শ্যাডোজ ইন দ্য মুনলাইট
লেখক: রবার্ট ই. হাওয়ার্ড, অনুবাদ - রনিন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১
নলখাগড়ার বনে ধাবমান ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। তারপরেই ভারী পতনের ধ্বনি। তার রেশ মিলিয়ে যাবার আগেই একটা হতাশ ও মরিয়া চিৎকার। মৃত্যুপথযাত্রী চতুষ্পদ প্রাণীটা ছটফট করছিল। তার ভারী শরীর থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়াল অশ্বারোহী। তন্বী যুবতী। পাদুকামোড়া চরণ দু-খানি, পরনে পশমি অঙ্গরক্ষা। কৃষ্ণভ্রমর চুলের রাশি তার শ্বেতবর্ণ কাঁধের ওপর এলিয়ে পড়েছে। মেয়েটির চোখের মণিতে অবশ্য খাঁচায় বন্দি অসহায় প্রাণীর ছটফটানি লক্ষ করার মতন।
পিছনে ফেলে আসা শরবনের দিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই একটুও। এমনকি দৃশ্যপট দখল করে থাকা নীল জলাশয়ের সৌন্দর্যেও তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। তার দৃষ্টিতে তখন আতঙ্ক আর উদ্বেগ। এক মনে সে ধেয়ে আসা অশ্বারোহীকে দেখছিল বিভ্রান্ত চক্ষু মেলে। লোকটা জলাজঙ্গলকে উচ্চকিত করে তার ঠিক সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।
পুরুষটি দীর্ঘদেহী। কৃশকায়। কিন্তু শরীরে ইস্পাতের কাঠিন্য। আপাদমস্তক নির্ভার রুপোলী ধাতব জালিকায় মোড়া তার দেহসৌষ্ঠব। নিখুঁত বর্তুলাকার সোনালি শিরস্ত্রাণের মধ্যে থেকে একজোড়া উজ্জ্বল বাদামি চোখ উঁকি মারছিল, তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে মারছিল যুবতীর দিকে।
“তফাৎ যাও!” মেয়েটির কণ্ঠস্বর আতঙ্কে তীক্ষ্নতর শোনাল।
“আমায় স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখাবেন না, শাহ আমুরাথ! এক পা এগোলেই, এই নীলদিঘিতে ঝাঁপিয়ে মৃত্যুবরণ করব আমি!”
লোকটা হাসল। মনে হল যেন মসলিনের কোশ থেকে কেউ তরবারি টেনে বার করল।
“উঁহু, সুন্দরী। এ দিঘির জলে কি আর তোমার চোখের গভীরতা আছে? এখানে ডুবতে পারো, কিন্তু মরবে না। ঈশ্বরের দিব্যি, বৃথাই আমায় এতটা দৌড় করালে তুমি! সব ক-টা প্রহরীকে পিছনে ফেলে আরেকটু হলেই আমার হাত গলে পালিয়ে যাচ্ছিলে। তবে কি জানো সুন্দরী, আমার আইটেম-কে দৌড়ে হারাবে এমন ঘোড়া পশ্চিম ভিলায়েতে এখনও জন্মায়নি।”
লোকটা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বলিষ্ঠ চার-পায়ের অধিকারী মরু-অশ্বের দিকে চেয়ে মাথা দোলাল।
“আমায় যেতে দাও—”
মেয়েটা কাঁদছে। চোখের জল বাঁধ মানছে না আর।
“আমার দুর্ভোগ কি এ জন্মে আর শেষ হবার নয়? অপমান, লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা— কিছুই কি আর বাকি আছে? কতদিন, আর কতদিন এই দুঃসহ অত্যাচারের ভার বইতে হবে আমায়, বলতে পারো?”
“যতদিন না তোমার অশ্রুতে, তোমার অনুযোগে, তোমার আকুতিতে আমার মন পরিতৃপ্ত হচ্ছে, ততদিন—” লোকটা এমন মিহি হাসি মুখে মাখিয়ে উত্তর দিল যা দেখলে অচেনা মানুষ তাকে দেবদূত ঠাওরাতে পারে।
“তোমার মধ্যে এক আশ্চর্য দৃঢ়তা রয়েছে অলিভিয়া। ওই অবাধ্যতা আমার ভারী ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমার নেশায় আমি আজন্মকাল ডুবে থাকব এমনি করেই। অন্য সব মেয়েদের ব্যাপারে আমার নেশা ক্ষণিকের, তুমি কিন্তু সেদিক দিয়ে একেবারে ব্যতিক্রমী। তুমি আমার চিরকালের অপাপবিদ্ধা, নিষ্কলুষ সৌন্দর্য। প্রতিদিন আমি তোমায় নতুন করে আবিষ্কার করি আর আশ্চর্য আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠি।”
লোকটা সামান্য থামল।
“অনেক হল, এবার আকিফে ফিরে চল সুন্দরী। দুর্ভাগা কোজাকিরা বশ্যতা স্বীকার করেছে। তারা তাদের নতুন নেতাকে বরণ করে নেবে বলে মুখিয়ে আছে। কিন্তু সেই নেতা বেচারা এখন এক সুন্দরী অপরাধীর শিশুসুলভ পলায়নের চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই হতকুচ্ছিত বনভূমিতে।”
“না—” মেয়েটা কুঁকড়ে গেল, জলের দিকে মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়াল অবাধ্য শিশুর মতন।
“হ্যাঁ—” চকিতে মেয়েটার কোমল কব্জিটাকে মুচড়ে ধরল লোকটা। চকমকি পাথর থেকে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ল— এমনি তার ক্ষিপ্রতা। পাশবিক জোর তার হাতের মুঠোয়। যন্ত্রণায় ডুকরে উঠল যুবতী। হাঁটু মুড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।
“পাতকি! তোকে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে মাটিতে টেনেহিঁচড়ে প্রাসাদে নিয়ে যেতে পারি, জানিস? কিন্তু তার বদলে তোকে দয়াভিক্ষা দেবো বলে ভেবেছি। এই ঘোড়ার জিনে বসিয়ে আকিফের মাটিতে ফিরে যাবো আজ। ধন্যবাদটা বকেয়া রাখিস, পরে যখন তোকে—”
মেয়েটাকে মুক্তি দিয়ে লোকটা হঠাৎ গালি পাড়ল। ছিটকে পিছিয়ে গেল। তার হাতের মুঠোয় উলঙ্গ তরবারিখানা শোভা পাচ্ছে। আসলে একটা ভয়ানক গর্জন ভেসে এসেছিল তার কানে। ক্রোধ আর প্রতিহিংসার ঝাঁজ গুমরে উঠছিল সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর থেকে।
অলিভিয়া চোখ তুলে চাইল। লোকটাকে সে দেখতে পেল। বর্বর কিম্বা বদ্ধ উন্মাদ? অন্তত তেমনটাই অলিভিয়ার মনে হল। লোকটা শাহ আমুরাথের দিকে এগিয়ে আসছিল মারাত্মক বিপদের বার্তা নিয়ে। শক্তির দম্ভ লোকটার শরীর জুড়ে। কোমরে দড়ি বাঁধা বস্ত্রখণ্ডটা নগ্ন দেহের লজ্জা নিবারণ করে রেখেছে কোনওরকমে। কাপড়ের টুকরোতে শুকনো পাঁক আর রক্তের দাগ। কালো অবিন্যস্ত চুলের রাশিতে বাসি রক্ত আর কাদামাটির মলিন প্রলেপ। রক্তের ধারা বইছে মানুষটার বুক থেকেও। তার হাতে ধরা সুদীর্ঘ তরবারির ফলাটাও শোণিতে মাখামাখি। চুলের জটার ফাঁক থেকে লোহিতবর্ন চোখ দুটো জ্বলছিল ধিকিধিকি। যেন নীল আগুন থেকে উঁকি মারছে জ্বলন্ত অঙ্গার।
“হ্যারকানিয়ার কুত্তা!” জংলী ভাষায় আক্রমণকারী চিৎকার করে উঠল। “আমার প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা নিয়তি হয়ে তোকে এইখানে টেনে এনেছে—”
“কোজাক!” শাহ আমুরাথ পিছু হটলেন সামান্য, তারপর ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “কি আপদ! একখানা কুকুরছানা ঠিক পালিয়ে এসেছে! আর আমি ওদিকে ভাবছিলাম, সব ক-টা বেজন্মার বেটা ইলবার্স নদীর পাড়ে নিথর শরীর নিয়ে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়েছে চিরকালের জন্য!”
“ওরা মৃত। সে কথা সত্যি বটে। আমিই একমাত্র জীবিত। সব তোর কৃতকর্ম শয়তান! কাঁটাঝোপে হামাগুড়ি দিয়েছি ক্লান্ত শরীরে। পাথরের ছায়ায় আবিষ্টের মতন পড়ে ছিলাম, বুভুক্ষু পিঁপড়ের দল মনের আনন্দে আমার মাংস খুবলে খেয়েছে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছি। কাদাজলে মুখ ডুবিয়ে মৃতের অভিনয় করেছি। অপেক্ষা করেছি। শুধু এই মুহূর্তের জন্য। স্বপ্ন দেখেছি তোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি উলঙ্গ তরবারি হাতে। স্বপ্ন দেখেছি প্রতিশোধ নেবার। কল্পনা করেছি তোর রক্তে স্নান করবো বলে, কিন্তু একবারের জন্যও ভাবিনি সে ভাবনা একদিন এমনি করে সত্যি হবে শয়তান! হে, নরকের ঈশ্বর, এই মধুর ক্ষণের অপেক্ষায় কি জান্তব যন্ত্রণায় ছটফট করে মরেছি, সে শুধু তুমিই জানো প্রভু!”
যোদ্ধার ভয়ানক রক্ত-লালসা দেখে শরীরে অস্বস্তি জাগাটা স্বাভাবিক। লোকটার প্রস্তর কঠিন চোয়ালের পেশিগুলোতে যেন খিঁচ ধরেছিল, কালো ঠোঁটজোড়া থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছিল।
সরু চোখে আগন্তুককে জরিপ করতে করতে শাহ আমরুথ ধমকে উঠলেন, “তফাৎ যাও—”
“চুপ—” বুনো নেকড়ের মতন গর্জে উঠল আগন্তুক যোদ্ধা, “আকিফের মহামহিম নরপতি— যে নরাধম আমার সহযোদ্ধাদের শকুনের খাদ্যে রূপান্তরিত করেছে— যে শয়তান, আমার বন্ধুদের শরীর ঘোড়ায় বেঁধে ছিন্নভিন্ন করেছে— যে অমানুষ, তাদের চোখ খুবলে নিয়েছে, জিব কেটে নিয়েছে— সেই পাপিষ্ঠ আজ আমার সুমুখে! তুই কুকুর, বুঝলি? তুই নরকের কীট—”
লোকটার কণ্ঠস্বর উঁচু তারে বাঁধা। উন্মাদের আর্তির মতন শোনালো তার ঘোষণা। সে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে ধেয়ে গেল শাহের দিকে।
যোদ্ধার বন্য আক্রোশকে ভয় পেলেও অলিভিয়া জানত লোকটা বেশিক্ষণ যুদ্ধে টিকবে না। শাহের ধাতব বর্মের বিরুদ্ধে লোকটার জান্তব পেশিস্ফালন হয়তো তরবারির এক আঘাতেই নিথর হয়ে পড়বে।
দ্বন্দ্বযুদ্ধে দুই প্রতিপক্ষ নিঠুর খেলায় মেতেছে। আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে শরবন বিক্ষুব্ধ। মাঝে মাঝেই দুটি তরবারির সংঘাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে উঠছিল। ধাতুর ফলাগুলো একে অপরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতন। এমন সময় হঠাৎ আগন্তুকের চওড়া তরবারির ডগাটা প্রবল বেগে হামলে পড়ল শাহের বাঁকা তরবারির ধারালো পাতের ওপর, তাকে খড়কুটোর মতন ভাসিয়ে আঘাত হানল তার মনিবের কাঁধে। অলিভিয়া আর্তনাদ করে উঠেছিল সে আঘাতের অভিঘাত লক্ষ করেই। বর্মের ছিঁড়ে যাবার শব্দ অতিক্রম করে তার কানে পৌঁছেছিল শাহের কাঁধের হাড় গুঁড়িয়ে যাবার ধ্বনি। আহত রাজপুরুষের অবশ হাতের ফাঁক গলে তার তরবারিটা মাটিতে আশ্রয় নিল। ভয়ে, আতঙ্কে পাণ্ডুর হয়ে উঠল শাহ আমরুথের মুখখানা, রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ল ক্ষতের মুখ থেকে।
“সন্ধি, ক্ষমা—” শাহ শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন কোনওক্রমে।
“ক্ষমা? যেমন তুই ক্ষমার পাত্র উপুড় করে দিয়েছিলি আমার পরাজিত বন্ধুদের ওপর?” লোকটার গলা কেঁপে উঠল। ক্রোধ, আক্রোশ, উন্মাদনা। যোদ্ধা যেন কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
অলিভিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। যুদ্ধ শেষ। লড়াই সমাপ্ত। এখন রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে বিজিতের মুণ্ডচ্ছেদ হবে। শাস্তি পাবে পরাজিত। সমস্ত হতাশা, রাগ, বেদনা এই মুহূর্তে আঘাতের বজ্র হয়ে ছিটকে পড়বে বুনো আক্রোশে। তেমনটাই তো যুদ্ধের নিয়ম। শাহের মৃত্যুতে দুঃখ পায়নি অলিভিয়া একটুও। লোকটার তো এভাবেই মারা যাওয়া উচিত! তবুও অলিভিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। দু-হাতে কান চাপা দিয়েও সে অবশ্য মৃত্যুর নগ্ন বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেল না। ভারী অস্ত্রের ঝটিতি নেমে আসা আর সেই সঙ্গে একটা অব্যক্ত কান্না মেশানো গোঙানির শব্দটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার আগে তাকেও স্পর্শ করে গিয়েছিল কয়েকটা মুহূর্তের জন্য।
চোখ খুলে তাকে দেখল অলিভিয়া। অতিকায় সবল লোকটা তখন ফেরার উপক্রম করছিল। ভ্রূ থেকে ঘাম ঝরছে। হাতখানা মৃতের রক্তে মাখামাখি। বুকখানা ওঠানামা করছে। খুনি আগন্তুকের পিছনে পড়ে আছে একখানা ছিন্নভিন্ন মাংসের পিণ্ড, যাকে মানুষ বলে চেনা যায় না আর।
বর্বর লোকটা কোনও কথা বলেনি। অলিভিয়ার দিকে একবারের জন্যও চোখ তুলে চায়নি। লম্বা লম্বা পায়ে নলবনের জলাজঙ্গল পেরিয়ে সে তখন মাথা নিচু করে কিছু খুঁজছিল। সবল হাতে টানছিল কোনও কিছুর প্রান্ত ধরে। সে টানাটানিতেই একখানা ডিঙি নৌকা গুপ্ত ঠিকানা ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করল। অলিভিয়া এতক্ষণ ভাবছিল, এবার ভাবনায় বিরতি দিয়ে সে কাজে নেমে পড়ল।
“পথিক, দাঁড়াও—” অলিভিয়া ভারী কাদাপথ মাড়িয়ে লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “আমায় একলা ফেলে যেও না। আমাকে সঙ্গে নাও।”
লোকটা ঝটিতি মুখ ফেরাল। দৃশ্যত লোকটার ভাবগতিক পালটে গিয়েছে ততক্ষণে। বহু অপেক্ষার পর রক্ততৃষা মিটে গেছে তার। পাগলামির যে আগুন এতদিন সে বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, সে আগুন নিভে গিয়েছে। লাল চোখ দুটোয় এখন শুধুই প্রশান্তি।
“কে তুমি?” লোকটা শুধাল।
“আমার নাম অলিভিয়া। লোকটা আমায় বন্দি করে রেখেছিল। পালিয়েছিলাম, তাই আমার পিছু নিয়ে শয়তানটা এইখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ওর সাগরেদরা নিশ্চয় কাছে পিঠেই আছে। যদি ওরা শাহের ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীরটাকে এখানে দেখে আর সেই সঙ্গে আমাকেও— তাহলে যে কী ভয়ানক পরিণাম হবে! দয়া কর, আমায় সঙ্গে নাও—”
মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠল।
“আমার সঙ্গে থাকাটা কি তোমার পক্ষে ভালো হবে?” বলবান যোদ্ধা বলল, “আমি বর্বর মানুষ, তোমার দু-চোখের দৃষ্টি বলছে, তুমি আমায় ভয় পাও—”
“হ্যাঁ, ভয় পাই,” মেয়েটা এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে মিথ্যে কথা তার মুখে এল না, “তোমার ভয়াল হাবভাব দেখে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে বটে, তবে হারকেনিয়ার জন্তুদের আমি আরও বেশি ভয় পাই। ওদের মৃত রাজার পাশে যদি আমায় ওরা আবিষ্কার করে তাহলে যে কি অমানুষিক অত্যাচার করবে— সে কথা ভাবলেই আমার বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তোমার পায়ে পড়ি, আমায় তোমার সঙ্গে নাও—”
“এস তবে,” যোদ্ধা সরে দাঁড়াল, অলিভিয়া একটা ছোট্ট লাফে নৌকায় চেপে বসল তৎক্ষণাৎ। জলযানের ডগাটায় আশ্রয় নিল সে। অচেনা যোদ্ধা বৈঠার ধাক্কায় নৌকাটাকে একটু এগিয়ে দিয়ে সেটার খোলে জাঁকিয়ে বসল। জলাভূমির অবাধ্য ঘাস জঙ্গলকে কাটিয়ে ডিঙ্গিটাকে সে নিয়ে চলল মুক্ত প্ৰবাহিনী জলস্রোতের দিকে। নদীর স্পর্শ পেতেই লোকটা দু-হাতে দু-খানা বৈঠা টানতে শুরু করল। পেলব গতি। নির্বিঘ্ন মসৃণ যাত্রাপথ। তার হাত আর কাঁধের পেশিগুলো যেন শ্বাসপ্রশ্বাস আর বৈঠার লয়ের যুগলবন্দীতে নেচে উঠল সহসা।
কিছুক্ষণের নীরবতা। মেয়েটি লজ্জাবনত। যোদ্ধা সবলে দাঁড় টানছিল। অলিভিয়া অবশ্য আড়চোখে তাকেই দেখছিল। তার অন্তরে তখন ঢেউ উঠছিল। সম্ভ্রম আর আকর্ষণের দোলায় দুলছিল তার হৃদয়। কে এই যোদ্ধা? লোকটা হারকেনিয়ার নয়। এমনকি হাইবোরিয়া-র জনজাতির সঙ্গেও বিশেষ মিল নেই তার দেহভঙ্গিতে। নেকড়ে সুলভ কাঠিন্য লোকটার চেহারায় সুস্পষ্ট। যুদ্ধের ক্ষত গোটা শরীর জুড়ে। অবাধ্য বন্যতা লোকটার অস্তিত্বজুড়ে। তবুও তাকে খারাপ অথবা নীচ ভাবতে কষ্ট হয়।
“তোমার পরিচয়? শাহ তোমাকে ‘কাজাক’ বলে ডাকছিলেন, তুমি কি ওদেরই বাহিনীর সৈনিক?” মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল অবশেষে।
“আমি সিমেরিয়া নিবাসী কোনান। কয়েকদিন কোজাকিদের সঙ্গে ঘুরেছিলাম বলে হারকেনিয়ার কুত্তাগুলো ওই নামেই ডাকত আমায়—” লোকটা অস্ফুটে বলল।
সিমেরিয়া। অলিভিয়া নামটা শুনেছিল। তার মাতৃভূমি থেকে অনেক অনেক দূরে উত্তর-পূর্ব কোনে কোনও এক জায়গায় সিমেরিয়া নামের দেশটা আছে— অলিভিয়া জানত।
এবার মেয়েটির আত্মপরিচয় দেবার পালা।
“রাজা অফির আমার জন্মদাতা। কথ যুবরাজকে বিয়ে করিনি বলে তিনি আমায় বেচে দিয়েছেন সেমাইট দলপতির হাতে—”
সিমেরিয়ার যুবক চমকে উঠল। জান্তব একটা শব্দ করল মুখে।
একটা তেঁতো হাসি মেয়েটার ঠোঁটের কোনে ঝিকমিকিয়ে উঠল।
“হ্যাঁ, আমাদের সভ্য দেশে ভদ্রলোকেরা তাদের অবাধ্য কন্যাসন্তানকে দাসীবাঁদীর মতন বিক্রি করে দেয় জংলী লোকেদের হাতে। অথচ লোকে তোমায় ‘বর্বর’ বলে ডাকে। কি নিষ্ঠুর পরিহাস, তাই না?”
