অগ্নিপথ ৭ – অগ্নিকন্দুক
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী: সুমন দাস
স্থানঃ হালিশহর
কালঃ ২০১৮
পাত্রঃ সুমন ও সুমনা
|| ৭ক ||
-কে তুমি?
আমার সামনে যে আছে সে আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে। চেয়ার উলটে পড়ে গেছে মেঝেতে। সে টেবিলের দিকে পিছন করে ঝুঁকে। আমি যদি তাকে এই মুহূর্তে আক্রমণ করি তাঁর বাধা দেওয়ার মত শক্তিও যে নেই সেটা বোঝাই যাচ্ছে। হত চকিত হওয়ার কারণ আছে। আমিও কম হত চকিত নই। কারণ আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আমারই অতীত, আমার আমি। কেবল পার্থক্য একটাই… সে মেয়ে, আর আমি ছেলে।
-আমি সুমন দাস…
সে বিড়বিড় করে কি বলল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি আবার বললাম,
-আমি তোমার ভবিষ্যৎ। ৩০১৮ সাল থেকে এসেছি, জন্মান্তর বলে যে একটা ব্যাপার আছে সেটা এই প্রথম প্রমাণিত হল।
-প্যারালাল ইউনিভার্স, তাঁর বিড়বিড়ানিটা এবার শুনতে পেলাম।
-হ্যাঁ। আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমাদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব একই সঙ্গে ঘটে। কেবল মাত্রা বদলে যায়। আমাদের আসলে অতীতও নেই, ভবিষ্যতও নেই। যা আছে তা কেবল বর্তমান।
-হুঁ…, সে একটু ধাতস্থ হয়েছে বলে মনে হল। ঘামছে। ঘরটা কোন আদ্যিকালের…
সে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বলল, আমার নাম সুমনা।
আমি হাসলাম।
ঢোক গিলল সে। এখনো ধাতস্থ হয় নি।
-আমি একটা ব্যাপারে জানতে এসেছি। তোমার ডায়েরীটা…, আমি ডায়েরীটা দেখালাম। সে চকিতে তাঁর আলমারির দিকে তাকাল। আমি বললাম, সেটা যথা স্থানেই আছে। এটা তোমার ভবিষ্যতের সম্পূর্ণ ডায়েরীটা।
সুমনা ‘হাঁ’ করে তাকিয়ে আছে। আমি সুমনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার ওকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে। লোভ সম্বরণ করলাম। কোন লাভ নেই। আমরা দুজন দুই মাত্রায় আছি। শব্দকেও মাত্রা বদল করাতে হচ্ছে।তত দূর পর্যন্ত আমাদের বিজ্ঞান যেতে পেরেছে। কিন্তু তা বলে স্পর্শ করা সম্ভব নয়। এতটা আমরা পারিনি। ও আমাকে দেখছে ছায়া ছায়া — কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছে যে, আমি ওরই একটা রূপ।
-তোমার ডায়েরীটা শেষ হয়েছে নিউক্লিয়ার ফিশান আর ফিউশন দিয়ে। মানে এরপর আর নেই।
-কিন্তু… কিন্তু আমি তো আরোও অনেক কিছু লিখেছি।
-সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।
-কীভাবে?
-সে অনেক গল্প। যাওয়ার সময় বলে যাব। কেবল একটা কথা জেনে রাখো, এখনকার পৃথিবী আর তোমাদের পৃথিবীর মতো নেই। সেখানে বাস করা যায় না। আমরা বাস করি মাটির তলায়।
-অ্যাঁ…!!!
