প্লিওনাসের ভয়ঙ্কর
লেখক: কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
ফ্যাকাশে একটা আলো। বিষণ্ণ, ধূসর। যেন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে সেটা ছড়িয়ে আছে চরাচর জুড়ে। মাথার ওপর আকাশটাও অদ্ভুত। যতদূর চোখ যায়, হাল্কা খয়েরি রঙের একটা আভা যেন মাখানো আছে গোটা আকাশের এ ধার থেকে ও ধার। সেইসঙ্গে ছড়ানো আছে যেন একটা করাল ছায়া। সে ছায়ায় একটা হিম অন্ধকারের অনুভূতি যেন মনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। আকাশের এমন রঙ আর এমন চেহারা দেখতে চোখ অভ্যস্ত নয়।
পায়ের নিচে পাথরের মত শক্ত জমি, যার অধিকাংশ জায়গা জুড়েই মস্ত মস্ত ফাটল। উঁচুনিচু, এবড়োখেবড়ো এইসব জমিতে কোন গাছপালা নেই। সেসব আছে শুধু দূর থেকে দেখতে পাওয়া পাহাড়ের সীমানায়। আর কি বিচিত্র যে সেইসব গাছ! কত জানা অজানা রঙের প্রলেপ তাদের গায়ে। সেইসব রঙ আর আকৃতি কোন পরিচিত ছবির সঙ্গে মেলানো যাবে না কোনভাবেই।
আর এই সবকিছুর ওপরে আছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা এই জায়গাটাকে করে তুলেছে আরও রহস্যময়। সেটা হল, এই গোটা পরিবেশ জুড়ে কোথাও কোন শব্দ নেই। প্রায় শ্মশানের মত একটা নীরবতা বিরাজ করছে ওদের চারপাশে। শুধু বাতাসের তীব্র হলাহল এখানে বয়ে যাচ্ছে সারাক্ষণ। সরীসৃপের মিহি নিঃশ্বাসের ওঠাপড়ার মতো একটা অস্পষ্ট হিসহিসানি শুধু। তার বাইরে শুধুই এক হিমশীতল নিস্তব্ধতা। এর মধ্যে কেউ কথা বলে উঠলেই যেন তোলপাড় হয়ে যাবে আকাশপাতাল জুড়ে। কোন পাখি গান গেয়ে উঠলেই যেন সাংঘাতিক কোন কান্ড ঘটে যাবে অলক্ষ্যে, অথবা দিগন্তের কোনও অজানা সীমানা থেকে যেন ভয়ঙ্কর কোন আতঙ্কের কালো ছায়া নেমে আসবে নিমেষের মধ্যে।
সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আর থমথমে পরিবেশ। কিন্তু এর বাইরেও আরও কিছু ছিল, যা অভ্যস্ত চোখ আর মনের বাইরে থাকা এই পরিবেশকে করে তুলেছিল আরও অস্বস্তিকর। কিন্তু সেটা যে ঠিক কী, তা বোঝার সাধ্য ওই দুজনের ছিল না। বাইরের এই অদ্ভুত পরিবেশ আর মনের মধ্যে অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি নিয়ে তাই এই মুহূর্তে বসে ছিল ওরা, দ্যুতিমান আর গ্রিভস। আর সেই না জানা অস্বস্তিটা যেন অজানা এক ভাগ্যরেখার মতোই ওদের চারপাশে খুব সাবধানে তার মায়াজাল বিছিয়ে চলেছিল।
তবে তা নিয়ে ওদের যে খুব বেশি মাথাব্যথা ছিল তা নয়। কারণ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওরা অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল। পিন পয়েন্টের লক্ষ্যে কাজ করে ওরা। পাখির চোখের মতো সেটা নিয়েই ওরা মাথা ঘামায়, যেটা ওদের দরকার। তাই এ গ্রহের সবকিছু ওদের চোখে পড়লেও, আর তা নিয়ে মনের মধ্যে কৌতূহল জমা হলেও এখন ওদের কাছে অনেক বেশি প্রয়োজন সেই রহস্যের সমাধান, যার জন্য ওরা হাজির হয়েছে এখানে।
কিন্তু এখানে এসে নামার পর থেকে গ্রহটার কয়েক মাইল এক্সপ্লোর করে ফেলা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত আসল রহস্যের কিছুই যখন ওদের চোখে ধরা পড়ল না, তখন ডুওক্র্যাফ্ট থামিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কি–ই বা উপায়? কোন্ পথে এখন ওরা এগোবে? কিভাবে খুঁজে পাবে এ রহস্যের সমাধান? হতাশার প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে তাই এ ওর মুখের দিকে তাকায়, যদি কোনরকমে খুঁজে পাওয়া যায় পথের সন্ধান, যদি দেখতে পাওয়া যায় আলোর ইশারা। কিন্তু না, ওরা দুজনেই এখন একই পথের যাত্রী। আর সে পথ গভীর অতলান্ত এক রহস্যের, যার সমাধান এই মুহূর্তে ওদের নাগালের বাইরে।
অদ্ভুত এই পরিবেশে ওরা চুপচাপ বসে ছিল প্রায় আধঘন্টা। দুজনেই যে যার নিজের চিন্তায় মগ্ন। এমনকি এই সময়টুকুর মধ্যে কেউ কারও দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত।
একইভাবে কেটে যায় আরও কিছু মুহূর্ত। তারপর একসময় দ্যুতিমান ছটফট করে ওঠে। কিছু করতে না পারার আক্ষেপ ওকে অস্থির করে তুলেছে যেন। মরীয়ার মতো গ্রিভসের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ওঠে, ‘ব্যাপারটা কি হল বলো তো?’
উত্তরে গ্রিভসও মুখ খোলে দীর্ঘ বিরতির পর। কাঁধটা একটু শ্রাগ করে বলে, ‘কি জানি, আমিও তো ঠিক বুঝছি না। কোথাও তো কোন সাড়াশব্দ নেই।’
‘সেই তো! তারপর ভাবো, এইরকম আবহাওয়ায়, যেখানে বাতাসে অ্যামোনিয়া আর কার্বন ডাই–অক্সাইড এত বেশি, টেম্পারেচার এইরকম মারাত্মক, সেখানে তো বেশিক্ষণ থাকাও মুশকিল। কাজেই এতদিনে ওরা যে আর বেঁচে নেই, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’
‘এক যদি না এখান থেকে অন্য কোথাও চলে গিয়ে থাকে’, অন্যমনস্কভাবে বলে গ্রিভস।
‘অসম্ভব! কি বলছো গ্রিভস?’ বেশ জোরেই বলে ওঠে দ্যুতিমান, ‘ভুলে যেও না, ওদের রকেট বিগড়ে যাওয়াতেই ওরা এখানে নামতে বাধ্য হয়। নামার পর ওদের ইঞ্জিনিয়ার রকেটটা সারানোর যথাসাধ্য চেষ্টাও করে। সে কাজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে কম্যান্ডার সাকসেনা পৃথিবীতে এস.ও.এস. পাঠান।’
‘আর তার বারো ঘন্টার মধ্যেই আমরা টেক–অফ করি ওদের খুঁজে নিয়ে যেতে। কাজেই ওদের আর অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়, তাই তো?’ বলে গ্রিভস, ‘কিন্তু ধরো, ওদের এখানে এসে নামা থেকে আমাদের পৌঁছনো পর্যন্ত দশদিন তো কেটে গেছে। আর ওদের সঙ্গে শেষ যোগাযোগ হয়েছে আজ থেকে সাতদিন আগে। তারপর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। যদি এর মধ্যে রকেটটা কোনক্রমে সারিয়ে ওরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ে! হয়তো ওরা এখন পৃথিবীর দিকেই চলেছে! শুধু আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না এই যা।’
গ্রিভসের যুক্তি শুনে মুগ্ধ হয়ে দ্যুতিমান বলে ওঠে, ‘বাঃ! খুব ভালো বলেছো তো! একথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে তো বেটার কিছু হতে পারে না।’
‘কিংবা এটাও হতে পারে যে’, খানিকটা চিন্তিতমুখেই বলে গ্রিভস, ‘হয়তো ওরা এখনও এই গ্রহেই আছে, কিন্তু কোন কারণে যোগাযোগ করতে পারছে না। তবুও বেঁচে ওরা আছেই। কারণ, দ্যাখো, ওদের কিন্তু গ্যালাক্সির ভয়ঙ্কর সব পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি আছে। সে তোমার অতিকায় মহাকাশ–পোকাই বলো, কিংবা তীব্র মহাজাগতিক রশ্মি ; সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য তৈরী হয়েই ওরা পৃথিবী ছেড়েছিল। কাজেই সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবার ক্ষমতা যাদের আছে, তাদের কাছে সামান্য এই তাপমাত্রার ব্যাপারটা খুব একটা এফেক্ট ফেলবে কি? আমার তো মনে হয় না।’
দ্যুতিমান গ্রিভসের কথাগুলো অস্বীকার করতে পারে না। মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, ‘ঠিক। একদম ঠিক বলেছো। কথাটা অবশ্যই ভেবে দেখার মতো। আর যদি তাই হয়, মানে ধরে নিলাম ওরা এখনও বেঁচেই আছে, এবং এই গ্রহেই, তবে তো আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল গ্রিভস। দায়সারা ভাবে এগোলে তো আর চলবে না। আর তার জন্যে দরকার হলে গোটা গ্রহটাই এক্সপ্লোর করতে হবে। তাই না?’
গ্রিভস বলল, ‘একশোবার। আর দেখ, আমরাও কিন্তু সবরকম অবস্থার কথা ভেবেই তৈরী হয়ে এসেছি। সঙ্গে রসদও আছে যথেষ্ট। আর তোমার বা আমার এরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতাও কম নয়। কাজেই যে কোন মূল্যেই ওদের খবর যে আমরা পাবই, এ আমার স্থির বিশ্বাস।’
‘আমারও সেটাই মনে হয় গ্রিভস,’ হাসির চিহ্ন মুখে ফুটিয়ে দ্যুতিমান বলে, ‘আর এক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে যেটা অ্যাডভান্টেজ, সেটা হল, আমাদের যান আর যোগাযোগ ব্যবস্থা দুটোই এখনও অক্ষত। সুতরাং আমরা তো প্রায় পৃথিবীর আওতাতেই রয়েছি, তাই না?’
কথাটার অন্তর্গত রসিকতায় নিঃশব্দে হেসে ওঠে গ্রিভস। কোটি কোটি মাইল দূরত্ব, অথচ দ্যুতিমান সেটা এমনভাবে বলল, যেন এই তো সামনেই, পা বাড়ালেই পৌঁছে যাওয়া যায়। মনে মনে হেসে উঠলেও মুখে আর কিছু বলে না গ্রিভস। শুধু ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা তুলে ধরে সমর্থনের ভঙ্গী করে। তারপর আবার স্টার্ট দেয় ওদের বাহনে। ডুওক্র্যাফ্ট্টা এগোতে শুরু করে গ্রহের উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো মাটির ওপর দিয়ে। ভেতরে বসে গ্লাসোনাইটের জানলা দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চারিদিক লক্ষ্য করতে থাকে দুই সহকর্মী।
গ্রহটার নাম প্লিওনাস। সূর্য থেকে প্রায় ষোল হাজার কোটি মাইল দূরে অবস্থিত ক্রিটান নক্ষত্রের গ্রহমন্ডলীর অন্যতম এই প্লিওনাস গ্রহ। এখানেই আজ ভোরে এসে নেমেছে একটা মহাকাশযান। যানটিতে যাত্রী বলতে মাত্র দুজন — বর্তমান পৃথিবীর দুই দুঃসাহসী নভোচর, দ্যুতিমান মুখার্জী আর হ্যারিসন গ্রিভস।
প্রায় মাসদুয়েক আগে পৃথিবী থেকে একদল মহাকাশচারী বেরিয়েছিল একটা সার্ভে করতে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে গ্রহ–নক্ষত্রগুলির খোঁজখবর নেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু মাত্র দশদিন আগে হঠাৎ পৃথিবীর রাডারে ভেসে ওঠে বিপদসংকেত। মহাকাশচারী দলটির নেতা ছিলেন কম্যান্ডার সাকসেনা। তাঁর পাঠানো সেই বিপদসঙ্কেত থেকে জানা যায় যে, রকেটে হঠাৎ গন্ডগোল ধরা পড়ায় কাছাকাছি থাকা প্লিওনাস গ্রহে ল্যান্ড করতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। এবং তারপর কয়েকঘন্টার বহু চেষ্টার পরেও রকেটটি কোনভাবেই চালু করা যায়নি।
না, রকেটের গন্ডগোলটা কি জাতীয় সেটা সম্পর্কে বিশদে তাঁরা কিছুই বলেননি। শুধু জানা গেছে যে, দলের সঙ্গে থাকা এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার ম্যালকম যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু খবর পাঠানোর সময় পর্যন্ত রকেটের গন্ডগোল দূর হয়নি। এদিকে সেই প্লিওনাস গ্রহটাও পৃথিবীর মানুষের কাছে একটা অজানা গ্রহ। কারণ এর আগে পর্যন্ত সেই গ্রহে কোন মানুষের পা পড়েনি। ফলে সেই অজানা অচেনা গ্রহটিতে তাঁরা সম্পূর্ণ অসহায় ও নিরাপত্তাহীন।
এই ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় যুদ্ধকালীন তৎপরতা। নিমেষের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। দুনিয়ার সমস্ত স্পেস রিসার্চ সেন্টারগুলির ডিরেক্টরদের মধ্যে বার্তাবিনিময় শুরু হয়। আর তার বারো ঘন্টার মধ্যেই সেই মহাকাশচারী দলটিকে উদ্ধারের জন্য পাঠানো হয় একটি মহাকাশযান, যেটি দ্যুতিমান আর গ্রিভসকে নিয়ে আজ সকালে এসে পৌঁছেছে এই প্লিওনাস গ্রহে।
যথাযোগ্য শিক্ষা ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত এই দুই নভোচরের প্রায় বারো বছরের সার্ভিস রেকর্ড মারাত্মক রকমের ভাল। বহু আপৎকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এই দুজন অনায়াসে সেইসব সংকট থেকে পৃথিবীকে বাঁচিয়েছে ওদের সহজাত দক্ষতায়। তাই আজ এইরকম একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, এতদিনে নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠা এদের দুজনকে বেছে নিতে কারুর কোন অসুবিধাই হয়নি।
ইতিমধ্যে আরও তিনদিন এই দলটির সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগ ছিল, আর সে খবর দ্যুতিমানরাও নিয়মিত পেয়েছে। কিন্তু তারপরেই যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে গত সাতদিন এখানে কি ঘটেছে না ঘটেছে, সে ব্যাপারে কোন ধারণাই ওদের নেই।
অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলছিল না দুই সহযাত্রী। প্রোগ্রামিং করা ডুওক্র্যাফ্ট্টা এগিয়ে যাচ্ছিল আপন গতিতে, আর ওরা শুধু বাইরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে গ্রহটার ভূপ্রকৃতি লক্ষ্য করছিল। সেইসঙ্গে ওদের সন্ধানী চোখ খুঁজে চলেছিল, যদি কোথাও ওই মহাকাশযাত্রীদের অথবা বিকল রকেটটার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়।
একটু পরে বড়ো করে একটা শ্বাস ছেড়ে গ্রিভস বলে ওঠে, ‘যতদূর বোঝা যাচ্ছে এ গ্রহে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। কাজেই আমাদের ভয় পাওয়ারও কোন কারণ নেই বলেই মনে হয়, কি বলো মুখার্জী?’
