অভয়ারণ্য মধুমিডা
লেখক: সিদ্ধার্থ ঘোষ
শিল্পী: ইন্টারনেট
পায়রার মতো বড়সড় চেহারার একটা জোনাকি পাখির ছোঁয়া ঘুম ভাঙিয়ে দিল। অনেকদিন বাদে এমন স্বপ্ন দেখল বিদুর।
আড় চোখে তাকাল শ্রীমতীর দিকে। এখনও গভীর ঘুমে অগোছালো আর নিশ্চিন্ত।
যেন ধরা পড়ার ভয়ে চোখ বুজে ফেলল বিদুর। সেই প্রথম সিগারেট টানার দিনগুলোর মতো। কেউ টের পাবে না জেনেও দূরে মুখ সরিয়ে রাখা, ঠোঁট টিপে কথা।
রঙিন আবরণে নিষিদ্ধ চিন্তা। দীর্ঘ বাইশ বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম গোপনে নিজের মন নিয়ে খেলা।
নিজেকে অনেক বুঝিয়েও কাজ হয়নি। বিদুরের হাতে স্টিয়ারিং বারকয়েক রেওয়াজ-ভাঙা মোচড় নিল। আজও না বলে কয়ে অফিসে লেট। কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে আসার পর উলটো ফল হয়েছে। কাজকর্মে আরও শিথিল।
মহাকাশ পর্যটন কেন্দ্রের ড্রাইভ-ইন সেন্টার তার অপরিচিত নয়। গাড়ি থেকে নামার আগে ব্যাঙ্ক অব কায়রো-র পাশ বইটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। এটা পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট। চাকরির টাকা এখানে জমা পড়ে না।
কম্পিউটারের কাছ থেকে রিজার্ভেসন তালিকা চেয়ে নিল বিদুর। সতেরোই নভেম্বরটা বেশ জুতসই। তেরো তারিখে অফিসের একটা সফর আছে। ফিরবে ষোলোই। সে দিনটা কলকাতার কোনও হোটেলে বডি ফেলতে হবে। পরের দিন পৃথিবী ছাড়িয়ে যাত্রা। তিন দিন মধুমিডা-য় কাটিয়ে বাড়ি ফিরলেও কেউই ধরতে পারবে না। অফিসিয়াল ট্যুরে হামেশাই তো দশ-বারো দিন সে নিখোঁজ হয়ে যায়।
ধাক্কা খেল বুকিং কাউন্টারে। হিসেব নিকেশ করে চেক অবধি কেটে দিয়েছে। বেঁকে বসল মেশিন। টিকিট দিতে রাজি নয়। সবুজ পর্দার উপর দপ দপ করছে, ‘স্পেশাল কেস! প্লিজ ভেরিফাই!’
সম্মানজনকভাবে পালাবার উপায় থাকলে বিদুর দ্বিতীয়বার চিন্তা করত না।
‘সরি স্যার, আপনাকে ডাইরেক্টরের কাছ থেকে স্পেশাল অনুমতি নিতে হবে। আপনি তো মাসখানেকের মধ্যেই সপরিবারে মধুমিডা থেকে একবার ঘুরে এসেছেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু এমন কোনও আইন আছে…’
‘না স্যার, আইনের ব্যাপার নয়। ডাইরেক্টর নিজেই বলবেন আপনাকে।’
বুকিং ক্লার্কের বিনয় আদেশের মতো শোনায়।
অবাক হল দুজনেই। অরীন এই দপ্তরের ভার নিয়েছে জানা ছিল না। একদিক থেকে মঙ্গল। অরীনের বিরুদ্ধে এক বছর ধরে একটা দুর্নীতির অভিযোগ ঝুলছে। ফাইলটা এখন বিদুরেরই হাতে। আর অরীনের সেটা অজানা নয়।
‘কী সব নিত্য নতুন আইন বানাচ্ছ বলো দিকি! কেউ যদি এক মাসের মধ্যে দু-বার বেড়াতে যেতে চায়, আপত্তি কীসের? হালকা চালের কথা গেঁথে বিদুর নিজের পায়ে জোর ফিরিয়ে আনার চেস্টা করছে।
‘বসুন—বসুন—আগে ওকে ছেড়ে দিই।’
বুকিং ক্লার্ক একটা ফাইল রেখে বিদায় নিল।
অরীন বলল, ‘একবার কেন, যত বার খুশি যেতে পারেন। কিন্তু অমন অভ্যর্থনা আর পাবেন না। সেইটাই জানিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।’
‘অভ্যর্থনা?’
কানাডিয়ান স্মোকিং ট্যাবলেটের সেলোফেনের আবরণ ছিঁড়ে অরীন বাড়িয়ে ধরেছে। দু-আঙুলে ঘষে ঘ্রাণ নিল বিদুর। এমন ফ্লেবার দিশি কোম্পানির কাছে এখনও আশা করা যায় না।
অরীন বলল, ‘আপনার কাছে কিছু গোপন করা সম্ভব নয়। তবে একটা রিকোয়েস্ট, মধুমিডায় কী ঘটেছিল যদি খুলে বলেন। হয়তো আমি…’
সাহায্য করতে চাইছে অরীন। তার মানে, কিছু নিশ্চয় আঁচ করেছে। ঘুঘু মাল। বিদুর ছোট্ট একটা অঙ্ক সেরে নিচ্ছে মনে মনে। ঘুঘু বলেই অবশ্য সুবিধে। বিদুরের কাহিনি পাঁচ কান করলে কার বেশি ক্ষতি সেটা বোঝার ক্ষমতা নিশ্চয় তার আছে।
ডিনার টেবিলে প্রথম পদ হিসাবে শ্রীমতী তিনটি কাগজের টুকরো পেশ করল। বিদুরের ভরসায় থাকলে কিছু হবে না জানতে আর তার বাকি নেই। পাঁচ বছর হল বড়দিনের ছুটিতে তারা বেড়াতে যায়নি। আর নয়। এবার সে নিজেই রকেটের সিট বুক করে এসেছে। তেইশ তারিখে যাত্রা।
বিদুরের আপত্তি করার কোনও উপায় ছিল না। তার আগেই লাফিয়ে উঠেছে বারো বছরের কৌতূহল। ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি মা? ওখানে মনোরেল আছে তো? ভিডিয়ো গেম না থাকলে কিন্তু…’
‘ওসব কিছু নেই। বেড়াতে গিয়েও ভিডিয়ো…’
বাপ্পু বেগতিক বুঝে বলল, ‘ঠিক আছে, তাহলে এবার পোলারয়েড সিনে ক্যামেরাটা কিনে দাও। ছবিটবি তুলেই সময় কাটবে। দেখবার মতো কী আছে মা ওখানে?’
