অগ্নিপথ
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী: সুমন দাস
স্থান: কেনিয়া
কাল: ৫,০০০,০০০ বি.সি.ই.
পাত্র: মুসা (পিকিং মানব)
[“Seek wood already touched by fire. It is not then so very hard to set alight” ~ African Proverb]
||১ক||
আকাশ লাল, বাতাস ভারী, ভোর অস্নিগ্ধ। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী উড়ে যাচ্ছে চীৎকার করতে করতে। অনতিদূরের বন থেকে দলে দলে পশুরা ছুটে পালাচ্ছে যতটা দূরে পারা যায়। বাঘের পাশে হরিণ, হাতির পাশে গণ্ডার, খরগোশের মাথার ওপর দিয়ে বন্য কুকুর। আর যে বড় গুহা-শ্রেণীর পাশ দিয়ে এই পলায়মান জীবনের স্রোত, যার আশেপাশে যাওয়া পশুপক্ষীদের অলিখিত নিষেধ, সেই গুহামানবদের দল এখনো গুহা থেকে বের হয়নি। নিমা আর তার দলবল গুহার মধ্যে এখনো থরথর করে কাঁপছে; তাদের প্রত্যেকের চোখে ভয়ানক আতঙ্ক। মেয়েরা সন্তান বুকে জড়িয়ে কাঁদছে, যুবকেরা হাতের পাথর আলগাভাবে ধরে রেখে চুপ করে বসে আছে আর প্রৌঢ়রা ভয়ানক অস্থির হয়ে বারে বারে নিমার দিকে তাকাচ্ছে।
কাল সারারাত আকাশ চীৎকার করেছে। দিনের আলো রাতের অন্ধকারে হানা দিয়েছে ওদের কাছে। নিমারা গুহায় থাকে বলে রক্ষা পায়। পশুপক্ষীরা শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পায় না। তাদের অনেকেই মরে যায়। নিমারা ছোঁয় না ওসব। শয়তান ওর মধ্যে বাস করে; ওদের মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ওরা ক’টা দিন ওই জায়গা থেকে দূরে দূরে থাকে।
নিমার ছেলে মুসা কাল রাত থেকে গুহায় নেই। অত্যন্ত ডাকাবুকো ছেলে – অসীম শক্তিধর, অকুতোভয়। আওয়াজ শুনে শয়তানকে নিকেশ করতে পাহাড় চুড়োয় উঠেছে, আর নামেনি। মুসা’র মা অঝোরে কাঁদছে – ইনিয়ে বিনিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করছে এক কোণায় বসে।
অতি-সাহসী দু’একজন, যারা দলপতি হওয়ার দাবীদার, তারা গুহার মুখে দাঁড়িয়ে গুহার বাইরে একবার উঁকি মেরেছিল। তারা সবাইকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে দেখে আর যাওয়ার কথা ভাবেনি। মুসার কথা তারাও ভাবছে। কী সাহসী! কিন্তু শয়তানকে কি হার মানানো যায়?
মুসার দুই প্রেমিকা – সিরি আর তিয়া। দুজনেই মৃতপ্রায়। মুসা না ফেরা মানে আর কারো সাথে তাদের থাকতে হবে। অথচ তা তাদের ইচ্ছা নয়। মুসার মতন শক্তিমান আর এ দলে কেউ নেই। সে তাদের ভয় পেতে দেখে আর মাটিতে মুখ গুঁজে গোঙাতে দেখে স্থির থাকতে পারেনি। হাতের লম্বা পাথরটাকে শক্ত করে চেপে ধরে পাহাড়ের মাথায় শয়তানের সঙ্গে লড়বে বলে গেছে। আর ফেরেনি।
এমন সময় গুহার মুখে জান্তব হুঙ্কার, আর তারপরেই সকলে সবিস্ময়ে দেখে গুহামুখে দাঁড়িয়ে মুসা, একহাতে শয়তানকে বেঁধে নিয়ে এসেছে!
***
মুসা পাহাড়ে উঠেছিল প্রচণ্ড বৃষ্টিকে সঙ্গী করে। পিছলে পিছলে যাচ্ছিল পা, কিন্তু হাতের অস্ত্রটাকে ছাড়েনি। সে যখন পাহাড়ের মাথায় উঠল তখন মাঝরাত। সে আকাশের দিকে তাকাল। তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। আকাশে কালো-বর্ণের জল। সেখান থেকে জল পড়ছে ধারাপাতের মত। শয়তান কি তাহলে জল? আকাশে উঠে গর্জন করে জল ঢালে?
