অকালচক্রের কাঁটা
লেখক: মোহাম্মদ সাইফূল ইসলাম
শিল্পী: অঙ্কিতা
অধ্যায় এক
স্থান: মেক্সিকোর সিজুলুব হসপিটাল, সময়: বিকাল ৩টা ৪২, ৫ মে ২০৭৬
হাসপাতালের ছোট্ট কেবিনে একাকী শুয়ে আছে উনিশ বছরের এক তরুণ, শূন্য দৃষ্টি ছাদের দিকে স্থির হয়ে আছে। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে; তরুণের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। সময় ফুরিয়ে এসেছে এটি সে ঠিকঠিক বুঝতে পেরেছে। মৃদু হাসিটি আরও বিস্তৃত হয়, কিছুক্ষণ পরে সেটি অট্টহাসিতে রূপ নেয়। একজন নার্স হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করে। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার জামিল, আপনার কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে? মাথায় যন্ত্রণা কি বেড়েছে খুব?”
“মাথার যন্ত্রণা বাড়লে কি কেউ এভাবে অট্টহাসি হাসতে পারে?” নার্সের অবাক চাহনি উপেক্ষা করে জামিল বলে, “সময়! খুব রহস্যময় আর জটিল জিনিস তাই না, মিস?” জবাবের অপেক্ষা না করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বলে, “দেখেন সময় আমার সাথে কীভাবে বিদ্রুপ করছে! আমার হাতে একদম সময় নেই, যেকোনও সময় আমি মারা যেতে পারি। সত্যি বলতে এখনও যে নিঃশ্বাস নিতে পারছি সেটিই একটা বিস্ময়। আর এই অন্তিম মুহূর্তেই কি না আমি সময়ের সূত্রের সমাধান করে ফেললাম! বিষয়টা খুব মজার না?”
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না; আপনার কি কিছু লাগবে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?” অল্পবয়সি নার্সের কন্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগের ছোঁয়া।
“কেন? সুদর্শন ছেলে দেখলেই মাথায় হাত বুলাতে ইচ্ছে করে?” নার্সের থতমত চেহারা দেখে হেসে আবার বলে, “আরে, এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? একটু মজা করলাম। তুমি কি কষ্ট করে প্রফেসর ড: ইগরকে একটু খবর দেবে? বলবে ব্যাপারটা অতি জরুরি।”
এক ঘণ্টা পর কেবিনে প্রবেশ করেন বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের একজন, প্রফেসর ইগর ভাসিলেভ। বয়স ষাটের কোঠায়, মাথায় চকচকে টাক, টিকালো নাকের আগায় একটি চশমা সবসময় ঝুলে থাকে। অ্যাকাডেমিক জগতে ‘পাগলা ইগর’ নামেই বেশি পরিচিত। সহকর্মীরা বেশ সমীহ করে প্রফেসরকে, তাঁকে নিয়ে গর্বেরও শেষ নেই তাদের। আড়ালে অবশ্য অনেকে আফসোস করে, দুঃখও পায় মনে মনে; গত দশ বছর ধরে ‘গণিতের রাজপুত্র’ হিসাবে খ্যাত এই প্রফেসর অপবিজ্ঞান বলে স্বীকৃত সময় ভ্রমণের গবেষণা নিয়ে পড়ে আছেন।
প্রফেসর ইগরের মন অসম্ভব খারাপ, কিন্তু মুখ হাসি হাসি করে জামিলের সামনে বসে আছেন। “কী খবর, ইয়াং ম্যান? ডাক্তার বলেছে তুমি খুব দ্রুত উন্নতি করছ। অল্প ক’দিনের ভেতর বাসায় চলে যেতে পারবে।”
“স্যার, আমি জানি আমার হাতে সময় নেই; এটা আমি মেনে নিয়েছি। বড়জোর কয়েক সপ্তাহ হাতে আছে। আপনার সময় সমীকরণ প্রোজেক্টের কোনও আপডেট আছে কি?” বিছানায় একটু নড়েচড়ে বলে জামিল।
“চলছে। নতুন কাউকে খুঁজছি আমার সহযোগী হিসাবে কাজ করার জন্য; কিন্তু তেমন আগ্রহী কাউকে পাচ্ছি না। আমি এখনও ভেবে পাই না তোমার মতো মেধাবী ছেলে কেনই বা আমার এই গবেষণায় যুক্ত হয়েছিলে। সে যাক, তুমি এসব নিয়ে একদম চিন্তা করবে না এখন। আমাকে কী যেন বলবে বলে জরুরি খবর পাঠিয়েছিলে?”
“আপনি ব্যস্ত হবেন না স্যার। এখন আর সহযোগী হিসাবে নতুন কাউকে পেতে সমস্যা হবে না।” বেশ রহস্যময় স্বরে বলে জামিল। একটু থেমে উত্তেজনা প্রশমিত করে শান্ত কণ্ঠে বলে, “আমি সময়ের ভ্রমণের সমীকরণের সমাধান করে ফেলেছি। এখন এই প্রজেক্টে কাজ করার জন্যে অনেকেই আগ্রহী হবে।”
এই মাত্র বলা জামিলের কথাগুলোর অনুধাবন করতে কিছুটা সময় নেন প্রফেসর ইগর। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন একেবারে, ঘরের ভেতর পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে; শুধু দু’জন মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ বাতাসে মৃদু কম্পন তৈরি করছে যেন। নীরবতা ভেঙে কিছুক্ষণ পর বলেন, “জামিল, কী বলছ তুমি? কী বলছ?”
মাথার ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন প্রচণ্ড ব্যথায়। বেশ কসরত করে জামিল বলে, “একটু কষ্ট করে স্ক্রিনটা সেট করে দিবেন স্যার?”
প্রফেসর ইগর জামিলের বুকের উপর ছোট গোল একটি চাকতি রেখে টিপ দিয়ে সুইচ অন করে দেন। জামিলের বুকের এক হাত উপরে একটি আলোর অবয়ব ফুটে উঠে; ভার্চুয়াল রাইটিং স্ক্রিন। দ্রুত হাতে একের পর এক সমীকরণ লিখে যাচ্ছে জামিল সেই স্ক্রিনের উপর। কিছুক্ষণ পর বলে, “স্যার, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি মোতাবেক সময় ভ্রমণ সম্ভব নয়। কারণ এই নীতি অনুসারে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনও কণিকার গতি ও অবস্থান নির্ভুলভাবে মাপা অসম্ভব। আমরা যদি অবস্থান বের করি, তবে গতি অনির্দিষ্ট হয়ে যাবে; আবার যদি গতি বের করি তবে অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে যাবে। যদি সময় সময় ভ্রমণ সম্ভব হয়, তবে এই অনিশ্চয়তার নীতি ভুল হয়ে যাবে। কারণ, ধরুন আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনও কণার শুধু বেগ নির্ভুলভাবে পরিমাপ করলাম। তারপর অতীতে গিয়ে ঠিক সেই সময়ে কণিকাটির শুধু অবস্থান বের করলাম। সেই ক্ষেত্রে দুটি ফলাফল সংযুক্ত করলে দেখা যাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা একটি কণার অবস্থান ও বেগ নির্ভুলভাবে নির্নয় করতে পেরেছি। কিন্তু আমরা জানি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি নির্ভুল! তাহলে, উপসংহার হলো, অতীত ভ্রমণ সম্ভব না।”
সম্পূর্ণ বিষয়টি আত্মস্থ করতে কিছুক্ষণ সময় নেন প্রফেসর ইগর। অনিশ্চিত কন্ঠে বলেন, “তার মানে বলতে চাচ্ছ কোয়ান্টাম মেকানিক্স মতে সময় ভ্রমণ সম্ভব নয়?”
“আপনি ঠিক ধরেছেন। ব্যাপারটি এবার ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’ অনুসারেও ব্যাখ্যা করা যাক। এই প্যারাডক্স মতে, আমি যদি অতীতে গিয়ে আমার দাদাকে মেরে ফেলি, তবে আমার বাবার জন্ম হবে না। আমার বাবা অস্তিত্বহীন হয়ে গেলে আমারও অস্তিত্ব নেই হয়ে যাবে। তাহলে আমি কীভাবে সময় ভ্রমণ যন্ত্রে অতীতে গিয়ে দাদাকে হত্যা করলাম? এটি একটি অমীমাংসিত চক্র তৈরি করবে।” প্রফেসরের সাথে কথা বলার সময়ও জামিলের হাত থেমে নেই; সে ক্রমাগত ভার্চুয়াল স্ক্রিনে বড় বড় সমীকরণ লিখে যাচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাথার যন্ত্রণা।
“কিন্তু কিছুক্ষণ আগে তুমি বলেছিলে সময় ভ্রমণের সমীকরণের সমাধান করে ফেলেছ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন প্রফেসর ইগর।
ততক্ষণে জামিলের টাইপ করা শেষ। স্ক্রিন জুড়ে একের পর এক বিশাল আকারের সমীকরণ। শেষের দিকে একটি সমীকরণকে উজ্জ্বল করে নির্দিষ্ট করে জামিল বলে, “এখন এইখানে দেখেন; এই পঞ্চমাত্রিক ভেক্টর সমীকরণে দেখা যাচ্ছে, সময় ভ্রমণ সম্ভব হবে যদি সম্ভাবনার এই রাশিগুলোর গুণফল হাইজেনবার্গের ধ্রুবকের সাথে এই ধ্রুবকের বর্গমূলের গুণফলের সমান হয়। এটিই সময় সমীকরণের সমাধান। দেখেন, এখানে নিকট অতীতের যাওয়া সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। যত দূরের অতীতে যাওয়া যাবে সফল হওয়ার সম্ভাবনা ততই বেড়ে যাবে। তার মানে, আমরা কেবল মাত্র অতীতের এমন একটি সময়েই যেতে পারব যেখান থেকে বর্তমানের উপর আর কোনও প্রভাব ফেলা সম্ভব নয়।”
চোখ বড়বড় করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রফেসর ইগর। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে; নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শুধু বলতে থাকেন, “ওহ! গড। ও গড!” ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী প্রফেসরের মুখে হঠাৎ এমন ঈশ্বরের ডাক শুনে শুধু মুচকি হাসে জামিল।
অনেকক্ষণ সমীকরণগুলোর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থেকে দ্রুত কতগুলো হিসাবে কষেন প্রফেসর ইগর। এখানে দেখা যাচ্ছে, এক কেজি ভরের একটি বস্তুকে তিন লক্ষ বছর অতীতে পাঠাতে আমাদের প্রায় 8.36 x 1020 জুল শক্তির প্রয়োজন, বৃহৎ আকারের একশোটি অ্যাটম বোমার যে শক্তি তার সমান। কিন্তু আমরা যদি ওই বস্তুটিকেই এক মিলিয়ন বছর অতীতে পাঠাতে চাই সেক্ষেত্রে মাত্র একটি মাঝারি আকারের অ্যাটম বোমার পরিমাণ শক্তি দরকার হবে।
প্রফেসর ইগরের হিসাবে দ্রুত নজর বুলিয়ে জামিল বলে, “ঠিক। কিন্তু একশোটি অ্যাটম বোমার মিলিত শক্তিকে এক বিন্দুতে নির্দিষ্ট করা এখনকার প্রযুক্তিতে সম্ভব না, কিন্তু একটির ক্ষেত্রে সম্ভব হতে পারে। এথেকে আর একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছে, আমরা কয়েক মিলিয়ন মিলিয়ন বছর অতীতে গিয়ে প্রাণের বিবর্তনকে কোনওভাবেই প্রভাবিত করতে পারব না। যদি অতীতে গিয়ে বিবর্তনের যে কোনও একটি পর্যায়কে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেই, তবু দেখা যাবে বাটারফ্লাই ইফেক্টের কারণে বর্তমান অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যে কোনও ভাবেই বর্তমান অপরিবর্তিত থাকবে।” মাথাব্যথা এখন অসহ্য পর্যায়ে চলে এসেছে, হালকা খিঁচুনির মতো হচ্ছে জামিলের। হঠাৎ লক্ষ করে ডান নাকের ফুটো দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
প্রফেসর ইগর সমীকরণগুলো দ্রুত সেভ করে স্ক্রিনটিকে বন্ধ করে স্কিনার চাকতিটি পকেটে পুরে নেন। ডাক্তার আর একজন নার্স দৌড়ে ঘরে ঢোকে। তাঁদের নির্দেশ মতো কেবিন থেকে বের হয়ে যেতে হয় তাঁকে। পেছন থেকে জামিল কাতর কণ্ঠে বলে, “আফসোস হচ্ছে, সময় ভ্রমণ নিজের চোখে দেখে যেতে পারলাম না।”
সময় নষ্ট না করে দ্রুত নিজের গবেষণাগারে ফিরে আসেন প্রফেসর। কাজ অনেক, সময় কম। একের পর এক হিসাব করে যাচ্ছেন পাগলের মতো, একাগ্র চিত্তে; আর কোনও দিকে তার খেয়াল নেই। এখন পর্যন্ত সব হিসাব ঠিকঠিক মিলে যাচ্ছে, প্রচণ্ড উত্তেজনা অনুভব করছেন। রাত দুইটার দিকে শেষ হয় তাঁর কাজ, এখন সব ডাটা কম্পিউটারে প্রবেশ করিয়ে ফাইনাল সিমুলেশন শুরু করেছেন; দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে শেষ হতে। হঠাৎ জামিলের কথা মনে পড়তেই হাসপাতালে ফোন করেন। অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন, আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছে। মনটা বিষন্নতায় ভার হয়ে যায় ড: ইগরের, আহারে বেচারা নিজের তত্ত্বের পরিণতি দেখে যেতে পারল না।
ভোর চারটার দিকে হঠাৎ জ্ঞান ফেরে জামিলের। চোখ খুলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে; সমগ্র ইন্দ্রিয় কেন্দ্রীভূত করে কিছু একটা চিন্তা করছে যেন। একজন নার্সকে ডেকে বলে, “জলদি প্রফেসর ইগরকে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলিয়ে দেন।”
“আপনার এ অবস্থায় ফোনে কথা বলে একদম উচিত হবে না, দয়া করে ঘুমোনোর চেষ্টা করুন।” ডিউটি নার্স তাড়া দিয়ে বলে।
“প্লিজ, বিষয়টা এতই জরুরি যে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছি আমরা।” মাথার ভেতর যন্ত্রণা বেড়ে যাচ্ছে জামিলের, “প্লিজ, একদম সময় নেই। আমি শুধু এক মিনিট কথা বলব। বলতে পারেন মৃত্যুর আগে এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।”
কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে মোবাইলে কল দিয়ে প্রফেসরকে ধরিয়ে দেয় আইসিইউ-র ডিউটিরত নার্স।
“হ্যালো স্যার, শুনতে পাচ্ছেন? ভবিষ্যতে মহা বিপর্যয় ডেকে আনবে এই সময় সমীকরণ। দয়া করে এগুলো পাবলিশ করবেন না।” শেষ এসে কণ্ঠে কোনও জোর পায় না জামিল; শেষের কথাগুলো অনেকটা আপন মনেই বলে যায় সে।
প্রফেসর ইগর শুধু ‘ভবিষ্যতে মহা’ এই দুটি শব্দ শুনতে পেরেছেন। তারপর তিনি শুধু,“হ্যালো, হ্যালো জামিল? হ্যালো হ্যালো” করে যাচ্ছেন।
হাত থেকে মোবাইলটি পড়ে যায় জামিলের। চোখের কোণে তখনও জলের ধারা বহমান।
অধ্যায় দুই
স্থান: মেক্সিকো, সিজুলুব ন্যাশনাল ফরেস্ট, সময়: সকাল ৯টা, ১০ মার্চ ২০৮৮
প্রায় একযুগ পার হয়ে গেছে জামিল সময় ভ্রমণের সমীকরণের সমাধান করেছে। আজ সেই সমীকরণের কার্যকারিতা পরখ করা হবে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন প্রফেসর ইগর। বয়সের ভারে কিঞ্চিৎ কুঁজো হয়ে আছেন তিনি। সিজুলুব শহরের এই বনের ভেতর কিছু অংশের গাছ কেটে খোলা মাঠের মতো জায়গা করা হয়ছে। এখানেই বসানো হয়েছে পৃথিবীর প্রথম পরীক্ষামূলক সময় ভ্রমণ যন্ত্র।
চারদিক থেকে চারটি ফিউশন রিঅ্যাক্টর থেকে প্রচণ্ড শক্তিশালী এনার্জি-বিম এক বিন্দুতে মিলিত হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে সেখানে এক বর্গফুটের মতো একটি টাইম পোর্টাল তৈরি হবে। পঞ্চমাত্রা ভেক্টর সমীকরণের চারটি চালককে চারটি এনার্জি বিম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে; পোর্টালটি তৈরি হলে আরেকটি এনার্জি বিম যেটি সময়ের চলক, সেটিকে নিক্ষেপ করা হবে। এই টাইম এনার্জি বিম দিয়েই কালের মান নির্ধারণ করা হবে। পাঁচটি এনার্জি বিমের মিলিত মান হতে হবে, হাইজেনবার্গের ধ্রুবকের সাথে জামিল ধ্রুবকের বর্গমূলের গুণফলের সমান হয়। দুইটি সুপার কম্পিউটার সর্বক্ষণ এর স্থিতাবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে।
লম্বা করে একটি দম নিলেন প্রফেসর ইগর ভাসিলেভ। একবার চোখ বন্ধ করে সাথে সাথে খুলে তাকালে। তাঁর পাশে বসে আছেন সেনাবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড, ডিফেন্স সেক্রেটারি, কয়েকজন সিনিয়র বিজ্ঞানী, সরকারি উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা ও বেশকয়েকজন সাংবাদিক। সকলে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন প্রথম সফল সময় ভ্রমণের পরীক্ষা দেখার জন্যে। প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগছেন প্রফেসর ইগর, শেষ মুহূর্তে আবার কোনও ঝামেলা না হয়ে যায়! বারবার মনে পড়ছে মৃত্যুর ঠিক আগে তাকে ফোন করেছিল জামিল; শুধু ‘ভবিষ্যতে মহা’ শব্দদুটি তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। সে কী বলতে চেয়েছিলো তা আর জানা সম্ভব নয়, অবশ্য বিশ্বের অনেক মেধাবী গণিতবিদ, পদার্থবিদ এই সমীকরণ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করেছে, এখনও করে যাচ্ছে। কেউই তেমন ভুল ধরতে পারেনি। একেবারেই যে কিছু সমালোচনা যে নেই তা নয়। তেমনটা প্রায় সব থিওরির ব্যাপারেই আছে। সেগুলোর জবাব দেওয়ার জন্যেই তো পরীক্ষা। নাহ, সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলেন তিনি মন থেকে।
সবকিছু সেট করা হয়ে গেছে। চট করে সুইচ অন করে দেন প্রফেসর ইগর। সাথে সাথে একটি আলোর ঝলকানিতে চারদিক আলোকিত হয়ে উঠে, চোখে প্রটেক্টর ছিল বলে কারও কোনও ক্ষতি হয়নি। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে যেন সবাই। ঠিকঠিক এক বর্গফুটের মতো ছোট একটি আলোর পোর্টাল তৈরি হয়েছে, যদিও প্রত্যাশা এমনই ছিল, তারপরেও সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম টাইম পোর্টাল দেখে হতবাক উপস্থিত সকলে।
প্রফেসর রেকর্ড করার জন্য বললেন “টাইম পোর্টাল তৈরি হয়েছে, এখন টাইম এনার্জি বিম চালু করা হচ্ছে। সময় তিন মিলিয়ন বছর অতীত।”
টাইম এনার্জি-বিমটি আলোর পর্দার মতো দেখতে পোর্টালের উপর পড়তেই হালকা একটু কেঁপে উঠে যেন সেটি। এখনও পর্যন্ত সব ঠিক আছে। তিন মিলিয়ন বছর অতীতে যাওয়ার প্রথম পোর্টাল তৈরি হয়েছে বলেই আঙুল নাড়িয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করেন প্রফেসর। মুহূর্তেই একজন বিজ্ঞানী ট্রে হাতে পোর্টালের দিকে এগিয়ে যায়; ট্রে এর উপর পাঁচশো গ্রাম ভরের একটি ইউরেনিয়ামের গোলক রাখে। চিমটা দিয়ে ধরে গোলকটি ধীরে ধীরে পোর্টালের ভেতর দিয়ে পার করে দেয়। সাথে সাথে প্রফেসর ইগর এনার্জি বিমগুলোরসংযোগ বন্ধ করে দেন। ইউরেনিয়ামের গোলকটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। উত্তেজনায় ঘেমে উঠেছে যেন সকলে। নিস্তব্ধতা নেমে আছে বনের ভেতর অস্থায়ী পরীক্ষাগারে।
একঘণ্টার বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয় পরীক্ষা। এই সময়ের ভেতর সকল যন্ত্রপাতিগুলো পুনরায় পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। সকলের মনে ফুরফুরে একটা ভাব, বুঝতে পারছে পরীক্ষা প্রায় সফল বলা চলে। এবার টাইম বিম দুই মিলিয়ন বছরে সেট করে পোর্টাল খোলা হয়া। এবারও আগের মতোই পাঁচশো গ্রাম ইউরেনিমের গোলক সেই পোর্টালের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। একই পরীক্ষা এক মিলিয়ন বছর অতীতে সেট করে করা হয়। এবারও ইউরেনিয়ামের গোলকটি গায়েব হয়ে যায়।
সকলের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি, একে একে সবাই প্রফেসর ইগরের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, তরুণ কয়েকজন প্রকৌশলী লাফিয়ে উঠে কিছু খাতা কাগজ শূন্যে ছুঁড়ে মারে। চারদিকে হই হই রব শুরু হয়েছে। উপস্থিত সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেছে প্রফেসরকে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে শান্ত হতে বলেন। “দেখুন আপাত দৃষ্টিতে পরীক্ষা সফল বলেই মনে হচ্ছে তবে এখনও শেষ ধাপ বাকি আছে।” তিনি কয়েকজনকে দ্রুত কিছু নির্দেশ দিলেন। দেরি না করে কয়েকটি এক্সকাভেটর মাঠে নেমে পড়ে, কয়েকজনের হাতে রেডিও অ্যাকটিভ ডিটেক্টর।
ইঞ্চি ইঞ্চি করে মাঠের আনাচে কানাচে অনুসন্ধান করা হচ্ছে; ঘণ্টাখানেকের ভেতর তিনটি ইউরেনিয়ামের গোলক খুঁজে পায় অনুসন্ধানকারী দল। দুইটি প্রায় কাছাকাছিই অবস্থিত ছিল, আরেকটি বেশ দূরে পাওয়া যায়। দ্রুত তিনটি গোলককে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রফেসর ইগরকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। সাংবাদিকরা বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। পরীক্ষার খুঁটিনাটি অনেক কিছুই তারা বুঝতে পারছে না। সুযোগের অপেক্ষায় আছে কখন প্রশ্নবাণে প্রফেসরকে ঘায়েল করা যাবে। তাদের ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পেরে তিনি হেসে বলেন, “আপনারা অস্থির হবেন না। কিছুক্ষণের ভেতরই পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট হাতে চলে আসবে। তখন আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে।”
কয়েকঘণ্টা পর ল্যাবরেটরি থেকে মেটালিক অ্যানালিসিস রিপোর্ট চলে আসে। হাসিমুখে এবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রফেসর ইগর।
“স্যার, আমরা দেখলাম তিনবার ইউরেনিয়ামের গোলক টাইম পোর্টালের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, সাথে সাথে সেটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমাদের একটু সহজ ভাষায় বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন, আসলে কী হয়েছে এখানে?”
“প্রথমে আমরা তিন মিলিয়ন অতীতের একটি টাইম পোর্টাল খুলি। এর ভেতর ইউরেনিয়ামের গোলকটি প্রবেশ করানোর সাথে সাথে সেটি হারিয়ে যায়। আসলে হারিয়ে যায়নি, সেটি তিনি মিলিয়ন বছর অতীতে চলে গিয়েছে। তারপর একই পরীক্ষা দুই মিলিয়ন ও এক মিলিয়ন বছর অতীতের টাইম পোর্টালের ক্ষেত্রে করা হয়। আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই জায়গায় টাইম পোর্টাল তৈরি করা হয়েছিল। তাই গোলকটি এই একই স্থানের অতীতে চলে গিয়েছে। চিন্তা করে দেখুন, একটি ইউরেনিয়ামের গোলক তিন মিলিয়ন বছর ধরে এই জায়গার পড়ে আছে! এই তিন মিলিয়ন বছরে এটির উপর দিয়ে কত ঝড়ঝাপটা গেছে? এত লম্বা সময়ে কিছুটা দূরে সরে গেছে এই জায়গা থেকে। সেই কারণে আমাদের খোঁড়াখুঁড়ি আর রেডিও অ্যাকটিভ ডিটেক্টর দিয়ে খুঁজতে হয়েছে। আমাদের ভাগ্য ভালো এই লম্বা সময়ের ব্যবধানে এগুলো একেবারে হারিয়ে যায়নি। আমাদের কাছে ল্যাবরেটরির মেটালিক অ্যানালিসিস রিপোর্ট এসেছে, তারা নিশ্চিত করেছে এই তিনটি গোলকই আমাদের পাঠানো। ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু ৭০৪ মিলিয়ন বছর। তার মানে হচ্ছে, এক কেজি ভরের ইউরেনিয়াম ৭০৪ মিলিয়ন বছরে অর্ধেক হয়ে যায়। সেই হিসাবে তিন মিলিয়ন বছরে শতকরা ০.৩, দুই মিলিয়ন বছরে ০.২ ও এক মিলিয়ন বছরে শতকরা ০.১ পরিমাণ ভর হারানোর কথা। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ঠিকঠিক এই পরিমাণ ভর গোলক তিনটি হারিয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে এই গোলকগুলো মিলিয়ন বছর ধরে এই স্থানে ছিল।” একটু দম নিয়ে প্রফেসর বুক টানটান করে বলেন, “আমাদের অতীত ভ্রমণ পরীক্ষা সফল।”
“কিন্তু স্যার, এই মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে অন্য কোনও কারণেও তো ভর হারাতে পারে এই গোলকগুলো। তাহলে আপনারা ঠিক কী করে নিশ্চিত হলেন এগুলো অতীতের ঠিকঠিক এই সময়েই চলে গিয়েছিল?”
“আপনারা যে গোলক দেখেছেন সেটি বাইরের আবরণ মাত্র। এর ভেতরে তিনটি ছোট ছোট গোলক রাখা ছিল। আমরা সেই ছোট গোলকের উপরেই মেটালিক অ্যানালিসিস করেছি।” মুহূর্তক্ষণ বিরতি নিয়ে বলেন, “আমরা এখন মিলিয়ন বছর অতীতে ভ্রমণ করতে পারব, ভুলের মাত্রা প্লাস মাইনাস দশ বছর।”
তারপর একের পর এক প্রশ্ন আসতে থাকে উপস্থিত সাংবাদিক ও সরকারী কর্মকর্তাদের ভেতর থেকে। এর গুরুত্ব সবাই ঠিকঠিক উপলব্ধি করতে পারছে। বুঝতে পারছে অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যাবে অল্প সময়ের ভেতর। কিন্তু মহাবিপর্যয়ের সূত্রপাত যে এই সময়কে জয় করার মাধ্যমে শুরু হয়েছে সে বিষয়ে যদি বিন্দুমাত্র ধারণা তাদের থাকত তবে কি এত আনন্দিত হতে পারত?
অধ্যায় তিন
স্থান: কানাডা, ইউনিভার্সিটি ব্রিটিশ কলম্বিয়া, সময়: ২১ জুন ২১৯০
প্রথম টাইম পোর্টাল তৈরির পর পার হয়ে গেছে একশো বছর। সভ্যতা জামিলকে মূল্যায়ন করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে জামিল চৌধুরির নামে গবেষণাগার আছে, তার জীবনী নিয়ে অনেক গল্প, উপন্যাস ও চলচ্চিত্রও হয়েছে। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তার শেষ ফোনকল নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত হয়ে আছে। কারও কারও অভিমত, ‘ভবিষ্যতে পৃথিবীর বড় কোনও বিপর্যয়ের কথা বলে প্রফেসর ইগরকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিল জামিল।’ আবার কারও কারও ধারণা, ‘সময় সমীকরণ; অতীত ও ভবিষ্যৎ দুটির ক্ষেত্রেই সমাধান করা হলেও কেন শুধু অতীতেই ভ্রমণ সম্ভব হচ্ছে ভবিষ্যতে যাওয়া যাচ্ছে না’ এই প্রশ্নের সমাধান দিতে চেয়েছিল। শেষ মুহূর্তের এই রহস্যময় ফোনকল নিয়ে অনেক গবেষণাও হয়েছে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে, নিত্যনতুন থিওরি নিয়ে এসেছে অনেকে; এখনও সভা সেমিনার হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘জামিল’স মিস্ট্রি’ হিসাবে শতাব্দীর অমিমাংসিত রহস্যের তালিকার শীর্ষে এটির অবস্থান।
সময় সমীকরণের সমাধানের দিন থেকে সভ্যতা পা দিয়েছে নতুন এক যুগে; নতুন এই যুগের নাম, ‘পাস্ট ট্রাভেল ইরা’। প্রথম প্রথম কেবল কয়েকটি সমৃদ্ধশালী দেশের এই টাইম পোর্টাল বানানোর সক্ষমতা ছিল। তারপরের কয়েক যুগ ধরে এই ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ ও গবেষণা হওয়ার ফলে প্রযুক্তিগত অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। আবিষ্কারের পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সব দেশের কাছেই একাধিক ‘পাস্ট-ট্র্যাভেল মেশিন’ চলে আসে। শুধু তাই নয়, অনেক কর্পোরেট কোম্পানিও অত্যাধুনিক মানের এই যন্ত্রের মালিক বনে যায়।
গত কয়েক দশকে বিশ্বের পর্যটন শিল্পের বড় অংশই অতীত ভ্রমণের দখলে চলে গেছে। ভ্রমণের জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ ও রোমাঞ্চকর হওয়ায়, পাস্ট ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো আশা করছে এই বছর এটি শতকরা পঁচানব্বই ভাগে উন্নীত হবে; শতশত ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার। মানুষ এখন আর নদী-পাহাড়-সমুদ্র দেখতে যায় না, তারা অতীত ভ্রমণে যেতে বেশি আগ্রহী। ‘মধুচন্দ্রিমাটা কোথায় কাটাবে, প্রিয়তমা?’ এর পরিবর্তে এখন জিজ্ঞেস করে, ‘মধুযামিনী কখন কাটাবে, প্রিয়তমা?’ ‘এবার পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে তোমাকে ডায়নোসরের পিঠে চড়িয়ে আনব।’ এমন আশ্বাস হরহামেশাই সন্তানকে দিচ্ছেন বাবা-মা।
বিজ্ঞানের অনেক শাখায় ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হচ্ছে এই সময় ভ্রমণ প্রযুক্তি। বিশেষ করে আর্কিওলজি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিত-প্রাণীবিদ্যা। বিজ্ঞানের মৌলিক এই শাখাগুলো অনেকটা সময় ভ্রমণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে নতুন এই যুগে এসে। গত একশো বছরে সভ্যতার গতিপ্রকৃতি পুরোই পাল্টে গেছে, রীতিমতো আমূল পরিবর্তন।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই সময় ভ্রমণ সমীকরণগুলোর ব্যাপারে অ্যালেক্সের ভেতর একসময় অত্যাসক্তি তৈরি হয়। জামিলের অন্তিমশয্যায় অপ্রকাশিত কথাগুলোর রহস্য উদঘাটনের জন্য অস্থির হয়ে উঠে সে। এই রহস্য সমাধানের জন্যে ওয়ার্ল্ড পাস্ট ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে ঘোষিত লোভনীয় অফারও এই উদগ্রীবতার একটা যৌক্তিক কারণ হতে পারে। আর যাই হোক পুরস্কারের টাকাটা নেহাত কম তো নয়! ‘অতীত ভ্রমণ করা সম্ভব হচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যত ভ্রমণ কেন করা যাচ্ছে না’ এই রহস্য তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল। টাইম পোর্টালে প্রবেশ করার মুহূর্তেই ঢেউয়ের মতো অনুভূতি কেন হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্যে দিনের বেশিরভাগ সময়ই অ্যালেক্স সময় সমীকরণের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধ্যান করে। ঘরের চারদিকে ও সমীকরণগুলোর বিভিন্ন ডেরিভেশন ও ভিন্ন ভিন্ন সমাধান লিখে রেখেছোতে করে যেদিকেই নজর যাক না কেন শুধু যেন এই সময় সমীকরণগুলোই তার চোখে পড়ে। এই সময় সমীকরণের অতিরিক্ত সময় দেওয়ার কারণে তার মূল গবেষণায় ঠিকমতো সময় দিতে পারছে না। এই কারণে তার প্রফেসর প্রায়ই তীর্যক খোঁচা দিয়ে বলেন, “পিএইচডি কি এতই সহজ? চাইলে আর পেয়ে গেলে? এখন তো তোমাদের ধৈর্য বলতেই নেই, আমাদের সময় ঘুমিয়েও শান্তি পেতাম না, স্বপ্নেও থিসিস নিয়ে কাজ করতে হত।”
অবশ্য শুধু পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার নিয়ে অ্যালেক্স এত চিন্তিত নয়। দরকার হলে মাঝপথেই ছেড়ে দেবে, এমন ভাব তার। বরং সময় সমীকরণ কাজটিতে সে অনেক আনন্দ পাচ্ছে, ব্যাপারটা তার কাছে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো দাঁড়িয়েছে। শুরু থেকেই তার কেন যেন মনে হতে থাকে, “সকল প্রশ্নের সমাধান এই সমীকরণগুলোর মধ্যেই নিহিত আছে।”
এখনও বিয়ে করেনি, পিছুটান নেই, কোনও বান্ধবীও নেই তার। কৈশোরে একজনের প্রেমে পড়েছিল, এখনও তার কথা মনে হলে হৃদয়ের ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়। কিছুতেই সেই মুখ ভুলতে পারে না সে। প্রথম প্রেম বলেই কি? না কি ‘ব্যর্থ প্রেম’ এই কারণে এখনও এত তীব্র আকর্ষণ বোধ কাজ করছে? এখনও জানে না কেন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সেই মেয়েটি।
প্রতিদিনের মতো ভোরে চোখ খুলতেই ছাদের উপর লেখা সমীকরণগুলোর উপর দৃষ্টি যায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে অ্যালেক্স। কিছুক্ষণ পর নিত্যদিনের রূটিনমতো ‘সায়েন্সের জগৎ’ খবরের কাগজটি খুলে বসে। ডান হাতে হাইপা চালু করতেই, চোখের সামনে একটি ভার্চুয়াল স্ক্রিনে ‘সায়েন্সের জগৎ’ পত্রিকাটি জ্বলজ্বল করে উঠে। বিস্তারিত খবর সে পড়ে খুব কম, বেশিভাগ সময় শুধু হেডলাইন দেখেই পরের খবরে চলে যায়। আচমকা জ্যোতিবিজ্ঞান বিভাগের একটি খবরে নজর আটকে যায় তার। “তবে কি নিভে যাচ্ছে গ্যালাক্সি?”- এমন নজরকাড়া শিরোনাম এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। দ্রুত সম্পূর্ণ খবরটি পড়ে নেয় সে।
“তেরো বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত পাঁচটি গ্যালাক্সির অস্তিত্ব আর খুঁজে পাচ্ছেন না জ্যোর্তিবিদরা। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন টেলিস্কোপের কোনও গণ্ডগোল হতে পারে, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ টানা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হয়েছে আসলেই হারিয়ে গেছে গ্যালাক্সিগুলো। তবে ডিপ-স্পেস অবজার্বার সংস্থা প্রতি মুহূর্তে কী হয় সেদিকে নজর রাখছেন।”
আরও অনেক তথ্য সংযুক্ত করেছে রিপোর্টার। কয়েকজন জ্যোর্তিবিজ্ঞানীর মতামতও তুলে ধরেছে। পরের সপ্তাহে একই রকমের আর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই এক সপ্তাহে আর একটি গ্যালাক্সি হারিয়ে গেছে। তার পরের সপ্তাহে আরও দুটি ‘নেই’ হয়ে যায়। যদিও লক্ষ কোটি গ্যালাক্সির ভেতর এমন কয়েকটা হারিয়ে গেলে তেমন কোনও প্রভাব পড়ার কথা না, তবে অভিনব এই ঘটনায় নড়ে চড়ে বসে বিজ্ঞান জগৎ। তবে কি মহাবিশ্ব ধ্বংসের সানাই বেজে উঠল?
“এই যে অ্যালেক্স, খবর শুনেছ নাকি?”, ল্যাবে ঢুকতেই সুপারভাইজার প্রফেসর মাইকেল গলা ফাটিয়ে বলে উঠেন। তারপর জবাবের অপেক্ষায় না থেকে বলেন, “একের পর এক গ্যালাক্সি তো গায়েব হয়ে যাচ্ছে! ভাবা যায়? একেকটা গ্যালাক্সি দশ হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত, কোটি কোটি সূর্য! এত বিশাল ভর নিয়ে একদিন টুপ করে গায়েব হয়ে গেল? এটা কোনও কথা হল?”
“স্যার, এখানে মনে হচ্ছে একটু বোঝার ভুল হচ্ছে। যে গ্যালাক্সিগুলো হারিয়ে গেছে; সবগুলোই প্রায় তেরো বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের। তার মানে হচ্ছে, আমরা যে গ্যালাক্সিগুলোর এই পরিণতি দেখছি তা আসলে তেরো বিলিয়ন বছর আগের ঘটনা। বর্তমানে এগুলোর কী অবস্থা তা জানার জন্যে আমাদের আরও তেরো বিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার পালাটি একটু বেশিই লম্বা, কী বলেন স্যার?” চোখের ভাষায় কৌতুক খেলে উঠে অ্যালেক্সের।
“ওহ অ্যালেক্স! তুমি হয়তো জানো না মহাবিশ্বের ত্রি-মাত্রিক ম্যাপ অনেক আগেই আমরা তৈরি করেছি। প্রায় সকল গ্যালাক্সিসহ ব্ল্যাকহোল, বিচ্ছিন্ন গ্রহাণু, নক্ষত্র— সবই এতে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। শত শত বছরে লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞানীর মিলিত প্রয়াস…” লম্বা বিরক্তিকর বক্তৃতা শুনার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় অ্যালেক্স মনে মনে।
“এক দশক আগে এই ম্যাপিংয়ের কাজে প্রথমবারের মতো সাব-স্পেস সিগন্যালিং প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। এই প্রযুক্তি খুব বেশি খরুচে হওয়ায় প্রতি চার বছরে একবার মাত্র এই ম্যাপ আপডেট করা হয়। সাব-স্পেস সিগন্যালিং প্রযুক্তি হচ্ছে স্পেসকে বাকিয়ে অসীম দূরত্বের দুটি বিন্দুকে কাছাকাছি এনে সুড়ঙ্গ বানিয়ে এর ভেতর দিয়ে সিগন্যাল পাস করা। তাই আমরা যে ঘটনা এখন দেখছি সেটি তেরো বিলিয়ন বছর আগের নয় বরং অতি নিকট অতীতের, বলতে গেলে বর্তমানেরই ঘটনা।”
ঘটনার গুরুত্ব এবার পুরোপরি উপলব্ধি করতে পারে অ্যালেক্স। ভয় লাগছে কিছুটা তার, তবে এটা ভেবে স্বস্তি বোধ করে যে এই ঘটনা ঘটছে তেরো বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোনও জায়গায়। “স্যার, আপনার কী মনে হয়? কেন, কীভাবে ঘটছে এসব? আমাদের কি ভয়ের কোনও কারণ আছে?”
“এখনও পর্যন্ত ভয়ের কিছু দেখছি না। এত দূরের ঘটনা আমাদের উপর প্রভাব পড়তে অনেক সময় লাগার কথা, ততদিনে আমাদের সূর্যই হয়তো মরে যাবে। আমিও এখন পর্যন্ত কিছু বুঝতে পারছি না। মহাবিষ্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হওয়া আমাদের এই মহাবিশ্ব এখনও ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে; গ্যালাক্সিগুলো প্রচণ্ড গতিতে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু মহাকর্ষ বলের কারণে এই সম্প্রসারণ একসময় না একসময় থেমে যাবে। তারপর শুরু হবে মহা সংকোচন। তখন মহাবিশ্বের সকল ভর-শক্তি আবার এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে সিঙ্গুলারিটি তৈরি করবে। অনেক বলছে এই গ্যালাক্সিগুলো হারিয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো মহাসংকোচন শুরু হয়ে গেছে। তবে আমার মতে এটা ভুল ব্যাখ্যা। গ্যালাক্সিগুলো এখনও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তার মানে সম্প্রসারণ এখনও চলছে। বুঝতে পারছি না এগুলোর গায়েব হওয়ার পেছনে ঠিক কী কারণ থাকতে পারে।” বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে প্রফেসরকে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলেন, “চিন্তা করতে পারছ? কোটি কোটি বিলিয়ন ট্রিলিয়ন মেট্রিক-টন ভরের এক-একটি গ্যালাক্সি কেমন ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেল? কোনও বিস্ফোরণের চিহ্ন নেই। নেই কোনও বিকিরণের ছিটেফোঁটাও! স্রেফ জাদুমন্ত্রের মতো না-ই হয়ে গেল যেন!”
ব্রেনের নিউরনের কিছুটা উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছিল অ্যালেক্সের, সুপারভাইজারের শেষ কথায় সেই নিউরনগুলো আচমকা শান্ত হয়ে যায়। এমন হয় যখন তার সমগ্র ইন্দ্রীয় কেবল নির্দিষ্ট কিছুতে কেন্দ্রীভূত হয়। মাথার ভেতর ঝনঝন করছে ‘স্রেফ নাই হয়ে গেল’ বাক্যটি। তার কেন যেন মনে হতে থাকে সময় সমীকরণের সাথে এসবের কোনও একটা সংযোগ আছে। অল্পক্ষণের ভেতর করণীয় স্থির করে ফেলে সে। ডুব দিতে হবে; লম্বা সময়ের জন্যে ডুব দিতে হবে।
অধ্যায় চার
স্থান: কানাডা, ইউনিভার্সিটি ব্রিটিশ কলম্বিয়া, সময়: ২ জুলাই ২১৯০
ছোট ঘরটিতে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে অ্যালেক্স। দশ দিন হয়ে গেল বাইরের কারও সাথে যোগাযোগ করছে না সে। মেইল বক্স নিস্ক্রিয়; কমিউনিকেটর ডিভাইস বন্ধ করে নিজেকে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলেছে দুনিয়ার চোখে। মাঝে একবার সুপারভাইজার লোক পাঠিয়ে খবর নিয়েছিল কেন ল্যাবে যাচ্ছে না। অসুস্থতার কথা বলে পার পেয়েছে। গ্যালাক্সিগুলোর মিলিয়ে যাওয়ার ঘটনার সাথে কিছুতেই সময় সমীকরণের সংযোগ ঘটাতে পারছে না সে। আর এই না পারাটাই অস্থির করে তুলছে তাকে; কিন্তু অবচেতন মন তাকে বারংবার সংকেত দিয়ে বলছে এদের ভেতর একটি পারস্পরিক সম্পর্ক অবশ্যই আছে।
সারাদিন সমীকরণের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের যতগুলো ডেরিভেশন আছে তার সাথে সময় ভ্রমণের সমীকরণগুলোর ইন্টারেকশন করিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন কোণ থেকে। মাঝেমাঝে চোখ বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী যেন ভাবে; কখনও কখনও পৃষ্টার পর পৃষ্ঠা লিখে আবার ছিঁড়ে ফেলে। কাগজের প্রচলন খুব একটা নেই আজকের দুনিয়ায়। এক বান্ডিল কাগজের চেয়ে একটি স্ক্রিন অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। তবে গবেষণার কাজে এখনও কাগজের ব্যবহার বহুল জনপ্রিয়। কোনও এক গবেষণায় দেখা গেছে হাতে কলমে লিখলে নাকি গবেষণায় দ্রুত অগ্রগতি হয়। আহাম্মক কোথাকার! গবেষণা নিয়ে গবেষণা করে!
ইচ্ছা করছে রাস্তায় বের হয়ে এমন কয়েকটা আহাম্মককে প্যাদানি দিয়ে আসতে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা জ্ঞানীদের মিলনমেলা, কিন্তু এর বদলে হয়েছে গরুছাগলের হাট। উফ! চিন্তা উল্টাপাল্টা দিগ্বিদিক ছুটছে; অস্থির হয়ে ওঠে অ্যালেক্স। কী সব উল্টাপাল্টা ভাবছে! টানা কয়েকদিন ঠিকমতন ঘুম হচ্ছে না তার। এর ভেতর আরও গোটাপাঁচেক গ্যালাক্সি ‘নেই’ হয়ে গেছে। এই নিয়ে পনেরোটা! চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসছে, তীব্র বেগে মাথা নাড়িয়ে ব্যাটাকে তাড়িয়ে দেয় সে।
“আমি ঘুমোব আর এই ফাঁকে একের পর এক গ্যালাক্সি হারিয়ে যাবে? না, ঘুমোনো যাবে না কিছুতেই।” এই বলে নিজেকে প্রবোধ দেয়।
ক্লান্তিতে মাথা নুয়ে আসে, আপন মনে কথা বলে, “আরে ঘুমের সাথে গ্যালাক্সির চুরি হয়ে যাওয়ার কী সম্পর্ক? কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে মন্দ হয় না। টানা আবদ্ধ পরিবেশে থেকে থেকে মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। নাহ! আমি ঘুমোব না। উফ! পাগল হয়ে যাচ্ছি!” আর কিছু মনে নেই তার। শুধু কানে এসেছে টেবিলের সাথে মাথা টুস করে ঠুকে যাওয়ার শব্দ।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ঠিক ঠাহর করতে পারে না অ্যালেক্স; কপালের সামনের দিকটা ছোট্ট আলুর মতো ফুলে গেছে; কী করে হল, কখন হল বুঝতে পারে না। চোখে মুখে পানি দিয়ে আবার সমীকরণ নিয়ে বসে যায়। “নাহ! এভাবে কোনও অগ্রগতি হচ্ছে না। ভাবনার স্রোতকে কিঞ্চিত ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে হবে।” মহাবিশ্ব সৃষ্টির মজার মজার হাইপোথিসিসগুলো হাইপারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে পড়তে থাকে সে।
গ্রিক মিথোলজি মতে, ‘দেবতা জিউস কাঁধে করে পৃথিবীকে বয়ে বেড়াচ্ছেন, আবার সুমেরিয়ান মিথোলজি মতে একটি ষাঁড়ের শিংয়ের উপর আসন গেড়ে আছে আমাদের পৃথিবী। আরও কিছু উদ্ভট থিওরি পড়ে হেসে মন কিছুটা হালকা করে অ্যালেক্স। উনবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানী ও সমসাময়িক দার্শনিকরা মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তার জগতে ঝড় তোলার মতো বেশ কতগুলো থিওরির প্রস্তাব করেছিলেন। হলোগ্রাফিক ইউনিভার্স, সিমুলেশন থিওরি, একক ইলেক্ট্রন ইউনিভার্স, মাল্টিভার্স; দ্রুত সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে বেশ কিছু মজার মজার গাণিতিক হিসাব নিকাশ ও সমীকরণ বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ একটি থিওরির উপর চোখ আটকে যায় তার।
১৯৭৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ট্রাইওন ‘শূন্য শক্তির মহাবিশ্ব’ এর মডেল প্রস্তাব করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, মহাবিশ্ব শূন্যে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে, মহাবিশ্বের মোট ধনাত্মক শক্তি ও ঋণাত্মক শক্তির যোগফল তাই শূন্য। তৎকালীন জোর্তির্বিদ ও পদার্থিবিজ্ঞানীরা হেসেই উড়িয়ে দেন তার এই থিওরি। পরবর্তী সময়ে এই থিওরি নিয়ে আর কেউ কাজ করেনি। হঠাৎ এই তত্ত্বের উপর তার চোখ আটকে যাওয়ার কারণ অবশ্য অন্য। মহাবিশ্বের মোট শক্তি কিংবা ভর শূন্য নয় বরং এর মান 1.09×1063কেজি এবং এটি ধ্রুবক। কারণ শক্তির নিত্যতার সূত্রানুসারে শক্তি বা ভরের সৃষ্টি কিংবা বিনাশ নেই। মহাবিস্ফোরণের ফলে টাইম-স্পেস কন্টিনিউম সৃষ্টির পর থেকে এটি চিরন্তর সত্য। ভয়ঙ্কর গতিতে মাথার ভেতর চিন্তা চলছে অ্যালেক্সের। মনে হচ্ছে গ্যালাক্সিগুলোর গায়েব হয়ে যাওয়ার কারণ কিছুটা অনুমান করতে পেরেছে সে। এখন এই ধারণাকে সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করে দেখতে হবে তা কতটুকু সত্য।
পরের পাঁচদিন বেঘোরে কাজ করে অ্যালেক্স, কখন দিন হচ্ছে আর কখন রাত কিছুই ঠাহর করতে পারেনি সে। খাওয়া খাদ্য খেয়েছে কিনা মনে করতে পারছে না। অবশ্যই খেয়েছে, না হলে শরীর চলত না। তার ঘোর কাটে যখন সমীকরণগুলো পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। কয়েকশো পাতার সমীকরণ লিখে ফেলেছে এই পাঁচদিনে। ফলাফলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে অ্যালেক্সের। যদি এই সমীকরণ সঠিক হয়, তবে সে শুধু গ্যালাক্সি গায়েব হয়ে যাওয়ার কারণই বের করেনি, সেই সাথে জামিল মিস্ট্রির সমাধানও করে ফেলেছে।
মহাগণিতজ্ঞ জামিল চৌধুরির শেষ ফোনালাপ রহস্যের ব্যাপারে যে দুটি ধারণা বেশি জনপ্রিয়, ভীষণ অবাক হয়ে লক্ষ করে সে এই দুটি মতবাদই সঠিক! অ্যালেক্স এখন জানে জামিল চৌধুরি ‘ভবিষ্যতে মহা’ এই শব্দদুটি দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছিলেন, আর এও জানে কেন শুধু অতীত ভ্রমণের জন্যে টাইম পোর্টাল খোলা যাচ্ছে; ভবিষ্যতের জন্যে খোলা যাচ্ছে না। সমীকরণগুলোর দিকে তাকিয়ে খুশি হওয়ার বদলে প্রচণ্ড হতাশা চেপে বসে অ্যালেক্সের, চিৎকার করে বলতে হচ্ছে করছে “নাহ! এগুলো সব ভুল। এমন হতেই পারে না”। কিন্তু সে জানে গণিত মিথ্যা বলে না, মহাবিশ্ব গণিতের ভাষায় বোনা এক চাদর। সমীকরণ যেখানে তন্তু। “এখানে কোনও ভুল নেই, আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছি।” ভাবে অ্যালেক্স।
বিছানায় ধপ করে পড়ে শরীর এলিয়ে দেয়, একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই যেন আর। তার ডান হাতে সমাধানের কাগজগুলো ধরা, ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, কিছুতেই চোখের পাতা খোলা রাখতে পারছে না। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ঠিক মনে নেই, নিজের উপর রাগ হচ্ছে তার। যে সময়টুকু ঘুমিয়েছে এর ভেতর হয়তো আরও কতগুলো গ্যালাক্সি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এই সমীকরণগুলো প্রকাশ পেলে বিশ্বজুড়ে ঝড় বয়ে যাবে। এমনও হতে পারে টাইম ট্রাভেল এজেন্সি সকল রিসার্চ গায়েব করে দিতে পারে। খুনও হয়ে যেতে হতে পারে সে। এই বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা কি আর তার এক কথায় বন্ধ করে দিবে তারা? কখনও না।
গতানুগতিক পদ্ধতিতে পেপার পাবলিশ, সভা-সেমিনার করা এভাবে এগোলে কিছুই হবে না। একটাই সমাধান, সব সমীকরণ আর হিসাব নিকেশগুলো নিয়ে ভিডিও বানিয়ে একযোগে হাইপার নেটে ছেড়ে দিতে হবে। একযোগে সব বিশ্ববিদ্যালয় আর রিসার্চ সেন্টারের কাছে এগুলো পৌঁছে গেলে আর চাপ প্রয়োগ করে এগুলোকে গায়েব করে দিতে পারবে না। অবশ্য একটা দুশ্চিন্তা এখনও তাকে বেশ পীড়া দিচ্ছে, প্রায়ই অতি উৎসাহী কিছু তরুণ-তরুণীরা ‘জামিল মিস্ট্রির সমাধান করে ফেলেছি’ এমন খবর হাইপার নেটে ছড়িয়ে থাকে, যেগুলো সবগুলোই এ পর্যন্ত মিথ্যা বা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন অ্যালেক্সকে তেমন কোনও অতি উৎসাহীর দলে ফেলে দিলে আর কিছু করার থাকবে না। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও যে নেই তার!
“আমার প্রিয় শিক্ষক, সহকর্মী এবং শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী-গবেষকগণ ও বিশ্ববাসী, আপনারা এতদিনে হয়তো শুনে থাকবেন যে তেরো বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের প্রায় বিশটা গ্যালক্সি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, আমার এই ভিডিও প্রকাশ হওয়ার সময় এই সংখ্যাটি আরও বাড়বে নিশ্চিত। আমি নিশ্চিত করে জানাতে চাই, এই রহস্যের কারণ আমি বের করেছি, আর এটার পেছনে আমাদেরই হাত আছে। আমি আরও বলতে চাই, অতীত ভ্রমণ এজেন্সি আমার এই ভিডিও প্রকাশের পর বেশ নাখোশ হতে পারে, কিন্তু আমি যা বলব সেটি শতভাগ সত্য। আমি কথা বলব বিজ্ঞানের মৌলিক ভাষা, গণিতের দ্বারা। যে ভাষায় লিখিত আমাদের সভ্যতা, আমাদের এই মহাবিশ্ব। সবচেয়ে বড় কথা, সময় ভ্রমণের সমীকরণগুলোর ব্যাপারে যার প্রাথমিক ধারণা আছে, তিনি নিজেই আমার সমীকরণগুলোর সাথে মিলিয়ে এই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখত পারবেন। সমীকরণগুলোর ভিডিও এর শেষে সংযুক্ত আছে, সেখানে যাওয়ার আগে আসুন বিষয়টি সহজ করে বোঝার চেষ্টা করি।”
একটি রুমাল দিয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু জমে উঠা ঘাম মুছে আবার বক্তব্য শুরু করে অ্যালেক্স, “আমাদের মহাবিশ্বে যে কোনও সময়ে মোট ভরের পরিমাণ স্থির। এটি ভর-শক্তির নিত্যতার সূত্র হিসাবে আমরা স্কুল পর্যায়ে পড়ে থাকি। এখন অতীত ভ্রমণের ফলে এই ভরের সাম্য নষ্ট হচ্ছে। একটি সহজ উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে আপনাদের।” বলেই টেবিলের উপর দুটি প্লাস্টিকের পাত্রে গুনে গুনে দশটি করে মার্বেল রাখে। একটা নাক বন্ধ হয়ে আছে মনে হচ্ছে; হালকা শব্দ করে টেনে পরিষ্কার করে আবার শুরু করে, “এই দুটি পাত্রেই দশটি করে মার্বেল আছে। পাত্র দুটিকে আমাদের মহাবিশ্বের সময়ের তিরের সাথে তুলনা করে ডান দিকের পাত্রটি বর্তমান আর বাঁ দিকের পাত্রটি অতীত হিসাবে ধরে নিই। তার মানে অতীত ও বর্তমান যেকোনও সময়ে মার্বেলের সংখ্যা সমান। এখন সময় ভ্রমণের ফলে যদি বর্তমানের পাত্র থেকে একটি মার্বেল অতীত পাত্রে নিয়ে নেই তাহলে কী হবে? তাহলে অতীত পাত্রে মার্বেল হবে এগারোটি আর বর্তমান পাত্রে হবে নয়টি। এভাবেই সময় ভ্রমণের কারণে ভরের সাম্য নষ্ট হচ্ছে। এখন এটাতে ভারসাম্য আনতে হলে কী করতে হবে?”
গলা শুকিয়ে এসেছে। পাশে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে আবার বক্তব্য শুরু করে, “এখন সাম্য আনার জন্যে, অতীত পাত্র থেকে দুটি মার্বেল তুলে ফেলে দিলাম। সেক্ষেত্রে দুটি পাত্রেই এখন নয়টি করে মার্বেল আছে। যেহেতু বর্তমান পাত্র থেকে একটি মার্বেল অতীতে গিয়েছিল, ভ্রমণ শেষে সেটি আবার বর্তমানে ফিরে আসবে। সেক্ষেত্রে এখন অতীত পাত্রে মার্বেল হবে আটটি আর বর্তমানে পাত্রে মার্বেলের সংখ্যা বেড়ে হবে দশটি। তাই পুনরায় সাম্য নিয়ে আসার জন্যে বর্তমান পাত্র থেকে দুটি মার্বেল তুলে ফেলে দিলাম, এখন দুটি পাত্রেই আটটি করে মার্বেল আছে। সুতরাং দেখতে পাচ্ছি একটি মার্বেলের অতীত ভ্রমণের জন্যে সম্পূর্ণ বিশ্বের দুটি মার্বেল গায়েব হয়ে যাচ্ছে।”
“দেখা যাচ্ছে, এভাবেই একক ভরের অতীত ভ্রমণের কারণে দ্বিগুণ ভরের পদার্থ মহাবিশ্ব থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। আমি গত কয়েক বছরের অতীর ভ্রমণের ডাটা সংগ্রহ করে দেখেছি, গড়ে প্রতিদিন বিয়াল্লিশ হাজার লোক অতীত ভ্রমণে যায়। সে হিসাবে প্রতিজন যদি গড়ে একশো কেজি ভর নিয়ে অতীতে যায় তাহলে বিয়াল্লিশ লক্ষ কেজি ভরের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। তাই মহাবিশ্ব থেকে চৌরাশি লক্ষ কেজি ভর গায়েব হয়ে যাবে। আর এটি হবে মহাবিশ্বে প্রান্তের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে। ব্যাপারটা কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ থাকলে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না। কারণ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন মেট্রিক টন ভরের প্রায় অসীম এই মহাবিশ্বের সাপেক্ষে এমন কয়েক কোটি কেজি ভর গায়েব হয়ে যাওয়া প্রকৃতপক্ষে কোনও ব্যাপার না। এটি ঠিক একটি টেবিল চামচ দিয়ে সমুদ্র সেচার মতো ব্যাপার।
একটু বিরতি নেয় অ্যালেক্স। হালকা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলে, “সমস্যা হল, দ্বিগুন পরিমাণ ভরইকেবল গায়েব হচ্ছে না। যেই মুহূর্তে অতীতে পৌঁছচ্ছে কোনও ভর, ঠিক সেই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত ভরের অসামঞ্জস্যতার একটি চেন এফেক্টের সৃষ্টি হচ্ছে। এই এফেক্ট একটি মহাজাগতিক ঢেউয়ের মতো অতীত থেকে বর্তমানে প্রবাহিত হয়, একে আমি নাম দিয়েছি সময়ের অ্যালেক্স ওয়েভ। সময়ের এই ঢেউয়ের ফলে প্রতি প্ল্যাংক সময়ে, ‘জামিল কন্সটেন্টের রুটের সাথে আলোর বেগের ধ্রুবকের স্কোয়ারের গুণফলের টু দ্য পাওয়ার ভর’ এই পরিমাণ ভর নেই হয়ে যাবে মহাবিশ্ব থেকে। সহজ কথায়, আমরা যদি একটি মার্বেলকে এক মিলিয়ন বছর অতীতে পাঠাই তাহলে বর্তমানে একটি গ্রহের সমান ভর শূন্যে মিলিয়ে যাবে। আর যদি এক কোটি বছর অতীতে পাঠাই, তাহলে হয়তো একটি সৌর ভর নেই যাবে। অথবা, একটি আস্ত মানুষ এক মিলিয়ন অতীতে গেল, আর এদিকে একটি সৌরজগত হাওয়া!”
একটু বিরতি নিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে আসে ঘরের বাইরে থেকে। রাত। ক্যাম্পাস প্রায় নীরব, হালকা শীতল বাতাস বইছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে তার। পৃথিবীর জন্যে মায়া হচ্ছে, অসম্ভব মায়া। “কম অত্যাচার করছি এই ভূমির উপর আমরা? তাও কি অসীম ধৈর্য নিয়েই না আমাদের এখনও বুকে আগলে রেখেছে!” আপন মনে ভাবে অ্যালেক্স। দেরি না করে ঘরে ফিরে এসেই আবার ভিডিও নিয়ে বসে যায় সে।“এই গ্যালাক্সিগুলো গায়েব হয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে যেদিন থেকে আমরা অতীত ভ্রমণ শুরু করেছি, কিন্তু আমাদের নজরে এসেছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ হল। হয়তো আরও বিলিয়ন বছর পরে এই ব্যাপারটা ধরতে পারতাম। কিন্তু ইউনিভার্সের ম্যাপ তৈরিতে চার বছর আগে সাব-স্পেস সিগন্যালিং প্রযুক্তি ব্যবহৃত হওয়ায় ব্যাপারটা এখনই ধরতে পেরেছি। আমার হিসাব মতে, যে হারে সময় ভ্রমণ চলছে আমাদের পৃথিবী শূন্যে মিলিয়ে যেতে আর সময় আছে দুই লক্ষ উনিশ হাজার বছর। তবে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, এভাবে ক্রমাগত গ্যালাক্সির পর গ্যালাক্সি গায়েব হয়ে গেলে, মহাবিশ্বের গ্র্যাভেটির ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যাবে, তখন অনেক ধরনের বিপর্যয়ই ঘটতে পারে। আমার ধারণা মহান গণিতবিদ জামিল চৌধুরি এই ব্যাপারটিই মৃত্যুর আগে বলে যেতে চেয়েছিলেন। আমি হয়তো সেই ‘জামিল মিস্ট্রির’ সমাধানও করে ফেলেছি।” মনটা খারাপ হয়ে যায় অ্যালেক্সের। স্কুলজীবন থেকে এই মিস্ট্রির সমাধান করার প্রবল ইচ্ছা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল, কিন্তু এর যে এমন পরিণতি হবে সেটি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সে।
“‘জামিল মিস্ট্রির’ সমাধানের পাশাপাশি আমরা কেন ভবিষ্যৎ ভ্রমণ করতে পারছি না সেটিরও সমাধান করেছি আপাতত ওটা পরের ভিডিওতে তুলে ধরব। আমাদের এখন এই বিশ্বকে বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি পাস্ট ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধণী ও প্রভাবশালী সংস্থা, অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব রাষ্ট্রের ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু তাদেরও বুঝতে হবে যদি আমাদের পৃথিবীই না থাকে তবে কাদের দিয়ে চলবে এই পর্যটন বাণিজ্য? আমরা সাধারণ জনগণেরও উচিত সব ধরণের সময় ভ্রমণ বর্জন করা। বর্তমানে কত সুন্দর মনোরম জায়গা আছে ভ্রমণের! কই একশো বছর আগেও তো আমাদের পূর্বপুরুষরা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতেন, তারা কি তাদের সময়কে উপভোগ করেননি? তাহলে আমরা কেন পারব না?”
ভিডিও তৈরি করা শেষ। বার কয়েক চেক করে ছোটখাটো কিছু এডিট করে ফাইনাল করে ফেলে অ্যালেক্স। এখন এটিকে হাইপারনেটে সব সাইটে একযোগে প্রকাশ করতে হবে, সেই সাথে যতগুলো রিসার্চ ইন্সটিটিউট, ল্যাবরেটরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে তার যোগাযোগ আছে সবাইকে ইমেল করতে হবে। লম্বা একটা দম নিয়ে সেন্ড বাটনে ক্লিক করে দেয় সে। বেজে গেল যুদ্ধের দামামা; আর পেছনে ফেরার উপায় নেই।
অধ্যায় পাঁচ
স্থান: নিউইয়র্ক, সময়: ১০ ফেব্রুয়ারি ২১৯১
অ্যালেক্সের আকাঙ্ক্ষার চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রায় সবগুলো সংবাদমাধ্যমের মূল আলোচিত বিষয় হচ্ছে বর্তমানের এই জামিল’স মিস্ট্রির সমাধান। যদিও পাস্ট এজেন্সিগুলো এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে; তবে তাদের বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে, শেয়ারে ব্যাপক ধস নেমেছে। যদিও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সাময়িক, জনগণের ভেতর প্রাথমিক উত্তেজনা হ্রাস পেলেই তারা নতুন নতুন প্যাকেজ আর লোভনীয় অফার নিয়ে হাজির হবে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ঠিকঠিক ঘুরে দাঁড়াবে, আর পৃথিবীকে নতুন বিপর্যয়ের দিকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে যাবে। অন্তত কয়েক লক্ষ বছর পরের পৃথিবীর পরিণতির কথা বিবেচনা করে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের এই ব্যবসা তারা বন্ধ করে দেবে, এতটা মহত্ব তাদের থেকে কেউই আশা করে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতারাতিই যেন অ্যালেক্সের সম্মান বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই প্রফেসর ও গবেষকরা দেখা করতে আসছেন। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করে লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছে সে। তেমনই এক গেস্ট লেকচারার হিসাবে নিউইউর্কে হাজির হয়। হোটেলে পৌঁছে মাত্রই শাওয়ার নিতে ঢুকবে তখনই দরজায় কে যেন নক করে। গুনে গুনে তিনবার। একই রকমভাবে। মাপা আওয়াজ।
দরজায় সামরিক বাহিনীর পোশাক পরা একজন কর্নেল পর্যায়ের অফিসার। পেছনে একজন ক্যাপ্টেন আর দু’জন সৈন্য। “মিস্টার অ্যালেক্স নেলসন?” চোখে দিকে তাকিয়ে জবাবের অপেক্ষা না করেই হাতে ধরা একটি নীল রঙের কার্ড তার দিকে এগিয়ে বলে, “আমি কর্নেল ডেনিয়েল টর; এটি প্রেসিডেন্টের একটি নিমন্ত্রণ কার্ড। আপনাকে এখনই আমাদের সাথে আসতে হবে।”
নিশ্চয়ই জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত অতি জরুরি কোনও বিষয় হবে, আর এটা যে তার সমাধানকৃত ‘জামিল’স মিস্ট্রি’র সাথে সম্পর্কিত তা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। দ্রুত তৈরি হয়ে তাদের সাথে গাড়িতে উঠে। পেছনের আসনে মাঝে অ্যালেক্স; দু’পাশে দু’জন সৈন্য, ড্রাইভ করছে ক্যাপ্টেন তার পাশে কর্নেল। রীতিমতো বিশেষ প্রহরা দিয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রেসিডেন্ট কি এখন নিউইয়র্কে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করে, “আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?”
“একটু পরেই বুঝতে পারবেন।” বলেই চুপ করে যায় কর্নেল ডেনিয়েল। বুঝিয়ে দেয় এই বিষয়ে আর কোনও কথা বলতে আগ্রহী নন তিনি।
কিছুক্ষণ পর গাড়িটি জাতিসঙ্ঘ এলাকায় প্রবেশ করে, গেটে কর্নেলের পরিচয়পত্র দেখে স্যালুট দিয়ে ছেড়ে দেয়। দশ মিনিটের ভেতর নিজেকে একটি বদ্ধ ঘরে ভাইস প্রেসিডেন্টের সামনে আবিষ্কার করে অ্যালেক্স। মাননীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট সাহেব খুবই তড়িৎকর্মা ব্যক্তি। একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বললেন, “মিস্টার অ্যালেক্স, আপনি নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্টের নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন; কিছুক্ষণের মধ্যে সিকিউরিটি কাউন্সিলের মেম্বার দেশগুলোকে নিয়ে একটি জরুরি সভা হবে। সেখানে সেসব দেশের ট্রাভেল মিনিস্টার, সিকিউরিটি সেক্রেটারি সহ জাতিসঙ্ঘের অ্যাম্বাসাডররা উপস্থিত থাকবেন। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থেই আপনাকে আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি। আপনি ‘জামিল’স মিস্ট্রি’র যে সমাধান ও গ্যালাক্সিগুলো হারিয়ে যাওয়া নিয়ে যে গাণিতিক মডেল দিয়েছেন সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিতে হবে। একটা পরামর্শ দিচ্ছি, উপস্থিত সবাই কিন্তু আপনার মতো গণিতজ্ঞ নয়, তাই যথাসম্ভব সহজ করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবেন। আর একটা বিষয় আপনাকে বলে রাখছি, আমাদের সামনে মহাবিপর্যয়। যে করেই হোক আমাদের এই মিটিংয়ে সবাইকে ঐক্যমতে আসতে হবে।”
ভাইস প্রেসিডেন্ট সাহেবের চোখে মুখে ভয়ের স্পষ্ট আভা, অ্যালেক্সকে তা ছুঁয়ে যায়। কিন্তু একটা বিষয় ঠিক বুঝতে পারছে না সে, ওঁকে খুব বেশি বিচলিত মনে হচ্ছে। প্রায় দুই লক্ষ বছর পরের বিপর্যয় নিয়ে এখনই এতটা বিচলিত হওয়ার কারণ কী হতে পারে? “আমি কি কিছু এড়িয়ে গেছি?” ভাবনাটি মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করে, “মাননীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট, আপনাকে খুব বেশি আতঙ্কিত মনে হচ্ছে। এর কি সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ আছে? আমার হিসাবে প্রায় দুই লক্ষ বছরের চেয়ে বেশি সময় আমাদের হাতে আছে!”
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি, “আপনি বুদ্ধিজীবী, সবকিছু যুক্তি আর সরল চোখে দেখে অভ্যস্ত। আর আমাদের প্রতিনিয়ত হুমকি ও বিপর্যয় নিয়ে চিন্তা করতে হয়। তাই একটি সিস্টেমের ভয়ঙ্কর দিকটি আমাদের কাছে সহজেই ধরা পড়ে। আচ্ছা আপনি তো গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে ‘যত বেশি ভর; যত বেশি অতীতে পাঠানো হবে তত বেশি ভর আমাদের বর্তমান বিশ্ব থেকে হারিয়ে যাবে।’ এখন কেউ যদি কয়েক বিলিয়ন অতীতের একটি পোর্টাল খুলে সেখান দিয়ে ক্রমাগত ভর পাচার করতে থাকে তাহলে হয়তো কয়েকশো বছরের ভেতরই আমাদের পৃথিবীসহ সম্পূর্ণ সৌরজগৎ শূন্যে মিলিয়ে যাবে। এই ব্যাপারটা কি ভেবে দেখেছেন? এখন সব দেশের হাতে এই মহাবিশ্ব ধ্বংসের প্রযুক্তি আছে। যে করেই হোক এটিকে ঠেকাতে হবে।”
অ্যালেক্সের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে; মৃদু কণ্ঠে বলে, “কিন্তু মিস্টার ভাইস প্রেসিডেন্ট; সময় সমীকরণের হিসাব মতে, এক থেকে একশো মিলিয়ন বছর পর্যন্ত টাইম পোর্টাল খুলতে যে শক্তি লাগবে সেটি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব। কিন্তু বিলিয়ন বছরের পোর্টাল তৈরি করতে হলে একটি প্রায় পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ ভরকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সোজা কথায়, পৃথিবীকে ধ্বংস না করে এত বিশাল পরিমাণ শক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।”
“সেটি আমাকে জানিয়েছেন আমাদের গবেষকরা। কিন্তু একটি একশো মিলিয়ন বছরের পোর্টাল খুলে ক্রমাগত ভর পাচার করতে থাকলেও তো প্রায় একই এফেক্ট পড়বে, তাই না?” চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে অ্যালেক্সের দিকে তাকান ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হবার জোগাড় হয়েছে অ্যালেক্সের। এই প্রথম বুঝতে পারে একটি সুতোর উপর ঝুলে আছে মহাবিশ্বের ভাগ্য! এটাও ঠিক ঠিক অনুধাবন করতে পারে, এটিকে ঠেকানোর কোনও উপায় কারও হাতে নেই। কিছুক্ষণ পর কর্নেল ডেনিয়েল এসে বলেন, “মিস্টার অ্যালেক্স, সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বক্তব্য দিয়েছে সে। কিন্তু আজকের বিষয়টা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্বের ভাগ্য যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে কোনও ভুল করা যাবে না। তবে যতটা ভয় সে পেয়েছিল ততটা ভীত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। খুব ভালো ভাবেই সম্পূর্ণ বিষয়টি সহজ ভাষায় উপস্থিত পনেরোটি দেশের মন্ত্রী ও সেক্রেটারিদের সামনে তুলে ধরে অ্যালেক্স। তারাও সহজেই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে মনে হল।
প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন জিজ্ঞেস করলেন, “মিস্টার অ্যালেক্স, সময় ভ্রমণের সমীকরণ সমাধানের পর থেকে অতীত ভ্রমণ সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু ভবিষ্যৎ ভ্রমণ করতে পারছি না কেন? এই বিষয়টা একটু সহজ করে ব্যাখ্যা করবেন কি?”
“অতীত ভ্রমণের জন্যে পোর্টাল খুলতে পারলেও এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা মিলিয়ন বছরের চেয়ে কম সময়ের আর একশো মিলিয়ন বছরের বেশি অতীতের পোর্টাল খুলতে পারি না। সহজ করে বললে এই রেঞ্জের বাইরে পোর্টাল খোলার মতো শক্তি এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করার মতো প্রযুক্তি এখনও আমাদের হাতে নেই। একই কথা ভবিষ্যৎ পোর্টালের ক্ষেত্রেও বলা যায়। মিলিয়ন বছরের চেয়ে কম সময়ের ভবিষ্যৎ পোর্টাল খোলার প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে মিলিয়ন বছর ভবিষ্যতের পোর্টালও খোলা যাচ্ছে না কেন? এর কারণ হয়তো মিলিয়ন বছর পরে আমাদের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে, তাই সেই সময়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
আর একজন সেক্রেটারি বলেন, “কিন্তু এখানে একটি বিষয় বুঝতে পারছি না; সময় ভ্রমণের সময় আমরা স্থান স্থির রেখে শুধু সময়ের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করি। তাই একই জায়গার কেবল অতীতে পৌঁছই। তারমানে স্থানের কোনও পরিবর্তন হয় না। সেই হিসাবে মিলিয়ন বছর ভবিষ্যতে যদি পৃথিবী বা সৌরজগত ধ্বংস হয়ে গিয়েও থাকে, তাহলেও তো স্থান একই থাকার কথা। আমরা ঠিক এই জায়গার ভবিষ্যতে পৌঁছতে পারি, হয়তো পৃথিবী নেই, কিন্তু মহাবিশ্বের স্পেস তো থাকবে!”
কিছুক্ষণ প্রশ্নকর্তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অ্যালেক্স, এমন বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন একজন আমলার কাছ থেকে আশা করেনি সে। “আপনি খুব সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ থেকে প্রশ্নটি করেছেন। ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদের সময়ের প্রকৃতি ঠিকমতো বুঝতে হবে। সময়ের উৎপত্তি হয়েছে মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে। এর আগে কী ছিল? কোথায় ছিল? বা কখন ছিল? এসবের উত্তর এখনও আমার জানি না। তাই মহাবিশ্বের বাইরে সময়ের অস্তিত্ব নেই। এখন কোনও কারণে আমাদের এই স্পেস বা পৃথিবী যদি মহাবিশ্বের বাইরে চলে যায় সেক্ষেত্রে এই স্পেসে সময়ের অস্তিত্বই থাকবে না। আমার ধারণা মিলিয়ন বছর ভবিষ্যতের পোর্টাল খোলা সম্ভব হচ্ছে না কারণ তখন আমাদের পৃথিবী কাল্পনিক সময়ের ভেতর ঢুকে গেছে, মানে মহাবিশ্বের বাইরে চলে গেছে বা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।”
যদিও মিলিয়ন বছর ভবিষ্যতে কথা বলা হচ্ছে, তবুও রুমের ভেতর মৃদু গুঞ্জন ওঠে, সেটি যে ভয়ের তা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি তার।
এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি বলেন, “আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরিস্থিতির গুরুত্ব ঠিক ঠিক অনুধাবন করতে পেরেছেন। পাস্ট ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সাথে আমরা আলোচনা করেছি, তারাও আমাদের সাথে একমত হয়েছে। তারা একটি নিয়ন্ত্রণের ভেতর দিয়ে পর্যটন ব্যবসা চালিয়ে যাবে যাতে করে পৃথিবী ধ্বংসের সময় দুই লক্ষ বছর থেকে বাড়িয়ে এক মিলিয়ন বছরে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু আমাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ অন্য। এখন পৃথিবীর যে কোনও দেশের হাতে, এমন কি অনেকগুলো প্রাইভেট কোম্পানির হাতেও আমাদের সৌরজগতসহ সম্পূর্ণ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পর্যন্ত শূন্যে মিলিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি আছে। এটিকে কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
‘‘মিস্টার সেক্রেটারি, আপনি কী করতে চাচ্ছেন? আমার জানা মতে আমাদের হাতে আর কিছু করার নেই, কোনও বিকল্পও নেই!”
প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে ডিফেন্স সেক্রেটারি বললেন, “আমরা একশো বারো বছর পেছনে ‘৫ই মে ২০৭৬’-এ গিয়ে মহান গণিতবিদ জামিল চৌধুরিকে বুঝিয়ে প্রফেসর ইগরকে সময় সমীকরণের সমাধান না জানানোর জন্যে বলতে পারি। আমার ধারণা তিনি যদি আর একদিন বেশি বেঁচে থাকতেন তবে নিজেই প্রফেসর ইগরকে বলে যেতেন সময় সমীকরণগুলো প্রকাশ না করার জন্যে। নিশ্চয়ই তাঁর শেষ ফোন কলের ইতিহাস আপনাদের অজানা নয়?”
এবার বেশ চমকে ওঠে অ্যালেক্স। গাণিতিক হিসাবে কোনও ভাবেই একশো বছরের অতীতে গিয়ে ঘটনা প্রবাহ পরিবর্তন সম্ভব নয়। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি বিরুদ্ধ এই ভ্রমণ, যা জামিল’স সময় সমীকরণের মূলনীতিও। আর এটি গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের তৈরি করবে, তাত্ত্বিকভাবে তাই কখনই সেটি সম্ভব নয়। তারপরেও, একশ বছর দূর অতীতে পোর্টাল খোলার মতো এনার্জি একবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করার প্রযুক্তিও এখন মানুষের হাতে নেই। হিসাব মতে সমগ্র পৃথিবীর ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করলে এক হাজার বছর দূরের টাইম পোর্টাল তৈরি সম্ভব, সেখানে মাত্র একশো বছর? অসম্ভব। কী বলছেন ডিফেন্স সেক্রেটারি? কোনও গোপন প্রযুক্তি কি আয়ত্ব করে বসে আছে সরকার? হালকা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে সে বলে, “কিন্তু মিস্টার সেক্রেটারি, এটা তো অসম্ভব! কোনও ভাবেই মাত্র একশো বছর পেছনে যাওয়া সম্ভব নয়।”
“কে বলল আমরা এখান থেকে মাত্র একশো বছর অতীতে যাব?” কণ্ঠে রহস্যের ছোঁয়া ডিফেন্স সেক্রেটারির। “আমরা একটি প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছি। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে বিস্তারিত পরে আপনাদের ব্রিফ করবে। তবে সংক্ষেপে যা বলতে পারি, আমরা সাড়ে ছয় কোটি বছর অতীতের একটি পোর্টাল খুলে সেই সময়ে মেক্সিকোর সিজুলুব উপকূলে একটি টাইম ট্রাভেল ল্যাবরেটরি স্থাপন করব। তারপর সেই ল্যাব থেকে সাড়ে ছয় কোটির চেয়ে একশ বার বছর কম ভবিষ্যতের একটি টাইপ পোর্টাল খুলে ঠিকঠিক ‘৪ মে ২০৭৬’-এ গিয়ে উপস্থির হব। সেখানে মহান গণিতবিদ জামিল চৌধুরির দেখা পেয়ে গেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে চিন্তা করুন, জামিল চৌধুরি যদি সময় সমীকরণের সমাধান না করতেন তাহলে আজকে আমাদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত না। প্রিয় বন্ধুরা, আমরা ইতিহাসের ধারা বদলে ফেলতে যাচ্ছি।”
“কিন্তু ঠিক সাড়ে ছয় কোটি বছরই কেন? ছয় মিলিয়ন বছর নয় কেন?” একজন মন্ত্রী চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
“কারণ নির্দিষ্ট করে কোনও একদিনের নির্ভুল সময় ভ্রমণ করতে হলে সাড়ে ছয় কোটি বছরের আগে থেকে না হলে সম্ভব নয়। যদি মিলিয়ন বছর অতীতে গিয়ে মিলিয়ন বছর ভবিষ্যতে যাত্রা করা হয় তবে দশ বছরের প্লাস মাইনাস ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।” কারও অপেক্ষায় না থেকে উত্তরটা অ্যালেক্সই বলে দেয়।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই ভীষণ চমকে উঠে অ্যালেক্স। ডিফেন্স সেক্রেটারি সরাসরি একশো বছর অতীতে না গিয়ে ভিন্নপথে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, থিওরি অনুসারে এটি সম্ভব! কিন্তু তিনি কি বুঝতে পারছেন এটি কেবল একমুখী ভ্রমণ? যে এই মিশনে যাবে তার আর এই সময়ে ফিরে আসার উপায় নেই? এমন কি তার শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া যায় না!
অধ্যায় ছয়
স্থান: অজানা; সময়: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২১৯১
সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় চলছে একটি সভা। বর্তমান পৃথিবীর সেরা ধনী ও প্রভাবশালী কুড়িজন মানুষ উপস্থিত এই সভায়। সকলেই পাস্ট ট্রাভেল এজেন্সির হর্তাকর্তা। বর্তমান বিশ্বে এঁদের প্রভাব এতই বেশি যে অনেক রাষ্ট্রের অর্থনীতি-পররাষ্ট্রনীতি এঁদের দ্বারা প্রভাবিত, কখনও কখনও নিয়ন্ত্রিতও হয়। তাঁরা এখানে মিলিত হয়েছেন গত সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্য নিয়ে।
“আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে আমাদের এত দিনের সকল শ্রম সম্পদ স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে” উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন উপস্থিত একজন মেম্বার।
“আমরা তাদের কথা দিয়েছিলাম যে, পাস্ট ট্রাভেল এজেন্সিগুলো খুব নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে। ফলে যে মহা বিপর্যয় হওয়ার কথা দুই লক্ষ বছর পরে, সেটা হয়তো হবে এক মিলিয়ন বছর পর। তারপর পৃথিবীর সভ্যতার প্রকৃতি কীরূপ হবে সেটি নিয়ে নিশ্চয়ই এখন ভাবনার কোনও কারণ নেই? কিন্তু তারপরেও জাতিসঙ্ঘ কেন এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল সেটি আমার বোধগোম্য নয়!” প্রায় চিৎকার করে বলে আরেকজন।
“হুম, আমি জেনেছি তারা একশো বছর অতীতে গিয়ে সময় সমীকরণের জনক মহান গণিতবিদ জামিল চৌধুরিকে এই সমাধান না প্রকাশ করার অনুরোধ করবে। যদিও তাদের আশ্বাস দিয়েছি যে আমরা সময় ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখবো, তবুও তারা ভরসা করতে পারছে না। মিলিয়ন বছর পরে দুনিয়ার কোনও এক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আমাদের এখন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? এটা পাগলামি ছাড়া কিছু না। আরে, এর আগেই তো কত বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে! যে করেই হোক তাদের এই প্রজেক্টকে প্রতিহত করতে হবে।”
সভায় সকলে একমত হয় নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে ঠেকাতে হবে এই প্রজেক্ট।
সভার চেয়ারপার্সন মৃদ হেসে বলেন, “আমরা কিন্তু এক দিকে দিয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। কয়েক কোটি বছর অতীতে যখন তাদের সময় ভ্রমণ ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে তখন যদি সেটি কেউ ধ্বংস করে দেয় সেক্ষেত্রে আইনি কোনও পদক্ষেপের কোনও ভয় নেই। কারণ যখন কোনও মানুষই পৃথিবীতে ছিল না সেই সময়ে সংঘটিত অপরাধের আবার বিচার কী করে হবে? যাই হোক, পরবর্তী সভায় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে।”
আজকের মতো সভা এখানেই শেষ হয়।
অধ্যায় সাত
স্থান: : মেক্সিকোর সিজুলুব শহর; সময়: ২৩ সেপ্টেম্বর ২১৯২
অ্যালেক্সকে ‘প্রজেক্ট,টাইম সালভেশন’-এ গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়। বিশ্বের নামকরা গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞনীদের সাথে তাকে কাজ করতে হচ্ছে প্রতিদিন। প্রচুর খাটুনি যাচ্ছে। দিনের শুরুই হয় প্রজেক্ট মিটিং দিয়ে আর শেষ হয় পরের দিনের কর্মপরিকল্পনা করে। আজ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় দু’জন যাবে অতীত ও অতীত থেকে ভবিষ্যতে। যেহেতু জামিল চৌধুরির নাগাল পাওয়ার জন্যে হাসপাতালে যেতে হবে তাই একজন ডাক্তার যাবে। বেশ সতর্কতার সাথে অনেক প্রার্থীর ভেতর থেকে একজন তরুণীকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তার সাথে আর একজন কে যাবে সেই ব্যাপারে আজ সিদ্ধান্ত হবে।
কাউকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অ্যালেক্স বলে, “দেখুন, আমি এই সমস্যার কারণ উদ্ঘাটন করেছি। আমি ‘জামিল’স মিস্ট্রি’র সমাধান করেছি। আমার চেয়ে যোগ্য আর কে হতে পারে এই মিশনে যাওয়ার? সবচেয়ে বড় বিষয়, মহামতি জামিল চৌধুরির সাথে বাদানুবাদ করতে গেলে তার যোগ্য একজনকেই পাঠানো উচিত! তাই না? আর আমি ‘জামিল’স টাইম ইকুয়েশন’ এত বিস্তারিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ জানি যে; হয়তো জামিল নিজেও তখন এত জানতেন না।” শেষ এসে আবেগের বশে তার গলার স্বর কিছুটা উচ্চ হয়ে যায়।
প্রজেক্টের ডিরেক্টর হেসে বলেন, “মিস্টার অ্যালেক্স, আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমরা তো আপনাকেই প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করে রেখেছি! আপনি রাজি না হলে তখন বিকল্প খুঁজতে হত!”
কিছুটা বিব্রত বোধ করে অ্যালেক্স, “ধ্যাৎ! আগ বাড়িয়ে কী দরকার ছিল এভাবে বলার?” নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার। কথা ঘোরানোর জন্য বলে, “সরি, আমি বুঝতে পারিনি। আমি অবশ্যই যাব। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন ছিল।”
“কী প্রশ্ন?”
“যদি, মহামতি জামিল চৌধুরির পরে অন্য কেউ নতুন করে আবার সময় সমীকরণের সমাধান করে? সেক্ষেত্রে কেবল তাঁকে ঠেকিয়ে কি আদৌ কোনও সুফল পাওয়া যাবে?”
কিছুটা সময় চিন্তা করে প্রজেক্ট ডিরেক্টর বলেন, “আমাদের এই ঝুঁকিটা নিতে হবে। তবে মহামতি জামিল চৌধুরির বিষয়টা একটু অস্বাভাবিক। জন্মের সময়ই তাঁর বাঁ হ্যানিস্ফিয়ারের উপর একটি টিউমার ধরা পড়ে। মানব মস্তিষ্কের এই অংশটি গণিত ও যুক্তিবিদ্যার উৎস হিসেবে কাজ করে। ধীরে ধীরে টিউমারটি বড় হতে থাকে, একসময় এটি তাঁর মস্তিষ্কের হ্যানিস্ফিয়ারের বর্ধিত অংশ হিসাবে সংযুক্ত হয়ে যায়। ছোট বেলা থেকেই তাঁর গণিতের অসাধারণ মেধার কারণ হিসাবে অনেকে এই টিউমারকেই দায়ী করেন। সহজ কথায়, জন্ম থেকেই তিনি সাধারণের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন গাণিতিক মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মান। এই বিশেষ সক্ষমতাই গণিতে তার সাফল্যের পাশাপাশি অল্পবয়সে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনটি হাজার কোটিতে একবার হয়তো ঘটতে পারে। তাই, মনে হয় না তারপরে আর কেউ সময় সমীকরণের সমাধান করতে পারবে।”
দ্রুতগতিতেই কাজ এগিয়ে চলছে। প্রতিদিনই কিছু কিছু যন্ত্রাংশ, মেশিন সাড়ে ছয় কোটি বছর অতীতে পাঠানো হচ্ছে। বিশাল আকৃতির ইরিডিয়ামের মেশিনপাতি। ল্যাবের দেয়াল, চেয়ার-টেবিল, সুপার কম্পিউটার, ফিউশন জ্বালানি থেকে শুরু করে সকল কিছুই ইরিডিয়ামের তৈরি। এই ‘প্রজেক্ট, টাইম সালভেশন’ ম্যাক্সিকোর সিজুলুব শহরের সমুদ্র উপকূলে বসানো হচ্ছে। এখানে বসানোর কারণ, জামিল চৌধুরি এই শহরের হাসপাতালেই জীবনে শেষ দিনটি কাটিয়ে ছিলেন। পরিকল্পনামাফিক অতীতের সেই সময়ে যখন ভবিষ্যতের টাইম পোর্টাল খোলা হবে তার ভেতর দিয়ে তারা দু’জন ঢুকে পড়বে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! স্থানের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটবে না! তাদের অবস্থান তখন হবে ঠিক হাসপাতালের করিডোরের এক কোনায়। যে জায়গাটিতে কোনও ক্যামেরা বা কোনও নজরদারি নেই। ফাইল ঘেঁটে, হাসপাতালের নকশার সাথে মিলিয়ে সেই জায়গাটি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যে সময়ে ল্যাবরেটরি বসানো হচ্ছে অতীতের সেই সময়ে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল বিরাট আকারের বিকট দর্শন সব ডাইনোসর। তাই খুব সতর্কতার সাথে কাজ করতে হচ্ছে সবাইকে। রাডার সিস্টেম বসাতে হয়েছে যাতে আচমকা ঘাড়ের উপর কোনও দানব এসে হামলে না পড়ে। আর যদি এসেই পড়ে সেটাকে ভড়কে দেওয়ার জন্যেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর সাতদিন মোটে হাতে আছে। তারপর এই সময়ের সবকিছুকে বিদায় জানিয়ে চিরতরে সময়ের অতলে হারিয়ে যাবে অ্যালেক্স।
ভাগ্যে কী আছে এখনও ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছে না। “ঘুরপথে দু’জনে প্রায় একশো বছর অতীতে পৌঁছলাম, গিয়ে জামিল চৌধুরিকে সময় সমীকরণ সমাধানে বাধা দিলাম, তখন আমাদের অবস্থা কী হবে? সময় সমীকরণের সমাধান না হলে এই টাইম ট্রাভেল মেশিনের আবিষ্কার হবে না, সেক্ষেত্রে আমরা কি করে ওই সময়ে উপস্থিত হলাম? ঘুরপথে হলেও পরোক্ষভাবে গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের সূচনা হচ্ছে। কী হবে আমাদের অস্তিত্বের? হতে পারে জামিল চৌধুরির মৃত্যুর সাথে সাথে আমাদের দুজনের অস্তিত্ব শূন্যে মিলিয়ে যাবে। অথবা আমরা ঠিকই থাকব, কিন্তু মহাবিশ্বের প্রান্ত থেকে কেবল দুজনের ভরের দ্বিগুণ পরিমাণ ভর হারিয়ে যাবে। খুব বেশি হলে সেই সময়ের অ্যালেক্স ওয়েভের প্রভাবের কারণে কয়েকটি নক্ষত্র পরিমাণ ভর মহাশূন্যের প্রান্ত থেকে হারিয়ে যাবে।” এমনই উদ্ভট সব চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে অ্যালেক্স।
দুশ্চিন্তা ভুলে সময় সমীকরণগুলো নিয়ে বসে সে, প্রতিদিনই এগুলো দেখছে আর নতুন অনেক কিছু শিখছে। “মহান গণিতজ্ঞ জামিল চৌধুরির মুখোমুখি হতে হলে গাধার মতো আচরণ করলে হবে না।” ভাবে সে মনে মনে। “অবশ্য যতই চর্চা করি না কেন, তাঁর তুলনায় আমি একেবারে গরু-গাধা না হলেও গণিতে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতোই হব। ভাবা যায়! সময় সমীকরণের পুরোটা তিনি মনে মনে সমাধান করেছেন! ধুর! আবার অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা এসে ভর করছে।” জোরে মাথা নাড়িয়ে সব ঝেড়ে ফেলে আবার স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দেয় অ্যালেক্স।
অ্যালেক্স ওয়েভ ফাংশনটির ভিন্ন ভিন্ন রূপ একে একে দেখছে। মনটা হঠাৎ কিঞ্চিৎ বিষন্ন হয়ে উঠে তার, “সময় সমীকরণ থাকবে না, আমার এই ‘অ্যালেক্স ওয়েভ ফাংশন থাকবে না! আমি থাকব না?” হঠাৎ একটা চিন্তা তার মাথায় আসে, “আচ্ছা যদি মিশন ঠিকমতো সমাধা হয়, ঠিকঠিক একশো বারো বছর অতীতে পৌঁছই, তাহলে আমি হয়তো সেই সময়েই স্থায়ী হয়ে যাব। সেখান থেকে কি বর্তমান আমার সাথে যোগাযোগের কোনও উপায় আছে? আমি কি অতীত থেকে কোনও বার্তা এই সময়ে পাঠাব?” স্থির হয়ে কিছুক্ষণ ভাবে সে, প্যাটা-হাইপার-মেইল প্রায় দেড়শো বছর ধরে সার্ভিস দিচ্ছে, অতীতের সেই সময়েও এই কোম্পানির কার্যক্রম ছিল। “আমি কি অতীত থেকে তাদের সার্ভারে একটা সিডিউল মেল সেটাপ করে রাখতাম, যাতে এই সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইমেলটি ডেলিভারি হয়?” ভাবনাটা মাথায় আসতেই দ্রুত হাতে ইমেল চেক করে সে, নাহ কোনও ইমেল আসেনি। আপন মনেই হেসে উঠে, মনে হচ্ছে অস্থির আচরণ করছে কিছুটা।
“আচ্ছা্ প্রায় একশো বছরের অতীতের রেকর্ড ঘেটে ‘অ্যালেক্স নেলসন মুলার’ নামের যতজনকে পাওয়া যায় তাদের ছবি কি মিলিয়ে দেখব?” মনে হতেই হাইপার নেটে সার্চ দেয়, টাইম ফ্রেম ২০৭৬ থেকে ২১৪০। দুই হাজার একশো বাইশ জনের লিস্ট বের করে দেয় কম্পিউটার, একে একে মিলিয়ে দেখছে তাদের ছবি সহ পরিচয়। কয়েক ঘণ্টা সময় নষ্ট। “ধ্যাৎ! আমি নিশ্চয়ই অতীতে পৌঁছে ‘অ্যালেক্স নেলসন মুলার’ নামে পরিচিত হব না। নিশ্চয়ই ছদ্মনাম নেব। উফ! এভাবে সময় কাটালে পাগল হয়ে যাব। বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।” বাইরে যাওয়া কথা ভাবতেই ঝিমঝিম ভাবট কিছু কমে এসেছে, ঘর থেকে বের হয়ে করিডরে দাঁড়ায় সে। ঠান্ডা মৃদু বাতাস বইছে, কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। হঠাৎ পেছনে কে যেন এসে দাঁড়ায়।
“কী খবর, মিস্টার অ্যালেক্স?” রিনরিনে একটা কণ্ঠ কানে যেতেই অদ্ভুত এক শিহরন জেগে ওঠে মনে প্রাণে। কাঁধ নেড়ে ‘তেমন কিছু না’ বুঝিয়ে দিতেই মৃদু হেসে মেয়েটি ডান হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডস্যাকের উদ্দেশ্যে।
অ্যালেক্সের সময় ভ্রমণের সফর সঙ্গী, ডা: লিনিয়া। বয়সে তার সমানই হবে। প্রায় পঁচিশ, কিন্তু দেখলে মনে হয় সদ্য কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্যে অপেক্ষা করছে স্বর্ণকেশী এই তরুণী। হাতটা চেপে ধরতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে যেন তার; সাধারণ মেয়েদের তুলনায় হাত কিছুটা রুক্ষ, চেহারায় কঠোর একটা ভাব আছে, যদিও মনে হচ্ছে চোখ দুটো সদাহাস্যোজ্জ্বল। এমন কঠোরে কোমলে মিশেল; স্বর্গ-সুন্দরী স্বর্ণকেশী যুবতীর সান্নিধ্য তার বয়সের যে কোনও যুবকের বুকে ঝড় তোলার জন্যে যথেষ্ট। প্রথমেই যে চিন্তাটি অ্যালেক্সের মাথায় আসে, ‘মেয়েটি কি জানে এই ভ্রমণ হয়তো একমুখী? হয়তো মৃত্যুও হতে পারে? মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়তে পারে আমাদের আমিত্ব?’ কিন্তু মুখে কোনও কথা ফুটছে না তার, একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন। এই মেয়েটির আশপাশে আসলে তার এমনটি হয়। নাকের অগ্রভাগে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমছে, বুকে যেন বজ্রপাত হচ্ছে ক্রমাগত একের পর এক বিরতিহীন।
অ্যালেক্সকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যেই লিনিয়া বলে, “আর মোটে চব্বিশ ঘণ্টা আছে ‘প্রজেক্ট, টাইম সালভেশন’-এর যাত্রা শুরুর, তাই দেখা করতে এলাম। এই তো কিছুক্ষণ আগে ক্লিয়ারেন্স পেয়েছি। কী কারণে এত গোপনীয়তা তা অবশ্য বুঝতে পারছি না। যাই হোক, আমাকেই প্রজেক্ট লিডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমার কাজ হচ্ছে যে করেই হোক তোমাকে ৪ মে ২০৭৪-এ পৌঁছে দেওয়া। তারপর পেছন পেছন আমিও উপস্থিত হব সেই সময়ে, ব্যাকআপ হিসাবে। কি মুখ এমন ভার করে রেখেছ কেন? কোনও সমস্যা? ভয় লাগছে নাকি?”
“বাপরে! করিডরে দাঁড়িয়েই নিজের কর্তৃত্ব জাহির করে ফেলেছে! আর বলে কি এই মেয়ে? আমাকে জিজ্ঞেস করছে ভয় পাচ্ছি কি না?” মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেয় তার কোনও সমস্যা নেই। মুখে বলে, “আমার কাজ জামিল চৌধুরিকে বুঝিয়ে সময় সমীকরণের সমাধানের পথ থেকে ফিরিয়ে আনা। আমি আপাতত অন্য কিছু ভাবতে চাচ্ছি না।”
“ঠিক আছে, আবার দেখা হবে”, বলেই ঘুরে চলে যায়; পেছনে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে অ্যালেক্স। লিনিয়াকে দেখলেই কেমন যেন বুকের ভেতর চিনচিন অনুভূতি হয়। আর তার আচরণেও কোনও সংকোচ নেই!
যাত্রা শুরুর এক ঘণ্টা আগে প্রজেক্ট ডিরেক্টরের রুমে ডাক পড়ে লিনিয়ার। ডিরেক্টরের পাশে বসে থাকা জেনারেল জর্জ ব্যালিজ টানা কিছু নির্দেশনা দিয়ে শেষে মৃদু কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, “ক্যাপ্টেন লিনিয়া, আবারও বলছি এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করা চলবে না। ক্লিয়ার? তোমার আর কোনও প্রশ্ন আছে কি?”
সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে সিক্রেট সার্ভিসে ক্যাপ্টেন, ডা: লিনিয়া মিলোকোসভা। চোখেমুখে কঠোর ভাব ফুটিয়ে বলে, “বুঝতে পেরেছি স্যার। অল ক্লিয়ার।”
অধ্যায় আট
স্থান: অজানা, সময়: ০৬ আগস্ট ২১৯২
চলছে পাস্ট ট্রাভেল এজেন্সির গোপন সভা। চেয়ারম্যান বলেন, “তারা কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে। আমাদের অবশ্য তেমন কোনও কষ্ট করতে হবে না। আমাদের বিজনেস সিকিউরিটি রিসার্চ টিম একটি পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সে বিষয়টি আপনাদের সামনে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরবে রিসার্চ টিমের দলনেতা।”
দাঁড়িয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দলনেতা তার বক্তব্য শুরু করে। “চেয়ারম্যান স্যার যেমনটি বলেছেন আমরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। তাদের মতো অতীতে আমাদের কোনও ল্যাবরেটরি বসাতে হবে না। সময় মতো শুধু টাইম পোর্টাল খুলে সেই সময়ে আমাদের স্ট্রাইক টিম উপস্থিত হয়ে একটি মিসাইল ছুড়ে তাদের ল্যাবরেটরি সহ সবকিছু গুড়িয়ে দেবে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে গোপনীয় ও নিরাপদ কেন্দ্র স্পেনের টেনেরিফ দ্বীপ থেকে ছোঁড়া মিসাইলটিকে প্রায় নয় হাজার কিলোমিটার দূরের একটি লক্ষ্যবস্তুতে সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত করা। দুটি কারণে এটি প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইল গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে লক্ষবস্তুতে আঘাত করে। কিন্তু সাড়ে ছয় কোটি বছর আগের পৃথিবীর অর্বিটে তো কোনও স্যাটেলাইট নেই। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, বর্তমানে টেনেরিফ থেকে সিজুলুব এর পয়েন্ট টু পয়েন্ট দূরত্ব হচ্ছে নয় হাজার দুশো একুশ কিলোমিটার। কিন্তু সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে এই দূরত্ব কত সেটি অজানা। প্লাস মাইনাস দশ কিলোমিটার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ঠিকঠিক ওই ল্যাবে আঘাত করা প্রায় অসম্ভব। এই কারণে আমরা পরিকল্পনা করেছি, ব্যালাস্টিক মিসাইলের সাথে একটি থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড যুক্ত করে দেব। সেক্ষেত্রে বিশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকায় জীবিত কোনও কিছু থাকবে না। আর সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে একটি পারমাণবিক বিষ্ফোরণের জন্যে আমাদের কোনও দায়ও থাকবে না।” ধূর্ত একটি হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার সারা মুখজুড়ে।
অধ্যায় নয়
স্থান: : মেক্সিকোর সিজুলুব উপকূল, সময়: সাড়ে ছয় কোটি বছর অতীত
তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভূত হয় সমগ্র দেহ জুড়ে। সম্ভবত অ্যালেক্স ওয়েভের কারণে এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। পোর্টালের অপর পার্শ্বে পৌঁছতেই শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু যেন কী একটি ছন্দে আন্দোলিত হতে থাকে। পাক্কা দশ মিনিট লেগেছে অ্যালেক্সের সুস্থির হতে। লম্বা দম নিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে আরও আগেই স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে লিনিয়া। মেয়েটি শারীরিকভাবে অনেক শক্তসমর্থ। তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে শরীর থেকে স্পেক্টা-টাইম-স্যুট খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে, “প্রথম ভ্রমণ?”
লজ্জা পেয়ে যায় অ্যালেক্স, অহমে লাগছে তার। মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেয়, “হ্যাঁ।” গায়ে তখনও জড়ানো স্পেক্টা-টাইম-স্যুট। অভিজ্ঞতা না থাকলে এটি নিজের নিজে পরা ও খোলা বেশ কষ্টকর। লিনিয়া দ্রুত নিজেরটা খুলে অ্যালেক্সেরটা খুলতে সাহায্য করে। প্রায় পনেরো কেজি ওজনের স্পেক্টা-টাইম-স্যুটে বারো ঘণ্টার মতো এমার্জেন্সি লাইফ সাপোর্টের যাবতীয় ব্যবস্থা থাকে। এই স্যুটের কারণে অ্যালেক্স ওয়েভের ধাক্কাটা কম লাগে। “ওহ! গড! এটাই যদি কম হয়, তাহলে স্যুট ছাড়া পোর্টালে ঢুকলে কেমন লাগবে?” ভাবতেই গা শিউরে উঠে তার।
ধীরেসুস্থে ল্যাবের সবকিছু পরীক্ষা করে দেখে দু’জনে মিলে। দু’জনের হাতেই একটি করে কোয়ান্টোটোমিটার। টাইম পোর্টাল অতিক্রমের সময় অ্যালেক্স ওয়েভের মাত্রা পরিমাপ করে এই কোয়ান্টোটোমিটার সময়ের হিসাব সেকেন্ডের ঘরে জানিয়ে দেয়। দু’জনেই হাতের কোয়ান্টোটোমিটার রিসেট করে নেয় শুরুতে। এখন একে একে চারটি ফিউশন রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিন চালু করতে হবে। তারপর সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে টাইম পোর্টাল খুলতে হবে। দ্রুত কাজে হাত লাগায় অ্যালেক্স, একেকটি ফিউশন রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিন চালু করছে আর কম্পিউটারের ডাটা অ্যানালিসিস করছে। সবকিছু ঠিকমতন সেটআপ ও কার্যক্ষম করতে প্রায় দশ ঘণ্টা সময় পার হয়ে যায়। আর দুই ঘণ্টা পর সময় নিয়ন্ত্রণের ফিউশন রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিন চালু করলেই কম্পিউটার ঠিকঠিক ৪ মে ২০৭৪ সালে এনে স্থির করবে টাইম পোর্টাল। একটু বিশ্রামের জন্যে থামে অ্যালেক্স। লিনিয়ার ভেতর বিন্দু পরিমাণ ক্লান্তির ছাপ নেই। মেয়েটি কোন ধাতুতে গড়া?
চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে অ্যালেক্স, হঠাৎ চিৎকার করে উঠে লিনিয়া; তন্দ্রাভাব ছুটে যায় তার। দ্রুত হাতে কম্পিউটারে কিছু ইনপুট দেয়। রাডারে কিছু একটা ধরা পড়েছে, চোখ বড় বড় করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে লিনিয়া! “সমস্যা।” দ্রুত পদক্ষেপে স্পেক্টা-টাইম-স্যুটের দিকে এগিয়ে যায়। অ্যালেক্সেরটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে “জলদি পরে নাও।”
“কী হয়েছে?” বিষ্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে সে।
“রাডারে একটি ব্যালাস্টিক মিসাইল ধরা পড়েছে, আমাদের এই দিকেই এগিয়ে আসছে। সময় আছে মাত্র পনেরো মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড। আমাদের এক্ষুনি পোর্টাল খুলতে হবে।”
এক জায়গায় স্থির হয়ে গিয়েছে যেন অ্যালেক্স। পা মাটিতে গেঁথে গেছে মনে হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “কী? মিসাইল? মিসাইল এখানে কোথা থেকে আসবে?”
“পাস্ট ট্রাভেল এজেন্সি এমন কিছু একটা করতে পারে আগে থেকেই কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলাম। কিন্তু এই মিসাইল নির্ভুলভাবে আমাদের অবস্থানে আঘাত করতে পারার কথা নয়। যদি না… ওহ মাই গড, মাই গড!” এই প্রথম মেয়েটিকে ভয় পেতে দেখে অ্যালেক্স। মুখমণ্ডল পুরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুহূর্তেই।
“কী হয়েছে? যদি না কী?”
“তারা নিউক্লিয়ার পে-লোড যুক্ত মিসাইল ছুড়েছে!”
দ্রুত লিনিয়ার সহযোগিতায় স্পেক্টা-টাইম-স্যুট পরে নেয় সে। “আর ছয় মিনিট” চিৎকার করে বলে লিনিয়া। লাফিয়ে সময় নিয়ন্ত্রণের ফিউশন রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিনের দিকে এগিয়ে যায় অ্যালেক্স। চালু করে কম্পিউটারের সাথে সংযোগ দিয়ে লিনিয়ার পাশে চলে আসে দ্রুত। লিনিয়া চিৎকার করে বলে “তিন মিনিট।” ধীরে ধীরে রিঅ্যাক্টরের এনার্জি নিয়ন্ত্রণ করে সময় বাড়িয়ে যাচ্ছে লিনিয়া। মূলত এই কাজটি অ্যালেক্সের করার কথা; অথচ এত দক্ষ হাতে মেয়েটি এটি করছে যেন সে ডাক্তার নয়, অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার; সারাজীবন রিঅ্যাক্টরের এনার্জি নিয়ন্ত্রণের কাজ করে এসেছে।
টাইম পোর্টাল খুলে গিয়ে ৪ মে ২০৭৪-এ এসে স্থির হয়েছে। অ্যালেক্সের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে লিনিয়া বলে “আর এক মিনিট একুশ সেকেন্ড।”
আশ্চর্য রকমের ধীরস্থির ভাব চলে এসেছে অ্যালেক্সের মধ্যে। বলে, “এক মিনিট অনেক সময়।” চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে লিনিয়ার হাত ধরে বলে, “চলো এবার যাওয়া যাক।”
স্ক্রিনের দিকে চোখ বুলিয়ে লিনিয়া আস্ফুট আওয়াজ করে বলে উঠে, “ওহ নো! নো! গড নো!”
আর সময় নষ্ট না করে লিনিয়ার হাত ধরে টান দিয়ে পোর্টাল লক্ষ করে তড়িদ্বেগে ঝাঁপ দেয় অ্যালেক্স। সারা শরীর দুলছে যেন প্রচণ্ডভাবে। মনে হচ্ছে কতকাল ধরে একটি অন্ধকার টানেলের ভেতর কাঁপতে কাঁপতে এগুচ্ছে। অদ্ভুত সেই অনুভূতি। এক সময় পর্দার মতো পোর্টালের ওপারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তারা, একসাথে। কিন্তু এ কী! এ কোথায় এসে পড়েছে তারা?
কোনও বাড়িঘর তো চোখে পড়ছে না! কোথায় হাসপাতালের করিডোর, কোথায় জনবসতি? ভয়ঙ্কর গতিতে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, তাপমাত্রা ছিয়াত্তর ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য; তার বদলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেনের আধিক্য। ধুলো-বালি-ছাই আর কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে আছে পুরো বায়ুমণ্ডল। কাদার মতো প্যাচপ্যাচে মাটি, ইষৎ উষ্ণ। লিনিয়া একটি পাথরের উপর স্থির বসে আছে।
“লিনিয়া? লিনিয়া? তুমি ঠিক আছ?” তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে গেছে! হঠাৎ মনে পড়তেই হাতের উপর সেট করা কোয়ান্টোটোমিটারে চোখ বুলায়। বিদ্যুৎ খেলে যায় যেন মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে। স্যুটের ভেতরই ঘেমে উঠে সে। “সাড়ে চার বিলিয়ন বছর! মাই গড! ও মাই গড! মাত্র সাড়ে ছয় কোটি বছর ভবিষ্যৎ অতিক্রাম করে সাড়ে চার বিলিয়ন বছর ভবিষ্যতে চলে এসেছি?” ভাবে অ্যালেক্স। “কিন্তু ততদিনে তো পৃথিবী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার কথা? ভুল দেখছি না তো?” ডান হাত দিয়ে কোয়ান্টোটোমিটারের গ্লাসটি একটু মুছে পরিষ্কার করে নিয়ে ভালো মতো নজর বুলায়। “ওহ! নো! গড! সাড়ে চার বিলিয়ন অতীতে চলে এসেছি! কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না! কী ভুল হল?” ভয়ানক দুশ্চিন্তা চেপে ধরে অ্যালেক্সকে।
লিনিয়ার পাশে বসতে বসতে বলে, “সময় দেখেছ?”
মাথা নেড়ে সায় দেয় লিনিয়া। কথা বলতে ভুলে গেছে যেন।
“কীভাবে কী হল? ঠিক মতন সময় সেট করোনি? নাকি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল সময় সেট করেছ?” প্রশ্নটি করেই নিজের ভুল বুঝতে পারে অ্যালেক্স। কোনও ভাবেই সাড়ে চার বিলিয়ন বছর অতীতে যাওয়া সম্ভব নয়। এর জন্যে যে পরিমাণ শক্তিকে টাইম বিম দিয়ে পাস করতে হবে সেটি এক বিন্দুতে ফোকাস করা সম্ভব নয়। যদি না একটি মহাদেশ ধ্বংস করার মতো পারমাণবিক বোমার শক্তি নিষ্ক্রান্ত হয়।
“সময় ঠিকই সেট করেছিলাম। আমরা যখন পোর্টালের ভেতর ঢুকি তখন ব্যালাস্টিক মিসাইলটি ছিল ত্রিশ সেকেন্ড দূরে। কিন্তু তুমি যখন আমার হাত ধরে টান দিলে ঠিক তার আগে আমি রাডারের স্ক্রিনে দেখছিলাম প্রায় তেরো কিলোমিটার দূরে একঝাঁক ক্যাটসোকায়ার্লাসের সাথে মিসাইলটির সংঘর্ষ হয়। তার মানে তখনই সেটি বিস্ফোরিত হয়। আর সেখান থেকে অ্যাটমিক রেডিয়েশন ওয়েভ ত্রিশ সেকেন্ডে না, বলতে গেলে তৎক্ষণাৎ আমাদের এখানে এসে আঘাত করে। সাথে সাথে আমাদের ল্যাবের চারটি ফিউশন রিঅ্যাক্টর ব্যাকআপ জ্বালানিসহ কয়েক টন ইরেডিয়াম একযোগে বিস্ফোরিত হয়। আমার ধারণা আমাদের ল্যাব যেখানে সেটআপ করা হয়েছিল তার আশপাশে অনেকটা প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম মজুদ ছিল। সবমিলিয়ে যে মিলিয়ন মিলিয়ন মেগাটন শক্তি সমাবেশ ঘটেছে তার ফলে টাইম পোর্টাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে এই কল্পনাতীত অতীতে আমাদের ছুড়ে দিয়েছে।” ভয়ে চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মেয়েটির।
সাড়ে চার বিলিয়ন বছর! পৃথিবীতে তখনও প্রাণের আবির্ভাব ঘটেনি। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই অ্যালেক্স বলে, “একটা বিষয় খেয়াল করেছ, বড় বড় কয়েকটি ঘটনা কীভাবে মিলে গেল? বিষয়টি কাকতালীয় হলেও হতে পারে।” লিনিয়ার জবাবের অপেক্ষা না করে বলে যায় অ্যালেক্স, “সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ম্যাক্সিকোর সিজুলুব উপকূলে বিশাল আকৃতির গ্রহাণুর পতনে সমগ্র পৃথিবীর ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই না?”
চমকে উঠে লিনিয়া। মাথা নেড়ে বলে, “তার মানে গ্রহাণুর আঘাতে নয়! আমাদের কারণে এই পারমাণবিক বিস্ফোরণ, আর এর ফলেই ডাইনোসরের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া! ওহ! মাই গড! আসলেই তো! তুমি জানো, ডাইনোসরের ফসিলের সাথে ওই এলাকায় প্রচুর ইরিডিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল? এর থেকে গবেষকরা ধরে নিয়েছিল গ্রহাণুর আঘাতেই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে ডাইনোসর। আর আমাদের ল্যাবের সব কিছু এই ইরিডিয়ামের তৈরি। ওহ! গড!” হঠাৎ ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে লিনিয়া, “বর্তমান পৃথিবীর কী অবস্থা?”
চমকে উঠে অ্যালেক্স, এতক্ষণ এই ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল। পকেট থেকে কম্পিউটারটি বের করে দ্রুত কিছু হিসেব করে সে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতে চায় তার! আমতা আমতা করে বলে, “যে পরিমাণ অ্যালেক্স ওয়েভ তৈরি হয়েছে আমাদের দু’জনের এই সময়ে আসাতে সেই হিসাবে বর্তমান সময় থেকে দশ কি বারো বছরের ভেতর সৌরজগৎ শূন্যে মিলিয়ে যাবে। বুক ফেটে কান্না আসছে পৃথিবীবাসীর দুর্দশার কথা ভেবে। তাদের বাঁচাতে গিয়ে উল্টে ধ্বংসের গতি ত্বরান্বিত করলাম, ডেকে আনলাম মহাবিপর্যয়!” ভাবে সে। “আর কতক্ষণ সময় আছে আমাদের হাতে?”
“আমার দশ ঘণ্টা এগারো মিনিটের মতো অক্সিজেন বাকি আছে, তোমার কতটুকু?”
স্যুট পরীক্ষা করে অ্যালেক্স বলে, “নয় ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট। যাক বাঁচা গেল।”
“মানে?” চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে লিনিয়া।
“মানে, তোমার বিশ মিনিট আগে আমি মারা যাচ্ছি, জীবনের শেষ সময়টুকু আমাকে নিঃসঙ্গ কাটাতে হবে না।”
হৃদয়বিদারক ব্যাপারটা উপেক্ষা করে চুপ করে আছে লিনিয়া। গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। অ্যালেক্সও কোনও কথা না পেয়ে চুপচাপ বসে থাকে। অপেক্ষা করছে নিশ্চিত মৃত্যুর। আচমকা লিনিয়া বলে, “মৃত্যুর আগে তোমাকে একটা সত্যি বলে যাই, মিশনের ব্যাপারে তুমি আংশিক সত্য জান। আমি ডাক্তার তবে সিক্রেট সার্ভিসের। আমার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল তোমাকে ৪ মে ২০৭৪-এ পৌঁছে দেওয়া। পাশাপাশি জামিল চৌধুরির সাথে যে করেই হোক সাক্ষাতের ব্যাবস্থা করে দেওয়া। তুমি তাঁকে বোঝাতে ব্যর্থ হলে আমার দায়িত্ব ছিল তাকে হত্যা করা। সেটি সম্ভব না হলে প্রফেসর ইগর ভাসিলেভকে হত্যা করা।” বলতে বলতে মাথা নিচু হয়ে যায় লিনিয়ার।
অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অ্যালেক্স। লিনিয়ার জন্যে খারাপ লাগছে তার। বেচারি! যে হত্যা সে করেনি তার জন্যে অনুতাপে ভুগছে। “এখন আর এসব চিন্তা করে লাভ কী বলো? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। চোখ বন্ধ করে একবার ভাবো, সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগের পৃথিবীতে আমি আর তুমি, শুধু দু’জন মানুষ! কোনও প্রাণী নেই। আর কোনও জীবনের স্পন্দন নেই। নেই কোনও প্রাণ, কোনও গাছ, কোনও শৈবাল। সত্যি বলতে এই সময়ে কিছুই নেই, ভাবতে পার?”
চমকে উঠে অ্যালেক্সের দিকে তাকায় সে। কিছু একটা ঝিলিক দিয়ে উঠে তার চোখে তারায়! আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় লিনিয়া। বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে, কিছু একটা ধরে দাঁড়াতে পারলে সুবিধা হত। বেশ দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, ঘণ্টা দেড়েক আগেও সূর্য ঠিক মাথার উপর ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায় অ্যালেক্স! এটা কি চাঁদ? মনে হচ্ছে মাথার উপর এসে পড়েছে একেবারে! এত কাছে আর এত বড়!
কিছু একটা মনের ভেতর খচখচ করছে, পাশেই একটি বড় পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে মনেমনে হিসাব কষতে থাকে অ্যালেক্স। গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সকে এখনও অতিক্রম করতে পারেনি তারা। টাইমলাইন বদলানো সম্ভব হয়নি মানুষের পক্ষে। সময়ের গতিপথ বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা একশো বছর অতীতে যেতেই পারেনি! প্রকৃতি নিজ হাতে এটাকে রক্ষা করছে। “আচ্ছা, আমাদের উদ্ধারের জন্যে কি ভবিষ্যৎ পৃথিবী থেকে কোনও দল আবার আসবে?” ভাবনাটা মাথায় খেলে যেতেই আশপাশ হেঁটে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে অ্যালেক্স; যদি অন্য কোনও দল টাইম পোর্টাল খোলে, তবে এর আশপাশেই হবে সেটির অবস্থান। লিনিয়া এখনও গভীর চিন্তায় মগ্ন, মাঝেমাঝে হালকা উষ্ণ পানিতে আনমনে হাত বোলাচ্ছে। “মানসিকভাবে খুব বেশি ধাক্কা খেয়েছে কি? কিছুটা অপ্রকৃতস্থ আচরণ করছে না সে?” ভাবনাটা উঁকি দেয় তার মনে।
পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় পার হয়ে গেছে, এখনও কোনও উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছায়নি। ভোরের আলো ফুটছে সন্তর্পণে। অপর দিকে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন! হঠাৎ মুখ তুলে লিনিয়া বলে, “তুমি এমন দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছ কেন?”
“পরীক্ষা করছি যদি, কোনও উদ্ধারকারী দল এসে উপস্থিত হয়!”
“এখানে এসে বসো”, বলেই হাতের ইঙ্গিতে তার পাশে বসার আহ্বান করে লিনিয়া। বসতেই অ্যালেক্সের হাতের উপর হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এত কাছ থেকে কাচের পেছনে তার মুখে প্রতিটি রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড এক দুঃখভাব ফুটে উঠেছে সেখানে। মৃদু কণ্ঠে বলে, “আসবে না, অ্যালেক্স! কোন সাহায্য আসবে না। এখানে, এই সময়েই আমাদের মৃত্যু হবে। এতক্ষণ ভেবে ভেবে জীবনের নিগূঢ় রহস্যের সমাধান করেছি, এটাই সেই রহস্যের চাবিকাঠি।” চোখের বাঁধ ভেঙে গেছে, অঝোরে বয়ে চলছে জলের ধারা।
কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তার সেই কান্না! নারীর দেবীরূপ প্রকাশিত হয় যখন সে অকৃত্রিম আবেগে চোখের জল ঝরায়। খুব ইচ্ছা করছে তার গালে হাত বুলিয়ে সেই আবেগধারাকে ছুঁয়ে দেখতে! মৃদু স্বরে বলে, “লিনিয়া, তুমি আমাকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলে?”
আচমকা এই প্রশ্ন শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় লিনিয়া। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না খুঁজে। ফিসফিস করে বলে, “আসলে আমি কোনও বাঁধনে বাঁধা পড়তে চাচ্ছিলাম না। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী ছিলাম, জীবনকে পুরোদমে উপভোগ করতে চেয়েছিলাম। রোমাঞ্চের লোভে সিক্রেট বাহিনীতে যোগ দিলাম, সেখান থেকে ডাক্তারি পড়তে পাঠানো হলো। ভালোই তো কেটে যাচ্ছিলো জীবন! কিন্তু এখন কেন যেন সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে, সবকিছু।”
পরিশিষ্ট
সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগের পৃথিবী; লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অবিউজেনেসিস প্রক্রিয়া চলছে পৃথিবীর সমুদ্রের পানিতে, জীবনের আদিগর্ভ। মৌলিক কনাগুলো দানা বাঁধছে আর তৈরি করছে জীবনের চারটি মৌলিক উপাদান লিপিড, কার্বোহাইড্রেট, অ্যামিনো অ্যাসিড ও নিউক্লিক অ্যাসিড। তৈরি হচ্ছে আর ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু জীবনের শুরু কেন যেন হচ্ছে না। কী যেন নেই! কীসের অভাবে শুরু হতে পারছে না জীবন নামের মহান বিশুদ্ধতম কোনও কিছুর অস্তিত্ব?
“আমাদের একজোড়া প্রাণ পৃথিবীতে জীবনের শুরুর বীজ হিসাবে কাজ করবে! এখানেই মৃত্যু হবে আমাদের। তারপর প্রাণ বায়ু, রুহ, সোল, আত্মা এটিকে যাই বলো না কেন, তা এই মৌলিক জড় উপাদানের ভেতর সঞ্চারিত করবে প্রথম স্পন্দন, প্রথম প্রাণ, প্রথম জীবন! বিজ্ঞানীদের কাছে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ধাঁধা, প্রথম আত্মার শুরু, আমি এখন জানি কীভাবে হয়েছে সেই শুরু। তুমি কি বাইবেল পড়েছে, অ্যালেক্স? আদম-ইভের গল্প বিশ্বাস করো?” করুণ চোখে অ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে থাকে লিনিয়া।
“বাইবেল সেভাবে পড়া হয়নি। আদম-ইভের গল্পকে গল্প হিসাবেই জানি। কেন? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করছ?”
“ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করে আদম ও ইভ নিষিদ্ধ আপেল খেয়েছিল। সেই নিষিদ্ধ আপেল ছিল প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের দরজা। এতেই তারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করে। আমরাও ঈশ্বরের নিষেধ অমান্য করে সময়কে জয় করে তার গতিপথ পরিবর্তণ করেতে চেয়েছিলাম। তাই এমন এক সময়ে আমরা নির্বাসিত হয়েছি, যখন নেই এখানে কোনও প্রাণের স্পন্দন। আমরা এই সময়ের সর্বপ্রথম প্রাণ!”
অক্সিজেন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, যৌক্তিক চিন্তা করার সামর্থ্যের উপর তার প্রভাব পড়ছে। অনেক উদ্ভট চিন্তা মাথায় খেলছে তার। লিনিয়া নিজেকে আদম-ইভের সাথে তুলনা করছে। তার এই হাইপোথিসিসে অনেক ভুল আছে। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সে ঠিক বলছে। গুছিয়ে ভাবতে পারছে না অ্যালেক্স এখন কোনও কিছু। পাথরের উপর বসে আছে অপরূপ সুন্দর মেয়েটি; তার কৈশোর জীবনের প্রেম। প্রথম ভালো লাগা। ঠিক পেছনে উদিত হচ্ছে ভোরের সূর্য। স্পেক্টা-টাইম-স্যুটের কাঁচের উপর দিয়েই তার চোখে মুখে গালে হাত বুলিয়ে দেয় অ্যালেক্স। “জীবনের শেষ কয়েকটি ঘণ্টা এত আনন্দে কাটবে স্বপ্নেও কি ভেবেছিলাম? পরিপূর্ণ এক জীবন কাটিয়েছি, পূর্ণ করেছি জীবনের আদি-অন্ত চক্র। ধ্বংসের ভেতর বাজিয়েছি প্রাণের নতুন ছন্দ। তৃপ্ত। অতি সুখের ভেতর দিয়ে বরণ করছি মৃত্যুকে।” মনে মনে ভাবে অ্যালেক্স। লিনিয়ার কোলে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলে, “আর মোটে এক মিনিট আছে অক্সিজেন। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে?”
ক্লিক করে একটি বাটন টিপতেই ক্যাঁচ আওয়াজ করে খুলে যায় কাঁচের আবরণটি। লিনিয়া মোজা খুলে অ্যালেক্সের মাথায় হাত বুলাতে থাকে, ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। মাথার উপর ঝুঁকে আছে লিনিয়া, হঠাৎ গালের উপর কয়েক ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে। “লিনিয়া তুমি আমার জন্যে কাঁদছ? কী করে শুধিব এই ঋণ, জীবনের এই শেষ সময়ে?” ভেতরে হাহাকার করে ওঠে অ্যালেক্সের। আর খোলা রাখতে পারছে না চোখ, বন্ধ হয়ে আসছে চিরতরে। আবছা ভাবে দেখতে পায় লিনিয়ার একটি হাত ধীরে ধীরে মাস্কের বাটনের দিকে এগিয়ে যায়। ক্যাচ করে খুলে যায় তার কাচের আবরণটি। কী সুন্দর, কী সুন্দর!