“আমরা আমাদের সন্তানদের কখনও বিক্রি করি না—” কোনান নামের যোদ্ধা গম্ভীর গলায় বলল, তার চোয়ালের পেশিগুলো কয়েকবার নড়াচড়া করে উঠল।
“আমাকে বিক্রি করা হয়েছিল। যে আমায় খরিদ করেছিল, সে আমার কদর বুঝেছিল। শাহ আমরুথের কৃপাদৃষ্টি লাভের অভিপ্রায়ে লোকটা আমায় ব্যবহার করল। তার দেওয়া অজস্র উপহারের সঙ্গে আমারও ঠাঁই হল রাজার প্রমোদ-ভবনে। তারপর—”
মেয়েটি শিউরে উঠল যেন। দু-হাতে মুখ ঢাকল ক্ষণিকের জন্য।
“লজ্জার সমুদ্রে ডুবে মরা উচিত আমার। ভাবি ভুলে যাবো যন্ত্রণাগুলোকে। কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি যেন চাবুকের মতন আঘাত হানে, বিষাক্ত হুল ফুটিয়ে যায় হৃদয়ে। সে যাক, এরপর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শাহের ডাক পড়ল তুরানের সীমানায়। সেখানে তাঁর বাহিনী লড়াই চালাচ্ছিল হানাদারদের বিরুদ্ধে। গতকালই তিনি ফিরলেন। শত্রুকে বিনষ্ট করে এসেছেন, প্রাসাদে তাই উৎসবের ধুম লেগে গেল। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম। একখানা ঘোড়া চুরি করে তার পিঠেই নগর জনপদ ছাড়লাম। ভেবেছিলাম— পালিয়ে বেঁচেছি। কিন্তু শয়তানটা পিছু নিল। দুপুরের আগেই তার নাগালে এসে পড়লাম। ওর সাঙ্গপাঙ্গদের চোখে ধুলো দিতে পারলাম বটে, কিন্তু শাহ আমায় ঠিক কবজা করে নিলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তোমার আবির্ভাব—”
“আমি লুকিয়ে ছিলাম এই জলায়। তুমি যে হানাদারদের কথা বললে, আমিও ছিলাম সেই দলে। পূর্ব-কথ প্রদেশের এক রাজকুমারের অনুগত ঘাতকবাহিনী ছিল আমাদের আশ্রয়। সব মিলিয়ে পাঁচ-হাজার সৈনিক। সকলেই ভিন্ন জাতের। নিজেদের ‘মুক্তি-যোদ্ধা’ বলতাম আমরা। আমরা তখন সীমানায় লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছিলাম অবাধে। তখনই হঠাৎ বিদ্রোহী কুমারের চৈতন্য হল। তিনি বিদ্রোহী থেকে সাম্রাজ্যের ‘বন্ধু’ হয়ে গেলেন এক নিমেষে। আমরা হারালাম আমাদের ‘জীবিকা’। বাঁচতে হবে। লড়তে হবে। তাই কথ, জামোরা আর তুরানে বিক্ষিপ্তভাবে লুঠতরাজ চালালাম আমরা কয়জনা। সপ্তাহখানেক আগে শাহ আমরুথ ইলবার্সের নদীতটে আমাদের ঘিরে ধরলেন। তাঁর সঙ্গে পনেরো হাজার অশ্বারোহী। মিত্রা-র দিব্যি, আকাশ ঢেকে গিয়েছিল শকুনের ছায়ায়। সাক্ষাৎ মৃত্যু যেন। আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে সময় লাগল না বিশেষ। কেউ উত্তরের দিকে পিঠটান দিতে চাইল, কেউ ছুটল পশ্চিমে। মনে হয় না, কেউ শেষ পর্যন্ত পালাতে পেরেছিল। যে দিকে দু-চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই দেখি অশ্বারোহীরা যোদ্ধারা বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে উৎরাই-এর পথে। আমি পূর্বদিকের পথ ধরলাম। অবশেষে ভিলায়েৎ-এর এই জলাভূমিতে আশ্রয় নিলাম। সেই থেকে এই জলাভূমিতে লুকিয়ে আছি আমি। বন্য পোকামাকড়ের মতন পড়ে আছি আত্মগোপন করে। কাদামাটি আর ঘাস-জঙ্গলে মাখামাখি হয়ে সরীসৃপের মতন বাঁচিয়ে রেখেছি নিজেকে। মাঝে মাঝেই সান্ত্রীরা এসে নলবনে লাঠি চালিয়ে গেছে নির্মমভাবে। পলাতক, আত্মগোপনকারীদের ওরা কোনওভাবেই রেহাই দেবে না। আমি ধরা পড়িনি। ওরা আমাকে খুঁজে পায়নি। ক-টা দিন নেংটি ইঁদুর ধরে খেয়েছি। কাঁচাই। আগুন কোথায় পাব? নৌকোটাকে আবিষ্কার করলাম আজ ভোরে। ভাবিনি সমুদ্রে পাড়ি দেব। কিন্তু শাহকে খুন করার পরে বুঝলাম, ওঁর পোষা কুকুরগুলো ঠিক পিছু নেবে। অগত্যা সেই পথেই পা বাড়ালাম—”
যোদ্ধা গম্ভীর গলায় তার আখ্যান শোনাল।
“এবার কী উপায়?”
“ওরা নিশ্চয় আমাদের অনুসরণ করছে। জলাভূমিতে আমাদের খুঁজে না পেলে ওরা বোধহয় কাদামাটিতে নৌকার দাগ দেখতে পাবে। যদিও পালানোর আগে আমি ওই দাগগুলোকে যতটা সম্ভব ঢেকে ফেলার চেষ্টা করেছি, তবে তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। ওই দাগগুলো দেখেই ওরা ঠিক বুঝে যাবে আমরা সমুদ্রের দিকে পা বাড়িয়েছি। সে বুঝুক। এভাবে অন্তত কিছুটা দূরে হলেও পৌঁছতে পারব। আর তা ছাড়া যতক্ষণ না একটা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছচ্ছি আমি নিরলস দাঁড় টেনে যাবো এই দু-হাতে।”
“কিন্তু নিরাপত্তা কোথায়?” অলিভিয়া নিরাশ কণ্ঠে বলে উঠল, “ভিলায়েতের সমুদ্র হারকেনিয়ার যোদ্ধাদের কাছে হাতের তালুর মতো পরিচিত।”
“উঁহু, অতটা সহজ নয়,” বিষন্নভাবে হাসল কোনান, “তা হলে এতগুলো ফাঁসির সাজা পাওয়া ক্রীতদাস ওখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকত না। ওদের অনেকেই শুনেছি এখন জলদস্যু—”
“তোমার পরিকল্পনাটা ঠিক কি?”
“আসলে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের অনেকটাই হারকেনিয়ার দখলে। আবার এদিকে ওদের উত্তরের সীমানা পেরোতে আমাদের এখনও অনেকগুলো দিন বাকি। তাই আমি যতক্ষণ না ওদের এলাকাটা পেরিয়ে যাচ্ছি ততক্ষণ উত্তরের বেলাভূমি ঘেঁষে চলব। তারপরেই অবশ্য পশ্চিমমুখো হব। তখনই একখানা অনধিকৃত সমভূমি দেখতে পেলে সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেব।”
“এর মধ্যে যদি তুফান ওঠে? জলদস্যুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে? সেখানে খাবই বা কি?”
মেয়েটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হল।
“আমি তো তোমায় আমার সঙ্গে আসতে বলিনি—”
“দুঃখিত,” কালো মাথাটা ঝুঁকিয়ে অলিভিয়া বলল, “তুফান অথবা জলদস্যু— তুরানের শয়তানগুলো ওদের চাইতেও ভয়ানক।”
“একদম হক কথা,” কোনানের মুখে আঁধার ঘনাল, “ব্যাটাদের এখনও ঠিকমতো শিক্ষা দেওয়া বাকি। বছরের এ সময়ে ভিলায়েতে খুব একটা ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সে চিন্তা না করাই ভালো। গন্তব্যে পৌঁছলে না খেতে পেয়ে মরব না, আমি নিশ্চিত। তাই চিন্তার কারণ দেখি না খুব একটা। আমি নিজে একখানা উলঙ্গ পাহাড়ি প্রান্তরে বড় হয়েছি, চারদিকে শুধু ডোবা আর মাছির ভ্যানভ্যানানি আর দুর্গন্ধ। অমন হতকুচ্ছিত জায়গা যখন আমায় কাবু করতে পারেনি তখন এ সব সমতল আমার কিছুই ক্ষতিবৃদ্ধি করতে পারবে না। রইল বাকি জলদস্যুরা—”
কোনান মুচকি হেসে উবু হয়ে দাঁড়ে টান মারল।
জ্বলন্ত তামার গোলকের মতন সূর্যটা অবশেষে সমুদ্রের বুকে ডুব দিল, সেই রঙের রূপটান ছড়িয়ে পড়ল ঢেউয়ের শরীর বেয়ে। আকাশের নীল সমুদ্রের সঙ্গে মিলে মিশে মন কেমন করা অসিত বর্ণের মখমলের রূপ নিল। গগনবাসী নক্ষত্র-শরীরগুলো প্রতিবিম্ব হয়ে ভেসে এল সমুদ্রের পেলব দেহবল্লরীকে সাজিয়ে তুলতে। নৌকার খোলে সুন্দরী অলিভিয়া শয্যা নিয়েছিল। শরীরে ক্লান্তি। মনে অবসাদ। দীর্ঘ যাত্রার ধকলে সে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছিল এক স্বপ্নিল মায়াময় জগতে। সে ভাবছিল। স্বপ্নে ভাসছিল। নক্ষত্রখচিত পথরেখার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। নির্ভার। নিশ্চিন্ত। একটি ছায়াশরীর একমনে দাঁড় টানছিল। অক্লান্ত। অবিরাম। তার যাত্রাপথের নীরব সঙ্গী সে। অপার্থিব কল্পলোকের আশ্চর্য মাঝি। যেন এই পথ মিশে যাবে একদিন মৃত্যুর অন্ধকারে। তবু ভয় নেই তার। অভিযোগ নেই। শুধু গতি আছে। আবেশ আছে। অলিভিয়া কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল এই ভবসমুদ্রের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে। ভোরের মিঠে আলোয় ঘুম ভাঙল তার। রাক্ষুসে খিদে নয়, তার ঘুম ভেঙেছিল নৌকাটার গতি পরিবর্তনে। কোনান বিশ্রাম নিচ্ছিল। তার দৃষ্টি অলিভিয়ার শরীরটাকে পিছনে ফেলে দিগন্তের দিকে হারিয়ে গিয়েছিল। লোকটার কি অসম্ভব সহ্যশক্তি! সমস্ত রাত্রি জেগে সে একলা একলা সমুদ্রের বুকে দাঁড় টেনেছে অবিরত! মেয়েটা ভাবছিল। তারপর শরীর মুচড়ে কোনানের দৃষ্টিপথ অনুসরণ করল।
জলের ধারে ঝোপ আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে শ্যামল বনানীর সুউচ্চ বৃক্ষ-বেষ্টনী চোখে পড়ল তার। ওদের বাহুবন্ধে ধরা দিয়েছে একফালি নীল-পান্না উপসাগর। শান্ত সমাহিত তার রূপ।
“এরকম ছোটখাটো দ্বীপ-ভূমি এই উপসাগরে হামেশাই দেখা যায়,” কোনান বলল, “এতে কেউ বাস করে বলে মনে হয় না। লোক মুখে শুনেছি, এ সব জায়গায় হারকেনিয়ার নরাধমগুলো খুব একটা পা ফেলে না। আর যদি আসেও, তাহলে উপকূল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পালায়। এতটা ভিতরে মাথা গলানোর দুঃসাহস ওদের অন্তত হবে না। এখন আমরা ওদের নাগালের বাইরে। গত রাতেই মূল ভূখণ্ডের নজর এড়িয়ে বেরিয়ে আসাটা খুব কার্যকরী হয়েছে এ ক্ষেত্রে।”
বৈঠার সামান্য কয়েকটা টানেই নৌকাটা বেলাভূমি ছুঁল। একটা প্রকাণ্ড গাছের মোচড়ানো শিকড় সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিল। তার সঙ্গে নৌকোটাকে বেঁধে ফেলল কোনান। তীরে পা রেখেই যোদ্ধা হাত বাড়িয়ে ধরল। অলিভিয়া সে হাতে নিজের হাত রাখল। সামান্য অস্বস্তি হল তার। মুখ কুঁচকে গেল। যোদ্ধার হাতে কয়েক ফোঁটা রক্তের দাগ ফুটে উঠেছে। কি অনির্বচনীয় শক্তি লুকিয়ে আছে ওই অস্থি-মজ্জার আড়ালে— সে কথাই যেন তার মনে পড়ে গেল হঠাৎ।
স্বপ্নময় নিস্তব্ধতায় মোড়া শ্যামল বনানী। সেই সবুজে ঘেরা সুনীল উপসাগর। অদূরেই জঙ্গলের কোনও এক গোপন ডেরা থেকে এমন সময় গেয়ে উঠল একটা অচেনা পাখি। রাগ ভৈরব যেন। ওদিকে এক রাশ সামুদ্রিক হাওয়া গাছের পাতায় পাতায় নাচন জাগিয়ে বেড়াচ্ছে। বনবীথিতে কানাকানি আর ফিসফিসানির ধুম লেগে গেছে তাতে। অলিভিয়া কান পেতে শুনছিল। শুনতে চাইছিল। তার শ্রুতি যে ঠিক কোন ধ্বনির আশায় বসে ছিল, অলিভিয়া সেটাই জানে না। কী আছে এই সুনিবিড় অরণ্যের আড়ালে? কোন বিপদ মুখ লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে ওই শ্যামলিমার আবছায়ায়? মেয়েটা ত্রস্ত চোখে তাদের খুঁজে বের করতে চাইছিল বোধহয়।
ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে গাছের ছায়া মাড়িয়ে অলিভিয়া যখন বনবীথিতে প্রবেশ করল ঠিক তখনই ডানা ঝটপটিয়ে কিছু একটা উড়ে এল। একখানা অতিকায় বন-টিয়া। গাছের সবুজ ডালে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসেই একটা পাক খেল সে। তার উজ্জ্বল সবুজ আর লালে মোড়া শরীরটা সূর্যের আলোয় ঝকমকিয়ে উঠল। ঝুঁটি নাড়িয়ে মাথাটাকে হেলিয়ে সে চাইল অনুপ্রেবশকারীদের দিকে। কাচ-কালো চোখের মণিদুটো নাচিয়ে সে যেন তাদের ভর্ৎসনা করল।
“ক্রমের দিব্যি, এই বুঝি সমস্ত পাখিদের ঠাকুরদা এলেন! চোখের মধ্যে দেখো কেমন প্রাগৈতিহাসিক জ্ঞানের ঝিলিক খেলে বেড়াচ্ছে! তা জ্ঞান-বৃদ্ধ মহাশয়, কোন প্রাচীন গুপ্ত রহস্য লুকিয়ে রেখেছেন, বলুন দেখি?”
কোনান বিড়বিড় করল।
সহসা পাখিটা তার আগুন রঙা ডানা দু-খানি মেলে ধরল। ডাল থেকে ঝাঁপ মারল শূন্যে। চেঁচিয়ে উঠল কর্কশকণ্ঠে।
‘ইয়াগকুলান ইয়োক থা, জুথাল্লা!’
একখানা বিকৃত অট্টহাসি ছেড়ে সে মিলিয়ে গেল বনবাদাড়ের সবুজ ছায়ার মধ্যে দিয়ে। হাসিটা মানুষের মতন।
অলিভিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়েছিল পাখিটার গমনপথের দিকে। কোনও এক অদৃশ্য কুটিল ছায়া যেন তার শীতল হাতখানি দিয়ে স্পর্শ করল মেয়েটির মেরুদণ্ডকে।
“পাখিটা কী বলে গেল, বল তো?” সে স্বগতোক্তি করল।
“মানুষের বুলি বটে, তবে ও বুলি আমার পরিচিত নয় মোটেই—”
কোনান উত্তর দিল।
“আমিও শুনিনি অমন ভাষা। হয়তো মানুষের কাছ থেকেই শিখেছে। মানুষ অথবা—”
অলিভিয়া অপাঙ্গে ভয়াল অরণ্যের শ্যামল ছায়াটাকে দেখে নিল একবার। কেন, সে নিজেও জানে না অবশ্য।
“ক্রমের দিব্যি, আমার পেটে আগুন জ্বলছে! একখানা আস্ত মোষ খেয়ে নিতে পারি, এমন অবস্থা আমার। এখানে ফল পাওয়া যাবে বোধহয়। তবে সে সবের আগে একবার স্নান করা জরুরি। শুকনো কাদামাটি আর রক্তের দাগ ধুয়ে না ফেললে শান্তি পাচ্ছি না কিছুতেই। জলাভূমিতে লুকিয়ে থাকাটা একেবারে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার—”
তরবারি মাটিতে রেখে সে সমুদ্রের কাছে আত্মসমর্পণ করল। নীলপান্না ঢেউয়ে শরীর ডুবিয়ে এগিয়ে গেল বেশ কিছুটা। শরীরের মালিন্য মুছে ফেলল। তারপর ঢেউয়ের মধ্যে থেকে উঠে এল সে বিজয়ীর মতন। সূর্যের আলোয় তার শরীর ঝকমক করে উঠল যেন। ব্রোঞ্জের মূর্তির মতন ধারাল দেহপট। সুদীর্ঘ কৃষ্ণভ্রমর কেশদাম, সেখানে আর আগের মতন কাদার কালিমা লেগে নেই। চোখের তারায় আগুনের ক্ষুধিত শিখার নাচন এখনও বর্তমান, তবে ক্লান্তির লালিমা ঘুচেছে। যোদ্ধাকে আর বর্বর বলে দাগিয়ে যায় না এখন। কিন্তু লোকটার পেশিতে পেশিতে যে নেকড়ের ক্ষিপ্রতা আর চরিত্রে যে ভয়ানক হয়ে ওঠার আশ্বাসটা ছিল, সেটা এখন আরও পরিস্ফুট।
তরবারিটাকে আবার কোমরে বেঁধে ফেলল কোনান। আঙুলের ইশারায় অলিভিয়াকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত করে সে চলতে শুরু করল অরণ্য পথে। পিছনে পড়ে রইল বালুকাবেলা। চলার পথে পথে তাদের অভ্যর্থনা জানাল গাছের ডালে তৈরি খিলানগুলো। পায়ের তলায় ঘাসের পেলব সবুজ স্পর্শ। দু-পাশে সরে সরে যাওয়া কাণ্ডগুলোর মধ্যে দিয়ে যেন এক অপার্থিব মায়ারাজ্যের হাতছানি এসে পৌঁছেছিল ওদের কাছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছের ডালে ঝুলে থাকা থোকা থোকা সরেস বাদামি ফলগুলোকে দেখতে পেল ওরা। রাসেট ফল। ওপরের লালচে-বাদামি খোসা, ভেতরে রসময় শাঁস। ভূপাতিত একটা গাছের ওপরে অলিভিয়াকে বসিয়ে তার কোলে ওই বাদামি ফলগুলোর ভাণ্ডার সাজিয়ে দিল কোনান। তারপর নিজেই খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বুভুক্ষের মতন।
“দেবী ইশটারের দিব্যি,” এক মুখ খাবার গলায় ঠেলে দিয়ে কোনান বলে উঠল, “ইলবারস ছাড়ার পর থেকে বুনো ইঁদুরের মাংস অথবা পুঁতিগন্ধময় পাঁক থেকে তুলে আনা কন্দ খেয়ে পেট ভরিয়ছি। এ ফলগুলো ছোট কিন্তু মিষ্টি। অনেকটা খেলে তবেই যদি আমার পেট ভরে!”