অকস্মাৎ তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে দেখল জলের মধ্যে আলো, দিনের আলোর মত আলো জলের একধার থেকে অন্যধারে চলে গেল। আর শয়তানের সে কি চীৎকার। যেন মুসাকে সে সহ্য করতে পারছে না। চলে যেতে বলছে। মুসা প্রত্যুত্তরে পাথর তুলে ভীষণ গর্জন করে বোঝাতে চাইল, সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
আর তারপরেই… অনেক দূরে বনের মধ্যে শয়তানের আলো নেমে এল, আর সে কী চীৎকার! মুসার হাত থেকে পাথরটা ঠক্ করে মাটিতে পড়ে গেল, সারা গা অবশ হয়ে গেল। সে দেখল আলো এবার বনের মাঝে। অর্থাৎ আকাশের শয়তান মাটিতে নেমেছে তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য। তাকে আহ্বান জানাচ্ছে বনের মধ্যে থেকে।
খানিকক্ষণের জন্য মুসা ভয়ে অবশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আবার তার মধ্যে সেই অকুতোভয় ভাব জেগে উঠল। সে এবার হাতের পাথরটা শক্ত করে ধরে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল।
বনের মধ্যে যখন পৌঁছল তখন শয়তান ভীষণাকার ধারণ করেছে। বনের পশু তার দিকে দৃকপাত না করেই দৌড়চ্ছে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞানশুন্য হয়ে। সে শয়তানের সামনে গিয়ে রণ-হুঙ্কার দিল। প্রত্যুত্তরে সে দেখল শয়তানের মধ্যে থেকে একটা হরিণ বের হয়ে এলো টলতে টলতে, তার সারা গায়ে শয়তান ভর করেছে। সে আর চলতে পারছে না। তার সারা গা কালো হয়ে গেছে। করুণ স্বরে কার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে জানাতে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে মুসার সামনে। অবশেষে মুসার পায়ের থেকে একটু দূরে ধপাস করে পড়ে গেল।
মুসা আবার রণ-হুঙ্কার দিল। ওপর থেকে জল পড়ার বেগ আরো যেন বেড়ে উঠল। তার সাথে রণ-হুঙ্কার। মুসা যেদিক থেকে হরিণটা এসেছিল, সেদিকে প্রাণপণ শক্তিতে হাতের পাথর ছুঁড়ে মারল। শয়তানের আজ আর নিস্তার নেই।
কিন্তু শয়তানের যেন কিছুই হল না। সে সেইরকমই রইল। মুসা এবার আশেপাশের বড় বড় পাথরগুলোকে বিপুল উদ্যমে তুলে নিল, আর এক এক করে শয়তানের দিকে ছুড়তে লাগল। এইভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল বাকি রাত। শয়তান নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আলো থামল, জল থামল, আকাশের জল মিলিয়ে গেল আকাশে।
জিতেছে! মুসা জিতেছে! সে কালো হয়ে যাওয়া বনের মধ্যে ঢুকল। চারদিকে নিস্তব্ধ। দূরে আর আকাশে পশুপাখির চীৎকার। তারা পালাচ্ছে। মুসা একটু দূরে তার পাথরটা খুঁজে পেল। সে সেটাকে হাতে নিলো। চারপাশে তার ছোঁড়া আরো বড় বড় পাথর। অর্থাৎ সে প্রচুর মার খেয়েছে। হঠাৎ তার মনে হল, কই শয়তান তো একবারও মার দেয়নি! এত অসীম শক্তিমান শয়তান নেমে এসেও মার দিল না! মার খেয়ে পালাল! তা কি করে হয়!
সে গভীর থেকে গভীরতর বনে এসে থমকে দাঁড়াল। এ কী! শয়তান এখানে এসে ধুঁকছে! ওই ওই একটা ডাল পড়ল মাটিতে। তার একটা দিকে শয়তান ভর করেছে। সে এগিয়ে এসে এবার আর পাথরটা ছুঁড়ল না। শয়তানকে ভাল করে দেখতে লাগল। দাউদাউ করে জ্বলছে শয়তান। সে মুখ নামিয়ে শয়তানের কাছে আনল। একটা উষ্ণতা তার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। বেশ লাগল। এটা কি তাহলে শয়তান নয়! বন্ধু? তাদের প্রিয়? না না তা কেন? তাহলে সবাই ভয় পায় কেন? না কি শুধু মানুষের বন্ধু?
