অদৃশ্য আলো – আলেক্সান্দর বেলিয়ায়েভ
লেখক: আলেক্সান্দর বেলিয়ায়েভ, বাংলা অনুবাদ - অদিতি কবির, সম্পাদনা - সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
“দেখুন, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে ভিরোভাল কত বড় চিকিৎসক।”
“অবশ্যই, একজন সম্পূর্ন অন্ধ মানুষও যখন তা দেখতে পান, তখন তিনি বড় চিকিৎসক তো বটেই।”
“আপনি কীভাবে জানলেন যে আমি একেবারে অন্ধ?” পাশে বসা অপরিচিতর দিকে ফেরেন রোগীটি।
“আরে, আপনার পরিষ্কার নীল চোখ দু’টো আমায় বোকা বানাতে পারবে না। একটা পুতুলের মতই আপনারগুলোও নিষ্প্রাণ।” অপরিচিত হেসে সেই সাথে আরও বলেন “তাছাড়া আমি আমার আঙুল আপনার সামনে নাড়লাম, অথচ আপনি পলকটাও ফেলেননি।”
“তা ভালই করেছেন,” তিক্তভাবে হাসলেন অন্ধ মানুষটি, তারপর নার্ভাসভাবে পরিপাটি বাদামী চুল আবার ঠিক করতে লাগলেন । “হ্যাঁ, আমি অন্ধ,” বললেন তিনি “যে কারই তা ‘চোখে পড়বে’ অভ্যাসবশতঃ। কিন্তু ধনসম্পত্তি আর মানমর্যাদা দেখবার জন্য আপনার চোখ থাকার দরকার নেই। এটা শহরের সবচাইতে ভাল জায়গা। ডাক্তারের নিজের একটি বাড়ি। এখানে ঢোকার মুখে গোলাপের সৌরভ; চওড়া সিঁড়ি, দারোয়ান। দরজায় দামী সুগন্ধীর সুবাস। চাকর, নফর আর সহকারীরা। চড়া, স্থায়ী বেতন। সহকারীরা প্রাথমিক পরীক্ষা করবে। মানুষের পায়ের তলায় নরম গালিচা।, সিল্কে মোড়া আরামকেদারা, মিষ্টি সুরভিত অভ্যর্থনা ঘর।”
“মনে রাখবার মত একটা মনস্তাত্ত্বিক উদযোগ,” আস্তে করে বলেন অপরিচিত। তাঁর হলদে মুখ দুঃখের হাসিতে কুঁচকে আছে। তিনি দ্রুত ভিরোভালের বিলাসবহুল অভ্যর্থনা ঘরটা দেখে নিলেন, যেন অন্ধ মানুষটির ভাবনার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন। আরামকেদারাগুলোর সবক’টিই রোগীদের দখলে, যাদের অনেকেই চোখে কালো চশমা বা চোখে পট্টি আর মুখে আশা, উদ্বিগ্নতা অথবা প্রত্যাশার ছাপ।
“আপনি তো কিছুদিন হল দৃষ্টি হারিয়েছেন। কীভাবে ঘটনাটি ঘটল?” তিনি আবার অন্ধ মানুষটিকে জিজ্ঞেস করেন।
“আপনার কেন মনে হল এটা কিছুদিন আগের?” অন্ধ মানুষটি ভুরু ওপরে তুললেন।
“যারা জন্মান্ধ তাদের আচরণ অন্য রকম হয়। বোঝা যাচ্ছে আপনার অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্ভবত সবচাইতে খারাপ, না বলার মতই অসুখ নেক্রোসিসেস প্রভাবে…”
অন্ধ মানুষটির গাল, কপাল, এমনকি তার চিবুক রাঙা হয়ে উঠল। তিনি ভুরু কোঁচকালেন।
“তেমন মোটেই নয়!” তিনি দ্রুত কথা বলতে থাকলেন ক্রোধের সাথে, অপরিচিতর দিকে মাথা না ঘুরিয়েই। “আমি একজন ইলেকট্রিশিয়ান। আমি ইউনিভার্সাল ইলেকট্রিক কোম্পানীর আল্ট্রাভায়োলেট ল্যাম্প জোড়া দেবার গবেষণাগারে কাজ করতাম…”
“বাকী গল্পটা আঁচ করেই নেয়া যায়। আমিও তাই করেছি। বেশ!” অপরিচিত দুই হাত ঘষে অন্ধ মানুষটির দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন – “বাদ দিন এই হাতুড়ে ভিভোরালকে। এর চাইতে একটা মুচিও আপনাকে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারবে। আপনার শেষ ডলারটা খতম না হওয়া পর্যন্ত ভিভোরাল আপনাকে ধোঁকা দিয়ে যাবেন। তারপর একদিন উনি ঘোষণা করে দেবেন যে, যা-যা সম্ভব সবই তিনি করেছেন। তার দিক থেকে দেখা যাবে তিনিই ঠিক যেহেতু দুনিয়ার আর কোন বিশেষজ্ঞই আপনার থেকে এক কানাকড়িও নিতে পারবে না। আপনার কী অনেক টাকা আছে? আপনার জীবন চলে কী করে?”
“আপনার নিশ্চয়ই আমাকে আহাম্মক মনে হয়েছে,” অন্ধ মানুষটি স্পষ্ট ঘৃণা নিয়ে বললেন। “কিন্তু একজন অন্ধ মানুষও ঠিকই আপনাকে ভেদ করে দেখতে পাবে। আপনি হচ্ছেন অন্য কোন ডাক্তারের দালাল।”
অপরিচিত নিঃশব্দে হাসলেন, তার মুখ কুঁচকে গেল।
“আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি একজন ডাক্তারের দালাল, আমার নাম ক্রুজ।”
“আর ডাক্তারবাবুর নাম?”
“সেটাও ক্রুজ।”
“একই নাম?”
“তার চাইতেও বেশি।” ক্রুজ খিকখিক করে হাসলেন। “আমি নিজেই নিজের দালাল। ডঃ ক্রুজ আপনার সেবায় নিয়োজিত। আপনার নাম জানতে পারি?”
অন্ধ মানুষটি একটু ইতস্তত করলেন, তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন:
“ডুবেল।”
“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।” ক্রুজ বন্ধুর মতই অন্ধ মানুষটির বাহু স্পর্শ করেন। “ডুবেল মশাই, আমি জানি আপনি আমায় কী ভাবছেন। ফেরিওয়ালা আর ব্যবসায়ী ভরা এই শহরে হাজার হাজার ডাক্তাররা রোগী নিয়ে কামড়াকামড়ি করে, যত নোংরাভাবে পারা যায় চালাকি আর দুষ্টামী করে। কিন্তু কোন ডাক্তারই এখন পর্যন্ত অন্য ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করে নিজের জন্য রোগী জোগাড় করার মত নীচে নামেনি। আপনি ঠিক তাই ভাবছেন, তাইনা ডুবেল মশাই?”
“ধরুন আমি তাই ভাবছি,” অন্ধ মানুষটি শুকনোভাবে বললেন। “তাতে কী?”
“তাহলে সম্মানের সাথে জানাচ্ছি যে আপনি ভুল করছেন ডুবেল মশাই।”
“আমায় বিশ্বাস করাতে আপনার অনেক কষ্ট হবে,” খেঁকিয়ে উঠলেন অন্ধ মানুষটি।
“সে দেখা যাবে!” ক্রুজ বলে উঠলেন, তারপর নিচু স্বরে বললেন, “আমি একটা যুক্তি দিচ্ছি যেটার কোন উত্তর আপনার কাছে নেই। শুনুন, আমি একজন অসাধারণ ডাক্তার। আমি চিকিৎসা করতে কোন টাকা নিই না। তাছাড়া, আমি আমার রোগীদেরকে নিজের খরচে সাহায্য করি।”
অন্ধ মানুষটির ভুরু কেঁপে উঠল।
“চ্যারিটি?” আস্তে করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
“ঠিক তা নয়,” ক্রুজ জবাব দিলেন। “আমি আপনাকে খোলাখুলিই বলি ডুবেল মশাই, আশা করছি কিছু একটা দিয়ে আপনি আমায় পাওনা মেটাবেন। আপনার সময়ও আসবে। আমার মা-বাবা আমায় বিরাট ধন-সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, তাই আমিও খরচা করে নিজের খেয়ালখুশী মত বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাতে পারি, নিজের বাড়িতে, যেখানে আমার একটি ক্লিনিক রয়েছে আর আছে ভাল ভাল যন্ত্রপাতি নিয়ে একটি গবেষণাগার। আপনাদের মত রোগীদের নিয়ে আমার আগ্রহ আছে।”
“আপনি কি বলতে চাইছেন?” ডুবেল অধৈর্য হয়ে কথার মাঝখানে বলে ওঠেন।
“এই মুহূর্তে কিছুই না,” ক্রুজ ব্যাঙ্গের হাসি হাসে। “আমার সময় আসবে যখন ভিরোভাল আপনার শেষ কপর্দকটিও নিয়ে নেবেন। কিন্তু আমায় জানতে হবে সেটা কবে হবে। বিশ্বাস করুন আপনার টাকা-পয়সায় আমার কোন আগ্রহ নেই।”
ডুবেল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন:
“আমার খুব বেশি টাকা নেই। আমার দুর্ঘটনার খবর কাগজে ছাপা হয়েছিল আর খুব হইচই ও হয়েছিল। কোম্পানী আমাকে এক বছরের বেতন দিতে বাধ্য হয় এই প্রচারের পাল্লায় পড়ে। এটা একটা বেশ বড় রকমের জয়। আজকাল তো স্বাস্থ্যবান কর্মীরা তেমন নিরাপত্তা পায় না।”
“আপনার টাকা শেষ হতে আর কত বাকী?”
“মাস চারেক।”
“তারপর?”
ডুবেল কাঁধ ঝাঁকায়।
“আমি সামনে কী হবে সেটা নিয়ে অত ভাবি না।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। ভবিষ্যত ভেবে চলা আজকাল খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি যারা চোখে দেখে তাদের জন্যও,” ক্রুজ মন্তব্য করেন। “চার মাস। হুমম… আশা করা যায় যে ডাঃ ভিরোভাল সেই সময়টি দ্রুতই নিয়ে আসবেন, আর তারপর আপনার না থাকবে চিকিৎসা করানোর টাকা, আর না থাকবে খাওয়া-পরার জন্য যথেষ্ট কিছু। দারুণ!! যখন সেটা হবে, আমার সাথে দেখা করবেন।“
ডুবেল উত্তর দেবার মত সুযোগ পেলেন না।
“নম্বর ৪৮!” মাড় দেয়া সাদা কাপড় পরা একজন নার্স ঘোষণা করলেন। অন্ধ মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন। নার্স তাঁর কাছে এলেন, তাঁর হাত ধরলেন, এবং অফিস ঘরের দিকে নিয়ে চললেন। ক্রুজ বার্নিশ করা গোল টেবিলের ওপরে রাখা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগলেন।
কয়েক মিনিট পর ডুবেল খুশী ও উত্তেজিতভাবে অফিস থেকে বের হলেন। ক্রুজ দ্রুত এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে।
“আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। আচ্ছা, কেমন হল সব? ভিরোভাল নিশ্চয়ই আপনার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবেন বলেছেন?”
“হ্যাঁ।” ডুবেল জানাল।
“স্বাভাবিক। এছাড়া তো আর পথ নেই।” ক্রুজ চাপাহাসি দিলেন। “উনি সত্যিই আপনার দৃষ্টি ফেরাবেন…একদিক থেকে। আপনি জানতে চেয়েছেন আমি আপনাকে কী প্রতিশ্রুতি দিতে পারি। সেটা আপনার ওপর নির্ভর করবে। আমি যতখানি সম্ভব চেষ্টা করব আপনার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণভাবে ফিরিয়ে দেবার। কিন্তু প্রথমে আপনাকে একটা উপকার করতে হবে… ওহ, ভয় পাবেন না। একটা ছোট্ট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার যা কোনভাবে আপনাকে অন্ধত্বের অন্ধকার থেকে বের করে আনবে।“
“এর মানে কী? তার মানে আমি আলো আর অন্ধকারকে আলাদা করতে পারব? কিন্তু ভিরোভাল তো আমায় কথা দিয়েছেন সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবার।”
“ওই যা বলেছিলুম! আমি জানতাম যে এগুলো হবে। আপনার সাথে আলাপ করাটা তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। আমার সময় তো এখনও আসেনি।”
ডুবেলের বাড়িতে যখন তাঁরা পৌঁছলেন, ক্রুজ বললেন:
“আমি এখন জানলাম আপনি কোথায় থাকেন। আমার কার্ডটা রাখুন; এতে আমার ঠিকানা দেয়া আছে। আশা করি তিন মাসের মধ্যে আমাদের দেখা হবে।”
“আমিও আশা করি আপনাকে দেখব নিজের চোখে। প্রমাণ করতে যে ভিরোভাল…”
“প্রতারক নন, তবে জাদুকর?” ক্রুজ হাসলেন তারপর দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ করলেন। “দেখা যাবে, দেখা যাবে।”
কোন জবাব না দিয়ে অন্ধ মানুষটি ফুটপাথ পার হলেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে এবং বাড়ির ভেতর মিলিয়ে গেলেন।
ডুবেল আবারও গাড়ির ভেতরে বসে আছেন, এবার একটা ট্যাক্সির ভেতর। তার কাছে ট্যাক্সি চালককে দেবার মত সামান্য রেস্ত আছে। গাড়ির শব্দ, পথের কোলাহল সব মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। তার ত্বকে একটা উষ্ণভাব, যেন সূর্যের আলো তার শরীরের উপর এক লঘু স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। কোন উঁচু ভবন নেই যা ছায়া দিতে পারে এ পথটিকে। পৃথিবীর বুকে বসন্তের মনোরম প্রলেপ ছড়িয়ে পড়েছে। ডুবেল নিজেকে বাগানে ঘেরা, ফুলে ছাওয়া একটা কুটীরে কল্পনা করলেন। কেবল মাঝে মাঝে গাড়ির চাকার শব্দে নির্জনতায় ছেদ পড়ছিল। গাড়িগুলো হয়তো এখানে যারা থাকে, তাদের। ক্রুজ নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক, যদি সে এমন রাস্তায় থাকে।
ট্যাক্সি থেমে গেল।
“পৌঁছে গেলাম?” ডুবেল প্রশ্ন করেন।
“আজ্ঞে হ্যাঁ,” চালক উত্তর দেয়।। “আপনাকে বাড়ির কাছে পৌঁছে দিচ্ছি।”
সামনের উঠোনে ফুলের গন্ধ আর পায়ের নীচে বালু কিচকিচ করছে।
“সাবধান, এখানে সিঁড়ি রয়েছে,” চালক সতর্ক করে।
“ধন্যবাদ। আমি এখন নিজেই পারব।”
ডুবেল চালককে ভাড়া মিটিয়ে একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন। সিঁড়ির মাথার দরজাটায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। সেটা অতিক্রম করে তিনি একটি ঠাণ্ডা হলঘরে প্রবেশ করলেন।
“আপনি কি ডাঃ ক্রুজের সাথে দেখা করতে এসেছেন?” একটি নারী কন্ঠ প্রশ্ন করল।
“আজ্ঞে হ্যাঁ। দয়া করে তাঁকে বলুন যে ডুবেল এসেছেন। উনি আমায় চেনেন।”
একটি ছোট্ট উষ্ণ হাত ডুবেলের হাত স্পর্শ করল।
“আসুন, আপনাকে বৈঠকখানায় নিয়ে যাচ্ছি।”
নানান গন্ধ আর তাপমাত্রার পরিবর্তন থেকে ডুবেল বুঝতে পারেন যে তাঁর সঙ্গিনী তাঁকে বড় ও ছোট, সূর্যালোকিত ও অন্ধকার, আসবাবপত্রওয়ালা ও আসবাবপত্রবিহীন বিভিন্ন রকম ঘর-এর মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একটি অদ্ভুত বাড়ি, আর এ যেন একটি অদ্ভুত প্রক্রিয়া- রোগীকে পুরো বাড়ির মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া।
একটা দরজা ক্যাঁচ করে উঠল, ভেতর থেকে ক্রুজের পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এল:
“কে? আরে-ডুবেল মশাই যে! ধন্যবাদ আইরিন, তুমি যেতে পারো।”
নারীটির হাত বদল হল ক্রুজের ঠাণ্ডা ও শুকনো হাতে। আরও কয়েক পা এগিয়ে ডুবেল পেলেন ওষুধের মিশ্রণের কড়া গন্ধ এবং চীনেমাটি আর কাঁচের গেলাসের টুংটাং শব্দ। কেউ একজন যন্ত্রপাতি আর কাঁচের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে।
“তাহলে আপনি এলেন ডুবেল মশাই,” খুশিভরা গলায় বলে উঠলেন ক্রুজ। “এই আরামকেদারায় বসুন… কিন্তু আমাদের শেষ দেখা হবার পরে কতদিন গেল? আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে দু’ মাস হল। হ্যাঁ, ঠিক দু’ মাস। আমার সম্মানিত সহকর্মী আমার ভবিষ্যদ্বাণীর চাইতেও দেখছি দ্রুত আপনার পকেট সাফ করে দিয়েছেন। আমাকে দেখতে পাচ্ছেন কিনা সেটা জিজ্ঞেস করা এখানে অপ্রয়োজনীয়, না?”
ডুবেল মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
“ঠিক আছে, বন্ধু, মন খারাপ করবেন না,” ক্রুজ শব্দ করে হাসলেন। “আসতে হল বলে দুঃখ হচ্ছে না তো?”
“আসলে আমার থেকে আপনি কী চাইছেন?” ডুবেল প্রশ্ন করে।
“আমি খোলাখুলি ভাবেই সব বলব।” ক্রুজ উত্তর দিলেন। “আমি আপনার মত একজন কাউকে খুঁজছিলাম। আমি আপনার চিকিৎসা নিখরচাতেই করে দেব, এমনকি নিজের পয়সাতেই আপনার খরচ চালাব, আর আপনার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেব আমাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে হতেই।”
“কী ধরনের চুক্তি?” সন্দেহের সাথে ডুবেল জিজ্ঞেস করেন।
“আমরা অবশ্যই একটা লিখিত চুক্তি করব,” ক্রুজ বলে চললেন, “আমাকে নিজের স্বার্থটাও তো দেখতে হবে। আমার একটা আবিষ্কার আছে যেটা পরীক্ষা করা বিশেষ দরকার। একটা অপারেশন করতে হবে যা আপনার জন্য একটু ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যদি অপারেশন সফল হয়, তবে আপনি অন্ধ হলেও এমন কিছু দেখতে পাবেন যা পৃথিবীর কেউই দেখেনি। আমি যখন নিজের আবিষ্কার পেটেন্ট করে নেব, আমি কথা দিচ্ছি আমার পক্ষে যা যা সম্ভব সবই করব আপনার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে।”
“তার মানে আমাকে শুধু রাজী হতে হবে?”
“ঠিক তাই! মি. ডুবেল। আপনার কি আর কোনো উপায় আছে? এখান থেকে আপনি কোথায় যাবেন? রাস্তায় ভিক্ষা করবেন?”
“অন্তুতঃ আমায় বলুন অপারেশনের পরে আমার কী হবে!” অন্ধ মানুষটি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন।
“ওহ, যদি গবেষণা সফল হয়, তাহলে… আমার মনে হয়… আমি নিশ্চিত… যে অপারেশনের পরে আপনি বিদ্যুত প্রবাহ, চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, রেডিও তরঙ্গ, এক কথায় ইলেক্ট্রনের যে কোন নড়াচড়া দেখতে পাবেন। অবিশ্বাস্য ব্যপার! কীভাবে? খুবই সহজ।”
পায়চারী করতে করতে ক্রুজ এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন তিনি কোথাও বক্তৃতা দিচ্ছেন:
“আপনি তো জানেন যে আমাদের প্রতিটি ইন্দ্রিয় বর্হি-উত্তেজকের প্রতি নিজের মত করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কানে আলতো করে টোকা দিলে পরে শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। চোখের মণিতে চাপ দিলে আলোর সৃষ্টি হয়। বলে না, যে চোখের সামনে আলোর ফুলঝুরি দেখতে পাবেন? অন্য কথায় বলতে গেলে দর্শনেন্দ্রিয় আলোর বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখায়। শুধু আলোর বিপরীতেই নয়, যান্ত্রিক, তাপীয় এবং বৈদ্যুতিক উত্তেজকের প্রতিও।”
আমি একটি ছোট্ট যন্ত্র আবিষ্কার করেছি, একটি ইলেক্ট্রনোস্কোপ, কিছুটা পরিশুদ্ধ গ্যালভানোস্কোপের মত, যেটার উচ্চমানের সংবেদনশীলতা আছে। এটার কন্ডাকটরগুলো – খুব ভাল রূপোর তৈরি – যা অপটিক নার্ভের সাথে যুক্ত করে দিলে আলোর সংবেদনশীলতার সাথে বিদ্যুৎ প্রবাহের প্রতিক্রিয়া ঘটাবে আমার যন্ত্রে। এ পর্যন্ত খুবই সহজ।
কঠিন ব্যপার হল, ইলেক্ট্রনোস্কোপের ভিতরের পদ্ধতির সাথে জীবন্ত কোন দর্শনেন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটানো, এবং আপনাকে ত্রিমাত্রিক আলোর সংবেদনশীলতা অনুভবে সক্ষম করে তোলা। যতদূর মনে হচ্ছে যে আপনার অপটিক নার্ভ এখনও পুরোপুরি নষ্ট হয়নি। কিন্তু সংযোগ করবার সবচাইতে ভাল কেন্দ্রটি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। আমরা অপারেশনে যাব যদি খুব দরকার পড়ে। আবার দরকার নাও হতে পারে। যেহেতু বিদ্যুৎ প্রবাহ কাছাকাছি ধমনী, পেশী আর রক্তশিরার মাধ্যমে পৌঁছতে পারে, তাই আশা করি অপারেশনটার খুব একটা প্রয়োজন হবে না। এটাই হল এর ভেতরকার তত্ত্ব। আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আপনাকে বিস্তারিত ব্যাখা করব…”
“আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি,” ডুবেল হাল ছেড়ে দেবার মত করে জানান। “আমার তো হারাবার কিছু নেই। আপনার যত খুশি গবেষণা করুন। আপনি দরকার পড়লে আমার খুলিও চেঁচে ফেলুন।”
“বাহ! দারুণ! যাক এখন অন্ততঃ আপনার জীবনের একটি লক্ষ্য আছে। পৃথিবীর কেউ যা দেখেনি তা দেখবার! এমন সুযোগ সবার বড় একটা হয় না।”
“আর এসবের মধ্য দিয়ে হয়তো আপনারও কিছু সুযোগ লাভের সম্ভাবনা রয়েছে, তাই না?” ডুবেল তিক্তভাবে বলেন।
“শুধুমাত্র প্রচার, আর কিছুই নয়। এই প্রচারই আমায় সাহায্য করবে ভিরোভালের কাছ থেকে সমস্ত রোগীকে ভাঙিয়ে নিতে,” ক্রুজ বাহাদুরীর হাসি হেসে জবাব দেন।
“অন্ধকার। ভুসো কালির মত কালো, খাদের মত গভীর, কিন্তু তা সত্যি নয়: পুরো অন্ধকারের কোন রূপ নেই। আমি বলতে পারব না আমার সামনের অন্ধকারকে কিলোমিটার বা সেন্টিমিটারে মাপা হবে কিনা, আমি ফাঁকা বা আমার চারপাশে কিছু আছে কিনা। এগুলোর অস্তিত্ব নেই যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তা অনুভব বা স্পর্শ করতে পারছি…”
ডুবেল চুপ করে যায়।
সে একটা বড় সাদা ঘরে বিছানার ওপর টান টান হয়ে শুয়ে আছে। তার মাথা ও চোখ শক্ত করে ব্যান্ডেজে বাঁধা। ক্রুজ বিছানার কাছে একটা আরামকেদারায় বসে সিগার টানছেন।
“ডাক্তারবাবু, আপনি এত জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন কেন আমায় বলুন তো?” ডুবেল প্রশ্ন করে।
“আমি জানিনা। হয়তো আমার হৃৎপিণ্ড ঠাট্টা করছে। উত্তেজনা থেকে…হ্যাঁ আমি উত্তেজিত, মিঃ ডুবেল। আমি মনে হয় আপনার চাইতেও বেশি উত্তেজিত… আপনি কিছু দেখেননি কেন? আপনি তো অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে আছেন।”
“দাঁড়ান! আমার মনে হচ্ছে… আমি দেখছি…”
“শেষ পর্যন্ত!” ক্রুজ তীক্ষ্ণভাবে হিসহিসিয়ে উঠলেন। “আপনি কী দেখছেন?”
“আমি দেখছি,” ডুবেল উত্তেজিতভাবে বলেন “… আমার মনে হচ্ছে… যদি এটা কোন দৃষ্টি বিভ্রম না হয়। অন্ধদের কী দৃষ্টি বিভ্রম হয়?”
“হ্যাঁ, তো? তো? আপনি কী দেখছেন?” ক্রুজ উত্তেজনায় ছটফট করে উঠলেন।
কিন্তু ডুবেল উত্তর দিলেন না। তাঁর মুখ ফ্যাকাশে আর টানটান হয়ে গেছে, যেন সে কিছু শুনতে পাচ্ছে। সাবধানে পা ফেলে ক্রুজ দরজার কাছে গিয়ে বৈদ্যুতিক ঘন্টি বাজালেন। যখন নার্স এলেন, তিনি খুব আস্তে করে নির্দেশ দিলেন, যেন তিনি ডুবেলের ভাবাবেশে বাধা দিতে চান না।
“জলদি… নাইট্রোগ্লিসারিন… আমার কিরকম অসুস্থ লাগছে।”
“ডাক্তারবাবু! ডাঃ ক্রুজ! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি দেখছি… অন্ধকার জীবন্ত হয়ে উঠেছে!” ডুবেল এমনভাবে কথা বলছে যেন সে নেশার ঘোরে রয়েছে। “ভেতর দিয়ে আলোর মেঘ উড়ে যাচ্ছে…”
“কী রং?” ক্রুজ ঘড়ঘড়ে গলায় প্রশ্ন করলেন, তাঁর শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে – শরীরটা উত্তেজনায় কেমন যেন আনচান করছে।
“সাদা…যদিও অন্ধকারের সীমানার রঙ মনে হচ্ছে খুবই হালকা নীল। আলোটা আসছে-যাচ্ছে ছন্দে ছন্দে, ঢেউয়ের মত।”
“ঢেউ!” ক্রুজের উত্তেজনার ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এবং তার সাথে তাঁর হার্টবিট। “ এই তো আমায় দিন! দিন আমায় এক্ষুণি!” নার্স ঘরে ঢোকা মাত্রই ক্রুজ তাকে হুকুম দিলেন। এক চুমুকে পুরো ওষুধ খেয়ে খেয়ে নেওয়ার পর, চোখ বুজে কেদারায় হেলান দিলেন। তাঁর শ্বাসের ঘড়ঘড় শব্দটা যেন অনেকটা প্রশমিত হল।
“আলো অল্পক্ষণ ধরে বিস্ফারিত হচ্ছে, তারপর অনেকক্ষণ ধরে,” ডুবেল কী দেখছেন তা বলে চলেন।
“ওটা টেলিগ্রাফ হতে পারে,” ক্রুজ আন্দাজ করেন। “যাক গে, আমি এখন ভাল বোধ করছি, অনেক ভাল। আমি শুনছি!”
“কী দারুণ। আমি আরও আলো দেখতে পাচ্ছি… ফুটকি, বিন্দু, বাঁকা, গোল, ঢেউ, সরুভাবে কাঁপা আলোর রেখা যা একটা আরেকটাকে ভেদ করে যাচ্ছে, গলে যাওয়া, আলাদা… একটা আলোর মৌচাক। নকশা…সবগুলোকে আলাদা করাই মুশকিল।”
“অসাধারণ! অবিশ্বাস্য!” ক্রুজ তাঁর গবেষণার সাফল্যে ভয়ানক খুশি। “আপনি ওগুলো আলাদা করতে পারছেন না কারণ আপনি এখনও যন্ত্রটিতে অভ্যস্ত হননি, আর আপনি বিভিন্ন শক্তির ঢেউকে আলাদা করতে পারবেন না। বোঝাই যাচ্ছে আপনার মনে হচ্ছে যেন আলোর হট্টগোল আপনাকে গ্রাস করেছে। আপনি শিগগীরই এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, আর তখন যে কোন মাত্রার আলোকতরঙ্গ বুঝতে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। তবে, এখন থামবেন না, বন্ধু! বলে যান আপনি আর কী কী দেখতে পাচ্ছেন?”
“অন্ধকার পুরোপুরি চলে গেছে,” ডুবেল বলে চলেন। “সবকিছু আলোকিত। বিভিন্ন শক্তি আর রংয়ের – হালকা নীল, লাল, সবুজ, বেগুনী, গাঢ় নীল। আপেলের সমান একটি আলোর ছিটে বামদিকে জ্বলে উঠল। নীলাভ রশ্মি ওটা থেকে বেরোচ্ছে যেন ছোট্ট সূর্য।”
“ওটা কী হতে পারে?” ক্রুজ বিস্মিত হলেন, কেদারা থেকে লাফিয়ে উঠলেন। “আপনি ওটা দেখেছেন? অবিশ্বাস্য! ওটা তো সূর্যের আলো দরজার পালিশ করা হাতলের ওপর পড়েছে। কিন্তু আপনার পক্ষে তো সেটা দেখা সম্ভব নয়!”
“আমি তো কোন হাতল দেখছি না। আমি শুধু একটা আলোর বল দেখছি যেটা থেকে নীলাভ রশ্মি বেরোচ্ছে।”
“কিন্তু কীভাবে? কেন? কী রশ্মি?”
“আমার মনে হয় উত্তরগুলো আমি জানি ডাঃ ক্রুজ। সূর্য রশ্মির শক্তি ইলেকট্রনকে হাতলের ধাতব জায়গাটা থেকে সরিয়ে নেয়া শুরু করেছে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ! হ্যাঁ! ঠিক বলেছেন, একেবারে ঠিক। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটার কথা ভাবিনি কেন? আচ্ছা, গবেষণা করি আসুন। আপনি অবশ্য পারবেন না করতে, আপনি বৈদ্যুতিক বাতির তারগুলো দেখতে পাচ্ছেন? না। আমি এখন বাতিটা জ্বালাচ্ছি। বিদ্যুৎ সচল হচ্ছে, আর…”
“আর আমি বিদ্যুতের তার দেখতে পাচ্ছি। একটা উজ্জ্বল রেখা ছাদ ধরে থেকে চলে গেছে,” ডুবেল আঙুল দিয়ে দেখান আর ক্রুজ সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়েন, “দেওয়াল ধরে… বিদ্যুতের একটা ফাঁক আছে কোণায়; আপনাকে একটা মিস্ত্রী ডাকতে হবে… তারপর তারটা চলে গেছে একসারি ঘরের ভেতর দিয়ে, প্রথমে এক তলায়, তারপর রাস্তায়। বালবের জ্বলজ্বলে আলোটিকেও আমি দেখতে পাচ্ছি। ঠিক ঐদিকে। শুধু বালবটিকেই দেখতে পাচ্ছিনা তবে এর উজ্জ্বল ফিলামেন্ট থেকে আসা ইলেক্ট্রনগুলোকে দেখতে পাচ্ছি।”
“তাপ নিঃসরনে-এডিসন এফেক্ট,” মাথা নাড়েন ক্রুজ।
“আর কী জানেন ডাঃ ক্রুজ?” ডুবেল খুশি মনে বলেন। “আমি এডিসন এফেক্টের চাইতেও দারুণ জিনিস দেখতে পাচ্ছি। তা এমনকি মাথা না ঘুরিয়েই দেখতে পাচ্ছি। দয়া করে বিছানার কাছে আসুন। এইতো ঠিক আছে। আপনার মাথাটা ঠিক এখানে, আর আপনার হৃৎপিণ্ড এখানে, না?”
“প্রায় ঠিক। আমার কথা! আপনি কী সত্যি… আপনি কী সত্যি আমার মস্তিষ্ক আর হৃৎপিণ্ড থেকে বিদ্যুতের বিচ্ছুরণ দেখতে পাচ্ছেন? তবে যত যাই হোক, এটাতে এত অবাক হবার কী আছে? আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া করে যা করতে সহায়তা করে বৈদ্যুতিক প্রপঞ্চ। তবে হৃৎপিণ্ড, বিশেষ করে মস্তিষ্ক হচ্ছে যথার্থ উৎস।”
“একটা নরম বেগুনী আলো আপনার মস্তিষ্ক থেকে বের হচ্ছে। ওটা উজ্জ্বল হচ্ছে যখন আপনি অনেক গভীর চিন্তা করছেন। আর আপনি যখন উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন, আপনার হৃৎপিণ্ড বিস্ফোরিত হচ্ছে আগুনে,” ডুবেল বলে।
“আপনি একটা সম্পদ, ডুবেল! খাঁটি সোনা! বিজ্ঞানের এক অমূল্য উপহার। কোন গ্যালভানোমিটার বর্ণনা করতে পারেনা ওটা কী দেখছে। আমি নিজের জন্য গর্বিত… আর আপনার জন্য, ডুবেল। আজ রাতে সারা শহরে গাড়ি করে ঘুরব, আর আপনি আমায় বলবেন যা দেখছেন।”
ডুবেলের সামনে নতুন এক পৃথিবী উন্মোচিত হল। সেই সন্ধ্যায় ক্রুজ যখন তাঁকে সারা শহরে ঘোরালেন, তা ডুবেলের মনে আজীবন খোদাই হয়ে থাকবে। প্রথম সন্ধ্যাটা ছিল পুরো জাদু।
ডুবেল আলো দেখতেন যখন কোথাও বিদ্যুৎ প্রবাহ থাকত। আর বড় শহরের যেখানে বিদ্যুৎ নেই? ডুবেল গাড়ির জেনারেটরের থেকে তীব্র ঝলক দেখতেন। ট্রামের মোটর চলত যেন চরকি, যেন তা স্ফুলিঙ্গ ছেটাচ্ছে – ইলেক্ট্রন। ট্রামের তারগুলো যেন জ্বলজ্বলে দড়ি, সেগুলোর চারপাশে এমন শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ঘিরে আছে যে পুরো পথটা আলোয় স্নান করছে। ডুবেল দেখেছেন বা বলা ভাল মনে করেছেন যে, মাথার ওপরের তার ছাদের ওপর দিয়ে চলে গেছে সামনের প্লাটফর্মের রেগুলেটরে, তারপর গাড়ির মেঝের লোহার কাঠামোয়, অক্ষদণ্ডে, চাকায়, রেলে আর মাটির নীচের তারে। বিপুল পরিমাণ তার মাটির নীচে জ্বলজ্বল করে চলেছে, যা এখানে-ওখানে ভাঙা। ডুবেল আলাদা করে দেখেছেন কীভাবে নীলাভ, চিরে যাওয়া ঝলকানি মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তার পেছনে, শহরের বাইরের দিকে, তিনি দেখেছেন আগুনের ঝর্ণা। শহরের বিদ্যুতের প্লান্টগুলো ওখানেই রয়েছে। সেগুলোর শক্তিশালী জেনারেটর থেকেই অগ্নিঝর্ণারা নির্গত হয়ে চলেছে।
বিশাল বাড়িগুলো দেখতে বেশ লাগে। ডুবেল দেয়াল দেখেন না। তিনি শুধু দেখেন ঝলমলে বৈদ্যুতিক বাতির কন্ডাকটরের জটিল জাল, আর টেলিফোনের তারের টিমটিমে আভা, গগনচুম্বী অট্টালিকার আলোকিত কঙ্কাল। এদিক-সেদিক গুচ্ছ গুচ্ছ মোটরের আলো দেখা যায়।
চারপাশের সমস্তই রেডিও তরঙ্গের আলো ছড়িয়ে আছে। প্রস্রবণ, তারার থেকে আলোর নদী নেমে এসেছে স্বর্গ আর মর্ত্যকে জুড়ে দিতে। ইলেক্ট্রনকে সূর্যের থেকে আলাদা করা, এবং পৃথিবী থেকে চৌম্বকীয় তরঙ্গের বিভেদ করা মহাজাগতিক রশ্মিকেও ডুবেল প্রত্যক্ষ করেছেন।
“অনেক বিজ্ঞানীই আপনার চোখ দু’টো তুলে নিতে চাইবেন এসব দেখবার জন্য!” ক্রুজ উৎফুল্লভাবে বিস্ময় প্রকাশ করলেন, ডুবেলের বর্ণনা শুনে। “যাকগে, মিঃ ডুবেল, তৈরি থাকুন। কাল বড় বড় সব খবরের কাগজের প্রতিবেদকরা আপনার সাক্ষাৎকার নেবেন আর তার পরদিন আপনাকে একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে পেশ করব আমি।”
ক্রুজের আবিষ্কার একটা আলোড়ন সৃষ্টি করল। কয়েকদিন ধরে সমস্ত খবরের কাগজ একে অপরকে টেক্কা দেবার চেষ্টা করে গেল প্রতিবেদনের সময়, আর ক্রুজ খ্যাতির জোয়ারে ভেসে গেলেন। তাঁরা ডুবেলের বারবার সাক্ষাৎকার নিলেন এবং প্রচুর ফোটো তুললেন। তারপর তিনি অগুনতি ব্যবসায়িক প্রস্তাব পেতে লাগলেন।
সমর বিভাগ প্রস্তাব করল ডুবেলকে দিয়ে শত্রুপক্ষের রেডিওগ্রাম ধরে ফেলা হবে যুদ্ধ চলাকালে। ডুবেল রেডিও তরঙ্গ দেখেন সারবাঁধা আলোর ঝলকানির মত করে করে বিভিন্ন সময় ধরে। তিনি একটি রেডিও গ্রহণ স্টেশনের কর্তা, কারণ তাঁর তরঙ্গের দৈর্ঘ্য সমন্বয় করতে হয় না। তিনি সবই দেখতে পান – বড় এবং ছোট।
একটি বড় বিদ্যুৎ সংস্থা তাঁকে প্রস্তাব দিল মাটির নীচের তারে ছিদ্র নিয়ন্ত্রণ এবং তথাকথিত উটকো স্পার্ক, যা মাটির নীচের তার এবং নানান ধাতুর কাঠামোর ক্ষতি করে তা বের করার মত কাজের। ফার্মটি হিসাব করে বের করে যে তারে ছিদ্র বের করার জন্য মেরামতকারী ও বাজারচলতি যন্ত্রপাতি সজ্জিত মিস্ত্রীর বদলে জীবন্ত যন্ত্র-ডুবেল-এ অনেক কম খরচ পড়বে ।
শেষতক, ইউনিভার্সাল ইলেক্ট্রিক কোম্পানী তাঁকে একটি প্রস্তাব দিল। তারা চাইছিল তিনি যেন গবেষণা কর্মের জন্য জীবন্ত যন্ত্র হিসেবে কোম্পানীর বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে যোগদান করেন। তারা ক্যাথড টিউব ও লন্ঠন, ওসিলোগ্রাফ, আল্ট্রাভায়োলেট, রঞ্জন, এবং গামা রশ্মি বের হয় এমন যন্ত্রের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে অনুসন্ধান করছে। তারা সেখানে সম্পূর্ণভাবে বৈদ্যুতিক-চৌম্বকীয় পরিবর্তন পরিমাপ নিয়ে অধ্যয়ন করছে এবং পরমাণু বোমা নিক্ষেপ ও কসমিক রশ্মির গুণ নিয়ে গবেষণা করছে। ডুবেলের মত একজন জীবন্ত যন্ত্র অবশ্যই বিপুল কাজে আসবে অদৃশ্য রশ্মি নিয়ে গবেষণার কাজে।
ক্রুজ অনুমতি দিলেন ডুবেলকে ইউনিভার্সাল ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর প্রস্তাবটি গ্রহণ করবার জন্য।
“কিন্তু আপনি আগের মতই আমার সাথে থাকবেন,” জানালেন ক্রুজ। “আমার জন্য সেটা খুবই সুবিধার হবে। আমাদের চুক্তি এখনও সচল থাকবে অবশ্যই। আপনাকে নিয়ে আমার গবেষণা এখনও শেষ হয়নি।”
আবার ডুবেল রোজগার করছেন এবং দুহাতে করছেন।
সকাল ৮টায় তিনি ওজোন, রাবার ও নানান এসিডের গন্ধে ভরপুর গবেষণাগারে বসেন। গবেষণা রাতে হোক বা দিনে, বাতির নিচে হোক বা অন্ধকারে, ডুবেল সবসময় তাঁর আলোয় চিত্রিত বল, বৃত্ত, মেঘ, ঝলকানি এবং তারায় ঘিরে আছেন। যন্ত্রে গুঞ্জন, গুনগুন এবং পটপট শব্দ হয়, আর ডুবেল দেখতে পান ইলেক্ট্রনের ধারা ছিঁড়ে যাচ্ছে আর বেঁকে যাচ্ছে, বা ভেঙে যাচ্ছে উড়ে যাবার সময় তৈরি করা বাধা, জাল বা ফাঁদে পড়ে। ডুবেল বলতে থাকেন, বলতে থাকেন আর বলতেই থাকেন। দু’জন স্টেনোগ্রাফার তার কথা লিখে রাখেন।
সম্পূর্ণ অবাক করা তথ্য রেকর্ড করা হল: ডুবেল আলোর বিস্ময়কর ঘটনা দেখেছেন যার পূর্বাভাস কোন বিজ্ঞানী দিতে পারেননি। যখন সচল যন্ত্রের চাইতে বড় আর ভারী একটি বিশাল বৈদ্যুতিক-চৌম্বকীয় জিনিষ বসানো হল কাজ করতে, তখন ডুবেল রিপোর্ট করলেন।
“উফ! এটা কাউকে অন্ধ করে দেবার জন্য যথেষ্ট! চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি শহরের একটা বড় জায়গা দখল করে আছে উজ্জ্বল আলো দিয়ে; এর সীমা বিস্তৃত রয়েছে শহরের বাইরে পর্যন্ত। আমি পুরো শহরের মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। আমি একই সাথে সারা শহরের বৈদ্যুতিক কঙ্কালটাকে সব দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি। আমি আপনাকেও দেখতে পাচ্ছি, মহাশয়। ইলেক্ট্রনেরা আমায় ঘিরে আছে ঝলমলে মৌমাছির ঝাঁকের মত। মি. লার্ডনার নাকের মধ্য দিয়ে স্ফুলিঙ্গ নামছে; মি. লামোটের মাথাটা আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে মেডুসার মাথাটিকে, আগুনের গোলার মত। আমি সব ধাতব জিনিস দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কারভাবে; সেগুলো সব জ্বলে যাচ্ছে, আর এ সবই জোড়া লেগে আছে ঝলমলে সুতো দিয়ে।”
ডুবেলের সাহায্যে অনেক বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান হল, তা না হলে সেগুলো রহস্যই থেকে যেত। কোম্পানী তাকে প্রশংসা করল এবং প্রচুর অর্থ দিল।
“অন্ধ হিসেবে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি, কিন্তু তারপরও মনে হয় যারা দেখতে পায় তারা অনেক সুখী আমার চাইতে,” সে ক্রুজকে বলে। ডাক্তার তাঁর প্রতিদিনকার কাজের বিবরণ শোনেন, এবং সেই মোতাবেক নিজের যন্ত্র নিখুঁত করতে থাকেন।
তারপর সেদিন এল, যেদিন ক্রুজ বললেন:
“মি. ডুবেল, আজ আমাদের চুক্তি শেষ হয়ে গেল। আমি আমার শর্ত অনুযায়ী আপনার স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেব। কিন্তু তাহলে আপনি আপনার ইলেক্ট্রনের নড়াচড়া দেখার ক্ষমতা হারাবেন। এটা আপনাকে জীবনের একটি চরম সুবিধা দিয়েছে।”
“মোটেই না! জীবন্ত যন্ত্র হবার সুবিধা নিতে আমার আর কোনো ইচ্ছে নেই। যথেষ্ট হয়েছে। আমি দেখতে চাই, আমি চাই স্বাভাবিক মানুষ হতে, কথা বলা, হেঁটে চলা গ্যালভানোস্কোপ নয়।”
“সে আপনার ইচ্ছা,” ক্রুজ চাপাহাসি দিলেন। “এই যদি হয় আপনার সিদ্ধান্ত, তবে শুরু হোক চিকিৎসা।”
ডুবেলের জীবনের সবচাইতে আনন্দের দিন অবশেষে এসে গেল। তিনি দেখতে পেলেন ক্রুজের কোঁচকান, হলদে মুখখানি – অল্পবয়স্ক সেই মানুষটি, যিনি তাঁকে সহায়তা করছেন। তিনি দেখতে পেলেন জানালার শার্শিতে বৃষ্টির ফোঁটা, শরতের ছাই রংয়ের আকাশ, হলদে ঘাস। প্রকৃতি ডুবেলের দৃষ্টি ফিরে আসা উপলক্ষে যেন রঙে সেজে উঠেছে। হয়ত ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক, যখন চোখ থাকে – সেটা রং খুঁজে নেয়।
ক্রুজ ও ডুবেল একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন। তারপর ডুবেল ক্রুজের হাতে উষ্ণভাবে ঝাঁকুনি দেন।
“আমি জানি না কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ দেব…”
“আমাকে ধন্যবাদ দেবার কোন কারণ নেই। আমার পুরস্কার হল কাজের সাফল্য। আমি প্রতারক নই, আমি ভিরোভাল নই। আপনার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়ে আমি সেটা সবার কাছে প্রমাণ করেছি। আমি আশা করি তার অভ্যর্থনা ঘর শিগগীরই ফাঁকা হয়ে যাবে… সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আপনি এখন সাধারণ দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ, ডুবেল। আমি আপনার স্বাস্থ্য, শারীরিক শক্তিকে হিংসা করি… আর, এখন কী করবেন?”
“আপনার ইশারাটি বুঝেছি। আমি এখন আর আপনার রোগী নই, তাই আপনার ওপর বোঝা হয়ে থাকব না। আমি আজ একটা হোটেলে গিয়ে উঠব, তারপর একটা বাড়ি আর কাজ জুটিয়ে নেব।”
“বেশ, শুভেচ্ছা রইল ডুবেল।”
এক মাস পার হল।
একদিন ক্রুজের ডাক পড়ল নীচতলার দোরের হলঘরে। সেখানে ডুবেল দাঁড়িয়ে আছে, কলার তোলা ওভারকোট পরা, টুপিটি হাতে। টুপির কোণা থেকে বৃষ্টির জল মেঝে ভাসিয়ে নিচ্ছে। ডুবেলকে রোগা আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
“ডাঃ ক্রুজ,” ডুবেল বলে “আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবার জন্য। আমি এখন পরিষ্কার দেখতে পারি…”
“বরঞ্চ আমায় বলুন আপনি কাজ জোটাতে পেরেছেন কিনা?”
“কাজ?” ডুবেল অবজ্ঞার হাসি হাসলেন “আমি পরিষ্কার দেখা শুরু করেছি ডাঃ ক্রুজ। আমি আগের চাইতেও দুই গুণ ভাল দেখি। আর আমি আপনার কাছে চাই যে… আমার অন্ধ করে দিন। আমাকে চিরকালের জন্য অন্ধ করে দিন। আমি ইলেক্ট্রনের নড়াচড়া ছাড়া আর কিছু দেখতে চাই না।”
“স্বেচ্ছায় অন্ধ হতে চান? কিন্তু সেটা তো ভয়ংকর হবে।” ক্রুজ বিস্মিত হলেন।
“আমার আর কোন উপায় নেই। আমি না খেয়ে থাকতে চাই না।”
“না, আমি তা করব না; আমি জোর গলায় তা প্রত্যাখ্যান করছি!” ক্রুজ রেগে জবাব দিলেন। “আমায় কী মনে করেছেন? যাইহোক, আপনি অনেক দেরী করে ফেলেছেন। আমি ইলেক্ট্রনোস্কোপে কিছু পরিবর্তন এনেছি, তা পেটেন্টও করিয়ে নিয়েছি। আর ইউনিভার্সাল ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর কাছে। এখন যে কেউই বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখতে পাবে। কোম্পানির এখন আর পরিষ্কার-দৃষ্টি সম্পন্ন অন্ধের দরকার নেই, যেমনটি আপনি ছিলেন ডুবেল।”
ডুবেল তাঁর ভেজা টুপিটা মাথায় দিলেন, নিজের যুবা হাতের দিকে চেয়ে রইলেন।
“ঠিক আছে,” ক্রুজের দিকে সরাসরি তাকালেন, “অন্ততঃ এ দু’টো তো রইল এই নারকীয় জীবনকে চুরমার করে দিতে! বিদায় ডাঃ ক্রুজ।” দড়াম করে দরজা বন্ধ করে তিনি চলে গেলেন।
বৃষ্টিটা যেমন এসেছিল, সেরকমই হঠাত থেমে গেল। সূর্যের নরম আভায় শরতের নীল আকাশ যেন উজ্জ্বল হয়ে সেজে উঠল।
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ
আলেক্সান্দর রোমানোভিচ বেলিয়ায়েভ (Алекса́ндр Рома́нович Беля́ев) (Alexander Romanovich Belyaev) জন্মেছিলেন রাশিয়ার স্মোলেনস্কে ১৮৮৪ সালে। ছোটবেলা থেকে তাঁর ইচ্ছে ছিল আকাশে উড়বেন, সেই ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মেরুদন্ড ভেঙেছিলেন। সেমিনারি স্কুল থেকে পাশ করে ঠিক করেছিলেন আইনজীবি হবেন। কিন্তু ভাগ্য নিয়ে যায় অন্যদিকে। ১৯২২ সালে সুস্থ হন, মস্কো চলে আসেন ১৯২৩ সালে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘প্রফেসর ডয়েলের মস্তক’। বাবা আর বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে তাঁর মা শোকে মৃত্যুবরণ করেন। জীবন ধারণ করতে তিনি স্কুলে পড়িয়েছেন, থিয়েটারের পট এঁকেছেন, সার্কাসে ভায়োলিন বাজিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি হাড়ের যক্ষ্মায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন । তাঁর প্রথম স্ত্রী অসুস্থ স্বামীর সেবা করতে অপারগতা জানিয়ে চলে যান। অসুস্থতার ছয়টি বছর বিছানায় কাটানো সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন বেলায়েভ; জ্যুল ভের্ন, এইচ. জি. ওয়েলস আর রুশী রকেট বিজ্ঞানী কনস্তান্তিন ত্সিয়োলকভস্কির লেখা পড়ে ফেলেন। ১৯২৮ সালে তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘উভচর মানুষ’।
১৯৩০ সালে এইচ. জি. ওয়েলস রাশিয়া ভ্রমণকালে বেলিয়ায়েভের সাথে দেখা করেন। বেলিয়ায়েভ জীবনের শেষ পর্যন্ত লেনিনগ্রাদের পুশকিন শহরে থেকেছেন। ১৯৪১ সালে নাৎসীরা শহর অধিকার করে নেয়, কিছুদিন আগে তাঁর অপারেশন হওয়ায় তিনি পালাতে পারেন নি। ১৯৪২ সালের ৬ জানুয়ারী অনাহারে আলেক্সান্দার বেলিয়ায়েভের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ও কন্যাকে পোল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। দুঃখজনক ব্যপার হল বেলিয়ায়েভের কবরের কোন সন্ধান পাওয়া মেলে নি। একটি গণকবরের ওপর তাঁর স্মরণে স্মৃতিফলক লাগান আছে।
বেলিয়ায়েভের অন্যান্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী উপন্যাসের মধ্যে আছে পৃথিবীর অধীশ্বর, জাহাজ ডুবির দ্বীপ, আটলান্টিসের শেষ মানুষ (১৯২৬), উভচর মানুষ, ইথারে যুদ্ধ, নিঃসীম রুটি (১৯২৮), চেহারা হারান মানুষ, বাতাস বণিক (১৯২৯), শূণ্যে ঝাঁপ (১৯৩৩), কেইজি তারা (১৯৩৬), ডব্লিউ ল্যাব (১৯৩৮) এবং অ্যারিয়েল (১৯৪১)। ১৯৩০ সালে তাঁর লেখা ‘হৈটি-টৈটি’ বড়গল্পের শিরোনামটি ইংরেজি শব্দমালায় আছে অর্থ পরিবর্তন করে, সম্ভবত তাঁর গল্পটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হবার পরই। একটি ব্যপার লক্ষ্য যোগ্য যে, বেলিয়ায়েভের সমস্ত উপন্যাসই রাশিয়া ছাড়া অন্যদেশের পটভূমিতে ঘটেছে। উভচর মানুষের আর্জেন্টিনা, প্রফেসর ডয়েলের মস্তক ফ্রান্সে, অ্যারিয়েলের পটভূমি ভারতে। হয়ত তিনি পরিস্থিতির বিবেচনায় তৎকালীন রাশিয়ার পটভূমিতে এমন গল্প ঘটবে ভাবতে পারতেন না।
১৯৭৭-১৯৭৮ সালে মার্কিন টিভিতে ‘ম্যান ফ্র্রম আটলান্টিস’ সিরিজ চলেছিল। আশ্চর্য ব্যপার, সিরিজ ক্রেডিট লিস্টে কোথাও বলা হয় নি এর কাহিনীমূল বেলিয়ায়েভের কাহিনী থেকে নেয়া। উভচর মানুষ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬২ সালে রুশ ভাষায় নির্মিত ছবিটির ব্যবসা সফলতা প্রমাণ করে এর জনপ্রিয়তা।
অনুবাদক অদিতি কবির ঢাকায় থাকেন। অনুবাদ তাঁর নেশা ও পেশা।
বর্তমান গল্পটি ‘প্রোফেসর ওয়েগনার-এর আবিষ্কার’ সিরিজভূক্ত। ১৯৩৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় Вокруг света (Around the world) পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। ১৯৬৩ তে Robert Magidoff সম্পাদিত Russian Science Fiction গ্রন্থে Doris Johnson প্রথম এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। এছাড়াও Diana Miller কৃত ইংরেজি অনুবাদটি ছাপা হয়েছিল Soviet Literature পত্রিকার v431 #2 1984 সংখ্যায়। ডোরিস জনসন-এর অনুবাদটি থেকেই থেকেই বর্তমান অনুবাদটি করা হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: আলেকসান্দর বেলিয়ায়েভ, ডোরিস জনসন, রবার্ট ম্যাজিডফ
Tags: অদিতি কবির, আলেক্সান্দর বেলিয়ায়েভ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, রাশিয়ান অনুবাদ গল্প, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
উভচর মানুষের লেখকের থেকে এরকম গল্প আর কল্পবিশ্বের লেখক গোষ্ঠীর থেকে এরকম অনুবাদই প্রত্যাশিত।
অসংখ্য ধন্যবাদ
I am a fan of his novel.