অলিভিয়া আহারে এমনি ব্যস্ত ছিল যে উত্তর দেবার ফুরসৎ পেল না। খিদের ধার কমার সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক অনুভূতিগুলোর ধার বাড়ল কোনানের। তার চোখ পড়ল ধবল-শুভ্রা সঙ্গিনীর দিকে।
এতটা মনোযোগ দিয়ে সে এর আগে কখনও চায়নি অলিভিয়ার পানে। তার আঁধার-মাখা চুলের ঝরনা, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণে মিশে থাকা গোলাপি রঙের আভাস, কমনীয় দেহ-বল্লরী— সামান্য মখমলি বস্ত্রখণ্ডের আড়াল থেকে বিলোল কটাক্ষ হানছিল বর্বর যোদ্ধার দিকে, তার ঊষর হৃদয়ে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ উঠছিল যেন। উদরপূর্তি শেষ হতেই কোনানের লক্ষ্যবস্তু চোখ তুলে চাইল তার দিকে। যোদ্ধার তৃষিত উত্তপ্ত চাহনির মুখোমুখি হতেই তার শরীর রং পালটালো। সেই ফাঁকে অভুক্ত ফলের টুকরোটা মেয়েটির হাত গলে পিছলে পড়ল মাটিতে।
কোনান নির্বাক রইল। তবে ইশারা করে যাত্রা চালু রাখার ইঙ্গিত দিল। মেয়েটাও তাকে অনুসরণ করে অরণ্যের সুনিবিড় শ্যামল ছায়ায় নিজেকে হারাল। সামনেই অবশ্য সঘন পত্ররাশি। জঙ্গলের ঘনত্ব বেড়ে গেছে বিপজ্জনকভাবে। এর মধ্যেই অবশ্য এক ফালি ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে পা রাখতেই কোনও এক অদৃশ্য ভারী বস্তু ক্ষিপ্র গতিতে ধেয়ে এল তাদের দিকে। কোনান সঙ্গিনীকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে নিজেও মুখোমুখি সংঘর্ষের হাত থেকে বাঁচল, এক নিমেষে তরবারি কোষমুক্ত করে রুখে দাঁড়াল সে। অলিভিয়া যোদ্ধার আড়ালে থেকেও তরবারির ওপর ঝুঁকে রইল। সে ত্রস্ত, ভীত। ওদিকে ধাবমান বস্তুটা উলটোদিকের ঘন ঝোপে আছড়ে পড়ল বিপুল শব্দে। কোনান দৌড়ে গেল সেদিকে। একটা ক্রুদ্ধ ভ্রূকুটি কোনানের মুখভাবে ফুটে উঠল।
“আশ্চর্য, কেউ নেই এখানে—” কোনান মৃদুকণ্ঠে গর্জন করে উঠল, “অথচ জিনিসটাকে কেউ ছুড়েছে আমাদের লক্ষ করে!”
পাথরটা পড়ে ছিল গাছের গোড়ায়। অতিকায় প্রস্তরখণ্ড, শরীরে সবুজ শৈবালের ছাপ। এর আঘাতেই আরেকটু হলে ভয়ানক আহত হতে পারত সিমেরিয়ার যোদ্ধা এবং তার সুন্দরী সঙ্গিনী। কোনান নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকেই যেন আর বিশ্বাস করতে পারছিল না।
“পরিত্যক্ত দ্বীপে এমন পাথর এল কেমন করে?”
কোনান যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছিল।
প্রশ্নটা অলিভিয়াকেও ভাবল। তার সুন্দর চোখের মণিদুটো বিস্ফারিত হল। কোনানের সংশয় নিরর্থক নয় মোটেই। পাথরের টুকরোটা সম-মাত্রিক, তার প্রতিটি তল কেউ যেন নিপুণ হাতে মাপ করে কেটেছে। কোনান দু-হাতের মুঠোয় চেপে ধরল পাথরটাকে। তারপর অমানুষিক শক্তি খরচ করে মাটি থেকে তুলল। পাথরটাকে মাথার ওপরে তুলতেই কোনানের শরীর ঘামে মাখামাখি হয়ে গেল। হাতের পেশিগুলো যেন এবার ঠিকরে বেরিয়ে আসবে তার দেহ থেকে। কোনান প্রস্তরখণ্ডটাকে ছুড়ল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। জিনিসটা বর্বর যোদ্ধার শরীর থেকে কয়েক হাত দূরেই মাটিতে সশব্দে গড়িয়ে পড়ল।
“কোনওমতেই কোনও জীবন্ত মানুষের পক্ষে এ জিনিস এতটা দূর থেকে ছুড়ে মারা অসম্ভব। একমাত্র প্রাকারভেদী যন্ত্র দিয়েই এমন কাজ সম্ভব। অথচ না আছে এখানে কোনও প্রক্ষেপ-যন্ত্র, না আছে কোনও দূরভেদী-উৎক্ষেপ কল!”
কোনান খানিক বিভ্রান্তভাবেই বলল।
“তাহলে হয়তো অমন একখানা যন্ত্র দিয়েই কেউ এ কাজ করেছে?” অলিভিয়া উত্তর খুঁজছিল।
“উঁহু, পাথরটা আকাশ থেকে পড়েনি মোটেও। একেবারে মাটির সঙ্গে সমান্তরালভাবে ছিটকে পড়েছে। কেউ যেন প্রবল শক্তিতে একটুকরো নুড়ি পাথরকে ছুড়েছে অনেকখানি দূর থেকে। গাছের ঝরা পাতাগুলো তেমনটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। কিন্তু সে কে? কেনই বা সে আমাদের ওপর হামলা করছে? আর কেমন করেই বা লোকটা এমন অসম্ভব কাজটা করতে পারছে?”
অলিভিয়া যোদ্ধার পিছু পিছু এগিয়ে গেল। যেখান থেকে আক্রমণ ধেয়ে এসেছিল হঠাৎ করে, সেদিকেই চলেছে ওরা। পাতা ঘেরা ঘন সবুজের আড়ালে একটুকরো পরিসর। ঝোপ জঙ্গলের ঘনত্ব কম এখানে। কোনান নিচু হয়ে ঘাসের গায়ে আক্রমণকারীর পদচিহ্ন খুঁজছিল। সে মরিয়া। কিন্তু এখানে সেখানে কয়েকটা বিক্ষিপ্ত জায়গায় দলিত মথিত ঘাস ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেল না তার সন্ধানী দৃষ্টি। কোনান বিরক্ত হল। তার সাবধানী চোখদুটো একটু একটু করে বনবীথির ঊর্ধ্বভাগে পৌঁছচ্ছিল। সেখানে চাপ বাঁধা সবুজ পাতার বিন্যাস। আকাশ ঢেকে গেছে ভারী ডালপালার বিসর্পিল খিলানপথে। আর তখনই কোনানের সমস্ত মাংসপেশিগুলো যেন একযোগে কঠিন হয়ে গেল।
সে উঠে দাঁড়াল। তরবারি উদ্যত। দেহভঙ্গিতে মৌন সতর্কতা। অলিভিয়াকে পিঠ দিয়ে নীরবে ঠেলে পশ্চাদপসরণ করল কোনান।
“জলদি পালাতে হবে এখন থেকে—”
মর্মরধ্বনির মতো ভেসে এল কোনানের ভয়-সন্ত্রস্ত সাবধানবাণী। আর সেটা শুনেই মেয়েটার রক্ত যেন জমাট বেঁধে গেল সহসা।
“কী দেখলে? কে আছে ওখানে?”
“কিচ্ছু না—” কোনান না থেমেই বলল। কণ্ঠস্বরে কিছু একটা লুকিয়ে রাখার প্রয়াস।
“আমায় বলো, কি দেখেছ তুমি?”
“সাক্ষাৎ মৃত্যু!” সংক্ষিপ্ত শঙ্কিত উত্তর কোনানের। তার দৃষ্টি তখনও হরিদ্রাভ পাতার ভিড়ে ন্যস্ত।
ঝোপ থেকে বেরিয়েই কোনান সঙ্গিনীর হাত ধরে ছুট লাগাল। একটা বৃক্ষ-বিরল ঘাসে ঢাকা সমতলে এসে ওরা থামল। সেখান থেকে আরেকটু যেতেই একটা প্রান্তর পাওয়া গেল। সেখানে গাছগাছালির সংখ্যা কম। তবে চারদিকে ঘন দীর্ঘ ঘাসের ঝোপ। সেই সমভূমির মাঝখানেই দেখা মিলল সবুজ ছোপ পড়া এক প্রকাণ্ড ইমারতের ধ্বংসাবশেষ।
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ ওরা। ভিলায়েতের কোনও দ্বীপে যে এমন একখানা ভগ্ন প্রাসাদ থাকতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে ওরা কোনওদিন বিশ্বাস করত না। ধীর পায়ে ধ্বংসাবশেষের দিকে এগিয়ে গেল তারা। ইমারতের দেয়ালে শ্যাওলার প্রলেপ, শৈবালের গাঢ় সবুজ ছাপ। ছাদটা বুক ফাটা হাহাকার নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। এদিকে সেদিকে ভাঙা মূর্তি। তাদের আবার কিছুটা ঘাসের আস্তরণে ডুবে গিয়েছে। যেন কোনও এক কালে এখানে এমন বাড়ি-ঘর আরও অনেক ছিল। হয়তো একটা আস্ত শহর ছিল। কিংবা জনপদ। কালের গ্রাসে হারিয়ে গেছে সে সব। রয়ে গেছে স্মৃতির তলানিটুকু। প্রস্তর-প্রাকারটা তবুও মাতালের মতন ঢলে পড়ছিল বুনো লতা-ঝোপের ওপর। কিছু বিচ্ছিন্ন কক্ষ আর অলিন্দ আকাশের পটভূমিকায় জেগে ছিল প্রেতমূর্তির মতন।
যে সিংহ-দরজা কোনও এক কালে এ প্রাসাদের গোপনীয়তা রক্ষা করত সে উধাও এখন। কোনান তার সহযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়াল হাঁ-মুখ দালানের সামনে। কৌতূহলী দৃষ্টি রাখল কক্ষের ভিতরে। ধ্বংসের ক্ষত থেকে আলোর রেণু ঝরে পড়ছে অন্ধকার মাখা ঘরগুলোর মধ্যে। আবছায়া মায়াজাল তৈরি হয়েছে আলো-আঁধারির সেই খেলায়। তরবারিটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কোনান কক্ষে প্রবেশ করল। শিকারি চিতাবাঘের মতন। মাথাটা নিচু। শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে তার। অলিভিয়া ভীত কম্পিত সাবধানী পদক্ষেপে তার পিছু নিল।
কক্ষে প্রবেশ করে কোনান বিস্মিত হল বটে, তবে অলিভিয়া একেবারে সন্ত্রস্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
“ওই দেখো—”
“ভয় পেও না, ওরা মূর্তি মাত্র—” কোনান সঙ্গিনীকে নিরস্ত করল।
অলিভিয়া ঘনিষ্ঠ হল। ফিসফিস করে বলল, ‘‘কিন্তু কেমন জীবন্ত ওরা, দেহভঙ্গিতে কী নারকীয় জিঘাংসার ছাপ!”
পেলব মসৃণ মর্মর পায়ের নিচে। প্রমোদকক্ষের সর্বত্র ধুলো আর প্রস্তরকণার আবরণ। পাথরের দেয়ালে বুনো লতার ক্ষয়িষ্ণু বাঁধন। ছাদের মাথায় কোনও চূড়া নেই। তার বদলে মাথা ঢাকার জন্য একখানা সমতল শতদীর্ণ আচ্ছাদন আছে বটে। সেটাকে কাঁধে নিয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র স্তম্ভ। ঘরটার দু-ধারে ওদের অবস্থান। প্রতিটি স্তম্ভের মাঝখানে যে সামান্য বিরতি, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি করে আশ্চর্য দর্শন মূর্তি। হ্যাঁ, মূর্তিই বটে। লোহার। ওদের সকলের শরীর ঝকঝক করছে। যেন নিয়ম করে ওদের গায়ে জমা ধুলোবালি কেউ পরিষ্কার করে দেয়। ওরা উন্নতদেহ, জীবন্ত-প্রায়। কঠিন দেহ সৌষ্ঠব। নগ্ন। ঈগলের মতন দীর্ঘ ক্রূর মুখ। হাত-পা-গোড়ালি সমস্ত কিছুই নিখুঁত। এমনকি শিরা উপশিরাগুলোও যেন সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত। তবে এ সবের চাইতেও ওদের যে বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে বেশি করে, তা হল ওদের মুখভাবে লুকিয়ে থাকা উদ্ধত অসহিষ্ণুতা। প্রতিটি মুখ সামান্য হলেও অন্যদের চাইতে আলাদা। প্রতিটি মূর্তি যেন একেবারে স্বকীয় চরিত্রে ভাস্বর। যদিও স্বজাতি-সুলভ একটা মিলও আছে ওদের গঠনে। কিন্তু মুখগুলো একেবারে আলাদা। বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ।
“ওরা সব শুনতে পাচ্ছে, ওরা অপেক্ষায় আছে—”
অলিভিয়া ফিসফিস করে উঠল।
তরবারির ধাতব হাতল দিয়ে মূর্তিগুলোর একটার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিল কোনান।
“ক্রমের দিব্যি! লোহা দিয়ে তৈরি তো বটেই, তবে কোন ছাঁচে গড়া এই বিদঘুটে মূর্তিগুলো?”
দিশাহীন যোদ্ধা মাথা নেড়ে কাঁধ ঝাঁকাল। সে বিস্মিত।
অলিভিয়া কাঁপছিল। ভয়ে ভয়ে অতি সন্তর্পণে সে কক্ষের ভিতরটায় চোখ বোলাচ্ছিল। কিন্তু বুনো লতার দেয়াল লিখনের মধ্যে ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিগুলোর সঙ্গেই শুধু তার চোখাচোখি হচ্ছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল তার। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু তার সঙ্গী ততক্ষণে মূর্তিগুলোকে নিয়ে মেতে উঠেছে। প্রতিটি প্রতিকৃতিকে সে খুঁটিয়ে দেখছিল। বর্বরতা তার মজ্জাগত। তাই সেই অভ্যাসের বশেই হয়তো মূর্তিগুলোর হাত-পা ধরে টানাটানি করছিল। তাদের ওপর গায়ের জোর ফলিয়ে দেখছিল, ভাঙতে পারা যায় কিনা। কিন্তু না, ওদের ভাঙা গেল না। মূর্তিগুলো যেন কোনানের ব্যর্থতায় হেসে উঠল উপহাস করে। নীরবে নিষ্প্রাণ ধাতুর প্রতিকৃতিগুলোকে গাল পেড়ে কোনান চেষ্টায় ইতি টানল।
“কাদের নকল করে এদের বানাল ঈশ্বরই জানেন!” কোনান যেন সমস্ত মনুষ্যজাতিকে প্রশ্ন করল, “গায়ের রং শ্যামলা, অথচ এরা কৃষ্ণাঙ্গও নয়! অন্তত আমার চেনা কোনও জাতের সঙ্গে এদের কোনও মিলই নেই!”
“চলো, এবার আলোর কাছে যাই—” অলিভিয়ার ভয় যায়নি এখনও। কোনান তখনও আবিষ্ট চোখে ভাস্কর্যগুলোকে দেখে যাচ্ছিল। ওদের ধ্যানমগ্ন কুটিল মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছিল। অলিভিয়ার কথায় সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
আলো-ছায়া মোড়া রহস্যময় ঘর থেকে ওরা বাইরে বেরিয়ে এল। জ্বলন্ত সূর্যালোকে এসে দাঁড়াল। আকাশের গায়ে আগুনের গোলাটা অনেকখানি সরে গিয়েছে। অলিভিয়া বিস্মিত। এতটা সময় তারা ওই রহস্যময় ঘরটায় কাটিয়েছে?
“নৌকায় ফিরি চল। এখানে বড্ড ভয় করছে। জায়গাটা যেমন ভূতুড়ে তেমনি অশুভ। যাদের অনুকরণে ওই মূর্তিগুলো তৈরি তারা যখন তখন আমাদের ওপর আক্রমণ শানাতে পারে।”
অলিভিয়ার ভয় এখনও যায়নি।
“গাছের তলায় না গেলেই আমরা নিরাপদ, এস দেখি—”
কোনান উত্তর দিল।
সমতল জায়গাটার ধারগুলো উৎরাইয়ের রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুব-পশ্চিম-দক্ষিণের অভিমুখে। গহীন অরণ্য ছড়িয়ে আছে সে পথে। একমাত্র উত্তর দিকেই চড়াই। সে পথেও অরণ্য। তবে ওর শেষে এক সুউচ্চ চূড়া। এ দ্বীপের সবচাইতে উঁচু ঠাঁই। তাই সে দিকেই যাওয়া মনস্থির করল কোনান। সঙ্গিনীর গতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সে মন্থরভাবে পা চালাল। মাঝেমধ্যেই সে পিছনে ঘুরে নজর রাখছিল অলিভিয়ার দিকে। মেয়েটা সেটা বুঝতে পেরেছিল। আশ্বস্ত হয়েছিল।
উত্তর প্রান্তে এসে পৌঁছল তারা। উপরের দিকে চোখ বোলালে তীক্ষ্ণ খাড়াইটাকে দেখতে পাওয়া যায় পরিষ্কার। চূড়ার শরীরে বৃক্ষের আস্তরণ। ঢালুর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গাছগুলো ঝুলে ছিল বিপজ্জনকভাবে। কোনান ভয়ার্ত চোখে সবুজের চাদরটাকে দেখছিল। একটা গোপন আতঙ্ক তার মনে ক্রমাগত খোঁচা মেরে যাচ্ছিল। কিন্তু সে দেরি করল না। উত্তরণের পথ ধরল অবলীলায়। চড়াইয়ের পথটা খুব খাড়া না হলেও মাঝে মাঝে অতিকায় প্রস্তরখণ্ড কিংবা ভাঙা পথরেখা বিপদে ফেলছিল ওদের। কোনান পর্বতের সন্তান। এ পথে সে বুনো বেড়ালের মতোই সাবলীল। কিন্তু অলিভিয়া? সে বেচারি রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিল। অলিভিয়া মাঝে মধ্যেই টের পাচ্ছিল একটা সবল বাহুর আকর্ষণ তাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওই সাহায্যটুকু না পেলে এ যাত্রা তার কোনওদিন শেষ হত না হয়তো। অচেনা লোকটার দুর্বার শক্তিকে সে আর ঘেন্নার চোখে দেখছিল না। ওই লৌহমুষ্টির আড়ালে কেমন যেন প্রতিরক্ষার আশ্বাস খুঁজে পেয়েছিল পলাতকা মেয়েটি।
অবশেষে চূড়ায় পৌঁছল ওরা দুজনে। সমুদ্রের হাওয়ায় ভিজল ওদের চুলের রাশি। পায়ের কাছ থেকেই ঢালু শুরু। প্রায় তিনশো থেকে চারশো ফুট নিচে গভীর বনভূমি জটাজুটের মতন গিয়ে পৌঁছেছে বেলাভূমিতে। দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি ফেরালে সমস্ত দ্বীপটাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। ডিম্বাকৃতি একখানা দর্পন যেন। ঢালু ধারগুলো একেবারে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। যেদিকে দু-চোখ যায়, সুনিবিড় নীলিমার বিস্তার। শান্ত। সমাহিত। দিগন্তের দিকে স্বপ্নালু অবচেনতময় মিলিয়ে যাওয়া।
“সমুদ্র শান্ত, জলপথে বেরিয়ে পড়লে হয় না?” অলিভিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
কোনান সমুদ্রের ভিজে হাওয়া গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে ছিল ব্রোঞ্জের প্রতিকৃতির মতন। সে উত্তরের দিকে তর্জনী নির্দেশ করল। সে দিকে তাকাল মেয়েটি। মনোযোগ দিয়ে দেখল। একটুকরো শ্বেতবর্ণ কণিকা। সুদূরে ভেসে আছে সঘন কুয়াশার জালে।
“কী ওটা?”
