের দেওয়ালের ওপর দিকে একটা জানালা দেখতে পায় সে। বাইরে এখনও রাত ঘনিয়ে আছে। কিন্তু আকাশে মেঘ। জ্যোৎস্না আছে সম্ভবত। কালকে তো আকাশ পরিষ্কার ছিল। তাহলে কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিল সে? বুড়ো পিশাচটা বলেছিল কালকে। তার মানে পুরো একদিন! তাই যদি হয়, তাহলে তো –
ঝনঝন করে দরজার বাইরে শিকল খোলার শব্দ পাওয়া গেল। ভারী পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল বেঞ্জামিন লিলিয়াক। পরনে সেই পশমের আলখাল্লা, শুধু চোখের কালো তাপ্পি দুটো আর নেই। তার জায়গায় দিমিত্রি দেখতে পেল বিশ্রী দুটো চোখ। মণির রং হলুদ। যেন আগুন জ্বলছে। বুড়ো পিশাচটার মুখে অসম্ভব নিষ্ঠুর হাসি। ভালো করে সে আপাদমস্তক দিমিত্রিকে দেখলে একবার।
“ঘুম ভেঙেছে? বাঃ, বেশ বেশ। আমাদেরও আয়োজন সম্পূর্ণ।”
দরজা খোলা থাকায় পাশের ঘর থেকে একটা চাপা গোঙ্গানির আওয়াজ পাচ্ছে দিমিত্রি। অ্যালেক্স!
“অ্যালেক্স কোথায়?” চাপা গলায় প্রশ্ন করে সে।
“অ্যালেক্স? ওহ্, তোমার ভাই? আছে, ওই পাশের ঘরেই আছে। বেঁচে আছে এখনও, তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। দ্রাগোস আছে ওর সঙ্গে। কাঁচা বয়েস তো, ওর খিদেটা বরাবরই বেশি। একটা গোটা মানুষ লাগে। আমাদের বুড়ো বুড়ির একটাতে ভাগাভাগি করেই চলে যায়।”
বৃদ্ধ দিমিত্রির সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসল। তারপর আলখাল্লার পকেট হাতড়ে বের করলে একটা ছুরি।
“আড়াইশো বছর বয়েস হল বুঝলে। আজকাল আর নিজে হাতে খাবার জোগাড় করতে ইচ্ছে করে না। কামড়াকামড়ি করতেও ভালো লাগে না। তাই ছুরিই ভালো।” মন দিয়ে ছুরিটাকে ভালো করে দেখতে থাকে বেঞ্জামিন। তারপর দিমিত্রির দিকে তাকায়। “তুই ভাবছিস আমরা বুড়ো হলাম কী করে? অমরত্ব যৌবন প্রদান করে না। আর যৌবন চিরস্থায়ী নয়। তাকে ফিরিয়ে আনতে হয়। তার পদ্ধতি আলাদা। আমি আর আমেলিয়া সেই পদ্ধতি শুরু করেছি। সময় লাগবে। যদ্দিনে জোয়ান হব ততদিনে দ্রাগোস হয়তো বুড়িয়ে যাবে। ও তো সবে আশি।”
দিমিত্রির থুতনিটা তুলে ধরে তার গলায় হালকা করে ছুরির বাঁটটা বোলায় বেঞ্জামিন। পাশের ঘরের গোঙানিটা ইতিমধ্যে চাপা চিৎকারে পরিণত হয়েছে। আর থেকে থেকে হালকা গর্জনের মতন একটা আওয়াজ পাচ্ছে দিমিত্রি। তার পেটের ব্যথাটা ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে। চোয়াল দুটোতেও যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
“আমেলিয়াকে গত সপ্তাহে এক ব্যাটা পাদ্রী আক্রমণ করেছিল। প্রায় মেরেই ফেলেছিল। দ্রাগোস সময় মতন না পৌঁছলে কী হত কে জানে! আজ এক সপ্তাহ কফিনে শুয়ে রয়েছে। এখনও হুঁশ ফেরেনি। আজ তোর তাজা রক্ততে ও অনেকটা চাঙ্গা হবে।”
দিমিত্রি আবার বুড়োর পিছনে জানালার দিকে তাকায়। রাতের আকাশের মেঘ কেটে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে জ্যোৎস্না। সে যা ভেবেছিল তাই। আজকে পূর্ণচন্দ্র।
দিমিত্রির থুতনিটা তুলে ধরে শক্ত করে চেপে ধরে বুড়ো পিশাচ। যন্ত্রণায় মুখ নীল হয়ে গেছে দিমিত্রির।
“বিদায় দিমিত্রি লিউপেই। লিলিয়াকের শরীরে রক্ত হয়ে তুমি—”
আচমকা দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ছিটকে আসে একটা তালগোল পাকানো বস্তু। বিদ্যুতের গতিতে ছিটকে সরে যায় বেঞ্জামিন। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আলখাল্লা জড়ানো দ্রাগোসের শরীরের ওপরে।
“দ্রাগোস!!” চিৎকার করে ওঠে বুড়ো বেঞ্জামিন।
এবারে দ্রাগোসের শরীরটা দেখতে পায় দিমিত্রি। তার মুখের একপাশ থেকে কণ্ঠনালী পর্যন্ত কে যেন ছিড়ে নিয়েছে। যন্ত্রণায় তার দাঁতের মাড়ি ফুলে উঠছে। তবু দিমিত্রির ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে।
“বাবা… ওরা…ওরা…”, অস্ফুট স্বরে কিছু বলতে চায় দ্রাগোস, কিন্তু পারে না।
বেঞ্জামিনের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সে তাকায় দরজার দিকে। অ্যালেক্স দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার নাকে মুখে কাঁচা রক্ত। তার সারা গায়ে সদ্য গজনো তামাটে রঙের ঘন লোম। আঙুলের ডগা ফেটে বেরিয়ে এসেছে ইঞ্চিখানেক লম্বা বাঁকানো নখ। লম্বাটে চোয়ালের তলা থেকে বেরিয়ে আসে তীক্ষ্ণ দুটো শ্বদন্ত। নেকড়ের মতন খাড়া দুটো লোমশ কান ক্রমশ টানটান হতে আরম্ভ করেছে। শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের মুহূর্ত। জ্বলন্ত চোখে বেঞ্জামিনের দিকে তাকিয়ে চাপা গর্জন করে ওঠে সে। ইতিমধ্যে জানলা দিয়ে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে। সেদিকে চোখ পড়তেই ধীরে ধীরে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায় অ্যালেক্স। তারপর সামনের দু-হাতে জানলার গরাদ ধরে শরীর কাঁপিয়ে ডেকে ওঠে সে। আর ঠিক সেই সময়েই দিমিত্রির নাভির ব্যথাটা প্রবল হয়ে তার শরীর চিরে বেরিয়ে আসে। এক ঝটকায় ছিড়ে যায় কব্জির আর পায়ের দড়ি। একমুখ আতঙ্ক নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় বেঞ্জামিন। দিমিত্রির শরীরটা তখন কাটা পাঁঠার মতন ঝটপট করছে মেঝেতে, আছাড়পিছাড় করছে। বেঞ্জামিনের বিস্ফারিত চোখের সামনে তার চামড়া ফেটে গিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে ঘন কালো লোম। আঙুলের ডগা চিরে বেরিয়ে আসে কালো বাঁকা নখ। বেঞ্জামিন এক পা এক পা করে পেছতে থাকে। দিমিত্রির গলা দিয়ে এখন যেটা বেরিয়ে আসছে সেটা আর চিৎকার নয়, গর্জন। তার চোখের মণি পালটে যাচ্ছে। তার মুখটা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে, কুকুরদাঁত দুটো এর মধ্যেই বিঘতখানেক বেড়ে গিয়ে মাড়ি ফাটিয়ে নীচের চোয়াল ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
