হোমো ইন্ডোসেনেক্সের সন্ধানে
লেখক: প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব, প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত
১
কালকে সারাদিন ধরে ব্লিজার্ড চলেছে। তাঁবু থেকে বের হতেই পারিনি। আজ সকালে ঝকঝকে আকাশ। উত্তর দিকে শতপন্থ গ্লেশিয়ার। ওপারে দুটো পিক দেখা যাচ্ছে বালাকুন আর চৌখাম্বা একটু ডান দিকে। পূর্বদিকে অলকানন্দা। ঘাটসোলের দু-নম্বর ক্যাম্প থেকে আমরা প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে। সোজা লাইন টানলে বারো কিলোমিটারই হয়। কিন্তু মাঝখানে একটা বিশাল এক উপত্যকার ব্যবধান। আরোয়া উপত্যকা। এখন আমরা এই আরোয়া উপত্যকার একপ্রান্তে আরোয়া হিমবাহের উপরে। এটা আমাদের চার নম্বর ক্যাম্প।
মনে হতে পারে এটা সাধারণ একটা পর্বতাভিযান। সব মিলিয়ে আমরা ছয়জন অভিযাত্রী। এর মধ্যে দুজন শেরপা। বাকি সবাইও বেশ পোক্ত অভিযাত্রী। দু-তিনটে এরকম অভিযান সবাই আগে করেছে। আমিও করেছি। এই অভিযানের একটা বিশেষত্ব হল এখানে যারা অংশ নিয়েছে তারা শুধুমাত্র পর্বতারোহীই নয়। তাদের আরও কিছু পরিচয় আছে।
আমাদের দলে আছে একজন ভূবিজ্ঞানী মানে জিওলজিস্ট। বছর পঁয়ত্রিশেকের এক বাঙালি ছেলে। নাম অরিন্দম। বিদেশে অধ্যাপনা করে। গ্লেশিয়লজিস্ট হিসাবে যিনি এসেছেন তিনি একটু বয়স্ক মহিলা। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। নাম রোহিনী বসু। তিনি একজন হাই অল্টিচুড ইকোলজিস্ট। মানে হিমবাহ ও অতি উচ্চভূমির বাস্তুতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন। কয়েক বছর আগে ভারতীয় অভিযানের সদস্য হিসাবে দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে কয়েকমাস ছিলেন।
আরও একজন বাঙালি এই দলে আছে, তার নাম সিতাংশু মুর্মু। যদিও এই সিতাংশু সাঁওতাল গোষ্ঠির মানুষ, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে জন্ম ও পড়াশোনা বলে এঁকেও আমি বাঙালি বলতেই চাইছি। এঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় ইনি একজন নৃতত্ববিদ। ভারতের প্রথম মানুষদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমার পরিচয় একটু দিই। আমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করি। যদিও আমি বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম, কিন্তু সাংবাদিকতাই আমার ভালো লাগে। আর ভালো লাগে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে। দু-বছর আগে রুয়েঞ্জরি পাহাড়ে অভিযানে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটায় সেই অভিযান বাতিল হয়ে যায়।
এই অভিযানের আসল স্পনসর আমরা চারজন। বলতে গেলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। আমরা প্রথম যেখানে ক্যাম্প করেছিলাম সে জায়গার নাম অলকাপুরি। একটা ছোট গ্রাম। এর অর্থনীতি পুরোটাই তীর্থযাত্রীদের উপর নির্ভরশীল। এই অলকাপুরীর থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে সেনাবাহিনীর একটা ছাউনি আছে। অলকাপুরি সত্যিই অলকাপুরি। ধর্মস্থানের কারণে জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট মন্দির গজিয়ে উঠেছে। ফলত একটু আবর্জনা আছে। তার বাইরে চারদিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। একপাশ দিয়ে অলকানন্দা বইছে। তার ওপারে আকাশ ছুঁয়ে আছে নীলকণ্ঠের শিখর। অন্য দিকে কিছুটা সমতলভূমি। তারপরে আবার পাহাড়। আরেকদিকে সরস্বতী নদী এসে অলকানন্দার সঙ্গে মিশেছে। মহাভারতে আছে মহাপ্রস্থানে যাবার পথে এখানেই দ্রৌপদী তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।
আমাদের পরের ক্যাম্প ছিল ঘাটসোলে। অলকাপুরি থেকে ঘাটসোল পর্যন্ত আমরা এসেছি মানা পাস রোড দিয়ে। সেনাবাহিনীর চলাচলের জন্য অলকানন্দার ধার দিয়ে চমৎকার রাস্তা চলে গিয়েছে। এখান থেকে আমাদের আসল ট্রেক শুরু হবে। আরোয়া নদীর গিরিখাত ধরে আমরা যাব আরোয়া হিমবাহের কাছ পর্যন্ত, যেখান থেকে কুড়ি থেকে একুশ হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরোয়া গ্রুপের গিরিশৃঙ্গগুলি। আরোয়া গিরিশৃঙ্গগুলির গোড়ায় যেখানে আরোয়া হিমবাহ প্রবাহিত হচ্ছে এবং কিছু দূরে গিয়ে গলে আরোয়া নদী হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের গন্তব্য সেখানে। প্রায় আঠেরো হাজার সাতশো ফুট উচ্চতায়।
২
আমাদের চারজনের এই অভিযানের পিছনে আছে একজন মানুষ, যাঁর নাম গিরিশ প্যাটেল। ফেব্রুয়ারি মাসে রুরকিতে একটা সায়েন্টিফিক সেমিনারে গিয়ে এঁর বক্তৃতা আমি প্রথম শুনি। আরও একজন এর পিছনে আছেন, তিনি রোহিনী বসুর বাবা, তাঁর কথা পরে বলছি।
চার দিনের এই সেমিনারে বিষয় ছিল ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে ভারতের ভূতাত্বিক ইতিহাসের মিল ও ভারতীয় সভ্যতার উপর তার প্রভাব। এই সেমিনারে দুজন প্রবীণ বিজ্ঞানী এসেছিলেন। একজন কলকাতার এসিয়াটিক সোসাইটির ড. সুনন্দ সরকার। আর একজন দিল্লী থেকে ড. গোবিন্দরাজালু।
সেমিনারের ভেনু ছিল একটা ইন্সটিটিউটে, আর থাকবার ব্যবস্থা ছিল আর একটি ইন্সটিটিউটের হস্টেলে। হস্টেল মানে থ্রি স্টার ব্যবস্থা। প্রত্যেকের জন্য আলাদা সুইট। দারুন একটা প্যান্ট্রি। হোটেলের থেকে কিছুমাত্র কম না। হস্টেলের পাশে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, বিশাল মাঠ, আর ছোট্ট একটা বনভূমি যেখানে হরিণ চরে বেড়ায়।
সেমিনারের মূল বক্তব্য যা বোঝা গেল ভারতবর্ষের সত্যিকারের ইতিহাস অধ্যয়ন করতে গেলে ভারতবর্ষের গত এক লক্ষ বছরের ভূতাত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করা দরকার এবং বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনির ভিতর থেকে আসল সত্যকে খুঁজে বের করে তার সঙ্গে জোড়া দেওয়া দরকার। ভারতের নৃতাত্বিক ইতিহাসে ভারতবর্ষে আধুনিক মানব প্রজাতি বা হোমোস্যাপিয়েন্স এসেছে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার বছর আগে। তারাই ভারতের আদি মানুষ। ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের সঙ্গে তাদের প্রাচীন গোষ্ঠিগুলিকেও জুড়ে নেওয়ার জন্য একটা দাবি উঠেছে। এই সব নিয়েই সেমিনারে নানা জনে নানা বক্তব্য রাখবেন।
লাঞ্চের সময় আলাপ হল রোহিনীদির সঙ্গে। লম্বা ছিপছিপে চেহারা। খাবারের থালা নিয়ে আমার সামনের চেয়ারে এসে বসল। বসেই জিজ্ঞাসা করল, “ভাই, বাঙালি মনে হচ্ছে। বাড়ি কোথায়?”
বললাম, “কলকাতা, আপনার?”
“আমার নাম রোহিনী বসু। আমি গ্লেসিওলজিস্ট। হিমবাহ নিয়ে কাজ করি। থাকি দিল্লীতে। ইউনিভার্সিটিতে পড়াই।”
আমি বললাম, “আমি সাংবাদিক। তবে একটু টেকনিকাল। এই সেমিনারের রিপোর্ট লেখার ভার পড়েছে আমার উপর।”
“তুমি কোন কাগজ থেকে এসেছ?”
বললাম, “কাগজ থেকে নয়, আমি ফ্রিল্যান্সার। এবারে আমাকে স্পনসর করেছে একটা অ্যানথ্রোপলজিকাল জার্নাল। এরা আমাকে বলেছে প্রত্যেক অথরের বক্তৃতা গুছিয়ে লিখে তাদের কাছে রিপোর্ট হিসাবে পাঠাতে।”
রোহিনীদি প্রশ্ন করল, “ওরা তো অথরদের কাছে আলাদা করে পেপার চাইতেই পারত।”
“সেটা সম্ভব নয়। একটা বড় পাবলিশিং হাউজ আগে থেকেই সেগুলি বুক করে রেখেছে। তাই আমাকে বলেছে রিপোর্টের মতো করে বক্তৃতাগুলি লিখে পাঠাতে। ওদের ওয়েবসাইটে সেগুলি পাবলিশড হবে। সুনন্দ সরকারেরটা আমি অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছি।”
রোহিনীদি বলল, “দারুণ ব্যাপার তো! এগুলিকে আজকাল নলেজ প্রোডাক্ট বলে। জ্ঞান পণ্য, তাই না?”
আমি একটু হাসলাম।
এর আগে অরিন্দমদার সঙ্গে রুয়েঞ্জরিতে এক্সপিডিশন করেছি সেটাও বললাম। শুনে রোহিনীদি বলল, “তুমি তো ভাগ্যবান হে, খোদ চাঁদের পাহাড় ঘুরে এসেছ।”
একটু পরে যিনি থালা হাতে আমাদের টেবিলে এসে বসলেন তিনি একটু বয়স্ক। ইংরাজিতে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “আমার নাম গিরিশ প্যাটেল। আমি পুরাণতত্ববিদ। যাকে বলে মাইথোলজিস্ট।”
আমরা বললাম, “এই রকম একটা সাইন্টিফিক সেমিনারে একজন মাইথোলজিস্টের কী কাজ?”
গিরিশ প্যাটেল বললেন, “সেটা আমি কাল আমার লেকচারে বুঝিয়ে দেব। তবে একটা কথা বলি, আমাদের মাইথোলজিতে এমন কিছু ব্যাপার আছে যা থেকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের অনেক ধারণাও পালটে যেতে পারে। মহাভারত পড়েছ তো?”
বললাম, “পড়েছি। তবে বাংলায়, রাজশেখর বসুর অনুবাদ।”
“তাহলে বুঝতে পারবে। মাইথোলজি আসলে কী? কতগুলি মিথ বা প্রচলিত কল্পকাহিনির সমাহার। কিন্তু কল্পকাহিনির পিছনে কিছু কিছু ইতিহাস ভূগোলের খোঁজ কি পাওয়া যায় না? যায়। ভাবতে হয়। আমি তোমাদের ভাবাবো, কালকে।”
লাঞ্চের পর ছিল সিতাংশু মুর্মুর বক্তৃতা। সিতাংশু মুর্মু যা বললেন তা থেকে নৃতত্বের অনেক অজানা বিষয় সামনে চলে এল। তিনি বললেন আজ থেকে প্রায় দু-লক্ষ বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সরা যখন আফ্রিকা ছেড়ে এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে তখন ইউরোপে নিয়ান্ডারথাল মানুষ, মধ্য ইউরেশিয়ায় ডেনিসভান ও ইন্দোনেশিয়ায় হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস নামে আরও তিনটি মানব প্রজাতি ছিল। এর বহু প্রমাণ আছে, এবং আজ থেকে ত্রিশ হাজার বছর আগেই হোমো স্যাপিয়েন্সদের আগ্রাসনে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
তিনি এর পরে যা বললেন তা হল আফ্রিকা, ইউরোপ, চিন ও ইন্দোনেশিয়ায় আদিম মানুষের চিহ্ন পাওয়া যায় যারা ত্রিশ হাজার বছর আগেও পৃথিবীতে ছিল। এরা কেউই হোমো স্যাপিয়েন্স নয়, অথচ তাদের খুব কাছাকাছি। তারাও পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত, আগুন জ্বালাতে পারত, ছবি আঁকতে পারত, এবং সম্ভবত ভাষাও ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষ ভৌগোলিকভাবে একটা মহাদেশের সঙ্গে তুলনীয় হলেও এখানে সেইরকম প্রাচীন মানবজাতির অবস্থানের জোরালো কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গিয়েছে আপাতদৃষ্টিতে তাতে মনে হয় আফ্রিকা থেকে আগত হোমো স্যাপিয়েন্সরাই ভারতের প্রথম আধুনিক মানব আদিবাসী। অথচ নর্মদার তীরে যেসব আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া গিয়েছে তাতে মনে হয় এক লক্ষ থেকে আশি হাজার বছর আগে উন্নতবুদ্ধির মানোবোপম প্রাণীর উপস্থিতি ছিল। এরা কারা? এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
সেমিনারের এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে ক্যান্টিনে বিশাল তর্ক জমে উঠল। প্রফেসার গোবিন্দরাজালু জোর দিয়ে বললেন, “ভারতে হোমো স্যাপিএন্সের আগে একটাই হোমিনিন প্রজাতি ছিল। এবং তারা হল হোমো ইরেক্টাস, যার থেকে বাকি হোমো স্পিসিসগুলি ইভলবড হয়েছে। এর প্রমাণ আছে।”
সিতাংশু মুর্মু বললেন, “হ্যাঁ, হোমো ইরেক্টাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছিল, এবং মধ্য প্লিস্টোসিনে সেটা ঘটেছিলো। ভারতেও ছিল। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল পরবর্তিকালের আমাদের জানা চারটি হোমো স্পিসিস, ইউরোপ, আফ্রিকা, চিন, জাভা সর্বত্রই ইভল্ভড হয়েছিল হোমো ইরেক্টাস থেকে। কিন্তু ভারতে হল না কেন? ভারতে হোমো ইরেক্টাসের পরবর্তী স্থানীয় কোনও হোমো স্পিসিস নেই কেন?”