“জাহাজের পাল—”
“হারকেনিয়ার?”
“এতদূর থেকে বলা যায় নাকি?”
“ওরা এখানে নোঙর ফেলবে আর তারপর আমাদের খুঁজতে তল্লাশি চালাবে—”
অলিভিয়া আঁতকে উঠল।
“আমার সন্দেহ আছে সে ব্যাপারে। ওরা উত্তর দিক থেকে আসছে যখন, তখন আমাদের ধরাটা ওদের উদ্দেশ্য হতেই পারে না। ওরা অন্য কারণে থেমেছে এখানে। তবে কারণ যাই হোক না কেন, গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকাটা আমাদের পক্ষে সবচাইতে নিরাপদ। এরা বড়জোর জলদস্যু হতে পারে। অথবা হারকেনিয়ার জলবাহিনী, যারা উত্তর-বিজয় সম্পন্ন করে ঘরে ফিরছে। সে ক্ষেত্রে ওরা যেদিক থেকে আসছে, আমাদের পালাতে হবে ঠিক সেই দিকেই। সে ক্ষেত্রে আজ রাতেই ওরা এই দ্বীপ ছাড়িয়ে চলে যাবে অনেক দূর। ওরা যতক্ষণ এ জায়গা ছেড়ে যাচ্ছে ততক্ষণ আমাদের সমুদ্রযাত্রা স্থগিত রাখাই সমীচীন।”
“তাহলে তো এই দ্বীপেই আমাদের রাত কাটাতে হবে!”
অলিভিয়া কেঁপে উঠল।
“হুম, সেটাই নিরাপদ—”
“তাহলে এই পাথুরে বিছানাতেই ঘুমাতে হবে দেখছি—”
যোদ্ধা মাথা নাড়াল। স্থির-চিত্রের মতন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজির দিকে চেয়ে রইল সে। ঘন সবুজ শরীর থেকে অসংখ্য শিকড়ের জাল যেন এই শৃঙ্গটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
“এখানে বড় বেশি গাছপালা। তার চাইতে প্রাসাদের ভগ্নস্তূপটাই রাত কাটানোর পক্ষে নিরাপদ।”
অলিভিয়া প্রতিবাদে চেঁচিয়ে উঠল।
“কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করবে না ওখানে,” কোনান সঙ্গিনীকে আশ্বস্ত করতে চাইল, “যে আমাদের লক্ষ করে পাথর ছুড়েছিল সে আমাদের পিছু নেয়নি এখানে। তা ছাড়া ওই প্রাসাদে যে অন্য কোনও ভয়াল প্রাণীর বাস আছে, তারও তো কোনও প্রমাণ নেই। তুমি কোমল-তনু রাজকন্যে। সেবা আর যত্নে অভ্যস্ত। এই পাথুরে শয্যায় হিমের প্রাদুর্ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারো। আমি পাথরের কোলে মানুষ। আমি উলঙ্গ হয়ে তুষারশয্যায় আরামে ঘুমোতে পারি। কিন্তু সে কি আর তোমার পক্ষে সম্ভব?”
অলিভিয়া অসহায়। নিমরাজি হয়ে তাকে কোনানের নির্দেশ মানতে হল। শৃঙ্গ থেকে নেমে সেই বিষণ্ণ বিপজ্জনক সবুজ পথটা পেরিয়ে তারা পৌঁছল ভগ্নস্তূপে। এবার অবশ্য আগের মতন আলোর প্রাচুর্য নেই। বরং সূয্যিমামা দিগন্তের কাছে অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নিঃশব্দে। ফলগুলোকে পাওয়া গেল আবার। সেগুলো দিয়েই রাতের ভোজ সম্পন্ন হল। মিটল তেষ্টাও।
রাত নামল ঝুপ করে। গাঢ় নীলচে আকাশে শ্বেতবর্ণের তারকা ছড়িয়ে। কোনান প্রাসাদের ধংসাবশেষে পা রাখল। সঙ্গে অনিচ্ছুক অলিভিয়া। মূর্তিগুলোর শীতল ক্রূর দৃষ্টিতে তার শরীরে শিহরণ জাগছিল। নক্ষত্রের আলোয় কক্ষের অন্ধকার দূর হয়নি একটুও। মেয়েটা তাই প্রতিকৃতিগুলোকে দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু ওদের নিঃশব্দে অপেক্ষারত অস্তিত্বকে প্রতিটি অনুভূতির তন্ত্রীতে উপলব্ধি করছিল মেয়েটা। অপেক্ষা— বহু শতাব্দীর অপেক্ষা।
কোনান দু-হাত ভরে গাছের পাতা এনেছিল। ওগুলো দিয়েই অলিভিয়ার শয্যা রচিত হল। মেয়েটা সেখানে মাথা ঠেকাল বটে তবে শান্তি পেল না। যেন একটা বিষধর সাপের গর্তে সে আশ্রয় নিয়েছে এই গভীর নিকষ নিশীথে।
অলিভিয়ার দুশ্চিন্তা কোনানকে মোটেও স্পর্শ করেনি। সিমেরিয়ার যোদ্ধা অলিভিয়ার কাছটিতেই বসেছিল। পিঠটা দেয়ালে ঠেকান, পায়ের ওপর নগ্ন তরবারি। অন্ধকারে তার চোখদুটো জ্বলছিল চিতাবাঘের মতন।
“নিশ্চিন্তে ঘুমাও,” কোনান বলল, “নেকড়ের মতন পাতলা ঘুম আমার। আমাকে না জাগিয়ে কেউ এই ঘরে পা পর্যন্ত রাখতে পারবে না।”
অলিভিয়া নিরুত্তর। পাতার শয্যা থেকে সে একমনে সেই মুখগুলোকে খুঁজছিল যারা অন্ধকারে অদৃশ্য থেকে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে একমনে। অলিভিয়া ভাবছিল আর অবাক হচ্ছিল। কেমন করে সে একজন বর্বর যোদ্ধার সঙ্গে এতটা পথ পাড়ি দিল? যে জাতের মানুষগুলোর নির্মম কাঠিন্য আর হিংস্র আচরণের গল্প আশৈশব সে শুনে এসেছে তাদেরই একজন আজ তার রক্ষাকর্তা! লোকটা ভয়ানক হিংস্র। নিষ্ঠুর। অথচ তার প্রতিটি আচরণে আত্মীয়তার পরিচয় পেয়েছে সে। লোকটার জ্বলন্ত চোখের মণিতে সে আগুন দেখেছে। কিন্তু কোনও ক্ষতি করেনি সে। বরং তার ওপর সমস্ত রকমের লাঞ্ছনা চালিয়েছে সেই মানুষটি যাকে কিনা মানুষ সভ্য বলে ভাবত। একটা আলগা আবেশ তার শিথিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল একটু একটু করে। নিদ্রার সফেন সমুদ্রে ডুবে গেল মেয়েটা। শুধু তার কুসুম কোমল শরীরে কোনানের বলিষ্ঠ স্পর্শের স্মৃতি ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে জেগে রইল তার চিত্তে।
২
অলিভিয়া স্বপ্ন দেখছিল। সে স্বপ্নের মধ্যে একখানা গুপ্ত বিপজ্জনক সম্ভাবনা ওঁৎ পেতে ছিল। ঠিক যেমন ফুলের বর্ণাঢ্যে সেজে ওঠা উদ্যানে কালো গোখরো লুকিয়ে থাকে। অধীর অপেক্ষায় মোচড়াতে থাকে বিষ উগরে দেবে বলে। বিচ্ছিন্ন বিখন্ডিত স্বপ্ন। বর্ণময়। অর্থহীন। ধীরে ধীরে অবশ্য ওই অর্থহীন খণ্ডিত চিত্রগুলোই স্ফটিকের মতন দানা বাঁধতে শুরু করল। উন্মাদ আতঙ্কের চেহারা নিচ্ছিল স্বপ্নটা। দানবীয় প্রস্তরখণ্ডে মোড়া এই ভগ্নস্তূপ ছিল সেই দুঃস্বপ্নের প্রেক্ষাপট।
স্বপ্নে একখানা প্রকাণ্ড ঘর দেখতে পাচ্ছিল অলিভিয়া। সে ঘরের ছাদখানা সুকঠিন স্তম্ভের ওপরে ভর করে দাঁড়িয়ে ছিল। স্তম্ভগুলোর চারদিকে সবুজ-লাল টিয়াপাখি দল উড়ে বেড়াচ্ছিল। ঘরের মধ্যে অজস্র কৃষ্ণবর্ণ ঈগল-মুখ যোদ্ধা। ওরা কৃশাঙ্গ নয় কেউই। তবে ওদের পোশাক কিংবা অস্ত্র— কোনটাই অলিভিয়ার চেনাশোনার বৃত্তে ছিল না।
এরকমই একটা স্তম্ভের সঙ্গে বাঁধা ছিল একজন বন্দি। তাকে ঘিরে যোদ্ধাদের দলটা ঠেলাঠেলি করছিল। বন্দি একজন কৃশতনু শ্বেতাঙ্গ তরুণ। তার শ্বেতস্ফটিক ভ্রূ-যুগলের ওপরে স্বর্ণাভ কেশদাম। তরুণের সৌন্দর্য অপার্থিব। জীবন্ত মর্মরের বুকে খোদাই করা দৈব স্বপ্নের মতন অবিনশ্বর তার রূপ-বৈভব।
তাকে নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি হচ্ছিল যোদ্ধাদের মধ্যে। অচেনা ভাষায় তাকে নিরন্তর অপমান করছিল ওরা, অপবাদ দিচ্ছিল, খোঁচাচ্ছিল। নগ্ন তরুণ যন্ত্রণায় মোচড়াচ্ছিল। তার উরু বেয়ে ঝরে পড়ছিল রক্তস্রোত, মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছিল। তার যন্ত্রণায় মোড়া আর্তি ঘরের দেয়ালে দেয়ালে যেন এক অবর্ণনীয় পাপের কাহিনি খোদাই করে যাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। এরপর সেই তরুণ মাথার ওপরে জেগে থাকা ছাদের দিকে মুখ তুলে অজানা কোনও একজনা’র নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠল। মরিয়া হয়ে ডাকল কারো নাম ধরে। কালো হাতে ধরা একটি ছুরিকা মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার কণ্ঠনালী লক্ষ করে। আর্তনাদ নীরব হল। তরুণের সোনালি মাথাটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
মৃত তরুণের আর্তনাদের প্রত্যুত্তরেই যেন ঐশ্বরিক রথের চাকার দুর্দান্ত শব্দ শুনতে পাওয়া গেল ঘরের মধ্যে। বাতাস ফুঁড়ে যেন উদয় হলেন একজন দেব-পুরুষ। মানুষের মতন দেখতে তাঁকে অবশ্যই, তবে কোনও নশ্বর মানুষের অমন রূপের ঐশ্বর্য দেখেনি অলিভিয়া। মৃত তরুণের সঙ্গে আশ্চর্য মিল আবির্ভূত দেব-পুরুষের। তবে যে মানবিক কমনীয়তা ছিল তরুণের দেহভঙ্গিতে, সে সব একেবারেই অনুপস্থিত এই আগন্তুকের শরীরে। ইনি কঠোর, নিঠুর।
কৃষ্ণদেহী যোদ্ধাদের ভিড় ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। ওদের চোখে ত্রাস আর আতঙ্কের আগুন। এক হাত তুলে আগন্তুক অভিশাপ দিলেন। তাঁর উচ্চারিত শব্দগুলো যেন কক্ষ আর অলিন্দের মধ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বজ্র নির্ঘোষের মতন।
যোদ্ধারা সহসা যেন নেশায় পাওয়া মানুষদের মতন টলমলিয়ে পিছিয়ে গেল। দু-ধারের দেয়াল বরাবর সার বেঁধে দাঁড়াল ওরা। আগন্তুক মহাপুরুষের কঠোর অধরযুগল থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এল এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ—
“ইয়াগকুলান ইয়োক থা, জুথাল্লা!”
সেই বজ্রনির্ঘোষের অভিঘাতে কৃষ্ণকায় সৈনিকদের শরীর অবশ ও প্রস্তরীভূত হল। ওদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে জড়িয়ে ধরল এক আশ্চর্য অচলায়তন, এক আতঙ্কের নাগপাশ। আগন্তুক মৃত তরুণকে স্পর্শ করলেন। তার বন্ধন ছিন্ন হল। শবদেহকে বুকে জড়িয়ে ফেরার পথ ধরলেন তিনি। তবে প্রত্যাগমনের আগে নজর ফেরালেন পাষাণ-সৈনিকদের দিকে। নিঃশব্দে তর্জনী নির্দেশ করলেন আকাশের বুকে ফুটে ওঠা বিম্বোষ্ঠি চন্দ্রিমার দিকে।
সৈনিকেরা সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষারত প্রতিকৃতি, যারা কোনও এক কালে মানুষ ছিল…
অলিভিয়ার ঘুম ভাঙল। ডালপালা আর পাতার শয্যায় উঠে বসল সে। অলিভিয়া ঘামছিল রীতিমতো। নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও তার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল পরিষ্কার। সে চঞ্চল হরিণীর মতন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল চারদিকে। কোনান দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমচ্ছিল অকাতরে। তার মাথাটা প্রশস্ত বুকের ওপর হেলে পড়েছে। চাঁদের রুপোলী আভা ছাদের ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল অন্ধকার কক্ষের মেঝেতে। সেখানে রুপোলী রেখার কারুকার্য তৈরি হয়েছে চন্দ্রালোকের বৈভবে। আধিভৌতিক অপ্রাকৃত আলোক-জালে অলিভিয়া দেখতে পাচ্ছিল ওদের। শ্যামল আবছায়া শরীর, উদগ্র চাহনি, অপেক্ষমাণ দেহভঙ্গি— অলিভিয়া অনুভব করতে পারছিল প্রস্তর-সৈনিকদের শীতল উপস্থিতি। উত্তেজনায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল তার।
ও কী? কিছু নড়ল মনে হয়! চাঁদের আলোয় যে ছায়াজাল তৈরি হয়েছিল সেখানে নড়াচড়ার আভাস অনুভব করল অলিভিয়া। আতঙ্কে শরীর আড়ষ্ট হয়ে এল মেয়েটার। যেখানে শুধু মৃত্যুময় স্থবিরতা থাকার কথা সেখানে হঠাৎ গতিময়তা? ধীর কম্পন, কালো অঙ্গের মুচড়ে ওঠা— একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ছিটকে এল অলিভিয়ার ঠোঁট গলে, এতক্ষণ যেন এক দুর্নিবার শৃঙ্খল তাকে বেঁধে রেখেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে, এবার সে মুক্তি পেল। তার চিৎকারে কোনান দাঁত খিচিয়ে তরবারি হাতে উঠে দাঁড়াল ক্ষিপ্রগতিতে।
“মূর্তি! মূর্তিগুলো সব একে একে জীবন ফিরে পাচ্ছে—”
কথাগুলো বলেই সে এক ছুটে দেয়ালের ফাটলের মধ্যে দিয়ে কক্ষের বাইরে এসে পড়ল। লতাপাতা, ঝোপঝাড় দুই পায়ে দলে মেয়েটা ছুটল অন্ধের মতন। আতঙ্কের আবেশে সে এমন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল যে কখন একজোড়া কঠিন বাহু তার গতিরোধ করে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে সে বুঝতে পারেনি। সে অবশ্য ওই সবল আকর্ষণের বিরুদ্ধে সাময়িক লড়াই করেছিল, তবে পরিচিত গলাখানা চিনতে পেরে সে চোখ মেলে চাইল। কোনান। তার কণ্ঠস্বর অলিভিয়ার ভয়ের কুয়াশা পেরিয়ে তার হৃদয়ে ধাক্কা দিয়েছে। মেয়েটা লড়াই থামাল। কোনান চন্দ্রলোকে দাঁড়িয়ে রইল বিভ্রান্ত হয়ে।
“ক্রমের দিব্যি, তুমি কোনও দুঃস্বপ্ন দেখেছ নাকি?”
কোনানের কণ্ঠস্বর যেন অপরিচিত ঠেকল তার কাছে। শব্দটা যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল। মেয়েটা দু-হাতে কোনানের বলিষ্ঠ গলা জড়িয়ে ধরল। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠল সে।
“ওরা কোথায়? নিশ্চয় আমাদের পিছু নিয়েছে শয়তানগুলো—”
“কেউ নেই কোত্থাও—”
কোনানের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
অলিভিয়া বসেই রইল। তার বাহুবন্ধনে কোনান আবদ্ধ তখনও। উন্মাদ আবেগে ভাসতে ভাসতে মেয়েটা দ্বীপের দক্ষিণ দিকে চলে এসেছিল। একটুখানি গেলেই ঢালুপথটা আত্মসমর্পণ করেছে বনময় ছায়ার হাতে। ওদের প্রেক্ষাপটে জেগে ছিল প্রাসাদের ধংসাবশেষ। জেগে ছিল ভয়ানক কোনও প্রেতের মতন।
“তুমি দেখতে পাওনি ওদের? ওই মূর্তিগুলো— ওরা জীবন্ত হয়ে উঠছিল, ওদের হাতগুলো নড়ছিল, অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলছিল নেকড়ের মতো—”
“না, দেখিনি—” বর্বর যোদ্ধা অস্বস্তি ঢেকে উত্তর দিল, “আসলে একটু বেশিই নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। বহুদিন পর এমন করে ঘুমোবার সুযোগ জুটেছিল, তাই নিজেকে আর জাগিয়ে রাখতে পারিনি। তবুও বলবো, আমায় না জাগিয়ে কেউই ওই ঘরে ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না।”
“কেউ ঢুকতে পারবে না!” মেয়েটা পাগলের মতন হেসে উঠল, “ওরা তো ওখানেই ছিল! হে মিত্রা, আমরা ওই শয়তানগুলোর মাঝেই নিশ্চিন্তে নিদ্রা গিয়েছিলাম, যেমন করে নির্বোধ ভেড়ার দল কসাইখানার মাঝখানে ঘুমিয়ে থাকে, ঠিক তেমনি—”
“তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না!” কোনান অধৈর্য হয়ে উঠল, “তোমার চিৎকার শুনেই চোখ মেলে চাইলাম আর কোনও কিছু বোঝার আগেই দেখলাম তুমি দেয়ালের ফোকর গলে ছুটে পালাচ্ছ। তোমার যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তক্ষুনি তোমার পিছু নিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি দুঃস্বপ্নের ঘোরে এমন করছ—”
“হ্যাঁ, দেখেছি! দুঃস্বপ্নই দেখেছি! কিন্তু সত্যিটা স্বপ্নের চাইতেও ভয়ানক। শোনো তবে—”
অলিভিয়া সমস্ত কিছুই বলল। স্বপ্নে দেখা ভয়ানক আখ্যান বিস্তারিতভাবে শোনাল সঙ্গীকে।
কোনান শুনল মন দিয়ে। সভ্য মানুষের প্রথাগত অবিশ্বাস তার চরিত্রে নেই। তার জনজাতির পুরাকথায় শুধুই ভূত-প্রেত-অপদেবতা-ডাইনির প্রাধান্য। অলিভিয়ার কথন শেষ হবার পরেও তাই সে নিরুত্তর বসে ছিল। আনমনে হাতের তরবারিটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সে।
“আহত বন্দিকে দেখতে হুবহু আগন্তুকের মতন দেখতে ছিল?”
