অদ্রীশ বর্ধন – একটি ফেনোমেনন
লেখক: অনীশ দেব
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
‘অদ্রীশ বর্ধন’ নামটা আমার জীবনের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে জড়িয়ে। কারণ, খুব ছোটবেলা থেকেই রহস্য–রোমাঞ্চ–গোয়েন্দা–ভৌতিক গল্প পড়তে ভালোবাসতাম আমি। এই ভালোবাসার একটা বড় কারণ ছিল গল্পগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা চমক আর বুদ্ধির মারপ্যাঁচ। মনে–মনে গল্পের গোয়েন্দার সঙ্গে কখন যেন বুদ্ধির লড়াইয়ে নেমে পড়তাম।
আমার অবশ্যপাঠ্য লেখকদের তালিকায় প্রেমেন্দ্র মিত্র, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন অদ্রীশ বর্ধন ও কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের পাশাপাশি আরও একজন লেখক আমার মনে দারুণভাবে জায়গা করে নিচ্ছিলেন – তিনি সত্যজিৎ রায়। ১৯৬০ – এর দশকের শুরু থেকেই বলতে গেলে সত্যজিতের গল্পের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলাম। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা এই কাজে আমাকে নিয়মিতভাবে সাহায্য করছিল। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’, ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, ‘বাদশাহী আংটি’ ইত্যাদির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায়।
যখন এইসব ঘটনা ঘটছিল তখন আমি মাঝ–কলকাতার হিন্দু স্কুলের ক্লাস সিক্স–সেভেনের ছাত্র।
সে সময়ে কয়েকটি পাল্প ম্যাগাজিন নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। তার মধ্যে দুটি মাসিক ক্রাইম ম্যাগাজিনের নাম ছিল ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ এবং ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’। অদ্রীশ বর্ধন ‘মাসিক রোমাঞ্চ’–র নিয়মিত লেখক ছিলেন এবং ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’–র পুজো সংখ্যায় তাঁর একটি উপন্যাস কিংবা গল্প প্রকাশিত হত। আমি এই পত্রিকা দুটির একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম এবং সেসময়ে বেশ কয়েক বছরের জন্য ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার গ্রাহকও ছিলাম।
অদ্রীশ বর্ধনের লেখা আমাকে টানত, যদিও কেন টানত সেটা ওই এগারো–বারো বছর বয়সে বুঝতাম না – বোঝার কথাও নয়। ওঁর কোন লেখা প্রথম পড়েছিলাম সেটা আজ আর মনে পড়ে না, তবে অন্য অনেক লেখার কথাই মনে আছে।
তরুণ লেখক অদ্রীশের সেসময়ের একটি গল্প সংকলনের নাম ‘কাচের জানালা’। প্রকাশিত হয়েছিল ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার প্রকাশনা সংস্থা ‘রোমাঞ্চ গ্রন্থালয়’ থেকে।
একই প্রকাশনা থেকে অদ্রীশের বেশ কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে দুটি উপন্যাসের কথা বেশ মনে আছেঃ ‘রুপোর টাকা’ এবং ‘মোমের হাত’।
অদ্রীশ বর্ধনের এইসব বই পড়ে আমি বড় হচ্ছিলাম। এ ছাড়াও ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওঁর লেখাগুলো এমনভাবে পড়ে ফেলতাম যেন ওগুলো আমার পরীক্ষার সিলেবাসের অবশ্যপাঠ্য বই। পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত এরকম দুটি উপন্যাস ছিল ‘পাতালকেতু’ ও ‘ঈগলের নখ’।
এইসব লেখাপত্র ছাড়াও অদ্রীশের যেসব বই প্রকাশিত হত আমি তার খোঁজখবর রাখতাম এবং পড়েও ফেলতাম। যেমন ‘প্রেতপ্রেয়সী’ উপন্যাসটি। উপন্যাসের মুখবন্ধে লেখকই জানিয়েছিলেন, উপন্যাসটি ফরাসী উপন্যাস ‘ডায়াবলিক’–এর ছায়ায় লেখা। এবং এই উপন্যাসটিকে ভিত্তি করেই আলফ্রেড হিচকক ‘ভার্টিগো’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন। পরে অবশ্য জেনেছি, এই সিনেমাটি ‘D’entre Les morts’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি, এবং সেটির লেখক Boileau-Narcejac । আমাদের মত আগ্রাসী পাঠকদের জন্য একটি ভালো কাজ অদ্রীশ করেছিলেন। সেটা হল, জি.কে. চেস্টারটনের ফাদার ব্রাউন সিরিজের গল্পগুলো তিনি ভাবানুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা ভাষায় অদ্রীশ ফাদার ব্রাউনের নাম রেখেছিলেন ‘ফাদার ঘনশ্যাম’। যতদূর মনে পড়ছে, ফাদার ঘনশ্যামের গল্পগুলোর বেশ কয়েকটি সেসময়ের সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকা ‘অমৃত’–র পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পগুলো নিয়ে অদ্রীশ বর্ধন দুটি বই প্রকাশ করেছিলেনঃ ‘রহস্য–সন্ধানী ফাদার ঘনশ্যাম’ এবং ‘গোলকধাঁধায় ফাদার ঘনশ্যাম’। বই দুটির প্রকাশক ছিল ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড’।
ফাদার ঘনশ্যামকে নিয়ে তৃতীয় একটি বইয়ের বিজ্ঞাপন সেসময়ের সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বইটার নাম ছিল ‘অভিনব গোয়েন্দা ফাদার ঘনশ্যাম’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইটি আর প্রকাশিত হয়নি। আমি বেশ কয়েকমাস ধরে হন্যে হয়ে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় বইটির খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু পাইনি। এতে পাঠক হিসেবে যে কীরকম দুঃখ পেয়েছিলাম এবং হতাশ হয়েছিলাম সে শুধু আমিই জানি। যদি অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় থাকত তা হলে আমি অবশ্যই আমার প্রিয় লেখকের বাড়িতে হানা দিতাম।
অদ্রীশের গোয়েন্দাকাহিনির নায়ক হ্যান্ডসাম স্মার্ট, তুখোড় বুদ্ধির মালিক গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র। ইন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘হীরামনের হাহাকার’। উপন্যাসটি সাপ্তাহিক ‘অমৃত’–তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি অদ্রীশের এমনই পাঠক ছিলাম যে, বাড়িতে ‘বড়দের’ পত্রিকা কেনার অনুমতি না থাকায় পাড়ার ম্যাগাজিন স্টলে দাঁড়িয়ে পত্রিকার প্রতি সপ্তাহের কিস্তি শেষ করতাম। অদ্রীশের গোয়েন্দা উপন্যাসের মধ্যে চারটিকে আমার সেরা মনে হয়। সেই চারটি উপন্যাস হলঃ ‘হীরামনের হাহাকার’, ‘বনমানুষের হাড়’, ‘লোহার কোট’ এবং ‘কংক্রিট বুট’। পাঠক হিসেবে আমার ভালো লাগাকে সম্মান জানিয়ে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ‘পত্রভারতী’–র কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় এই চারটি উপন্যাসকে একসঙ্গে গ্রন্থিত করে ‘সেরা গোয়েন্দা উপন্যাস’ বইটি ২০১৬–তে প্রকাশ করেন। এবং আমাকে, মানে, ‘পাঠক অনীশ দেব’–কে, একটি ভূমিকা লেখার সুযোগ দিয়ে সম্মানিত করেন।
এসব কথা বলে শুধু এটুকু বোঝাতে চাইছি যে, সেই ১৯৬০–এর দর্শক থেকেই ‘পাঠক অনীশ দেব’ লেখক অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ফলে অদ্রীশের লেখার ভক্ত হিসেবে প্রথম না হলেও প্রথম সারিতে থাকার যোগ্যতা বোধহয় আমার আছে। এর আরও একটা প্রমাণ হল অদ্রীশ বর্ধনের অন্যরকম বই ‘তখন নিশীথ রাত্রি’। এই বইটি নাম ক’জন পাঠকের জানা জানি না। বইটি, যতদূর মনে পড়ে, ১৯৬০–এর দশকেই প্রকাশিত হয়েছিল। দাম ছিল দশ টাকা। অর্থাৎ, যথেষ্ট মোটা বই। বইটি বিশিষ্ট এই কারণে যে, এর বিষয়বস্তু ছিল অদ্রীশের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখগাথা।
এরপর বলি অদ্রীশের ‘আশ্চর্য!’ কান্ডকারখানা।
ভারতীয় ভাষায় প্রথম কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩–র জানুয়ারিতে। আমি তখন ক্লাস এইটের বালক মাত্র। আর অদ্রীশ বর্ধনের বয়স তখন একত্রিশ।
‘আশ্চর্য!’-র প্রতি সংখ্যার দাম ছিল এক টাকা। পাঠক হিসেবে আমি পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যা কিনতাম এবং পড়তাম। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ‘আকাশ সেন’। অদ্রীশ বর্ধনের ছদ্মনাম।
‘আশ্চর্য!’ বহু মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিল। আমারও।
পরে অদ্রীশের লেখা থেকেই জেনেছি পত্রিকাটি প্রকাশের জেনেসিস থেকেই কীরকম উন্মাদনা তাঁর ভেতরে কাজ করছিল। হয়তো বয়স যখন কুড়ি বা তিরিশের কোঠায় তখনই এমন পাগলামো সম্ভব। ‘পাগলামো’ বলছি এই কারণে যে, অদ্রীশ বর্ধন পত্রিকার জন্য নিয়মিত লিখতেন (প্রথম সংখ্যাতেই তিনি এইচ.জি.ওয়েল্স–এর ‘দ্য টাইম মেশিন’ উপন্যাসটির অনুবাদ পাঠকদের উপহার দিয়েছিলেন), লেখকদের কাছ থেকে লেখা জোগাড় করতেন, শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকানোর কাজ করতেন, প্রেসে গিয়ে লেখার প্রুফ দেখা, ছাপার কাগজের বন্দোবস্ত করা, বাইন্ডিংখানায় বাঁধাইয়ের কাজ শেষ হলে পত্রিকা পরিবেষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া – আর এসবের সঙ্গে–সঙ্গে সম্পাদনার কাজ – সবটাই করতেন অদ্রীশ। উন্মাদনা না থাকলে এতসব কাজ করা যায়!
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার পাতাতেই ‘সায়েন্স ফিকশন’–এর বিকল্প বাংলা হিসেবে ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দটি অদ্রীশ বর্ধন প্রথম ব্যবহার করেন। এছাড়াও পত্রিকাটিতে অসংখ্য ইনোভেশানের নজির রেখেছিলেন তিনি। যেমন, কল্পবিজ্ঞান–কবিতা প্রকাশ করেছিলেন, উপহার দিয়েছেন কল্পবিজ্ঞান কার্টুন, কল্পবিজ্ঞান অনুগল্প, সায়েন্স পাজ্ল, বিজ্ঞান নিবন্ধ, পুস্তক সমালোচনা – বলতে গেলে কিছুই বাদ দেননি।
‘আশ্চর্য!’ কে ঘিরে হাজারটা কাজের মধ্যে থেকেও দুরন্তভাবে লেখালেখির কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন অদ্রীশ। তখন তিনি এককথায় ‘সুপারম্যান’। স্বনামে বেনামে তাঁর লেখা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত ‘আশ্চর্য!’-র পাতায়। কল্পবিজ্ঞান অথবা ফ্যানটাসি গল্প–উপন্যাসের পাশাপাশি ব্যতিক্রমী লেখাও উপহার দিতেন তিনি। এরকমই একটি লেখা হল পিটার হারকোসেসর ‘সাইকিক্’ লেখাটির অনুবাদ।
‘আশ্চর্য!’ কে ঘিরে অদ্রীশের উন্মাদনা লেখক আর পাঠকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল সংক্রামক ব্যাধির মতো। বাংলা পত্র–পত্রিকার ইতিহাসে এরকম পাগল করা আলোড়ন তোলা ভালোবাসার নজির আর নেই।
কিন্তু ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘আশ্চর্য!’-প্রদীপ স্তিমিত হয়ে এল। পত্রিকা হয়ে গেল অনিয়মিত। ‘আশ্চর্য!’-র লেখক আর পাঠকরা যেন থমথমে মুখে রুদ্ধশ্বাসে পত্রিকাটির শেষ নিশ্বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
‘আশ্চর্য!’ ফুরিয়ে গেল। কিন্তু অদ্রীশ বর্ধন তখনও ফুরিয়ে যাননি। সেটা প্রমাণ করতেই, ১৯৭৫ সালে স্বনামে সম্পাদক হয়ে তিনি ‘ফ্যানটাস্টিক’ পত্রিকা নিয়ে বাংলা ম্যাগাজিনের জগতে হাজির হলেন। কিন্তু এই পত্রিকা টি ছিল ‘আশ্চর্য!’-র ছায়া মাত্র। এবং একত্রিশ বছরের আকাশ সেনের কাছে তেতাল্লিশের অদ্রীশ বর্ধনও ছিলেন ছায়ার বেশী কিছু নয়। এর কারণ, ‘ফ্যানটাস্টিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকত ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার নানান লেখার পুনর্মুদ্রণ। এ ছাড়া ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার কোনও কোনও ছবি অথবা ইলাস্ট্রেশানও খুঁজে পাওয়া যেত ‘ফ্যানটাস্টিক’–এর পাতায়।
যে কোন কারণেই হোক, ‘ফ্যানটাস্টিক’ কল্পবিজ্ঞানকে মূলমন্ত্র করে পথ চলতে পারেনি। হয়তো তরুণ সম্পাদক আকাশ সেনের তুলনায় মাঝবয়সী অদ্রীশ বর্ধন অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তরুণ বয়সের উন্মাদনা হয়তো ক্ষয়ে গিয়েছিল সময়ের সঙ্গে–সঙ্গে।
১৯৮৯–৯০ সাল নাগাদ ‘ফ্যানটাস্টিক’–এর আয়ু ফুরিয়ে যায়। তার পর থেকে, এই সিকি শতক পরেও, আমরা কোনও কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকা পাইনি। সেখানে শুধুই শূণ্যতা।
এখানে বলা দরকার, পত্রিকা প্রকাশের কাজে ব্যস্ত থাকলেও অদ্রীশ কখনও তাঁর লেখা থামাননি। নানান ধরনের গল্প–উপন্যাস লিখে গেছেন নিয়মিতভাবে। সেই কারণেই অদ্রীশ বর্ধন আমার কাছে একটি ফেনোমেনন।
আমার একান্ত বিশ্বাস, শুধুমাত্র ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার স্রষ্টা হিসেবে অদ্রীশ বর্ধনকে বাংলা সাহিত্য মনে রাখবে চিরকাল। আর আমি এই সুযোগে সেই ফেনোমেননকে আমার আন্তরিক প্রণাম জানাই।
Tags: অনীশ দেব, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস, স্মৃতিচারণ
Khub bhalo laglo pore.
অসামান্য স্মৃতিচারণ। বাংলা সাহিত্যে অদ্রীশ বর্ধনের অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন, তথা বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে “আশ্চর্য!” নিয়ে আলোচনা করতে হবেই।
বেশ লাগল