ঈশ্বরের গণিত
লেখক: মোহাম্মদ সাইফূল ইসলাম
শিল্পী: সৌরভ দে
অধ্যায় এক
১৭ এপ্রিল, ২০৬৪ স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন; ইউএস, ক্যালিফোর্নিয়া
“এমিলি, কফি খাবে?” পেছনের সারি থেকে বলে ওঠে মাইক।
“একটু পর, একটা মজার জিনিস পেয়েছি। চাইলে তুমি একা খেয়ে আসতে পারো, আসার সময় আমার জন্যে এক কাপ নিয়ে এসো।”
এমিলি, নতুন জয়েন করেছে এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের জুনিয়র পর্যবেক্ষক হিসাবে। নতুন নতুন সবারই এমন উৎসাহ উদ্দীপনা একটু বেশি থাকে। যাই দেখে তাতেই অবাক হয়। মুচকি হেসে কফি বানাতে চলে যায় মাইক। প্রায় পাঁচ বছর ধরে একই জিনিস দেখতে দেখতে, একই কাজ করতে করতে আর ভালো লাগে না তার। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ছেড়েই দেবে হতচ্ছাড়া এই চাকরিটা। কাজ বলতে সারাদিন সামনের সারি সারি কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা আর দিন শেষে স্যাটেলাইটে তোলা সকল ছবি আর্কাইভে ঢোকানো।
কফির মগটি এমিলির ডেস্কের উপর ঠক করে রেখে টেবিলের উপরেই বসে পড়ে মাইক; জিজ্ঞেস করে, “এতো মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ?”
বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে তারা কয়েকজন সর্বক্ষণ সমগ্র পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করছে। সচরাচর চাঞ্চ্যলকর কিছু না ঘটলে মোটামুটি একঘেঁয়ে ছকে বাঁধা তাদের কাজ। এমিলি মধ্য আফ্রিকার পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে আছে।
“দেখ এই লোকগুলো এই গর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে দুইটা জ্যান্ত হরিণ।”
“আফ্রিকার অঞ্চলে তো এখন রাত, তুমি স্যাটেলাইটের নাইট-ভিশন চালু করেছ?” কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মাইক।
রাতে সাধারণত স্যাটেলাইটের ছবি তোলা হয় না, তবে বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিলে নাইট-ভিশন চালু করা হয়। অবশ্যই তার জন্যে আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় এমিলি। ফিসফিস করে বলে, “উঁহু, নেয়া হয়নি অনুমতি। এমন মজার একটা জিনিস যে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারিনি। তবে এই ছবিগুলো আর্কাইভে তুলবো না।”
পাশের আরেকটি স্ক্রিনে রাতের স্বাভাবিক ছবিও দেখাচ্ছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে এমিলি বলে, “এইগুলো সেভ করে নাইট ভিশনের রেকর্ডগুলো ডিলিট করে দেব। কেউ টেরই পাবে না।”
এমিলির সাহস দেখে কিছুটা অবাক হয় মাইক। যতই ডিলিট করুক না কেন, লগ ফাইলে ঠিকই সব রেকর্ড হয়ে থাকবে; তবে কিছু না বলে কফিতে হালকা চুমুক দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে। স্যাটেলাইটের তোলা রাতের ছবি। হিট এন্ড রেডিয়েশন সিগনেচার ভিডিয়ো।
নীল রঙা সমতল অঞ্চলের মধ্যে কয়েকটা হালকা আকাশি টিলা আর তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট কালো বিন্দু। তার মানে টিলা মধ্যবর্তী ওই অঞ্চলের গভীরতা বেশ বেশি। কোনও গর্ত জাতীয় কিছু হবে। আশপাশে কয়েক কিলোমিটার গভীর বনাঞ্চল। পাশ দিয়ে একটি সাদা রঙের রেখা এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে; কোনও নদী বা লেক হবে হয়তো। এমিলি দৃষ্টি নিবন্ধ আছে স্ক্রিনের কেন্দ্রের একটি ছোট হালকা বেগুনী বিন্দুর উপর। সেটার চারধারে দিকে গোল হয়ে কতগুলো হলুদ রং নাচানাচি করছে। ড্যানিয়েলের বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে ওগুলো আসলে মানুষ। স্যাটেলাইট হিট সিগনেচার মোডে মানুষ আর জন্তু সবসময় স্পষ্ট বোঝা যায় না।
মানুষগুলোর হাতে ধরা আগুন জাতীয় কিছু। হয়তো সবাই হাতে মশাল ধরে রেখেছে। হিট সিগনেচারের কারণে সম্পূর্ণ অবয়বটাই জ্বলজ্বল করছে। আরও দুইটা জ্বলজ্বলে হলুদ বিন্দুকে টেনে হিচড়ে গর্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দলটি। কী ও দুটো? মানুষ নাকি?
স্ক্রিনের এক কোণায় জ্বলজ্বল করছে ওই এলাকার কোর্ডিনেট, পাশে লেখা কঙ্গো। আজ পূর্ণিমা, আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি এই অঞ্চলে এখনও। আদিবাসী দলটা কি পূর্ণিমা রাতে নরবলি দেয়? এমিলি স্যাটেলাইট ইমেজ আরও জুম করতে ড্যানিয়েল আশ্বস্ত হল। নাহ, ওই দুটো বিন্দু মানুষ নয়। জুম করতেই সাধারণ হলদেটে আলোক-অবয়ব সংক্রান্ত তথ্য বলে দিল স্যাটেলাইট। বিন্দু দুটো হরিণ।
কিছুক্ষণ পর হরিণদুটোকে গর্তে ফেলে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ সেটিকে কেন্দ্র করে নাচতে থাকে আদিবাসীরা। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে যায়। সম্পূর্ণ উৎসবটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে মাইক ও এমিলি।
মাইকের অনুসন্ধিৎসু মনে কিছু একটা খচখচ করছে, কিন্তু তাৎক্ষণিক ধরতে পারছে না ব্যাপারটি কী। তার মনে হয় কোথায় যেন একটু অস্বাভাবিকতা আছে সম্পূর্ণ উৎসবটিতে। হাতের কফি অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে, হঠাৎ মনে পড়তেই ঠান্ডা কফিতেই আলতো চুমুক দিয়ে বলে, “এমিলি, তুমি হঠাৎ আজ এই ব্যাপারটা নিয়ে এত উৎসাহ বোধ করছ কেন?”
“জানি না! জংলিদের কাজকারবার কখনও দেখিনি তো, তাই আজ একটু সরাসরি দেখতে ইচ্ছা করছিল। আমি গত কয়েক মাসের আর্কাইভ ঘেঁটে দেখেছি, প্রতি পূর্ণিমায় ওই আদিবাসীগুলো এই গর্তটাকে ঘিরে এমন যজ্ঞ পালন করে।”
“এমন উদ্ভট ধরণের অনেক আনুষ্ঠানিকতা তুমি আমাজনের বনে, হিমালয়ের পাদটিকায়, আফ্রিকার গভীর অরণ্যে, আন্দেজ পর্বতমালার উপজাতিদের ভেতরও দেখতে পাবে। এতে খুব আশ্চার্যন্বিত হওয়ার কিছু নেই। খোদ আমেরিকাতেও শয়তানের উপাসনাকারী নামের একটি গোপন সংঘ আছে। বছরে একটি দিন কোনও এক বনের ভেতর গিয়ে তারা উদ্ভট সব কীর্তিকলাপ করে থাকে।” মাইক বলল। এমিলিকে জ্ঞান দান করলেও তার মনের ভেতর ঠিকই অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। আজকে যা দেখেছে সেটিকে অন্য সব পূজা পার্বনের সঙ্গে ঠিক মেলাতে পারছে না সে। কোথায় কী যেন একটা ঝামেলা আছে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছে না।
বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে রাতে বাসায় ফেরে মাইক। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, চমকে ঘুম থেকে উঠে জেগে ওঠে। সে ধরতে পেরেছে অবচেতন মনে কী খোঁচাচ্ছিল আজ সারাদিন ধরে। ভোর হতে না হতেই আবার ছুটে যায় অফিসে। লগ ফাইল থেকে গতকালের ভিডিয়োটা নামায়। তারপর সেটা বারংবার চালিয়ে গতকালের সেই দৃশ্য আবার দেখতে থাকে সে। তার বুক দুর দুর করছে উত্তেজনায়! দ্রুত হাতে কম্পিউটার খুলে অফিসে ইমেল করে এক সপ্তাহের ছুটির আবেদন জানিয়ে দেয়। তাকে একবার স্বচক্ষে দেখতেই হবে গর্তটা।
ঘুণাক্ষরেও কি সে টের পেয়েছিল কঙ্গোর সেই গভীর বনে কী ভয়ংকর সত্য অপেক্ষা করছে তার জন্যে?
অধ্যায় দুই
১৯ জানুয়ারি, ২০৬৫ কঙ্গোর দুর্গম জঙ্গল
“আর কতক্ষণ? আর তো পারছি না!” প্রায় চিৎকার করে বলে ড্যানিয়েল। পিঠে মাঝারি সাইজের ট্রাভেল ব্যাগটা না থাকলে এক্ষুণি এখানেই একটু গড়িয়ে নিত সে।
“এই তো প্রায় চলে এসেছি। এত অল্পতেই অস্থির হলে চলে?” কিছুটা বিরক্তি মাইকের কণ্ঠে।
“সেই আড়াই ঘণ্টা ধরেই তো বলছিস আর কিছুক্ষণ আর কিছুক্ষণ। সত্যি করে বল তো পথ হারিয়ে ফেলিসনি তো আবার? আমি কিন্তু আর ঘুরতে পারবো না বলে দিচ্ছি! কোন কুক্ষণে যে তোর সঙ্গে বাজি ধরেছিলাম! এখন তো ইচ্ছে হচ্ছে বাজির টাকাটা তোর হাতে গুঁজে দিয়ে আমি আমার ল্যাবে ফিরে যাই।” বড় বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলে ড্যানিয়েল; সে হাঁপাচ্ছে রীতিমতো।
“এত অস্থির হচ্ছিস কেন? বাজির শেষ না দেখে এমনিই এমনিই টাকা নিয়ে নেব ভাবলি কেমন করে? এতটা ছোটলোক এখনও আমি হইনি। আসলে তুই টের পেয়েছিস হেরে যাবি, তাই এত বাহানা”
“থাম তো। যত ফালতু কথা। এইসব জঙ্গলে তোদের চমকে ওঠার মতো ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ থাকতে পারে। আমাদের মতো ফিজিসিস্টদের জন্য কিছুই নেই। দেখিস শেষমেশ আবার গুহাটুহা দেখিয়ে বাজি জেতার ধান্দা করিস না যেন।”
“তোর মতো ফিজিসিস্টকেই চমকাবো। আর সেটাই বাজি। না চমকালে হাতে হাতে টাকা দিয়ে দেব।”
“কিন্তু আর তো পারছি না ভাই।” আসলে ড্যানিয়েলের দোষ নেই, সারাজীবন ল্যাব, এক্সপেরিমেন্ট আর গণিত নিয়েই কাটিয়েছে সে। তাই খানিকটা শারীরিক পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে উঠেছে।
আরে পথ ভুল হচ্ছে না, মাত্র গত বছর ঘুরে গিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, সঙ্গে এই যে দুইজন স্থানীয় গাইড দেখছিস; বাতাসে গন্ধ শুঁকে শুঁকে পথ খুঁজে বের করতে পারে এরা।” ড্যানিয়েলকে আস্বস্ত করে মাইক।
“তাহলে একটু জিরিয়ে নি? আধা ঘণ্টার জন্যে বসে চা-টা কিছু খেয়ে নিতে পারি তো। কি বলিস?”
কিছুটা লজ্জার আভাস ড্যানিয়েলের কণ্ঠে। নিচু স্বরে বলে, “তোর মতো তো আর বন জঙ্গল পাহাড় সাগরে ঘুরে বেড়াই না! অভ্যাস নেই অতো।”
“আচ্ছা। আধঘণ্টার একটা ব্রেক নিয়ে নিই। তবে তোকে যে জিনিসটা দেখানোর জন্য নিউ জার্সি থেকে ধরে বেঁধে এই আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে নিয়ে এসেছি সেটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তোর সব কষ্ট, পরিশ্রম লাঘব হয়ে যাবে এটা বলতে পারি।”, মুচকি হেসে বলে মাইক।
“বুঝতেই পারছি আসলে কিছুই পাব না। বাজি জিতব আমিই।” গাল লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ড্যানিয়েলের, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভা। সে ধপ করে মাইকের পাশেই বসে পড়ল। পুরো ব্যাপারটাই যে মাইকের একটা অতিউৎসাহী ছেলেমানুষি কাণ্ড গোছের কিছু সে ব্যাপারে ড্যানিয়েলের আর সন্দেহ নেই। একটা উষ্ণ প্রস্রবণ কি নতুন কোনও হীরের খনি আবিষ্কার করেছে হয়তো। সেটা দেখিয়ে চমকাতে চাইছে ড্যানিয়েলকে।
চা এর কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে মাইক। সঙ্গের দুইজন গাইড অস্থির হয়ে উঠেছে। স্থানীয় ভাষায় কিছু একটা বলছে; উত্তেজিত ভাব ভঙ্গি। “এখন সকাল, তারা বলছে আর দুই আড়াই ঘণ্টার ভেতর ঈশ্বরের মুখের কাছে পৌঁছে যাব। সন্ধ্যা হতে হতে গ্রামে ফিরতে হবে। রাতের বেলায় এই গভীর জঙ্গলে থাকা নিরাপদ নয়। দেরি না করে উঠে পড় বন্ধু, আরও ঘণ্টাখানেক হাঁটতে হবে আমাদের।”
চারজনের ছোট্ট দলটা আফ্রিকার গভীর বনের ভেতর দিয়ে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আশপাশে বিশ-বাইশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও জনপদ নেই। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া থেকে এখনও অনেক দূর এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। এতই দুর্গম এই জঙ্গল যে হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। হেলিকপ্টার ভাড়া নিতে পারতো, তবে এত খরচ করার সামর্থ ড্যানিয়েল বা মাইক কারোরই নেই। আরও দুই ঘণ্টা হাঁটার পর আচমকা একটি বিশাল আকারের গর্তের সামনে হাজির হয় তারা। চারদিকে ঘন বন, এর মাঝে ভুঁইফোড়ের মতো হঠাৎ করেই যেন এই গর্তটার আবির্ভাব হয়েছে। ভীষণ অবাক হয় ড্যানিয়েল। এর কথাই কী বলেছিল মাইক? ঠিক আছে, বেশ অবাক করার বিষয়ই, প্রায় দশ মিটার ব্যাসার্ধের একটি মাঝারি পুকুর আকৃতির গর্ত। কিন্তু এটাই বা তাকে দেখানোর কী আছে? কিছুটা বিরক্তি নিয়ে মাইকের দিকে তাকায় ড্যানিয়েল।
“কী! সুন্দর না গর্তটা?” চোখে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠেছ মাইকের।
হতভম্ব হয়ে একবার মাইকের দিকে আরেকবার গর্তটার দিকে তাকায় ড্যানিয়েল। কী করবে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না।
“এই গর্ত দেখানোর জন্যে আমাকে এত কষ্ট করিয়েছিস?” রাগের চোটে লাল হয়ে গেছে ড্যানিয়েলের চোখ, সারা শরীর কাঁপছে মৃদু মৃদু; ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যে কোনও সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইককে এক থাবড়া মেরে দিতে পারে।
আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই ড্যানিয়েলের রাগে জল ঢেলে দেয় মাইক। ছোঁ দিয়ে ড্যানিয়েলের মাথা থেকে টুপিটা তুলে গর্ত লক্ষ করে ছুড়ে মারে।
“কী করলি? আরে কী করলি?” চিৎকার করে উড়ন্ত টুপিটার দিকে তাকিয়ে থাকে ড্যানিয়েল। মুহূর্তক্ষণ মাত্র, তারপরই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার! কী দেখল সে এটা! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না যেন সে। আমতা আমতা করে বলে, “এটা কী হল? কী হল এটা?”
গর্তের মধ্যে পড়ার আগেই তার টুপিটা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। ঠিক শূন্যের মাঝখানে।
***
আশ্চর্য এই গর্তটাকে স্থানীয়রা বলে মুরুঙ্গুর মুখ। মুরুঙ্গু স্থানীয়দের দেবতার নাম। প্রতি পূর্ণিমায় এই গর্তে জ্যান্ত হরিণ বা গরু উৎসর্গ করে এই দেবতাকে তৃপ্ত রাখে তারা। অন্যথায় এই মুখ ধীরে ধীরে তাদের সমগ্র বনাঞ্চল গ্রাস করে নেবে। আদিবাসীদের বিশ্বাসের কথা জানায় মাইক।
“আস্ত হরিণ…” প্রাথমিক ধাক্কাটা এখনও ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ড্যানিয়েল, বাক্যটা শেষ করতে পারল না সে; তার গলা কাঁপছে।
“এভাবেই চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়। তা, কী বুঝলি? কী মনে হচ্ছে? পারবি এই রহস্যময় গর্তের আদ্যপান্ত বের করতে?”
“বুঝতে পারছি না, এখনও তো ঠিক মতো পরীক্ষাই করতে পারলাম না।” বলতে বলতে নিজের ব্যাগ খুলে যন্ত্রপাতি সেট করা শুরু করে দেয় ড্যানিয়েল। নতুন খেলনা পেয়ে যেন তার চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। সেই সঙ্গে দ্রুতগতিতে মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। “যন্ত্রপাতি সব সেট করতে মিনিট তিরিশেকের মতো সময় লাগবে; সময় নষ্ট না করে এর ভেতর এই গর্তের ইতিহাসটা একটু ব্যাখ্যা কর। যদি দয়া হয় আর কি।”
প্রচ্ছন্ন খোঁচাটি আমলে না নিয়ে তীর্যক দৃষ্টি হেনে মাইক বলে, “বাহ! বাহ! একটু আগেই তো পারলে আমার টুঁটি চেপে ধরছিলি।”
“আহ! মাইক, অযথা সময় নষ্ট করিস না তো। জলদি যা জানিস বলে ফেল। এটা… মনে হচ্ছে… খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার। এতদিন এটা নিয়ে কেন হৈ চৈ হয়নি সেটাই বুঝতে পারছি না।” কণ্ঠে অস্থিরতা ড্যানিয়েলের।
ড্যানিয়েলের কণ্ঠে কিছু একটা ছিল; কথা না বাড়িয়ে তার পাশেই মাটিতে বসতে বসতে মাইক বলে, “যতটুকু জানি অনেক আগে থেকেই রহস্যময় এই গর্তটি এই জঙ্গলে আছে। তবে সেটি কত বছর তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। এইদিকটা এতই দুর্গম যে, আশেপাশে কয়েকশো কিলোমিটারের ভেতর কয়েকশো বছরে কোনও বসতি গড়ে উঠেনি।”
একটু দম নেয় মাইক। মাটিতে হাত দিয়ে আনমনে কিছু ঘাস তুলতে তুলতে বলে, “এতদিন এটা কেন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি সেটাই একটা রহস্য। এমনিতে দিনের বেলায় এই গর্তের আশেপাশেও কেউ আসে না। স্যাটেলাইট দিয়ে শুধু একটা কালো বিন্দুর মতো দেখা যায়। আশপাশে এমন গর্ত আরও আছে কয়েকটা। তাই এতদিন এটাকে দেখেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি কোনও পর্যবেক্ষক। বছরখানেকের বেশি হল পূর্ণিমার রাতে এখানকার আদিবাসীরা যজ্ঞ পালন করছে। অবশ্য সেটাও এমনকিছু গুরুতর ব্যাপার নয়। তবে সেদিন এমিলির পাশে বসে স্যাটেলাইট থেকে সরাসরি দেখার সময় প্রথম একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নজরে আসে আমার। তখন থেকেই এটার ব্যাপারে আমার আগ্রহ জন্মায়।”
মুখে কোনও শব্দ না করে চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করে ড্যানিয়েল।
“আমরা স্যাটেলাইট থেকে দেখছিলাম আদিবাসীগুলো মিছিল করে হরিণ নিয়ে আসে। তারপর গর্ত ঘিরে নাচানাচি করে। শেষে হরিণদুটোকে গর্তে ফেলে দেয়। স্যাটেলাইটের নাইট-ভিশন চালু ছিল। স্ক্রিনে ছোট দুটো জ্বলজ্বলে হলুদ বিন্দুর মতো হরিণ দুটোকে বোঝা যাচ্ছিল। তার মানে গর্তের ভেতরে পড়ে যাওয়ার পরেও বিন্দুর মতো হলেও হরিণ দুটোর হিট-সিগন্যাচার স্যাটেলাইটে ধরা পড়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম গর্তে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই হিট-সিগন্যাচার মিলিয়ে গেছে। এই অস্বাভাবিকতাটাই প্রথম আমার দৃষ্টিগোচর হয়। হরিণ দুটো গর্তে পড়ে ঘাড় ভেঙে মরলেও এত দ্রুত হিট সিগনেচার মেলাতে পারে না। আবার এই কালো বিন্দুর মতো গর্তটাও এমন বিশাল গভীর হতে পারে না যে তক্ষুনি হিট সিগনেচার মিলিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে গর্তের রংটাই অন্যরকম দেখাতো স্যাটেলাইটে।
আমার মনে হয়, এর আগে কেউ দেখে থাকলেও ব্যাপারটা আমল দেয়নি অথবা ঠিকঠাক ধরতে পারেনি। এমিলি নিজেই তো ধরতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে ছুটি নিয়ে চলে আসলাম এই বনে, সেটাও প্রায় এক বছর হয়ে গেল। তুই তো আসতেই চাচ্ছিলি না। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছিস কি জিনিসের খোঁজ তোকে পাইয়ে দিলাম?”
“হুম, সেটা ঠিকই বলছিস। এমন ঘটনার মুখোমুখি হব জীবনেও ভাবিনি। সে যাক, তারপর কী হল?”, বলে ড্যানিয়েল।
“তারপর আর কী! এখানে এসে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পেরেছি, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে হয়তো কাছাকাছি কোনও গ্রাম থেকে শিকারী দল পথ হারিয়ে এই গর্তের সন্ধান পায়। তারা হয়তো প্রথম খেয়াল করে এই গর্তে যে কোনও কিছু ফেললে মুহূর্তেই সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। ঐশ্বরিক কিছু একটা ভেবে তারা এটার পূজা শুরু করে ,সেই সঙ্গে শুরু হয় উৎসর্গ করা। এর বেশি কিছু তারাও জানে না।” অদূরে কিছু হায়েনার হাসির তীব্র শব্দ কানে আসে আচমকা। শিউরে ওঠে মাইক। তারপর প্রশ্ন করে, “তো, তোর কী মনে হচ্ছে? এটা কোনও ব্ল্যাকহোল না তো?”
অবাক দৃষ্টিতে মাইকের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ড্যানিয়েল। ব্ল্যাকহোল! মনে মনে হাসল ড্যানিয়েল, এত কম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটা মানুষ বেঁচে থাকে কী করে? আর এই মূর্খের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বই বা হল কীভাবে? মুখে গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলে, “আরে এটা ব্ল্যাকহোল হলে এর কাছাকাছি আসতে পারতাম? এমন পুকুরের আকারের একটা ব্ল্যাকহোল সমগ্র পৃথিবীকেই গিলে ফেলত।”
“তাহলে কি এটি অন্য জগতে যাওয়ার কোনও পোর্টাল?” গোবেচারা (উত্তেজনায় কথা আটকে আসে মাইকের) একটা ভাব ফুটে উঠেছে মাইকের অঙ্গভঙ্গিতে।
“এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।” কথা বলতে বলতে একটি লোহার দন্ড ধীরে ধীরে গর্তের ভেতর প্রবেশ করায় ড্যানিয়েল। দন্ডটি যতটুকু ঢুকছে ততটুকুই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। অর্ধেকের মতো ঢুকিয়ে আবার টেনে বের করে নেয়; অবাক হয়ে দেখে ঐ অংশটি যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার হাতে ধরা আছে বাকি অর্ধেক।
বিস্ময়ে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায় ড্যানিয়েল। তার মাথায় আপাতত কিছুই ঢুকছে না। চিন্তিত মনে চারদিনের না কামানো চিড়বিড়ে গাল খস খস করে চুলকাতে চুলকাতে আপন মনে বিড়বিড় করে বলে, “মনে হচ্ছে এখানে একটি অদ্ভুত ফিল্ড সক্রিয় আছে। এই ফিল্ডের ভেতর কিছু ঢুকলেই সেটা গায়েব হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটি যাচ্ছে কোথায়?”
দ্রুত সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্য মাথার ওপর এসে এখন কিছুটা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে ড্যানিয়েল। গর্তটার পরিধি বরাবর কম করে হলেও দশবার ঘুরে এসেছে সে। মাঝেমাঝে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে চোখমুখ কুঁচকে কিছু পরীক্ষা করেছে। এখন আবার কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট পাথর তুলে উপরের দিকে ছুঁড়ে মারছে আর কিছু একটা স্কেচ আঁকছে হাতের কাগজে। দূর থেকে অবাক হয়ে ড্যানিয়েলকে লক্ষ করছে মাইক। সদ্য পাওয়া এই রহস্যময় অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপারটা নিয়ে তার বন্ধু যে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে বিষয়ে কোনও অনিশ্চয়তা নেই মাইকের মনে।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডির থিসিস পেপার লেখা শেষ করে হাতে আপাতত কোনও কাজ না থাকায় পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল ড্যানিয়েল। কাজ পাগল এই ছেলেটা জীবনে নিজের শহর ছেড়ে বের হয়নি। তার স্বপ্ন সারাজীবন একটা ল্যাবে কাটিয়ে দেওয়া। মজা করে প্রায়ই বলে “যদি স্টিফেন হকিং এর ন্যায় এমিওট্রোফিক ল্যাটারাল স্ক্যালোরিস এর মতো কোনও অসুখে পড়তাম, তবে বেশ হত। তাহলে সারাজীবন হুইলচেয়ারে বসে বসে পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এই রাজকীয় রোগ হওয়ার মতো সৌভাগ্য তো আমার নেই। আমার হবে গিয়ে পেটখারাপ, আর সব কাজ ফেলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় টয়লেটে দৌড়াতে হবে। যত্তসব।”
‘ব্যাপার কী?’ বন্ধুকে উদ্বিগ্ন মুখে গর্তটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাইক জিগ্যেস করে।
মুখ গম্ভীর করে মাইকের পাশে এসে বসে ড্যানিয়েল। “ ব্যাপারটা বেশ জটিল! মারাত্মকও হতে পারে। আরও যন্ত্রপাতি আর সময় নিয়ে আসতে হবে।”
“কিছু বুঝতে পারলি না?” তার অস্থিরতা দেখে মাইকও গম্ভীর হয়ে উঠছে।
“গর্তটার ব্যাসার্ধ দশ মিটার, গভীরতাও দশ মিটার। ভালো করে তাকিয়ে দেখ, গর্তের মধ্যের মাটি পাথর গাছের শিকড় সবই অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কাটা। যেন লেজার দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে। আমি পাথর ছুড়ে ছুড়ে পরীক্ষা করেছি, ওই লাঠি খাওয়া অঞ্চলটার উচ্চতাও দশ মিটার। এর উপর দিয়ে কিছু ছুড়ে মারলে অপরপাশে গিয়ে পড়ছে, কিন্তু তার কমে হলে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এসবের মানে বুঝতে পারছিস?”
“নাহ, একটু সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা কর তো।”
“এই স্বচ্ছ ফিল্ডটা বিশ মিটার ব্যাসের একটা গোলক। এখন এটা অনেক কিছুই হতে পারে। প্রথমত এটা কোনও ব্ল্যাক-হোল নয় তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এটা যদি ব্ল্যাক-হোল হত, তবে সমগ্র পৃথিবীকেই আস্ত গিলে ফেলত। তাই এই সম্ভাবনা বাদ।
ওয়ার্ম-হোল হতে পারে। সেক্ষেত্রে এর ভেতর যত কিছুই প্রবেশ করুক না কেন তা হয়তো অন্যপাশে চলে যাচ্ছে। এই ধারণা সত্য হলে এর ভেতর দিয়ে মহাবিশ্বের অন্য কোথাও চলে যাওয়া সম্ভব, যদি তাই হয় তাহলে অন্যপাশ থেকেও এই পাশে কিছু না কিছু আসবে। রেডিয়ো তরঙ্গ, আলোক বিচ্ছুরণ। কিন্তু পরীক্ষা করে আপাতত যা পেয়েছি তা হচ্ছে এর ভেতর থেকে কিছুই নিঃসৃত হচ্ছে না। না কোনও আলোক বিচ্ছুরণ, না কোনও রেডিয়ো তরঙ্গ। তাই আপাতত ওয়ার্মহোলের তত্ত্ব বাদ দিতে হচ্ছে। যদিও পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা না করে এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। তবে একটা প্রাথমিক ব্যাপার বলতেই পারি ওয়ার্ম-হোল হলেও এর ভেতর যখন কোনও বস্তুর অর্ধেক প্রবেশ করানো হচ্ছে তখন আপাতভাবে অদৃশ্য হয়ে গেলেও, লাঠিটা টেনে বের করে আনলে তখন সেটি যথারীতি আগের মতোই ফিরে আসার কথা।”
“কিন্তু? এক্ষেত্রে তো তা হচ্ছে না! একটি লাঠির অর্ধেক ভেতরে ঢুকিয়ে আবার বের করে নিয়ে আসলে, ভিতরের অর্ধেক শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।” উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠে ড্যানিয়েল
“তার মানে এটি ওয়ার্মহোল নয়। যদিও আমি নিশ্চিত নই…” বিড় বিড় করে শেষ শব্দক’টা যোগ করে ড্যানিয়েল।
কিন্তু তেমন কিছু আপাতত দেখছি না। যদি অন্য জগতের যাওয়ার কোনও পোর্টালও হয়, তবুও অর্ধেক ঢোকানো বস্তু বের করলে আগের অবস্থানে চলে আসার কথা। কিন্তু তেমনও হচ্ছে না।
“আচ্ছা, যদি এটা সমান্তরাল মহাবিশ্বের কোনও প্রবেশপথ হয়?” জ্বল জ্বল করছে মাইকের মুখ। সে কল্পচক্ষে দেখতে পাচ্ছে অন্য জগতের দ্বার খুঁজে পাওয়ার জন্য তার নামটা ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে। মাইক গড় গড় করে বলে চলল, “হতে পারে এটা ভিনগ্রহী কোনও বুদ্ধিমান প্রাণীর খোলা পোর্টাল। হয়তো এর ভেতর আমরা যা প্রবেশ করাচ্ছি সব কিছু মহাবিশ্বের অন্য কোথাও গিয়ে পড়ছে আর ভীণগ্রহী প্রাণীরা সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছে।”
“খুব বেশি সায়েন্স ফিকশন মুভি দেখছিস না কি ইদানিং?” বন্ধুর কথায় আশার ফানুসটা চুপসে গেল মাইকের। ড্যানিয়েল বলল, “বললাম না, এটা অন্য জগতের প্রবেশপথ হলেও অর্ধেক বস্তু গায়েব হয়ে যেত না। ঠিকঠাক ফিরে আসত।” ভাবভঙ্গিতে রাগ ফুটে উঠলেও বন্ধুর বোকামিপূর্ণ কথাবার্তায় বেশ মজাই পাচ্ছে ড্যানিয়েল।
“কিন্তু যদি সমান্তরাল বিশ্ব প্রতিপদার্থ দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে? সেক্ষেত্রে যতটুকু ভেতরে প্রবেশ করবে ততটুকু পদার্থ-প্রতিপদার্থ একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। মানে লাঠির বাকি অংশটুকুকে গায়েব করে দেবে। এমনটা কি হতে পারে না?” কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুটা বিজ্ঞের মতো বলে মাইক।
ড্যানিয়েল চোখ বড় বড় করে তাকায় মাইকের দিকে, “ইয়ার্কি পেয়েছ? এ তোমার কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। পদার্থ-প্রতিপদার্থ মিলিত হলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে একে অপরকে নিস্ক্রিয় করে দেবে ঠিকই; সেক্ষেত্রে পিউর এনার্জি নির্গত হবে আর তার পরিমাণ হবে অকল্পনীয়।” হাতের কাঠিটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “এটা সম্পূর্ণ প্রতিপদার্থ দিয়ে এনার্জিতে রূপান্তরিত করলে যে শক্তি নির্গত হবে তাতে আশপাশের প্রায় বিশ কিলোমিটার জঙ্গল স্রেফ ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। বুঝেছিস?”
মাইক চুপ করে গেল। ব্ল্যাকহোল নয়, ওয়ার্ম হোল নয়, অন্যজগতের প্রবেশদ্বার নয়। তার বুদ্ধিতে আর কিছুই আসছে না। সে ড্যানিয়েলের দিকে তাকাল কৌতুহল নিরসনের আশায়, কিন্তু ড্যানিয়েল চুপ করে এক দৃষ্টিতে লাঠির নিপুনভাবে কাটা অংশটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন চুপ করে আছে ড্যানিয়েল।
“তুই কি বিশেষ কিছু ভাবছিস?”
“হ্যাঁ। এগুলো ছাড়াও আরেকটা সম্ভাবনার কথা মাথায় আসছে আমার।” কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে, নিজের উপরেই ড্যানিয়েল ভীষণ বিরক্ত এমন উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসার জন্যে।
“কি সম্ভাবনা? ভয়ানক কোনও কিছু নাকি?” মাইকের কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ ধরা পড়ে।
বলা ঠিক হবে কী না বুঝতে পারছে না ড্যানিয়েল। অস্থির হয়ে উঠে পড়ে মাইকের পাশ ছেড়ে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক হাঁটে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে বলে, “হতে পারে এটা একটা শূন্যস্থান।” বলেই চুপ হয়ে যায় সে।
“মানে?”
“মানে প্রকৃত শূন্যস্থান।”
“কিছুই বুঝতে পারছি না কী বলছিস তুই!” মাইক হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করে। প্রকৃত শূন্যস্থান আবার কী বস্তু!?
ড্যানিয়েল ফিরে এসে বসে বন্ধুর পাশে, বলে “শূন্যস্থান বলতে তুই কি বুঝিস?”
“ওয়েল্ল! যদিও আমার পড়াশোনার বিষয় আর্কিওলজি… তবুও পদার্থবিজ্ঞানের যতটুকু জানি তাই বলছি।” মাইক মাথা চুলকে নেয় একটু। “এই যেমন, যেমন, আমাদের চারপাশে প্রায় বেশির ভাগই শূন্যস্থান।”
ড্যানিয়েল ভুরু কোঁচকাতেই মাইক হাত তুলে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি জানি। পৃথিবীতে শতভাগ শূন্যস্থান বলে কিছু নেই, সবই বাতাসে পূর্ণ। এখানে শূন্যস্থান তৈরি করতে হয় কৃত্রিমভাবে। কিন্তু মহাকাশ? সেখানে তো বায়ুও নেই। আমাদের মহাকাশটা শূন্য। এই হিসাবে বলা যায়, এই গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি প্রভৃতিগুলো বাদ দিলে, মহাবিশ্বের বেশির ভাগ শূন্যস্থান। তাই না?” বক্তব্য শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সামান্য অনিশ্চিয়তা নেমে এল মাইকের কণ্ঠে। এই কথাগুলোতো স্কুলের বাচ্চারাও জানে, তাকে ড্যানি কেন এমন প্রশ্ন করছে?
“একদম ভুল।” হেসে জবাব দেয় ড্যানিয়েল। লেকচার দেওয়ার সুযোগ পেয়ে চোখে-মুখে খুশির ঝলক দেখা দেয় তার। “আসলে স্পেস বা স্থান একক কোনও বিষয় নয়। তিনটি মাত্রার স্থান ও একটি মাত্রার সময়কে নিয়ে স্থান-কালের চাদরে মোড়া আমাদের এই মহাবিশ্ব…”
“সেই রিলেটিভিটির থিয়োরি তো? আইনস্টাইনের?” মাইক উচ্ছে খাওয়া মুখ করে ড্যানিয়েলের লেকচারে বাধা দিল। “সেটা তো বড্ড জটিল।”
“যতটা পারি সোজা করে বোঝাচ্ছি তোকে। দেখ, আইনস্টাইনের মতে এই মহাবিশ্ব স্থান কালের অদৃশ্য চাদরে মোড়া। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনও একটি বস্তু ত্রিমাত্রিক একটা স্থানকে দখল করে রাখে।
যেমন ধর, এই গ্লাসটা এই মুহূর্তে এই জায়গায় আছে, আমি এটাকে সরিয়ে এই ফাঁকা স্থানে এনে রাখলাম”, বলতে বলতে সামনের গ্লাসটা কিছুটা সরিয়ে রাখে ড্যানিয়েল। “এখন এই জায়গায় আগে বাতাস ছিল, সেগুলোকে সরিয়ে এই গ্লাসটা তার স্থান দখল করে নিয়েছে। তার মানে দুটো বস্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে একই স্থানে অবস্থান করতে পারে না। এই যে বাতাস সরিয়ে গ্লাসটা জায়গা দখল করল, সেক্ষেত্রে বাতাসের আগে এখনে কী ছিল? বুঝতে পারছিস?”
অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে মাইক। আড়চোখে সঙ্গের দু’জন স্থানীয় গাইডকে দেখে নেয় একবার। তারা অস্থির হয়ে উঠছে ফেরার জন্যে। “চেষ্টা করছি, বলে যা।”
“এখন যদি কোনও স্থানের বাতাসকেও সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটাকে কি শূন্যস্থান বলা সম্ভব? নাহ, বড়জোর তাকে বায়ুশূন্য স্থান বলা যেতে পারে। তারপরেও এখানে আলোক তরঙ্গ বা ফোটনের অস্তিত্ব থাকবে। যেমন মহাকাশ বেয়ে বেয়ে সূর্যের আলোকতরঙ্গ আমাদের ছুঁয়ে আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ে।”
“তার মানে বলছিস মহাকাশ শূন্য নয় কারণ আলোকতরঙ্গ ওখানে থাকে…” একটু অনিশ্চিত স্বরে বলল মাইক। একটু থেমে যোগ করল, “কোনও একটা সময়ে।”
“এক্স্যাক্টলি। এবার অন্ধকার একটা আপাত শূন্য চেম্বারের কথা চিন্তা কর। যেখানে হয়তো বায়ু নেই, আলোক তরঙ্গ নেই, কোনও অণু-পরমাণু বা পার্টিকেল নেই, অন্যান্য বিবিধ জিনিসের কিছুই নেই; কিন্তু X, Y, Z এই তিনটি স্থানিক মাত্রা ও t এর সময় মাত্রাসহ স্থান-কালের অদৃশ্য চাদর তবুও বিদ্যমান। এই চাদরের উপরে কোনও একটা সময় কোনও বস্তু অবস্থান করতে পারে। চাইলেই ওটার মধ্যে দিয়ে তরঙ্গ যেতে পারে, অথবা ওর মধ্যে কোনও বস্তু রেখে দিতে পারিস। কিন্তু, এমন একটা ব্যাপার কি ভাবতে পারবি যেখানে কোনও কিছু অবস্থান করতে পারবে না?” বলে নিজেই চোখ বন্ধ করে মৃদু মৃদু মাথা নাড়তে থাকে ড্যানিয়েল।
“অবস্থান করতে পারবে না!? সে আবার কি?”
“সেটাই। তুই চাইলেই মহকাশে একটা রকেট পাঠাতে পারিস। অথবা স্যাটেলাইট স্থাপন করতে পারিস। তো মহাকাশ যাকে শূন্যস্থান বলে কল্পনা করছিস সেখানে কখনো না কখনো তুই কিছু একটা বস্তুকে রাখতে পারিস। কিন্তু প্রকৃত শূন্যস্থান হল এমন এক অবস্থা যেখানে কোনও সময়েই কিছুই অবস্থান করতে পারে না। একবার চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে চিন্তা কর তো, আমাদের মহাবিশ্বে আসলেই শূন্যস্থান বলে কিছু কি আছে?
“কিন্তু পরমাণুর ভেতর? সেখানেও কি শূন্যস্থান নেই? আমি যতটুকু শুনেছি একটা পরমাণুর ভেতর শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগই নাকি ফাঁকা?”
“নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিস্তরে ইলেকট্রন অবস্থান করে, এটা ঠিক। তাই পরমাণুর আয়তনের প্রায় ৯৯.৯৯ ভাগই ফাঁকা। কিন্তু এই ফাঁকা স্থান শূন্যস্থান নয়। এখানেও ইলেকট্রন অবস্থান করতে পারে। ইলেকট্রন নিজের কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায় প্রোটনকে কেন্দ্র করে। প্রয়োজন মতো আমরা ইলেকট্রনকে সরিয়ে আনতে পারি; নতুন ইলেকট্রনও ঢোকাতে পারি পরমাণুর মধ্যে। কারণ, আপাত এই ফাঁকা স্থানও X, Y ও Z অক্ষ এবং t এর ভিত্তিতে গঠিত স্থান। তাই আমরা তার ব্যবহার করতে পারি। সত্যি বলতে আমাদের মস্তিষ্ক শূন্যস্থানকে ধারণ করার মতো গঠিত নয়, শূন্যস্থান নিয়ে আমরা চিন্তাও করতে পারি না।”
“সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের এই গর্তের কি সংযোগ? তোর কেন মনে হচ্ছে এটা একটা প্রকৃত শূন্যস্থান?”
“সবকিছু যেন সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। দশ মিটার ব্যাসের একটা শূন্য গোলক। এটার কোনও অস্থিত্ব এই মহাবিশ্বে নেই। এই যে গর্তটা দেখছিস, আসলে এটা গর্ত না। এটা আসলে কিছুই না। পার্ফেক্ট নাথিং। তাই এটার ভেতরে কিছু ঢোকালে সেটাও অস্থিত্বহীন হয়ে পড়ে।” উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকায় ড্যানিয়েল। “এখন প্রশ্ন হচ্ছে এটা এখানে তৈরি হল কী করে? কবে থেকে এটা এখানে আছে? কারা তৈরি করেছে? কেন করেছে?” একযোগে অনেকগুলো প্রশ্ন খেলে যায় ড্যানিয়েলের মাথায়।
তার মানে স্বীকার করে নিচ্ছিস এই রহস্যের কিছুই তুই বুঝতে পারছিস না? ঠিক?” উত্তরের অপেক্ষা না করে চোখ টিপে বলে মাইক, পদার্থবিজ্ঞানের গোলকধাঁধা পেরিয়ে সে আবার নিজের হাসিখুশি চরিত্রে ফিরে গেছে। “তাহলে এখন বাজির এক হাজার ডলার ফেল, জলদি।”
বিড়বিড় করতে করতে কাধের ব্যাগ হাতড়ে কয়েকটা নোট বের করে মাইকের দিকে এগিয়ে দেয় ড্যানিয়েল। এসবে একেবারেই মনোযোগ নেই, তার সমগ্র চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আছে সদ্য আবিষ্কৃত রহস্যময় গর্তসদৃশ শূন্যস্থানটিতে। একটা প্রকৃত শূন্যস্থান! বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ বিস্ময়!
অধ্যায় তিন
২০ জানুয়ারি, ২১৫৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রত্যয়ের বুক ধড়ফড় করছে; বারবার গলা শুকিয়ে আসছে উত্তেজনায়। বড় একটা ভুল করে বসেছে সে। অবশ্য এ ছাড়া তার কোনও উপায়ও ছিল না। কয়েকটা জার্নালে তার প্রস্তাবিত থিয়োরির সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছিল, কিন্তু খুব বাজে রিভিউ এসেছে সেগুলো থেকে। একজন তো বলেই দিয়েছে তার নাকি সায়েন্স ফিকশন লেখার হাত বেশ ভালো। বৈজ্ঞানিক জার্নাল না লিখে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
প্রত্যয়ের গবেষণার বিষয় কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আজ কনফারেন্সে এই বিষয়ের উপর একটা পেপার উপস্থাপন করার কথা তার। কিন্তু সে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে অন্য একটি বিষয় নিয়ে। বিশ্ব-প্রতিবিশ্বের মাত্রার ওপর অভিনব একটা ধারণা। আগে থেকে না জানিয়ে এভাবে পেপারের বিষয় পরিবর্তন করাটা নিয়মবহির্ভূত। তাকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হতে পারে এই হঠকারিতার জন্য। সব জেনেও দৃঢ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েই আজ এসেছে সে। নিজের থিয়োরি নিয়ে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী প্রত্যয়। কিন্তু কেন যে অন্য গবেষকরা তার প্রস্তাবিত থিয়োরিকে পাত্তা দিচ্ছেন না সেটা তার মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই। নিজের উপর বিশ্বাস থেকেই আজ এই ঝুঁকি নেওয়া। কিন্তু সময় যতই এগিয়ে আসছে প্রত্যয়ের বড়ই ভয় লাগছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ক্রমশ।
যথাসময়ে স্টেজে ডাক পড়ে প্রত্যয়ের। ছোট ছোট পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায় প্রত্যয়। টাই এর গোড়ায় মাইক্রোফোন ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নেয়। শুরুতেই মৃদু কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলে ওঠে, “আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আজ আমার যে পেপার উপস্থাপন করার কথা সেটা না করে অন্য একটা থিয়োরি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত আপনারা মনোযোগ দিয়ে শুনলে আমাদের সামনে নতুন এক বিশ্বের দ্বার খুলে যাবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল অডিটরিয়ামে হঠাৎ করেই যেন পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। বাংলাদেশের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা প্রফেসররা উপস্থিত আজ এ সম্মেলনে। এ ছাড়াও আছেন বহু বিদ্বান ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা। এমন সুযোগ সহজে আসবে না। সামনের সারিতে বসে আছেন প্রত্যয়ের বিভাগেরই কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ প্রফেসর। কিঞ্চিত ভ্রু কুচকে নিজ আসনে খানিকটা নড়েচড়ে বসেন তারা। কথা না বাড়িয়ে দ্রুত মূল বক্তব্যে ঢুকে পড়ে প্রত্যয়।
একে একে তার থিয়োরির মৌলিক স্বীকার্যের বিষয়গুলো উপস্থাপন করে প্রত্যয়। ছয়টি মৌলিক বলের চরিত্র ও এদেরকে একিভূত করা নিয়ে গবেষকদের নিরন্তর চেষ্টা, আইনস্টাইনের ফিল্ড থিয়োরি, স্থান-কালের ভেক্টরের টেনসর অপারেশন ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা করে অবশেষে মাত্রা নিয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরে। ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে তার থিয়োরি। ভেতর ভেতর উদ্বেগ বাড়ছে। এত অল্পসময়ে অত্যন্ত জটিল এই থিয়োরির ধারণাটাও সম্পূর্ণ উপস্থাপন করা এক কথায় অসম্ভব। অন্তত প্রাথমিক ধারণাটুকু দিয়ে উপস্থিত প্রফেসরদের মনের মধ্যে খানিক আলোড়ন তুলতে পারলে তার কিছুটা কার্যসিদ্ধি হবে। তারপর না হয় সময় বুঝে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
এক ঘণ্টার দশ মিনিট আগে একজন স্টেজের পাশ থেকে তাকে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় আর দশ মিনিট সময় আছে। চমকে উঠে প্রত্যয়! সময় যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে! গতি বাড়িয়ে দেয়, গাণিতিক বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে যায়। শেষপর্যন্ত ছোট্ট একটা টুং শব্দে নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে যায়। প্রত্যয় বক্তৃতা থামিয়ে টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা ঢক ঢক করে শেষ করে। এবার শুরু হবে প্রশ্নোত্তর পর্ব। সামনের প্রফেসররা ছিঁড়ে খাবে তাকে। বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে প্রত্যয়ের। নিজের থিয়োরির বিষয়টা শ্রোতাদের আদৌ কতটুকু বোঝাতে পেরেছে? সন্দিহান হয়ে ওঠে সে।
অবশেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়। আশায় বুক বাধে প্রত্যয়। হয়তো, প্রশ্নের উত্তরে আরও কিছু বিষয় পরিষ্কার করতে পারবে।
একজন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে প্রশ্ন করেন, “মিস্টার আহমেদ, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন মৌলিক বলগুলোকে আপনি একিভূত করতে পেরেছেন এই থিয়োরির মাধ্যমে?
“সেক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয় প্রত্যয় আহমেদ ‘ইউনিফাইড থিয়োরি অব এভ্রিথিং’ পেয়ে গেছি কি বলেন?” আরেকজন বলে উঠল পাশ থেকে। মৃদু হাসির একটা লহরী ভেসে যায় অডিটোরিয়ামে। জবাবে কী বলবে ভেবে পায় না প্রত্যয়। এরা তাকে নিয়ে উপহাস করছে! তার সারাজীবনের পরিশ্রমকে এভাবে উপেক্ষা করার কারণ কী? বয়োজ্যেষ্ঠ জ্ঞানীগুণী মানুষ তারা, কিন্তু কেন এত অহংকার তাদের? জ্ঞানের অহংকার? হয়তো। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে নিজের দুঃখটাকেও যেন ঝেড়ে দেয় সে। শত শত বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যকে মানুষ সহজে ত্যাগ করতে পারে না। নতুন মৌলিক ধারণাকে সবসময়ই এভাবে গলা চেপে রাখা হয়েছে।
একে একে আরও দু-একজন প্রশ্ন করেন তাকে। সবগুলোই যেন কৌতুক কিংবা অপমানিত করার জন্য। ভীষণ মর্মাহত হয় প্রত্যয়। অবশেষে শেষ হয় তার উপস্থাপনার পালা। রীতিমতো পালিয়ে আসতে হয় তাকে মঞ্চ থেকে।
দুই দিন নিজেকে ঘরেই আটকে রাখে প্রত্যয়। এর ভেতর অনেক ফোন কল এসেছে, ধরেনি; ইমেইলও চেক করেনি। তৃতীয় দিন সময়মতো ডিপার্টমেন্টের হাজির হয় সে। ওইদিনের বিপর্যয় আপাতত কাটিয়ে উঠেছে। নিজের ডেস্কের দিকে এগিয়ে যেতেই পাশের একজন বলে উঠে, “এই দুই দিন কোথায় ছিলেন প্রত্যয় ভাই? ডীন স্যার তো আপনাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। জলদি দেখা করে আসেন।”
মনে মনে যে আশংকা করছিল কপালে হয়তো তাই আছে। শেষমেষ চাকরি নিয়ে টানাটানি না পড়ে যায়।
সালাম দিয়ে ডীন স্যারের ঘরে ঢোকে প্রত্যয়। কিছু একটা পড়ছিলেন কম্পিউটার স্ক্রিনে। ইঙ্গিতে বসতে বলে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলেন। তাকে যেন রীতিমতো উপেক্ষা করছেন স্যার। কিছুক্ষণ পর আচমকা চোখ তুলে বলেন, “প্রত্যয়, আমি তোমাকে বুদ্ধিমান ভাবতাম; কিন্তু তুমি এটা কী কাজ করলে?”
চুপচাপ বসে আছে প্রত্যয়। বলার মতো কিছু পাচ্ছে না সে আপাতত। হঠাৎ পকেটে রাখার কমিউনিকেশন ডিভাইসটা নড়েচড়ে ওঠে। অপরিচিত কেউ একজন যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। নাম্বারটা না দেখেই, কেটে দেয়।
“সে যাক, গতকাল একাডেমিক কাউন্সিলে মিটিং হয়েছে। কনফারেন্সে নিয়মবহির্ভূত ভাবে পেপার উপস্থাপনের জন্য তোমাকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে তোমার ব্যবহারের কারণ দর্শিও। প্রথম ভুল যেহেতু, হয়তো তেমন কিছু হবে না; আর দয়া করে নতুন কোনও পাগলামি করো না। তোমার মতো মেধাবী শিক্ষককে হারাতে চাই না। আর বোঝোই তো, সহকর্মীরা অনেক সময় ঈর্ষা থেকেও ছোট বিষয় নিয়ে জল ঘোলা করে। এবার বিদায় হও সামনে থেকে।”
দ্বিতীয় কোনও কথা না স্যারের রুম থেকে বের হয়ে আসে প্রত্যয়। মনেমনে খুব রাগ হচ্ছে, ইচ্ছা করছে কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবে সোজা রেজিগনেশন লেটারই জমা দিয়ে দেবে। কিন্তু সে ঠিক জানে রাগ কমে গেলে এই চাকরি বাঁচানোর জন্যেই আবার তাকে উঠেপড়ে লাগতে হবে। হতচ্ছাড়া কমিউনিকেশন ডিভাইসটি আবার বেজে ওঠে। সেই অপরিচিত নাম্বার থেকেই কল এসেছে। ধরতেই একটা ভরাট কণ্ঠ বলে উঠে, “এসব নোটিশ ফোটিশ নিয়ে মোটেও ঘাবড়াবে না। আমি একটা ঠিকানা দিচ্ছি, আজ বিকেল চারটের সময় সেখানে চলে এসো। একসঙ্গে চা-টা খাবো আর তোমার থিয়োরি নিয়ে আলাপটাও সেরে ফেলা যাবে সেইসঙ্গে।”
নাম্বারটা ঘেঁটে দেখে প্রত্যয়। কলার আইডি প্রাইভেট করা। নিশ্চয় হোমরাচোমড়া কেউ হবে। কর্তৃত্বপূর্ণ বাজখাঁই গলা, শুরু থেকেই প্রত্যয়কে তুমি করে সম্মোধন করেছে। মানে হচ্ছে বয়সে তার চেয়ে বড়, এবং শিক্ষকশ্রেণীর কেউ হবে। অথবা কেউকেটা গোছের কোনও বিজ্ঞানী বা পয়সাওয়ালা হতে পারে। কেবল তারাই এভাবে নির্দ্বিধায় অপরিচিতিজনকে তুমি করে সম্মোধন করে।
ভাবনার মাঝেই টুং করে শব্দ করে একটা মেসেজ আসে। খুলে দেখে একটা এড্রেস সেই সঙ্গে সেই জায়গার কোর্ডিনেট। কী মনে করে ইন্টার্নেটে ঠিকানার কোর্ডিনেট দিয়ে সার্চ দিতেই একটা প্রাসাদতুল্য বাড়ির ছবি সামনে নিয়ে আসে কম্পিউটার। চোখ ছানাবরা হয়ে যায় প্রত্যয়ের! কি দেখছে সে এসব! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করেত পারছে না! অনিল চট্টোপাধ্যায় তাকে ডেকেছেন? বাংলাদেশের এডিসন অনিল চট্টোপাধ্যায়!?
অধ্যায় চার
২৫ জানুয়ারি, ২১৫৪ ঢাকা
‘তাহলে প্রথম থেকে শুরু করা যাক।’ অনিল চট্টোপাধ্যায় বলে উঠলেন। প্রত্যয় নড়েচড়ে বসল। নিজের ভাগ্যকে এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না। অনিল চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশের একজন বিজনেস টাইকুন। না, একজন নয়, বলা উচিত সর্বোচ্চ। তবে সেটাই শুধু তাঁর পরিচয় নয়। তিনি একজন আবিষ্কারকও বটে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর নিজস্ব আবিষ্কার কিছু কম নয়। সেইগুলোকেই বাজারজাত করে আর পেটেন্ট নিয়ে তিনি আজ বাংলাদেশের সবথেকে ধনী ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। বিজ্ঞানের আদি অকৃত্রিম পৃষ্ঠপোষক হিসাবে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের নাম আজ দেশের কোণে কোণে। সেই অনিল চট্টোপাধ্যায় তাকে নিজের থেকে ডেকে পাঠিয়েছেন! ভাবতেই আবার পেটটা গুর গুর করে উঠল প্রত্যয়ের।
“হুম, আমার কিন্তু পুরো পেপারটাই এখনও অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে।” ভদ্রলোক অনায়াস ভঙ্গীতে হেলান দিয়ে বসে আছেন বেতের সোফায়।
“ঠিক কোন জায়গাটাতে আপনার এমন মনে হচ্ছে?”
“পুরো সমাধানটাই।” অনিলবাবু বলে উঠলেন। “বিশেষ করে শুরুতেই তুমি কিছু স্বীকার্য ধরে নিয়েছ, আমার তো মনে হচ্ছে এগুলোতেই গণ্ডগোল আছে। যেমন তুমি ধরেই নিয়েছে আমাদের বিশ্বের সমান্তরালে আরেকটা প্রতিবিশ্ব আছে। কিন্তু এমনটা নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তোমার থিয়োরি তো কিছুই প্রমাণ করে না। এক কাজ কর, তুমি শুরু থেকে আমাকে সম্পূর্ণ বিষয়টি বুঝিয়ে বলো।”
প্রত্যয় নড়েচড়ে বসল। এটা তার প্রিয় কাজ।
“সমান্তরাল বিশ্ব বলতে কি বোঝেন আপনি?”
প্রত্যয়ের এই প্রশ্নে ভদ্রলোকের ঘন ভুরু সামান্য কোঁচকালো। চৌকো চোয়ালে বিরক্তির রেখা দেখা দিল, তাও তিনি উত্তর দিলেন, “প্রতিবিশ্ব মানে প্রতিপদার্থের বিশ্ব। যেখানে পদার্থের পরিবর্তে প্রতিপদার্থ নিয়ে জগৎ গঠিত। পদার্থ ও প্রতিপদার্থ মিলিত হলে বিপুল শক্তি নির্গত করে একক শক্তিতে পরিণত হয়। বিকট বিস্ফোরণে সব ধ্বংস হবে। অথবা মোবিয়াস এফেক্ট…”
“যেখানে কেউ যদি প্রতিবিশ্ব ভ্রমণ করে আসে তবে আগে সে ডানহাতি হয়ে থাকলে ভ্রমণ শেষ নিজেকে বাঁ-হাতি হিসাবে আবিষ্কার করবে। আর নয়তো, হৃৎপিণ্ড সরে যাবে বাঁ দিকে থেকে ডান দিকে।” কথাটা শুনেই প্রত্যয় আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সশব্দে হেসে ফেলল।
ভদ্রলোক প্রায় ধমকে উঠলেন, “এতে হাসার কি হল?”
“আজগুবি। সব আজগুবি, স্যার।” প্রত্যয় নিজেকে সামলে নিল।
“আজ তোমার কাছে যা হাস্যকর মনে হচ্ছে এক সময় এগুলোই ছিল যুগান্তকারী ধারণা। তোমার প্রস্তাবিত থিয়োরিও এমন হাস্যকরই মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার। মনে হচ্ছে তোমাকে এখনই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সোজা পাগলা গরাদে।” ধমকে উঠলেন ভদ্রলোক।
প্রত্যয় সোজা হয়ে বসল। না, আর ভণিতা না করে ভদ্রলোককে তার থিয়োরিটা বুঝিয়ে বলা যাক। মনে মনে বক্তব্যগুলো গুছিয়ে লম্বা দম নিয়ে শুরু করে, “ঈশ্বর এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তাই…”
প্রত্যয়কে থামিয়ে দিয়ে অনিল চ্যাটার্জি হাত নেড়ে বলে উঠলেন, “ঈশ্বর-এর চিন্তা ধর্মবিদদের হাতে ছেড়ে দাও। বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কাজ করে না।”
“ঠিক আছে স্যার। এক অসীম শক্তির মহাবিষ্ফোরণের দ্বারা আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশ্ব কি শূন্য থেকে সৃষ্টি? না কী, কোনও একক শক্তি থেকে সৃষ্টি?”
“একক শক্তি?” অনিল চ্যাটার্জির ঘন ভুরু আকাশে উঠল। অনায়াস ভঙ্গী ছেড়ে একটু টান টান হয়ে বসলেন। “তুমি একক শক্তি বলতে ছয়টি মৌলিক বলের সমন্বয়সাধন করার কথা বলছ?”
“জ্বি স্যর।” কণ্ঠে অনিশ্চিত ভাব প্রত্যয়ের। মনে মনে কিছুটা শঙ্কিত, এই বুঝি চোখ রাঙিয়ে আহম্মক বলে ধমকিয়ে উঠবেন ভদ্রলোক।
ধমক দেওয়ার বদলে মুচকি হেসে অনিল চ্যাটার্জি বললেন, “হাঃ। কয়েকশো বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মৌলিক বলগুলোকে একিভূত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা কি জানো?”
প্রত্যয় একটু ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ল, “জানি স্যার।”
উনি বলে চলেন, “উনিশ শতকের মাঝমাঝি ‘মহাকর্ষ, তড়িৎচুম্বকীয়, দুর্বল নিউক্লিয় ও সবল নিউক্লিয়’ এই চারটি মৌলিক বলের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় পদার্থবিজ্ঞানীরা। তারপর প্রায় একশো বছর ধরে চলে সেই মৌলিক চারটি বলকে একিভূত করে ‘থিয়োরি অব এভ্রিথিং’ নিষ্পন্ন করার চেষ্টা। সেটা তো হলই না উলটে, একশো বছর আগে ডার্কম্যাটার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে পঞ্চম মৌলিক বলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে বসেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। আর দুই দশক আগে ষষ্ঠ বল নিয়েতি-ম্যাটারের কথা জেনে বিষয়টা আরও ঘোলাটে করে ফেলেছে তারা। এখন তো পদার্থবিজ্ঞানীদের সামনে ‘থিয়োরি অব এভ্রিথিং’ এর কথা বললে এই মারে তো সেই মারে অবস্থা! আর সেই মৌলিক ছয়টি বলকে এতো সহজেই তুমি একিভূত করে ফেলার কথা ভাবছ?” কথা শেষ করে হাসি হাসি মুখে ঠান্ডা চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনিল চ্যাটার্জি।
প্রত্যয় আমতা আমতা করে বলে “আমি মৌলিক বলগুলোকে একিভূত করার পদ্ধতির কথা বলছি না, স্যার। আমি কেবল মহাবিশ্বের মাত্রার প্রকৃতি নিয়ে ভাবছি।”
“বিশ্ব কি শূন্য থেকে সৃষ্টি? না কী, কোনও একক শক্তি থেকে সৃষ্টি? এই কথাই বলছিলে তুমি।”
“হ্যাঁ স্যার। ওই প্রশ্নদুটি সৃষ্টিতত্ত্বের খুবই মৌলিক প্রশ্ন। অনেক বছর ধরে আমি এটি নিয়ে ভাবছিলাম। ভাবনার এক পর্যায়ে মনে হল, আমরা যে কোনও ফাংশনের বিপরীত ফাংশন বা সংখ্যার ইনর্ভাস বের করতে পারি। যেমন ‘৫’ একটি মৌলিক সংখ্যা। এটির ইনভার্স সংখ্যাটি কি? ‘-৫’ না কী ‘১/৫’?”
অনিল চ্যাটার্জি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্রত্যয়ের দিকে। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে যেন।
আপন মনে বলে চলে প্রত্যয়, “আসলে দুটি উত্তরই সঠিক। যদি আমরা শূন্যকে রেফারেন্স হিসাবে ধরি তবে ‘-৫’ হচ্ছে ‘৫’ এর ইনভার্স সংখ্যা। দুটি সংখ্যা মিলিত হলে আবার শূন্য চলে আসে। আবার যদি ‘১’ কে রেফারেন্স হিসাবে ধরি তবে ‘১/৫’ হচ্ছে ‘৫’ এর ইনভার্স। সেক্ষেত্রে ‘৫’ ও ‘১/৫’ গুণ করলে উভয়ে মিলে হয় ‘এক’।”
কখন যেন চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসছেন অনিল চ্যাটার্জি। দেখে মনে হবে ঘুমিয়ে পড়েছেন, কিন্তু তাঁর সমগ্র চেতনা প্রত্যয়ের প্রতিটি কথার দিকে শিকারী ঈগলের মতো ফোকাস করে আছে।
“এখন যদি আমাদের মহাবিশ্বকে একটি ফাংশন (f (x)) হিসাবে চিন্তা করি, তবে এর ইনভার্স ফাংশন (f-1(x)) হবে আমার বর্ণনা করা প্রতিবিশ্বের মতো। গাণিতিক সমীকরণগুলো বাদ দিয়ে আমার থিয়োরিটাকে যদি সহজ ভাষায়, সংক্ষেপে বর্ণনা করি; তবে আমাদের প্রতিবিশ্ব দুই ধরণের হতে পারে।
প্রথম ক্ষেত্রে, মহাবিশ্ব কোনও একক আদিশক্তি হতে সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে প্রতিবিশ্ব হবে প্রতিমাত্রার বিশ্ব, যেখানে আমাদের তিনটি স্থানিক মাত্রা (x,y,z) ও একটি সময় মাত্রা (t) পরিবর্তে তিনটি ঋণাত্মক স্থানিক মাত্রা (-x, -y, -z) ও একটি ঋণাত্মক সময় মাত্রা (-t)-র অস্তিত্ব থাকবে। আর এই দুটি বিশ্ব এক বিন্দুতে মিলিত হলে একক শক্তি তৈরি করবে। ফলাফল হবে, এক।
সেক্ষেত্রে বোঝা যাবে, ঈশ্বর অথবা ওই একক আদি শক্তিপুঞ্জের হাত ধরেই মহাবিশ্ব ও প্রতিমহাবিশ্বের সৃষ্টি; এতেই ধ্বংস ও এতেই সমাপ্তি।”
অনিল চ্যাটার্জি নড়েচরে বসেন, “বুঝলাম। কার্তেসিয় স্থানাঙ্ক গণিতে মূল বিন্দুটি (০,০,০,০)। এই মূলবিন্দুর একদিকে ধনাত্মক স্থানাঙ্ক (+x,+y,+z,+t); আরেকদিকে ঋণাত্মক স্থানাঙ্ক (-x,-y,-z,-t)। প্রতিবিশ্বের সাপেক্ষে আমাদেরটা আবার ঋণাত্মক। মানে সেই প্রতিবিশ্বে অবস্থিত কেউ মনে করবে তারা ধনাত্মক বিশ্বে আছে আর আমরা ঋণাত্মক বিশ্বে আছি, যেমনটা এখন আমরা ভাবছি। অর্থাৎ দুটো বিশ্ব একে অপরের বিপরীত সীমায় অবস্থিত। সুতরাং সেই বিশ্বটা হবে অনেকটা আয়নায় আমাদের প্রতিবিম্বের মতো।”
“হ্যাঁ। এটাই আমাদের স্বাভাবিক পদার্থ–প্রতিপদার্থ মহাবিশ্বের মডেল। ওই ম্যাটার অ্যান্টিম্যাটারের সংঘর্ষ টাইপের কল্পনা যেগুলো।”
বয়োবৃদ্ধরা যেমন শিশুদের নিষ্পাপ আবোলতাবোলগুলোকে কৌতুকের চোখে দেখে, রাশভারী এই ভদ্রলোকের সামনে বসে প্রত্যয়ের ঠিক তেমন অনুভূতি হচ্ছিল। হাসি হাসি মুখে অনিল চ্যাটার্জি বললেন, “হুম, ঠিক আছে, তারপর বলে যাও। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কি?”
“দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা হচ্ছে প্রতি মহাবিশ্বের মাত্রা হবে ঋণাত্মক সময়ের তিনটি আর স্থানের একটি মাত্রা। এই প্রতি মহাবিশ্বটির সঙ্গে আমাদের মহাবিশ্বের অস্ত্বিত্ব সম্পূর্ণ বিপরীত। এই দুটি বিশ্ব মিলিত হলে শূন্যে মিলিয়ে যাবে। এখন এটি সঠিক হলে ধরে নিতে হবে সকল সৃষ্টি শূন্য হতে পারে।” এটুকু বলে চুপ করে যায় প্রত্যয়। যেন সে অপরজনকে সময় দিচ্ছে এইমাত্র বলা কথাটা আত্মস্থ করার।
অনিল চ্যাটার্জির তীক্ষ্ণ চক্ষু দুটি কুঁচকে এল, “দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি আমার কল্পনায় ঠিক ধরা পড়ছে না, প্রত্যয়। ঋণাত্মক ‘স্থানের’ একটি ও ঋণাত্মক ‘সময়ের’ তিনটি মাত্রা কীভাবে সম্ভব?”
“আমাদের চারটি মাত্রার আপেক্ষিক দর্শনের বাইরে ভিন্ন কিছু কল্পনা করা মানুষের পক্ষে আসলেই বেশ কষ্টকর। এমনকি সময়কে একটি মাত্রা হিসাবে চিন্তা করাও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। যদি দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি সঠিক হয়, তবে মহাবিস্ফোরণের সময় আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, পাশাপাশি এমন আরেকটি প্রতিবিশ্বেরও সৃষ্টি হয়েছে যার সময়ের মাত্রা তিনটি আর স্থানের মাত্রা একটি এবং এগুলো আমাদের মাত্রার বিপরীতে অবস্থিত। মানে, সম্পূর্ণভাবে একটা ইনভার্স ফাংশন।
“সেই বিশ্বে মাত্রাগুলো কীভাবে কাজ করে বলে তোমার মনে হচ্ছে?”
“আমাদের বিশ্বে সকল বস্তু; স্থানের তিনটি মাত্রায় চলাচল করতে পারে। আর সময়ের মাত্রা কেবল এক দিকে প্রবাহিত হচ্ছে; অতীত থেকে ভবিষ্যতে। আর এই দ্বিতীয় রকমের ইনভার্স বিশ্বের ব্যাপারটা হবে; স্থানের একটি মাত্রায় তারা ভ্রমণ করতে পারে, আর সময়ের তিনদিকে তারা পরিভ্রমণ করতে পারবে।
“তার মানে বলতে চাইছ তারা স্থির থাকে একটি স্থানেই। আর ঘুরে বেড়ায় অতীত ভবিষ্যতে। সময় তাঁদের বিচরণ ক্ষেত্র।” বলতে বলতে চিন্তিত মুখে ভদ্রলোক বসে থাকেন প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে। সমস্ত শরীর স্থির। শুধু অদ্ভুত ভঙ্গিমায় গালে ঘষে যাচ্ছে আঙুলগুলো। কিছুক্ষণ পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ভদ্রলোক বলেন, “তারা বলতে কাদেরকে বোঝাচ্ছ?”
“সেটা জানি না। প্রতিবিশ্বে যদি কোনও বুদ্ধিমান স্বত্তার উদ্ভব হয়ে থাকে… শুধু যে তাদের বিশ্ব একস্থানে স্থির থেকে সময়ে ঘোরাফেরা করে ব্যাপারটা তা না হয়ে খানিক অন্যরকমও হতে পারে। হয়তো তাদের কাছে স্থানের মাত্রাটা অনেকটা বিমূর্ত ব্যাপার, যেমনটা আমাদের ক্ষেত্রে সময়ের মাত্রাটা বিমূর্ত। হয়তো স্থানের কেবল একদিকেই তারা গতিশীল, হয়তো তাদের সকল কার্যক্রম শুধু সময়কে নিয়ে। বিষয়টা আমাদের অনুধাবন করা একটু কষ্টকরই বটে। আদৌও এমন কিছু সম্ভব কিনা সেটার ব্যাপারেও নিশ্চিত নই। এমন কিছু আছে কি না সেটাও জানি না। আমি কেবল সম্ভাবনার কথা বলছি।” কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠে বলে প্রত্যয়। সে কি বোঝাতে পেরেছে ওই উল্টোদিকের মানুষকে?
“তোমার কথাতে যা বুঝতে পারছি, বিগ ব্যাং এর ফলে আমাদের মহাবিশ্বে ইনভার্স বিশ্ব তৈরি হয়েছে। যদি ‘একক’ প্রকৃতির ইনভার্স হয়, তবে মহাশক্তিধর এক শক্তির কোনও কিছুর কারণে মহাবিশ্বদ্বয়ে উদ্ভব আর যদি ‘শূন্য’ প্রকৃতির ইনভার্স হয়, তবে সকল কিছু শূন্য হতে সৃষ্টি। এটাই তো তোমার সম্পূর্ণ থিয়োরির সারসংক্ষেপ?” সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বলেন প্রফেসর অনিল চট্টোপাধ্যায়।
মাথা নেড়ে সম্মতির মতো একটি অভিব্যক্তি দেখায় প্রত্যয়।
কারও মুখে কোনও কথা নেই। মনে হচ্ছে মুখোমুখি বসে ধ্যাণে মগ্ন দুজন জ্ঞানতাপস দাবার চালে একে অপরকে জেতার চেষ্টা করছে!
আচমকা নিরবতা ভেঙে বেতের হাতলে চাপড় মেরে প্রফেসর বলে ওঠেন, “আমি তোমার এই প্রজেক্ট এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। পার্টিক্যাল কোলাইডার ল্যাব, ফান্ডিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটার। যা লাগবে, সব আমি জোগাড় করবো। তুমি শুধু মন দিয়ে এই থিয়োরিটা নিয়েই কাজ কর, বুঝলে।”
আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে প্রত্যয়ের অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে সে। অনিল চ্যাটার্জি হঠাৎ তাকে এত সাহায্য করছেন কেন? বহুদিন অনিল চ্যাটার্জির নামে নতুন কিছু আবিষ্কারের কথা শোনা যায় না। জীবনের শেষ সময়ে স্মরণীয় কিছু করে যেতে চাইছেন?
“এই মুহূর্তে থিয়োরিটায় পেটেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে। এই কাগজ কটায় তোমার সিগনেচার লাগবে, প্রত্যয়।” প্রত্যয় চমকে উঠল। অনিল চ্যাটার্জির ইশারায় কখন যেন ওঁর সেক্রেটারি এসে এক গোছা কাগজপত্র রেখে গেছে সামনের টি টেবলটায়। তাহলে কী? তাহলে কী? এইভাবেই প্রত্যয়ের মতো নবীন আবিষ্কারকদের কাছ থেকে অনিল চ্যাটার্জি হাতিয়ে নেয় আবিষ্কার! হ্যাঁ, অনিল চ্যাটার্জি সম্পর্কে সেরকম কথাও অনেক শুনেছে প্রত্যয়। এই কারণেই নতুন বিজ্ঞানীরা অনিল চ্যাটার্জিকে ‘বাংলাদেশের এডিসন’ বলে।
প্রত্যয় বিমূঢ় চোখে তাকাল অনিল চ্যাটার্জির দিকে।
অনিলবাবু হাসলেন। “একি! তোমার মুখ ওরকম শুকিয়ে গেল কেন? আরে, তোমার থিয়োরির পেটেন্ট তোমারই থাকবে, প্রত্যয়। আমি শুধু ইনভেস্টর হিসাবে সমস্ত প্র্যাকটিক্যাল প্রবলেমের দায়িত্ব নিচ্ছি। তুমি সময় নিয়ে কাগজগুলো পড়ে দেখতে পারো। চাইলে কোনও ভালো উকিলকেও দেখিয়ে নিতে পারো। আমার কোনও অসুবিধা নাই।”
প্রত্যয় কাগজের লেখাগুলো পড়তে থাকে।
উল্টোদিকে বেতের সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন অনিল চ্যাটার্জি। তাঁর মাথার ভেতর ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে। সূক্ষ্ণভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে তার চোখের পাতি তিরতির করে কাঁপছে।
ঈশ্বর! ঈশ্বর! এক আদি অনাদি শক্তি! ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে যাচ্ছি আমরা! আমরা আবিষ্কার করতে যাচ্ছি ‘ঈশ্বরের গণিত’। সৃষ্টি ধ্বংস প্রলয় আমার হাতের মুঠোয়! এই বিশ্ব, এই মহাবিশ্বের একচ্ছত্র মালিক হব আমি! ঈশ্বর! ঈশ্বর হব আমি!!!
অধ্যায় পাঁচ
২৩ নভেম্বর, ২০৬৫ আফ্রিকার কঙ্গোর জঙ্গল
অস্থায়ী ক্যাম্পে কম্পিউটারের সামনে বসে রীতিমতো ঘামছে ড্যানিয়েল মুর। দশ মাস আগে বন্ধু মাইকের সঙ্গে এসে এই পদার্থবিদ্যার অন্যতম বিস্ময় এই গর্তটাকে প্রথম দেখেছিল সে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওরা এই আবিষ্কারের কথা আর কাউকে জানতে দেবে না। যতদিন না ক্ষেত্রটার সঠিক রূপ বুঝতে পারছে। স্থানীয় আদিবাসীদের সাহায্যে এখানে ক্যাম্প সাজিয়ে বসেছে ড্যানিয়েল। মাইকের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে এসেছে ল্যাবরেটরি স্থাপনের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি। অবশ্য বিশাল সাইজের বা অতি উচ্চ রেডিয়েশনের কোনও যন্ত্রের প্রয়োজন এখানে বিশেষ নেই। তা হলে ড্যানিয়েলকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে গবেষণাগার পাততে হত না, অনেক আগেই সরকার কিংবা গোয়েন্দা দপ্তর খবর পেয়ে যেত এইসবের। আর পুরো কৃতিত্ব লুটে নিত বিশ্ববিজ্ঞান সংস্থা।
মোটামুটি ক্ষমতা সম্পন্ন একটা কম্পিউটার আর সামান্য কিছু যন্ত্রপাতিতেই ড্যানিয়েলের কাজ মিটে গেছে। অবশ্য ড্যানিয়েল প্রথমেই ধারণা করছিল শূন্যস্থানের জটিলতাটা আসলে গাণিতিক এবং অনেকাংশেই থিয়োরেটিক্যাল। দিন রাত অমানুষিক খাটুনির ফলাফল আজ পেয়েছে। চোখ বড় বড় করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কাঁপা কাঁপা হাতে কমিউনিকেশন ডিভাইসটি তুলে নেয় ড্যানিয়েল।
দীর্ঘক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। “হ্যালো!”
“মাইক। ড্যানিয়েল বলছি।” অনেক কষ্টে গলার কাঁপুনি থামিয়ে বলল ড্যানিয়েল। “ড্যানিয়েল! কী খবর তোর? এত রাতে কী মনে করে?” ঘুমঘুম চোখে জিজ্ঞেস করে মাইক।
“তুই কি আসতে পারবি? ব্যাপারটা খুবই জরুরি। আর শোন, সঙ্গে করে বাজির এক হাজার ডলার নিয়ে আসতে ভুলিস না কিন্তু!” গম্ভীর কণ্ঠে বলে ড্যানিয়েল।
ঘুম ছুটে গেছে মাইকের। উত্তেজিত মাইক প্রায় চিৎকার করে উঠে, “ওহ! গড! তুই সমাধান করে ফেলেছিস?” এত রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে বাজির টাকা ফেরত চাওয়ার মতো অপরাধ মুহূর্তেই ভুলে যায় সে।
আর কিছু না বলে লাইন কেটে দেয় ড্যানিয়েল। কারুর ওপরেই তার বিশ্বাস নেই। কেউ যদি মাইকের ফোনে আড়ি পাতে! তীরে এসে তরী ডুববে। মাইক যে সবকিছু ফেলে এখানে ছুটে আসবে, এ ব্যাপারে এখন পুরোপরি নিশ্চিত সে। প্রচণ্ড ভয় ঝেঁকে ধরে আচমকা!
ড্যানিয়েল সারাজীবন ল্যাবে কাটিয়েছে, দুনিয়ার জটিলতা অনেক কিছুই তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিপরীতে মাইকের অনেক বিষয়ে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা আছে; সারা জীবন সে বিপদজনক সব অভিযানের পেছনে দৌড়িয়ে বেড়িয়েছে। যেখানেই অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়েছে সেখানেই আগুপিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মাইককে ভীষণ দরকার এই মুহূর্তে। যদি ড্যানিয়েলের সমাধান সত্যি হয় তবে সামনে মহাবিপদ ঘনিয়ে আসছে। সে জানে না কীভাবে ঠেকাবে এই বিপর্যয়?
পরের দিনই সরাসরি ফ্লাইট ধরে কঙ্গোতে এসে পৌঁছায় মাইক। হন্তদন্ত হয়ে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের ভেতর সেই গর্তের এলাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে আসে প্রায়। অনেকদিন পর দুই বন্ধুর দেখা নির্জন এই পরিবেশে। ঝাঁপিয়ে পড়ে ড্যানিয়েলকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাইক। সাময়িক আবেগের তরঙ্গ ড্যানিয়েলকেও ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, কিন্তু অনাগত আশঙ্কা তার উচ্ছ্বসিত আবেগকে স্থিমিত করেছে।
“তাহলে সমাধান করেই ফেললি? অবশ্য আমি ঠিক জানতাম, কেউ যদি এ সমাধান করতে পারে সে কেবল তুই।” বলে ড্যানিয়েলের পিঠ চাপড়ে দেয় মাইক। “তো বলে ফেল কীভাবে করলি? কী কী পেলি! জলদি বল। আর তর সইছে না।”
“আরে থাম থাম। ঠান্ডা হ। হাত মুখ পরিষ্কার করে নে। কফি বানাচ্ছি, খেতে খেতে কথা হবে।” ড্যানিয়েল বলে।
ড্যানিয়েলের গলার স্বরে কী যেন ছিল, মাইকের উচ্ছ্বাস থমকে যায়।
বেশ ঠান্ডা পড়েছে আজকে, ক্যাম্পের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে পাশাপাশি বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ড্যানিয়েল বলে, “এই পরম শূন্যস্থানের উৎপত্তি কবে হয়েছে? কীভাবে হয়েছে? এই ছিল আমার মনের প্রথম প্রশ্ন।”
কৌতুহলের দৃষ্টিতে ড্যানিয়েলের দিকে তাকায় মাইক।
“প্রথমে আমি বোকার মতো আশেপাশের গ্রামের অনেক বয়স্ক লোকের সঙ্গে কথা বলি। কেউই আমাকে প্রকৃত সময় বলতে পারেনি। এটা বলে শুধু যে গর্তটা পুরোনো। প্রায় বছর চল্লিশের পুরোনো তো হবেই। তখন আমার মাথায় আসে তোর কথা।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে।” ব্যস্তভাবে ড্যানিয়েলকে থামিয়ে দেয় মাইক। “তুই আমাকে বলেছিলিস স্যাটেলাইট আর্কাইভে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে। উফ্ যা কেলেঙ্কারি হয়েছিল। আরেকটু হলেই চাকরিটা যেত। কোনওমতে সামলেছিলাম।”
ড্যানিয়েল মাথা দোলায়। মৃদু হেসে কফিতে চুমুক দেয়, বলে, “স্যাটেলাইট ম্যাপিং হিস্ট্রোরিতে সব রেকর্ড করা থাকে। অতীতের আর্কাইভ ঘাঁটতে ঘাঁটতে, হঠাৎ দেখি ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর এই গর্তটির কোনও অস্তিত্ব নেই। তার মানে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বরে কোনও এক সময় এটির সৃষ্টি হয়েছে। সেই ৬ তারিখের প্রতি ঘণ্টার ছবি আর্কাইভ থেকে বের করি…”
“কী পেলি?” কথার মাঝখানেই উদ্বিগ্ন সুরে প্রশ্ন করে মাইক।
“যা আন্দাজ করেছিলাম, ৬ তারিখ ঠিক বিকাল তিনটার সময় আচমকা এটার উদ্ভব ঘটে। আশপাশে কোনও প্রতিক্রিয়া বা কোনও ধরনের পরিবর্তন না ঘটিয়ে, কোনও রেডিয়েশন নির্গত না করে; একেবারে শূন্য থেকেই যেন এটার জন্ম হয়েছে। অতি শান্তভাবে। এ যেন কোনও এক জাদুমন্ত্রের খেলা! তারপর থেকে প্রতি ঘণ্টার ছবি বের করে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছি। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই চোখে পড়েনি। শুধু মাঝে মাঝে দেখ আশেপাশের গ্রামের লোকজন জ্যান্ত গরু ছাগল হরিণ এনে এই গর্তে ফেলছে।”
“তাহলে?” মাইক বেশ বিমর্ষই হয়।
“তখনও টের পাইনি কী চমক অপেক্ষা করছে সামনে! সেটা ধরা পরে আরও দুইদিন পর।” বলেই চুপ করে যায় ড্যানিয়েল।
মাইক খেঁকিয়ে ওঠে, “তাড়াতাড়ি বল, কী হয়েছিল দুইদিন পর?”
“দুইদিন পরে কি মনে করে আবার স্যাটেলাইটের আর্কাইভ ঘাঁটতে গিয়ে পিলে চমকে ওঠে। গর্তটা এখন দেখাচ্ছে ৫ ডিসেম্বরের ছবিতে।
“মানে?”
“মানে যে গর্তটা আগের দিন দেখেছিলাম তৈরি হয়েছে ৬ ডিসেম্বের, সেটি এখন দেখাচ্ছে ৫ ডিসেম্বর! বুঝতে পারছিস কি ভয়ানক ব্যাপার?”
“এটা কি করে সম্ভব? এই শূন্যস্থানটা সময়ের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হচ্ছে নাকি!” বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গেছে মাইকের।
“ঠিক ধরেছিস। এটা সময়ের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের এখানে দু’দিন সামনের দিকে সময় অতিবাহিত হলে ওই পরম শূন্যস্থানটি সৃষ্টির তারিখ একদিন বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে!”
“ওহ! গড! কী বলছিস তুই!” মাইকের চোখে সন্দেহ। দীর্ঘদিন এই বনেবাদাড়ে একলা পরে থেকে থেকে ড্যানিয়েলের মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়নি তো? মাইক শুনেছে এইসব বনেজঙ্গলে এমন পোকামাকড় থাকে যেগুলোর কামড়ে মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়।
“আমি জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না। নিজের চোখেই দেখ। এই যে দেখ, স্যাটেলাইটের এই ছবিটি তোলা হয়েছে ৩ জুলাই ২০২৩ সালের বিকাল চারটার সময়।”, কোলের উপর রাখা স্ক্রিনটা মাইকের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে ড্যানিয়েল। “ঠিক তিনটের সময় যে ছবিটা তোলা হয়েছে, সেখানে দেখ এই গর্তটার কোনও অস্তিত্ব নেই। এখন দু’ঘণ্টা অপেক্ষা কর। দেখবি স্যাটেইলাইটের হিস্ট্রোরির বিকেল তিনটের ছবিটা পরিবর্তিত হয়ে সেখানে এই গর্তটা ফুটে উঠবে।”
ঘণ্টাদুয়েক অপেক্ষা করার পর মাইক তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল। বাক রুদ্ধ হয়ে গেছে তার। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ভীষণ। বিষণ্ন বদনে গাঢ় নীল আকাশের দিকে সে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেঘমুক্ত অন্ধকার আকাশ, হাজার হাজার তারা ফুটে আছে আকাশজুড়ে, যেন হলুদ রঙা সর্ষের ক্ষেত।
গোটা একটা রাত লেগেছে মাইকের নিজেকে সামলে নিতে। বিশ্বের এই অলৌকিক বিস্ময় তাকে মানসিকভাবে অস্থির করে দিয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার খানিক স্বাভাবিক বোধ করে মাইক। ব্রেকফাস্টের থালা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে ড্যানিয়েলকে, “উৎপত্তির ব্যাপারে তো খানিক ধারণা পাওয়া গেল। আর কিছু জানতে পেরেছিস? কে তৈরি করেছে? কেন তৈরি করেছে?”
“ধৈর্য্য ধর বন্ধু, এখনও তো আসলে রহস্যের কিছুই তোমাকে বলিনি। এই পরম শূন্যস্থানটা যেটাকে আমরা একটা গর্ত হিসাবে দেখছি, এটা দেখছি কীভাবে?”
“বুঝলাম না। কীভাবে দেখছি মানে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মাইক।
“প্রাথমিকভাবে আমরা ধরে নিয়েছি এটা পরম শূন্যস্থান। তাই এর ভেতর যে কোনও কিছুর প্রবেশ করালে মুহূর্তেই সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আলোক তরঙ্গ হারাচ্ছে না কেন? যদি আলোক তরঙ্গও এর ভেতর হারিয়ে যেত তবে এটাকে আমরা দেখতেই পেতাম না। যেহেতু আলোকরশ্মি এর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে অপর দিকে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে, তাই এটাকে আমরা পরম স্বচ্ছ হিসাবে দেখতে পাচ্ছি। যদি আলোকরশ্মিও অদৃশ্য হয়ে যেত, তবে এটা পরম কালো আকারে দেখতে পেতাম।
“হুম। তার মানে অন্য কিছুই এটাকে ভেদ করতে পারে না। শুধু আলো ছাড়া।” খানিকটা খাবার মুখ পুরতে পুরতে বলল মাইক।
“একদম। অন্য সমস্ত কিছু এই পরম শূন্যস্থানে এসে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। আমি অবশ্য সেগুলো খানিক পরীক্ষা করেই দেখেছি। তাই তখন ঠিক করলাম যে, এর ভেতর দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির আলোক তরঙ্গ পাঠাবো।
তাকে থামিয়ে দিয়ে মাইক বলে, “তোর কী মনে হচ্ছে? মহাজাগতিক কোনও প্রাণী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাচ্ছে?”
“কেউ না কেউ তো অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে, তবে এরা আমাদের মহাবিশ্বের মহাজাগতিক কোনও প্রাণী নয়। তারা ভিন্ন একটা মহাবিশ্বের ভিন্ন মাত্রায় অস্তিত্বশীল কোনও স্বত্তা।”
আচমকা মাথা ঝাঁকিয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হওয়ার ভঙ্গি করে মাইক। খাবারের প্লেটটা কোলে রেখে দুই হাত তুলে ড্যানিয়েলকে থামিয়ে বলে, “দাঁড়া! দাঁড়া; কি বলছিস কি! মহাজাগতিক প্রাণী! তাও আবার ভিন্ন মহাবিশ্বের ভিন্ন মাত্রার? ওহ গড! আমার মাথায় সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে, তবে আর কোনও কথা নেই এবার আমরা এই আবিষ্কারের কথা সারা পৃথিবীকে জানাব। তুই তো বিখ্যাত হচ্ছিসই সঙ্গে আমিও!”
“আগে পুরোটা শোন! তারপর লাফাবি। কিছু না শুনেই এত উত্তেজিত হয়ে উৎপাত করিস না। আর বাজির টাকাটা কিন্তু ফেরত দিতে হবে! সঙ্গে করে এনেছিস তো?”, মুচকি হেসে বলে ড্যানিয়েল।
“উফ্, পাগল নাকি তুই? এই খবর বেচে কত লক্ষ লক্ষ ডলার কামাব, আর তুই সেই হাজার ডলারের বাজি নিয়ে বসে আছিস! ঠিক আছে, আগে রহস্যের সমাধান বোঝা, তারপর বাজির টাকা ফেরত পাবি।”
ড্যানিয়েল বলতে শুরু করে, “সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মাত্রা থেকে আমাদের বিশ্বে একটা বার্তা আসছে। সেই জগতটা আমাদের ঠিক বিপরীত মাত্রায় অবস্থিত। আমার ধারণা বিগব্যাং এর ফলে দুটো মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, এদের একটা আরেকটার বিপরীত। এখন আমরা যে পরম শূন্য স্থানটা গোলক আকারে দেখতে পাচ্ছি এটা আসলে আমাদের বিপরীত পৃষ্ঠে অবস্থিত বিশ্ব থেকে খোলা একটা পোর্টাল।”
“পোর্টাল! এই যে বললি শূন্যস্থান!”
“আহা শূন্যস্থান আমাদের দিক থেকে। উল্টোদিক থেকে ওটা একটা পোর্টাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
“ব্যবহার করা হচ্ছে! মানে? কে ব্যবহার করছে? এলিয়েন?” প্রায় চিৎকার করে উঠে মাইক। “কী বলছে তারা? কী সংকেত পাঠাচ্ছে? ”
“আবার অস্থির হ! শান্ত হয়ে বস তো। বলছি এক এক করে।”
“বসছি। আগে বল, কীভাবে এই রহস্যের সমাধান করলি?”
“কীভাবে এই রহস্যের সমাধান পেয়েছি সেটা পরে ব্যাখ্যা করছি। সে এক জটিল শ্বাসরুদ্ধকর ব্যাপার। তার আগে তোকে বুঝতে হবে এখানে কী হচ্ছে আর তারা কী বার্তা পাঠাচ্ছে। আগেই বলেছি বিপরীত মাত্রা থেকে তারা বার্তা পাঠাচ্ছে। এটার গুরুত্ব বুঝতে পারছিস?”
মাইক বোকা বোকা হাসি হেসে বলে, ‘দিব্যি বুঝতে পারছি। কোটি কোটি ডলার।’
ড্যানিয়েল রাগত স্বরে বলে, ‘যা ভাগ! তোকে আর কিছু বলব না।’
‘আরে না না! ইয়ার্কি মারছিলাম। একটু একটু বুঝতে পারছি। এলিয়েনরা বিপরীত মাত্রা থেকে বার্তা পাঠাচ্ছে।’ মাইক বলে।
“কিন্তু, দুটো বিপরীত মাত্রা যখন একত্রে মেশে তখন কি হয় ভেবেছিস?”
“ওরেবাবা সে তো বিস্ফোরণ।”
“আরে ধুর ছাই! সেটা পদার্থ, প্রতি-পদার্থ। এখানে আমরা মাত্রা নিয়ে কথা বলছি। দুই বিপরীত মাত্রা মিলিত হবে তখন কী হবে? তখন একটি পরম শূন্য স্থানের সৃষ্টি হবে। এখানে ঠিক এটাই হয়েছে।”
“তার মানে বিপরীত মাত্রার বিশ্ব থেকে পাঠানো এই সিগন্যাল থেকেই এই পরম শূন্য স্থানের জন্ম; এই কারণেই কি এটার জন্মক্ষণ প্রতি মুহূর্তে অতীতের দিকে ধাবিত হচ্ছে?” নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কানেই অপরিচিত ঠেকছে মাইকের।
“উঁহু। অতীতে যাওয়ার ব্যাপারটা আলাদা। পরে বলছি ওটার কথা। তবে তোর অনুমান কিছুটা সঠিক। যদিও এখানে মাত্রার বিষয়টা সাধারণ বিপরীতার্থক নয়। আরও বেশি জটিল ও দুর্বোদ্ধ”, উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠে ড্যানিয়েল। “কিন্তু তুই যে আমাকে অবাক করে দিলি; দেখে যেমন মনে হয়, বাস্তবে অতটা বোকাও তুমি নও।”
খোঁচাটা গায়ে না মেখে মাইক বলে, “আরও জটিল? ঠিক আছে আমার অতশত বুঝে কাজ নেই। তারা কি বার্তা পাঠাচ্ছে সেই বল।”
দ্রুত আশেপাশে নজর বুলিয়ে নেয় ড্যানিয়েল। সামনের দিকে ঝুকে আসে কিছুটা, মাইকের কানের কাছে মুখ এনে নিচুস্বরে বলে, “যে বার্তাটি আমরা পাচ্ছি তা হল,
‘হে প্রতিবিশ্বের স্বত্তা, তোমাদের বিশ্ব থেকে কোনও ত্রি-মাত্রিক বস্তু আমাদের বিশ্বে পাঠাবে না। যদি পাঠাও তবে আমাদের মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।
46Q321456.86mE2473067.04mN5997715200’
এক মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে গেল মাইকের হাত পা। শিড়দাড়া বেয়ে কুলকুলিয়ে নেমে যাচ্ছে তীব্র ভয়ের স্রোত।
অধ্যায় ছয়
২৫ জানুয়ারি, ২১৫৫, লালন দ্বীপ
“টরণ কণিকা।”
“টরণ কণিকা?” হতভম্ব প্রত্যয়ের মুখ থেকে শব্দ দুটো বেরিয়ে এল। মস্তিষ্কের আঁতিপাতি ঘেঁটেও সে শব্দদুটোর অর্থ উদ্ধার করতে পারল না। এমন কোনও কণিকার নাম তো কখনও সে শোনেনি।
অনিল চ্যাটার্জির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পরে কেটে গেছে গোটা একটা বছর। হ্যাঁ, ভদ্রলোক কথা রেখেছেন। যা যা চাই সব জোগাড় করে এনেছেন এই বাংলাদেশে। এমনকি পৃথিবী ঘুরে নিয়ে এসেছেন তাবড় তাবড় ইঞ্জিনিয়ার, গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ, পরমাণুবিদ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের তিনটে কোণায় কাজ চলছে
নোয়াখালি থেকেও প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের গভীরে, কুড়ি হাজার একরের বড়সর একটা দ্বীপে বসবাস করছে প্রত্যয়। শুধু সেই নয়, আরও শ’দেড়েক বিজ্ঞানী এবং হাজারের উপরে ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়াও অন্যান্য কর্মী আর মিলিটারিও কম নেই সেই দ্বীপে। ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যে কোনও বড় শহরকে টেক্কা দেবে এই দ্বীপশহরটা।
প্রত্যয়ের ‘ঈশ্বরের গণিত’ এখন শুধুই একটা থিয়োরি নয়। বরং বিজ্ঞানের এক শাখা হিসাবে অদূর ভবিষ্যতেই আত্মপ্রকাশ করতে চলছে। যার বাস্তবিকতা নিয়ে গবেষণা চলছে বাংলাদেশের এই একটেরে এক দ্বীপে। এই গবেষণার গোপনীয়তা চূড়ান্ত। টাকার জোরে আর নিজের প্রভাব খাটিয়ে এই দ্বীপে প্রায় স্বয়াত্তশাসন জারি করেছেন অনিল চ্যাটার্জি। অবশ্য প্রত্যয় বিশ্বাস করে তা না করলে এত দ্রুত আকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের কাছাকাছি তাঁরা পৌঁছতে পারত না কখনোই।
অনিল চ্যাটার্জির টাকা ও ক্ষমতার ব্যাপারে গত এক বছরে বহুবার সন্দিহান হয়েছে প্রত্যয়। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হত গরীব বঙ্গভূমিতে দাঁড়িয়ে এই জটিল গবেষণার বাস্তব উপাদান সংগ্রহ করা নিতান্তই স্বপ্ন মাত্র। কিন্তু প্রত্যেকবার তাকে ভুল প্রমাণ করে ঠিক ঠিক বস্তু বা ব্যক্তি এনে হাজির করে দিয়েছেন অনিল চ্যাটার্জি।
আজকাল প্রত্যয়ের মনে হয় সে যেন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেমন আড়াইশো বছর আগে অন্য এক মহাদেশে তৈরি হয়েছিল ম্যানহাটান প্রজেক্ট। আর বদলে গেছিল পুরো মানব সভ্যতার ভাগ্য। ঠিক তেমনি আজ সে দাঁড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক প্রোজেক্টের ঠিক চূড়ায়। যে কোনও মুহূর্তে সফল হয়ে যাবে তাঁর আবিষ্কার আর তারপরেই বদলে যাবে…
“তুমি নিশ্চয় নিউট্রিনো কণিকার কথা জান?” অনিল চ্যাটার্জি কথায় সম্বিত ফিরল প্রত্যয়ের। সে গম্ভীর মুখে ঘাড় নাড়ল।
হ্যাঁ। প্রত্যয় জানে নিউট্রিনো কণিকার কথা। বিজ্ঞানের প্রথমযুগে ধারণা করা হয়েছিল এই নিউট্রিনো কণিকার কোনও ভর নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে এরও ভর নির্ণয় করা সম্ভব হয়; যদিও প্রায় শূন্যই বলা চলে সেই ভর। এই নিউট্রিনো কণিকা কোনও কিছুতেই বাধা পায় না। প্রতিনিয়ত পৃথিবী, এমনকি মানুষের শরীরকেও ভেদ করে চলে যাচ্ছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন নিউট্রিনো কণিকা। কোনও কিছুর সঙ্গেই বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া করে না তারা।
কিছুটা ইতস্তত করে প্রত্যয় বলে, “নিউট্রিনো কণিকার কথা আমার জানা আছে স্যার, কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের ঈশ্বরের গণিত প্রজেক্টের কী সম্পর্ক?”
“যদি তোমার থিয়োরি সঠিক হয়, তবে দুই বিশ্বের ভেতর যাওয়া আসা করছে এমন একটি কণিকার অস্তিত্ব থাকার কথা।” অনিল চ্যাটার্জি বললেন। প্রত্যয় কিছু বলল না, শুধু ঘাড় নাড়ল।
“পদার্থবিজ্ঞানীরা এই সূত্র ধরেই এগোচ্ছিলেন। নিউট্রিনো যেমন কেবল আমাদের বিশ্বে কোনও কিছুর সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে না, ঠিক তেমন দুই বিশ্বের ভেতর কোনও ক্রিয়া না করে চলাচল করছে তেমন একটা কণিকা অবশ্যই থাকবে। এখন আমাদের এই কণিকার মাধ্যমেই সেই বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। এখন বল, সেই কণিকার বৈশিষ্ট্য কেমন হবে?”, সামনের দিকে ঝুকে এসে আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন প্রফেসর।
“আমার যতদূর মনে হয় শূন্য ভর, শূন্য মাত্রা…” কথাটা বলেই কিছুটা ঘাবড়ে যায় প্রত্যয়; এ আবার কেমন বস্তু! শূন্য ভর! শূন্য মাত্রা! কিন্তু অনিল চ্যাটার্জি হাততালি দিয়ে ওঠেন।
“ব্রিলিয়ান্ট। আমার মনেই হয়েছিল তুমি অলরেডি এই রাস্তাতেও খানিক চিন্তাভাবনা করেছ।”
“কিন্তু এটা সম্ভব নাকি?” প্রত্যয়ের চোখে সংশয়।
অনিল চ্যাটার্জি হাসলেন, “প্রজেক্ট ঈশ্বরের গণিতের চ১১৯ শাখার বিজ্ঞানীরা একটা সমাধান অলরেডি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।”
টেবিলের উপরে ঠেলে দিলেন একটা পাতলা ট্যাব। ট্যাবের পর্দায় জটিল অংক। একগাদা হাতির শুঁড়ওলা ইকুয়েশন আর অজানা রাশির ভিড়। প্রত্যয় আলগোছে চোখ বোলালো। এই অংকের অনেকটাই সে জানে। শেষটা জানতো না, আজকে দেখছে। গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য সবাইকে সবটুকু জানানো হয় না কখনোই।
গলা খাঁকারি দিল প্রত্যয়, “এটা তো একেবারে মৌলিক একটি কণিকা দেখছি। শূন্য ভর। শূন্য মাত্রা। ইলেকট্রনকে ধরা হয় শূন্য মাত্রার বিন্দু কণিকা; কিন্তু তারও ভর আছে। এই কণিকাটা…”
“টরণ কণিকা।” অনিল চ্যাটার্জি বলে উঠলেন।
চমকে উঠে প্রত্যয়, চোখে প্রশ্ন।
“হ্যাঁ, আমিই এই কণিকার নাম দিয়েছি টরণ কণিকা। অলরেডি থিয়োরেটিক্যালি প্রুভড্। শুধু এখন বাস্তবায়িত করার কর্মযজ্ঞ শুরু।”
প্রত্যয় হাত কচলালো। এই ভয়টাই সে পেয়ে এসেছে এতদিন ধরে। বাস্তব ক্ষেত্রে তাঁর থিয়োরির অ্যাপ্লাই। তবু মুখের ভাবে সে কোনও ছাপ ফুটে উঠতে দিল না। সামনে বয়োবৃদ্ধ ধুরন্ধর মানুষটার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল, “কিন্তু তা এত তাড়াতাড়ি কী করে সম্ভব?”
“সম্ভব।” অনিল চ্যাটার্জি মুচকি হাসলেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন জানালার বাইরে।
এই কুড়িতলা সুউচ্চ বিল্ডিং-এর জানালা দিয়ে দ্বীপ শহরটার প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। দেখা যায় আরও দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আরেকটা দ্বীপ। প্রায় একই রকম। শুধু আয়তনে ছোট। এই জমজ দ্বীপ জোড়ার নাম রাখা হয়েছে লালন দ্বীপ ও হাসন দ্বীপ।
অধ্যায় সাত
২১ জুলাই, ২১৫৫ হাসন দ্বীপ
হাসন দ্বীপ; লালন দ্বীপের প্রায় গা লাগোয়া আরেকটা দ্বীপ। এখানেই প্রায় ত্রিশ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে গবেষণাগার। পার্টিক্যাল কোলাইডারটি তেমনি একটি গবেষণাগারের অংশ হিসাবে এখানে তৈরি করা হয়েছে। মাটির একশো পঁচিশ মিটার গভীরে প্রায় চার কিলোমিটার ব্যাসের একটি টানেল। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই পার্টিক্যাল কোলাইডারে কাজ করার অনুমতি পাওয়াও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।
এই মুহূর্তে দেশি বিদেশি মিলিয়ে প্রায় দু লক্ষ মানুষ কাজ করছে এই প্রজেক্টে। বিগত পাঁচ বছর ধরেই চলছে কাজ। সুবিধার জন্য দুটি দ্বীপকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে দশ কিলোমিটার লম্বা একটা অ্যালয় স্টিলের ব্রিজ দিয়ে। টাকা গলে যাচ্ছে জলের মতো নয়, বরং বলা উচিত আন্টার্টিকার বরফ গলার মতো। এই পাঁচ বছরে প্রত্যয় একবারও হাসন চরে পা রাখেনি। অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতোই লালন দ্বীপ আর মূল ভূখন্ডের মধ্যেই তাঁর যাতায়াত নির্দিষ্ট ছিল।
আজ এক মাহেন্দ্রক্ষণ। টরণ কণিকা আবিষ্কার হয়ে গেছে গত সপ্তাহেই। এখন পরীক্ষার শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছে তারা।
এই মুহূর্তে পুরো ল্যাবে নিজের বাছাই করা কয়েকজনকে ছাড়া আর কাউকে থাকার অনুমতি দেননি প্রফেসর অনিল।
আগামীকাল বেলা এগারোটা পঁয়ত্রিশে শুরু হবে প্রথম মার্বেল এক্সপেরিমেন্ট। সফল হলে এটাই হবে মানব ইতিহাসের প্রথম অপর একটি মহাবিশ্বের সঙ্গে সফল যোগাযোগ। যেখানে বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত সৌরজগতের বাইরে মহাবিশ্বের অন্য কোনও নক্ষত্রে বা গ্রহে অভিযান চালাতে পারেনি সেখানে অপর একটি মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন! এ যেন কল্পনাকেও হার মানায়!
কফি কাপে ধীর লয়ে চুমুক দিতে দিতে প্রত্যয় ভাবছিল সমীকরণের ধাপগুলোর কথা। কোথাও কোনও ফাঁক থেকে যায়নি তো? সত্যি বলতে আজই সে প্রথম এসেছে হাসন দ্বীপে। টরণ কণিকার পরীক্ষা যেদিন হয়েছিল সেইদিন সে পুরো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করেছিল লালন দ্বীপে বসেই। এর আগেও অত্যাধিক গোপনীয়তার কারণে এই দ্বীপটায় কোনওদিন কোনও বিজ্ঞানীকেই পা দিতে দেওয়া হয়নি।
আজই প্রথম। একবার ঘড়ি দেখল প্রত্যয়। আর চব্বিশ ঘণ্টা। এরপরে এক নতুন যুগ সন্ধিক্ষণের শুরু।
“তাহলে প্রথম থেকে পুরো ব্যাপারটা একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক প্রত্যয়?”
“হ্যাঁ বলুন স্যর।” এত বছর পেরিয়েও প্রত্যয় কিছুতেই অনিল চ্যাটার্জির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। ভদ্রলোকের চোখ দুটো যেন অতিমাত্রায় শীতল।
“তোমার তত্ত্ব মতে যদি শূন্য থেকে দুটো মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে, শূন্য ভরের শূন্য মাত্রার এই টরণ কণিকা ক্রমাগত দুটি বিশ্বের ভেতর আসা যাওয়া করবে। যেহেতু এর কোনও ভর নেই; নেই কোনও মাত্রাও, তাই দুই বিশ্বের কোনওকিছু সঙ্গেই এ টরণ কণিকা কোনও প্রকার প্রতিক্রিয়া করবে না।”
“একদম!” অনিল চ্যাটার্জির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রত্যয় বলতে শুরু করল, “আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে একটা মার্বেল আকৃতিতে লোহার গোলকের চারপাশে এই টরণ কণিকার একটা ক্ষেত্র তৈরি করা। এর জন্যে বিপুল পরিমাণ পার্টিকল, কোলাইডারের পরিধি বরাবর ঘুরতে থাকবে। প্রতিটি ঘুর্ণনে এর গতি বাড়তে বাড়তে একসময় আলোর বেগের সমান হবে। এই বেগে একে অপরের দিকে ধাবিত হয়ে পার্টিক্যালগুলো সংঘর্ষে ভেঙে যাবে আর টরণ কণিকার সৃষ্টি করবে। যখন বিপুল পরিমাণ এই টরণ কণিকা ক্ষুদ্র একটি স্পেসে একত্রিত হবে, তখন সেই স্পেসকে সঙ্গে করে সকল টরণ কণিকা প্রতিবিশ্বে পাড়ি জমাবে।”
“একই সঙ্গে এই স্পেসে থাকা মার্বেল সদৃশ লোহার গোলকটিও তখন সেই বিশ্বে চলে যাবে।” ধরে থাকা কফির মগ ধোঁয়া ছড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অনিল চ্যাটার্জির সেদিকে কোনও মনোযোগ নেই। “তাইতো?”
“হ্যাঁ, স্যার, টরণ কণিকার ক্ষেত্র তৈরি পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছি। আগামীকাল শুধু ওই মার্বেলের চারপাশে ক্ষেত্র তৈরির পরীক্ষা।” কথাটা বলে একটু থমকে গেল প্রত্যয়। জুড়িয়ে যাওয়া কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল,
“আসলে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জটা হবে প্রতিবিশ্বে গোলকটি পাঠিয়ে দেওয়ার পর। কারণ টরণ কণিকা ক্রমাগত দুটি বিশ্বের আসা যাওয়ার মধ্যে থাকে। তাই যেটুকু স্পেস নিয়ে প্রথমে টরণ কণিকাগুচ্ছ প্রতিবিশ্বে ভ্রমণ করবে, পর মুহূর্তেই আবার সেই স্পেস নিয়ে আমাদের বিশ্বে ফেরত চলে আসবে। যেতে এক প্ল্যাঙ্ক, ফিরতে এক প্ল্যাঙ্ক; মাত্র দুই প্ল্যাঙ্ক সময় ব্যবধান। গোলকটি প্রতিবিশ্বে গিয়ে আবার ফেরত চলে এসেছে কিনা সেটা বুঝার কোনও উপায় আমাদের নেই।” আলতো করে গালটা একটু চুলকিয়ে নেয় প্রত্যয়। পাঁচদিনের না কামানো দাঁড়িতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।
“যদি না প্ল্যাঙ্ক সময়কে আমরা নিয়ন্ত্রণ করি!” প্রত্যয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন অনিল চ্যাটার্জি। “যেই মুহূর্তে গোলকটি প্রতিবিশ্বে পাড়ি জমাবে ঠিক তার ‘এক প্ল্যাঙ্ক সময়’ পর আমরা পার্টিক্যাল কোলাইডারের সুপার-কন্ডাকটারের পাওয়ার বন্ধ করে দেব। তাহলে যে প্রচণ্ড শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র উৎপন্ন টরণ কণিকাগুলোকে ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে রেখেছিল, সেই সুপার-চৌম্বকক্ষেত্র আর থাকবে না। তখন টরণ কণিকাগুলো প্রতিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে সেগুলোর মিলিত প্রভাবে যে মার্বেলটা প্রতিবিশ্বের চলে যাবে সেটা আর ফেরত আসবে না। আমাদের পৃথিবী থেকে বাস্তবিকই অদৃশ্য হয়ে যাবে মার্বেলটা।”
“এই পর্যন্ত আমাদের পরিকল্পনা ঠিক আছে। তবে এক প্ল্যাঙ্ক সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা সত্যি অনেক কষ্টসাধ্য। এমন হতে পারে যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই সময়কে নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা ঠিকমতো কাজ করেনি। এমনও হতে পারে একই পরীক্ষা কয়েক’শো বার করতে হতে পারে, কখন সেই এক প্ল্যাঙ্ক সময়ে কম্পিউটার ট্রিগার করবে বলা মুশকিল।” প্রত্যয়ের কণ্ঠস্বরে দ্বিধা স্পষ্ট।
“দশটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার সমান্তরালে যুক্ত করে সুপার-কোয়ান্টাম কম্পিউটারে রূপান্তরিত করেছি। এই কম্পিউটারের ক্ষমতা এখন কল্পনাতীত। আমাদের এক্সপেরিমেন্ট সফল হবেই।” নিজেকে নিজেই যেন অভয় দিচ্ছেন প্রফেসর। প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির মগে লম্বা করে একটা চুমক দেন অবচেতনভাবে।
“কিন্তু তারপরেও প্ল্যাঙ্ক সময়ে ট্রিগার করা সম্ভবনা এক হাজারে মাত্র একবার। কারণ প্ল্যাঙ্ক সময় হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষুদ্র সময়ের মান; এর চেয়ে কম সময়ের অস্তিত্ব নেই। তাই কম্পিউটারের ক্ষমতাও প্ল্যাঙ্ক সময়কে অতিক্রম করে যেতে পারবে না।” অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল প্রত্যয়।
“আজেবাজে চিন্তা করে নিজের শক্তিক্ষয় করো না তো!” কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলেন প্রফেসর অনিল। যদিও জানেন প্রত্যয়ের আশংকা অমূলক নয়। এই প্রথম তারা পরীক্ষা করতে যাচ্ছে মহাবিশ্বের স্বরূপ। এই বিশ্ব কি একক শক্তিশালী কোনও স্বত্তা সৃষ্টি করেছে? না কি, শূন্য থেকে আপনিই সৃষ্টি হয়েছে? এক কথায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে এই পরীক্ষা। সফল হওয়ার সম্বাবনা কতটুকু? ঈশ্বরই জানেন। ঈশ্বের অস্বিত্ব নিয়ে পরীক্ষা, আবার ঈশ্বরই জানেন বলে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন! ঈশ্বরের কি লীলা! আপন মনেই হেসে উঠেন তিনি।
ঘরের মধ্যে অনিল চ্যাটার্জিকে একলা ছেড়ে প্রত্যয় বেরিয়ে এল করিডোরে। সন্ধে হতে বেশি বাকি নেই আর। ঘরে গিয়ে একটা স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া যাক। সকাল থেকেই শুরু হবে কাজ। আগামী কয় সপ্তাহ একভাবে জেগে থাকতে হবে ঈশ্বরই জানেন।
কোলাইডারের এরিয়াটা বিশাল। এখানে সেইভাবে কেউই আসে না। সমস্তই কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রিত হয় লালন দ্বীপ থেকেই। আজকের মিলন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক।
কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার এখনও কাজ করছে নিজস্ব কম্পিউটারে। গত সপ্তাহে পাওয়া ডাটাগুলো চেক করে নিচ্ছে হয়তো। পাইপের করোসন চেক করে নিচ্ছে। কাচের ঘরের পাশ দিয়ে লিফটের দিকে যেতে যেতে প্রত্যয় কৌতুহলী হয়ে দেখল জনা চারেক ইঞ্জিনিয়ার একত্র হয়ে গুজ গুজ করছে।
এই যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও গল্প। কোনও সন্দেহ নেই টাকা দিয়ে আর যাই হোক মানুষের আগ্রহ কেনা যায় না। প্রত্যয় কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এল।
“কাজ নেই আপনাদের? গল্প করছেন কেন?”
এই প্রজেক্টের মুখ্য বিজ্ঞানী হিসাবে প্রত্যয়কেও সমস্ত কর্মীই চেনে। পাঁচজন ইঞ্জিনিয়ার জড়সড় হয়ে দাঁড়াল।
“আগামীকাল এত বড় একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে আর এই সময়ে আপনারা এরকম ফাঁকি দিচ্ছেন! ছিঃ এটা আমি একদমই এক্সপেক্ট করিনি।” স্বভাববিনয়ী প্রত্যয় যতটা পারা যায় ঝাঁঝের সঙ্গে ধমকাল ইঞ্জিনিয়ারগুলোকে।
“আসলে… স্যর… ” একজন আমতা আমতা করে কী যেন বলার চেষ্টা করল।
প্রত্যয় ভুরু কুঁচকে তাকাল। “কী হয়েছে?”
“স্যার আমরা গল্প করিনি। আমরা কাজই করছিলাম।”
বাচ্ছাগুলোর সাহস দেখে প্রত্যয় অবাক। দোষ করে আবার মুখে মুখে তর্ক। বহুদিন বাদে হারানো প্রফেসারি মেজাজটা ফিরে আসছিল প্রত্যয়ের। কিন্তু, কিছু বলার আগেই, একজন ফস করে বলে বসল, “একটা সিগন্যাল আসছে স্যার।”
“কী?”
“স্যার এখানে একটা স্যাটেলাইট সিগন্যাল আসছে খালি খালি।”
“স্যাটেলাইট সিগন্যাল! কখন থেকে?”
“এই ঘণ্টা তিন-চার আগে থেকে বলতে পারেন।”
“ঠিক করে বল।” প্রত্যয় ধমকে উঠল।
একজন চট করে কম্পিউটারটা দেখে নিল। “এই তো ঠিক দুপুর এগারোটা পঁয়ত্রিশে আসা শুরু করেছে।”
“কীসের সিগন্যাল এটা?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না, স্যর। আপনি তো জানেনই স্যর গোপনীয়তার কারণে এই এরিয়াটাকে সম্পূর্ণভাবে স্যাটেলাইট জ্যামার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে যাতে কোনওরকম আউটগোয়িং ট্রান্সমিশন না করা যায়। আর এই ইনকামিং সিগন্যালটার যেহেতু সিকিউরিটি সার্টিফিকেট নেই, তাই বাউন্স করে চলে যাচ্ছে।”
প্রত্যয়ের ভুরু কুঁচকে উঠল। এগারোটা পঁয়ত্রিশ! অন্তিম পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগে!
“সিগন্যালটা দেখাও আমাকে।”
কম্পিউটারে তরঙ্গের মতো একটা সিগন্যাল ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ পরপর এটি বাউন্স করছে। কম্পিউটারে কিছু একটা এন্ট্রি করে প্রত্যয়, তড়িৎ গতিতে। সেখানে একটা সংখ্যা জ্বলজ্বল করে উঠে, ১৭৩২১৭৩২১৭৩২…
দ্রুত গতিতে চিন্তা চলছে প্রত্যয়ের মাথায়। চট করে বুঝতে পারে এই সংখ্যাটার গুরুত্ব! এটাকে লালন দ্বীপে তাঁর নিজস্ব কম্পিউটারে ট্রান্সফার করা প্রয়োজন। কারা পাঠাচ্ছে এই সিগন্যাল? কেনই বা পাঠাচ্ছে?
ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে প্রত্যয় লালন দ্বীপের নিজস্ব কম্পিউটারে ট্রান্সফার করল সিগন্যালটা।
বিশাল আকারের একটা ডাটা প্যাকেট। এনকোড করা। ঝাড়া দশ ঘণ্টা লাগল প্রত্যয়ের সুপার কোয়ান্টাম কম্পিটারের সাহায্যে প্যাকেটটা ডিকোড করতে।
‘প্রতিমাত্রার প্রতিবিশ্ব হতে জরুরী বার্তা’। প্রেরক ড্যানিয়েল মুর নামের একজন। পাঠিয়েছে ২১ জুলাই, ২০৬৬ তারিখে, ঠিক আজকের দিনে; ৮৮ বছর আগে।
কী! ৮৮ বছর আগে! এও কি করে সম্ভব! হোক্স নাকি?
তবু প্রত্যয় অবহেলা করল না। ঝট করে বাকি মেসেজটাকে ডিকোড করল। কি ভয়ংকর! কি ভয়ংকর একটা কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছিল সে! এই মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে হবে কাজ। নয়তো সব শেষ হয়ে যাবে!
তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই চমকে উঠল প্রত্যয়। তাঁর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনিল চ্যাটার্জি। “ওহ স্যার! আপনার এখানেই যাচ্ছিলাম।”
“কী ব্যাপার প্রত্যয়? তোমাকে নার্ভাস মনে হচ্ছে?”
ভয়াবহ কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে স্যার, আমাদের এখনই এই প্রজেক্ট বন্ধ করে দিতে হবে।
সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে ছোবল মারেন যেন অনিল চ্যাটার্জি; ঘন ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
নিজেকে সংযত করে প্রত্যয়। ধীর পদক্ষেপে এককোণে আরামদায়ক সোফায় গা এলিয়ে দেয়, তাকে অনুসরণ করে অনিলবাবুও পাশের সোফায় বসে যান।
একে একে সম্পূর্ণ বিষয়টি খুলে বলে প্রত্যয় একেবারে শুরু থেকে খুটিনাটি সব। কোনও বাধা না দিয়ে এক মনে তার বক্তব্য শুনতে থাকেন অনিল চ্যাটার্জি। সবশুনে শুধু একটি বাক্যই তার মুখ থেকে বের হয়, “এই প্রজেক্ট বন্ধ হবে না।”
কিন্তু স্যার…
ডান হাত শূন্যে তুলে তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলেন, “তোমার ধারণা আছে কত টাকা আর শ্রম এই প্রজেক্টে ইনভেস্ট করা হয়েছে? আর ওই মহাবিশ্ব টিকে থাকা না-থাকা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। এক্সপেরিমেন্ট চলবে।”
স্যার, আপনি ব্যাপারটার গুরুত্ব ধরতে পারেননি। ওই বিশ্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আমাদেরটা কি টিকে থাকবে? দুটি বিশ্ব একটি আরেকটির সম্পূরক। একটি না থাকলে আরেকটি থাকবে না। তার মানে ওইটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আমাদেরটারও একই পরিণতি হবে।”
তোমার কী ধারণা এত এত বিজ্ঞানী গণিতবীদ এতদিন এখানে ঘাস কেটেছে? এই সম্ভবনা আমাদের বিবেচনাতে আগে থেকেই ছিল। যদি দুটি বিশ্ব ধ্বংস হয়েই যাই, তাহলে সেটি শুরু হবে মহাবিশ্বের প্রান্ত থেকে। আমাদের মহাবিশ্বের প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে শূন্যে মিলিয়ে যেতে থাকবে। তারপর সেই মিলিয়ে যাওয়ার এগিয়ে আসতে আসতে একসময় আমাদের এখানে এসে মিলিত হবে। আমাদের অবর্জাবেবল মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ উনপঞ্চাশ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। যদি আলোর বেগেও এই শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া এগিয়ে আসে, তাহলে কত সময় লাগবে তোমার ধারণা আছে?”
“স্যার, আলোর বেগের চেয়ে স্পেস-টাইম ফিল্ডের বেগ অনেক বেশি। আর আপনি কি করে নিশ্চিত হচ্ছেন যে এই শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া মহাবিশ্বের প্রান্ত থেকে হবে? আমাদের এই এক্সপেরিমেন্টের জায়গা থেকেও তো হতে পারে?
“আর কোনও কথা নয়।” ভারী কণ্ঠ গমগম করে উঠে অনিল চ্যাটার্জির। প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা করে উচ্চারণ করেন তিনি, “বিজ্ঞানের স্বার্থে আমাদের এইটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। প্রথম যখন পার্টিকাল কোলাইডারের এক্সপেরিমেন্ট করা হয় তখনও নানান ধরণের আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল পৃথিবীজুড়ে।” চোখের পাতা না ফেলে বরফশীতল কণ্ঠে উচ্চারণ করেন “যে কোনও মূল্যে এই এক্সপেরিমেন্ট চলানো হবে।”
দু’হাত সোফার হাতলে চাপড় মেরে উঠে দাড়ান আচমকা নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হওয়া অনিলবাবু। দৃঢ় পদক্ষেপে ঘর থেকে বের হয়ে যান, পেছনে অসহায় হতভম্ভ প্রত্যয়।
অধ্যায় আট
২৩ নভেম্বর, ২০৬৫ আফ্রিকা কঙ্গোর জঙ্গল
‘হে প্রতিবিশ্বের স্বত্তা, তোমাদের বিশ্ব থেকে কোনও ত্রি-মাত্রিক বস্তু আমাদের বিশ্বে পাঠাবে না। যদি পাঠাও তবে আমাদের মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। 46Q321456.86mE2473067.04mN5997715200’
কিছুক্ষণ পরপর এই মেসেজটা পড়ছে আর মাথা হাত দিয়ে ইতস্তত হেঁটে বেড়াচ্ছে মাইক।
“ওহ্ গড! তাহলে আমাদের দিক থেকে কিছু গেলেই ওদের বিশ্ব তো ধ্বংস হয়ে যাবে!” মাইকের গলায় চরম আতঙ্ক।
“হ্যাঁ।” গম্ভীর স্বরে বলল ড্যানিয়েল।
মাইক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। তাকে চরম উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। প্রায় পাগলের মতো সে বিড় বিড় করে উঠল, ‘এ কী করেছি আমরা! এ কী করেছি?’
প্রিয় বন্ধুকে এরকম অস্থির হয়ে উঠতে দেখে ড্যানিয়েলও ঘাবড়ে গেছে, সে মাইকের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল। “কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?”
“ড্যানি! ড্যানি…” মাইক শুধু কাঁদতে বাকি রেখেছে।
“আহ বলবি তো কী হয়েছে? এরকম পাগলের মতো করছিস কেন?”
“এতদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। এত এত গরু ছাগল হরিণ… তোর মাথার টুপি… ঢিল…”
ড্যানিয়েলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বন্ধুর আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি থামাতে পারল না কিছুতেই।
ড্যানিয়েল হাসতে শুরু করতেই মাইকের ভুরু কুঁচকে গেল। “হাসছিস কেন তুই? এটা হাসার সময়?”
“উফ্ মাইক! মাথায় তোর কি আছে? গোবর?” ড্যানিয়েল হাসতে হাসতেই বলে উঠল। “এটা কোনও পোর্টাল নয় রে বুদ্ধু। এটা একটা পরম শূন্যস্থান। আমাদের দিক থেকে এখানে কিছু ফেললে তা ওদের জগতে গিয়ে পড়ে না। একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়। বুঝলি ইডিয়ট!”
মাইক ভুরু কুঁচকে গোড়ার থেকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। পোর্টাল নয়, পরম শূন্যস্থান। হ্যাঁ, ড্যানিয়েল অবশ্য বহুদিন আগে বুঝিয়েছিল পরম শূন্যস্থান কাকে বলে…
ড্যানিয়েল হাসি থামিয়ে, শান্ত স্বরে বলল, “অবশ্য এটা একটা পোর্টালও বটে। কিন্তু সেটা আমাদের দিকে নয়। ওই প্রতিবিশ্বের দিকে। ওইদিক থেকেই যাতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সিগন্যাল আসতে পারে, আমাদের দিক থেকে ওদের দিকে কিছুই না যায় সেই ব্যবস্থাটাই ওঁরা করেছে।”
“তুই কিন্তু এখনও বলিসনি কীভাবে এই রহস্যের সমাধান করলি।” বন্ধুর কাছে বোকা বনে গিয়ে কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল মাইক।
“এত উতলা হচ্ছিস কেন? অবশ্যই বলব, তবে তার আগে আমাদের এই বার্তাটি নিয়ে কাজ করতে হবে। একটি মহাবিশ্ব ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। তোর কী মনে হচ্ছে এই বার্তাটি পড়ে? এই ভিন্ন মাত্রার ভিন্ন মহাবিশ্ব থেকে পাঠানো এই বার্তাটি ঠিকমতো বুঝতে পারলে সব রহস্যের আবরণ পটাপট খুলে যাবে।”, বাঁ হাতে উল্টোপাশ দিয়ে নাকের ডগা কিঞ্চিত ডলতে ডলতে বলে ড্যানিয়েল; চোখ জ্বলজ্বল করছে তার।
কপাল কুঁচকে উঠে মাইকের। মস্তিষ্ক ঝড়ের গতিতে কাজ করছে; কিছু একটা হিসাব মেলাতে চেষ্টা করছে, বেশ কিছুক্ষণ পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “নাহ!। আমার মাথায় কিছুই ধরছে না। আর ভণিতা না করে ব্যাখ্যা কর।”
“বিগব্যাং এর ফলে আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শুধু আমাদের বিশ্বই নয় সেই সঙ্গে প্রতিবিশ্বেরও সৃষ্টি হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, আমাদের যেমন চারটি মাত্রার বিশ্ব, ঠিক প্রতি-বিশ্বও চারটি মাত্রার, তবে ঋণাত্মক দিকে তাদের অবস্থান।”
“হ্যাঁ। সেই ব্যাপারটা আমি বুঝেছি। তুই আগে বাঢ়।” অধৈর্য্য হয়ে মাইক বলল।
“এখন ওই ল্যাটিচুড ল্যাঙ্গিচুড হিসাব করে পেয়েছি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সমুদ্র মধ্যবর্তী অঞ্চল কোনও এক ল্যাব থেকে একটি বস্তুকে প্রতিবিশ্বে পাঠানোর পরীক্ষা করবে কোনও এক ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী।”
“বলিস কি!?”
“হ্যাঁ। এখন যেহেতু আমাদের বিশ্বের বস্তু অপর বিশ্বে প্রবেশ করছে, তাই সেখানে এই বস্তু প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ‘বস্তু-প্রতিবস্তুর’ মিথষ্ক্রিয়ায় সেই বিশ্বটি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তারা আমাদের বিশ্বে এই পোর্টাল খুলে বার্তা পাঠিয়ে আকুতি জানাচ্ছে যেন মাত্রা অতিক্রমের সেই পরীক্ষা না চালানো হয়। তারা বার্তায় সেই পরীক্ষার নির্ভুল অবস্থান ও সময় পর্যন্ত জানিয়ে দিচ্ছে।”
“আর এই ব্যাটার ব্যাপারটা কীরকম? পিছন দিকে হাঁটছে কেন ওটা?” গর্ত-এর দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করল মাইক।
“যেহেতু, আমাদের সাপেক্ষে তাদের সময়ের দিক বিপরীত। সেই সূত্র ধরেই এই পোর্টালটি, যেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি পরম শূন্যস্থান হিসাবে; প্রতি মুহূর্তে আরও অতীতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।”, শান্ত স্বরেই বলে ড্যানিয়েল।
ডান হাত চিরুনির মতো করে মাথার চালিয়ে চুলগুলোকে এলোমেলো করে দেয় কিছুটা মাইক; ভাবখানা এমন যেন এলোমেলো চুলের ফাঁকে আরও বুদ্ধি খেলে যাবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মাইক। সম্পূর্ণ ব্যাখ্যাটি আত্মস্থ করছে যেন। একটু পরে মৃদু মাথা হেট করে বলে, “এখন বল এই রহস্যভেদ করলে কী করে?”
“ধাপে ধাপে সমাধান করেছি। প্রথমে পর্যবেক্ষণ করেছি সময়ে পশ্চাৎগতি। তারপর পরীক্ষা করে দেখি যে আলোক তরঙ্গ এই শূন্যস্থানের ভেতর দিয়ে শূন্য সময়ে অতিক্রম করে যাচ্ছে। তার মানে এই স্থানটি এক পাশ থেকে পাঠানো তরঙ্গ কোনও সময় ব্যয় না করে অপর পার্শে চলে যাচ্ছে। এ থেকে বুঝতে পারি এটি কোনও সাধারণ ফাঁকা স্থান নয়; এটি একটি পরম শূন্যস্থান।
পরম শূন্যস্থান কেবল বিপরীত মাত্রার মিলনেই তৈরি হতে পারে। এর সঙ্গে সময়ের মাত্রার বিষয়টি যুক্ত করতেই বুঝতে পারি, বিপরীত কোনও মাত্রা থেকে কিছু এসে এই স্থানে মিশছে তাই এই পরম শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে।
তাহলে কি বিপরীত মাত্রার প্রাণীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে? এই শেষের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনুমান ছিল আমার। কিন্তু অনুমানটা একদম ঠিক ছিল।” আত্মপ্রসাদের চওড়া হাসি হাসল ড্যানিয়েল।
“হুম।”
“এই পরম শূন্যস্থানটা যে বিপরীত মাত্রার একটা পোর্টাল, এই ব্যাপারটাই আমি প্রথমে বুঝিনি। অবেশেষে মাথায় আসে, একটি পরম শূন্যস্থান তো অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত শূন্য থাকবে না, তৈরি হওয়ার পরমুহূর্তেই আমাদের বিশ্বের স্থানের চাদর আবার এটিকে দখল করে নিবে, কিন্তু এটা টিকে আছে। তার মানে সেই বিপরীত বিশ্ব থেকে ক্রমাগত কিছু একটা পাঠানো হচ্ছে, তাই ক্রমাগত দুই বিপরীত বিশ্বের মিলন হচ্ছে। আর এটা টিকে আছে। তখনই বুঝি এটা আসলে বিপরীত বিশ্ব থেকে খোলা একটা পোর্টাল। এবার মাথায় আসে দ্বিতীয় প্রশ্ন। কী পাঠাচ্ছে ওঁরা?”
চোখে প্রশ্নবোধক ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে মাইক। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে ড্যানিয়েলের বক্তব্য।
“অনেক বছর ধরে বিপরীত বিশ্বের প্রাণীরা এই পোর্টাল খুলে রেখেছে। এই কথাটা ভাবতে মনে হয়, হয়তো তারা আমাদের বিশ্বের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানতে পেরেছে। তাহলে তাঁরা এমন কিছু পাঠাবে যা মানুষ বুঝতে পারে। হয়তো কোনও সিগন্যাল। কোনও তরঙ্গ।
পরম শূন্যস্থান তৈরি করার পর সেখানে তারা ক্রমাগত সিগন্যাল পাঠাচ্ছে, কিন্তু আমরা কোনও কিছু রিসিভ করতে পারছি না। কেন? এই প্রশ্নটা আমাকে পাগল করে দিয়েছিল প্রায়। এই জায়গায় এসে বেশ কিছুদিন আটকে ছিলাম। অবশেষে গত সপ্তাহে এর সমাধান করতে পেরেছি।”
“কীভাবে?” উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে মাইক।
“বলছি, বলছি, কিন্তু তার আগে বল, আমাদের বিশ্বে কোনও একটি তরঙ্গ কীভাবে প্রোপাগেট করে?”
“মানে? প্রশ্নটাই বুঝলাম না। কীভাবে প্রপাগেট করে মানে?”
“মানে একটা তরঙ্গ আমাদের বিশ্বে কীভাবে এগিয়ে যায়?”
মাইক চুপচাপ ঘাড় নাড়ল। সে প্রশ্নটাই বোঝেনি নাকি উত্তরটা জানে না সেটা ঠিক ধরা গেল না।
“যেমন ধর পুকুরের মাঝে একটি তরঙ্গের সৃষ্টি হল। এটি কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে? এক বিন্দু থেকে তিন মাত্রা সর্বদিকে সমহারে গতিশীল হয়। তাই না? কিন্তু সেই প্রতিবিশ্বে সময় তো আমাদের বিপরীত; আমাদেরটা ধনাত্মক হলে তাদেরটা ঋণাত্মক তাই না? তার মানে তাদের সিগন্যালে আসা তরঙ্গসমূহ পরিধি থেকে প্রপাগেট করে এক বিন্দুতে মিলিত হবে। বুঝতে পারছিস? তার মানে ঠিক আমাদের বিপরীত প্রক্রিয়া আর কী!” খুব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ড্যানিয়েল।
“আরেকটু সহজ করে ব্যাখ্যা করতে পারবি? আমার মাথায় তো সব ভজগট পাকিয়ে গেছে।” অস্থির হয়ে বলে মাইক।
“পুকুরের মাঝে একটি ঢিল ছুড়ে মার। তাহলে যে ঢেউ সৃষ্টি হবে সেগুলো ঢিল পড়ার স্থান থেকে একটি বৃত্তাকার আকৃতি নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, ঠিক? এবার এই ব্যাপারটা ভিডিয়ো রেকর্ডিং কর। তারপর রিউয়াইন্ড করে চালিয়ে দাও। কী দেখবে? দেখবে চারদিক থেকে ঢেউগুলো এক বিন্দুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ঠিক এটাই ঘটছে আমাদের এই পরমশূন্যস্থানে। যেই মাত্র ফুরিয়ার ট্রান্সফরমেশন করে বিপরীত মাত্রায় হিসাব করে সিগন্যাল রিসিভার সেট করি সঙ্গে সঙ্গে এই বার্তা ধরা পড়ে যায়।”
মাইক অবাক দৃষ্টিতে ড্যানিয়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ফিসফিস করে বলে, “আমি জানতাম কেবল তুই পারবি এই রহস্যের সমধান করতে। শুরু থেকেই আমার এই বিশ্বাস ছিল তোর উপর। আমি জানতাম।”
“কী! তাহলে স্বীকার করছিস তো পৃথিবীতে আসলে ভৌতিক ব্যাপার বলে কোনও কিছুর অস্বিত্ব নেই? এখন ঝটপট বাজির টাকাটা ফেরত দে।” বলে হাত বাড়িয়ে দেয় ড্যানিয়েল।
ড্যানিয়েলের কথাকে এড়িয়ে ঘাসের উপর গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে মাইক। কারও মুখে কোনও কথা নেই। অনেকক্ষণ পর বলে “দেখেছিস আকাশে কত তারা উঠেছে আজ? কি অদ্ভুত সুন্দর তাই না? বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি জানান দেয়, কেমন যেন চিনচিন করে উঠে।
ড্যানিয়েলও ঘাসের উপর গা এলিয়েছে। শান্ত স্বরে সে বলে, “আমাদের যে করেই হোক ভবিষ্যতের সেই পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। আর এই আবিষ্কার গোপন রাখাটাও জরুরি। না হলে অন্য কেউ যদি এই পরীক্ষা চালায় তাহলেও সেই মহাবিশ্বের একই পরিণতি হবে।”
একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাইক বলে, “ঈশ্বর সকল কিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, মহাবিশ্ব পর্যন্ত জোড়!”
“ঠিকই বলেছিস। বিগত কিছুদিন ধরে এই কথাটা আমিও ভাবছিলাম।”
অবাক দৃষ্টি হেনে ড্যানিয়েলের দিকে তাকায় মাইক। “তুই ঈশ্বর নিয়ে ভাবিস! এটা তো জানা ছিল না!”
“আসলে আমি প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছি। যতই বিজ্ঞানকে জানছি, ততই নতুন নতুন অজানা বিষয় ঘাড়ে চেপে বসছে। বাদ দে এসব দার্শনিক ভাবনা, এখন বল কীভাবে অন্য সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এই বার্তা ভবিষ্যতের সেই পরীক্ষাগারে পৌঁছান যায়?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাইক বলে, “একটা আইডিয়া পেয়েছি কীভাবে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এই বার্তা ভবিষ্যতে পাঠাতে পারি।”
“কীভাবে?”
“সেই পরীক্ষাটি কখন করা হবে আমাদের জানা আছে, কোথায় করা হবে সেটিও আমরা জানি। ঠিক?”
“বলে যা, শুনছি।”
“আমরা একটা স্যাটেলাইট সফটওয়্যারের মধ্যে সিগন্যালিং-এর ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে পারি। সঠিক সময়ে ওটা চালু হয়ে যাবে আর ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে স্যাটেলাইট সিগন্যাল পাঠাবে ওই এরিয়াতে।”
“যদি ওই এরিয়াতে জ্যামার লাগানো থাকে? মানে এরকম একটা গবেষণা হবে যেখানে সেখানে তো…”
ঠিকই বলেছিস। জ্যামার থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এটা সাধারণত আউটগোইং এর ক্ষেত্রে। প্রজেক্টের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্যে এমন এটা করা হবে। ভেতর থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না। তবে বাইরে থেকে যোগাযোগ করার যাবে; কিন্তু সেগুলো একটা নির্দিষ্ট গেইটওয়ে দিয়ে ফিল্টার হয়ে যাবে। যেসব কমিউনিকেশন সিস্টেম তারা সিকিউরিটি পাস দেবে কেবল সেগুলোই ওই এরিয়ার ভেতরে ঢুকতে পারবে।”
“তাহলে তুই নিশ্চয় আশা করছিস না যে আমাদের সিগন্যালকে তারা …”
ড্যানিয়েলকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মুখ ভার করে মাইক বলে, “এটি একটি বড় বাধা।”
আচমকা মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠে ড্যানিয়েলের। “দারুন আইডিয়া পেয়েছি। আমরা সেই সিগন্যালটিকে এক সেকেন্ড, সাত সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড ও দুই সেকেন্ড ইন্টারভেলে বারবার পাঠাবো। এই প্রজেক্টে ১.৭৩২ খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। এই প্যাটার্ন নজরে এলে নিশ্চিত তারা একে ডাউনলোড করবে।”
“১.৭৩২? ওটা আবার কি?”
“আমি মিনিট বাই মিনিট পরীক্ষা করে দেখেছি এই গর্তটা ঠিক অতখানিই অতীতে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এখানে সময় ১.৭৩২০৫ দিন সামনে গেলে গর্তটি ১ দিন পেছনে যায়। সংখ্যাটার ব্যাখ্যা আমি সঠিক ভাবে বুঝতে পারিনি। শুধু এইটুকুই জানি একক বাহু বিশিষ্ট একটা ঘনকের কর্ণের দৈর্ঘ্য ওটা হয়। কিন্তু সে যাই হোক, ওই অন্য জগতের প্রাণীরা যখন শূন্যস্থানটাকে এইভাবে চালনা করছে তখন এর কোনও একটা প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই আছে। আমিও ওই মেথডেই সিগন্যালটা পাঠাব। এই সমস্যা না হয় সমাধান করলাম, কিন্তু মূল সমস্যা এখনও রয়ে গেছে।” যে গতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো ড্যানিয়েলের মুখ, তার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে অন্ধকার হয়ে যায়।
“কী সমস্যা বন্ধু?” ড্যানিয়েলের উৎকণ্ঠা মাইককেও ছুঁয়ে যায়।
“এত বছর কি কোনও সফটওয়্যারকে আক্টিভেট রাখা সম্ভব? নাকি কোনও মেশিন টিকতে পারে একশো বছর?”
“নাহ, এতো লম্বা সময় কোনও ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসকে সচল রাখার সম্ভব নয়। ইনফেক্ট আমাদের স্যাটেলাইটগুলোর লাইফটাইমও পনেরো থেকে বিশ বছর। তারপর সেগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে আছড়ে পড়ে পুড়ে ঝলসে যায় অথবা স্যাটেলাইট গ্রেভইয়ার্ড অর্বিটে পার্কিং হয়ে স্থানিকসমাধি হয়ে যায়। তবে, আমরা একটা কাজ করতে পারি। তুই তো জানিস, স্যাটেলাইটের ছবি, ভিডিয়ো ইত্যাদি আর্কাইভে তুলে রাখা হয়। এমন কোনও ট্রোজান কি বানাতে পারবি যেটা ওই সময়ে ট্রিগার করবে? আমি সেই ট্রোজানটি ইমেইজ এক্সটেনশন হিসাবে আর্কাইভে সেভ করে রাখবো। কেউ বুঝতেই পারবে না। এই আর্কাইভ শত শত বছর ক্লাউড মেমোরিতে টিকে থাকবে। সময় মতো সেগুলো সেই সময়ের স্যাটেলাইটে আপলোড হয়ে বাংলাদেশের সেই জায়গায় সিগন্যাল হিসাবে ডাটাগুলো পাঠিয়ে দিবে। যন্ত্র না টিকে থাকুন, ডাটা ঠিকই টিকে থাকবে।”, চোখ নাচিয়ে বলে মাইক। ড্যানিয়েলকে কিছু বিষয়ে জ্ঞান দিতে পেরে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে সে।
আশার আলো দেখতে পাচ্ছে ড্যানিয়েল। এই জন্যেই মাইককে সে এত পছন্দ করে। একটু বোকাসোকা হলেও ব্যবহারিক জ্ঞান তার অনেক বেশি। “আমি ব্যাপারটা এমনভাবে এনকোডেড করে দেব যাতে ডাটাগুলো অন্য কারও হাতে পড়লেও যাতে এর মর্মোদ্ধার করতে না পারে।” বলল ড্যানিয়েল।
“কীভাবে?”
ডাটা প্যাকেটগুলো সর্বোচ্চ সংখ্যাক কী দিয়ে লক করে দেব। সেই সময় নিশ্চয় ওই প্রজেক্টে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহৃত হবে। ওটা দিয়ে কয়েকঘণ্টায় এই পাসওয়ার্ড ভাঙতে পারবে তারা। সাধারণ কম্পিউটার দিয়ে যা সম্ভব হবে না।
অধ্যায় নয়
বাংলাদেশ, হাসন দ্বীপ
রাত তিনটা বাজে, কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সম্পূর্ণ হাসন দ্বীপ জুড়ে। কিছুদূর পরপর সিকিউরিটি কিছুটা অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। এর ভেতর একটি ছায়ামূর্তি ইঞ্জিনিয়ারদের ভবন থেকে বের হয়েছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পকেটে হাত রেখে। অজান্তেই পকেটে রাখা ছোট বাক্সটা আরেকবার হাতের স্পর্শে অনুভব করে নেয়। মাটির নিচে একটি লিফটের সামনে এসে থামে ছায়ামূর্তিটি। চেয়ারে বসে ঢুলছে সিকিউরিটি। একটা জোরসে ধমক দিতেই লাফিয়ে উঠে স্যালুট ঠুকে সটান দাঁড়িয়ে যায়। “স্যার, আপনি এত রাতে?”
“শেষবারের মতো দেখতে এসেছি সব ঠিকঠাক আছে কী না। তুমি ঘুমাচ্ছ কেন? দরজা খোল, জলদি।” কণ্ঠে কর্তৃত্ব ছায়ামূর্তিটির।
কোনও কথা না বলে হাতের কার্ডটি পাঞ্চ করে লিফটের দরজা খুলে সরে দাঁড়ায় সিকিউরিটি, কাচুমাচু একটা ভাব ফুটে উঠে তার আচরণে। এখন জলদি উনি কেটে পড়লে বাঁচে। তার রিপোর্টে লাল কালির দাগ না পড়লেই রক্ষে।
একশো পঁচিশ মিটার গভীরে নেমে আসে লিফট, মাত্র বিশ সেকেন্ডে। পার্টিক্যাল কোলাইডার; এর ভেতর ছোট একটি রেললাইন চলে গেছে অনেক দূরে, চোখের আড়ালে। রেলের উপর চড়ে সেটিকে চালিয়ে দেয় ব্র্যানডন, এই ঈশ্বরের গণিত প্রজেক্টের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। রেল ধীর গতিতে কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিছুদূর পরপর কয়েকজন টেকনিশিয়ান ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে টুকটাক কাজ করছে।
একেবারে কেন্দ্রের কাছাকাছি এসে রেলটি থামায় ব্র্যানডন। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে কেন্দ্র পর্যন্ত। চারদিকে একবার আলতো করে নজর বুলিয়ে নেন তিনি। কোনায় কোনায় সিসি ক্যামেরা সেট করা। তার অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। এই সেন্টারের যে কোনও জায়গায় যে কোনও সময় যাওয়ার ক্লিয়ারেন্স তার আছে। জিরো আওয়ারের পাঁচ ঘণ্টা মাত্র বাকি, এই সময় সবকিছু খুঁটিনাটি পরীক্ষা তিনি করতেই পারেন। তিন মিটার উঁচু একটি প্লাটফর্ম, স্টিলের মই বেয়ে উঠে যান তিনি। তিন দুই সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি ছোট লোহার গোলক। রেডিয়েশনরোধক গ্লাভস পড়ে নিয়ে পকেট থেকে বাক্সটি খুলে একই রকম দেখতে আরেকটি গোলক বের করে আনেন অতি সতর্কতার সঙ্গে; সিসি ক্যামেরাকে ফাঁকি দিয়ে।
বাঁ হাতে লোহার গোলকটি আলতো করে তুলে নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে কিছু একটা পরীক্ষা করার অভিনয় করেন। আচমকা ডান হাতের গোলকটির সঙ্গে আদলবদল করে নেন। ধীরে ধীরে ইউরেনিয়ামের গোলকটি জায়গা মতো রেখে চারপাশে নজর বুলিয়ে নেন। বাহিরে ধীরস্থির ভাব ধরে রাখলেও বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একটি স্ক্রু ড্রাইভার হাতে তুলে ফ্রেমটির কয়েকটি নাট খুলে আবার লাগিয়ে দেন।
আশেপাশে কেউ নেই, সিসি ক্যামেরাতে তেমন সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়ার কথা নয়। সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে। এই শেষ মুহূর্তে আর কেউ এদিকে আসবে না। এখন দেখা যাক অন্তিম পরিণতি কী হয়। ফিরতি পথে আরও দু’এক জায়গায় নেমে কিছু নাটবল্টু নেড়ে চেড়ে দেখলেন ব্র্যানডন মুর।
অধ্যায় দশ
জিরো আওয়ার এর আর বাকি দশ মিনিট। কন্ট্রোল রুমে কেবল তারা তিনজন, প্রত্যয়, অনিল ও ব্র্যানডন। কাচের ঘর, বড় বড় স্ক্রিন আর কন্ট্রোল কীবোর্ড। প্রত্যয় এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে অনিল চ্যাটার্জিকে বোঝাতে। তাদের আলাপচারিতা মনোযোগ দিয়ে শুনছে ব্যানডন মুর। বুকের ভেতর বিউগল বাজছে যেন তার। এই মুহূর্তে যদি এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে তার গ্র্যানপা, ড্যানিয়েল মুরের সারাজীবনের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
পকেটে রাখা লেজার গানটি আলতো করে ছুঁয়ে দেখে প্রত্যয়। প্রয়োজন হলে একেবারে শেষমুহূর্তে এর ব্যবহার করবে সে। “স্যার, আমি বলছি প্লিজ, আরেকবার ভেবে দেখুন। মাত্রই ড্যানিয়েল মুরের সেই বার্তা পেয়েছি। আমরা তো এক্সপেরিমেন্ট কিছুদিন পরেও করতে পারি। জিরো আওয়ার না হয় কয়েকদিন বা কয়েক মাস পিছিয়ে দিলাম।” কণ্ঠে আকুতি প্রত্যয়ের।
প্রত্যয়ের মুখে ড্যানিয়েল মুরের নাম শুনে চমকে উঠে ব্রানডন। তার চমকে ওঠা নজর এড়ায় না প্রত্যয়ের।
প্রত্যয়ের আকুতিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত হাতে কম্পিউটারে কিছু এন্ট্রি দিতে থাকেন অনিল চ্যাটার্জি। মৃদু স্বরে বলেন, “দেখ প্রত্যয়, এতো ভয় পেলে চলবে না। বিজ্ঞানের জন্যে আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।” মাইক্রোফোন চালু করে দ্রুত কিছু ইন্সট্রাকশন দেন। তার বার্তা দ্বীপের প্রতিটি কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে জিরো আওয়ারে। পার্টিক্যাল কোলাইডার ছেড়ে সবাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে।
“কিন্তু স্যার পৃথিবীই যদি না থাকে তাহলে বিজ্ঞান দিয়ে কী হবে?” মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করছে প্রত্যয়।
৫৯, ৫৮, ৫৭, ৫৬ … কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। একটি লাল রঙের চ্যাপটা বাটনের উপর হাত রেখে কাউন্ট ডাউন ডিসপ্লের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অনিলবাবু।
আর উপায় নেই, পকেট থেকে লেজার গানটি বের করে প্রত্যয় চিৎকার করে উঠে, “খবরদার, বাটন ছেড়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যান। আপনাকে মারবো না, তবে পায়ে লেজার চালাতে একমুহূর্তও দ্বিধা করবো না।” লেজার গানটি ধরে থাকা হাত মৃদু কাঁপছে। জীবনের এই প্রথম কারও দিকে বন্দুক তাক করেছে প্রত্যয়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যে লেজার গানটি তার কাছে অনেকদিন ধরেই ছিল। আজ যে এটি এভাবে কাজে লাগবে ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল সে?
চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে অনিল চ্যাটার্জি। আচমকা প্রত্যয়ের এমন আচরণের কোনও ব্যাখ্যা তার মাথায় ঢুকছে না। যে প্রত্যয় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারতো না, সে এখন লেজার গান তাক করে হুমকি দিচ্ছে?
৩০, ২৯, ২৮, … এক্সপেরিমেন্ট চালানোর জন্যে মরিয়া অনিল চ্যাটার্জি আর যাই হোক নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নেবেন না। লাল বাটন থেকে হাত উঠিয়ে দু’কদম পিছিয়ে আসেন তিনি। “কি পাগলামী করছ প্রত্যয়? মাথা ঠিক আছে তো তোমার?”
চিফ ইঞ্জিনিয়ার ব্র্যানডন ধীরে ধীরে প্রত্যয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার দিকে প্রত্যয়ের কোনও খেয়াল নেই। মিস্টার প্রত্যয় এখন এক্সপেরিমেন্ট কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না। আপনি গান নামান।
১০, ৯, ৮ … ধককে উঠে প্রত্যয়। “আমি সত্যি সত্যি আপনার পায়ে গুলি করে দেব। খবরদার বাটনের দিকে এগোবেন না।”
পেছন থেকে প্রত্যয়ের হাত ধরে ফেলে ব্র্যানডন। উপরের দিকে দুইবার লেজার বের হয়ে ছাদ ফুটো হয়ে যায়। প্রত্যয়কে জাপটে ধরে ব্র্যানডন। মাটিতে পড়ে যায় দুজন।
৫, ৪, ৩, দ্রুত কয়েক কদম এগিয়ে আসেন অনিল; ১, ০ টিপে দেন লাল বাটনটি। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রত্যয় ও ব্রানডন। এখনও ট্রিগারের উপর থেকে আঙুল শিথিল করেনি প্রত্যয়। আরও কয়েকবার লেজার ছুটে বের হয় গানটি থেকে। আচমকা একটি অনিল চ্যাটার্জির কপাল বরাবর ছুটে যায়। এক সেকেন্ডের কম সময়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে তার দেহটি। কপাল বরাবর দুই সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের ফুটো, সেখান থেকে রক্তের ছোট একটা ধারা চুয়ে চুয়ে বের হচ্ছে।
আর এক সেকেন্ড পর সম্পূর্ণ কম্পাউন্ডটি বিকট শব্দে কেঁপে উঠে। কী দেখছে তারা! স্থির হয়ে গেছে প্রত্যয় ও ব্রানডন, পড়ে আছে অনিলবাবু নিথর দেখ। বাইরে যেন নরক ভেঙে পড়েছে। দূরের দ্বীপের সম্পূর্ণ পার্টিক্যাল কোলাইডার ঘিরে একটি মাসরুম আকৃতির আগুনের কুন্ডলি। দমকা একটা শক ওয়েভ এসে আছড়ে পড়ে লালন দ্বীপে বিকট শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয় সকলের। দেয়ালে আছড়ে পড়ে তিনটি দেহ।
অধ্যায় এগারো
মুখোমুখি বসে আছে প্রত্যয় ও ব্র্যানডন মুর। দুজনের মন বিষন্ন, গত কয়েক মাস রীতিমতো ঝড় বয়ে গেছে তাদের উপর দিয়ে। একের পর এক তদন্ত কমিটি, সিকিউরিটি সংস্থা, বিজ্ঞান কাউন্সিলের জেরার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। সেই সঙ্গে পার্টিক্যাল কোলাইডারের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল রুমের বেশ খানিকটা অংশ ভেঙে পড়েছে। অনিল চ্যাটার্জীর মৃত্যুকে সেই দুর্ঘটনার অংশ হিসাবেই দেখানো গেছে।
“স্যার, আমাদের মন খারাপের কিছু নেই। একটি বিষয় ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি, আমাদের বিশ্বটি তাদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। আর যাই হোক, তারা আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আরেকটা বিষয়, আজ আমাদের এই এক্সপেরিমেন্ট না হয় বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ভবিষ্যতে নতুন করে কেউ এই কাজ করবে না সেটার তো কোনও নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।”, চোখেমুখে স্পষ্ট ভয় ফুটে উঠে ব্রানডনের।
“এটা নিয়ে ভাববেন না। আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গবেষকদের একটি দল নিয়ে কীভাবে ওই বিশ্বের সঙ্গে নিরাপদের যোগাযোগ করা যায় তা নিয়ে কাজ করে যাব। এত বড় একটা এক্সপেরিমেন্ট ব্যাক্তিপর্যায়ে পরিচালনা করা উচিত হয়নি। যেখানে দু’দুটি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত।” চিন্তিত মুখে বলে প্রত্যয়। “তবে মিস্টার ব্র্যানডন, একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছি না?”
“কোন বিষয়টা?”
“পার্টিক্যাল কোলাইডারে নিউক্লিয়ার বিষ্ফোরণ কী করে হল? আমার কোনও হিসাবেই এটা মিলছে না।”
“ড্যানিয়েল মুর, আমার গ্র্যানপা ছোটবেলা থেকেই এই এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে সাবধান করেছেন। অত্যন্ত গোপনে আমাকে ধীরে ধীরে তৈরি করেছেন। আমি শুরু থেকেই এই পরীক্ষার পরিণতির কথা জানতাম। ওই বার্তাটা এসেছিল লোহার গোলকটি ওই বিশ্বে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বিশ্ব শূন্যে মিলিয়ে যেত, সঙ্গে আমাদেরটাও। আর এটা হত তাৎক্ষণিক। তাই যে কোনও মূল্যে এটাকে থামাতে হত।”
ব্যান্ডেজ করা বা হাতটা চোখের সামনে একটু নেড়েচেড়ে পুনরায় বলেন, “জিরো আওয়ারের কয়েক ঘণ্টা আগে আমি লোহার গোলকটা বদলিয়ে একই সাইজের ওয়েপন গ্রেডের এনচিড ইউনিরেনিয়ামের একটি গোলক রেখে আসি। সেই সঙ্গে আরেকটা কাজ করি, ওই ফ্রেমটি এক সেন্টিমিটার ডানদিকে সরিয়ে দিই। এর ফলে হাই রেজুলেশন পার্টিক্যাল বিম গোলকটির চারপাশের স্পেসে আঘাত না করে, সরাসরি এটার উপর আঘাত করে। আর এতেই চেইন-রিএকশন আর তারপর বুম!, তবে অন্য যে কোনও ক্ষেত্রেই আমি কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই অস্বীকার করব।”
“আপনার গ্র্যানপা ড্যানিয়েল মুর গ্রেট ম্যান। ইতিহাস তাকে কীভাবে বিচার করবে আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে তিনি আজীবন নায়ক হয়ে থাকবেন। দুটি মহাবিশ্বকে রক্ষা করার সুযোগ বারে বারে আসে না।”
মুখটা ভার করে ব্র্যানডন বলেন, “গ্র্যানপা আমাকে ব্যাকআপ ডিফেন্স হিসাবে তৈরি করেছেন। তিনি কিন্তু কখনও আমাকে বলেননি যে অতীত থেকে ভবিষ্যতে এই সিগন্যালের সিস্টেমও তিনি করে রেখেছেন। আমি এখন বুঝতে পারছি তার পরিকল্পনা ছিল যদি আপনারা স্বেচ্ছায় এই এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করে দেন তাহলে তো আর সাবোটাজ করার দরকার পরবে না!”
প্রত্যয় চুপ করে বসে ছিল। ব্র্যানডন মুর খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “স্যার। আমি নিজেও একজন পদার্থবিদ কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার আমার কাছে একদমই পরিষ্কার নয়। আপনি যদি একটু সাহায্য করেন।”
“নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। বলো কী জানতে চাও?”
“প্রথমত, একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আমাদের বিশ্বের ক্ষুদ্র একটি বস্তু যদি প্রতিবিশ্বে প্রবেশ করেই, তার জন্যে সম্পূর্ণ একটি মহাবিশ্ব কী করে ধ্বংস হয়ে যাবে? বড়জোর অল্পকিছু স্থান ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে! এই বিষয়টা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।” ব্র্যানডন মুর মাথা চুলকে বলে উঠলেন।
প্রত্যয়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, “প্রথমে বলো ১.৭৩২০৫ এই সংখ্যাটার তাৎপর্য কী তুমি বুঝতে পেরেছিলে?”
ব্র্যানডন মাথা নাড়ল।
“তোমার দাদু পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। আমাদের সময় ১.৭৩২০৫ দিন সামনে গেলে গর্তটি ১ দিন পেছনে চলে যায়। এই ১.৭৩২০৫ সংখ্যাটি হল একটি একক ঘনকের কর্ণের দৈর্ঘ্য।”
ব্র্যানডন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্রত্যয়ের দিকে।
“এর থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয় ওই বিশ্বে সময়ের তিনটি মাত্রা। যেহেতু তাদের সময়ের X, Y ও Z এই তিনটি মাত্রা; তাই আমাদের এখানে এসে এটি একদিকে প্রবাহিত হচ্ছে; অর্থাৎ X, Y ও Z বিশিষ্ট একটি ঘনকের কর্ণ বরাবর। এক্ষেত্রে ঘনকটি হল সময় ঘনক।”
ব্র্যানডন ঢোঁক গিলল। “কিন্তু একটা ক্ষুদ্র মার্বেল গুলি কি করে… ”
“আসছি, আসছি।” প্রত্যয় হাত নাড়ল। “এখন তাদের সময়ের মাত্রা যেহেতু তিনটি, তাই স্থানের মাত্রা একটি। তার মানে সেই জগতের স্বত্তারা এক জায়গায় স্থির অথবা কেবল এক সরল রেখা বরাবর চলতে পারে। কিন্তু সময়ের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে তারা বিচরণ করতে পারে। এখন আমাদের বিশ্বে ত্রিমাত্রিক বস্তুর প্রকৃতি কেমন? ধর একটি ত্রিমাত্রিক বই, এর X, Y ও Z তিনটি মাত্রা, মানে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। এখন মনে কর এই বইটিতে একশোটি পাতা আছে। প্রতিটি পাতা একটি দ্বিমাত্রিক বস্তু, যার কেবল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে কিন্তু উচ্চতা নেই। কিন্তু আসলে তো অতি ক্ষুদ্র হলেও প্রতিটি পাতার একটি উচ্চতা আছে। তাই না? এই কারণে এটিতে একশোটি পাতা আছে। কিন্তু যদি প্রতিটি পাতা শূন্য উচ্চতা বিশিষ্ট হয়, তবে বইটিতে কতগুলো দ্বিমাত্রিক পাতা আটবে?”
“অসংখ্য। অগুন্তি। সেক্ষেত্রে বইটিতে শূন্য উচ্চতার পাতার সংখ্যা হবে অসীম। যেমন, একটা দ্বিমাত্রিক পাতায় অসীম সংখ্যক এক মাত্রার সরলরেখা আঁকা যায়। তোমাকে জবাব দিতে হবে না।” ব্র্যানডন বলে উঠল।
“এবার বুঝে নাও, আমাদের একটি ত্রিমাত্রিক বস্তু যদি এক স্থানিক মাত্রার কোনও বিশ্বে প্রবেশ করে তবে সেখানে এটি হবে “অসীম টু দ্য পাওয়ার অসীম টু দ্য পাওয়ার অসীম! এই কারণে আমাদের একটি বই-এর পাতা কিংবা একটি অণুও যদি সেই বিশ্বে প্রবেশ করে তাহলে সেটি ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংস বলতে আমি বুঝাচ্ছি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। একেবারে নেই, হাওয়া; পার্ফেক্ট শূন্যস্থান।”
“কিন্তু তাদের বিশ্বে তো কোনও বস্তু নেই! তাদের বিশ্বে স্থানের একটি মাত্র মাত্রা! তাঁরা কী করে ওই শূন্যস্থান তৈরি করল আমাদের পৃথিবীতে?”
“ওই শূন্যস্থানটা সম্পর্কে তোমার দাদুর পরীক্ষাগুলো সবই দেখেছি। আমার মনে হয় ওঁরা তাদের বিশ্ব থেকে বিপরীত সময়ের তরঙ্গ পাঠাচ্ছিল। সেই বিপরীত সময়ের তরঙ্গ এখানে এসে আমাদের বিশ্বের সময়ের একটি মাত্রাকে শূন্য করছিল। আমার ধারণা গর্তটির ঠিক কেন্দ্রের উপর সময় স্থির হয়ে আছে। অবশ্য সেটা পরীক্ষা করার কোনও উপায় কখনই ছিল না।”
“কিন্তু সেক্ষেত্রে তো তাদের বিশ্ব থেকে আমাদের এখানে যে মুহূর্তে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে তার পরমুহূর্তেই সেই শূন্যস্থানটি আবার ভরাট হয়ে যাওয়ার কথা!”
“তোমার এই প্রশ্নটি অত্যন্ত যৌক্তিক। এখন তারা যেহেতু সময়ের ভেতর চলাচল করতে পারে, তাই ঠিক যেই সময়ে এই গর্তটি তৈরি হয়েছে ঠিক সেই সময়টিকে তারা স্থির করে রেখেছে। তাই এই গর্তটি মিলিয়ে যাচ্ছে না। আবার ভেবে দেখে, তারা দুইটি কাজ একসঙ্গে করছে; প্রথমত এই গর্তটি তৈরি করেছে আবার ঠিক এই সময়েই তারা একটি বার্তা ক্রমাগত পাঠিয়ে যাচ্ছে। তারা সময়কে স্থির করে রেখেছে এখানে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ব্র্যানডন বলে, “কী অদ্ভুত সেই স্বত্তা তাই না? তারা সময়ের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে বিচরণ করে, কিন্তু হয়তো এক স্থানে চিরস্থির হয়ে আছে! কেমন সেই স্বত্তা! আমার কল্পনাতেও ধরছে না! আচ্ছা আর একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না!”
“কী?”
“ওই প্রতিবিশ্বের শূন্যস্থানটা কঙ্গোর ওই বনভূমিতেই কেন তৈরি করল তারা? আর সেই সময়ে কেন? সরাসরি হাসন দ্বীপে আমাদের সময়েও তৈরি করলেও তো হত, তাই না?”
“কী জানি! হয়তো তারা এই সময়েই তৈরি করেছে, কিন্তু সময়ের বিপরীত প্রবাহের কারণে এই অতীতে চলে গেছে। এখন আর তা কোনওভাবেই বোঝা সম্ভব নয়।”
“আর স্থান?”
“তারা যেহেতু এক স্থানে চিরস্থির, হয়তো ঠিক কঙ্গোর ওই স্থানের বিপরীত স্থানেই তারা অবস্থান করছে, তাই সেখানেই ওটি তৈরি হয়েছে। আসলে প্রকৃত সত্য হয়তো আমাদের পক্ষে আর জানা সম্ভব হবে না কখনও।”
ব্র্যানডন নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। প্রকৃত সত্য জানা সম্ভব নয় শুনে মনে মনে সে বেশ দমে গেছে।
প্রত্যয় ব্র্যানডনের আশাহত মুখ দেখে বলে, “আমাদের এক্সপেরিমেন্ট কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আমরাই প্রথম কোনও এক্সপেরিমেন্ট না করেও এক্সপেরিমেন্টের সফল ফলাফল হাতে পেয়ে গেছি।”
“কী বোঝাতে চাচ্ছেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন ব্র্যানডন।
“আমরা এখন নিশ্চিত করে জানি প্রতিবিশ্বের অস্তিত্ব আছে, সেটির মাত্রার প্রকৃতিও আমরা জানি। তার মানে ইউনিভার্সের শূন্য থিয়োরিটাই সত্য হল। সকল কিছু শূন্য হতে সৃষ্টি হয়েছে।”
“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, ঈশ্বরের অস্থিত্ব নেই? একক মৌলিক বল বলে কিছু নেই? ছয়টি মৌলিক বলকে একিভূত করলে সেগুলো শূন্যে মিলিয়ে যাবে?”
“এই বিষয়টি আমি এখনও নিশ্চিত নই, মিস্টার ব্র্যানডন। আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে মনে হবে, ঈশ্বর হয়তো সকল কিছু শূন্য হতেই সৃষ্টি করছেন। হয়তো ঈশ্বরের অস্থিত্ব আরও উপরে; আমি আসলেই জানি না। ঈশ্বরের পূর্ণরূপ হয়তো আমরা কোনওদিনই বিজ্ঞান দিয়ে বের করতে পারবো না।”
আচমকা নিরবতা নেমে আসে রুমজুড়ে। দুইজন বিজ্ঞানীর হৃদয়ে একসঙ্গে দুটি শব্দ বেজে উঠে “ওহ! ঈশ্বর!”
উপসংহার
ঠিক তিনমাস পর সকল সমীকরণ, বার্তা, প্রাপ্ত সকল ডেটা ও ছবি পর্যাপ্ত ব্যাখ্যাসহ একটি ফাইলে ঢুকিয়ে পরিকল্পনা মতো ইমেইল শিডিউলে যুক্ত করে ছেড়ে দেয় ড্যানিয়েল।
পাশে বসে মাইক বলে “আচ্ছা, আমাদের এই পরিকল্পনা সফল হয়েছে কী না তা কি করে বুঝতে পারবো?”
“একটা উপায় আছে, দাঁড়া দেখি কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না।” বলেই দ্রুত স্যাটেলাইটের ইমেজ খুলে বসে ড্যানিয়েল। অবাক হয়ে তারা দেখে সেই পরম শূন্যস্থানটির অস্বিত্ব আর নেই!
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে মাইক। ড্যানিয়েলকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো আনন্দে লাফাতে থাকে আর চিৎকার করে বলতে থাকে “আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে! সফল হয়েছে!”
“আমি এখনও নিশ্চিত নই” মুখ ভার করে বলে ড্যানিয়েল। “পরম শূন্যাস্থানটি অস্তিত্বহীণ হয়ে গেছে এর দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে, এক- হয়তো আমাদের এই মেইল পেয়ে তারা পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে, তাই প্রতিবিশ্বের স্বত্তাও পোর্টাল বন্ধ করে দিয়েছে। দুই- তারা পরীক্ষা চালিয়েছে, আর এর ফলে সেই মহাবিশ্বটি ধ্বংস হয়ে গেছে!”
মাইক ধপ করে বসে পড়ে ড্যানিয়েলের পাশে। তাঁর কণ্ঠ থেকে একটাই শব্দ বেরিয়ে আসে। “ঈশ্বর!”
বিশেষ কৃতজ্ঞতা – অঙ্কিতা
Tags: উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মোহাম্মদ সাইফূল ইসলাম, সৌরভ দে
একটি অসাধারণ উপন্যাস। পড়ে অভিভূত হলাম। তবে উপন্যাসে প্রতিবিশ্বের যে দুটি কাল্পনিক মডেলের কথা বলা আছে, সে’দুটির একটি আমাদের চতুর্মাত্রিক বিশ্বের additive inverse এবং অপরটি আমাদের বিশ্বের multiplicative inverse. সে’ক্ষেত্রে দুটি মডেলেরই x, y, z এবং t ― এই চারটি মাত্রা ঋণাত্মক হবে না বলেই মনে হয়। শুধুমাত্র additive inverse প্রতিবিশ্বের ক্ষেত্রে মাত্রাগুলির ভ্যালু ঋণাত্মক হবে, অর্থাৎ যে প্রতিবিশ্ব ও আমাদের বিশ্ব শূন্য থেকে শুরু বলে গল্পে মনে করা হয়েছে। অন্য প্রতিবিশ্বের মডেলটির ক্ষেত্রে অর্থাৎ যেটিতে সবকিছু এক বা একক শক্তিদ্বারা সৃষ্টি বলে মনে করা হয়েছে, মাত্রাগুলি ধনাত্মক ও আমাদের বিশ্বের মাত্রাগুলোর reciprocal হবে। তাছাড়া, প্রথম মডেলের একমাত্রিক সময়কে ঋণাত্মক ধরলে আমরা আরেকটি সমস্যার সম্মুখীন হব ― সেটি হল Big Bang-এর সময় থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়া।
তবে উপন্যাসটির অভিনবত্বের জন্য লেখকের আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন প্রাপ্য।
অনেক ধন্যবাদ দাদা। আপনি চমৎকার কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরেছেন।
ঠিকই বলেছেন, Multiplicative inverse এর মাত্রাগুলো ঋণাত্মক হওয়ার চান্স নেই। গল্পে এই বিষয়টাকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছি ইচ্ছাকৃতভবেই। প্রত্যয় যে ফাংশনের মাধ্যমে আমাদের ইউনিভার্সকে ডিফাইন করেছে সেই ফাংশনটাকে উহ্য রেখেছি। যদি এই ফাংশনে একটি ইমাজিনারি কোফিশিয়েন্ট চলে আসে তাহলে ইনভার্স ঋণাত্মক (যদি আমাদের বিশ্বে ধনাত্মক হয়) হবে। আর এই বিষয়টা ভেবেই এখানে মাত্রার সাথে ইউনিভার্সের ফাংশনটির কো-রিলেটের ব্যাপারটাও উহ্য রেখেছি। তারপরেও এটা নিছকই কষ্টকল্পনা, স্বীকার করছি। পরবর্তি লেখায় এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকবো।
দ্বিতীয় পয়েন্ট, একমাত্রিক সময়ের ঋণাত্মক বিষয়টা। এটা আমার কাছেও ক্লিয়ার না, ব্যাপারটা ধারনাই করতে পারছি না। পুরো বিষয়টাই বিমূর্ত। উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা বলতে পারেন। অপারগতা স্বীকার করে নিচ্ছি।
সবশেষে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, চমৎকার আলোচনা করার জন্যে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখলাম।
লেখাটি পড়ে দারুণ লাগলো…..গল্পে Multiplicative & additive universe এর কথা তুলে ধরা হয়েছে আর Big Crunch এর তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়েছে।
দারুন লাগল , এরকম আরও লেখা চাই
অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।
এইরকম হার্ড সাইফি বাংলায় পড়তে পাব – এমনটা কখনও ভাবিনি। সত্যিই আন্তর্জাতিক মানের লেখা। পড়ানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আগামী লেখালেখির জন্য রইল অজস্র শুভকামনা।
অনেক ধন্যবাদ গাঙ্গুলী ভাই। আপনার মত গুণী মানুষের প্রশংসা আমার পরবর্তি লেখাতে অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করবে। শুভেকামনা রইল।
অসাধারণ লাগল উপন্যাসটি। বাংলায় যে হার্ড সাইফি লেখা সম্ভব এবং সেটা ভীষণ মনোগ্রাহী হয়ে উঠতে পারে তা আপনার এই লেখাটি পড়লে বোঝা যায়। এর আগেও কল্পবিশ্বে আপনার আরেকটি উপন্যাস পড়ে খুব ভাল লেগেছিল। নামটা মনে পড়ছে না। কণাবিদ্যা নিয়ে লেখা সম্ভবত এটিই প্রথম বাংলা উপন্যাস। আপনি হার্ড সাইফি লিখলেও তা আপনার ভাষার গুণে খুবই প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে। অনেক শুভেচ্ছা।
অনেক ধন্যবাদ পার্থ’দা। আপনার চমৎকার কমেন্টে অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
আপনি মনে হয় সময় ভ্রমণ নিয়ে লেখা “অকালচক্রের কাঁটা” গল্পটার কথা বলছেন।
ভাষার কারুকাজ এর পেছনে সিংহভাগ কৃতিত্ব আমি কল্পবিশ্বকে দেব। বিশেষ করে অঙ্কিতাদি অবদান অনস্বীকার্য। মনে হচ্ছে আমি কংকাল জাম দিয়েছিলাম; আর কল্পবিশ্ব গোস্ত, চামড়া যুক্ত করে পূর্নতা এনে দিয়েছে। কমেন্টের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখলাম।
আপনাকে আবারও ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।
সাধু , সাধু । অভিভূত হলাম ।
অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।
চমৎকার জমজমাট একটা গল্প। বেশ সাবলিলভাবে চতুর্থ অধ্যায় পর্যন্ত গল্পের কাহিনি এগিয়েছে। কিন্তু যেহেতু সফট সাইফাই নয়, তাই এরপরে পাঠকের মস্তিষ্কে একটু অনুরণনের পালা। একটু চিন্তাভাবনা, বারবার পড়া- এভাবেই একটা সময় মাঝের অংশটুকুতে তার ‘আহা! মোমেন্ট’টি পেয়ে যাবেন। গল্পের কাহিনি বেশ উপভোগ্য। আনপ্যারালাল স্টোরিলাইন গল্পটির একটি বৈশিষ্ট্য। অনেকদিন ধরেই এমন একটা স্টোরিলাইনের খোঁজে ছিলাম। এবার পেয়ে গেলাম। পাঠককে আটকে রাখার চেষ্টা পুরো গল্পেই লক্ষণীয়। ছোট হোক বা বড়, গল্প যদি গল্পকার যত্ন নিয়ে লেখেন, তাহলে সেটা অনুভব করা যায়, ভালোও লাগে। আমারও সেরকমই অনুভূতি।
আরো উন্নত করার চিন্তায় মাঝের তত্ত্বীয় অংশটিকে একটু সাবলিল করার চিন্তাটা লেখক মাথায় রাখতে পারেন।
অনেক ধন্যবাদ রুশদী।
গল্পের ভাষা ও সহজিকরণ এর ক্ষেত্রে অনেকটা কৃতিত্ব কল্পবিশ্বের অঙ্কিতা’দির। প্রথমে তো আরও দুর্বোদ্ধ ছিলো। তাঁর কাঁটাছেড়াতেই না অনেকটা সহজ হয়েছে
শুভকামনা রইল।
যদিও ব্যাকগ্ৰাউন্ড থিওরির ওপর আমার জ্ঞান যৎসামান্য, তারপরেও ‘লেম্যান’ হিসেবে গল্পটি দারুণ উপভোগ করেছি কাহিনির অভিনবত্ব আর গতির জন্য। ভবিষ্যতে আরও এই জাতীয় সৃষ্টির অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক ধন্যবাদ। চমৎকার মন্তব্য দিয়ে উৎসাহিত করার জন্যে। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল অনেক।
অসাধারণ লেখা। কল্পবিশ্ব ছাড়া এরকম হার্ড সাইন্স ফিকশন নিয়ে লেখা কোথাও পাব না, সেই বিশ্বাস আমার অনেকদিন আগে থেকেই ছিল। যাই হোক, লেখকের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানলাম। বিজ্ঞানের প্রতিপাদিত থিওরির সঙ্গে একটা কাহিনীকে মেশাতে গেলে কি পরিমাণ মাথা ঘামাতে হয়, সেটার খানিকটা অভিজ্ঞতা আমার আছে। এমন আন্তর্জাতিক মানের লেখা লিখতে প্রচুর পরিশ্রম আর গবেষণার দরকার। সবচেয়ে বড় ভাবনা, যাঁরা আদৌ বিজ্ঞানের তত্ব জানতে আগ্রহী নয়, তাঁদের গল্পটা আটকে রাখতে পারবে কি না? বেশিরভাগ অংশেই লেখক সেটা পেরেছেন। বাংলায় হার্ড সাই ফাইয়ের অভাব খানিকটা তো আছেই, সেটা আপনি ভরাট করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস। কয়েকজন অন্তত সেই কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে দেখে সত্যিই ভাল লাগছে।
অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ঠিকই বলেছেন। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোকে সহজে প্রকাশ করা একটা আর্টই বলা চলে৷ এই আর্ট এখনো পুরোপুরি আয়ত্বে আনতে পারিনি। কল্পবিশ্বের সম্পাদকমণ্ডলী অনেক খেটেছেন এই গল্পটিকে সহজবোধ্য করার ক্ষেত্রে।
এখনো লেখা শিখছি, আশা করি সাথে থেকে এমনিভাবে উৎসাহিত করবেন।
মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলিতে আলোড়ন সৃষ্টি করার স্পর্ধা সব ক্ষণজন্মা লেখকের হয়না। সাইফুল বাবুর এই লেখা পড়ে ভাবতে বসতে হয়েছে। অঙ্ক আমার কাছে চিরকাল ভয়পাতালের প্রহরী হয়েই ছিল। এই গল্প পড়ে আন্দাজ করা যায় লেখকের পড়াশুনো দিগন্ত বিস্তৃত ব্যাপ্তি এবং ভাষার ঈর্ষণীয় দক্ষতা সম্পর্কে। পরবর্তী সৃষ্টির জন্য স্বভাবতই মুখিয়ে থাকবো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ সোহম’দা। আপনার লেখা গল্পের মতোই আপনার কমেন্টের ভাষা! কী শৈল্পিক বাক্যগঠন, কী চমৎকার শব্দের প্রয়োগ! গ্রেট। নশ্বর গল্পটা পড়েই আপনার লেখার ভক্ত বনে গেছি।
এই গল্পের ভাষার কারুকাজের অনেকটা কৃতিত্ব কল্পবিশ্বের সম্পাদকমন্ডলির, বিশেষ করে অঙ্কিতা’দির।
এমন কমেন্ট ও উৎসাহ পেলে ইচ্ছা হয়, এক্ষণি দৌড়িয়ে আরেকটা গল্প লিখে ফেলি। অনেক ধন্যবাদ আবারও। শুভকামনা রইল।
দারুণ লিখেছেন। এক কথায় অসাধারণ একটি উপন্যাস। আপনার কাছে এরকম আরো অনেক লেখা পাবো আশা করি!…
অনেক অনেক ধন্যবাদ চমৎকার কমেন্ট করে উৎসাহিত করার জন্যে। শুভকামনা রইল।