-হ্যাঁ। একটা বিশ্বযুদ্ধে সব শেষ। পৃথিবীর ওপরে বাস করার মত আর অবস্থা নেই। আমাদের কাছে এই ডায়েরীটা রূপকথার মতই… আমি এসেছি একটাই কথা জানতে। এতে আর কি কি লিখেছ? আমরা বেশিদিন থাকব না। পৃথিবীতে আর বেশিদিন আমরা বাঁচতে পারব না। তাঁই জেনে যেতে চাই অতীতের পৃথিবী কেমন ছিল।
সুমনা কি নিজেকে পাগল ভাবছে? কি জানি। হয়তো ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে। তাঁর কাছে তো এটা স্বপ্নই। সে আলমারি থেকে ধীরে সুস্থে ডায়েরীটা বের করল। দেখলাম, সে নিজের হাতে একবার চিমটিও কেটে নিল। আমার হাসি পেল। চেয়ারে বসে ধীরেসুস্থে ডায়েরীর পাতা খুলে বলল, এরপর লিখেছিলাম আতসবাজী নিয়ে।
-আমায় সংক্ষেপে বলো।
|| ৭খ ||
মোটামুটি হাজার বছর আগে চীন দেশে আতসবাজীর আবিষ্কার হয় এবং তা উৎসব উপলক্ষেবহুল ভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। আসলে বারুদের আবিষ্কারই এর পেছনের মূল কারণ। বাঁশের নল নিয়ে তার মধ্যে বারুদ ঠেসে ঠেসে ভরা হত। এবং তারপর একটা অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে তার পরে তাঁর মধ্যে ছুড়ে দেওয়া হত। তার কিছুক্ষণ পরেই ‘দুম ফটাশ’। আসলে চিনারা মনে করতেন, এরকম হঠাৎ তীব্র শব্দে শয়তান ভয় পেয়ে দূরে চলে যাবে। উৎসবের সময় শয়তানের আগমন কারোরই কাছে মনঃপুত ছিল না।
এর পর একটা বড় কঞ্চির ডগায় সেই ‘বংশ-কন্দুক’ বেঁধে তাতে আগুন ধরানো হতে লাগল। প্রথম রকেটের ব্যবহারের কথা জানা যায় ১২৩২ সালের কাই-কেং’র যুদ্ধে। চায়না আর মঙ্গোলিয়ার মধ্যে এই যুদ্ধ হয়েছিল। চীনারা এই যুদ্ধে রকেট-তীর নিক্ষেপ করে মঙ্গোলিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে। তারপর তাদের দেখাদেখি মঙ্গোলিয়ানরাও এই ধরনের রকেট ব্যবহার করতে শুরু করে। এরপর সেখান থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই রকেটের ব্যবহার।
ইংরেজ ফিলোজফার রজার বেকন তাঁর লেখায় জানান, কীভাবে বারুদের ব্যবহারকে আরোও উন্নত করার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয় এবং সেই সাথে রকেটের পাল্লাও বেড়ে যায়। ১৪০০ সালের আশেপাশে ফ্রান্সের ফ্রইসার্ট লেখেন কিভাবে রকেটের পাল্লা আরোও বাড়ে এবং তার লক্ষ্যভেদ নিখুঁত করা সম্ভবপর হয়।
আবিষ্কারের প্রথম ৭০০ বছর কিন্তু আতশবাজীর রঙ ছিল শুধু হলুদ। তারপর ফরাসী কেমিস্ট ক্লাউডি বেরহোল্ট যখন পটাশিয়াম ক্লোরেট আবিষ্কার করার পর আতশবাজী রংবেরং হতে শুরু করে।
|| ৭গ ||
কাগজের বা কাঠের ছোট্ট ছোট্ট কাঠি তৈরী করে তার মাথায় বারুদ অল্প করে — ব্যাস, আপনার দেশলাই কাঠি তৈরী। একটু ঘর্ষণেই উৎপন্ন হবে তাপ, জ্বলে উঠবে আগুন। যখন খুশি তখন আগুন ধরানো বা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে অগ্নির প্রয়োজনে, কিম্বা ধুমপান করার উদ্দেশ্যে যার কোন জুড়ি নেই।
ইংরেজ কেমিস্ট জন ওয়াকার ১৮২৭ সালে এই দেশলাই কাঠি আবিষ্কার করেন। তাঁর একটা ফার্মেসী ছিল, যেখানে বিস্ফোরক নিয়ে গবেষণা করতেন। হঠাৎ করেই তিনি এই রাসায়নিক মিশ্রণ আবিষ্কার করেন — এন্টিমণি সালফাইড আর পটাশিয়াম ক্লোরেট। একটু ঘষলেই এরা জ্বলে ওঠে। এর আগে ওয়াকার পটাশিয়াম ক্লোরেটের তৈরী দেশলাই কাঠি বানিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেটাকে জ্বালাতে গেলে কাঠিটাকে সালফিউরিক এসিডের বোতলে ডুবাতে হত। এরপর আরোও গবেষণা করেন, এবং অবশেষে পাঁচ ভাগ পটাশিয়াম ক্লোরেট, পাঁচ ভাগ এন্টিমণি সালফাইড, তিনভাগ এরাবিক গাম এবং এক ভাগ আয়রন অক্সাইড দিয়ে তৈরী হয় এই অনবদ্য কাঠিটি।
পেটেণ্ট কিন্তু পেয়েছিলেন স্যামুয়েল জোনস। লুসিফার ম্যাচ নাম দিয়ে প্রথম এটা বাজারে বের হয়। প্রথম দিকের কাঠিগুলো বেশ ভালোই পরিমাণে আগুন ঝলসে উঠত, সাথে সাথে আওয়াজও ছিল তেমনি। আগুনও এক এক সময় এক এক রকম ভাবে ধরত, কখনও বা ধরত না আদৌ। আর গন্ধের কথা না বলাই ভাল। পরবর্তীকালে সাদা ফসফরাস এই সমস্যাগুলো দূর করে। কিন্তু তখনকার সময়ে কাঠিগুলোকে কিন্তু এয়ার টাইট কৌটোর মধ্যে রাখতে হত।
সুইডিশ কেমিস্ট গুস্তভ এরিক পাসচ ১৮৪৪ সালে আবিষ্কার করলেন আমরা যাকে বলি ‘সেফটি ম্যাচ’(Safety Match)। আগের ম্যাচটাকে বলা হত ‘ফ্রিকশান ম্যাচ’ (Friction Match)। প্রথমেপাসচ সাদা ফসফরাসকে বাদ দিলেন। তার বদলে নিয়ে এলেন লাল ফসফরাস। আর লাল ফসফরাস এবং গ্লাস পাউডার দিয়ে তৈরী করলেন একটা সমতল কোটিং, যার উপর কাঠিটাকে ঘষা হবে। এরপর বাদ গেল এন্টমণি সালফাইড এবং পটাশিয়াম ক্লোরেটও। অল্প পরিমাণ সাদা ফসফরাস আবার যোগ করা হল তার বদলে। এটা কাঠিটার মাথাটাকে হঠাৎ করে অল্প ঘর্ষণে জ্বলে উঠতে দারুণ ভাবে সাহায্য করল। অবশেষে যে দেশলাই তৈরী হল, তা কেবল নিরাপদই নয়, সবদিক থেকেই তুখোড়।
পেটেণ্ট নেওয়ার পরে গুস্তভ স্টকহোমের একটি কারখানায় এই দেশলাই উৎপন্ন করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে জন লান্ডস্টর্ম নামক আরেক জন সুইডিশ বিজ্ঞানী বাক্সের বাইরের গায়ে কোটিং করা রেড ফসফরাস বাদ দেন এবং তার বদলে ব্যবহার করেন স্যান্ড পেপার। ১৮৮৫ সালে এই সেফটি ম্যাচ বাজারে বেরোতে শুরু করে। লান্ডস্টর্ম আর তাঁর ভাই কার্ল ফ্রান্স এই কাঠি বাজারে ছাড়েন যথেষ্ট পরিমাণে রাজনীতি করেই, গুস্তভের ম্যাচ মার্কেট থেকে পিছু হটতে শুরু করে। যদিও লান্ডস্টর্মের সেফটি ম্যাচ অনেক বেশি নিরাপদ ছিল, কিন্তু তবুও সেই ম্যাচে যে জিনিসগুলো ব্যবহৃত হত সেগুলো একদিক থেকে বিষাক্ত এবং যথেষ্ট ক্ষতিকর। ১৯১০ সালে ডায়মণ্ড ম্যাচ কোম্পানী আমেরিকার বাজারে প্রথম দেশলাই কাঠি বাজারে নিয়ে আসে যা বিষাক্ত নয়।
|| ৭ঘ ||
১৯০০ সালের মাঝামাঝি গানপাউডার বা বারুদই ছিল একমাত্র শক্তিশালী বিস্ফোরক। ১৮৪৬ সালে নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার হওয়ার পরে কিন্তু ব্যাপারটা বদলে যায়। কারণ নাইট্রোগ্লিসারিন কি রকম ধরণের ভয়ানক বিস্ফোরক তা কল্পনাও করা যায় না। পীতাভ তরল এই পদার্থের অল্প পরিমান ব্যবহার করে পাহাড় ধ্বসিয়ে দেওয়া সম্ভব! এর সাথে সাথে যোগ হয় এর ‘আনস্টেবিলিটি’, অর্থাৎ কি না পরিবহনে একটু এদিক ওদিক হলেই গেছেন আর কি। যিনি বয়ে নিয়ে চলেছেন, তিনি ত গেলেনই, সাথে সাথে তেমন পরিমাণ হলে আশপাশের ছোট খাটো অঞ্চল পুরো উড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল এই কঠিন কাজটা সম্পন্ন করলেন। তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। এই নাইট্রোগ্লিসারিনকে অক্লেশে এবং নির্ভয়ে পরিবহনই শুধু নয়, তাকে ঠিকমত ব্যবহার করার মতন অবস্থায় নিয়ে চলে এলেন। এর পরিবর্তে তাকে কি খেসারত দিতে হল? পরীক্ষা করতে গিয়ে বিস্ফোরণে তাঁর ফ্যাক্টরীর একাংশ উড়ল, তাঁর ভাই সমেত বেশ কয়েকজন শ্রমিকের মৃত্যু হল।
নোবেল প্রথম যেটা করতে পারলেন তা হল মার্কারি ফালমিনেট ডিটোনেটরের সংগে নাইট্রোগ্লিসারিনকে মিশ্রিত করতে সক্ষম হলেন। এরপর তিনি এই বিস্ফোরককে বাজারে আনলেন বটে, কিন্তু এর ক্ষমতা এবং বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার জেরে বেশ কয়েকটি দেশে এর ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া। কারণ একটু ভুল ব্যবহারে প্রাণহানি বা ক্ষয় ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। নোবেল আবার কাজ শুরু করলেন। তাঁর হাতে এল চক পাথর, যাকে বলে Diatomeceous earth, এর সাথে তিনি মেশালেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে। সৃষ্টি হল ‘ডিনামাইট’। মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড, কিন্তু তা মনুষ্যসৃষ্ট এবং অনেকখানি নিরাপদও বটে।
১৮৬৭ সাল থেকে এর ব্যবহার শুরু হয় বিশ্ব জুড়ে। মুস্কিলটা কি হল জানেন? পাহাড় ফাটানো ইত্যাদি কাজে এর ব্যবহার আশীর্বাদই বটে। বিশেষত নোবেল সাহেব সেই ভেবেই এটাকে বানিয়েছিলেন, কিন্তু মানুষ কি আর সেই টুকুতেই থেমে থাকে? তাকে অভিশাপ না বানানো পর্যন্ত যে তাঁর শান্তি নেই। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক অবশেষে মানুষেরই বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে লাগল। যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে যে এর জুড়ি নেই!
নোবেল চমকে গেলেন। তাঁর দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ঠাঁই পায় নি যে এমনটা হতে পারে। তাঁর ভাইকে বলি দিয়েছেন এমন একটা পরম আশীর্বাদে। আর সেই মহান সৃষ্টিরই কি না অবশেষে এমন চরম পরিণতি! তিনি একে বললেন ‘Merchant Of Death’। এবং অবশেষে তাঁর সমস্ত অর্থ উইল করে সাতটি ক্ষেত্রে পুরস্কারের বন্দোবস্ত করলেন, আজ যা নোবেল পুরস্কার বলে খ্যাত।
আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সুমনাকে বললাম, কেন যে তোমরা ডায়নামাইট বানাতে গেলে। ধ্বংসের বীজ ত সেদিনই পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। নোবেল এমন আকটা ভয়ানক কাজ না করলে তো আমদের এমন শেষের সে দিনটাকে দেখতে হত না।
“বিজ্ঞান আর রাজনীতি যে এক বস্তু নয়।” সুমনা বলল, “ডায়নামাইট তো ছল মাত্র। চেঙ্গিস খাঁ বা তৈমুর লঙ যা ঘটিয়েছিল তা কোন ডায়নামাইট ব্যবহার করে? যে মানুষের রক্তে বিষ তার হাতে ডায়নামাইট না, একটা পাটকেলই যথেষ্ট।”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। ভগ্নকন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর? আর কি মারণাস্ত্র তোমরা বানিয়েছিলে এরপর?”
|| ৭ঙ ||
-এর পর বানিয়েছিলাম আমরা অনেক কিছুই, কিন্তু আমি ডায়েরীতে তা লিখিনি, একটা বাচ্চাকে বোমের কথা বলতে ভাল লাগে না। তোমায় বলি শোনো…
-ডায়নামাইট যুদ্ধের গতি প্রকৃতিই বদলে দিল। একের পর এক মারাত্মক বোমা আবিষ্কার হতে লাগল। ১৯০০ সালের আশেপাশে দেশে দেশে টালমাটাল অবস্থা চলছিল, তাঁর একটা মারাত্মক রূপ নেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ…
-হ্যাঁ… সে সম্পর্কে আমরা জানি।
-তাঁর কিছু পরের কথা। ১৯৬৫ সাল। ভিয়েতনামের যুদ্ধে এক ধরনের বোম আমেরিকা ব্যবহার করল। এই বোমের বিশেষত্ব হচ্ছে, নির্দিষ্ট কোন টার্গেটকে মারতে না পারলেও, টার্গেট ও তাঁর আশপাশের অনেকটা অঞ্চল ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম। যেমন ধর এয়ারোড্রোম, কিম্বা মিলিটারী ব্যারাক, বা ধরো ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা একদল যোদ্ধা।
-ক্লাস্টার বোম?
-হ্যাঁ। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়াতে যে কার্পেট বম্বিং করা হয় তাতে কেমিক্যালও ছিল। সে যা তা কেমিক্যাল নয়, এক্কেবারে ন্যাপাম। অর্থাৎ বিস্ফোরণের হাত থেকে কোন ভাবে রেহাই পেলেও এই কেমিক্যালের বলি হবে আরোও বেশি। আর তাই ঘটেছিল। এতে করে যত না দস্যু বলো বা সেনা বলো, মারা গিয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি মারা গিয়েছিল সাধারণ মানুষ। পরবর্তীকালে এই বোমের ব্যবহার দেখা যায় কোসোভো, ইরাক, আফগানিস্তান বা ইসরায়েলের যুদ্ধেও। এই বোম আর কিছু পারুক না পারুক, অঞ্চল জুড়ে সাধারণ মানুষের ক্ষতি সাংঘাতিক বেশি করে করতে পারে।
-হুমমম… বুঝলাম।
-এর পর এল যাকে বলে বাউন্সিং বোম। সালটা ১৯৪২। হিটলারের হাইড্রো ইলেকট্রিক প্ল্যান্ট ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এই বোমের জন্ম। কোডনেম ‘আপকিপ’ (Upkeep)। একটা গ্যাস সিলিন্ডারের মত দেখতে এই বোম বানালেন বার্ণস নেভিলি ওয়ালিস। অনেক উঁচু থেকে এই বোম ফেলার উদ্দেশ্যেই এই বোমের জন্ম। এর ধ্বংস করার ক্ষমতা ছিল অনেকটাই বেশি। একটা বোমে কতটা পরিমাণ বিস্ফোরক থাকত জানেন? ২৯৫০ কেজি প্রায়।
-বাপরে! বলো কি! তখনকার হিসাবে তো এই বোম যথেষ্ট পরিমাণে ধ্বংসাত্মক!
-হ্যাঁ তো… কিন্তু এর একটাই শর্ত, কম পক্ষে ৬০ ফুট উপর থেকে বোমটাকে ফেলতে হবে। না হলে হবে না।
-বোঝ…
-তবে আজও আমার যে বোমটাকে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে সেটা হল লেজার গাইডেড বোম। ১৯৬২ সাল থেকে আমেরিকা রিসার্চ শুরু করল এমন একটা বোম বানানোর জন্য, যা লেজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এর একটা বড় সুবিধা কি জানো? বসে বসেই টার্গেট ঠিক করবে, এবং সেই টার্গেটে তুমি নিখুঁত ভাবে আঘাত করতে সক্ষম হবে। ১৯৬৭ সালে প্রথম এই বোম বানানো সম্ভবপর হয়। নাম হয় বোল্ট ১১৭। ভিয়েতনামের যুদ্ধে এর ব্যবহার তো বহুল আলোচিত, সমালোচিতও বটে। এঁকে অনেকে স্মার্ট বোম্ব বলতেও শুরু করল।
-হ্যাঁ, বড়দের মুখে এই ধরনের ওয়েপনের কথা বলতে শুনতাম বটে…
-আসলে প্রথমে লেজার দিয়ে ভাল করে নিখুঁত ভাবে টার্গেট ফিক্সড করা হত। লেসারের তীব্রতা সম্পর্কে তো কমবেশি জানো। তার নিখুঁতত্ত্ব সম্পর্কেও তাই নতুন করে বলার কিছু নেই। যে লোকেশানে লেজার বীম টার্গেট করা হত সেই লোকেশানকে বলা হত ‘বাস্কেট’। তো সেই লেজার দিয়ে নিখুঁত ভাবে টার্গেট একবার ফিক্সড করা হয়ে গেলে আর কি, দাও বোম ছেড়ে। নিক্ষিপ্ত বোমটাকে আবার সুবিধামত নীচের কন্ট্রোলরুম থেকে দিক পরিবর্তন করানোও যেত। তবে প্রথম দিকে এত সুবিধা ছিল না। হয় ‘হিট’, নয় ‘মিস’। আর তাছাড়া আবহাওয়া পরিস্কার না থাকলে কিন্তু পাইলটরা ঠিকঠাক টার্গেট করতে পারত না। পরবর্তীকালে লেজার প্রযুক্তি আরোও উন্নত হওয়ার পাশাপাশি, কম্পিউটারেরও অনেক accuracy আসে। ফলে এখন এই বোম আরও বেশি মারণাত্মক…
-এ তো সাংঘাতিক…
-হ্যাঁ… সাংঘাতিকই বটে… তবে এটম বোমের তুলনায় এ তো কিছুই নয়।
-জানি। তোমার ডায়েরিতে আছে, এটম বোম আর হাইড্রোজেন বোম। তাঁর সুফল তো আমরা এখন ভোগ করছি… কোথায় যায়, কি করি… আমাদের প্রজন্ম কিছুই বুঝতে পারছে না। পৃথিবীটাই আর বাস যোগ্য নেই।
-হুঁ তুমি বলছ তো বটে… কিন্তু কি হয়েছিল বলতে পারো?
-পারি কিন্তু তাঁর আগে তুমি বলো, আগুন কি তোমাদের ভাল কিছু শেখায় নি? শুধুই কি ধ্বংস করতেই শিখিয়েছে? সেগুলোর গল্প বলো…
[ক্রমশ]
[সব চরিত্র কাল্পনিক]
Tags: তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রবন্ধ, সুমন দাস