দ্যুতিমান সামান্য মাথা নেড়ে সায় দেয়। তারপর চিন্তিতমুখে বলে, ‘একদিকে তোমার একথা যেমন ঠিক, তেমনই একথাও সত্যি যে, যদি ভয়ের কিছুই না থাকে, তবে ওরা গেল কোথায়? এতগুলো লোক তো আর একসঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না?’
গ্রিভস বলে, ‘নিশ্চয়ই না। তবে আমার বিশ্বাস যে ওরা সবাই এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। দেখ, ওদের সঙ্গে তো আর খাবারের অভাব নেই! কাজেই কোন অঘটন না ঘটলে ওরা বেঁচে থাকবেই। হয়তো এই গ্রহেই, যেখানে রকেটটা অচল অবস্থায় পড়ে আছে, তার ভেতরেই ওরা দিন কাটাচ্ছে আর আমাদের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে! ট্রান্সমিটার খারাপ, তাই কারও সঙ্গে কোনভাবে যোগাযোগ করবারও উপায় নেই ওদের। কি ভয়ংকর টেনশানে দিন কাটছে বুঝতে পারছো! না মুখার্জী, আর সময় নেই। যত দ্রুত সম্ভব ওদের রকেটটা আমাদের খুঁজে বার করা দরকার।’
‘ইয়েস। একদম ঠিক বলেছো গ্রিভস’, দ্যুতিমান বললো, ‘এক কাজ করা যাক। আমরা বরং আকাশে উঠে পড়ি, কী বলো? ওপর থেকে আরও ভালভাবে অবজার্ভ করা যাবে, তাই না?’
গ্রিভস সায় দিতে দ্যুতিমান কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে এসে বসে। দু–চারটে সুইচ টিপে রান প্রোগ্রাম রি–সেট করতে করতে বলে, ‘তোমার মনে আছে গ্রিভস, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার আগে শেষ কী কথাবার্তা হয়েছিল?’
‘অবশ্যই। মনে থাকবে না? কিন্তু সে তো অতি মামুলি কথাবার্তা! যেমন, বিকল রকেটের ভেতর একদম অসহায় অবস্থায় ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ; ইঞ্জিনিয়ার ম্যালকমের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও রকেটটা তখনও সারানো যায়নি। তবে ওরা হাল ছাড়েনি, তখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর মাঝের এই দুদিন ওরা প্রায় পিকনিকের মোডে কাটালেও সেই তৃতীয় দিনে . . .’
গ্রিভসের কথা কেড়ে নিয়েই বলে দ্যুতিমান, ‘ইয়েস। দ্যাট’স দ্য পয়েন্ট। সেই তৃতীয় দিনে ওরা প্ল্যান করেছিল যে, ক্যাপসুলটা নিয়ে ওদের দলের দুজন বেরোবে গ্রহটায় একটা চক্কর দিতে। আর সেইসঙ্গে নিয়ে আসবে এ গ্রহের মাটি আর পাথরের কিছু নমুনা। কারণ . . .’
এবার দ্যুতিমানের কথায় বাধা দেয় গ্রিভস, ‘কারণ বাইরে থেকে গ্রহটাকে দেখে ওদের মনে হয়েছিল যে, গ্রহটা এখনও তার শৈশব অতিক্রম করেনি, এখনও গ্রহটার প্রাথমিক বিবর্তনের দশা চলছে। এই তো?’
দ্যুতিমান সায় দেয়, ‘রাইট। আর এই কথা হবার মাত্র কয়েকঘন্টা পরেই ওদের ট্রান্সমিটার হঠাৎই নিশ্চুপ হয়ে যায়। যোগাযোগ হয়ে যায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ . . .’
কথা শেষ না করেই গ্রিভসের মুখের দিকে তাকায় দ্যুতিমান। তার চোখে একটা অনুচ্চারিত বার্তা।
সেটা দেখেই চমকে ওঠে গ্রিভস। উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে, ‘অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছো, ঠিক তখনই, মানে ওদের বেরোবার পরেই এমন কিছু একটা ঘটে যায়, যার ফলে . . .’
অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে দ্যুতিমান, ‘না, সিওর করে কিছুই বলা যাচ্ছে না, তবে অনুমান তো কিছু করাই যায়। হয়তো ওরা বাইরে গিয়ে অস্বাভাবিক কিছু দেখে রিপোর্ট করে, ফলে সবাই মিলে বাইরে যায়, তারপর আর ফিরে আসে না ; অথবা ওরা বাইরে যাবার পর রকেটেই কোন আক্রমণ ঘটে, যার ফলে রকেটটাই গেছে ধ্বংস হয়ে, হয়তো সেই দুজন ছাড়া আর কেউ এখন বেঁচে নেই ; কিংবা ধরো ওরা যে মাটি আর পাথরের নমুনা এনেছিল, তার থেকেই অজানা কোন জীবাণুর সংক্রমণে গোটা টিমটাই . . .’
দ্যুতিমানের কথায় চিন্তিতমুখে সায় দেয় গ্রিভস, কিন্তু কোন কথা বলে না। দ্যুতিমানও আর কিছু না বলে চুপ করে যায়। দুজনের মনেই চিন্তার ঝড়। ততক্ষণে ওদের ডুওক্র্যাফ্ট্ আকাশের বেশ কিছুটা ওপর দিয়ে চলেছে গ্রহটার দক্ষিণ দিক লক্ষ্য করে। ওদের নিচে এখন এক বিস্তীর্ণ জলরাশি। এটা কি এই গ্রহের কোনও সমুদ্র? জলের রঙটা কেমন অস্বাভাবিক রকম লালচে আর ঘন। জলের নিচে কী আছে বোঝার কোন উপায় নেই। জায়গায় জায়গায় জল থেকে ধোঁয়া উঠছে পাক খেয়ে খেয়ে। কে জানে, জলের মধ্যে কোন্ পদার্থ মিশে আছে! ওরা কি এই জলেরও নমুনা সংগ্রহ করেছিল? এই দিকটায় কি এসেছিল ওরা?
আনমনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন সেই জলের ওপর দিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছিল তারা। হঠাৎ অনেকটা দূরে একটা আবছা রেখা। অনেকটা সমুদ্রতটের মতো। কিন্তু সেই তট যেন ঠিক পৃথিবীর মতো বালিয়াড়ি দিয়ে ঘেরা নয়। বরং অনেকটা পাথুরে। তার অস্বাভাবিক বেগুনী রঙ এই গ্রহের ফ্যাকাশে আলোর মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিচ্ছে।
ভালো করে দেখার জন্যে চোখে ম্যাক্রোগ্লাসটা এঁটে নিল দ্যুতিমান। পরক্ষণেই উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘গ্রিভস, গ্রিভস, বাঁদিকে চলো, বাঁদিকে। ঐ দিকটায় কিছু একটা দেখা যাচ্ছে।’
দ্যুতিমান যেদিকটায় আঙুল তুলে দেখাল, বোতাম টিপে সেইদিকে ডুওক্র্যাফ্টের মুখ ফেরাল গ্রিভস। তারপর সেও নিজের ম্যাক্রোগ্লাসটা তুলে চোখে লাগালো।
একটু পরেই ওদের চোখে ধরা দিল বস্তুটা। লম্বাটে একটা মিনার যেন খাড়া হয়ে আছে মাটির ওপর, আর তার গায়ে বড় বড় অক্ষরে কিছু একটা লেখা আছে, যা এত দূর থেকে ঠিক পড়া যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে ওটা একটা নাম। হ্যাঁ, আর কোন ভুল নেই, ওটাই সেই রকেট — গ্র্যাভিটো ৩৩ওয়াইবি, যা অচল হয়ে এই গ্রহে আটকে ফেলেছে পৃথিবীর এক্সপ্লোরিং টিমটাকে।
এখনও অনেকটাই দূর। আসলে ওদের ম্যাক্রোগ্লাসের পাওয়ার তো অনেক বেশি, তাই যেটা আবছা মনে হবে, সাদা চোখে তা ধরাই পড়বে না।
লাল সমুদ্রের ওপর দিয়ে ওদের ডুওক্র্যাফ্ট্ উড়ে চলল নিশানার দিকে। ভেতরে ওরা চুপ করে বসে থাকলেও একটা উত্তেজনা রীতিমতো ওদের হার্টবীটের গ্রাফ বাড়িয়ে তুলছিল। কী হতে চলেছে এবার? ওখানে গিয়ে কি অবশেষে কম্যান্ডার সাকসেনা আর তার টিমের দেখা পাওয়া যাবে? গেলেও সবাইকে সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যাবে তো? অবস্থা কি ওদের অনুকূলেই আছে, না কি কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতি ওঁৎ পেতে আছে ওদের জন্যে?
এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই ধীরে ধীরে ডুওক্র্যাফ্ট্টা গিয়ে পৌঁছল রকেটটার কাছে। তারপর আকাশে একটা চক্কর মেরে ল্যান্ড করল রকেটের ফুটপঞ্চাশেক দূরে।
ভয়ংকর এক হাড় হিম করা স্তব্ধতা চারিদিকে। এমনকি একটু দূরেই থৈ থৈ করা জলের মধ্যেও কোন কাঁপন নেই। নিথর, নিষ্কম্প। এই স্তব্ধ পরিবেশের মধ্যেই নিশ্চল রকেটটা দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে জমির ওপর। মাটি থেকে খানিকটা উঁচুতে তার দরজা। সেটা এখন খোলা। আর দরজার নিচে থেকে একটা লম্বা ফোল্ডিং সিঁড়ি নেমে এসেছে মাটিতে।
ওরা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল রকেটটার দিকে তাকিয়ে। রকেটের ভেতর একজনও যদি থাকে, সে এতক্ষণে নিশ্চয়ই টের পেয়েছে ওদের আসার কথা। হয়তো রকেটের ভেতর বসে সে লক্ষ্য রাখছে ওদেরই দিকে। আগন্তুক বন্ধু না শত্রু, তা তো আগে বুঝে নিতে হবে। আর যদি সে বা তারা বুঝে নিতে পারে যে এই যানে করে পৃথিবীর মানুষ এসেছে ওদেরই উদ্ধারের জন্য, তবে দ্যুতিমানদের কিছুই করতে হবে না, তারাই হৈ হৈ করে ছুটে আসবে ওদের ডুওক্র্যাফ্ট লক্ষ্য করে।
কিন্তু বৃথা আশা। প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পরেও কারুর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। তেমনই নিস্তব্ধ সেই রকেট, আর তেমনই মৌন এখানকার গোটা পরিবেশ। অর্থাৎ রকেটের ভেতরে কেউ থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই।
চোখে চোখে কথা বললো দ্যুতিমান আর গ্রিভস। তারপরেই চটপট দুজনে দাঁড়িয়ে উঠে হাত বাড়াল ওপরের লক করা বাঙ্কটার দিকে। ওটা একটা ছোটখাটো স্টোর। ওখানে প্রচুর দরকারী জিনিষের সঙ্গেই রাখা আছে কার্বাইডের থার্মোস্যুটগুলো। দুটো থার্মোস্যুট নামিয়ে এনে সেগুলো পরে ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওরা। বাইরে বেরোতেই হবে। আর প্লিওনাসের এই সাংঘাতিক তাপমাত্রায় প্রচন্ড তাপসহ ঐ সেরামিকের পোশাক ছাড়া গতি নেই।
গ্র্যাভিটো ৩৩ওয়াইবি–এর ভেতরে ঝিম মেরে বসে ছিল দুই বন্ধু। দুজনেরই মন ভীষণ খারাপ। সবকিছু খুঁটিয়ে দেখা হয়ে গেছে। সম্ভাব্য সব পরীক্ষাও শেষ। আর সেই পরীক্ষার নীট রেজাল্ট হল একটা অজানা রহস্য, যা এই যন্ত্রযানের মানুষগুলোকে অদ্ভুতভাবে লোপাট করে দিয়েছে।
আসলে গোটা ব্যাপারটাই ওদের কাছে একটা ধাঁধাঁ। রকেটটা যদিও এই মুহূর্তে অচল, আর তার কারণটা ওদের কারুরই জানা নেই, তবু ভেতরের সবকিছুই কিন্তু মোটামুটি ঠিকঠাকই আছে। এমনকী ট্রান্সমিটার–টাও সচল! এই তো, যানের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে যখন দেখা গেল যে, ট্রান্সমিটারটা রীতিমতো জ্যান্ত, তখন ওই ট্রান্সমিটার দিয়েই তো কিছুক্ষণ আগে গ্রিভস পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, আর সেইসঙ্গে পাঠিয়েছে ওদের লেটেস্ট রিপোর্ট।
তাহলে এর মানে কী হয়? মানে হয় এটাই যে, ওরা হয় বেঁচে নেই, অথবা বেঁচে থাকলেও গত সাতদিন এই রকেটের ধারেকাছে আসতে পারেনি। তবে কি এই গ্রহের কোনও জায়গায় আটকে পড়লো তারা? সেটা কি প্রাকৃতিক কারণে, নাকি এই গ্রহেরই নাম–না–জানা কোন জীবের দল তাদের বন্দী করেছে?
