ওরা হারিয়ে যায়
লেখক: অয়ন অধিকারী
শিল্পী: তৃষা আঢ্য
ওরা হারিয়ে যায়
লেখক – অয়ন অধিকারী
অলংকরণ – তৃষা আঢ্য
বৃষ্টিটা একটু ধরেছে এই বিকেল থেকে। লাগাতার দু-দিন ধরে এক নাগাড়ে হচ্ছে তো হচ্ছেই। মুষলধারে নয়, টিপ টিপ করে কিন্তু বিরামহীন ভাবে। এইরকম প্যাচ প্যাচে ওয়েদারে শরীরটাও ভীষণ ম্যাজ ম্যাজ করছে শিউলির। ম্যাদা মেরে বিছনায় গা এলিয়ে পরে থাকতে মন চায়। তবে মন চাইলেই তো হবে না, পেটের টান যে বড় টান। তাই খদ্দের পাওয়ার তেমন কোনও আশা নেই জেনেও রাস্তায় দাঁড়াতে হয়েছে তাকে আজও। আড়মোড়া ভেঙে বেশি করে জর্দা দেয়া পানটা মুখে ফেলে একবার আকাশের দিকে দেখে নিলো শিউলি।
নিম্নচাপের কালো মেঘ ঢেকে রেখেছে চাঁদের মুখ। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় চারিদিক যেন কোনও রহস্যময়ীর সাজে সেজেছে। ভেজা রাস্তার উপর দিয়ে মাঝে মধ্যে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে গুটি কয়েক গাড়ি। আর কালো রাস্তাটি যেন কোনও আদিম হিংস্র ময়াল। প্রচন্ড খিদেতে, ধাবমান সব যানগুলিকে সেঁধিয়ে নিচ্ছে তার কালো মুখগহ্বরে।
পিচ – শব্দ করে পানের পিক রাস্তায় ফেলল শিউলি।
****
— ওখানে খাবার পাবো অনেক? যা চাইবো, তাই পাবো?
— হুম। পাবিই তো। যা চাইবি তাই পাবি। মাছ, মাংস, পোলাও, কোর্মা যা চাইবি তাই।
— তুমি সত্যি বলছো কাকু?
—হ্যাঁ রে বাবা। তাহলে আর বলছি কি। তুই শুধু আমার সঙ্গে চল। তোর মতো কত্ত মেয়েরা আছে ওখানে দেখবি, সারাদিন খেলবি, ঘুমাবি আর খাবি।
— আমায় নিয়ে চলো কাকু। আমি যাবো। তুমি তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো আমায়।
***
নতুন ছুঁড়িগুলো আসার পর থেকে গলির মধ্যে তাকে আর দাড়াঁতে দিচ্ছে না মোহিনী মাগীটা। বলে, “তোর গতর ঢিলে হয়েছে শিউলি ফুল। খদ্দেররা মজা পায় না আর। নতুন কুঁড়িগুলোকে ফুটতে দে। কাজ শিখুক। আর তুই ওই বড় রাস্তাটা সামলাগে যা। যা পাবি সব তোর। ভাগ চাইবো না।”
শালী খানকি মাগী। যখন শিউলির বয়স ছিল তখন খদ্দেরের অভাব ছিল না তার। এমন ও হয়েছে যে রাতের পর রাত জেগে বড় বড় বাবুদের রাত রঙিন করেছে সে। তখন কত্ত খাতির তার। আর আজ! আজ যেন সে অচ্ছুৎ। শরীরের আর দোষ কি, এত ধকল কি আর সইতে পারে? তাইতো অল্প বয়সেই বুড়িয়ে গেছে শিউলি।
***
—এই ফ্যাচ-ফ্যাচানি কান্না বন্ধ কর ছেমরি। ছিঁচকাদুনে মাল খদ্দেররা পছন্দ করে না।
—ওই লোক গুলো, ওই লোকগুলো কেউ ভালো না। আমার, আমার খুব ব্যাথা করে….
—চুপ কর মা। মেয়ে মানুষ ওর হাজার গুণ বেশি ব্যাথা সইতে পারে। সব সয়ে যাবে একদিন।
***
শিউলি। আদর করে নামটা মোহিনীরই দেয়া। তার মতো আরও যারা আছে, সবারই এমনই নাম দেওয়া হয়। ফুলের নামেই। আসল নাম ছিল একটা। তবে সে নামে শেষবার তাকে কে ডেকেছিল তা আজ আর মনে পড়ে না তার। এখন সে ঝরে পড়া শিউলির মতোই, বাসি আর বিবর্ণ। গন্ধ আছে ঠিকই, তবে তা আর মানুষের মন টানে না।
দূর থেকে ক্ষুদ্র দুটি হলদে আলোক বিন্দু হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে আসছে। যেন শ্বাপদের দুটো চোখ শিকারের খোঁজে বেরিয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে আরো খানিকটা এগিয়ে আসে শিউলি। শাড়ীর আঁচল খানিকটা সরু করে নিয়ে বুকের উপর দিয়ে চালান করে দেয় পিঠের দিকে। হলদে আলোয় বুকের খাঁজ আরো খানিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সস্তার লিপস্টিক মাখা টকটকে লাল ঠোঁটে পেশাদারি হাসি, ডান হাত কোমরে আর বাম হাতের তর্জনী খেলা করছে কোঁকড়ানো চুলের সঙ্গে।
লাস্যময়ী শিউলি আজ যেন এক জীবন্ত ফাঁদ। যে ফাঁদে শিকারীরা ধরা দেয়, শিকার রূপে।
হুশ করে কালো গাড়িটা বেরিয়ে গেল তার সামনে দিয়ে। হতাশার চরম সীমায় পৌঁছে, ভিতরের সমস্ত রাগ যখন অশ্রাব্য খিস্তি রূপে উঠে এসেছে শিউলির ঠোঁটে, ঠিক তখনই সশব্দে ব্রেক চেপে গাড়িটি দাঁড়িয়ে পড়ল হাতবিশেক দূরে। খুশিতে নেচে উঠল শিউলির মন। দৃপ্ত পদক্ষেপে সে এগিয়ে গেল গাড়িটির দিকে।
বিদেশী গাড়ি, কালো কাঁচের কারণে ভেতরের কোনও কিছুই দেখা সম্ভব নয়। চালকের বাঁ দিকের দরজা খুলে গেল বিনা শব্দে। শিউলি দেখল বছর সাতাশ-আঠাশের এক যুবক হাত নেড়ে তাকে ভিতরে আসবার ইঙ্গিত করছে।
“পোটেকসান আছে তো?”
চকিতে একটি হাসির রেখা ঝলসে উঠে আবার মিলিয়ে গেল লোকটির মুখ থেকে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আবারও ইঙ্গিত করল তাকে ভিতরে আসবার জন্য।
গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে। রাতের পিচকালো অন্ধকার গাড়ির হেডলাইট দুটো যেন চিরে ফেলছে দুফালা করে।
টিপ টিপ বৃষ্টিটা আবার শুরু হয়েছে। গাড়ির উইন্ড স্ক্রিন এর উপর ওয়াইপারের সপাত সপাত শব্দ ছাড়া গাড়ির মধ্যে অন্য কোনও আওয়াজ নেই। লোকটি নির্বিকার চিত্তে গাড়ি চালাচ্ছে। একটিবারের জন্যেও তার দিকে তাকায়নি। এবারে একটু অস্বস্তি বোধ করছে শিউলি। সাধারণত এমনটা হয় না। খদ্দেররা রেট জিজ্ঞেস করে, আবার কেউ কেউ তো দরদামও করে। যেন বাজারের আলু পটল কিনতে এসেছে। কিন্তু এই লোকটি সেসবের ধার কাছ দিয়েও গেল না। কেন জানি না শিউলির ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না। লোকটির অন্য কোনও মতলব নেই তো?
ইজ্জতের ভয় তার আর নেই। সেটা বেচেই তো পেট চলে। তবে আজকাল যা সব শোনা যাচ্ছে; এই তো গতমাসেই মোহিনীর কাছে দার্জিলিং থেকে এল নতুন যে ছুঁড়িটা, একমাস যেতে না যেতেই নাগর জুটিয়ে ভেগে গেল। তা পালাবি আর কদ্দুর, এক হপ্তা বাদে ওই তো ওই পাশের ভাগাড়ে ক্ষত বিক্ষত দেহ পাওয়া গেল মেয়েটির। করা জানি মেয়েটির চোখ দুটো উপরে নিয়েছে। আরও কিসব কিডনি, ফিডনি তারপর ওই হার্ট না কি বলে সেসবও ছিল না দেহে। শরীরের এসব যন্ত্রপাতি নাকি খুব দামি, সব বিক্রি হয় পয়সাওয়ালা লোকেদের কাছে। পুলিশ বেশ চেপে ধরেছিল মোহিনীকে সেইবার। ওরই ঠেক থেকে তো গায়েব হয়েছে। কানাঘুষো শুনেছে শিউলি, লাখ টাকায় রফা হয়েছিল পুলিশ এর সঙ্গে মোহিনীর। ব্যাস, আর কি। সব ধামা চাপা পড়ে গেল।
একটা মেয়ে যে কি না পেটের দায়ে এসেছিল এ লাইনে, বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছিল হয়তো। আবার পালিয়েও গিয়েছিল। ভালোবেসে ঘর বাঁধবে ভেবেছিল হয়তো। সেই মেয়েটির খুনের দাম লাখ টাকা। বেঁচে থাকতে অতো টাকা রোজগারই করলো না, আর মরে যেতেই কত লোকের কত কত টাকা লাভ হয়ে গেল। ভালোই হয়েছে।
বেঁচে থেকে এ নরক যন্ত্রনা ভোগ করার চেয়ে মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে।
গাড়ি ইতিমধ্যে মেইনরোড ছেড়ে বাঁ পাশের কাঁচা রাস্তায় এগিয়ে গিয়েছে খানিকটা। কাঁচা রাস্তার পাশে ঝোপ জঙ্গল। কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর ঝোপ ঝাড়ের পরিমান আরো খানিকবেড়ে গেল যেন। বড় একটি গাছের নিচে এসে ব্রেক চেপে থামলো গাড়িটি। গাড়ির ভেতর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই কি গাছ। বুঝেই বা করবে কি সে!
লোকটি ড্রাইভিং সিট এর পাশের দরজা খুলে নেমে দাঁড়াল এবারে, লাইটার দিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে হাঁটা দিল মেইন রোডের দিকে।
জীবনে অনেক রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে শিউলির, তবে এমন অদ্ভুত খদ্দেরের পাল্লায় সে কখনও পড়েনি। শহর থেকে এতদূরে, এই অদ্ভুত পরিবেশে অন্ধকারের মধ্যে তাকে ফেলে রেখে গেল কই? আর কেনই বা গেল? গাড়ির হেডলাইট এর আলোয় সামনের কাদাময় কাঁচা রাস্তা ছাড়া আর দেখবার বিশেষ কিছুই নেই।
হঠাৎ শরীরে এক অদ্ভুত রকমের শিরশিরানি অনুভব করল শিউলি। গাড়ির ব্যাক সিটে কিছু একটা নড়ে উঠল যেন।
গাড়ির ভেতরটা জমাট অন্ধকার। অভ্যস্ত হাতে ব্লাউসের মধ্যে থাকা ছোট মোবাইল ফোনটি বের করে জ্বালিয়ে দিল শিউলি।
—আহ্। আলো বন্ধ কর।
দীর্ঘদিনের সর্দি বসে গেলে কথা বলবার সময় যেমন ঘর ঘর শব্দ হয়, ঠিক তেমন স্বরেই আলো নেভানোর আদেশ ভেসে এল গাড়ির পিছন দিক থেকে। গাড়ির ব্যাকসিটের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে বসে রয়েছে একজন মধ্য পঞ্চাশের লোক। গোল আলুভাতে মার্ক বদন। মাথায় চুলের বালাই নেই। ক্ষনিকের আলোয় যতটুকু দেখতে পেল, তাতে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পেল না শিউলি। তবে এই বর্ষার রাত্রে, গাড়ির মধ্যে অন্ধকারেও লোকটি কালো চশমা পরে রয়েছে দেখে কিছুটা অবাক হল বটে। তা ছাড়াও এতটা রাস্তা গাড়িতে বসে এল, অথচ একটিবারের জন্যও গাড়িতে তৃতীয় কারোর উপস্থিতি টের পেল না সে। এটাও ভারী অদ্ভুত।
—নেমে পিছন দিকে এস।
আবার সেই গা ঘিন-ঘিনে স্বর ভেসে এল। এই তাহলে আসল খদ্দের। কথা না বাড়িয়ে শিউলি নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। খুট শব্দ করে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে গেল। শিউলি এক অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আরো এক অন্ধকারে প্রবেশ করল।
লোকটি কম কথার মানুষ। গাড়িতে উঠতেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। একদিক থেকে শিউলির এমন খদ্দের বেশ ভালো লাগে। বেকার কথাবার্তার ঝাম তার আর পোষায় না। ঝটপট কাজ, পটাপট পেমেন্ট। যত তাড়া তাড়ি কাজ শেষ হবে, তত তাড়াতাড়ি সে বাড়ি ফিরতে পারবে।
বাড়ি! হাসতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে শিউলি। তার মতো বাজারীদের আবার বাড়ি হয় নাকি! ওই মাথা গোঁজার একটা খুপরি। সেই কোন ছোট্টবেলায় এসেছিল, প্রথম প্রথম মোহিনী নিজের কাছে রাখলেও পরবর্তীকালে ওই খুপরিটাই হয়ে যায় ওর আস্তানা। ওর সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, ব্যাথা, বেদনা, যন্ত্রনা সব কিছু দেখেছে, সব জানে ওই ছয় বাই চারের ঘরটি। সব।
লোকটির ক্রমশ ভারী হয়ে আসা নিঃশ্বাস প্রেসার কুকারের মতো সো সো আওয়াজ করছে। দুটো প্রাপ্তবয়স্ক শরীর মেতে উঠেছে আদিমতায়। তবে শুধুমাত্র দেয়া নেয়ার বিনিময় প্রথা এটি নয়। এখানেও খাদ্য-খাদকের সেই প্রাচীন সম্পর্ক অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, যখন শিকারী তার লালসায় ডোবানো থাবা বসাবে শিকারের উপর।
লোকটির থল থলে শরীরে যে এত শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে, সেটা আগে বুঝতে পারেনি শিউলি। মেদবহুল দুটো হাতের বাঁধনে শিউলির দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ক্ষুধার্থ পশুর মতো আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করছে সে শিউলি কে। তবে এসব তার গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই কোনওরকম প্রতিরোধ সে করল না। চোখ বন্ধ করে সয়ে চলেছে সেই নারকীয়তা। হঠাৎ গলার নিচে ঘাড়ের কাছে ছুঁচ ফোঁটার মতো একটি সুক্ষ যন্ত্রনা অনুভব করলো শিউলি, মাথাটা ভারী হয়ে গেল নিমেষে। চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুমের নিকষ কালো পর্দা।
তার মানে…তার মানে…..
***
—পার্টি রেডি আছে তো?
—হ্যাঁ, দাদা।
—গুড।
—তবে দাদা, পার্টি কিছু কনসেশন এর কথা….
—পাঁচ লাখের এক পয়সা কম হবে না জানিয়ে দে। না পোষালে অন্য পার্টিও আছে। শালাগুলো পাঁচ লাখে কিনে বেচবে ডবল দামে।
—ঠিক আছে দাদা। তাহলে ডেলিভারি কনফার্ম করে দি?
—হুম। কাজ কমপ্লিট করে মাল ডেলিভারি দিবি, ক্যাশ নিবি। আর হ্যাঁ, আগের বারের মতো পুলিশি লাফড়া চাইনা।
—চিন্তা করোনা দাদা। এক ভুল দুবার হবে না।
—দ্যাটস বেটার। বাট হলে, পরবর্তী ভুলটি করার জন্য তুই আর থাকবি না।
—কি যে বলো দাদা! আগের বারে তাড়াহুড়োয় বডিটা গ্যারেজ করতে পারিনি। এবারে আর…
—পুঁতে দিবি। ঝামেলা খতম।
—ওকে দাদা।
অন্ধকার ঘরে ঘুমিয়ে থাকা কালীন কেউ এসে লাইট জ্বালিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে যায় না। চোখ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও আলোর রেশ টের পাওয়া যায়, আর ঘুমের ঘোর একটু একটু করে হালকা হয়ে আসে। শিউলির ঘুমের ঘোরও আবছা হয়ে এসেছে অনেকটা। চোখ বন্ধ রেখেই সে টের পাচ্ছে, সে শুয়ে আছে আর মাথার উপর জোড়ালো একটি হলুদ আলো জ্বলছে। পাশেই থাকা কমপক্ষে দুজন লোকের আওয়াজ সে শুনতে পারছে। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু কথা হাওয়ায় ঘুরপাক খেয়ে তার কানে আসছে।
শিউলির সারা শরীরে এবারে এক অসহ্য জ্বালা অনুভূত হতে শুরু করেছে। তল পেটের দিকটায় মোচড় দিয়ে উঠে ব্যথায় কুঁকড়ে গেল শরীরটা। বমি পাচ্ছে, গলার কাছটায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে। ঠেলে বেরিয়ে আসবে, না বেরোলে দম বন্ধ হয়ে যাবে তার। সারা শরীরটা মৃগী রুগীর মতো কেঁপে উঠে হঠাৎ থেমে গেল। ঠিক যেমন নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপের শিখা।
ঘটনার আকস্মিকতায় ঘরের মধ্যে থাকা লোক দুটি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল।
—কি রে, মরে গেল নাকি? শালা কাজই তো কমপ্লিট হল না।
—এখন কি হবে দাদা?
—আমার গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো হবে বানচো… যা শালা গিয়ে দেখ, মাগি মরল নাকি!
ধীর পায়ে আজ্ঞাবহ কুকুরের ন্যায় এগিয়ে এল লোকটি মালিকের হুকুম তামিল করতে। স্ট্রেচারের উপর আলু-থালু বেশে শায়িত একটু আগেই ফাঁদে ধরা পড়া শিকার। মনে তো হচ্ছে না বেঁচে আছে। হাত দুটো অসহায়ের মতো ঝুলছে স্ট্রেচারের দু-পাশে। নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে গিয়েও নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কোনও চিহ্ন পেল না সে।
—দাদা, এতো টেঁশে গেছে। এখন কি হ……
কথা শেষ করতে পারলোনা লোকটি। চোখ খুলে তাকিয়েছে এবারে শিউলি। সে দৃষ্টিতে এখন নরকের বিষ। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে অস্বাভাবিক ভাবে। হাপরের মতো ওঠানামা করছে বুকের উন্মুক্ত মাংস খন্ড দুটি। চকিতে লোকটির ডান হাত ধরে ফেলল শিউলি, এক ঝটকায় টেনে আনলো লোকটিকে নিজের কাছে।
আঁক করে একটা শব্দ হল শুধু। রিভলভিং চেয়ারে বসে থাকা টাক মাথা, আলুভাতে মার্কা চেহারার লোকটির দৃষ্টি বিস্ফারিত এখন। যে দৃশ্য চোখের সামনে সে দেখছে, তা এতদিন কেবল টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে শুধু। একটু আগেই যাকে মৃত বলে ভুল করেছিল সেই সেই অর্ধনগ্ন নারীবেশী, নরকজাত প্রাণীটি দাঁত বসিয়েছে তার বিশ্বস্ত অনুচর রাঘবের গলায়। কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে করতে নিমেষে শান্ত হয়ে গেল দেহটা। ধপ করে, নোংরা মেঝের উপর পরে গেল রাঘবের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া স্পন্দনহীন মৃতদেহটি।
সমস্ত ঘরময় অদ্ভুত এক স্যাঁতসেঁতে, হিমশীতল হওয়া ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘরের জোরালো হলুদ আলোর বাল্বটি কয়েকবার দপ দপ করে নিভে গেল। অন্ধকারেও প্রাণীটির জ্বলন্ত কয়লার মতো চোখ দুটি জ্বলে উঠতে দেখা গেল আরো একবার।
হওয়ায় ভেসে এগিয়ে আসছে সেই আগুন। কাছে, আরও কাছে…..এ..ক..দ.. ম..কা..ছে…
***
ঝোড়ো হওয়া বইছে,সেই সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। কালো মেঘের আড়াল থেকে চাঁদের সামান্য যেটুকু আলো আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এক ঝাপসা অবয়ব। অগোছালো ভাবে, নেশা গ্রস্তের মতো পথ চলছে। ছোট ছোট বৃষ্টি কণা হওয়ার চোটে ধাক্কা খাচ্ছে তার সারা শরীরে। শান্ত কালো চোখ দুটিতে ঈষৎ লালের আভা। আর ঠোঁটে পরিতৃপ্তির ছাপ।
না, নরপিশাচিনী সে নয়। রক্ত তৃষ্ণা তার নেই। সে গণিকা। সে বাজারী। যাকে টাকার বিনিময়ে শয্যাসঙ্গিনী করতে পারে যে কেউ। তবে আরও একটি পরিচয় তার আছে। সে নরকজাত, সে বিষকন্যা। এ বিষ তার জন্মসূত্রে পাওয়া, কেবল আত্মরক্ষার্থের জন্য। যেমন আরও অনেক প্রাণীদের থাকে। আজ অবধি কোনও নিরীহ প্রাণ এ বিষের বলি হয়নি, আর হবেও না।
সে জানে সে ভয়ংকর, সে জানে সে বিষাক্ত।
তবে সমাজের বুকে মানুষের ভেকধারী রক্ত পিপাসুদের মধ্যে তিল তিল করে জমতে থাকা লালসার বিষ, তা আরও ভয়ংকর। আরও বিষাক্ত।
ভাগ্যিস, সে মানুষ নয়।
Tags: অয়ন অধিকারী, ওরা হারিয়ে যায়, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, তৃষা আঢ্য, পূজাবার্ষিকী, হরর গল্প