গিরিশ প্যাটেল একটু দূরে বসে হাসছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “ছিল, আদিম মানুষ ছিল। আমাদের প্রাচীন মাইথোলজিতে এর প্রমাণ আছে।”
আমি বললাম, “পুরাণ কথাকে কেন আপনি আনছেন? তার বাস্তব ভিত্তি নেই। বিজ্ঞানও একে সমর্থন করে না।”
দেখলাম প্রায় সবাই আমার কথা সমর্থন করল। গিরিশ প্যাটেল কিন্তু মুখের থেকে হাসি সরালেন না। বললেন, “কালকে আমি আমার বক্তব্য রাখব। তারপর আপনারা যা বলবার বলবেন।”
পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ সেমিনার শুরু হল। আজকের বক্তা গিরিশ প্যাটেল। তিনি মঞ্চে উঠে বললেন, “আমি আপনাদের একটা ভূতাত্বিক সময়ের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, যার নাম হল মেঘালয়ান স্টেজ। এটি শুরু হয়েছিল আজ থেকে ৪৩০০ বছর আগে। তার কয়েক শতাব্দী পর থেকে আমরা ভারতীয় পুরাণ বা মহাকাব্যগুলিকে পাই। বলা যায় মেঘালয় সময়টা বৈদিক যুগের আগের পর্ব। এই মেঘালয় সময়ের সঙ্গে আমাদের পৌরাণিক কাহিনির সম্পর্ক কোথায় তা নিয়ে আমি দু-একটা কথা বলব।
“মেঘালয় নামে এই সময়টাতে পৃথিবীতে জলবায়ুর এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে। প্রবল খরায় বিশ্বের অনেক দেশ আক্রান্ত হয়। ফলে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও ওই সময়ে হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আপনারা খান্ডবদাহনের কথা মহাভারতে পড়েছেন। খান্ডববন নামে যমুনার পশ্চিম তীরে এক বিশাল অরণ্য ছিল। দাবানলে সেই বন পুড়ে যায়। যদিও মহাভারতের আদি পর্বে বলা আছে অগ্নিদেবকে তুষ্ট করতে পান্ডবরা সেই আগুন লাগিয়েছিল। কিন্তু আমি বলব এই দাবানল প্রবল খরার কারণে ঘটেছিল। এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যায় ও সমুদ্রতীরস্থ অনেক নগরী সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায়।
এর পরে যে ঘটনাগুলি ঘটে তা হল মাইগ্রেশন। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা ভারতের দক্ষিণদিকে চলে যেতে থাকে কারণ তখন সিন্ধু উপত্যকা ও গঙ্গার অববাহিকাতে প্রচণ্ড জলকষ্ট। আর্যগোষ্ঠির মানুষদের একটা দল ক্রমশ উত্তরদিকে সরতে সরতে হিমালয়ের উচ্চভূমিতে আশ্রয় নেয়। আজকে আমরা যে উচ্চতায় হিমবাহ পাচ্ছি তখন হিমবাহ সঙ্কুচিত হয়ে আরও বেশি উচ্চতায় চলে গিয়েছে। ফলে হিমালয়ের এই অঞ্চলে আর্যদের একটা গোষ্ঠির বাসস্থান গড়ে ওঠে। এই অঞ্চলের জলবায়ু এত ভালো ছিল এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ছিল যে এই জায়গাকে স্বর্গভূমি বলা হত।
“এখানে যেমন একটা লোকালয় গড়ে উঠেছিল, সেইরকম এখানে মুনিঋষিরাও তপস্যা করতে আসতেন। তাঁরা অবশ্য একটু বেশি উচ্চতায় প্রাকৃতিক গুহাগুলিকে তাদের বাসস্থান হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই বাসস্থান বা গুহাগুলি আগে থেকেই মানুষের মতো একদল বুদ্ধিমান প্রাণীর দখলে ছিল। তারা উচ্চতায় সাধারণ মানুষের থেকে বড়। দৈহিক শক্তিও বেশি। এই মানুষের মতো প্রাণীদের সঙ্গে এই আর্যগোষ্ঠির মানুষদের নিত্য সংঘাত বেধে থাকত। এই সংঘাতগুলিকেই আমাদের পুরাণে দেবতাদের সঙ্গে দৈত্য দানবদের যুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
“পৌরাণিক দিক থেকে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অসীম। বলা হয় এখানে একটা গুহায় রাজা মুচুকুন্দ, যিনি মান্ধাতার ভাই ছিলেন, বাস করতেন ও অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। আর একটা গুহার নাম ব্যাস গুহা, যেখানে বসে ব্যাসদেব মহাভারত রচনা করেছিলেন।” এর পর গিরিশ প্যাটেল নানা কল্পকাহিনির উদাহরণ দিলেন। বারবার বললেন, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন কোনও জীবের সংস্পর্শে এসেছিলেন, যার জন্য এই সব গল্প তৈরি হয়েছে।”
লাঞ্চের সময় গিরিশ প্যাটেলকে ঘিরে তর্ক জমে উঠল। অনেকেই বলল, হতে পারে হোমো স্যাপিয়েন্স এর আগে কোনও আদিম মানব এই অঞ্চলে কিম্বা ভারতবর্ষে বাস করত। কিন্তু সে সব প্রমাণ করতে পৌরাণিক কাহিনির আশ্রয় কেন নিতে হবে? ফসিল, টুলস বা এই ধরনের আরও অকাট্য প্রমাণ দরকার। পৌরাণিক কাহিনি আশ্রয় করে কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা অভিযান, কিছুই চালানো যায় না।
লাঞ্চের পরের সেশনটা ছিল অনন্ত দেশপান্ডের। ইনি জিওলজিস্ট, বয়স বছর চল্লিশ হবে। এর সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছি তা হল ইনি রিমোট সেন্সিং এবং ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। এঁর বক্তৃতায় জানতে পারলাম ভারত বর্তমানে এমন এক মহাকাশ প্রযুক্তি হাতে পেয়েছে যার ফলে প্রায় কয়েক সেন্টিমিটার গ্রাউন্ড রেজলিউশনের ছবি মহাকাশ থেকে তোলা যায়। নাসা বা মার্কিন জিওলজিকাল সার্ভের থেকেও উন্নত মানের ক্যামেরা এতে বসানো হয়েছে। তিনি নিজের মৌলিক গবেষণার কিছুটা আভাস আমাদের দিলেন। রিমোট সেন্সিং এর সাহায্যে কীভাবে ভূতত্ব ও বাস্তুতন্ত্রের মানচিত্র রচনা করা যায় তা নিয়ে তাঁর কাজ আমাদের কাছে প্রকাশ করলেন।
তিনি বললেন বর্তমানে এখানকার যে পরিবেশ রয়েছে এবং যে সব চিহ্ন রয়েছে তা থেকে তিনি কয়েক হাজার বছর ধরে হিমালয়ের জলবায়ুর পরিবর্তন কীভাবে ঘটেছে তার একটা চিত্র রচনা করেছেন। অনন্ত দেশপান্ডে বললেন, “এবার আমি আপনাদের কিছু চমক দেবো। ১৯২০/৩০ সালে হিমবাহের যে অবস্থান ছিল আজ তার থেকে কিছুটা পিছনে সরে যাওয়ায় এই অঞ্চলে কয়েকটি অদ্ভুত জিনিস পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে একটি হল কিছু নতুন গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে, যার খোঁজ মানুষের জানা ছিল না। গুহা ছাড়াও প্রচুর হিমবাহজাত হ্রদ উন্মুক্ত হয়েছে। আগে এগুলি হিমবাহের নীচে ছিল। দ্বিতীয়ত, একদল অভিযাত্রী গত বছর একটি হ্রদের তীর থেকে কিছু পাথরের অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। তৃতীয়ত, আমি আপনাদের আরও কিছু উপগ্রহ চিত্র দেখাচ্ছি যা দেখে আপনারা চমকে উঠবেন।
এখানে শীত খুব বেশি নেই। তাপমাত্রা সন্ধ্যাবেলায় দশ ডিগ্রির কাছাকাছি। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। তাই সন্ধ্যাবেলায় একটু হাঁটতে বের হই। হস্টেলটা চারদিক তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার বাইরে যাওয়ার দরকার হয়না। মাঠের মধ্যেই কিছুটা হাঁটাহাঁটি করি। আমার মতো অনেকেই এ সময় বাইরে বেরিয়ে পড়ে। মাঠের প্রান্ত ধরে কয়েকটা ওয়াচ টাওয়ার। তার উপরে রাইফেল হাতে পাহারাদার বসে আছে। সেখান থেকে তীব্র সার্চলাইট সারা রাত মাঠটাকে আলোকিত করে রাখে। আমি দেখলাম গাড়ি চলার রাস্তা দিয়ে কে একজন এগিয়ে আসছে। পরনে ট্র্যাক স্যুট আর একটা জ্যাকেট। মাথায় টুপি। কাছে আসতে দেখলাম রোহিনী বোস। এঁর হস্টেল কিছূটা দূরে।
রোহিনী বসু আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। তারপর এগিয়ে এসে বলল, “তুমি একা একা দাঁড়িয়ে কী করছ? কফি খাবে?”
আমি বললাম, “খেতে পারি। কিন্তু এখন কোথায় পাব?”
“এখানে একটা কাফেটেরিয়া আছে। ওই বিল্ডিংটার পিছনে। ভালো জায়গা। ইন্সটিটিউটের ছাত্র, প্রফেসাররাও আসে। ভালো লাগবে।”
কাফেটেরিয়া গিয়ে দেখলাম বেশ জমজমাট আড্ডার পরিবেশ। দু-একজন রোহিনী বোসকে দেখে হ্যালো হাই করল। আমি অবশ্য কাউকেই চিনতে পারলাম না।
আমরা একটা টেবিলে কফি নিয়ে বসলাম। রোহিনীদি বলল, “তুমি রুয়েঞ্জরি গিয়েছিলে, তার গল্প বলো।”
আমি বললাম, “সেখানে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল। আমাদের এক্সপিডিশন হয়নি। আমরা কোনও পিকে উঠতেও পারিনি। জাস্ট একটু ঘুরে এসেছি বলতে পারেন।”
আমি আবার বললাম, “আচ্ছা আপনি এখানে কী নিয়ে বলবেন? আপনি তো আন্টার্কটিকা গিয়েছিলেন। আপনার পেপার কি তার উপরে?”
রোহিনী দি বললেন, “না, ঠিক তা নয়। আলপাইন রেঞ্জে মানুষ নিজেকে কীভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তাই নিয়ে বলব। এই খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তার কিছু নিদর্শন আমি পেয়েছি। শুধু হিমালয় নয়, বিদেশের কয়েকটা আলপাইন রেঞ্জে আমি কাজ করেছি।”
রোহিনী দিকে দেখে আমার খুব ভালো লাগল। একজন বাঙালি মহিলা গ্লেশিওলজিস্ট হয়ে সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেখে বেশ গর্ব হল। বললাম, “আপনি এই লাইনে এলেন কীভাবে? আপনার মেজর কী?”
রোহিনীদি হাসলেন। বললেন, “মেজর? ওটা গৌণ। ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আর্থ সায়েন্সের এই লাইনে কেন এলাম, সেটা একটা বিশাল গল্প। বাই দ্য ওয়ে, আমাকে রোহিনীদি বলে ডাকবে। তুমি করেও বলতে পারো।”
আমি বললাম, “শুনি সে গল্প। হাতে এখন বেশ কিছুটা সময় আছে। ডিনার দেবে সাড়ে আটটায়।”
রোহিনীদি শুরু করল, “আমার বাবা মৃগাঙ্ক বোস পড়াশোনাও করেছিল ভূগোল নিয়ে। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর বাবার মাথায় ভূত চাপল মাউন্টেনিয়ার হওয়ার।”
আমি বললাম, “ইন্টারেস্টিং।”
“বাবা একজন মাউন্টেনিয়ার ছিল। উনিশশো ছেষট্টি সালে চতুরঙ্গী এক্সপিডিশনে যাওয়ার পর বাবার খুব নামডাক হয়। বলা যায় বদনাম। তার কারণ অভিযান ফ্লপ করে। একটা দুর্ঘটনা হয়। হিমালয়ান জার্নালে আমি এই এক্সপিডিশনের উপর একটা লেখা পড়েছি।”
“তারপর বাবা বারবার হিমালয়ে নানা পিকে ওঠার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবার কোনও না কোনও কারণে তার অভিযান ব্যর্থ হয়। আর এই কারণেই আমার মার সঙ্গে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।”
“অবাক ব্যাপার তো! সেটা কোন সাল?” আমি বললাম।
“বাবা বিয়ে করে ১৯৭০ সালে, আমার জন্ম হয় একাত্তর সালে। আমার এক বছর বয়সে বাবা আর মার ডিভোর্স হয়। ফলে আমি বাবাকে দেখিনি বললেই চলে। দু-হাজার দুই সাল। মা মারা গিয়েছে। আমি সদ্য পিএইচডি শেষ করেছি। খবর পেলাম বাবা মারা গিয়েছে। যাদবপুরের একটা এক কামরার ফ্ল্যাটে একা অতি দরিদ্র অবস্থায় মারা গিয়েছেন। খবর পেয়ে কলকাতায় এলাম। সে সময় বাবার কাগজপত্রের মধ্যে আমি বেশ কিছু লেখা পাই। বাবার চতুরঙ্গী অভিযানের সময় কী ঘটেছিল তাও জানতে পারি এই সব লেখা থেকে। জানতে পারি বাবা বারবার হিমালয়ে এক্সপিডিশনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। সেসব পড়েই আমার আগ্রহ হয় হিমালয়ের গ্লেশিয়ার নিয়ে কাজ করার।”
তাই নাকি?
“বাবার সম্পত্তির মধ্যে আমি আরও একটা অসাধারণ জিনিস পাই যার সঙ্গে এই সেমিনারের মিল আছে।”
“মানে? কী পেয়েছিলে?”
“মানুষের হাড়। হিমালয়ের একটা গুহায় বাবা সেটা খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু এটা এখন গোপন থাক তুমি কাউকে কিছু বোলো না।”
আমি বললাম, “না না রোহিনীদি তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, আমি কাউকে কিছুই বলব না।”
রোহিনীদি বলল, “তুমি যদি আমার সঙ্গে দিল্লীতে আমার বাড়ি যাও তাহলে সেটা দেখাবও।”
পরদিন রোহিনীদির বক্তৃতার পর ভ্যালেডিক্টরি সেশন হল। তারপর বিকেল বেলায় যে যার মতন ফিরে যেতে শুরু করল। আমি একটা গাড়ি ভাড়া করলাম দিল্লী পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। রোহিনীদিকে বললাম, “তুমি যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও তাহলে আমি দিল্লীতে তোমার বাড়িতে নামিয়ে দিতে পারি।” শুনে নীলকান্ত রাও নামে একজন ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেল। আমরা তিনজন চললাম দিল্লীর দিকে।
এই নীলকান্ত রাও রোহিনীদির পূর্ব পরিচিত। একজন আর্কিওলজিস্ট, এই সেমিনারে শুধু শোনার জন্য এসেছিল। সারা রাস্তা এই নীলকান্ত রাও সমানে বলে গেল সে কতগুলি আর্কিওলজিকাল সাইটে কাজ করেছে। তার কতগুলি ইন্টারন্যাশনাল পেপার আছে ইত্যাদি। মাঝপথে একটু তর্কও হল। তার বক্তব্য গিরিশ প্যাটেল যা বলেছে সে সবের কোনও মানে নেই। হিমালয়ে পাথরের আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া এমন কিছু অদ্ভুত ব্যাপার নয়। চার-পাঁচ হাজার বছর আগে ওখানে যারা বাস করত তাদের কাছে ধাতুর অস্ত্র সহজলভ্য ছিল না। তারা পাথর এবং ধাতুর অস্ত্র দুইই ব্যবহার করত। ওই সব পুরাণটুরান নিয়ে ভালো গল্প ফেঁদেছে ভদ্রলোক। এই সরকারকে বাগিয়ে কিছু ফান্ড জোগাড় করার ধান্দা।”
আমি বললাম, “আমার কিন্তু গিরিশ প্যাটেলের কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছে।”
নীলকান্ত আমার দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল, “ইউ সেইড সো বিকজ ইউ আর এ লেম্যান।”
শুনে রোহিনীদি একটু বিরক্ত হল। বলল, “নীলকান্ত আমি তোমাকে প্রমাণ দিতে পারি গিরিশ প্যাটেল ঠিক কথা বলেছেন। তার জন্য আমার বাড়ি যেতে হবে।”
নীলকান্ত একটা বাঁকা হাসি হেসে বলল, “দুনিয়ায় সবাই এখন আর্কিওলজির চর্চা করছে। সাবজেক্টটার জাত ধর্ম আর রইল না।”
দিল্লীর চিত্তরঞ্জন পার্কের বারো নম্বর পকেটে রোহিনীদির বাড়ি। বাড়ি নয়, অ্যাপার্টমেন্ট। একতলা আর বেসমেন্ট নিয়ে রোহিনীদির সংসার। সংসার বলতে রোহিনীদি একাই থাকে, আর একজন বাঙালি কাজের মহিলা। আমরা পৌঁছালাম রাত আটটায়।
রোহিনীদি বলল, নীলকান্ত, তোমার ফ্লাইট তো কাল সকালে, আমার বাড়িতে বিশ্রাম করে তারপর চলে যেও এয়ারপোর্টে। আমরা রাতটা রোহিনীদির বাড়িতেই থাকব বলে ঠিক হল। আমার ট্রেন পরদিন বিকেলে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে রোহিনীদি বলল, “আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাব বলেছিলাম। নীলকান্ত তোমাকেও দেখাতে পারি, কিন্তু কথা দিতে হবে এখন কাউকে এ সম্বন্ধে কিছু বললতে পারবে না।”
নীলকান্ত বলল, “কথা দিচ্ছি।”
খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরে রোহিনীদি আলমারি খুলে একটা ছোট কাঠের বাক্স নিয়ে এল। খুব সাধারণ বাক্স, সম্ভবত চা রাখা হত তাতে। সেটা খুলে তার ভিতর থেকে কাগজে মোড়া একটা জিনিস নিয়ে টেবিলের উপর রাখল। কাগজের মোড়কটা খুলতেই দুটো হাড়ের টুকরো বেরিয়ে এল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এগুলি কী?”
রোহিনীদি বলল, “ভালো করে দেখো, আমার বাবার সম্পত্তি, আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। তবে শুধু এটা নয়, একটা খাতায় কিছু লেখাও পেয়েছি।”
“সে না হয় হল, কিন্তু এদুটো কী তা তো বলবে!” আমি বললাম।
নীলকান্ত আমার মুখের থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “বলছি, একটা হল দাঁত, মানুষের দাঁত, আর একটা চোয়ালের হাড়। মোলারটা মানুষের মোলার থেকে একটু বড়, কিন্তু চোয়ালটা মানুষেরই মতো কিন্তু একটু আলাদা, বিশেষ করে চোয়ালের নীচের দিকটা।”
মানুষের দাঁত! আমি অবাক হয়ে বললাম, “তা এত যত্ন করে রাখা কেন?”
নীলকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোয়াল ঝুলে গিয়েছে। দুই চোখ বিষ্ফোরিত। আমার দিকে ফিরে বলল, “তার কারণ এগুলি আমাদের মতো মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্সের দাঁত নয়। কিন্তু হতে পারে বুদ্ধিমান, দু-পেয়ে, লেজহীন, প্রায় মানুষের দাঁত।”
আমি লাফিয়ে উঠলাম, “তার মানে গিরিশ প্যাটেলের কথামতো ভারতবর্ষেও নিয়ান্ডারথালের সমসাময়িক একটা মানব প্রজাতি ছিল? তোমার কাছে তার প্রমাণ আছে?”
রোহিনী দি বলল “প্রমাণ যে আমার কাছে আছে, সেটা দেখতেই পাচ্ছ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা স্বীকৃতি দিলে তবেই না! আমি তো সাহস করে কারো কাছে যেতেই পারছি না এগুলি নিয়ে।”
আমি বললাম “এই সেমিনারের পরে মনে হয় আর অসুবিধা হবে না। এখন অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে মানুষের ইভলিউশন নিয়ে আরও অনেক চমক বাকি আছে।”
“বাট,” নীলকান্ত বলল, “এই প্রমাণটা যথেষ্ট বড় প্রমাণ নয়, আরও অনেক প্রমাণ চাই। সবচেয়ে বড় কথা এই দাঁতদুটোর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পরীক্ষা করা দরকার ও জিন সিকোয়েন্স বের করা দরকার।”
রোহিনীদি এ কথার কোনও উত্তর দিল না।
নীলকান্ত হাড় দুটো নেড়েচেড়ে বলল, “এগুলি খুব পুরোনো বলে মনে হচ্ছে না। মোলারের ক্রাউনটা একটু ভাঙা। কিন্তু তোমার বাবা এগুলি পেলেন কোথায়?”
“বাবা কোথায় পেয়েছেন সব বাবা একটা খাতায় লিখে রেখেছেন। তোমরা পড়ে দেখতে পারো।” বলে রোহিনীদি একটা খাতা আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন।
নীলকান্ত খাতাটা নেড়েচেড়ে বলল, “বাংলায় লেখা, আমি পড়তে পারব না। আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি পড়ে নাও। তারপর সকালে আমরা কথা বলব।”
৩
মৃগাঙ্ক বোসের গল্প
জার্মানি থেকে ফিরে আমি আর গুন্টার ঠিক করলাম ধারাবাহিকভাবে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের কয়েকটা পিকে উঠব। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে আমরা হরশিলে এস পৌঁছাই। আমাদের দরকার ছিল পঁচাত্তর জন কুলি কিন্তু পেয়েছিলাম মাত্র পঞ্চান্ন জন। হরশিল থেকে গঙ্গোত্রী পর্যন্ত সারা রাত ধরে চাঁদের আলোয় ট্রেক আমার সারা জীবন মনে থাকবে। নন্দনবনে যেদিন গিয়ে পৌঁছালাম সেদিন বুঝতে পারলাম শীত ঋতু শুরু হয়ে গিয়েছে। চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ারের দক্ষিণ তীরে বাসুকিতালে ষোল হাজার দুশো ফুট উচ্চতায় আমরা আমাদের বেস ক্যাম্প তৈরি করলাম। এখান থেকে শতোপন্থের উত্তর দিকের শৈলশিরা দেখা যায়। সেদিক দিয়ে শতোপন্থে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে এক বিপত্তি ঘটল। আমাদের ধারণাই ছিল না যে শক্ত নীল বরফের আস্তরণের ঠিক নীচে হালকা তুলার মতো নরম বরফের একটা স্তর রয়েছে। আমরা তার উপর পা রাখতেই বরফের স্তর ভেঙে ক্রমে গভীরে ঢুকে যেতে শুরু করল। আমরা তিন দিন ধরে সেই স্তর পার হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আমাদের যা সরঞ্জাম ছিল তাই নিয়ে শতোপন্থে ওঠা কঠিন, বিশেষ করে ছুরির মতো ধারালো গিরিশিরা অনেক অভিযানকেই এর আগে ব্যর্থ করে দিয়েছে।
কিন্তু এতদূর এসে এভাবে তো ফিরে যাওয়া যায় না। তাই ঠিক করা হল কুড়ি হাজার আটশ চল্লিশ ফুট আরোয়া গ্রুপের সবচেয়ে উঁচু পিক আরোয়া টাওয়ারে উঠব। অক্টোবরের কুড়ি তারিখে পাহাড়ের পশ্চিম ঢালে আমাদের এক নম্বর ক্যাম্প রাখা হল। ২৩ অক্টোবর সুধাময় সেন, অমর চক্রবর্তী, পেম্বো তাসি, এবং ওয়াং নোরবু দশ ঘণ্টা কঠিন চেষ্টার পরে শীর্ষে উঠতে পারল। আমার একটু বমি বমি ভাব থাকায় আমি উনিশ হাজার দুশো ফুটে আমাদের ক্যাম্পে ছিলাম। ২৪ অক্টোবর সকালে একজন পোর্টার আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে এবং আমাকে বলে যে কেউ পাহাড় থেকে ফিরে আসেনি এবং সারা রাত ধরে তাদের চিৎকার শোনা গিয়েছে। তারা কোথায় আছে তাও বোঝা যাচ্ছে না।
বেলা সাড়ে তিনটার সময় অমরকে খুঁজে পাওয়া গেল। প্রচণ্ড ফ্রস্ট বাইটের কারণে তার হাত পায়ে কোনও সাড় নেই। সন্ধ্যা ছ-টা নাগাদ সে মারা গেল।
যারা চূড়ায় উঠেছিল তারা নামার সময় পাসাং নোরগের উপর একটু বেশি নির্ভর করেছিল। বাকিরা ওই প্রচণ্ড খাড়া ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছিল। হঠাৎ পাসাং এর দড়ি খুলে যায় ও পিছন থেকে সোজা বিদ্যুৎবেগে নীচে পড়ে যেতে থাকে। তারপর সবাই একসঙ্গে নীচে পড়তে থাকে। প্রায় সাতশো ফুট ধরে তারা গড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা যে গড়িয়ে পড়ছে আমরে প্রথমে তা কেউই বুঝতে পারিনি। কুয়াশায় চারদিক একেবারে ঢেকে ছিল। পেম্বো তাসি, এবং ওয়াং নোরবু ভয়ঙ্করভাবে আহত হয়। প্রায় মাঝরাতের দিকে পেম্বা তাসির মৃত্যু হয়। নোরবু মারা যায় পরের দিন দুপুরবেলায়। সুধাময়কে বেস ক্যাম্পে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব নয়।
আমি তখন রেডিয়োতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। অবশেষে সেনাবাহিনী আমাদের জানায় ওরা একটা হেলিকপটার পাঠাচ্ছে। তখন আমরা প্রায় সতেরো হাজার আটশো ফুটে, তারিখটা ২৭ অক্টোবর। আমার থেকে বাকিদের দূরত্ব ছিল প্রায় দুশো ফুট। এখানে পাহাড়ের ঢালে রয়েছে আইসফল ও সেরাক। বিকেল তিনটে নাগাদ ওরা আমার চোখের আড়ালে চলে যায়। ঠিক এই সময় আর একটা তুষার ঝঞ্ঝা শুরু হয়। আমার রেডিয়ো আমার হাত থেকে খসে পড়ে।
ঘণ্টা দুই পরে তুষার ঝড় থেমে যাওয়ার পরে আমি দেখলাম একটা আইসফলের ধারে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। আমার কাছে পাহাড় থেকে নামার কিছু সরঞ্জাম আছে কিন্তু পিঠে একটা মস্ত বোঝা নিয়ে এই দেয়াল বেয়ে নামা অসম্ভব। ঘড়িতে দেখলাম সন্ধ্যা ছ-টা। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। এখন আমাকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে সেটা ভাবাটাই একটা অসম্ভব ব্যাপার। কাল সকালের আগে কেউ আসবে না। তবে একটাই বিশ্বাস, সেনাবাহিনী যখন এই কাজটা হাতে নিয়েছে, কাল অন্তত এরা আমাকে উদ্ধার করবে।
এই সেরাকের দেয়াল পার হয়ে আর হাজার খানেক ফুট নামতে পারলেই কিছুটা সমতল জায়গা পাবো। এখন আমার একটাই রাস্তা যা পর্বতারোহীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ। তা হল সোলো রাপেলিং বা একা একা দড়ি ধরে নামা। পাথরের দেয়াল হলে কাজটা কিছুটা কম বিপজ্জনক, কিন্তু এই বরফের দেয়াল যে কোনও সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। কিন্তু এখানে বসে থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু। আমাকে হাত-পা চালিয়ে যেতে হবে, শরীর গরম রাখতে হবে, নইলে ফ্রস্টবাইট হয়ে যেতে পারে।