মুসা একবার ভাবল, তারপর বন্ধুর গায়ে হাত দিতে গিয়েই আর্তনাদ করে উঠল। সে লাফিয়ে দু’পা দূরে সরে গেল। জ্বলন্ত চোখে তাকাল। এ শয়তান না হয়েই যায় না। কিন্তু…
শয়তান তাকে আঘাত করল না। মুসার মনে হল যেমন করে তারা তাদের জাদুকরকে ছুঁতে পারে না, কেবল জাদুকর একমাত্র যাকে তাকে নিজের ইচ্ছামত ছুঁতে পারে এই আলোও তেমনি। একে ছোঁয়া যায় না, যেতে পারে না। মুসারা জাদুকরের লাঠি মাথায় ছুঁয়ে শিকারে বের হয়। তার আশীর্বাদ সঙ্গে গেলে শিকার ভাল হয়। তবে কি…!!!
মুসা গাছের ডালের যেদিকটায় আলো ধরে নি, সেই দিকটা হাত ছোঁয়ায় আলতো করে। না, কোন ব্যথা লাগে না। এবার পাথরের অস্ত্রটাকে একপাশে রেখে দু’হাতে ডালটাকে তুলে নেয়। ডালের মাথায় আলো। মশালটাকে (হ্যাঁ, ভবিষ্যতে একে এই নামেই ডাকা হবে) দু’হাতে মাথার ওপর নিয়ে আনন্দে চীৎকার করে। তারপর একহাতে অস্ত্র, আরেক হাতে আলো নিয়ে বনের বাইরে বেরিয়ে আসে…
||১খ||
মানব সভ্যতায় বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয় আগুন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে। ঠিক কীভাবে, কবে মানুষ আগুনের ব্যবহার শুরু করে তা আজও অজ্ঞাত। তবে সভ্যতার যে সূচনা তার দু’পায়ে ভর করে দাঁড়ানো থেকে শুরু হয়েছিল, আগুনের ব্যবহারে সেই সূচনা অগ্রগতিতে পরিণত হয়। মানুষ এরপরে কাঁচা মাংস পুড়িয়ে খেতে শেখে। গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে শ্বাপদের হাত থেকে নিজের সমাজ ও সভ্যতাকে বাঁচাতে শেখে। আরো পরে কীভাবে আগুন তৈরি করা শেখে, তাও জানা যায় না। তবে চকমকির আবিষ্কার অনেক পরের কথা। দাবানল, বজ্রপাত বা অগ্নুৎপাতের ওপর অনেকটা সময় ভরসা করে যে তাদের চলতে হয়েছিল একথা সত্য।
পাঁচ লক্ষ বছর আগে মানবজাতির এক প্রাচীন প্রতিনিধি – পিকিং মানবের হাত ধরে আগুনের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৮১ সালে কেনিয়াতে এক জীবাশ্ম থেকে যে প্রমাণ মেলে, আপাতত সেটাই হল সবচেয়ে পুরনো, প্রায় ১,৪২০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ আগে মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত, তার প্রমাণ মেলে।
সেই সময় দিনের শেষে আগুন জ্বালানো হত, সারারাত জ্বলত আলো, ভোরের দিকে কমে যেত তার জোর। বাকি সারাদিন ধিকিধিকি করে জ্বালিয়ে রাখা হত। তারপর সন্ধেয় সবাই ফিরে এলে আবার আগুনের তেজ বাড়ানো হত। সেই আগুনে চলত মাংস ঝলসানোর পালা; শীতে তাপ পোহানোর কাজ; বা অনেক সময় পুরোহিত এই সময় জাদু দেখাত, কিংবা পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে পূজো করত; হয়তো কোথাও কোথাও ছেলে-মেয়েতে মিলে আগুনকে ঘিরে চলত নাচ; তারপর ক্লান্ত মানুষ পোড়া মাংস খেয়ে গুহামুখে আগুনের তেজ বাড়িয়ে যেত শুতে। নিশ্চিন্ত ঘুমের গভীরে স্বপ্ন দেখত… সুখের স্বপ্ন।
ঘর্ষণের ফলে যে আগুন জ্বলে তা মানুষ শিখল এরপর। প্রথম কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালাতে শিখল – অরণি। বিজ্ঞানী চিরকালই আছে, তখনও ছিল। তাদের কেউ কেউ এই আগুন জ্বালানোর মন্থর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করল চকমকি পাথর। আগুনের মাহাত্ম্য বাড়ল। শিকারের প্যাটার্ন গেল বদলে। আগুনের ভয়ে পশুপাখি বন ছেড়ে সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে ঢুকে গেলে বাকি মানুষেরা পিটিয়ে মেরে শিকার করতে শুরু করল। গর্তে থাকা খরগোস জাতীয় প্রাণী এবার আস্তে আস্তে মানুষের খাদ্য তালিকায় ঢুকে পড়ল। তারপর শত্রু-পশু যেমন বাঘ বা সিংহ – এদেরকেও একইভাবে মেরে ফেলে নিজেদের অঞ্চলকে আরো সুরক্ষিত করার কাজে আগুনের ব্যাপক ব্যবহার হতে শুরু করল।
আস্তে আস্তে নিজেদের এলাকা পরিষ্কার করার কাজেও আগুন লাগল। আগুন দিয়ে বনের কিছু অংশ অল্পসময়ের মধ্যে সাফ করে বসতি স্থাপন হতে লাগল। মানব প্রজাতির আস্তে আস্তে বিস্তার ঘটতে লাগল। যাযাবর জাতির মানুষ আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো আফ্রিকা থেকে, ছড়িয়ে পড়ল একে একে মিডল ইস্ট, এশিয়া মাইনর; সেখান থেকে সাইবেরিয়া হয়ে রাশিয়ার উত্তরাংশের বরফ অধ্যুষিত এলাকার প্রণালী পেরিয়ে নিজেদের অজ্ঞাতে পা দিল উত্তর কানাডায়, তারপর সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে, এবং সাউথ আমেরিকা। সারা বিশ্বজুড়ে শুরু হল মানুষের জয়যাত্রা। প্রকৃতিকে জয় করে নিজেদের একাধিপত্য স্থাপন – অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রামে এবং পরে আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রামে। কিন্তু সে অন্য গল্প। সেখানে আগুনের ব্যবহার অন্যরকম, অন্যভাবে। সে গল্প আরেকদিন করা যাবে।
||১গ||
মুসা পরে আবিষ্কার করল, কাঁচা মাংস খাওয়ার থেকে পোড়া মাংসের স্বাদ আরো বেশি। বন থেকে বেরোনোর পরে যে হরিণটা পড়েছিল সেটাকে সে পরে নিয়ে আসে তার লোকেদের দেখানোর জন্য। আগুন শয়তান নয়, শত্রু নয়, সে কারোও শরীরে ঢুকে ক্ষতি করে না, এটা দলের লোকেদের সামনে প্রমাণ করতে গিয়ে সে হরিণের মাংস খেয়ে দেখায়, এবং তখনই আবিষ্কার করে মাংসের অনাস্বাদিত স্বাদ। যদিও দলের লোকেরা অনেক চাঁদ পরে তার দেখাদেখি মাংস খেতে শুরু করল। সিরি মুসার দেখাদেখি পোড়া মাংস খেতে শুরু করলেও, তিয়া কিন্তু আজীবন কাঁচা মাংসই খেয়ে এসেছে। সে তার বাপ-দাদাদের শেখানো নিয়ম ভাঙতে চায় নি।
মুসা তার জীবনের বাকি সবকটা চাঁদ শুধুমাত্র আগুন কীভাবে পুরোমাত্রায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তার চেষ্টা করে গিয়েছিল। সে দলপতি হতে পারেনি। পেয়েছিল দলপতির চেয়েও উচ্চ আসন। তাকে জাদুকর বলা হতে লাগল – বিজ্ঞানীর সর্বপ্রাচীন দশা। সে মারা যাওয়ার পর পরের জাদুকরেরাও তার দেখানো পথে চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে কয়েক শতাব্দী পরে হঠাৎ করে আবিষ্কার হল – কাঠে অগ্নি-তত্ত্ব আছে।
[ক্রমশ]
[সব চরিত্র কাল্পনিক]
Tags: প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, প্রবন্ধ, সুমন দাস