এক কল্পবিজ্ঞানীর কথা
লেখক: সঞ্জয় বোস
শিল্পী: সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
সেদিন বিকেলবেলা জানালার পাশে বসে আছি। দেখি এক ঝাঁক পাখি আকাশ জুড়ে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে উড়ে চলেছে। আমার দেখতে বেশ লাগলো। এমন করে ওরা একবার শীতের আগে উড়ে আসে, আবার শীতের শেষে। ওদের সাথে সাথে গোধুলির আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার চোখে কেমন রেশ লেগে যায়। তখন পুরনো অনেক কথা ছায়াছবির মত চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হয়ত এরকম সবার সাথেই ঘটে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে।
কাকতালীয় ভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে কল্পবিশ্বের এক বন্ধুর সাথে আলাপ হয়ে গেল। আর সত্যি বলতে কি ওঁর সাথে কথা বলতে বলতে সেদিনের বিকেলবেলায় কিছু স্মৃতি কথার ছলে বলে ফেললাম। সেই সময়ের কথা ভাবতে বসে আজ হাসি পায়, তবুও দেখতে দেখতে প্রায় চব্বিশ বছর পেরিয়ে গেল। এখন সেই ঘটনাটি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে “ক্লাসিক” এর পর্যায়ে বোধহয় ফেলা চলে – অন্তত আমার জীবনে।
তখন কলকাতার পাট তুলে পাকাপাকি ভাবে দিল্লিতে এসে বসবাস শুরু করেছি, কেন বা কি পরিস্থিতিতে সেটা এখানে অপ্রয়োজনীয় বলে আর বলছি না। তা সে যাই হোক, সদ্য কলকাতা ছেড়ে এসেছি। দিল্লির চাকচিক্যে আমার ছোটবেলার শহরের অনেক কিছু, কিশোর মন নিজের অবচেতনে স্মৃতির মনিকোঠায় জমা করতে শুরু করে দিয়েছে। এখানে বলে রাখি, পরের দিকে যত বয়স বেড়েছে, আমি ওই শহরটির প্রতি ধীরে ধীরে নতুন ভাবে আকৃষ্ট হয়েছি, কিন্তু মন যতবার ফিরে যেতে চেয়েছে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আর অনুমতি দেয় নি।
সেটা ১৯৯৩ বা ৯৪ সাল হবে। তখন কলকাতা ময়দানে বইমেলা হত। আরো অনেক পরে অনুষ্ঠানটি স্থানান্তারিত হয়। তবে প্রকৃত অর্থে “ওল্ড স্কুল চার্ম” বলতে যা বোঝায় সেটা ওই ময়দানের ধুলো মাখা দিন গুলোতে হারিয়ে গেছে। আজকাল বই এর প্রতি মানুষের প্রবণতাও কমেছে, এবং সংবেদনশীলতাও। কত পর্যাবরণ বিশারদদের এর নিষেধ মেনে, সবুজ কে ধ্বংস করে, শহর ও শহরতলির সুউচ্চ অট্টালিকার সারি মাথা তুলে দাঁড়ায়; অথচ দিন সাতেক এর বই এর আঘ্রান পাওয়া ময়দান না জানি কোন বিধি নিয়ম এর মানদণ্ড ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে দিল। আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তার হিসেব দিতে দিতে প্রায় দশ বছর পার করে দিলেন।
সেবার মেলায়, পকেটে পয়সা বড় কম। এই স্টল, সেই স্টল ঘুরে ঘুরে কল্পবিজ্ঞান আর অতি প্রাকৃতিক বই খুঁজে চলেছি পুরো দমে। পত্রভারতী আর ফ্যানট্যাসটিক স্টল এ ঢুকলে, বেরোতে আর মন চাইত না। সেই সময় কিছু এমন বই পেয়েছিলাম যার সমতুল্য আজও খুঁজে পাইনি কোনো বাংলা বইমেলায়। সেই সময়ের অনেক লেখক এখনো লেখেন, তবে লেখায় তেমন আবেগ পাই না আর। যা হোক, বোধ হয় পত্রভারতী বা ফ্যানট্যাসটিক এর স্টলে সেবার ঢুকে দেখি স্বয়ং শ্রী অদ্রীশ বর্ধন মহাশয় বসে আছেন। আমার তো দেখেই যাকে বলে পায়ের নিচের থেকে মাটি সরে যাবার উপক্রম! উনি যে আমার আরাধ্য দেবতার মতন! আর দেবতা নিজে উপস্থিত! সত্যি বলতে কি, আমার সেই কিশোর মনে, ঘটনাটা যে কি ছাপ ফেলেছিল, সেটা যারা কোনো লেখকের ভীষণ বড়ো ভক্ত, তারাই একমাত্র বুঝতে পারবেন বলে আমার ধারণা।
ওনার লেখা হেন বই ছিলো না যা আমি পড়িনি, বলাই বাহুল্য সেগুলোর সিংহ ভাগ, অতিপ্রাকৃতিক অথবা কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক রচনা। তখন অবশ্য ইন্দ্রনাথ রুদ্রের গল্প শুরু করিনি, পরে কিছু পড়ে দেখেছি, ভালো লাগেনি। ওনার হাতে সবচেয়ে বেশি খুলতো “অতীন্দ্রিয়” লেখন শৈলী। কোন সেই ক্লাস সিক্স এ পড়ার সময়, এক সহপাঠী “হাঙ্গরের কান্না” বইটি উপহার দেয়। সেটি বহুবার পরেও মনের তৃষ্ণা মেটাতে পারিনি। দুটো গল্প আজ ও আমাকে ওই বইটির “হন্ট” করে, এক “উল্কা” এবং “প্রলয় এনেছিল পারার ধূমকেতু”।
এরপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওনার লেখা পড়েছি। এমন ও ঘটেছিলো যে, কোথাও “অদ্রীশ বর্ধন” নাম চোখে পড়লেই থেমে যেতাম। ওনার লেখা “গাছ” গল্পটি পড়ে, সেই অল্প বয়সে স্তম্বিত হয়ে গেছিলাম। অনেকবার ভেবেছি ভদ্রলোক কি করে অমন লিখলেন? কি করে অমন করে ভাবলেন, যেমন করে আমি নিজেও ভাবতে চাই! মনে মনে কল্পনা করেছি, হয়ত উনি আমাদের চিরাচরিত জগতেরই কেউ নন – অন্য কোনো সমান্তরাল ব্রহ্মান্ডের অধিবাসী!
তখন বয়সটা অতিপ্রাকৃতিক আর বিকট রসের সাহিত্যের দিকে পূর্ণ মাত্রায় কেন্দ্রিত ছিল। অদ্রীশ বর্ধনের লেখা তাতে সংযোজন করে সহজ লভ্যতা, মনের মতন ভাষা আর অজানা অন্ধকারের হাতছানি। আমি আজও সেসব দিনের কথা ভুলিনি, ভোলা সম্ভব নয়। একদিকে, “পো”, “বিয়ার্স”, “কোনান ডয়েল”, “আসিমভ” দের মতন লেখকদের রচনা সম্ভার, অন্যদিকে অদ্রীশ বর্ধন, ক্ষিতিন্দ্র নারায়ণ, ত্রিদিব চ্যাটার্জি ইত্যাদিদের লেখা পড়ে নিজেকে সম্পূর্ণ অন্য জগতের মধ্যে খুঁজে পেতাম।
ফিরে আসি আবার মূল ঘটনায়, না হলে এই লেখা শেষ করতে করতে কোথায় যে পৌছে যাব তা আমার নিজের কাছেই অজানা।
সেবারের স্টল এর দরজার সামনে টেবিল এর ওপাশে বসে ছিলেন উনি। দোকানে যেই ছেলেটি বই বিক্রির কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তাকে জিজ্ঞেস করতেই, বুঝলাম আমার ধারণা অভ্রান্ত। তখন ওনার মাথায় কাঁচা পাকা চুল, এবং দাড়ি রাখা শুরু করেন নি।
ওনার একটা বই কিনে, দুরু দুরু বক্ষে, এগিয়ে যাই টেবিলের কাছে। তখন উনি যতদুর মনে পড়ে আরো কিছু মানুষের ভিড়ে ঘেরাও হয়ে বসেছিলেন। আসলে অত দিনের পুরনো স্মৃতি, সবকিছুর স্থান কাল আজ তেমন মনে নেই।
আমি ভিড় ঠেলে অনুরোধ করি যদি উনি একটি নিজের সাক্ষর বইটির উপরে লিখে দেন। বলতে পারেন তখন রীতিমত বস্তুকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিলাম আর কি। বন্ধুসমাজে দেখাবো লেখকের “অটোগ্রাফ”! কম বড় কথা নাকি? তার থেকেও বড় কথা, সংগ্রহে থাকবে ওনার হাতের লেখা। যতবার বই খুলবো ততবার চোখের সামনে ভাসবে ওনার নিজের হাতে লেখা নাম।
বই মেলে ধরতেই উনি পাশের ভদ্রলোককে বললেন যে, অযাচিত ভাবে এমন করে যেন আর কেউ ওনাকে বিরক্ত না করে, সেদিকে নজর রাখতে। আর আমার দিকে ফিরে বললেন – “এমন আপনারা করলে তো ভারী মুশকিল হয়।”
আমি আমতা আমতা করে বলি —“একটা অটোগ্রাফ স্যার”। (এরকমই কিছু একটা কথোপকথন হয়েছিল)
যতদিন কলকাতায় ছিলাম, এবং দিল্লি ফেরার পথে, মাথার ভেতরে একটাই কথা ঘুরপাক খেয়েছিল, “কেন উনি অমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন? আমি তো ওনাকে বলতেও পারলাম না, স্যার আমি আপনার হয়ত সবচেয়ে বড় অনুরাগী, আমার অধিকার আছে আপনার হাতের ওই স্বাক্ষরটির উপর।”
দিল্লি ফিরে যতবার বইটা খুলতাম, মনে এক অদ্ভুত ধারণার জন্ম নিত। স্বাভিমানী মনে এমন এক দাগ কেটে গেছিল যার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবসরে গল্পের বই নিয়ে বসলেই মাথার মধ্যে বিরক্তিকর এক চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগত। কাউকে বলতেও ইচ্ছে হত না যে আমার প্রিয় লেখকটি আমাকে একটি অটোগ্রাফ দিয়েছেন যা দেওয়ার ইচ্ছে ওনার ছিল না। অনেক ভেবে চিন্তে এই পুরো ঘটনার পরিসমাপ্তি করি, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পন্থায়। বই থেকে ওনার সই করা অংশটি কেটে, একটি চিঠি সহযোগে পাঠিয়ে দি ওনারই ঠিকানায়। চিঠিতে ঠিক কি লিখেছিলাম আজ আর তা মনে নেই, তবে ভাবার্থ এই, যে অনুরাগী হয়ে এমন ব্যবহার আমার প্রাপ্য ছিল না। আমার মনের ভেতর যে হতাশার জন্ম হয়েছে তার সমাপ্তি এভাবেই হোক। এছাড়া ঘটনাটির বর্ণনাও দিয়েছিলাম, যাতে ওনার মনে পড়ে।
তারপরে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আমিও নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি এই ভেবে যে, এবারে হয়ত উনি বুঝবেন অনুরাগীদের বঞ্চনা করলে কষ্ট পেতে হয়।
একদিন অফিস ফেরত বাবা একটা খাম নিয়ে আমাকে দিলেন। বললেন, “তোর জন্য এসেছে”।
অবাক হয়ে দেখি অদ্রীশবাবুর চিঠি! লিখেছেন, ম্যালেরিয়া বা ওরকম কোনো রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে উনি অনেকদিন পর বইমেলায় জনসমক্ষে এসেছিলেন, তাই অতিরিক্ত ভীড় এবং শারীরিক দুর্বলতার জন্য উনি অপারগ ছিলেন। আন্তরিক ভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে পাঠক হিসেবে আমার মঙ্গল কামনা করে চিঠি শেষ করেন।
এক্ষেত্রেও আমার পুরো বয়ান মনে নেই, কারণ সেই চিঠিটি আমি হারিয়ে ফেলেছি। হয়ত আজও কোনো বইয়ের ভাঁজে রয়ে গেছে। এরপর পুরো ঘটনার পূর্ণ সমাপ্তি ঘটিয়ে ওনাকে আর একটি চিঠি আমি লিখেছিলাম, যার উত্তর আমি পাইনি।
তারপরে সময়ের হাত ধরে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। দিল্লির সেই পুরনো বাড়ি ছেড়ে চলে যাই নতুন আর এক ঠিকানায়। ঠিকানা বদলায় আর বদলায় আমার বই পড়ার বিষয়গুলোও। এরপর নানা বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়তে পড়তে, কোথাও যেন অদ্রীশ বর্ধন হারিয়ে গেলেন।
অতিন্দ্রীয় বা অতিমাত্রিক লেখার আরো অনেক বইয়ের সাথে পড়লাম জীবন যুদ্ধের কত কাহিনি। নানা রকমের বই এর হাত ধরে মনের ভেতরে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে নিলেন আর এক অতিন্দ্রীয় কবি – জীবনানন্দ দাশ।
“কল্পবিশ্বে“ শুরুর দিন গুলোর থেকে সাথে জুড়ে আছি, পড়ে চলেছি সুন্দর রোমাঞ্চকর সব লেখা। নতুন লেখক/লেখিকাদের হাত ধরে উঠে আসছে দারুন দারুন সৃষ্টি, বুঝতে পারি আজ এই বিষয়টা নিয়ে মানুষ পড়ছে, ভালবাসছে। আমি ভাবতেও পারিনি “লাভক্রাফট” নিয়ে বাংলা ভাষায় এমন সুন্দর একটি সংখ্যা এখানে পড়তে পারবো।
মনে পড়ে, ১৯৯৭/৯৮ সালে আমি মেটাল মিউজিক নিয়ে এমন ভাবে ডুবে থাকতাম, যে অনেকে বলত “এসব কি শোন?” তখন “ওপেথ”, “মাই ডায়িং ব্রাইড”, “প্যারাডাইস লস্ট”, বা “লেক অব টিয়ারস” দের নাম খুব কম মানুষই জানতেন। আজ এদের গান অনেকেই শুনছেন। বাংলা ব্যান্ড এর হাত ধরে মেটাল অনেক উপরে উঠে এসেছে। কল্পবিজ্ঞান ও অতিপ্রাকৃতিক সাহিত্যেরও যেন বিগত দু বছরে নবজাগরণ হয়েছে বাংলা ভাষায়। শুধু যদি আরো স্থায়ী পাঠক সংখ্যার বৃদ্ধি হত, তাহলে কত নতুন লেখকই না উঠে আসতেন। যা হোক যা চলছে তাই বা কম কিসে?
এই, “কল্পবিশ্বের” প্রথম পর্বে হঠাৎ একদিন দেখি অদ্রীশবাবুর একটি ভিডিও। অবাক হয়ে ভাবি, কি ভীষণ বয়স বেড়ে গেছে ওঁনার। শুনলাম উনি আজকাল আর কলম ধরেন না, হয়ত আর কোনোদিন প্রফেসর নাটবল্টু চক্র কথা বলবে না। বিক্রমজিত উড়ে যাবে না গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, খুঁজে পাব না সেই শিরশিরে গা হিম করা ভৌতিক রচনা গুলো। একটি সম্পূর্ণ দুনিয়া কুয়াশায় ঢেকে যাবে।
পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখে অজান্তেই সেই দিনগুলোর কথা ভেবে হেসে উঠি। ভাবি বয়স তো আমারও বেড়ে গেছে, উনি শুধু প্রবীন হয়েছেন অস্থি চর্মে। আমার বইয়ের ভেতরে আজও উনি অন্য ব্রহ্মান্ডের বাসিন্দা। চির নবীন – অতিন্দ্রীয় ……
“কত যুগ, বছর কেটে গেল হায়, সময়, তুমি ফিরে দেখনি …
প্রজন্ম শেষে সূর্যের তেজ যদি নিভে যায়, এক মুঠো পলাশের রং এ
লেখক, তুমি থেকে যাবে, যুগ যুগ ধরে কোনো মৃত সভ্যতায় …..
শুধু, কিছু পৃষ্ঠা জেনো, তখন ফসিলের রূপ নেবে …”।
Tags: এক কল্পবিজ্ঞানীর কথা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সঞ্জয় বোস, সৌরভ দে, স্মৃতিচারণ
১৯৬৩ বা ৬৪.আশ্চর্য ম্যাগাজিন সবে বের হতে শুরু করেছে, তখন থেকে ওনার লেখা পড়েছি। পরে সমরজিত কর ইত্যাদি পড়েছি।But he is the pioneer in pure science fiction in বাংলা।