আমি বরফের একটা খাঁজে প্রথম র্যাপেল অ্যাঙ্কর লাগিয়ে ফুট তিনেক নীচে একটা বরফের খাঁজের উপর পা রাখতেই সেটা হড়কে গেল। আমি নীচে গড়িয়ে পড়তে লাগলাম। তবে খুব একটা বেশি নীচে পড়লাম না। একটা শক্ত বরফের স্তূপের মাথায় গিয়ে আটকে গেলাম। এখনও আকাশে কিছুটা আলো আছে। চেষ্টা করলে আরও কিছুটা নামা যাবে। আমি দু-খানা আইস এক্স নিয়ে খুব সন্তর্পনে বরফের স্তূপের গা বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম। আরও কিছুটা নামার পরে মনে হল কিছুটা সমতল জায়গা রয়েছে। সেখানে পা রাখতে পারলে কিছুটা সুবিধা হবে।
আমি বুঝতে পারিনি যে ওই সমতল জায়গাটা আসলে নরম বরফ। সেখানে পা রাখতেই আমি ভুস করে ডুবে গেলাম। সোজা তলার দিকে চলে যেতে থাকলাম। ক্রমে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। কতটা নেমেছিলাম বলতে পারছি না, কিন্তু এক সময় দেখলাম আমার চারপাশটা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে একটা অন্ধকার গর্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছি। পায়ের নিচে শক্ত ঠেকছে। সেটা বরফও হতে পারে আবার পাথরও হতে পারে।
আমার পিঠের রুক স্যাকের একটা স্ট্র্যাপ ছিড়ে গেলেও কোমরের সঙ্গে বাঁধা থাকায় খসে পড়েনি। ওর মধ্যেই আমার যা কিছু রসদ রয়েছে। কিন্তু অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে আমি কী অবস্থায় আছি বুঝতে পারছি না। আমি রুকস্যাক থেকে টর্চ বের করে জ্বালালাম। মনে হল আমার চারপাশে পাথরের দেয়াল। আমি একটা গুহার মধ্যে পড়ে গিয়েছি। গুহাটার চারপাশে আলো ফেলে বুঝতে পারলাম সাত-আট ফুট উঁচু গুহা। চওড়ায় পাঁচ ফুটের মতো হবে। একদিকে অন্ধকার, টর্চের আলো ফেলে বুঝতে পারলাম গুহাটা সেই দিকে চলে গিয়েছে। কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে কে জানে।
আমি যেখান দিয়ে গুহার ভিতরে এসে পড়েছি সেদিক দিয়ে বের হওয়ার কোনও উপায় নেই। কিন্তু গুহার যদি অন্য দিকে একটা মুখ থাকে তবে হয়তো আমি বের হতে পারব। নইলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। আমার সঙ্গে যা টিনের খাবার আছে তা দিয়ে তিন-চারদিন চলবে। তার মধ্যে একটা পথ খুঁজে নিতে হবে। আমি গুহার একটা দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে যেতে থাকলাম। গুহাটার যদি অন্য একটা মুখ থাকে তা কত দূরে হতে পারে তা অনুমান করার চেষ্টা করলাম। যদি চার-পাঁচ কিলোমিটারও হয় তা হলেও আমি বেরিয়ে যেতে পারব। তবে সব সময় টর্চ জ্বালিয়ে রাখলে চলবে না। মাঝে মাঝে টর্চ নিবিয়ে অন্ধকারে হাঁটতে হবে। গুহার ভিতরে তত ঠান্ডা নেই। মাঝে মাঝে উপর থেকে জল পড়ে নীচে বরফের স্তূপ গজিয়ে উঠেছে শিবলিঙ্গের মতো। এটা লাইমস্টোনের গুহা নয় এটা বোঝা যাচ্ছে।
আমার মনের মধ্যে দুটো ভয়, যদি এই গুহার আর কোনও খোলা মুখ না থাকে! কিন্তু নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে গুহার খোলা মুখ না থাকলে আমি নিশ্বাস নিতে পারতাম না। কিন্তু সেই খোলা মুখ কত দূরে কে জানে। আরও একটা ভয় যদি কোনও হিংস্র জন্তুর মুখোমুখি হতে হয়।
গুহার এক দিকের দেয়াল ধরে সন্তর্পনে এগোতে এগোতে মনে হল গুহার মেঝেটা ক্রমশ নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আমি ঘড়ি দেখলাম। রাত দশটা। শরীর প্রচণ্ড ক্লান্ত। ব্যাগের থেকে একটা চকলেট বের করে খেতে খেতে একটু বসলাম। বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
ঘুম ভাঙল যখন তখন ঘড়িতে দেখলাম সাতটা বেজেছে। তার মানে সকাল সাতটা। আজ ২৮ অক্টোবর। আবার উঠে হাঁটতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে সামনের পথ দেখে নিচ্ছিলাম। মনে হল গুহাটা পাঁচ ছয় ফুটের মতো চওড়া। ছাদ কোথাও কোথাও আট নয় ফুট উঁচু। মাঝে মাঝে দেয়ালে লম্বা লম্বা গর্ত। কেন কে জানে।
গুহার ভিতরে আরও একটা দিন কেটে গেল। পাছে উলটো দিকে আবার চলে যাই সেই ভয়ে ডান দিকের দেয়াল ঘেঁষে থাকছি, চলার সময় এবং বিশ্রাম করার সময়। পরদিন অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর মনে হল সামান্য আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। আমি সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রায় এক কিলোমিটার চলার পরে গুহার মুখ দেখতে পেলাম।
গুহার মুখটাও পাঁচ ফুটের মতো। কিন্তু ভিতরে কিছুটা চওড়া। সেখানে মেঝের উপর দেখতে পেলাম। গোল গোল করে কিছু পাথর সাজানো রয়েছে। সেই গোলের ভিতরে কয়েকটা করে হাড়। দেখে মানুষের হাড় বলেই মনে হল। আমি তার থেকে দু-টুকরো হাড় নিয়ে আমার ব্যাগে ভরে নিলাম। গুহার মুখে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কোথায় এসেছি। গুহার থেকে ফুট দশেক নীচে একটা উপত্যকা, তবে হিমবাহ রয়েছে। আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখলাম হিমবাহ খুব বেশিদূর পর্যন্ত নেই। সাদা বরফের পরে প্রায় এক কিলোমিটার ডার্টি গ্লেশিয়ার রয়েছে। তার মানে হিমবাহ ওই দিকেই বইছে। আমার ভয় আর উদ্বেগ কমে যাওয়ায় অনেকটা বল পেলাম। চারদিক দেখে মনে হল আমি একটা গ্লেশিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি। তার মানে পূর্বদিকে গেলে একটা নদী পাবো।
সেদিনই বিকেলের দিকে সেনাবাহিনীর একটা হেলিকপটার আমাকে উদ্ধার করে মানা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ দেখে ওরাও খুব অবাক হয়ে যায়।
৪
মৃগাঙ্ক বোসের ডায়েরি শেষ করে আমি চুপ করে বসে রইলাম। হিমালয়ে বেশ কিছু গুহা আছে বলে শুনেছি। কিন্তু এরকম টানেলের মতো গুহা আবার তার মধ্যে মানুষের হাড় পাওয়া আবার বেশ অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। ঠিক করলাম কাল সকালে রোহিনীদিকে জিজ্ঞাসা করব এই দাঁত নিয়ে রোহিনীদি কিছু করেছে কিনা, মানে কোনও তথ্য বের করার চেষ্টা করেছে কিনা।
সকালবেলায় উঠে দেখলাম নীলকান্ত টেবিলের সামনে বসে দাঁতগুলির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম “আপনি এয়ারপোর্ট যাননি? আপনার ফ্লাইট তো সকাল আটটায়।”
নীলকান্ত বলল, “ক্যানসেল করেছি। বেলা দুটোর ফ্লাইটে যাব। এগুলোকে একটু ভালো করে দেখে নিই। রোহিনী, তুমি তো আমাকে আগে বলনি তোমার কাছে এই জিনিস আছে। তাহলে সেমিনারে হইচই ফেলে দিতে পারতাম।”
রোহিনীদি টেবিলের উপর ব্রেকফাস্ট সাজাতে সাজাতে বলল, “এখন মনে হচ্ছে, এগুলি নিয়ে কিছু একটা করা দরকার।”
আমি রোহিনীদিকে প্রশ্ন করলাম, “তুমি এতদিন ধরে এগুলি নিয়ে কিছু করনি কেন? লোকে অন্তত এ নিয়ে কিছুটা গবেষণা করতে পারত।”
রোহিনীদি বলল, “আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সমস্যা একটা জায়গায়। এগুলি কোথায় পেয়েছি সেটা লোকেদের বোঝানো খুব কঠিন কাজ। এগুলি দেখে অনেকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে শুরু করল। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এগুলি মানুষের হাড়, কিন্তু আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সের নয়। সেটাই কাউকে বোঝাতে পারিনি। তা ছাড়া এটা আমার নিজের বিষয় নয় বলে এ নিয়ে জোর দিয়ে কাউকে কিছু বোঝানোও সম্ভব হচ্ছিল না।”
“বাট টাইম হ্যাজ চেঞ্জড নাও। তোমার বাবা কোথায় পেয়েছিলেন এগুলি?” নীলকান্ত প্রশ্ন করল।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “ইন এ কেভ নিয়ার চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ার।” বলেই মনে হল বলাটা ঠিক হয়নি। আমি রোহিনীদির মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম ইশারায় আমাকে চুপ করে থাকতে বলছে।
“কিন্তু তোমার কী করে মনে হল এগুলি মানুষের হাড় নয়, মানে আমাদের মতো মানুষের নয়? তুমি তো অ্যানথ্রোপলজিস্ট নও।”
“বছর দুই আগে আমি একজন অ্যানথ্রোপোলজিস্টকে দেখিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন এগুলি কোনও অজানা হোমিনিনের হতে পারে। বলেছিলেন এগুলি ফেকও হতে পারে। কিন্তু আমি তো জানি এগুলি ফেক নয়। আমার বাবার নিজের কালেকশন।”
নীলকান্ত বলল, “রোহিনী, আমি কিন্তু এ ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। এগুলো দেখে মনে হচ্ছে ভারতবর্ষে হিউম্যান মাইগ্রেশন এবং ইভলিউশন নিয়ে অনেক কাজ করা বাকি আছে। আর্কিওলজি আমার বিষয়। আমি এটা নিয়ে কাজ করতে চাই। প্লিজ হেল্প মি। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন একটা অসাধারণ কিছু করার।”
রোহিনীদি একটু চিন্তায় পড়ে গেল। বলল, “তার মানে এগুলি তুমি তোমার ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যেতে চাও?”
“অবশ্যই, প্রথমে এর বয়স বের করতে হবে, আর বয়স বের করতে গেলে এগুলি নিয়ে যেতে তো হবেই।”
রোহিনীদি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তা হয় না নীলকান্ত, এটা আমার বাবার কালেকশন। এটা নিয়ে আমিই কাজ করব ঠিক করেছি। তা ছাড়া একটা ব্যাপারে তোমার খুব সুনাম নেই, তুমি অন্যের কাজ নিজের বলে চালাতে ওস্তাদ। তা ছাড়া এখুনি আমি এগুলি হাতছাড়া করতে রাজি নই। যদি সত্যিই কিছু করতে চাও তাহলে আমি তাতে সক্রিয়ভাবে থাকতে চাই।”
নীলকান্ত একটু রেগে বলল, “রোহিনী, এগুলি তোমার কোনও কাজে আসবে না। কিন্তু তুমি এগুলি নিজের কাছে রেখে দিতেও পারবে না। একদিন কেউ না কেউ এগুলি তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে।”
রোহিনীদি বলল, “তুমি তা নিয়ে ভেবো না নীলকান্ত, আমি এগুলির সঠিক ব্যবস্থা নেবো। তবে তোমাকে দিতে আমি রাজি নই।”
নীলকান্ত রাওয়ের মুখ দেখে মনে হল রোহিনীদির কথা তার পছন্দ হচ্ছে না। বলল, “রোহিনি, ইউ কান্ট ইমাজিন হোয়াট আ লার্জ ফান্ড ইউ ক্যান গেট ইফ ইউ মেক ইট পাবলিশড। হোয়াট এ ডিসকভারি।”
রোহিনীদি উত্তর দিল না।
বেলা এগারোটা নাগাদ নীলকান্ত রাও হায়দারাবাদের প্লেন ধরতে বেরিয়ে গেল। আমি আর রোহিনীদি বসে বসে গল্প করতে শুরু করলাম। যাওয়ার আগে নীলকান্ত বলে গেল, “আমি আবার আসব রোহিনী। আমি ওগুলো ঠিক নিয়ে যাব।”
রোহিনীদি বলল, “এই নীলকান্ত তো আমাকে ভাবনায় ফেলে দিল। ওকে এটা দেখানো ঠিক হল কিনা জানি না। ও আমার কাছে এটা দেখেছে, কাজেই ও এগুলো দখল করা চেষ্টা করবে। আমাকে বার বার বিরক্ত করার চেষ্টা করবে।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এই নীলকান্ত রাও কী করে?”
“ওর নিজস্ব একটা ইন্সটিটিউট আছে। মানব চর্চা নামে। দিল্লীতে ওর এক কাকা ক্যাবিনেট মন্ত্রী। প্রচুর দেশিবিদেশি ফান্ড জোগাড় করে। কিন্তু লোকটা সুবিধার নয়।”
আমি বললাম,” আমি একটা কথা বলব রোহিনীদি? যাবে নাকি হাই অল্টিচুড একটা এক্সপিডিশনে? নীলকান্ত কিছু করার আগে আমরাই বরং জায়গাটা খুঁজে বের করি। অন্তত চেষ্টা তো করতে পারব।”
রোহিনীদি বলল, “আমি তো রাজি। কিন্তু দুম করে একটা এক্সপিডিশন করা কি সম্ভব?”
“দুম করে করা যাবে না। কিন্তু যেতে হবে। নইলে নীলকান্ত রাওয়ের মতো লোকরা এসে সমস্ত কৃতিত্ব নিয়ে নেবে।”
“আমরা যদি আসল জায়গাটায় পৌঁছাতে পারি তা হলে অনেক তথ্যই খুঁজে পাব। ভারতবর্ষের এই অন্য একটা মানব প্রজাতির নিদর্শন ছাড়াও আরও নানা বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে। তবে এই দুই জনে হবে না। আরও লোক দরকার, মানে সায়েন্টিস্ট দরকার।”
“আমার আর দুজনের কথা মনে হচ্ছে, একজনের নাম নাম সিতাংশু মুর্মু। তুমি কি বল, রোহিনীদি?”