অ্যালেক্স এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো দ্রাগোসের দেহের কাছে। মুখ ঘুরিয়ে আরও একবার জানালার বাইরে তাকালো সে। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে জ্বলজ্বল করছে। বাবা বারবার করে বলে দিয়েছিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সোভাটা পৌঁছতে। সেখানকার জঙ্গলটাই ওর দাদা পছন্দ করে রেখেছিল শিকারের জন্যে। কিন্তু এই পিশাচগুলো সব গণ্ডগোল করে দিল। আর কোনও পথ নেই। দ্রাগোসের মৃতপ্রায় দেহের টুঁটি কামড়ে ধরল অ্যালেক্স। থরথর করে কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল দ্রাগোসের দেহটা। বুড়ো বেঞ্জামিন আর সহ্য করতে পারল না। হাতের ছুরি নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল অ্যালেক্সের ওপরে। কিন্তু না। অ্যালেক্সকে ছোঁবার আগেই আরও বড় একটা কালো বিশাল লোমশ দেহ তাকে জাপটে ধরে ছুড়ে ফেলে দিল জানলার ওপরে। জানলা ভেঙে বেঞ্জামিনের দেহ বাইরে পড়তে না পড়তেই জানোয়ারটা তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি ছিড়ে নিলে। আর একটাও শব্দ করল না বেঞ্জামিন। বুড়ো শরীরটা নিথর হয়ে যেতে তবেই তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দিমিত্রি। আর শরীরে যন্ত্রণা নেই। বরং শরীরের প্রতিটা শিরায় সে অদম্য শক্তি অনুভব করছে। খিদে পেয়েছে তার। রাতের কার্পেথিয়ার ঠান্ডা বাতাস তার শরীরের ঘন কালো লোমে খেলা করতে থাকে। একটা বড় নিশ্বাস নিল সে। আঃ, তাজা রক্তের গন্ধ, কতদিন পর! পাশের পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাধোয়া ঘাসে অ্যালেক্স এসে দাঁড়িয়েছে। দ্রাগোসের দেহ ছোঁয়নি সে। দিমিত্রিও বেঞ্জামিনের দিকে আর তাকাল না। ভ্যাম্পায়ারদের শরীরে মাংস বলে বিশেষ কিছু থাকে না। আজ রাতে খাবার জন্যে তাদের শিকার করতে হবে। আকাশে আর মেঘ নেই। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ডেকে ওঠে দিমিত্রি। কার্পেথিয়ার আদিম জঙ্গলের বুক চিরে ছুটে যায় নেকড়ের রক্তজল করা চিৎকার। দুটি পূর্ণ বয়স্ক লাইক্যান এবার একে অপরের দিকে তাকায়। অভিশাপ শুধু লিলিয়াকরাই বহন করে না। কার্পেথিয়ার জঙ্গল আরও অনেক আদিম, আরও অনেক গভীর, আরও অনেক ভয়াবহ অভিশাপের সাক্ষী। গা ঝাড়া দেয় অ্যালেক্স। রাতের অন্ধকারে তার সবুজ চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। পাশের জঙ্গলের দিকে তাকায় দিমিত্রি। তার নাকে আসছে তাজা রক্তের গন্ধ, কানে আসছে মরা পাতার ওপর হালকা পায়ে চলে যাওয়া হরিণের পায়ের শব্দ। আর দেরি নয়। নখ, দাঁত আর আদিম অভিশাপের হিংস্রতায় ভরা এই পূর্ণিমার রাত আজ তাদের অপেক্ষায়।
Tags: গল্প, শাম্ব নিয়োগী, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, হরর
ভ্যাপমায়ার আর ওয়ারউলফের উপকথাগুলোকে সুন্দর করে এক বাঁধলে ধরে দিয়েছেন।