টিকা:
- হাইপা – (কাল্পনিক) – ভবিষ্যতের কমিউনিকেটর ডিভাইস। পকেট কম্পিউটার, মোবাইল, স্মার্ট ডিভাইস সবকিছু একটার মধ্যে।
- সাবস্পেস সিগনালিং – (কাল্পনিক) – স্থানকে বাঁকিয়ে দূরবর্তী দুটি বিন্দুকে কাছে এনে তার ভেতর দিয়ে দ্রুতগতিতে সিগনাল আদান প্রদানের পদ্ধতি।
- মহাবিশ্বের ভর – বর্তমান হিসাব মতে মহাবিশ্বের ভর প্রায় 1.5×1053 কেজি। কিন্তু আমার এই গল্পে আমি ব্যবহার করেছি 1.09×1063 কেজি; কারণ গল্পের পটভূতি আজ থেকে প্রায় পৌঁনে দুশো বছর ভবিষ্যৎ। তখনকার হিসাব মতে কাল্পনিক এই মান ব্যবহার করেছি।
- প্ল্যাংক সময়ে – সম্ভাব্য সবচেয়ে ক্ষুদ্র সময়ের একক। এটার মান 39 x 10−44 সেকেন্ড।
- হাইপার নেট – (কাল্পনিক) – ভবিষ্যতের সুপার ফাস্ট ইন্টারনেট।
- ইরিডিয়াম – অত্যন্ত বেশি ঘনত্ব বিশিষ্ট ধাতু। ২২.৫৬ গ্রাম/সিসি।
- স্পেক্টা-টাইম-স্যুইট – (কাল্পনিক) – সময়ের পোর্টাল অতিক্রম করার সময় এই স্যুটটি পরতে হয়। জীবন রক্ষাকারী অতিজরুরী কিছু জিনিস সেট করা আছে এতে।
- কোয়ান্টোটোমিটার – (কাল্পনিক) – কাল্পনিক ঘড়ি। এটি টাইম পোর্টালে ঢুকার সময় যে অ্যালেক্স ওয়েভের সৃষ্টি হয় তা পরিমাপ করে কত সময় অতীতে ভ্রমণ হয়েছে সেটির সেকেন্ডের কাটায় মেপে বের করে দেয়।
- ক্যাটসোকায়ার্লাসের – উডন্ত বিশাল আকৃতির ডাইনোসর।
অসামান্য, অপূর্ব – উপন্যাসটি হার্ড সাই ফাই বটেই, কিন্তু চমৎকার সাহিত্যের রাস্তা থেকে একচুলও সরে আসেনি। টাইম ট্রাভেল নিয়ে লিখতে বসে অনেক নামকরা লেখকও ছড়িয়েছেন। কিন্তু এই লেখাটি একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। দুর্দান্ত ব্যাখ্যা সমেত একটা সম্পূর্ণ কল্পবিজ্ঞান। লেখককে অনেক অনেক অভিনন্দন। আমরা তাঁর থেকে এরকম আরও লেখা আশা করব।
ধন্যবাদ দাদা। এই গল্পটা অনেকটা রাগ করেই লেখা। বাংলায় সেই গতানুগতিক ধাচের টাইম ট্রাভেল সাইফাই পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়েই এই লেখাটা লিখতে বসেছিলাম।
“দাদার ডাইরি পড়ে বাড়ির গ্যারেজে বসে বসে টাইমমেশিন বানিয়ে ফেললাম অথবা অতীতে গিয়ে নিজেকে মহাগুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়ে আসলাম বা নিজের বোকামীর জন্যে একটি চক্রে আটকা পড়লাম” এই ধরনের চর্বিতচর্বণ প্লটের গল্প পড়ে রাগ থেকে এই গল্পের অবতারণা।
বলছি না যে ঐ প্লটের গল্প ভালো হয় না, অবশ্যই ভালো গল্পও হতে পারে। কিন্তু একই টাইপের গল্প আর কত ভালো লাগে? তাই ব্যতিক্রমী কিছু লেখার চেষ্টা আর কী! এখন পাঠকের ভালো লাগলেই রাগ/দুঃখ/অভিমান সব স্বার্থক হবে।
অনেক শুভকামনা রইল।
কী লিখেছেন ভাই! হ্যাটস অফ! হার্ড সাইফি আর কল্পনার এমন মিশ্রণ এই বাংলায় এমন মৌলিক কাহিনিতে দেখতে পাব – এ ভাবতেও পারিনি। অসাধারণ লেখা। আরও লিখুন, পড়ার জন্য আমরা আছি, থাকব। অল দ্য বেস্ট।
অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনার মতো গুণী লেখকের কাছ থেকে এমন প্রশংসা পাওয়া আমার জন্যে অনেক অনুপ্রেরণার। অনেক শুভকামনা রইল।
Banglay time travel niye eto bhalo hard sci fi pray porai hoyeni Amar…ba hoyto lekhai hoyeni…ei lekha ek itihas.. suvecha o bhalobasa neben…erokom golpo aro chai :)darun . Darun…
থ্যাংকস ভাই। চেষ্টা করেছি ব্যতিক্রমী কিছু লেখার। আপনার ভালো লেগেছে দেখে আমারও ভালো লাগছে। লেখার খাটুনিটা আনন্দে রুপান্তরিত হয়ে গেল। অনেক শুভকামনা রইল।
বিজ্ঞান থেকে শুরু হয়ে মানবিকতায় শেষ, এক অসামান্য হার্ড সাই ফাই পড়লাম , আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা, ভবিষ্যতের জন্য দাবী রইলো পাঠক হিসেবে।
অনেক ধন্যবাদ ভাই। শুভকামনা রইল।
অসামান্য লেখা! বাংলায় এমন বাস্তব কল্পবিজ্ঞান কবে পড়েছি মনে করতে পারছি না, বিশেষ করে সময় ভ্রমণের ওপর। তার সঙ্গে এক টানটান থ্রিলারের স্বাদ এবং এমন একটি অনুভূতি যা এই লেখাটি পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসিয়ে রাখে। কুর্ণিশ!
অনেক ধন্যবাদ ভাই, এমন চমৎকার মন্তব্য করে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে। শুভকামনা রইল।
Daun. Durdanto. kono bhasha nei. aro beshi beshi kore likhun… amader porar khide bariye dilen.
অনেক অনেক ধন্যবাদ। এমন চমৎকার মন্তব্য লেখার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেক শুভকামনা রইল আপনার জন্যে।
অসাধারন হয়েছে। এমন scientific লিখা আগে পড়িনি। time machine related English movie দেখেছি। চমৎকার লিখা হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ দিদি। আপনার জন্যে অনেক শুভকামনা রইল।
Awesome💯💯💗💗
অসাধারণ !!!! অপূর্ব !! বহুদিন পর এমন দুর্দান্ত একটি sci-fi পড়লাম। আরও এমন লেখা পড়ার আশায় রইলাম।
অনেক অনেক ধন্যবা। এমন মন্তব্য আরও লেখার অনুপ্রেরণা জোগা। ভালো থাকুন, নিরন্তর শুভকামনা।
অসাধারণ অসাধারণ ! মিথ্যে বলবোনা লাস্ট একবছর মতো এই ম্যাগাজিনে কল্পবিজ্ঞান গল্প এর নামে যে পরিমাণ অত্যাচার করা হতো পাঠকদের উপর তা রীতিমতো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। অনেক টা ওই যা লেখে তাই আধুনিক কবিতার মতো যা লেখে তাই কল্পবিজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো! আগে প্রতি তিনমাস অন্তত অপেক্ষা করে থাকতাম কবে বেরোবে ম্যাগাজিন! এইবারের দেখলাম অবচেতন থেকেই ভুলে গেছি ম্যাগাজিন টার কথা। মানে মস্তিষ্ক আর চাচ্ছেনা কল্পবিজ্ঞান পড়ার নামে তার উপর কোনো অত্যাচার হোক।
.
এই অবস্থায় আজ হঠাৎ এক বন্ধু আপনার গল্পের লিঙ্ক পাঠিয়ে বলল অসাধারণ লিখেছেন ভদ্রলোক ‚ পড়ে দেখ। লিঙ্ক খুলে দেখি ……………! বাপরে বাপ! কি সাঙ্ঘাতিক লিখেছেন দাদা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। খাওয়ার সময়ও ফোন হাতে করে বসেছি ‚ না পড়ে ছাড়তে ইচ্ছাই করছিলোনা।
.
দারুণ দারুণ! আপনার হাতে তো সরস্বতী বাস করে দেখছি। অসাধারণ হয়েছে ! ধন্যবাদ এমন একটা উপহারের জন্য!
কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। আপনি এতো উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করেছেন যে, রীতিমতো আপ্লুত হয়ে গেছি। সেইসাথে কিছুটা বিব্রতবোধও করছি। এতো প্রসংশার কি আসলেই যোগ্য এই লেখা?
অদ্ভুত ভালোও লাগছে আপনার চমৎকার মন্তব্য পড়ে, বারবার পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে।
অনেক অনেক শুভকামনা রইল, দাদা। দোয়া করবেন যেন আরও লিখে যেতে পারি।
আপনার মতামতের জন্যে ধন্যবাদ সৌভিক। কল্পবিশ্ব শুধু কল্পবিজ্ঞান নয়, স্পেকুলেটিভ ফিকশানের পত্রিকা। তার সমস্ত গল্প কল্পবিজ্ঞান নাও হতে পারে। যাই হোক শুধু মাত্র কল্পবিজ্ঞানের নামে ‘অত্যাচার করা হচ্ছে’ এমন অভিযোগ এই প্রথম আমরা পেলাম। কিন্তু মুস্কিল হল, ব্যাখ্যা করে না জানালে তো এই নিয়ে আলোচনা চালানো যায় না। আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি কল্পবিজ্ঞান গ্রুপে আপনার অপছন্দের ‘যা লেখে তাই কল্পবিজ্ঞান’ নিয়ে একটু আলোচনা করতে। তাহলে আমরাও একটু দিশা পাবো আপনাদের পছন্দ কি ধরনের কল্পবিজ্ঞান তাই নিয়ে। কল্পবিশ্বের পাঠক সংখ্যা সারা পৃথিবীতে লাখ খানেক ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে সবার পছন্দ মত সব গল্প প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তবুও আপনাকে অনুরোধ করব – এই ধরনের মন্তব্য করার আগে একটু ভেবে চিন্তে আলোচনার মাধ্যমে আপনার পছন্দ অপছন্দ জানাতে। আমাদের সাথে আপনি kalpabiswa.kalpabijnan@gmail.com – এই ইমেইল আইডিতেও মতামত জানাতে পারেন।
-কল্পবিশ্ব
দারুণ লিখেছেন। আপনার কলমের দীর্ঘায়ু কামনা করি।
আমি মূলত হার্ডকোর সাইফাই লেখি। এধরণের গল্পের পাঠক আমাদের এখানে কম। স্রোতে না ভেসে তাই এখনও এইসব গল্প লিখে যাচ্ছি। আপনার মতো পাঠকের এমন চমৎকার অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্য লেখার আগ্রহ বাঁচিয়ে রাখে। অনেক ধন্যবাদ৷ আশা করি সামনের লেখাগুলোও ভালো লাগবে।
খুবই ভালো লাগলো। চালিয়ে যান
অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশা করি সামনের লেখাগুলোও আপনার ভালো লাগবে।
আমি অনেকক্ষন ভাবলাম কি মতামত করব। কিন্তু এত্তো এত্তো চমৎকার একটা সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত সম্বোধনসূচক মতামত আমি খুঁজে পাচ্ছিনা মনের ডিকশনারিতে
কিছু বলতে হবে না। আপনার অল্পকিছু শব্দই আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে। শুভকামনা রইল।
কি অসাধারন গল্প লিখলেন আপনি!!!!!!!অনেকদিন পর আমি কোন ওয়েবসাইটে এক বসাতেই পুরো একটি গল্প\উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম।সময় ভ্রমন নিয়ে পড়তে পড়তে বুঝতেই পারিনি কতোটা সময় চলে গেছে। প্লিজ আরো লিখুন।এ গল্পটি পড়েই আপনার নতুন বইটি কেনার লিস্টে নিয়ে ফেললাম রকমারিতে।শুভ কামনা ভাইয়া।
অনেক ধন্যবাদ ভাই। সম্মানিতবোধ করছি। আশা করি ও টু উপন্যাসটিও ভালো লাগবে। পড়া হলে একটা রিভিউ দিয়েন, সম্ভব হলে। শুভকামনা রইল।
বাংলাদেশ থেকে পড়ছিলাম;
এখন সায়েন্স ফিকশন বলতে তো একক গল্প হয়ে গেছে। আর এ লেখায় বহু চরিত্রের সংমিশ্রণে বাস্তবতা আর যুক্তি সবমিলিয়ে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।
পুরোটা সময় লেখার মধ্যে ডুবে ছিলাম।
যা বুঝলাম লেখকের লেখার প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান, যেটা খুব একটা এই সময়ের লেখকদের মাঝে দেখা যায় না।
শুভকামনা রইলো, পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকলাম ❤️
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক। আপনার মন্তব্য পরের গল্প লেখায় অনুপ্রেরনার কাজ দিবে।
পরের গল্প, (ঠিক গল্প নয়, উপন্যাস) নালন্দা প্রকাশনি থেকে এবারের একুশে বই মেলায় বের হয়েছে। উপন্যাসের নাম “ও টু” পড়ে দেখতে পারেন। শুভকামনা রইল। রকমারি থেকে অনলাইনেও যোগাড় করতে পারেন।
গল্পের মাঝামাঝি আছি। চমৎকার লেখা। একটা বিষয়ে খটকা লাগল – টাইম ট্রাভেল এজেন্সি গুলো যে মানুষগুলোকে অতীতে পাঠাচ্ছে, তারা ফেরত আসছে কিভাবে? ভবিষ্যৎ ভ্রমণ তো সম্ভব নয়! এক মিলিয়ন, দুই মিলিয়ন বছর অতীতের যাত্রা যদি একমুখী হয়, তাহলে লোকজন ছুটি কাটাতে, হানিমুন করতে অতীতে যাওয়ার প্ল্যান করছে কিভাবে?
আপনি কতটুকু পড়েছেন বুঝতে পারছি না। আপনার প্রশ্নটির উত্তর গল্পে আছে। আমি আপাতত কমেন্টে সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি। স্পয়লারও হয়ে যেতে পারে।
পোর্টাল একবার খোলার পর যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রাভেলররা ফিরে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি একটিভ রাখা হয়। কারণ একই সময়ে আবার টাইম পোর্টাল খোলার সম্ভব নয়। কারণ মিলিয়ন বছর অতীতে একুরেসি প্লাস মাইনাস দশ বছর। আর এই কারণেই দুই বার ভরের অসামঞ্জস্যতা তৈরি হচ্ছে। প্রথমবার যখন অতীতে যাচ্ছে, দ্বিতীয় বার যখন আবার নিজ সময়ে ফিরে আসছে। আর এই কারণেই সেই সুদূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এলেক্স ওয়েভের সৃষ্টি হচ্ছে এবং মহাবিশ্ব বিপুল পরিমান ভর হারাচ্ছে।
আর জামিল কিন্তু সময় সমীকরণের সমাধান অতীত ও ভবিষ্যত ভ্রমণ দুটি ক্ষেত্রেই সমাধান করা করেছিলো। কিন্তু ভবিষ্যত ভ্রমণ যে কারণে সম্ভব হচ্ছে না সেটির ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। নিকট অভিষ্যতে তো যাওয়া যাবে না, প্রচুর শক্তির প্রয়োজন। আবার দুই তিন মিলিয়ন বছর ভবিষ্যতের পোর্টাল খোলা যাচ্ছে না, কারণ তখন আমাদের পৃথিবী শূন্যে মিলিয়ে গেছে। মানে, স্থান-কালের মাত্রার বাইরে, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
অনেক ধন্যবাদ। পড়া শেষ হলে আপনার বিস্তারিত সমালোচনা প্রত্যাশা করছি। শুভকামনা রইল।
পড়া শেষ করেছি।
টাইম ট্র্যাভালিং নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন সাধারণ থেকে একটু বেশি। এ সংক্রান্ত কোন গল্প পেলে পড়ে ফেলি। নেটফ্লিক্সে মুভি দেখার ইচ্ছা হলে “টাইম” লিখে সার্চ দেই। নেটফ্লিক্সে “Dark” নামের একটি টিভি সিরিজ আছে – জার্মান টিভি সিরিজ। কাহিনী, সাসপেন্স, থ্রিল সবকিছু মিলিয়ে আমার দেখা সবচেয়ে উপভোগ্য টাইম ট্রাভেল সংক্রান্ত টিভি প্রোগ্রামগুলোর একটি।
এই গল্পটিতে “Dark” এর সাসপেন্স আর থ্রিল রয়েছে। তবে সবকিছু মিলিয়ে “Dark” কে ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে গল্পের পেছনের মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কার্যকরণের সম্পূর্ণতা। আন্তর্জাতিক সাহিত্যে টাইম ট্রাভেল অনবদ্য সব সৃষ্টি রয়েছে, তাই সে তুলনায় আমি যাব না। বাংলা ভাষায় এ নিয়ে যেসব লেখা আমি পড়েছি, তার মধ্যে এটিকে প্রথমে স্থান দেয়া যায়।
এই গল্পটি ইংরেজিতে প্রকাশের কোন পরিকল্পনা লেখকের আছে? এটি অন্যান্য ভাষাভাষী পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার দাবী রাখে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি যেভাবে লেখাটির প্রশংসা করলেন, কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। খানিকটা আপ্লুত হয়ে গিয়েছি।
ইংরেজিতে প্রকাশের ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু আমি নিজে করলে সাহিত্যমান বজায় রাখতে পারবো না।
তবে টেক্সাসে বসবাসকারী একজন বাঙালী বড়ভাই লেখাটার ইংরেজি করার কথা বলেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই আশা করি শেষ হবে।
অনেক ধন্যবাদ, শুভকামনা রইল।
বাহ! চমৎকার! সাইফূল ইসলাম হাইজেনবার্গ অনিশ্চয়তা ও ভরের সংরক্ষণ নীতিকে খুবই সুচারুভাবে প্রয়োগ করেছেন। ভবিষ্যতের দেশ-কাল বিলোপের দরুণ ভ্রমণ সম্ভব হচ্ছে না সেই ধারণাটিও বেশ অভিনব। অনেক কটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নীতিকে লেখক মুন্সীয়ানায় প্রয়োগ করেছেন। যবনিকাটিও অনান্য। তাঁকে অভিননন্দন। তিনি আরো লিখুন। দীপেন ভট্টাচার্য
গল্পটা এক কথায় দারুণ লাগলো। মনে হলো যেন সবকিছু এমনি হতে পারে। Today’s fiction tomorrow’s reality, who knows what will happen. যুক্তিগুলো একেবারে অকাট্য ছিল। বেশ উপভোগ করেছি গল্পটি।