‘বলছি তো কিচ্ছু নেই। শুধু বেড়াতে যাওয়া, ক-দিন ছুটি। ব্যস।’
টাইয়ের ফাঁসটা আলগা করতে করতে বিদুর বলল, ‘কোনও হিল স্টেশনের টিকিট…’
‘তা না হলে আর বুদ্ধি! এই সিজনে দুনিয়ার কাঁথা কম্বল কাঁধে তুলে রকেটে চেপে পাড়ি দাও। আমি মধুমিডার টিকিট কিনেছি। এই সময়ে কেউ বলে বেড়াতে যায় না। ভিড় কম। তা ছাড়া এমন সব অদ্ভুত আর সুন্দর সুন্দর জন্তুর ছবি দেখাল—শিকারেও বাধা নিষেধ নেই।’
‘শিকার? আমিও শিকার করব? আমাকে মেশিনগান দেবে তো?’
টারা—টাট্টা—টারা—টাট্টা—বাপ্পু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য মেশিনগান হাতে ঘরের তিন দেওয়ালকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল।
লটবহর তবু কম হল না। বিদুর তো তার বাইনোকুলার আর ক্যামেরার ভারেই অচল। শ্ৰীমতীর দু-কাঁধে দশ বোতল জলের বোঝা। যে যাই বলুক বিদেশ বিভূঁইয়ের খাওয়ার জল সম্বন্ধে তার সন্দেহ দূর হওয়ার নয়। বিশেষ করে বাপ্পুর জন্যে অন্তত দিন কয়েকের জলের রেশন রাখতেই হবে। এর পরে আসল বাক্স-প্যাঁটরা। তিনটে পলিথিন সুটকেস, একটা ওষুধ-ভরা অ্যাটাচি কেস আর প্রসাধনের সরঞ্জামসহ ফোল্ডিং ড্রেসিং-টেবিল।
‘দুটো কুলি ডাকো, বুঝলে?’ কথাটা প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে বিদুর পা চালাল টেক-অফ-কাউন্টারের দিকে। টিকিটগুলো পরীক্ষা করিয়ে ছাপ মারাতে হবে।
এতটকু বৈষয়িক বুদ্ধি থাকলে বিদুর এই কাজটা শ্ৰীমতীকেই দিত। যেখানে পোর্টার সব মাল বইতে পারে, সেখানে ওরা তিন জনকে নিযুক্ত করার দাবি জুড়েছে। আর দর যা হাঁকছে সেটা কলকাতা থেকে এই লঞ্চিং প্যাড অবধি পৌঁছনোর হেলিকপ্টারের ভাড়ার অর্ধেকের কাছাকাছি।
‘কত নম্বর গাড়ি?’ লাল ফাইবার গ্লাসের শিরস্ত্রাণধারী এক পোর্টার জানতে চাইল।
সবাই শক্তের ভক্ত, এই থিয়োরিতে মিলে যাচ্ছে ভেবে শ্রীমতী খুশি হল, ‘মার্কারি পাঁচশো সতেরো!’
‘বহুত ভিড়। সিট মিলবে না।’ পোর্টার পিছন ফিরল।
বাপ্পু মায়ের হাতে টান দিল, ‘আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাব না…’
ছোট্ট একটা কানমলার আগে চুপ করেনি বাপ্পু! মার্কারি ট্র্যাভেলের ভাড়া কম। কিন্তু তারা অসংরক্ষিত আসনের কথা গোপন করেছিল বলার উপায় নেই। রকেটের দেড় হাজার সিট ভরে গেছে। ভাবা যায় না। মানুষের এত পয়সা!
শ্রীমতীকে স্বীকার করতেই হবে যে পোর্টারদের সাহায্য ছাড়া সিট দুটো তারা পেত না। ইতিমধ্যেই শতাধিক যাত্রী টিকিট ফেরত দেবে বলে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু বাড়তি টাকার প্রলোভন সত্ত্বেও তৃতীয় আসনের ব্যবস্থা করতে পারেনি পোর্টাররা। বিদুর যখন এসে পৌঁছল রকেটের কেবিনের প্যাসেজে প্রায় শ’দুয়েক মানুষের ভিড়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাপ্পুকে মায়ের কোলে চড়তে হল।
‘দরজা বন্ধ করা হচ্ছে। আর এক মিনিট সময় দিচ্ছি। তারপর আসন গ্রহণ করেননি যাবতীয় যাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে রকেটের মালবহন কক্ষের বিভিন্ন চেম্বারে স্থানান্তরিত করা হবে।’—ঘোষণা শেষ হল।
বাপ্পু পকেট কম্পিউটারে ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশানালের লড়াইয়ে মশগুল, শ্রীমতীর ঠোঁটের সামনে উদ্যত সোনালী লিপস্টিক—টিকিট চেকার এসে দাঁড়াল।
টিকিট পাঞ্চ করতে করতেই বাপ্পুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কত বয়স?’
‘এগারো।’
কথাটা বিশ্বাস করেনি। পকেটে গোঁজা বয়স পরীক্ষার এজোমিটার বার করে বাপ্পুর কপালে ঠেকিয়ে নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরল।
‘এগারো বছর সাত মাস প্লাস! যা ভেবেছিলাম। ওকে তো কোলে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না।’
অগ্যতা বিদূরকে সেই উঠতে হল। বাপ্পু মায়ের পাশের সিটে বসেছে।
কফিনের আকারের কাচের আধারে ভরে বিদূরকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে টিকিট চেকায় আবার ফিরে এল। শ্রীমতীর হাতে দুশো পনেরো নম্বর কুপন ধরিয়ে দিয়েছে। যাত্রা শেষ হওয়ার পরে এই কুপনটি দাখিল করলে বিদূর সমেত যাবতীয় মালপত্র ফেরত পাওয়া যাবে।
শ্ৰীমতীর দুশ্চিন্তা লক্ষ করে চেকার হাসি মুখে বলল, ‘আপনার মিস্টারই ভাগ্যবান। এই তিন দিনের একঘেয়ে যাত্রার কোনও ট্রেনই ওনার গায়ে লাগবে না। দেখবেন, কেমন তাজা ঝরঝরে দেখাচ্ছে।’
‘থ্যাংক ইউ।’
‘খরচও অনেকটা বাঁচল। ওনার খাওয়া-দাওয়ার কোনও চার্জ লাগবে না। না না, না খাইয়ে ফেলে রাখা হবে না। হাইবারনেশনে রাখার সময়ে খাদ্যের প্রয়োজনই কমে যায়। যেটুকু দরকার তার ব্যাবস্থা আছে বৈ কি!’
তিনটি তারা ছুঁয়ে রকেট শেষ ষ্টেশন মধুমিডায় পৌঁছল মাত্র শ’খানেক যাত্রী নিয়ে। একটু নিশ্চিন্ত বধ করল শ্রীমতী। হোটেলে ঘর বুক করে আসেনি। ঝাঁক বেধে গাদা টুরিস্ট হাজির হলে ঝঞ্ঝাট তো বাধাতেই পারে।
কলকাতার রকেটপোর্টের মতো মাল টানাটানি নিয়ে এখানে সমস্যা নেই। পরিবহন কর্তৃপক্ষই গাড়ি আড্ডা অবধি পৌঁছে দেবে। অবশ্যই বিদুর এই হিসেবের বাইরে।
বিদুর হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়াতেই পুরানো কথা মনে পড়ে গেল শ্রীমতীর। বয়সের সঙ্গে আর যাই পালটাক মন বিশেষ পালটায় না। সেই হনিমুনের সময়েও ঠিক একই রকম দেখেছে মানুষটাকে। গন্তব্যে পৌঁছে তবে মুখে হাসি। আর তার আগে শুধু অহেতুল দুশ্চিন্তা।
হাতে উদ্যত মেশিন এয়ার-গান নিয়ে আগে আগে চলেছে বাপ্পু। রকেটে আসার সময়েই মধুমিডার জীবজন্তুদের অনেক গল্প শুনেছে মায়ের মুখে। সবচেয়ে ভয়ংকর দেখতে যে মধুমিডাস—লম্বায় ষাট ফুট, গায়ে হাঙরের মতো ধারালো অসংখ্য পাখনা, জলে স্থলে সমান গতি, গিরগিটির মতো আবার রংও পাল্টায়—সেও নাকি নিতান্তই নিরীহ আর গোবেচারা। বছর দশেকের মধ্যে, মধুমিডায় মানুষের জাতায়াত শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার টেরোমিডাস শিকারীদের হাতে মারা পড়েছে। এই জন্তু শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পড়ে সত্যি বলতে ভ্রমণকারীর সংখ্যা বেশ কমেছে। তবে এ ছাড়াও জন্তুর অভাব নেই এখানে, আর তাদের শিকারেও বাঁধা নেই।
শ্রীমতীর হাত বিদুরের হাতটাকে খুঁজে নিয়েছে। কতদিন পরে বুকের মধ্যে শিরশির ভাব। আড়চোখে চাইল একবার বিদুরের দিকে। বিদুরপ আশা করছিল। তবেই বোঝো এন বেড়াতে আসা দরকার!
রকেটপোর্টের অভ্যর্থনা কক্ষ। কক্ষ না বলে প্রাসাদ বলাই উচিত। এমন রাজকীয় সেন্টার পৃথিবীতেও আছে কিনা সন্দেহ। হোটেল, রেস্তোরাঁ, মার্কেটিং কমপ্লেক্স—বিশাল আয়োজন। বাপ্পু একটা খেলনার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘মা, রেডিয়ো রেসিং কার!’
‘এখন নয় বাবা। ফেরার সময় দেখা যাবে।’
লাল ভেলভেট মোড়া একটা ট্রে হতে মেয়েটি যখন হাসিমুখে ওদের পথরোধ করে দাঁড়াল, মনে হয়েছিল কিছু গাছাবার মতলব। সেলস গার্ল।
ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। চেহারা বা সাজসজ্জা কোনওটাই সরকারি চাকুরিজীবীকে চিনে নিতে সাহায্য করে না। টুরিস্ট সেন্টারগুলো আর যাইহোক একটু ভেবেচিন্তে চালাচ্ছে তা হলে ভারত সরকার।
প্রত্যেকের বুকে ছোট্ট একটা চাকতির মতো চেহারার যন্ত্র ক্লিপ দিয়ে আটকে দিয়ে মেয়েটি বলল, ‘সরকারের তরফ থেকে মধুমিডায় পা দেওয়ার পর এটা আমাদের প্রথম উপহার। স্বয়ংক্রিয় অনুবাদ যন্ত্র। মধুদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে হলে এটা ছাড়া উপায় নেই।’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফুরফুরে চুলের প্রান্তে একটু ঢেউ খেলিয়ে মেয়েটি অন্তরঙ্গভাবে যোগ করল, ‘বেজায় খটমটে ভাষাটা। আমার এখানে দু-বছর হয়ে গেল, তাও নো প্রগ্রেস—’
শ্রীমতী হোটেল বুকিঙের কথা পাড়া মাত্র থামিয়ে দিয়ে রিসেপশনিস্ট বলল, ‘কোনও অসুবিধা হবে না। মোটর স্ট্যান্ড থেকে যাই ধরুন, ড্রাইভাররা প্রত্যেকে অত্যন্ত হেল্পফুল। শহরে যাওয়ায় পথে প্রয়োজনীয় সব কথা তারাই জানিয়ে দেবে। ইন ফ্যাক্ট ওরাই গাইড। শুধু একটা জিনিস দেখে নেবেন। ওদের লাইসেন্স। সরকারি স্ট্যাম্প ও তারিখ দেওয়া। শুভযাত্রা!’
ইলেকট্রিক অটো আর নিউক্লিয়ার ট্যাক্সির ড্রাইভাররা মধুমিডার আগন্তুকদের ছেঁকে ধরেছে। জটলা বচসা দরাদরি কথা কাটাকাটির গোলকধাঁধার মধ্যেই বিদুররা সিন্ধান্ত নিয়েছে অটো ভাড়া করবে। তাতে দুটো নদী পার হওয়ার সময় নামতে হবে ঠিকই, কিন্তু বেড়াতে এসে প্রথম দিনেই তাড়ার কি? ভাড়ার ফারাকাটা তো কম নয়।
কয়েকজন ট্যাক্সিওলা বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে দেরিতে পৌঁছালে ভালো হোটেলে ঘর পাওয়া যাবে না। বিশ্বাসযোগ্য নয়। টুরিস্টদের সঙ্গে ড্রাইভারদের সংখ্যা তুলনা করলেও বোঝা যায় সিজন এখনও তুঙ্গ ছোঁয়নি।
কলকাতা ও বাঙালি, এই দুটো প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা মাত্র পাঁচ জন বাঙালি ড্রাইভার বিদুরদের ওপর তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছে।
‘কোত্থেকে আসছেন স্যার? ভবানীপুর…’
‘হাতিবাগানের…’
বিদুর আর শ্রীমতীকে ছেড়ে বাপ্পুর প্রতি বেশি মনোযোগী হয়েছে একটি অল্পবয়সী ছেলে। রীতিমতো ইন্টালিজেন্ট। বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতে দু-তিনটে বাক্যের বেশি লাগেনি। সেই ফাঁকে সংগ্রহ করে নিয়েছে তাদের তাল-তলার ঠিকানা।
পকেট ক্যালকুলেটালের আকারের লিজার থেকে বিদুরদের তিনটে বাড়ির পর নস্করদের নাম করেছে। গত বছরেও এসেছিল তারা।
কিন্তু তাতেও বোধহয় বিদুরদের সে নিজের অটোতে তুলতে পারত না। বিদুরের পদবীটা জানা মাত্র একজন বুড়ো ড্রাইভার তার ক্যালকুলেটর প্রিন্ট আট থেকে অশেষ সরকারের পারিবারিক গ্রুপ ফটো পেশ করেছে। বিদুরের সেজমামা। সত্যি বলতে ওরা যে তিনমাস আগে এখান থেকে ঘুরে গেছে সেটাই একটা আবিষ্কার।
কিতু বাপ্পু ততক্ষণে আঙ্কেলের হাত ধরে ফেলেছে। আর কারুর সঙ্গেই সে যেতে রাজি নয়।
নীল পদ্মফুলের গহন অরণ্যের মাঝ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে রাস্তা। অচেনা একটা গন্ধে সুরভিত স্বচ্ছ বাতাস। বিশাল গাছপালা একটাও চোখে পড়েনি এখনও, শুধু লতা জাতীয় একই ধরণের উদ্ভিদ।
বাপ্পু ড্রাইভারের সঙ্গে সামনের সিটে। উদ্ভিদ জগতের বৈচিত্রের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেস্টা বৃথা। কাকু বলেছে এখানে নাকি তিন পা-ওলা সাপের মতো ডেংরি দেখা যায়। বাইনোকুলার চোখে সে টেন্স্।
ড্রাইভার ছেলেটা মিশুকে ও খোলামেলা। নিজের থেকেই প্রায় ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছে। মধুমিডার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা তার কাছে নিছক দায়িত্ব পালন নয়, আসলে কথা বলতেই ভালোবাসে।
জীবজন্তুর চেয়ে মধুমিডার অধিবাসীদের সম্বন্ধে বেশি কৌতূহল শ্রীমতীর। এখন অবধি তো কই একটিও মধু (স্ত্রী) ও মাধু (পুরুষ) চোখে পড়ল না।
‘ওদের রকেটপোর্ট বা প্রধান সড়কের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। শহরে গেলে চোখে পড়বে। হোটেলে বা বাজারে ফাইফরমাস খাটে বা কুলির কাজ করে অনেকেই। যা মোটা বুদ্ধি, এর বেশি ওদের কাছ থেকে আশা করা যায় না।’
‘মানুষ হিসেবে কিরকম?’ বিদুরের প্রশ্ন।
‘মানুষ? ওদের মানুষ বলছেন?’ হেসে ফেলে তিরকি। ‘চেহারাটাই শুধু মানুষের কাছাকাছি। গায়ের নীল চামড়া দেখলেই এক নজরে চেনা যায়। ওদের মানুষ বলবেন না।’
‘ভয়ের কিছু নেই তো?’—শ্রীমতী।
‘কিচ্ছু না। আপনারা থাকবেন শহরে। মধুমিডায় শহর বলতে ওই একটাই। আমরাই বানিয়েছি। আর আপনাদের যা ঘোরাঘুরি সবই সংরক্ষিত অঞ্চলে। পুরো আমাদের নিয়ন্ত্রণে। এই অঞ্চলে আজ অবধি কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে, একটা কথা বলব। ওদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেস্টা না করাই ভালো।’
‘কেন কেন?’ জোড়া প্রশ্ন বিদুরের।
‘এখনও আমরা ওদের ঠিক চিনতে পারিনি। এমনিতে ভারি নিরীহ কিন্তু ভারতীয় ধর্মসেবা সঙ্ঘের পাঁচ জন সেবাইতকে লোপাট করে দিয়েছে। তারা ওদের ভেতরের গ্রামে গিয়েছিল। তারপর থেকেই টুরিস্টদের আমরা নিরাপদ অঞ্চলের বাইরে যেতে দিই না। এটা তো স্বীকার করবেন যে এত বড় একটা গ্রহের সব রহস্যভেদ করার পক্ষে বছর দশ-বারো কিছুই…’
নিঃশব্দ অটোযানকে হঠাৎ ব্রেক চেপে দাঁড় করিয়ে ফিসফিস করে তিরকি বলল, ‘শব্দ করবেন না।’
বাপ্পুর হাত ধরে সে নেমে পড়েছে। বিপদের আশঙ্কায় শ্রীমতী বাধা দিতে যাচ্ছিল, বিদুর তাকে চোখ টিপে বারণ করল। পথের ধারে একটা লতার গায়ে যে রঙিন কীটটি বসে আছে সেটা পাখি আর প্রজাপতির মাঝামাঝি কিছু একটা।
বাপ্পুকে প্রায় তার হাত তিনেকের মধ্যে টেনে এনে তিরকি ইশারা করল। টিপে ভুল হয়নি। মেশিনগানের ছররা খেয়ে খসে পড়েছে মাটিতে। তিরকিই ডানা ধরে সেটাকে তুলে আনল।
শ্রীমতীর গা শিউরে উঠছে। এসব তার মোটে বরদাস্ত হয় না, ‘ফেলে দাও, ফেলে দাও বলছি—’
তিরকি বলল, ‘এর মাংস মুরগির চেয়েও ভালো বৌদি। আপনারা না নেন, আমি নেব!’
বাপ্পু লাফাচ্ছে, ‘আমার প্রথম শিকার, প্রথম শিকার!’
হোটেল স্টাররাইজের ঘরের কিঞ্চিৎ অপরিচ্ছন্ন চেহারা, টয়লেটে বেসিনের ভাঙা কানা, রাতে ডিনার দিতে আধঘণ্টা দেরি ইতাদি খারাপ দিকগুলোকে সম্পূর্ণ মুছে দিয়ে ফেল ভোরের আলো। হোটেলের একটা দেওয়াল পুরো কাচের। আর তারই ওপারে মধুমিডার মায়াবী সূর্যোদয়। টিলার মাথায় এই হোটেলের শয্যা থেকেই চোখ ভেসে যায় ছোট ছোট পাহাড় আর উপত্যাকার ঢেউয়ের মাথায় গহন সবুজের প্রলেপ ছুঁয়ে।
দরজায় টোকা।
ড্রেসিং গাউনের ফিতে বাঁধার আগেই আবার তাগাদা। কোনওরকমে স্লিপার পায়ে গলিয়ে দরজার পাল্লা একটু ফাঁক করে তাকাল বিদুর। প্রভাতী চায়ের সাজি হাতে এক মধু দাঁড়িয়ে। ট্রে-টা হাত বদলের ফাঁকেই মধুর যৌবন বিদুরের চোখ থেকে নিশান্তের অবসাদ কাটিয়ে দিয়েছে। সত্যি বলতে এই প্রথম ভালোভাবে একটা মধুকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ।
মধু কিছু বলল কিন্তু বিন্দুবিসর্গ বোধগম্য হল না। চায়ের ট্রে-টা নামিয়ে রেখে মাইক্রোফোন অনুবাদক এঁটে ফিরে এল বিদুর।
‘ব্রেকফাস্টে কী আপনারা মধুমিডার স্পেশাল ওমলেট খাবেন?’
‘সেটা কী জিনিস?’
‘টিংগি নামে একটা পাখির ডিম থেকে তৈরি হয়। অনেকটা হাঁসের ডিমের মতোই কিন্তু টক-টক।’
মেয়েটা সপ্রতিভ। চোখে চোখ রেখে কথা বলে।
মাথা ফিরিয়ে শ্রীমতীর উপদেশ চাইল বিদুর। তারপর বলল, ‘শুধু একটা। বাকিগুলো কনভেনশনাল ইন্ডিয়ান ডিশ। বুঝেছ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘তোমার নাম কী?’
‘পাঁচ নম্বর। টেলিফোনে বললেই হবে।’
প্রাতরাশ সারার আধ ঘণ্টার মধ্যেই তিরকি হাজির। কালই কথা হয়ে গিয়েছিল সাইট সিয়িং-এ বেরোবার। বাপ্পু কোনক্রমে দুধের গেলাস শেষ করেই ওপর তলায় টেবিল টেনিস নিয়ে ব্যস্ত। বেশ কয়েকজন বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছে।
বিদুর বলল, ‘তিরকি, তুমি বাপ্পুকে একটু ডেকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসো। আমরা এক্ষুনি তৈরি হয়ে নামছি।’
বহুকাল বাদে স্কার্ট-ব্লাউজ পরে শ্রীমতীর যেন দশটা বছর কমে গেছে। স্ট্র্যাপ আঁটা জুতোটা আঁটতে আঁটতে শ্রীমতী বলল, ‘দেখো, বাপ্পুকে কিন্তু এখানে খুব বেশি মিশতে দেওয়া ভালো নয়। আশপাশের ঘরের বাসিন্দাদের যেটুকু এক-আধ নজরে দেখেছি, খুব একটা ভালো মনে হয়নি।’
‘অন্যের ভালো মন্দ নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। আমরা তো বাইরে বাইরেই ঘুরব। সারাক্ষণ হোটেলে বসে কাটালেই বাপ্পু স্বাভাবিকভাবেই নিজের বয়সী সঙ্গীর খোঁজ করবে।’
‘তা ঠিক। যাই বলো, বাপ্পুর জন্যেই কিন্তু তিরকি ছেলেটাকে পেয়ে গেছি আমরা।’
‘সে কী! তুমিই তো কাল রাত্তিরে বলছিলে যে তিরকির কথা শুনে এই হোটেলে আসা ঠিক হয়নি।’
‘নাও—নাও চলতো এখন।’
‘এখানে সাইট সিয়িঙের কতকগুলো রেওয়াজ আছে। ফাইভ পয়েন্ট, সেভেন পয়েন্ট ইত্যাদি…’
তিরকিকে থামিয়ে বিদুর বলল, ‘তুমি যা ভালো বোঝো করো। সন্ধের মধ্যে ফিরলেই হল।’
‘তা হলে আপনাদের একেবারে অন্য রুটে নিয়ে যাব। যেখানে ফালতু লোকের ভিড় নেই। নিশ্চিন্তে থাকুন, পয়সা বেশি নেব না।’
‘আঙ্কল—শিকার হবে তো?’
‘নিশ্চয়!’
এক ঘণ্টার মধ্যে অচেনা লতার অরণ্যে জমকালো পতঙ্গের ছবি তুলতে তুলতেই দু-রোল ফিল্ম খতম। তাও শুধু গাড়িতে বসেই তোলা। চলার পথে।
এত প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মধ্যেও একটা একঘেয়েমি যখন সবে অনুভবে ধরা দিতে শুরু করেছে, রাস্তাটা হঠাৎ বনের প্রান্তে বিশাল এক উপত্যাকায় পৌঁছে শেষ হয়ে গেল।
‘চা বাগান নাকি হে? বুনোগুলো চাষবাস করে বলে শুনিনি তো!’
‘না, এটা ওষুধ বাগিচা। আর একটু এগলেই দেখতে পাবেন বিভিন্ন ধরণের গাছ আছে এখানে। প্রায় সাড়ে তিনশো প্রজাতি। একটা কথা, গাছের পাতা বা ফুল ছিঁড়বেন না। ওরা এই ব্যাপারে বেজায়…’
বিদুর বলল, ‘তুমি বলতে চাও এই বিশাল বাগিচা মধুদের তৈরি?’
‘হ্যাঁ। এই রহস্যের আজও কিনারা হয়নি। মধুরা চাষবাস জানে না, লিখতে জানে না, ওদের সাহিত্য নেই, সঙ্গীত নেই কিন্তু ওষুধের ব্যাপারে দারুণ উন্নত। অথচ ওদের কোনও ডাক্তারও নেই। যার যখন শরীর খারাপ হয়, এই ওষুধের বাগিচায় এসে নিজেই গাছ বেছে তার পাতা, ফল বা ফুল ছিঁড়ে খায়। সেরেও যায়। সারা মধুমিডায় কম করে এমন সত্তর-আশিটা বাগানের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সবচেয়ে অদ্ভুত হল প্রত্যেকটার সেম অ্যারেঞ্জমেন্ট—একই ধরণের গাছ বা ঝোপ একই ভঙ্গিতে সাজানো।’
‘তুমি যা বলছো তাতে তো ওদের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা…’
‘হ্যাঁ, কোনও এক কালে নিশ্চয় উন্নতি করেছিল, এখন কিন্তু ওদের আচরণ ঠিক জন্তুর মতো। বেড়াল যেমন অসুস্থ হলে বেছে বেছে ঘাসপাতা চিবোয়…’
বাগিচার মধ্যে কিছুটা ঢোকার পরেই চোখে পড়ল মধু ও মাধুদের কয়েকটা দল গাছের পরিচর্যা করছে। মেয়েদের পরনে ঘাগরার মতো বেগুনি রঙের পাতার পোশাক আর ছেলেদের মাথায় একটা করে ঝালর-বসানো টুপি। পরনে শুধু লজ্জা নিবারক কাঠবস্ত্র।
‘নমস্কার স্যার।’—অপরিচিত বাঙালি গলা শুনে চমকে গেল বিদুর। পিছন ফিরে দেখে কাঁধে দুটো ক্যামেরা ঝুলিয়ে এক ভদ্রলোক। তার দু-হাতে এক রাশ রঙিন বেশবাস।
‘মধু-মাধুদের ড্রেস পরে একটা ছবি তোলাবে নাকি?’
শ্রীমতী বলে উঠল, ‘ভারি মজা তো?’
বিদুর বলল, ‘ছবিত আমিই তুলতে পারি।’
‘গ্রুপ ফোটো তুলবেন না? সব টুরিস্টরাই তোলে। ড্রেসের জন্য আলাদা ভাড়া দিতে হবে না।’
বাপ্পু চার ধরণের জলচর ও তিনটি চতুষ্পদ শিকার করার পরও ফিরতে চাইছিল না। তিরকির কাছে টিনে ভরা খাবারেরও ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু শ্রীমতীর ইচ্ছে শহরে ফিরে ভালো হোটেলে দুপুরের খাওয়া সারবে।
তিনটে বেজে গেল হোটেল থেকে বেরতে বেরতে। তিরকি বলল, ‘আজ তা হলে মার্কেটিং সেরে নিন। এখানকার ডিউটি ফ্রী শপে। এত সস্তায় সব জিনিস পাবেন যা কলকাতায় ভাবাও যায় না।’
‘ভালো পারফিউম পাওয়া যাবে?’—শ্রীমতী।
‘যা নাম করবেন তাই।’
‘রেডিয়ো রেসিং-কার আছে?’—বাপ্পু।
‘সব—সব।’
বাপ্পু আর শ্রীমতীকে নিয়ে তিরকি বাজার ঘোরাতে গেল। বিদুর ফিরে এল হোটেলে। না, শুধু ক্লান্ত বলে নয়।
‘পাঁচ নম্বরকে একটু পাঠিয়ে দিন।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে ওয়ার্কিং টেবিলের সামনে চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বসল বিদুর। এখান থেকে দরজার পাল্লার ওপর আধখানা নজর রাখা যায়। জুতর দ্বিতীয় পাটি অপসারণের সময়ে দরজায় মৃদু টোকা।
‘এসো।’
এখন আরও সুন্দরী দেখাচ্ছে। ভারতীয় স্টাইলে শাড়ি পরেছে। মানুষ হোক বা না মানুষের বিচারেই অদ্বিতীয়া। এটা কি ব্যতিক্রম, না মধুদের সৌন্দর্য্যের স্বাভাবিক মাত্রাটাই…
‘এক কাপ চা আনতে পারবে?’
‘হ্যাঁ’ পিছন ফিরেও আবার ঘুরে দাঁড়াল মধু, ‘মধুমিডার একটা গোলাপি লিকার অনেকে খুব পছন্দ করে। চায়ের বদলে একবার…’
‘বেশ তো। তাই আনো।’
বিদুর মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছিল, মধু এলেই সরাসরি জানতে চাইবে যে মিনিট কয়েক কথা বলতে তার আপত্তি আছে কি না। সময় হবে কি না।
তার দরকার হল না। মধু কাচের ছোট্ট গেলাসে লিকার ঢেলে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই এখন একা একা লাগছে। আমি বসতে পারি।’
বিছানার এক পাশে মধু বসল। লিকারের গ্লাস শেষ করে নামিয়ে রাখল বিদুর। মধু বলল, ‘ঘরের ভেতরটা বড্ড গরম, তাই না?’
মধু প্রথমে গায়ের থেকে তার আঁচলটা সরিয়ে নিল।
‘তুমিই বলো, এর পরে আর আমার কী করার থাকতে পারে! সাত দিন ছিলাম। সাতটি দুপুরের সম্পর্ক। ফিরে এসেও কিছুতেই ভুলতে পারছি না। বয়সটা যদি বছর দশেকও কম হত, নির্ঘাত সংসার ভাঙত! অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা।’
অরীন বলল, ‘অবিশ্বাস্য নয়, বলুন অপার্থিব। আকর্ষণের ওইটাই বোধহয় মূল কারণ। তবে সংসার ভাঙার ব্যাপারে বলি, সংসার ভাঙতে পারে কিন্তু তা বলে নতুন সংসার গড়ার কোনও আশা নেই।’
‘ঠিক বোধগম্য হল না।’
‘মধুরা ভিন্ন প্রজাতি। মানুষের সন্তান ধারনে ওরা অক্ষম। সেই জন্যেই ওদের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই আইনের চোখে অনৈতিক নয়।’
‘আইন নিয়ে কে মাথা ঘামাচ্ছে। বাধা একটাই, এত বছরের বিবাহিত জীবন, বিবেকের কাছে যেন দোষী মনে হয়। তবুও মুক্তি নেই। বিশেষ করে যখনই ছবিটার কথা মনে পড়ে। অথচ ভেবে দেখো ওইটাই সবচেয়ে মারাত্মক। দুষ্কর্মের একটি রঙিন সাক্ষীও বলতে পারো। মুছে ফেলার কোনও উপায় নেই। তাই না?’
বিস্মিত হয় অরীন কিন্তু প্রকাশ করে না। ছোটখাটো ডিটেলের কথা বাদ দিলে মধুমিডায় কী ঘটেছে সেটা অরীনের অজানা নয়। কিন্তু ছবি, রঙিন সাক্ষী—এসব কী প্রলাপ শুরু করল বিদুর। সেরকম নীতিবাগিশ বলে তো মনে হয় না যে অপরাধবোধের চাপে পড়ে… আরেকটু খুঁচিয়ে সবটা জেনে নেওয়া দরকার।
বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে অরীন। ছবির ব্যাপারটা সে জানে না বুঝলে নিশ্চয় আর এক শব্দও বেশি কবুল করত না বিদুর।
বিদুর বলল, ‘তুমি কোনও মধুর খপ্পরে পড়েনি এখনও?’
‘সুযোগ পেলাম কোথায়। সবে তো মাসছয়েক জয়েন করেছি। মহাকাশে সাত সাতটা টুরিস্ট সেন্টার। মধুমিডা ও মিমিওকায় এখনও হয়নি।’
‘তাই বলো।’
অরীন টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘মিস্টার সেন, মধুমিডায় যাই বা না-যাই, সেখানে যা কিছু ঘটছে সবই আমার নখদর্পণে। কিংবা বলতে পারেন, আমার ইচ্ছা অনুসারেই ঘটে। এই ধরুন, শুনলে হয়তো রাগ করবেন, কিন্তু আপনারা যে মধুমিডায় গিয়েছিলেন, সেটা ছিল কনডাকটেড ট্যুর।’
‘কী বললে?’
‘কনডাকটেড ট্যুর। আপনাদের মনে হচ্ছিল স্বাধীনভাবে যত্রতত্র, খুশি মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিন্তু পুরো ছকটা আমরা সাজিয়ে রেখেছিলাম। ওই তিরকি থেকে পাঁচ নম্বর—ভার্জিন সবই পূর্ব পরিকল্পিত।’
‘তাই নাকি! কৃতার্থ হলাম। তা হঠাৎ আমাকে এমন রাজকীয় অভ্যর্থনার মতলবটা তো…’
‘শুধু আপনি নন, মুখে মুখে পাবলিসিটি হয় যাতে তার জন্যে বেছে বেছে কিছু টুরিস্টদের আমরা এক্সট্রা ফেসিলিটি দিই। সেইজন্যেই আজ আপনার নামে টিকিট কাটার সময় ঝামেলা হয়েছে। এত ঘন ঘন তো একজনকে এরকম খাতির জানানো সম্ভব নয়। অথচ আপনি না জেনেই এক্সপেক্ট করবেন যে, আগের বারের মতোই…’
‘কিছুই এক্সপেক্ট করছি না। তোমার সরকারি দয়া-দাক্ষিণ্যের কোনও প্রয়োজন নেই। চাই পাঁচ নম্বরকে। ভালো কথা, কে বলেছে যে পাঁচ নম্বর ভার্জিন। দালাল বোধহয় কিছু বেশি হাতিয়েছে। এবার থেকে পিঠের ছবি দেখে চেক করে নিও। আমাকে নিয়ে পাঁচ নম্বরের পিঠের অ্যালবামে এখন তিনটি মুখ।’
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিদ্যুতের কাছ থেকে অরীন বাকিটুকুও জেনে নেয়। মানুষের সঙ্গে মিলনের সময়ে মধুদের পিঠে তার প্রেমিকের রঙিন প্রতিচ্ছবি ঠিক উল্কির মতো পাকাপাকিভাবে ফুটে ওঠে। এই বৈশিষ্ট্য শুধু পাঁচ নম্বরের নিজস্ব প্রাকৃতিক ক্ষমতা বলে মনে করার নিশ্চয় কোনও কারণ নেই।
অরীন বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে দু-কাপ কফি অর্ডার করল। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে টয়লেটে ঢুকল। ধাতস্ত হওয়ার জন্য একটু সময় চাই।
মধুরা বর্বর হতে পারে কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই বিচিত্র। আরও কি কি বুনো ক্ষমতা আছে কে জানে। অনেক অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।
অরীন প্রথমেই ভাবল পাঁচ নম্বরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে কেমন হয়। বিদুরকে ভয় দেখিয়ে ফাইলটা যদি এই বেলা… পরমুহূর্তেই হাসি পায়। কান টানলে মাথা আসবে। বিদুর তো চুনোপুটি। আরও কত লোকে ফাঁসবে। বেছে বেছে হোমরা চোমরাদের জন্যেই তো অরীন সুব্যাবস্থা করেছে। উলটো ফল হবে। সে জেনে শুনে ট্র্যাপ পেতেছে। না, তাস ফেলে খেলতে হবে। আপাতত, মধুমিডা অভয়ারণ্যে রকেট সার্ভিস বন্ধ।
অফিসে এসে কফির কাপ হাতে তুলে অরীন বলল, ‘মিস্টার সেন। আপনি খুব বড় একটা উপকার করেছেন। একটা সিদ্ধান্ত নেব নেব করেও নিতে পারছিলাম না। মধুমিডা আপাতত বন্ধ করে দিচ্ছি। আপনাদেরই স্বার্থে।’
‘ঠাট্টা করো না।’
‘ঠাট্টা নয়। মধুদের কার্যকলাপ নিয়ে নানা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের অভিসন্ধি ধরে ফেলেছে।’
‘অভিসন্ধি কিসের?’
‘মধুরা মানুষ না হলেও ওদের সরাসরি নিশ্চিহ্ন করার কোনও উপায় নেই। নানা দিক থেকে বাধা। অথচ মধুমিডাকে পুরোপুরি ভোগ করতে হলে ওদের সরাতেই হবে। রয়েসয়ে একটা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিই আমরা নিতে চেয়েছিলাম। এক ধরণের ফ্যামিলি প্ল্যানিং বলতে পারেন। মধু বা মাধুরা একবার মানুষের সংসর্গে এলে তাঁদের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পায়।’
বিদুর ঘর কাঁপিয়ে হাসে, ‘তা হলে এই কর্মযজ্ঞে আমিও সৈনিকের ভূমিকায় মহান দায়িত্ব পালন করেছি, কি বলো?’
হাসিতে সামিল হাতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নেয় অরীন। মনে পড়ে, একা বিদুর এই কৃতিত্ব আত্মসাৎ করতে পারবে না। শ্রীমতীও একই ভূমিকা নিয়েছে।
মধুমিডায় শ্রীমতীর দুপুরগুলোও তো পরিকল্পিত। বেহিসেবি উচ্ছ্বলতায় ভরিয়ে দেওয়ার আয়োজনে কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু শ্রীমতীর ছবিটিও কি একইভাবে তার মাধুর অ্যালবামে ধরা পড়েছে? জেনে নিতে হবে।
সম্পাদক: গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গল্পপত্র শারদীয়া ১৯৯০ সালে। সমুদ্র বসুকে অনেক ধন্যবাদ গল্পটি পুরানো পত্রিকা ঘেঁটে গল্পটি উদ্ধার করার জন্য। গল্পটি টাইপ করে দিয়েছেন সন্তু বাগ।
Tags: ইন্টারনেট, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সিদ্ধার্থ ঘোষ
বাপ রে! এত রকমের লেখালেখির ভিড়েও সিদ্ধার্থ ঘোষ রুলস্!