এইসব ভাবতে ভাবতে রকেটের ভেতরেই এটা–সেটা নেড়েচেড়ে দেখছিল ওরা। নানা যন্ত্রপাতি, ওদের ব্যবহার্য জিনিষপত্র ঘেঁটে দেখছিল, কোথাও যদি ওদের নিরুদ্দেশ হবার কোন হদিশ মিলে যায়। সেইসময় হঠাৎ দ্যুতিমানেরই মাথায় আসে কথাটা। গ্রিভসকে বলতেই সে কথাটা লুফে নেয়। আর তারপরেই কন্ট্রোল প্যানেলে আঁটা কম্পিউটার চালিয়ে ওরা রকেটের সার্ভারে ঢুকে পড়ে। ফাইলের পর ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজতে থাকে সেই বায়ো–সেন্সর ফাইলটা, যা এই রকেটের প্রত্যেকটা যাত্রীর হার্ট–বীটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় খুঁজেও পায় ফাইলটা। আর তখনই চরম হতাশায় ভেঙে পড়ে দুজনে। মনিটরের পর্দায় সমস্ত গ্রাফগুলো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শুধুমাত্র একটা গ্রাফের লাইনে সবুজ বিন্দুর ওঠাপড়া। সেই গ্রাফ কম্যান্ডার সাকসেনার। তার মানে গোটা দলের মধ্যে একমাত্র সাকসেনা ছাড়া আর কেউই জীবিত নেই!
কতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল ওরা, নিজেই জানে না। শুধু একটা অজানা বিপদের আশঙ্কা ধীরে ধীরে ওদের মনকে গ্রাস করছিল। অবশেষে একসময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে গ্রিভস। দ্যুতিমানের কাঁধদুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ওঠে, ‘ওক্কে মুখার্জী। বসে বসে আকাশ–পাতাল ভেবে কিছু লাভ নেই। চলো বেরিয়ে পড়ি। কম্যান্ডার সাকসেনাকে খুঁজে বার করতে না পারলে এ–রহস্যের কিছুই বোঝা যাবে না।’
মাথা নেড়ে উঠে পড়ে দ্যুতিমান। গ্রিভসের কথাগুলো এই মুহূর্তে চরম সত্য। সাকসেনাকে সবার আগে খুঁজে বার করা দরকার। আর তাঁকে খুঁজে পেতে গেলে ওদের কল্পনা আর চোখই সম্বল। কারণ আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত যখন সেন্সর যন্ত্রের মাধ্যমে কারও সন্ধান পাওয়া যেত, তখন সেই যন্ত্রের ট্র্যাকার ফলো করেই কাউকে খুঁজে নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন এই বায়ো–সেন্সর তা আর হতে দেয় না। এখানে কারও অস্তিত্ব বোঝা যাবে, কিন্তু ট্র্যাক করা যাবে না।
শেষবারের মতো আরও একবার দুজনে মিলে রকেটের ভেতরটায় নজর বুলিয়ে নেয়। তারপর পা বাড়ায় বাইরের দিকে।
কিন্তু বাইরে বেরোনোমাত্র দুজনে অবাক হয়ে যায়। ওরা তো রকেটের ভেতরে অনেকটাই সময় কাটিয়েছে। সময়ের বিচারে গেলে পৃথিবীতে এখন গোধূলিবেলা। অথচ এখানকার পরিবেশে কোন তফাৎ নেই। সেই একইরকম ফ্যাকাশে আলোর মধ্যে সুতীব্র আগুনের হলকা আর অপার্থিব নৈঃশব্দ্য। দ্যুতিমান অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ওর মনে পড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর গোধূলির কথা। এই সময়টায় ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গেই ঘরে ফেরা অসংখ্য পাখির কলরবে কেমন মুখরিত হয়ে থাকে পৃথিবীর আকাশ। অথচ এখানে! কোন প্রাণই এখানে নেই, আর পাখি। দ্যুতিমানের মন খারাপ হয়ে যায়। কি অদ্ভুত যে পৃথিবীর মায়া!
ততক্ষণে পায়ে পায়ে ওরা এসে ঢুকেছে ওদের ডুওক্র্যাফ্টের ভেতর। আর গ্রিভস বসে পড়েছে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওদের বাহন আবার ওদের নিয়ে উঠে পড়লো আকাশে। আর আগের মতোই দুজনে টুকটাক কথা বলতে বলতে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চললো চারপাশে।
কেটে গেল বেশ কিছু সময়। এই সারাটা সময় ধরে চারপাশে সেই একই নিষ্প্রাণ প্রকৃতি দেখতে দেখতে ওদের প্রাণ যেন হাঁফিয়ে উঠছিল। ততক্ষণে ওরা গ্রহের পূর্ব–দক্ষিণ দিক থেকে পর্যবেক্ষণ শুরু করে দক্ষিণ আর পশ্চিমে বেড় দিয়ে আবার উত্তরমুখো হয়েছে। মানে আবার ফিরে চলেছে সেই সমুদ্র অভিমুখে। কারণ একটাই। ওদের মাথায় ঘুরছে যে, এই বিপন্ন অবস্থায় সাকসেনা কোন অবস্থাতেই রকেট থেকে বেশি দূরে যাবেন না। তাই রকেটটাকে কেন্দ্র করে দশ কিমি দূরত্বের একটা ব্যাসার্ধ তৈরী করে ওরা উড়ছে আর তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছে, কোথাও যদি কম্যান্ডার সাকসেনার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়।
গ্রহের এই উত্তর–পশ্চিম দিকটায় এসে ওরা একটু চনমনে হয়ে ওঠে। এদিকটা একটা পাহাড়ি অঞ্চল। ছোটবড়ো বেশ কিছু টিলা, পাহাড় আর অদ্ভুত চেহারার সব গাছপালার সমাবেশ এখানে। এতক্ষণ মনের মধ্যে একটা একঘেঁয়ে জড়তায় আর সাকসেনাকে খোঁজার টেনশানে ওরা এমনই অন্যমনস্ক ছিল যে, ভাবতেই পারেনি এর মধ্যে কতটা সময় কেটে গেছে ওদের অজান্তে। এখন হঠাৎ ডিসপ্লের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়তেই দ্যুতিমান চমকে ওঠে। আরে! প্রায় দু ঘন্টা পেরিয়ে গেছে ওরা উড়ে চলেছে। এতক্ষণে তো সন্ধের অন্ধকার নেমে আসার কথা। কিন্তু কই? চারপাশের আলো তো যেমন ছিল তেমনই! ব্যাপারটা কী হল?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দ্যুতিমান বলেই ফেলে, ‘কী ব্যাপার বলো তো গ্রিভস? এই গ্রহে কি দিন–রাতের কোন পার্থক্য নেই?’
উত্তরে গ্রিভসের কাছ থেকে কোন জবাব না পেয়ে দ্যুতিমান ফিরে তাকায় গ্রিভসের দিকে। লক্ষ্য করে গ্রিভসেরও ভুরুদুটো কুঁচকে আছে, তার মানে সেও বোধহয় এতক্ষণে নজর করেছে ব্যাপারটা, আর সেটা নিয়েই ভেবে চলেছে। দ্যুতিমান একটু আশান্বিত হয়। স্পেস সায়েন্স নিয়ে গ্রিভসের পড়াশোনা দ্যুতিমানের চেয়েও বেশি। ও নিশ্চয়ই এর একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
‘কী হল? বলো!’ দ্যুতিমান বলে।
ওর তাড়া খেয়ে গ্রিভস একটু দ্বিধান্বিতভাবেই উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ মুখার্জী, তাই তো দেখছি। হয়তো এই গ্রহে সবটাই দিন। রাত বলে হয়তো এখানে কিছু নেই।’
গ্রিভসের উত্তর শুনে দ্যুতিমানের ভুরু কুঁচকে যায়। অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে, ‘কিন্তু এর কারণটা কী হতে পারে বলে মনে হয় তোমার?’
গ্রিভস খানিকক্ষণ ভেবেচিন্তে কী একটা বলবার জন্য মুখ খুলতে যায়। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই বাইরের কোন একটা দৃশ্য দেখে ওর মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়। প্রবল উত্তেজনায় সেদিকে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে গ্রিভস, ‘মুখার্জী, মুখার্জী, দেখ তো, ওটা কী? কী ওটা ওখানে?’
চমকে গিয়ে সেদিকে তাকায় দ্যুতিমান। তারপর আরও ভালো করে দেখবার জন্যে ঝুঁকে পড়ে গ্রিভসের কাঁধের পাশ দিয়ে। পাহাড়ি অঞ্চল বলে ডুওক্র্যাফ্টটা ওরা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল মাটির অনেক ওপর দিয়ে। সেইখানে, ওদের যানের বহু নীচে, বাঁদিকের উপত্যকার মাঝে একটা বাটির মতো জায়গা। চারিদিকে টিলা দিয়ে ঘেরা সেই জায়গাটায় অদ্ভুত আকৃতির গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা আলোর ঝলকানি। সেটা যেন থেকে থেকে চমকে চমকে উঠছে।
নিমেষের জন্যে দুজনের চোখে চোখে কথা হয়ে যায়। পরক্ষণেই যানের গতি কমিয়ে আস্তে আস্তে সেটা নীচের দিকে নামিয়ে আনতে লাগলো গ্রিভস, আর দ্যুতিমান চোখে তুলে নিল তার ম্যাক্রোগ্লাস।
এক থেকে দেড় মিনিট। দ্যুতিমান চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আগুন, আগুন। গ্রিভস, ওখানে আগুন জ্বেলেছে কেউ। সেটাই গাছের ফাঁক দিয়ে আলোর ঝলকানি বলে মনে হচ্ছিল।’
গ্রিভস দ্রুত নিঃশ্বাসের সঙ্গে বললো, ‘বলে যাও মুখার্জী। আমি ততক্ষণ ল্যান্ড করতে চেষ্টা করছি।’ ওর চোখ আর হাত যানটা চালাচ্ছিল, আর মনটা ছিল দ্যুতিমানের কথায়।
দ্যুতিমান রিলে করে চলে, ‘হ্যাঁ ওই তো, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগুনটা। খানিকটা জায়গা জুড়ে আগুন জ্বলছে, আর তার পাশে ডাঁই করে রাখা প্রচুর ডালপালা, হয়তো পরে কাজে লাগবে বলে। দাঁড়াও দাঁড়াও, ওটা কী? ইয়েস। একটা গুহার মুখ! গ্রিভস, ঐ দেখ, গুহার মুখে বোধহয় নিরাপত্তার জন্যেই কেউ আগুন জ্বেলেছে।’
‘ইউরেকা। আমরা কম্যান্ডার সাকসেনাকে খুঁজে পেয়েছি মুখার্জী। আমি সিওর। কারণ যেখানে কোন প্রাণিরই অস্তিত্ব নেই, সেখানে আর আগুন জ্বালবে কে, উনি ছাড়া? তার মানে কম্যান্ডার এখনও নিরাপদেই আছেন। কিন্তু সাকসেনাকে আগুনই বা জ্বালতে হয়েছে কেন? তাও এই দিনের আলোয়? তবে কি বিপদের মুখে পড়ে আছেন কম্যান্ডার? নাকি তাঁর অস্তিত্ব জানানোর জন্য?’
দ্যুতিমানের সঙ্গে এইসব কথা বলতে বলতেই গ্রিভস ঐ টিলাঘেরা জায়গাটার বাইরে একটু দূরে একটা ফাঁকা জমি লক্ষ্য করে। যদিও সে জমিটাও খুব সমতল নয়, বেশ উঁচুনীচু। ন্যাড়া পাথরের জমিটা ঘিরে দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা অচেনা ছোটবড় গাছ। কিন্তু ও ছাড়া ধারেকাছে আর নামার কোন জায়গা তো দেখা যাচ্ছে না। তাই গ্রিভস ওখানেই ল্যান্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর তার পরেই অত্যন্ত দক্ষ হাতে সেই জমিটার ওপর ধীরে ধীরে নামিয়ে আনতে থাকে ডুওক্র্যাফ্ট–টাকে।
একসময় গ্রিভসের দক্ষতায় ওদের ডুওক্র্যাফ্ট বেশ নিরাপদেই সেই জমিটায় এসে ল্যান্ড করে। আবার সেই আগের মতো কিছুক্ষণ চুপ করে তার ভেতরে অপেক্ষা করে ওরা। চারপাশের নিরাপত্তা ঠিকঠাক আছে কিনা সেটা দেখে নেওয়া। এসব ওদের ট্রেনিং–এরই অঙ্গ। যে কোন মহাকাশযাত্রীকেই এসব শিখে নিতে হয়।
নিঃশব্দে কেটে যায় দু তিন মিনিট। চোখে চোখে একবার কথা হয়ে যায় দুজনের। পরক্ষণেই ওরা বেরিয়ে আসে বাইরে। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে লক্ষ্য ঠিক করে নিয়ে চলতে শুরু করে সেই টিলাঘেরা জায়গাটার উদ্দেশ্যে।
ওপর থেকে টিলাটা অনেক কম উচ্চতার বলে মনে হচ্ছিল। কাছে আসতে দেখা গেল মোটেই তা নয়। ঐ উঁচু টিলা অতিক্রম করে বাটির মতো জায়গাটায় প্রবেশ করা বেশ কঠিন ব্যাপার। একেই টিলাটা বেশ খাড়াই, তার ওপর ওইসব অদ্ভুত গাছপালা বেশ দুর্ভেদ্য করে রেখেছে ভেতরে ঢোকার পথটা। তবু হাল ছাড়লে তো চলবে না। যে করেই হোক, ঐ টিলা টপকে ভেতরে প্রবেশ করতেই হবে।
অনেকক্ষণের চেষ্টায় আর বহু পরিশ্রমে ওরা প্রায় আধঘন্টা পরে এসে পৌঁছলো টিলার চূড়ায়। এখান থেকে ঢালু হয়ে টিলাটা নেমে গেছে নীচে। গাছপালা এখানে অনেক হাল্কা, বরং পাথর এখানে অনেক বেশি। ছোটবড়ো নানা আকৃতির আর নানান রঙের পাথর টিলার এপাশটা যেন রঙীন করে রেখেছে। আর সেখানেই স্পষ্ট চোখে পড়ছে সেই গুহামুখটা, যার মুখে একটা আগুনের বলয়। কিন্তু ভেতরে কম্যান্ডার সাকসেনা আছেন তো?
ভাবতে ভাবতেই ওরা দ্রুত নামতে থাকে ঢালু বেয়ে। জায়গাটায় পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগবে না। বড়োজোর মিনিট দশেক।
পাঁচ মিনিট নামার পরেই দ্যুতিমানের কী মনে হল, সে নামতে নামতেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, ‘কম্যান্ডার, কম্যান্ডার সাকসেনা। আপনি কোথায়? আমরা পৃথিবী থেকে এসেছি আপনাকে নিয়ে যেতে। কোথায় আপনি কম্যান্ডার?’
জায়গাটা ঘেরা বলে ওর আওয়াজটা যেন খানিকক্ষণ প্রতিধ্বনি ছড়ালো সেখানে। তারপর দু–এক মুহূর্ত কোথাও কোন সাড়া নেই। চারিদিকের পরিবেশে এক মৃত্যুশীতল নিস্তব্ধতা। শুধু পথের ওপর ওদের দুজনের পায়ের আওয়াজই শোনা যাচ্ছে।
ঠিক তার পরেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটলো।
ওরা প্রায় হুড়মুড় করেই নামছিল সেই গুহামুখ লক্ষ্য করে। ওদের পায়ের তলায় পাথুরে জমি, আর চারপাশে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে পাথরের রাজত্ব। ওরা দুজন চলতে চলতেই লক্ষ্য করলো, সেই পাথরগুলোর মধ্যে যেন কোন কোন পাথর হঠাৎ করেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। যেন পাথরের দলের মধ্যে কোথাও কোথাও আকস্মিকভাবে সাড়া পড়ে গেছে। যেন একটা দুটো করে পাথর হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে।
দুজনেই চমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এ ওর মুখের দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার তারা আশেপাশে নজর ফেরাল। আর পরক্ষণেই একটা হিমঠান্ডা আতঙ্ক যেন নিমেষের মধ্যে ওদের শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ সঞ্চারিত করলো। চারিদিকের পাথরের স্তূপের মধ্যে থেকে সবুজ রঙের পাথরগুলো সত্যিই জেগে উঠেছে। একে একে সেইসব সবুজ পাথর সুশিক্ষিত সৈন্যের মতো যেন ওদের ঘিরে ফেলে ওপর থেকে নেমে আসছে।
এক অজানা বিস্ময় আর আতঙ্ক এক পলকের জন্য ওদের আচ্ছন্ন করেছিল। তারপর ওদের অজান্তেই ওদের গলা থেকে জান্তব চিৎকার বেরিয়ে এল। আর ওরা প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলো নিচের দিকে। কোনদিকে তাকাবার আর সময় নেই। প্রাণে বাঁচতে হবে। কোন সন্দেহ নেই, পাথরগুলো ওদের লক্ষ্য করেই গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে ওপর থেকে।
ছুটতে ছুটতে প্রায় সেই গুহার সমতলে নেমে এসে গ্রিভস হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। কী হল? দ্যুতিমান কোথায় গেল?
পেছনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় গ্রিভস। কি আশ্চর্য, একটু ওপরের সেই ঢালু অংশে পাথরগুলো অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেই ভয়ঙ্করভাবে আর ওদের পেছনে ছুটে আসছে না। আর সেই পাথরগুলো থেকে কিছুটা দূরেই দ্যুতিমান দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে রয়েছে পাথরগুলোর দিকেই। যেন সে তার দৌড় থামিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে পাথরগুলো কী করে।
দেখে ভয় পেয়ে যায় গ্রিভস। দ্যুতিমানের থেকে পাথরগুলোর দূরত্ব খুব বেশি নয়। আবার গড়াতে শুরু করলেই ওরা দ্যুতিমানকে ধরে ফেলবে যে কোন মুহূর্তে। তাই দিগ্বিদিক ভুলে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কুইক মুখার্জী! কুইক। দাঁড়িয়ে থেকো না। চলে এসো।’
তার এই চিৎকারে দ্যুতিমান ঘুরে দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তেই যা যা ঘটল, তা ওরা স্বপ্নেও কোনদিন দেখেনি।
গ্রিভস যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে বড়োজোর কুড়ি মিটার তফাতে দ্যুতিমান দাঁড়িয়ে ছিল। ওর ডাকে দ্যুতিমান এদিকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রিভস দেখল, সেই সমস্ত পাথরগুলো আবার নড়ে উঠল। যেন এতক্ষণ দ্বিধান্বিত অবস্থায় ওরা চুপ করে ছিল। এবার আবার গ্রিভসের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই ওরা আবার জীবন্ত হয়ে একসঙ্গে ধেয়ে এল ওদের দিকে। আর . . . আর . . . সেইসঙ্গে একটা দৃশ্য দেখে ভয়ে, আতঙ্কে গ্রিভসের শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। পাথরগুলো শুধু যে দ্যুতিমানের দিকে তেড়ে আসছে তাই নয়, গড়িয়ে আসতে আসতে ওদের শরীরের আশপাশ থেকে কিছু কিছু অংশ ঠেলে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসছে, আর বেরোতে বেরোতে সেগুলো ক্রমশই যেন কিরকম হাতের মতো আকার নিচ্ছে। প্রত্যেকটা পাথরের গা থেকে যেন বেরিয়ে আসছে অনেকগুলো হাত, আর সেই প্রত্যেকটা হাতের মাথায় যেন দৃশ্যমান হচ্ছে একটা করে বিকট থাবা।
গ্রিভসের সমস্ত শরীর কয়েক মুহূর্তের জন্য অবশ হয়ে গেল। সে সেই গুহার কাছেই দাঁড়িয়েছিল স্থাণুর মতো। দ্যুতিমান মরীয়ার মতো দৌড়ে এল ওর দিকে। কিন্তু গ্রিভসের কাছাকাছি আসতে না আসতেই সেই আশ্চর্য পাথরগুলো চোখের নিমেষে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরল ওদের। তারপর ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে। তাদের হাতগুলো এখন আরও লম্বা, আর হাতের আগায় থাবাগুলো এখন কোনও এক জিঘাংসায় যেন জিভের মতো লকলক করছে।
দ্যুতিমান তখন হাঁফাচ্ছে আর অসহায়ের মতো চারিদিকে তাকাচ্ছে। গ্রিভস অভ্যেসবশে কোমরে হাত রাখলো আর পরক্ষণেই তার শিরদাঁড়ায় একটা শিহরণ খেলে গেল। সেন্ট্রিফুগাল পিস্তলটা তার সঙ্গে নেই। ওটা পড়ে রয়েছে ডুওক্র্যাফ্টের ভেতর। ব্যাপারটা টের পাওয়ামাত্র গ্রিভসের শরীরের সমস্ত শক্তি যেন নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
কিন্তু পাথরগুলোও কি বুঝতে পেরেছে ওদের অসহায় অবস্থা? নাহলে এখন ওগুলো একটু একটু করে এগিয়ে আসছে কেন, যার ফলে প্রতি মুহূর্তে ছোট হয়ে আসছে তাদের বৃত্ত? ওগুলো কী? যন্ত্র, না প্রাণী? কেউ কি চালনা করছে ওদের?
বেশি কিছু ভাবার অবকাশ নেই। একেবারে সামনে এসে গেছে তারা। গ্রিভস আর দ্যুতিমান একবার চোখাচোখি করল। যেন লড়াইয়ের আগে শেষ চোখে চোখে কথা। এবার শুধু হাতেই ওই পাথরগুলোর মোকাবিলা করতে হবে। তারপর যা থাকে কপালে। দুজনেই তৈরী হয়ে দাঁড়াল।
আর ঠিক সেই সময় আচমকা একটা চিৎকার। সেটা এসেছে ওদের পেছন থেকে। ওরা চমকে উঠে দেখল, গুহার ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল একটা মানুষ। হাতে অত্যাধুনিক এক আগ্নেয়াস্ত্র। সেটা থেকে রশ্মির পর রশ্মি বেরিয়ে চলেছে, আর সে রশ্মিগুলো ছুটে যাচ্ছে পাথরগুলোকে উদ্দেশ্য করে। এবার সেদিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওদের। এ কী? রশ্মিগুলোর সবই যে লক্ষ্য বিদ্ধ করছে তা নয়, কিন্তু যে পাথরগুলোর গায়ে লাগছে, সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে না গিয়ে কেমন ন্যাতনেতে হয়ে গলে গলে মাটিতে মিশে যাচ্ছে!
পাথরের দলটা যেন সেই আচমকা আক্রমণে পিছু হঠতে হঠতে ক্রমশ উঠে যেতে লাগল সেই ঢালু টিলার গা বেয়ে। আর তাই দেখে অসীম উল্লাসে চিৎকার করে উঠল দ্যুতিমান আর গ্রিভস। এবারের মতো প্রাণে বেঁচে গেছে ওরা।
লোকটা তখনও সমানে তাড়া করে যাচ্ছে পাথরগুলোকে। টিলার বেশ খানিকটা দূর পর্যন্ত তাদের তাড়িয়ে দিয়েই সে দৌড়ে ফিরে এল ওদের দিকে। ওরা তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে। অস্ত্রটা জামার পকেটে গুঁজে লোকটা দুহাতে ওদের দুজনকে টানতে টানতে আগুনের বলয় টপকে ঢুকে পড়ল গুহার ভেতরে। গ্রিভস কী যেন বলতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু লোকটার চোখের ইশারায় স্পষ্ট নিষেধ। দেখে চুপ করে গেল গ্রিভস। কোন কথাই আর বলার চেষ্টা করল না। আর পরমুহূর্তেই ওরা হারিয়ে গেল গুহার ভেতরের গভীর অন্ধকারে।
বাইরের আলো থেকে হঠাৎ অন্ধকারে ঢুকে পড়লে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। কিছুক্ষণ যেন কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। সেরকমই হচ্ছিল ওদের। আস্তে আস্তে চোখটা সয়ে আসতে ওরা বুঝতে পারলো, গুহার ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়। একটা আগুন এখানেও জ্বলছে, আর সেটা জ্বলছে গুহার একটা কোণে। লোকটা বোধহয় ওদের একটু ধাতস্থ হয়ে নেবার সময় দিচ্ছিল, আর কান খাড়া করে বাইরের পরিস্থিতিটা বোঝবার চেষ্টা করছিল। কিছুক্ষণ পরে যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ওদের দিকে তাকাল।
ওরা দুজনেই তখন তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ওদের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লোকটা হাসল। আর তাই দেখে এতক্ষণে একটু স্বস্তি পেল দুজনে। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে গুহার ভেতরে চারপাশে চোখ ফেরাল ওরা।
গুহাটা বিশাল কিছু বড় নয়। একটা ছোটখাটো হলঘরের মতো। খুব বেশি হলে বারো বাই পনেরো ফুট হবে। তবে হাইট অনেক। কম সে কম কুড়ি ফুট ওপরে গুহার ভেতরের ছাদটা। আর সেই ছাদ থেকে কিছু কিছু জায়গায় বহু প্রাচীন কিছু স্ট্যালাকটাইট–ও ঝুলতে দেখা গেল।
গুহার যে কোণে ছোট্ট আগুনটা জ্বলছিল, তার উল্টোদিকটায় গুহাটা বেশ অন্ধকার, সবটা স্পষ্ট নজরে আসছিল না। তবে আগুনের দিকটা বেশ ভালই দেখা যাচ্ছিল। সেখানে আগুনের পাশেই খানিকটা জায়গা জুড়ে গাছের পাতা বেছানো ছিল, আর তার ওপরে রাখা ছিল কিছু টুকিটাকি জিনিষ, যেমন কিছু শুকনো খাবারের কৌটো, জলের বোতল, কার্বোথিনের একটা ব্যাগ, এইসব।
ওরা যখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এইসব দেখছিল, লোকটা ততক্ষণ ওদেরই পর্যবেক্ষণ করছিল ভাল করে। এবার গুহার মেঝেতে যেখানে গাছের ডালপাতাগুলো বেছানো ছিল, সেইখানে বসে পড়ে লোকটা ওদের ডাকল, ‘এসো, এখানে এসে বসো। এবার নিশ্চিন্তে কথা বলা যাক।’
একটু ইতস্তত করার পর এপাশ ওপাশ তাকিয়ে গ্রিভস আর দ্যুতিমান একে একে বসে পড়ে লোকটার কাছে। একরাশ প্রশ্ন তখন ভিড় করে এসেছে ওদের মনে। গ্রিভসই প্রথম মুখ খুলল, ‘আগে বলুন, আপনিই তো কম্যান্ডার সাকসেনা?’
ভদ্রলোক মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলতেই গ্রিভস বলে, ‘ইয়েস। আমি জানতাম। আমরা আপনাকেই খুঁজতে এসেছি কম্যান্ডার। আমি গ্রিভস আর ও মুখার্জী, দ্যুতিমান মুখার্জী। আপনার এস.ও.এস. পাওয়ার পর পৃথিবী থেকে আমাদের পাঠানো হয়েছে আপনাদের খুঁজে নিয়ে যেতে। কিন্তু আজ আপনাদের রকেটটা খুঁজে পাওয়ার পর সেখানে বায়ো–সেন্সর ফাইল থেকে আবিষ্কার করলাম যে আপনি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। তখন . . .’
ওর কথার মাঝখানেই বিষণ্ণ মুখে সাকসেনা বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ। দুর্ভাগ্য ওদের, ওরা কেউই আর বেঁচে নেই। আমিও হয়তো এতদিন আর বেঁচে থাকতাম না, যদি না হঠাৎ . . .’
দ্যুতিমান আর চুপ থাকতে পারে না। বলে ওঠে, ‘কিন্তু কম্যান্ডার, ওরা মারা গেল কী করে? তার জন্যে কি ওই অদ্ভুত পাথরগুলোই দায়ী? ব্যাপারটা কী? ওরা কারা?’
অধৈর্য গ্রিভসও যেন সঙ্গে সঙ্গে দ্যুতিমানের কথার প্রতিধ্বনি করে, ‘হ্যাঁ কম্যান্ডার, বলুন। ওগুলো কী? যন্ত্র, না প্রাণী? কে নির্দেশ দিচ্ছে ওদের? নাকি আমাদের মতোই ওরাও মগজধারী কোন জীব?’
সাকসেনার মুখে মৃদু হাসি। কিন্তু সে হাসিতে বিষণ্ণতা মাখানো। ধীরে ধীরে মাথাটা ওপর–নীচে করতে করতে তিনি বলেন, ‘সব বলছি। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার সবটাই খুলে বলছি তোমাদের। কারণ এই মুহূর্তে বাইরের যা পরিস্থিতি, তাতে ইচ্ছে থাকলেও এখন আমরা বাইরে বেরোতে পারব না। অথবা বলা যায় এখনই আমাদের বাইরে বেরোনো উচিত হবে না। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে, সবকিছু থিতিয়ে গেলে, তবেই আমরা আবার ঐ টিলায় গিয়ে উঠবো। ততক্ষণ তোমাদের বরং সব ঘটনা খুলেই বলি। তাতে তোমরাও আগে থেকে সাবধান হতে পারবে।’
সাকসেনার কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে দুজনে। সেইসঙ্গেই গ্রিভস জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু কম্যান্ডার, ও দিকটা ছাড়া আর কি কোন রাস্তা নেই আমাদের পালাবার?’
সাকসেনা মাথা নাড়েন, ‘দুঃখের বিষয় — না। বাঁচতে হলে আমাদের ঐ টিলার ওপরে ওঠা ছাড়া গতি নেই। যে দিকটা দিয়ে তোমরা নেমে এসেছ এখানে, ওই দিকটাই হল এই বাটির মত জায়গাটা থেকে বেরোনোর একমাত্র রাস্তা। তবে একটু এধার ওধার দিয়ে যাওয়া যায় অবশ্য। আর আমরা যাব সেভাবেই।’
কথা বলতে বলতে একটু থামেন কম্যান্ডার সাকসেনা। তারপর ওদের মুখের ভঙ্গী থেকে প্রশ্নটা বুঝে নিয়ে নিজেই আবার বলেন, ‘ভাবছ তো এই কথাটা কী করে জানলাম? আসলে গত চার দিন ধরে আমি এই জায়গাটায় আটকে আছি। অবশ্য খানিকটা নিজে থেকেও রয়ে গেছি বলা যায়। কারণ এই গ্রহের অন্য খোলা জায়গাগুলোর তুলনায় আমি এখানটা খানিকটা নিরাপদ বলেই মনে করেছি। আর এই ক’দিনে, বুঝতেই পারছ, এ জায়গার চারিদিকটা আমার ভালভাবেই দেখা হয়ে গেছে।’
গ্রিভস বলল, ‘কিন্তু আপনার কাছে তো অস্ত্র আছে কম্যান্ডার? আপনি তো ইচ্ছে করলেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারতেন!’
সাকসেনা উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, অস্ত্রটা আছে বটে, আর সঙ্গে গুলিও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যাব কোথায়? রকেটটা ছাড়া কোন আস্তানাই তো নেই। সে রকেটও অচল, আর তার সঙ্গে ওরা আমাদের রকেটও অ্যাকসেস করে ফেলেছে। কেন, তোমরা তো রকেটের কাছে গেছ, ভেতরেও ঢুকেছ, কিছু বোঝোনি?’
ফ্যাকাশে মুখে দ্যুতিমান বলে ওঠে, ‘না তো কম্যান্ডার। সেরকম কিছু তো বুঝিনি আমরা! কেন, সেখানে কি কোন বিপদের সম্ভাবনা ছিল?’
সাকসেনা স্থির চোখে একবার দ্যুতিমানের দিকে আর একবার গ্রিভসের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘তার মানে তোমাদের ভাগ্য খুবই ভাল বলতে হবে। কারণ, আজ থেকে প্রায় সাতদিন আগে, আমার দলের শেষ দুজন সঙ্গী ম্যালকম আর আব্দুলকে নিয়ে যখন শেষবারের জন্য রকেটে ঢুকতে যাই, তখন একসঙ্গে ওদের আক্রমণের মুখে পড়ে প্রাণ নিয়ে পালাতে বাধ্য হই। সেই শেষ, তারপর থেকে শুধুই পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। এদিক থেকে ওদিক, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তারপর ঠিক দু দিনের মাথায় ওরা দুজনেও . . . ওঃ! কী ভয়ঙ্কর!’
কথাগুলো বলতে বলতে কম্যান্ডার যেন শিউরে ওঠেন। এই অসমসাহসী লোকটার আতঙ্ক দেখে অজান্তেই যেন দ্যুতিমান আর গ্রিভসও ভয় পেয়ে যায়। কী এমন সাংঘাতিক সেই ঘটনা? সাকসেনা যত সময় নেন, ততই তীব্র কৌতূহলে ওদের ভেতরটা ছটফট করতে থাকে। কিন্তু কিছু না বলে ওরা চুপ করেই থাকে।
খানিকক্ষণ স্থির হয়ে নিজেকে সামলে নেন সাকসেনা। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন, ‘ঘটনার শুরু আজ থেকে ঠিক দশদিন আগে। তখন আমরা ডেল্টা প্রক্সিমা নক্ষত্রের গ্রহগুলো সার্ভে করা শেষ করে পাড়ি দিয়েছিলাম সিগমা ক্যানোপাসের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল, ওখানকার কোন একটা গ্রহে নেমে দু চারদিন রেস্ট নিয়ে আবার শুরু করব আমাদের এক্সপ্লোরেশন। তার আগে প্রায় একমাস ধরে অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে সকলেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাজেই সকলেরই মোটামুটি পছন্দ হল আমাদের এই প্ল্যানিং। কিন্তু . . .’
‘কিন্তু? কিন্তু কী কম্যান্ডার?’ সাকসেনাকে চুপ করতে দেখে প্রায় চেঁচিয়েই বলে দ্যুতিমান।
‘কিন্তু মানুষ এক ভাবে, আর এক ঘটে তার ভাগ্যে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে গিয়েই হল বিপর্যয়। আমরা যত দ্রুত সম্ভব যেতে চাইছিলাম সিগমা ক্যানোপাসের সবচেয়ে কাছের গ্রহটার দিকে, আর তার ফলেই হয়তো রকেটের গতি নিয়ন্ত্রণে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়, অথবা হয়তো জ্বালানিগত কিছু সমস্যা। তা সে যাই হোক না কেন, মোট কথা আমাদের রকেটটা বিগড়ে যায় মারাত্মকভাবে। আর সে এমনইভাবে বিগড়োয় যে, ম্যালকমের মতো এক্সপার্টও তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না।
আমরা তখন যে রুট ধরে যাচ্ছিলাম, তার ধারেকাছে তখন একমাত্র এই প্লিওনাস গ্রহটাই ছিল, ফলে আমরা তড়িঘড়ি করে এখানেই এসে নামতে বাধ্য হই। যদিও এ গ্রহে আজ পর্যন্ত কোন মানুষের পা পড়েনি, ফলে গ্রহটার আগাপাশতলা আমাদের কাছে ছিল অজানা অচেনা, তবু আমাদের যানের কম্পিউটার থেকে এই গ্রহের যেসব জিওফিজিক্যাল ডেটা পাওয়া গেল, তাতে আপাতদৃষ্টিতে গ্রহটাকে নিরীহ বলেই মনে হল। তাই মনে মনে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েই আমরা এখানে নামতে পারলাম।
কিন্তু তারপর দু–দুটো দিন ধরে চেষ্টা করার পরও যখন কিছুতেই কিছু হল না, কোনভাবেই রকেটটা ঠিক করা গেল না, তখন . . .’
গ্রিভস ব্যস্ত হয়ে সাকসেনাকে প্রায় থামিয়ে দিয়েই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ কম্যান্ডার, এই পর্যন্ত সবটাই আমরা জানি। আপনি এস. ও. এস. করার সময় এই কথাগুলোই তো বলেছিলেন, তাই না?’
সাকসেনা মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিকই। এই পর্যন্ত সবটাই আমরা পৃথিবীতে ট্রান্সমিশন করেছিলাম। কাজেই তোমরাও হয়তো সেটা শুনেছ। ইন ফ্যাক্ট, এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকও ছিল। কিন্তু আসল ঘটনার শুরু হল এর পর।
আমরা দুদিন ধরে রকেটের ভেতর শুয়ে বসে প্রায় হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। করারও কিছু ছিল না, আবার গ্রহটা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন আর একদমই অজানা বলে অকারণ বীরত্ব দেখাতে ঘুরে বেড়াতেও পারছিলাম না। আর তোমরা তো জানোই, এনার্জি কনজাম্পসানের ব্যাপারেও কিছু বাধানিষেধ আমাদের থাকেই। তা সে যাই হোক, তৃতীয় দিনে আর থাকতে না পেরে মার্টিমোর প্রায় জোর করেই ক্যাপসুলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তাব দিল। আমি প্রথমে রাজি হইনি, কিন্তু তারপর ওর সঙ্গে যখন আবার বার্তেল্লো যোগ দিল, তখন আর বাধা দিতে পারলাম না। ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল ক্যাপসুলটা নিয়ে। অবশ্য শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়, সেইসঙ্গে এ গ্রহের প্রাকৃতিক স্যাম্পেলও নিয়ে আসার কথা হল।’
একটু দম নেবার জন্য সাকসেনা থামলেন। দ্যুতিমান সাগ্রহে বলে উঠল, ‘তারপর? তারপর কী হল কম্যান্ডার?’
সাকসেনা বললেন, ‘বলছি। তবে তার আগে একবার বাইরের অবস্থাটা দেখে আসা দরকার। তোমরা চুপ করে বোসো, আমি আসছি।’
এই বলে সাকসেনা উঠে দাঁড়ালেন। আগ্নেয়াস্ত্রটা আগেই বের করে হাতের কাছে রাখা ছিল। সেটা নিয়ে গুহার মুখের কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে ওদের চোখের আড়ালে চলে গেলেন।
দ্যুতিমান আর গ্রিভস বসে বসে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। এমনিতেই সাকসেনার অসমাপ্ত কাহিনী ওদের কৌতূহল উদগ্র করে তুলেছিল, তার সঙ্গে এখন যোগ হল উদ্বেগ। সাকসেনার জন্য উদ্বেগ, বাইরের অবস্থার কথা ভেবে দোলাচল, এমনকি ওরাও সাকসেনার মতো এখানে আটকে থাকবে না কি এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেরোতে পারবে তার দুশ্চিন্তা, এই সব মিলিয়ে ক্রমশই প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠছিল ওদের মন।
এমন সময় গুহামুখের কাছে অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল। ওরা টানটান হয়ে উঠল। কিন্তু না, দেখা গেল সাকসেনা ফিরে আসছেন। ওরা আশ্বস্ত হল।
সাকসেনা বেশ চিন্তিতমুখে ওদের কাছে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘শোনো, বাইরেটা যা দেখে এলাম, তাতে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। আমাদের আর দেরী করলে চলবে না। এই মুহূর্তেই বেরিয়ে যেতে হবে। ওদের চোখ এড়িয়ে পালাতে হলে এটাই সুবর্ণ সুযোগ। ওঠো, চটপট রেডি হয়ে যাও।’
একথা বলে সাকসেনা গুহার মেঝেতে থাকা নিজের জিনিষপত্রগুলো গুছিয়ে নেবার জন্যে বসে পড়েন। দ্যুতিমান বলে, ‘কিন্তু কম্যান্ডার, তারপর কী হল বলবেন না? আমরা যে মনে মনে ছটফট করছি সব জানার জন্যে। বিশেষ করে ওই পাথরগুলো, ওদের ব্যাপারটা জানার জন্যেই আরও ছটফটানি।’
ওদের দিকে ঘুরে সাকসেনা বলেন, ‘তার আগে তোমরা বলো, তোমাদের কি পৃথিবীতে ফিরে যাবার ইচ্ছে আছে, নাকি এখানেই থেকে যেতে চাও তোমরা?’
সাকসেনার কথা শুনে ওরা লজ্জিত হয়ে পড়ে। ঘটনার বৈচিত্র্যে ওরা এতটাই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল যে, চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু ভাবছিলই না। সত্যিই তো, ওই গল্প পরেও শোনা যাবে। আগে ওই অদ্ভুত পাথরগুলোর হাত এড়িয়ে এখান থেকে পালানো দরকার।
‘বলুন কম্যান্ডার, আপনি কী করতে বলেন।’ বলল গ্রিভস।
কম্যান্ডার বললেন, ‘তাহলে আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো। তোমাদের যানটা কোথায় আছে?’
‘ডুওক্র্যাফ্ট্–টা আছে এই টিলাটার উল্টোপিঠে আধ কিলোমিটার দূরে। আর আমাদের রকেটটা ল্যান্ড করে আছে গ্রহের উত্তরদিকে।’
‘বেশ। তার মানে যেভাবেই হোক আমাদের আগে ডুওক্র্যাফ্টে গিয়ে উঠতে হবে। তারপর উড়ে যেতে হবে তোমাদের রকেটের দিকে। একবার ডুওক্র্যাফ্টে ঢুকে যেতে পারলে আর চিন্তা নেই। কিন্তু খুব সাবধান,’ সাকসেনার চোখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছায়া, ‘গোটা রাস্তায় কোন শব্দ করা চলবে না। আমরা নিঃশব্দে যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে যাব ওখানে। ঠিক আছে?’
‘কিন্তু কম্যান্ডার, দ্রুত চলতে গেলে শব্দ তো হবেই’, দ্যুতিমান বলে।
সাকসেনা বললেন, ‘হ্যাঁ সেটা আমি জানি। আর সেজন্যেই তোমাদের সতর্ক করা। যথাসম্ভব শব্দ না করে আমাদের হেঁটে যেতে হবে। বিশেষ করে মুখে কোন আওয়াজ করা চলবে না। গোটা রাস্তায় একটা কথাও নয়। ওকে?’
গ্রিভস আর দ্যুতিমান দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দেয় বটে, কিন্তু মনের মধ্যে কৌতূহল দানা পাকাতেই থাকে। এ কী ব্যাপার? রহস্য যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে!
ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে সাকসেনা বলেন, ‘বুঝতেই পারছি, তোমাদের কৌতূহল আর বাধা মানছে না। আসলে পুরো ব্যাপারটা তোমাদের বুঝিয়ে বলতে অনেক সময় লাগবে। তাই এখন সেটা চাইছি না। শুধু শুনে রাখো, ঐ পাথরগুলোই হল সবকিছুর মূল। ওগুলোই আমার সমস্ত সঙ্গীদের কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। আর ওদের হাত থেকেই কোনরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে আমি আশ্রয় নিয়েছি এই গুহায় এসে।’
গ্রিভস অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে, ‘সে তো বুঝতেই পারছি কম্যান্ডার। কিন্তু . . .’
সাকসেনা বললেন, ‘না, এখন আর কোন কথা নয়। বাকি সমস্ত ব্যাখ্যা আমি পরে তোমাদের দেব। তার আগে প্রাণ নিয়ে এখান থেকে পালানো দরকার।’
সাকসেনার কথায় গুরুত্ব আছে, তাই আর কথা না বাড়িয়ে ওরা চুপ করে যায়, আর সাকসেনা দ্রুত তৈরী হয়ে নিতে থাকেন। তাঁরও একটা কার্বাইডের স্যুট ছিল, যেটা তিনি খুলে রেখেছিলেন গুহার ভেতর। সেটা তিনি গায়ে চাপিয়ে নেন। তারপর পড়ে থাকা খাবারের প্যাকেট আর জলের বোতলগুলো একটা কার্বোথিনের ব্যাগে ঢুকিয়ে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে তিনি প্রস্তুত হলেন। ওরাও প্রস্তুত। এবার তিনজনে একসঙ্গে পা বাড়ায় বাইরের দিকে।
গুহার বাইরে সেই মরা আলো আর মৃত্যুর নিস্তব্ধতা। আশেপাশে সেইসব মৃত্যুদূত পাথরগুলোর কোন চিহ্ন নেই। হয়তো তারা আবার নিরীহের মতো টিলার গায়ে গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে ওরা এগিয়ে চলল টিলার ওপরে উঠবে বলে। এখন ওদের গাইড কম্যান্ডার সাকসেনা।
কিছুটা এগোতেই হঠাৎ সাকসেনা থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখাদেখি ওরাও দাঁড়িয়ে পড়ল। কী হল আবার? সাকসেনা মুখে আঙুল দিয়ে ওদের চুপ থাকতে বলে এদিকে ওদিকে ঘাড় ফিরিয়ে কিছু যেন দেখতে লাগলেন। তারপর হাতের ইঙ্গিতে ওদের পেছন পেছন আসতে বলে এগিয়ে চললেন একটা দিকে। কিছুটা যাবার পর বোঝা গেল ব্যাপারটা। এখানে দুটো টিলা দুদিক থেকে এসে মিশেছে, আর তার মাঝখানটায় অনেক কম উচ্চতার একটা খাঁজ। এখান দিয়ে খুব অল্প আয়াসেই টিলাটা পেরিয়ে ওপারে চলে যাওয়া যাবে। তার মানে এই জায়গাটা সাকসেনার আগে থেকেই দেখা। হয়তো মুক্তির তাগিদেই। ব্যাপারটা দেখে বেশ ভাল লাগল দ্যুতিমান আর গ্রিভসের। যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল ওরা। তবু তো ওপরে ওঠার পরিশ্রম অনেক কম হবে। সেইসঙ্গে বিপদের ভয়ও একটু হলেও কমবে।
তিনজনে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে টিলায় উঠতে শুরু করলো। সবার আগে সাকসেনা, পেছনে ওরা দুজন। পথ বলে তো কিছু নেই, গাছপালা ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে রাস্তা বার করে নিয়ে চলা। এখানেও নানা পাথরের রাজত্ব, আর তার মধ্যে ভয়ঙ্কর সেই সবুজ পাথরও কিছু কম নেই। এখন তারা নিঃসাড়ে শুয়ে আছে। যেন সত্যি পৃথিবীর পাথরের মতোই নিষ্প্রাণ তারা। কিন্তু খানিকক্ষণ আগের অভিজ্ঞতা থেকে ওরা জানে, নিমেষে কি ভয়ঙ্কর, কি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে ঐ নিরীহ পাথরগুলো।
ধীরে ধীরে টিলার ওপরের খাঁজটায় এসে উঠলো তিনজনে। এর মধ্যেই বেশ হাঁফ ধরে গেছে। একে টিলায় ওঠানামার পরিশ্রম, তার ওপর এইসব অদ্ভুত ঘটনার টেনশান, সব মিলিয়ে ওরা রীতিমতো হাঁফাচ্ছে। কিন্তু রেস্ট নেবার উপায় নেই। আর এইটুকু নামতে পারলেই কেল্লা ফতে। বাকিটুকু হেঁটে গিয়ে ডুওক্র্যাফ্টে উঠে পড়া। উৎসাহের আতিশয্যে এবার একটু তাড়াতাড়িই নামতে লাগল ওরা। বেশ খানিকটা নেমেও এল। আর ঠিক তখনই আচমকা একটা গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে খুব জোর সামলে নিল গ্রিভস। অস্ফূটে সামান্য একটা শব্দ শুধু বেরিয়ে এল ওর মুখ দিয়ে। কিন্তু পেছনে থাকা দ্যুতিমান সব ভুলে গিয়ে আচমকাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘সামলে গ্রিভস, সামলে’।
ওর মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে মুখ ফিরিয়ে ধমকে উঠলেন সাকসেনা, ‘আঃ, চুপ!’ গ্রিভসও মুখে আঙুল রেখে শব্দ করল, ‘হাশ্–স্–স্–স্’।
কিন্তু ততক্ষণে যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। ওদের চোখের সামনে নড়ে উঠল ঝোপঝাড়গুলো। আর তার ফাঁক থেকে জীবন্ত বিভীষিকার মতো বেরিয়ে আসতে লাগল একের পর এক সবুজ পাথর। ওদের গলার আওয়াজে আবার তারা জেগে উঠেছে, আবার তারা একটু একটু করে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে তাদের ভয়ংকর হিংস্রতা নিয়ে।
গ্রিভস আর দ্যুতিমান আতঙ্কিত শিহরণ নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু সাকসেনার অভিজ্ঞতার দাম অনেক। তিনি এক পলক ওপরদিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপরেই চিৎকার করে ‘ফলো মী’ বলেই ছুটতে শুরু করলেন নিচের দিকে।
দাঁড়িয়ে ভাবার আর কোন অবকাশ নেই। দ্যুতিমান আর গ্রিভসও সঙ্গে সঙ্গে দুদ্দাড় করে অনুসরণ করল সাকসেনাকে। গাছপালা ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে, পাথরের পর পাথর টপকে, দিশেহারা হয়ে ওরা ছুটতে লাগল নিচের দিকে। পেছনে মৃত্যুদূতগুলো গড়গড় করে গড়িয়ে আসছে, তা ছুটতে ছুটতেই প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছিল ওরা। ওদের মনে হচ্ছিল, যে কোন মুহূর্তেই বোধহয় একটা গা–ঘিনঘিনে থাবা এসে পড়বে ওদের ঘাড়ের ওপর।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হল না। প্রাণপণে ছুটতে ছুটতেই ওরা একসময় এসে পড়ল টিলার নিচে সমতল এলাকায়। সাকসেনা তার কয়েক সেকেন্ড আগেই এসে পৌঁছেছেন সেখানে, আর পেছনে ঘুরে তাঁর অস্ত্র তাগ করেছেন গড়িয়ে আসা ভয়ংকর পাথরগুলোর দিকে। ওরা ছুটতে ছুটতেই দেখতে পেল, সাকসেনার অস্ত্র কয়েকবার রশ্মিবর্ষণ করল, আর তার ফলে আগের মতোই বেশ কিছু পাথর জেলির মতো গলে যেতে লাগল। কিন্তু বাকি পাথরগুলো এবার আর তাতে ভয় পেল না। তারা সেই একই গতিতে গড়িয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে।
হিম হয়ে আসা শরীরে পাগলের মতো চারিদিকে তাকাল ওরা দুজন। ডুওক্র্যাফ্টটা কোথায়? কিছুটা দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে যানটাকে দেখতে পাওয়ামাত্র দিগ্বিদিক ভুলে সেদিকে দৌড়োল ওরা। এবার আগে আগে ছুটেছে গ্রিভস আর দ্যুতিমান, তাদের পেছন পেছন সাকসেনা। আর কালান্তক যমের মতো তাদের পেছনে গড়িয়ে আসছে সবুজ পাথরগুলো।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা এসে গেল তাদের বাহনের কাছে। দরজা খোলাই ছিল। টপ টপ করে লাফিয়ে উঠে পড়ল ওরা। একে একে তিনজনে ভেতরে ঢোকামাত্র দ্যুতিমান কাঁপা কাঁপা হাতে দরজাটা টেনে লক করে দিল। আর তার পরমুহূর্তে একটা বিকট শব্দ। ভয়ংকর গতিতে লাফিয়ে এসে দরজায় আছড়ে পড়েছে দুটো পাথর।
বিচিত্র সব গাছপালা আর ভয়াবহ পাথরের রাজত্ব ছেড়ে দ্রুতগতিতে ডুওক্র্যাফ্টটা উড়ে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। চালকের আসনে গ্রিভস। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড উত্তেজনা সত্ত্বেও সে একমনে যানটার গতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত ছিল বাইরের দিকে তাকিয়ে।
দ্যুতিমান এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছে। বড়ো করে নিঃশ্বাস নিয়ে সে এবার সাকসেনার দিকে তাকাল। সাকসেনা স্থির নিষ্কম্প দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন নিচে ফেলে আসা পাথরগুলোর দিকে। তাঁর কঠিন মুখের রেখায় যেন এক সংকল্পের চিহ্ন।
দ্যুতিমানও নিচের দিকে তাকাল। কিন্তু সেখানে এখন সবকিছুই অত্যন্ত স্বাভাবিক। পাথরগুলো নির্জীব হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এদিকে সেদিকে। এই মুহূর্তে তাদের দেখে একটু আগের দৃশ্য কল্পনা করাও যায় না। যেন সরল স্বাভাবিক একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য।
সেদিকে দেখতে দেখতেই মুখ খুলল দ্যুতিমান, ‘কি ভয়ঙ্কর! কি ভয়ঙ্কর! বাপরে বাপ! নিজের চোখে না দেখলে এ জিনিষ বিশ্বাস করাও অসম্ভব। কিন্তু কম্যান্ডার, এ কী আশ্চর্য ব্যাপার! নির্জীব পাথরের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার? আর তাদের এমন হিংস্র পশুর মতো আচরণ? কিভাবে? আমাদের এত উন্নত বিজ্ঞানেও তো আমরা আজ পর্যন্ত এমন কথা শুনিনি! এর কারণ কী? প্লীজ কম্যান্ডার, দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন প্লীজ? আর তাছাড়া আপনি বলছিলেন, আপনাদের গোটা টিম ধ্বংস হয়ে যাবার মূলেও নাকি এই পাথরগুলো, সেটাই বা কেমন করে হল? বলুন কম্যান্ডার!’
সাকসেনা তখনও অন্যমনস্ক হয়ে ছিলেন। সেই অবস্থাতেই মাথা নেড়ে বললেন, ‘কী বলছো? ও ইয়েস, পাথরগুলো। ওরা কী বা কারা, তাই তো?’ বলে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘বেশ, বলছি শোনো।’
এগিয়ে গিয়ে গ্রিভসের পেছনে দেয়ালে আটকানো একটা আসনে একটু রিল্যাক্স করে সাকসেনা বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘দেখ, যদিও সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত, তার মানেই এই নয় যে সেটাই ঠিক। হয়তো এর পেছনে আরও কিছু অজানা সত্য লুকিয়ে আছে, আরও কোন অজানা বিজ্ঞান, যা আমাদের চিন্তা–ভাবনার বাইরে। তবু সবকিছু দেখেশুনে আমার যা মনে হয়েছে, আমি সেটাই তোমাদের বলছি। কিন্তু সে ব্যাখ্যাটা করার আগে পুরো ঘটনাটা তোমাদের জানা দরকার।
‘সেদিন মার্টিমোর আর বার্তেল্লো ক্যাপসুলটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার পর আমি খানিকটা চিন্তিতই ছিলাম। বাইরে তেমন কিছু প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে একটা টেনশান আমার ছিলই। কারণ আফটারঅল এই গোটা দলটার আমিই লীডার। দলের যে কোন ভালোমন্দের কৈফিয়ত আমাকেই দিতে হবে। তাই মনে মনে ওদের ফিরে আসার প্রতীক্ষাতেই সময় কাটাচ্ছিলাম। সেইসঙ্গে অবশ্য আর একটা কথাও মাথায় ঘুরছিল যে, ওরা যদি কিছু স্যাম্পেল নিয়ে আসে, তাহলে ভালই হয়। সেই স্যাম্পেলগুলো বিশ্লেষণ করে এই গ্রহটা সম্পর্কে একটা আউটলাইন ধারণা তৈরী করা যায়।
‘ঠিক ঘন্টাচারেক পর, তখন আমাদের সবাই বেশ রিল্যাক্সড মুডে ছিল; কেউ কেউ সুপার–পাজলে বা মুভিতে ব্যস্ত ছিল, কেউ বা আবার এয়ারট্যাবে গ্যালাক্সি–গেম খেলছিল। আমি নিজেও একটু আগেই লাস্ট রিপোর্টটা পৃথিবীতে কনভে করে এসে রোজকার মতো ইউনিনেট খুলে বসেছিলাম। ঠিক কী করছিলাম, সেটা এই মুহূর্তে আর মনে নেই, বোধহয় আমাদের কোন কোন স্যাটেলাইটের চীফের সঙ্গে কথা বলা বা ঐ জাতীয় কিছু একটা করছিলাম।
‘হঠাৎ কন্ট্রোল রুম থেকে আর্জেন্ট কল। দৌড়ে গেলাম। ওখানে তখন কাজ করছিল সুধাংশু নামে একটা ছেলে। অল্প বয়েস, তবে কাজের ব্যাপারে খুব সীরিয়াস। সে দেখলাম সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেছে। একটু আগেই রেকর্ড করে রাখা মেসেজটা শোনালো। আর সেটা শুনে আমারও রীতিমতো টেনশান শুরু হয়ে গেল। এ কী ব্যাপার?’
সাকসেনা চুপ করলেন। তাঁর গলা শুকিয়ে এসেছে। দেয়ালে ঝোলানো জলের প্যাকেট একটা টেনে নিয়ে ছিঁড়ে জলটা খেলেন।
ততক্ষণে দ্যুতিমান অধীর হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করে ফেলেছে, ‘কী মেসেজ কম্যান্ডার? কার মেসেজ?’
সাকসেনা একবার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘মেসেজটা এসেছিল মার্টিমোর আর বার্তেল্লোর কাছ থেকে। সাংঘাতিক কোন বিপদের মধ্যে পড়ে ওরা প্রাণপণে আমাদের সাহায্য চাইছিল। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, বিপদটা ঠিক কী জাতীয়, সেটাই ওরা বলতে পারছিল না। শুধু অদ্ভুত একটা আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ওরা আমাদের ডাকছিল।’
‘মাই গড!’ বলে উঠল গ্রিভস। বাহনটা চালাতে চালাতেও ওর কান পড়ে রয়েছে এদিকেই। দ্যুতিমান অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
সাকসেনা মাথা ঘুরিয়ে একবার গ্রিভসের দিকে তাকালেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ। ওরা তখন সেই বিপদের মধ্যেই পড়েছিল, যে বিপদ আমরা এড়িয়ে এলাম একটু আগেই। কিন্তু তখন সেটা সম্পর্কে কিছুই বুঝিনি। শুধু শুনেছিলাম, ওরা বারবার আমাদের সাহায্য চাইছে, আর ওরা কোন্ জায়গাটায় আছে, তার ভৌগোলিক অবস্থানটা জানাচ্ছে। অর্থাৎ সেই মেসেজ থেকে এটা পরিষ্কার যে, ওদের পক্ষে জায়গাটা ছেড়ে বেরোনো সম্ভব নয়। কিন্তু বিপদটা কী? কিছুই বুঝলাম না। সেই মুহূর্তে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলাম, কিন্তু আর কোন যোগাযোগ হল না। কাজেই সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের যেতে হবে সেখানে, এবং সেটা তক্ষুনি।’
দ্যুতিমান বলল, ‘নিশ্চয়ই তখনই আপনি ওখানে গেলেন?’
সাকসেনা বললেন, ‘অভিয়াসলি! শুধু আমি একা নই, ওদের বিপদের কথা শোনামাত্র দলের বাকি ছ–জনের প্রত্যেকেই তৎক্ষণাৎ ছুটে যেতে চাইছিলাম সেখানে। তবে শেষ পর্যন্ত সুধাংশু রয়ে গেল রকেটে। তাকে কন্ট্রোল রুমে বসিয়ে আমরা বাকি পাঁচজন রওনা দিলাম রকেটের আর একটা ক্যাপসুল নিয়ে।’
‘তারপর? তারপর?’ ব্যগ্র স্বরে বলল গ্রিভস।
সাকসেনা বলে চললেন, ‘ওরা যে জায়গাটার কথা জানিয়েছিল, সেটা আমাদের রকেট থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। সেটা একটা উপত্যকা অঞ্চল। একদম রূক্ষ ধূসর এলাকা। তবু তার মধ্যেই এক একটা জায়গায় গাছপালা যেন জমাট বেঁধে আছে। যেন অনেকগুলো গাছকে ধরে ধরে কেউ একেক জায়গায় জড়ো করে রেখেছে। আর ওর মধ্যেই একটা জায়গায় চোখে পড়ল ওদের ক্যাপসুলটা। ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাছের জটলার পাশে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা।
ওখানেই আমরা আমাদের ক্যাপসুলটা নামালাম। তারপর খুঁজতে শুরু করলাম ওদের। কিন্তু না, শুধু ওই ক্যাপসুলে কেন, আশেপাশে কোথাও কোন চিহ্নই নেই মার্টিমোর আর বার্তেল্লোর। এদিকে বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছি ওদের সঙ্গে যে কোনভাবে কানেকশান করার, কিন্তু না পাচ্ছি ওদের কোন ফ্রিকোয়েন্সি, না পাচ্ছি কোন সিগন্যাল। অগত্যা সবাই মিলে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে খুঁজতে শুরু করলাম। ম্যালকম আর আব্দুল আমার সঙ্গেই ছিল, আমরা ক্যাপসুলের আশেপাশেই খুঁজতে থাকলাম ওদের। ডেভিস আর কিম গেল অন্য দিকটায়। গাছের জটলার পাশ কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ওরা আমাদের চোখের বাইরে চলে গেল। আর তার ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই ঘটে গেল সেই মারাত্মক ঘটনা।’
এক মুহূর্ত থেমে দম নিলেন সাকসেনা। দ্যুতিমান আর গ্রিভসের মুখে কোন কথা নেই। উত্তেজনার অধীর হয়ে ওরা পরবর্তী ঘটনা শোনার প্রতীক্ষা করছে।
সাকসেনা বলতে থাকেন, ‘আমরা যখন এদিকটায় খোঁজাখুঁজি করছি, তখনই একবার যেন শুনলাম ডেভিসের গলা। মনে হল সে চেঁচিয়ে মার্টিমোর আর বার্তেল্লোর নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। তার পরেই একটা আবছা হুড়মুড় আওয়াজও যেন কানে এসেছিল। সেরকম গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু তার পরেই কানে এল আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ আর তীব্র তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার। সেটা যে ডেভিস আর কিমেরই গলা, তা নিয়ে আমাদের কোন সংশয় ছিল না। মুহূর্তে অস্ত্র বার করে আমরা তিনজনেই ছুটে গেলাম সেদিকে, যে দিক দিয়ে ডেভিস আর কিম গিয়েছিল। মোটামুটি চিৎকারটা আন্দাজ করে একটু গিয়েই দেখলাম, কোথাও কেউ নেই, শুধু একটা জায়গায় একগাদা সবুজ রঙের পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর তাদের ঘিরে আশেপাশে কিছুটা জায়গায় সবুজ রঙের কিছু তরল পদার্থ, আর জেলির মতো থকথকে কিছু যেন মাঝে মাঝে নড়ছে। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার সন্দেহ নেই, কিন্তু তখন আমাদের সেইসব খুঁটিয়ে দেখার মন নেই। আমরা ওখানে দাঁড়িয়েই ডেভিস আর কিমের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকলাম দু তিনবার। আর তার পরক্ষণেই যা দেখলাম, তাতে গোটা শরীর নিমেষে ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হল, একটা ভয়ঙ্কর বিস্ময় আর আতঙ্কের ছায়া যেন নিমেষে গ্রাস করে ফেলছে আমাকে। সেই পাথরগুলো, আমাদের চারপাশের সেই সবুজ পাথরগুলো যেন এক পলকে জীবন্ত হয়ে উঠে আমাদের আক্রমণ করতে আসছে। কী বলব, সেই মুহূর্তে বোধহয় মাথা আর কাজ করছিল না। তাই হাতের অস্ত্রের কথা ভুলে গিয়ে আমরা তিনজনেই বুকফাটা চিৎকার করে দৌড়তে শুরু করেছিলাম আমাদের ক্যাপসুলের দিকে। কোনরকমে সেখানে পৌঁছে ক্যাপসুলে চেপে বেরিয়ে এসেছিলাম ওদের আয়ত্তের বাইরে।
‘আর তখনই, সেই ভয়ঙ্কর আক্রমণ থেকে শুরু করে ক্যাপসুলে করে রকেটের দিকে আসার মধ্যেই দূর হয়ে গিয়েছিল সমস্ত রহস্য। এই প্লিওনাস গ্রহের ভয়ঙ্কর এই সবুজ পাথরের আসল রূপ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।’
‘এই তো, এটাই তো আসল কথা কম্যান্ডার,’ দ্যুতিমান বলে, ‘এতক্ষণ ধরে এই ব্যাখ্যাটা শোনার জন্যেই তো অপেক্ষা করছি। বলুন আপনি, এ রহস্যের কী ব্যাখ্যা আপনি খুঁজে পেয়েছেন?’
সাকসেনা কিছু বলার আগেই গ্রিভস বলে ওঠে, ‘কম্যান্ডার, আমরা এসে গেছি।’
দুজনেই চমকে মুখ তুলে তাকায়। দ্যুতিমান দেখে, একটু দূরেই ওদের রকেটের দিকে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে ওদের ডুওক্র্যাফ্ট। এতক্ষণ কথার মধ্যে ডুবে থাকায় ওরা খেয়ালই করেনি, কখন আকাশ পাড়ি দিয়ে ওরা এসে পৌঁছে গেছে ওদের রকেটের কাছে।
সাকসেনা বললেন, ‘যাক। সব ভালো যার শেষ ভালো। এবার ভালোয় ভালোয় পৃথিবীর পথে পাড়ি দেওয়া যাক। চলো, যাত্রা শুরু করার পর বাকিটা তোমাদের ব্যাখ্যা করব।’
দ্যুতিমান জানলা দিয়ে তাকায়। রকেটের ওপর খোলা অংশটা দিয়ে একদম হিসেব করে ডুওক্র্যাফ্টটাকে নামিয়ে রকেটের ভেতরে ঢোকাচ্ছে তার সহকর্মী, তার বন্ধু।
‘দেখ, প্রথমে আমিও তোমাদের মতোই অসহায়ভাবে এ রহস্যের ব্যাখ্যা খুঁজছিলাম। কারণ আমার জ্ঞানত এমন কোন বিজ্ঞান নেই, যা পাথরের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে পারে। তাহলে এগুলো কী?’
ব্যাখ্যাটা আবার শুরু করেছেন কম্যান্ডার সাকসেনা। গ্রিভস আর দ্যুতিমান বসে শুনছে। ওদের রকেট এখন প্লিওনাস গ্রহ ছেড়ে উঠে মহাকাশের বুকে ভাসমান। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এখন রকেটটা চলছে। অঙ্ক আর জ্যোতির্বিদ্যার নিখুঁত নিয়ম মেনে এই যান এখন পাড়ি দিয়েছে পৃথিবী নামের মায়াময় সেই গ্রহটার দিকে। আগামী দশদিন ধরে ওদের এখন ছুটে যেতে হবে আলোর গতিতে। তবেই আবার ওরা গিয়ে পড়বে সেইসব চেনা মুখ আর চেনা বিজ্ঞানের জগতে।
সাকসেনা তখন বলে চলেছেন, ‘প্রাণপণে ক্যাপসুলের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মাথার মধ্যে তখন এইসব প্রশ্নই ঘুরছিল। এগুলো কী? এরা কি নিজেরাই কোন প্রাণী, নাকি আমাদের অজ্ঞাত কোন প্রাণীর তৈরী করা কোন রোবটজাতীয় যন্ত্র? কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? আপাতদৃষ্টিতে এ গ্রহে প্রাণেরই কোন চিহ্ন আমরা দেখতে পাইনি, বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীর কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাহলে এত উন্নত বিজ্ঞানের প্রয়োগ কিভাবে হতে পারে? আর কোন্খানেই বা? মাটির নিচে? তাই বা কী করে সম্ভব? এইসব সাতপাঁচ ভাবনা ভাবতে ভাবতেই দৌড়োচ্ছিলাম। কোনরকমে ক্যাপসুলে পৌঁছে যখন ইঞ্জিনে স্টার্ট দেওয়া হয়ে গেছে, পাথরগুলো একটু দূরেই গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে আমাদের ক্যাপসুলের দিকে, তখন হঠাৎ আব্দুল তার অস্ত্র তাগ করে ধরল পাথরগুলোর দিকে, আর গুলি ছুঁড়তেই অবাক হয়ে দেখলাম যে . . .’
কথার খেই ধরে গ্রিভস, ‘দেখলেন যে সেই রশ্মির আঘাতে পাথরগুলো জেলির মতো থলথলে হয়ে নেতিয়ে পড়ছে।’
‘ইয়েস, ইয়েস। ও হ্যাঁ, সে তো তোমরাও দেখেছ,’ মুচকি হেসে ঘাড় নাড়েন সাকসেনা, ‘ঠিক তাই। আর এতেই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ওগুলো কোন যন্ত্র নয়, ওগুলো আসলে প্রাণী। তোমার আমার মতোই ওদের প্রাণ আছে, আর তাই মৃত্যুও আছে।’
এতক্ষণ খানিকটা দ্বিধান্বিত ছিল গ্রিভস আর দ্যুতিমান, সাকসেনা কী ব্যাখ্যা দেন এই ভেবে। এবার যেন স্তম্ভিত হয়ে যায়।
দ্যুতিমান অস্পষ্ট গলায় বলে, ‘কিন্তু . . . কিন্তু . . .’
সাকসেনা দ্যুতিমানের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলেন, ‘এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই মুখার্জী। যে বিজ্ঞানের প্রভাবে এখানে আকাশের রঙ খয়েরী, জলের রঙ মেরুন লাল, সেই বিজ্ঞানই এখানে পাথরে প্রাণের সৃষ্টি করেছে। আসলে এ গ্রহের প্রাণীরা হল এমন একদল প্রাণী, যাদের শরীর পাথরের মতো, কিন্তু তার ভেতরে প্রাণের মহিমা। হ্যাঁ, ঠিকই অনুমান করছো তোমরা। আমাদের পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যে প্রাণীর শুধু কল্পনাই করে এসেছেন এতদিন, কার্বন–বেস্ড্ প্রাণীজগতের বাইরে সিলিকন–বেস্ড্ এক প্রাণীর জগৎ, এই প্রাণীরা হল সেই প্রাণী।’
‘ও মাই গড!’ বলে ওঠে গ্রিভস।
‘ইয়েস,’ সাকসেনা গ্রিভসের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের চরম সৌভাগ্য যে, হাজার হাজার বছর ধরে বিজ্ঞানীর দল যে সিলিকন–বেস্ড্ প্রাণীর কথা ভেবে এসেছেন, আমরা নিজের চোখে সেই প্রাণীদের দেখা পেলাম। এও জানতে পারলাম যে প্রাণীগুলো তাদের জগতে অচেনা কোন শব্দ পেলেই জেগে ওঠে। তাই মানুষের গলার শব্দ পাওয়ামাত্র ওদের পাথুরে দেহে প্রাণের সঞ্চার হয়। আর তখনই ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে তারা জীবন্ত হয় সর্বগ্রাসী ক্ষুধায়। তাই ডেভিস আর কিমকে ঘিরে ধরে ওরা শেষ করেছে। তাদের অস্ত্র কয়েকটা পাথরের মৃত্যু ঘটালেও তারা নিজেদের বাঁচাতে পারেনি। নিশ্চয়ই তার আগে মার্টিমোর আর বার্তেল্লোরও একই দশা হয়েছিল। আর আমার চোখের সামনে ওই পাথরের দলের শিকার হয়েছে আমার প্রিয় দুই সঙ্গী — ম্যালকম আর আব্দুল।’
সাকসেনার গলা ভারী হয়ে আসছিল। তিনি চুপ করলেন। দ্যুতিমান আর গ্রিভসও সেই মুহূর্তে কথা না বলে চুপ করে থাকে।
বাইরের দিকে নজর পড়ে দ্যুতিমানের। আকাশের সেই ম্রিয়মাণ আলো থেকে ওরা ক্রমশ অন্ধকারের বুকে মিশতে চলেছে। হঠাৎ কী যেন মনে পড়তে সে বলে ওঠে, ‘আচ্ছা কম্যান্ডার, এই প্লিওনাস গ্রহে দিনরাতের ব্যাপারটা তো কিছু বোঝা গেল না। এখানে কি রাত বলে কিছু নেই? আমরা তো যতক্ষণ ছিলাম, শুধু দিনের আলোই দেখে গেলাম। এর মানেটা কী?’
সাকসেনা অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কি? তোমরা জানো না? এখানে পাঠানোর আগে এ গ্রহের জিওফিজিক্স তোমাদের জানানো হয়নি? আমি তো জানি, যে কোন এক্সপিডিশানে যাবার সময় সে জায়গাটা সম্পর্কে একটা আউটলাইন নলেজ দিয়ে দেওয়া হয়!’
গ্রিভস বলল, ‘সেটা এক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি কম্যান্ডার। আপনার এস.ও.এস. পাবার পর এমন তাড়াহুড়ো করে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হয়েছে যে, ফর্মাল ক্লাশ নেবার আর সময় ছিল না।’
সাকসেনা বললেন, ‘বুঝেছি। তবে তোমরাও চেষ্টা করলে তোমাদের রকেটের কম্পিউটার থেকে ডেটা নিয়ে নিতে পারতে। হয়তো টেনশানে তারও চেষ্টা করোনি। খুব স্বাভাবিক। যাই হোক, ব্যাপারটা তোমাদের বুঝিয়ে বলি। আসলে পৃথিবীর মতোই এ গ্রহ নিজ অক্ষে আবর্তিত হয়, কিন্তু প্রায় তিনগুণ কম গতিতে। আর তাই ২৪ ঘন্টার বদলে ৭২ ঘন্টায় এর দিনরাত সম্পূর্ণ হয়। অর্থাৎ ৩৬ ঘন্টা দিনের পর ৩৬ ঘন্টা রাত। তারপর আবার ৩৬ ঘন্টার দিন। এইভাবে চলতে থাকে।’
দ্যুতিমান মাথা নেড়ে বলল, ‘বুঝলাম। যেহেতু আমাদের এখানে আসা থেকে ৩৬ ঘন্টা এখনও পার হয়নি, তাই ধরতে পারিনি ব্যাপারটা।’
সাকসেনা মৃদু হেসে সায় দিলেন। বললেন, ‘আমি তো এই এতদিনের মধ্যে মাত্র তিনটে দিন আর তিনটে রাত দেখতে পেয়েছি। ওঃ! সেই রাতগুলো যে কী এক বিভীষিকাময় আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে! ভাবতে পারবে না।’
গ্রিভস বলল, ‘কম্যান্ডার! আমি কিন্তু তখন থেকে একটা কথাই ভাবছি। এই যে অদ্ভুত পাথর–প্রাণীর দল, আমরা যদিও খুব আকস্মিকভাবেই এদের দেখা পেয়েছি, কিন্তু এখন তো জেনেছি যে এদের অস্তিত্ব আছে! সেক্ষেত্রে আমরা কি এই ব্যাপারে আর কোন স্টেপ নেব না? বিজ্ঞান তো আমাদের শিখিয়েছে যে, নতুনকে জানার চেষ্টাই হল বিজ্ঞান, আর সেটাই হল সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ধাপ!’
সাকসেনা বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমি সেটা ইতিমধ্যেই ভেবে রেখেছি। পৃথিবীতে ফেরার পর কিছুদিনের মধ্যেই আমি এখানে ভালোমতো একটা এক্সপ্লোরিং–এর ব্যবস্থা করব। আমাদের বিজ্ঞানে অজানা নতুন কিছু সংযোজনে হয়তো দিশারী হয়ে থাকবে এই প্লিওনাস গ্রহের পাথর–প্রাণীর দল। আর সেই কারণেই সে টিমে আমাদের সঙ্গে থাকবেন নামকরা কিছু ভূ–বিজ্ঞানী আর জীববিজ্ঞানীর দল।’
‘বাঃ! খুব ভাল হবে কম্যান্ডার। আচ্ছা, সেই টিমে কি আমরা দুজনেও থাকতে পারি না?’ বলে দ্যুতিমানের মুখের দিকে তাকায় গ্রিভস। দ্যুতিমানের চোখেও ঝিলিক। তার মানে তারও ইচ্ছে আছে।
দুজনের মুখের দিকে তাকিয়েই ঘাড় নাড়েন কম্যান্ডার সাকসেনা। তাঁকেও কেমন খুশি খুশি দেখাচ্ছে। আগামী অভিযানের কল্পনায় যেন এখন থেকেই তিনি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন।
সবাই মিলে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। ওদের রকেট একই গতিতে ধাবমান। আর সেই দেখে এতক্ষণে যেন হুঁশ হয় ওদের। মারাত্মক খিদে পেয়েছে। সেই কখন যে ওরা খেয়েছে তা আর বোধহয় মনেই পড়ে না।
গ্রিভস বলে, ‘বসুন কম্যান্ডার। আমি দেখি স্টোরে কী আছে। এই বলে স্টোরের দিকে এগোয় গ্রিভস। আর দ্যুতিমান পা বাড়ায় টয়লেটের দিকে। সাকসেনা চুপ করে বসে আকাশ–পাতাল ভাবতে থাকেন।
রকেটের পেছনদিকের একটা চেম্বারে টয়লেটটা। সেদিকের করিডোরের মুখে একটা দরজা। সুইচ টিপতেই দরজাটা সরে গিয়ে দেয়ালের গায়ে ঢুকে গেল। হালকা মনে শিস দিয়ে একটা গানের সুর তুলতে তুলতে এগিয়ে যাচ্ছিল দ্যুতিমান। হঠাৎ একটা অজানা শিরশিরে অনুভূতি ওর মনে ছায়া ফেলল। একটা আনক্যানি ফিলিংস।
এরকম হচ্ছে কেন? ভুরু কুঁচকে আশেপাশে চোখ ফেরায় দ্যুতিমান। একটু দূরে করিডোরটা গিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিয়েছে। সেদিকেই আছে ডুওক্র্যাফ্টটা। একটা খোলের মতো নির্দিষ্ট সীমানায়। ওদিক থেকে কোন শব্দ এল কি? না, সেরকম তো কিছু মনে হয়নি। তবু কী ভেবে ওদিকটায় এগিয়ে যায় দ্যুতিমান।
করিডোরটা বাঁক নিয়ে ঘুরেই আচমকা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো স্থির হয়ে যায় সে। একটা অব্যক্ত শব্দ বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে।
ছোটবড়ো সাইজের তিনটে পাথর করিডোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ওদের গা থেকে শ্যাওলা সবুজ রঙ প্রতিফলিত হচ্ছে করিডোরের ডিজিটাল আলোয়। আর ওদের অদৃশ্য চোখ যেন কালের অতল গহ্বর থেকে নিরীক্ষণ করছে দ্যুতিমানকে।
এক মুহূর্তের জন্য হাতের শক্ত মুঠোয় দ্যুতিমান চেপে ধরে প্যাসেজের পাশের একটা রড। তারপরেই ঊর্ধ্বশ্বাসে পেছন ফিরে দৌড় শুরু করে কন্ট্রোল রুমের দিকে।
কিন্তু ঝড়ের বেগে কন্ট্রোল রুমের ভেতর পৌঁছেই থমকে যায় দ্যুতিমান। ওরা কোথায়?
গ্রিভস না হয় স্টোরে গেছে, কিন্তু সাকসেনা? তিনি তো এখানেই ছিলেন? কোথায় গেলেন তিনি? অথচ এই মুহূর্তেই ওদের দুজনকে দরকার। ওদের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তাকে ছিন্নভিন্ন করে বিপদ যে রকেটে ঢুকে পড়েছে, সে কথা ওদেরও তো জানা দরকার এই মুহূর্তেই!
স্টোরের দিকে পা বাড়ায় দ্যুতিমান। সাকসেনাকে না পেলেও গ্রিভসকে তো পাবেই! আর ওকে পেলেও কর্তব্য স্থির করতে অসুবিধে হবে না।
স্টোরের দরজা বন্ধ। একইরকম সুইচ সিস্টেম এখানেও। যথারীতি সুইচ টিপতেই পাশে ঢুকে গেল দরজাটা। দ্যুতিমান পা বাড়ায় ভেতরে ঢোকার জন্য, আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য তার শরীরের সমস্ত নার্ভ যেন এক নিমেষে শিথিল করে দেয়। বীভৎস একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে দ্যুতিমান। এ কী দেখছে ও?
স্টোরের ভেতরে গ্রিভসের কোন চিহ্ন নেই। তবে সাকসেনা আছেন। কিন্তু এ কোন্ সাকসেনা? তাঁর সারা গায়ে এমন সবুজ রঙ কেন? আর তাঁর শরীরটা ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে ক্রমশ এমন গোলাকার হয়ে যাচ্ছে কেন? গোটা শরীরের মানবিক কমনীয়তা পাল্টে গিয়ে একটা রূক্ষ কঠিন দানব যেন জেগে উঠছে দ্যুতিমানের চোখের সামনে। তবে কি . . . তবে কি . . .
হঠাৎ দ্যুতিমানের মনের পর্দায় সুপার–মুভির মতো কয়েকটা ছবি যেন খেলা করে গেল চোখের পলকে। ওর পরপর মনে পড়তে থাকল, পৃথিবীর এক্সপ্লোরিং টিমটার প্রত্যেকটা মানুষ মারা গেলেও সাকসেনা যেন বেঁচে রয়েছেন কোনও অলৌকিক জাদুমন্ত্রে। তাছাড়া সেই গুহার ভেতর সাকসেনা তাঁর থার্মোস্যুটটা খুলে রেখেছিলেন, যেটা ছাড়া এই গ্রহের প্রচন্ড তাপমাত্রায় চলাফেরা করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ নানা উত্তেজনায় ওরা সেটা খেয়ালই করেনি তখন। আর অস্ত্রের আঘাতে ওই পাথরগুলোর জেলির মতো গলে গলে পড়া! কঠিন পাথরের এই অদ্ভুত রূপান্তর দেখেও ওদের এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি এই পাথর–প্রাণীর রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতার কথা!
অথচ এখন সেটা বোঝা গেল। এই চরম মুহূর্তে, যখন আর কিছু করার নেই।
প্রাণীটা ঘুরে তাকিয়েছে দরজার দিকে। সাকসেনার ছদ্মবেশ থেকে এখন প্রায় পুরোটাই পাথরে পরিণত হয়ে গেছে সে। অথচ দ্যুতিমানের শরীরে কোন জোর নেই। কোথায় যাবে সে? কোনদিকে?
Tags: কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্লিওনাসের ভয়ঙ্কর, সুপ্রিয় দাস