কোনান অবশেষে প্রশ্ন করল।
“পুরো বাপের মুখ পেয়েছে ছেলেটা,” মেয়েটা উত্তর দিল তারপর দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলে উঠল, “মনুষ্য জাতির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্মিলনে যদি কখনও কোনও সন্তানের জন্ম হয় তবে তাকে যেমন দেখতে হবে ঠিক তেমনি ওই তরুণ আর আগন্তুক মহাপুরুষের মুখের মিল। আমাদের পুরাকথায় কিন্তু পুরা-দেবতা আর নশ্বর মানবীর মিলনের উল্লেখ আছে।”
“কারা সেই দেবতা?” কোনান বিড়বিড় করল।
“নাম-গোত্রহীন, বিস্মৃত দেব-পুরুষ তাঁরা। আমিও কি ছাই সঠিক জানি নাকি? তাঁরা এখন লুকিয়ে আছেন শান্ত জলাশয়ে, তাঁরা মিলিয়ে গেছেন পর্বতের গোপন কন্দরে, তাঁরা রয়ে গেছেন নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত দিগন্তের ওধারে। আজ ওঁরা মানুষের চাইতেও অস্থির, অশান্ত।”
“কিন্তু ঈশ্বরের অভিশাপে এই শয়তানগুলো যদি প্রস্তরমূর্তিতে পরিণত হবে, তাহলে ওদের ঘুম ভাঙাল কে?”
“চাঁদের আলো। ওই আলোয় মায়া আছে—” মেয়েটার শরীরে কম্পন জাগল, “আগন্তুক চন্দ্রিমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন। তাই তার আলো আকাশের বুকে ফুটে উঠলেই মূর্তিগুলো জেগে ওঠে।”
“কিন্তু ওরা তো আমাদের পিছু নেয়নি।” কোনান স্বগতোক্তি করল, তার চোখদুটো প্রেক্ষাপটে জেগে থাকা ভগ্নস্তূপকে স্পর্শ করে গেল, “আমি ভাবছি আরেকবার ওখানে গিয়ে একটু ভালো করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক—”
“না, না—” কোনানের কবজি হাতের মুঠোয় চেপে ধরে অলিভিয়া আর্তনাদ করে উঠল, “হয়তো চাঁদের আলো ওদের কক্ষের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে। দোহাই তোমার, ওদিকে আর যেও না। ওরা তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। তার চাইতে বরং আমরা সমুদ্রে নৌকা ভাসাই আবার, এই অভিশপ্ত দ্বীপটাকে পিছনে ফেলে পালাই। হারকানিয়ার দুর্বৃত্তগুলো এতক্ষণে নিশ্চয় এই দ্বীপের সীমানা ছেড়ে চলে গিয়েছে—”
অলিভিয়ার মিনতি কোনানের সংকল্পে চিড় ধরিয়েছিল। অদম্য কৌতূহল আর অন্ধ-বিশ্বাস— এই দুইয়ের দোলায় দুলছিল তার বিচারবুদ্ধি। অস্থি-চর্ম সর্বস্ব শত্রু, তাদের সংখ্যা অসীম হলেও, কোনান তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে পিছপা হবে না। কিন্তু অপদেবতাদের সামান্যতম উল্লেখই তার মনের মধ্যে ভয়ের কৃষ্ণ-করাল ছায়ামূর্তিগুলো নড়ে চড়ে উঠত প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতন। অচেনা শক্তির প্রতি এই অদম্য সমীহ— তাদের বর্বর সমাজের ঐতিহ্য।
মেয়েটার হাত ধরে কোনান তাই চলল নিচের বনভূমিকে উদ্দেশ্য করে। যেখানে পাতায় পাতায় কানাকানি, যেখানে নিদ্রার আবেশে হঠাৎ হঠাৎ করে ডেকে উঠছে নাম-না-জানা পাখির দল। পথে পথে ঘন বনানীর সঘন ছায়াশরীর। কোনান অবশ্য গভীর বনপথ এড়িয়ে চলছিল। তার ত্রস্ত দৃষ্টি বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল চারদিক। মাঝে মাঝে মাথার ওপরে ঝুলে থাকা ডালপালার ঝুরিগুলোকেও সে দেখে নিচ্ছিল আড়চোখে। দ্রুত কিন্তু সাবধানী পদক্ষেপ তার। মেয়েটার কোমরে কোনানের সবল বাহুপাশ এমন কঠিনভাবে চেপে বসেছিল যেন হেঁটে নয়, সে উড়ে চলেছে। দুজনেই মৌন অবশ্য। মেয়েটার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দটুকুই যা শোনা যাচ্ছিল। আর শোনা যাচ্ছিল ঘাস লতাপাতায় তার পায়ের আলতো স্পর্শের ক্ষীণ শব্দ। অবশেষে অরণ্যের পথ শেষ করে ওরা এসে পৌঁছল বেলাভূমিতে। চাঁদের নির্মল জ্যোৎস্নায় জলাশয়টা তখন গলিত রুপোলী আলোয় সেজে উঠেছে।
“খানকতক ফল আনলে হত,” কোনান বিড়বিড় করে বলল, “অবশ্য শিগগিরিই এরকম আরও একখানা দ্বীপে পৌঁছে যাওয়া যাবে। ভোর হতে এখনও ঢের বাকি—”
কোনানের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হল। গাছের কাণ্ডের সঙ্গে দড়িটা এখনও বাঁধা আছে, তবে তার অপর প্রান্তে নৌকাটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জলের মধ্যে থেকে উঁকি মারছে তার ডগাটা।
অলিভিয়ার ঠোঁটের ফাঁক গলে একটা রুদ্ধ তীক্ষ্ণ আর্তি বাতাসে মিলিয়ে গেল। কোনান দ্রুত জঙ্গলের দিকে ফিরে চাইল। জঙ্গলটাও যেন তার দিকে ভ্রূকুটি করে প্রত্যুত্তর দিল। রাতচরা পাখিদের ডাক একদম স্তব্ধ। বাতাসের গতি রুদ্ধ। যেন হাওয়ার গতিপথ ওই ঘন ডালপালার মধ্যে মুখ বুজে গুমরে গুমরে উঠছে। আর সেই হতাশ যন্ত্রণায় গাছের কয়েকটা পাতা যেন দুলে উঠল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বনবিড়ালের ক্ষিপ্রতায় অলিভিয়াকে কোলে নিয়ে দৌড় শুরু করল কোনান। ছায়ার ভিড়ের মধ্যে সে ছুটল। সে ছুটল প্রেতের মতন। একটা আশ্চর্য শব্দ ওদের ফেলে আসা গতিপথে ভেসে এল। পাতার গায়ে কাঁপুনি জাগানো এক বিচিত্র শব্দ ওদের অনুসরণ করতে লাগল। প্রতিটি মুহূর্তে ওই ভয়াল শব্দটা ওদের কাছে এগিয়ে আসছিল। এমন সময় হঠাৎ বৃক্ষরাজির চাঁদোয়া সরে গেল ওদের মাথার ওপর থেকে। চাঁদের আলোর বিচ্ছুরণ ঠিকরে পড়ল আশীর্বাদের মতন। ন্যাড়া চড়াই ধরে কোনান ছুটল শৃঙ্গের দিকে।
চূড়ায় পৌঁছে কোনান অলিভিয়াকে মাটিতে বসিয়ে দিল সযত্নে। তারপর ফেলে আসা ভয়াল আরণ্যক পথটার দিকে চেয়ে রইল। ছায়াঘেরা রহস্যময় বনপথটাকে মনোযোগ দিয়ে জরিপ করল সে। পাতাগুলো যেন সহসা বাতাসের দোলায় দুলে উঠেই থেমে গেল। ঝাঁক বাঁধা এলোমেলো চুলের রাশি নাড়িয়ে কোনান মৃদু গর্জে উঠল। মেয়েটি ভয়ার্ত শিশুর মতন হামাগুড়ি দিয়ে এসে দাঁড়াল তার পায়ের কাছটায়। আতঙ্কে অবশ অলিভিয়া চোখ তুলে চাইল তার সঙ্গীর দিকে।
“এবার কী হবে আমাদের?” মেয়েটা ফিসফিসিয়ে উঠল কোনানের কানের কাছে।
“খাদের ধারটায় আমাদের পৌঁছতেই হবে,” মেয়েটিকে কোলে তুলে কোনান উত্তর দিল, “ভোরবেলায় কাঠের ভেলা তৈরি করে তাতেই পাড়ি জমাবো সমুদ্রের বুকে। তারপর দেখা যাবে কপালে কী লেখা আছে—”
“ও-ও-রা বোধহয় আমাদের নৌকাটাকে ভাঙেনি, তাই না?”
প্রশ্নের চাইতে উত্তরের নিশ্চয়তা ছিল অলিভিয়ার কণ্ঠস্বরে।
মৌন সম্মতিতে গম্ভীরমুখে মাথা নাড়াল কোনান।
চন্দ্রালোকে বিধৌত সমতল। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানী। তবে ভগ্নস্তূপের অভিশপ্ত ছায়াটার দিকে তাকিয়ে অলিভিয়া আবার আতঙ্কে ডুবল। শরীর ভিজল ঘামে। কোনও কালো ছায়া অবশ্য ওই পাষাণপুরি থেকে বেরিয়ে আসেনি। অবশেষে একটা এবড়োখেবড়ো জায়গায় এসে পৌঁছল ওরা। কোনান দ্বিধাগ্রস্তভাবে সেখানেই আশ্রয় নেবার সিদ্ধান্ত নিল।
“এবার শুয়ে পড় দেখি, যতটা সম্ভব ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করো।” কোনান মেয়েটিকে আশ্বাস দিল, “আমি জেগে পাহারা দিচ্ছি।”
মেয়েটা ঘুমোল না। তার ক্লান্ত দৃষ্টি বারবার ছুঁয়ে গেল কৃষ্ণকালো ছায়াময় ভগ্নস্তূপটাকে। ছুঁয়ে গেল দুঃসহ আতঙ্কে মোড়া বনবীথিকে। তারপর কখন যেন তারাগুলো মলিন হতে হতে মুছে গেল আকাশের পট থেকে। পুব দিগন্তে সাদার আভাস জাগল। ঘাসের ডগায় শিশিরের বিন্দুগুলো ঝকমকিয়ে উঠল। ভোরের কমলা আলোয় যেন ধরিত্রীর বুকে আগুনের পরশ লাগল।
জড়তায় মাখামাখি হয়ে উঠে বসল অলিভিয়া। তার মন খালি ফিরে ফিরে যাচ্ছিল গতরাতের ঘটনাবহুল মুহূর্তগুলোর দিকে। সূর্যের আলো কিছু স্মৃতিকে ক্লান্তিকর দুঃস্বপ্নের মত দূরে ঠেলে দিয়েছে বটে, তবে তাদের রেশ এখনও স্নায়ুতে স্নায়ুতে জেগে আছে বিলক্ষণ। এমন সময় কোনান হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এগিয়ে এল। যে ক-টা বাক্য সে উচ্চারণ করল, তাতে অলিভিয়ার শরীরে বিদ্যুতের স্ফুরণ জাগল যেন।
“ভোর হবার একটু আগেই আমি কাঠের ঠকঠকানির শব্দ শুনেছি। দড়িদড়া টানাটানি, দাঁড়ের ঠোকাঠুকি— একটা আস্ত জাহাজ নোঙ্গর ফেলেছে নিচের দিকে। গতকাল বোধহয় ঠিক এই জাহাজটাকেই দূর থেকে দেখেছিলাম। আমাদের আবার ওপরের শৃঙ্গে পৌঁছতে হবে। ওপর থেকে ওদের গতিবিধি লক্ষ রাখাটা এই মুহূর্তে খুব জরুরি—”
আবার উত্তরণ। আবার সেই শৃঙ্গ। সেখানেই উঁচু পাথরের স্তূপের আড়াল নিয়ে ওরা দুজনায় আভূমি শুয়ে শুয়ে নজর রাখল অনাহূত অতিথিদের ওপর। তাদের সন্দেহ সত্যি। পশ্চিমের গাছগাছালিতে মোড়া শ্যামল বনভূমির আড়ালে একটা রঙিন মাস্তুল উঁকি মারছে!
“পালের হাল-হকিকত দেখে হারকেনিয়ার জাহাজ বলে মনে হচ্ছে, তবে জাহাজের মাঝি মাল্লারা—”
সমবেত কণ্ঠস্বর ভেসে এল এবার। শুধু তাই নয়, পশ্চিমের চড়াই ধরে এগিয়ে আসা লোকগুলোকে দেখতে পেল ওরা। আগন্তুকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাক-বিতণ্ডায় ব্যস্ত। কোন দিকে যাওয়া যায়, সেটা নিয়ে বিস্তর কথা চালাচালি হচ্ছে ওদের মধ্যে। ওদের সঙ্গে নানাবিধ অস্ত্র, চিত্র-বিচিত্র তরবারির সম্ভার। উচ্চকিত অভদ্র কথাবার্তার ধরন ধারণ। তর্জার শেষে ওদের দলটা ভগ্নস্তূপের দিকে পা বাড়াল।
“জলদস্যু!” একটা শুকনো হাসি কোনানের মুখে লেগে রইল, “ব্যাটাচ্ছেলেরা হারকেনিয়ার জাহাজ দখল করে এইখানে উপস্থিত হয়েছে। জলদি এইখানে লুকিয়ে পড়ো। যতক্ষণ না আমি আসছি ওদের নজর এড়িয়ে থাকার চেষ্টা কোরো, বুঝলে?”
পাথরের আড়ালে মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখে যাবার আগে কোনান বলল, “কুত্তাগুলোর সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। যদি আমার পরিকল্পনা সফল হয় তাহলে ওদের জাহাজে চেপেই পালাবার পথ খুঁজে নেওয়া যাবে। আর যদি না ফিরি, তবে যতক্ষণ না ওরা এই দ্বীপ ছেড়ে যায় ততক্ষণ গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। এদের মতন হিংস্র পশু কিন্তু এই গোটা দ্বীপ খুঁজলেও পাবে না।”
অলিভিয়ার অনিচ্ছুক আলিঙ্গন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনান ঢালুপথে নিজেকে হারাল।
গোপন আস্তানা থেকে ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে অলিভিয়া দেখতে পাচ্ছিল তার সঙ্গীর কার্যকলাপ। দস্যুগুলো ততক্ষণে খাদের পাদদেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। কোনান তখনই পাথরের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করল। মুখোমুখি দাঁড়াল ওদের। তার হাতে উদ্যত তরবারি। তীক্ষ্ণ ভয়ার্ত চিৎকার ছুড়ে ওরা প্রথমে চমকে উঠল। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এল কোনানের দিকে। প্রায় সত্তর জন হবে দস্যুরা। নানা জাতের মানুষ তারা। ওদের কেউ কথ, কেউ আবার জামোরিয়ার অধিবাসী, কারোর ঠিকানা ব্রাইথোনিয়া, কেউ আবার এসেছে কোরিন্থিয়া কিংবা সেমাইট থেকে। ওদের হাবভাবেই জংলী পরিচয় প্রকট। সকলের চামড়াতেই গরম লোহার পোড়া দাগ স্পষ্ট। কারো কান কাটা, কারোর নাক খুবলে নিয়েছে কেউ, কারোর চোখে অন্ধকার খোঁদল। কেউ হয়তো ফাঁসিকাঠের মায়া ত্যাগ করে পালিয়েছে। কেউ পালিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। লোকগুলো অর্ধনগ্ন। তবে যতটুকু পরনে আছে সেগুলো মহার্ঘ্য বেশভূষা। তবে তাতে কালিঝুলি আর রক্তের মলিন দাগ লেগে রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে রুপোলী অঙ্গসজ্জাও। নাকে নথ, কানে দুল— লোকগুলোর বেশবাস একেবারে উৎকট।
ওই বিচিত্র মানুষের বিচ্ছিন্ন ভিড়টার মুখোমুখি কোনান। একাকী। তার বলবান ঋজু দেহসৌষ্ঠব ওদের সামনে পর্বতের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অবিচল স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
“এই কে রে তুই?”
“আমি সিমেরিয়া নিবাসী কোনান—”
যেন সিংহ গর্জে উঠল হঠাৎ।
“মুক্তিযোদ্ধাদের একজন দলছুট সৈনিক আমি, শোণিত-সংঘের জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তোমাদের দলপতি কোথায়?”
“ইশতারের দিব্যি, আমিই এই সংঘের নেতা—”
একটা গমগমে গলা বেজে উঠল। সেই সঙ্গে এগিয়ে এল একজন অতিকায় মানুষ। রাজকীয় চাল তার। দৈত্যটার ঊর্ধ্বাঙ্গ উলঙ্গ। তবে একজোড়া সরু কাপড়ের ফালি দিয়ে তার কুঁজোর মতন ভুঁড়ি আর চওড়া কোমরবন্ধ দিয়ে তার পরনের মসলিনের সুদীর্ঘ পাৎলুনকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ন্যাড়ামুণ্ড। কিন্তু একখানা লম্বা ঝুঁটি রয়েছে সেখানে। লোকটার মোটা গোঁফের প্রান্তদুটো ইঁদুরের গর্তের মতন মুখের দু-পাশ দিয়ে নেমে এসেছে থুতনির দিকে। পায়ে তার শুঁড়ওয়ালা সবজে জুতো। সেমাইটদের বৈশিষ্ট্য। লোকটার হাতে একখানা সুদীর্ঘ সোজা তরবারি।
কোনান চোখ পাকিয়ে চাইল এবং তারপরেই গর্জে উঠল।
“হায় রে ক্রম, এ যে খোরসার সার্গিয়াস!”
