অদৃশ্য
লেখক: সৌগত বসু
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
লোকটা বারবার কেন আসে? সে কী চায়?
ব্যাপারটা অনিন্দ্যকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে। একজন শিশিবোতলওয়ালার সাথে রুমেলারই বা এত ঘনঘন কী এমন দরকার থাকতে পারে? রুমেলা যদি তাকে বাড়ির পুরনো শিশি, বোতল, খবরের কাগজ ইত্যাদি বিক্রি করত, তাহলেও বোঝা যেত, কিন্তু তাও তো নয়! যখনই অনিন্দ্য বাড়ি থাকে না, তখনই লোকটা রুমেলার কাছে আসে আর অনিন্দ্যকে দেখলেই তড়িঘড়ি করে চলে যায়। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত।
যবে থেকে লোকটা আসছে তবে থেকে শুরু হয়েছে এই ঝামেলা। মাসখানেকও হয় নি, এতো বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটে গেলো, তার থেকে সামলে উঠতে না উঠতে এ এক নতুন চিন্তা। রুমেলাকে এই নিয়ে কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছে না অনিন্দ্য। সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে পরামর্শ করা হয়েছে, তিনি বলেছেন ধৈর্য ধরতে, কিন্তু ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে!
রুমেলার ছেলে অন্তঃপ্রাণ। অনিন্দ্য আর রুমেলার একমাত্র সন্তান বুবাই – বছর বারো বয়স। সারাদিন রুমেলা তার ছেলেকে নিয়ে মেতে থাকে। ছেলের পড়াশোনায় মন নেই, সারাক্ষণ খেলাধুলায় ব্যস্ত। সেই নিয়ে রুমেলা অনিন্দ্যর কাছে অনেক অভিযোগ জানায়। অনিন্দ্য শুধু শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুমেলার দিকে। সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছেন যে তাকে ধৈর্য ধরতে।
ব্যাপারটা শুধু বুবাইতে আটকে থাকলে হত, তার সাথে যে যোগ হয়েছে কৃষ্ণা আর পাপ্পু। কৃষ্ণা অনিন্দ্যদের বাড়ির রাতদিনের কাজের লোক আর পাপ্পু হচ্ছে কৃষ্ণার একমাত্র ছেলে। পাপ্পুর বয়স ওই বুবাইয়ের আশেপাশেই। সে হচ্ছে বুবাইয়ের খেলার সাথী।
অনিন্দ্য একটি বহুজাতিক সংস্থার আইটি প্রফেসানাল। কাজের চাপে নিজের সংসারের দিকে তাকাবার ফুরসৎ পায় না সে। অনেকবার সে রুমেলাকে বলেছে একটা নতুন রাতদিনের কাজের লোক রাখবার কথা, কিন্তু রুমেলার বক্তব্য কৃষ্ণা থাকতে আবার নতুন কাজের লোকের কী দরকার? ব্যাপারটা একটা জটিল ধাঁধার মত ঠেকে অনিন্দ্যর। কিন্তু ওই যে, ধৈর্য ধরতে হবে।
কিন্তু সব ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল সেই রাতে। নিজেদের বেডরুমে অনিন্দ্য বিছানায় শুয়ে ছিল, রুমেলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম মাখছিল আর বুবাইকে নিয়ে নানান অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ রুমেলা বলে ওঠে,
“এতো রাতে আবার অফিস থেকে ফোন আসছে কেন? এককাঁড়ি টাকা দিচ্ছে বলে কি ফ্যামিলি লাইফটাকেও কিনে নিয়েছে ?”
অনিন্দ্য তার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে কোনও ফোন আসেনি। কিন্তু রুমেলা হাওয়ায় আঙুল চালিয়ে যেন ফোন আসার দিকনিদর্শন করতে থাকল, ঠিক যেন ও দেখতে পাচ্ছে মোবাইল সিগন্যাল্। রুমেলার আঙুল যখনই অনিন্দ্যর ফোনের ওপর এসে থামল, ঠিক তক্ষুনি অনিন্দ্যর ফোনটা বাজতে শুরু করল, স্ক্রিনে দেখা গেলো অফিসের নাম্বার।
ব্যাপারটা সাইকিয়াট্রিস্টকে পর্যন্ত বিব্রত করে তুলেছে। একজন মানুষের পক্ষে খালি চোখে রেডিও সিগন্যাল্ ডিটেক্ট করা কীভাবে সম্ভব? ঠিক যেমন আমাদের কান শুধুমাত্র ২০ হাৎর্জ থেকে ২০ কিলো হাৎর্জ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শুনতে পায়, ঠিক তেমনি আমাদের চোখও একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের আলোকতরঙ্গ দেখতে পায় । যে রেডিও সিগন্যাল্ এই ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের বাইরে পড়ে, আমাদের চোখে তা ধরা পড়া অসম্ভব। এই জগতের অতি সামান্য একটা ভগ্নাংশই আমাদের কাছে দৃশ্যমান, বাকি সবটাই অদৃশ্য।
সাইকিয়াট্রিস্ট অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করেন, “যে সময় রুমেলা দেবী এই ফোন আসার কথা বলেন, তখন কি উনি চোখে কোনও স্পেশাল ডিভাইস কিছু পরে ছিলেন?”
অনিন্দ্যর মনে পড়ে যায় যে রুমেলা ঠিক সেই সময় চশমটা পড়েছিল। রুমেলা চশমা ব্যবহার করে, কিন্তু সেই চশমাটা অনিন্দ্যর প্রথম সেদিন চোখে পড়েছিল। ও বারবার রুমেলাকে বারণ করেছিল যাতে রুমেলা একা একা বাইরে না বেরোয়। তাও রুমেলা অনিন্দ্যকে না জানিয়ে নিজের জন্য নতুন চশমার ফ্রেম কিনে আনল?
রুমেলা বলে যে সে বাড়ি থেকে বেরোয় নি। সপ্তাহদুয়েক আগে তাকে এই চশমা দিয়েছে সেই শিশিবোতলওয়ালা।
অনিন্দ্য যেন অন্ধকারের মধ্যে একটু আলো দেখতে পায়। সপ্তাহদুয়েক থেকেই রুমেলার এই মানসিক বিকার দেখা দিয়েছে। তাহলে এই চশমার মাধ্যমেই কি অদৃশ্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে?
তড়িঘড়ি অনিন্দ্য নিজের বাড়ি ফিরে আসে । রুমেলা ঘরে নেই, তাদের ড্রয়িংরুমে সেই শিশিবোতলওয়ালা বসে। অনিন্দ্যকে দেখেই সে চলে যাচ্ছিল। অনিন্দ্যর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, সে কলার চেপে ধরে সেই শিশিবোতলওয়ালার।
“রুমেলাকে তুমি কিসের চশমা দিয়েছ? এক্ষুনি বলো, নইলে আমি তোমায় পুলিশে দেবো!”
নির্বিকার শিশিবোতলওয়ালা মৃদু হেসে বলে, “ওসব ঝামেলায় গিয়ে কী দরকার দাদাবাবু! বউদিদি এখন তো দিব্যি আছেন!”
“একজন অসহায় মহিলাকে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে পাগলামির দিকে ঠেলে দিতে লজ্জা করে না তোমার? একমাসও হয়নি, আমাদের একমাত্র ছেলে বুবাই ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেলো। আমার জলজ্যান্ত ছেলেটা!! আর তোমার চশমা পরে আমার স্ত্রী সেই মরা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছে বলতে চাও? কী মন্ত্র তুমি ওর কানে দিয়েছ? মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে ছেলেখেলা করছ?”
“ঘটনাটা কি আপনি পুরো বললেন দাদাবাবু?”
অনিন্দ্য থমকে যায়। শিশিবোতলওয়ালা বলে চলে, “সেদিন আপনাদের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে শুধুই কি আপনার ছেলে বুবাই মারা গিয়েছিল ? একটু মনে করে দেখুন তো!
অনিন্দ্য কেমন থম মেরে গেছে। শিশিবোতলওয়ালা বলে চলে,
“মনে পড়ছে না বুঝি? বুবাইয়ের সাথে সেদিন ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে আপনাদের কাজের মেয়ে কৃষ্ণার একমাত্র ছেলে পাপ্পু, যে আপনার বুবাইয়ের সবসময়ের খেলার সাথী ছিল, সেও পড়ে গিয়েছিল, তার কথা ভুলে গেলেন নাকি? আর আপনারা শুধুমাত্র আপনাদের ছেলে বুবাইকে নিয়ে ছুটে গেলেন হাসপাতালে, পাপ্পু ওইভাবেই রক্তমেখে রাস্তায় পড়ে রইল!”
অনিন্দ্য প্রতিবাদ করে ওঠে, “না, ব্যাপারটা মোটেই তা নয় ! আমরা অ্যাম্বুলেন্স কল করেছিলাম, কিন্তু আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে…”
“শুধুমাত্র আপনাদের ছেলেকে নিয়ে নিজেদের গাড়ি করে চলে গেলেন!!!”
“অ্যাম্বুলেন্সকে আমার বলা ছিল, এলেই ওরা পাপ্পুকে নিয়ে চলে যেত …”
“জীবন কি অত সময় দেয় দাদাবাবু? আপনাদের গাড়িটা তো বেশ বড়, ওখানে কি পাপ্পুর একটু জায়গা হল না? একটু আগে পৌঁছলে হয়ত ছেলেটা বেঁচেও যেতে পারত।”
“কী করব, অ্যাম্বুলেন্সটা এতো দেরি করবে আসতে, বুঝতে পারি নি। অবশ্য আমার ছেলেটাকেও কি বাঁচাতে পেরেছিলাম?”
শিশিবোতলওয়ালা চিৎকার করে ওঠে, “আপনাদের ছেলের জন্য আপনারা অন্তত একটা চেষ্টা করেছিলেন, আর পাপ্পু বিনা চিকিৎসায়, রাস্তায় ছটকাতে ছটকাতে মরে গেলো। একবার পাড়ার লোকজনদেরও খবর দিয়ে যেতে পারলেন না? তারা অন্ততঃ একবার চেষ্টা করে দেখতে পারত!”
অনিন্দ্যর মুখের ভাষা যোগাচ্ছে না। সে বলতে চায়, কিন্তু বলে উঠতে পারে না যে নিজের সন্তানের যখন ওইরকম অবস্থা, তখন কারোরই মাথার ঠিক থাকে না …
শিশিবোতলওয়ালার চোখের দৃষ্টি ক্রমশ পাল্টাতেই থাকে। সে বলে চলে,
“এদিকে কৃষ্ণা ঠিক সেই সময়ই আপনাদেরই জন্য বাজার করতে গেছে। কেউ নেই ছেলেটার পাশে দাঁড়ানোর মত, আমাদের পাপ্পুটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো!”
অনিন্দ্য চমকে ওঠে, “আপনাদের পাপ্পু? মানে?”
“আমার পরিচয়টা এখনো বোধহয় বুঝতে পারেন নি? আমি কৃষ্ণার স্বামী, পাপ্পুর বাবা!”
অনুশোচনায় অনিন্দ্যর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
“আপনি পাপ্পুর বাবা? বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই খুবই লজ্জিত! আপনি একবার নিজেকে আমার জায়গায় ফেলে ভাবুন, আপনার ছেলের মর-মর অবস্থা, তখন কি আপনার মাথা ঠিক থাকতে পারে?
শিশিবোতলওয়ালা ধীর কণ্ঠে বলে, “পারে না তো! তাই তো ভেবে ভেবে একটা উপায়ও বার করেছি!”
অনিন্দ্যর কেমন যেন সন্দেহ হয়, “উপায়? আপনার মতলবটা কী বলুন তো?”
শিশিবোতলওয়ালা আবার নির্বিকার, “দাঁড়ান দাঁড়ান দাদাবাবু, এখানে মৃত্যুর হিসেব যে এখনো মিলল না, সবে যে হাফ টাইম হোল। ১-১ ড্র চলছে, কিন্তু ফাইনাল রেজাল্ট যে অন্যরকম দাদাবাবু!”
“মানে?”
শিশিবোতলওয়ালার নজর আর চোয়াল দৃঢ় হতে থাকে । সে বলে, “সেদিন আপনার বাড়িতে মৃত্যু হয় একটা, আপনাদের আদরের ছেলে বুবাইয়ের। কিন্তু আমার বাড়িতে মৃত্যু হয় দু-দুটো। পাপ্পুর মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার বউটা, মানে আপনাদের কাজের লোক কৃষ্ণা গলায় দড়ি দেয়।”
অনিন্দ্যর অনুশোচনা যেন দ্বিগুন হয়ে ওঠে। সে শুনেছিল কৃষ্ণার মৃত্যুর কথা। মাথা নিচু করে বসে থাকা ছাড়া তার আর এখন কিছুই করার নেই। শিশিবোতলওয়ালার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা যেন সে হারিয়ে ফেলেছে।
শিশিবোতলওয়ালা বলে চলে, “ছেলেটা অবহেলায় মারা গেলো, বউটা গলায় দড়ি দিলো, আমি গেলাম থানায়, আপনাদের নামে ডায়রি করতে । থানার বড়বাবু বুদ্ধি দিলেন, আপনারা বড়লোক, আপনাদের সাথে আমরা পেরে উঠব না । তাই আপনাদের ছেড়ে দিলাম …”
শিশিবোতলওয়ালা কিছুক্ষণ প্রাণ খুলে হাসতে থাকে। যেন তার দয়ায় অনিন্দ্য বেঁচে গেছে। কিন্তু আবার তার কণ্ঠস্বর পাল্টে যায়, তার দৃষ্টি দৃঢ় হয়ে ওঠে। সে আবার বলে, “তাহলে স্কোরটা কত দাঁড়াল দাদাবাবু? ২-১। তাই তো? তবে খেলা এখনো শেষ হয়নি দাদাবাবু, ইনজুরি টাইম চলছে, গোল আমি শোধ দেবোই, তার সাথে আরও একটা গোল দেবো, দেখে নেবেন!”
অনিন্দ্য এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “কী আবোল তাবোল বকছেন! যা হয়ে গেছে, সেটা নিয়ে তো সত্যিই আমরা অনুতপ্ত! আপনি যদি বলেন তো এই ব্যাপারে আপনার সাথে একটা বোঝাপড়াও করতে রাজি আছি… কত চান বলুন!”
শিশিবোতলওয়ালার কণ্ঠস্বর কেমন যেন কান্নার মত শোনাল।
“দাদাবাবু, এখনো সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভাসছে গো, কাঁটাপুকুর থেকে আমার ছেলেটার আর বউটার বডিটা যখন দিল …”
“ওসব কথা এখন থাক …”
অনিন্দ্য কথাটা ঘোরাতে চায়। সে বলে, “আপনি কী চশমা দিয়েছেন বলুন তো? সেটা দিয়ে কী দেখা যায়?”
“আশ্চর্য জিনিস দাদাবাবু! নানান লোকের বাড়ি বাড়ি আমাকে ঘুরতে হয় কিনা! এক পাগলা বিজ্ঞানী এটা আবিষ্কার করেছিলেন, তিনিই আমাকে গোটাচারেক এই চশমা দিয়েছিলেন, এমনিই! পাগলা মানুষ তো! যা আমরা নাকি নিজেদের চোখে দেখতে পাই না, তাই নাকি এই চশমা দিয়ে ধরা পড়ে – এমন কথাই বলেছিলেন উনি! কিন্তু একেবারে যে পরলোকের দর্শন পাওয়া যায় তা আমায় বলেন নি। ছেলে-বৌটা মারা যাওয়ার পর একদিন মনটা খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ মনে পড়ল এই চশমার কথা। অবাক কাণ্ড! পরে দেখি স্পষ্ট আমার চোখের সামনে ছেলেটাকে আর বউটাকে দেখতে পাচ্ছি, তারা আমার দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে। তাই ভাবলাম, বউদিদিও নিশ্চয়ই নিজের ছেলেকে দেখতে আকুল হয়ে উঠছেন, তাই ওনাকেও একখানা চশমা দিয়ে গেলাম। তারপর থেকেই তো উনি আবার আপনাদের বুবাইকে সবসময় দেখতে পাচ্ছেন। কৃষ্ণা আর পাপ্পুকেও দেখতে পাচ্ছেন। এরা যে আর বেঁচে নেই, সেই কথা ভেবে ওনাকে আর কষ্ট পেতে হচ্ছে না! ওনার কাছে এরা সবাই যে জীবিত! উনি এখন কত ভালো আছেন বলুন!
অনিন্দ্যর হঠাৎ মনে পড়ে রুমেলার কথা। সত্যি তো! রুমেলা কোথায় গেলো?
শিশিবোতলওয়ালার জবাব, “ছাদে! বুবাই দাদাবাবু ঘুড়ি ওড়াচ্ছে কিনা, পাপ্পু আর কৃষ্ণাও ওখানেই আছে। ওদের নিয়ে তো আর চিন্তা নেই, চিন্তা শুধু বৌদিদিকে নিয়ে। আপনাদের ছাদের পাঁচিলগুলো বড্ড নিচু! কখন যে কী ঘটে যায়!”
কথাটা অনিন্দ্যর সমস্ত শরীর জুড়ে যেন এক তড়িৎপ্রবাহ ছুটিয়ে দেয়। অনিন্দ্য ছুটে যায় ছাদের দিকে।
“দাদাবাবু!!”
শিশিবোতলওয়ালার পিছুডাকে থেমে যায় অনিন্দ্য। ঝোলা থেকে আরেকটা চশমা বার করে অনিন্দ্যর পকেটে গুঁজে দিয়ে শিশিবোতলওয়ালা বলে, “দাদাবাবু, এটা পরে নিন, অনেক কিছু দেখতে পাবেন! দেখবেন মৃত্যুর পরের অদ্ভুত দুনিয়াটা!”
অনিন্দ্য রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যায় ছাদে। সে দেখে, রুমেলা ছাদের প্রায় ধারের দিকে এগিয়ে গেছে, তার চোখে সেই অদ্ভুতুড়ে চশমা। অদৃশ্য বুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রুমেলা কথা বলে চলেছে, “বুবাই! অনেক ঘুড়ি ওড়ানো হোল বাবা, এবার একটু পড়তে বসবি চল! তোর আর সব বন্ধুরা ভালো ভালো রেজাল্ট করবে আর তুই গাড্ডা খাবি, সেটা কি তোর ভালো লাগবে বল?”
অনিন্দ্য চিৎকার করে ওঠে, “রুমেলা! ছাদের পাশ থেকে সরে এসো! তুমি কার সাথে কথা বলছ ? এখানে কেউ নেই!”
রুমেলা অনিন্দ্যকে দেখতে পায়।
“এই দেখ না অনিন্দ্য! বুবাই আবার কথা শুনছে না! তুমি ওকে একবার বল না, তোমাকে ভয় পায়, তোমার কথা শুনবে, আমাকে তো ট্যাঁকে গোঁজে।”
অনিন্দ্য ছুটে এসে রুমেলাকে জড়িয়ে ধরে।
“রুমেলা, নেমে চলো, এখানে কেউ নেই তুমি আর আমি ছাড়া!”
“মানে? কী বলছ তুমি? তুমি এদের দেখতে পাচ্ছ না? বুবাই, কৃষ্ণা, পাপ্পু? এদের দেখতে পাচ্ছ না?”
“অনিন্দ্যর নজর পড়ে নিজের বুকপকেটে। সেখানে সেই শিশিবোতলওয়ালার দেওয়া চশমা। শত দ্বন্দ্বকে উপেক্ষা করে অনিন্দ্য চশমাটা পরে নেয়। সাথে সাথে এ কোন্ দৃশ্যের উন্মোচন হোল তার চোখের সামনে! সে দেখতে পাচ্ছে নানান গাছগাছালির মধ্যে সাজানো এক অচেনা প্রান্তর। সেখানে তাদের ছেলে বুবাই ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, পাপ্পু লাটাই ধরে আছে, কৃষ্ণা একপাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এ যে অসম্ভব!”
অনিন্দ্যদের বাড়ির নিচ দিয়ে শিশিবোতলওয়ালা চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে ছাদের দিকে তাকায়। ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে অনিন্দ্য আর রুমেলা।
শিশিবোতলওয়ালা পাড়ার লোকজনকে ডেকে চিৎকার করে ওঠে “ওই দেখো! ও দাদাবাবু! ও বউদিদি! আরে সরে যান ধার থেকে, পড়ে যাবেন যে! এ কী কাণ্ড! পড়ে যাবেন! সরে যান!”
পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায়, সবাই বলতে থাকে “পড়ে যাবেন, সরে যান”।
অনিন্দ্য মুহূর্তের ঘোর কাটায়। সে বলে ওঠে, “রুমেলা, এটা একটা ইলিউশন! এটা আমাদের জগত নয়! আমাদের এখান থেকে বেরোতেই হবে! এগুলো যা আমরা দেখছি তা সত্যি না! এরা কেউ বেঁচে নেই!”
রুমেলা অবাক হয়ে যায়। “কী বলছ তুমি অনিন্দ্য?”
“আমি ঠিকই বলছি! কারণ এই চশমা খুলে নিলেই এটা আর বাস্তব থাকবে না! এই চশমাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া! খুলে ফেল এই চশমা! দেখবে সব অদৃশ্য হয়ে গেছে! দেখতে পাবে কেবল আমাদের নিজেদের জগতকে!”
অনিন্দ্য নিজের আর রুমেলার চশমা খুলে দে। কিন্তু একী! এই দৃশ্যের তো কোনও পরিবর্তন ঘটল না! গাছগাছালির মধ্যে সাজানো সেই অচেনা প্রান্তর, বুবাই, পাপ্পু, কৃষ্ণা এখনো তার সামনে দৃশ্যমান। এ কীভাবে সম্ভব?
রুমেলা বলে ওঠে, “কই! সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! এখনো তুমি বলবে এটা ইলিউশন? কাজ কাজ করে তোমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে দেখছি! বুবাই! বাবা এসেছে, দেখেছ? বাবা কিন্তু এইবার খুব বকবে! চলে এসো এবার!”
বুবাই নিজের ঘুড়ি ফেলে পিছনে তাকায়। সে যেন অনিন্দ্যকে আর রুমেলাকে দেখতে পেল। ছুটে এসে বুবাই জড়িয়ে ধরল তার বাবা-মাকে। সে বলে ওঠে,
“বাবা, মা! তোমরা তাহলে সত্যি সত্যি এসে পড়েছ?”
নিথর হয়ে অনিন্দ্য দাঁড়িয়ে থাকে। সে এখনো বুঝে উঠতে পারল না যে চশমা ছাড়া এ দৃশ্য কীভাবে দৃশ্যমান!
হঠাৎ অনিন্দ্যর সামনে ভেসে উঠল শিশিবোতলওয়ালার হিংস্র মুখ। শিশিবোতলওয়ালার চোখে সেই অলৌকিক চশমা। তার শান্ত অথচ সুতীব্র কণ্ঠস্বর শোনা যায়, “দাদাবাবু, ফাইনাল হুইসল বেজে গেছে। রেজাল্ট ৩-২!
***
পরের দিন খবরের কাগজের পাতায় হেডলাইন দেখা গেলো – ‘ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে দম্পতির রহস্যজনক মৃত্যু’। সাথে অনিন্দ্য আর রুমেলার ছবি।
ব্যাপারটা নিয়ে পাড়ার লোকের মধ্যে নানান আলোচনা চলতে থাকে।
“ট্র্যাজিক ব্যাপার! যেভাবে ছেলেটা মারা গেল, ঠিক একইভাবে বাবা-মা মারা গেলো?”
“আরে বুঝলি না, এটা হোল গয়ে অভিশাপ। মনে নেই? ওদের কাজের লোকের ছেলেটাকে ফেলে রেখে নিজের ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল …”
“ঠিক বলেছিস, ভগবান শাস্তি দিল।”
“পাড়ায় একটা শনিপুজো করতে হবে! ইস্স্ ! একই বাড়িতে তিন-তিনটে অপঘাত!”
“আমার তো মনে হয় এসব কোনও অ্যাকসিডেন্ট নয়, পাতি সুইসাইড কেস!”
“না রে, বউটা পাগল হয়ে গিয়েছিল শুনেছিলাম না, তাই বোধহয় বরটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে, সাথে সাথে পা ফস্কে নিজেও পড়ে গেছে।”
ইত্যাদি ইত্যাদি…
সেই শিশিবোতলওয়ালার খবর কেউ জানে না।
Tags: প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস, সৌগত বসু