ক্যাম্পবেলের সঙ্গে একটি দুপুর – ফ্রেড লারনার
লেখক: ভাষান্তর - অঙ্কিতা
শিল্পী:
The FANAC FAN HISTORY PROJECT PRESENTS
জন ক্যাম্পবেলের সাক্ষাৎকার
ফ্রেড লার্নার
সৌজন্যে – দ্য প্রিন্টেড ওয়ার্ড। বইয়ের দুনিয়ার বিভিন্ন খোঁজখবর সংক্রান্ত একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান।
ফ্রেড লার্নার: আজ আমাদের অতিথি কল্পবিজ্ঞান লেখক ও সম্পাদক বিখ্যাত জন ক্যাম্পবেল জুনিয়র। মিস্টার ক্যাম্পবেলের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘who goes there’। এর থেকে সাম্প্রতিককালে একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে, ‘the thing’(১)। তবে, বিগত পঁচিশ বছর ধরে ওঁকে সবাই চেনেন “The astounding Science Fiction” পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে। এ ছাড়াও ‘The astounding Science Fiction Anthology’ এর গল্পগুলো নিয়ে দুটো সংকলনও সম্পাদনা করেছেন উনি। আসুন, ওঁর কাছ থেকে জানা যাক তথাকথিত লিটারারি ফিকশনের সঙ্গে সায়েন্স ফিকশনের সম্পর্ক কেমন।
ক্যাম্পবেল: লিটেরারি ফিকশন। মূলধারার সাহিত্য… এই ‘মূলধারার সাহিত্য’ কথাটা অনেকটাই একটা স্ব-অভিষিক্ত শব্দমাত্র। কে ঠিক করবে কোনটা মূলধারা? কে ঠিক করে দিয়েছে সাহিত্য আসলে কী? আসলে ওই ধরনের শব্দের প্রেক্ষিতে কিছু বলাটাই খুব সমস্যাদায়ক। আপনি যখন জানেনই না ওই শব্দটার আসল অর্থ কী, তখন কীভাবে ওটার সঙ্গে অন্য কারোর সম্পর্ক নিরূপণ করবেন?
সাহিত্য কী? আমার কাছে সাহিত্যের সংজ্ঞা হল, উৎকৃষ্ট চিন্তাভাবনার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশভঙ্গি। এখন বলুন, আইনস্টাইনের রিলেভিটি সংক্রান্ত মূল পেপারটিকে কি সাহিত্য? অথবা, ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিজ বইটা? ওগুলো কিন্তু এই পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট কিছু চিন্তাভাবনার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ।
এবার আসা যাক, মূলধারার সাহিত্য প্রসঙ্গে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন কল্পবিজ্ঞান মূলত হচ্ছে মানুষের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। তবে, শুধুমাত্র আমাদের পৃথিবী বা বর্তমান সময়ে নয়; যে কোনও স্থানে যে কোনও সময়ের গল্প। আমরা বলতেই পারি যাকে মূলধারার সাহিত্য বলা হচ্ছে তা আসলে কল্পবিজ্ঞানের একটি শাখা মাত্র। কারণ, মূলধারার সাহিত্য মূলত লেখা হয় পৃথিবী আর বর্তমান সময়কে কেন্দ্র করে। ওটা মানুষের বিশাল অভিজ্ঞতার ময়দানে বেড়া দেওয়া ছোট একটা উঠোন মাত্র।
আবারও বলছি, আপনারা যে সাহিত্য ঠিক কাকে বলেন, সেটা আমি জানি না। ওই শব্দগুলোকে আমি কোনওদিনই খুব পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারিনি। জেমস জয়েস থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের গণ্যমান্য সমালোচকরা বারংবার চেষ্টা করেছেন দাগিয়ে দিতে, এটা সাহিত্য, ওটা সাহিত্য নয়; তাঁদের মতামতের বিপক্ষে আমার সবসময়ই অজস্র প্রশ্ন আছে।
আচ্ছা! আপনারা বলেন চিরায়ত সাহিত্য। যা কিনা সমকালীন অন্যন্যদের থেকেও অনেক বেশি সময় বেঁচে থাকে। তেমন একটা উদাহরণ নিয়ে দেখা যাক। একটা গল্প। প্রায় তিন হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের বলে যাওয়া একটা গল্প। প্রায় সবধরনের সংস্কৃতি আর ভাষার ঘেরাটোপ অতিক্রম করে আজও এসে গল্পটা জনমানসে আবেদন রাখে। ওটা লেখা হয়েছিল মানুষ যখন মাটির কুঁড়েতেই থাকত তখন। আর আজ এসে জেটপ্লেনের এয়ারপোর্টেও সেই গল্পের আধুনিক পেপারব্যাক এডিশন বিক্রি হচ্ছে। এই ধরনের লেখাকেই তো চিরায়ত সাহিত্য বলা হয়। বার্বারিয়ানদের লেখা সেই গল্পটার নাম ওডিসি। ওটা সাহিত্য, ওটা মহাকাব্য; সর্বোপরি ওটা একটা কল্পবিজ্ঞান। হ্যাঁ, ওটা কল্পবিজ্ঞানই ছিল, যখন ওটা লেখা হয়েছিল তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ওটা কল্পবিজ্ঞানই ছিল, তাই নয় কি?
কেন ওটা কল্পবিজ্ঞান? কারণ, ওটাও তো অন্য সময় আর অন্য জায়গার গল্প। অতীতের উপর দাঁড়িয়ে আজকে আমদের কার্যক্রমের প্রভাব। শুধুমাত্র আমাদের আজকের বর্তমান দুনিয়াতেও নয়, ভবিষ্যতেও; সেটাই কল্পবিজ্ঞান। হোমারের ওডিসি একটা কল্পবিজ্ঞান, এখানে বিভিন্ন অদ্ভুত জগতকে অন্বেষণ করা হয়েছে, বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ফ্রেড লার্নার: আচ্ছা! তবে এখন যে সমস্ত কল্পবিজ্ঞান লেখা হয় আর অন্যান্য ম্যাগাজিনে যে সমস্ত গল্প বেরোয় তারা যে একে অপরের থেকে অনেকাংশে আলাদা, সেটা তো আপনি মানবেন?
ক্যাম্পবেল: নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার মতে, পার্থক্যটা হল কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রটা অনেক বেশি সম্ভবনাপূর্ণ, প্রায় অবাধ। বলতে পারেন, অধিকতর মুক্তমনা। সংকীর্ণ গতানুগতিক মফস্বলী ধ্যানধারণার ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ তো নয়ই। সাহিত্যের অন্য যে কোনও শাখার থেকে বেশি আছে গল্পের বাঁক, রয়েছে কল্পনার ঘোড়া ছোটাবার জন্য বিস্তীর্ণ মাঠ। কালজয়ী পৌরাণিক গাথাগুলোর মতোই এখানেও গল্প কখনও একটা সময়ে একটা স্থানে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না।
ফ্রেড লার্নার: ধরে নিলাম কল্পবিজ্ঞান গতানুগতিক চিন্তাধারার বাইরে উচ্চতর বা অন্যরকম মননেরই বিনোদন; তাহলে বিটনিকরা(২) কেন কল্পবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট নয়? বিটনিকরা তো নিজেদেরকে গতানুগতিকের ঠিক উল্টোটা বলেই মনে করে।
ক্যাম্পবেল: মানুষই এই মহাবিশ্বের প্রধান বিষয় নয়। কল্পবিজ্ঞান এই বোধটাকে দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। যে কোনও ভালো কল্পবিজ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর একটা হল সুশৃংখলিত মানসিক নিয়মানুবর্তিতা। সেটা বিটনিকদের…
এ ছাড়াও আরও একটা ব্যাপার আছে। ঈশ্বরের ধারণাটা বিটনিক গোত্রীয়দের মধ্যে একদমই জনপ্রিয় নয়। আসলে, এই ধারণাটা সর্বদা ঘোষণা করে, ব্যক্তি মানুষের চিন্তাভাবনা, মতামত, এমনকি বিশ্বাসের থেকেও সহস্রগুণে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রয়েছে আমাদেরই চারপাশে। প্রতিমুহূর্তে মহাবিশ্বের কোণায় কোণায় এমনসব ঘটনা ঘটে চলেছে, যেখানে সমবেত মনুষ্যজাতির ইচ্ছা দ্বারাও কোনও পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। কল্পবিজ্ঞান ঠিক এই বিশ্বাসটাই তুলে ধরে। কল্পবিজ্ঞানের পাঠকরা এই ব্যাপারটা মানতে বাধ্য। কিন্তু, এই ধারণাটা বিটনিকদের কাছে ঠিক গ্রহণযোগ্য নয়।
ফ্রেড লার্নার: এক্ষেত্রে একটা কথা আছে। আমি এমন অনেক কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়েছি যেগুলো কিছু গোষ্ঠীর কাছে অসম্মানজনক মনে হতে পারে। যেমন ধরুন, রবার্ট হেইনলাইনের ‘stranger in strange land’ বইটি বাস্তবিকই অনেক মানুষের ধর্মাবেগে আঘাত করেছে।
ক্যাম্পবেল: আমার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়নি ওটা। হেইনলেইনের বক্তব্য ও পন্থার সঙ্গে অনেক জায়গাতেই আমার মতবিরোধ আছে। তবে এটাও মনে রাখবেন; ধর্ম কিন্তু নিয়ত পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, স্থানের বিভিন্নতায় ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমরা দেখেছি। মনে করে দেখুন, সক্রেটিসকে হত্যা করা হয়েছিল, কারণ সে তাঁর তৎকালীন সময় ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অধার্মিক হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন। আমরা আদতে জানিই না ধর্ম কী? আমার মতে, এই মহাবিশ্বে মানুষের থেকেও বড় কিছু জিনিস আছে। যদি আমরা এটা মেনে নিই যে, এই মহাবিশ্ব সততই আমাদের থেকে বড়; ওঁর থেকে আমাদের এখনো অনেক কিছু শেখার আছে। এই বক্তব্যটাই কি যে কোনও ধর্মের মূল কথা নয়? তা তাকে আমরা মহাবিশ্বই বলি, কি ঈশ্বর নামে ডাকি, কি জেসাস; তাতে কি আদৌ কিছু আসে যায়?
ফ্রেড লার্নার: হ্যাঁ। এই ব্যাপারটা আমি লক্ষ করেছি বেশির ভাগ বিজ্ঞান লেখকরাই যথেষ্ট ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন হন। অন্য কথায় যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন। আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের প্রথম লেখক কাকে বলবেন আপনি?
ক্যাম্পবেল: হুম। এটা নির্ভর করছে আধুনিক বলতে কী বোঝাচ্ছেন তার উপরে। আমি যেমন হোমারের কথা বললাম। তাঁর নিজস্ব সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একজন আদি কল্পবিজ্ঞান লেখক। তবে এক্ষেত্রে বলা যেতেই পারে, গালিভার ট্রাভেলের কথা। ওটাও অদ্ভুত জগৎ খুঁজে বেরাবার এক কল্পবিজ্ঞানের গল্প। ওইসব সময়ে তাঁরা স্পেসশিপের কল্পনা করে ওঠেনি। কারণ তখনও পুরো পৃথিবীটাই ঘুরে দেখা শেষ করেনি তাঁরা। তাই গালিভারের জাহাজ ঝড়ে ভেঙে পড়ত কোনও এক অদ্ভুত দ্বীপে। আজকের দিনে, সেটাই স্পেসশিপ ভেঙ্গে পড়ে কোনও এক অদ্ভুত গ্রহে। জাহাজের বদলে স্পেসশিপ বিশাল কোনও পরিবর্তন আনে না। প্রয়োজনীয় কথাটা একই।
তবে সত্যি সত্যি আধুনিক কল্পবিজ্ঞান আমি যা মনে করি তা বললে হয়তো শ্রোতারা অবাক হবেন। রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর কল্পবিজ্ঞানগুলো। তিনি ভীষণ সুন্দর বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন। সত্যি বলতে কি, আজও যদি রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর ওই গল্পগুলো আমার ম্যাগাজিনে জমা পড়ত, তাহলে আমি নিশ্চয়ই ছাপতাম। ১৯২৫ সালের আগের আর কোনও লেখকের কথা তো মনে করতে পারছি না, যাঁর লেখা আজও আমি আমার ম্যাগাজিনে নির্দিধায় প্রকাশ করতে পারি। কিপলিং-এর বেশ কিছু গল্প— যেমন ধরুন the ABC। পুরো শব্দটা হল the aerial board of control। অথবা ‘with the night mail’ এখানে এই নাইট মেইল হল একটা ট্রান্স-ওসানিক এয়ারলাইনার। এ ছাড়াও আরও কিছু গল্প যেমন ‘not not seven’ এবং ‘the ship that found herself’ এগুলোও প্রায় কল্পবিজ্ঞানই। আমার মনে হয় আধুনিক কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসাবে উনিই প্রথম।
ফ্রেড লার্নার: আমি এক্ষুনি খেয়াল করলাম, অনেক কল্পবিজ্ঞান লেখকই কিপলিং-এর কবিতাকে অথবা তাঁর তৈরি চরিত্রকে কোটেশন হিসাবে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন গল্পে। রবার্ট হেইনলেইন তো করেইছেন, আরও অনেক বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখকরাও করেছেন।
ক্যাম্পবেল: তিনি এমন একজন লেখক যিনি বিভিন্ন কালচারাল প্যাটার্নের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। আজকালকার আধুনিক সাহিত্যিকরা তো বেশির ভাগই এক ধরনের কালচারাল প্যাটার্নের বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না। আপনি ‘Kim’ পড়েছেন?
ফ্রেড লার্নার: হ্যাঁ, অবশ্যই। ওটা তো আমার খুব পছন্দের একটা।
ক্যাম্পবেল: গল্পে একজন তিব্বতী লামার চরিত্র আছে। আবার একটা ছেলেকে আনা হবে আই-এর বাজারে। সেখানে আছে একজন আফগান ঘোড়া ব্যবসায়ী। এই যে একাধিক কালচারাল প্যাটার্নের বুনট, এই যে বহুমুখী চিন্তাভাবনা; এটাই হচ্ছে সাহিত্যের সেই মূল সুর যা কল্পবিজ্ঞান তৈরি করার চেষ্টা করছে। এই কারণেই কিপলিং কল্পবিজ্ঞান লেখকদের মধ্যে এত জনপ্রিয়।
ফ্রেড লার্নার: আচ্ছা, কল্পবিজ্ঞানের গল্পের সময়কাল হিসাবে বর্তমান অথবা নিকট ভবিষ্যতকে বেছে নেওয়াটা খানিক বোঝা যায়। কিন্তু আজকাল অনেক কল্পবিজ্ঞান লেখকই তাঁদের গল্পের পটভূমি তৈরি করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানে। আপনার ম্যাগাজিনেই ম্যাক রেনল্ড(৩) এরকম একটা সিরিজ লিখছে যার পটভূমি আফ্রিকাতে। অন্যান্য ম্যাগাজিনগুলোতেও এরকম গল্প প্রায়ই দেখা যায়। এর কারণটা কী?
ক্যাম্পবেল: বর্তমানে মানুষের প্রধান অসুবিধার একটা জায়গা হচ্ছে বিভিন্ন রকমের সংস্কৃতিকে বুঝে ওঠা। অন্যান্য সংস্কৃতির অন্তর্গত ভিত্তিটুকুও মানুষের ধারণার বাইরে। যেমন ধরুন, এই মুহুর্তে আমাদের সব থেকে বড় অসুবিধার ক্ষেত্রটা হল কমিউনিজম কালচার ভার্সেস আমাদের আমেরিকান কালচার। যদি সঠিকভাবে সারটুকু বুঝতে পারা যেত। এক পক্ষ যদি অন্য পক্ষের সংস্কৃতির মূলটুকু বুঝতে পারত, তাহলে কখনওই এত সমস্যা তৈরি হত না জনমানসে। বলতে পারেন এই কালচারাল কনফ্লিক্ট-টাই বর্তমান যুগে মানুষের প্রধান বাধা। এটাই এখন মানুষ জয় করতে চাইছে।
কল্পবিজ্ঞান আমাদের বিভিন্ন সংস্কৃতির মৌলিক নীতিগুলোর সামাজিক গুরুত্ব নেড়েঘেঁটে দেখার একটা সুযোগ দেয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, প্রত্যেকটা সমাজ এবং সংস্কৃতির কিছু প্রয়োজনীয় শর্ত থাকে। যেগুলোকে আমরা সাধারণত ‘inalienable rights of man’ বলে থাকি। তবে এটা মনে রাখা উচিত, অধিকার বলে আসলেই কিছু নেই। শুধু সেইটুকুই আছে যা আপনি অর্জন করতে পারেন। এমনকি বিনামূল্যে স্বাধীনতাও পাওয়া যায় না। সেটাও মানুষকে অর্জন করতে হয়। সেইজন্যেই বলা হয়, যদি স্বাধীনতা চাও তাহলে তার জন্যে তোমাকে লড়াই করতে হবে।
প্রত্যেকটা সমাজের কিছু নিজস্ব নীতি আছে। এবার কল্পবিজ্ঞান গল্পে আমরা সেই বিকল্প মৌলিক নীতিগুলোই বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। খুঁজে দেখা হয় কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন মৌলিক নীতিগুলো মানবসমাজকে আরও উৎকৃষ্ট করে তুলতে পারে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে গল্পগুলোতে প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য থাকে বেশি পরিমাণে। তবে অস্বীকার করা যায় না যে, আজকাল প্রযুক্তি অনেক জায়গাতেই সংস্কৃতিকে চালনা করে। উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি— কয়েক বছর আগে এক যুবক লিনোটাইপ অপারেটর হবে বলে টাইপসেটিং-এর পুরো জগঝম্প ব্যাপারটা শিখতে চাইছিল। শেষমেশ তাকে কড়াভাবেই বোঝাতে বাধ্য হলাম, যে এখন ওটা শেখা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। পুরো বাজারটাই এখন পড়তির দিকে। কিছুদিনের মধ্যেই ওই কাজটা সম্পূর্ণভাবে কম্পিউটারে করা হবে।
আমাদের মনের মধ্যে সমাজের মৌলিক নীতিগুলো সাধারনত দ্রুত পরিবর্তিত হয় না। কিন্তু বাস্তব সমাজ অতিদ্রুত পরিবর্তন হয়ে চলেছে। যেমন, মানাসিক শ্রম কমানোর জন্য কম্পিউটারকে বাস্তবায়িত করেছি। এতে করে সমাজের অনেক নীতিই খানিক বদলে গেছে। একমাত্র কল্পবিজ্ঞানই সমাজের এই দ্রুত পরিবর্তন, এই ভিন্নতর মৌলিক নীতির সাম্ভব্যতাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম। সাহিত্যের অন্য কোনও ধারা এই কাজ করতে পারে না।
ফ্রেড লার্নার: আমাদের শ্রোতাবন্ধুরা মনে হয় খুব বেশি কল্পবিজ্ঞান পড়েননি। আমি নিজেও বিশেষ কিছু জানি না কল্পবিজ্ঞান সম্বন্ধে। আমরা খানিকটা ধারণা পেলাম, যে কল্পবিজ্ঞান কাকে বলে আর কেন মানুষ কল্পবিজ্ঞান পড়বে। তবে কল্পবিজ্ঞান সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত জানার আগে এটা জানতে চাই, কল্পবিজ্ঞান আর ফ্যান্টাসির মধ্যে পার্থক্য করেন কীভাবে? আপনার মত কী?
ক্যাম্পবেল: হ্যাঁ, ওই দুটোর প্রভেদটা আমার পরিপ্রেক্ষিতে একটু জটিলই। তবে একটা সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞান গল্প আমি তাকেই বলব, যে গল্পে লেখক অন্তত একটি নতুন মৌলিক নীতির প্রদর্শন করিয়েছে। সেই মৌলিক নীতিকে ঘিরে পাক খেয়ে খেয়ে খেলার নিয়মগুলো একটি সঙ্গত গল্প তৈরি করে। এবং, সেই গল্পটা যখন আমাদের জানা বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়; তখনই সেটা সার্থক কল্পবিজ্ঞান।
একটা ফ্যান্টাসি গল্প যেখানে খুশি যেতে পারে। এর কোনও সীমাবদ্ধতা থাকে না। ফ্যান্টাসি গল্প অনেকটা স্বপ্নের মতো। যা খুশি তাই ঘটতে পারে। কিন্তু কোনও ঘটনা এখন যেভাবে ঘটছে সেইভাবেই এটাকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাই হচ্ছে সায়েন্স ফিকশন। এক্ষেত্রে আমাদের জানা তথ্যগুলোকে ভিত্তি ধরেই লেখককে গল্প তৈরি করতে হয়। অনেকটা একটা সরলরেখাকে পেন্সিল দিয়ে এঁকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো।
তিরিশের দশকের প্রথম দিকে যে কোনও গড়পরতা সায়েন্স ফিকশনে রকেট শিপ, অ্যাটমিক পাওয়ার এইসব নিয়ে লেখা হত। সেই সময়ে ওই গল্পগুলোকে ফ্যান্টাসি বলা হত। কিন্তু ওগুলো কোনওমতেই ফ্যান্টাসি নয়। ওগুলো সর্বান্তকরণে কল্পবিজ্ঞান, কারণ ওগুলো কোনও ভিত্তিহীন স্বপ্নের উপরে তৈরি হয়নি। তখনকার দিনে ওগুলোই ছিল ভবিষ্যতে কি হতে পারে তার ছায়া।
ফ্রেড লার্নার: এই প্রসঙ্গে আমি একটা গল্প শুনেছিলাম। তিরিশ এবং চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে কল্পবিজ্ঞান লেখকরা নাকি অ্যাটম বোম আবিষ্কারের আগেই সেইকথা বলে দিয়েছিলেন গল্পে। এর ফলে এফবিআই এজেন্ট বা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সি এসে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করে সেই সমস্ত লেখকদের। এটা কি সত্যি ঘটনা?
ক্যাম্পবেল: এর মধ্যে একটা ঘটনা তো একদম সত্যি। আসলে, বোমটার কথা ভবিষ্যবাণী করাটা ওঁদেরকে অতটা বিচলিত করেনি। ওইরকম ভবিষ্যদ্বাণী আমরা প্রায় এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে করে চলেছি কল্পবিজ্ঞানে। ওঁরা আসলে বিচলিত হয়েছিলেন বোমটার এতটাই বিশদ বিবরণ আমরা দিয়ে দিয়েছিলাম সেই ব্যাপারে। (হাসি)
আসলে ঘটনাটা ঘটেছিল ক্লিভ কার্টমেলের ‘ডেড লাইন’ গল্পটাকে নিয়ে। গল্পটায় একটা বর্ণনা আছে ইউরেনিয়াম বোমের আর্মিং মেকানিজম কেমন হতে পারে সেই নিয়ে। আর সেটা লেখা হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। আলামগর্ডো টেস্টের (*প্রথম নিউক্লিয়ার টেস্টের বিস্ফোরণ। যার পোষাকী নাম ট্রিনিটি টেস্ট।) এক বছরেরও বেশি আগে। যখন বইটা প্রথম ছেপে ম্যাগাজিন স্টলগুলোতে আসে, তখন পেন্টাগন প্রায় রাতারাতি বইটার সমস্ত কপি বাজার থেকে তুলে নিয়েছিল।
লেখাটা এতটাই নিঁখুত ছিল, পড়ে মনে হচ্ছিল যে ওই প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত কেউ মুখ ফসকে তথ্যগুলো বলে ফেলেছে। আর, আমাদের লেখক কোনও ‘পাব’-এ বসে সেটা শুনে ফেলেছেন। তো ওঁরা সত্যিসত্যিই অত্যন্ত দ্রুত একটা ইনভেস্টিগেটিং-এর ব্যবস্থা করেছিলেন ওই গল্পটার ব্যাপারে। আমি যতদূর জানি গ্রীনগ্লাস স্পাই ট্রায়ালের তথ্যগুলো লোকসমক্ষে আসার আগে পর্যন্ত, ওই গল্পটার থেকে বেশি যথাযথ কোনও তথ্য বাজারে ছিল না।
অবশ্য এর উত্তরটা খুবই সহজ। একজন পদার্থবিজ্ঞানীকে বছরের পর বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় যা তিনি থিওরেটিক্যালি জানেন, সেটাকেই বাস্তবে পরিণত করার জন্যে। কল্পবিজ্ঞান লেখকদের সুবিধা হলো তাঁদের জিনিসটা বাস্তবে ইট কাঠ পাথর দিয়ে তৈরি করতে হয় না। তাঁরা শুধু বলে দেন যে কীভাবে জিনিসটা হতে পারে। এইভাবেই ক্লিভ কার্টমেলও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তাঁর গল্পটা বাস্তবের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একজন পদার্থবিজ্ঞানী বলেছিলেন, উনি সঠিক উত্তরটা জানতেন কারণ তাঁকে জিনিসটা বাস্তবে বানাতে হয়নি তাই।
তো জিনিসটা বাস্তবে আসার বছরখানেক আগেই সেটা আমরা গল্পে পেয়ে গেছি। এটা আগেও ঘটেছে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ম্যাগাজিনের সূত্রে এমন অনেক গল্পই আমি প্রায়শই পাই, যেগুলো আমি জানি এখনও টপ সিকিউরিটি মেজারের মধ্যে আছে। সেগুলো আমি ছাপি না, এবং লেখকদেরও বারণ করি তাঁরা যেন অন্য কোথাও ঐ গল্প না ছাপায়। মাঝে মাঝেই লেখকরা এমনসব ঘটনা ভেবে ফেলেন। বাস্তবের সঙ্গে প্রায় একইরকম, কিন্তু অজানা।
ফ্রেড লার্নার: আচ্ছা ১৯৩০ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কল্পবিজ্ঞান ক্ষেত্রে কীরকম পরিবর্তন আপনি লক্ষ করেছেন?
ক্যাম্পবেল: হ্যাঁ, পরিবর্তন হয়েছে। সবথেকে বড় পরিবর্তন হয়েছে লেখকদের মধ্যে। আমরা একদল নতুন যুগের লেখক পেয়েছি যারা এই পরিবেশেই বড় হয়ে উঠেছে। অন্যান্য ক্ষেত্র থেকেও লেখকরা ক্রমে এগিয়ে আসছে। এঁদের সবার কাছেই নতুন নতুন সব চিন্তাভাবনা আছে। এই ক্ষেত্রেই তাঁরা সেটা প্রয়োগ করতে চান। এর ফলে যেটা হয়েছে, সেটা হল সামগ্রিক চিন্তাভাবনার একটা ক্রমোন্নতি। সঙ্গে বিশদ বিশ্লেষণও বেড়েছে প্রচুর।
বুঝিয়ে বলি। ব্যাপারটাকে ব্যবসায়ী হিসাবে আমি এইভাবে দেখি—আমাদের পাঠকরা তাঁদের পকেট থেকে পঞ্চাশ সেন্ট বার করে কাউন্টারে রাখেন, যাতে করে আমার লেখকরা তাঁদের জন্যে কিছু করতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে, একজন মানুষ কেন লেখককে এই কাজের জন্যে পয়সা দিতে চাইবেন?
হয় লেখক এমন কিছুটা আইডিয়া খুঁজে দিতে পারবেন যা পাঠক নিজে সারাজীবনেও ভেবে উঠতে পারবেন না। অথবা, লেখক কোনও একটা আইডিয়াকে এতটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করেন যে, একজন পাঠক সেই আইডিয়াটা জানা থাকলেও, কোনওদিনই নিজে ভেবে সমোৎকর্ষতা লাভ করতে পারবেন না। অথবা, লেখক লেখার মাধ্যমে এমন কোনও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যে সিদ্ধান্তটা পাঠককে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। বহুক্ষেত্রেই পাঠক মোটেও সেই সিদ্ধান্তটাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু যদি লেখক নিজের লেখার মাধ্যমে গল্পটাকে ভালোভাবে গড়ে তোলেন তখন পাঠক বলতে বাধ্য হন যে, ‘হ্যাঁ, সিদ্ধান্তটা আমার ভালো লাগেনি ঠিকই, কিন্তু ওটা ঠিক। আমি কখনই অমনভবে ভাবতে পারতাম না।’ তখনই লেখাটা একটা ভালো গল্প হয়ে ওঠে। এই সম্পূর্ণ ঘটনাগুলো বিগত তিরিশ বছরে বারংবার ঘটেছে। শুধু যে ঘটেছে তাই নয়, ক্রমান্বয়ে নিজেদের উন্নতিসাধনও করে চলেছে।
ফ্রেড লার্নার: আপনি তখন বললেন যে কিছু লেখক যারা কল্পবিজ্ঞানের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছেন। এমন কয়েকজনের নাম কি আপনি বলতে পারবেন?
ক্যাম্পবেল: হ্যাঁ, অবশ্যই। সেই আটত্রিশ সালের শেষের দিকে আমি যখন “Astounding Science Fiction” পত্রিকায় সবে কাজ শুরু করেছিলাম, তখন একটা বাচ্চা ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত। সে তখন কলম্বিয়ার এক আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র ছিল। ছেলেটার নাম আইজাক আসিমভ। এখন যিনি ড. আইজাক আসিমভ, বস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর। তিনি বড়ই হয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে। কল্পবিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে তাঁর অবদান কখনোই ভোলার নয়। বেশ কিছু নতুন লেখক যারা এখন আমাদের জন্য গল্প লিখছেন। তাঁরা অনেকেই ওই কল্পবিজ্ঞানের সময়ে জন্মেছেন। তাঁরা অনেক কিছু শিখেছেন। পুরোনো কল্পবিজ্ঞানকে ভিত্তি করে তাঁরা ক্রমেই সম্পূর্ণ ক্ষেত্রটিকে উন্নত করে তুলছেন। পরিবর্তনও করে চলেছেন।
ফ্রেড লার্নার: আপনার কী মনে হয় আগামী বছরগুলোতে কল্পবিজ্ঞানের গল্প কেমন হবে?
ক্যাম্পবেল: ইস! আমি যদি সত্যি জানতাম, তাহলে আমি এখনই সেই লেখককে ধরে নিয়ে এসে পত্রিকায় লেখাতাম। আসলে, একজন সম্পাদকের ব্যবসার প্রকৃতিটা অনেকটা টেলিফোন লাইনের অপর পারের কথা শোনার মতো। শুধু এক্ষেত্রে তাকে ছয় মাসের মতো অপেক্ষা করতে হয়। আজকে আমি যে গল্পটা আমার টেবিলে বসে পড়ছি, ঠিক ছয় মাস আমাকে অপেক্ষা করতে হবে গল্পটা সম্পর্কে পাঠকের মতামত জানার জন্য।
আমাকে আজকে বসে আন্দাজ করে নিতে হয় ছয় মাস বাদে পাঠক কী ভাবতে পারে গল্পটা সম্বন্ধে। আর এই ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়েই আমাকে গল্প নির্বাচন করতে হয়, আমাকে পত্রিকাও বিক্রি করতে হয়। ভালো লেখকরা সবসময়ই তাঁদের গল্প দিয়ে আপনাকে অবাক করে দেবে। তাঁরা এক একটা গল্প নিয়ে আসবেন, আর পড়ে আপনার মনে হবে কই এরকম তো ভাবিনি কখনো। সত্যি বলতে কি, লেখকরা আমাকে প্রতিনিয়ত দেখিয়ে যাচ্ছেন যে কল্পবিজ্ঞানে কত ভালো লেখা তৈরি হতে পারে!
ফ্রেড লার্নার: কল্পবিজ্ঞান লেখা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে। এই প্রশ্নটা শুধু আমিই নয়, অন্য অনেক লোকের মাথাতেও ঘোরে। যেহেতু আপনিও একজন লেখক, সেহেতু প্রশ্নটা আপনাকেও করা যেতে পারে। এই সমস্ত আইডিয়াগুলো আপনারা কোথা থেকে পান?
ক্যাম্পবেল: সর্বত্র। যেমন, আমার প্রথম দিকের লেখায় আমি একটা আইডিয়া ব্যবহার করেছিলাম। সেটা আমি পেয়েছিলাম ডক্টর নরবার্ট ওয়েনারের কাছ থেকে। উনি এম আই টি-র একজন প্রফেসর। ১৯৩১ সাল নাগাদ তিনি সাইবারনেটিক্স-এর কাজে খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন। আর একটা আইডিয়া আমি পেয়েছিলাম একজন গ্যারাজ মেকানিকের কাছ থেকে। গাড়ির ইঞ্জিনের বাজে ডিজাইনের জন্য সে ঘোরতর অসন্তোষ প্রকাশ করছিল। এ ছাড়া একটা টেক্সটবুক পড়তে পড়তেও আমি একটা আইডিয়া পেয়েছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল লেখক ঠিক লেখেননি, এটা এইভাবেও তো হতে পারে। আর তারপরেই আমি একটা গল্প লিখে ফেললাম। কেউ বলতে পারে না সে কোথা থেকে আইডিয়া পায়।
ফ্রেড লার্নার: শ্রোতাদের জন্য কিছু সদ্য প্রকাশিত বইয়ের নাম যদি বলেন…
ক্যাম্পবেল: হুম। আসলে, আমি বই পড়ি না। না না, এমন নয় যে ম্যাগাজিনের জন্যে আসা লেখাগুলো আমি পড়ি না। বরং অফিসে ওগুলো শুধু আমিই পড়ি। গল্পগুলোকে ঝাড়াই বাছাই করার জন্য আমার কাছে কোনও সম্পাদকীয় দল নেই। সত্যি বলতে কি, রাশি রাশি পাণ্ডুলিপি পড়ে পড়ে যখন পাগলের মতো দশা হয় তখন আর এক্সট্রা কিছু পড়তে ইচ্ছা করে না। আমি এমন একটাও লেখা কখনও পড়িনি, যেটা আগে আমার ম্যাগাজিনের জন্য আসেনি। আমার পক্ষে জাস্ট সম্ভব নয়। আমারও তো একটা সীমা আছে। এটাই আমার ছুটি নেওয়ার পন্থা বলতে পারেন।
ফ্রেড লার্নার: আচ্ছা! তাহলে আপনি আমাদের কিছু লেখকদের নাম বলুন। অনেক শ্রোতাবন্ধুরা হয়তো আগে কখনো কল্পবিজ্ঞান পড়েনি, প্রথমবারের জন্য তাঁরা কল্পবিজ্ঞান পড়তে আগ্রহী। তাঁদের জন্য কিছু লেখকের নাম বলুন।
ক্যাম্পবেল: এটা নির্ভর করছে তাঁরা ঠিক কোনদিক থেকে কল্পবজ্ঞানের দুনিয়ায় ঢুকতে চাইছেন। একজন পদার্থবিদ যিনি আগে কখনও কল্পবিজ্ঞান পড়েননি, সেরকম পাঠকের জন্যে আমার মাথায় এক্ষুনি আসছে ফ্রেড হয়েলের কথা। আপনি তো জানেনই তিনি এখন বিশ্বের প্রধান কসমোলজিস্টদের মধ্যে একজন। তিনি বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞানের বই লিখেছেন।
ফ্রেড লার্নার: উনি ‘a for andromeda’ লিখেছেন না?
ক্যাম্পবেল: ওটা আমি পড়িনি। কিন্তু ওটা ওঁর কাজ নয়। উনি লিখেছেন ‘the black cloud’। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটা। তবে কোনও পাঠক যদি সামাজিক সাহিত্যের দিক থেকে আসেন, সেক্ষেত্রে আমি তাঁকে রে ব্র্যাডবেরির লেখা পড়তে বলব। তাঁর লেখা মনের মধ্যে এক অনুরণন তৈরি করে। পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে। বব হেইনলেইনও বেশ কিছু অসাধারণ গল্প লিখেছেন। যেমন আমি বলছিলাম, রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর কিছু অসামান্য সায়েন্স ফিকশন আছে। আজকের দিনে বসেও সেগুলো অবশ্য পড়া যায়।
কিছু মজার ঘটনা এই প্রেক্ষিতে বলা যায়। ওঁর লেখা ‘with the night mail’ গল্পটা ১৮৯০-তে যে ম্যাগাজিনে প্রথম বেরিয়েছিল তাঁরা বেশ কিছু বিজ্ঞাপন বার করেছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষকালের বিভিন্ন জিনিস, ফ্লাইং মেশিন ইত্যাদি, কেমন হতে পারে সেই নিয়ে বিজ্ঞাপন। বেশ সুন্দর সুন্দর মজার বিজ্ঞাপন ছিল গল্পটা নিয়ে।
প্রচুর ভালো ভালো কল্পবিজ্ঞান বেরিয়েছে। সবগুলোর কথা আমার সত্যিই মনে নেই।
ফ্রেড লার্নার: অসংখ্য ধন্যবাদ মিস্টার ক্যাম্পবেল। আজকের অনুষ্ঠানে আমাদের অতিথি ছিলেন জন ক্যাম্পবেল জুনিয়র। অ্যানালগ ম্যাগাজিনের সম্পাদক এবং কল্পবিজ্ঞান লেখ। ‘the printed word’ থেকে আমি ফ্রেড লার্নার বলছি।
টীকা:
(১) 1951 সালে প্রথম চলচ্চিত্রটি তৈরি হয়, নাম ছিল The thing from Another World। অবশ্য জনগণের মধ্যে সিনেমাটি The Thing নামেই বিখ্যাত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮২ নাগাদ The thing নামে আরও একটা সিনেমা মুক্তি পায় একই উপন্যাসের উপরে।)।
(২) চল্লিশের দশকের শেষভাগে আমেরিকার সাহিত্য জগতে বিটনিক বিপ্লব শুরু হয়। বাংলা সাহিত্যেও তার কিঞ্চিৎ আঁচ এসে লাগে। বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গাঙ্গুলির বন্ধু কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এই বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। )
(৩) বিকল্প আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির পটভূমিতে সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন ম্যাক রেনল্ডস।
Tags: অঙ্কিতা, অনুবাদ, ইন্টারভিউ, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ফ্রেড লারনার, সাক্ষাৎকার
দারুণ লাগল ইন্টারভিউটি।