“হ্যাঁ, আমিই বটে,” দৈত্যের গলা বেজে উঠল মেঘমন্দ্রস্বরে। লোকটার কুঁতকুঁতে চোখদুটো ঘৃণায় চকচক করে উঠল। “ভেবেছিস ভুলে গেছি? সে গুড়ে বালি! শত্রুকে ভুলে যাবার বান্দা নয় এই সার্গিয়াস। দ্যাখ, আজ তোকে কেমন করে পাহাড়ে ঝুলিয়ে তোর চামড়া উপড়ে নিই। এই, কে কোথায় আছিস, ধর শয়তানটাকে—”
“হ্যাঁ, পাঠিয়ে দে তোর পোষা কুত্তাগুলোকে। পেটমোটা অপদার্থ কাপুরুষ কোথাকার!” কোনান মুখ কুঁচকে টিটকিরি ছুড়ল শত্রুর উদ্দেশে, “কথদের মধ্যে জন্ম নেওয়া ইতর তুই, দেখি তোর দৌড় কদ্দূর—”
“আমায় ভিতু বললি হতভাগা?” অপমানে লোকটার চওড়া মুখটা কালো হয়ে উঠল “অস্ত্র হাতে প্রস্তুত থাক, আজ যদি তোর হৃৎপিণ্ড উপড়ে না ফেলেছি—”
কয়েক পলকের মধ্যেই দস্যুরা কোনানকে ঘিরে বূহ্য রচনা করে দাঁড়াল। ওদের চোখগুলো জ্বলছিল। রক্তের গন্ধ পাওয়া হিংস্র শ্বাপদের মতন ওরা জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছিল। ওদিকে প্রস্তরখন্ডের আড়াল থেকে সমস্ত কিছুই দেখতে পাচ্ছিল অলিভিয়া। দুর্দম উত্তেজনায় তার নখের ডগা ডুবে যাচ্ছেল হাতের তালুতে। সে বিপদের আভাস পাচ্ছিল।
বিনা আনুষ্ঠানিকতেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সার্গিয়াস হিংস্র বন-বেড়ালের মতন ধেয়ে গেল শত্রুর দিকে। ক্ষিপ্র, সবল আক্রমণ। তরবারি চালাতে চালাতে চোয়াল শক্ত করে সে প্রতিদ্বন্দ্বীকে গাল দিচ্ছিল। কোনান অবশ্য নীরব। সরু চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে সার্গিয়াসের প্রতিটি পদক্ষেপকে জরিপ করছিল। তবে ওর শান্ত চোখের মণি দুটোয় যেন উন্মুক্ত আগুনের লেলিহান শিখা নাচানাচি করে বেড়াচ্ছিল।
কথ নিবাসী দৈত্যাকৃতি যোদ্ধা গালি দেওয়া বন্ধ করল এক সময়। দম বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। তাই শুধুমাত্র তরবারির সংঘাত, পায়ের পাতার ক্ষিপ্র নড়াচড়া, শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘন ঘন ওঠাপড়ার শব্দই শোনা যাচ্ছিল তখন। তরবারির ফলাদুটো বাতাস কেটে ঘূর্ণির মতন নেচে নেচে উঠছিল। প্রভাতের প্রথম কিরণে শ্বেতাগ্নির মতন ঝলসে উঠছিল ওদের ধাতব শরীর। প্রতিটি প্রত্যাঘাতে দুই যোদ্ধা ছিটকে যাচ্ছিল, আবার দ্বিগুণ শক্তিতে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল পরস্পরের ওপর। সার্গিয়াস পিছু হঠতে শুরু করেছিল। অস্ত্রবিদ্যায় দক্ষতা ছিল বলেই সে এতক্ষণ কোনানের দুর্দম শক্তি আর দুর্নিবার গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পেরেছে।
সংঘর্ষের প্রাবল্য বাড়ল। তারপরেই ধাতুর উচ্চকিত ধ্বনি শোনা গেল। শুনতে পাওয়া গেল ইস্পাতের ফলার ওপর দিয়ে আরেকটা ইস্পাতের ফলার গড়িয়ে যাবার শব্দও। একটা দমবন্ধকরা গোঙানিও শোনা গেল। কোনানের তরবারির ডগাটা যখন সার্গিয়াসের অতিকায় শরীরকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল, একটা কর্কশ আর্তনাদের প্রতিধ্বনি উঠল দস্যুদের ভিড় থেকে। সে শব্দ যেন ভোরের বাতাসকে ফালা ফালা করে দিয়ে গেল। সার্গিয়াসের দু-কাঁধের মাঝখানে একটা ক্ষতের চিহ্ন এঁকে গেল কোনানের অসির ধারাল ডগাটা। ধাক্কা সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে ভূমিশয্যা নিল দস্যুদলের নেতা সার্গিয়াস, তার চারদিকে রক্তসমুদ্র। সে নিথর, তবে তার চওড়া হাতটা তখনও কাঁপছিল।
হতবাক দস্যুদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল কোনান।
“এই দেখ, কুত্তার বাচ্চারা, তোদের নেতাকে কেমন নরকের দরজা দেখলাম,” কোনান সিংহের মতন গর্জন করে উঠল। “এইবার বল, তোদের শোণিত-সংঘের নিয়ম কানুন তোদের কী নিদান দিচ্ছে?”
কেউ উত্তর দেবার আগেই বার্থিয়ার এক ইঁদুরমুখো দস্যু আড়াল থেকে গুলতি ছুড়ল কোনানকে উদ্দেশ করে। ঢিলটা তিরের বেগে আঘাত হানল সিমেরিয়ার যোদ্ধার কপালে। কোনান সে আঘাতেই জ্ঞান হারাল। অতিকায় বৃক্ষ যেমন কুঠারের আঘাতে সশব্দে ভূপাতিত হয় ঠিক তেমনি সে-ও রক্তধারায় মাখামাখি হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অলিভিয়া পাথরের খণ্ডগুলোকে দু-হাতে চেপে ধরে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করল। দৃশ্যপট সবই যেন তার চোখের সামনে দুলে উঠল। আহত রক্তাক্ত যোদ্ধা মাটিতে অচেতন পড়ে আছে অসহায়ভাবে— অন্ধকারে ডুবে যাবার আগে দৃশ্যটা গেঁথে রইল মেয়েটার হৃদয়পটে।
আনন্দের আতিশয্যে ইঁদুর-মুখো নেচে উঠল, উন্মুক্ত ছোরা হাতে দৌড়ে গেল কোনানের বুকে আঘাত হানবে বলে। কিন্তু কৃশকায় আরেক দস্যু তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল।
“ইতর কোথাকার, শোণিত-সংঘের নিয়ম ভাঙবি নাকি তুই?”
শীর্ণদেহী কোরিন্থিয়ার অধিবাসী চেঁচিয়ে উঠল।
“কোনও নিয়ম ভাঙা হয়নি—”
ইঁদুর-মুখো ঝাঁঝিয়ে উঠল।
“অরাতিয়াস, হতচ্ছাড়া ইবলিশের বাচ্চা! যে লোকটার প্রাণ নিতে যাচ্ছিলিস, নিয়মানুযায়ী সেই লোকটা এখন আমাদের নেতা, বুঝলি কুকুরের পো?”
“মোটেই না! ও আমাদের কেউ না। ও বহিরাগত। আমাদের বন্ধু হবার যোগ্যতাই নেই ওর। শুধু সার্গিয়াসকে মেরেছে বলেই আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে দেব নাকি ওকে? আমাদের মধ্যে থেকে কেউ যদি ওস্তাদকে নিকেশ করত, তা হলে আমি চুপচাপ তাকে নেতা বলে মেনে নিতাম। হুঁহ—”
লোকটা ক্ষিপ্ত প্রতিবাদ জানাল।
“কিন্তু লোকটা আমাদের সঙ্গী হতে চেয়েছিল,” শীর্ণদেহী উত্তর দিল, “সবাই শুনেছে সে কথা—”
ঝগড়াঝাঁটি শুরু হল। বাদ প্রতিবাদে বনভূমি মুখরিত। কেউ অরাতিয়াসের পক্ষ নিল, কেউ ইভানোস নামের শীর্ণদেহী লোকটার দলে নাম লেখালো। গালাগালি আর কটুকাটব্যের ঝড় উঠল। হাতাহাতি গুঁতোগুঁতিও শুরু হল। সবার হাত অস্ত্রের হাতল ধরার জন্য নিশপিসিয়ে উঠল।
অবশেষে একজন সেমাইট হইহল্লার মধ্যেই গলা উঁচিয়ে প্রশ্নটা করে বসল।
“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু একটা মৃতদেহ নিয়ে আমরা শুধুমুধু ঝগড়া করে মরছি কেন?”
“লোকটা মরেনি,” শীর্ণদেহী কোনানের শরীরটাকে পর্যবেক্ষণ করে উত্তর দিল, “হঠাৎ ধাক্কায় বেহুঁশ হয়ে পড়েছে খালি।”
এ উত্তরেও সন্তুষ্ট নয় কেউ। তাই আবার গোল বাঁধল। এর মধ্যেই ইঁদুরমুখো লোকটা বারবার হতচেতন কোনানকে আঘাত করতে চাইছিল। তরবারি হাতে তাকে যেন তেন প্রকারেণ ঠেকিয়ে রেখেছিল শীর্ণকায় লোকটা। অলিভিয়া বুঝতে পারছিল, লোকটার প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেঁকার নয়। অরাতিয়াস নামের লোকটার গলায় গলা মেলাচ্ছে ওদের অনেকেই। ওরা সার্গিয়াসের সহযোদ্ধা, আনুগত্য এত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারেনি দস্যুরা। আরও কিছুক্ষণ হই-হট্টগোলের পর একটা সিদ্ধান্তে এল দস্যুরা। কোনানকে আপাতত বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হবে তাদের সঙ্গে। পরে সময় সুযোগ বুঝে সকলের মতামত নিয়ে তবেই তার শাস্তি ঠিক করা যাবে।
কোনানের জ্ঞান ফিরছিল। চামড়ার দড়িদড়ায় রীতিমতো আবদ্ধ সে। চারজন দস্যু কাঁধে তুলে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল বাকিদের সঙ্গে দল বেঁধে। ভারী শরীরটাকে নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ, অনুযোগ আর শাপশাপান্তের অন্ত ছিল না। দুর্বৃত্তগুলো একযোগে চলছিল ভগ্নস্তূপের দিকে। পিছনে উন্মুক্ত রণাঙ্গনে সার্গিয়াসের রক্তাপ্লুত মৃতদেহটা পড়ে রইল অযত্নে।
শিলাখণ্ডের গোপন আস্তানায় অলিভিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিল। এমন দুর্যোগের ঘনঘটায় সে স্থবির হয়ে পড়েছিল। দুর্বৃত্তগুলো যখন সোল্লাসে তার রক্ষাকর্তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অসহায় অলিভিয়া তখন প্রস্তর শয্যায় আত্মগোপন করেছিল। এ ছাড়া তার করার কী-ই বা ছিল?
কতক্ষণ যে সে পাথরের আবডালে লুকিয়ে ছিল, অলিভিয়া জানে না। তার চোখের সমানেই বন্দিকে টেনেটুনে দস্যুরা প্রাসাদের ভগ্নাবশেষে আশ্রয় নিল। ঝাঁকে ঝাঁকে ওরা প্রাসাদে ঢুকছিল আর বেরোচ্ছিল। ওদের সমবেত হট্টগোলে পরিত্যক্ত কক্ষগুলো মুখর হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের মধ্যে একটা দল বেরিয়ে পড়ল হঠাৎ। সমতল জায়গাটা পেরিয়ে ছুটল ঘন অরণ্যের দিকে। মৃত নেতার দৈত্যাকার শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে ওপরে তুলল ওরা। সম্ভবত সর্গিয়াসের নশ্বর দেহটাকে তারা ওপর থেকে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে সলিল সমাধি দেবে। আরেক দল দস্যু ততক্ষণে গাছ কাটতে শুরু করে দিয়েছে। কাঠ কেটে আগুন জ্বালাবার রসদ জোগাড়ে ব্যস্ত ওরা। অলিভিয়া ওদের চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিল। যদিও এত দূর থেকে সে সবের অর্থোদ্ধার করা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। ওদিকে কয়েক জনের পদশব্দ ভেসে এল গাছগাছালির ভেতর থেকে। মদ আর আর খাবারের বস্তা ঘাড়ে ওরা চলছিল ভারবাহী গাধার মতন। প্রতি মুহূর্তে অশ্রাব্য গালাগালি ছুড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল লোকগুলো।
এ সমস্ত কোলাহলের মধ্যে অলিভিয়ার মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছিল একেবারে। চিন্তাভাবনায় জড়তা আর শৈথিল্য অনুভব করছিল মেয়েটা।
ক্লান্ত। বিপন্ন। অরক্ষিতা। এই মুহূর্তে ওই ঋজুদেহী বলবান বর্বর যোদ্ধার সবল বাহুর প্রতিরক্ষার অভাবটা মর্মে মর্মে টের পাচ্ছিল সে। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! সম্রাটের সুন্দরী কন্যা আজ এক অপরিচিত হিংস্র যোদ্ধার সহ-অভিযাত্রী! নিজের জনজাতির ওপরে ঘৃণা জাগল তার মনে। তার বাপ, শাহ আমরুথ— এঁরা সকলেই তো সভ্য মানুষ বলে বড়াই করতেন। অথচ ওদের মতন সভ্যরাই তাকে সবচাইতে বেশি নিপীড়নের শৃঙ্খলে পিষেছে। নিঃস্বার্থভাবে কেউই তাকে দয়া দেখায়নি। কোনান একমাত্র ব্যতিক্রম। সে নিরাপত্তা দিয়েছে তাকে। প্রতি মুহূর্তে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। অথচ কিছুই চায়নি তার পরিবর্তে। মেয়েটা দুঃখে আর হতাশায় কেঁদে ফেলল তাই। আর তখনই দূর থেকে ভেসে এল অসভ্য দুর্বৃত্তদের কোলাহল। অলিভিয়া ভয়ে কুঁকড়ে উঠল। তার কোনও বিপদ হবে না তো?
তমসাময় ভগ্নস্তূপের দিকে চোখ ফেরাল অলিভিয়া। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছায়ামূর্তিগুলো জড়াজড়ি করে টলমল পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল নিচের বনভূমির দিকে। ওই প্রাসাদের অন্ধকারে যে সৈনিকদের অবয়ব কাল রাতে দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করেছিল তাকে, তাদেরকে তবুও অলীক বলা যেতে পারে। কিন্তু ছায়ানিবিড় অরণ্যপথে যে অদৃশ্য শয়তান তাদের পিছু নিয়েছিল, তাকে তো নিজের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিল সে। কোনানকে কী ওরা মেরে ফেলেছে? নাকি বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরই সঙ্গে? প্রশ্নগুলো অস্বস্তির জালে জড়িয়ে ফেলছিল তাকে। সে নিরুপায়। তার সামনে দুটি মাত্র পথ খোলা আছে এখন। অশান্ত সমুদ্রের অসভ্য দুর্বৃত্তদের হাতে ধরা দেওয়া অথবা অপদেবতার অভিশাপে মোড়া এই নিঃসঙ্গ দ্বীপে একলা রাত্রি যাপন। কোনটা বেশি ভয়াবহ?
আতঙ্কের ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই ঢেউয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে অলিভিয়ার চোখের সামনে দৃষ্টিপট দুলে উঠল সহসা। পা কেঁপে গেল। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তার অবচেতন দেহখানি।
৩
অলিভিয়ার জ্ঞান ফিরল। সূর্যটা তখন পশ্চিম দিগন্তের খুব কাছে আকাশের বুকে দোল খাচ্ছিল। মৃদু বাতাসে ভর করে দস্যুদের বিক্ষিপ্ত চিৎকার চেঁচামেচি আর অশ্লীল গানের কলি পৌঁছে যাচ্ছিল তার কানে। সাবধানে উঠে বসে মেয়েটা চোখ মেলে চাইল সামনের দিকে। আগুনের কুণ্ড জ্বলছে প্রাসাদের ভগ্নস্তূপের বাইরে। দুর্বৃত্তগুলো দল বেঁধে তার চারপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এক দঙ্গল দস্যু ভারী কিছু একটা টেনেটুনে প্রাসাদের বাইরে বের করে আনল। বন্দি। কোনান নিশ্চয়। অলিভিয়ার হৃৎপিণ্ড উত্তাল হল। ওরা বন্দিকে দেয়ালের সঙ্গে বাঁধল। তারপর হাত-পা ছুড়ে ঝগড়া করল। অস্ত্র উঁচিয়ে কিছুক্ষণ পরস্পরকে শাসাল। তারপর আবার হ্যাঁচড়-প্যাঁচোড় করে বন্দিকে টেনে টেনে প্রাসাদের অন্ধকারে বিলীন হল। এ সবের পরে আকণ্ঠ মদ্যপানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল লোকগুলো। এ ব্যাপারে তাদের মতৈক্য অবাক করার মতন।
অলিভিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সিমেরিয়ার যোদ্ধা তাহলে এখনও জীবিত? স্বস্তি পেল সে। এইটুকু তথ্যই তার অন্তরে নতুন আশার জন্ম দিল। জন্ম দিল ইস্পাত-কঠিন সংকল্পের। রাত বাড়লেই সুযোগমতো ওই পাষাণ প্রাকারের অলিন্দে সে পা রাখবে সকলের অগোচরে। কোনানকে মুক্ত করবে শত্রুর থাবা থেকে। প্রয়াস বিফলে গেলে ওদের হাতেই বন্দি হবে সে। দুঃখ নেই তাতে, রক্ষাকর্তার জন্য সে সমস্ত বিপদ নিঃস্বার্থভাবে মাথা পেতে গ্রহণ করবে।
ভাবনাচিন্তাগুলোকে সঙ্গে নিয়েই মেয়েটা খাবার খুঁজতে উদ্যত হল। অনেক বাদাম গাছ চতুর্দিকে। ওগুলো দিয়েই উদরপূর্তি হল তার। গতকালের পর থেকে কোনও কিছু দাঁতে কাটার সময় সুযোগ মেলেনি তার। তাই ক্ষুধার অনুভূতিটা তার সমস্ত স্নায়ুকে একেবারে দখল করে বসেছিল। এ সবের মধ্যেও একটা চোরা অস্বস্তি তাকে বিব্রত করছিল। কেউ পিছন থেকে তার গতিবিধি লক্ষ করছে নাকি? গোপনে, লুকিয়ে কেউ কি তার ওপর নজর রাখছে? অলিভিয়া মাথা ঘুরিয়ে দেখল। কেউ নেই কোত্থাও। সন্দেহ হল তার। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিকে ছুটে গিয়ে সে খাদের দিকে চোখ বোলাল অলিভিয়া। সূর্যাস্তের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে ঘন জঙ্গলের সবুজ ঢেউয়ে। সেখানেও কেউ নেই। ওই খাদ থেকে কেউ তাকে দেখবে, সেটা অসম্ভব। এমনকি খাদের ধারে এসে দাঁড়ালেও অত দূর থেকে কেউ তার অস্তিত্ব টের পাবে না। অলিভিয়া জানত সে কথা। তবু ওই সঘন অরণ্যের আড়ালে একজোড়া জ্বলন্ত চোখের আগুনে স্পর্শ সে টের পাচ্ছিল বেমালুম। কেউ ওখানে লুকিয়ে আছে। জীবিত এবং সচেতন কেউ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। ভয়ে অলিভিয়ার গলা শুকিয়ে গেল।
চুপি চুপি নিজের গোপন আস্তানায় ফিরে এল অলিভিয়া। পাথরের আড়ালে শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে। ভগ্নস্তূপের দিকে চেয়ে রইল শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে। অবশেষে রাতের আকাশ থেকে একসময় কালো অন্ধকার ঝুপ করে নেমে পড়ল মাটিতে। অসভ্য দস্যুগুলোর ছায়াগুলোকে ঢেকে ফেলল নিকষ তমসায়। অলিভিয়া অবশ্য নিভু নিভু আগুনের শিখা আর তার চারদিকে টলোমলো পায়ে নড়তে চড়তে থাকা প্রতিকৃতিগুলোকে দেখে ওদের অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা করে ফেলছিল।
অবশেষে সে উঠে দাঁড়াল। মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। কোনানকে মুক্ত করার এর চাইতে ভালো সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। তবে সে কাজে হাত দেবার আগে সে আরেকবার এসে পৌঁছল উত্তরের খাদটার সামনে। দৃষ্টি প্রসারিত করে সে অরণ্যভূমিকে মনোযোগ দিয়ে দেখল। আর তখনই তার হৃৎপিণ্ড যেন হিমশীতল শৈত্যে অবশ হয়ে গেল সহসা।
অনতিদূরেই ঘন অন্ধকারে কিছু একটা নড়ে উঠল। বনভূমির ছায়া থেকে কে যেন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। ধীরপায়ে সে এগিয়ে আসছে চড়াই ধরে। অস্পষ্ট অবয়ব। নিরাকার আবছায়া। আতঙ্কে অধীর হল অলিভিয়া। একটা অসহায় আর্তি উঠে এল তার কণ্ঠনালী বেয়ে। অনেক কষ্টে তাকে সম্বরণ করে অলিভিয়া পিছু ফিরল। ছুটে গেল দক্ষিণ দিকে।
ছায়াঘেরা উৎরাইয়ের পথটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন ছিল মেয়েটার কাছে। সে পড়ছিল। উঠছিল। ধারালো পাথরের টুকরোগুলোকে আঁকড়ে ধরে সে নামছিল মরিয়া হয়ে। কোনান নেই। সে থাকলে এই পথটুকু অলিভিয়া নিমেষে পার করে দিত তার বাহুবন্ধনকে আশ্রয় করে। কোনান বন্দি। তাই এই পথটাই তার পরীক্ষা নিল। সে আহত। ক্ষত বিক্ষত। তার কোমল অঙ্গে আঘাতের পরশ আজ। বর্বর লোকটার অভাব আজ বড় বাজছিল তার অন্তরে।
ভয় হচ্ছিল তার। তবে শুধু ভয়ই নয়। তার মনের মধ্যে আবেগের একটা অন্ধ ঘূর্ণি মাথা খুঁড়ে মরছিল আর তার সমস্ত চিন্তাভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছিল।
অবতরণের পথটা সীমাহীন মনে হলেও একটা সময় সে পথও শেষ হল। ঘাসের ডগায় পায়ের পাতা ঠেকল অলিভিয়ার। উত্তেজনা আর আবেগের বশে সে ছুটল আগুনের কুণ্ডের দিকে। সেখানে রাত্রির হৃদপিণ্ডের মতন জ্বলছিল আগুনের লালচে শিখাগুলো। তার পেছনেই পাথরের সরে সরে যাবার দুর্দান্ত শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল সে। কে আসছে ধেয়ে? সেই ছায়ামানুষ? কে সেই অতিকায় বিভীষিকা, যার চলার পথে অমন করে ছড়িয়ে পড়ে ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন? মেয়েটা ভয়ে আকুল হয়ে উঠছিল।
ক্ষিপ্র পদক্ষেপ। মরিয়া প্রচেষ্টা। ভয় চাপা পড়ে যাচ্ছিল কর্মতৎপরতার প্রভাবে। প্রাসাদের কাছটায় পৌঁছনোর অনেক আগেই অলিভিয়ার মন আর মগজ দুটোই দ্বিধার কুয়াশা থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। শরীর যদিও কাঁপছিল ক্লান্তিতে।
সমতলে হামাগুড়ি দিয়ে মেয়েটা এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে। যে ক-টা গাছ দস্যুদের কুড়ুলের উৎপাত এড়িয়ে বেঁচে ছিল, তাদেরই একটার আড়াল নিয়ে সে শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ করল মনোযোগ দিয়ে। নৈশভোজ সমাপ্ত। এবার ওরা মদের পিপেতে হাতলভাঙা কাঠের পাত্র অথবা মণিমুক্তোয় মোড়া পানপাত্র ডুবিয়ে মদিরা তুলছিল আর গলায় ঢালছিল পরমানন্দে। কেউ কেউ ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছিল। নাক ডেকে ঘুমচ্ছিল নিশ্চিন্তে। বাকিরা ওই পোড়ো প্রাসাদে ঠাঁই নিয়েছিল রাতটুকুর জন্য। কিন্তু কোনান কোথায়? অলিভিয়া নিশ্চিত হতে পারছিল না। তাই সে অপেক্ষা করল। পড়ে রইল নিস্তেজ হয়ে। ওদিকে শিশিরের বিন্দুগুলো ঘাসের ডগায় জেগে উঠল। অলিভিয়ার শরীরটুকুকে বাদ দিয়ে তৃণ-প্রান্তরকে কোমল পরশে ডুবিয়ে দিল একেবারে।
ওদিকে দস্যুগুলো আগুন ঘিরে গুলতানি জুড়েছিল। কেউ খিস্তি দিচ্ছিল। কেউ আবার ঝগড়া বিবাদে ব্যস্ত। বাকিরা নিদ্রার ঠাঁই খুঁজতে ভগ্ন প্রাসাদের কোলে হারিয়ে গিয়েছিল।
অলিভিয়া ওদের ওপর নজর রেখেছিল। অপেক্ষায় অধীর মেয়েটার সমস্ত স্নায়ুগুলো বীণার তারের মতন টান টান হয়ে উঠেছিল। কোনও এক অদৃশ্য ভয়াল জীব পিছন থেকে তার গতিবিধি লক্ষ করছে শিকারির মতন— এ কথাটা ভাবতেই তার দুটো কাঁধের মধ্যে দিয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। দুর্বৃত্তগুলো অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ছে ততক্ষণে। আগুনের চারপাশে জড়দেহের মতন পড়ে ছিল লোকগুলো।
অলিভিয়া সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হচ্ছিল তার। গাছের ফাঁকে উজ্জ্বল গোলকটাকে জ্বলজ্বল করে উঠতে দেখেই তার শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল সহসা। চাঁদ উঠছে আকাশে!