“সিতাংশু মুর্মুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। কিন্তু মনে হয়েছে ওঁকে সঙ্গে নিলে ভালোই হবে। বয়স কম, তা ছাড়া উনিও মনে করেন ভারতে আরও কয়েকটি হোমিনিড স্পিসিস ইভলভ্ড হয়েছিল। অন্তত আফ্রিকা থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স ভারতে প্রবেশের আগে অবশ্যই ছিল। আর একজন কে?”
আর একজনকে আমি খুব ভালো চিনি। থাকে টেক্সাসে। তবে বললেই রাজি হয়ে যাবে।
“কী নাম তার?”
“অরিন্দম সেন, জিওলজিস্ট আমরা এক সঙ্গে রুয়েঞ্জরিতে গিয়েছিলাম।”
“একজন জিওলজিস্ট সঙ্গে থাকলে তো খুব ভালো হয়।”
বিকেলবেলায় রোহিনীদির বাড়ি থেকে চলে আসার সময় রোহিনীদি বলল, “তুমি কলকাতায় গিয়েই সিতাংশু মুর্মুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে রেখো। আমি যাবো।”
কলকাতায় ফিরে আমার প্রথম কাজ হল অরিন্দমদার সঙ্গে যোগাযোগ করা। একদিন একটু গভীর রাত্রে একটা ভিডিয়ো কলে তাকে পেয়ে গেলাম। সব শুনে অরিন্দমদা বলল, খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আমি তো তোমাদের সঙ্গে যেতেই পারি। আমি থাকলে তোমাদের সুবিধাই হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের আগে হবে না। আমি বললাম, “সেপ্টেম্বর তো অনেক দেরি।”
তারপর অনেক কথা হল অরিন্দমদার সঙ্গে। অরিন্দমদা বলল, তুমি আমাকে হাড়গুলির কয়েকটা বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি পাঠাতে পারবে? আমি এগুলি বিখ্যাত প্যালিওন্টলজিস্ট সারা নেলসনকে দেখাব। উনি একটা হাড়ের টুকরো থেকে সম্পূর্ণ প্রাণীর চেহারা তৈরি করতে পারেন। কিছুটা নিজের জ্ঞান ও কিছুটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে।”
আমি অবাক হয়ে বললা, “এটা সম্ভব নাকি?”
সম্ভব তো বটেই, “ডাইনোসরদের কথাই দেখো না কেন। অল্প কয়েকটা ডাইনোসরের সম্পূর্ণ স্কেলিটন পাওয়া গিয়েছে। বেশির ভাগেরই তো কয়েক টুকরো হাড় ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। কিন্তু ওই হাড়ের টুকরোর উপর ভিত্তি করে তাদের যে চেহারা তৈরি হয়েছে তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য।”
“তুমি বলছ এই দাঁত আর চোয়াল থেকেই সম্পূর্ণ মানুষটার একটা চেহারা পাওয়া যাবে?”
“অবশ্যই যাবে।”
অরিন্দমদা আমাকে বুঝিয়ে দিল কীভাবে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ক-টা ছবি নিতে হবে, যাতে তার থেকে একটা স্কেলসম্মত ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা যায়। এই ছবি থেকে একটা থ্রিডি প্রিন্টারে প্রিন্ট নিলেই হাড়গুলির একটা রেপ্লিকা পাওয়া যাবে। তার থেকে পুরো চেহারাটা তৈরি করা হবে। এ ব্যাপারে সারা নেলসনের সমকক্ষ আর কেউ নেই।
আমি রোহিনীদিকে জানিয়ে দিলাম কীভাবে ছবি তুলতে হবে। সেই সঙ্গে অরিন্দমদার ঠিকানা ফোন নম্বর সব দিয়ে দিলাম।
মাসখানেক পরে সিতাংশু মুর্মুর সঙ্গে ফোনে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিতে হল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টে একটা ঘরে তিনি বসেন। সায়েন্স কলেজে লিফটের সামনে রোহিনীদির সঙ্গে দেখা হল। রোহিনীদি একটা দারুণ শাড়ি পরে এসেছে। হাতে একটা ব্যাগ, তার মধ্যে হাড়ের টুকরোগুলি। আমাদের মনে একটাই সংশয় সিতাংশু মুর্মুকে সব কথা খুলে বলা যাবে কিনা বা আমাদের প্রস্তাবে উনি রাজি হবেন কিনা। আমাদের কাছে আরও একটা জিনিস রয়েছে। অরিন্দমদার পাঠানো একটা ছবি। হোমো ইন্ডোসেনেক্সের ছবি, সারা নেলসন তৈরি করে দিয়েছে। ওটা রোহিনীদির ল্যাপটপে রয়েছে। দরকার হলে ওটাও দেখাব।
সিতাংশু মুর্মু তার চেম্বারে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল। রোহিনী দিকে দেখে বলল, “আপনি রোহিনী বোস তো? আমি দেখেই চিনতে পেরেছি। হাই অল্টিচুড অ্যাডাপ্টেশনের উপর আপনার পেপারটা আমার খুব ভালো লেগেছে।”
রোহিনীদি আমার পরিচয় দিল। বলল, “এও সেই সেমিনারে ছিল সাংবাদিক হিসাবে।”
সিতাংশু মুর্মুর বয়স বেশি নয়। চল্লিশের কম। রহিনীদির দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশ ডক্টর বোস, বলুন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?”
রোহিনীদি একটু ইতস্তত করে বলল, “আপনার সঙ্গে আমরা একটা খুব জরুরি এবং গোপন বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। এটা আপনারও কাজে লাগবে। শুধু আপনাকে একটা কথা দিতে হাবে, তা হল, আপনি যদি আমাদের প্রস্তাবে রাজি নাও হন, তাহলেও আমাদের আজকের এই আলোচনা গোপন রাখতে হবে।”
“আগে বলুন বিষয়টা কী নিয়ে। যদি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তবে শুনব এবং কথাও দেব।”
“এটা আপনারই বিষয়। আপনি সেমিনারে বলেছিলেন, এবং গিরিশ প্যাটেলও বলেছিল ভারতে হোমো স্যাপিয়েন্স আসার আগে এবং হোমো ইরেক্টাসের পরে একটা হোমিনিন স্পিসিস ছিল যাদেরকে অ্যানাটমিক্যালি মডার্ন হিউম্যান বলা হয়। কিন্তু তারা যে ছিল তার কোনও প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।”
সিতাংশু মুর্মু মাথা নাড়ল। বল, “হ্যাঁ বলেছিলাম। প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি বটে কিন্তু তারা যে ছিল এটা আমি বিশ্বাস করি। পরোক্ষ প্রমাণ কিছু আছে।”
“বেশ, আমি যদি আপনাকে তার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখাতে পারি আপনি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হবেন তো?”
সিতাংশু লাফিয়ে উঠে বলল, “মানে? আপনি প্রমাণ পেয়েছেন? কোথায় পেলেন? নর্মদা ভ্যালিতে?”
রোহিনীদি হেসে বলল, “না হাই অল্টিচুডে। এবার মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিলে আপনাকে প্রমাণ দেখাতে পারি।”
“শিওর, আমি শপথ নিচ্ছি।”
রোহিনীদি ব্যাগের থেকে হাড়ের টুকরাটা বের করে টেবিলের উপর রাখল। সিতাংশু মুর্মু অফিসের ফোনে তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে কাকে যেন বলল, এখন কেউ যেন আমার ঘরে না আসে।
হাড়গুলি বেশ ভালো করে দেখল সিতাংশু। তারপর বলল, “দুটো জিনিস পরিষ্কার, এক নম্বর এটা হোমো স্যাপিয়েন্সের নয়। দুই এটা অ্যানাটমিকালি মডার্ন হিউম্যানের। মানে মানুষের মতো কোনও প্রাণীর। একটু ভালো করে চোয়ালের নীচের দিকটা দেখুন। মানুষের থুতনি সামনের দিকে এগোনো থাকে, কিন্তু এর থুতনি একটু পিছনের দিকে। সামনের দাঁতগুলি মানুষের দাঁতের তুলনায় বড়। তা ছাড়া এ হাড় বেশি পুরু বলে মনে হচ্ছে। আপনি এটার রেডিয়োকার্বন ডেটিং করিয়েছেন?”
রোহিনীদি বলল, “করিয়েছি, জিএসআই থেকে। আমার খটকা লাগছে সেখানেই। এগুলি মাত্র চার হাজার বছর পুরোনো।”
“তার মানে গিরিশ প্যাটেলের কথাও ঠিক। আমার নিজের থিয়োরিও মিলে যাচ্ছে। হতেই পারে, চার হাজার বছর আগেও হয়তো এরা কেউ কেউ বেঁচে ছিল। কিন্তু সবচেয়ে ভালো হয় যদি এর ডিএনএ পরীক্ষা করা যায়। তাহলে জেনম সিকুয়েন্স বের করে এরা ঠিক কী ধরনের হোমিনিন তা বের করা যাবে।”
আমি বললাম, “এখন করা যাবে?”
“করা যাবে, তবে লাভ নেই, কারণ কোথায় পাওয়া গিয়েছে সেটা না জানা পর্যন্ত কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
“তাহলে আপনি কী করতে বলেন?”
সিতাংশু মুর্মু বলল, “কিন্তু এগুলি নিয়ে এখন কী করা? গোপন রাখলে তো চলবে না। এটা একটা বিশাল আবিষ্কার। সারা পৃথিবীর মানুষের জানা দরকার।”
“অবশ্যই।” রোহিনীদি বলল, “কিন্তু এটা কোথায় পাওয়া গিয়েছে সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে আমার বাবা হিমালয়ের কোনও একটা জায়গায় এটা পেয়েছিলেন। সেই জায়গাটা খুঁজে না পেলে আপনি কীভাবে লোককে বোঝাবেন যে এটা কী? সেটা না জানলে আপনার অনুসন্ধান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
সিতাংশু একটু ভেবে বলল, “এই জিনিস আপনার কাছে ছিল, আপনি সেমিনারের সময় বলেননি কেন? অনেকে ছিল, আপনি অনেক মতামত পেতেন।”
“কী করে বলব? কোথায় পাওয়া গিয়েছে সেটাই তো ঠিকমতো জানি না। তা ছাড়া এটার গুরুত্ব সম্পর্কে সেমিনারের আগে আমার কোনও ধারণাই ছিল না।”
আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। কিন্তু আমার একটু কৌতুহল হল। বললাম, “আপনার থিয়োরিটা কী?”
সিতাংশু আমার দিকে ফিরে বলল, “তুমি আমার থেকে অনেক ছোট, তোমাকে তুমি করেই বলছি। তাহলে শোন। ভারতবর্ষে অ্যাডভান্স হোমিনিনদের আগমন সম্ভবত সাত-আট লক্ষ বছর আগে। তারাও আফ্রিকা থেকে এসেছিল এবং সম্ভবত তারা ছিল হোমো ইরেক্টাস। হোমো ইরেক্টাস ছাড়া আর কোনও মানুষের খুব কাছাকাছি হোমিনিন ফসিল এদেশে পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ, দেড় কোটি বছর আগে মায়োসিনে হিমালয়ের শিবালিক পাহাড়ে কিছু এপ বা লেজহীন দু-পায়ে চলা একটু অগ্রসর প্রাণীর ফসিল পাওয়া গিয়েছে। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে শিভাপিথেকাস, সুগ্রিবপিথেকাস ইত্যাদি। কিন্তু তারা হোমো ইরেক্টাসের মতো এত অগ্রসর ছিল না। হোমিনিন কাকে বলে জানো তো?”
বললাম, “জানি, মানুষের মতো দৈহিক গঠনযুক্ত প্রাণী, যেমন হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান্ডারথাল, বা আমরা।”
“হ্যাঁ ঠিক বলেছ। নব্বইয়ের দশকে নর্মদার তীরে হাথোরা থেকে বোল্ডার কংগ্লোমারেটের মধ্যে হোমো ইরেক্টাসের মাথার খুলির যে অংশটি পাওয়া গিয়েছে তা বলা চলে গত তিন দশকের মধ্যে ভারতে হোমিনিন জীবাশ্মের একমাত্র আবিষ্কার। তার পর আর কিছু পাওয়া যায়নি।
“তাহলে?”
“আমার থিয়োরি বলে কালের প্রভাবে দেড় থেকে দু-লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্টাস অবলুপ্ত হয়ে যায় এবং ভারতবর্ষে হোমো ইরেক্টাসের থেকে আরও একটা হোমিনিন স্পিসিস ইভলভ্ড হয়।”
আমি দুম করে বলে বসলাম, “হোমো ইন্ডোসেনেক্স।”
সিতাংশু মুর্মু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দারুন নাম দিয়েছ তো! হোমো ইন্ডোসেনেক্স। তার মানে ভারতের প্রাচীন মানুষ। নামটা আমি নিলাম।”
আমি বললাম, “নামটা রোহিনীদি রেখেছেন।”
সিতাংশু মুর্মু বলল “এই হোমো স্পিসিসটা কবে ইভলভড হয়েছিল বলা যাচ্ছে না। তবে সম্ভবত দেড় লক্ষ বছর বা তার থেকেও আগে। সেই সময় হোমো স্যাপিয়েন্সরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ভূমধ্য সাগরের পূর্ব পারের ল্যাভেন্ট করিডর দিয়ে তারা ইউরোপের দিকে এগোচ্ছে। নিয়েন্ডারথালদের সঙ্গে মোলাকাত হচ্ছে। তাদের আর একটা দল আরবের ভিতর দিয়ে ভারতের দিকে এগোচ্ছে। আজ থেকে পঁচাত্তর হাজার বছর আগে আরব ছেড়ে ভারতে ঢুকতে গিয়ে তারা একটা বিশাল বাধার সম্মুখীন হল।”
“সেটা কী?”
“সেটা হল ইন্দোনেশিয়ার টোবা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত। আজ থেকে পঁচাত্তর হাজার বছর এই আগ্নেয়গিরির ছাই অর্ধেক এশিয়াকে ঢেকে দিয়েছিল হাজার বছরের জন্য। বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে সেটা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পৌঁছাতে পারত না। ভারত জুড়ে প্রায় হিমযুগের মতো পরিস্থিতি নেমে এসেছিল। হঠাৎ করে এই শীতল আবহাওয়ায় বহু প্রাণী মারা পড়ে। এই কারণে হোমো স্যাপিয়েন্সরা ভারতে তখন ঢুকতে পারেনি। ইন্ডোসেনেক্সরা এই হিমযুগের সঙ্গে ক্রমশ খাপ খাইয়ে নিতে থাকে। এর পরে প্রায় ষাট হাজার বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সরা ভারতে আসতে থাকে। আবহাওয়া ক্রমশ গরম হতে থাকায় এবং হোমোস্যাপিয়েন্সদের চাপে এই ইন্ডোসেনেক্সরা হিমালয়ের দিকে চলে যায়।”
রোহিনীদি বলল, “আমি আরও একটা জিনিস দেখাতে পারি। কিন্তু ডক্টর মুর্মু, আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হবেন।”
“প্রস্তাবটা কী?”
“আমরা সেপ্টেম্বর মাসে একটা এক্সপিডিশন করব ভাবছি। আপনাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। আপনি পাহাড়ে উঠেছেন কখনও?”
“উঠেছি, তবে ওই গঙ্গোত্রী পর্যন্ত।”
“ব্যাস তাহলেই হবে। আমরা সেপ্টেম্বর মাসে ইন্ডোসেনেক্সের সন্ধানে যাচ্ছি। আপনাকেও আমরা সঙ্গে পেতে চাই। আমি পুরোটা স্পনসর করব। আপনাকে একটা পয়সাও খরচ করতে হবে না।”
“সেটা বড় কথা নয়। খরচ আমি শেয়ার করব। কিন্তু আমি অফিশিয়ালি এই কাজে থাকতে পারব বলে মনে হয় না। নানা পারমিশনের ব্যাপার আছে। তবে ছুটি নিয়ে যেতেই পারি। কিন্তু আপনি কী একটা দেখাবেন বলছিলেন না?”
রোহিনীদি ল্যাপটপ খুলে একটা ছবি বের করল। একটা মানুষের মুখ, পুরুষ, মুখে দাঁড়িগোঁফ আছে। কপালটা মানুষের তুলনায় একটু ছোট। নাকটা বেশ শার্প। থুতনিটা একটু পেছোনো।
“এই আপনার ইন্ডোসেনেক্সের ছবি? আঁকালেন কাকে দিয়ে?”
“সারা নেলসন।”
নামটা শুনে ডক্টর মুর্মু বলল, “সারা নেলসন? বাপরে! তাহলে তো আর কথাই নেই। আমি রাজি।”
ওঠার আগে আমরা সিতাংশু মুর্মুর কাছ থেকে কথা আদায় করে নিলাম যে সে আমাদের সঙ্গে থাকবে এবং ব্যাপারটা আপাতত গোপন রাখবে।
৫
আমাদের ইচ্ছে ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের অভিযান শুরু করা। জুলাই মাসের শেষের দিকে অভিযান শুরু করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত। কিন্তু অরিন্দমদার জন্য সেটা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে হল। এর মধ্যে আমরা আমাদের রুট ঠিক করে নিয়েছি। মৃগাঙ্ক বোস যে পথে গিয়েছিল সেই পথেই আমরা যাব এবং চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ারের উত্তর দিকে আরোয়া পিকের নীচে সেরাকের পাশে কোনও গুহা পাওয়া যায় কিনা সেই সন্ধান করব। বরফের নীচে কোনও গুহা আছে কিনা জানার জন্য আমরা একটা পোর্টেবল গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার বা জিপিআর সিস্টেম নিয়ে যাব।
জুলাই মাস নাগাদ হঠাৎ একটা খবর আমাদের স্তম্ভিত করে দিল। খবরটা পাঠিয়েছে অরিন্দমদা। একটা আর্কিওলজিকাল জার্নালে একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। প্রবন্ধ না বলে একটা রিসার্চ নোট বলা উচিত। কিন্তু বিষয়টা আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। আমাদের সব আয়োজন ব্যর্থ করে দেবার মতো খবর।
রিসার্চ নোটটা লিখেছে ডক্টর নীলকান্ত রাও। সেখানে সে দাবী করেছে ভারতে একটা অজানা মানব প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে। নর্মদা উপত্যকায় তাদের তৈরি পাথরের অস্ত্র এবং হিমালয়ের উচ্চ অববাহিকায় সেই মানুষের দাঁত ও চোয়াল পাওয়া গিয়েছে। এর সব কৃতিত্বের দাবীদার নীলকান্ত রাও। প্রবন্ধের সঙ্গে কয়েকটা ছবি আছে, সেগুলি সব ক-টা রোহিনীদির বাড়ির সেই দাঁতগুলি। এই প্রবন্ধের সঙ্গে একটা ম্যাপ রয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ারের পাশে কয়েকটা জায়গা যেখানে এই সব প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে আরও কয়েকটা পাথরের আর্টিফ্যাক্টের ছবি যোগ করেছে, সেগুলি সেই সেমিনারের পাবলিকেশন থেকে নেওয়া।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। নীলকান্ত রাও রোহিনীদির বাড়িতে কোনও এক সময় সকলের অজান্তে ছবিগুলি তুলেছে। তারপর মনগড়া একটা প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে। লোকটা এতটা অসৎ ভাবতেও পারিনি। পুরোটাই চুরি।
রোহিনীদিকে খবরটা ফোন করে জানালাম। কিন্তু রোহিনীদির কাছ থেকে যা জানতে পারলাম তাতে আরও মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। নীলকান্ত রাও ইতিমধ্যেই ভারত সরকারের কাছ থেকে একটা বড়সড়ো ফান্ড জোগাড় করে ফেলেছে। গঙ্গোত্রী এবং চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ারের আশপাশে বিশাল এক জায়গা জুড়ে একটা বৈজ্ঞানিক অভিযান করা হবে। যার নেতৃত্বে থাকবে নীলকান্ত রাও নিজে। তাকে সাহায্য করবে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ইসরো। দু-বছর ধরে এই অভিযান চলবে।
নীলকান্ত রাও রোহিনীদিকে একটা অফার দিয়েছে। রোহিনীদি যদি তার সংগ্রহের দাঁতগুলি নীলকান্ত রাওকে দিয়ে দেয় তবে সে রোহিনীদিকে এই এক্সপিডিশনে সামিল করবে।
শুনে আমার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ারের নাম আমার মুখ দিয়েই সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল।
আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। আমাদের কুড়িজন কুলি এবং তিনজন শেরপা হরশিল থেকে জোগাড় করতে হবে। সে ব্যাপারে যোগাযোগ করে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা হরশিলে পৌঁছাব। তবে একটাই সমস্যা নীলকান্ত রাওয়ের টিমের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। খবর পেয়েছি ওরা এখন চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ারের উপরে একটা অ্যাডভান্স ক্যাম্প করেছে। সেখান থেকে সবরকম আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সন্ধান চালাচ্ছে। আমাদের আগে যদি ওরা গুহাটা খুঁজে পায় তা হলে আমাদের সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে।
ওদের চোখ এড়িয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব হবে তাই নিয়ে আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম।
সেপ্টেম্বরের আট তারিখে সব কিছু ফাইনাল করতে রোহিনীদি কলকাতায় এল। আমরা বারো তারিখ রওনা হব দিল্লী হয়ে। কুড়ি দিনের যাত্রা। একটা কোম্পানি থেকে জিপিআর সিস্টেম ভাড়া করা হয়েছে। তার জন্য সেই কোম্পানির একজন লোককে সঙ্গে নিতে হবে।
রোহিনীদির কলকাতায় থাকার জায়গা না থাকায় আমাদের বাড়িতেই এসে উঠেছে। আমাদের গেস্টরুমটা ছেড়ে দিয়েছি। আমার বাবা-মার সঙ্গেও দেখলাম রোহিনীর খুব ভাব হয়ে গিয়েছে।
ন তারিখে অরিন্দমদা এসে হাজির হল। দশ তারিখ সন্ধ্যাবেলায় আমরা গিয়ে হাজির হলাম অরিন্দমদার ফ্ল্যাটে। কলকাতায় এলে ওঠার জন্য এই ফ্ল্যাটটা কিনে রেখেছে। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পরে অরিন্দমদা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করল সব কিছু। রোহিনীদিকে বলল, আপনি আপনার বাবার খাতাটা কি এনেছেন? আমি একটু পড়ব। তারপর ম্যাপ দেখে জায়গাটা বের করার চেষ্টা করব।
এই কথাবার্তার মধ্যে রোহিনীদির ফোন বেজে উঠল। ফোন নিয়ে রোহিনীদি বারান্দায় গিয়ে কথাবার্তা শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে শুনতে পেলাম রোহিনীদি খুব উত্তেজিত গলায় কথা বলছে। কথা সব শোনা না গেলেও বুঝতে পারছিলাম গণ্ডগোল একটা হয়েছে। প্রায় আধঘণ্টা কথাবার্তা চলার পর রোহিনীদি ফোন বন্ধ করে। ঘরে ঢুকল। মুখটা থমথমে হয়ে আছে।
অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকার পর রোহিনীদি বলল, “আমাদের এক্সপিডিশন হবে না।”
আমি বললাম “তার মানে?”
“তার মানে হল নীলকান্ত রাও কীভাবে যেন খবর পেয়েছে আমরা এক্সপিডিশন করছি। সম্ভবত হরশিলের কুলি বা শেরপাদের কাছ থেকে। আমরা যে যাচ্ছি সে খবরটা ও কয়েকদিন আগেই পেয়েছে। আমাকে আগেও বলেছে আলাদা এক্সপিডিশন না করার জন্য। কিন্তু আজ সরকার থেকে একটা অর্ডার বের করিয়েছে। এক বছরের জন্য গঙ্গোত্রী আর চতুরঙ্গীতে সব ধরনের ট্রেকিং বা মাউন্টেনিয়ারিং বন্ধ রাখা হল। এলাকাটাকে নোটিফাই করা হল।”
অরিন্দমদা কী কাজে পাশের ঘরে ছিল। সে বেরিয়ে এসে বলল, “আমাদের এক্সপিডিশন হবে না?
রোহিনীদি মুখ তুলে বলল, “কী করে হবে? এম্বার্গো হয়ে গেছে। এলাকাটা নোটিফাই করা হয়েছে।”
আমরা মন খারাপ করে মাথা নীচু করে বসে রইলাম। অরিন্দমদা বলল, “আমার আসাটাও ফালতু হয়ে গেল।”
সন্ধ্যাবেলায় বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরলাম। রোহিনীদি ঠিক করল পরদিনই দিল্লী ফিরে যাবে।
খুব ভোরে শুনি ফোন বাজছে। অরিন্দমদা ফোন করেছে। খুব উত্তেজিত। বলল, “রোহিনীদিকে বল আমাদের এক্সপিডিশন হবে, কিন্তু আমরা চতুরঙ্গী যাব না। আমি এইমাত্র একটা ম্যাপে গুহার জায়গাটা প্লট করে তার ল্যাটিচুড লঙ্গিচুড মেপেছি। জায়গাটা চতুরঙ্গী গ্লেশিয়ারের মধ্যে পড়ছে না। বরং সম্পূর্ণ অন্য একটা উপত্যকায় পড়ছে, যেখানে যেতে গেলে হরশিল বা বাসুকী তাল হয়ে যেতে হবে না। আমরা যাব বদ্রিনাথ হয়ে আরোয়া ভ্যালিতে। পথে যোশীমঠ পড়বে, সেখান থেকে কুলি আর শেরপা জোগাড় করা যাবে। ওখানেই বাকি সব সরঞ্জাম ভাড়া পাওয়া যাবে। আমাদের বরফের উপর কাজ করতে হবেনা বরং একটা গ্লেশিয়াল ভ্যালির দু-পাশের পাথরের দেয়াল জুড়ে অনুসন্ধান চালাতে হবে। আর আমার মনে হয় জিপিআর সিস্টেম নিয়ে যাওয়ার দরকারও নেই।”
আমি বললাম, “তুমি কী করে করলে? ক্লু পেলে কোথায়?”
“আমি ওঁর বাবার ডায়েরি খুব ভালো করে পড়েছি। গুহাটা কোথায় তার কিছু আভাস কিন্তু তাঁর লেখায় আছে। গুহাটার সঠিক স্থানাঙ্ক মৃগাঙ্ক বোসের পক্ষে মাপা সম্ভব ছিল না, কারণ সে সময়ে জিপিএস আসেনি। তাঁর কাছে ছিল একটি মাত্র ব্র্যান্টন কম্পাস যা দিয়ে তিনি গুহার মুখে দাঁড়িয়ে কাছাকাছি কয়েকটা পরিচিত পিকের বেয়ারিং নিয়েছিলেন, যা তাঁর খাতায় লেখা রয়েছে। আমি সেই বেয়ারিংগুলোর সাহায্যে ম্যাপে লোকেশনটা প্লট করেছি।” অরিন্দমদা বলে চলল।
আমি হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। রোহিনীদিকে বলাতে তার মুখেও হাসি ফুটে উঠল।
৬
আমরা উপত্যকা ধরে এগিয়ে চলেছি। আমাদের দলে দুজন শেরপা এবং দশ জন কুলি। আমাদের সবার পিঠে ব্যাকপ্যাক, আমার হাতে ক্যামেরা। মাঝে মাঝে ছবি নিচ্ছি। পুরো অভিযানের একটা ধারাবাহিক ডকুমেন্ট রাখতে হবে। আমার এখানে কাজ ছবি তোলা।
ঘাটসোলে আমরা দু-দিন বিশ্রাম নিয়েছি অ্যাক্লেমিটাইজেশনের জন্য। ঘাটসোলের উচ্চতা তেরো হাজার ফুট। আমাদের যে পর্যন্ত যেতে হবে তার উচ্চতা আঠেরো হাজার ফুটের কিছু বেশি। এতটা উচ্চতা আমরা খুব ধীরে ধীরে উঠব যাতে হাই অল্টিচুড সিকনেস না হয়।
ঘাটসোল থেকে আমরা পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়েছি আরোয়া নদীর উপত্যকা ধরে যাব বলে। উপত্যকায় কোনও হিমবাহ চোখে পড়ছে না। তবে প্রায় এক কিলোমিটার চওড়া ইংরাজি ইউ আকৃতির উপত্যকায় যে এককালে হিমবাহ ছিল তা স্পষ্ট। এটা অবশ্য অরিন্দমদাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। সেবার রুয়েঞ্জরি অভিযানে গিয়ে হ্যাঙ্গিং-ভ্যালি দেখেছিলাম। এখানে এই উপত্যকার দু-পাশে প্রায় হাজার ফুট উপরে হ্যাঙ্গিং-ভ্যালি দেখা যাচ্ছে, তার বুকে হিমবাহ ঝুলছে। সব ক-টার নীচে একটা করে ক্ষীণ জলের ধারা নেমে এসেছে। অনেক উপরে পাহাড়ের মাথায় বরফ জমে আছে।
এসব সত্বেও মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চতুরঙ্গীর দিকেও গুহার একটা মুখ আছে। কিম্বা ওখানে আরও গুহা থাকতে পারে। আমাদের আগে যদি নীলকান্ত রাও খোঁজ পেয়ে যায়, আমাদের আর কিছুই করার থাকবেনা। প্রথম ক্রেডিট ওরাই নিয়ে নেবে। ওদের হাতে নানা ধরনের যন্ত্র রয়েছে। দুজন জিওফিসিসিস্ট কাজ করছে।
অরিন্দমদার হাতে একটা জিপিএস রিসিভার। তাই দিয়ে আমরা বুঝে যাচ্ছি ঠিক কোথায় আমরা এসেছি। মৃগাঙ্ক বোস যে জায়গাটার কথা লিখে গিয়েছে তার কাছাকাছি এসে পড়লেও সেই পাহাড়ের দেয়াল চোখে পড়ছে না। এই পঞ্চাশ বছরে হিমবাহের কিছু পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু যেখানে সেই গুহামুখটা আছে সেখানে পাহাড় এতটাই খাড়া যে বরফে ঢেকে যাওয়ার কথা নয়।
অরিন্দমদা আমাদের বুঝিয়ে বলল, “ওরা কাজ করছে গ্লেশিয়ারের উপরে, আর আমরা কাজ করছি ভ্যালিতে যার দু-পাশে পাথরের দেয়াল। এখানেই গুহা থাকার সম্ভাবনা বেশি। পৃথিবীর সর্বত্র এই সব হাঙ্গিং ক্লিফের গায়েই গুহাগুলি দেখা গেছে। কাজেই নিরাশ হওয়ার কিছু নেই।”
আমাদের তিন নম্বর ক্যাম্পটা ছিল এমন একটা জায়গায় যেখানে দুটো উপত্যকা এসে মিশেছে। দুটোই আরোয়া হিমবাহের শাখা। আমরা এর মধ্যে দক্ষিণ দিকের উপত্যকা ধরে এগোব। চারদিকের দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়। উচ্চতা পনেরো হাজার ফুট। একটা ছোট্ট জলের স্রোত বইছে। উপত্যকায় অজস্র ফুলের ঝোপ, নানা রঙের ফুল ফুটে রয়েছে। সিতাংশু মুর্মুর চোখ সাংঘাতিক। পাহাড়ে ঢালে ইতিমধ্যেই কয়েকটা পাথরের টুকরো সংগ্রহ করে ফেলেছে, যেগুলি দেখলেই বোঝা যায় পাথরের অস্ত্র। অরিন্দমদা দেখে বলল, “এগুলি মেটাসেডিমেন্টারি কোয়ার্টজাইট, ফ্লিন্ট নয়।”
সিতাংশু মুর্মু বলল, “এগুলি স্পষ্ট নিওলিথিক। খুব সুন্দর করে পালিশ করে ছেনির মতন বানিয়েছে। আরেকটা হল কুঠার। কাঠের হাতলের সঙ্গে বেঁধে ব্যবহার করা হত। তবে এগুলি স্থানীয় নাও হতে পারে। অন্য জায়গা থেকে জলের স্রোতে ভেসে এসে থাকতে পারে।”
সেদিন বিকেলে বৃষ্টি নামল। পাহাড়ের চূড়োগুলি মেঘে ঢেকে রইল। পরদিন সকালে দেখলাম আকাশ পরিষ্কার। দু-ধারের পাহাড়ের উপর বরফ আরও নীচ পর্যন্ত নেমে এসেছে। আজকে আমাদের প্রায় ছয় কিলোমিটার যেতে হবে আরোয়া গ্লেশিয়ারের মুখ পর্যন্ত। ওটাই আমাদের শেষ ক্যাম্প, যেখান থেকে আমরা গুহার খোঁজ করব এবং নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করব।
তিন নম্বর ক্যাম্পকে আপাতত বেস ক্যাম্প হিসাবে রাখা হল। এর পর আমরা একেবারে আরোয়া গ্লেশিয়ারের উপর আমাদের ক্যাম্প করব।
পথে যেতে যেতে একটা জায়গায় কয়েকটা গুহার মতন কিছু দেখা গেল। কিন্তু এগুলি পাথরের গায়ে বড়সড়ো ফাটল মাত্র। সিতাংশু মুর্মু বলল, “এগুলি রক শেল্টার, ঠিক গুহা বলা যাবে না। একটু দেখা যাক কিছু আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যায় কিনা।” শেল্টারগুলির মুখে প্রচুর নুড়ি পাথর স্তূপ হয়ে রয়েছে। অরিন্দমদার ভাষায় ল্যাটারাল মোরেন বা হিমবাহের পার্শ্ব অবক্ষেপ। আমরা কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু পেলাম না।
এই ছয় কিলোমিটার ট্রেক আমার খুব ভালো লাগলেও কষ্ট হয়েছে যথেষ্ট। কারণ এই ট্রেকে কুলি কমিয়ে দিয়ে আমরা নিজেরা অনেক বেশি মাল বহন করেছি। তার উপরে মোরেন বা হিমবাহের অবক্ষেপের উপর দিয়ে হাঁটা। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মতো অবক্ষেপের স্তূপ ছড়িয়ে আছে।
আমরা ঠিক করেছিলাম হিমবাহের উপরে একটা সমান জায়গায় ক্যাম্প করব, যেখান থেকে চারদিক ভালো দেখা যায়। প্রয়োজন হলে যাতে কয়েকদিন থাকতে হয় তার সবরকম ব্যবস্থা রাখা আছে। এই কারণেই মাত্র দুজন কুলি আর দুজন শেরপা আমাদের সঙ্গে রয়েছে।
আমাদের এই চার নম্বর ক্যাম্প বসল আঠেরো হাজার তিনশো ফুট উচ্চতায়। পশ্চিম দিক থেকে আরোয়া গ্লেশিয়ার নেমে এসেছে। তার উপরে আরোয়া গ্রুপের পিকগুলি। এই জায়গা থেকে অবশ্য পিকগুলি দেখা যায়না। এক ফাঁক দিয়ে শতোপন্থের চূড়াটা শুধু দেখা যায়।
ব্লিজার্ডের জন্য আমাদের একটা দিন নষ্ট হল। প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া তার সঙ্গে তুষারপাত। সেপ্টেম্বরে এরকম আবহাওয়া হওয়ার কথা নয়।
পরদিন সকাল থেকে আমরা কয়েকটা ছোট ট্রেক করলাম। হিমবাহের দুই পাশে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছোট ছোট শাখা উপত্যকায় যতটা সম্ভব উঠে খোঁজ করলাম কোনও গুহা চোখে পড়ে কিনা। অরিন্দমদা বলল, “এখানে রক টাইপ গ্রানাইট এবং বেশ আবহবিকারগ্রস্ত। বেশ কিছু ফাটল বা জয়েন্ট আছে। গ্রানাইটের উপর এই আবহবিকারগ্রস্ত স্তর, যাকে রেগোলিথ বলে, তা অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।”
“আমি কখনও এরকম ল্যান্ডস্কেপে কাজ করিনি। এখানে গুহা আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না।” সিতাংশু মুর্মু বলল।
দেখুন, “অরিন্দমদা বলল, এখানে বড় গুহা থাকার কথা জানি না। কিন্তু গ্রানাইটের ফাটলে রক শেল্টার থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট।”
এখানে সবটাই গ্রানাইট, বলা চলে গ্রানাইট নিস। তার ভিতরে মাঝে মাঝে চওড়া সাদা কোয়ার্টজাইটের শিরা উঠে গিয়েছে। তার ভিতর থেকে মাইকা উঁকি দিচ্ছে। এসব আমার অরিন্দমদার কাছ থেকে শেখা। গ্রানাইটের মধ্যে মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা ফাটল, তবে তেমন চওড়া নয় যে তার ভিতরে মানুষ ঢুকে বসে থাকতে পারে।
তৃতীয় দিন একটা ছোট ট্রেকে বেরিয়ে দেখতে পেলাম একটা ছোট উপত্যকা এর সঙ্গে এসে মিশেছে। তার উপরের দিকে বরফ জমে আছে। এগুলি খুব গভীর গিরিখাত যাকে বলে গর্জ। খাড়াই খুব বেশি। এর সঙ্গে সংলগ্ন দু-পাশে আরও অনেক সরু সরু গিরিখাত। যেখানে যেখানে এই ছোট গিরিখাতগুলি গভীর গিরিখাতটার সঙ্গে মিশেছে সেখানে নুড়ি পাথরের স্তূপ নৈবেদ্যর মতো উঁচু হয়ে আছে। এক একটা খাতের মুখে প্রায় পঁচিশ ত্রিশ ফুট উঁচু এরকম পলির স্তূপ। উপর থেকে পাথর ধ্বসে এখানে জমা হয়েছে। অরিন্দমদার ভাষায় এর নাম আউটওয়াশ ফ্যান ডিপোজিট।
এত খুঁজেও এখন পর্যন্ত কোনও গুহা চোখে পড়ল না। কোন গিরিখাতের ভিতর সেই গুহা লুকিয়ে আছে কে জানে। হয়তো এই রকম পাথরের স্তূপের আড়ালে এটা চাপা পড়ে গিয়েছে।
আমরা ঠিক করেছিলাম এখানে চার দিন থাকব। অবশ্য যদি কোনও কারণে বেশি থাকতে হয় সেই ভেবে আমরা ছয় দিনের রসদ নিয়ে এসেছি। তৃতীয় দিন সন্ধ্যাবেলায় ক্যাম্পে ঢোকার আগে অরিন্দমদা বলে দিল, আগামী কাল যদি কিছু না পাওয়া যায় তা হলে আমরা আর একটা মাত্র দিন এক্সটেন্ড করব। ছয় নম্বর দিন সকালবেলায় আমরা ফিরে যাব। আমরা সবাই সায় দিলাম। এভাবে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। আরও বড় গ্রুপ আর বেশি লোক নিয়ে আসা দরকার।
রোহিনীদি বলল, “নীলকান্তরা একটা সিস্টেমেটিক এক্সপ্লোরেশন শুরু করেছে। পোলার রিজিয়নে যেভাবে কাজ করা হয় অনেকটা সেভাবে কাজ শুরু করেছে। আমরা শুধু আবেগের বশে চলে এসেছি।”
আমি বললাম, “আর একটু চেষ্টা করে দেখি।”
চতুর্থ দিনটা একটু মেঘলা আকাশ। আজ ইকুইনক্স, দিন-রাত্রি সমান। এমন একটা কালসন্ধিক্ষণে হিমালয়ের এই উচ্চতায় বরফের এই রাজ্যে লাল গ্রানাইট ঘেরা উপত্যকায় আসতে পারব কোনওদিন ভাবিনি। এখানে রাতের বেলায় বরফের স্তর অনেক নীচে নেমে আসে। দিনের বেলায় আবার উপরে উঠে যায়। আজ আমরা আর একটা গিরিখাতের ভিতরে হেঁটে যাব। সেটাও আগেরটার মতোই তবে ঢাল কিছুটা কম। বিশেষ চড়াই ভাঙতে হবে না।
বেলা বারোটা নাগাদ আমরা যে গিরিখাত দিয়ে এগোচ্ছিলাম সেখানে হঠাৎ সামনে একটা খাড়া দেয়াল দেখতে পেলাম। তার সামনে উপর থেকে ধ্বসে পড়া নুড়ি পাথরের স্তূপ। এই সব পাথরের আকার খুব বড় নয় কোনওটাই এক-দেড় ফুটের থেকে বড় নয়। ছোট সাইজ, এমনকি ছোট নুড়ির সাইজের টুকরোও আছে। কিন্তু তার ভিতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় পাথরের পিলার। রংটাও কালো। ব্রাউন রঙের পাথরের স্তূপের মধ্য থেকে প্রায় তিন ফুট উঁচু হয়ে বেরিয়ে আছে। অরিন্দমদাই প্রথম বলল, “এ তো দেখছি ব্ল্যাক লাইমস্টোন, কালো কষ্ঠিপাথর। এখানে তো এ পাথর থাকার কথা নয়। এই পাথর পাওয়া যায় নেপালে, তা প্রায় তিন-চারশো কিলোমিটার দূর।
আমরা সবাই এক সুরে বলে উঠলাম, “তার মানে?”
এই উপত্যকাটার মাঝে মাঝে চাপ চাপ বরফ জমে থাকলেও হেঁটে যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই দেয়ালটার সামনে এসে এই পাথরের স্তূপ দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। অরিন্দমদা বলল, “ডেব্রিস সরিয়ে দেখতে হবে। এখানে কিছু একটা আছে। এই ব্ল্যাক লাইমস্টোন এমনি এমনি এখানে আসেনি।”
আমরা সবাই মিলে প্রাণপণে পাথরটার পাশ থেকে নুড়ি সরিয়ে সেটাকে বের করে আনার চেষ্টা করতে থাকলাম। কিছুটা সরাতে যেতেই হঠাৎ ঝুরঝুর করে সব পাথর নীচের দিকে চলে যেতে শুরু করল। মনে হল নীচে মাটি ফাঁক হয়ে গেছে, তার ভিতরে ওগুলো ঢুকে যাচ্ছে। কিছুটা পাথর নেমে যাওয়ার পর দেখতে পেলাম পাথরের দেয়ালের মধ্যে একটা ফোঁকর মতন। একজন মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে সেই ফাঁকের ভিতর ঢুকে যেতে পারে। সেই গর্তের পাশে এই পাথরের পিলার খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সিতাংশু মুর্মু বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে বলল, “এগুলি মেনহির। কবর অথবা ধর্মীয় স্থানে প্রাচীন মানুষেরা এরকম মেনহির ব্যবহার করে স্থান চিহ্নিত করে। বাড়ির সামনেও রাখার চল ছিল। একে মেগালিথিক কালচার বলে। হোমো স্যাপিয়েন্সরা এই মেনহির শুরু করে নব্য প্রস্তর যুগে, মানে প্রায় দশ হাজার বছর আগে।”
আমি বললাম, “তার মানে এগুলি ইন্ডোসেনেক্সের নাও হতে পারে। আমাদের মতো মানুষের কীর্তিও হতে পারে?”
ডক্টর মুর্মুও মেনহির দেখে একটু হতাশ। বলল, “হতেই পারে। আবার নাও হতে পারে। হতে পারে ইন্ডোসেনেক্সের সন্ধানে আমরা ভুল জায়গায় এসেছি। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। একটা কিছু তো পেলাম, সেটাই বা কম কি? আমাদের আগে আর কেউ হিমালয়ে এত বড় আর্টিফ্যাক্ট পায়নি।”
আমি একটুও খুশি হতে পারলাম না। বললাম, “কিন্তু হাড়গুলি তো আমরা সবাই দেখেছি। সেগুলি তো মিথ্যা নয়। ইন্ডোসেনেক্স হিমালয়ে কোথাও না কোথাও অবশ্যই আছে।”
রোহিনীদি বলল, “গুহার মুখ একটা দেখা যাচ্ছে যখন, ভিতরে গিয়ে দেখতে দোষ কোথায়। আমি ভিতরে নামব। এত দূর এসে আমি হাল ছেড়ে দিতে রাজি নই।”
অরিন্দমদা বলল, “পাথর পড়ে গুহার মুখটা অনেকটা ঢেকে আছে। পাথর সরিয়ে দেখতে হবে। তবে আজকে আর সম্ভব নয়, কাল সকালে এসে যা করার করব।”
সেদিন রাত্রে উত্তেজনায় অনেক দেরিতে ঘুম এল। স্বপ্ন দেখলাম আমি একটা গুহার ভিতর পড়ে গিয়েছি। উপর থেকে বরফ এসে আমার মুখে চোখে পড়ছে আর গুহার মুখটা ঢেকে দিচ্ছে। চারদিক অন্ধকার। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি হাত বাড়িয়ে অক্সিজেনের সিলিন্ডার খুঁজছি। সে অবস্থায় হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। তাঁবুর চেন খুলে মুখ বের করে দেখি আকাশ অন্ধকার। বরফ পড়ছে।
৭
প্রায় সারাদিন ধরে ঝির ঝির করে বরফ পড়ল। আমাদের চারপাশ চার-পাঁচ ইঞ্চি নরম বরফে ঢেকে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। নানাভাবে বাধা আসছে। শেষ পর্যন্ত খালি হাতে ফিরে যেতে হবে নাকি কে জানে। বরফের জন্য আরও একটা দিন নষ্ট হল। আমরা আজ কখন কাজে বের হতে পারব জানি না। এখানে যা খাবারদাবার আছে খুব বেশি হলে আর একটা দিন থাকতে পারব। তারপর আমাদেরকে তিন নম্বর ক্যাম্পে নেমে যেতে হবে।
বিকেলের দিকে বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেল। মেঘটাও অনেক উপরে উঠে গেল। কালকের দেখা গুহাটা আমাদের ক্যাম্প থেকে বেশি দূরে নয়। আধ ঘণ্টার রাস্তা। আমরা চারজন, সঙ্গে দুজন শেরপা আর দুজন কুলিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে নরম বরফ জমে আছে। হাঁটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। গুহাটার কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম মুখে স্তূপাকার বরফ জমে আছে। তার মানে বরফ আর পাথর দুইই সরাতে হবে। আমাদের কাজ অনেক বেড়ে গেল। বরফ সরানোর জন্য আমাদের কাছে কিছুই নেই। বেলচা দরকার। কুলিরা উপরে উঠে দু-হাত দিয়ে বরফ সরাতে লাগল। আমরাও আইস এক্স দিয়ে পাথর সরাতে থাকলাম। একটু পরে গুহার মুখ একটু দেখা গেল। এখানে এখন খুব শব্দ করা যাবে না। পাহাড়ে নানা জায়গায় চাপ চাপ বরফ জমে আছে। শব্দ হলে সব আঁভালাসের মতো গড়িয়ে নীচে নেমে আসতে পারে।
সন্ধ্যা হওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা যতটা সম্ভব বরফ আর পাথর সরিয়ে গুহার মুখটা পরিষ্কার করলাম। ভিতরে গভীর অন্ধকার। আমাদের সঙ্গে আলো আছে। কিন্তু আজ রাত্রে এর ভিতরে নামা ঠিক হবে না। কাল নামব। ক্যাম্পে ফিরতেই একজন কুলি বলল, আমাদের খাবারদাবার শেষ হয়ে গেছে। সকালের ব্রেকফাস্ট আর প্যাক লাঞ্চ হবে। কিছু চকলেট পড়ে আছে।
এর একটাই অর্থ কালকে আমাদের ক্যাম্প গুটিয়ে ফিরে যেতে হবে তিন নম্বর ক্যাম্প পর্যন্ত। আমাদের অভিযানের এখানেই সমাপ্তি।
অরিন্দমদা প্রচুর পাহাড়ে চড়েছে। এই অভিযানে সেই দলপতি। আমরা তার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। অরিন্দমদা বলল, “এখানে আমাদের পাঁচ দিন হয়ে গেছে, কাল ফিরে যেতেই হবে। কালকে আমরা ক্যাম্প গুটিয়ে দুজন কুলি আর শেরপার সঙ্গে তাঁবু আর বেশির ভাগ সরঞ্জাম পাঠিয়ে দেব। আমরা সকালে উঠে গুহায় নামব এবং বারোটা পর্যন্ত কাজ করব। ঠিক বারোটায় আমরা দু-নম্বর ক্যাম্পের দিকে রওনা হব।”
আমি ভাবলাম, কাল যেন আকাশ পরিষ্কার থাকে। আমাদের হাতে আর সময় নেই। সবার ছুটি ফুরিয়ে আসছে।
পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। যতটা সম্ভব হালকা মাল, মই, ক্যামেরা, ব্যাটারি ও আলোর ব্যবস্থা নিয়ে আমরা সেই উপত্যকার দিকে রওনা হলাম। গুহার মুখটা আজকে অনেকটা পরিষ্কার। চার ফুটের মতো উঁচু আর চওড়া। আমরা উপর থেকে মই নামিয়ে দিলাম। দেওয়ার পরে সবার আগে সিতাংশু মুর্মু নামল, তারপর রোহিনীদি, তারপর আমরা দুজন। মোটামুটি আট ফুট উঁচু গুহা, ভিতরটা অন্ধকার। কতটা গভীর বোঝা যাচ্ছে না। একে একে আমরা চারজন নামার পরে আলো জ্বালিয়ে গুহাটাকে ভালো করে দেখা হল। এই গুহাটা লম্বায় কুড়ি ফুট হবে। মুখটা ছোট হলেও ভিতরে বেশ চওড়া, বারো ফুটের কম তো নয়ই। গুহার শেষের দিকে আলো ফেলে দেখলাম কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে গিয়েছে আরও উঁচু আর আরও বড় একটা হল ঘরের মতো জায়গায়।
আমাদের ধারণা ছিল এই গুহায় কিছু পাথরের অস্ত্র এবং সেই সঙ্গে কিছু হাড় পাবো। কিন্তু এই বড় গুহায় ঢুকে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। দুই পাশের দেয়াল জুড়ে অসংখ্য আঁকিবুকি, দাগ কাটা। নানা ধরনের ছবি, মানুষ, জন্তু এসব তো আছেই তার সঙ্গে এমন কিছু আছে যা দেখে মনে হয় কোনও ঘটনার বর্ণনা আঁকা বা লেখা। আমি সিতাংশু মুর্মুর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আনন্দ ও বিস্ময়ে মাখামাখি সেই মুখ।
আমি একটানা ছবি তুলে গেলাম; অনেকগুলি ভিডিয়ো তুললাম। সেই সঙ্গে এক-এক করে অরিন্দমদা, রোহিনীদি ও সিতাংশু মুর্মুর বক্তব্য রেকর্ড করলাম। অরিন্দমদা বলল, “এই গুহাগুলি আংশিক প্রাকৃতিক। কারণ গ্রানাইটের ফাটলের কারণে এই গুহাগুলির উৎপত্তি। যার ফলে এখানে প্রথমে একটা রক শেলটার তৈরি হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই। এখানে যারা বাস করত তারা আবহবিকারগ্রস্ত গ্রানাইট এবং মাইকা শিস্টের স্তর কেটে এই গুহা তৈরি করেছে।”
রোহিনীদি বলল, “আমার মনে হয় এটা ছিল এদের শেষ আশ্রয়। এদের থেকে শক্তিশালী এবং আগ্রাসী কোনও মানব গোষ্ঠি এদেরকে এই প্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল।”
সিতাংশু বেশ কিছু পাথরের আর হাড়ের অস্ত্র খুঁজে পেয়েছে। সেগুলি এক জায়গায় জড়ো করে বলল, “মনে হচ্ছে পাথরের অস্ত্র দিয়েই এই গুহা খনন করা হয়েছে। কয়শো বছর লেগেছে কে জানে।”
আরও কিছু অদ্ভুত জিনিস পেলাম। কয়েকটা পাথরের পাত্র। কালো লাইমস্টোনের। পাথর ঘষে ঘষে গর্ত করে বাটির আকার দেওয়া হয়েছে। গুহার মধ্যে নানা জায়গায় কিছু কাঠকয়লা পড়ে আছে। পাশে জন্তুর হাড় পড়ে আছে। ঠিক মনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে এখানে বসে কেউ আগুন জ্বালিয়েছিল। আমরা আসার একটু আগে তারা এখান থেকে চলে গিয়েছে।
অনেকক্ষণ পরে অরিন্দমদাই প্রথম কথা বলল, “এবার আমাদের ফিরে যেতে হবে।”
এটা সত্যি কথা যে এটা রোহিনীদির বাবার দেখা সেই গুহা নয়। তার মানে আরও এরকম গুহা এখানে আছে। আর এই গুহা আমরাই প্রথম আবিষ্কার করলাম। আমাদের মাথায় আসছিল না এতবড় একটা আবিষ্কার আমরা কীভাবে সেলিব্রেট করব। ঠিক হল এখানে যা কিছু যেমন আছে ঠিক তেমন থাকবে। শুধুমাত্র কিছু পাথরের অস্ত্র, বাসন, কাঠকয়লা আর দু-টুকরো হাড় খুব সাবধানে সব রকম ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ডিএনএ টেস্টের জন্য আর রেডিয়োকার্বন ডেটিং এর জন্য। মানুষের হাড় না পাওয়ায় প্রমাণ হল না এগুলি কারা বানিয়েছিল। তারা আমাদের মতো মানুষ না ইন্ডোসেনেক্স এই প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হল না।
বাইরে বেরিয়ে সবকিছু গুটিয়ে নেবার পর আমরা রওনা হলাম বেস ক্যাম্পের দিকে। আমার হঠাৎ মনে হল গুহাটার চারপাশের ভালো ছবি তোলা হয়নি। ভাবলাম আশেপাশে একটু ঘুরে কয়েকটা ছবি নিয়ে নিই। আমি সবাইকে বললাম এগিয়ে যেতে, আমি ধরে নেব। আমি এই ছোট উপত্যকা ধরে আরও একটু উজানে হেঁটে গেলাম। সামনের একটা বাঁক ঘুরে একটু এগিয়ে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম। সেই ম্যাসিভ গ্রানাইটের পাহাড়ের মাঝখানে একটা বিশাল ফাটল। প্রায় আট ফুট চওড়া আর দুশো ফুট লম্বা। উপরের দিকটা ফাঁকা, আকাশ দেখা যাচ্ছে। গ্রানাইটের দেয়াল উঠে গিয়েছে প্রায় হাজার ফুট। দেয়াল বেয়ে বরফ গলা জলের ধারা নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে দু-পাশের দুর্গের প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে একটা সড়ক চলে গিয়েছে। আর তার মধ্যে কিছুদূর অন্তর সারি সারি কালো কষ্ঠিপাথরের মেনহির বা পিলার বসানো রয়েছে। মেনহিরগুলির অনেকটাই নুড়ি পাথর পড়ে ঢেকে গিয়েছে। শুধু উপরের অংশটা দেখা যাচ্ছে। চারপাশে চাপ চাপ বরফ ছড়িয়ে আছে।
আমার শিরদাঁড়ার উপর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আজ একদম শেষ মুহূর্তে যখন আর একেবারে সময় নেই তখন আমার সামনে এই দৃশ্য দেখা দিল। তার মানে এই একটা গুহা নয়, আরও অনেক গুহা আছে এখানে। ওগুলো কী, কেন ওখানে আছে ভাবতে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে হল ছুটে গিয়ে বরফ আর পাথর সরিয়ে দেখি ওখানে কী আছে। কিন্তু আর সময় নেই অন্ধকার হওয়ার আগে তিন নম্বর ক্যাম্পে পৌঁছাতেই হবে। বাকিরা সবাই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এতক্ষণে হয়তো মূল উপত্যকায় পৌঁছে গিয়েছে। বুকের ভিতরটা হায় হায় করতে লাগল।
এই হিমালয়ের বরফের আচ্ছাদনের আড়ালে আরও কত যে বিষ্ময় লুকিয়ে আছে কে জানে। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে উঠল। কিন্তু এখন আর প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। উত্তর পেতে আবার এবং বারবার ফিরে আসতে হবে এই পাহাড়ে। এই বরফের দেশে এই নির্জন উপত্যকায়। আজ ফিরে যেতেই হচ্ছে। বাকিরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।
আমি পা চালালাম ওদের ধরে ফেলার জন্য।
Tags: উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা