একটি অসমাপ্ত কাব্য
লেখক: সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
শিল্পী: সুমন দাস
নাঃ কবিতা লেখা আমার দ্বারা আর হোল না। অথচ এত ভালবাসি আমি কবিতা লিখতে। এই তো আমাদের প্রবীর – কবিতা লেখায় কত নাম ডাক। ফি বছর স্কুলের ম্যাগাজিনে ওর কবিতা প্রথমেই থাকে। আমাদের বাংলার স্যার রমাপ্রসাদ বাবু বলেছেন ও নাকি বড় হয়ে নামজাদা কবি হবে। প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউসন অনুষ্ঠানেও নিজের লেখা কবিতা পড়ে রুপোর মেডেল পেয়েছিল। আমিও কত চেষ্টা করি ভাল কবিতা লেখার। কত পাতা লিখে কেটে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। একবার দূর্গাপূজোর সময়ে মামার বাড়ী বেড়াতে গেছিলাম। শরতের নীল আকাশ, মাঠঘাট সাদা কাশফুলে ছেয়ে গেছে – পুকুরে হাঁসের দল চড়ে বেড়াচ্ছে। আমার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা হঠাৎ জেগে উঠল। পকেট থেকে ছোট খাতাটা আর কলম বার করে লিখে ফেললাম –
শরৎকালের ঝকঝকে রোদ মাঠটি ভরে কাশ।
পুকুর জলে সাঁতরে বেড়ায় গেরস্তদের হাঁস।
চাষীর মেয়েরা বস্তাভরে কাটছে কত ঘাস।
গাছের তলায় চাটাই পেতে খেলছে লোকে তাস।
আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এতদিন যেখানে এত চেষ্টা করেও দুটো লাইন মেলাতে পারতাম না আর আজ কবিতাটা যেন আপনিই কলম দিয়ে বেরিয়ে এল। নিজে পড়ে নিজেরই খুব ভাল লাগল। তবে? – খুলুক না স্কুলটা – দেখে নেব প্রবীরকে এবার।
ভাইফোঁটার পর স্কুল খুলল। আজ আমার মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। প্রবীর কি একটা নতুন কবিতা পড়ছে আর সবাই ওকে ঘিরে শুনছে আর হাততালি দিচ্ছে। ওর পড়া শেষ হলে আমি বললাম –
“শোন তোরা হয়তো জানিস না – কবিতা আমিও লিখি”।
সকলে সমস্বরে বলে উঠল – তুই! তুই আবার কবে থেকে কবি হলি?”
আমি একটু গম্ভীর ভাবে বললাম – “আমি মুখে মুখে কবিতা বানাতে পারি। ঐ যে সামনের মাঠে কাশ ফুটেছে – আমি ঐ নিয়েই কবিতা বানাচ্ছি – শোন”।
‘শরৎকালের ঝকঝকে রোদ মাঠটি ভরে কাশ’ – এই পর্য্যন্ত বলে পরের লাইনটা যেন বানাচ্ছি এ রকম ভাব করে বলতে যাব এমন সময়ে আমাদের ক্লাসের সবথেকে বখা আর ফাজিল ছেলে সজল আমার নাকের সামনে হাত ঘুরিয়ে নেচে নেচে বলে উঠল – ‘নাদায় করে জাবনা দেব পেটটি ভরে খাস’।
তাই না শুনে ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে, বেঞ্চি বাজিয়ে এমন কান্ড আরম্ভ করল যে আমার রাগে, দুঃখে লজ্জায় চোখে জল এসে গেল। অথচ কারোর একটু মায়া হ’ল না। কবিতাটা না হয় আগে পুরোটা শুনেই নিত। ঠিক আছে – এক মাঘে শীত যায় না। আমি মনে মনে ভাবলাম আমার কবিতাটা রমাপ্রসাদ বাবুকে শোনাতে হবে– উনি যদি একবার প্রশংশা করেন তো কেউ টু শব্দটাও করতে পারবে না।
ভগবানের দয়ায় সু্যোগও এসে গেল। সেদিন ক্লাসে স্যার এসে যে কোন একটা ঋতু নিয়ে রচনা লিখতে দিলেন। একবার ভাবলাম আমার কবিতাটা তো শরৎকাল দিয়ে শুরু – এটাই রচনা বলে স্যারকে দেখাই আর কবিতা লিখেছি দেখলে স্যার নিশ্চয়ই খুশী হবেন। কিন্তু লিখতে গিয়ে আমার কলম দিয়ে কিভাবে যেন অন্য একটা কবিতা বেরিয়ে এল। আমি নিজেই পড়ে অবাক। আমি তাড়াতাড়ি খাতা নিয়ে স্যারের কাছে গিয়ে বললাম– ‘স্যার হয়ে গেছে’। স্যার তখন বৈষ্ণব সাহিত্যের কি একটা বই খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। আমার কথা শুনে গম্ভীরভাবে খাতাটা নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন। আমার তো এদিকে বুক ধুকপুক করছে – স্যার কি বলেন। একটু পরে স্যার চোখ তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখে নিয়ে ক্লাশের ছেলেদের বললেন – শোন– শুভেন্দু ঋতু নিয়ে কি রকম কাব্যরচনা লিখেছে –
গরমেতে ঘেমে নেয়ে করি হাঁসফাঁস
বরষার জলে ভিজে ভুগি সারামাস।
শরতেতে পূজো আসে আমি জ্বরে বন্দী
হেমন্তে অ্যানুয়েল, পড়াতেই মন দি।
শীতকালে জুবুথুবু লেপে আর কম্বলে
বসন্ত ভুগে মরি ব্যাথা আর অম্বলে।
আমি তোমাদের ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’ পড়িয়েছি। আর এ হোল শুভেন্দুর ষড়ঋত্যু। শুনে সবাই এমন হো হো করে হাসতে শুরু করল কি বলব। এমন সময়ে টিফিনের ঘণ্টা পড়ে গেল। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে ‘ভালই হয়েছে’ বলে চলে গেলেন। আর আমার এমনই পোড়া কপাল – যে স্যারের এই কমেন্টটা হৈ হট্টগোলের ঠেলায় কেউ শুনতেই পেল না। মাঝের থেকে সবাই আমাকে ‘ষড়ঋত্যু’ ‘ষড়ঋত্যু’ করে ক্ষেপাতে আরম্ভ করল। আমি যতই বলি স্যার এটা ‘ভাল হয়েছে’ বলেছেন – কে কার কথা শোনে। আমার নামই স্কুলে হয়ে গেল ‘ষড়ঋত্যু’। রাগে, দুঃখে আমি কবিতা লেখাই ছেড়ে দিলাম।
সে আজ প্রায় বছর পনের আগের কথা। কবিতা লেখার কথা একদিনের জন্যও আর মনে হয় নি। এখন আমি একটা মাড়োয়ারির গদীতে চাকরি করি। কাঁচা পাটের জোগানদার। আমার অফিস কৃষ্ণনগরে। অফিসে অবশ্য আমি কমই থাকি। কাঁচা পাট ওঠার সময়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষীদের থেকে পাট দেখে যাচাই করে গ্রেড অনুযায়ী দরদাম ঠিক করে – পাট কিনে কৃষ্ণনগরে যেখানে আমাদের বেলপ্রেস আছে সেখানে পাঠিয়ে দিই। প্রেসে পাটের বেল তৈরী করে পাটের গুদামে চালান দেওয়া হয়। সেখান থেকে কলকাতার আশপাশে বিভিন্ন চটকলে পাটের জোগান দেওয়া হয়। তাই আমাকে কখনো কৃষ্ণনগরের অফিসে কখনো বা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হয়।
অগাস্ট মাসের শেষাশেষি এসেছিলাম কমলপুরে। কৃষ্ণনগরের রতন পাল – আমাদেরই একজন পাটের যোগানদার – ওনার শ্বশুরবাড়ি এই কমলপুরেই। বেশ কয়েক বিঘা চাষের জমিও এখানে ওনার আছে। বড় শ্যালক সনাতন মন্ডলই সব দেখাশোনা করে। সনাতনেরও অনেক জমিজমা আছে। রতন পাল ও সনাতন মন্ডল – দুজনকেই আমাদের কোম্পানীর তরফ থেকে দাদন দেওয়া আছে। নতুন পাট উঠেছে – সব বুঝে নিয়ে যেতে হবে। সে জন্যই এখানে আসা।
বাস থেকে নেমে একটা চায়ের দোকান– জিজ্ঞাসা করলাম– “সনাতন মণ্ডলের বাড়িটা কোনদিকে”? একজন বলল –“এই মেঠোপথ ধরে চলে যান। দেখবেন একটা মুদীর দোকান – বলবেন রাজবাড়ি পাড়াটা কোনদিকে? ওখানে গেলে যে কেউ আপনাকে সনাতন মণ্ডলের বাড়ি দেখিয়ে দেবে”। মেঠো রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা গিয়ে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে সনাতন মণ্ডলের বাড়ি এলাম। অবস্থাপন্ন গেরস্ত – দালান কোঠা, পুকুর, গোয়াল, ধানের মড়াই, বাগানসহ অনেকটা যায়গা নিয়ে বসতবাটি। রতন পাল অবশ্য আগেই আমার আসবার কথা বলে রেখেছিল। সনাতনবাবু যথেষ্ট খাতির–যত্ন করে ঘরে নিয়ে বসালেন – লুচি বোঁদে নারকোলের নাড়ু, চা সব খাওয়ালেন। এর ফাঁকেই কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু মুশকিল হল আমি বাস থেকে নামা ইস্তক শরীরে, মনে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম যা ঠিক নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। সনাতন বাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। সনাতন বাবুর কথাগুলো যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। চোখটা কি রকম ভারী হয়ে আসছিল। ব্যাপারটা সনাতনবাবুর নজর এড়ায়নি বুঝতে পারলাম যখন আমায় বললেন – “ছোটবাবু (অফিসে আমায় সবাই ছোটবাবু বলে) – আপনাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে – রাস্তায় অনেক ধকল গেছে তো। আমি বলি কি, আপনি স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে ঘুমান – বিকালে আমি সব আপনারে বুঝিয়ে দেব, আর রাতে থেকে যান – কাল না হয় যাবেন”।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম– “না, আসলে প্রায় দিন পনেরো–কুড়ি ধরে নানান যায়গায় ঘুরছি তো – তাই … ভাবছিলাম আপনার এখান থেকে গিয়ে ক’টা দিন ছুটি নেব – কিন্তু এখন তো পাট যোগাড়ের সময় – অফিস থেকে ছুটি দেবে বলে মনে হয় না”।
সনাতন বাবু স্নেহের স্বরে বললেন – “আপনি আমার এখানেই তিন–চার দিন থাকেন – আমি আশপাশের গাঁ থেকে আপনার পাট যোগাড় করে দেব। আমার বড় ছেলে বলাইয়ের ট্রাক্টর আছে – ও আপনার পাট কৃষ্ণনগরে পৌঁছে দেবে”।
কথাটা মন্দ লাগল না – তবুও আমি একটু ইতস্তত করতে লাগলাম। সনাতনবাবু, সংসার–অভিজ্ঞ বিচক্ষণ লোক – বৌ, তিন ছেলে, তাদের বৌরা, নাতি–নাতনী নিয়ে ভরা সংসার। আমার ইতস্ততভাব দেখে বললেন – “আপনার অসুবিধা হবে না – আমাদের জামাইয়ের বাড়ি তো খালিই আছে – আপনি না হয় ওখানেই থাকবেন আর আমার এখানে খাওয়া–দাওয়া করবেন”। কথাটা বেশ মনঃপুত হলেও মুখে তেমন কিছু বললাম না – শুধু একটু হেসে বললাম – “আচ্ছা দেখি”।
কমলপুর গ্রামটা এখানকার আর পাঁচটা গ্রামেরই মতন – দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, চাষের ক্ষেত, গাছগাছালি, বাঁশের ঝাড়, পদ্ম–শালুকে ভরা পুকুর, দোচালা মাটির ঘর – বেশ কিছু দালান–কোঠাও আছে। বর্ষাকাল – চারদিক জলে থৈ থৈ – কাদায় ভরা রাস্তা। মফস্বল শহরে মানুষ হয়েছি – কিন্তু কাজের সুবাদে দীর্ঘদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে এ দৃশ্য আমার অতি পরিচিত। তবুও এ জায়গাটা আমার মনে এক অদ্ভুত মোহের সৃষ্টি করছে। ইচ্ছে করছে এখানে থেকে যেতে। আমি বললাম – “মণ্ডলবাবু, ভাবছি না হয় দিন কতক এখানে থেকেই যাই”। সনাতনবাবু খুশি হয়ে বললেন – “আমি তো আপনাকে সে কথাই বলছি। থাকেন না, যে ক’দিন ইচ্ছা থাকেন”।
দুপুরে খাওয়ার পর সনাতন বাবুর সঙ্গে রতন পালের বাড়িতে এলাম। বাড়িটা বাস রাস্তার ওপারে। বেশ খানিকটা মেঠোপথ ধরে যেতে হয়। দু’ধারে ধানের ক্ষেত। কিছুটা গিয়ে গাছগাছালিতে ভরা জায়গা – একটা বড়পুকুর – পার ঘিরে নারকেল, সুপুরি গাছের সারি। ওপারে খেজুরগাছ, তালগাছ। একদিকে একটা বড় অশ্বত্থগাছ আর তারই প্রায় ছত্রছায়ায় মেহেদির বেড়া দিয়ে ঘেরা রতন পালের বাড়ি। মাটিরবাড়ি, সামনে দাওয়া– চারচালা খড়ের ছাউনি। ঘর একটাই বেশ বড়। অনেকটা উঠান। একটা কুয়ো আছে – টিন দিয়ে ঘেরা বাথরুম। অনেকটা বড় উঠোন পেরিয়ে বাগান – তবে সাজান নয়। বেশ কয়েকটা কলাগাছ, একটা পেয়ারা গাছ – সন্ধ্যামালতি আর নয়নতারার ঝাড়। বড় বড় ঘাসে জঙ্গল হয়ে আছে। চাষবাস সংক্রান্ত কাজ হলে রতন পাল এখানে এসে ক’দিন থাকে। খাওয়া–দাওয়া সনাতন বাবুর বাড়িতে।
সনাতনবাবু ঘরের তালা খুলে দিলেন। নিপাট পরিচ্ছন্ন ঘর – চকিতে চাদর বালিশ দিয়ে বিছানা করা, পায়ের কাছে একটা সুজনি ভাঁজ করে রাখা। টেবিলে জলের জগ, গ্লাশ রাখা। দেয়ালের তাকে বড় গোল টিনের কৌটো, ছোটো একটা সসপ্যান, কাপ ডিশ, চামচ – কাঁচের মতন স্বচ্ছ পলিথিনের কৌটোয় চিনি আর চা পাতা, একটা ছোট স্পিরিট স্টোভ, দুটো বড় মোমবাতি গুছিয়ে রাখা আছে। আমি অবাক হয়ে সনাতন বাবুর দিকে তাকাতে উনি একটু হেসে বললেন –“আমার ছোট বৌমা আর ছেলে এসে গুছিয়ে রেখে গেছে – আপনি চা খেতে ভালবাসেন। টিনের কৌটোয় মুড়ি আছে”। এই বলে ওনার সঙ্গে আনা ব্যাগ থেকে দুটো মাঝারি মাপের ষ্টীলের টিফিন কৌটো বের করে টেবিলে রেখে বললেন –“আপনি তো বললেন ঝড় বাদলায় আর রাতে খেতে আসবেন না – মুড়ি হলেই চলবে। তাই কি হয়? এই টিফিন কৌটোয় খাবার রইল। রাতে যা হোক চালিয়ে দিন। কাল জলখাবার আর ভাত কিন্তু আমার ওখানেই খাবেন”।
আকাশে ঘন কালো মেঘ। অন্ধকার হয়ে আসছে। সনাতনবাবু আর দাঁড়ালেন না। “কাল সকালে আসব” – বলে হন হন করে হেঁটে চলে গেলেন। বৃষ্টি দু’ এক ফোঁটা করে পড়তে আরম্ভ করছে। আমি কৌতূহল বশতঃ স্টীলের টিফিন কৌটো দুটো খুলে দেখি একটা ভর্তি লুচি আর আর একটা নারকোলের সন্দেশ, নাড়ুতে ঠাসা – সঙ্গে গোটা চারেক দরবেশ। সনাতন বাবু গ্রামের ঘর গৃহস্থ মানুষ – ‘অতিথি দেব ভব’ আদর্শ ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছেন। তার অতিথি রাত্রে দুটো শুকনো মুড়ি চিবিয়ে কাটাবে সেটা তিনি কি ভাবে মেনে নেবেন? পাছে আমি আপত্তি করি তাই বাড়িতে থাকতে কিচ্ছুটি বলেন নি।
দুপুরেও যত্ন করে পাশে বসিয়ে খাইয়েছেন। সত্যি বলতে এ রকম বাড়ির খাওয়া যে কবে শেষ খেয়েছি মনে পড়ে না। কৃষ্ণনগরে অফিসেরই দোতলার একটা ঘরে একাই থাকি। কাজের শেষে আর সকলে চলে যায়। তখন আমার একমাত্র সঙ্গী আমার নিঃসঙ্গতা। আমার অবশ্য ভালই লাগে। খাওয়া নিতাই সাহার হোটেলে। হয় চারাপোনা, নয় কাটাপোনার ছোট একটা টুকরো – পাতলা মুসুরির ডাল আর একটা তরকারি। তরকারির রকম রোজ পাল্টালেও স্বাদ পাল্টায় না। তাই সনাতনবাবুর বাড়িতে খাওয়াটা আজ একটু বেশীই হয়ে গেছে। চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছে।
কিন্তু এ তো ঘুমের নেশা নয়। এ এক অদ্ভূত অনুভব। চোখ দুটো কি ভারী – আধা বোজা অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি সমস্ত দুনিয়াটা আমাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।এই ঘর, এই বাড়ি, উঠোন, বাগান, পুকুর তালগাছ সব যেন ঘুরতে ঘুরতে আমাকে ক্রমশঃ পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরছে। আর বাকি গ্রাম, সনাতনবাবু, রতনপাল, কৃষ্ণনগর সব কেমন ঢেউয়ের মতন দুলতে দুলতে দূরে সরে দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যেতে লাগল। আমি যেন কোথায় হারিয়ে যেতে লাগলাম। মন একদম শূন্য। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না, শুনতে পাচ্ছি না – নিঃশব্দ অন্ধকারে কোন গহ্বরে, কোন অতলে দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছি।
কতক্ষণ এ অবস্থা ছিল জানি না। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এল ঘন্টার শব্দে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি বঙ্কুবিহারীর আরতি হচ্ছে। মন্দিরের চাতালে বসে আছি। রাজা কমলেশ্বর রায়ের গৃহদেবতা বঙ্কুবিহারী। আজ পূর্ণিমার বিশেষ পূজো।
রাজা কমলেশ্বর রায়। যৌবনের প্রারম্ভে নদীয়ার শান্তিপুর থেকে ভাগ্য অন্বেষণে একদিন হাজির হয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর দরবারে। ভাল আরবি–ফার্সী শিখেছিলেন। চাকরী মিলল নবাবের রাজস্ব দপ্তরে। সততা ও কর্মদক্ষতার জন্য অচিরেই নবাবের সুনজরে পড়লেন। নবাব সুজাউদ্দিনও সরফরাজের আমলেও সন্মানের সঙ্গে চাকরী করেন। ক্রমে ক্রমে নবাব আলিবর্দী খাঁ-র আমলে তিনি দিওয়ান–ই খালসা পদে উন্নীত হন। নবাবের বদান্যতায় তিনি রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হ’ন ও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক হ’ন। প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হ’লে চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে এই কদমডাঙা গ্রামে প্রাসাদোপম অট্টালিকা স্থাপন করে বসবাস করতে শুরু করেন। এই গ্রামসহ আশেপাশের অনেকগুলো গ্রাম তাঁর জমিদারীর এলাকাভুক্ত। দয়ালু, মহৎপ্রাণ অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ – সকলেই তাঁকে দেবতার মতন ভক্তিশ্রদ্ধা করে।
রাজার প্রাসাদের অন্দরে ঠাকুরদালান। মন্দিরে বঙ্কুবিহারীর মনোহর মূর্তি। দেবতার নিত্যসেবা। দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, রাশপূর্ণিমা, ঝুলনযাত্রার সময় বিশেষ উৎসব হয়। রথযাত্রার সময়ে জমিদারির অন্তর্গত সমস্ত গ্রামবাসীদের খাওয়ানো হয়। প্রতি পূর্ণিমাতে বিশেষ পূজোর পর ব্রাহ্মণ ভোজন হয়। আজও হবে আর একটু পরে। মনে পড়ে বছর পাঁচেক আগের এরকম একটি দিনের কথা। সেদিনটাও ছিল পূর্ণিমা।
নদিয়া জেলার দেবগ্রাম। পিতৃদেব ঈশ্বর বিপ্রবর মিশ্রের চতুষ্পাঠীতে সংস্কৃত, ব্যাকরণ, কাব্য, ছন্দ কিছু কিছু শিক্ষালাভ করেছিলাম। আমার পুঁথি লেখার হাতেখড়িও তাঁরই কাছে। নিজে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন কিভাবে পুঁথির পাতা, কালি আর বাঁশের কলম বানাতে হয়। কচি নরম তালপাতা থেকে শির বাদ দিয়ে লম্বায় পনেরো – বিশ আঙ্গুল আর চওড়ায় আঙ্গুল চারেক মাপে কেটে কেটে নিতাম। কাটা পাতাগুলো জলে সিদ্ধ করে হাল্কা রোদে ছাওয়ায় শুকোতে দিতাম। তারপর বালি দিয়ে ঘষে পালিশ করে নিতে হ’ত। সুত্রধরের বাড়ি থেকে পাতার মাপে পালিশ করা কাঠের পাটা অনেক বানিয়ে এনেছিলাম। পাটাগুলোর দু’পাশে মাঝ বরাবর দুটো ফুটো করা থাকতো। পাটার ঐ ফুটোর মাপে লোহার তার লাল গরম করে পাতাগুলোকে ফুটো করে নিতাম। রেশমি সুতোর শক্ত সরু নাড়া দিয়ে দুটো কাঠের পাটার মাঝে পাতাগুলো রেখে বেঁধে চাপ দিয়ে রেখে দিতাম। তামার হাঁড়ির তলায় প্রদীপের সলতের শিখা ধরে কালো মোটা ভুসো হ’লে চেঁচে নিয়ে তার সঙ্গে চষক আর গঁদের আঠা মিশিয়ে কালি বানিয়ে শুকিয়ে গুঁড়ো করে রেখে দিতাম। লেখার সময়ে জল দিয়ে গুলে নিতে হ’ত। সবুজ কচি সরু বাঁশের ডগা ছুড়ি দিয়ে কোনাকুনি কেটে কলম বানিয়ে নিতাম। কলমের মাথাটা ছুঁচল না হয়ে একটু চওড়া হ’ত। এতে একই কলমে সরু মোটা লেখা যেত। আশেপাশের গাঁয়ের পন্ডিতদের পুঁথি নকল করে দিয়ে আমার কিছুটা অর্থাগমও হ’ত।
আমি আমার সাত বৎসর বয়সে মাতৃহীন হই। এবারে পিতৃদেব গত হ’লে আমি সংসারে একাকী, অনাথ হয়ে পড়লাম। জমিজমা ও পুঁথি নকলের যৎসামান্য আয়ে আমার হয়তো চলে যেত কিন্তু বিধিলিপি ছিল অন্যবিধ। গ্রামে গ্রামে বর্গীরা হানা দিয়েছে। অবাধ লুঠতরাজ, নরহত্যার লীলা চলছে – ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। মারাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের সঙ্গে বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁর যুদ্ধ চলছে। গ্রামের অন্যদের মতন আমিও প্রাণের ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে অর্ধাহারে, অনাহারে অস্নাত মৃতপ্রায় অবস্থায় একদিন এসে পড়লাম এই কদমডাঙা গাঁয়ে।
পথের ধারে একটা ছাতিমগাছ। তার তলায় বিশ্রাম নিচ্ছি। নিজের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা ভাবছি। দূর থেকে দেখি একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ আসছেন। আমি উঠে প্রণাম করলাম। আমাকে দেখে বৃদ্ধ স্বস্তিবচন বলে জিজ্ঞাসা করলেন –
“তুমি কে বৎস? ভিনদেশী বলে মনেহয়। আগে তো এ গাঁয়ে দেখিনি”।
আমি বললাম – “বর্গীর হানায় গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। অবস্থা শান্ত হ’লে ফিরে যাব। আমি গত দু’দিন ধরে অভুক্ত”।
বৃদ্ধ বললেন –“তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান। এ অঞ্চলের জমিদার রাজা কমলেশ্বর রায়ের বাটিতে আজ ব্রাহ্মণ ভোজন। তুমি এসো আমার সঙ্গে”।
আমি বৃদ্ধের সঙ্গে রাজবাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। তিনি জনৈক ব্যক্তিকে ডেকে বললেন – “এই ব্রাহ্মণ অভুক্ত। একে নিয়ে গিয়ে পঙক্তিতে বসিয়ে দাও”। ব্যক্তিটি কাছাড়িবাড়ির একতলায় টানা বারন্দার এক পাশে আমাকে বসিয়ে দিয়ে গেল। অনেকদিন পরে সেদিন আকন্ঠ খেয়েছিলাম। ব্রাহ্মণ বিদায়ের সময় রাজা কমলেশ্বর রায় নিজে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে একটি করে তাম্রমুদ্রা – এক দাম, দক্ষিণাস্বরূপ দান করছিলেন। হঠাৎ রাজা মহাশয়ের নজর আমার ওপর পড়ে। পাশে থাকা একটি ব্যক্তিকে কি যেন বললেন। আমি দক্ষিণা নিয়ে চলে আসছি এমন সময়ে একটি লোক এসে আমায় বলল – “মহাশয় আপনি চলে যাবেন না। জমিদার মশাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান”। লোকটি এই কথা বলে আমাকে নিয়ে কাছারির একটি ঘরে এল। ঘরের মাঝে গালিচা পাতা। “আপনি এখানে বিশ্রাম করুন। সময় হ’লে আমি আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব” – এই কথা বলে লোকটি চলে গেল।
আমি গালিচার ওপর বসলাম। একে ক্লান্ত দেহ – তার ওপর অত খাওয়া হয়েছে। ঘুমে আমার দু’চোখ জড়িয়ে আসছে। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ঘুম যখন ভাঙল, তখন অপরাহ্ন বেলা। আমি সচকিত হয়ে উঠে বসলাম। মনে পড়ল জমিদার রায় মশাই আমার সঙ্গে কথা বলবেন বলেছেন। কিন্তু হঠাৎ আমার সঙ্গে কেন? আমাকে তো উনি চেনেন না, কোনদিন দেখেনও নি। আমি নিজেও জীবনে কোনদিন কোন রাজপুরুষের সম্মুখীন হইনি। সুতরাং বেশ ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে উঠলাম। সাতপাঁচ ভাবছি এমন সময়ে এক ব্যক্তি এসে আমাকে বললেন – আসুন – রাজামশাই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার বুকের ভিতরটা কি রকম ধক্ ধক্ করতে লাগল। তবুও আত্মবিশ্বাসে ভর করে সঙ্গী ব্যাক্তিটির সঙ্গে রাজ সন্দর্শনে চললাম।
কাছারি দালানেই একটি বিশাল সুসজ্জিত ঘর। অনেক লোকজন উপস্থিত। রাজা মশাইয়ের দরবার। বড় বড় থাম, খিলান, উঁচু ছাদ। ঘরের মাঝে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে উঁচু বেদীর মতন। তার ওপর একটা পালিশ করা কাঠের পুরু মখমলের গদি আঁটা কারুকার্য মন্ডিত কেদারা। রাজামশাই বসে আছেন। পায়ের তলায় রেশমের উপাধান রাখা একটি জলচৌকি। তার ওপরে রাজামশাই পা রাখেন। তাঁর ডানপাশে একটি শ্বেত পাথরের মেজ, শ্বেত পাথরের জলপাত্র – ঢাকনা দেওয়া। বা দিকে বড় রূপোর আলবোলা – তার লম্বা নল সোনার জড়ি দেওয়া। নলের মুখ রাজামশাইয়ের বা হাতে ধরা। মাঝে মাঝে হাল্কা করে ঠোটে নিয়ে মৃদু মৃদু সুখটান দিচ্ছেন। উৎকৃষ্ট তামাকের একটা সুগন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে। রাজামশাই সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, গায়ের রঙ শ্যামলা – মাথায় কাঁচাপাকা চুল – গোঁফও তাই। খুবই ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। দেখলে ভীতির থেকে শ্রদ্ধা বেশী হয়। সাদা রেশমের ধুতি, সবুজ রঙের সোনালী সুতোর ফুলতোলা রেশমের মেরজাই। সোনার ঘুন্টি দিয়ে একপাশে বাঁধা। একটু সামনে বা দিকে একজন প্রৌঢ় ভদ্র ব্যক্তি একটা তুলোট কাগজ হাতে কি পড়ছেন। আমার পশ্চাতে দুই ব্যক্তির কথায় বুঝতে পারলাম উনি নায়েবমশাই। রাজা মশাই শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন ও মৃদুস্বরে কি বলছেন। আমি আমার সঙ্গী লোকটির সঙ্গে চুপ করে একটা থামের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর রাজা মশাই হাতের ইশারা করে কাকে ডাকছেন। আমি এদিক ওদিক দেখছি। আমার সঙ্গী আমাকে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল –“রাজা মশাই ডাকছেন”। আমি থতমত খেয়ে সামনে এগিয়ে এসে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে রাজা মশাইকে নমস্কার করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রাজামশাই গম্ভীর অথচ ধীর শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন–“তুমি ব্রাহ্মণযুবক–দেখে মনে হয় শিক্ষিত ও সদ্বংশজাত। তুমি তো এদিকের লোক নও। কোথা হতে আসছ? তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি একবস্ত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছ?
রাজামশায়ের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হলাম। আমি বললাম –“আপনি সঠিক আন্দাজ করেছেন রাজামশাই। আমার নাম শ্রী সুধন্য মিশ্র। পিতা ঈশ্বর বিপ্রবর মিশ্র। নিবাস নদে জেলার দেবগ্রামে…”।
রাজা মশাই আমাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন – “বিপ্রদাস মিশ্র মানে যিনি শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য বিষয়ক অনেক গীত রচনা করেছেন?”
– “আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার পিতার চতুষ্পাঠী ছিল। বৈষ্ণবশাস্ত্রে তাঁর দখলছিল। তা’ছাড়া তিনি ভাল পুঁথিকার ছিলেন”।
– “তোমার বিদ্যাশিক্ষা নিশ্চয়ই পিতার কাছে?”
– “আমি পিতার নিকট সংস্কৃত, ব্যাকরণ, কাব্য, ছন্দ, জ্যোতিষশিক্ষা লাভ করেছি। পরে নবদ্বীপে পন্ডিত মাধবদাস কবিরাজের নিকট কাব্য ও সাহিত্যে বিশেষ শিক্ষালাভ করি। পিতা আমাকে পুঁথিলেখার পদ্ধতি শিখিয়েছেন এবং আমি পুঁথির তালপত্র, কালি ও কলম প্রস্তুত করতেও দক্ষ”।
– “আমি তোমার পরিচয়ে বিশেষ প্রীত হলাম। তোমার পরিবারে কে কে আছেন? আর বর্তমানে তোমার এরূপ অবস্থার কারণ”?
– “আমি পিতামাতার একমাত্র সন্তান – শৈশবে মাতৃহীন। আমি চিরকুমার থেকে কাব্য ও শাস্ত্রচর্চ্চা করব বলে মনস্থির করেছি। সামান্য জমিজমা ও পুঁথির নকল করে যা উপার্জ্জন হয় –তা’তে আমার একার সংসারে অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্ত কয়েকদিন আগে গ্রামে বর্গীরা হানা দিয়েছে। লুঠ করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রাণের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। দিক্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আজ এই গ্রামে এসে পড়েছি”।
রাজামশাই বললেন – “যে কয়দিন ইচ্ছা হয় আমার এখানে থাকতে পার। কিন্তু তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?”
আমি বললাম – “অবস্থা শান্ত হলে হয়তো দেবগ্রাম ফিরে যাব। কিন্তু হানাদারেরা আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে – নতুন করে গড়ে তোলবার মতন সংস্থান আমার নেই। তাই ভাবছি নবদ্বীপ গিয়ে বাকি জীবন শিক্ষকতা, বৈষ্ণব শাস্ত্রপাঠ ও কাব্যচর্চ্চা করে কাটিয়ে দেব”।
রাজামশাই নীরবে তামাক সেবন করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে বললেন –“তোমার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা তা’তে নবদ্বীপ তোমার পক্ষে উপযুক্ত স্থান তা’তে কোনও সন্দেহ নেই। শাস্ত্রে বলে – ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্ব্বত্র পূজ্যতে’। আমার একটি অনুরোধ বিবেচনা করে দেখতে পার। আমি বলি তুমি এখানেই থেকে যাও। আমি তোমাকে এ গ্রামে কয়েকবিঘা নিষ্কর জমি আর সেখানে তোমার থাকার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। আমার সেরেস্তা থেকে তুমি যাতে আজীবন মাসোহারা পাও তার বন্দোবস্ত করে দেব। আমাদের এখানকার পন্ডিত শ্রীধর আচার্য্য মহাশয়ের একটি চতুষ্পাঠী আছে। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন এবং নিঃসন্তান। পন্ডিত মহাশয়ের অনুমতি হ’লে তুমি পুত্রবৎ তাঁকে সহায়তা করতে পার। নিশ্চিন্তে এখানে বসে তুমি শাস্ত্রপাঠ ও কাব্যচর্চ্চা করতে পার। আমার সন্ধানে বেশ কিছু দূর্মূল্য পুঁথি আছে – তুমি তার নকল করে দেবে যেগুলো আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকবে”।
“রাজামহাশয়ের এ প্রস্তাব অতি উত্তম। আমি সানন্দে অনুমতি প্রদান করলাম। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে আমার চতুষ্পাঠীর সুনাম অক্ষুন্ন থাকবে” –এই কথা শুনে আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কে এই কথা বলছেন। দেখি আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার ঠিক পেছনেই বা দিকে একটা বড় কাঠের চৌকি – মোটা গালিচা পাতা আর সেখানে পাঁচ জন ব্রাহ্মণ বসে আছেন। যিনি কথা বলছিলেন তিনিই তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। বুঝলাম উনিই পন্ডিত শ্রীধর আচার্য্য মহাশয় – আজ সকালে যিনি আমাকে এই রাজবাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন।
আমি মাথা নত করে করজোড়ে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। আমার এই দুরবস্থার কালে রাজা মশাইয়ের এই অযাচিত দানের মধ্যে আমার মতন এই অকিঞ্চনের প্রতি ঈশ্বরের পরম করুণার কথা ভাবে দু’চোখ জলে ভরে উঠল। আমি হাত জোড় করে বললাম – “রাজা মশায়ের দান আর আচার্য মহাশয় আজ আমার প্রতি যে করুণা প্রদর্শন করেছেন তার জন্য আমি আপনাদের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকব। আমি আপনাদের এই প্রস্তাবকে পিতৃ আদেশ মনে করে শিরোধার্য করলাম”।
জনৈক প্রৌঢ়ব্রাহ্মণ বললেন – গীতিকার বিপ্রবর মিশ্রের নাম আমরা অবগত আছি। এই যুবক তাঁর পুত্র জেনে বিশেষ সুখী হলাম। এর শিক্ষা ও যোগ্যতা ছাড়াও এর আর একটি গুণ এর বিনয়। কথায় বলে ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’। নবদ্বীপের পন্ডিত শিরোমণি মাধবদাস কবিরাজের শিষ্য যে কোন চতুষ্পাঠীর সম্পদ। আমরা এই যুবককে স্বাগত জানাই”। রাজা মশাই মাথা নেড়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। আমার দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল – কন্ঠরোধ হয়ে কোন কথা বলতে পারলাম না।
দৌবারিক ঘন্টাধ্বনিতে জানাল সূর্যাস্তের সময় হয়েছে। দরবার শেষ। রাজা মশাই গাত্রোত্থান করলেন – অন্দরমহলে যাবেন। যাবার আগে নায়েব মশাইকে মৃদুস্বরে কিছু নির্দেশ মনে হয় দিয়ে গেলেন। ব্রাহ্মণগণউঠে দাঁড়ালেন। আমি গিয়ে তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। তাঁরা অত্যন্ত প্রীত হয়ে আমায় আশীর্ব্বাদ করলেন। বিশেষ করে শ্রীধর আচার্য মহাশয়ের মুখে একটা পিতৃস্নেহের চিহ্ন লক্ষ্য করলাম। ব্রাহ্মণরা সকলে বিদায় নিলেন।
নায়েব মশাই আমার কাছে এসে হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন। আমিও প্রতি নমস্কার করলাম। তিনি আমার ঐ সঙ্গী লোকটিকে ইশারায় ডেকে বললেন –“চরণদাস, আমি তোমাকে মিশ্র মহাশয়ের তত্ত্বাবধায়ক রূপে নিযুক্ত করলাম। এখন থেকে তুমি শুধু ওনার দেখাশোনা করবে”। আমাকে বললেন – “আপনার যখন যা প্রয়োজন চরণদাসকে বলবেন – ও সব ব্যবস্থা করে দেবে। যতদিন আপনার গৃহাদির সুবন্দোবস্ত না হচ্ছে আপনি রাজবাড়ির অতিথিশালায় থাকুন”।
কাছারিবাড়ি ছাড়িয়ে খানিকটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গন। পাশ দিয়ে রাস্তা। বাম দিকে একটা পুকুর পাড় বাধাঁনো। তার পরেই ঠাকুর দালান। গৃহদেবতা বঙ্কুবিহারীর মন্দির। সামনে নাটমন্ডপ। তার দু’পাশে বাঁধান উঠান ঘিরে ছোটবড় সারি সারি ঘর – অতিথিশালা। উৎসব উপলক্ষে দূরাগত সম্ভ্রান্ত অতিথিরা এলে থাকেন। অতিথি শালার একটি ঘরে আমার আপাতত থাকার ব্যবস্থা হ’ল। চরণদাস খাজাঞ্চিখানা থেকে চাবি নিয়ে এসে ঘর খুলল। ঘরে শোবার নিমিত্ত একটি কাঠের খাট ও দুটি কেদারা আছে। দেয়ালে তিন থাকের কাঠের পাটাতন দেওয়া তাক ও অপরদিকের দেওয়ালে একটি কুলুঙ্গি। একটি ব্যক্তি এসে চরণদাসের কাছে একটি কাপড়ের পুঁটুলি রেখে গেল। চরণদাস পুঁটুলি খুলে তার থেকে তিনটি নতুন ধুতি, তিনটি নতুন উত্তরীয় ও দুটি নতুন গামছা আমাকে দিয়ে বলল – “নায়েবমশাই এগুলো আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনি স্নান সেরে আসুন – আমি আপনার ঘর গুছিয়ে ঠিক করে রাখছি। আমাদের এখানে সকল কর্মচারি অতিথি অভ্যাগতদের জন্য ঠাকুর দালানের পিছন দিকে পাকশালা ও খাবার জায়গা আছে। তবে আপনাকে সেখানে যেতে হবে না। রাজবাড়ির অন্দরমহলের পাকশালা থেকে আপনার খাবার দিয়ে যাওয়া হবে – রাজা মহাশয়ের আদেশে সে রকম ব্যবস্থা হয়েছে”।
আমি কাপড়–গামছা নিয়ে পুকুরে চলে গেলাম। স্নানান্তে ফিরে দেখি চরণদাস ইতিমধ্যে আমার ঘরের সুব্যবস্থা করে ফেলেছে। খাটে তোষক, নতুন চাদর, উপাধান – একটি মোটা চাদর পায়ের নিকট রাখা আছে। কুলুঙ্গিতে মাটির বড় প্রদীপ। পাশে একটি পাত্রে রেড়ির তেল। তাকে ঢাকা দেওয়া জলপাত্র। মোটা রজ্জুতে আমার নতুন ধূতি, উত্তরীয় ঝুলান রয়েছে। একটি কাঠের জলচৌকি ও একটি কাষ্ঠাসন। তাকের ওপর পাট করা একটি কার্পেটের আসন। চরণদাস আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমি আসতেই বলল – “আপনি কি এখন ঘরে বিশ্রাম করবেন? আমি তা হ’লে…”
আমি বললাম – “না – মন্দিরে আরতি শুরু হয়েছে – আমি ভাবছি সেখানে গিয়ে একটু বসব”।
চরণদাস বললে – “ভালই হবে। আরতির পর নাটমন্দিরে নাম–সংকীর্তন হবে। আমি সেখানে খোল বাজাই। তাই আমাকে এখন একটু অনুমতি দিতে হবে”।
চরণদাসকে বিদায় দিয়ে আমি নাটমন্দিরে এসে বসলাম। আরতির পরে কীর্তন শুরু হ’ল। আমার মন তখন গত কয়েকদিন ধরে আমার ভাগ্যের যে অদ্ভুত উত্থান–পতন হ’ল তার কথা ভাবছে। বর্গীর হানায় পথের ভিখিরি থেকে হঠাৎ একেবারে রাজ–অতিথি। একেই বলে ‘পুরুষস্য ভাগ্যম’। রাজামশাইকে তো হ্যাঁ বলে দিলাম। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গা – অচেনা পরিবেশ, অচেনা লোকজন। অবশ্য আমি একা মানুষ – কিই বা আর অসুবিধা হবে। তাছাড়া দেবগ্রামে ফিরে গিয়েই বা আমি কি করব? সেখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনাহারে মরতে হবে। কিছুদিন এখানে থেকে দেখি – তেমন অসুবিধা হ’লে নবদ্বীপে আচার্যদেব মাধবদাস কবিরাজের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেব। অভিভাবক স্বরূপ বলতে তো এখন উনিই।
সংকীর্ত্তন অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে। আমি চুপচাপ বসেছিলাম। চরণদাস একটি প্রদীপ হাতে এসে বলল – “আপনার রাত্রের খাবার নিয়ে এসেছে”। আমি ধীরে ধীরে উঠে তার সঙ্গে ঘরে এলাম। দরজার সামনে একজন বর্ষীয়ান মহিলা– দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় কাপড় দেওয়া – হাতে বড় একটি ঢাকা দেওয়া কাঁসার থালা। তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। চরণদাস চৌকি পেতে, আসন পেতে খাবার জয়গা করে দিল। থালায় লুচি, মালপোয়া, মোহনভোগ, মিষ্টান্ন – বঙ্কুবিহারীর প্রসাদ।
“কিন্তু আমি তো এত খেতে পারব না” – আমার কথা শুনে মহিলাটি বলল – “বাবাঠাকুর, আপনি যতটা পারেন খান”। আমি বললাম – “দেবতার প্রসাদ – ফেলতে নেই। বরঞ্চ একটা পাত্র নিয়ে এসো – তুলে রাখি”। চরণদাস একটি থালা নিয়ে এল। আমি কিছুটা প্রসাদ তুলে রাখলাম। রাতে খাবার পর চরণদাস চলে গেল।
কাছাড়ি বাড়ির পশ্চিম দিকে খানিকটা দূর গেলে একটা বড় পুকুর – তার পারে সারি সারি ঘর আছে – রাজবাড়ীর রক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীদের থাকার জন্য বিশেষতঃ যাদের বাড়ী দূর দেশে। সে রকম একটি ঘরে চরণদাস থাকে। চল্লিশের ওপর বয়স। বছর দুই হ’ল কাছাড়ির কাজে নিযুক্ত হয়েছে। খুবই বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান কর্মী। নবদ্বীপের কাছে মায়াকোলে দেশ। জাতে সদগোপ। দেশে সামান্য জমিজমার আয় থেকেই সংসার নির্বাহ হ’ত। দু’টি সন্তান হয়েছিল– কিন্তু বাঁচেনি। পত্নীবিয়োগের পর দেশের জমিজমা বিক্রী করে নবদ্বীপে এসে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে বৃন্দাবন চলে যায়। সঞ্চিত টাকাপয়সা ফুরিয়ে গেলে বৃন্দাবনেই একটি যাত্রীনিবাসে সামান্য কাজ করছিল। নায়েবমশাই বিশ্বম্ভর নন্দী যখন বৃন্দাবনে তীর্থ করতে আসেন ঐ যাত্রীনিবাসে ছিলেন। চরণদাস নন্দীমশাইয়ের সঙ্গে বঙ্গদেশে ফিরে আসে। ইতিমধ্যে নন্দীমশাই রাজা কমলেশ্বর রায়ের জমিদারিতে নায়েব পদে বহাল হন। নায়েব মশাই শান্তিপুরের লোক – রাজা মশাইয়ের কিছুটা পূর্ব পরিচিত। নায়েব মশাই চরণদাসকে কাছারির কাজকর্মে নিযুক্ত করেন।
দেখতে দেখতে কদমডাঙায় তিন মাস কেটে গেল। গ্রামের ব্রাহ্মণ সমাজ আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। শ্রীধর আচার্য মহাশয় আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন। ওনার চতুষ্পাঠীতে আমি সংস্কৃত ব্যাকরণের অধ্যাপনা করছি। আচার্য মহাশয়ের ন্যায়শাস্ত্রে বিশেষ দখল আছে। আমি তাঁর নিকট ন্যায় শিক্ষা করতে চাই এরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করাতে তিনি অত্যন্ত সুখী হলেন। প্রতিদিন এক ঘন্টা করে তিনি আমাকে ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষা দান করেন। ইতিমধ্যে রাজামশাই কবি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল নামক কাব্যগ্রন্থটি যোগাড় করে আমাকে তার নকল করে দিতে অনুরোধ করেন। আমি চরণদাসের সাহায্যে পুঁথির জন্য তালপত্র, কাঠার পাটা, কালি ও বাঁশের কলম সব নিজে প্রস্তুত করে প্রতিদিন দুই ঘন্টা ব্যয় করে নকল করা শুরু করলাম।
রাজামশাইয়ের অনুগ্রহে ও নায়েব মশাইয়ের তত্ত্বাবধানে এই গ্রামে আমার স্থায়ী নিজস্ব বাসস্থানের ব্যবস্থা হ’ল। রাজবাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে এগিয়ে গেলে রাস্তা যা গিয়ে নবদ্বীপ–কৃষ্ণনগর যাবার প্রধান সড়কের সঙ্গে মিশেছে। রাস্তার ওপারে কিছুটা পথ গিয়ে খানিকটা গাছগাছালিতে ভরা জায়গা পেরোলে একটা বড় পুষ্করিণী – তার চারিদিক ঘিরে তাল, নারিকেল, সুপারি, খেজুরগাছের সারি। একদিকে একটা অশ্বত্থগাছ খানিকটা বড় হয়েছে– তার কাছে বাঁশের কঞ্চির বেড়া দেওয়া দুটো নতুন মাটির ঘর – একটা বেশ বড় – চারচালা খড়ের ছাউনি – বড় দাওয়া। সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে উঠান – সেখান থেকে পথ গেছে পুকুরের দিকে – ছোটঘাট – সিঁড়ি নেমে গেছে পুকুরে। পুকুরের অপর পাড়েও কয়েকটি মাটির বাড়ি দেখা যায়। নতুন বাড়িতে নারায়ণ পূজা করে দিলেন বঙ্কুবিহারীর মন্দিরের পূজারি সত্যদেব গোস্বামী মহাশয়। নায়েবমশাই সকল ব্যবস্থা করেছেন। শ্রীধর আচার্য মহাশয় ও গ্রামস্থ কিছু সজ্জন উপস্থিত ছিলেন। রাজামশাই স্বয়ং কিছুক্ষণের জন্য পাল্কী করে এসেছিলেন।
দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেছে। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, পুঁথির নকল ও কাব্যচর্চ্চায় কোথা দিয়ে এতটা বছর চলে গেল। রাজামশাই খুবই বিদ্যোৎসাহী ও কাব্যানুরাগী। তাঁর ইচ্ছে এই অঞ্চল বিদ্যাচর্চ্চার একটি বড় কেন্দ্র হয়ে উঠুক। স্মৃতিশাস্ত্রে সুপন্ডিত রামানন্দ শাস্ত্রী ও নৈয়ায়িক মধুসূদন বাচস্পতি মহাশয়গণকে এই গ্রামে থেকে চতুস্পাঠী স্থাপন করে শিক্ষাদান করতে অনুরোধ করেন। তাঁরা এখন এখানেই স্থায়ী বসবাস করছেন। দূরাগত ছাত্রদের থাকবার জন্য রাজামশাই কয়েকটি কুটির নির্মাণ করে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস অচিরেই এই স্থান বিদ্যাচর্চ্চার এক বিশিষ্ট কেন্দ্ররূপে খ্যাতিলাভ করবে।
ব্রাহ্মণ ভোজনের পর নিজগৃহে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে লেখার কাজ শুরু করতে হবে। বৎসরাধিক কাল ধরে আমি ‘ভীষ্মচরিত’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ লিখছি – মহাভারতে বর্ণিত পিতামহ ভীষ্মের জীবন কাহিনী অবলম্বনে। দুটি খন্ডে পনেরটি সর্গে এই কাব্যগ্রন্থটি শেষ করব – এরূপ ইচ্ছা আছে। প্রথম খন্ড ছয়টি সর্গে সমাপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয় খন্ডের নবম সর্গ শুরু করেছি। কাশীরাম দাসের মহাভারত পড়ার পর থেকেই আমার পিতামহ ভীষ্মের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করি। নির্লোভ, সত্যনিষ্ঠ, মহাবীর, মহাজ্ঞানী ও চিরকুমার এই চরিত্র আমার অত্যন্ত প্রিয়। এই মহান চরিত্রটি নিয়ে একটি কাব্যগ্রন্থ লেখার বাসনা আমার অনেকদিনের। এই কদমডাঙা গ্রামে রাজ অনুগ্রহে আজ যখন নিশ্চিন্ত জীবন যাপনের সু্যোগ মিলেছে – তখন এই সুপ্তবাসনা বাস্তবে পরিণত করার প্রচেষ্টা শুরু করলাম।
প্রথম সর্গ সবে লেখা হয়েছে। ফাল্গুন মাস – সকাল বেলা। তখনও অল্প শীতের আমেজ রয়ে গেছে। ঝিরঝির করে হাওয়া দিচ্ছে। আমি ঘরের দাওয়ায় বসে দ্বিতীয় সর্গের দ্বিতীয় স্তবক লিখছি। এমন সময়ে রাজামশাই গৃহদ্বারে উপস্থিত। প্রায়শই তিনি সকালের দিকে গ্রাম পরিদর্শন করেন। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেন তাদের কথা শোনেন। কখনও কখনও তাঁর জমিদারীর অন্তর্গত অন্যান্য সকল গ্রামেও তিনি পরিদর্শনে যান। রাজামশাইকে দেখে আমি উঠে এসে হাতজোড় করে নমস্কার জানালাম। রাজামশাইও প্রতিনমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন – “কি লিখছ?”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম –“না সেরকম কিছু নয়। একটু আধটু কাব্য লেখার চেষ্টা করছি”।
রাজামশাই সামনে লেখা দু’টো পুঁথির পাতা নিয়ে একটু পড়লেন। তারপর বললেন –“তোমার কবিতার হাত তো বেশ ভাল। মনে হচ্ছে তুমি কোনও কাব্যগ্রন্থ লেখার পরিকল্পনা করেছ”।
আমি আমতা আমতা করে বললাম –“পিতামহ ভীষ্মের জীবন অবলম্বনে একটা কাব্য লেখার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই ছিল। এতদিন সম্ভব হয়নি। তাই দেখি কতটা লিখতে পারি”।
রাজামশাই বললেন – “এ যাবৎ যতটা লিখেছ – কাল সকালে আমাকে শোনাবে, আমার অনুরোধ কেমন?”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। রাজামশাইয়ের অনুরোধ আর আদেশের মধ্যে বিশেষ কোনও তফাৎ নেই। পরদিন তাই প্রথম সর্গের পাতাগুলো দুটো কাঠের পাটায় বেঁধে লাল শালু কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে রাজবাড়িতে এলাম। দরবার শেষ হ’ল। রাজামশাই আমাকে অন্দরমহলে নিয়ে এলেন। খাসমহলের একতলার শ্বেতপাথরের টানা বারান্দা দিয়ে খানিকটা গিয়ে ডান দিকে বাঁক নিলে বারান্দা বিশাল চওড়া হয়ে গেছে। সেখানে শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর শ্বেতপাথরের পাঁচটি বেদি গালিচা পাতা – তার মধ্যে মাঝের টি বড় আর তার থেকে হাত তিনেক তফাতে দুই পাশে দু’টি করে। মাঝের বেদীতে রাজামশাই তাকিয়া হেলান দিয়ে বসলেন। পাশের বেদীতে আমি একটি ছোট আয়তাকার কাঠের জলচৌকির ওপর পুঁথি রেখে প্রথমসর্গের পাঠ শুরু করলাম – গণেশ, নারায়ণ ও সরস্বতী বন্দনা দিয়ে। আটটি স্তবকের পাঠ শেষ হ’ল অষ্টবসুর বৃত্তান্ত ও গঙ্গার সঙ্গে রাজা শান্তনুর বিবাহ দিয়ে।
রাজামশাই নীরবে চোখ বুজে আলবোলায় তামাক টানতে টানতে শুনছিলেন। পাঠ শেষ হ’লে আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন – “আমি যতটুকু শুনলাম তাতেই আমি তোমার কাব্যপ্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় পেলাম। তোমার এই কাব্যের পরিকল্পনা কি রকম”।
আমি বললাম – “গ্রন্থটি দুটি খন্ডে লেখার ইচ্ছে। প্রথম খন্ডে জন্মবৃত্তান্ত, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য কন্যাহরণ ইত্যাদি। দ্বিতীয় খন্ডে উদ্যোগ পর্ব্ব থেকে যুদ্ধের দশম দিনে ভীষ্মের পতন, শরশয্যা, শান্তি পর্ব্ব ও অনুশাসন পর্ব্বে বর্ণিত যুধিষ্ঠিরকে ধর্মতত্ত্বের যে উপদেশ দিয়েছিলেন তার বর্ণনা ও সর্ব্বশেষে উত্তরায়নে দেহত্যাগ।
রাজামশাই বললেন –“আমি আজ সত্যিই খুব আনন্দিত। তুমি চেষ্টা কর যত দ্রুত সম্ভব এই গ্রন্থ শেষ করার। প্রতিটি স্তবক লেখা হ’লে আমাকে শুনিয়ে যেতে হবে – এটা আমার বিশেষ অনুরোধ। আমার ধ্রুব বিশ্বাস নান্নুর, ফুলিয়া, শিঙ্গি, দামুন্যার মতন একদিন এই কদমডাঙা গ্রাম ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে থাকবে তুমি ও তোমার ‘ভীষ্মচরিত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য”।
রাজামশাই উচ্চপদিস্থ রাজকর্মচারী ছিলেন। বহুলোক তাঁর অধিনে কাজ করতো। তিনি জানেন কার থেকে কি ভাবে কাজ আদায় করতে হয়। আমার আর আলস্যতার উপায় রইল না। প্রায় দিনই আমাকে যতটুকু লিখি, পড়ে শুনিয়ে আসতে হয়। মাঝে মাঝে শ্রীধর আচার্য, রামানন্দ শাস্ত্রী ও মধুসূদন বাচস্পতি মহাশয়গণও থাকেন। তাঁরা আমার কাব্যের উচ্ছাসিত প্রশংসা করেন – আলোচনা করেন। স্মার্ত শাস্ত্রী মহাশয়ের নিকট পৌরাণিক সমাজ ব্যবস্থা ও সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি যা আমার কাব্যের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন।
বাইরে আজ বেশ হাওয়া দিচ্ছে। ঘরের ভেতর প্রদীপ জ্বেলে লিখতে বসলাম। আমি সাধারণত কার্পেটের আসনে বসে জলচৌকির ওপর পুঁথি রেখে লিখি। এবার শুরু হ’ল নবম সর্গ–
(১)
দশদিন পূর্ণ আজি কুরুক্ষেত্র রণে
রণোন্মত্ত হৈয়ে যত কুরুসেনা গণে।
কালান্তক যম সম ভীষ্ম মহামতি
সহস্র সেনানী বধে কুরু সেনাপতি। ৪
দুইবার রণে ভঙ্গ দিলা সব্যসাচি।
গান্ডীব ফেলিয়া কৃষ্ণে করজোড়ে যাচি।
ইচ্ছামৃত্যু যাঁর তাঁরে কেমনে বধিব
এ হেন দুরূহ কার্য কেমনে সাধিব? ৮
প্রতিজ্ঞা ভুলিয়া কৃষ্ণ অর্জ্জুনের হয়ে
ধাইল ভীষ্মের পানে রথচক্র লয়ে।
মৃতুরূপে বাসুদেবে দেখি বীরবরে
অস্ত্র ত্যাজি রথোপরি রহে করজোড়ে। ১২
পিছে পিছে ধাবমান তৃতীয় পান্ডবে
পদ ধরি ফিরাইয়া আনিল কেশবে।
কহিলাপার্থকৃষ্ণে – চক্ষেধারাবহে
কেমনে নিবারিব অজেয় পিতামহে? ১৬
কহিলা বাসুদেব – সখা, কহে কূটনীতি
রণক্ষেত্রে কোন নীতিই নহে দুর্নীতি।
শিখন্ডী নামেতে যোদ্ধা আছে তব দলে
তারে লয়ে সাধিব কার্য আজি রণস্থলে। ২০
এ কথা জেনো সখা শিখন্ডী পুরুষ নহে
দ্রুপদ–রাজ কন্যা সে যে জন্মসূত্র কহে।
পুর্ব্বজন্মে অম্বা নামে কাশীরাজ দুহিতা–
মদ্ররাজ শল্য প্রতি ছিল আকর্ষিতা। ২৪
ভীষ্ম যবে ভ্রাতৃ লাগি কন্যা হরণ করে–
অম্বিকা, অম্বালিকা সাথে অম্বাকেও হরে।
অম্বার কথা শুনি ভীষ্ম, কহে অম্বা–প্রতি
মহামতি মদ্ররাজ তব উপযুক্ত পতি। ২৮
মদ্রদেশে ভীষ্ম তারে দিলা প্রেরণ করি
শল্যরাজ নাকচ করিলা ক্ষাত্রধর্ম স্মরি।
উপেক্ষিতা হৈয়া অম্বা ভীষ্ম কাছে যায়
তব হেতু দুঃখ মোর, তুমি লহ দায়। ৩২
চিরকুমার দেবব্রত হৈল অরাজি
অপমানে ক্ষোভে অম্বা দেহ দিল ত্যাজি।
ভীষ্মবধের কারণ হইব প্রতিজ্ঞা করিল
সেই হেতু এ জনমে শিখন্ডী হইল। ৩৬
শিখন্ডী পুরুষ নহে পিতামহ জানে
সেহেতু তাহারে কভু বিঁধিবে না বাণে।
শিখন্ডীরে ঢালরূপে রাখ যদি দৈবে
পিতামহের পরাজয় সহজেতে হৈবে। ৪০
(২)
ধাইলা কপিধ্বজ রথ রথী ভীষ্ম পানে
কালান্তক বাসব যথা বজ্রবাণ হানে।
হুঙ্কারিয়া পিতামহ ধনু লইয়া করে
চাহিয়া দেখিল শিখন্ডী বসি রথোপরে।১
পশ্চাতে ফাল্গুনীরে দেখি জ্যা রোপন করি
হাসিলা গঙ্গানন্দন নিজ কর্তব্য স্মরি।
ইচ্ছামৃত্যু হইবে মোর লেখা এ বরাতে
না যদি চাহিব, মোরে কে বধিবে ধরাতে।২
অবধ্য রণেতে আমি
সহসা সচকিত হয়ে উঠি জোরে বাজ পড়ার শব্দে। লেখায় মন ছিল বলে এতক্ষণ খেয়াল করিনি। গবাক্ষপথে তাকিয়ে দেখি মূহুর্মূহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর তার সঙ্গে কর্ণবিদারক বজ্রধ্বনি। এখন তো ভরা বর্ষা। ভাদ্র মাসের প্রায় মাঝামাঝি – আজ ১২ই ভাদ্র। ‘এ ভরা বাদর এ মাহ ভাদর’। আকাশ ঘন কাল মেঘে ঢাকা। অপরাহ্ন বেলা অথচ চারিদিকে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে। তার সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো বাতাস। তালগাছ, সুপারিগাছের মাথাগুলো সজোরে আন্দোলিত হচ্ছে। আবার লিখতে শুরু করলাম। হঠাৎ মনে হ’ল আমার ধুতি, উত্তরীয় প্রাঙ্গণে দড়িতে শুকোতে দেওয়া আছে। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে বাইরে এলাম। দাওয়া থেকে নেমে কিছুটা গিয়ে পুকুরের ধারে দুটো বাঁশে দড়ি টাঙান। তাতে সকালে স্নান করে আমি আমার ধূতি আর উত্তরীয় মেলে দিয়েছিলাম। বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি মাত্র আরম্ভ হচ্ছে। ধূতি আর উত্তরীয় নিয়ে দ্রুত ফিরে আসছি। হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। দু চোখ অন্ধকার – কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। সমস্ত শরীরটা প্রবল ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে শরীরের ভেতর দিয়ে কি যে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না – মনে হ’ল…
এবারে কান ফাটান তীব্র শব্দে চমকে উঠে বসলাম। আমি কোথায়? চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আমি যেন কোন অন্ধকার গহ্বর থেকে দ্রুত ভেসে আসছি। আশেপাশে কারা যেন দ্রুত সরে যাচ্ছে। আবার কিসের যেন জোর শব্দ আর আলোর ঝলক। আবছাআবছা দেখতে পাচ্ছি। বিশাল এক প্রাসাদের মতন বাড়ি, কত লোকজন,পুকুর মাটির ঘর, লাল শালু মোড়া কত পুঁথি সব যেন কেমন কাঁপতে কাঁপতে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি কেমন ঘোরের মতন বিছানা থেকে নাবলাম। কে যেন আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মোহগ্রস্তের মতন দরজা খুললাম। চোখটা অনেকটা পরিস্কার হয়েএসেছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টিপড়ছে – ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর তেমনি মেঘের গর্জ্জন। বিকেল বেলা কিন্তু বেশ অন্ধকার। আকাশে ঘন কালো মেঘ।
“ও কি? – কে ওখানে? উঠানে ধূতি চাদর পরা কে একজন এই বৃষ্টিতে শুয়ে আছে। পাগল টাগল নাকি?” কাছে যেতেই আমি আঁতকে উঠে চিৎকার করে উঠলাম। এ কি? এ যে আমারই মুখ – আমারই মৃতদেহ। সারা গায়ে কালশিটে গাছের শিকড়ের মতন শাখা প্রশাখা উঠে গেছে – মাঝে মাঝে কালো ছোপ ছোপ। এ তো বজ্রাঘাতে মৃত্যু। তবে কি আমি মৃত? আমি বেঁচে নেই? শুনেছিলাম মানুষ মারা গেলে মানুষের আত্মা নাকি অনেকক্ষণ বুঝতে পারে না সে জীবিত না মৃত। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। সব কিরকম অন্ধকার হয়ে এল।
মনে হ’ল কে যেন মুখে গায়ে জল ছেটাচ্ছে। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি রতন পালের ঘরের সামনে উঠানে পড়ে আছি। রাত প্রায় শেষ – অন্ধকার ফিকে হতে আরম্ভ করেছে। গায়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। থতমত খেয়ে উঠে বসলাম – মনে পড়ল আমি আমার মৃতদেহ দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ঘুরে দেখি কোথায় কি? কিচ্ছু তো নেই। আমি কি তা’হলে কোনও স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার মধ্যে আবার নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিল। তবে কি এটা আমার মৃত্যুর পূর্বাভাষ? আমার কেবলই মনে হচ্ছে মৃত্যু যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। আর এক মূহুর্তও এই কমলপুরে নয়। এখনতো আগে সনাতন বাবুর বাড়ি যাই। আমি কোন মতে উঠে ছুটতে আরম্ভ করলাম। জল কাঁদায় ভরা রাস্তা। জোরে যেতেও পারছি না – বারে বারে পা পিছলে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ – কেবলই মনে হচ্ছে মৃত্যু আমার পেছনে তাড়া করে আসছে। মেঠো পথ ধরে যতটা তাড়াতাড়ি চলা যায়। বুকে যেন হাতুড়ি পিটছে। সামনে বাস রাস্তা দেখা যাচ্ছে। ওপারে সনাতনবাবু বাড়ি – কোনো মতে একবার গিয়ে পড়তে পারলে হয়।
বড় রাস্তায় উঠেই ছুটতে শুরু করলাম। বাস স্টপেজের সামনে চায়ের দোকানটা দেখা যাচ্ছে। আর একটু পথ – গতি বাড়িয়ে দিলাম। দোকানের কাছে এসে রাস্তাটা পেরোতে যাব। হঠাৎ আবার সেই তীব্র আলোর ঝলকানি – আর তার সঙ্গে কান ফাটান শব্দ। কে যেন আমাকে ধাক্কা মেরে শূন্যে তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপরেই নেমে এল এক নিঃশব্দ নিকষ কালো অন্ধকার। লরিটা যে এত জোরে ছুটে আসছিল বুঝতে পারিনি।
Tags: একটি অসমাপ্ত কাব্য, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী, হরর
Golpota te jatismor esche abar aloukik mrityu o dekha diyeche, kintu kolpobigyan r “K” o dekha jai ni!
বিশুদ্ধ কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক রচনার প্রধান বিশেসত্ত্ব – দৃঢ় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত ভাবীকালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং মানব সমাজ বা জীবনের ওপর তার সম্ভাব্য প্রভাব। কিন্তু ফ্যান্টাসি, অলৌকিক, হরর বা রহস্য গল্প তা নয়। আমি গল্পটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প ভেবে আদপেই লিখি নি – তাই কল্পবিজ্ঞানের কিছু আশা করাটাই বৃথা। কল্পবিশ্বে – কল্পবিজ্ঞানের গল্প ছাড়াও ফ্যান্টাসি, হরর গল্পও প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
সনৎ গল্প টা দারুন হয়েছে। এটা তো ইতিহাস ভিত্তিক লেখা। অনেক পড়াশুনা করে আর চিন্তা ভাবনা করে লেখা। অসাধারণ লেগেছে আমার।
গল্পটা ভালো লেগেছে । দুটি জীবন ও দুটি দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুকে একই সুতোয় ভালো গেঁথেছো । গ্রাম বাংলার প্রকৃতির ছবি আঁকায় ও শাস্ত্র মুগ্ধ রাজার চরিত্র গঠনে তোমার মুনশিয়ানা বেশ উপভোগ্য । তোমার মধ্যে লেখার ক্ষমতা আছে, সেটার ব্যবহার আরও অনেক দেখতে চাই ।