এক বুক শ্বাস নিয়েই মেয়েটা চটজলদি আত্মগোপনের ডেরা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। তার গন্তব্য ভগ্নস্তূপ। তৃণ-শয্যায় শায়িত মাতাল শয়তানদের এড়িয়ে এড়িয়ে মেয়েটা ছুটল। সাবধানে। পা টিপে টিপে। তার বুক ঢিব ঢিব করছিল ক্ষণে ক্ষণে। প্রাসাদের অন্দরমহলে দস্যুদের সংখ্যাটা আরও বেশি। ওরা ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে উঠছিল, হাত পা নাড়ছিল। কিন্তু কেউই জেগে ছিল না। সে সুযোগে অলিভিয়া একেবারে মসৃণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। কোনানের চেহারাটা দৃশ্যমান হতেই মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠল। আনন্দের সে অভিব্যক্তি তার ঠোঁটের বাঁধুনি পেরিয়ে বাইরে এল না অবশ্য। সিমেরিয়ার অকুতোভয় যোদ্ধা জেগে ছিল। উঁচু থামের সঙ্গে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিল জলদস্যুর দল। নিভু নিভু আগুনের শিখার প্রতিফলনে অন্ধকারেও তার চোখদুটো জ্বলছিল শ্বাপদের মতন।
কোনান তাকে দেখতে পেয়েছিল ঠিক। অলিভিয়ার পায়ের সাবধানী পদধ্বনি তার কানে পৌঁছে গিয়েছিল ঠিক। প্রাসাদের দেয়ালে যে ফাটল আছে, সেখানেই মেয়েটার অন্ধকার অবয়বকে দিব্যি চিনে নিয়েছিল তার চোখদুটো। তাই একটা বিষণ্ণ হাসি তার কঠিন ঠোঁটজোড়ায় ফুটে উঠেছিল।
কোনানের কাছে পৌঁছতেই মেয়েটা তার গলা জড়িয়ে ধরল। বাহুবন্ধনে বাঁধল বন্দিকে। তার হৃৎপিণ্ডের দুলুনি ছড়িয়ে গেল যোদ্ধার বুকে আত্মগোপন করে থাকা কঠিন হৃদয়ের অন্দরমহলে। দেয়ালের গায়ে যে ফাটলটা এতক্ষণ সকলের যাত্রাপথ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল এখন সে পথ দিয়ে চাঁদের কিরণ প্রবেশ করল প্রাসাদের অন্ধকার কক্ষে। আর তখনই ঘরের বাতাসে যেন অদৃশ্য বিপদের অচেনা ছায়া জেগে উঠল। কোনানের ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে উঠেছিল। আর তাই তার শরীরটাও প্রস্তরের মতন কঠিন হয়ে উঠল। অলিভিয়া নিজেও আঁতকে উঠল নিঃশব্দে। ঘুমকাতুরে দস্যুগুলোর অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। ওরা তখনও নিদ্রাতুর। অলিভিয়া নিচু হয়ে ওদের একজনের কোমর থেকে ছুরি বার করে ত্রস্তহাতে কোনানের বন্ধন খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নৌকার দড়ি ওগুলো। যেমনি মজবুত তেমনি দৃঢ় ওদের বাঁধনি। একেবারে নাবিকদের পোক্ত হাতের শক্ত গেরো। তড়িঘড়ি কাজটা করতে গিয়ে অলিভিয়া হাঁপাচ্ছিল। ওদিকে চন্দ্রিমার ম্লান জ্যোৎস্না প্লাবনের রূপ নিয়ে মেঝের ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসছিল ক্রমশ। আলোর বৃত্ত ক্রমে ক্রমে পৌঁছে যাচ্ছিল অন্ধকারে মোড়া আবলুশ কালো স্থাণু মূর্তিগুলোর পাদদেশের দিকে।
কোনানের হাতদুটো মুক্ত হল অবশেষে। কনুই আর পায়ের বাঁধন অটুট তখনও। অলিভিয়া ভীত চোখে মূর্তিগুলোকে দেখছিল। ওরা নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। কৌতূহলী ক্ষমাহীন চোখে চেয়ে আছে ওদের দিকে। মেয়েটা ভয়ে আকুল হয়ে উঠছিল। তার পায়ের কাছে ঘুমন্ত লোকগুলো নড়েচড়ে উঠল। কেউ কেউ আবার মৃদু গোঙানি ছেড়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। চাঁদের আলো তখন প্রায় মূর্তিদের চরণ স্পর্শ করে ফেলেছে। কোনান এক ঝটকায় হাতের বাঁধন খুলে অলিভিয়ার কাছ থেকে ছুরিটা ছিনিয়ে নিয়ে পায়ের বাঁধনটাও কেটে ফেলল এক কোপে। এক লাফে এগিয়ে এল সে। হাত-পা ছুড়ল। অসাড় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হওয়াটা জরুরি। সেই সুযোগে মেয়েটা তার কাছে এগিয়ে এল। সে কাঁপছিল। ঝড়ের সামনে দিশেহারা গাছের পাতার মতন। কোনও জাদু নাকি? তা না হলে চাঁদের আলোর স্পর্শ পেতেই মূর্তিগুলোর দু-চোখে অমন করে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠছে কেমন করে?
কাছেই অস্ত্রশস্ত্রগুলো পড়ে ছিল। সেখান থেকে নিজের তরবারিটি হাতিয়ে নিয়েই কোনান বনবিড়ালের ক্ষিপ্রতায় অলিভিয়াকে আরেক হাতে ছোঁ মেরে তুলে নিল আলতো যত্নে। তারপর লতায় পাতায় ঢাকা দেয়ালের একটা খোঁদল খুঁজে সে বেরিয়ে এল অভিশপ্ত প্রাসাদের আশ্রয় ছেড়ে।
ওরা দুজনেই নীরব। একটিও শব্দ বিনিময় হয়নি ওদের দুজনের মধ্যে। কোনান মেয়েটাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে জ্যোৎস্না-স্নাত সমতল জায়গাটাকে পেরিয়ে চলল নিঃশব্দে। অলিভিয়ার হাতদুটো বেড় দিয়ে আছে তার ইস্পাতকঠিন ঘাড়টাকে। তার ভ্রমরকৃষ্ণ চুলেঢাকা মাথাটা আলতো আবেশে স্থান খুঁজে নিয়েছে কোনানের কাঁধে। চোখ বুজে ছিল সে। নিরাপত্তার এই সঘন আশ্বাসটুকু বড় ভালো লাগছিল তার।
অলিভিয়ার ভার কাঁধে নিয়ে কোনান ক্ষিপ্রগতিতে ঢালু বেয়ে নেমে চলল। অলিভিয়া চোখ খুলেই আবিষ্কার করল, তারা চলেছে পাহাড়ের ছায়াঘেরা পথ ধরে।
“কেউ একজন এই পথে ওপরে উঠেছিল,” অলিভিয়া ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, “আমি তার পায়ের চাপে পাথর গুঁড়িয়ে যাবার শব্দ শুনেছি—”
“কিচ্ছু করার নেই, এ পথটাই আমাদের মুক্তির একমাত্র উপায়—” কোনান উত্তর দিল।
“আমার এখন ভয় করছে না আর—”
অলিভিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
“আমায় উদ্ধার করতে ওই পাষাণপুরীতে যখন পা রেখেছিলে তুমি, তখনও তো ভয় পাওনি,” কোনান বলল, “ক্রমের দিব্যি, কি একখানা ঘটনাবহুল দিন আজ! কোনওদিন এত ঘ্যানঘ্যানানি আর ঝগড়া শুনিনি বাপু। কান যেন ঝালাপালা হয়ে যাবে। অরতাউস আমার হৃৎপিণ্ড কেটে ফেলবে, কিন্তু ইভানোস মোটেই সেটা হতে দেবে না। সে ব্যাটা আবার অরতাউসকে মনেপ্রাণে ঘেন্না করে। দিনভর দুজনায় তর্জন গর্জন করে মরল। শেষটায় লোকগুলো বিরক্ত হয়ে এত মদ খেল যে আমায় নিয়ে কী করবে সেটা ঠিক করার আগেই একেবারে ভূমিশয্যা নিয়ে ফেলল।”
কোনান থামল হঠাৎ। একেবারে স্থির। চাঁদের আলোয় ব্রোঞ্জের মূর্তি যেন সে। অলিভিয়াকে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে নামিয়ে তাকে আড়াল করে দাঁড়াল। মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে গিয়েও আর্তনাদ করে উঠল।
পর্বতগাত্রের ছায়া সরিয়ে বেরিয়ে এল ‘সে’। প্রকৃতির এক বিকট উপহাস। এক অতিকায় দৈত্য। যার পরিচয়ে লেগে আছে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক শিকড়ের গন্ধ।
মানুষের সঙ্গে বিশেষ তফাৎ নেই তার। তবে চন্দ্রালোকে তার যে মুখচ্ছবি ফুটে উঠছিল তাতে শুধুই জান্তব অভিব্যক্তি। কানদুটো ঘনসন্নিবদ্ধ। নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত। থলথলে মাংসল ঠোঁট। তার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সুদীর্ঘ ধারাল শ্বদন্ত। ভয়ানক প্রাণীটির শরীর ঘন লোমে ঢাকা। ধূসরের সঙ্গে রুপোলী রঙের মাখামাখি। আর সে কারণেই চাঁদের আলোয় প্রাণীটার গোটা দেহ ঝকমক করছিল। জন্তুটার পুরুষ্ট কিন্তু আকৃতিহীন থাবাদুটো মাটির ওপরে ঝুলছিল। বন্দুকের গুলির মতন ছুঁচালো করোটিসহ বাকি ভারী শরীরটা একজোড়া বাঁকানো পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে সব মানুষের মাথা ছাড়িয়ে। তার রোমশ বুক আর চওড়া কাঁধের বিস্তার অবাক করার মতন। অবাক করার মতন ঘের তার হাত আর পায়ের পেশিরও। হাত দুটো যেন আস্ত গাছের গুঁড়ি এক-একটা।
জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া জগৎ চরাচর দুলে উঠল অলিভিয়ার চোখে। এই কি তবে পথের শেষ? এই পর্বতপ্রমাণ অপার্থিব প্রাণীর পাশবিক আস্ফালনের সামনে হেরে যেতে হবে তাদের? তবুও আশায় বুক বেঁধে সে সঙ্গীর দিকে চোখ ফেরাল। কি আশ্চর্য! প্রস্তরমূর্তির মতন ঋজু দেহভঙ্গি নিয়ে রুখে দাঁড়ানো মানুষটার সঙ্গে ওই দানবাকৃতি প্রাণীটার যেন কোনও পার্থক্যই নেই। এ যেন মানুষের সঙ্গে অ-মানুষের লড়াই নয় মোটেই। এ যেন দুই বন্য প্রাণীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। দুজনেই সমান হিংস্র। দুজনেই সমান নির্মম। চকচকে ধারালো শ্বদন্ত খিঁচিয়ে অবশেষে প্রাণীটা ধেয়ে এল।
হাতদুটোকে দু-পাশে ছড়িয়ে বুক চিতিয়ে সে এল। ক্ষিপ্র গতিবেগে। কোনানের নড়াচড়ায় গতির ঠমক এতটাই যে অলিভিয়া নগ্ন চোখে সে সবের তল খুঁজে পেল না বিশেষ। তবে এতটুকু সে দেখেছে নিশ্চিত— কোনান করাল থাবাটাকে এড়িয়ে তার তরবারি চালাতে পেরেছে নিখুঁতভাবে। ধারাল অস্ত্রের ডগাটা বিদ্যুতের মতন ঝকমকিয়ে আছড়ে পড়েছে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটার কাঁধ আর কনুইয়ের মাঝখানে। ঘাসের গালিচায় যেন রক্তের প্লাবন বয়ে গেল। কাটা হাতটা মাটিতে খসে পড়ল। থরথরিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। অন্য হাতটা অবশ্য ততক্ষণে কোনানের চুলের মুঠি ধরে নিয়েছে সুযোগ বুঝে।
কোনানের ভাগ্য ভালো, তার ঘাড়ের পেশি ইস্পাত কঠিন। তা না হলে এক মুহূর্তেই তার মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারত। কোনান তার বাম হাতে প্রাণীটার গলা টিপে ধরেছে। পায়ের ডগা দিয়ে আঘাত করে চলেছে শত্রুর রোমশ পেটে। ভয়ানক হাতাহাতিটা কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও অলিভিয়ার কাছে সেটা কয়েক যুগের অপেক্ষা বলে মনে হচ্ছিল।
প্রাণীটা চুলের মুঠি ছাড়েনি। উদগ্র আকর্ষণে সে কোনানকে টেনে নিচ্ছিল ধারালো দাঁতগুলোর দিকে। নিজেকে বাঁচাতে কোনানও তার বাম হাতের মুঠো আলগা করেনি একটুও। আর তার ডান হাতে ধরা তরবারির ডগাটা মাখনের মধ্যে ছুরির মতন আঘাত হেনে চলেছিল আক্রমণকারীর শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে।
জন্তুটা নিঃশব্দে আঘাতগুলোকে সহ্য করে নিচ্ছিল। ক্ষতের উৎসমুখ থেকে রক্তের ফিনকি ছুটলেও সে কিছুতেই দুর্বল হয়ে পড়ছিল না। কোনানের কঠিন হাত আর পায়ের বাধাকে অসীম শক্তিতে পরাজিত করে ফেলছিল সে। অসহ্য চাপে কোনানের হাত বেঁকে যাচ্ছিল ক্রমশ। লালা মাখানো করাল গ্রাসের অন্ধকূপের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে। এর মধ্যেই কোনানের জ্বলন্ত দৃষ্টি থমকে গেল প্রাণীটার রক্তস্নাত চোখের মণিতে। যোদ্ধা অসহায়ভাবে তরবারি চালাচ্ছিল। শত্রুর শরীরে আঘাত হানার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল তখনও। দাঁতগুলো থেকে যখন তার শরীরটা মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে, ঠিক তখনই জন্তুটার চোয়াল খটাস করে বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। লালার ফেনায় ঢাকা মুখের ভাবে যন্ত্রণায় কুঁচকে ওঠার অভিব্যক্তি দেখতে পেল সে। মৃত্যুযন্ত্রণায় প্রাণীটা কোনানকে ছুড়ে ফেলল ঘাসের ওপর।
অলিভিয়া আতঙ্কে অবশ হয়ে পড়েছিল প্রায়। অপলকে সে চেয়েছিল জন্তুটার দিকে। মৃত্যুযন্ত্রণায় অতিকায় দৈত্যটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল, হাত-পা ছুড়ছিল, ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়ছিল। মানুষের মতন হাবভাব তার। কিন্তু মানুষ নয় সে। কোনানের তরবারি আহত জন্তুটার শরীরে মুখ লুকিয়ে ছিল। শুধু তার হাতলটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। এর মধ্যেই শেষবারের মতন কেঁপে উঠল প্রাণীটা। থেমে গেল তার হৃৎস্পন্দন। নিষ্প্রাণ মৃতদেহটা পড়ে রইল রক্তের সমুদ্রে।
কোনান উঠে দাঁড়াল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পৌঁছল মৃতদেহের কাছে। তার শরীরের সমস্ত পেশি আর হাড়গুলো যেন কেউ দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। সে ব্যথায় কাতর হয়ে মাথায় হাত বোলাল। নিঃশব্দে গালি দিল মৃতের উদ্দেশে। উৎকট প্রাণীটার হাতের মুঠোয় এখনও কোনানের রক্তমাখা চুলের গোছা ধরা আছে।
“ক্রমের দিব্যি, শরীরটাকে যেন ছারখার করে দিয়েছে জন্তুটা। এক দঙ্গল দস্যু পেটানো এর চাইতে অনেক সহজ কাজ। আরেকটু হলেই আমার মাথাটাকে ধড় থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেলত শয়তানটা। এর মধ্যেই মাথার অর্ধেক চুল উপড়ে নিয়েছে হতভাগা!”
কোনান হাঁপাচ্ছিল।
দু-হাতের মুঠোয় হাতল ধরে অমানবিক টানে তরবারির ফলাটাকে দৈত্যটার শরীর থেকে মুক্ত করল কোনান। অলিভিয়া তার হাত চেপে ধরেছিল। কোনানের শরীরের ছায়ায় লুকিয়ে অবাক চোখে খুঁটিয়ে দেখছিল চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকা আশ্চর্য প্রাণীটাকে।
“এ-এ-টা ঠিক কোন ধরনের প্রাণী?”
মেয়েটা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল।
“ধূসর নর-বানর। নির্বোধ কিন্তু মানুষখেকো। পূর্বদিকের বেলাভূমিতে যেখানে পাহাড়ের সীমানা, সেখানেই এদের বাস। এ দ্বীপে যে কেমন করে পৌঁছল বাছাধন, সে কথা জানা নেই। সম্ভবত জোয়ারের জলে ভাসতে ভাসতে এসে পড়েছে কিংবা মূল ভূখণ্ড থেকে ঝড়ের তাণ্ডবে এদিকে এসে উপস্থিত হয়েছে।”
কোনান উত্তর দিল।
“এই সেই প্রাণী যে আমাদের উদ্দেশে পাথর ছুড়ে মেরেছিল?”
“একদম তাই! ঘন অরণ্যে মাথার ওপরে বেঁকে যাওয়া গাছের ডালগুলোকে দেখে ওর স্বরূপ আমি আগেই ধরে ফেলেছিলাম। এরা জঙ্গলের গভীরতম অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। সহজে এদের দেখা পাওয়া যায় না। কেন যে মরতে বনভূমি ছেড়ে ফাঁকা মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কে জানে! তবে সেটাই আমাদের সৌভাগ্য, তা না হলে ওই গাছগাছালির মধ্যে ওকে কিছুতেই মারতে পারতাম না।”
“ও আমার পিছু নিয়েছিল,” অলিভিয়া কেঁপে উঠল, “আমি প্রাণীটাকে পাহাড়ে উঠতে দেখেছি।”
“আদিম প্রবৃত্তি অলিভিয়া। ওরা অন্ধকারের জীব। নিঃশব্দ নিরালা এদের ভারী পছন্দ। সূর্য আর চাঁদের আলোর সঙ্গে এদের শত্রুতা। তাই তো সমতল ছেড়ে পাহাড়ের ছায়াঘেরা জায়গাটা দিয়ে ও ওপরে ওঠার চেষ্টা করছিল।”
“ওরা কি সংখ্যায় অনেক?”
“উঁহু, যদি তাই হত তাহলে নিশ্চয় দস্যুগুলোকে অনেক আগেই ওরা আক্রমণ করে বসত। ওদের শক্তি থাকলেও ওরা সাবধানী। আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও তাই নর-বানরটা অনেকখানি অপেক্ষা করেছে। তোমার শরীরের প্রতি ওর লালসার টান এতটাই বেশি ছিল যে শেষমেশ উপায়ন্তর না দেখে ফাঁকা জায়গাতেই আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসেছে। এ কি—”
যে পথে ওরা দুজন এসেছিল সে পথেই কোনান এগিয়ে গেল চুপিসারে। রাতের অন্ধকার চিরে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছিল একখানা তীক্ষ্ণ আর্তনাদে। শব্দটা আসছিল ভগ্নস্তূপের দিক থেকে। ক্ষণিকের মধ্যেই শুরু হল চিৎকার, চেঁচামেচি আর আর্তনাদের সমবেত কলতান। ওই শব্দের মধ্যে মিশে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানিও। তবে বেশ বোঝা যাচ্ছিল যুদ্ধক্ষেত্র নয়, ও শব্দের উৎস আসলে একটা নির্মম বধ্যভূমি।
কোনান স্থির। অলিভিয়া তার হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। শিউরে শিউরে উঠছিল সে। কলরবের কলকণ্ঠ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। হট্টগোল চলছিল পুরোদমে। সিমেরিয়ার বর্বর যোদ্ধা এর মধ্যেই খাদের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় ভাস্বর গাছগাছালির সামনে পৌঁছল। অলিভিয়ার পা কাঁপছিল। তাই তাকে আগের মতন বাহুবন্ধে বেঁধে সে আগামী যাত্রার প্রস্তুতি নিল। তার সুগঠিত শরীরের আলিঙ্গনে মুখ লুকিয়ে অলিভিয়া অবশেষে ভয়কে ভুলল।
তারপর ওরা চলল আলোকিত বনবীথির বুক চিরে। এবার আর কোনও দ্বিপদ রক্তপিপাসু প্রাণী ওঁৎ পেতে নেই ওখানে। কোনও আবছায়া আতঙ্ক ছিল না তাদের অপেক্ষায়। কয়েকটা পাখি ঘুমের মধ্যেই ডেকে উঠছিল ক্ষীণ স্বরে। বিপদ কেটে গিয়েছিল। আর্তনাদের ত্রাহি রব ততক্ষণে ম্লান হয়ে এসেছে। অস্পষ্ট কলরবকে আর রক্তাক্ত রাতকে পিছনে ফেলে রেখে ওরা এগিয়ে চলল। কাছেই কোথাও টিয়াপাখিটা চেঁচিয়ে উঠল যেন হঠাৎ।
‘ইয়াগকুলান ইয়োক থা, জুথাল্লা!’
ওরা পৌঁছে গিয়েছিল বেলাভূমিতে। সেখানে দেখা মিলল নোঙরবাঁধা জাহাজখানার। তার সাদা পাল জ্যোৎস্নার আলো মেখে হাসছিল মিটিমিটি। আকাশের বুকে রাতভর জেগে থাকা নক্ষত্রগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিল দূর দিগন্তের দিকে।
৪
ভোরের তরল শুভ্র আলোয় ওদের দেখা গেল। দস্যুরা। রক্তাক্ত। ক্ষতবিক্ষত। ক্লান্ত। ঘন জঙ্গলের আড়াল থেকে ওরা ছুটে আসছিল উন্মাদের মতন। বেলাভূমিতে জমায়েত হচ্ছিল সকলে। সর্বসাকুল্যে চুয়াল্লিশ জনের মতন সংখ্যাটা। ভীত, সন্ত্রস্ত, পরাহত। ওরা হাঁপাচ্ছিল। ভয়ানক হতাশায় সমুদ্রের ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল মরিয়া হয়ে। হাত-পা ছুড়ে জাহাজটার দিকে এগোতে চাইছিল দস্যুগুলো। কিন্তু সে পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একজনা।
কোনান। সোনা গলা ধবল আলোয় ভেসে যাওয়া আকাশের কোলে খোদাই করা ছিল তার ঋজু সুঠাম চেহারাটা। জাহাজের গলুইয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। উদ্যত তরবারি হাতে সে স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল দুর্বৃত্তগুলোকে। বাতাসের ঢেউয়ে তার কালো চুলের রাশি এলোমেলো উড়ছিল।
“থামো!” কোনান নির্দেশ দিল। “জাহাজের দিকে আর একটুও এগোবে না। তোমাদের বক্তব্যটা ওখান থেকেই শোনাও দেখি—”
“আমাদের এই জাহাজে ঠাঁই দাও ভাইটি,” কাটা কানের গর্তে আঙুল ঘষতে ঘষতে একজন রোমশ দস্যু বলল, “এ দ্বীপে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না আমরা—”
“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এদিকে পা বাড়িয়েছ তো তরবারির এক কোপে খুলি ফাটিয়ে দেব, কথাটা মনে থাকে যেন!”
কোনানের সংক্ষিপ্ত ঘোষণা।
দস্যুদের সংখ্যা চুয়াল্লিশ। কোনান একা। কিন্তু অভাগাগুলোর লড়াই করার ক্ষমতা যেন কেউ নিংড়ে নিয়েছে একেবারে। তাই ওদের শাসন করার সুযোগ কোনানের হাতেই তুলে দিয়েছে ভবিতব্য।
“আমাদের সঙ্গে নাও ভায়া,” লাল উর্দি পরা এক দুর্বৃত্ত কঁকিয়ে উঠল। অপাঙ্গে পিছনের ভয়াল শান্ত বনানিটাকে দেখে নিল সে। “বিশ্বাস করো, আমরা এতটাই আহত, রক্তাক্ত, ক্লান্ত যে ইচ্ছে থাকলেও তরবারি হাতে তোলবার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই আর, লড়াই করা তো দূরে থাক।”
“আরতাউস নামের কুকুরটা কোথায়?”
কোনান ওদের মুখগুলোকে কড়া চোখে জরিপ করল।
“বাকিদের মতন ও ব্যাটাও অক্কা পেয়েছে। শয়তানের দল রাতের অন্ধকারে আমাদের একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে। ঘুম ভাঙার আগেই আমাদের জনা বারো শক্তপোক্ত যোদ্ধাকে ওরা পেড়ে ফেলেছিল। ওই অভিশপ্ত প্রাসাদে আগুন-চোখো ছায়ারা ঘুরে বেড়ায়। যেমনি ওদের ধারালো শ্বদন্ত, তেমনি ওদের নখরের ধার—”
“খাঁটি কথা বলেছ ভায়া,” আরেকজন বলে উঠল চেঁচিয়ে, “ওরাই এই দ্বীপের মায়াবী আতঙ্ক। ওরাই রাতের অন্ধকারে মূর্তি সেজে আমাদের বোকা বানিয়েছে। ইস্তারের নামে শপথ খাচ্ছি, একটুও সন্দেহ হয়নি আমাদের। তাই তো একেবারে ওদের মধ্যিখানে গিয়েছিলাম আশ্রয় নিতে। সত্যি বলছি, আমরা ভীতু নয় মোটেই। কিন্তু খোদ অন্ধকারের সঙ্গে লড়ব এমন সাধ্য কার আছে বল দেখি? তাই তো পালিয়ে এলাম। ওরা তখন মৃতদেহগুলোকে শেয়ালের মতন ছিঁড়েখুঁড়ে ফর্দাফাই করছিল। আমি নিশ্চিত, শয়তানগুলো এখানেও আমাদের ধাওয়া করবে—”
আরেকজন রুগ্ন দস্যু চেঁচিয়ে উঠল এইবার।
“জাহাজে আমাদের জায়গা দিতেই হবে। তরবারি নিয়েই আমরা জাহাজে উঠব। আমরা সংখ্যায় অনেক। তুমি একাই অনেককে মেরে ফেলতে পারবে, তবুও আমরা কয়েকজনা তো প্রাণে বাঁচব। তারপর?”
“তারপর আমি এই জাহাজে একখানা এত্তবড় গর্ত করে দেব তরবারির এক আঘাতে—” কোনান গম্ভীর মুখে ঘোষণা করল। আর সেই কথা শুনেই দস্যুদের মধ্যে কোলাহল বেঁধে গেল। কোনান নিজেই সেই কোলাহলের ইতি টানল সিংহের গর্জনে।
“হতভাগা, তোদের এই জাহাজে জায়গা দিয়ে নিজের ক্ষতি করব, এমন আহাম্মক আমি? তোরা কুকুরের জাত, সুযোগ বুঝে ঠিক আমার হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলার মতলব করবি। কি, ঠিক কিনা?”
“না, না, একদম নয়,” ওরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, “আমরা সব্বাই বন্ধু! আ-আ-ম-রা সব্বাই সহযাত্রী। সহযোদ্ধা। তুরানের রাজা আমাদের সকলের শত্রু। তাই অন্তর্দ্বন্দ্ব একদম নয়—”
ওদের মরিয়া দৃষ্টি কোনানের গম্ভীর মুখের ওপর থেমে রইল। ওদের সকলের চোখে আশার আলো।
“যদি সত্যিই আমায় বন্ধু ভাবো,” কোনান গর্জে উঠল, “তাহলে শোণিত-সংঘের নিয়ম অনুযায়ী আমি যেহেতু তোমাদের নেতাকে ন্যায়যুদ্ধে হারিয়েছি, তাই তোমাদের নেতৃত্ব দেবার হক একমাত্র আমার। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ আছে নাকি?”
না, নেই। দস্যুদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই। ওরা এতটাই ভীত, সন্ত্রস্ত যে কোনও মতে এই দ্বীপ ছেড়ে যেতে পারলে তারা বাঁচে এবার। কোনানের দৃষ্টি খুঁজে নিল রক্তে ভেজা চেনা মুখটাকে।
“এই যে ইভানো! তুমি আগেরবার আমার পক্ষ নিয়েছিলে। এবার কি আমার দাবি নিয়ে তোমার কোনও আপত্তি আছে?” কোনান জানতে চাইল গর্বিতভাবে।
“মিত্রার দিব্যি, তোমার দাবি একেবারে সমুচিত—”
ইভানো উত্তর দিল। সে দস্যুদের অবস্থাটা বেশ বুঝতে পারছিল। নিজেকে কোনানের কাছের লোক হিসাবে প্রমাণ করতে পারলে বাকিদের ওপর সর্দারি করার সুযোগ আছে। বাকিরাও তাকে খুশি করতে চাইছিল। তাই একযোগে ওরাও গলা মেলাল।
শান্ত অভিশপ্ত অরণ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কৃষ্ণ-ছায়া বাহিনী। অভিশপ্ত দ্বীপ। শীতল মৃত্যুর নিঃশব্দ ঘেরাটোপ। দস্যুরা ভয়ে কাঁপছিল। প্রাণে বাঁচতে ওরা ইভানোর সঙ্গে গলা মেলাল বটে তবে সেই সহমতে উচ্ছ্বাস খুব একটা ছিল না।
“তরবারির হাতল ধরে শপথ নাও—”
কোনানের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
চুয়াল্লিশখানা তরবারি একযোগে কোনানের দিকে উঁচিয়ে ধরল দস্যুরা। কোনানকে নেতা হিসাবে স্বীকার করে নেবার এই তাদের সমবেত অঙ্গীকার।
কোনান হাসল। তরবারিকে কোশবন্ধে স্থান দিল।
“জাহাজে উঠে পড় সাহসী দুর্বৃত্তের দল, হাল ধরো, বৈঠা চালাও সব্বাই—”
অলিভিয়া এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল জাহাজের ডগায়। তাকে দু-হাতে টেনে তুলল সিমেরিয়ার দুর্দান্ত যোদ্ধা।
“আমার কি গতি হবে, প্রভু?”
মেয়েটা হাসল। পরিহাসের লঘু পরশ তার কণ্ঠস্বরে।
“তাই তো, তোমার কি হবে বল দেখি?” কোনান পাল্টা প্রশ্ন করল।
“যে পথে আঁকা হবে তোমার চরণচিহ্ন সে পথেই নিজেকে হারাবো আমি—” অলিভিয়া যোদ্ধার ইস্পাত কঠিন গলাটাকে কোমল বাহুবন্ধনে বেঁধে সোল্লাসে বলে উঠল।
দস্যুদের মধ্যে যেন কাঁপুনি জাগল। ওলিভিয়াকে দেখতে ওদের মধ্যে ঠেলাঠেলি বেঁধে গেল। এমন আগুনে সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা ঢোঁক গিলল বিস্ফারিত চোখে।
“আমাদের জাহাজ চলবে রক্ত আর মৃত্যুর পথ মাড়িয়ে,” কোনান গর্জে উঠল, “এই শান্ত সমুদ্রের বুকে শোণিত-নিশান এঁকে যাবে আমাদের এই রণতরী—”
“সমুদ্রের রং হোক নীল বা লাল- আমরা চলব অবাধ, অনর্গল।” অলিভিয়া আবেগে থরথর কণ্ঠে ঘোষণা করল, “তুমি বর্বর। আমি পরিত্যক্তা। আমরা দুজনেই কুল-গোত্রহীন দুই ভবঘুরে। দুই বাউণ্ডুলে। রহস্যে মোড়া এ ধরাতল আমাদের চারণভূমি। আমায় তোমার সঙ্গে নাও কোনান—”
সমুদ্রের দমকা হওয়ার মতন হেসে উঠল কোনান। দু-হাতে তুলে নিল সে অলিভিয়াকে। পরুষ ঠোঁট ঠেকাল মেয়েটার অধর-পুষ্পে।
“ক্রমের দিব্যি! ইলদিজের রাজার পরনের বসনে আগুনের শিখা এঁকে দেব আমরা। এই ধরাধাম জিতে নেব বাহুবলে। চল বন্ধুরা, এগিয়ে চল। আর অলিভিয়া, সব কিছুর শেষে এই নীল সমুদ্রের সিংহাসনে বসাবো তোমায়। রানীর মুকুট পরাবো তোমার মাথায়। কথা দিলাম—”
জাহাজটা ভেসে চলল এক নতুন অভিযানের সন্ধানে।
***
(‘Sword and Sorcery’ সংক্ষেপে (S&S) হল ফ্যান্টাসি গোত্রের মধ্যে একটি বিশেষ ঘরানা। এখানে নায়কের হাতে থাকে তরবারি আর তার প্রতিপক্ষে থাকে ভয়ানক জাদুকরেরা। এ সব আখ্যানে বীরত্বের সঙ্গে উঠে আসে মন্ত্র, জাদু কিংবা রোমান্সের মৃদু অনুষঙ্গ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গল্প বলার ঢঙে মিশে থাকে অতিনাটকীয়তা। সত্যিকারের পৃথিবীর সাধারণ মানুষের গল্প নয় সে সব। এই গল্পের নায়ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্জয় সাহসী, অকুতোভয়, নির্ভীক। তাই বোধহয় উচ্চতর মার্গের ফ্যান্টাসিতে এই ধারার জায়গা হয়নি তেমন একটা। তবে তাই বলে তার জনপ্রিয়তা লোকসমাজে কম নয় মোটেই। তাহলে এই বিখ্যাত ধারার প্রথম পিতা কে? উত্তর আমাদের সবার জানা। ভদ্রলোকের নাম রবার্ট ই. হাওয়ার্ড (জন্ম: ১৯০৬ – মৃত্যু: ১৯৩৬)। মার্কিন লেখক। এই ধরনের গল্প লিখে তিনি রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন এক সময়। দুর্দান্ত অভিযান, সাহসী নায়ক, সুন্দরী নায়িকা আর সেই সঙ্গে লড়াই, প্রেম, জাদুর অমোঘ ককটেল। রীতিটাকে সম্মান জানাতে আরেকজন মার্কিন শব্দশিল্পী ফ্রিৎজ লেইবের প্রথম হাওয়ার্ডের গল্পগুলোকে ‘Sword and Sorcery’ নামে অভিহিত করলেন। সেই শুরু। এই জনপ্রিয় গল্পের রীতি আজও পাঠকদের কাছে কল্পগল্পের সীমাহীন বিনোদনের সুরাপাত্র হয়ে উঠেছে। রবার্টের সব চাইতে বিখ্যাত চরিত্র ‘কোনান’-কে নিয়ে তৈরি হয়েছে কমিক বুক, গ্রাফিক নভেল এবং একাধিক চলচ্চিত্র। কোনান সিরিজের একটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী গল্প- Shadows in the Moonlight- তারই ভাবানুবাদ এই গল্পটি।)
Tags: অনুবাদ উপন্যাস, ফ্যান্টাসি, রনিন, রবার্ট ই. হাওয়ার্ড, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা