ক্লাউন – আতংক
লেখক: রোশনি রেবেকা স্যামুয়েল, বাংলা অনুবাদ - কৃষ্ণা রক্ষিত ও সিফন বণিক
শিল্পী: রোশনি রেবেকা স্যামুয়েল
ঊনত্রিংশ শতাব্দী। ক্লাউনরাই এখন জগৎ শাসন করে। পৃথিবী বর্জন করেছে টেকনোক্রেসিকে। টেকনোক্রেসিই এই পৃথিবীতে মারাত্মক সব প্রাণঘাতী অস্ত্রের জন্ম দিয়েছে যা একসময় এই পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। দুনিয়া আজ তাই দুটো সমান্তরাল ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এর একটা অংশ শাসন করে কিং ক্লাউন আর অন্যটা রেক্স করিডন। কিং ক্লাউন তাঁর প্রাণোচ্ছল স্বভাবের জন্য পরিচিত। খুব পারদর্শিতার সঙ্গে তিনি তাঁর পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ মুছে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি রিসাস গ্রহে শাসন করছেন। রেক্স করিডন তুলনামূলকভাবে কঠোর শাসন ব্যবস্থা বলবৎ করার পক্ষপাতী। তাঁর মতে একমাত্র দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও ভীতির মাধ্যমেই দেশ চালানো সম্ভব। তার রাজত্ব টিমোর গ্রহে।
রিসাসের লকরভ স্ট্রিটের পরিবেশটা আজ কেমন থমথমে। টেলিপোস্টার বোর্ডে একটি ছেলের নিখোঁজ বার্তা জ্বলজ্বল করছিল। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট সব জলে ডুবে গেছে। প্লাসিডো একদৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিল। সেইসময় তার চোখ পড়ল শ্রীমতী ইমানির দিকে। তিনি গজগজ করতে করতে তার চপচপে ভিজে থাকা জামাকাপড়গুলো তুলছিলেন।
উজ্জ্বল সোনালী চুলের প্লাসিডোকে দেখতে ভারি সুন্দর। বাদামী চোখের রোগাটে গড়নের ছেলে প্লাসিডো একটি বেঢপ বুট পরেছিল তখন। হঠাৎ সে দেখতে পেল যে একটা দলে মুচড়ে যাওয়া কাগজের নৌকা ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির জলের তোড়ে। জলের স্রোত সেটাকে নর্দমার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সে লক্ষ্য করল নৌকার গায়ে নীল কালিতে লেখা আছে ‘এস.এস’। দেখে মনে হচ্ছিল প্রবল জলের তোড়ে সেটা প্রায় ডুবে যেতে চলেছে। অন্ধকারে ওই নর্দমার জলকে পিচ-এর মতো কালো লাগছিল।
একটা ছোট ছেলে তখন বর্ষাতি আর এক জোড়া বুট পরে নর্দমার পাশে লাফালাফি করছিল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলি টুপটাপ শব্দে তার টুপির ওপর পড়ছিল। শুনে মনে হচ্ছিল যেন কোন বাড়ির চালে বৃষ্টি পড়ছে। এই শব্দ শুনে সে খুব মজা পাচ্ছিল। বৃষ্টি ভেজা ভোরের মাটির সোঁদা গন্ধে তার পুলক জেগেছিল ভারি। প্লাসিডো একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর ঘুরে আশপাশের গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকাল। এগুলোকে সে বহুবার দেখেছে, তবুও পরিবারই কেমন যেন অবাক হয়ে যায়। আগের জগৎ কেমন ছিল সে জানত আর এ-ও জানে যে বর্তমানে তার কী পরিবর্তন হয়েছে।
যে বোমার মারাত্মক বিস্ফোরক শক্তিতে পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত, সেই বোমা সম্পর্কে প্লাসিডো অনেক গল্প শুনেছে। এগুলো সে বিশ্বাস করতে চায় না। তার জন্মের আগে যে অন্য একটা পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল এটা সে মানতে নারাজ। এসব বাস্তবে হতে পারে বলে সে বিশ্বাস করে না।
রিসাস বিভাজিত পৃথিবীর একটি অংশ। কিং ক্লাউনের তৈরি এই জগৎই ছিল তার বাসস্থান। বস্তুত পৃথিবী এখন দ্বিধাবিভক্ত— একটি অংশ আনন্দের, যেখানে সে থাকে আর অন্য অংশটা ভয়ের, যেখানে অন্য মানুষেরা থাকে। কিন্তু প্লাসিডোর কাছে এসব গল্পকথা বলে মনে হয়।
শোবার ঘরের জানলার কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ ড্রামের আওয়াজের মতো শোনাচ্ছিল। প্লাসিডো যে ছেলেটার দিকে তাকিয়েছিল তার মাথায় পাতলা কালো চুল আর নাকের চারপাশে ছিল ছোট ছোট বাদামী দাগ। ছেলেটিও হতবাক হয়ে ওই গগনচুম্বী বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়েছিল একদৃষ্টে।
শীতকালে সন্ধ্যার শুরুতে তুষারদন্ডগুলোকে যেমন দেখায় বাড়িগুলোকেও ঠিক তেমনই দেখাচ্ছিল। প্লাসিডো নাক টানতে টানতে তার ওভারকোটটি পরে নিল। তার মা তখন পিয়ানোতে ‘সোনাটিনা ক্লিমেন্টি’-র সুরটা বাজাচ্ছিল। মায়ের বাজানো এই সুরটি তার খুব ভালো লাগছিল।
প্লাসিডো ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ওখানে কাগজের নৌকাটি নিয়ে কি করছ?”
ছেলেটি ভুরু কুঁচকে বলল, “এটা কাগজের নৌকা নয়, এটা একটা জাহাজ।”
প্লাসিডো বলল, “তুমি কাগজের নৌকা বানানো শিখবে? আমি তোমাকে বানিয়ে দেব, তারপর সেটা আমরা ভাসাব।”
ছেলেটি তখন সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার নাম কী?”
“প্লাসিডো, আর তোমার নাম?”
“আমার নাম কাই লিন, কিন্তু মা আমকে কাই বলেই ডাকে।”
“নৌকা বানানো শিখতে তুমি কি আমার বাড়িতে আসবে?” প্লাসিডো ওকে জিজ্ঞাসা করল।
“আমি জানি না, মা আমাকে অচেনা লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে।” কাই উত্তরে বলল।
প্লাসিডো তখন ওকে বুঝিয়ে বলল, “আমরা মোটেও অপিরিচিত কেউ নই, আমরা তো প্রতিবেশী। তুমি আমার বাড়ির উলটো দিকে থাকো তাই না?”
উত্তরে কাই বলল, “হ্যাঁ থাকি, কিন্তু আমার মা প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব একটা বেশি কথা বলা পছন্দ করে না।”
প্লাসিডো তখন মনে মনে ভাবল, “এটা ঠিকই, মিসেস ইমানী সত্যিই কারোর সঙ্গে মেলামেশা করেন না। তিনি কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যান না, এমনকি কারো বাড়িতেও যান না।”
কাই নিরিহ চোখে প্লাসিডোর দিকে তাকাল, তার চাহনিটা ছিল অনেকটা হরিণীর দেখা দিনের প্রথম শিশির বিন্দুর মতো। সে তার মাথাটা খুব খুব জোরে জোরে নাড়ছিল, এতটাই জোরে যে তা যদি খুলে যেত তো প্লাসিডো অবাক হবে না।
প্লাসিডো ইশারায় কাইকে তার ঘরে আসতে বলল। কাই তখন তার ভেজা বর্ষাতি ও লাল বুট খুলে ঘরে প্রবেশ করল।
“আমি এসেছি বলে তোমার বাবা মা কিছু মনে করবে না তো?” কাই জিজ্ঞাসা করল।
প্লাসিডো মৃদু হেসে বলল, “তারা তোমাকে দেখতেই পাবে না।”
প্লাসিডো এক গাদা কড়কড়ে হিজিবিজি কাটা হলুদ রঙের কাগজ আনল। তারপর সেগুলো একটি মসৃণ কাঠের টেবিলের ওপর রাখল। প্রচন্ড বৃষ্টি ও ঝোড়ো হওয়াতে কাঠের টেবিলের ওপর রাখা নাইট ল্যাম্পটা দপদপ করছিল।
প্লাসিডো খুব সন্তর্পনে দক্ষতার সঙ্গে যথাযথভাবে কাগজ মুড়ে নিখুঁত একটি কাগজের নৌকা বানাল। তারপর একটা নীল রঙের মার্কার দিয়ে তার ওপর লিখলো ‘এস. এস. কাই’।
“দাঁড়াও এবার এটাকে ওয়াটার প্রুফ করে দিচ্ছি, নয়তো জলে ভিজে এটা নষ্ট হয়ে যাবে।” প্লাসিডো বলল। ওই নৌকাটাকে ওয়াটারপ্রুফ করার জন্য সে খুব যত্ন সহকারে তার ওপর হাইড্রোফোবিক মেমব্রেন লাগিয়ে দিল।
কাই চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে এতক্ষণ এসব দেখছিল।
প্লাসিডো উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, নৌকাটা ভাসান যাবে কি না। সব জিনিসপত্র এক জায়গায় জড়ো করে তারা ঝোড়ো বৃষ্টিমুখর আবহাওয়ার মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। তখন ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে, যেন মনে হচ্ছে পুরো শহরটাকে গিলে খাবে। বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে বাঁদিকে একটা বিলবোর্ডের পাশ কাটিয়ে তারা চলে গেল। বোর্ডটাতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে, “ভয় পেয়ো না, আমি হলাম এখানকার অধিপতি আর আমি এখানে সাহায্যের জন্য আছি।”
বোর্ডটাতে হাসিখুশি মুখের কিং ক্লাউনের বুড়ো আঙুল দেখানো একটা ছবি ছিল। সেখানে হাস্যরত কিং ক্লাউনের ছবির চারপাশে একটা বর্ডার ছিল যেটাতে কমলা ও লাল বর্ণের আলো পর্যায়ক্রমে জ্বলছিল আর নিবছিল।
তারা রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল সরু রাস্তাটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিং ক্লাউনের বিভিন্ন ছবির পোস্টারে ভর্তি আর প্রত্যেকটাতে একই বার্তা লেখা।
কাই প্লাসিডোর দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখ, কেমন হাস্যকর দেখতে, তুমি কি আগে কখনও ওকে দেখেছ?”
প্লাসিডো ভয় জড়ানো চোখে পোস্টারটার দিকে তাকাল। তার চোখমুখের অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গিয়ে সে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। কাই এই ব্যাপারটাকে অতটাও গুরুত্ব দিল না। সে কেবলমাত্র প্লাসিডোর খাকি প্যান্টটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে প্যান্টটা একদম চিপসে গেছিল। কাই লক্ষ্য করল যে, হাঁটুর দিকটায় প্যান্টটা বেশ গোল হয়ে ছিঁড়ে গেছে। কাই মজার ছলে প্লাসিডোর হাঁটুতে একটু সুড়সুড়ি দিল।
“আহ! এটা কি করছ? তোমার আঙুলটা যে খুব ঠাণ্ডা।” প্লাসিডো আনমনা ভাব কাটিয়ে উঠল।
“এই ধরণের প্যান্ট তুমি কোথায় পেয়েছ? জানো, আমার বাবাও না এইরকম প্যান্ট পরত, কিন্তু সে তো আর আমাদের মধ্যে নেই।”
“আহা, কি হয়েছিল তার?”
“আমি ঠিক জানি না।” প্লাসিডো বিষণ্ন মুখে বলল। সে আকাশের দিকে কোনও দেবদূত দেখবার আশায় তাকিয়ে রইল, যে তাকে বলবে তুমি চিন্তা কোরো না, তোমার বাবা এখানেই আছে। তুমি জানও না ঠিক কতটা তোমার কাছে আছে।
“তুমি জানো না! একথার মানে কি? তাহলে তুমি কি এটা বলতে চাইছ যে তোমার বাবা হঠাৎই কোনও একদিন কোনও চিহ্ন না রেখেই অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেছে আর তুমি সত্যিই তাকে কখনওই দেখনি?”
“নাহ, ঠিক তা নয়, আমি তাকে দেখেছি, আমার মায়ের কাছে বাবার একটা ছবি আছে। সেখানে আমিও বাবার সঙ্গেই আছি, কিন্তু আমি এতটাই ছোট ছিলাম যে ঠিক করে মনেও পড়ে না।”
“এটা তো খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। তুমি কখনও তোমার মায়ের কাছে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করোনি?”
“না। আমি কখনও সেভাবে কিছু জানতে চাইনি।” কাই বলল।
প্লাসিডো বুঝতে পারছিল যে তার কথাগুলো কাইকে কেমন অস্বস্তির মধ্যে ফেলছে। তাই সে অন্য কথায় চলে গেল। “আচ্ছা, এই নৌকাগুলোকে আমরা কেন ভাসাচ্ছি না?”
কাই মাথা নাড়িয়ে তাতে সম্মতি জানাল আর তখনই তার মুখ থেকে ফিক্ করে একটা হাসি বেরিয়ে আসল। প্লাসিডো নৌকাটা কাই-এর হাতে দিয়ে বলল, “নৌকাটিকে ভাসিয়ে দেখাও তো? দেখি তুমি কেমন পারো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি ঠিক পারব, দেখ।” কাই নৌকাটাকে বৃষ্টির জলে ভাসিয়ে দিল। আর যেই না মাত্র ভাসিয়েছে ঠিক তখনই বর্ষার জলের তোড় এটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেক দূরে। নৌকাটা যেন আর থামতেই চাইছে না। কাইও ঠিক তেমনি ওটার পিছনে ছুটতে লাগল, কারণ নৌকাটা তাকে ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে গেছে।
“আরে প্লাসিডো! দেখ এটা কেমন সুন্দর ভাসছে!” প্লাসিডো কাইকে ধরবার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। কাই ফূর্তিতে রাস্তা দিয়ে বেশ লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল তখন। আর নৌকাটা রাস্তার পাশে জলের স্রোত ধরে দিয়ে দ্রুতগতিতে বয়ে চলেছে। সেই চলার পথে সব রকম ঘূর্ণাবর্তকে কাটিয়ে নৌকাটা তার মতো করে এগিয়েই চলেছে। কাই-এর পিছনে ছুটতে ছুটতে প্লাসিডো হাঁপিয়ে উঠল। তার দম প্রায় শেষ। ইতিমধ্যেই প্লাসিডোর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে ইনহেলার বার করে শ্বাস নিতে থাকল। পরক্ষণেই সে তাকিয়ে দেখল যে কাই আর সেখানে নেই। ক্ষণিকের বিদ্যুৎ ঝলকানির মতো সে কেমন যেন মিলিয়ে গেছে। প্লাসিডো চারিদিকে ভালো করে খুঁজে দেখল, কিন্তু না পেয়ে “কাই”,”কাই” বলে চিৎকার করতে শুরু করল। “তুমি কোথায় কাই? আরে আমার জন্য তো একটু দাঁড়াও!” কিন্তু কোনও সাড়া নেই চারিপাশে শুধুমাত্র রাস্তার ওপর বৃষ্টির টিপটিপ শব্দ ছাড়া। তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। প্লাসিডো লক্ষ করল যে নৌকাটা নর্দমায় আটকে গেছে। সে যতদূর সম্ভব দ্রুত ছুটতে লাগাল। কাই, কাই বলে সে আবারও চিৎকার করতে শুরু করল। সে নৌকাটা হাতে তুলে নিল। দেখলো কাগজটা জলে আধভেজা হয়ে যাওয়াতে এস এস কাই শব্দটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। নৌকাটাকে হাতের মধ্যে নিয়ে সে নাড়াচাড়া করতে লাগল। ভয়ে যখন সে রাস্তার দিকে তাকাল তখনও কাই এর কোনও চিহ্ন নেই। শুধুমাত্র বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার মৃদু আলো দেখতে পেল সে। সেই মুহূর্তেই সে তার বাড়ির দিকে ছুটল। তখন তার মাথায় কেবল যতোসব দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন সে কী করবে? রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কোনও একটা চিহ্ন অন্ততঃ দেখতে পাবে বলে আশা করছিল সে।
“ছেলেটা গেল কোথায়? কিভাবেই বা হারিয়ে গেল?” সে বারবার তার আশেপাশে ঝোপঝাড় আর সরু রাস্তার দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিল যদি তার নতুন বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যায়। হঠাৎ সে দেখতে পেল রাস্তার এক কোনে একটা সাদা দস্তানা পড়ে রয়েছে। সে ওটাকে তুলল। মনে হয় কাইয়েরই হবে কেননা এটা খুব ছোট বাচ্চাদের গ্লাভসের মতো।
সে ভাবল বাড়ি গিয়ে মিসেস ইমানিকে সবটা জানাবে। ঝড় থেমে গেছে। এখন মিসেস ইমানি তার বাগানে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। প্লাসিডো এর আগে কখনও তার সঙ্গে কথা বলেনি। এটাই প্রথমবার। সবুজ কাঠের দরজাটার দিকে এগোতে এগোতে সে শুনতে পেল উইন্ড চাইমসের একটানা মৃদুমন্দ আওয়াজ। ডোরবেলটা বাজানো চেষ্টা করতে না করতেই দরজাটা হাট্ করে খুলে গেল। মিসেস ইমানি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে। তার মুখটা চিনামাটির পুতুলের মতো গোল আর ফ্যাকাশে লাগছিল। তার চুলগুলো ছিল মিশমিশে কালো আর তার মুখের চারিপাশে কয়েক গোছা ছোট চুল ঝুলছিল। মুখ দেখে তার বয়স ঠিক বোঝা যায় না।
“হ্যাঁ, বলো।” কেমন একটা সন্দেহের চোখে মিসেস ইমানি প্লাসিডোর দিকে দেখল।
“মিসেস ইমানি, আমি কি আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি? একটু কাই এর ব্যাপারে কথা বলব।”
ইমানি সরু রাস্তাটার দিকে উঁকি মেরে দেখে বলল, “কে তুমি?”
“আমার বাবা প্লাসিডো গঞ্জালেজ, আমি এই রাস্তাটার উলটোদিকে থাকি।”।
মিসেস ইমানি রাস্তার দিকে এক পলক ভালো করে দেখে নিল যে কেউ রাস্তা দিয়ে আসছে কি না। তারপর তাকে ভিতরে আসতে বলল। প্লাসিডো বাড়িটায় ঢুকল।
“একটু আগেই আপনার ছেলে কাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমরা একটা কাগজের নৌকা বানিয়ে সেটাকে ভাসানোর চেষ্টা করছিলাম আর দেখছিলাম নৌকাটা কেমন করে ভেসে ভেসে যায়। আমরা নৌকাটার পিছনে ছুটতে লাগলাম।” মহিলাটি তার কথার মধ্যে বাধা দিল, “আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি হঠাৎ আমার ছেলের সঙ্গে কেন কথা বলেছ?”
“আমি ওকে শুধু সাহায্য করছিলাম নৌকাটা বানানোর জন্য।”
“ঠিক আছে, সে কোথায় এখন?” ওনার গলায় বেশ বিরক্তির সুর।
হতাশাজনকভাবে প্লাসিডো বলল, “আমি ঠিক জানি না। ও নৌকাটার পিছনে জোরে ছুটতে ছুটতে একটা বাঁক নিল। আমি ওর সঙ্গে পেরে উঠছিলাম না বলে দম নেওয়ার জন্য একটু থেমে গেছিলাম। আর তারপরেই ওকে আর দেখিনি। …মিসেস ইমানি আমি ওকে সব জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু শুধু এটা পেয়েছি।” এই বলে সে সাদা দস্তানাটা তার হাতে দিলো। মিসেস ইমানি ভয় ভয় চোখে প্লাসিডোর দিকে তাকাল একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে। প্লাসিডো বুজতে পারল যে, খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। প্লাসিডোর হাতটা ধরে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে মিসেস ইমানি বেশ ধমকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি আমার ছেলের সঙ্গে কী করেছ? চল আমাকে নিয়ে তোমার বাবার কাছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
প্লাসিডো ভয়ে ভয়ে মিসেস ইমানি দিকে তাকাল, “সত্যি বলছি। আমি জানি না কী হয়েছে।”
মিসেস ইমানি তাকে প্রায় উপেক্ষা করে রাস্তা দিয়ে গটগট করে হাঁটতে লাগলেন। প্লাসিডোর বাড়ির বারান্দায় পৌঁছে কলিং বেল বাজানোয় মিঃ গঞ্জালেজ দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কাকে খুঁজছেন?”
মিসেস ইমানি রেগে বললেন, “আপনার ছেলে বলছে যে সে এতক্ষণ আমার ছেলে কাই-এর সঙ্গে ছিল। আর এখন সে বলছে তাকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
মিঃ গঞ্জালেজ প্লাসিডোকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাচ্চাটা কোথায়?”
প্লাসিডো বললো, “আমি ওকে নৌকা ভাসাতে সাহায্য করছিলাম। আমি এক সেকেণ্ড-এর জন্য নিচে তাকাতেই আর তখনই সে উধাও হয়ে গেল।”
ওর মা মিসেস গঞ্জালেজ প্লাসিডোকে ধমকে বলল, “চেনা নেই জানা নেই, যার তার সঙ্গে কথা বলিস কি করে?”
প্লাসিডো বলল, “আমি শুধু ওকে একটু সাহায্য করছিলাম।”
মিঃ গঞ্জালেজ একটু গম্ভীরভাবে বললেন, “ঠিক আছে। এসব নিয়ে পরে কথা হবে। এখন চলো সবাই আলাদা আলাদা হয়ে ওকে খুঁজি। মিসেস ইমানি! আপনি আর প্যাট্রিসিয়া পশ্চিম দিকে যান , আমি পূর্ব দিকটা খুঁজে দেখি আর প্লাসিডো তুই যেখানে ওকে শেষবারের মতো দেখেছিলিস ঠিক সেখানে গিয়ে আরেকবার ভালোভাবে খুঁজে দ্যাখ।”
প্লাসিডো তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়েছিল ভরসা পাবার জন্য। কিন্তু তেমন কিছুই দেখতে না পেয়ে অভীষ্ট দিকে সে হাঁটতে লাগল, যেখানে বৃষ্টির জলের ধারাস্রোত প্রায় একটা নদীর মতো হয়ে গিয়েছিল। সে ফুটপাথের দিকে তাকাল কিছুক্ষণ আগেই যেখানে তাদের পায়ের চিহ্ন ছিল। কংক্রিটের রাস্তায় এখন তার লেশমাত্র নেই। ঘন্টাখানেক পর বিধ্বস্ত হয়ে প্রত্যেকে ফিরে এল শুধুমাত্র প্লাসিডো বাদে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর গঞ্জালেজ আর মিসেস ইমানি এক সঙ্গে তার খোঁজ করতে গেল। প্লাসিডো তখনও নিখোঁজ। বৃষ্টির জল তার সব চিহ্ন মুছে দিয়েছে শুধুমাত্র তার টুপিটি ছাড়া। সেটা কাদা লাগানো অবস্থায় একটা নর্দমার পাশে পড়ে ছিল। প্লাসিডোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। নিখোঁজ ছেলে দুটির নাম ধরে তারা জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু তাদের কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। জলের তোড়ে ছেলেগুলো নর্দমায় পড়ে গেছে ভেবে নর্দমার কাছাকাছি গিয়ে তারা আরও জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন ওদের নাম করে। কিন্তু উত্তরে শুধু নিজেদের ডাকের প্রতিধ্বনিই ভেসে আসছিল নর্দমার ফাঁকা জায়গায় ধাক্কা খেয়ে । শব্দটা যেন ঠিক ক্রূর হাসির শব্দের মতো শোনাচ্ছিল। এইসব ঘটনায় বড়োই উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেলেন মিসেস ইমানি । প্রথমে স্বামীকে হারানো আর তারপরেই সন্তানকে! এখন তার কাইকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? ওর স্বামী ছিলেন জনপ্রিয় ‘সার্কাস ম্যাক্সিমাস’ ম্যাগাজিনের এডিটর। একদিন এমন হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন তিনি। ওর কাছে এই দ্বিতীয় আঘাতটা ছিল আরো সাংঘাতিক। তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কোনক্রমে মিসেস গঞ্জালেজ তাকে ধরে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
তারা যাওয়ার পরপরই রাস্তার ধারে নর্দমার ভেতর থেকে কে যেন আনন্দে হা হা করে হেসে উঠল। সে ছিল পাউন্ড ফুলিশ। জাগলিং ক্লাউন আজকে দুটো শিকার পেয়েছে, তাই সে খুব খুশি। তার বস বলেছিল রিসাস থেকে একটি ছেলে ধরে আনতে, অথচ সে দুজনকে ধরেছে। বস তার উপর আজ খুব খুশি হবে। যেই না কাই ভাসমান নৌকাটার পেছন পেছন ওই নর্দমা পর্যন্ত এগিয়ে আসল তখনই জাগলিং ক্লাউন, পাউন্ড ফুলিশ তাকে ধরে টেনে নিয়ে গেল নর্দমার ভেতর। এর ঠিক পরেই প্লাসিডোকে কাই-এর খোঁজে সেখানে আসতে দেখে সে একটা ফন্দি আটল। সে নর্দমার ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দে বলে উঠল, “বাঁচাও।”
শব্দ শুনে প্লাসিডো নর্দমার কাছে ঝুঁকতেই পাউন্ড ফুলিশ তাকেও হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। জাগলিং ক্লাউন প্লাসিডো আর কাইকে শক্তিশালী নিদ্রা রশ্মি টিউব দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর সে তাদেরকে ওয়ার্ম হোলের প্রবেশদ্বারে নিয়ে গেল যেটা রিসাস ও টিমোরকে সংযোগ করে স্থানকালের আবর্তে। এই বিশেষ ওয়ার্ম হোল রেক্স করিডনের নির্দেশে তৈরি করা হয়েছে। এত একটি অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার যা শুধুমাত্র তার কাছের ক্ষমতাবান লোকেরাই জানে।
রেক্স করিডন গোপনে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের একটা দল তৈরি করেছিলেন। এই দলের বিজ্ঞানীদের স্থানকালকে বিকৃত করার ক্ষমতা ছিল। তারা তাদের অসাধারণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে রিসাস ও টিমর গ্রহের মাঝখানে এই ওয়ার্ম হোল সুড়ঙ্গটি তৈরি করেছে। মুহূর্তের মধ্যেই জাগলিং ক্লাউন, পাউন্ড ফুলিশ টিমোরের এক অজানা রাস্তার ধারে নর্দমার ভেতরের গোপন ডেরায় এই ওয়ার্ম হোলের মধ্যে তাদের মহাজাগতিক চলাচল করে বেড়াত। এরই মধ্যে কাই আর প্লাসিডোকে ‘সেন্টার ফর মাইন্ড রিকনস্ট্রাকশন’এ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই কেন্দ্রটা টিমোর গ্রহের ভূগর্ভে স্থাপিত একটা বেশ গোপনীয় অংশ। তবে এর ভেতরটা আসলে খুব কোলাহলপূর্ণ। এখানে রিসাস গ্রহ থেকে ধরে আনা বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করা হয় যাতে তারা রেক্স করিডনের সেনাবাহিনীর উপযুক্ত সৈন্য হিসেবে কাজ করতে পারে। যাদের অসাধারণ গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা আছে তাদের ভবিষ্যতের প্রযুক্তিবিদ হিসাবে গড়ে তোলা হয়, তাদেরকে এমন বিজ্ঞান শেখানো হয় যাতে তারা টিমোর রাষ্ট্রের সুবিধার্থে প্রকৃতিকে আয়ত্তে আনতে পারে। আর বাকিদের গড়ে তোলা হয় গুপ্তচর হিসাবে। এরা রেক্স করিডনকে তার রাজ্যের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অবগত করবে। যাই হোক জ্ঞান-ই শক্তি আর শক্তি মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে।
এই কেন্দ্রের এক প্রধান হলেন ‘মগজ ধোলাই’। তিনি এক শান্ত প্রকৃতির লোক। তার মাথায় বিশেষ চুল নেই। তাকেও বেশ কিছু বছর আগে রিসাস থেকে অপহরণ করা হয়েছিল।
কৌশলের দ্বারা তার স্নায়ুকোষে ডেলটা রশ্মির প্রয়োগ করে তার মগজকে দুভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল যার ফলে তার মস্তিস্কের সক্রিয় অংশ থেকে রিসাস গ্রহে কাটানো পূর্ব জীবনের সব স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে মুছে গেছে। ‘মাইন্ড রিকনস্ট্রাকশন’- এর ইঞ্জিনিয়াররা খুব দক্ষতার সঙ্গে তার মস্তিষ্কের দু-ভাগের স্নায়ুকোষগুলির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এরপর তার মস্তিষ্কের সচেতন অংশটাকে পুরোপুরি ‘সেন্টার ফর মাইন্ড কনস্ট্রাকশন’ এর নির্দেশকের কর্তব্য পালনের জন্য প্রোগ্রাম করে দেয়া হয়েছে।
বাচ্চাদের মস্তিষ্কের নতুন রূপ দেওয়া অনেক বেশি সহজতর যেহেতু তাদের মস্তিষ্কের উপাদান অনেক বেশি নমনীয়। আর তাদের মন অলিখিত ফলকের মতো, যেখানে অনায়াসেই যে কোনও কিছু লেখা যেতে পারে।
কাই ঘুম ভেঙে দেখল, সে একটা ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে যেখানে চারিদিকে তার মতো অনেক বাচ্চা রয়েছে। তাদের কাউকেই চেনে না সে। স্কুলের প্রথম দিনে অচেনা বাচ্চাদের মধ্যে যেমন অস্বস্তিবোধ হয় কাইও ঠিক তেমন বোধ করছিল। সেখান থেকে এক এক করে বাচ্চাগুলোকে লিফটে নিয়ে যাচ্ছিল একটা ক্লাউন, তারপর তাদের বিশেষ একটা তলায় পাঠাচ্ছিল। লিফটটা এমন নিপুণভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে ওপর তলায় যাওয়ার আগে শুধুমাত্র নির্বাচিত ব্যক্তির ওপরই ডেল্টা রশ্মির প্রয়োগ হয়। এই ডেল্টা রশ্মির প্রয়োগের ফলে তাদের মস্তিষ্কের পুনর্বিন্যাস ঘটে।
ওপরতলায় বাচ্চাগুলোকে একটি বিশেষ একটা পরীক্ষার মধ্যে যেতে হয় যেখানে মস্তিষ্কের গঠন অনুযায়ী সবাইকে বিশেষ কোন কাজে নিয়োগ করা হয়। এই পরীক্ষায় কাই গুপ্তচর ও গুপ্তসংবাদদাতার বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল।
ওই কেন্দ্রে আসা প্রত্যেক বাচ্চাকে নিজে নিরীক্ষণ করত ‘মগজ ধোলাই’। তাই কাইকেও মগজ ধোলাই–এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওকে একটা ঘরে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। কারণ তার আগে লাইনে যে বাচ্চারা ছিল তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল, যতক্ষণে তার পালা এল খিদে তেষ্টায় সে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যেতে বসেছিল। কাইকে অফিস ঘরে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে টেবিলের ওপর থেকে একটা জলের বোতল দেখে দ্রুত ও তার থেকে ঢক ঢক করে জল খেতে লাগল। জল খাওয়া শেষ করতেই ও দেখল টাকমাথা একটা লোক ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। লোকটা একবার চোখ বন্ধ করে চোখটা ডলে নিয়ে ওর দিকে আবার তাকাল যেন চোখের সামনে যেটা দেখছে সেটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর ফিসফিস করে বলে উঠল, “কাই… তুই এখানে!”
কিন্তু কাই-এর কিছুই মনে নেই। এমনকি নিজের নামটা পর্যন্ত। কাই এখন মনে করে তার নাম – CMR10248। ‘মগজ ধোলাই’ বুঝতে পারল কাই-এর সঙ্গে কী ঘটেছে– ওর মস্তিষ্ক থেকে সব স্মৃতি মুছে ফেলা হয়েছে।
কাই-এর মুখ দেখা মাত্রই মগজ ধোলাই-এর মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলির পুনঃসংযোগ ঘটে একপ্রকার আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সে তার ছেলে কাই লিনকে চিনতে পারে, যার কাছ থেকে দীর্ঘ সাত রিসাস বছর আগে নিষ্ঠুরভাবে তাকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। তার মস্তিষ্কে স্নায়ুর প্রবল আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। একে একে সমস্ত হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি সে ফিরে পেতে লাগল– তার স্ত্রী সাকুরা ইমানী, তার গ্রহ রিসাস, সেখানে ‘ম্যাক্সিমাস ম্যাগাজিন’-এ তার মুখ্য এডিটরের চাকরি, তার অতীত জীবনের সব কথা, তার বাগান করার শখ, ছেঁড়া খাকি পাজামাটা। মুহূর্তের মধ্যেই একে একে তার সব কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে অনুভব করল এই মুহূর্তে এত উত্তেজনা দেখান ঠিক নয়। সে নিজেকে সামলে নিল। ট্যাবলেটে ছেলের নম্বরটি টুকে নিয়ে পরের জনকে ডেকে নিল। এরপর ভয়ঙ্কর ক্লাউনের মুখোশ পরা কিছু গার্ড এসে কাইকে সেখান থেকে অন্য কক্ষে নিয়ে গেল। নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য ওই কেন্দ্রের গার্ডরা এমন মুখোশ পরে থাকে।
এদিকে প্লাসিডোর ঘুম ভাঙার পর, সেও নিজেকে একটা ঘরে দেখতে পেল। সেখানেও অনেক বাচ্চা ছিল। সে অবশ্য বুঝতে পারল না কাইও সেই একই ঘরে আছে কিনা। হঠাৎ সে দেখল একটি স্ক্রিনের লেখা রয়েছে ‘শুধুমাত্র কর্মচারীদের জন্য’। উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে প্লাসিডো সেই স্ক্রিনের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। অবশ্য একটু আগে যা যা ঘটেছে প্লাসিডো সেসবের কিছুই জানে না। সে খুব অস্থির বোধ করছিল। কষ্টেসৃষ্টে সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরোতেই সে কাইকে দেখতে পেল। খুব অবাক হয়ে গেল সে। কাই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে রোবটের মতো চলছিল। স্টাফদের চোখের আড়াল করে সে কাই-এর হাত ধরে টেনে সিঁড়ির নিচের জায়গাটাই নিয়ে এল। কাই-এর কাঁধ ধরে ঝাকুনি দিয়ে প্লাসিডো ফিসফিস করে বলল, “কাই তুমি আমাকে চিনতে পাচ্ছো? আমি তোমার জন্য খুব চিন্তায় ছিলাম… ভাবলাম তোমাকে হারিয়েই ফেলেছি।”
কাই নিথর দৃষ্টিতে প্লাসিডোর দিকে তাকাল। তার ঠোঁট দুটি শক্তভাবে আটকে ছিল। প্লাসিডো ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কাই তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না!”
কাই কোনও উত্তর দিল না। প্লাসিডো তখন বুঝতে পারল নিশ্চয় কাই-এর খারাপ কিছু ঘটেছে। সে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। “কাই তোমার এই অবস্থার জন্য আমি দুঃখিত, তোমাকে আমার কিছু ফেরত দেওয়ার ছিল।”-এই বলে প্লাসিডো তার পকেট থেকে একটি কাগজের নৌকা বার করল যার ওপর লেখা ছিল এস. এস. কাই। নৌকাটা দেখামাত্রই কাই-এর নিথর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। যেন তার মৃত চোখদুটোতে আলো খেলে গেল। তার মনে হল যেন এইমাত্র এক গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে সে। ধীরে ধীরে কাই এর সমস্ত স্মৃতি ফিরে এল। কাই বিড়বিড় করে বলে উঠল, “প্লাসিডো… তুমি!”
সেই মুহূর্তে তারা একটা শব্দ শুনতে পেল, কেউ যেন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছে। লোকটা ছিল ‘মগজ ধোলাই’। সে এসে কাই ও প্লাসিডোর হাত ধরে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে গেল। অন্ধকারে সরু আলোর রেখা এসে লোকটার মুখের ওপর পড়ছিল। “তোমরা ভয় পেও না, আমি তোমাদের এখান থেকে উদ্ধার করব।” মগজ ধোলাই তাদের বলল।
“কে তুমি?” প্লাসিডো জিজ্ঞাসা করল ওই লোকটাকে। আলোতে তার মাথার টাকটা চকচক করছে।
“আমি কাই-এর বাবা।” এটা শুনে অন্ধকারেও কাই-এর চোখ দুটিতে চমক খেলে গেল। এত আনন্দিত কাই এর আগে কখনও হয়নি। সে তার বাবাকে বিড়বিড় করে বলল, “বাবা তুমি জানো আমি তোমাকে কত্তো মিস করেছি, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে?”
মগজ ছেলেকে জড়িয়ে তার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, “আমি তোকে কখনওই ছেড়ে যেতে চাইনি সোনা।”
প্লাসিডো কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, “মি. ইমানী, এসব কি হচ্ছে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
মগজ ধোলাই কাই-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ব্রেন ওয়াশ হওয়ার আগে এটাই আমার নাম ছিল… কাই, আমি কতদিন তোর মাকে দেখিনি।”
মগজ ধোলাই বাচ্চা দুটোকে তার ঘরে নিয়ে গেল। সে তাদেরকে সব কিছু বলল– কীভাবে রেক্স করিডন তার খারাপ অভিসন্ধি সফল করার জন্য বাচ্চাদের রিসাস গ্রহ থেকে অপহরণ করত। তারপর তার গুপ্ত সেনাবাহিনীর উপযুক্ত সৈন্য বানানোর জন্য তাদের ব্রেন ওয়াশ করত। সেদিন রাতে নরম বিছানাই তাদের ভালোই ঘুম হল। সকালে খুব চনমনে বোধ করছিল ওরা। কিন্তু তখনই মগজ ধোলাই-এর কাছে একটা জরুরী বার্তা এল। ‘মাইন্ড রিকনস্ট্রাকশন সেন্টার’-এ সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি না দেখার জন্য রেক্স করিডন সারপ্রাইজ ভিজিট-এ আসছেন।
খবরটা শোনামাত্রই মগজ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সে একটা ফন্দি আঁটল। রেক্স করিডনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে সে লিফটটাকে রিপ্রোগ্রাম করে নিল। প্লাসিডো ও কাই মগজের পেছন পেছন গেল। ওপরে যাওয়ার সময় লিফট থেকে নির্গত ডেল্টা রশ্মি তাদের সকলের মস্তিষ্কগুলোকে রিপ্রোগ্রাম করে দিল। কাই, প্লাসিডো ও মগজ ধোলাই-এর মস্তিষ্ক তাদের মৌলিক অবস্থাতেই ফিরে এল। কিন্তু রেক্স করিডনের মস্তিষ্ক দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। প্লাসিডো রেক্স করিডনের হাত মুচড়ে বলল, “এখন তুমি ওই অপহরণ করা বাচ্চা সৈন্যগুলির মতো দুর্বল।” রেক্স নিথর দৃষ্টিতে প্লাসিডোর দিকে তাকাল। সে একদম ভয়ে কুঁকড়ে গেল। মগজ ভার্চু়্য়াল রিয়ালিটি মাইন্ড অল্টারনেটিং গ্লাসটা নিয়ে রেক্স করিডন এর মাথার ওপর রেখে তাকে নির্দেশ দেওয়া শুরু করল, “এখন থেকে আর ভয় দেখিয়ে তুমি টিমোরকে শাসন করবে না। আজ থেকে তুমিও তোমার ভাইয়ের মতো খুব হাসি খুশি ক্লাউন কিং হয়ে থাকবে, হাসি আর আনন্দের মাধ্যমেই দেশ চালাবে ভীতির প্রদর্শন করে নয়। তুমি ‘সেন্টার ফর মাইন্ড রিকনস্ট্রাকশন’ এর সব কর্মচারীদের একত্রিত করে একটা লাফটার সেশন এর আয়োজন করবে।”
লিফট থেকে বেরনো মাত্রই রেক্স করিডনের সমস্ত ভয় কেটে গেল সে হো হো করে হাসতে লাগল। তারপর আবার লাফটার সেশন এর কথা ভেবে খিলখিল করে হেসে উঠল সে।
মগজ ধোলাই এসেস্মব্লি বেল বাজিয়ে সব কর্মচারীদের মেইন হলে জড়ো করল। হলে দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় তীব্র ডেল্টা রেডিয়েশনের প্রয়োগে তাদের মস্তিষ্কের পুনর্বিন্যাস করা হল যাতে তারা ভয়ের মাধ্যমে শাসন না করে কিংবা শাসিত না হয়ে কেবলমাত্র হাসি ও আনন্দের মাধ্যমে দেশ চালাতে পারে।
কিন্তু কাই ও প্লাসিডোর মনে হল কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। তাদের লাফটার সেশনে সবাই স্বতস্ফুর্তভাবে হেসে চলেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একে অপরের দিকে আঙুল দেখিয়ে খিলখিল করে হাসছে, কেউ বা কেউ বা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কেউ বা পায়ে চাপড় মারতে মারতে হাসছে। কিন্তু রেক্স করিডনের হাসির ধরনটা অনেকটা সংযত, সে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “আমি যখন এক গুনব সবাই হা হা হা করে হাসবে, দুই গোনার সঙ্গে সঙ্গে হি হি হি করে হাসবে আর তিন গোনা মাত্রই হো হো হো করে আসবে।”
এদের মধ্যে একটা ক্লাউন ছিল যে রেক্স ক্লাউন এর নিয়ম না মেনে অদ্ভুতভাবে হাসছিল। অন্যদের হাসির সঙ্গে তার কোনও সঙ্গতি ছিল না। তখন রেক্স করিডন তুড়ি মেরে পুলিশ ক্লাউনদের ডেকে তাকে ধরে নিয়ে যেতে বলল। পুলিশ ক্লাউনরা এসে অপরাধীকে দুপাশ থেকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তখনও তার অদ্ভুত হাসি থামেনি বরং আগের চাইতে আরও জোরে জোরে হাসতে লাগল।
লেখক: গল্পটি স্টিফেন কিং এর ‘ইট’ থেকে অনুপ্রাণিত।
Tags: অনুবাদ গল্প, কৃষ্ণা রক্ষিত, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প, রোশনি রেবেকা স্যামুয়েল, সিফন বণিক