কাল-করোটি – ফিলিপ কে. ডিক
লেখক: ভাষান্তর - সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: ইন্টারনেট
“কাজটা কী? সেরকম হলে ভেবে দেখতে পারি।” কনজার নড়েচড়ে বসল।
নিস্তব্ধ ঘরে অপেক্ষমান মানুষগুলির প্রতি জোড়া চোখ এখন কয়েদীদের আধময়লা পোশাক চাপানো কনজারের ওপর নিবদ্ধ।
বক্তা একটু ঝুঁকে বসলেন।
“জেলে ঢোকার আগে তোমার বেআইনি কাজগুলো থেকে তো ভালোই কামাচ্ছিলে। আপাতত এখন তোমার কাছে ফুটো কড়িও নেই। তা ছাড়া, এখনও প্রায় বছর ছয়েক হাজতবাস বরাদ্দ আছে তোমার।”
কনজার কটমট করে বক্তার দিকে তাকাল।
“কিন্তু তোমার কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে, যেটা কাউন্সিলকে এই মুহূর্তে ভীষণ সাহায্য করতে পারে। ব্যাপারটা গুরুতর। অবশ্য তোমার কাছে কাজটা ইন্টারেস্টিং লাগতে পারে। শিকার ধরার জন্য ওত পেতে থাকা, অসীম ধৈর্যের সঙ্গে শিকারকে ফলো করা, ঝোপে ঝাড়ে বসে লক্ষ করে সময় বুঝে তাকে নিকেশ করা, এসব তো তুমি প্রচুর করেছ। আমার তো মনে হয়, শিকার করার ব্যাপারটা তুমি বেশ উপভোগই করো। শিকারের পেছনে পেছনে ছোটা, তাকে পেড়ে ফেলা…”
কনজারের বুক থেকে হাপরের মতো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আড়মোড়া ভেঙে একটু অন্যমনস্কভাবেই সে বক্তাকে থামিয়ে দিল, “ওসব এখন বাদ দিন। কাজের কথায় আসুন। ঠিক কাকে নিকেশ করতে হবে?”
এতক্ষণে বক্তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। “বলব, সব বলব। সময় হলেই জানতে পারবে।”
গাড়িটা একটা শব্দ তুলে ব্রেক কষল। রাত ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকার রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে কনজার একটু অবাকই হল।
“এটা আবার কোন জায়গা? জানতে পারি?”
গার্ডের কঠিন মুষ্ঠি চেপে বসল কনজারের বাহুতে, “চলো, ভেতরে চলো।”
গাড়ির দরজা খুলে স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে নেমে দাঁড়াল কনজার। গাড়ির অপর পাশের দরজা খুলে আবির্ভূত হলেন বক্তা। গার্ড আর বক্তা পরিবেষ্টিত কনজার প্রথমে বুকভরা একটা নিঃশ্বাস নিল শীতল বাতাসে, তারপর পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল সামনে। অন্ধকারের মধ্যে একটা উঁচু ইমারতের সিল্যুয়েট দেখা যাচ্ছে।
“জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে। আমি মনে হয় আগেও এসেছি এখানে।… আরে এটা তো…”
“হুম—আদিগীর্জাঘর।” কনজারের কথা শেষ করতে না দিয়ে বক্তা বলে উঠলেন। “এটাই আমাদের গন্তব্য।”
“এটা গন্তব্য?” কনজারের গলায় অবিশ্বাস। “কিন্তু আপনি ভালো করেই জানেন ওদের এই আদিগীর্জাতে আমাদের প্রবেশ নিষেধ। তার ওপর আমরা সশস্ত্র…”
বক্তা ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজার কাছে পৌঁছে গেছেন। কনজার টের পেল দু’জন গার্ড এসে তার দু’পাশে দাঁড়িয়েছে। সে নিঃশব্দে পা বাড়াল।
বক্তার ঈশারায় রক্ষীরা গীর্জার প্রবেশপথ খুলে ধরল। কনজার দেখতে পেল সারি সারি সশস্ত্র রক্ষীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছে আদিগীর্জার বিরাট হলঘর। নওজওয়ান রক্ষীরা গীর্জার দেওয়ালে শোভিত নানা অসাধারণ চিত্রকলার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল।
কনজার অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, “এলাহি ব্যাপার তো!”
“আজ্ঞে হ্যাঁ” বক্তা বলে চললেন, “এলাহি করতে হয়েছে, কারণ আমাদের সঙ্গে, কেবল আমাদেরই সঙ্গে এই আদিগীর্জার সম্পর্ক মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। কখন কী হয়, কিস্যু বলা যায় না।”
“কিন্তু এ দিয়েও কি শেষ রক্ষা হবে?”
“কাজ তো চলে যাবে এখনকার মতো। দেখাই যাক না।“
বড় হলঘরটা পেরিয়ে ওরা প্রবেশ করল মূল প্রার্থনাকক্ষে। যেখানে দেওয়ালজুড়ে মূর্ত হয়ে রয়েছে নানা ছবি। বক্তা ছবিগুলোর দিকে চকিতে তাকিয়েই ঢুকে গেলেন পাশের একটা ছোট ঘরে। কনজারকে ডেকে নিলেন ইশারাতে।
“এখানেই আছে জিনিসটা। আমাদের একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে বাপু। ভক্তের দল যে কোনও মুহূর্তে হানা দিতে পারে।”
ছোট্ট একটা ঘর, অনেকটা চিলেকোঠার মতো। নিচু ছাদে বসানো কারুকার্যময় কড়ি-বরগা। দেওয়ালে দেওয়ালে পুরোনো কাঠের প্যানেল। কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে ঘরটার মধ্যে থেকে। চারপাশেও কিছু পোড়া কাঠের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
“কীসের গন্ধ এটা? ওই টুকরোগুলোই বা কী?” কনজার জোরে জোরে দু’বার নাক টানল।
“কী করে জানব?” বক্তার গলায় বিরক্তি আর অস্থিরতা, “তবে আমাদের পাওয়া তথ্য অনুসারে এখানেই জিনিসটার থাকা উচিত…”
কনজার ঘরের চারপাশ ভালো করে দেখছিল। বই, কাগজপত্র, পবিত্র চিহ্ন, ছবি এসবে ঠাসা ঘরের তাকগুলো। অদ্ভুত একটা শীতল অনুভুতি তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল।
“আমাকে কি চার্চের কাউকে…মানে, সেক্ষেত্রে…”
“তাহলে কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে তুমিও মহান স্রষ্টার প্রতি অনুরক্ত?” বক্তার গলায় বিদ্রুপ। “তোমার মতো একজন কুখ্যাত শিকারী, বলা ভালো সুপারি কিলার—সে কিনা…”
“আরে না না। কিন্তু ওদের ক্রিয়াকলাপ তো কারুর অজানা নয়। যুদ্ধ, রক্তপাতের বিরুদ্ধে তাদের যে অবস্থান…”
“তাহলে তোমার সমস্যাটা ঠিক কোথায়?”
“আসলে, আমি এগুলোর সঙ্গে জড়াতে চাই না। আপনারা তো জানেন ওদের ক্ষমতা। উন্মাদের দল সব। ওদের বোঝানো অসম্ভব।”
বক্তা কনজারের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন।
“উঁহু, তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওই ভক্তদের মধ্যে কাউকে কিছু করতে তোমায় ডাকিনি। ওদের মেরে কোনও লাভ নেই। রক্তবীজের ঝাড় সব। যত মারব, তত বাড়বে। ওভাবে হবে না।”
“তাহলে? চলুন বেরিয়ে পড়ি এখান থেকে।”
“আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও। আমরা এখানে এসেছি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের খোঁজে। যেটা তোমাকে সাহায্য করবে শিকারকে খুঁজে বের করতে। এটা ছাড়া তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।” একটা চকিত হাসি খেলে খেল বক্তার মুখে। “বেছে বেছে একদম ঠিক টার্গেটকে নিকেশ করতে হবে, বুঝলে। ভুলচুক হলেই কেলেঙ্কারী।”
“দেখুন মশাই, আমার ভুলটুল হয় না।” কনজারের ছাতি গর্বে বিশহাত হয়ে উঠল।
“উঁহু। এ বড় সাধারণ ব্যাপার নয় হে। এরকম আগে কখনও হয়নি,” বক্তা সামান্য অন্যমনস্ক, “এই শিকারকে তুমি খুঁজেই পাবে না, যদি না এই নির্দিষ্ট বস্তুগুলো তোমার কাছে থাকে। সনাক্তকরণের একমাত্র উপায় এই জিনিসগুলোই। এগুলো ছাড়া…”
“আরে, কিন্তু জিনিসগুলো কী?”
বক্তা ঘরের একটা দেওয়ালের বিশেষ জায়গায় আলতো করে চাপ দিলেন। দেওয়ালটা চাকার ওপর ভর দিয়ে সরে যেতেই পেছনের ঘরের মেঝের ওপর একটা চৌকো কালো অংশ দৃশ্যমান হয়ে উঠল।
“ওই ওখানে রয়েছে।”
হাঁটুমুড়ে বসে কনজার জায়গাটা ভালো করে দেখল। তারপর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল।
“আরে ওটা তো একটা খুলি!! না না, শুধু খুলি নয়—পুরো কঙ্কাল!!”
“ঠিকই! তুমি যে লোকটার খোঁজ করবে সেই লোকটা দু’শো বছর আগে গত হয়েছে। আপাতত তার অবশিষ্টাংশর দিকেই তুমি তাকিয়ে রয়েছে। আর এগুলো দিয়েই তোমাকে সনাক্ত করতে হবে লোকটিকে।” বক্তা বলে চললেন।
কনজার বেশ খানিকক্ষণ আবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল সেই হাড়গোড়ের স্তূপের দিকে। হলদেটে ক্ষয়িষ্ণু এই কঙ্কালের পূর্বতন দেহধারীকে কোন ম্যাজিকে খুন করবে সে? কীভাবে একজন দু’শো বছরের মরা মানুষের জন্য ওঁত পেতে থাকা সম্ভব?
কনজার একজন শিকারী। সে আজ অবধি কারোর দয়ায় বাঁচেনি, কাউকে দয়া করেনি। নিজের মতো, নিজের হিসেবে জীবনকে সে বয়ে নিয়ে এসেছে এতদিন। পৃথিবী থেকে চোরাই ফার, পশুর চামড়া কেনাবেচা করেই সে তার নিজের জীবিকা নির্বাহ করেছে এতদিন। ফাঁকি দিয়েছে পৃথিবীর কাস্টমস্কে বারংবার। চন্দ্রলোকের বিপুলাকায় বন্য ভয়াল পর্বতসংকুল অঞ্চলে সে শিকার করেছে। মঙ্গলের শ্মশানের মতো নির্জন শহরেও সে শিকারকে তার শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে দেয়নি—আর আজ কিনা…
কনজার শুনতে পেল বক্তা এক রক্ষীকে বলছেন, “এই যে, তুমি চটপট এই হাড়ের স্তূপগুলো বয়ে আমার গাড়ি অবধি পৌঁছে দাও দিকিনি। সাবধান, কোনও টুকরো যেন খোয়া না যায়।”
সৈন্যটি সাবধানে হাঁটুমুড়ে বসে সেই হাড়গুলিকে জড়ো করার কাজে লেগে পড়ল।
বক্তা এবার কনজারের দিকে তাকালেন।
“এবার সময় সমাজের প্রতি তোমার আনুগত্য দেখানোর। আমরা জানি যে লোকে ভুল করে, কিন্তু সেটা শুধরোবার সুযোগ সবাই বড় একটা পায় না। আজ সেরকম এক সুযোগ তোমার সামনে। মনে হয় না এর থেকে ভালো কিছু তুমি আর কোনওদিন পাবে বলে। আর, তোমার কাজের জন্য তোমাকে সান্মানিকও দেওয়া হবে।”
কনজার আর বক্তা দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। কনজারের রোগা চেহারা, উস্কোখুস্কো পরিধান আর বিপরীতে বক্তা দামী স্যুটে টিপটপ।
“বুঝলাম”, কনজার যেন সম্বিৎ ফিরে পেল হঠাৎ। “মানে ওই সুযোগের অংশটুকু বুঝলাম। কিন্তু একটা দু’শো বছরের পুরোনো মড়াকে…”
“পরে বলব। আপাতত আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে।” রক্ষীটি ততক্ষণে হাড়গোড়গুলো একটা কাপড়ে জড়িয়ে নিচে চলে গেছে। বক্তা দরজা অবধি এসে বললেন, “শিগগিরি চলো। ওরা টের পেয়ে গেছে যে আমরা অনধিকার প্রবেশ করেছি এখানে। যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়তে পারে।”
প্রায় দৌড়েই গাড়িতে উঠল সবাই। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল। আদিগীর্জার চূড়ার কাছে একটা চক্কর মেরে নক্ষত্রবেগে উড়ে গেল পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।
গাড়ির সীটে আরাম করে বসে বক্তা কথা শুরু করলেন।
“আদিগীর্জার একটা অদ্ভুত ইতিহাস আছে। তুমি নিশ্চয়ই কিছুটা শুনেছ—এখন আমি সেই অংশগুলোই শোনাব যার সঙ্গে আমাদের বর্তমান কাজের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।”
“এই আন্দোলনের সূত্রপাত বিংশ শতাব্দীতেই—এক ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। আন্দোলনটা ভীষণ দ্রুতহারে সংক্রমিত হয়েছিল জনমানসে। যুদ্ধের কোনও শেষ নেই, একটা যুদ্ধ বকলমে আরও একটা যুদ্ধের জন্ম দেয়—এই বিপুল হতাশা এবং নিষ্ফল ক্রোধ আন্দোলনকে ক্রমাগত ইন্ধন যোগায়। ওরা এই যুদ্ধ সমস্যার একটা সরল সমাধান বের করে। কোনও অস্ত্র নয়, কোনও সৈন্য নয়—অর্থাৎ যুদ্ধসামগ্রীর সম্পূর্ণ বিনাশসাধন। সামগ্রী না থাকলে যুদ্ধ হবে না। আর যুদ্ধসামগ্রী বানানোর জন্য যে উন্নত যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেগুলোকে উৎপাদন আটকে দিলে যুদ্ধের অস্ত্রই তৈরি হবে না। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি।
আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল, প্ল্যানিং করে যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব নয়, যুদ্ধবাজ মানুষ যুদ্ধ করবেই, ক্ষমতার লোভে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। তারওপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে আরও বেশি যুদ্ধোন্মাদ করে তুলছে। তাকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে পতনের দিকে—বলা ভালো আরও ভয়ানক যুদ্ধের দিকে। এরকম সমাজ উচ্ছন্নে যাক—এমন প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানও নিপাত যাক। নাহলে আর কয়েকটা যুদ্ধের পর পৃথিবীতে আর থাকবেটা কী? এই হল ওদের মোদ্দা কথা।
কিন্তু এই আদিগির্জা আন্দোলনের স্রষ্টা ভদ্রলোকের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এতটুকু জানা যায় যে তিনি আমেরিকার মধ্য-পাশ্চাত্য অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। শোনা যায় যে তিনি একদিন ভুঁইফোঁড়ের মতো আবির্ভূত হন। অহিংসা, সহনশীলতা বৃদ্ধি, যুদ্ধের জন্য কর না দেওয়া, ওষুধ ছাড়া অন্য কোনও কিছুর জন্য রিসার্চকে সমর্থন না করা ইত্যাদি নিয়ে গালভরা প্রচার করেন। বলেন, শান্ত, অনুত্তেজিতভাবে থাকতে। নিজের বাড়ি এবং সংলগ্ন বাগিচার সমৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে, নিজের চরকায় তেল দিতে এবং অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতে। আরও বলেন, ধনী এবং লোভী হওয়ার চেয়ে, অকিঞ্চিতকর এবং দরিদ্র হওয়া ভালো। এছাড়া প্রচুর দান-খয়রাত করতে বলেন এবং বলেন শহর ত্যাগ করে গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে। আপাতত তাঁর প্রচারের মধ্যে থেকে এটুকু সারমর্ম উদ্ধার করা গেছে।”
গাড়িটা এতক্ষণে আসমান থেকে জমিতে অবতীর্ণ হয়েছে। জমি বলতে একটা বাড়ির প্রশস্ত ছাদ।
“মহান স্রষ্টা বক্তিমে তো দিয়ে দিলেন, তবে সেই মতবাদের পোকা শুরুতে কতগুলো লোককে কামড়েছিল, তার হিসেব পাওয়া যায় না। বস্তুত, বক্তৃতা দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ স্রষ্টাকে গ্রেফতার করে এবং তিনি জীবনের বাকিটা সময় জেলেই কাটান। পরে ওঁর মৃত্যুদণ্ড হয় এবং দেহটা গোপনে কবর দেওয়া হয়। একরকম নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, যে স্রষ্টার সঙ্গে তার মতবাদও মাটিচাপা পড়ে গেছে।”
“কিন্তু এরপর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। মারা যাবার কয়েকবছর পর কয়েকজন স্রষ্টাকে জীবন্ত দেখতে পায়। দাবানলের মতো গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে উনি মৃত্যুহীন, অমর, অজেয়। তিনি স্বয়ং ঈশ্বরের দূত। ক্রমশ এই গুজব বিশ্বাসের আকার নেয়, আর দেখো আমরা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। আদিগীর্জা, তার উন্মাদ ভক্তকুল—এই সমাজকে কেবলই পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তার স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে গলা টিপে মারছে—ঠেলে দিচ্ছে অরাজকতার দিকে…”
“কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে স্রষ্টা যা বলেছিলেন…” কনজার না বলে পারল না।
“যুদ্ধ? হ্যাঁ, তা বলতে পারো এই অহিংসা নীতির ফলে পরবর্তীকালে যুদ্ধ আর হয়নি। স্রষ্টার সৃষ্ট নীতির প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে এটুকু স্বীকার করা যেতেই পারে। কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখ, যুদ্ধের দরকার কি একেবারেই নেই? যুদ্ধের ফলে যোগ্যতমের নির্বাচন হয়—যা মেন্ডেলিজম বা ডারউইনিজমের মতো বিবর্তনবাদের অনুসারী। যুদ্ধ না হলে আগাছার মতো, ক্লীব লোকজনেরা সমানাধিকার নিয়ে পৃথিবীর বুকে কীটের মতো বেঁচে থাকবে। কেন? সেটা কি হতে দেওয়া যায়? না যায় না।”
বক্তার গলায় কিছুটা উত্তেজনার ছোঁয়া পেল কনজার। “যুদ্ধ, একমাত্র যুদ্ধই পারে এসব অযোগ্যদের থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে। বেঁচে থাকবে কেবল শক্তিশালী, বুদ্ধিমত্তায় উজ্জ্বল মানবগোষ্ঠী। যেমন মহামারী, দুর্ভিক্ষে মানুষ মরে—তেমনি যুদ্ধও অযোগ্যকে ঝেঁটিয়ে ফেলার জন্য প্রকৃতির সৃষ্ট আরও একটা উপায় বলতে পারো।”
“এখন যে সমাজে আমরা বাস করছি, সেখানকার সাধারণ মানুষের এই বিজ্ঞান-যুক্তিবাদের ওপর বিন্দুমাত্র আস্থা রয়েছে? একদমই না। একজন পেশাদার বিজ্ঞানী, তাঁকে চোখ রাঙানোর সাহস রাখে কিনা একটা অযোগ্য মূর্খ!! এসব হতে দেওয়া যায় না। যখন বিজ্ঞানীদের হাতেই ব্যাটন থাকবে কেবল তখনই…”
আচমকা কথা থামিয়ে বক্তা ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর দ্রুত দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, “বাকিটা হাঁটতে হাঁটতে বলছি।”
অন্ধকারে প্রশস্ত ছাদ হেঁটে অতিক্রম করতে করতে বক্তা বলে চললেন, “এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ কার হাড়গোড় আমরা ওখান থেকে এত যত্ন করে তুলে আনলাম। আর আমাদের টার্গেট কে সেটাও নিশ্চই আন্দাজ করতে পেরেছ। এই অশিক্ষিত গোঁয়ার লোকটা কোথা থেকে উদয় হয়ে কিছু একটা আগড়ুম বাগড়ুম বলে দিয়েছিল আর তার ফল এখন আমাদের ভুগতে হচ্ছে। তখনকার ঢিলে প্রশাসন, লোকটাকে পুরোটা বলার জন্য এতটা সময় কী করে দিয়ে দিল—আমি তো ভেবেই আশ্চর্য হয়ে যাই!!
কিন্তু কেমন হত যদি লোকটা মুখ খোলার আগেই খালাশ হয়ে যেত? যদি কিছু বলতেই না পারত, তাহলে তো এসব তৈরিই হত না। ওই সামান্য সময়, ওইটুকু সময়েই সে যা বলার বলে দিয়েছিল। শোনা যায়, সে নাকি কথাগুলো একবারই বলেছিল, মানে বলতে পেরেছিল আর কি! তারপর প্রশাসনের কর্তারা এসে কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে যায়। লোকটা অবিশ্যি কোনও বাধা দেয়নি। খুব একটা ঘটনাবহুল কিছু হয়নি তারপর।”
বক্তা কনজারের দিকে তাকালেন।
“ঘটনাবহুল না হলেও, ব্যাপারটা ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য দুর্ঘটনার চেয়ে কিছু কম ছিল না তা তো বুঝতেই পারছ!”
ছাদ পেরিয়ে ঘরে ঢোকার পর কনজার লক্ষ করল স্রষ্টার হাড়গোড়গুলো টেবিলের ওপর কাপড় পেতে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে গম্ভীর মুখের সান্ত্রীরা।
কনজার টেবিলের কাছে গিয়ে মন দিয়ে হাড়গোড়গুলো দেখল। “তাহলে এগুলো সেই মহান স্রষ্টার হাড়গোড় যা আদিগীর্জা দু’শো বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিল?”
“হুম, কিন্তু এখন এগুলো আমাদের হাতে। চলো, তোমাকে আরও কিছু দেখানোর আছে।”
ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে দু’জনে পাশের আর একটা ঘরে প্রবেশ করল। দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কনজার টের পেল ভেতরে ভীষণ সিরিয়াস কিছু কাজকর্ম চলছে। ঘরটা বেশ বড়সড় এবং প্রচুর মেশিনপত্রে ভর্তি। কয়েকটা মেশিনের ঘড়ঘড় করে ঘোরার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছু প্রযুক্তিবিদ হন্তদন্ত হয়ে এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করছে। কনজারদের দেখে প্রাথমিকভাবে তাদের ব্যস্ততাতে একটু ছেদ পড়ল।
কনজার খেয়াল করে দেখল ঘরের কোনার দিকে বড়সড় স্ফটিকস্বচ্ছ কিছু একটা উজ্জ্বল হয়ে আলো বিকিরণ করছে।
বক্তা কনজারের হাতে এরকটা স্লেম-গান তুলে দিয়ে বললেন, “দেখো বাপু, খুলিটা কিন্তু ফেরত আনবে প্রমাণ হিসাবে। তাই মাথায় গুলি না করে বুকে করবে। বুঝলে?”
কনজার অস্ত্রটা হাতে নিয়ে ওজনটা অনুভব করে মনে মনে খুশি হল। “জিনিসটা দারুণ। আগে দেখেছি, কিন্তু ব্যবহার করার সৌভাগ্য হয়নি আজ অবধি।”
“তোমাকে অস্ত্রটা এবং এই যান্ত্রিক খাঁচাটা চালানোর ব্যাপারে বিশদ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।” বক্তা বলে চললেন, “আপাতত আমাদের কাছে ওই সময় এবং জায়গার ব্যাপারে যতটা তথ্য আছে তা তোমাকে জানানো হবে। যতটুকু জানা গেছে, জায়গাটার নাম হাডসন ফিল্ড। ডেনভার, কলোরাডোর কাছে একটা ছোট্ট গ্রাম—সময়টা ১৯৬০। আর হ্যাঁ, মাথায় রাখবে, সনাক্ত করার একমাত্র বস্তু হল ওই করোটি। খেয়াল করে দেখবে সামনের পাটির দাঁতগুলোর মধ্যে বিশেষত্ব রয়েছে। বাঁ দিকের কৃন্তকটা…”
কনজারের এসবে মন ছিল না। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল দু’জন সাদা অ্যাপ্রনপরিহিত কর্মী কী সুচারুভাবে করোটিটাকে প্ল্যাস্টিক ব্যাগে মুড়ে স্ফটিকের খাঁচাটায় রেখে এল। কনজার অন্যমনস্কভাবেই মন্তব্য করল, “আচ্ছা যদি আমি কোনওভাবে ভুল করি?”
“মানে ভুল লোককে শিকার করলে কী হবে জানতে চাইছ? কী আর হবে? ঠিক লোককে খুঁজে বের করে তাকে নিকেশ করবে। আর ততক্ষণ অবধি তোমার ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। কোনওভাবেই যেন স্রষ্টা মুখ খুলতে না পারে। ট্যাঁ ফোঁ করার আগেই মুখ চিরতরে বন্ধ করিয়ে দিতে হবে। তোমাকে সব গুছিয়ে রাখবে হবে আগে থেকে। দ্রুত কাজ করতে হবে। তোমার মনে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়, তাহলেই শ্যুট করে দেবে। খেয়াল করে দেখবে লোকটা নিশ্চিতভাবেই বহিরাগত—তাই ওখানকার সাধারণ বাসিন্দাদের থেকে একটু অন্যরকম হবে নিশ্চয়ই।”
কনজার চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল।
বক্তা এবার একটু অধৈর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, “কী হে। পুরোটা মাথায় ঢুকল নাকি আরও ট্রেনিং লাগবে?”
“না না, এই যথেষ্ট।” কনজার চুপচাপ তার ট্রেনিং নিতে থাকল।
ট্রেনিং শেষে সে সন্তর্পনে স্ফটিকের খাঁচাটিতে বসে হাতলটা চেপে ধরল।
বক্তা বললেন, “গুড লাক। আর আমরা অপেক্ষা করব সুসংবাদের জন্য। বহুদিন ধরেই একটা দার্শনিক ধারণা রয়েছে যে অতীতকে পরিবর্তন করে নাকি বর্তমানে বদল আনা সম্ভব নয়। তোমার এই অপারেশনের ফলে সেই ধারণা যে কতটা ভ্রান্ত সেটাই প্রমাণ হবে।”
কনজার মেশিনটার কন্ট্রোলগুলো আর একবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল।
“আর একটা কথা”, বক্তা কনজারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মেশিনটাকে কিন্তু আমরা সারাক্ষণ নজরবন্দী করে রেখেছি এবং রাখব। তাই এই অপারেশনের সঙ্গে সম্বন্ধ নেই এমন কোনও কাজে এটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে না। সেরকম যদি বুঝি, তাহলে আমরা এটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব—আর দরকার পড়লে তোমাকে ছাড়াই। আশা করি বোঝাতে পারলাম। এবার যাও। শুভমস্তু।”
খাঁচার দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কনজার কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর আঙুল ছোঁয়াল। ধীরে ধীরে চাকাটা ঘোরাল—ঠিক যেভাবে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তখনও সে আড়চোখে নজরে রাখছিল প্লাস্টিকে মোড়া খুলিটাকে—কীরকম একটা অদ্ভুত অনুভূতি জাগে খুলিটার দিকে তাকালেই। যাইহোক, কনজার তার কাজে মন দিল। চাকা ঘোরানো থামতেই আস্তে আস্তে চারপাশের ঘরটা ধোঁয়াটে হয়ে উঠল। ধোঁয়ার একটা কুয়াশা ঘিরে ধরল খাঁচাটাকে। ধীরে ধীরে চারপাশের ঘরটা যেন হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
বেশ খানিকক্ষণ কিছুই বোঝা গেল না—কেমন যেন অপার শূন্যতা! চারপাশে ঘূর্ণায়মান কুয়াশা আর তার ভেতরে অবস্থিত এই স্ফটিকের কারাগার ছাড়া আর যেন চরাচরে কিছুর অস্তিত্ব নেই। সেই নিঃসীম স্তব্ধতায় কনজারের মনের মধ্যে নানারকম প্রশ্ন ভেসে আসতে লাগল। স্রষ্টাকে সে চিনবে কেমন করে? আগে থেকেই বা সে প্রস্তুতি কীভাবে নেবে? লোকটাকে কেমন দেখতে হতে পারে? নামই বা কি লোকটার? তার আচার আচরণ কথাবার্তাই বা কেমন? লোকটাকে সাধারণ দেখতে নাকি উন্মাদের মতো তার প্রকৃতি?
চিন্তাগুলো ক্ষণিকের জন্য সরিয়ে রেখে কনজার অস্ত্রটা হাতে তুলে নিল। চমৎকার জিনিস। পরম মমতায় বন্দুকটাকে নিজের গালে ঠেকাল কনজার। আহা, যেমন ঠান্ডা তেমনি মসৃণ! এ জিনিস কনজারের হাতে একবারই এসেছিল। তখন মঙ্গলের বিশাল মরুভূমিতে সে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। তবুও ঘন অন্ধকারের মধ্যে অতন্দ্র প্রহরায় জেগে রয়েছে তার প্রতিটি ইন্দ্রিয়, যদি শিকার একবার নড়ে…
অস্ত্রটা পাশে রেখে কনজার আবার কনট্রোলে মনোনিবেশ করল। মিটারের রিডিংগুলো ঠিকভাবে পড়ে নিয়ে সেইভাবে হাতলকে সেট করতেই চারপাশের ঘূর্ণায়মান কুয়াশা প্রথমে ঘন তারপর ক্রমশ ফিকে হয়ে এল। ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর সরে যেতেই কনজারের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল এক অচেনা জগৎ।
কনট্রোল অফ করে কনজার স্ফটিকের খাঁচাটার বাইরে এসে দাঁড়াল। মেশিনসমেত সে একটা ছোট টিলার ওপর দাঁড়িয়েছে। আকাশে উঠেছে পূর্ণচন্দ্র। ফিকে অন্ধকারে অনতিদূরেই দেখা যাচ্ছে একটা ছোট শহরের রেখা। শুকনো অথচ মৃদুমন্দ বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিল কনজার। দূরে রাস্তা দিয়ে কয়েকটা গাড়ি চলে গেল শব্দ করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কনজার আবার খাঁচার মধ্যে ঢুকল।
তাকের ওপর রাখা আয়নাটার পেড়ে আনল কনজার। দাড়িটা ছোট করে ছাঁটা হলেও চুলটা ওরা পরিপাটি করেই কেটে দিয়েছে তার। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যেমন পোশাকের চল ছিল, সেরকমই জামা আর প্যান্ট ওর পরনে। উঁচু হয়ে থাকা জামার কলার, সঙ্গে ছোট একটা কোট। জুতোটাও জানোয়ারের চামড়ার। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সে অনুভব করল এক বান্ডিল নোটের উপস্থিতি। এই আমলের। নিশ্চিন্ত হল কনজার। আপাতত এটাই সবচেয়ে জরুরী তার কাছে।
এসব কাজে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত, কিন্তু এরকম অবস্থায় আগে কোনওদিন সে কাজ করেনি।
খাঁচা থেকে বেরিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে সে শহরের দিকে হাঁটা লাগাল।
স্ট্যান্ডে থাকা খবরের কাগজগুলো থেকে একটা তুলে নিল সে। তারিখ ৫ এপ্রিল, ১৯৬১!
আশা করা যায় সে সময়মতোই এসে পৌঁছেছে। ভালো করে চারপাশটা দেখল কনজার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু-একটা মুদির দোকান, একটা ছোট পেট্রোল পাম্প, একটা গ্যারেজ, কয়েকটা ছোটখাটো বিল্ডিং—বৈশিষ্ট্যহীন জায়গা। নিস্তরঙ্গ।
খুঁজে খুঁজে একটা ছোট পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকল কনজার। দরজা ঠেকে ভেতরে প্রবেশ করতেই লাইব্রেরিয়ান তাকে দেখে একটা অমায়িক হাসি দিল।
“স্বাগতম! কোনওভাবে সাহায্য করতে পারি?”
কনজার মুচকি হেসে অভ্যর্থনাটা ফিরিয়ে দিল, কিন্তু কোনও কথা বলল না। সে জানে, এই সময়ের নিরিখে তার উচ্চারণ ভঙ্গিমা, শব্দচয়ন কিছুটা আলাদাই হবে। কারুর মনে কোনওরকম সন্দেহের উদ্রেক করা এখন তার উদ্দেশ্য নয়। সে চুপচাপ একটু দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসল। টেবিলের পাশে ডাঁই করে রাখা একগাদা সাময়িক পত্রিকা। কিছুক্ষণ সেগুলো নাড়াচাড়া করে হঠাৎ উঠে পড়ল সে। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে রাখা একটা তাকের দিকে এগিয়ে গেল—তার বুকটা এখন আবিষ্কারের উত্তেজনায় ধুকপুক করছে।
খবরের কাগজ—গত সপ্তাহের। সে পুরো বাঞ্চটা বগলদাবা করে নিয়ে এসে টেবিলে বসল। দ্রুত ওল্টাতে লাগল পাতার পর পাতা। ছাপার অক্ষরবিন্যাস, এমনকী কাগজের পাতাগুলোও যেন কেমন কেমন। এমনকি কিছু শব্দও বেশ অচেনা লাগল তার। কাগজগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে সে আবার পড়তে শুরু করল। এবার আরও মনোযোগ দিয়ে। অবশেষে সে খুঁজে পেল—পাতার এক কোনায় পড়ে রয়েছে খবরটা।
কাগজটার নাম “চেরিগুড গেজেট” আর প্রথম লেখাটা রয়েছে পাতায় শেষের দিকে—
জেলবন্দীর আত্মহত্যা
একজন অপরিচিত বন্দী, যাকে প্রশাসন অপরাধমূলক মতবাদের প্রচার এবং বে–আইনিভাবে দলপাকানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল, আজ সকালে তাকে জেলের মধ্যেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়…
কনজার পড়া শেষ করল। ধুস—এতে হবে না। দরকারি তথ্যই নেই। ফালতু রিপোর্টিং। আরও তথ্য দরকার তার। সে কাগজগুলোকে নিয়ে তাকে রেখে এল। কিন্তু ততক্ষণে তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
লাইব্রেরিয়ান একজন চশমা পরা ভারিক্কী চেহারার মধ্যবয়েসী মহিলা। কনজার তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল।
“আরও কাগজ চাই—মানে পুরোনো কাগজ। হবে?”
লাইব্রেরিয়ান ভুরু কোঁচকাল, “কোন কাগজ? কত পুরোনো?”
“এই মাসখানেকের পুরোনো, বা তারও আগের।”
“গেজেট এর? আমাদের তো আপাতত এই আছে। আপনি কী খুঁজছেন বলুন, আমি সাহায্য করতে পারি আপনাকে।”
কনজার কোনও কথা বলল না।
“আপনি এক কাজ করুন। আপনি পাশের গেজেট-এর অফিসে যাচ্ছেন না কেন?” লাইব্রেরিয়ান চশমাটা চোখ থেকে খুলে বললেন, “ওখানে আপনি সব পুরোনো এডিশন পাবেন। তবে আপনি যদি আমাকে বলেন আমিও…”
ততক্ষণে কনজার লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিয়েছে গেজেট অফিসের দিকে।
লাইব্রেরি ছাড়িয়ে কিছুটা হাঁটলে ফুটপাতের ওধারে গেজেট এর অফিস। ফুটপাতের অবস্থা ভালো না। জায়গায় জায়গায় চাঙড় উঠে গেছে। ছোট অফিসঘরে ঢুকে কনজার এদিক ওদিকে তাকাতেই একজন ভারী চেহারার লোক উঠে চেয়ার থেকে উঠে তার দিকে এগিয়ে এল।
“কী চাই?”
“একমাস বা তার বেশি পুরোনো খবরের কাগজ।”
“কিনবেন নাকি?”
“হ্যাঁ, সেরকমই ইচ্ছে আছে।” কনজার পকেট থেকে একগোছা নোট বের করে বাড়িয়ে ধরল।
লোকটা নোটগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তড়বড় করে বলল, “একটু দাঁড়ান। এখুনি এনে দিচ্ছি।”
একটু পরেই দেখা গেল লোকটা ঘরের ভেতর থেকে দু’হাত ভরে প্রচুর খবরের কাগজ নিয়ে আসছে। কাগজের স্তূপের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তার ভারী অবয়ব। কনজারের সামনে ধপাস করে সেগুলো ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আপাতত এগুলো নিন। পুরো বছরের আছে। আপনি যদি আরও চান…”
কনজার দ্বিরুক্তি না করে কাগজের স্তূপটা তুলে নিয়ে বাইরে চলে এল। পড়তে লাগল অখন্ড মনোযোগে। আপাতত চারমাস আগের খবরটা দেখলেই হবে, তার মানে ডিসেম্বর।
এই তো!! পাওয়া গেছে!
খবরটা এতটাই ছোট যে এখুনি ওর চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিল প্রায়। পড়তে পড়তে ওর হাত কাঁপতে লাগল। পকেট থেকে অভিধান বের করে কয়েকটা পুরোনো শব্দের অর্থও বুঝতে হল ওকে।
বে–আইনি সমাবেশে বক্তব্য রেখে গ্রেপ্তার এক ব্যক্তি
কুপার ক্রিক শেরিফ অফিসের বিশেষ বাহিনী আজ এক পরিচয়হীন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। শেরিফ অফিস থেকে স্বয়ং শেরিফ ডাফ ঘটনাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন। জানা গেছে লোকটিকে নাকি সম্প্রতি কুপার ক্রিকের ধারে কাছে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছিল। তারপর থেকেই লোকটির ওপর চব্বিশ ঘন্টা নজরদারী শুরু হয়…
আচ্ছা! তাহলে জায়গাটা কুপার ক্রিক আর সময়টা ১৯৬০ এর ডিসেম্বর!
কনজারের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এটুকু তথ্য যথেষ্ট। ফুটপাত থেকে উঠে দাঁড়াল সে। প্যান্ট থেকে ধুলো ঝেড়ে নিল পরিপাটিভাবে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। চারপাশের রক্তিমাভা জানান দিচ্ছে সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। কনজারের মুখে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। খুব দরকারি তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে সে। স্রষ্টার আবির্ভাবের স্থান ও কাল দুটোই এখন তার হাতের মুঠোয়।
তার পরবর্তী গন্তব্য এখন কুপার ক্রিক, আপাতত ১৯৬০ এর নভেম্বরে গেলেই হবে।
কনজার নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে চলল শহরের মূল রাস্তা ধরে। লাইব্রেরি পেরিয়ে, মুদির দোকান গ্যারেজ অতিক্রম করে সে সোজা হেঁটে চলল টিলাটার দিকে। সে জানে তার কাজের কঠিনতম ধাঁধাটা সে নির্বিঘ্নে সমাধান করে ফেলেছে। এবার কুপার ক্রিকে গিয়ে তাকে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হবে আর অপেক্ষা করতে হবে সেই বিশেষ দিনটির।
চলতে চলতে একটা মোড় ঘুরেই কনজার দেখল একজন মহিলা এগিয়ে আসছেন হাতে প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে। জিনিসের ভারে নুয়ে পড়েছেন তিনি। রাস্তাটা ছোট হওয়ায় কনজার একপাশে দাঁড়িয়ে মহিলাকে আগে যেতে দিল। মহিলা তার পাশ দিয়ে যাবার সময় স্বাভাবিক কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য তার দিকে তাকালেন এবং মুহূর্তের কি একটা দেখে তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হাঁ করে কনজারের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি।
কনজার মহিলাকে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। কী ব্যাপার রে বাবা! কিছু গণ্ডগোল হল নাকি? মহিলা অমন করে কেন? কনজার একবার ঘুরে পেছনে তাকাল। মহিলা তখনও ঠায় তার দিকে চেয়ে আছেন। হাতে জিনিসপত্র মাটিতে ফেলে দিয়েছেন তিনি। কনজার বিপদ বুঝে প্রায় দৌড় লাগাল।
একটা বাঁক ঘুরে কনজার রাজপথ ছেড়ে একটা গলি রাস্তা ধরল। পেছনে তাকিয়ে দেখল দূরে মহিলা দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছেন তার দিকে। শুধু তাই নয়, তাঁর সঙ্গে আর দু’জন লোকও জুটেছে। সবাই মিলে তার দিকেই আসছে। কনজার আর অপেক্ষা করল না। এদিক সেদিক করে দ্রুত ছুটে তাদের চোখের আড়ালে চলে গেল সে।
টিলার উপর খাঁচাটার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে ভাবতে লাগল—গণ্ডগোলটা কীসে পাকল। তাহলে কি তার পোষাক-আশাক সময়োচিত হয়নি? এটা দেখেই সন্দেহ করল নাকি লোকজন? কে জানে! কনজার কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
সন্ধে ঘনালে স্ফটিকের খাঁচাটায় ঢুকে সেটা চালু করে দিল কনজার। কন্ট্রোল প্যানেলটা ভালো করে বুঝে নিয়ে হাতলে সামান্য চাপ দিল সে। সতর্কভাবে। মেশিনের চারপাশে আগেরবারের মতোই ঘনিয়ে এল কুয়াশার ঝাঁক। তবে এবার তা বেশিক্ষণের জন্য নয়।
বৃদ্ধ বেশ সন্দেজনক দৃষ্টিতে ওকে দেখছিলেন।
“ভেতরে আসুন। যদি না বাইরের ঠান্ডায় মরতে চান।”
“অনেক ধন্যবাদ।” বৈঠকখানায় ঢুকতে ঢুকতে কনজার মন্তব্য করল।
ঘরের ভিতরটা চমৎকার গরম। ঘরের এককোনে রাখা কেরোসিনের হিটারটা বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বিশাল এক গাউন পরিহিতা ভদ্রমহিলাকেও বাড়ির ভেতরে দেখতে পেল কনজার। মহিলা সম্ভবত রান্নাবান্না করছলিনে। ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা দু’জনে মিলেই কোনও কথা না বলে কনজারকে বেশ মনোযোগ দিয়ে জরিপ করতে লাগলেন।
“আমার নাম মিসেস অ্যাপেলটন।” ভদ্রমহিলা নিজের পরিচয় দিলেন, “আমাদের ঘরটা বেশ আরামদায়ক, যথেষ্ট উষ্ণ। বছরের এই সময়টায় এরকম ঘর না হলে টিঁকে থাকা মুশকিল।”
“আপনাকে ধন্যবাদ ম্যাডাম।” কনজার ভদ্রতার হাসি হাসল।
“আপত্তি না থাকলে আপনি আজ আমাদের সঙ্গে নৈশাহার করে নিতে পারেন।”
“আমি… কী করে নিতে পারি?”
“রাতের খাবার খেয়ে নিতে পারেন।“ ভদ্রলোকের ভুরুটা একটু কুঁচকে উঠল, “আপনি এদিককার লোক নন নাকি?”
“ঠিকই ধরেছেন।” কনজার হেসে ওঠে। “জন্ম আমার এদেশেই, কেবল নিবাস পশ্চিমের দিকে— অনেকটা দূরে।”
“ক্যালিফোর্নিয়া?”
“না না—অরেগন।” কনজার বলল।
“জায়গাটা কীরকম?” মিসেস অ্যাপেলটন বলে উঠলেন, “নিশ্চয়ই খুব গাছপালা রয়েছে, ছায়াঘেরা গভীর বনানীতে ভর্তি? আহা, আমিও শিকাগো থেকে এসেছি জানেন। কিন্তু এই জায়গাটা পুরো ন্যাড়ামুড়ো! কিস্যুটি নেই।”
ভদ্রলোক দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, “বাজে বোকো না তো। শিকাগো আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যে। আর তুমি কি বহিরাগত নাকি?”
কনজার বিনীতভাবে বলে উঠল, “আজ্ঞে, অরেগনকেও তো স্টেটস এরই অংশ—তাই নয় কি।”
ভদ্রলোক কিছুটা আপনমনেই ঘাড় নাড়লেন, কিন্তু কনজার বুঝতে পারল তিনি স্থির দৃষ্টিতে তার পোষাকের দিকেই চেয়ে রয়েছেন।
“আপনার জামাকাপড়গুলো কিন্তু বেশ অদ্ভুত। এসব পেলেন কোথায়?”
কনজার থতমত খেয়ে গেল। একটু সময় নিয়ে সে আস্তে আস্তে বলল, “আমার জামাকাপড় তো বেশ ধোপদুরস্তই। বুঝতে পারছি না তাতে সমস্যাটা কি! দেখুন, আপনাদের যদি আমার সঙ্গ পছন্দ না হয় তাহলে আমি বরঞ্চ অন্য কোথাও…”
দুজনেই হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। মহিলা কাষ্ঠহেসে বললেন, “দেখুন কিছু মনে করবেন না। সরকারের আদেশ আছে যেন আমরা কোনও অপরিচিত ব্যক্তিকে একটু দেখেশুনে নিই। জানেনই তো—লালেদের ওপর সরকারের কিরকম মনোভাব।”
“লাল? লাল আবার কারা?” কনজার একটু ধাঁধায় পড়ে গেল।
“ওরা নাকি আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে সবসময়। সরকার বাহাদুর জানিয়ে দিয়েছেন যেন কাউকে একটু অন্যরকম মনে হলেই পুলিশে খবর দেওয়া হয়।”
“আমার মতন?”
বৃদ্ধ দম্পতি সামান্য অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন, “আরে না না। আপনাকে দেখে মোটেই কমি টাইপ মনে হয় না। কিন্তু বোঝেনই তো। সাবধানে থাকতে হয়—ট্রিবিউনে লিখেছে…”
কনজার অন্যকিছু ভাবছিল। স্রষ্টাকে খোঁজার কাজটা এখন তার জলবৎ তরলং মনে হচ্ছে। স্রষ্টা এলেই সে জানতে পেরে যাবে। অবস্থা যা, তাতে সামান্য চোখ-কান খোলা রাখলে আশপাশের লোকজনের কানাঘুষোতেই ও জেনে যাবে। শুধু ঘাপটি মেরে থেকে খবরটা আদায় করতে হবে—সম্ভব হলে দোকানে-টোকানে বসে, একটু আড্ড টাড্ডা মারলেই কিছু খবর তো বেরিয়ে আসবেই। তা ছাড়া এই মিসেস অ্যাপেলটনকেও একটু পেট পাতলা বলেই মনে হচ্ছে তার।
“আমার ঘরটা একটু দেখতে পারি?” কনজার মিসেস অ্যাপেলটনকে অনুরোধ করল।
“হ্যাঁ নিশ্চই” মিসেস অ্যাপেলটন বলে উঠলেন, “এদিকে আসুন।”
মহিলা তাঁকে দোতলায় নিয়ে গেলেন। ওপরতলাটা নীচের চেয়ে তুলনামূলক ঠান্ডা। কিন্তু বাইরের ঠান্ডার তুলনায় কিছুই না—তা ছাড়া সেই হিমশীতল মঙ্গলের মরুভূমির অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল কনজারের। উফফ, সেদিক থেকে দেখতে গেলে, এ তো স্বর্গ!
দোকানের শোকেসে সাজানো কাঁচা সবজির ক্যান আর কাচঢাকা ফ্রিজের মধ্যে রাখা ফ্রেস মাছ মাংসের স্লাইসগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কনজার।
দোকানের সামনে একটা অদ্ভুত ড্রেসপরা দাড়িওয়ালা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসিটা চাপতে পারল না এড ডাভিস। “কিছু লাগবে নাকি?” এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।
“ন্যা” লোকটা মজাদার উচ্চারণে বলল, “অই একটু ঘুরে ঘুরে দেখছি আর কি।”
“বেশ” এড আবার কাউন্টারে ফিরে গেল। চোখ তুলে দেখল মিসেস হ্যাকেট ট্রলিটা নিয়ে দোকানে ঢুকছেন।
“কে ওটা?” মিসেস হ্যাকেটের চোখ ছোট হয়ে এসেছে দোকানের বাইরের লোকটার দিকে তাকিয়ে। “আগে তো দেখিনি এখানে কখনো।”
“কি করে বলব? আমিও আজ প্রথম দেখছি।” এড জবাব দিল।
“কিম্ভূত দেখতে। এরকম দাড়ি কে রাখে? কেউ রাখে? কিছু একটা গন্ডগোল নিশ্চই আছে।“
“হতে পারে ওভাবে দাড়ি রাখা লোকটার শখ। শখ তো অনেকেরই অনেকরকম থাকতে পারে। আমার এক কাকা…”
“চুপ, একদম চুপ” মিসেস হ্যাকেট সিঁটিয়ে গেলেন, “আরে কী নামটা ছিল—দুচ্ছাই সব ভুলে যাচ্ছি! ওই কমিটার কী নাম ছিল, বুড়ো মতন যার দাড়ি ছিল—হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, কার্ল মার্ক্স।”
এড হো হো করে হেসে ফেলল, “আরে দূর দূর। ও কার্ল মার্ক্স কেন হতে যাবে? আমি মার্ক্সের ছবি দেখেছি। সে মোটেই এমন দেখতে নয়।”
মিসেস হ্যাকেট অবাক হয়ে এডের দিকে তাকালেন, “কি আশ্চর্য—তুমি মার্ক্সকেও দেখেছ? যাকগে, শোন এড—এই লোকটার ওপর নজর রাখো। আমাদের ভালোর জন্যই এটা দরকার।”
“উঠে আসুন।”
কনজার চমকে ঘুরে তাকাল। নিজের অজান্তে এবং কিছুটা অভ্যেসের বশেই তার হাতটা দ্রুত কোমরের বেল্টটা ছুঁয়ে ফেলল।
পেছনে তাকিয়ে কনজার আশ্বস্ত হল। একটা গাড়িতে একজোড়া কিশোর কিশোরী বসে তাকে হাত নাড়ছে। সে মুচকি হেসে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল, “বেশ।”
গাড়িতে উঠে কনজার দরজা বন্ধ করতেই বিল উইলেট অ্যাক্সেলেটরে চাপ দিয়ে উল্কাবেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
“লিফট দেবার জন্য ধন্যবাদ”, কনজার সতর্কভাবে মেপে মেপে কথাগুলো বলল, “আসলে আমি একটু এদিক ওদিকে দেখতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু যা বুজছি, পাশাপাশি দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্বটা একটু বেশিই।”
গাড়িতে বসে থাকা সুন্দরী লোরা হান্ট তাকে দেখছিল। নীল স্কার্ট আর হলুদ সোয়াটারে প্রজাপতির মতো লাগছিল তাকে। “আপনি কোথা থেকে আসছেন?” লোরা জিজ্ঞেস না করে পারল না।
“কুপার ক্রিক।”
গাড়ি চালাতে চালাতে বিল মন্তব্য করল, “আরে, কুপার ক্রিকের বাসিন্দা আপনি? অদ্ভুত ব্যাপার। আগে তো দেখিনি আপনাকে ওখানে।”
“আপনি কি ওখান থেকেই আসছেন?”
“আরে আমার জন্ম কুপার ক্রিকে। ওখানকার প্রতিটা ইট আমি চিনি।”
“অ—তা আমি সবেমাত্র অরেগন থেকে এসেছি।“
“ওহ! জানতাম না অরেগনের লোকজনের উচ্চারণে এতটা পার্থক্য আছে।“
“আমার কি উচ্চারণে সমস্যা আছে?”
“আরে না না – কিন্তু আপনি বেশ মজাদার ভাবে কথা বলেন। তাই না লরা?”
“কীরকম?”
লরা হাসতে হাসতে বলল, “আপনার উচ্চারণে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। তবে আপনি কথা বলতে থাকুন। আমার কিন্তু শুনতে বেশ লাগছে।“ কনজার লরার দিকে দেখছিল। ওর হাসি দেখে অকারণেই তার বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে উঠল।
“আমার একটু কথা আটকে যায়—মানে একটু সমস্যা আছে।”
“ওহ” লরার চোখ বড় হয়ে উঠিল, “দুঃখিত। আমার তাহলে এভাবে বলা উচিত হয়নি।”
গাড়ির আওয়াজের মধ্যে কনজার দ্রুত ভাবতে লাগল কথাটা কিভাবে পাড়া উচিত—কীভাবে জিজ্ঞেস করলে তার ওপর কেউ সন্দেহ করবে না।
“শহরের বাইরে থেকে খুব একটা লোকজন এখানে আসে না, তাই না?” কনজার জিজ্ঞেস করল।
“নাহ—বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল।” বিল মাথা নাড়ল।
“তাহলে একমাত্র আমিই এতদিন পরে বাইরে থেকে এসেছি, তাই না?”
“মনে তো হয়।”
কনজার একটু ইতস্তত করল, “আসলে আমার এক বন্ধু অনেক দূর থেকে আসছে। মানে এখানেই আসছে আর কি। আমি চাই না সে আমাকে দেখতে না পেয়ে ফিরে যাক। তাই ঠিক কীভাবে আর কোথায় তাকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি? কাউকে জিজ্ঞেস করলে লাভ হবে কি?”
বিল আর লরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বিল বলল, “কী আর করবেন? চোখ-কান খোলা রাখুন। কুপার ক্রিক বিশেষ বড় জায়গা তো নয়।”
এ কথার পর সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। বিল গাড়ি চালাতে লাগল আর কনজার আড়চোখে লরাকে দেখছিল। কনজারের মনে হল, লরা বিলের প্রেমিকাও হতে পারে বা পরীক্ষামূলক স্ত্রী-ও হতে পারে। তবে কনজার ঠিক জানে না এই সময় এখানে পরীক্ষামূলক বিয়ে চালু হয়েছে না হয়নি। তবে যাইহোক, লরার মত সুন্দরী যে সিঙ্গল ঘুরবে না সে বিষয়ে কনজার নিশ্চিত। কতই বা বয়েস হবে লরার—এই ষোলো কি সতেরো! পরের বার যদি একান্তে সাক্ষাতের সুযোগ হয়, তাহলে জিজ্ঞেস করে নেবে সে।
পরেরদিন সকালে কনজার কুপার ক্রিকটা পায়ে হেঁটে দেখার উদ্দ্যেশে বেরোল। মূল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাজার, দুটো পেট্রল পাম্প, পোষ্ট অফিস পেরিয়ে সোডা ফাউন্টেন দোকানটা দেখতে পেল।
লরা ভেতরে বসে রয়েছে। দোকানের এক কর্মচারীর সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় মশগুল। কনজার দোকানের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কী ভেবে দোকানে ঢুকে পড়ল। ভিতরে ঢুকতেই এক ঝলক আরামদায়ক উষ্ণ বাতাস তাকে যেন আলিঙ্গন করল। কনজার দেখল লরা ক্রিম দিয়ে হট চকলেট খাচ্ছে। কনজারকে দেখে ভুরু তুলে তাকাল সে—বেশ অবাকই হয়েছে।
কনজার লরার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
“আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?” কনজার অনুনয়ের সুরে জিজ্ঞেস করল।
“না না একদমই না।” লরার চোখগুলো কি মোহময়ী!
দোকানের কর্মচারী এগিয়ে এল অর্ডার নিতে। কনজার বলল, “ও যা খাচ্ছে, সেম আমার জন্য।”
লরা কনজারকে লক্ষ করছিল। অর্ডার দেওয়া হলে সে বলল, “কাল আমি আপনাকে আমার নাম বলতে ভুলে গিয়েছি। আমার নাম লরা হান্ট।”
লরা হাত বাড়িয়ে দিলে কনজার ইতস্তত করে ওর হাতটা গ্রহণ করল, কিন্তু বুঝতে পারল না তারপর কী করতে হবে। “আমার নাম কনজার,” কুণ্ঠিতস্বরে সে বলল।
“কনজার? এটা কি নাম না পদবী?”
“হুম, এটা পদবী। আমার পুরো নাম ওমর কনজার।”
“ওমর—আহা। মানে সেই কবির মতো? ওমর খৈয়াম?” লরা হেসে ফেলল।
“খৈয়ামের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বলতে গেলে, কবিদের ব্যাপারে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। আমাদের ওখানে শিল্প এবং কলা ব্যাপারগুলো খুবই কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। কেবল আদিগীর্জাতেই এসব…” কনজার আচমকা থেমে গিয়ে লরার দিকে তাকাল। লরা এক দৃষ্টিতে তাকে দেখে চলেছে। কনজার লাল হয়ে উঠল, “না মানে, আমি যেখান থেকে আসছি আর কি!!”
“আদিগীর্জা, কোন গীর্জার কথা বলছেন আপনি?”
“গীর্জা মানে গীর্জা” চকলেট এসে যাওয়াতে কনজার প্রায় বুভুক্ষুর মত গোগ্রাসে খেতে লাগল।
লরা মন দিয়ে কনজারকে দেখছিল। “দেখুন, আপনি একটু অন্যরকম। বিলে-র যদিও আপনাকে ঠিক পছন্দ নয়। ওর কথা আমি না হয় বাদই দিলাম। গতানুগতিকার থেকে আলাদা এমন সবকিছুই ওর অপছন্দের। বড্ড বেরসিক। যাইহোক, আপনার কি মনে হয় না একজন মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলানো উচিত?”
কনজার নীরবে মাথা নাড়ল।
“ও বলে বিদেশিরা নিজেদের দেশেই ভালো। এখানে যেন না আসে। মানে প্রাচ্যদেশীয়দের কথা বলতে চেয়েছে হয়তো। কিন্তু আপনাকে তো অতটা বিদেশি লাগে না।”
কনজার আবার নীরবে ঘাড় নাড়ল।
দরজার ঘন্টি শুনে বোঝা গেল দোকানের দরজা ঠেলে কেউ ঢুকছে। কনজার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বিল।
লরা এবং কনজারকে একসঙ্গে দেখে বিলের ভুরু কুঁচকে গেল। স্পষ্টতই বোঝা গেল বিরক্ত হয়েছে যথেষ্ট।
“লরা তোমাকে এইসময় এখানে দেখব, সত্যিই আশা করিনি।” বিলের দৃষ্টি কনজারের ওপর নিবদ্ধ।
কনজারের শরীরের পেশি টানটান হয়ে উঠল। পরিষ্কার বুঝতে পারল ছোকরার মধ্যে একটা রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
“কেন বিল, কোনও সমস্যা হয়েছে?”
“নাহ, সব ঠিক। লরা, চলো।” বিল লরার দিকে তাকায়।
“যাব? কেন?” লরা বেশ অবাকই হয়।
“আমি বলছি বলেই যাবে। এত প্রশ্ন করার কি আছে?” বিলের কণ্ঠস্বর কঠিন। “চলো বাইরে গাড়ি স্টার্ট দিয়েই এসেছি।”
“বিল উইলেট—ব্যাপারটা কী শুনি? এটা কি শুধুই ঈর্ষা?” লরা চটপট বলে ওঠে।
“এ লোকটা কে? তুমি কি চেন একে? সামান্যতম ধারণাও আছে এর ব্যাপারে? তাকাও এর দিকে। এরকম দাড়ি…”
লরা আচমকা চিৎকার করে ওঠে, “তাতে কি হয়েছে? এই লোকটা হয়তো প্যাকার্ড চালায় না বা তোমার মতো কুপার হাই-তে মস্তি করতে যায় না, তাতে তোমার আঁতে ঘা লাগছে কেন শুনি?”
কনজার বিলকে একবার মেপে নিল। তার তুলনায় যথেষ্ট লম্বাচওড়া। শক্তিশালীও বটে। ছোকরা করেটা কী? লোক ঠেঙিয়ে বেড়ায় নাকি!
“দুঃখিত, আমি বরং উঠি।” কনজার উঠে দাঁড়াল।
“তোমার এখানে কাজটা কী হে?? কী জন্য এসেছ এ শহরে তুমি? আর লরার চারপাশে ঘুরঘুর করছ কেন?” বিল জিজ্ঞেস করল।
কনজার লরার দিকে একবার তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল, “আজ আসি। পরে কথা হবে।”
কনজার উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোনোর উদ্যোগ নিতেই বুঝতে পারল বিলের বিশাল চেহারাটা তার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চকিত কনজারের হাত তার বেল্টে চলে গেল। বেশি নয়। অর্ধেক চাপ দিলেই হবে, সাবধানে!
কনজার ঝুঁকে পড়ে কোমরে চাপ দিতেই ঘরটা যেন একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। কনজার জানে তার পোষাকের মধ্যে থাকা প্লাস্টিক লাইনিং তাকে এই শক থেকে রক্ষা করছে।
“উফ, ভগবান!” লরার মুখ থেকে এই কথাটুকু ছিটকে বেরিয়ে এল। কনজার লরাকে কষ্ট দিতে চায়নি, কিন্তু কি আর করা! আপাতত একটা তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে পুরো শরীরটা সাময়িকভাবে পক্ষাঘাতস্থ হয়ে উঠবে। শরীরটা হয়ে পড়বে স্থাণু জড়বৎ, তার আর নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু একটু পরেই এর প্রভাব কেটে যাবে।
কনজার রাস্তায় নেমে কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলল। কিছুক্ষণ পর বিলকে দেখা গেল মাতালের মতো দোকান থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে আসতে। ততক্ষণে অবিশ্যি কনজার গলিটা পেরিয়ে মূল রাস্তায় গিয়ে উঠেছে।
কনজারকে যেন আজ ভূতে পেয়েছে। সে হেঁটেই চলেছে ক্রমাগত। সোডা ফাউন্টেন থেকে বেরিয়ে আসার পর সে কেবল পথ চলেছে নিরুদ্দেশের যাত্রায়।
অন্ধকার ঘনিয়ে এলে, কনজার লক্ষ করল কিছুটা দূরে আধো অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“কে? কে ওখানে?” কনজার গলা তুলল।
“আপনি কে?” সেই ছায়ামূর্তি বলে উঠল। সঙ্গে কিছু একটা ক্লিক করা শব্দ। পরমুহূর্তেই একটা তীব্র টর্চের আলো কনজার চোখের পড়ে তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।
“আরে এটা আমি।” কনজার বলে উঠল।
“আমিটা কে?”
“আমি, আমি কনজার। অ্যাপেলটনদের বাড়ির ভাড়াটে। আপনি কে?”
কণ্ঠস্বরের অধিকারী এগিয়ে এলেন। কনজার দেখতে পেল লোকটির পরনে একটি লেদার জ্যাকেট এবং কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলছে পিস্তল।
“আমি শেরিফ ডাফ। আপনাকেই খুঁজছি। আপনি আজ ব্লুমস-এ ছিলেন না দুপুর তিনটের সময়?”
“ব্লুমস?”
“সোডা ফাউন্টেন—বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো যেখানে আড্ডা দেয়।” শেরিফ ডাফের টর্চের আলো এখন কনজারের মুখের ওপর। সে চোখ পিটপিট করল।
“আলোটা সরাবেন প্লিজ?”
কয়েক মুহূর্ত পর আলোটা মাটির দিকে নেমে গেল। শেরিফ বললেন, “তার মানে আপনি ওখানে ছিলেন। ওই ওয়ালেট ছোকরার সঙ্গে ঝামেলাও করে এসেছেন শুনলাম। ওর লাভার মেয়েটাকে নিয়ে কিছু ফস্টিনাস্টি…”
“আমরা আলোচনা করছিলাম, আর কিছু না।“ কনজার সতর্কভাবে জবাব দিল।
“তারপর কী হল?”
“কী আবার হবে?”
“না না, কিছু তো হয়েছে। আমি শুনলাম আপনি কিছু একটা কায়দা তো করে এসেছেন। ওরা আমাকে বলল কীরকম একটা আলোর ঝলকানি দেখেছে আর তারপর সবাই নাকি পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছিল।“
“ওরা কেমন আছে এখন?”
“ঠিকই আছে।”
কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ।
“ওটা কী ছিল মিঃ কনজার? কোনও বোমা নাকি?” শেরিফ জিজ্ঞেস করলেন।
“বোমা? হা হা হা” কনজার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। “আরে না না। আমার সিগারেট লাইটারটা হঠাৎ লিক করে আগুন ধরে গেছিল। তাই ওরকম আলোর ঝলকানি দেখেছে ওরা।”
“কিন্তু ওরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল কেন?”
“আরে লাইটারটা লিক করে বিশ্রী কটু গন্ধ বেরিয়েছিল না, সেইজন্য।” কনজার কিছু একটা যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। শেরিফ মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছেন। কনজারের হাতটা আপনা থেকেই তার বেল্টের কাছে চলে এল।
একটা চাপা শব্দ করে শেরিফ নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। “ঠিক হ্যায়। আপনার কথা বিশ্বাস করছি। কারণ কারো ক্ষতি তো কিছু হয়নি। আর ওই উইলেট ছোকরাকে আমার ঠিক পছন্দ নয়, বড্ড বেশি ডেঁপো।”
“ধন্যবাদ শেরিফ। শুভরাত্রি।” কনজার চলে যাবার উদ্যোগ করল।
“এক মিনিট দাঁড়ান।” শেরিফ পথ আটকে দাঁড়ালেন। “আপনার পরিচয়পত্রটা একটু দেখি।”
“এই যে” কনজার স্বাভাবিকভাবেই প্যান্টের পকেট থেকে কাগজগুলো বের করে দিল।
শেরিফ কাগজগুলোর ওপর টর্চের আলো ফেলে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কনজার চুপচাপ দেখছিল, কিন্তু ভেতর ভেতর ঘামছিল সে। যদিও ওরা সমস্ত ঐতিহাসিক নথিপত্র খুব ভালোভাবে চেক করেই এ ডকুমেন্টগুলো বানিয়েছে, তবুও যদি কোথাও ভুল থেকে যায়?
“এই নিন, দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মিঃ কনজার।” শেরিফ টর্চটা নিভিয়ে দিলেন।
কনজার যখন অ্যাপেলটনদের বাড়িতে পৌঁছাল, তখন বৃদ্ধ দম্পতি টিভিতে কিছু একটা দেখছিলেন। কনজারের আগমন খেয়ালও করলেন না। তবুও কনজার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
“একটা কথা জানার ছিল মিঃ অ্যান্ড মিসেস অ্যাপেলটন। আজ তারিখটা ঠিক কত?”
“পয়লা ডিসেম্বর! কেন? এই তো নভেম্বর শেষ হল।”
কনজার নিজের ভুল বুঝতে পারল। সে এখন বিংশ শতাব্দীতে রয়েছে। এখানে এখনও বারো মাসে বছর গণনার পুরোনো সিস্টেম চলছে। নভেম্বরের পরে সোজাসুজি ডিসেম্বরে ঢুকে যায়। কোয়ার্টেম্বরের ধারণা এখনও আসেনি।
কনজার চমকে উঠল। তার মানে কালই সেই দিন!!
ধন্যবাদ জানিয়ে কনজার নিজের ঘরে এসে হাঁপাতে লাগল।
কি গাধা সে। খবরের কাগজেই তো পড়ে এল যে দোসরা ডিসেম্বর স্রষ্টা আসবেন এবং প্রচার করবেন তাঁর মতবাদ। আর মাত্র বারো ঘণ্টা—তারপরেই ঘটবে সেই ঘটনা। আর গ্রেপ্তার হতে হবে তাঁকে।
সকালটা বেশ চমৎকার। উষ্ণ, মেঘমুক্ত আকাশ। কনজারের জুতোর চাপে পথের বরফগুলো যেন দিবানিদ্রা ভেঙে মড়মড় শব্দে বিরক্তি জানাচ্ছিল। চারপাশে যে ক’টা গাছপালা আছে সবেতেই বরফের একটা সাদা চাদর বিছানো। টিলার ওপর দাঁড়িয়ে কনজার প্রকৃতিকে মুগ্ধভাবে দেখছিল। তারপর অলস পদক্ষেপে টিলার নীচে নামতে লাগল সে। বরফে পা হড়কে যাচ্ছিল বারংবার, কিন্তু সতর্ক হওয়ার চেয়ে কেমন একটা একটা গভীর আচ্ছন্নতাকে ভেতর থেকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করছিল তার।
টিলার ওপাশে নেমে সে একবার চারপাশে দেখে নিল। না, সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য জায়গা। কনজার কোমর থেকে টেনে বের করল একটা ছোট ধাতব লাঠির মতো জিনিস। সেটার হাতলটা মোচড়াতেই তার পারিপার্শ্বের হাওয়াটা যেন কাঁপতে লাগল। মুহূর্তমধ্যে স্ফটিকের খাঁচাটা তার সামনে উপস্থিত হল প্রায় শূন্য থেকেই। কনজারের কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগল—তার ফিরে যাওয়ার একমাত্র উপায় এই জিনিসটাই।
তার সামনে এখন হাডসন’স ফিল্ড। বিরাটা ফাঁকা প্রান্তরটা টিলা ছাড়িয়ে মিশে গেছে মূল রাস্তায়। পাতলা বরফের চাদরে ঢাকা এই জায়গাটা এখন সম্পূর্ণ খালি। আর কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য এখানে আসবেন মহান স্রষ্টা—সূচনা করবেন ইতিহাসের এক নব-অধ্যায়ের। তারপর তিনি গ্রেপ্তার হবেন এখান থেকেই।
তবে আজ ব্যাপারটা একটু আলাদা হবে। আজ স্রষ্টা কিছু বলার আগেই তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ হবে কনজারের হাতে।
স্ফটিকের খাঁচায় ঢুকে সে তাক থেকে অস্ত্রটা নামিয়ে ভালো করে দেখল। তারপর অস্ত্রটা সেট করে হাতে নিয়ে বেরোনোর সময় সে থমকাল। এখন অস্ত্রটা নিয়ে ঘোরাফেরা করা হয়তো ঠিক হবে না! স্রষ্টার আসতে এখনও প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি আছে। এরমধ্যে যদি অন্য কেউ এসে পড়ে! স্রষ্টা আসছে দেখলেই সে চট করে খাঁচায় ঢুকে অস্ত্রটা নিয়ে নেবে।
অস্ত্রটা তাকে রেখে সে অন্য প্যাকেটটা তাক থেকে সন্তর্পণে নামাল। প্যাকেট খুলে খুলিটা হাতে নিতেই একটা ঠান্ডা স্রোত তার মেরুদন্ড বেয়ে দ্রুত নীচে নেমে গেল। যার খুলিটা সে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভাবতেই অদ্ভুত লাগে যে সেই লোকটা এখনও বেঁচে। কিছুক্ষণ পর সেই এইখানেই পঞ্চাশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলবে। ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল কনজার।
আচ্ছা যদি স্রষ্টা কোনও ভাবে নিজের খুলিটা দেখতে পায়? নিজের হলদে হয়ে যাওয়া দাঁত বের করা বীভৎস করোটি যদি তার হাতে ওঠে—সেটা দেখে সে ঠিক কী করতে পারে? তারপরও কি তার কথা বলার মতো অবস্থা থাকবে? আর থাকলেও কী বলবে সে?
মানুষ যদি নিজের করোটি নিজে দেখতে পায় তাহলে সে কি করতে পারে? নিজের ক্ষণজন্মা জীবনকে উপভোগ করতে পারে নিজের মতন করে। নিজের খুলি হাতে করে মানুষ হয়তো জীবনের কিছু সুপ্ত উদ্দেশ্যকে সফল করার চেষ্টা করতে পারে, যা সে হয়তো জীবদ্দশায় আশাই করেনি কোনওদিন। কিন্তু তাই বলে সম্পূর্ণ বিপরীত একটা জিনিস প্রচার করা…
বাইরে একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল কনজার। কে?
খুলিটা রেখে অস্ত্রটা বাগিয়ে ধরে কনজার এক পা এক পা করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
এখন এখানে কে হতে পারে? স্রষ্টা নাকি? হয়তো বাইরের ঠান্ডায় থাকতে না পেরে এখানে উঠে আসতে চাইছেন। হয়তো বা ঝালিয়ে নিচ্ছেন প্রচারের শব্দমালা। যদি উনি দেখে ফেলেন যে কনজার এতক্ষণ হাতে কী ধরে দাঁড়িয়েছিল!!
দরজাটা এক ধাক্কায় খুলেই সে অস্ত্র তাক করল বাইরে! আরে এ যে লরা!
উলের জ্যাকেট আর বুট পরে ঠিক দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। নাক মুখ থেকে দমকে দমকে সাদা বাষ্প বেরিয়ে আসছে তার। হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুক।
কনজার কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। তারপর অস্ত্রটা নামিয়ে লরাকে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার লরা। তুমি এখানে কী করছ?”
লরা কথা বলল না। আঙুল দিয়ে মূল রাস্তার দিকে দেখাতে লাগল। কনজার উঁকি মেরে দেখল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।
“কি বলতে চাইছ পরিষ্কার করে বলবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।“
“ওরা আসছে।”
“ওরা? কারা আসছে?”
“ওরা—পুলিশ। কাল রাতে শেরিফ নাকি ফোন করে রাজ্য পুলিশের থেকে পুরো ফোর্স চেয়ে পাঠিয়েছিল। গাড়ির পর গাড়ি ভর্তি পুলিশ আসছে। প্রায় ষাটজন। রাস্তা পুরো বন্ধ।”
লরা দম নেওয়ার জন্য একটু থামল। “ওরা বলছে…”
“কী বলছে?”
“ওরা বলছে তুমি একজন কমিউনিস্ট। ওরা বলছে…”
কনজার খাঁচার তাকে নিজের অস্ত্রটা রেখে দিয়ে বেরিয়ে এল। লরার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “আর তুমি আমাকে সতর্ক করতে এতদূর ছুটে এসেছ? তুমি কি বিশ্বাস করো না যে আমি কমিউনিস্ট?”
“জানি না!”
“একাই এসেছ?”
“না, জো ওর ট্রাকে করে আমাকে পৌঁছে দিয়েছে।”
“জো, সে কে?”
“জো ফ্রেঞ্চ—কলের মিস্ত্রি। আমার বাবার বন্ধু।”
“চলো” কনজার লরার হাত ধরে এগিয়ে গেল হাডসন’স ফিল্ডের দিকে।
টিলাটা অতিক্রম করে তারা যখন মাঠের নেমে এল, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ট্রাকটা নজরে পড়ল কনজারের। বেঁটেখাট ভারি চেহারার জো ফ্রেঞ্চ স্টিয়ারিঙে বসে পাইপ টানছিলেন।
“তুমিই কি সে?” ভারী গলায় জো জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ আমিই?” কনজার উত্তর দিল, “আমাকে সাবধান করার জন্য ধন্যবাদ।”
ভদ্রলোক কাঁধ ঝাকালন। “দেখ আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানি না। লরা বলল, “তুমি লোক ভালো, তাই এলাম। তা ছাড়া…” কনজারে দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন জো, “পুলিশ ছাড়া আরও লোক আসছে কিন্তু এখানে।“
“পুলিশ ছাড়া? আর কারা আসছে?” কনজার শহরের রাস্তাটার দিকে তাকাল। এবার দেখা যাচ্ছে—এখনও বেশ দূরে রয়েছে। খুদি খুদি কালো পিঁপড়ের মতো সারিবদ্ধভাবে দেখা যাচ্ছে তাদের।
“শহরের লোকজন! আরে ছোট শহরে এসব ব্যাপার বেশিক্ষণ চাপা থাকে নাকি? আমরা প্রায় সবাই পুলিশ রেডিয়ো শুনি। লরা যেভাবে খবর পেয়েছে, ঠিক একইভাবে অনেকেই পেয়েছে, তারপর বাকিটা ছড়িয়েছে।”
কনজার এবার সবাইকে দেখতে পেলেও কয়েকজনকে মোটামুটি চিনতে পারছে। ওই তো বিল উইলেট আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা আসছে। অ্যাপেলটন দম্পতিকেও দেখতে পেল সে। ওরে বাবা—সেই দোকানদার এড ডাভিসও আসছে।
জো বললেন, “এবার আমি কাটি। লোকজনের হেবি কৌতূহল। এবার পুলিশও আসবে। আমার কোনও শখ নেই আমার সাধের ট্রাকের গায়ে বুলেটের গুলির ফুটো নিয়ে ঘোরার। লরা, উঠে পড়ো।”
লরা বিস্ফারিত নয়নে কনজারের দিকে তাকিয়ে রইল।
জো তাড়া লাগালেন, “কী হল! ওঠো। এখানে তোমার পক্ষে থাকাটা একেবারেই উচিত নয়।“
লরা বলে উঠল “কেন?”
জো অবাক হলেন, “কেন মানে? আরে এখানে গোলাগুলি চলবে। সেটাই তো দেখতে আসছে সবাই। কি কনজারবাবু, আপনি তো জানেনই।”
“হুম”
“অস্ত্রশস্ত্র তোমার কাছে কিছু আছে নাকি ওসব পাত্তা দাও না?” জো কাষ্ঠহাসি হেসে মন্তব্য করল, “এরকম ওরা আগেও তুলে নিয়ে গেছে ভায়া। জেলে তোমার সঙ্গীর অভাবে হবে না সেটা হলফ করে বলতে পারি।“
কনজার বুঝল মানুষটা তাকে সাবধান করতে চাইছে। কিন্তু তার উপায় নেই। সে এখান থেকে একচুলও নড়তে পারবে না। যে কোনও মুহূর্তে স্রষ্টা চলে আসতে পারে। আচ্ছা, এত লোকের মধ্যে তো যে কেউ হতে পারে সেই স্রষ্টা। সে হয়তো চুপচাপ মজা দেখছে দূর থেকে।
জো ফ্রেঞ্চ-ও স্রষ্টা হতে পারে, তা ছাড়া পুলিশের দলের যে কেউই হতে পারে। এগিয়ে এসে বক্তৃতা দেওয়াটাই তো কাজ। আর আজ যেটা বলা হবে, ভবিষ্যতের সেটাই পাথেয়!
নাহ—কনজারের পালানো চলবে না। তাকে থাকতেই হবে এখানে মাটি কামড়ে! স্রষ্টার মুখনিঃসৃত প্রথম শব্দ উচ্চারিত হবার আগেই…
কনজার লরার দিকে ফিরল, “তুমি চলে যাও লরা। জো তোমাকে নিয়ে যাবে। জায়গাটা তোমার জন্য আর সেফ নয়।”
লরা কাঠের পুতুলের মতো জো ফ্রেঞ্চের পাশে বসল। থিকথিক করা ভিড়ের দিকে তাকিয়ে জো বলে উঠল, “দেখো দেখো—কেমন শকুনের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সব! যেন মৃত্যু উদযাপন করতে এসেছে এরা।”
লরাদের ফেলে যাওয়া পথের দিকে কনজার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল। তারপর ছুটে গেল সেই টিলাটার দিকে। সে ইচ্ছে করলে এখুনি পালিয়ে যেতে পারে এই জায়গা থেকে, কিন্তু কর্তব্য ছেড়ে চলে যাওয়া তার স্বভাবে নেই। চটজলদি খাঁচার মধ্যে ঢুকে সে তাক থেকে নামিয়ে নিলে তার সাধের স্লেম গানটা। নচটা ঘুরিয়ে অস্ত্রটাকে পূর্ণ ক্ষমতায় নিয়ে এল। এবার কেবল ট্রিগার টানার অপেক্ষা। পুরো শহর কুপোকাত হয়ে যাবে এর শক্তিতে। যত্তসব হারামি ধর্ষকামী কুত্তার দল। বেশি কৌতূহল না? দেখ কেমন লাগে…
ওকে কারোর ছোঁবার ক্ষমতা নেই এখন। এই স্লেম গান দিয়ে সব ক’টাকে যে যমের দুয়ারে পাঠাতে পারে এক নিমেষে। পুরো শহরের পুলিশ, বাসিন্দা সবকটাকে। তারপর না হয় সে পালাবে। এরা যদি সেটাই চায়, তবে তাই হোক।
খাঁচা থেকে বেরোনোর আগে হঠাৎ তাকে রাখা খুলিটার দিকে তার নজর গেল।
কী মনে হতে কনজার অস্ত্রটা রেখে খুলিটা তুলে নিল। ঘুরিয়ে দাঁতের দিকটা ভালো করে দেখল। তারপর আয়নার দিকে এগিয়ে গেল!
আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে কনজার খুলিটাকে তুলে ধরল মুখের কাছে। খুলিটার মৃত্যুকঠিন গালে সে তার গালটা ঠেকাল। খুলিটা যেন দু’শো বছরের পুরোনো হলদেটে দাঁত বের করে তাকে উপহাস করছে—কিছু একটা উপলব্ধির পূর্বে তার অজ্ঞতার জন্য ঠাট্টা করছে তাকে। কনজার ঠোঁটটা ফাঁক করে নিজের দাঁতের পাটিগুলোকে ভালোভাবে লক্ষ করল।
আর তখনই সে বুঝতে পারল। পুরোটাই।
এটা তার নিজেরই করোটি। এতদিন ধরে সে তার নিজেরই করোটি বহন করে এসেছে। এতকিছুর মূলে আর কেউ নয়, সে নিজেই।
মহান স্রষ্টা আর কেউ নয়—সে নিজে!
খুলিটা নামিয়ে রেখে কনজার অন্যমনস্কভাবে কনট্রোল প্যানেলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। বাইরে ততক্ষণে গাড়ির আওয়াজ আর লোকজনের কোলাহল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওরা এসে গেছে, সবাই এসে গেছে। কী করবে সে? পালিয়ে আসবে বর্তমানে যেখানে বক্তা তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে? নাকি…
সে পালাবে কোথায়? নিজের করোটিকে নিজের হাতে ধরে আছে সে। নিশ্চিত মরণের থেকে পালিয়ে সে যাবে কোথায়?
কতদিন সে পালিয়ে বেড়াতে পারবে? ঠেকিয়ে রাখবে নিজের ভবিতব্যকে? এক মাস, এক বছর, দশ বছর? পঞ্চাশ বছর? নাহ – সম্ভব নয়! সে জানে সময়টা কোনও ব্যাপার নয়। দু’দিন আগেই সে দু’শো বছরের পুরোনো একটা মেয়ের সঙ্গে বসে আইসক্রিম ভাগ করে খেয়েছে। পালাতে সে পারবে, তবে বেশিদিনের জন্য নয়।
“পালানো” যাকে বলে, সে অর্থে তার পক্ষে আর পালানো সম্ভব নয়। নিজের ক্ষয়ে যাওয়া হাড়, নিজের হলদেটে করোটি হাতে ধরে সেই অনুভূতি থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কোনওমতেই। কেউই পালাতে পারবে না!!
খাঁচাটা থেকে বেরিয়ে সে মাঠের দিকে এগিয়ে গেল। খালি হাতে। মাঠের চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রচুর মানুষ। ওরা একটা দারুণ যুদ্ধ দেখতে এসেছে। সোডা ফাউন্টেনের ঘটনা ওরা নিশ্চই জানে। তাই সবাই চাখতে এসেছে একটা সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ের স্বাদ।
তা ছাড়া চারপাশে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। টিলার ওপরে, পাহাড়ের ঢালে, গাছের আড়ালে বন্দুক হাতে ওঁত পেতে রয়েছে পুলিশের দল। কাঁদানে গ্যাসের শেল, বড় বড় রাইফেল হাতে তাড়া গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করছে সঠিক সময়ের।
ভিড়ের মধ্যে থেকে কিছু একটা উড়ে এসে কনজারের পায়ের কাছে পড়ল। একটা পাথর। কনজার মুচকি হাসল শুধু।
“কী হল?” কেউ একজন বলে উঠল, “বোমা টোমা ছোঁড়ো কিছু।”
“আরে অ্যাই দাড়িওয়ালা—ছোঁড়, বোমা ছোঁড়? এরকম ম্যাদা মেরে গেলে হবে?”
“দেখি তোর কত ক্ষমতা।”
“কিরে ছোঁড়—দুটো বোমা ছুঁড়ে মার দেখি।”
হাসির একটা রোল পড়ে গেল জনতার মধ্যে। কনজারও হাসছিল। এবার হাতদুটোকে সে কোমরে রেখে দাঁড়াল।
লোকজনের হাসির আওয়াজ মিলিয়ে এল ধীরে ধীরে। সবাই বুঝল ও কিছু বলতে চায়।
“আমি সত্যি দুঃখিত। আমার কাছে বোমাটোমা কিছু নেই।” কনজার স্পষ্ট উচ্চারণে বলল।
একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল ভিড়ের মধ্যে থেকে।
“তবে একটা বন্দুক আছে। দুর্দান্ত জিনিস। তোমাদের থেকে অনেকগুণে ভালো। বিজ্ঞানের তৈরি—তোমাদের চেয়ে অনেক আধুনিক বিজ্ঞানের। কিন্তু আমি সেটাও ব্যবহার করতে আসিনি।”
ভিড়টা যেন হঠাৎ থতমত খেয়ে চুপ করে গেছে।
“কেন জানতে পারি?” কেউ একজন জিজ্ঞেস করল। কনজার চারপাশে তাকাল। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক মহিলা—সামান্য বয়স্ক। মুখটা খুব চেনা লাগছে যদিও। কোথায় দেখেছে মহিলাকে, কোথায়?
কনজারের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। স্পষ্ট মনে পড়েছে। সেদিন লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে যখন টিলার দিকে ফিরছিল সে, এই মহিলা তাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তখন কনজার বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন সে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারছে।
তাহলে এই হল স্রষ্টার মৃত্যুঞ্জয়ী রহস্য! বন্দুক থাকা সত্ত্বেও সেটা না ব্যবহার করার বোকামিতে যারা তার ওপর আজ হাসছে, বিজ্ঞানের একটা ছোট্ট প্যাঁচে তারাই তাকে অমর বলে দু’দিন পর পুজো করবে। জেলের মধ্যে পচে মরার কয়েক মাস পরেই তার আবির্ভাব ঘটবে।
এইভাবেই সে মৃত্যুকে বারবার এড়াতে থাকবে—কেবলমাত্র একটা দুপুরের জন্য। একটামাত্র দুপুর। কিন্তু ওইটুকুই ওদের জানার জন্য যথেষ্ট যে সে বেঁচে রয়েছে। মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সে ফিরে এসেছে পৃথিবীর বুকে।
তারপর—তারপর দুই শতাব্দী পরে সত্যি সত্যি আবির্ভূত হবে সে পুনর্বার। জন্ম নেবে মঙ্গলগ্রহের এক ছোট্ট গ্রামে। বড় হবে, শিখবে শিকার করতে আর জানবে নিঁখুত চোরাকারবারি কেমন করে সামলাতে হয়।
একটা পুলিশের গাড়ি শব্দ করে মাঠের প্রান্তে এসে দাঁড়াল। লোকজন পিছিয়ে গেল কিছুটা। কনজার আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে দুহাত তুলল।
“আপনাদের একটা পুরোনো ধাঁধা বলি।” নিস্তব্ধ পরিবেশে কনজারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল মাঠের বাইরে থেকেও।
“যারা জীবন নেয়, তারা জীবন দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করবে। যারা হত্যা করে, তারাও হৃত হবে। কিন্তু যারা জীবন বিলিয়ে দেয়, তারা ফিরে আসবে। বার বার।”
প্রত্যুত্তরে ভিড়ের মধ্যে এবার কিছু শুকনো হাসি শোনা গেল, কিন্তু তাতে কোনও প্রাণ ছিল না। লোকজন কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেছে। পুলিশের দল ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। আসুক। তার আর কিছু বলার নেই। যা বলার ছিল, সে বলে দিয়েছে। এই ছোট্ট ধাঁধাটা নিয়ে মানুষ ভাববে, মনে রাখবে।
হাসিমুখে কনজার তার ভাগ্যনির্দিষ্ট মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল।
মূল গল্প – দ্য স্কাল
লেখক – ফিলিপ কে ডিক
Tags: অনুবাদ গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ফিলিপ কে. ডিক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
সম্ভবতঃ এই সংখ্যার সেরা গল্প এটি। অনুবাদও যথাযথ হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সত্যি চমৎকার গল্প। এতো প্রাণবন্ত! মনেই হয়নি যে অনুবাদ।
তবে শেষের টুইস্টটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। টাইম ট্রাভেলিং নিয়ে বেশি গল্প-মুভি দেখার ফল হতে পারে।
তবে কেবল টুইষ্ট নির্ভরগল্প এটা নয়। এতো ছোট পরিসরে যেভাবে ষাটের দশকের আবহ ফুটিয়ে তুলেছে, এককথায় অসাধার! বুঝাই যাচ্ছে, প্রতিটি বাক্য প্রতিটি শব্দ মেপেমেপে বসানো হয়েছে।
শুভকামনা রইল। এমন গল্প সামনে আরও আশা করছি।
অনেক ধন্যবাদ সইফুলদা। আপনার প্রতিক্রিয়াটি মনোগ্রাহী। ঠিকই বলেছেন – গল্পটার মধ্যে একটা চোরা বার্তা রয়েছে, যেজন্য গল্পটা একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আপ্লুত হলাম।
ব্রাভো সন্দীপন! দুরন্ত অনুবাদ। ফিলিপ কে ডিকের গল্পে এমনিতেই একটা টানটান ব্যাপার থাকে। সেটাকে অনুবাদে একটু ক্ষুণ্ণ করোনি। দারুণ! কেন যে তুমি আরও লেখো না?
এই প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ভালোবাসা বিশুদা। 🙂
শুধু ভালোবাসায় চিড়ে ভিজবে না। আরও লেখা চাই। মৌলিক, অনুবাদ।
গল্পটি যে অসাধারণ সে বিষয়ে কিছু বলাই বাহু। আমি শুধু বলবো এত সুন্দর সাবলীল অনুবাদ যে কোথায় মনেই হয়নি অনুবাদ গল্প পড়ছি। এই গল্পের রেশ অনেকদিন থেকে যাবে।অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ দীপাঞ্জনবাবু। 🙂
অসামান্য গল্পের অতুলনীয় অনুবাদ। ব্রাভো সন্দীপন, ব্রাভো!